দুর্যোধন – ৬০

ষাট 

দ্রৌপদী কাছে গেলে অসহায় কণ্ঠে ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘মানুষ হিসেবে আমারও সীমাবদ্ধতা আছে মা। স্নেহ, অন্যায়, পাপাচার, অপদস্থ হওয়ার ভয়—এসবের ঊর্ধ্বে নই আমি। সিদ্ধান্তের ভুলে আমিও অবিচার করেছি যাজ্ঞসেনী তোমার ওপর, পঞ্চপাণ্ডবের ওপর। প্ররোচিত হয়েই করেছি আমি, একাজ। তোমার শাশুড়ি গান্ধারীর কথায় আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। তুমি আমায় ক্ষমা করো মা।’ ধৃতরাষ্ট্রের দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নামল। 

দুর্যোধন পিতার কথা শুনে বারবার লাফিয়ে দাঁড়াতে চাইল। শকুনি বারবার আসনের সঙ্গে চেপে ধরে থাকল তাকে। চোখে নির্জীব থাকার কড়া নির্দেশ। দুর্যোধনের কাছে এখন মামার গুরুত্ব অসীম। এই মামাই তো তাকে আজ অতুল বৈভব আর দিগন্তবিস্তারী সাম্রাজ্যের নৃপতি করে দিয়েছে! তাই মামার নির্দেশ মান্য করল সে। চুপ থাকল। 

মামার কণ্ঠস্বর কানে এলো দুর্যোধনের, ‘চুপ করে শুধু নাটক দেখে যাও ভাগনে। দেখ, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র কী নিপুণ অভিনেতা!’ 

দ্রুপদনন্দিনী দ্রৌপদী। পাণ্ডবমহিষী সে। রাজপরিবারের আদব-কায়দায় অভ্যস্ত। কুরুজ্যেষ্ঠদের সম্মান করতে জানে সে। তাই মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তার অনেক কিছু বলার থাকলেও জ্যেষ্ঠ শ্বশুরকে অপমান করতে চাইল না। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রাখল দ্রৌপদী। 

ধৃতরাষ্ট্র আবার বলতে শুরু করল, ‘আমি তোমার স্বামীদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিচ্ছি মা। বাজিতে হারা সকল ধনসম্পদ আমি পাণ্ডুপুত্রদের ফিরিয়ে দিচ্ছি। দুর্যোধনের জেতা সকল রাজ্য এখন থেকে আবার পাণ্ডবদের হলো। তুমিও এই মুহূর্ত থেকে স্বাধীন দ্রুপদকন্যা। আমি আজকের ঘটনায় ভীষণভাবে মর্মাহত। এই বুড়ো বাপটার দিকে তাকালে তুমি আমার ভেতরের ভাঙনটা বুঝতে পারবে দ্রৌপদী। তুমি আমাকে, আমার পুত্রদের ক্ষমা করে দিয়ো।’ 

এই সময় চাপা কণ্ঠে দুঃশাসন বলে উঠল, ‘দাদা, এত কষ্ট করে তোমার জিতে নেওয়া সব কিছু ওই বুড়োটা মাটি করে দিল তো!’ 

এই ঘটনার পর কালবিলম্ব না করে যুধিষ্ঠির সবাইকে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের উদ্দেশে রওনা দিল। 

এদিকে দুঃশাসনের সকল স্বস্তি তিরোহিত হয়ে গেল। একদিকে অর্জিত সম্পত্তির বিনাশ, বিনাশই তো, বাজিতে জেতা সকল সম্পদ আবার ফিরিয়ে দেওয়ার নাম বিনাশ নয়! অন্যদিকে পাণ্ডবদের আস্ফালন, ভীমের জিঘাংসু চেহারা, অর্জুনের ক্ষিপ্ত রণমূর্তি, নকুল সহদেবের প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ দুঃশাসনকে অস্থির করে তুলল। দ্রুত সে শকুনি মামার সঙ্গে দেখা করল। কর্ণের সঙ্গে পরামর্শ-শেষে তিনজনে গিয়ে দুর্যোধনের সামনে উপস্থিত হলো। 

অশান্ত গলায় দুর্যোধনকে উদ্দেশ করে দুঃশাসন বলল, ‘অনেক ক্লেশ আর বুদ্ধি খরচ করে পাণ্ডবদের ধনসম্পদ সকল কিছু অর্জন করল দাদা। বৃদ্ধ রাজা সব কিছু নষ্ট করে দিল!’ 

‘শুধু তো তাই নয়, তোমাদের দোষী করে দ্রৌপদীকে নানা মিষ্টি কথা বলে গেলেন! আমি ভাবলাম, তিনি বুঝি অভিনয় করছেন! কিন্তু পরে দেখলাম সেটা অভিনয় নয়, সত্যি সত্যি মনের কথা। ওমা! যা কিছু অর্জন করিয়ে দিলাম আমি তোমাদের, এর মধ্যে পাণ্ডুপুত্ররা আর দ্রৌপদীও আছে—সবকিছু ফিরিয়ে দিলেন মহারাজ!’ আক্ষেপে ফেটে পড়ে বলল শকুনি। 

মিতভাষী কর্ণ বলল, ‘এ সব কিছুর পেছনে কিন্তু তোমাদের মা গান্ধারীর ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উনি যদি ক্ষিপ্ত হয়ে সভামণ্ডপে উপস্থিত না হতেন, যদি মহারাজকে উদ্দেশ করে প্রাণঘাতী ওই কথাগুলো না বলতেন, তা হলে আজকের দৃশ্যপট অন্যরকম হতো।’ 

দুঃশাসন বলল, ‘এখনো সময় আছে দাদা, ভালোমন্দ কিছু একটা করো। নইলে যে আমরা অকূল সমুদ্রে ভেসে যাব!’ 

দুর্যোধন ভীষণভাবে শঙ্কিত। অপমানিত-লাঞ্ছিত হয়ে পাণ্ডবরা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করছে। তাদের বুকে এখন প্রতিহিংসার আগুন। সেই আগুনে তারা কুরুদের জ্বালাবেই জ্বালাবে। এই মুহূর্তে সেই ক্রোধানল থেকে কীভাবে নিস্তার পাওয়া যায়, তা ভেবে অস্থির হলো দুর্যোধন। পাণ্ডবরা এখন সংহারোদ্যত। ক্রুদ্ধ ভুজঙ্গের মতো ফণা তুলে তারা অচিরেই হস্তিনাপুরের দিকে ধেয়ে আসবে। আজ হোক কাল হোক, যুদ্ধ এরা করবেই। অস্থিরমতি ধৃতরাষ্ট্রকে সিংহাসনচ্যুত করে অবিভক্ত রাজত্ব না পাওয়া পর্যন্ত পাণ্ডবরা শান্ত হবে না। আজকের ঘটনায় বিদুরও সুবিধা পেয়ে গেল। জনমত পাণ্ডব আর বিদুরের দিকে চলে গেল। আসলে দ্রৌপদীকে সভায় এনে এ রকম করে অপমান করা উচিত হয়নি। এটা মস্তবড় একটা অশোভন, অনৈতিক এবং মর্মান্তিক কাজ হয়েছে। দ্রৌপদীর অপমান পাণ্ডবদের আহত সিংহ করে তুলেছে। ভীম প্রতিজ্ঞা করেছে তার উরুভঙ্গ করবে আর দুঃশাসনের বুক চিরে রক্তপান করবে। ভাবতে ভাবতে অশান্ত হয়ে উঠল দুর্যোধন। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো- আঃ। 

শকুনি বলল, ‘তুমি অস্থির হলে সব কিছু ভেস্তে যাবে ভাগনে। অস্থিরতা মানুষের বিবেচনাশক্তি লুপ্ত করে। 

‘কী করতে বলো মামা তুমি আমায়?’ 

‘তুমি এক কাজ করো ভাগনে, তোমার পিতার কাছে চলো। তাঁকে দিয়ে পাণ্ডবদের ফিরিয়ে আনাও। আবার খেলায় বস। এবার বাজি ধনসম্পদ, পাণ্ডুপুত্র, দ্রৌপদী নয়।’ 

‘তা হলে!’ 

‘এবারের পণের বিষয় হবে অন্য কিছু।’ 

‘অন্য কিছু?’ 

‘এর অধিক জানতে চেয়ো না এখন। আগে দ্রুত রাজার নিকট চলো। সেখানেই সব কিছু খুলে বলব আমি।’ বলল শকুনি। 

অবিলম্বে সকলে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো। 

ধৃতরাষ্ট্রকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দুর্যোধন কণ্ঠে ক্রোধ ঢেলে বলল, ‘আপনি কি বৃহস্পতি- শুক্রের মতো রাজনীতিবিদদের নাম শোনেননি বাবা? তাঁরাই তো বলে গেছেন, বাগে-পাওয়া শত্রুকে ছেড়ে দিতে নেই। রেগে যাওয়া সাপ আর শত্রুকে একবার মাথায় উঠিয়ে নিলে তাকে কি আর নামানো যায়? আমরা পাণ্ডবদের বাগে পেয়ে খেপিয়েছি, এখন যদি তাদের আমরা ছেড়ে দিই, তা হলে কি তারা আমাদের ছেড়ে দেবে? আপনি তো দেখেননি বাবা—অর্জুন কীরকম ফুঁসতে ফুঁসতে গাণ্ডিবে মোচড় দিচ্ছিল, দেখেননি তো—ভীম কীরকম গদায় হাত ঘষচ্ছিল, দেখেননি তো—নকুল- সহদেবের আস্ফালন! ওরা আমাদের কিছুতেই ছাড়বে না বাবা। বিশেষত আমরা দ্রৌপদীকে যা করেছি, ভীমার্জুন এর অণু অণু প্রতিশোধ নেবে। 

মহারাজ দুর্বল কন্ঠে কী যেন একটা বলতে চাইল। 

শকুনি দ্রুত বলে উঠল, ‘পাণ্ডবদের ঠাণ্ডা করার একটা উপায় আছে মহারাজ। আবার পাশাখেলা।’ 

‘আবার পাশাখেলা! না না, তা কখনো হতে পারে না।’ কঠিন গলায় বলে উঠল ধৃতরাষ্ট্র। ‘হতে পারে মহারাজ। আপনার সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য হতে পারে। নইলে যে পাণ্ডবরা দুর্যোধন-দুঃশাসনদের হত্যা করবে মহারাজ।’ বলল শকুনি। 

পুত্রহত্যার কথা শুনে চুপসে গেল ধৃতরাষ্ট্র। 

এই অবস্থায় শকুনি আবার বলল, ‘আপনার পুত্রদের বাঁচিয়ে রাখার একটামাত্র পথ আছে এখন, আর তা হলো— যুধিষ্ঠিরকে পুনরায় পাশাখেলায় বসানো। তবে এবারের বাজি হবে—হারাদলকে বারো বছরের জন্য বনবাসে যেতে হবে। এরপর এক বছরের অজ্ঞাতবাস। অজ্ঞাতবাসকালে ধরা পড়লে ফের বারো বছরের বনবাস। 

দুর্যোধন বলে উঠল, ‘আর পিতাশ্রী আপনি তো জানেন—জিতব আমরাই। পাণ্ডবরাজ্য, তাদের ধনসম্পদ সব আমাদের হবে। 

ধৃতরাষ্ট্র আবার নীতিচ্যুত হলো। দ্রুত রাজাদেশ ঘোষিত হলো— পাণ্ডপুত্রদের পথিমধ্য থেকে ফিরিয়ে আন। ভীষ্ম-দ্রোণ-সোমদত্ত-কৃপাচার্য-বিকর্ণ-যুযুৎসু এমনকি রাজমহিষী গান্ধারী এই আদেশের প্রবল বিরোধিতা করলেন। কিন্তু তাঁদের প্রতিবাদ অবহেলিত হলো। 

যুধিষ্ঠির পরিজনসহ পুনরায় ফিরে এলো। 

দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে বলল, ‘যুধিষ্ঠির, এই সভায় নতুন আরও অনেক লোকের সমাগম হয়েছে। চলো আমরা আবার পাশা খেলি। 

যুধিষ্ঠিরের জুয়াড়ি রক্ত পুনরায় কল্লোলিত হলো। 

পুনরায় ঘুঁটি হাতে তুলে নিল যুধিষ্ঠির। 

এবং হারল। 

একষট্টি 

কুরুশিবিরে এখন উষ্ণ অসংযমী নাগরিক উল্লাস। 

কাকে নিয়ে উল্লাস, হুল্লোড়? 

তিনি ভীষ্ম নন। দ্রোণাচার্য নন। কৃপাচার্য নন। এমনকি কুরুনৃপতি ধৃতরাষ্ট্রও নয়।

সে শকুনি। সুবলতনয় মাতুল শকুনি। 

এখন কৌরবশিবিরের সবচাইতে আদরের মানুষ মামা শকুনি। তার আদরে-আপ্যায়নে কৌরবরা মশগুল। 

ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে আজ। যুদ্ধে জয়লাভ হয়েছে। রক্তপাতহীন যুদ্ধ। কূটকৌশলের যুদ্ধ। এই যুদ্ধজয়ে কাউকে লাগেনি। পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ, ধনুর্বিদ কর্ণ-কারোরই প্রয়োজন হয়নি। 

এই যুদ্ধজয়ের সেনাপতি মাতুল শকুনি। শকুনি একাই বাজিমাৎ করেছে আজ। দুর্যোধনের মতো সুখী ব্যক্তি আজ আর দ্বিতীয়জন নেই। তার মনোবাসনা আজ পূর্ণ হয়েছে। 

সর্বশেষ পাশাখেলায় পাণ্ডবদের পরাজয় ঘটেছে। বারো বছরের অরণ্যবাস এবং এক বছরের অজ্ঞাতবাসের পণে খেলেছে যুধিষ্ঠির। এবং হেরেছে। পাণ্ডবরা এখন রাজ্যচ্যুত। দাসাদি দাস। 

কয়েক প্রহর আগেও যারা রাজা, রাজভ্রাতা, রাজমহিষী ছিল, এখন তারা সর্বস্বান্ত। অতুলনীয় ঐশ্বর্য হারিয়ে তারা এখন দুর্যোধনের আজ্ঞাধীন। 

পাণ্ডবরা রাজ্যচ্যুত। হতমান। সর্বহারা। কলঙ্কিত। 

পাণ্ডুপুত্ররা মহার্ঘ রাজকীয় পরিচ্ছদ ত্যাগ করেছে। তাদের অঙ্গে এখন বহু মূল্যবান রত্নরাজি শোভা পাচ্ছে না। 

তাদের পরিধানে এখন জীর্ণবসন। 

দুগ্ধফেননিভ শয্যার পরিবর্তে তারা শক্তভূমিতে আশ্রয় নিয়েছে। 

রাত্রি গভীর। 

রাজপ্রাসাদের বাইরের অংশে দাসদাসীদের আবাসন। ওখানকার একটা কক্ষে দ্রৌপদীসমেত পাণ্ডবরা অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করছে সূর্যোদয়ের জন্য। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ওরা কুরুরাজপ্রাসাদ ছেড়ে যাবে। 

অরণ্যের পথে পা বাড়াবে তারা। 

দ্বাদশ বর্ষ বনবাস। এক বছর অজ্ঞাতবাস। 

পাশার দানে গতদিনের শেষবেলায় তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। 

পাণ্ডবরা গভীর চিন্তায় মগ্ন। চক্ষু শুষ্ক। ললাট ভ্রুকুটিপূর্ণ। মনে সুতীব্র জ্বালা। ক্রোধের অনলে পুড়ে পুড়ে ছাই হচ্ছে তারা। 

কনিষ্ঠ পাণ্ডব সহদেব। মিতভাষী। জ্যেষ্ঠানুগত। ধীরস্থির। ক্রোধসংযমী। বিবেচক। প্রায়ান্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে আছে। ভাবছে। গত অপরাহ্ণের স্মৃতি আজ বড় বিচলিত করে তুলছে সহদেবকে। একের পর এক দৃশ্য তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। 

অক্ষক্রীড়ার সভামণ্ডপ পরিপূর্ণ। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপসহ অন্য দিকপাল রাজন্যবর্গের সমারোহ। ওঁদের চোখের সামনেই দুর্যোধন দুঃশাসনের ব্যভিচার সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেল। ঔদ্ধত্যের অট্টহাস্যে গোটা সভাগৃহ উতরোল। 

দুর্যোধন সব কিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়েছে। 

কত কত মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং শিক্ষার ফল আজকের এই সভ্যতা। কুরুবংশের ঐতিহ্যে সভ্যতার সঘন উপস্থিতি। কার অবদান নেই এই কুরুসভ্যতায়? মহামতি প্রতীপ। রাজচক্রবর্তী শান্তনু। পিতামহ ভীষ্ম। বিচিত্রবীর্য। পাণ্ডু। দীর্ঘ কুরুবংশধারা। দিগন্তবিস্তারী পরম্পরা। 

দুর্যোধন কুরুসভ্যতার পরম্পরা ভেঙেছে। ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতিতে কুঠারাঘাত করেছে। ভদ্রতা, সৌজন্য, রুচি, আত্মীয়তা, কুলনিয়ম, নারীমর্যাদা—কিছুই মানেনি। 

ভেবে যাচ্ছে সহদেব। দুর্যোধন না হয় কদাচারী। না-হয় দুর্বিনীত। না-হয় সকল সম্ভ্রমবোধ তিরোহিত তার। কিন্তু মহারথীরা? যাঁরা সভাস্থলে বসেছিলেন? তাঁরা তো দুর্যোধনের ব্যভিচারের কোনো প্রতিবাদ করলেন না! এমনকি কুলকলঙ্ক দুঃশাসন দ্রৌপদীকে যখন বিবস্ত্র করছে, তখনো তো তাঁরা নীরব থেকেছেন! মাথা নিচু করে বসেছিলেন তাঁরা! 

সভ্যতা কি সত্যি মুমূর্ষু? দুর্যোধনদের হাতে পড়ে মানবসভ্যতার কি অন্তিমকাল উপস্থিত হয়েছে? জীবনের মহার্ঘগুলো কি এভাবেই লুণ্ঠিত হবে? 

বোঝে সহদেব। ভীষ্ম-দ্রোণাদি ধৃতরাষ্ট্র-অনুগ্রহে প্রতিপালিত। রাজার উচ্ছিষ্টভোগী তাঁরা। আরাম-আয়াসে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তাঁরা। তাই প্রতিবাদে অক্ষম। যদি রাজপ্রাসাদ থেকে বিতাড়িত হন। কোথায় যাবেন এই বয়সে? তার চেয়ে বিবেকের টুটি চিপে ধরে অধোবদনে বসে থাকা ভালো। সভ্যতা নিপাত যাক। বিবেকের শ্রাদ্ধ হোক। সংস্কৃতির অপমৃত্যু ঘটুক। তাও ভালো। 

সভায় উপস্থিত সবাই বুঝে গেছেন। তাঁরা অনুগৃহীত, বিক্রীতবিবেক। পরাধীনের দল তাঁরা। উচ্ছিষ্টভোগী। 

তাঁদের মাথা হেঁট হওয়ার কারণ লজ্জা, নাকি আত্মগ্লানি। জানা নেই সহদেবের। 

ভীম ভেবে চলেছে অন্যভাবে। ভিন্নরকমভাবে। সেই ভাবনায় আত্মানুশোচনা। যুধিষ্ঠিরের প্ৰতি ক্রোধ। 

ভীম ভাবছে। দুর্যোধন-দুঃশাসন-কর্ণ-শকুনির অনীতি-দুর্বিনয়ের বিরুদ্ধে তারা কি কিছু করতে পারত না? পাণ্ডবরা? প্রতিবাদ-প্রতিরোধ? তারা কি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত না? কুরুদের ওপর? ছারখার করে দিতে পারত না সব কিছু? লন্ডভন্ড? ধ্বংসলীলায় মাততে পারত না তারা? 

যদি পারত, নিষ্ক্রিয় নির্জীব হয়ে বসে রইল কেন পাণ্ডবরা? 

প্রথম থেকেই তো বোঝা যাচ্ছিল—শকুনি প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। খেলার নিয়ম মানছে না। ছলনা করছে। দ্যূতক্রীড়া ন্যায়ভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। 

এই অবস্থায় পাণ্ডবরা তো রুখে দাঁড়াতে পারত! তাদের অধিকারের মধ্যেই তো পড়ে ওই অন্যায়কে থামিয়ে দেওয়া! 

কিন্তু তারা তা করেনি। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করেনি কেন পাণ্ডবরা? করেনি জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের কারণে। যুধিষ্ঠির তাদের নৈতিক অধিকার প্রয়োগের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

যুধিষ্ঠির সত্যপালনে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। পাশার দানে হেরেছে। অতএব দাসত্ব মেনে নিতে হবে। পাশার দানে হেরেছে। অতএব দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে দিতে হবে। পাশার দানে হেরেছে। অতএব বারো বছরের বনবাস আর এক বছরের অজ্ঞাতবাস স্বীকার করে নিতে হবে। প্রতিবাদ করা চলবে না। রুখে দাঁড়ানো যাবে না। 

ভীম ভাবে—দাদার এ সত্য তো বাস্তবতাবর্জিত সত্য। জীবজগৎ সম্পর্করহিত সত্য। এটা কি সত্য, না নির্বুদ্ধিতা? 

ভীম ক্রুদ্ধ। যুধিষ্ঠিরের ওপর। এ কারণেই। যুধিষ্ঠিরের তথাকথিত সত্যানুরাগের খেসারত দিতে হচ্ছে আজ দ্রৌপদীসহ সবাইকে। 

একসময় সভাস্থলে যুধিষ্ঠিরকে লক্ষ করে বলেও উঠেছিল ভীম, ‘আমাদের পৌরুষ আছে। সাহস আছে। শৌর্য, বীরত্ব আছে। কেন অসহায়ের মতো দুর্যোধনের ব্যভিচার, শকুনির ছলনা মেনে নেব? 

যুধিষ্ঠির ধর্মের দোহাই দিয়েছে। নৈতিকতার অজুহাত দেখিয়েছে। সত্যের বাহানা তুলেছে। ভীমকে শান্ত থাকবার নির্দেশ দিয়েছে। 

কিন্তু ভীম মানবে কেন? সে একরোখা। সত্যটত্য তার কাছে মিথ্যে ভাবাবেগ। সংসারী সে। বাস্তবজগতের মানুষ। নীতি-ধর্ম-যুক্তি- এসবে তার কোনো আগ্রহ নেই। ভার্যা দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা, রাজা যুধিষ্ঠিরের অপদস্থতা, অন্য ভাইদের অবমাননা দাদার তথাকথিত সত্যপ্রীতির কারণে মুখ বুজে সহ্য করে যেতে হয়েছে তাকে। 

আর অর্জুন? ভীমের মতো ক্রোধপরায়ণ নয়। ধৈর্যশীল। কিন্তু কুরুদের কদাচারে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সব অন্যায়। দুর্যোধনের পাশাখেলার আয়োজন অন্যায়। ধৃতরাষ্ট্রের সমর্থন অন্যায়। কুরুবৃদ্ধদের নীরব থাকা অন্যায়। শকুনির ছলচাতুরি অন্যায়। দুঃশাসনের দ্রৌদপীলাঞ্ছনা ঘোরতর অন্যায়। কিন্তু এ সকল অন্যায়ের কোনোটাকে রুদ্ধ-স্তব্ধ করে দিতে পারেনি অর্জুন। কেন? চোখের সামনে তর্জনী বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে যুধিষ্ঠির! 

এ কেমন যুধিষ্ঠির? 

একবস্ত্রা, রজঃস্বলা দ্রৌপদীর সকরুণ মিনতি যুধিষ্ঠিরের হৃদয় টলাতে পারেনি। তার তীব্র- তীক্ষ্ণ প্রতিবাদে যুধিষ্ঠির বিচলিত হয়নি। তথাকথিত অলীক সত্যে নিষ্ঠ থেকেছে। ঊরুর কাপড় তুলে দুর্যোধন দ্রৌপদীকে অশ্লীল ইঙ্গিত করল। যুধিষ্ঠির নির্বিকার। দুঃশাসনের হাতে দ্রৌপদীর নারীমর্যাদা ধুলোয় মিশে গেল। যুধিষ্ঠির নির্বিকার। দ্রৌপদী যেন তার ভার্যা নয়! যেন কোনো আত্মীয় নয়। দ্রৌপদী যেন কোনো নারীই নয়! যদি হতো, যুধিষ্ঠির জ্বলে উঠত। কিন্তু জ্বলে উঠা তো দূরের কথা, সভার মাঝে বধির-অন্ধ বোবার মতো উদাসীন থাকল যুধিষ্ঠির! 

বাষট্টি 

তীক্ষ্ণ চোখে দাদা যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়েছিল অর্জুন। 

অনুমতি চাই। অস্ত্রধারণের অনুমতি দাও দাদা। অত্যাচারীর বক্ষ বিদীর্ণ করার উন্মত্ত ক্রোধ অর্জুনের চোখেমুখে। ভীম নিজেকে আর সংবরণ করতে পারছে না। আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। হাতে গদা। অনুমতি দাও দাদা। নকুল-সহদেব স্বভাবলাজুক। তাদের হাতে ধনুক। দৃষ্টিতে প্রার্থনা-অনুমতি দাও। ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত করবার অনুমতি দাও। হস্তিনাপুরকে গঙ্গার জলে নিক্ষেপ করবার অনুমতি দাও। কুরুবংশকে নির্বংশ করবার অনুমতি দাও। দুর্যোধন-দুঃশাসন-শকুনির মুণ্ডু ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার অনুমতি দাও। 

কিন্তু যুধিষ্ঠিরের অধোদৃষ্টি। 

সকলেই যুধিষ্ঠিরের অনুমতি চেয়েছে। অন্যায়কারীদের দণ্ডদানের অনুমতি।

যুধিষ্ঠির অনুমতি দেয়নি। 

আজ এই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে সব ভাই মুখোমুখি। সবাই জানতে চাইছে— কারচুপির ব্যাপারটা বুঝেও কেন যুধিষ্ঠির তীব্রভাবে প্রতিবাদ করল না? কেন দ্বিতীয়বার ছলনার পাশা খেলায় সম্মত হলো? কেন কুরু-আক্রমণের অনুমতি দিল না? 

যুধিষ্ঠির নিরুত্তর। 

বড়ভাই হিসেবে সে সবার শ্রদ্ধার পাত্র। তার প্রতি সকল ভাইয়ের প্রবল আনুগত্য।

যুধিষ্ঠির কি এই শ্রদ্ধা আর আনুগত্যের সুযোগ নিয়েছে? জানতে চায় ভীম। 

অর্জুন বলল, ‘এই মুহূর্তে অনুশোচনা করে কোনো লাভ নেই মধ্যমভ্রাতা। দাদা যুধিষ্ঠির যা করেছে, তার কৈফিয়ৎ চাওয়া আমাদের উচিত নয়। মহারাজ আমাদের জ্যেষ্ঠ, সম্মানের পাত্র। কনিষ্ঠ হয়ে তার কাছে আমাদের কৈফিয়ৎ চাওয়া উচিত নয়। কৈফিয়ৎ যদি তাকে দিতেই হয়, তা হলে নিজের বিবেকের কাছে দেবে। আমাদের কাছে নয়।’ 

অর্জুনের কথা ভীমের মোটেই পছন্দ হলো না। তার পরও ক্রোধ সংবরণ করল সে। চুপ করে গেল। 

মাথা তুলল যুধিষ্ঠির। দেখল-অর্জুনের দৃষ্টি ভূমিতে নিবদ্ধ। ভাবনামগ্ন। ভীমের মস্তক অন্যদিকে ঘোরানো। দেহকম্পন দেখে বোঝা যাচ্ছে—ফুঁসছে সে। 

দ্রৌপদীর দিকে তাকাল যুধিষ্ঠির। তার মনোভাব কী? জানা বড় প্রয়োজন। কিন্তু আধো আলো আধো অন্ধকারে দ্রৌপদীর চোখমুখ স্পষ্ট নয়। 

যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কিছু বলবে না দ্রৌপদী?’ 

দ্রৌপদী নিরুত্তর। যুধিষ্ঠিরের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিল। 

যুধিষ্ঠির চকিত দেখল, দ্রৌপদীর চোখে জল নেই। গ্রীষ্মের কটকটে ফাটা মাঠের মতো পদ্মসম দ্রৌপদীর চোখ দুটি। যুধিষ্ঠিরের মনে হলো, দ্রৌপদীর রক্তবর্ণ চোখে বুঝি ভয়ঙ্কর অশনি সংকেত! 

যুধিষ্ঠির ভয় পেয়ে যায়। এ কোন দ্রৌপদী? 

দ্রৌপদী অতীব রূপসী নারী। রূপে আর লাবণ্যে সে অদ্বিতীয়া, অতুলনীয়া। সে না-খর্বাকৃতি, না-দীর্ঘা। তার তনু না-কৃশ, না স্থূল। তার কুন্তল ঝাঁকড়া এবং বিপুল। পদ্মলোচনা। শারদোৎপলগন্ধা। ভুবনমোহিনী। দ্রৌপদী সম্বন্ধে এই-ই যুধিষ্ঠিরের অভিজ্ঞতা। 

কিন্তু এই মুহূর্তের দ্রৌপদী তো তার চেনা নয়! এ তো সেই দ্রৌপদী নয়, যাকে সে এতদিন দেখে আসছে, চিনে এসেছে। এ-তো রোষষায়িত নয়নের অতি ক্রুদ্ধ এক নারী! এ যেন এক বিনাশী শক্তি! সংহারিণী! এ-তো অগ্নিসম এক রমণী! 

কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল যুধিষ্ঠির। হঠাৎ সংবিতে ফিরল। দেখল— দ্রৌপদী তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি, সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দেওয়া দৃষ্টি। 

চোখাচোখি হতে আবার মুখ ফিরিয়ে নিল দ্রৌপদী। দ্রুপদকন্যা বড় অভিমানী। 

এখন দ্রৌপদীকে অভিমান মানায় না। এখন তার মুখে মানায় ভর্ৎসনা। তার চোখে মানায় অগ্নিঝরা দৃষ্টি। এখন তাকে মানায় দুর্মুখতা। 

ভাইদের সকল অভিমান-অভিযোগ মাথা পেতে নিয়েছে যুধিষ্ঠির। শান্তচিত্তে গ্রহণ করেছে তাদের তিরস্কার। তারা তাদের ক্রোধ-ভর্ৎসনা রাখঢাক ছাড়া প্রকাশ করেছে। তাতে তাদের ক্ষোভ কিছুটা কমেছে। কিন্তু দ্রৌপদী যে কিছুই বলছে না! 

তাতে যে তার মন অশান্ত হয়ে উঠছে! 

দ্রৌপদী যে তার সবচাইতে নরম জায়গা! দ্রৌপদী যে তার জীবনের কুসুম! মনোহারী সুবাস! দ্রৌপদী যে তাকে ভালোবাসে! অতলান্ত ভালোবাসা! 

সেই দ্রৌপদী আজ নিশ্চুপ! নিশ্চুপতার চেয়ে মুখরতা ভালো। আপন মনে গুমরে মরার চেয়ে ভর্ৎসনা-তিরস্কার শ্রেয়। দ্রৌপদী তুমি নিশ্চুপ থেকো না। মুখর হও তুমি দ্রৌপদী। ভর্ৎসনা করো আমায়। তিরস্কার করো। ধিক্কার জানাও। 

যুধিষ্ঠিরকে ঘিরে এখন অদ্ভুত এক নীরবতা 1 

তার চারপাশে সবাই আছে। তবু যেন কেউ নেই। যুধিষ্ঠিরের জগৎ এখন হিমশীতল পর্বতচূড়ার মতো নিস্তব্ধ 

একা। নিঃসঙ্গ। যুধিষ্ঠির। তার মনোজগতে এখন তোলপাড়। তার চক্ষু সক্রিয়, সচল। 

চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভাইদের দেখছে যুধিষ্ঠির। সকলেই শ্রান্ত-ক্লান্ত। সকলের উত্তেজনা-ক্রোধ এখন ঝিমিয়ে এসেছে। স্নায়ুর ওপর প্রবল চাপ গেছে আজ ওদের। তারা কি এখন তন্দ্রাচ্ছন্ন? বোঝা যাচ্ছে না। তবে একজনকে বোঝা যাচ্ছে যে জেগে আছে। সে দ্রৌপদী। দু-হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে বসে আছে। দু-হাত দিয়ে দুই পা বেড় দিয়ে জড়িয়ে আছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের গমনাগমনে তার শরীরটা মৃদু মৃদু কাঁপছে। দ্রৌপদী জানে, যুধিষ্ঠির জেগে আছে, তবুও মুখ তুলছে না। তার ভেতর পুঞ্জীভূত ক্রোধ উন্মাতাল। যুধিষ্ঠির বোঝে, এরকম করে মাথা গুঁজে থাকা মানে যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে নিজেকে লুকানো নয়, এ যুধিষ্ঠিরের মুখ দেখতে না চাওয়ার প্রয়াস। যুধিষ্ঠির জানে, দ্রৌপদীর কণ্ঠে যুধিষ্ঠিরের জন্য এখন একদলা ঘৃণা। 

যুধিষ্ঠির মনে মনে বলল, আমি মস্তবড় ভুল করে ফেলেছি দ্রুপদনন্দিনী। লোভের কাছে আমি নতজানু হয়েছি। জ্যেষ্ঠতাত আমাকে যে-বিশাল সাম্রাজ্য দিয়েছে, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকিনি আমি। আমি আরও আরও পেতে চেয়েছি। গোটা কুরুসাম্রাজ্য আমি আমার করতলগত করতে চেয়েছি। তাই তো পাশাখেলার আহ্বান যখন ইন্দ্রপ্রস্থে গেল, অস্থির হয়ে উঠেছিলাম আমি। নিজের ওপর আস্থা ছিল আমার খুব। আমি বিশ্বাস করতাম, আমার চেয়ে দক্ষ পাশাড়ে ভূ-ভারতে নেই। শকুনি যে এত বড় অক্ষবিদ হয়ে উঠেছে, জানতাম না। এটাও জানতাম না, খেলার চালের সঙ্গে ছলনা মেশাতে অত্যন্ত চৌকশ সে। বোঝা যাচ্ছে, পাশার চালে চাতুরি মেশাচ্ছে সে, কিন্তু ধরার উপায় নেই। ধরার কৌশলটি আমার অজ্ঞাত। রক্তপাতহীনভাবে আমি জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রকে সিংহাসনচ্যুত করতে চেয়েছিলাম, দুর্যোধনের রাজ্য হরণ করে শত ভাইকে পথের ধুলোয় নামাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই শকুনিটা তা হতে দিল না। উলটো আমাদের অরণ্যবাসী করে ছাড়ল। তুমি আমায় ক্ষমা করো দ্রৌপদী। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি পদ্মলোচনা। 

ভাইদের দিকে চোখ ফেরাল যুধিষ্ঠির। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। ভাইদের খুব ভালোবাসে যুধিষ্ঠির। পিতৃহীন তারা। পিতার অবর্তমানে সে-ই তাদের আশ্রয়স্থল। ভাইয়েরা, আমি তোদের আরও আরও সুখ দিতে চেয়েছিলাম, ঐশ্বর্যবান করতে চেয়েছিলাম। তাই তো পাশাখেলার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম আমি! ভেবেছিলাম, পাশার এক চালেই কুরুসাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে যাব! তোদের আমি এক এক রাজ্যের নৃপতি বানাব। সুখে রাজ্যশাসন করবি তোরা। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত সুফল বয়ে আনল না। আমার জন্যই আজ তোদের মাটিতে শয়ন, জীর্ণবস্ত্র পরিধান, অজানা শ্বাপদসংকুল অরণ্যপথে যাত্রা। আমায় মাফ করে দে ভাইয়েরা। 

যুধিষ্ঠির ভেবে যাচ্ছে, বনবাসপর্বের রুক্ষ জীবনকে এরা বইতে পারবে তো? দীর্ঘসময়, দীর্ঘ পথযাত্রা দ্রৌপদীর সহনীয় হবে তো? 

যুধিষ্ঠির বাইরের দিকে তাকাল। সংকীর্ণ গবাক্ষ দিয়ে বাইরের তারাভরা একচিলতে আকাশ দেখা যাচ্ছে। চরাচর অন্ধকারে সমাহিত। 

ধীরে ধীরে ভোর ফুটছে। তাদের যাত্রার সময় ঘনিয়ে আসছে। ভাইদের জাগাতে হবে। দ্রৌপদীকে ডাকতে হবে! 

জননী কুন্তী কুরুরাজপ্রাসাদে। গান্ধারী-সান্নিধ্যে। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে। তাকে সঙ্গে নিতে হবে। 

যুধিষ্ঠিরদের সামনে অজানা ভবিষ্যৎ। 

তেষট্টি 

প্রত্যুষ। সূর্যের উদয়কাল। পুবাকাশ ঘনকালো মেঘে ঢাকা। 

যুধিষ্ঠির এগিয়ে চলেছে। কুরুপ্রাসাদাভ্যন্তরের দিকে। সেখানে যে জননী কুন্তী! ভাইয়েরা যুধিষ্ঠিরের পশ্চাদ্‌গামী। 

রাজ অন্তঃপুরে বিষাদের কোনো চিহ্ন নেই। সেখানে অপার সন্তুষ্টি। 

পাণ্ডবদের দেখামাত্র তুমুল ব্যঙ্গধ্বনি উঠল। দাসদাসী কেউই বাদ গেল না। সবার চোখেমুখে বিদ্রূপের কশাঘাত। দুর্যোধন-দুঃশাসনরা পাণ্ডবদের টুকরো টুকরো করতে পারলে খুশি। তাদের প্রতিশোধস্পৃহা এখনো অনির্বাপিত। 

যুধিষ্ঠির মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সামনে এসে দাঁড়াল। যুক্ত কর। পেছনে ভাইয়েরা—ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব। নীরব, নির্বাক। তাদের দৃষ্টিতে উপেক্ষা। ভীমের চক্ষু ঘূর্ণিত। ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ সে। অর্জুন গম্ভীর। নকুল-সহদেবের চাহনিতে ঘৃণা—ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি। 

ধৃতরাষ্ট্রকে উদ্দেশ করে যুধিষ্ঠির বলল, ‘জ্যেষ্ঠতাত, আপনাকে প্রণাম। আমরা বিদায় নিচ্ছি। আপনার অনুমতি প্রয়োজন। বনেবাসে যাচ্ছি আমরা। তেরো বছর পর ফিরব। ফিরে যাতে আপনার দৰ্শন মিলে।’ 

ধৃতরাষ্ট্র নির্বিকার। যেন কিছুই হয়নি, এমন ভঙ্গি তার। গতকাল এত কিছু যে হয়ে গেল, তার পেছনে তার কোনো হাতই নেই, এমন হাবভাব মহারাজের আচরণে, দেহভঙ্গিতে। যুধিষ্ঠিরের কথা তার কানে ঢুকেছে বলে মনে হলো না। অন্তত তার মুখভঙ্গি দেখে তা মনে হচ্ছে না। 

সব বুঝতে পারে বিদুর। প্রথম থেকে ধৃতরাষ্ট্রের ওপর নজর রেখেছে সে। ধৃতরাষ্ট্রের দিকে ঘৃণার চোখে তাকিয়ে যুধিষ্ঠিরের দিকে এগিয়ে এলো বিদুর। 

ধৃতরাষ্ট্রের হয়ে বিদুরই যেন ক্ষমা প্রার্থনা করছে, ‘যুধিষ্ঠির, ক্ষমা করো। ক্ষমা করো।’ বলে মুহূর্তকাল থামল। 

কণ্ঠকে উঁচুতে তুলে বলল, ‘আর্যা কুন্তীর শরীর ভালো নেই। বার্ধক্য তাঁকে ঘিরে ধরেছে। বনগমনের ধকল তিনি সইতে পারবেন না। তুমি অনুমতি দিলে তাঁকে আমি আমার গৃহে পরম যত্নে সসম্ভ্রমে রাখব। তোমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি তাঁর সম্মানে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগাতে দেব না। এই আমার প্রতিজ্ঞা।’ 

যুধিষ্ঠির তৃপ্তি পেল। বলল, ‘আপনি আমাদের পিতৃতুল্য। আপনার ইচ্ছা আমরা মেনে নিলাম। মা আপনাদের সঙ্গে থাকুক। বনবাসকালে মাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না আমাদের।’ 

বিদুর পঞ্চপাণ্ডবের উদ্দেশে অভয়ের ডান হাতটা তুলল। 

ধৃতরাষ্ট্রকে প্রণাম করে যুধিষ্ঠির ভাইদের নিয়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলো। 

.

যাত্রাপথের দু-পাশে অগণিত মানুষ। চোখেমুখে ঘৃণা। ধিক্কারধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ধিক্কার দুর্যোধনের জন্য, ধৃতরাষ্ট্রের জন্য। 

সবার আগে যুধিষ্ঠির। সমুন্নত শির। দৃষ্টি বহুদূর প্রসারিত। মৌন, শান্ত। 

তার পেছনে অর্জুন। হাতে গাণ্ডীব। পৃষ্ঠে তিরভর্তি তৃণ। দুচোখে দহন। অর্জুনের দু-পাশে নকুল আর সহদেব। দৃঢ় আর নিশ্চিত পদক্ষেপে তারা যুধিষ্ঠিরকে অনুসরণ করছে। 

তাদের একটু পেছনে দ্রৌপদী। আলুলায়িত কুন্তল। রক্তবর্ণ নেত্র। বক্র ওষ্ঠ। শুষ্ক মুখমণ্ডল। সেখানে আগুনের হলকা। নগ্নপদে হেঁটে যাচ্ছে দ্রুপদকন্যা। ভূমিতলে দৃষ্টি তার। ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে দ্রৌপদী। হাওয়ায় তার রাশি রাশি চুল উড়ছে। এখন দ্রৌপদীকে মূর্তিমতী প্রবল এক ঝঞ্ঝা বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘূর্ণায়মান প্রত্যক্ষ এক মৃত্যু। 

সবার পেছনে ভীম। তার দৃষ্টি নিচের দিকে। ডান হাতে গদা। গদাটি কাঁধে নয়। মাটিতে। ছেঁচড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভীম। গদার ঘর্ষণে মাটি ফালা ফালা হচ্ছে। ভীমের চোখে এ মৃত্তিকাবক্ষ নয়। এ দুঃশাসনের বুক, দুর্যোধনের ঊরু। 

পাণ্ডবদের দেখামাত্র হস্তিনাপুরের সাধারণ জনগণ প্রবল আবেগে চিৎকার দিয়ে উঠল বহুজনের কলরব একত্রে ধ্বনিত হওয়ায় তাদের কথার মানে ধরা যাচ্ছে না। এ যেন তাদের কণ্ঠস্বর নয়, সমুদ্রগর্জন! ফুঁসছে জনমণ্ডলী। দুবাহু ওপর দিকে নিক্ষেপ করতে করতে ক্ষোভ জানাচ্ছে তারা। 

.

বহু পথপ্রান্তর, বহু বন্ধুর পথরেখা অতিক্রম করে, বহু পর্বতচূড়া ছাড়িয়ে, বহু শ্বাপদময় অরণ্য শেষে পাণ্ডবরা সস্ত্রীক দ্বৈতবনে এসে পৌঁছল। 

যুধিষ্ঠির ঠিক করল–এই অরণ্যে কিছুদিন কাটাবে। 

এদিকে কুরুরাজসিংহাসনে বসল দুর্যোধন। পিতা ধৃতরাষ্ট্র যথামর্যাদায় অবসরে গেল। 

পাণ্ডবদের বনে পাঠিয়ে দুর্যোধন এখন সর্বেসর্বা। কুরুসাম্রাজ্য, যা বিভক্ত করে একদা পাণ্ডবদের দিয়ে দিয়েছিল ধৃতরাষ্ট্র, তা সহ একা ভোগ করছে দুর্যোধন। সমস্ত রাজা এখন তাকে কর দিচ্ছে। আনুগত্যে হাঁটু গেঁড়ে বসছে তার সামনে। মহারাজা বলতে এখন সবাই দুর্যোধনকেই বোঝে। 

রাজসভায় দুর্যোধনকে ঘিরে এখন কর্ণ, শকুনি, অশ্বত্থামা। দুঃশাসন এখন তার আদেশ তামিল করার জন্য শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকে। দুর্যোধনের মাথায় এখন মহামূল্যবান রাজমুকুটটি জ্বলজ্বল করছে। রাজদরবারের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার সময় স্ত্রী ভানুমতী দুর্যোধনের প্রশস্ত কপালে রাজটীকাটি এঁকে দেয়। 

কুরুবৃদ্ধরাও থাকেন রাজসভায়। পিতামহ ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, বিদুর—কারো মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেনি মহারাজ দুর্যোধন। সবাই স্ব স্ব মর্যাদায় নিজ আসনে আসীন হন। কিন্তু ওঁদের মনে হয়—আগের মতো গুরুত্ব নেই তাঁদের, দুর্যোধনের রাজসভায়। দুর্যোধনের হাবেভাবে কীসের যেন একটা ঘাটতি অনুভব করেন তাঁরা! তাঁরা আছেন, কিন্তু নেই যেন! যথাসময়ে আসেন তাঁরা, রাজকার্যে দুর্যোধন পরামর্শ চাইলে, দু-একটা পরামর্শ দেন, তারপর রাজসভা ত্যাগ করে চলে যান। দুর্যোধনের এখন অধিকাংশ পরামর্শ চলে কর্ণ-শকুনি-অশ্বত্থামার সঙ্গে। ওদের সাহচর্যে মহারাজ স্বস্তি পায়। 

একদিন শকুনি বলল, ‘মহারাজ, পাণ্ডবরা এখন কোথায় আছে জান তো?’ 

‘জানি। দ্বৈতবনে। গুপ্তচররা সংবাদ এনেছে।’ 

‘বনবাসক্লেশে ওরা কেমন আছে? দ্রৌপদীর অবস্থাই-বা কী?’ 

‘তা কী করে জানব আমি!’ 

‘জানতে ইচ্ছে করে না? দেখতে ইচ্ছে করে না পাণ্ডুপুত্রদের বর্তমানের হাল-অবস্থা? ‘বর্তমানের হাল-অবস্থা!’ 

‘তুমি তো এখন অঢেল ধনসম্পত্তির মালিক। তা একবার দেখিয়ে এসো না পাণ্ডবদের।’

‘দেখিয়ে আসব! কীভাবে?’ 

মামা শকুনির প্রস্তাব মন কেড়ে নিল দুর্যোধনের। সত্যি তো তার তো খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ভীম, অর্জুন, যুধিষ্ঠির কীভাবে গতর খাটিয়ে দিনযাপন করছে। দ্রৌপদীই-বা কীভাবে চলছে, তা দেখতেও তার মন চাইছে। কিন্তু মন চাইলে তো আর হবে না। দ্বৈতবনে যাওয়ার একটা অজুহাত তো লাগবে! চিন্তায় পড়ল দুর্যোধন। 

তাই মামাকে উদ্দেশ করে দুর্যোধন আবার বলল, ‘আমার ধনৈশ্বর্য দেখিয়ে আসার কথা বলেই তো তুমি চুপ মেরে গেলে মামা, কিন্তু কীভাবে কী কারণ দেখিয়ে আমি দ্বৈতবনে যাব, তা তো বললে না!’ 

এবার কর্ণ বলে উঠল, ‘দ্বৈতবনের নিকটে যে গয়লাপাড়াটি আছে, সেখানে কুরুরাজার বহু গোধন আছে। সেই গরুগুলোর অবস্থা দেখতে যাবে তুমি। অতি নিকটেই দ্বৈতবন। একটু এগিয়ে পাণ্ডবদের দেখা কঠিন হবে না তোমার জন্য।’ 

লাফিয়ে উঠল দুর্যোধন, ‘অতি উত্তম বলেছ বন্ধু। ভীমকে যদি ক্ষুধায় কাতর দেখি, কী যে আনন্দ লাগবে আমার! অর্জুনকে যদি বাকলপরা অবস্থায় দেখি, কী যে সুখ লাগবে আমার! আর দ্রৌপদী! কী গুমোর ছিল! ভানুমতী এবং রাজবাড়ির অন্য মহিলাদের স্বর্ণালংকারে সজ্জিত দেখে আত্মগ্লানিতে যুধিষ্ঠিরকে ধিক্কার দিয়ে উঠবে সে। তা সব দেখেশুনে কী যে তৃপ্তি পাব আমি, তোমায় বলে বুঝাতে পারব না বন্ধু।’ 

সাজ সাজ রব উঠল প্রাসাদজুড়ে। 

কিন্তু কেন? 

রাজা দুর্যোধন দ্বৈতবনের অনতিদূরের গোয়ালপাড়ায় যাবে। সেখানকার গোধনের হিসাবনিকাশ নেওয়া প্রয়োজন। 

ধৃতরাষ্ট্রের কাছ থেকে নামকাওয়াস্তে একটা অনুমতি নেওয়া হলো। ভীষ্ম-বিদুর ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে বাধা দিলেন। দুর্যোধন উড়িয়ে দিল তাঁদের কথা। 

বিদুর তার গুপ্তচরদের মাধ্যমে আগে থেকেই পাণ্ডুপুত্রদের অবস্থান জানত। আসন্ন দুর্ঘটনার জন্য আতঙ্কিত হয়ে উঠল বিদুর। দুর্যোধন যে পাণ্ডবদের অপদস্থ না করে ছাড়বে না! 

চৌষট্টি 

কিন্তু দ্বৈতবনে বিপরীত ঘটনা ঘটল। 

হাতি-ঘোড়া আর ভৃত্য-বাহনের বিরাট দল নিয়ে দুর্যোধনরা দ্বৈতবনের দিকে রওনা দিল। সঙ্গে স্ত্রী ভানুমতী, অন্যান্য রমণী এবং দাসীরা। দ্বৈতবনের ঘোষপল্লিতে অস্থায়ী আবাস তৈরি করা হয়েছে। 

ওখানে পৌঁছে শত শত গরু দেখা, চিহ্নিত করা, গণনা করা—এসব কাজ যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই করল দুর্যোধন। 

এর পর বেরোল মৃগয়ায়, দ্বৈতবনে। আসল উদ্দেশ্য তো মৃগয়া নয়! প্রকৃত লক্ষ্য তো পাণ্ডবদের সঙ্গে সাক্ষাৎ! কর্ণ-দুঃশাসন-অশ্বত্থামারা দুর্যোধনকে উপর্যুপরি উৎসাহ জুগিয়ে যেতে লাগল। 

দ্বৈতবনের মাঝখানে মনোরম এক সরোবর। এই সরোবরের তীরে পঞ্চপাণ্ডব এবং দ্রৌপদীর অরণ্যকুটির। এদের অবস্থান সম্পর্কে আগেই সংবাদ সংগ্রহ করে ফেলেছে দুর্যোধন। যুধিষ্ঠিরদের বিপরীত দিকে, সরোবরের অন্যপ্রান্তে অস্থায়ী অথচ বিলাসবহুল ক্রীড়াগৃহ নির্মাণের আদেশ দিল দুর্যোধন। নির্মাণকারীরা সরোবরের দিকে রওনা দিল। কিন্তু অচিরেই দুঃসংবাদ নিয়ে হাজির হলো আহত এক নির্মাণকর্মী। বিপর্যয়টা অন্য এক উৎস থেকে। 

নির্মাণকর্মীটি জানাল, মহামান্য দুর্যোধন-নির্ধারিত স্থানে ক্রীড়াগৃহ নির্মাণ করতে গেলে বাধা আসে। বাধা দেয় গন্ধর্বরা। কারণ কী? গন্ধর্ব চিত্রসেন কুবেরের প্রাসাদ ছেড়ে অনেক গন্ধর্ব এবং অপ্সরাদের নিয়ে বহু আগে থেকেই সরোবরের তীরে বসবাস করে আসছে। তারা রাজা দুর্যোধনের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে রাজি নয়। ধস্তাধস্তি হয়। বেশ কিছু নির্মাণকর্মী আহত হয়। একজন প্রাণে বেঁচে সংবাদটি নিয়ে এসেছে। 

ক্ষিপ্ত দুর্যোধন নিজ সৈন্যদের আদেশ দিল, ‘সরিয়ে দাও ওখান থেকে ওই গন্ধর্বদের।’ 

কুরুবাহিনী গিয়ে গন্ধর্ববাহিনীকে বলল, ‘ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র মহাবলী দুর্যোধন এই সরোবরের তীরে বিহার করতে আসছেন। তোমরা এখান থেকে সরে যাও।’ 

গন্ধর্বসেনারা তাচ্ছিল্যভরে উত্তর দিল, ওই বেটারা শোন। আমরা দেবলোকের বাসিন্দা। গন্ধর্ব আমরা। তোরা তো মূর্খ দেখছি। কাকে কী বলতে হয় জানিস না। আমাদের ক্ষমতা সম্পর্কে কিছু বুঝিস বলেও তো মনে হচ্ছে না। মরতে চাস নাকি? উলটা-পালটা কথা বললে কচুকাটা করব বেটারা।

গন্ধর্বসেনাদের এই দম্ভের কথাগুলো অচিরেই দুর্যোধনের কানে গিয়ে পৌঁছল। ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল দুর্যোধন। প্রতিপক্ষের শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়া প্রয়োজনবোধ করল না। এরা পাণ্ডবদের পক্ষের কিনা, তারও অনুসন্ধান করল না। 

গর্জে উঠল দুর্যোধন। চিৎকার করে সৈন্যদের নির্দেশ দিল, ‘আমার বিরুদ্ধাচরণ করে! এত বড় সাহস গন্ধর্বদের! জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা করে সব শেষ করে দাও।’ 

নির্দেশ পেয়ে কুরুসৈন্যরা গন্ধর্বসেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। 

চিত্রসেন নিজে এলো সৈন্য পরিচালনা করতে। তার অস্ত্রদক্ষতায় কুরুসৈন্যরা পিছু হটতে শুরু করল। দুঃশাসন-অশ্বত্থামা পালাতে বাধ্য হলো। এমনকি ধনুর্ধর কর্ণ, সেও চিত্রসেনের আক্রমণে বেসামাল হয়ে পড়ল। কোনোরকমে বিকর্ণের রথে চড়ে অকুস্থান ছেড়ে গেল কৰ্ণ। 

দুর্যোধন কিন্তু পালাল না। কুরুরাজা বলে কথা! সামান্য কিছু সৈন্য নিয়ে একা যুদ্ধ করে যেতে লাগল সে। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। ঘিরে ধরল গন্ধর্বসেনারা। বন্দি করল দুর্যোধনকে। দুঃশাসন আর রাজবধূদের সকলকে বন্দি করল চিত্রসেন। 

অবশিষ্ট কৌরবসেনারা যুধিষ্ঠিরের সামনে উপস্থিত হলো। দুর্যোধনাদির এবং কুরুরমণীদের বন্দিত্বের কথা যুধিষ্ঠিরকে সংক্ষেপে জানাল। 

এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি খুশি হলো ভীম। সবচেয়ে বেশি দুঃখ পেল যুধিষ্ঠির। তার চোখের সামনে তখন দুর্যোধন নয়, দুঃশাসন নয়, রাজকুলবধূদের লাঞ্ছনার দৃশ্য ভেসে ভেসে উঠতে লাগল। 

ভীমের বাধাকে উপেক্ষা করে যুধিষ্ঠির বলল, ‘মানুষের বিপদে এগিয়ে যাওয়া মানুষের ধর্ম। দুর্যোধনরা আমাদের জ্ঞাতি। তার বিপদে সাহায্য করা আমাদের উচিত। জ্ঞাতিদের মধ্যে পরস্পর ভেদ-বিভেদ থাকতে পারে, শত্রুর বিপদে সুযোগ নেওয়া উচিত নয়। তোমাদের প্রতি আমার আদেশ, যেকোনো মূল্যে কুলবধূদের সম্মান বাঁচাও। গন্ধর্বদের হাত থেকে তাদের উদ্ধার করো।’ 

পাণ্ডবরা আর দ্বিরুক্তি করেনি। গন্ধর্বদের দিকে এগিয়ে গেছে। মরণপণ যুদ্ধ হয়েছিল চিত্রসেনের সঙ্গে পাণ্ডবদের। অর্জুনের সঙ্গে পেরে ওঠা চিত্রসেনের পক্ষে সম্ভব হয়নি। পরাজিত হয়েছিল। 

কুরুপ্রাসাদের রাজবধূরা মুক্ত হয়েছিল। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছিল দুর্যোধনরাও। 

দুর্যোধনকে সামনে রেখে যুধিষ্ঠির বলে উঠেছিল, ‘সাহস উত্তম। হঠকারিতা ভালো নয় দুর্যোধন। তুমি যা করেছ, অর্বাচীনতা ছাড়া কিছুই নয়। শত্রুর ওজন মাপতে হয়। তুমি গন্ধর্বদের মাপনি। তাই তোমাদের এই হাল।’ 

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে যুধিষ্ঠির আবার বলল, ‘যা হয়েছে, হয়েছে। তুমি এবার প্রাসাদে ফিরে যাও। আজকের অপমানের দুঃখ মনে রেখ না।’ 

বিমনা, হতমান দুর্যোধন মাথা নিচু করে বাড়ির পথ ধরল। রথের মধ্যে মাথা হেঁট করে ভাবতে লাগল—যাদের আমি শত্রু বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছি, তারাই আমাকে বাঁচাল আজ! এর চাইতে অপমানের আর কী হতে পারে? হস্তিনাপুরে আমি মুখ দেখাব কী করে? এই হেনস্থার কথা তো আর গোপন থাকবে না! যদি ভীষ্ম, দ্রোণ-কৃপ জিজ্ঞেস করেন, কী জবাব দেব আমি? 

হস্তিনাপুর পৌঁছে চরম এক বিষণ্ণতা দুর্যোধনকে ঘিরে ধরল। কর্ণ-শকুনিরা আপ্রাণ চেষ্টা করে গেল বিষণ্ণ দুর্যোধনকে আগের দুর্যোধনে ফিরিয়ে আনবার জন্য। 

দুর্যোধন বুঝে গিয়েছিল, বনবাসে পাণ্ডবদের বারবার উত্ত্যক্ত করে কোনো লাভ হবে না। পাণ্ডবদের প্রতি জনসমর্থনের পাল্লা ভারী, তার ওপর বিদুরসহ অন্যদের গোপন সহানুভূতি, ঘরে-বাইরে তার দুর্ভাগ্য বাড়িয়ে তুলবে। তাই বারো বছরের পাণ্ডবদের বনবাসের কালটায় নিষ্ক্রিয় থাকার সিদ্ধান্ত নিল দুর্যোধন। তবে মনে মনে ঠিক করে রাখল—এক বছরের অজ্ঞাতবাসকালে পাণ্ডবদের ধরে ফেলতে হবে এবং সেটাই হবে পাণ্ডবদের ওপর মোক্ষম আঘাত। আর তার নিজের জন্য হবে পরম স্বস্তিকর। 

বারো বছর চুটিয়ে রাজত্ব করল দুর্যোধন। 

ভোগ, সুখ—সবই এখন তার করতলগত। কিন্তু একটি দুশ্চিন্তা তাকে কীটের মতো কুরে কুরে খায়। পাণ্ডবদের বারো বছরের বনবাসের সময়কাল অতিক্রান্ত, অজ্ঞাতবাসের বছরটি চলছে। কিন্তু পাণ্ডবদের সন্ধান মিলছে কই? 

গুপ্তচররা এসে খবর দেয়—কোথায় পাণ্ডবদের খুঁজিনি মহারাজ? হাটে-মাঠে-গৃহে-গোঠে- গ্রামে-গঞ্জে-পাহাড়ে-গুহায় বনেবাদাড়ে-নগরে—সবখানে খুঁজে ফিরেছি আমরা। কোথাও পাণ্ডবদের সন্ধান মিলল না। 

বিরাট রাজবাড়িতে পাণ্ডবরা তখন আশ্রিত। ছদ্মবেশে। যুধিষ্ঠির কঙ্ক নামে বিরাট রাজার দ্যূতক্রীড়ার দোসররূপে, ভীম বল্লভ নামে পাচকরূপে, অর্জুন বৃহন্নলা নামে বিরাটরাজপুত্রী উত্তরার নৃত্যশিক্ষক রূপে, নকুল বিরাটরাজার অশ্ব-তত্ত্বাবধায়করূপে গ্রন্থিক নামে, সহদেব তন্তিপাল নামে গোশালাধ্যক্ষরূপে এবং দ্রৌপদী সৈরিন্ধ্রীরূপে। তার কাজ ছিল বিরাটরাজমহিষীর কেশবিন্যাস করা। 

এদিকে গুপ্তচরদের কথা শুনে ফুঁসতে ফুঁসতে দুর্যোধন বলল, ‘অজ্ঞাতবাস শেষ হতে আর বেশিদিন বাকি নেই। ওদের খুঁজে বের করতেই হবে। সবাই ওদের খোঁজে নেমে পড়ো! আমি আরও অনেককাল নির্দ্বন্দ্বে নিরাপদে রাজত্ব করতে চাই।’ 

এই সময় রাজসভায় ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা উপস্থিত হলো। সংবাদ দিল—বিরাটের অত্যাচারী শ্যালক কে বা কাদের হাতে নিহত হয়েছে। ও ছিল বিরাটরাজার প্রধান শক্তি। সুশর্মা এই সুযোগে বিরাটরাজ্য আক্রমণের পরামর্শ দিল। আক্রমণ হবে দ্বিমুখী। একদিকে সুশর্মা আক্রমণ করে বিরাটসৈন্যদের ব্যস্ত রাখবে। এই সুযোগে কৌরবরা বিরাটরাজার বিশাল গোশালা লুটে নেবে। 

দুর্যোধন প্রস্তাবটা লুফে নিল। কী হবে এখন পাণ্ডবদের অনুসন্ধান করে? ওরা তো এখন অর্থসামর্থ্যহীন পথের ভিখারি! 

কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বিরাটবাহিনীর হাতে কুরুবাহিনী পর্যুদস্ত হলো। বিরাটপুত্রের সঙ্গে অর্জুন সংগ্রামভূমিতে উপস্থিত হলো। ভীষ্ম-দ্রোণ অর্জুনকে দেখে চিনে ফেললেন। অর্জুনকে চিনতে দুর্যোধনেরও ভুল হলো না। পরাজয়ের গ্লানি ভুলে দুর্যোধন বলে উঠল, ‘পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস শেষ হয়ে যায়নি। আমি অর্জুনকে চিনে ফেলেছি। শর্তানুযায়ী পাণ্ডুপুত্রদের আবার বনবাসে যেতে হবে। 

দ্রোণ বললেন, ‘অর্জুনের দেখা দেওয়ার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। আমার মনে হয়, অজ্ঞাতবাসের দিন শেষ হয়ে গেছে।’ 

দুর্যোধন জোরগলায় বলল, ‘আপনার কথাটা ঠিক নয় গুরুদেব। আমার কাছে হিসাব আছে। অজ্ঞাতবাস শেষ হতে আরও কিছুদিন বাকি।’ 

দ্রোণাচার্য ব্যাপারটা ভীষ্মের ওপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘পিতামহ, অজ্ঞাতবাসের সঠিক কালটা আপনি ঠিক করে দিন।’ 

ভীষ্ম চান্দ্র মাস, সৌর মাস, তিথি, নক্ষত্র নানা পদ্ধতিতে গণনা করে দুর্যোধনকে বুঝিয়ে বললেন, ‘পাণ্ডবপুত্রদের অজ্ঞাতবাসের সময় পূরণ হয়ে গেছে এবং সেটা ধ্রুব জেনেই অর্জুন আজ যুদ্ধ করতে এসেছে। রাজ্য এবার ওদের ফিরিয়ে দিতেই হবে দুর্যোধন। 

দুর্যোধন তুড়ি মেরে ভীষ্মের কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘সে যাই হোক, যুদ্ধ ছাড়া আমি পাণ্ডবদের এক ফোঁটা জমিও ছাড়ব না পিতামহ।’ 

পঁয়ষট্টি 

বনবাসপর্ব শেষ। উদ্যোগপর্বের সূচনা। 

এ যেন উদ্যোগের আরম্ভ নয়, এ যেন মৃত্যুর আয়োজন। এ যেন কুরুক্ষেত্রে মহাশ্মশান নির্মাণের প্রারম্ভকাল। এই উদ্যোগপর্বে এসে কুরু-পাণ্ডবের গৃহবিবাদের পুনরায় সূত্রপাত হলো। 

পাণ্ডবদের ছদ্মবেশ উন্মোচিত হয়ে গেছে। অজ্ঞাতবাসকাল সম্পূর্ণ হলে যুধিষ্ঠিররা স্ব-রূপে বিরাটরাজার সম্মুখে উপস্থিত হলো। রাজা প্রথমে হকচকিয়ে গেল, পরে পরম আদারে পাণ্ডবদের নিজ রাজপ্রাসাদে অভ্যর্থনা জানাল। শুধু তাই নয় পাণ্ডবদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপন করল। কন্যা উত্তরাকে অর্জুনপুত্র অভিমন্যুর সঙ্গে বিয়ে দিল। 

এবার পাণ্ডবদের রাজ্যলাভের ক্ষেত্রে সহায়করূপে এগিয়ে এলো রাজা বিরাট 

বিরাটরাজার প্রাসাদে মন্ত্রণাসভা বসল। কীভাবে দুর্যোধনের হাত থেকে পাণ্ডবদের পিতৃরাজ্য উদ্ধার করা যায়, সে বিষয়ে মন্ত্রণা। সেই সভায় উপস্থিত থাকলেন বলরাম, বলরাম অনুজ কৃষ্ণ, যদুবীর সাত্যকি, পাঞ্চাল নৃপতি দ্রুপদ এবং রাজা বিরাট স্বয়ং। 

দ্রুপদ বলল, ‘দুর্যোধন সহজে রাজ্য ফিরিয়ে দেবে না। এখন প্রয়োজন ধর্মসম্মত যুক্তি দেখিয়ে দুর্যোধনকে রাজি করানো।’ 

বলরাম বললেন, ‘আমারও একই কথা, দ্বন্দ্বে না জড়িয়ে দুর্যোধনকে সম্মত করার চেষ্টা করা উচিত।’ 

কৃষ্ণ ত্বরিত বলল, ‘আপনার কি বিশ্বাস হয় দাদা, দুর্যোধনের মতো লোভী রাজ্য ছাড়তে রাজি হবে?’ 

‘তুমি তো প্রথমেই পক্ষ নিয়ে নিলে কৃষ্ণ! আমি নিরপেক্ষভাবে বলছি—দুর্যোধনের কাছে প্রথমে দূত পাঠানো উচিত।’ 

দাদার কথা শুনে কৃষ্ণের লজ্জা পাওয়ার কথা। কিন্তু কৃষ্ণ লজ্জা পেল না। দ্রুপদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার কী অভিমত মহারাজ দ্রুপদ?’ 

দ্রুপদ বলল, ‘যদুশ্রেষ্ঠ বলরাম ঠিকই বলেছেন, প্রথমে দুর্যোধনের কাছে দূত পাঠানো উচিত তবে এটা সত্য যে দুর্যোধন নরমের যম। কোনো মানুষ তার সঙ্গে নরম সুরে কথা বললে দুর্যোধন তাকে পেয়ে বসে। অপদস্থ করে। তার কাছে এমন দূত পাঠাতে হবে, যে শক্ত কণ্ঠে কথা বলতে জানে। শক্তের ভক্ত সে।’ 

দ্রুপদ রাজার প্রস্তাব সবাই সমর্থন করল। 

নৃপতি দ্রুপদ তার পুরোহিতকে দূত নির্বাচন করল। যাওয়ার আগে পুরোহিতকে বলল, ‘আপনি কুরুরাজসভায় পৌঁছে দুর্যোধনকে ধর্মবাক্যের মাধ্যমে পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দিতে বলবেন। আপনার কাজ শুধু ওটা নয় পুরোহিত মহাশয়, কুরুবাহিনীর গতিবিধির ওপর নজর রাখবেন, ভীষ্ম-দ্রোণ কৃপাচার্যের মনোভাব বুঝবেন, বিদুরের ইঙ্গিতের প্রতি লক্ষ রাখবেন। যদি কোনো রকমে কুরুভাইদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে দিতে পারেন, তা হলে আপনার দূতক্রিয়া অনেক সাফল্য পেয়েছে বলে মনে করব। আর হ্যাঁ, আপনার ভাষা হবে তীক্ষ্ণ ও কর্কশ।’ 

বলরাম বললেন, ‘আপনারা একতরফাভাবে শুধু দুর্যোধনকেই দোষী সাব্যস্ত করে গেলেন! যুধিষ্ঠিরের দোষটা দেখলেন না! রাজা হয়ে জুয়ায় আসক্ত কেন সে? এটা তো একজন নৃপতির স্বভাব হতে পারে না! ধৃতরাষ্ট্র ডাকলেন বলে, যেতে হবে যুধিষ্ঠিরকে? শকুনির সঙ্গে খেলতে রাজিই-বা হলো কেন সে? তার তো খেলার কথা দুর্যোধনের সঙ্গে! আসলে পাশাখেলার নেশাটা তাকে পেয়ে বসেছিল সেসময়।’ যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করলেন বলরাম। 

‘ও হ্যাঁ, আমার আরেকটা জরুরি কথা আছে, যদি আপনারা শান্তি চান মিষ্টবাক্যে দুর্যোধনকে প্রসন্ন করুন!’ বললেন বলরাম। 

বলরামের কথাটা মন্ত্রণাসভায় উপস্থিত কারোরই পছন্দ হলো না। 

সাত্যকি ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, ‘দুর্যোধন ছল করে যুধিষ্ঠিরের রাজ্য হরণ করেছে। শকুনি কপট পাশায় যুধিষ্ঠিরকে হারিয়েছে। আপনিই বলুন না দুর্যোধনকে, ওর তুলনায় পাণ্ডবরা অধিক বলশালী। আপনার কথা শুনবে ও, ও যে আপনার প্রিয়শিষ্য, গদাশিষ্য!’ 

সাত্যকির কথার শেষে দিকে ব্যঙ্গ যে ছলকে উঠেছে, অন্যরা টের না পেলেও বলরামের বুঝতে অসুবিধা হলো না। 

বলরাম বললেন, ‘বলশালীর কথা বলছ সাত্যকি? মানি। যুধিষ্ঠির অনেক বেশি শক্তিশালী রাজা ছিল। কিন্তু পাশার নেশা যে তাকে শক্তিহীন করে ছেড়েছে, তা তোমার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে কেন?’ 

সাত্যকি যদুবংশীয় রাজা শিনির পুত্র। শ্রীকৃষ্ণের সারথি সে। সে উগ্রস্বভাব ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির। বড়-ছোট জ্ঞানে খামতি আছে তার। 

বলরামের কথার জবাবে সাত্যকি উগ্র কণ্ঠে বলল, ‘আপনি শুধু যুধিষ্ঠিরের দোষ দেখে গেলেন! পাণ্ডবদের কোনো গুণ আপনার চোখে পড়ে না? দুর্যোধনের প্রশংসা ছাড়া আপনার মুখে অন্য কারও কথা নেই! শকুনির সাফাই-ই গেয়ে গেলেন শুধু!’ 

বলরাম গর্জে উঠলেন, ‘সাত্যকি, ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করে যাচ্ছ তুমি।’

দু-জনের বাকবিতণ্ডাকে আর বাড়তে দিলেন না রাজা বিরাট। 

.

যথাসময়ে দ্রুপদ-পুরোহিত কুরুরাজসভায় উপস্থিত হলো। সভা পরিপূর্ণ তখন। যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে পুরোহিত বলল, ‘আমি মাননীয় মহারাজ দ্রুপদের কুলপুরোহিত। মহামান্য কুরুনৃপতির কাছে আমি মহারাজ দ্রুপদের দূত হয়ে এসেছি। আমাকে দিয়ে তিনি এবং পাণ্ডবরা কুরুনৃপতির কাছে একটি সংবাদ পাঠিয়েছেন।’ এইটুকু বলে থেমে গেল পুরোহিত। তার হঠাৎ করে রাজা দ্রুপদের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, রাজসভায় মেজাজে কথা বলবেন। আপনার ভাষা হবে কর্কশ এবং অমসৃণ। 

সুর পালটিয়ে ফেলল পুরোহিত। 

দুর্যোধনকে লক্ষ করে বলল, ‘আপনি পাণ্ডবরাজ্য দখল করেছেন। পরস্বাপহরণকারী আপনি ছলনার আশ্রয় নিয়ে পাশাখেলা খেলতে যুধিষ্ঠিরকে বাধ্য করেছেন আপনি। এখন মহারাজ যুধিষ্ঠির তার লুণ্ঠিতরাজ্য ফেরত চান। আপনি তাঁর রাজ্য তাঁকে অবিলম্বে ফেরত দিন।’ 

পুরোহিতের রূঢ় ভাষণ শুনে সভার সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এমনকি অত্যন্ত শান্ত মেজাজের যে পিতামহ ভীষ্ম, তিনি পর্যন্ত বিরক্ত হলেন ভীষণ। অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললেন, ‘আপনার কথার মর্মার্থ যা-ই হোক, বলার ভঙ্গি এবং ভাষাটা অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং মর্মঘাতী। অশোভনও। আপনি ব্রাহ্মণ বলেই কি এরকম মেজাজ দেখালেন, এই কুরুসভায়?’ 

পুরোহিতের কথা শুনে রাগে দুর্যোধনের মুখ দিয়ে কথাই বেরোল না। থর থর করে কাঁপতে লাগল সে। 

কর্ণ বলল, ‘আপনি ভাবলেন কী করে যে, আপনার অভব্যভাষণ শুনে মহারাজ দুর্যোধন পাণ্ডুপুত্রদের রাজ্য ফিরিয়ে দেবেন? আপনি মহারাজকে এত দুর্বলচিত্তের ভাবলেন কী করে? আপনার রাজা দ্রুপদ কি ভুলে গেছে, দুর্যোধনের সামরিক শক্তির কথা?’ 

কর্ণের কথায় যে দুর্যোধনের পূর্ণ সমর্থন আছে, দুর্যোধনের চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। 

সমর্থন পেয়ে কর্ণ আবার বলল, ‘মৎস্যরাজ বিরাট আর পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের ভয় দেখিয়ে রাজ্য উদ্ধার করতে চাইছে পাণ্ডবরা? ওদের গিয়ে বলুন, দ্রুপদ-বিরাটের চোখ রাঙানিকে দুর্যোধন ভয় পান না। পাণ্ডবদের গিয়ে বলুন, অজ্ঞাতবাস শেষ হওয়ার আগে আমরা ওদের দেখে ফেলেছি। শর্ত অনুসারে পাণ্ডুপুত্রদের আবার বনে যেতে বলুন। বনবাস থেকে ফিরে এলে মহারাজ দুর্যোধন তখন রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবেন।’ 

দ্রুপদ রাজার দূত ফিরে গেল। 

.

এর পর কৃষ্ণ পাণ্ডবদের দূত হয়ে কুরুরাজসভায় এলো। কৃষ্ণ আসবার আগেই তার আগমন-সংবাদ দুর্যোধনের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। যথামর্যাদায় কৃষ্ণের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে রাখল দুর্যোধন। কিন্তু কৃষ্ণ দুর্যোধনের আতিথ্য গ্রহণ করল না। রাজপ্রাসাদের অভ্যর্থনাকে অবহেলা করে কৃষ্ণ বিদুরের বাড়িতে গিয়ে উঠল। এতে দুর্যোধন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল 

পরদিন কৃষ্ণ রাজসভায় সবার সঙ্গে দেখা করতে এলো। কৃষ্ণকে দেখেই রাগ দুর্যোধনের মস্তিষ্ককে এলোমেলো করে দিল। উগ্র ভঙ্গিতে কৃষ্ণকে লক্ষ করে দুর্যোধন বলল, ‘তুমি আমাদের সঙ্গে অভদ্র ব্যবহার করেছ কৃষ্ণ! আমাদের অভ্যর্থনাকে অস্বীকার করে তুমি ক্ষত্তা বিদুরের বাড়িতে গিয়ে উঠেছ! এর কারণ কী? জবাব দাও তুমি।’ 

কৃষ্ণ বলল, ‘তুমি আমার কাছে জবাব চাওয়ার কে? জবাবদিহি যদি করতেই হয়, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে করব।’ 

কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রের দিকে ফিরে বলল, ‘মহারাজ, পাণ্ডবদের রাজ্য আপনি ফিরিয়ে দিন। তাতে জ্ঞাতিশত্রুতা হবে না। যুদ্ধ এড়ানো যাবে।’ 

গর্জে উঠল দুর্যোধন, ‘পাণ্ডুপুত্রদের কোনো রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া হবে না। এই রাজ্য আমাদের, কুরুদের। পাণ্ডবরা উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল এখানে। ওরা বহিরাগত।’ 

ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর সবাই দুর্যোধনকে বোঝালেন—কৃষ্ণের প্রস্তাব মেনে নিতে। কিন্তু দুর্যোধন তখন মরিয়া। কুরুবৃদ্ধদের কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘যদি রাজ্য ফিরে পেতে চায়, তা হলে পাণ্ডবদের যুদ্ধ করতে হবে। কুরুদের হারাতে পারলে রাজ্য ফিরে পাবে তারা।’ 

এই সময় ভীষ্মের মৃদু কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘সমস্ত শাসনের বাইরে চলে গেলে তুমি দুর্যোধন! কারও নিয়ন্ত্রণেই থাকলে না তুমি! এর জন্য তোমাকে মাশুল গুনতে হবে দুর্যোধন।’ 

ছেষট্টি 

ভীষ্মের কথা শুনে দুর্যোধনের মনে অভিমান ও ক্ষোভ দলা পাকিয়ে উঠল। 

কৃষ্ণকে উদ্দেশ করে দুর্যোধন বলল, ‘আচ্ছা কৃষ্ণ, তুমিই বিবেচনা করে বলো তো সবাই আমার দিকে তর্জনী উঁচিয়ে আমার নিন্দামন্দ করে কেন? এই যে তুমি, তুমি তো যদুবংশের লোক, কুরুদের সঙ্গে তোমার কোনো স্বার্থসংযোগ নেই, সেই তুমিও আমাকে অবহেলা দেখিয়েছ, গালমন্দ করেছ! কেন বলো তো? আমি বলছি—তুমি পাণ্ডবদের তেল খেয়ে এখানে এসেছ। তুমি পাণ্ডবদের চামচা বলে বিবেচনা হারিয়েছ?’ 

ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনের এরকম কথা শুনে হা হা করে উঠল। পিতার আহাজারিকে উপেক্ষা করে দুর্যোধন আবার বলল, ‘সেই যে পাশাখেলাটা হলো, সেখানে শকুনি মামা দান ফেলে পাণ্ডবদের রাজ্য জয় করে নিল, সেখানে আমার কী দোষ? যুধিষ্ঠির স্বেচ্ছায় পাশা খেলল। হারল। বনে গেল। তাতে আমার অপরাধটা কী?’ 

কৃষ্ণ বলল, ‘তুমি যথার্থ একজন মতলববাজের মতো কথা বললে দুর্যোধন। ধড়িবাজরা এ রকম করে কথা বলে। এই সকল কিছুর পেছনে যে কলকাঠি নেড়েছে, সে যে তুমি, তা এই ভূ-ভারতের কারো জানতে বাকি আছে! ফন্দিফিকির ছাড় দুর্যোধন, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দিতে বাধা দিয়ো না। মনে রেখ, পাণ্ডবদের পেছনে রাজা বিরাট আর দ্রুপদ দাঁড়িয়েছেন।’ 

অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল দুর্যোধন, ‘বিরাট আর দ্রুপদের ভয় দেখাচ্ছ আমায় কৃষ্ণ? কুরুদের সামরিক শক্তির কোনো খোঁজ রাখ তুমি? বিরাট-দ্রুপদের মতো ওরকম শত রাজাকে একদিনে পরাস্ত করার ক্ষমতা রাখে কুরুসেনারা।’ 

কৃষ্ণ কিছু বলার আগে দুর্যোধন আবার বলে উঠল, ‘কৃষ্ণ, কান দিয়ে শোন। আমার পিতা যতটুকু রাজ্য পাণ্ডবদের দিয়েছিলেন, আমি বেঁচে থাকতে তার ক্ষুদ্রাংশও ফেরত পাবে না পাণ্ডুপুত্ররা। আমি যতদিন বেঁচে আছি, সূচাগ্র মেদিনীও ছাড়ব না আমি।’ 

সরোষে সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেল দুর্যোধন। ধৃতরাষ্ট্র কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকল। 

এরপর কর্ণ, দুঃশাসন, শকুনির প্ররোচনায় কৃষ্ণকে বন্দি করতে চাইল দুর্যোধন, কিন্তু ব্যর্থ হলো। বিদুরের সহযোগিতায় কৌশলে কুরুরাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল কৃষ্ণ। 

কৃষ্ণের দৌত্য ব্যর্থ হলো। 

কুরু আর পাণ্ডব—উভয় শিবিরে যুদ্ধোদ্‌যোগ শুরু হয়ে গেল। 

সৈন্যসংগ্রহ, দেশে দেশে দূত পাঠানো—এসব আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল উভয় শিবিরে। কৃষ্ণের দূতগিরি ব্যর্থ হওয়ার পর তা জোরেশোরে আরম্ভ হলো। কৃষ্ণ শান্তির দূত হয়ে হস্তিনাপুর আসার আগেই দুর্যোধন দ্বারকায় গিয়ে কৃষ্ণের নারায়ণীসেনা সংগ্রহ করে নিয়েছিল। এবার পররাষ্ট্রনীতি জোরদার করল সে। দেশে দেশে বিচক্ষণ দূত পাঠাল। কোনো দেশকে ভয় দেখিয়ে, কোনো দেশকে তোষামোদ করে আবার কোনো নৃপতিকে কৌশলে কৌরব দলে টানল দুর্যোধন। দুর্যোধনের বিচক্ষণতায় বহুদেশ কুরুদের হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিল। কুরুপক্ষ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে সম্মত হলো জয়দ্রথের দেশ সিন্ধু সৌবীর, শকুনির রাজ্য গান্ধার, সিন্ধুতীরের সীমান্ত প্রদেশ, ত্রিগর্তের রাজা সুশর্মা, বিপাশা নদীর তীরের দেশ কেকয়, মদ্ররাজ শল্য, মহারাজ সুদক্ষিণের রাজ্য কম্বোজ, মাহিষ্মতী, মহারাজ ভগদত্তের দেশ প্রাগজ্যোতিষপুর, রাজা শ্রুতায়ুর অম্বষ্ঠ, কোশলরাজ্য, বাহ্লিক, ক্ষুদ্রক, অবস্তী, বিদেহ, বৎস্য, কলিঙ্গ, অঙ্গ, পূর্ব মগধ, পুণ্ড্র-বঙ্গ, অহিছত্র, ভোজ, শূরসেন, কুকুরদেশ, অশ্মক এবং কৃষ্ণের শ্বশুর ভীষ্মকের দেশ বিদর্ভ। 

পাণ্ডবদের ডাকে সাড়া দিল মাত্র ছয়টি দেশের রাজা। দ্রুপদরাজ পাঞ্চাল, মৎস্যদেশের রাজা বিরাট, চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু এবং করুষ, কাশী, পশ্চিম মগধের রাজারা। 

পদাতিক, রথারোহী, গজারোহী, অশ্বারোহী মিলে কুরুদের সৈন্যসংখ্যা দাঁড়াল এগারো অক্ষৌহিণী। অর্থাৎ চব্বিশ লক্ষ পাঁচ হাজার সাতশ জন। চতুরঙ্গসেনা মিলিয়ে পাণ্ডবদের সৈন্য দাঁড়াল সাত অক্ষৌহিণী। মানে পনেরো লক্ষ ত্রিশ হাজার নয়শ জন। 

মোট উনচল্লিশ লক্ষ ছত্রিশ হাজার ছয়শ জন সৈন্য রক্তরঞ্জিত যুদ্ধের জন্য কুরুক্ষেত্র নামক বিশাল এক সমতল ময়দানের দিকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলো। 

কুরুদলের রথী-মহারথীরা হলেন দ্রোণাচার্য, ভীষ্ম, কৃপাচার্য, অশত্থামা, ভগদত্ত, ভূরিশ্রবা, হার্দিক্য, কৃতবর্মা, জয়দ্রথ, সুদক্ষিণ, নীল প্রমুখ। 

আর পাণ্ডবপক্ষের রথী-মহারথীরা হলেন চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু, জরাসন্ধপুত্র জয়ৎসেন, দ্ৰুপদ, বিরাট, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রমুখ। 

পাণ্ডবপক্ষে যোগদান করল কুশলী ও দ্বারকাধীশ কৃষ্ণ। কৃষ্ণই পাণ্ডবদের বলভরসা, পরামর্শদাতা, পদপ্রদর্শক। 

পাণ্ডবদের সেনাবাহিনীর তুলনায় কুরুবাহিনী অনেক বেশি শক্তিশালী। কিন্তু যুদ্ধজয়ের জন্য শক্তির পরিমাণগত দিকের চেয়ে কৌশলগত দিকের অপরিহার্যতা অধিক। 

দুর্যোধন ভরসা করেছিল ভীষ্ম আর দ্রোণাচার্যের ওপর। তাঁদের অস্ত্রদক্ষতায় দুর্যোধনের আস্থা ছিল ভীষণ। কিন্তু দুর্যোধন একবারও ভেবে দেখল না, যে ভীষ্ম দ্রোণ যুদ্ধের বিপক্ষে ছিল, যুদ্ধ থেকে বিরত হয়ে পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য যাঁরা বারবার দুর্যোধনকে পরামর্শ দিয়েছেন, সেই ভীষ্ম-দ্রোণ যুদ্ধ করবার সময় আন্তরিক থাকবেন কিনা? না দায়সারা রকমের যুদ্ধ করে সময় ক্ষেপণ করবেন? 

ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পেরে মহিষী গান্ধারী পর্যন্ত দুর্যোধনকে সতর্ক করেছিল–দেখো দুর্যোধন, যদিও আমি এই যুদ্ধের ঘোরবিরোধী, তারপরও তোমাকে একটা কথা না বলে পারছি না 

আমি। পিতামহ ভীষ্ম এবং অস্ত্রগুরু দ্রোণ পাণ্ডব আর কৌরবদের সমান চোখে দেখেন। সেক্ষেত্রে তাঁরা যে সর্বশক্তি দিয়ে তোমার হয়ে যুদ্ধ করবেন, আমার বিশ্বাস হয় না বাছা। 

দুর্যোধন মায়ের কথার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারেনি। আর বুঝতে পারলেও ভীষ্ম দ্রোণের কথায় বিভ্রান্ত হয়েছে। 

ভীষ্ম-দ্রোণ—উভয়ে দুর্যোধনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাঁরা পাণ্ডবদের প্রচুর সৈন্য বধ করবেন। তাঁরা একবারও বলেননি যে পাণ্ডবদের হত্যা করবেন তাঁরা। 

দুর্যোধন যে তাঁদের কথা অনুধাবন করতে পারেনি, তা ঠিক নয়। ভেবেছে— পাণ্ডবদের সৈন্যক্ষয় করলেই তো হলো! পাঁচ ভাইকে হত্যা করব তো আমরা, কুরুভাইয়েরা এবং কর্ণ! 

সেই পথও রুদ্ধ করে দিয়েছেন পিতামহ ভীষ্ম। 

দুর্যোধন যখন তাঁকে কুরুপক্ষের সেনাপত্য গ্রহণ করবার অনুরোধ করল, ভীষ্ম রাজি হলেন। কিন্তু শর্ত দিয়ে বসলেন একটা। 

তিনি দুর্যোধনকে বললেন, ‘আমি যে-কদিন সেনাপতি থাকব, সে-কদিন সূতপুত্র কর্ণ যুদ্ধ করতে পারবে না। 

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল দুর্যোধন। অজান্তে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘কেন?’ 

নিরাবেগ কণ্ঠে ভীষ্ম বললেন, ‘তোমার ওই কেনর উত্তর আমি দিতে রাজি নই দুর্যোধন। এতদিন কুরুরাজ্যের খেয়েছি-পরেছি। তাই রাজ্যের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা আছে। সেই ঋণ শোধের জন্য আমি যুদ্ধ করব শুধু।’ শুধু শব্দটির ওপর শ্বাসাঘাত করে কথা শেষ করলেন ভীষ্ম । 

দুর্যোধন বিচক্ষণ। পিতামহের সকল কথা বুঝতে পারল সে। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেও এখন নিরুপায়। প্রথম দিকে পিতামহ ভীষ্মের মতো দুর্দান্ত দুর্ধর্ষ একজন সেনাপতি কুরুপক্ষে থাকা নিতান্ত প্রয়োজন। তাই ভীষ্মের এই অযৌক্তিক শর্ত মেনে নিল। কর্ণকে অনুরোধ করল যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে। 

বিচক্ষণ দুর্যোধন যুদ্ধের প্রথমেই মস্তবড় একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল। 

অপরপক্ষে পাণ্ডবরা যুধিষ্ঠিরকেই তাদের সেনাধ্যক্ষ নির্বাচন করল। যুধিষ্ঠির সেনাপতি নির্বাচিত হলে কী হবে, তার কুটিল-সরল — দুই ধরনের পরামর্শদাতা থাকল কৃষ্ণ। দুর্যোধনের পক্ষে কৃষ্ণের মতো তেমন পরামর্শদাতা নেই। গুরুদেব বলরামকে পরামর্শক হিসেবে আহ্বান জানিয়েছিল দুর্যোধন। বলরাম যুদ্ধের পক্ষপাতী ছিলেন না বলে কৃষ্ণকে তিরস্কার জানিয়ে তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলেন। 

এতবড় যুদ্ধের দামামা হয়তো বাজত না। যদি রাজা দ্রুপদ তার পুরোহিত দূতকে কুরুসভায় কর্কশ ভাষায় উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার জন্য পরামর্শ না দিত। যদি কুলপুরোহিত শান্ত-ভদ্রজনোচিতভাবে কথা বলত, তা হলে হয়তো দুর্যোধন রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবে রাজি হতেও পারত। কৃষ্ণ এসে দুর্যোধনের ক্রোধে আর অভিমানে ঘি ঢেলেছে। কৃষ্ণ তো আসলে কুরুরাজসভায় যুদ্ধ থামাবার অভিলাষে আসেনি, এসেছিল যুদ্ধকে উস্কে দিতে। 

কৃষ্ণের চক্রান্ত সফল হয়েছিল। 

সাতষট্টি 

ধৃতরাষ্ট্র শেষ চেষ্টা করল। তার একান্ত অভিপ্রায় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে থামিয়ে দেওয়া। 

নিজের একান্ত সচিব সঞ্জয়কে দূত হিসেবে পাণ্ডবশিবিরে পাঠাল। 

রাজা দ্রুপদ যেমন দূত কুলপুরোহিতকে অভব্য ব্যবহারের প্ররোচনা দিয়ে কুরুরাজসভায় পাঠিয়েছিল, ধৃতরাষ্ট্র কিন্তু তা করল না। সঞ্জয়কে শুধু বলল, ‘তুমি বিরাটসভায় সবাইকে যথাযথ সম্মান দেখিয়ে কথা বলবে। এমন কোনো শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করবে না সঞ্জয়, যাতে পাণ্ডুপুত্রদের বা অন্য মর্যাদাবানদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়।’ 

রাজা দ্রুপদ যেখানে দূতের মাধ্যমে যুদ্ধের আগুন জ্বালাতে চেয়েছে, ধৃতরাষ্ট্র সেখানে সঞ্জয়ের মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ করবার আন্তরিক উদ্যোগ নিয়েছে। 

শৈশবে সঞ্জয় অর্জুনের প্রিয়সখা ছিল। দৌত্য করতে গিয়ে সঞ্জয় সেই বন্ধুত্বের কথা স্মরণে রেখেছে। 

অর্জুনসখা সঞ্জয় যুধিষ্ঠিরকে বলেছে, ‘জ্ঞাতিবধের এই যুদ্ধের প্রয়োজন কীসের জন্য? যে যুদ্ধে উভয়পক্ষের সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী, সে যুদ্ধের প্রয়োজন কেন? যে যুদ্ধের পরিণতিতে পাপ এবং নরকবাসের নিশ্চয়তা, সে যুদ্ধের প্রয়োজন কেন? যে যুদ্ধে জয় আর পরাজয় সমান মূল্যবহ, সে যুদ্ধের প্রয়োজন কেন? যে যুদ্ধ শুভ্রবস্ত্রে কজ্জলের ন্যায় প্রকাশ পাবে, কোন বিচক্ষণ জ্ঞানবান ব্যক্তি সে যুদ্ধের আয়োজন করেন? এখন বলুন মহারাজ যুধিষ্ঠির, যুদ্ধের নামে জ্ঞাতিবধের এই আয়োজন করাটা কি আপনার উচিত হচ্ছে?’ 

সঞ্জয়ের মুখে এই ধরনের কথা শুনে যুধিষ্ঠির বা কৃষ্ণ কেউই কথা বলতে পারল না।

তারা কথা বলছে না দেখে সঞ্জয় আবার বলল, ‘এ যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ নয়, এ পাপযুদ্ধ। পরিণামে হাহাকার ছাড়া এই যুদ্ধ থেকে পাওয়ার আর কিছুই থাকবে না মহারাজ।’ 

সঞ্জয়ের কথাগুলো এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। কিছু একটা জবাব তো দিতেই হবে! তাই মুখ খুলল যুধিষ্ঠির, ‘দেখো সঞ্জয়, তুমি জ্যেষ্ঠতাতের দূত হয়ে আমার কাছে এসেছ।’ 

এই সময় কৃষ্ণের মনে হলো, সঞ্জয়ের সত্যকথার মুখোমুখি হয়ে গলে গেছে যুধিষ্ঠির। হয়তো মুখ ফসকে সে বলেই ফেলবে—এই যুদ্ধ হবে না। আশঙ্কিত আতঙ্কিত কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের মুখের কথা কেড়ে নিল। 

অত্যন্ত মধুমাখা গলায় কৃষ্ণ বলে উঠল, ‘মহারাজ যুধিষ্ঠির ধর্মের পক্ষে। তাঁর চিন্তায় এবং আচরণে অধর্মের কোনো স্থান নেই। তাই মানুষেরা তাঁকে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বলতে শুরু করেছে।’ 

একটা বাঁকা হাসি সঞ্জয়ের মুখে ঝিলিক তুলে মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। 

কৃষ্ণ নিজের কথায় মগ্ন। বলছে, ‘শুধু তা নয়, যুধিষ্ঠির একজন যথার্থ ক্ষত্রিয়ও। আর যুদ্ধ করাই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। সমাজের চারটা বিভাজনের কথা তুমি জান সঞ্জয়। ব্রাহ্মণ শুধু অধ্যয়ন, যজন এবং দান গ্রহণ করবেন। বৈশ্য বাণিজ্য দ্বারা উপার্জন করবে এবং সেই উপার্জন দিয়ে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের সেবা করবে। অধ্যয়ন, বাণিজ্য করা শূদ্রের জন্য নিষিদ্ধ। তারা উদয়াস্ত কায়িক পরিশ্রম করে উচ্চ তিন বর্ণের সেবা করে যাবে। এ সবই স্মৃতিশাস্ত্রের নির্দেশ।’ 

‘মহারাজ যুধিষ্ঠির স্মৃতিশাস্ত্র, মানে আপনার কথিত নির্দেশনায় রাজ্য স্থাপন করতে চাইছেন এবং এটাকেই আপনি বলতে চাইছেন ধর্মরাজ্য—তাই তো দ্বারকাধীশ?’ বেদনাহত কণ্ঠে বলে গেল সঞ্জয়। 

‘তাই-ই তো! ঠিক তা-ই! তুমি যথার্থই ধরতে পেরেছ সঞ্জয়। যুধিষ্ঠির এমন একটা রাজ্য স্থাপনে বদ্ধপরিকর, যেখানে ব্রাহ্মণের প্রাধান্যে ক্ষত্রিয়েরা শাসন ক্ষমতায় থাকবে। আর নীচ বর্ণের মানুষেরা স্ব স্ব কর্তব্য করে যাবে।’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল কৃষ্ণ। 

সঞ্জয় বলল, ‘তা হলে এটা বুঝে নিতে পারি যে মহারাজ যুধিষ্ঠির স্থাপিত নতুন রাজ্যটিতে সাধারণ মানুষের কোনো অধিকার থাকবে না। তারা সেবাদাসে পরিণত হবে। নিজস্ব সুখদুঃখ বলে কিছুই থাকবে না শূদ্রদের। প্রভুর, মানে উচ্চবর্ণীয়দের সুখদুঃখই তাদের সুখদুঃখে পরিণত হবে।’ 

‘ঠিকই ধরতে পেরেছ তুমি সঞ্জয়।’ বলল কৃষ্ণ 

সঞ্জয় এবার আহত কণ্ঠে বলল, ‘তা হলে বর্তমানে সকল শ্রেণির মানুষের অধিকার নিশ্চিত করে ধৃতরাষ্ট্র, মানে দুর্যোধন যে কুরুরাজ্য শাসন করছেন, তা সম্পূর্ণরূপে অবহেলিত হবে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের ধর্মরাজ্যে?’ 

কৃষ্ণ মুখে জবাব না দিয়ে মৃদু মৃদু হাসতে লাগল। সঞ্জয়ের বক্তব্যকে সমর্থনের হাসি এটি। 

সঞ্জয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে বলল, ‘বড় আশা নিয়ে মহামান্য ধৃতরাষ্ট্র আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছিলেন মহারাজ! তিনি মনেপ্রাণে জ্ঞাতিবধের এই যুদ্ধটা বন্ধ করতে চান। তিনি আপনাকে অনুরোধ করেছেন, যুদ্ধটা না করতে। কুরুশ্রেষ্ঠ এ-ও আপনাকে বলতে বলেছেন, দুর্যোধন তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ভীষ্ম-দ্রোণ এবং তিনি নিজে আপ্রাণ চেষ্টা করেও দুর্যোধনকে যুদ্ধোদ্যোগ থেকে বিরত করতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত আপনাকে ভরসা মেনেছেন তিনি। দয়া করে জ্যেষ্ঠতাতকে বিমুখ করবেন না মহারাজ। ভ্রাতৃঘাতী এই যুদ্ধ বন্ধ করুন।’ 

অদ্ভুত এক অশোভন কণ্ঠে গর্জে উঠল ভীম, ‘এই যুদ্ধ থামিয়ে দিলে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার প্রতিশোধ কীভাবে নেব? দুর্যোধনের ঊরু কীভাবে চূর্ণ করব? দুঃশাসনের রক্ত কীভাবে পান করব?’ 

একটু থেকে ভীম সতেজে আবার বলল, ‘আপনি গিয়ে পুতুলরাজা ধৃতরাষ্ট্রকে বলুন, এই যুদ্ধ হবেই। যেদিন তাঁর শত পুত্র আমার হাতে নিহত হবে, সেদিনই কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধ বন্ধ হবে।’ 

কৃষ্ণও দ্রুত বলে উঠল, ‘আমারও একই কথা- ধর্মস্থাপনের জন্য যে যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছে যুধিষ্ঠির, শেষ পরিণতিতে না-পৌঁছনো পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলতে থাকবে। 

করুণ চোখে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকাল সঞ্জয়। যুধিষ্ঠিরের চোখেমুখে তখন বিমূঢ়তা। 

ধৃতরাষ্ট্রের কাছে ফিরে সঞ্জয় তার ব্যর্থতার কথা জানান। সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের কাছে শুধু ব্যর্থতার খবর আনেনি, পাণ্ডবদের সাময়িক শক্তির সংবাদও নিয়ে এসেছে। কৌরবরাজসভায় সঞ্জয় পাণ্ডবপক্ষের বীরদের শৌর্যবীর্যের বিশদ বিবরণ দিল। সে এও বলল যে কুরুপক্ষের বীররা পাণ্ডবপক্ষের বীরদের সমকক্ষ নন। যুদ্ধ বাধলে কৌরবরা সবংশে ধ্বংস হবে। 

শুনে ধৃতরাষ্ট্র ভয় পেয়ে গেল। এই সময় ভীষ্ম-দ্রোণ জানালেন যে, এই যুদ্ধ পরাজয় ডেকে আনবে। 

ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, ‘কৃষ্ণের মাধ্যমে মাত্র পাঁচখানি গ্রাম চেয়েছে পাণ্ডুপুত্ররা, তুমি তাতে সম্মত হও দুর্যোধন। পাঁচখানি গ্রাম ওদের দিয়ে যুদ্ধের পথ থেকে ফিরে এসো।’ 

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল দুর্যোধন। ব্যঙ্গ মিশানো কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ভয় পেয়ে গেলেন নাকি পিতামহ? সঞ্জয় যে বানিয়ে বাড়িয়ে বলছেন না, তার নিশ্চয়তা কী? আমি, কর্ণ আর দুঃশাসন পাণ্ডবদের বিনাশ করতে সক্ষম। আপনাদের কারও সাহায্য লাগবে না এই যুদ্ধে জিততে।’ 

এবার কণ্ঠে গাম্ভীর্য আর ক্রোধ ঢেলে দুর্যোধন বলল, ‘আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি–পাণ্ডবরা ভিক্ষুকের মতো যতই পাঁচখানি গ্রাম ভিক্ষা করুক, রাজি নই আমি তাতে। এই যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। এই যুদ্ধে পাণ্ডবদের বধ করে হয় আমি কুরুসাম্রাজ্যের নৃপতি হব, না হয় পাণ্ডবরা আমাদের হত্যা করে রাজা হবে। আমি জীবন ত্যাগ করতে রাজি, কিন্তু পাণ্ডবদের সঙ্গে কুরুরাজ্য ভাগাভাগি করতে রাজি নই।’ 

দুর্যোধনের অভিমানী, আত্মদর্শী কথা শুনে কুরুরাজসভা স্তব্ধবাক হয়ে রইল। 

কুরু-পাণ্ডবযুদ্ধ নিশ্চিত হয়ে গেল। 

দুর্যোধন এই সময় উলূক নামের এক দূতকে পাণ্ডবশিবিরে পাঠাল। যুধিষ্ঠির এবং কৃষ্ণকে দুটি কথা বলবার জন্যই উলূককে পাঠাল দুর্যোধন। রওনা দেওয়ার আগে কথা দুটি উলূককে শিখিয়ে দিল সে। 

উলূক যুধিষ্ঠিরকে গিয়ে বলল, ‘হে রাজন, মহারাজ দুর্যোধন বলেছেন, আপনার ধার্মিক সেজে থাকা ভেকধরা ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনার বাহ্যিক রূপ একরকম, কিন্তু কাজ করেন তার বিপরীত। আপনি লোককে দেখানোর জন্য বেদ অধ্যয়ন করেন, ধার্মিক সাজেন। ভেতরে ভেতরে আপনি একজন পররাজ্যলোভী ছাড়া আর কেউ নন।’ 

উলূকের কথা শুনে যুধিষ্ঠির নিথর হয়ে গেল। 

কৃষ্ণ সতেজে বলল, ‘উলূক, দূত অবধ্য। তাই তুমি আজ প্রাণে বেঁচে গেলে। তোমার এই অভব্যতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়।’ 

কৃষ্ণের কথা কানেই তুলল না উলূক। কৃষ্ণকে লক্ষ করে বলল, ‘ও হ্যাঁ দ্বারকাধীশ কৃষ্ণ, আপনার জন্যও এটা সন্দেশ পাঠিয়েছেন কুরুরাজ দুর্যোধন। তিনি আপনাকে বলতে বলেছেন, ভয় দেখিয়ে কাউকে বশে আনা যায় না। অন্তত মহারাজ দুর্যোধনকে যাবে না। আরও বলতে বলেছেন, কীসব মায়া-কুহক সৃষ্টি করে পাণ্ডবদের যেভাবে হাতের পুতুল করেছেন, সেরকম মহারাজ দুর্যোধনকে করতে পারবেন না। আর আপনি মানুষের কাছে দেবতা সাজতে চাইছেন, আপনার সেই দেবতার ছদ্মবেশ টেনে খুলে ফেলবেন, বলেছেন মহারাজ দুর্যোধন।’ 

হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বিকট কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠল কৃষ্ণ। 

উলূক শিরদাঁড়া সোজা করে পাণ্ডবশিবির থেকে বেরিয়ে গেল। 

আটষট্টি 

যুধিষ্ঠির তার ভাইদের সৈন্যবাহিনী সুসংগঠিত করতে আদেশ দিল। 

তাদের সংগৃহীত সাত অক্ষৌহিণী সেনাকে সাত ভাগে বিভক্ত করা হলো। দ্রুপদ, বিরাট, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, চেকিতান, সাত্যকি এবং ভীমকে সাত বিভাগের সেনাধ্যক্ষ করা হলো। 

প্রচণ্ড আবেগ আর উত্তেজনায় পাণ্ডবশিবিরে যুদ্ধের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। হাতি, ঘোড়া, রথের বিপুল সমাবেশ ঘটল। সকল প্রকার রণবাদ্যে চারদিক উচ্চকিত হয়ে উঠল। 

এক শুভসময়ে কুরুক্ষেত্রের দিকে অগ্রগমন শুরু করল পাণ্ডববাহিনী। ভীম, নকুল, সহদেব, অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পুত্ররা, ধৃষ্টদ্যুম্ন সেনাবাহিনীর অগ্রভাগে থাকল। আর সেনাদলের পেছন পেছন অগ্রসর হলো রাজা বিরাট, কুন্তীভোজ-এরা। রাজা যুধিষ্ঠির রণহস্তী, যানবাহন, তাঁবুর সরঞ্জাম, অস্ত্রশস্ত্র, খাদ্যসামগ্রী, চিকিৎসক এবং সৈন্যদলের মনোরঞ্জনকারী বেশ্যাদের নিয়ে বাহিনীর মধ্যবর্তী হয়ে এগোতে লাগল। আর যুধিষ্ঠিরকে বৃত্তাকারে ঘিরে এগিয়ে চলল কৈকেয়রা, বসুদান, শ্রোণিমান, শিখণ্ডী প্রভৃতিরা। সৈন্যসামন্তের কাছাকাছি চলতে লাগল রথারোহী অর্জুন। অর্জুনের রথ চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণ। যুদ্ধপ্রস্তুতির সময় কৃষ্ণ জানিয়ে দিয়েছিল, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সে অস্ত্র হাতে তুলে নেবে না। শুধু অর্জুনের সারথি হয়ে তাকে পরামর্শ দিয়ে যাবে। 

একসময় পাণ্ডবরা সসৈন্যে কুরুপ্রান্তরে পৌঁছে গেল। যথাস্থানে শিবির সন্নিবিষ্ট হলো। 

ওদিকে দুর্যোধনও বসে ছিল না। সেও সৈন্যবাহিনীকে সুগঠিত করল। কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্য, শল্য, জয়দ্রথ, কর্ণ, সুদক্ষিণ, কৃতবর্মা, অশ্বত্থামা, ভূরিশ্রবা, শকুনি এবং বাহীক—এই এগারো জন বীরকে এক এক অক্ষৌহিণীর সেনাপতি করল। তারপর পিতামহ ভীষ্মের সামনে গিয়ে করজোড়ে প্রধান সেনাধ্যক্ষ হতে অনুরোধ করল। 

ভীষ্ম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আমি তোমাকে আমার প্রথম শর্তের কথা আগেই জানিয়েছি। আমার আরও একটা শর্ত আছে। সেটা পূরণ হলে তোমার বাহিনীর প্রধান সেনাধ্যক্ষ হতে সম্মত আছি আমি।’ 

দুর্যোধন বিস্ময়ভরা স্বগত কণ্ঠে বলল, ‘আরও একটা শর্ত!’ 

স্পষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘আপনার সেই শর্তটা কী পিতামহ?’ 

ভীষ্ম বললেন, ‘দ্রুপদসন্তান শিখণ্ডীর সঙ্গে কখনো যুদ্ধ করব না আমি। তাকে হত্যাও করব না।’

‘যুদ্ধ করবেন না! হত্যা করবেন না! শিখণ্ডীকে!’ গভীর বিস্ময়ে বলে উঠল দুর্যোধন। 

নিরাবেগী কণ্ঠে ভীষ্ম বললেন, ‘শিখণ্ডী দ্রুপদের ঘরে প্রথমে নারী হয়ে জন্মেছে। পরে দৈহিক রূপান্তরের কারণে সে পুরুষে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে পুরুষ হলেও প্রকৃতপক্ষে শিখণ্ডী তো নারীই! একজন নারীকে বধ করা আমার ধর্ম নয়।’ 

কতক্ষণ চেতনাহীন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল দুর্যোধন। তারপর অসহায় ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনার দ্বিতীয় শর্তটিও মেনে নিলাম পিতামহ। এবার আপনি প্রধান সেনাপতির পদটি গ্রহণ করুন।’ 

ভীষ্ম সম্মতির মাথা দোলালেন। 

দুর্যোধন নিজে রওনা দেওয়ার আগে বিপুল সৈন্যবাহিনীকে কুরুক্ষেত্রের উদ্দেশে রওনা করিয়ে দিল। সঙ্গে গেল অস্ত্রশস্ত্রসহ নানা যুদ্ধসামগ্রী, খাদ্যদ্রব্য, লক্ষ লক্ষ সুসজ্জিত হাতি, ঘোড়া, অশ্বারোহী, গজারোহী সেনা ও শতসহস্র পদাতিক সৈন্য। দুর্যোধনের আদেশে বাদ্যকাররা শত শত শঙ্খ, ভেরি ও অন্যান্য রণবাদ্য বাজাতে বাজাতে চলল। 

কুরুক্ষেত্রে পৌঁছে কর্ণের সঙ্গে পরামর্শে বসল দুর্যোধন। বিশাল এক সমতল ভূমিতে শিবির স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিল দুজনে। 

সব কিছু ঠিকঠাক মতো সম্পন্ন হলো। কিন্তু একটা বিরোধ কৌরবশিবিরে থেকেই গেল। তা হলো ভীষ্ম-কর্ণের বিবাদ। কর্ণের প্রতি ভীষ্মের মন বিষিয়ে ছিল। যতবার ভীষ্ম কুরুসভায় দুর্যোধনকে সৎ পরামর্শ দিয়েছেন, ততবারই তাঁর বিরোধিতা করেছে কর্ণ! ফলে ভীষ্মের মনে কর্ণের জন্য বিপুল এক ঘৃণা জমা হয়েছিল। তাই ভীষ্মের হাতে যখন সুযোগ এলো—শর্ত দিলেন তিনি বেঁচে থাকতে কর্ণ যুদ্ধ করতে পারবে না। কর্ণও ঔদ্ধত্য দেখিয়ে ভীষ্মের শর্ত মেনে নিয়েছিল। উভয়ের মধ্যে এই বিরোধ যদি উপস্থিত না হতো, কর্ণ আর ভীষ্ম একত্রিত হয়ে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যদি যুদ্ধ করতেন, তা হলে অচিরেই পাণ্ডবরা ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হয়নি। দুর্যোধনের নিয়তি খারাপ বলেই হয়নি। 

পাণ্ডবরা কুরুময়দানের পশ্চিম প্রান্তে আর কৌরবরা পূর্ব প্রান্তে অবস্থান নিল। 

যুদ্ধারম্ভের সকল প্রস্তুতি শেষ হলো। কুরুক্ষেত্রের মধ্যিখানে যুদ্ধের নীতি-নির্ধারণী সভা বসল। সেখানে উভয়পক্ষের বাঘা বাঘা সেনাপতিরা উপস্থিত থাকলেন। এই যুদ্ধনীতি যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অবশ্যই পালনীয়। কোনো পক্ষ এই নীতির ব্যত্যয় ঘটালে সেই পক্ষ যুদ্ধাপরাধে দায়ী হবে। প্রাচীনকালে এই ধরনের নিয়ম সব যুদ্ধেই মেনে চলা হতো। 

কুরু-পাণ্ডব মিলে যে সকল যুদ্ধনীতি ঠিক করল, সেগুলো হলো—সমানশক্তির যোদ্ধারা পরস্পর যুদ্ধ করবে। প্রতিদিন যুদ্ধশেষে বিরোধীপক্ষের যোদ্ধারা পরস্পর বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করবে। যুদ্ধে কোনোরকম কপটতা চলবে না। বাগযুদ্ধ বাগ্যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকবে। পলায়নরত কোনো সৈন্যকে পেছন থেকে আঘাত করা যাবে না। রথারোহী রথারোহীর সঙ্গে, গজারোহী গজারোহীর সঙ্গে, পদাতিক পদাতিকের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। ভয়বিহ্বল কাউকে আঘাত করা চলবে না। যে সৈন্যের অস্ত্রশস্ত্র আর বর্ম নষ্ট হয়ে গেছে, তাকেও আঘাত করা যাবে না। সারথিকে আঘাত করা যাবে না। অস্ত্রশস্ত্র বহনকারী এবং রণবাদ্যবাদকদের কখনোই আঘাত করা যাবে না। 

এই সভায় কুরুপক্ষে যেমন ভীষ্ম, দ্রোণ কৃপ অশ্বত্থামা, দুর্যোধন ছিলেন, তেমনি পাণ্ডবপক্ষে কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির, অর্জুন, ভীম, দ্রুপদ, বিরাট, ধৃষ্টদ্যুম্নরাও ছিল। 

কৌরবসেনারা পশ্চিমমুখী হয়ে এবং পাণ্ডবসৈন্যরা পূর্বমুখী হয়ে কুরুক্ষেত্রে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। যুদ্ধ শুরু হওয়ার মুখে এক অকল্পনীয় ঘটনার অবতারণা হলো পাণ্ডবশিবিরে। 

হঠাৎ দেখা গেল—যুধিষ্ঠির অস্ত্রশস্ত্র-বর্ম পরিত্যাগ করে করজোড়ে কৌরবসেনাদের মধ্যে অবস্থানরত পিতামহ ভীষ্মের দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। 

কৌরবরা ভাবল, যুধিষ্ঠির বুঝি ভয় পেয়ে গেছে, তাই যুদ্ধবন্ধের প্রার্থনা নিয়ে পিতামহের দিকে এগিয়ে চলেছে। সতর্ক চোখ রাখল তারা যুধিষ্ঠিরের ওপর। 

যুধিষ্ঠির ভীষ্মের নিকটে গিয়ে তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল। চরণবন্দনা শেষে করজোড়ে তাঁর আশীর্বাদ প্রার্থনা করল এবং যুদ্ধ শুরুর অনুমতি চাইল। 

যুধিষ্ঠিরের এই আচরণে ভীষ্ম আবেগে বিহ্বল হয়ে পড়ল। করুণা আর ভালোবাসায় তাঁর চোখমুখ আঁধার হয়ে এলো। আবেগে-স্নেহে উদ্বেলিত ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে আলিঙ্গন করলেন। আমার প্রতি এত ভক্তিশীল যুধিষ্ঠির। এত ভালোবাসে আমায়! আবেগান্ধ ভীষ্ম ভাবলেন। তাঁর মন পাণ্ডবপক্ষের অনুকূল হয়ে গেল। এরপর একই কাজ দ্রোণাচার্যের সঙ্গেও করল যুধিষ্ঠির। ভক্তিভরে গুরুর পা দুটো স্পর্শ করে তাঁর আশীর্বাদ চাইল। গুরু শিষ্যকে আন্তরিক আশীর্বাদ করলেন। 

এই সময় দ্রোণাচার্যকে অদ্ভুত এক প্রশ্ন করে বসল যুধিষ্ঠির, ‘গুরুদেব আপনাকে বধ করার উপায় কী?’ 

চমকে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়েছিলেন দ্রোণাচার্য। 

মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘মিথ্যে কথা। আমাকে মিথ্যে কথায় ভোলাতে পারলে আমার মৃত্যু হবে।’

এটা যে পাণ্ডবপক্ষের মস্তবড় এক চালাকি বুঝতে পারলেন না পিতামহ। এই ধাপ্পাবাজি যে কৃষ্ণের মস্তিষ্কপ্রসূত অনুধাবন করতে পারলেন না তিনি। 

মূলত ভীষ্মের ভয়ে কম্পিত ছিল পাণ্ডবপক্ষ। ভীষ্ম যে দুর্ধর্ষ এক যোদ্ধা, তিনি যে অজেয়, ইচ্ছে করলে অল্পসময়ের মধ্যে পাণ্ডবদের পরাজিত করতে পারেন তিনি, সেটা সম্যক জানত কৃষ্ণ। এবং তার এও অজানা ছিল না যে কুরুদের প্রধান সেনাপতি নির্বাচিত হয়েছেন পিতামহ। তিনি যদি যুদ্ধে নমনীয় না থাকেন, তা হলে পাণ্ডবদের অচিরেই পরাজয় ঘটবে। কী করা যায়? কী করলে ভালো হয়? ভাবতে ভাবতে কৃষ্ণের মাথায় পরিকল্পনাটি ঝিলিক দিয়ে উঠল। রাতে পঞ্চভ্রাতার সঙ্গে আলোচনাটা সেরে রাখল কৃষ্ণ। 

পরদিন প্রত্যুষে যুদ্ধারম্ভের একটু আগে ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলল যুধিষ্ঠির। 

এই ধাপ্পাবাজির ফল সুদূরপ্রসারী হলো। ভীষ্ম দ্রোণের মন বিগলিত হয়ে গেল। পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যে কঠোরতা এই দুই মহাবীরের মনে দানা বেঁধেছিল, যুধিষ্ঠিরের চাতুরিময় ভক্তিপূর্ণ আচরণে তা গলে জল হয়ে গেল। 

পরবর্তীকালে তাঁরা পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন বটে, কিন্তু প্রকৃত যোদ্ধার মতো যুদ্ধ করেননি। তাঁদের সম্পূর্ণ অস্ত্রদক্ষতা কুরুদের অনুকূলে ব্যবহার করেননি তাঁরা। জীবনাবসান পর্যন্ত অদ্ভুত এই সংকোচে আক্রান্ত ছিলেন এই দুই মহাবীর। 

এও দুর্যোধনের মর্মান্তিক এক দুর্ভাগ্য। যাঁদের সে আপন ভেবে বুকের কাছে টেনে নিয়েছে, তাঁরাই বিশ্বাসঘাতকতার চাকু চালিয়েছেন তার বুকে। 

উনসত্তর 

ভীষ্ম দ্রোণকে সন্তুষ্ট করেই থেমে থাকেনি যুধিষ্ঠির, তার ধোঁকাবাজির সীমা বাড়িয়েছে। 

এরপর এগিয়ে গেছে কৃপাচার্যের দিকে। কুরুশিবিরে অস্ত্রবিদ্যায় ভীষ্ম আর দ্রোণের পরেই কৃপাচার্যের স্থান। 

কৃপাচার্যের পায়ের কাছে প্রায় লুটিয়ে পড়ল যুধিষ্ঠির। প্রথম অস্ত্রগুরু বলে কথা! 

বিগলিত গলায় যুধিষ্ঠির বলল, ‘আপনি আমার প্রথমগুরু। আপনার হাত দিয়েই আমার প্রথম অস্ত্রশিক্ষার শুরু। আপনার আশীর্বাদই আমার সবচাইতে বেশি কাম্য। আপনার চরণে আমার মাথা রাখছি গুরুদেব। আমাকে যুদ্ধজয়ের আশীর্বাদ করুন।’ 

‘আহা যুধিষ্ঠির! করো কী! করো কী! তোমার স্থান আমার পায়ে নয়, আমার বুকে।’ বলে যুধিষ্ঠিরকে বুকের কাছে টেনে নিলেন কৃপাচার্য 

যুধিষ্ঠিরের চোখমুখ তখন ক্রুর হাসিতে ভেসে যাচ্ছে। 

উদ্বেলিত কণ্ঠে কৃপাচার্য আরও বললেন, ‘আমি তোমার আচরণে অত্যন্ত তৃপ্ত বস। আমি তোমাকে অভিশাপ দিতাম, যদি তুমি আমার কাছে না আসতে।’ 

‘আমাকে আশীর্বাদ করুন গুরুদেব।’ 

‘তোমার জন্য আমার হৃদয়পূর্ণ আশীর্বাদ যুধিষ্ঠির। জেনে রাখো—এই যুদ্ধে পাণ্ডবরাই জয় পাবে। রোজসকালে আমি তোমাদের বিজয় কামনা করেই যুদ্ধ শুরু করব।’ 

সারাজীবন কুরু-আশ্রিত কৃপাচার্য পাণ্ডবদেরই মঙ্গল চাইলেন। কামনা করলেন কুরুদের পরাজয়। 

যুধিষ্ঠিরের পরবর্তী লক্ষ্য মদ্ররাজ শল্য। শল্য যুধিষ্ঠিরের মামা। নকুল-সহদেবের জননী মাদ্রীর ভাই। ভাগনেদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করার কথা শল্যের। পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধ করবে বলে সসৈন্যে কুরুক্ষেত্রের দিকে রওনাও দিয়েছিল। সংবাদটা দুর্যোধন শিবিরে চলে এসেছিল। পথিমধ্যে শল্যের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো দুর্যোধন। দুর্যোধন ভক্তি-আদর-আপ্যায়নে শল্যকে এতই মুগ্ধ করে ফেলল যে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কৌরবশিবিরে যোগদান করে বসল মদ্ররাজ শল্য! 

সিদ্ধান্ত পালটানো সেই শল্যের সামনে গিয়ে দাঁড়াল যুধিষ্ঠির। ভক্তিভরে করজোড়ে বলল, ‘মামা, যদিও আপনার ওপর আমাদের পূর্ণ অধিকার ছিল, তারপরও আপনি সিদ্ধান্ত পালটে দুর্যোধন দলে যোগ দিয়েছেন। না না, তাতে আমি কিছু মনে করিনি। জানবেন, আপনার প্রতি পাণ্ডবদের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা অটুট আছে। এই সংকটকালে নকুল-সহদেব আপনাকে পাশে পেলে ভরসা পেত মামা। যা হোক মামা, তাতে কিছু আসে যায় না। আপনার আশীর্বাদ পেলেই আমরা বেঁচে যাই।’ 

এমনিতেই শল্য তার কাজের জন্য সংকুচিত হয়েছিল। যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে আরও কুঁকড়ে গেল। মিনমিনে গলায় বলল, ‘বলো, কী আশীর্বাদ চাও তুমি?’ 

যুধিষ্ঠির ভেজাবেড়ালের কণ্ঠে বলল, ‘জানি মামা, এখন আপনি দল পালটাবেন না। তবে আপনার কাছে আমার একটিমাত্র চাওয়া।’ বলে চুপ করে গেল যুধিষ্ঠির। 

‘বলো, কী সেটা?’ স্নেহার্দ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল শল্য। 

যুধিষ্ঠির বলল, ‘কর্ণের সঙ্গে যখন আমাদের যুদ্ধ হবে, তখন আপনি তার সারথি হবেন এবং যুদ্ধকালে নানা কথা বলে তার মনের জোরটা নষ্ট করে দেবেন।’ 

‘ঠিক আছে। তাই করব আমি। তোমাকে কথা দিলাম ভাগনে।’ বলল মদ্ররাজ শল্য। 

এরপর আরও এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল যুধিষ্ঠির। কুরুসৈন্যদের সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল, ‘তোমাদের মধ্যে যেসব সৈন্য কুরুপক্ষ ত্যাগ করে পাণ্ডবশিবিরে যোগদান করতে চাও, তাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি। তোমরা আমার পিছু পিছু এসো। তোমাদের জন্য পাণ্ডবশিবিরে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা অপেক্ষা করছে।’ 

বিমূঢ় দুর্যোধন। তার কথাবলার শক্তি কোথায় উবে গেছে! কী করবে, কী বলবে দিশা পাচ্ছে না সে! 

যুধিষ্ঠিরের এই আহ্বানে কাজ হলো। দুর্যোধনের সর্বকনিষ্ঠ ভাই যুযুৎসু সসৈন্যে কুরুপক্ষ ত্যাগ করে গেল। 

দুর্যোধন ভাবছে—এ কোন যুধিষ্ঠির? এতদিন লাজুক, নির্ভেজাল, ভীরু, নীতিবান যে যুধিষ্ঠিরকে দেখে এসেছি, এ তো সেই যুধিষ্ঠির নয়! এ তো প্রতারক, ধাপ্পাবাজ এক কূটকুশলী যুধিষ্ঠির! ভক্তির মুখোশ পরে ভীষ্ম দ্রোণ-কৃপের মন গলাল! শল্যের অপরাধবোধ বাড়িয়ে গেল! পরোক্ষভাবে এঁদের নিজের দলেই তো টেনে নিয়ে গেল প্রবঞ্চকটা! ভাইটিকে পর্যন্ত সঙ্গে করে নিয়ে গেল ওই ভণ্ড ধর্মানুরাগীটা! 

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া দুর্যোধনের সেই মুহূর্তে আর কিছুই করার থাকল না। 

এদিকে যুধিষ্ঠির নিজ শিবিরে ফিরতে না ফিরতে কৃষ্ণ আরেক ঘটনার অবতারণা করে বসল। 

যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত দুর্যোধনপক্ষ। সারি করে দাঁড়িয়েছেন দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, দুঃশাসন, মদ্ররাজ শল্য, অশ্বত্থামা, দুর্যোধনের অন্য ভাইয়েরা। তাঁদের পেছনে শতসহস্র সশস্ত্র সৈন্য-রথারোহী, অশ্বারোহী, গজারোহী এবং পদাতিক। সবার আগে রণসাজে সজ্জিত রথারোহী ভীষ্ম। সৈন্যদের গর্জন, তুরি, ভেরি ইত্যাদি রণবাদ্যের ধ্বনি, হস্তির বৃংহণ ও ঘোড়ার ডাকে চারদিক কল্লোলিত। 

ঠিক এই সময় কৃষ্ণ রথ চালিয়ে কুরুপক্ষের সামনে অর্জুনকে নিয়ে এলো। অর্জুন তাকিয়ে দেখল—তার সামনে মরণপণ যুদ্ধ করার জন্য যাঁরা সশস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁরা সবাই তার জ্ঞাতি। কেউ পিতামহ, কেউ শিক্ষাগুরু, কেউ খেলার সাথি, কেউ ভাই, কেউ মামা, কেউ চেনাজানা বন্ধু-সুহৃদ। 

অর্জুনের বুকের তলায় প্রচণ্ড এক আলোড়ন উঠল। হঠাৎ করে তার বুকটা ভেঙে চুরমার হতে শুরু করল। উন্মাদ উন্মাদ মনে হতে লাগল নিজেকে। কাদের হত্যা করতে এখানে উপস্থিত হয়েছে সে? এঁরা কারা? এঁরা তো তারই জ্ঞাতিস্বজন! শৈশবের সঙ্গী! খুড়ো! মামা-জেঠা-মেসো-পিসা! এঁদেরকেই হত্যা করবে সে! কেন হত্যা করবে? রাজ্যের জন্য? রাজ্য কী? সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলো নিয়েই তো রাজ্য! রাজ্য মানে তো একখণ্ড ভূমি নয় শুধু! গাছপালা-নদী-ঝরনাও নয়! এঁদের যদি আমি হত্যা করি, তা হলে রাজ্যে আর রইল কী? পোড়ামাটি ছাড়া আর কিছুই তো নয়! আত্মীয়হীন, প্রজাবিহীন, জনসাধারণশূন্য হস্তিনাপুর নিয়ে যুধিষ্ঠির কী করবে? ভালোবাসবার জন্য যদি কোনো জ্ঞাতি না থাকে, শাসন করবার জন্য যদি কোনো প্রজা না থাকে, তা হলে সেই রাজ্যের মূল্য কী? 

আর পাপ? এত এত ঘনিষ্ঠজনকে হত্যা করার জন্য যে পাপ হবে, তার থেকে মুক্তির জন্য তো কোনো পথ খোলা নেই তার সামনে! নির্ঘাত রৌরব নরকে নিক্ষেপিত হবে সে! কার জন্য, কীসের লোভে এত বড় পাপ করতে উদ্যত হয়েছে সে? ভাবতে ভাবতে মাথায় ঘূর্ণি উঠল অর্জুনের। 

নিজের অজান্তে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘না না! এই যুদ্ধ আমি করব না। জ্ঞাতি-আত্মীয় হত্যার এই যজ্ঞে আমি কিছুতেই অংশ নেব না, নেব না।’ বলতে বলতে গাণ্ডীব ত্যাগ করে রথের মধ্যে বসে পড়ল অর্জুন। 

অর্জুনের হঠাৎ ভাবান্তর দেখে একেবারেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল কৃষ্ণ। কৃষ্ণ বিচক্ষণ এবং কূটনীতিক। দক্ষ কূটনীতিকের মতো নিজেকে সামলে নিল কৃষ্ণ। 

বোকা বোকা চেহারা করে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে পার্থ? হঠাৎ তোমার এ রূপান্তর কেন?’

অর্জুন কুরুপক্ষের স্বজনদের নির্দেশ করে কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আমি বিজয় চাই না কৃষ্ণ। যাঁদের হত্যা করবার জন্য তুমি আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছ, তাকিয়ে দেখ তাঁরা কারা? আমার সামনে কাদের দেখছি আমি! পিতা-পিতামহস্থানীয় গুরুজন, আচার্য, মাতুল, শ্বশুর, ভ্রাতা, পুত্র এবং সুহৃদ্‌গণ। এঁদের বক্ষ লক্ষ করে তির ছুড়ব আমি? এঁদের ঘাড় লক্ষ করে অসি চালাব! না না, আমি যুদ্ধ করব না কৃষ্ণ। রথ ঘোরাও তুমি।’ 

কৃষ্ণ বলল, ‘এই সংকটকালে তুমি ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ো না পার্থ। আত্মীয়তার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছ তুমি। নপুংসকের মতো কথা বলো না।’ 

কৃষ্ণের কথায় অর্জুনের কোনো ভাবান্তর হলো না। শোকাচ্ছন্ন হয়ে রথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকল অৰ্জুন। 

কৃষ্ণ দেখল—তার পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে। কুরুবংশ ধ্বংস করে যুধিষ্ঠিরের মাধ্যমে যে ব্রাহ্মণ্যশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মাঠে নেমেছে কৃষ্ণ, তা বুঝি আর পূরণ হলো না! কৃষ্ণ অস্ত্র বের করল, কথার অস্ত্র। কথার মায়াজাল বিস্তার করে অল্পসময়ের মধ্যে অর্জুনের সামনে এক কুহক তৈরি করে ফেলল কৃষ্ণ। কথার করণকৌশলে অর্জুন সেই মায়ায় বিভোর হলো। পুরোপুরি সম্মোহিত হয়ে গেল অর্জুন। এখন কৃষ্ণ যা বলছে, তা-ই দেখছে বলে মনে হতে লাগল অর্জুনের। 

অদ্ভুত এক মায়াময় কণ্ঠে কৃষ্ণ বলছে, ‘দেখো পার্থ, তোমার সামনে তাকিয়ে দেখো। যাঁদের তুমি এখন জীবন্ত দেখছ, তাঁরা আসলেই মৃত। ওই দেখো, পিতামহ ভীষ্মের মৃতদেহ দেখ, দ্রোণাচার্যকে দেখো, শল্যকে দেখো, হাজার লক্ষ সৈন্যকে দেখো, সবাই মৃত। কী দেখছ তুমি? মাটিতে পড়ে-থাকা অগণন লাশ দেখছ না? তুমি মারার আগেই আমি তাঁদের হত্যা করে রেখে দিয়েছি। তোমার এই যুদ্ধ নিমিত্তমাত্র। তুমি যুদ্ধ না করলেও এঁরা মারা যাবেন।’ 

সেই বিভ্রম অবস্থাতেই অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ‘কে তুমি? তুমি কি দেবেশ?’ 

ঘোরলাগা কণ্ঠে কৃষ্ণ বলল, ‘আমি লোকক্ষয়কারী শমন। এখানে যারা সমবেত হয়েছে, তারা মরবেই মরবে পার্থ। তুমি উছিলামাত্র। ওঠো অর্জুন, ওঠো। গাণ্ডীব হাতে তুলে নাও। যশোলাভ করো। শত্রুজয় করে সমৃদ্ধ হস্তিনাপুর ভোগ করো।’ 

এই সময় পাণ্ডবশিবিরে উল্লাসধ্বনি উঠল। 

যুযুৎসুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এই আনন্দধ্বনি। 

অর্জুন আবেগ-বিচ্ছিন্ন হলো। গাণ্ডিবের দিকে হাত বাড়াল সে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *