দুর্যোধন – ৫০

পঞ্চাশ 

দিনকয়েক পরে বিশেষ একটি মন্ত্রণাসভায় বসল ধৃতরাষ্ট্র। বসল মানে কুরুকুলের বৃদ্ধদের চাপে বসতে বাধ্য হলো। 

এই মন্ত্রণাসভায় পিতামহ ভীষ্ম আছেন, আছেন দ্রোণাচার্য-কৃপাচার্য। বিদুরকেও আমন্ত্রণ না জানিয়ে পারল না মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। বিদুর যে রাজসভায় ভীষ্ম-দ্রোণাদির সমতুল্য! এবং মহামন্ত্রী! 

পিতামহই প্রথমে কথাটা তুললেন। দুর্যোধনকেই লক্ষ করে ভীষ্ম বললেন, ‘যেদিন থেকে শুনছি, পাণ্ডবরা জতুগৃহের আগুনে মারা গেছে, সেদিন থেকে দুর্যোধন তোমার দিকে তাকাতে পারছি না আমি। এখন যদি তুমি পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে আসতে বাধা দাও, তা হলে লোকে মৃত পুরোচনকে দুষবে না, সরাসরি দুষবে তোমাকে। তাই বলছি, পাণ্ডুপুত্রদের হস্তিনাপুরে আহ্বান করে নিয়ে এসো। 

পিতামহের কথা শুনে দুর্যোধন ফুঁসতে লাগল। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘কাকা পাণ্ডু বাবাকে সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করেছে। বিদুর কাকার প্ররোচনায় আমাকে যুবরাজ করেননি আপনারা। আর এখন বলছেন, পাণ্ডবদের আহ্বান করে এখানে নিয়ে আসতে! একে খাল কেটে কুমির আনা বলে না? ঘরের শত্রু বিভীষণ আরও কত হিংস্র হয়ে উঠবে, ভেবে দেখেছেন পিতামহ?’ শেষের বাক্যটি বিদুরের দিকে তাকিয়েই শেষ করল দুর্যোধন। 

ভীষ্ম শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘পাণ্ডবদের সঙ্গে নতুন করে কোনো বিরোধে জড়াও, চাই না আমি। তোমার বাবা কুরুরাজা হলেও বর্তমানে তুমিই ধর্মত রাজ্যলাভ করেছ। পাণ্ডবরাও ইতোপূর্বে রাজ্যাধিকার পেয়েছিল, নইলে যুধিষ্ঠির যুবরাজ হলো কী করে? অতএব বিবাদে প্রয়োজন নেই দুর্যোধন। সৌহার্দ্য দেখিয়ে তাদের হস্তিনাপুরে ডেকে আন।’ 

এরপর ধৃতরাষ্ট্রের দিকে ঘাড় ফেরালেন পিতামহ। কোমল কণ্ঠে বললেন, ‘দুর্যোধনের কথায় না চলে নিজের বুদ্ধিতে চলো ধৃতরাষ্ট্র। আমার কথা মান— পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে ফিরিয়ে এনে অর্ধেক রাজ্য ওদের দিয়ে দাও। তাতেই কুরুরাজ্য জুড়ে শান্তি বিরাজ করবে।’ 

ক্ষিপ্ত হয়ে দুর্যোধন কী একটা বলতে চাইল। বিদুর কুঁজো হয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘মহারাজ, পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে রণে পরাজিত করতে পারে, এমন যোদ্ধা পৃথিবীতে জন্মায়নি এখনো।’

‘তুমি চুপ কর কাকা। বাবাকে মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছ কেন? তুমি কি কর্ণের তেজোবীর্যকে ভুলে গেলে? বন্ধুবর কর্ণের কথা বাদ দাও, যুধিষ্ঠির এক ঘণ্টাও তো দাঁড়াতে পারবে না আমার সামনে! সে একজন অতিক্ষুদ্র যোদ্ধা। সেই ক্ষুদ্রমতি যুধিষ্ঠিরের ভয় দেখাচ্ছ পিতাশ্রীকে?’ গর্জে উঠল দুর্যোধন। 

দুর্যোধনের কটু কথা গায়ে মাখল না বিদুর। বলল, ‘আপনাদের বিরুদ্ধে অকীর্তি ধ্বনিত হচ্ছে চারদিকে। পাণ্ডবদের ওপর অবিচারের অকীর্তি। এখন সময় এসেছে সেই অকীর্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার। আপনি পিতামহ ভীষ্মের কথা শুনুন। দুর্যোধনের কথা শুনবেন না মহারাজ। শুনলে ও এই কুরুরাজ্যকে রসাতলে নিয়ে যাবে।’ 

ধৃতরাষ্ট্র কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গালে হাত দিয়ে সিংহাসনে বসে রইল। পিতামহ ভীষ্ম আর বিদুরের কথা শুনবে, না দুর্যোধনের কথা মানবে—এই দোটানা চলতে লাগল মহারাজার মনে। 

ওই সময় দ্রোণাচার্য বলে উঠলেন, ‘পিতামহের সিদ্ধান্তই আমার অভিমত। আমারও কথা এই যে, বিরোধে না জড়িয়ে পাণ্ডবদের এখানে নিয়ে আসুন মহারাজ। ওদের হাতে অর্ধেক রাজ্য দিয়ে দিন।’ 

শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো- পাণ্ডুপুত্রদের ফিরিয়ে এনে অর্ধেক কুরুরাজ্যের রাজত্ব ওদের হাতে তুলে দেবে ধৃতরাষ্ট্র। 

কুরুরাজসভায় সব কিছুর আলোচনা হলো, আলোচনা হলো না শুধু একটি বিষয় নিয়ে। এক কন্যার একই সময়ে পাঁচটি স্বামী হয় কী করে? তাদের বিয়েটা সঙ্গত হয়েছে কিনা? এত যে স্পষ্টভাষী ভীষ্ম, তিনিও কেন জানি এই প্রসঙ্গে নিশ্চুপ থাকলেন! 

ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে উদ্দেশ করে বলল, ‘তা হলে ঠিক আছে বিদুর। তোমাদের কথাই রাখব আমি। তুমিই যাও পাঞ্চালরাজ্যে, আমার প্রতিনিধি হয়েই যাও তুমি। কুন্তী আর দ্রৌপদীসহ পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে নিয়ে এসো তুমি।’ 

বিদুর খুশিতে আত্মহারা হলো। আজকে তার আনন্দের অবধি নেই। একদিন চক্রান্ত করে যে পাণ্ডবদের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটিয়েছিল দুর্যোধন, আজকে সেই দুর্যোধনের সামনেই ধৃতরাষ্ট্র বলল, বিদুর, পাণ্ডুপুত্রদের হস্তিনাপুরে নিয়ে এসো তুমি। আমার কত বড় জয় হলো ভেবে দেখেছিস পাপাত্মা দুর্যোধন? আমাকে এই রাজসভায়, এই কুরুরাজপ্রাসাদে কোণঠাসা করে রেখেছিলি না, পাণ্ডবরা এই হস্তিনাপুরে এসে নিক, তারপর তোকে বোঝাব কোণঠাসা কাকে বলে। 

ক্ষিপ্ত চোখে দুর্যোধনের দিকে তাকিয়ে এ রকম করে ভেবে গেল বিদুর। তারপর ভাবল, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কথায় প্রথমেই রাজি হওয়া কি ঠিক হবে? না একটু টালবাহানা করা দরকার? গড়িমসি করলেই তো বোধহয় ভালো হবে! রাজসভায় গুরুত্ব বাড়বে। বিদুর তৎক্ষণাৎ আবার ভাবল, না না, মহারাজের কথায় এত দোনোমনা দেখানো ঠিক হবে না। তার ইতস্তততা দেখে মহারাজ যদি মত পালটে ফেলেন? যদি অন্য কাউকে দায়িত্ব দিয়ে বসেন? তা হলে যে তার সর্বনাশ হয়ে যাবে! পাণ্ডুপুত্রদের কাছে তার যে গুরুত্ব কমে যাবে! এখন হলে বলতে পারবে, দেখ দেখ বাছারা, আমার বুদ্ধিতে চলার কারণে প্রাণে তো বেঁচে গেছই তোমরা, উপরন্তু রাজকন্যাকে হাতে পেয়েছ। শুধু তো তা-ই নয়, ধৃতরাষ্ট্রকে বাধ্য করিয়েছি তোমাদের হস্তিনায় ফিরিয়ে নিতে। এই দেখ আমি এসেছি, তোমাদের নিয়ে যেতে। শুধু বৌঠান আর তোমরা নও, দ্রুপদকন্যা দ্রৌপদীও আমার সঙ্গে সসম্মানে যাবে। 

যেমন চিন্তা তেমন কাজ। বিদুর সাগ্রহে বলল, ‘ঠিক আছে মহারাজ, আগামীকালই আমি পাঞ্চালনগরীর উদ্দেশে যাত্রা করব।’ 

পরদিন ধৃতরাষ্ট্রের আদেশক্রমে নানাবিধ রত্ন ধনসম্পত্তি নিয়ে বিদুর দ্রুপদরাজ্যে উপস্থিত হলো। রাজা দ্রুপদ আর পাণ্ডবরা তাকে দেখে খুবই আহ্লাদিত হলো। দ্রুপদ বিদুরকে সাদর সম্ভাষণে অভ্যর্থনা জানাল। বিদুর পাণ্ডবদের স্নেহভরে আলিঙ্গন করল। যুধিষ্ঠিরকে বেশিক্ষণই বুকের কাছে ধরে রাখল বিদুর। বৌঠান কুন্তীর দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর দ্রুপদ রাজার কাছে তার আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল। 

আবেগভরে বিদুর বলল, ‘আমি পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে নিয়ে যেতে এসেছি। আপনার কন্যারত্নটিও আমার সঙ্গে যাবে। সালঙ্কারা হয়ে সসম্মানে শ্বশুরবাড়িতে যাবে দ্রৌপদী।’ 

রাজা দ্রুপদ আমতা আমতা করে বলল, ‘কিন্তু মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র? দুর্যোধন? হস্তিনাপুরের পরিস্থিতি…?’ জ্ঞাতিশত্রুতার কথা ইতোমধ্যে রাজা দ্রুপদ পাণ্ডবদের কাছ থেকে জেনে ফেলেছে। 

বিদুর দ্রুত বলে উঠল, ‘পরিস্থিতি একেবারে অনুকূলে। আর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কথা বলছেন? তিনিই তো পাঠালেন আমাকে আপনার কাছে। 

পাশে দাঁড়ানো যুধিষ্ঠির বলল, ‘আর দুর্যোধন?’ 

‘আরে, রাখো তো বাছা দুর্যোধনের কথা! জোঁকের মুখে নুন পড়লে যা হয়, দুর্যোধনের অবস্থাও সেরকম। সে এখন সকলের চাপে জড়সড়।’ 

তারপর পাঁচ ভাইয়ের মুখের ওপর চোখ রাখল বিদুর। গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, ‘হস্তিনাপুরে তোমাদের জন্য চরম এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে।’

‘কী সেই বিস্ময়, বলো না কাকা।’ ভীম বলল। 

হাবেভাবে পূর্বের মতো গাম্ভীর্য বজায় রেখে বিদুর বলল, ‘তা এখন বলা যাবে না। গেলেই দেখতে পাবে।’ 

এই সময় দ্রুপদ বলে উঠল, ‘কৌরবদের সঙ্গে বিবাহসম্বন্ধ স্থাপিত হওয়ায় আমি যথেষ্ট তৃপ্তি পাচ্ছি। পাণ্ডবদের আপনার সঙ্গে যাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আমার কন্যা কৃষ্ণার হস্তিনাপুর যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’ পাশে দাঁড়ানো পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নের দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করল রাজা দ্রুপদ। 

রাজজ্যোতিষী তিথি নক্ষত্র বিবেচনা করে যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক করে দিল। 

নির্ধারিত দিনে মনোরমভাবে সজ্জিত রথে চড়ে সবাই হস্তিনাপুরের উদ্দেশে রওনা দিল।

বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে অসংখ্য রথের সমাহারে রাজা দ্রুপদ কন্যা আর জামাতাদের রাজ্যের সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিল। 

কুরুসীমান্তে কৌরববাহিনী পাণ্ডুপুত্রদের স্বাগত জানাল। 

এরপর রাজধানী হস্তিনাপুর পৌঁছাতে পাণ্ডবদের অল্পই সময় লাগল। 

একান্ন 

কুরুরাজসভা তখন গমগম করছে। 

ভীষ্ম-দ্রোণ থেকে আরম্ভ করে দুর্যোধন দুঃশাসন-কর্ণ, মন্ত্রীবর্গ এবং অন্যান্য রাজন্য—সবাই উপস্থিত। দুর্যোধনের কাছাকাছি আসনে বসেছে মাতুল শকুনি। গান্ধারীর সহোদর শকুনি হস্তিনাপুরে এসেছে বহুদিন হয়ে গেল। ভাগনে দুর্যোধনের প্রধান পরামর্শকদের একজন হয়ে উঠেছে ইদানীং। 

হঠাৎ বাইরে শঙ্খধ্বনি হলো। সঙ্গে বাদ্যবাজনা। বাজনায় স্বাগত জানানোর সুর। সবাই বুঝে গেল—পাণ্ডবরা এসে গেছে। সবাই গা-ঝাড়া দিলেন। ভীষ্ম শিরদাঁড়া সোজা করলেন, দ্রোণাচার্য শাশ্রুতে হাত বোলালেন। 

শকুনি নিষ্পলক চোখে দ্বারের দিকে তাকিয়ে থাকল। সবার চোখ উন্মীলিত। কারও চোখে কৌতুক, কারও চোখে আনন্দ-আগ্রহ, কারও চোখে নিস্পৃহতা। একজন শুধু চোখ বুজে আছে, সে দুর্যোধন। সেই নিমীলিত চোখে ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংস্রতা, অসহিষ্ণুতা মিলেমিশে একাকার। 

বিদুর সপাণ্ডব রাজসভায় প্রবেশ করল। পাণ্ডবরা গুরুজনদের পাদবন্দনা করল। দ্রৌপদী মাননীয় সভাজনদের উদ্দেশে প্রণতি জানাল। পিতামহ ভীষ্ম দু-হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন। অন্ধ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র দু-হাত বাড়িয়ে দ্রৌপদীকে নিকটে যাওয়ার আহ্বান জানাল। দ্রৌপদী কাছে গেলে আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখা প্রচুর মণিমুক্তা অলঙ্কার দ্রৌপদীকে উপহার দিল। সভাজুড়ে হর্ষধ্বনি উঠল। বিদুরের কণ্ঠধ্বনি সবাইকে ছাড়িয়ে গেল। 

দুর্যোধন চোখ খুলল। প্রথমেই তাকাল বিদুরের দিকে। কী নিষ্ঠুর কৌতুক বিদুরের চোখে! তারপর তাকাল পিতামহ ভীষ্মের মুখের দিকে। সেই মুখে আনন্দ আর তৃপ্তির মাখামাখি। ধৃতরাষ্ট্রের নয়ন নেই বলে পিতার মনোভাব বুঝতে পারল না দুর্যোধন। অন্য সবার চোখমুখ সাধারণ আনন্দ প্রকাশের আভায় উদ্ভাসিত। এরপর দুর্যোধন তাকাল দ্রৌপদীর দিকে। নাহ্, দ্রৌপদীকে দেখে তার মনে বিন্দুমাত্র লালসা জাগল না। তার চোখে দ্রৌপদীকে সাধারণ একজন নারী ছাড়া আর কিছুই মনে হলো না। আর্য নারীদের মতো গৌরবর্ণা নয় সে। বরং তাদের তুলনায় দ্রৌপদীর গায়ের রং বেশ কালো। হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে কৃষ্ণাঙ্গী দ্রৌপদীকে বেমানান বলেই মনে হলো দুর্যোধনের। হ্যাঁ, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ওই কৃষ্ণ অঙ্গের মধ্যে অসাধারণ এক রূপময়তা ঝকমক করছে। তাতে কী? দুর্যোধন এবার একে একে পাঁচ পাণ্ডবের মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিল। শেষপর্যন্ত অর্জুনের মুখের ওপর দৃষ্টি স্থির হলো দুর্যোধনের। দুর্যোধনের মুখ দিয়ে অস্ফুট বেরিয়ে এলো, ‘বেচারা হতভাগা।’ 

খিলখিলে হাসি হেসে উঠতে গিয়ে নিজের হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরল শকুনি। ভাগনে দুর্যোধনের কথা তার কান এড়ায়নি। 

এই সময় পিতাশ্রী ধৃতরাষ্ট্রের কণ্ঠস্বর দুর্যোধনের কানে এলো। মহারাজ বলল, ‘ঠিক আছে বাছারা। অনেক দূর থেকে এসেছ তোমরা। পথশ্রমে ক্লান্ত তোমরা। এখন তোমাদের বিশ্রামের প্রয়োজন। স্নানাদি শেষ করে আহার গ্রহণ করো। তারপর বিশ্রামে যাও। তোমাদের সঙ্গে এখন আমার আর কোনো কথা নেই।’ 

‘আমার আছে।’ কর্কশ কণ্ঠে বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল দুর্যোধন। 

সবাই সচকিত হয়ে দুর্যোধনের মুখের দিকে তাকাল। বিদুর দ্রুত ভেবে নিল—এই পাষণ্ডটা কী জানি আবার কী ঘোঁট পাকায়! সবার চোখেমুখে জিজ্ঞাসা। 

ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘ঠিক আছে সুযোধন, তোমার যদি কিছু বলার থাকে, তা কাল বলো। কাল তো রাজসভা আবার বসছে!’ 

‘না পিতাশ্রী। কথা আমাকে আজকেই বলতে হবে। যা বলতে চাইছি, আজ না বললে আগামীকাল তা গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে।’ 

ভীষ্ম বললেন, ‘প্রয়োজনীয় এবং মূল্যবান কথা কখনো গুরুত্ব হারায় না বস।’ 

‘হারায় পিতামহ। কিছু মানুষের ষড়যন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ কথা গুরুত্ব হারিয়ে বসে। তাই আজকের কথাটি আমাকে আজকেই বলতে হবে। বিদুরের চোখে চোখ রেখে বলল দুর্যোধন। 

ভীষ্ম এবার কণ্ঠস্বরে রূঢ়তা ঢেলে বললেন, ‘বলো, কী বলতে চাইছ তুমি। পথশ্রমে ক্লান্ত ওরা। সংক্ষেপে বলবে।’ 

দুর্যোধনের সারা মুখে হিংস্র হাসি ছড়িয়ে পড়ল। পিতামহকে উদ্দেশ করে বলল, ‘প্রশ্নটা আপনাকে পিতামহ, বিয়েটা কী বৈধ?’ 

‘বিয়ে! কার বিয়ে? কোন বিয়ের কথা বলছ তুমি দুর্যোধন?’ বললেন ভীষ্ম 

‘কার নয়, বলুন—কাদের বিয়ে।’ 

বয়স হয়ে গেছে পিতামহের। দুর্যোধনের কথাটি তাই বুঝতে পারছেন না। চুপ করে থাকলেন পিতামহ। 

দুর্যোধন হিংসানো গলায় বলল, ‘আমার কথা আপনি ধরতে পারছেন না তাই তো?’ 

‘না। সত্যিই তোমার কথার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না আমি।’ 

দুর্যোধন বলল, ‘আচ্ছা পিতামহ, একজন পুরুষ একই সময়ে অনেক নারীকে বিয়ে করতে পারে, শাস্ত্রই বলছে তা। কিন্তু একজন নারী কি একই সময়ে অনেকগুলো পুরুষকে স্বামী বলে গ্রহণ করতে পারে?’ 

এবার ধরতে পারলেন পিতামহ, দুর্যোধনের কথার ইঙ্গিতটা। এমন প্রশ্নের জন্য মোটেই প্ৰস্তুত ছিলেন না তিনি। তাই তৎক্ষণাৎ উত্তরটা তাঁর মুখে এলো না। 

পিতামহের বিপন্নতা বিদুর বুঝতে পারল। চট করে উঠে দাঁড়াল। 

বিদুরকে উঠে দাঁড়াতে দেখে খেপা কণ্ঠে দুর্যোধন বলে উঠল, ‘তুমি উঠে দাঁড়িয়েছ কেন ক্ষত্তা? প্রশ্নটা তো তোমাকে করিনি আমি! বসো তুমি।’ 

তারপর ভীষ্মকে লক্ষ করে বলল, ‘প্রশ্নটা আপনাকে করেছি পিতামহ। পাণ্ডবদের এই বিয়ে কি সঙ্গত হয়েছে? দ্রৌপদী গলায় মালা দিল অর্জুনের, লুঠের মালের মতো দ্রৌপদীকে ভাগাভাগি করে নিল পাঁচজনে! এ কেমন বিয়ে পিতামহ! একে কি বিয়ে বলে? নাকি একজন নারীকে কাড়াকাড়ি করে ভোগ করা বলে?’ 

এবার বিদুর বলে উঠল, ‘এ রকম রীতি আর্যসমাজে আছে। ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে তার।’

কান ফাটানো হাসিতে ফেটে পড়ল দুর্যোধন। হাসি থামিয়ে বলল, ‘চুপ করো, চুপ করো ক্ষত্তা। জোরগলায় বলছ বটে উদাহরণ আছে, কিন্তু প্রমাণ দিতে পারবে না তুমি।’ 

দুর্যোধনের কথা শুনে চুপসে গেল বিদুর। ভেবেছিল, গলাবাজি দেখালে থেমে যাবে দুর্যোধন। কিন্তু কার্যত তা হলো না। 

দুর্যোধন ভীষ্মকে উদ্দেশ করে বলল, ‘ওই লোভী ক্ষত্তা বিদুর মেনে নিতে পারে এই অবৈধ বিয়েটি, আপনি মেনে নিলেন কেন? আপনি তো কাউকে ভয় পান না পিতামহ। আপনি তো সেই পিতামহই, যিনি পাণ্ডু কাকাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করিয়েছিলেন?’ 

একেবারেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন ভীষ্ম। গোটা রাজসভা নিস্তব্ধ। ভীম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে চাইলে যুধিষ্ঠির চোখ-ইশারায় তাকে চুপ থাকতে নির্দেশ দিল। 

দুর্যোধন বলে যেতে লাগল, ‘একদিন কুন্তীভোজের কন্যা কুন্তীকে স্বয়ংবরসভা থেকে জিতে এনেছিলেন পাণ্ডু কাকা। কুন্তীর মাল্য গলায় পরেই বিবাহিত হয়েছিলেন দুজনে। কিন্তু পিতামহ, আপনি সেই বিয়ে মেনে নেননি। এমনকি কুন্তীকেও তেমন করে গ্রহণ করেননি আপনি। দ্বিতীয়বার বিয়ে করিয়েছিলেন পাণ্ডু কাকাকে। রাজা শল্যের ভগিনী মাদ্রীকে বিয়ে করিয়েছিলেন পুনরায়। আপনার বিবেচনায় মাল্যদানের বিয়েটি অবৈধ এবং অন্যায্য। তাই তো পিতামহ? আজ সেই পিতামহ পাণ্ডুপুত্রদের মাল্যদানের বিয়েটি অবলীলায় মেনে নিলেন! তাও না হয় মেনে নিলাম, কিন্তু স্বামীর দাবিদার হয়ে এক নারীকে পাঁচ ভাই মিলে ভোগ করার ব্যাপারটিও মেনে নিলেন আপনি? 

‘চুপ করো দুর্যোধন, চুপ করো। আমি আর সইতে পারছি না। আমাকে ক্ষমা করো তুমি।’ বলতে বলতে পিতামহ চোখ বন্ধ করলেন। 

এবার সভাজনদের দিকে মুখ ফেরাল দুর্যোধন, ‘ওই যে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকা দ্রৌপদী নামের নারীটির দিকে তাকান আপনারা। শুধু আপনারা কেন, ওই যুধিষ্ঠিররা, ওই রাজা দ্রুপদ এবং তার পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন কি একবারের জন্যও ভেবেছে ওই নারীটির অন্তর্জালার কথা! ও তো অর্জুনকেই পছন্দ করে স্বামী হিসেবে গলায় মালা পরিয়েছে! কিন্তু যুধিষ্ঠিরের লোভ আর কুন্তী কাকির কূটবুদ্ধি ওই দ্রৌপদীকে শুধু একজনের সঙ্গে ঘর করতে দিল না। বহুভোগ্যা হয়ে গেল সে। এটা কি সমাজবিরোধী নয়? বলুন আপনারা। দুরাচারী ক্ষত্তা বিদুর, তুমিই বা কী বলো!’ 

ধৃতরাষ্ট্র আর্তনাদ করে উঠল, ‘থামো দুর্যোধন, এবার তুমি থামো। অন্তত আমার দিকে তাকিয়ে তুমি চুপ করো সুযোধন। 

দুর্যোধন বলল, ‘ছিঃ!’ 

এই শব্দটি কাকে লক্ষ করে বলল দুর্যোধন, বোঝা গেল না। 

বায়ান্ন 

রাত গভীর। সবাই নিদ্রায় আচ্ছন্ন। ঘুম নেই শুধু দ্রৌপদীর চোখে। 

দুগ্ধফেননিভ শয্যায় যুধিষ্ঠির ঘুমে অচেতন। মৃদু আলো কক্ষে। রাজপ্রাসাদের উঁচু এই কক্ষটি থেকে বাইরেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একপা দুইপা করে দ্রৌপদী বাতায়ন পর্যন্ত হেঁটে গেল। বাইরে চোখ রাখল। দেখল গোটা হস্তিনাপুর আলোয় উদ্ভাসিত। নগরজুড়ে উঁচু উঁচু হর্ম্যরাজি, আলোকোজ্জ্বল মন্দিরচূড়া। প্রশস্ত রাজপথ দিগন্তে মিলিয়ে গেছে। এগুলো দেখতে দেখতে দ্রৌপদীর মনে প্রশ্ন জাগল–আমি কে? আমি দ্রুপদরাজকন্যা কৃষ্ণা? ধৃষ্টদ্যুম্নের বোন? আমি পত্নী? কার পত্নী? অর্জুনের? যুধিষ্ঠিরের, না পাঁচ ভাই পাণ্ডবের? আমি কি সতী? সতী তো সে-ই, যে এক-স্বামীতে নিষ্ঠ। সেই অর্থে আমার কি একজন স্বামী? তা তো না! আমার স্বামী তো অনেক! বহুভোগ্যা আমি। বহুভোগ্যারা কি সতী হতে পারে? পছন্দ করে ভালোবেসে গলায় মালা দিয়েছিলাম তো অর্জুনের! কিন্তু সেই অর্জুনকে তো একার করে পেলাম না! হয়ে গেলাম পাঁচ ভাইয়ের রক্ষিতা। রক্ষিতাই তো! রক্ষিতা ছাড়া আমি আর কী? বলো যুধিষ্ঠির, উত্তর দাও— গলা ফাটিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল দ্রৌপদীর। মায়ের কাছে নিয়ে গেলে তুমি আমায়! কৌশলের আশ্রয় নিলে। বললে, ভিক্ষা করে বস্তু এনেছি। মা-টাও তেমন, ছেলের সঙ্গে সঙ্গত করলেন। আসলে যুধিষ্ঠির, আমার প্রতি তোমার লালসা জন্মেছিল। আমাকে দেখেই তুমি ভাবতে শুরু করেছিলে – আহা, লাবণ্যঘেরা দেহটি যদি আমার হতো! যদি এই দেহটির আঁকেবাঁকে হাত বুলাতে পারতাম! হিম্মত ছিল না তোমার, লক্ষ্যবস্তু বিদ্ধ করার। অর্জুনকে পাঠালে। ভাইয়ের জেতা নারীকে অঙ্কশায়িনী করতে দ্বিধা করলে না। তুমি নাকি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির! তোমার নাকি ন্যায় ও সত্যের পথে গমনাগমন। তাহলে ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে কৌশলে কেড়ে নিয়ে নিজের শয্যাসঙ্গিনী বানালে কেন? বিধান দিলে—আগে বড় ভাই, তারপর মধ্যম ভীম। এর পরে অর্জুন, নকুল, সহদেব—এরা। অর্থাৎ অনাঘ্রাতা দেহটি প্রথমে নিজেই ভোগ করবার ব্যবস্থা নিলে যুধিষ্ঠির! একটি বছর তুমি আমার শরীর চাটবে ইচ্ছেমতন। তারপর ছুড়ে দেবে ওই ভীমটার কোলে। ওই মাথামোটাটা একটি বছর ধরে আমার দেহের কী হাল করে ছাড়বে, ভেবে দেখেছ? দু-দুটি বছর তোমাদের দুই ভাইয়ের হাতে মদ্রিত, লাঞ্ছিত, ধর্ষিত হয়ে আমি অর্জুনের কাছে যাওয়ার সুযোগ পাব। সেই অর্জুন কি আমাকে যথাযথ মর্যাদায় গ্রহণ করবে তখন? গ্রহণ করার যোগ্য কি তখন আমি? 

দুর্যোধনকে তোমরা সবাই ঘৃণা করো। আমি তো তাকে ঘৃণা করতে পারছি না যুধিষ্ঠির! ও তো ঠিকই বলেছে—আমাদের ওই বিয়েটা বৈধ হয়নি। বিয়ের নামে প্রহসন করেছ তুমি। এ বিয়ে তো সমাজ মেনে নেয়নি কখনো! তোমরা রাজপুত্র বলে, আমার বাবা দ্রুপদ রাজা বলে মানুষের মুখ বন্ধ থেকেছে। তবে তা তো আপাতত! এমন একটা দিন আসবে এই ভারতবর্ষের লোক চিৎকার করে বলবে— দ্রৌপদী স্বৈরিণী। সে একটা বেশ্যা ছাড়া আর কিছু ছিল না। 

শোনো যুধিষ্ঠির, তুমি আজ ধর্মের আর ন্যায়ের মুখোশ পরে যতই নিজেকে আড়াল করে রাখো না কেন, এমন একদিন আসবে, যেদিন লোকে বলবে, যুধিষ্ঠির একজন ভণ্ড ছাড়া কিছুই নয়। নিজের ছোট ভাইয়ের বউকে ছলনায় নিজের বিছানায় নিয়ে গেছে যে যুধিষ্ঠির, সে পাষণ্ড, দুরাত্মা। 

কখন চোখের জলে দ্রৌপদীর বুক ভেসে গিয়েছিল, টের পায়নি। হঠাৎ বুকটা ভিজা ভিজা লাগায় সংবিতে ফিরল দ্রৌপদী। 

দ্রৌপদী অচিরেই আবার ভাবনায় ডুবে যায়। জননী কুন্তীর কথা শুনে যুধিষ্ঠির বিধান শুনিয়েছিল—আজ থেকে দ্রৌপদী পঞ্চস্বামিত্ব প্রাপ্ত হলো। জ্যেষ্ঠানুক্রমে বছরব্যাপী এক একজনের শয্যাসঙ্গিনী হবে সে। অন্য ভাইয়েরা তখন ভাশুর হবে। স্বামী ছাড়া অন্য কোনো ভাই ভুলক্রমে বা ইচ্ছে করে দ্রৌপদীর কক্ষে প্রবেশ করলে বারো বছরের বনবাসে যেতে হবে সেই ভাইকে। 

সব শুনে বেঁকে বসেছিল দ্রৌপদী। এ কেমনতরো বিধান! ‘মানি না আমি, এই বিধানকে ঘৃণাভরে অগ্রাহ্য করি আমি।’ চিৎকার করে বলে উঠেছিল দ্রৌপদী। 

নিরুপায় পাণ্ডবরা দ্রৌপদীকে নিয়ে পাঞ্চালরাজার কাছে উপস্থিত হয়েছিল। 

রাজা দ্রুপদের মনে তখন ক্ষমতার লোভ, দ্রোণাচার্যের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের বাসনা। এ দুটোর কাছে দ্রুপদের বুদ্ধিবিবেচনা পরাস্ত তখন। তখন তার মনে দ্রৌপদীকে বিকিয়ে হলেও ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ রাজা হওয়ার দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা। তাই কন্যার অনীহাকে পাত্তা দিল না দ্রুপদ। উপরন্তু পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের পক্ষ নিল। 

কন্যাকে উদ্দেশ করে দ্রুপদ বলল, ‘মা কৃষ্ণা, এই ভূ-মণ্ডলে জননীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই। মায়ের আদেশ বেদবাক্য ছাড়া আর কিছুই নয়। তুমি পাণ্ডবমাতা কুন্তীর ইচ্ছাটা মেনে নাও মা। পঞ্চস্বামিত্ব গ্রহণ করো। তাতে তোমার মঙ্গল হবে মা। এতে আমার রাজনৈতিক শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে কৃষ্ণা। 

শেষ কথাটাই পিতার আসল কথা, বুঝতে অসুবিধা হলো না কৃষ্ণার। পিতার কাছে নীতি-নৈতিকতা, নারীদেহের পবিত্রতা—কিছুরই বালাই নেই। তার কাছে ক্ষমতাটাই আসল। 

পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকে দ্রুপদ নানা ছলে-কৌশলে প্রভাবিত করেছিল। ধৃষ্টদ্যুম্ন ও নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল।

দ্রৌপদী বুঝে নিয়েছিল—পিতা আর ভ্রাতার ইচ্ছের বলি হতে হবে তাকে। একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছিল দ্রৌপদী। 

তারপর তো বড় ধুমধাম করে পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে দ্রুপদ নিজ কন্যাটিকে বিয়ে দিয়েছিল। 

পিতা বা ভ্রাতা একটুক্ষণের জন্যও ভাবেনি, দ্রৌপদী এই বিয়েটা সানন্দে মেনে নিয়েছে কিনা, ভাবেনি অনাহত শুদ্ধচরিত্রের দ্রৌপদী পছন্দের একজনের গলায় বরমাল্য পরিয়েও জ্যেষ্ঠভ্রাতার শয্যায় যেতে নিজেকে কলুষিত বা লাঞ্ছিত মনে করছে কিনা? সে তো কোনো পদার্থ নয়! সে তো প্রেম-বাসনায় থরোথরো হৃদয়ের এক তরুণী! অর্জুনকে মাল্য পরিয়ে তাকে কেন জ্যেষ্ঠের বিছানায় যেতে হলো? 

নিঝুম রাতের অন্ধকারে চোখের জলে ভেসে যেতে লাগল দ্রৌপদীর হৃদয়ের সকল স্বপ্নসাধ। পরদিন কুরুরাজসভায় পাঁচ ভাইকে ডেকে পাঠাল মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। সভায় সবাই যার যার আসনে বসে আছে। কিছু উৎসুক মাননীয় নাগরিককেও দেখা যাচ্ছে, যারা নিয়মিত রাজসভায় আসে না। আজকে এসেছে, কারণ তারা জেনে গেছে, কুরুরাজসভায় আজ বিশেষ একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। 

ধৃতরাষ্ট্র নম্র কণ্ঠে যুধিষ্ঠিরকে বলল, ‘বৎস, তুমি আমার ভ্রাতুষ্পুত্র। তুমি তোমার অন্য ভাইদের নিয়ে আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। পুত্র দুর্যোধনের সঙ্গে তোমাদের তেমন সদ্ভাব গড়ে ওঠেনি। তোমরা দুর্যোধনকে শত্রু মনে করো। দুর্যোধনও মনে করে, তার রাজক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করেছ তোমরা। আমার মৃত্যুর পরে এই অনৈক্য আরও প্রবল হয়ে উঠবে। তাই আমি ঠিক করেছি—কুরুরাজ্যের অর্ধেকটা আমি তোমাদের দিয়ে দেব।’ 

সভা থেকে সাধু সাধু ধ্বনি উঠল। হাসিতে বিদুরের চোখমুখ ভরে গেল। দুর্যোধন অস্থির হয়ে উঠল। পিতার কথার প্রতিবাদ করার জন্য উসখুস করতে লাগল। ডান হাত উপরে তুলল রাজা ধৃতরাষ্ট্র। সভা চুপ হয়ে গেল। 

ধৃতরাষ্ট্র আবার বলতে শুরু করল, ‘তোমরা রাজ্যের অর্ধেকাংশ গ্রহণ করো এবং সেখানে রাজধানী স্থাপন করে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে রাজ্যশাসন করো। এতে দুর্যোধনাদির সঙ্গে তোমাদের বিবাদ হওয়ার আর কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না।’ 

বিদুর উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘রাজ্যের কোন কোন অংশ দিচ্ছেন পাণ্ডবদের?’ 

মৃদু একটু হেসে মহারাজ বলল, ‘বিদুর তোমার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে—এই রাজ্য যেন তুমিই পাচ্ছ!’ 

হাস্যগুঞ্জন উঠল সভায়। বিদুর চুপসে গেল। 

ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘তোমরা খাণ্ডবপ্রস্থে গিয়ে বাস করো। ওই অঞ্চলটাই আমি তোমাদের দিলাম। রাজধানী নির্মাণ করো। ভালো থাক।’ 

বিদুর আবার বলে উঠল, ‘ওটা তো অত্যন্ত ঊষর স্থান! মরু অঞ্চল। শস্যসম্পদ কিছুই জন্মে না ওখানে। সেখানে গিয়ে এই অসহায় পাণ্ডবরা কী করবে মহারাজ?’ 

যুধিষ্ঠির উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমাদের ওখানে যেতে কোনো আপত্তি নেই মহামন্ত্রী। আপনি শুধু শুধু ত্রস্ত হচ্ছেন।’ 

তারপর মহারাজার দিকে ফিরে বলল, ‘জ্যেষ্ঠতাত, আপনার নির্দেশ আমরা মাথা পেতে নিচ্ছি অতি অল্পসময়ের মধ্যে আমরা আপনার নির্দেশিত রাজ্যে চলে যাব।’ 

এই প্রথম যুধিষ্ঠির চিরশুভাকাঙ্ক্ষী বিদুরের বিরোধিতা করল। 

তিপ্পান্ন 

বিদুর যতই বলুক না খাণ্ডবপ্রস্থ ঊষর, বাস-অযোগ্য, প্রকৃতপক্ষে খাণ্ডবপ্রস্থের ভূমিরূপ সেরকম নয়। মিথ্যে বলে রাজসভায় একটা বিভ্রান্তি তৈরি করতে চেয়েছে বিদুর। 

আসলে খাণ্ডবপ্রস্থ একটি বনময় প্রান্তর। পরম রমণীয় এই খাণ্ডবপ্রস্থ। এখানে এসে নগরের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে গেল সবাই। কুন্তী-দ্রৌপদীর বাঁধভাঙা আনন্দ। 

খাণ্ডবপ্রস্থ অতি সুরক্ষিত। এর চারদিকে জলপূর্ণ বিশাল পরিখা। গগনস্পর্শী প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। এই নগরী অতিশয় সুশোভিত। পাণ্ডবগণ এই অপূর্ব নগরীটি দেখে অত্যন্ত পুলকিত হয়ে উঠল। 

একদিন কৃষ্ণ এসে উপস্থিত হলো খাণ্ডবপ্রস্থে। সমস্ত কাজকর্ম ফেলে কৃষ্ণ কেন এলো খাণ্ডবপ্রস্থে? কুন্তীপুত্ররা তার পিসতুতো ভাই যে! দ্রুপদকন্যা কৃষ্ণার সঙ্গে তার নিবিড় বন্ধুত্বের বন্ধন যে! 

কৃষ্ণ এলে পাণ্ডবদের মানসিক জোর বেড়ে গেল। কৃষ্ণের সহায়তায় রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ প্রতিষ্ঠা করল তারা। বহু সৌধ-প্রাকার মণ্ডিত করে তুলল ইন্দ্রপ্রস্থকে। 

একদিন কৃষ্ণ আর অর্জুন মিলে খাণ্ডববন দগ্ধ করল। হাজার লক্ষ পশু-পাখি, নিষাদ-সরীসৃপের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পাণ্ডবরা বিশাল প্রান্তর পেল। সেখানে রাজপুরী নির্মাণ করা হলো। 

ময়দানব এলো একদিন ইন্দ্রপ্রস্থে। ময়দানব ভুবনখ্যাত সৌধনির্মাণশিল্পী। খাণ্ডব অরণ্য দহনকালে অর্জুন প্রাণ বাঁচিয়েছিল ময়দানবের। প্রতিদানে ময়দানব ইন্দ্রপ্রস্থের রাজপ্রাসাদে এমন একটি সভাস্থল নির্মাণ করে দিল, যা এই মর্ত্যের কোনো রাজবাড়িতে নেই। 

প্রকৃত অর্থে রাজার সন্তান না হয়েও যুধিষ্ঠির আজ রাজা। বিদুরের বুদ্ধিতে পা ফেলে ফেলে চলে, অর্জুনের বীরত্বে, ভীমের শক্তিতে আজ সে অদ্বিতীয়া রূপবতী পত্নীর পতি হয়েছে। 

কী এক মায়াবলে যুধিষ্ঠির আজ একটি রাজ্যের নরপতি! অথচ এসব কিছুর জন্য তার কোনোই অবদান নেই। দশ আঙুলের একটিকেও নাড়াতে হয়নি তাকে। 

সব কথা দুর্যোধনের কানে গেল। কোনো কিছুকে পাত্তা দিল না সে। ভাবল—ওই গোয়ালাপুত্ৰ কৃষ্ণ আর কতটুকু করতে পারবে! ইন্দ্রপ্রস্থ প্রতিষ্ঠা করেছে, করুক। হস্তিনাপুরের কণা পরিমাণও তো হবে না পাণ্ডুপুত্রদের ওই ইন্দ্রপ্রস্থ! 

যুধিষ্ঠিরের মনে ধৃতরাষ্ট্রের চেয়েও বড় রাজা হওয়ার বাসনা। তার রাজাধিরাজ হওয়া চাই। কিন্তু রাজসূয় যজ্ঞ না করলে যে রাজাধিরাজ হওয়া যায় না! রাজসূয় যজ্ঞ করবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল যুধিষ্ঠির। 

কৃষ্ণ ভেতরে ভেতরে কম্পমান হলো। রাজসূয় যজ্ঞের প্রবল বাধা প্রবল-প্রতাপী জরাসন্ধ। তাকে হত্যা না করে রাজসূয় যজ্ঞ সমাপন সম্ভব নয়। জরাসন্ধ কৃষ্ণের ঘোরতর প্রতিপক্ষ। এই সুযোগে ভীমার্জুনকে দিয়ে শত্রুকে নির্মূল করতে চাইল কৃষ্ণ। কৃষ্ণ পাণ্ডবদের সহায়তায় চিরশত্রু রাজা জরাসন্ধকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল। 

দুর্যোধন জরাসন্ধ-হত্যাকাণ্ডটা দেখে গেল বটে, কিন্তু রাজনৈতিক ধূর্তামিটুকু তার মাথায় ঢুকল না। রাজনীতির মঞ্চে কে কতটা উঁচুতে খেলছে, বুঝল না দুর্যোধন। উপরন্তু রাজসূয় যজ্ঞের সমাপ্তি দিনে যুধিষ্ঠিরের নিমন্ত্রণ পেয়ে দুর্যোধন ইন্দ্রপ্রস্থে গেল। সেখানে যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে নিয়ে আরেক খেলা খেলল। দেশ-বিদেশের রাজাদের দেওয়া উপহারের হিসাব রাখার দায়িত্ব দিল দুর্যোধনকে। কুরুরাজ্যের যুবরাজের জন্য এটা যে কত বড় হীন কাজ, বুঝতে পারল না দুর্যোধন! জতুগৃহে পুড়িয়ে মারতে চাওয়ার অপরাধের সামান্য পরিমাণ শোধ নিল বুঝি যুধিষ্ঠির! 

দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরের কর্মকাণ্ডের অত কিছু তলিয়ে দেখল না। শুধু বিস্ফারিত চোখে পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য দেখে যেতে লাগল। রাজসূয় যজ্ঞে অত বড় কাণ্ডটা যে হয়ে গেল, কৃষ্ণ যে রাজা শিশুপালকে হত্যা করল, তার দিকে কোনো খেয়াল নেই দুর্যোধনের। এ যে দুর্যোধনকে আগামবার্তা দেওয়া—প্রয়োজনে কৃষ্ণপাণ্ডব জোটবদ্ধ হয়ে যে কোনো শক্তিধরকে হত্যা করার ক্ষমতা রাখে, বুঝল না দুর্যোধন। 

তার পর তো ঘটল জলভ্রমের সেই ঘটনাটি। স্ফটিকের উচ্ছ্বাসকে জল বলে ভ্রম করা, হাঁটুর ওপর পর্যন্ত দুর্যোধনের পরিধেয় বস্ত্র তোলা, দ্রৌপদীর হাস্য এবং অপমানজনক মন্তব্য–একের পর এক সবই ঘটে গেল ইন্দ্রপ্রস্থের রাজপ্রাসাদে। শুধু তো তা-ই নয় দ্রৌপদীর অভব্য হাসিতে যোগ দিয়েছিল অর্জুন, নকুল, সহদেব। চাকরবাকরেরাও হেসে উঠেছিল। 

অপমানে মরমে মরে যেতে লাগল দুর্যোধন। 

হস্তিনাপুরে প্রত্যাবর্তনকালে বড়ই বিমর্ষ দেখাল দুর্যোধনকে। রাজপ্রাসাদে ফিরে সবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল। ঈর্ষা আর বেদনা তাকে কুরে কুরে খেতে লাগল। দুর্যোধন ভেবে যেতে লাগল—এত অল্পসময়ের মধ্যে পাণ্ডবদের এত লোকরঞ্জন, এত সমৃদ্ধি, এত মর্যাদা! কী করে সম্ভব হলো এসব? আর ওই যে অপমান! তাকে দিয়ে উপহারের হিসাব রাখানো! জলভ্রমে স্ফটিককক্ষে কাপড় তুলে হাঁটা! হোঁচট খাওয়া! দ্রৌপদীর খিলখিলানো হাসি! একে একে সবই মনে পড়তে লাগল দুর্যোধনের। এক একটা দৃশ্য মনে পড়ে আর মর্মযাতনায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে দুর্যোধন। পরশ্রীকাতরতা আর পাণ্ডবদের তাচ্ছিল্য-উপেক্ষা তাকে প্রায় বোবা করে ছাড়ল। 

শকুনি মামা ভাগনে দুর্যোধনকে বড় ভালোবাসে। তার চিন্তাকুলতা দেখে অস্থির হয়ে ওঠে শকুনি। একদিন ভাগনেকে চেপে ধরল শকুনি। 

জিজ্ঞেস করল, ‘দুর্যোধন, তোমার কী হয়েছে? এ রকম বিষণ্ন দেখাচ্ছে কেন তোমায়?’ 

দুর্যোধন মনের কষ্ট মনে চেপে রাখে। মামার প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না। 

শকুনি নাছোড়। মমতামাখানো কণ্ঠে বলে, ‘কী হলো দুর্যোধন? এত ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলার কী আছে? আমাকে বলোই না কী হয়েছে? মনের কথা আপন মামাকে না বললে কাকে বলবে?’ 

মামার সহানুভূতিতে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না দুর্যোধন। মনের দুঃখকথা গল গল করে বলা শুরু করল। বলল, ‘আমার বুকের তলায় এমন জ্বালা হচ্ছে মামা, বেঁচে থাকতেই ইচ্ছে করছে না আর!’ 

শকুনি বিস্মিত চোখে ভাগনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এ তুমি কী বলছ দুর্যোধন! এ রকম অলক্ষুণে কথা বলছ কেন তুমি?’ 

‘সত্যি বলছি মামা, বেঁচে থাকার আনন্দটাই হারিয়ে ফেলেছি আমি। প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বলছি আমি। সমস্ত দুনিয়া এখন যুধিষ্ঠিরের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। আর ওই যে কৃষ্ণটা, পাণ্ডবদের হাতিয়ার করে হেন পাপ নেই যা করছে না! জরাসন্ধকে মারল, প্রকাশ্য যজ্ঞস্থলে শিশুপালকে হত্যা করল। এ কেমন বিচার মামা? এ পাপের কি কোনো বিচার নেই? এই দুষ্কর্মের কি কোনো শাস্তি হওয়া উচিত নয়? ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে মামা আমার, পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে!’ ব্যক্তিগত ঈর্ষা, ক্রোধ এবং প্রভুত্ব দুর্যোধনকে দিশেহারা করে তুলল। 

শকুনি বলল, ‘ধৈর্য ধরো ভাগনে। অস্থির হয়ো না।’ 

দুর্যোধন বলল, ‘কী করে বলো তুমি মামা আমাকে ধৈর্য ধরতে! সামন্ত রাজারা ধনরত্নের ডালা নিয়ে যুধিষ্ঠিরের প্রাসাদে উপস্থিত হলো! দেখলে না, কীরকম তোষামোদ করে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে কথা বলছে ওরা? এসব দেখেশুনে আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে মামা। ইচ্ছে করছে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মরি, ইচ্ছে করছে বিষ খাই, জলে ডুবে মরি।’ 

শকুনি বুঝল, দুর্যোধন বেশ উতলা হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় তাকে কীভাবে সামাল দেওয়া যায়—উপায় খুঁজে পেল না শকুনি। 

দুর্যোধন আবার বলে উঠল, ‘ওই পাণ্ডুপুত্রদের বিপাকে ফেলবার জন্য আগেও অনেক চেষ্টা করেছি আমি। কিন্তু প্রত্যেকবার কোনো না কোনো উপায়ে পার পেয়ে যায় ওরা। বার বার পাঁক থেকে উঠে আসা পদ্মের মতো জ্বলজ্বল করে পাণ্ডবরা। সত্যি আমি আর সহ্য করতে পারছি না মামা। এই ইন্দ্রপ্রস্থ, তার ঐশ্বর্য, ওই সভাগৃহ, ওই অর্থ, সামরিক শক্তি…উঃ আর ভাবতে পারছি না আমি!’ 

দুর্যোধনের এসব কথা শুনে শকুনি বলল, ‘সবই কপাল ভাগনে, সবই ললাটলিখন। তুমি তো ওদের দমিয়ে রাখার জন্য কম চেষ্টা করোনি! কিন্তু কপাল জোরে ওরা সর্বদা পার পেয়ে গেছে।’ 

এরপর দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে শকুনি আবার বলল, ‘শেষ পর্যন্ত দ্রৌপদীর মতো একটা সুন্দরী বউ পেয়ে গেল পাণ্ডুপুত্ররা, দ্রুপদের মতো মহাশক্তিধর একজন শ্বশুরও পেল। শুধু তো তা-ই নয়, দোসর হিসেবে কৃষ্ণকেও পেল। এমনকি তথাকথিত বাপের যে সম্পত্তি পাওয়ার কথা তাদের নয়, তারও অর্ধেক অংশ পেয়ে গেল তারা! 

মামার কথা শুনে দুর্যোধনের দুঃখ আরও বেড়ে গেল। প্রায় হা-হুতাশের কণ্ঠে বলল, ‘আর ওই ভীম-অর্জুনের মতো সহোদর…।’ 

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শকুনি বলল, ‘তুমি নিজের পক্ষের বীরদের কথা ভুলে যাচ্ছ কেন ভাগনে? ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ-আরও কত কত বীর যোদ্ধা তোমার সঙ্গে আছে!’ 

চুয়ান্ন 

‘তুমি ওই বিভীষণ বিদুরটার কথা ভুলে যাচ্ছ কেন মামা? ওই দাসীপুত্রটাই তো যত নষ্টের মূল! ও-ই তো পাণ্ডবদের মনে লোভ ঢুকিয়েছে, রাজা হওয়ার, রাজ্যাংশ পাওয়ার।’ ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠল দুর্যোধন। 

‘তুমি মিথ্যে বলোনি ভাগনে। ওই মহামন্ত্রী ক্ষত্তা বিদুর একজন পাকা খেলোয়াড়। ওই-ই পাণ্ডবদের খেপিয়ে তুলেছে। খেপিয়ে তুলেছে যুধিষ্ঠিরকে। তাকে লোভী করে তুলেছে কুরুরাজসিংহাসনে রাজা হয়ে বসবার। তবে আমি কিন্তু তার তেমন দোষ দেখিনে ভাগনে।’ 

‘দোষ দেখ না? তা হলে কার দোষ দেখ? 

‘বিদুর যে এমন করে বেড়ে উঠল, তোমার বাবার প্রশ্রয় পেয়ে পেয়েই তো!’ 

‘পিতাশ্রীর প্রশ্রয় পেয়ে?’ 

‘হ্যাঁ তো! পিতা তোমার বিদুর-আনুগত্যে আচ্ছন্ন। সামনে কী পদলেহী ভাব তার! মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যেন তার ভাই নয়, যেন সহোদর, যেন পিতা! মাঝেমধ্যে এমন আচরণ করে, পিতামহের সম্মানকেও খেলো মনে হয় তখন! 

দুর্যোধন এবার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, ‘বাবাকে এত করে বোঝাই, বাবা ক্ষত্তা বিদুরের এ আসল চেহারা নয়। ও একটা ভেজাবেড়াল, ছদ্মবেশী আততায়ী সে। বাবা কিছুতেই আমার কথা বিশ্বাস করেন না। বলেন, তুমি বিদুরকে পছন্দ করো না বলেই তার গুণগুলো দেখ না। মন থেকে ক্রোধ আর সন্দেহ সরিয়ে বিদুরের দিকে তাকালে তুমি দেখতে পাবে, তার মতো কুরুহিতৈষী আর দ্বিতীয়টি নেই এই কুরুরাজ্যে। শুধু তো তা-ই নয়, পিতামহ ভীষ্ম, গুরুদেব দ্রোণাচার্য—সকলেই বিদুরকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন।’ 

শকুনি খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, ‘বিদুরকুহক থেকে মহারাজকে যেকোনোভাবেই বের করে আনতে হবে।’ 

দুর্যোধন হিংস্র গলায় বলল, ‘কেউ আমার পক্ষে থাকুক বা না থাকুক, আমি আমার একার ক্ষমতাবলেই যুদ্ধ করব। আমি আমার সম্মান এভাবে আর পাণ্ডবদের দ্বারা আহত হতে দেব না। 

দুর্যোধনের কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠল শকুনি। বলল, ‘না না না! দুর্যোধন, যুদ্ধের কথা ভেব না এখন। 

‘যুদ্ধ করার এখনই তো সময় মামা! দেখে তো এলাম, রাজধানী স্থাপন করেছে ঠিক, রাজসূয় যজ্ঞও করেছে, কিন্তু এখনো তো পাণ্ডবরা ঠিকমতো গুছিয়ে বসতে পারেনি! এই অগোছালো সময়টাতেই তো…।’ 

‘চুপ চুপ ভাগনে, অর্বাচীনের মতো কথা বলো না। রক্ত না ঝরিয়ে শুধু কৌশলে যদি পাণ্ডবজয়টা তোমার হস্তগত হয়, তা হলে সেটাই ভালো নয় কি?’ 

‘রক্তপাতহীন জয়!’ 

এবার প্রাণখুলে হেসে উঠল শকুনি। সেই হাসিতে বিজ্ঞতা আর ক্রূরতার মিশেল। ডান চোখটা চিকন করে দুর্যোধনের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। কণ্ঠকে একেবারে খাদে নামিয়ে, এদিক ওদিক একবার দেখে নিয়ে শকুনি বলল, ‘হ্যাঁ-ভাগনে। রক্তপাতহীন জয়। বাতাসে গদার শোঁ শোঁ শব্দ উঠবে না, তলোয়ারের ঝনঝনানি শোনা যাবে না, একবিন্দু রক্তও ঝরবে না কারও দেহ থেকে, শুধু জয়টা টুপ করে তোমার হাতে এসে যাবে।’ 

মামার কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না, আবার বিশ্বাস না করে স্বস্তিও পাচ্ছে না দুর্যোধন। এই অবস্থায় মামার আরও নিকটে এগিয়ে এলো সে। অবিশ্বাসের কন্ঠে বলল, ‘এসব কী বলছ মামা তুমি! আমার সামনে কোন মায়াজগৎ তৈরির খেলায় নেমে পড়লে তুমি! আমাকে আর বিভ্রমে ফেল না মামা! মিথ্যে আশ্বাসে আমাকে আর বিমূঢ় করো না!’ 

ভাগনে দুর্যোধনের আকুলতা দেখে বড় মায়া লাগল শকুনির। স্নেহমাখা চোখে দুর্যোধনের দিকে তাকিয়ে থাকল। 

দুর্যোধন বলল, ‘কুরুপক্ষের যত বড় বড় বীরের কথা বললে তুমি একটু আগে, ওঁদের কাউকে আমার প্রয়োজন নেই। শুধু তুমি আমার সহায় থাক মামা। তোমার সহায়তায় আমি পাণ্ডবদের পথে বসাতে চাই।’ 

‘পারবে তুমি ভাগনে, পারবে। আমার বুদ্ধি ধরলে ওই পাণ্ডুপুত্রদের পরান্নভোজী ভিক্ষুকে পরিণত করতে পারবে।’ 

‘পারব?’ 

‘হ্যাঁ, পারবে তো।’ তারপর হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে শকুনি জিজ্ঞেস করল, ‘ভাগনে, তুমি জান তো আমার একটা বিশেষ গুণ আছে?’ 

‘বিশেষ গুণ!’ প্রসঙ্গ পালটানো প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল দুর্যোধন। 

‘আরে ভাগনে, আমি যে ভালো পাশা খেলতে পারি, তা তুমি ভুলে গেলে!’ চোখ বুজে কী যেন একটু ভেবে নিল শকুনি। বলল, ‘এই ভারতবর্ষে একজন দক্ষ পাশাড়ে হিসেবে আমার সুনাম বা দুর্নাম আছে, জান না তুমি?’ 

‘মামা, বুঝে উঠতে পারছি না, পাণ্ডবদের পথে বসাবার সঙ্গে তোমার পাশাখেলার দক্ষতার কী সম্পর্ক?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল দুর্যোধন। 

শকুনি দুর্যোধনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আরেকটা প্রশ্ন করে বসল, ‘আচ্ছা দুর্যোধন, বলো তো তুমি—যুধিষ্ঠিরের নেশা কী?’ 

‘নেশা! যুধিষ্ঠিরের আবার কী নেশা থাকবে?’ 

‘আছে ভাগনে, আছে। গভীরভাবে চিন্তা করে উত্তরটা দাও তুমি এবং ওই নেশার নেশায় গো হারা হারবে যুধিষ্ঠির, তোমার কাছে।’ 

এবার দুর্যোধন বেশ আগ্রহী হয়ে উঠল। বলল, ‘মামা, আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। আমাকে আর অস্থিরতায় রেখ না। বলো, যুধিষ্ঠিরের সেই সর্বনাশা নেশা কী!’ 

‘জুয়া।’ নিস্পন্দ কণ্ঠে বলল শকুনি। 

বোবা চোখে মামার দিকে তাকিয়ে থাকল দুর্যোধন। 

শকুনি বলল, ‘বুঝলে না তো কিছু? ভাগনে, তোমার ওই এক অভ্যেস হঠাৎ রেগে যাওয়া। রাগলে হিতাহিত জ্ঞান হারাও তুমি। ওই কারণে মানুষকে তুমি পড়তে শেখনি। আমার দিকে তাকাও। সাত চড়ে রা কাড়ি না। কেউ অপমান করলেও জবাব দিই না। অপমানকারীর দুর্বলতাটা খুঁজে বের করে রাখি। সুযোগ বুঝে ওই দুর্বল জায়গাটাতে এমন ঘা দিই না, চোখেমুখে আঁধার দেখে!’ 

তারপর দুর্যোধনের মাথায়-পিঠে কোমল ডান হাতখানি বুলাল শকুনি। মমতাভরা কণ্ঠে বলল, ‘আমি বহুদিন ধরে যুধিষ্ঠিরকে অবলোকন করে যাচ্ছি ভাগনে। যুধিষ্ঠিরের অনেক গুণ মানি, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের চরিত্রে সাংঘাতিক এক দুর্বলতা আছে। সে পাশাখেলার প্রতি আসক্ত। ও পাশা খেলতে খুবই ভালোবাসে। কিন্তু জেতার কৌশলটা জানে না সে। পাশাখেলা তো আর এমনি এমনি হয় না। বাজি ধরেই পাশাখেলা হয়। বাজি ধরে যারা খেলে তাদের জুয়াড়ি বলে। যুধিষ্ঠির একজন জুয়াড়ি। তবে দক্ষ জুয়াড়ি নয়। ভালো করেই জানি আমি। এটা আমি দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানে জেনেছি।’ অনেকক্ষণ কথা বলে হাঁপিয়ে উঠেছে শকুনি। 

দম নেওয়ার জন্য একটু থামলে দুর্যোধন বলল, ‘সত্যি বলছ মামা তুমি! ওই পাণ্ডবটার পাশাখেলার নেশা আছে? তাও আবার বাজি ধরে?’ 

শকুনি বলল, ‘আমাকে আর অবিশ্বাস করো না ভাগনে। এখন তোমার কাজ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে রাজি করিয়ে যুধিষ্ঠিরকে এই হস্তিনায় নিয়ে আসা। পরের কাজটা আমার। পাশাখেলায় সে কখনো আমাকে হারাতে পারবে না। আমাকে হারাবে, এমন কেউ ভারতবর্ষে জন্মায়ওনি। তুমি যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলতে ডাক—ওর রাজ্যপাট, ধনদৌলত – সব সব কিছু জিতে আমি তোমাকে দেব। এই মুহূর্তে তোমার একমাত্র কাজ শুধু মহারাজকে রাজি করানো। 

হতাশার বাতাস মুখ দিয়ে বের করে দিয়ে দুর্যোধন বলল, ‘তুমি কি বিশ্বাস কর মামা, পিতাশ্রী আমার প্রস্তাব মেনে নেবেন? তুমি জান না, তিনি ভাইপোদের কী পরিমাণ ভালোবাসেন? আর ওই দাসীপুত্র বিদুরটা, সে কি এই প্রস্তাব কার্যকর হতে দেবে? না না মামা, পিতাশ্রীকে রাজি করানো আমাকে দিয়ে হবে না। কুরুরাজসভার কেউ যদি বাবাকে রাজি করাতে পারে, সে তুমি মামা। তুমিই বাবার সঙ্গে আগে কথা বলো মামা। তারপর তো আমি আছিই।’ 

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধৈষণার বিপরীতে কূটকৌশলে যদি পাণ্ডবদের নিঃস্ব করে ফেলা যায়, তাতে মন্দ কী—ভাবল দুর্যোধন। 

পঞ্চান্ন 

ভাববে না-ই বা কেন দুর্যোধন? 

যে পাণ্ডবরা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে হস্তিনায়, যে পাণ্ডবরা বাল্যকাল থেকে তাদের শত ভাইয়ের জীবনটা অতিষ্ঠ করে তুলেছে, যারা চক্রান্ত করে পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে সিংহাসন থেকে হটাতে চাইছে, যারা সামন্তরাজাদের বশে এনে কুরুবংশ উৎখাতের জন্য ওত পেতে আছে—তাদের ছলে-কৌশলে নিঃস্ব করবার চিন্তা করবে না কেন দুর্যোধন? 

যন্ত্রণা, লজ্জা, অপমানে দগ্ধ দুর্যোধন যুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। বীর সে। দুর্যোধন লুকিয়ে হত্যা করার লোক না। সে জানে, ক্ষত্রিয়ধর্মের বিপরীত তা। তাই তো অস্ত্রহাতে বুক ফুলিয়ে পাণ্ডবদের সামনে দাঁড়াতে চাইছিল সে। সভাগৃহে জলভ্রমে পরিচ্ছদ উৎক্ষিপ্ত করিয়ে যে অপদস্ত পাণ্ডুপুত্ররা তাকে করেছে, তার শাস্তি তাদের পেতেই হবে। তাই তো পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে চেয়েছে। কিন্তু মাতুল শকুনি দুর্যোধনকে তা করতে দেয়নি। যুযুৎসা থেকে বিরত করে পাশাখেলার মন্ত্রণা দিয়েছে। মন্ত্রণাটাকে দুর্যোধন খুব পছন্দ না করলেও মন্দের ভালো বলে ভেবেছে। মামাকে অনুরোধ করেছে, পিতাশ্রী ধৃতরাষ্ট্রকে পাশাখেলায় অনুমোদন দিতে রাজি করাতে। 

শকুনি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সামনে উপস্থিত হয়েছিল। তবে সরাসরি অক্ষক্রীড়ার প্রসঙ্গ তোলেনি শকুনি। মনুষ্যচরিত্র ভালো করে পড়া তার। সে জানে, সরাসরি পাশাখেলার প্রস্তাব দিলে এক ঝটকায় ধৃতরাষ্ট্র সেই প্রস্তাব উড়িয়ে দেবেন। তাই শকুনি ভূমিকা করল। 

বলল, ‘মহারাজ, পুত্র দুর্যোধনের দিকে একবারও তাকিয়ে দেখেছেন? কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে তার চেহারা! কী রকম যেন দুর্বল দুর্বল! ফ্যাকাশে গায়ে রং!’ বলে থেমে গেল শকুনি। 

শুনে ধৃতরাষ্ট্রের প্রাণটা আনচান করে উঠল। উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে উঁচু গলায় বলে উঠলেন, ‘কেন, কী হয়েছে আমার পুত্রের? কীসের অভাব তার? কীসের কষ্ট? কেন কষ্ট?’ 

তারপর বললেন, ‘দুর্যোধন আছে এখানে?’ 

মৃদু কণ্ঠে শকুনি বলল, ‘আছে। আমার পাশেই আছে।’ 

ধৃতরাষ্ট্র দ্রুত জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীসের কষ্ট তোমার পুত্র? তুমি আমায় একবার বলো। যে বাবা পুত্রের কষ্ট লাঘব করত পারে না, সেই বাবাকে ধিক্কার জানাই আমি। বলো পুত্র, বলো দুর্যোধন, তোমার কষ্টের কথা বলো। তোমার কষ্ট আমি মুহূর্তেই দূরীভূত করে ছাড়ব। 

‘দুর্যোধনের কষ্টের কারণটা একটু জটিল মহারাজ।’ কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে কোমর বাঁকিয়ে বলল শকুনি। 

একটু থতমত খেল হস্তিনাধিপতি। নরম কণ্ঠে বলল, ‘জটিল! কেন আমার পুত্র জটিল কষ্টে ভুগছে বুঝতে তো পারছি না আমি! দুর্যোধন, বলো তুমি। শকুনি বলছে, তোমার মনে অপার বেদনা। অভাব থেকেই তো বেদনার জন্ম! তুমি তো কোনো কিছুর অভাবে নেই বৎস! ভালো জামাকাপড় পরছ, মাংস আমিষ খাচ্ছ, যেখানে খুশি বেড়াতে যেতে পারছ। তবুও কীসের এত কষ্ট তোমার?’ 

পিতার এ রকম ছেলেভোলানো কথায় মন ভরল না দুর্যোধনের। অভিমান তার গলা পর্যন্ত উঠে এলো। রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘বাবা, জীবন মানেই কি শুধু খাওয়া-পরা শোয়া? জীবন মানে কি যেখানে ইচ্ছে ঘুরে বেড়ানো? যেসব পুরুষ শুধু ভালো খাওয়া-পরা পেয়েই সুখি হয়, তাদের মতো অধম পুরুষ তো আমি নই! খাওয়া-পরা থেকে দৃষ্টিটা একটু বাইরে আনুন পিতা, দেখবেন—আপনার রাজ্যের প্রজাদের নিজের প্রজা বলে ভাবতে শুরু করেছে একজন। সেটা আপনি সহ্য করতে পারেন, আমি সহ্য করতে পারি না পিতাশ্রী।’ 

দুর্যোধনের কথা শুনে ভীষণভাবে চমকে উঠে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। ‘আমার প্রজাদের নিজের প্রজা বলে ভাবছে কেউ! কে সে? তোমার এই কথা তো যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ দুর্যোধন! তোমার এই কথার মধ্যে তো রাজনীতি আছে! রাজদ্রোহের ইশারা আছে!’ 

দুর্যোধন কীরকম অদ্ভুত এক কণ্ঠে বলল, ‘বাবা, সন্তুষ্টি মানুষের সবচাইতে বড় শত্রু। সন্তুষ্টি ব্যাপারটা মানুষের সবকিছু নষ্ট করে দেয়। ঐশ্বর্য, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অভিমান—সবকিছু ওই সন্তুষ্টির কারণেই হারিয়ে বসে মানুষ। রাজনীতিতে সন্তুষ্টি মানায় না পিতাশ্রী।’ বলে চুপ করে গেল দুর্যোধন

অন্ধ চোখ দুটো দিয়ে পুত্রের দিকে তাকিয়ে থাকল ধৃতরাষ্ট্র। তার কপাল ঈষৎ কুঞ্চিত। 

দুর্যোধন এবার খাঁকারি দিল। ভেতরের সকল সংকোচ-অভিমান বের করে দিল যেন দুর্যোধন! তারপর নিষ্পাপ কণ্ঠে বলল, ‘আপনি জানতে চাইছিলেন না— আমি রোগা হচ্ছি কেন, গায়ের রং ফ্যাকাশে কেন? আমি বলছি বাবা, ওই যুধিষ্ঠিরের দীপ্যমান রাজলক্ষ্মী আমাকে বিবর্ণ করে ছেড়েছে। যদি ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে না দেখতাম যে সুখ আর বিত্ত কত বিপুল হতে পারে, তা হলে আমার কোনো কষ্ট হতো না পিতাশ্রী। সম্পদ আর প্রাপ্তি যে কত অগাধ হতে পারে, ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে দেখে এসেছি আমি। আমার বড় জ্বালা হচ্ছে বাবা, বড় যন্ত্রণা পাচ্ছি আমি। ওই যন্ত্রণার প্রকোপে আমার শরীর-মন—দুটোই বিধ্বস্ত হতে বসেছে। আমি শান্তি পাচ্ছি না বাবা, কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না।’ 

এবার ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনের কষ্টের কারণ বুঝতে পারল। এই কষ্টের পেছনে যে ঈর্ষা আর পরশ্রীকাতরতা কাজ করছে, তাও বুঝে গেল ধৃতরাষ্ট্র। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের এই শ্রী, এই ঐশ্বর্য তো তাকে বঞ্চিত করে নয়! নিজেদের কৃতিত্বেই তো সকল সম্পদ-বিত্তের মালিক হয়েছে পাণ্ডুপুত্ররা! তাতে দুর্যোধনের ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠার কারণ কি? হস্তিনাপুরের ধনসম্পদেরও কি অবধি আছে? তার রত্নভাণ্ডার, রাজকোষ, হাতিশালা, ঘোড়াশালা—সবই তো পূর্ণ। এগুলোতে তৃপ্ত না থেকে যুধিষ্ঠিরদের বিত্ত-ঐশ্বর্যে লুব্ধ হচ্ছে কেন দুর্যোধন? বুঝে উঠতে পারছে না মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। 

‘আমাকে কী করতে বলো তুমি? পাণ্ডুপুত্ররা সম্পদশালী হয়ে উঠলে আমার করার কী আছে—বুঝতে তো পারছি না!’ বলল মহারাজ। 

‘বাল্যকাল থেকে পাণ্ডবরা আমাদের যে লাঞ্ছনা দিয়েছে, আপনাকে উৎখাত করবার জন্য যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তারা, আমি তার একটা শোধ নিতে চাই বাবা।’ 

‘শোধ নিতে চাও!’ আকাশ থেকে পড়ল ধৃতরাষ্ট্র। 

‘মহামান্য মহারাজ, এই প্রতিশোধে কোনো রক্তপাত নেই, তলোয়ারের ঝনঝনানি নেই কোনো।’ কুঁজো হয়ে দাঁত কেলিয়ে বলল শকুনি। 

‘রক্তপাত নেই! তলোয়ারের…!’ কথা শেষ করলেন না মহারাজ। 

ভাগ্যিস, দুর্যোধন আর শকুনি আসার কিছুক্ষণের মধ্যে রাজসভা মুলতবি ঘোষণা করেছিল ধৃতরাষ্ট্র! ভাগ্যিস সভায় তখন ওরা তিনজন ছাড়া অন্য কেউ ছিল না! তারপরও কথা শেষ না করে ডানে-বাঁয়ে সামনে মাথা ঘোরাল মহারাজ, কেউ শুনে ফেলার আশঙ্কায় মানুষেরা যেভাবে চতুর্দিকে তাকায়। 

দুর্যোধন বলল, ‘পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধই ঘোষণা করতে চেয়েছিলাম আমি। মামা আমাকে বাধা দিল। বুদ্ধি দিল একটা— পাশাখেলার বুদ্ধি। যুধিষ্ঠির নাকি জুয়ায় আসক্ত, কিন্তু সে নাকি পাশাখেলায় আনাড়ি-বলল মামা শকুনি। মামা আরও বলেছে, যুধিষ্ঠিরকে কোনোরকমে হস্তিনাপুরে এনে পাশাখেলায় বসাতে পারলেই হবে। শকুনি মামা পাশার চালে পাণ্ডবদের সকল ধন হরণ করে ছাড়বে বলেছে।’ 

‘আমি নিশ্চিতভাবে কথা দিচ্ছি মহারাজ, একবার যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরে নিয়ে আসতে পারলেই হবে, আমি তাকে নিঃস্ব করে ছাড়ব। ওই যে তার বিত্তভৈবব, যা দেখে এসে দুর্যোধন ঈর্ষায় কাতর হয়ে পড়েছে, সব সব কিছু আপনার করে দেব মহারাজ। যুধিষ্ঠিরের মতো অদক্ষ পাশাড়ে কখনো আমাকে হারাতে পারবে না। ভাগনের কথাকে সমর্থন করে দৃঢ় কণ্ঠে বলল শকুনি। 

‘যুদ্ধ করা আমার অভিপ্রেত নয়।’ বলল মহারাজ। 

‘তাই তো পাশাখেলার আয়োজন করতে বলছি মহারাজ! সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। যুধিষ্ঠিরের পাশা-আসক্তির কথা সবাই জানে। সবাই ধরে নেবে, মহারাজার আমন্ত্রণে পাণ্ডবরা হস্তিনাপুরে বেড়াতে এসেছে। আনন্দচ্ছলে খেলতে বসেছে। তার পরের দায়িত্ব আমার।’ বলে গেল শকুনি। 

ধৃতরাষ্ট্র দোনোমনায় পড়ে গেল। একদিকে পুত্র দুর্যোধনের চাপ, অন্যদিকে পাণ্ডবদের সর্বনাশের আয়োজন। কোনদিকে যাবে সে? 

ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘বিদুর আমার রাজসভার মহামন্ত্রী। আমার আস্থাভাজন সে। তার দূরদর্শিতা প্রশংসাজনক। পাণ্ডব-কুরু–উভয়পক্ষের মঙ্গল চায় বিদুর। বিদুরকে একবার জিজ্ঞেস না করে তোমাদের প্রস্তাবে সায় দিতে পারি না আমি। তাকে একবার জিজ্ঞেস করতে হবে।’ 

দুর্যোধন বলে উঠল, ‘বলছিলাম না মামা, পিতাশ্রী বিদুরকুহক থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন না!’ 

ছাপ্পান্ন 

ধৃতরাষ্ট্র কোমল গলায় বলল, ‘তুমি বুঝতে পারছ না কেন পুত্র, বিদুর অত্যন্ত দূরদর্শী। তার ভাবনায় কোনো কুটিলতা নেই। ধর্ম-নীতি-সমাজ-বংশ — সবদিক বিবেচনা করেই সে মতামত দেবে আমায়। তুমি আজকের দিনটা অপেক্ষা করো দুর্যোধন, বিদুরের সঙ্গে কথা বলে কালই তোমাকে জানাচ্ছি।’ 

পিতার মুখে বিদুরের এত প্রশংসা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল দুর্যোধন। বলল, ‘আবার বিদুরের কথা বলছেন বাবা! আমি নিশ্চিত জানি, বিদুর কাকা আপনাকে বারণ করবে। ও তো আমাদের আপন ভাবে না! ক্ষত্তা তো পাণ্ডববান্ধব! পাণ্ডবরা বেকায়দায় পড়ুক, এ রকম কোনো কাজে বিদুর কাকা কখনো সমর্থন দেবে না।’ 

এরপর অভিমান-বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে দুর্যোধন বলে উঠল, ‘যদি ওই ক্ষত্তার কথা শুনে পাশাখেলার ব্যাপার থেকে আপনি পিছিয়ে আসেন পিতাশ্রী, তা হলে আমাকে মরতে হবে। আমি মরলেই তো আপনার সুখ বাবা! তখন বিদুর কাকাকে নিয়ে মনের সুখে এই কুরুরাজ্য ভোগ করবেন।’ একনিশ্বাসে কথাগুলো বলল দুর্যোধন। 

পুত্রের কথা শুনে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র হা হা করে উঠল। পুত্রের এ রকম আত্মঘাতী কথা শুনে তার ভেতরটা কেঁপে উঠল। দুর্যোধন যে তার প্রাণের অবিচ্ছেদ্য অংশ! সে যে তার স্বপ্নসুখের উৎস! দুর্যোধন যে তার প্রাণবায়ু! এ রকম একজনের মুখে আত্মহননের কথা শুনলে কে ধৈর্য ধরে থাকতে পারে? ধৃতরাষ্ট্রও তো রক্তমাংসের মানুষ! সেও তো একজন পিতা! 

পুত্রের কথা শুনে পিতৃহৃদয় আর্তনাদ করে উঠল, ‘দুর্যোধন, তুমি এ রকম করে বলো না বৎস। আমি নিজে চোখে দেখি না সত্যি, কিন্তু বাবা, তুমিই যে আমার নয়নের মণি। তোমার মধ্য দিয়েই আমি আমার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীদের অবলোকন করি।’ বলতে বলতে গলা শুকিয়ে এলো মহারাজের। একটু থেমে সুস্থির হলো। 

তারপর বলল, ‘আমাকে মন্ত্রী সভাসদদের নিয়ে চলতে হয়। এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া স্বৈরাচার। তাই আগামীকাল রাজসভায় বিদুরের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে চাইছি। তুমি নিশ্চিন্ত থাক পুত্র, সিদ্ধান্তটা তোমার অনুকূলে যাবে। চাই বিদুর সমর্থন করুক আর না-ই করুক।’ 

উল্লাসে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করল দুর্যোধনের, মামার হাত ধরে ধেই ধেই করে নেচে উঠতে ইচ্ছে করল। অনেক চেষ্টায় নিজেকে সংযত করে মামার দিকে তাকাল। মামা তার দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ হাসি হাসল। শকুনির সেই হাসিতে শব্দ নেই, সেই হাসি কুটিলতায় ভরা। 

পুত্র দুর্যোধনের আর্তহাহাকার শুনে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের দিকেই ঝুঁকে পড়ল। নির্মাণশিল্পীদের ডেকে পাঠাল ধৃতরাষ্ট্র। তাদের উদ্দেশে বলল, ‘তোমরা এমন একটি সভাগৃহ নির্মাণ করো, যা ভারতবর্ষে হবে অদ্বিতীয়। কেউ দেখে যাতে বলতে না পারে, আরে, এর চেয়ে বাড়া সভাগৃহ তো আমি অমুক রাজার প্রাসাদে দেখে এসেছি! এই সভাগৃহের নাম হবে তোরণস্ফটিক। এটি হবে সহস্ৰস্তম্ভশোভিত, হেমবৈদুর্যখচিত এবং শতদরজা বিশিষ্ট। এটি হবে বিশাল। আর হবে সুনির্মিত। আজ থেকেই কাজ শুরু করো তোমরা।’ 

দুর্যোধন এবং শকুনি প্রীতমনে স্থানান্তরে গেল। 

পরদিন ধৃতরাষ্ট্রের মুখে পাশাখেলার প্রস্তাব শুনে বিদুর প্রথমে আঁতকে উঠল, পরে প্রবল আপত্তি জানাল। বলল, ‘মহামান্য মহারাজ, এ কী বলছেন আপনি! এ যে সর্বনাশা প্রস্তাব! জ্ঞাতিবিরোধের বীজ যে এই প্রস্তাবে বপন করা আছে! প্রস্তাবিত পাশাখেলার পরিণতি কী হবে, তা দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি আমি। আপনাকে হাতজোড় করে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি, এই বিধ্বংসী খেলার অনুমোদন আপনি করবেন না।’ 

মহারাজ বলে উঠল, ‘আরে বিদুর, তুমি তো অতিমাত্রায় অধৈর্য হয়ে উঠছ দেখছি! এটা তো রাজরাজড়াদের অনুমোদিত খেলা! প্রত্যেক দেশে আনন্দ উপভোগের জন্য এই খেলা খেলে থাকে মানুষেরা। এতে সর্বনাশের কী দেখলে তুমি, বুঝতে পারছি না তো! 

তারপর কণ্ঠকে কোমলতায় সিক্ত করে ধৃতরাষ্ট্র আবার বলল, ‘ভাইয়ে ভাইয়ে বন্ধুর মতন খেলবে—যুধিষ্ঠির আর দুর্যোধনে। তাতে সর্বনাশ বা বিপর্যয়ের কী আছে? তাছাড়া এই খেলায় আমি থাকব, ভীষ্ম দ্রোণ থাকবেন, তুমিও থাকবে। আমাদের সকলের সামনে কী এমন ঘটতে পারে যে যার জন্য তুমি আতঙ্কিত হচ্ছ?’ 

বিদুর সর্বস্বান্ত কণ্ঠে বলল, ‘আপনি অনুমান করতে পারছেন না মহারাজ, কী অরাজকতা ধেয়ে আসছে এই কুরুরাজপ্রাসাদের দিকে। এতে ন্যায় লাঞ্ছিত হবে। ধর্ম দলিত হবে। সত্যের অপমৃত্যু ঘটবে মহারাজ। আপনি এই খেলা বন্ধ করুন মহামান্য।’ 

মৃদু হেসে হালকা কণ্ঠে ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘সত্যিই তো তুমি উতলা হয়ে উঠেছ দেখছি! আনন্দ-উচ্ছ্বাসকে সর্বনাশের মোড়কে উপস্থাপন করছ! ন্যায়-ধর্ম-সত্যকে টেনে এনে পাশাখেলার আনন্দটাকেই মাটি করে দিতে চাইছ তুমি! আরে বিদুর! কিচ্ছু হবে না। দেখে নিয়ো প্রাসাদজুড়ে উল্লাসের বন্যা বইবে।’ 

বিদুর এবার স্বগত কণ্ঠে বলল, ‘বিকৃত উল্লাসের বন্যা বইবে।’ 

ধৃতরাষ্ট্রের কণ্ঠস্বর বিদুরের কানে ভেসে এলো, ‘তুমি এক কাজ করো বিদুর, আমার দূত হয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে যাও। পাণ্ডবদের নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এসো হস্তিনাপুরে। পাশাখেলায় তুমি আর মাথা ঘামিয়ো না।’ 

মহারাজার শেষ বাক্যটি বিদুরের কানে নির্দেশের মতো শোনাল। 

বিদুর আর একটি শব্দও করল না। মাথা নত করে কুর্নিশ জানিয়ে মহারাজের সামনে থেকে চলে গেল। 

ধৃতরাষ্ট্র আবার দ্বিধায় পড়ে গেল। পুত্রের দিকে যাবে, না বিদুরের কথা মানবে? দোলাচলে দুলতে শুরু করল আবার মহারাজ। 

দুর্যোধন এলে ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘পাশাখেলার প্রস্তাবে বিদুর মোটেই সম্মত নয়। সে দূরদর্শী, ধর্মানুসারী। তার পরামর্শ ফেলতে পারি না আমি। তুমি পাশাখেলার চিন্তা ত্যাগ করো দুর্যোধন।’ 

দুর্যোধন শকুনির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখলে তো মামা, পিতাশ্রীর চিন্তা আবার ঘুরে গেছে! ওই বিদুর কাকা বাবার মাথা আবার গুলিয়ে দিয়েছে।’ 

তারপর পিতার দিকে ফিরে উচ্চৈঃস্বরে দুর্যোধন বলল, ‘কাকে আপনি ধার্মিক বলছেন বাবা? ওই মহামন্ত্রী বিদুরকে? ও তো ধর্মের মুখোশ পরে আছে! যত অনৃতভাষণ ওই কাকাই তো দেয়! আপনাকে উৎখাত করার যে ষড়যন্ত্র, তার পেছনে তো ওই ক্ষত্তারই হাত আছে!’ 

বিদুরের দুর্নাম শুনতে রাজি নয় ধৃতরাষ্ট্র। তার চোখে বিদুরের মতো ন্যায়পরায়ণ এই কুরুসভায় দ্বিতীয়টি নেই। ধৃতরাষ্ট্র তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘পাশাখেলার জন্য তুমি পাগলপ্রায় হয়ে গেলে কেন বুঝলাম না! তোমার কীসের অভাব বলো তো দুর্যোধন? তুমি রাজপদে প্রতিষ্ঠিত, পৈতৃকরাজ্য বর্ধিত করেছ, তোমার প্রতিটি নির্দেশ এই রাজ্যে অক্ষরে অক্ষরে পালিত হচ্ছে। তারপরও তোমার দুঃখের অন্ত নেই! কেন বলো তো?’ 

পিতার এ রকম প্রশ্নের উত্তর আগে একবার দিয়েছে দুর্যোধন। এখন আবার একই রকম প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করল না দুর্যোধনের। শুধু হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘আপনি না গতকাল তোরণস্ফটিক নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন পিতাশ্রী? বলেছেন না সভাগৃহটি অতি মনোরমভাবে সাজাতে?’ 

দুর্যোধনের কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্রের কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। কী প্রতিক্রিয়া জানাবে ধৃতরাষ্ট্র? ও তো একজন নৃপতি! ভারতবর্ষের অতি সুপরিচিত প্রসিদ্ধ নরপতি সে! সে এ রকম একটি অন্যায্য কুটিল অক্ষক্রীড়ার আয়োজন করে কী করে! দুর্যোধনের প্রতিশোধস্পৃহা পাশাখেলার পেছনে যে কাজ করছে, তা বুঝতে তো কারও বাকি থাকবে না! না না, একজন রাজা হয়ে, জ্যেষ্ঠতাত হয়ে, পাণ্ডবদের সর্বনাশী অক্ষক্রীড়ার আয়োজন সে করতে পারে না! তাছাড়া মহামন্ত্রী বিদুরেরও তো সায় নেই এই খেলায়! এ রকম ভাবতে ভাবতে নিশ্চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিল ধৃতরাষ্ট্র। 

দুর্যোধন বুঝে গেল পিতার মনোভাব। বিরক্তিতে তার কপাল কুঁচকে গেল। নাসিকা দিয়ে উষ্ণ বাতাস বেরোতে শুরু করল। সে বুঝে গেল, নরম কথায় পিতাকে বশে আনা যাবে না। আঙুল বাঁকাতে হবে। আঙুল বাঁকালও দুর্যোধন। কণ্ঠস্বরে ঝাঁঝ মিশাল। 

উদ্ধত ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনার অবস্থাটা কী রকম জানেন বাবা? আপনার শাস্ত্রজ্ঞান আছে মানি বাবা, কিন্তু সেই শাস্ত্রজ্ঞানের সঙ্গে যে বাস্তববুদ্ধি মেশাতে হয়, তা জানা নেই আপনার। আমাকে নিয়ে আপনি অহঙ্কার করেন। কিন্তু বিকশিত হতে দেন না আমাকে। একটা বড় নৌকার পেছনে একটা ছোট নৌকা বাঁধা থাকে। মানুষ বড় নৌকাটিকে দেখে, ছোটটিকে পাত্তা দেয় না। আমারও হয়েছে ছোট নৌকাটির মতো অবস্থা। আমি আছি বটে কুরুরাজ্যে, কিন্তু কেউ মূল্যায়ন করে না আমায়। মূল্যায়ন না-করার দলে আপনিও আছেন বাবা। 

ছেলের কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্র একেবারেই দমে গেল। 

মাঝখানে শকুনি বলে উঠল, ‘অযথা ভাবছেন মহারাজ। পাশাখেলায় আমি পাণ্ডবদের সব জিতে নেব।’ 

ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের সঙ্গে আবার পরামর্শ করতে চাইল। 

দুর্যোধন বলল, ‘কাকা তো আপনার মাথা আবার আউলাঝাউলা করে দেবে বাবা।’ 

ধৃতরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত বলল, ‘আমার বাছা এসব আর ভালো লাগছে না। তোমার যা মন চায়, করো।’ 

সাতান্ন 

শেষ পর্যন্ত বিদুরকে ইন্দ্রপ্রস্থে যেতেই হলো। 

রাজাদেশ অবহেলা করার উপায় নেই। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে ডেকে নির্দেশ দিয়েছিল, ‘যাও বিদুর, শিগগির ইন্দ্রপ্রস্থে যাও। পাশাখেলার জন্য যুধিষ্ঠিরকে সঙ্গে করে নিয়ে এসো।’ 

বিদুরকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল পাণ্ডবরা। 

যুধিষ্ঠির দ্রুত জিজ্ঞেস করেছিল, ‘খুল্লতাত, আপনি! আগাম সংবাদ না দিয়ে হঠাৎ ইন্দ্রপ্রস্থে এলেন! কোনো দুঃসংবাদ নয় তো?’ 

বিদুর মর্মাহত গলায় বলল, ‘দুঃসংবাদই বটে যুধিষ্ঠির, সর্বনাশের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে আমি তোমার রাজধানীতে এসেছি।’ 

যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সঙ্গে অন্য চার ভাইও বুঝে উঠতে পারল না বিদুর কাকার কথার মাহাত্ম্য।

অর্জুন বলল, ‘খুল্লতাত, আপনার কথা আমরা বুঝতে পারছি না। খুলে বলবেন?’ 

‘বলছি।’ বলে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকাল বিদুর। বলল, ‘মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পাশাক্রীড়াচারীদের সম্মেলন ডেকেছেন হস্তিনাপুরে। সেই ক্রীড়ায় অংশগ্রহণের জন্য মহারাজ তোমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।’ 

উল্লাসে ফেটে পড়ে যুধিষ্ঠির বলল, ‘অ হো! এই কথা! এ তো বিশাল এক আনন্দসংবাদ!’ যুধিষ্ঠিরের জুয়াড়িমন হস্তিনাপুরে যাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। 

এবার বিদুরের অবাক হওয়ার পালা। যুধিষ্ঠিরের অরাজাসুলভ উচ্ছ্বাস দেখে বিদুর সত্যিই স্তম্ভিত হলো। বলল, ‘পাশাখেলার কথা শুনে তুমি এ রকম আবেগাকুল হয়ে উঠলে কেন যুধিষ্ঠির, বুঝতে পারছি না। এ তো পাশাখেলার আসর নয়, সর্বনাশের যজ্ঞানুষ্ঠান। এর পেছনে তোমাদের চিরশত্রু দুর্যোধনের হাত আছে। মূলত তারই উৎসাহে-উদ্যোগে ওই অক্ষক্রীড়ার আয়োজন করা হয়েছে। এতে তোমাদের সর্বস্বান্ত হওয়ার পুরো সম্ভাবনা।’ 

বিদুরের এই যে আকুতি, এই যে সর্বনাশের ইঙ্গিত, তার কিছুই যুধিষ্ঠিরের কানে ঢুকল না। তার চোখে তখন পাশাখেলার সজ্জিত আলোকিত আড়ম্বরপূর্ণ আসর, মনে শুধু পাশাখেলার উন্মত্ত নেশা। 

ওই অবস্থাতেই যুধিষ্ঠির বিদুরকে জিজ্ঞেস করল, ‘দুর্যোধন ছাড়া আর কোন কোন অক্ষবিদ সেখানে উপস্থিত থাকবেন বলুন খুল্লতাত। দুর্যোধন তো অতি সাধারণ মানের খেলোয়াড়। ওকে আমি গুনছিই না। আর যাঁরা থাকবেন, তাঁদের শতবার পরাজিত করার ক্ষমতা রাখি আমি। অন্যদের নাম বলুন খুল্লতাত। 

বিরক্তিতে বিদুরের চোখমুখ ভরে গেল। এতদিন যে যুধিষ্ঠিরকে দেখে আসছে বিদুর, এ যেন সেই যুধিষ্ঠির নয়! কোথায় গেল সেই ধীরস্থির, শান্ত, বিবেচক, দূরদর্শী যুধিষ্ঠির? এই যুধিষ্ঠির তো অস্থির, জুয়াড়ি, বিবেচনাহীন, অদূরদর্শী একজন সাধারণ মানুষ ছাড়া আর কেউ নয়! এ যুধিষ্ঠিরকে তো বিদুর চেনে না! 

তড়িতাহত কণ্ঠে বিদুর বলল, ‘অক্ষনিপুণ শকুনি, বিবিংশতি, চিত্রসেন, রাজা সত্যব্রত, জয়-এঁরা সবাই ওই অক্ষক্রীড়ায় উপস্থিত থাকবেন।’

‘বড় সুখের সংবাদ দিলেন খুল্লতাত! মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকেও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, এ রকম একটা আয়োজনে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলে। আমি প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছি। আগামীকালই আমরা রওনা দেব।’ 

‘তুমি প্রস্তুত হয়ো না যুধিষ্ঠির। কোনোভাবেই হস্তিনাপুর যাবে না তুমি। সেখানে বিপুল ক্ষতি ও অসম্মান তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’ একেবারে ভেঙেপড়া গলায় বিদুর বলল। 

যুধিষ্ঠির বলল, ‘আপনি এ রকম অস্থির হচ্ছেন কেন খুল্লতাত? এ তো কোনো যুদ্ধ নয়, এ তো সাধারণ একটা পাশাখেলা!’ 

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অস্থির কণ্ঠে বিদুর বলল, ‘এ পাশাখেলা নয় শুধু, এ যে পাশাখেলার মধ্য দিয়ে রক্তের হোলি উৎসবের আয়োজন!’ 

এই সময় ভীম বলে উঠল, ‘বিদুর কাকা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী। তাঁর কথায় নিশ্চয়ই কোনো মানে আছে। তিনি হস্তিনাপুরে যেতে নিষেধ করছেন। কাকার নিষেধ শুনে তোমার ওখানে না-যাওয়া উচিত দাদা।’ 

যুধিষ্ঠির বলল, ‘বৃকোদর, তোমরা শুধু পাশাখেলাকে দেখছ, জ্যেষ্ঠতাতের সম্মানটা দেখছ না! বড় আশা নিয়ে তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এখন আমি যদি হস্তিনাপুরে না যাই, তা হলে কুরুনৃপতি ধৃতরাষ্ট্রকে অপমান করা হয় না? তুমিই বলো বৃকোদর, জ্যেষ্ঠতাতকে এ রকম অপমান করা আমার উচিত কি না।’ 

আসলে মহারাজের মান-অপমানের ব্যাপারটা যুধিষ্ঠিরের কাছে মুখ্য নয়, আসল কথা তার রক্তের ভেতরে জুয়ার কল্লোল। পাশাখেলার নেশায় মাতোয়ারা তখন সে। 

বিদুরের অনিচ্ছাসত্ত্বেও যুধিষ্ঠির পরদিন ভার্যা দ্রৌপদী, জননী কুন্তী এবং ভাইদের নিয়ে হস্তিনাপুরে উপস্থিত হলো। সেই রাত্রিটা পরম সুখে রাজপ্রাসাদে অবস্থান করল তারা। 

পরদিন সভ্রাতা রাজা যুধিষ্ঠির সভামণ্ডপে প্রবেশ করল। 

সভামণ্ডপ তখন জমজমাট। দেশ-বিদেশের বাঘা বাঘা পাশাড়েরা উপস্থিত। তারা সভায় স্ব স্ব মর্যাদায় বসে আছে। তাদের সঙ্গে সঙ্গীসাথিরা। নিরানব্বই কুরুভ্রাতা সভা সামলাচ্ছে। 

দুর্যোধন-কর্ণ-শকুনি পাশাপাশি। সামনে পাশাটি বিছানো। যুধিষ্ঠির পাশাটি সামনে রেখে দুর্যোধনের মুখোমুখি বসল। তার পেছনে পাণ্ডবচতুষ্টয় — ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব। সবাই উপবিষ্ট। 

যুধিষ্ঠির বসেই দুর্যোধনকে লক্ষ করে বলল, কার সঙ্গে কার খেলা হবে এবং পণের অর্থই-বা কে দেবে, তা আগে ঠিক হোক।’ 

দুর্যোধন বা শকুনি কেউই পণের কথা বলেনি যুধিষ্ঠিরকে। যুধিষ্ঠির আপনা থেকেই বাজির কথা প্রথমে উল্লেখ করল। কারণ যুধিষ্ঠিরের ভেতর তখন জুয়াড় নেশার ঘূর্ণি উঠেছে। সেই ঘূর্ণি তার ভেতরের সকল বিবেচনা তছনছ করে দিচ্ছে। ওই জুয়াঝড়ের প্রকোপেই যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে বাজির কথা বলল। 

এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল দুর্যোধন। যুধিষ্ঠিরের কথার সূত্র ধরে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘পণের অর্থ দেব আমি, আর আমার হয়ে পাশার চাল দেবে আমার মামা শকুনি।’ 

যুধিষ্ঠির চমকে উঠে বলল, ‘এটা তো বড় অনুচিত কথা দুর্যোধন! তোমার হয়ে অন্য লোকের খেলা, এটা তো উচিত নয়! তুমি যখন বাজি ধরছ, পাশার দানও চালবে তুমি। তোমার হয়ে শকুনি মামার খেলা তো অনিয়ম! তা তো হতে পারে না!’ 

পাশাখেলার নিয়ম-অনিয়মের জবাব দিতে কোনো আগ্রহ দেখাল না দুর্যোধন। ধৃতরাষ্ট্রের শিথিলতার কারণে কুরুসভার আইন, আভিজাত্য এবং শিষ্টতা—সবই দুর্যোধনের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। এমনকি পাশাখেলার যে সাধারণ নিয়মনীতি, তাও দুর্যোধনের ইচ্ছানুসারে চলবে বলে বোঝা গেল। 

যুধিষ্ঠিরের প্রতিবাদ শেষ হতে না-হতেই মহারাজা ধৃতরাষ্ট্র এসে আসন গ্রহণ করল। অখুশি মন নিয়ে এলেন পিতামহ ভীষ্ম। এলেন দ্রোণাচার্য-কৃপাচার্য। চোখেমুখে গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে হাজির হলো মহামন্ত্রী বিদুর। এঁদের আগমনের সমারোহের তলায় যুধিষ্ঠিরের প্রতিবাদটি চাপা পড়ে গেল। 

ধৃতরাষ্ট্রের প্রবর্তনায় পাশাখেলা শুরু হলো। 

প্রথম চালেই জয় পেল শকুনি। প্রথম চালেই যুধিষ্ঠির বুঝতে পারল, মামা শকুনির চালে কপটতা আছে। যুধিষ্ঠির শকুনিকে উদ্দেশ করে বলল, ‘মামা, আপনার চালে প্রতারণা আছে। শঠতায় প্রথম বাজিটা জিতে নিলেন আপনি।’ 

মামা অবাক হওয়ার ভান করল। বোকা বোকা চাহনি শকুনির। যুধিষ্ঠির বুঝতে পারল না শকুনির এই বোকা চাহনির অন্তরালে কী ক্রূর কুটিলতা সক্রিয়! 

যুধিষ্ঠিরের এই প্রতিবাদে কেউ কান দেননি। মূলত প্রতিবাদ আমলে নেওয়ার পরিবেশই রাখেনি দুর্যোধনরা। 

এর পর শকুনি জুয়াড়ির কপটতা কাজে লাগিয়ে একটার পর একটা পণ জিতে নিতে থাকল। বিদুর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ধৃতরাষ্ট্রকে লক্ষ করে কর্কশ কণ্ঠে বলল, ‘এ কী হচ্ছে মহারাজ এখানে? এই যে আপনি দুর্যোধনকে প্রশ্রয় দিয়ে জুয়ার আসরে বসিয়ে দিয়েছেন, তার পরিণতি হবে ভয়ংকর, লোমহর্ষক এবং রক্তক্ষয়ী। পাণ্ডবদের ধনসম্পত্তি-ঐশ্বর্যে আপনার লোভ আছে, নইলে দুর্যোধনের মতো একজন কুলাঙ্গারকে পাশাখেলার অনুমতি দিলেন কেন? যদি চোখ থাকত আপনার, তা হলে দেখতে পেতেন, কী অন্যায় এবং কপট চাল প্রয়োগ করে শকুনিটা বাজি জিতে নিচ্ছে। আপনাকে আবারও বলছি, এই খেলা বন্ধ করুন। নইলে পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে। 

আটান্ন 

বিদুরের প্রতিবাদের উত্তরে একটি কথাও বলল না ধৃতরাষ্ট্র। 

অদ্ভুত এক সহনশীলতায় ধৃতরাষ্ট্র নির্লিপ্ত থাকল। ওই যে পিতামহ ভীষ্ম, যাঁকে সবাই নীতির পক্ষের লোক বলে, যাঁর চক্ষু-কর্ণ এখন খোলা, যাঁর বুদ্ধি বিবেচনা সচল, তিনিও একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন না। দ্রোণাচার্য-কৃপাচার্য উদাসীন থাকলেন। বিদুর বারবার ওঁদের দিকে তাকিয়েও কোনো সমর্থন পেল না। তার পরও দমে গেল না বিদুর। সভায় দাঁড়িয়ে পাশা চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে যেতে লাগল। 

দুর্যোধন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে তখন বেপরোয়া। তার চোখেমুখে ঔদ্ধত্য, কণ্ঠে কর্কশতা। পিতার নিশ্চুপতা তার ধৃষ্টতাকে বাড়িয়ে তুলল। 

অমার্জিত কণ্ঠে বিদুরকে বলল, ‘তুমি শুধু শত্রুর গুণ গাও, আমাদের নিন্দা কর। তোমার কাছে ভালো কারা, তা আমি বেশ করে জানি। আর আমাদের কি বাচ্চা ছেলে পেয়েছ যে পাঁচ কথা শুনিয়ে যাচ্ছ! কুলাঙ্গার বলছ তুমি আমায়! আমার জন্মের পর আমাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলে না তুমি? তুমি কি ভুলে গেছ—তুমি কার সন্তান? বেটা তুই হলি ক্ষত্তা। বামুনের বীজে দাসীর পেটে জন্ম তোর। তুই হলি বাড়িতে পোষা বেড়ালের মতন। বেড়াল যেমন বাড়ির জিনিসই মেরে খায়, তুইও তাই করছিস। তুই আমাদের খাচ্ছিস পরছিস, আর নির্লজ্জের মতো আমাদের নামেই যা ইচ্ছে বলে যাচ্ছিস।’ 

একটু থেমে গলায় আরও জোর ঢালল দুর্যোধন, ‘আমি তোকে সাবধান করে দিচ্ছি ক্ষত্তা, আমাদের ব্যাপারে মাথা ঘামাবি না। কুরু আর পাণ্ডবের মধ্যকার ঘটনার মধ্যে নাক গলাবি না।’ 

দুর্যোধনের এই কর্কশ ভাষণের পরও ধৃতরাষ্ট্র চুপ থাকল। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ বা অন্য কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী দুর্যোধনের এ রকম অসৌজন্যমূলক কথার বিরুদ্ধে রা কাড়লেন না। ফলে দুর্যোধনের সকল বাঁধন অবারিত হয়ে গেল। তার সকল ভয়ডর কেটে গেল। 

আবার পাশাখেলা আরম্ভ হলো। 

কুরুদের সহর্ষধ্বনিতে সভামণ্ডপ উচ্ছলিত হতে থাকল। মাঝখানে মাঝখানে কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্রের কণ্ঠস্বর শোনা যেতে লাগল—জিতেছে তো? দুর্যোধন জিতেছে তো? আর শকুনির গলা শোনা যেতে লাগল জিতেছে। দুর্যোধন জিতেছে। 

শেষের দিকে যুধিষ্ঠির ভাইদের বাজি ধরল। হারল। নিজেকে পণ রাখল। হারল।

সবশেষে দ্রৌপদীকে বাজি ধরে হেরে গেল। 

এবার সব সভাজন হায় হায় করে উঠলেন। কুরু বৃদ্ধরা ধিক্কার দিয়ে উঠলেন, ‘এতক্ষণ নিজের ধনসম্পদ রাজ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছ যুধিষ্ঠির। শেষ পর্যন্ত নিজেদের স্ত্রীকে বাজি ধরা! এ কেমন বাজি ধরা যুধিষ্ঠির? এ কী রকম জুয়ার নেশা? এতক্ষণ পঞ্চভ্রাতা দুর্যোধনাদিদের দাস ছিল, এখন তাদের নিরপরাধী পত্নী দ্রৌপদীও কুরুদের দাসী হয়ে গেল।’ 

দুর্যোধন বিদুরের দিকে তাকিয়ে তালি বাজিয়ে বলল, ‘বিদুর কাকা, মাথা হেঁট করে বসে আছ কেন? যাও এবার পাণ্ডবদের প্রেমের বউ দ্রৌপদীকে নিয়ে এসো। সে আমাদের প্রাসাদের দাসদাসীর সঙ্গে ঘরদোর ঝাড়ামোছা করুক।’ 

বিদুর কিন্তু চুপ থাকার পাত্র নয়। কঠিন কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তুমি এখন একটা উঁচু জায়গায় ঝুলে আছ দুর্যোধন। কখন সেখান থেকে মাটিতে পড়ে চুরমার হয়ে যাবে, তার ঠিক নেই। তুমি হরিণ হয়ে সিংহকে খেপিয়ে তুলেছ। মাথার ওপর তোমার ক্ষিপ্ত সাপ ঘুরছে। আর মনে রেখো, দ্রৌপদীকে পাশায় জেতার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কেননা যুধিষ্ঠির আগে নিজেকে বাজি ধরে হেরেছে। এরপর দ্রৌপদীকে পণ ধরার অধিকার নেই যুধিষ্ঠিরের।’ 

বিদুরের এই সব যুক্তিমূলক কথায় দুর্যোধনের কোনো ভাবান্তর হলো না। এই মুহূর্তে তার মাথার মধ্যে ঘুরছে দ্রৌপদী। পাণ্ডবদের সবচাইতে নরম জায়গা দ্রৌপদীকে হেনস্থা করে মনের জ্বালা মেটাতে চায় দুর্যোধন। ইন্দ্রপ্রস্থের রাজভবনে জলবিভ্রমের কথা, দ্রৌপদীর নিন্দাসূচক উচ্চহাস্য, তার কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের স্মৃতি দুর্যোধনের জ্বালা বাড়িয়ে তোলে। পাণ্ডবদের ওপর এত দিনকার সঞ্চিত ক্রোধ সব দ্রৌপদীর ওপর গিয়ে পড়ে। 

প্রতিকামী নামের এক সারথীকে দুর্যোধন নির্দেশ দেয়, ‘তুমি গিয়ে দ্রৌপদীকে এই সভাগৃহে নিয়ে এসো।’ 

প্রতিকামী সাধারণ একজন রাজভৃত্য। কিন্তু সে সৌজন্যশূন্য নয়। নিজের সমূহ ক্ষতি হবে জেনেও দ্রৌপদীকে আনতে অস্বীকার করল প্রতিকামী। 

দুর্যোধন ছোট ভাই দুঃশাসনকে উদ্দেশ করে বলল, ‘প্রতিকামীকে আমি পরে দেখে নিচ্ছি। এখন তুমি যাও ভাই, দ্রৌপদীকে সভার মাঝে নিয়ে এসো। শিগগির যাও দুঃশাসন। আমার তর সইছে না। 

দাদার নির্দেশ পেয়ে দুঃশাসন দ্রুত পায়ে সভামণ্ডপ থেকে বেরিয়ে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে দ্রৌপদীর চুলের মুঠি ধরে কুরুসভায় সকলের সামনে নিয়ে এলো। 

কুরুসভা তখন বাদে-প্রতিবাদে, হর্ষে-হুল্লোড়ে উন্মাতাল। 

দ্রৌপদীকে দেখে দুর্যোধন ‘দাসী’

‘দাসী’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল। সে তখন নিজেকে সংযত করে রাখতে পারছিল না। দুর্যোধনের চোখমুখ, অঙ্গভঙ্গি অতিশয় অশালীন হয়ে উঠল I 

দুঃশাসন বলে উঠল, ‘তুমি লজ্জা ছেড়ে একবার দাদা দুর্যোধনের দিকে তাকাও দেখি বৌঠান। চেহারাখানা তাঁর যুধিষ্ঠিরের চেয়ে মন্দ নয়।’ 

কর্ণ বলল, ‘পাণ্ডবরা আর তোমার কেউ নয় গো দ্রৌপদী! এবার কৌরবদের মধ্য থেকে তোমার নতুন একটা স্বামী বেছে নাও।’ 

কর্ণের এই অভব্য মন্তব্য সমস্ত শালীনতাকে অতিক্রম করে গেল। 

এত সব উত্তেজক প্ররোচনা শুনে দুর্যোধন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। সকল ভদ্রতাকে ছাড়িয়ে গেল সে। হঠাৎ নিজের উরুর কাপড় সরিয়ে অশালীন কণ্ঠে দুর্যোধন বলল, ‘দেখ দেখ দ্রৌপদী, এই ঊরু দেখে একদিন ইন্দ্রপ্রস্থের স্ফটিকগৃহে কুৎসিতভাবে হেসে উঠেছিলে, মনে পড়ে তোমার? শুধু তো তা-ই না, অভদ্ৰ মন্তব্যও করেছিলে তুমি। আজ সেই ঊরুতেই বসাতে চাই আমি তোমাকে।’ 

দুর্যোধনের কথায় সভাগৃহে আবার হুল্লোড় উঠল। 

দুর্যোধনের চরিত্রে আর যা-ই থাকুক, স্ত্রীলোক-সংক্রান্ত কোনো ব্যভিচার-দোষ ছিল না। স্ত্রী ভানুমতীকে নিয়ে সংহত সংযত সুখী জীবন তার। তার বিরুদ্ধে কোনো নারীকে অপমান করার অপবাদ নেই। সেই দুর্যোধন আজ খেপে উঠেছে। খেপে উঠেছে শুধু প্রতিশোধস্পৃহায়। এতদিনের পুঞ্জীভূত অপমান, আবাল্য লাঞ্ছনা, পাণ্ডবদের অতুল ভৈববের কারণে দুর্যোধনের ভেতরে ক্রোধ দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছিল। এই ক্রোধের তাড়নায় যে-দুর্যোধন লম্পট নয়, সে-দুর্যোধন আজ লাম্পট্যের সকল সীমা অতিক্রম করে গেল! 

দুর্যোধনের এত বড় কুৎসিত ইঙ্গিতের পরও সমবেত সামন্তরাজাদের কেউ প্রতিবাদ করল না। করল না দুর্যোধনের ভয়ে। কিন্তু ভীষ্ম দ্রোণ-কৃপের মতো কুরু বৃদ্ধদের কেউই দুর্যোধনের বিরুদ্ধে একটি কথাও বললেন না। তাঁরাও বললেন না ভয়ে। যদি দুর্যোধন এই সভামধ্যে তাঁদের অপমান করে বসে! অপমান করাটা দুর্যোধনের কাছে কিছুই না। কারণ তার ওপর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কোনোই নিয়ন্ত্রণ নেই এখন। রাজ্যের সকল ক্ষমতা এখন দুর্যোধনের করতলগত। ধৃতরাষ্ট্র এখন কুরুসাম্রাজ্যের পুতুলরাজা। 

দুর্যোধনের ঔদ্ধত্যে দুঃশাসন দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে। সে দ্রৌপদীর বস্ত্র ধরে টানাটানি শুরু করল। দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করেই ছাড়বে সে। 

তেজস্বী দ্রৌপদী ক্রন্দনরত অবস্থাতেই জ্বলে উঠল, ‘ভরতবংশীয়দের ক্ষাত্রধর্মে ধিক্কার জানাচ্ছি। এই সভায় কুরুবংশের অনেক ধর্মজ্ঞ উপস্থিত আছেন। তাঁদের মধ্যে একজনও কুলাঙ্গার দুর্যোধন আর দুরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে নিন্দা জানাচ্ছেন না! বোধহয় এই পাষণ্ডদের দুষ্কর্মে এঁদের সমর্থন আছে, নইলে চুপ করে আছেন কেন কুরু বৃদ্ধরা? পাণ্ডব রাজবধূর বিবসনক্রিয়াটি তাঁরা কি স্বচক্ষে উপভোগ করতে চান?’ 

বিজ্ঞ রাজা-রাজন্য, মন্ত্রী, কুরুবৃদ্ধ, এমনকি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রও দ্রৌপদীর এই আকুলতায় সাড়া দিলেন না। সবাই বোবা যেন! কালা, অন্ধও। কিন্তু একজন প্রতিবাদবিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। সে দুর্যোধনভ্রাতা বিকর্ণ। 

আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বিকর্ণ বলল, ‘দাদা যুধিষ্ঠির বাসনাসক্ত হয়ে পাশাখেলায় মগ্ন হয়েছেন। তিনি বৌঠান দ্রৌপদীকে বাজি ধরেছেন ঠিক, কিন্তু সেই পণ ধরাতে ভুল আছে।’ 

দুঃশাসন রূঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘ভুল আছে? কী ভুল আছে বিকর্ণ?’ 

বিকর্ণ বলল, ‘দাদা যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বাজি ধরবার আগে নিজেকে বাজি ধরে হেরেছেন। হেরে তিনি কুরুদের অধীন হয়ে গেছেন। ফলে তিনি বৌঠানের ওপর অধিকার হারিয়েছেন। আমার প্রশ্ন স্বত্ববিবর্জিত একজন মানুষ কী করে বৌঠান দ্রৌপদীকে পণ ধরতে পারেন? আমার বিবেচনায় দ্রৌপদী বাজিলব্ধ নন। তিনি কখনো দাদা দুর্যোধনের দাসী হতে পারেন না।’ 

বিকর্ণের একথা শুনে কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, ‘শাস্ত্রে স্ত্রীলোকের এক স্বামীর বিধান আছে। দ্রৌপদী সেই বিধি লঙ্ঘন করে পাঁচজন স্বামীর বউ হয়েছে। একাধিক পুরুষের ভোগ্যা যে, সে তো বারবণিতাই। সুতরাং একজন বারবণিতাকে সভামধ্যে আনয়ন, বিবসনা করা মোটেই অন্যায়ের কিছু নয়।’ 

উনষাট 

‘তুমি চুপ থাক বিকর্ণ। একটি শব্দও করবে না আর।’ গর্জে উঠল দুর্যোধন। বিকর্ণের চোখমুখ দেখে মনে হলো না, দুর্যোধনের গর্জন শুনে সে ভয় পেল। তবে আর কোনো কথা বলল না সে। পিতার দিকে একবার এবং পিতামহের দিকে একবার অশ্রদ্ধার চোখে তাকিয়ে বসে পড়ল। 

দুর্যোধন এবার দ্রৌপদীকে লক্ষ করে বলল, ‘তুমি যে প্রশ্ন করলে বা ওই নষ্ট বিকর্ণটা যে প্রশ্নটা তুলল, তার উত্তর তো তোমার অন্য চার স্বামী দিতে পারে! ভীষ্ম, অর্জুন, সহদেব, নকুল- এদের যে কোনো একজন বলুক না, যুধিষ্ঠির তোমার স্বামী নয়। তার কোনো অধিকার নেই তোমাকে পণ রাখার।’ 

পাঁচ ভাইয়ের কেউই কোনো উত্তর দিল না। 

কর্ণ এবার সহাস্যে বলল, ‘তা হলে বুঝতেই পারছ দ্রৌপদী, তুমি যুধিষ্ঠিরের স্ত্রী, মানে তার অধিকারের সম্পত্তি। একজন স্বত্বাধিকারী যে কোনো সময়, যখন ইচ্ছে তার সম্পত্তি নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে। বেচারা যুধিষ্ঠিরও তা-ই করেছে। তার দোষ দিয়ে তো লাভ নেই।’ শেষ বাক্যটা বলল বিকর্ণের দিকে তাকিয়ে। 

কর্ণের কথাগুলো দুর্যোধনের মনে আগুনে ঘি ঢালার কাজ করল। দুর্যোধন সমস্ত জীবনে কোনোদিন যা করেনি, তাই করতে থাকল। সে তার বজ্রসার বাম ঊরু দ্রৌপদীকে দেখিয়ে যেতে লাগল। দুর্যোধন কোনো কামাবেগে তাড়িত হয়ে এই কাজ করতে থাকল না। তার এই লাম্পট্য-প্রদর্শনের একমাত্র কারণ পাণ্ডব আর দ্রৌপদীকে অপমানে জর্জরিত করা। 

ঝঞ্ঝাবেগে ভীম নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার অক্ষিগোলক রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। নাসিকা দিয়ে উষ্ণ হাওয়া উনপঞ্চাশ বায়ুবেগে বের হচ্ছে। শরীর ঘর্মাক্ত। কপালে স্বেদবিন্দু। কণ্ঠে গরগর আওয়াজ। 

যুধিষ্ঠিরের দিকে ডান হাত প্রসারিত করে ভীম ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘পিতার পরবর্তী স্থানটা তোমাকেই দিয়েছিলাম দাদা যুধিষ্ঠির। পিতার সান্নিধ্য তেমন করে আমরা চার ভাই পাইনি, যতটুকু সাহচর্য তোমার পেয়েছি আমরা। তুমি আমাদের কাছে পিতার তুল্য ছিলে। আজ সেই তুমি আমাদের পায়ের তলায় নেমে এলে। লোকে তোমাকে ধর্মজ্ঞ যুধিষ্ঠির বলে। তুমি নাকি ন্যায়বান, সত্যবাদী! তুমি প্রজারঞ্জক, জ্ঞাতিহিতৈষী! তোমার চরিত্রে নাকি কোনো দোষই নেই—এই কথা বারবার করে বুঝিয়েছে আমাদের, ওই কাকা বিদুর। ওই বিদুর কাকাটা আমাদের মিথ্যে বুঝিয়েছে। তুমি যে একজন জুয়াড়ি, জুয়ার নেশা যে তোমার ন্যায়-অন্যায়বোধ কেড়ে নেয়, জুয়ার নেশা যে তোমাকে অমানুষে পরিণত করে, সেই কথাটি বিদুর কাকা আমাদের কাছ থেকে অতি যত্নে লুকিয়ে রেখেছিল।’ 

এই সময় মধ্যমাগ্রজকে থামাবার চেষ্টা করল অর্জুন। অর্জুনকে হাতের ঠেলায় দূরে সরিয়ে দিল ভীম। 

আগের মতো প্রজ্বলিত কণ্ঠে আবার বলতে শুরু করল ভীম, ‘মানুষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার মনুষ্যত্ব হারিয়ে বসে, জানি। কিন্তু তোমার মতো তথাকথিত দেবতাজাতের মানুষ মনুষ্যত্ব হারালে কেন? কেন তুমি পশু হয়ে গেলে দাদা? পশুরও তো বিবেচনাবোধ আছে, তোমার সেটাও নেই।’ 

তার পর কণ্ঠে হাহাকার মেশাল ভীম, ‘ধনসম্পদ, হাতি-ঘোড়া-মণিমুক্তা-রাজ্য—সব কিছু হারালে তুমি, নিশ্চুপ থেকেছি আমরা। ভেবেছি, রাজা হিসেবে ওগুলোতে তোমারই অধিকার। এরপর বাজি ধরলে আমাদের। ভেবেছ, হাতিঘোড়ার মতো কোনো পশুই বুঝি আমরা, আমাদের নিয়ে পণ ধরাই যায়! চুপ করে থেকেছি আমরা। কোনো প্রতিবাদ করিনি। তারপর নিজেকে হারালে! এরপর কী করলে তুমি? দ্রৌপদীর মতো সতীসাধ্বীকে বাজি ধরে হারিয়ে বসলে তুমি!’ 

ভীমের শেষের বাক্যটি শুনে দুর্যোধনাদি ভাইয়েরা, কর্ণ, শকুনি এবং অন্যান্য দুর্যোধনানুরাগী রাজা-রাজন্য বিকৃত হাসিতে ফেটে পড়ল। 

সবার হট্টগোলকে ছাপিয়ে দুঃশাসনের বীভৎস কণ্ঠ শোনা গেল, ‘সতী…! সাধ্বী…! দ্রৌপদী… ‘ 

সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করল না ভীম। যুধিষ্ঠিরকে লক্ষ করে বলল, ‘তুমি যদি আমার সহোদর না হতে, তা হলে তোমাকে হত্যা করতাম আমি।’ 

ভীমের মুখে হাতচাপা দেওয়ার জন্য অর্জুন দৌড়ে কাছে পৌঁছনোর আগে ভীমের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘আমি তোমাকে ঘৃণা করি দাদা, ধিক্কার জানাই তোমাকে।’ 

এবার দুঃশাসনের দিকে ফিরল ভীম। সরোষে বলল, ‘শোন কুলাঙ্গার ধার্তরাষ্ট্র, আজ দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের চেষ্টা করে যে জঘন্য অপরাধ তুই করলি, তার জন্য তোকে সাজা পেতেই হবে।’ 

‘সাজা! হি হি হি! ও হো হো!’ বিকৃত অঙ্গভঙ্গিতে হেসে উঠল দুঃশাসন। 

ভীম তর্জনী বাগিয়ে বলল, ‘একদিন আমি তোর রক্তপান করব। তোর বুকের ওপর চড়ে, এই দুটো হাত দিয়ে তোর বুক চিরে আমি তোর রক্ত খাব। এই আমার প্রতিজ্ঞা জেনে রাখ তোরা, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা।’ 

হঠাৎ করে সভাজুড়ে পিনপতনের নিস্তব্ধতা নেমে এলো। হুল্লোড়, হট্টগোল, কদাকার দেহভঙ্গি নিমিষেই থেমে গেল। ধৃতরাষ্ট্র হা হা করে উঠল। এতক্ষণ মাথা নিচু করে থাকা বিদুর চকিত চমকে ভীমের দিকে তাকাল। তার চোখে জলের ধারা। 

এরপর দুর্যোধনের দিকে ফিরল ভীম। সভাস্থল উচ্চকিত করে ভীম বলল, ‘পাষণ্ড দুর্যোধন, আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন, তুই যে ঊরু উন্মুক্ত করে আজ আমাদের সবচাইতে সম্মানের নারীটিকে অপমান করলি, তার প্রতিশোধ নেব আমি। একদিন আমাদের হাতে সময় আসবে, সেদিন আজকের দিনের প্রতি পলের শোধ নেবে এই পঞ্চপাণ্ডব।’ 

তারপর ক্রোধে রক্তচক্ষু ঘুরিয়ে কণ্ঠে গর্জন ঢেলে ভীম উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করল, ‘যুদ্ধে যদি গদার আঘাতে আঘাতে তোর ওই ঊরু আমি চুরমার না করি, তা হলে আমি আমার পিতা- পিতামহের সঠিক বংশধর নই।’ 

ভীমের প্রতিজ্ঞাভঙ্গি, কণ্ঠের রোষ, ঘূর্ণিত চক্ষুগোলক দেখে সভার সবাই বুঝে গেলেন যে—এ বিজিতের অক্ষম আস্ফালন নয়। এ সত্যি সত্যি ক্রোধে উন্মত্ত একজন বীরপুরুষের হৃদয় নিংড়ানো প্রতিজ্ঞা। 

ভীমের বলায় এমন কঠোরতা ছিল যে সবাই ভয় পেয়ে গেল। দুর্যোধন এমন ভয় পেল যে ত্রাসযুক্ত হরিণীর মতো এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করল। সভার মধ্যে শঙ্কাটা এত গভীরভাবে ছড়িয়ে পড়ল যে প্রতি প্রত্যেকের চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। 

ঠিক ওই সময় মহামহিষী গান্ধারী এসে সভাস্থলে প্রবেশ করল। 

চোখে পট্টবস্ত্র বাঁধা গান্ধারী এতক্ষণ মজা দেখতে থাকা ধৃতরাষ্ট্রকে উদ্দেশ করে কঠোর কণ্ঠে বলে উঠল, ‘দুর্যোধন কুরুবংশের কালিমা। এই কুলাঙ্গার পাষণ্ডটা কুরুবংশধারাকে বিলুপ্তির খেলায় মগ্ন হয়েছে। বিদুর এই ছেলেটি জন্মানোর পর এমনি এমনি বলেনি একে মেরে ফেলতে। দূরদর্শিতা দিয়ে বিদুর বুঝতে পেরেছিল, এই দুর্যোধন কুলক্ষয়ের কারণ হবে। আর আপনিও মহারাজ এই অন্যায়-অধর্মের খেলায় নিজেকে আচ্ছা করে জড়িয়ে ফেলেছেন। এত বড় সাম্রাজ্য আপনার, তারপরও আপনার ভেতর থেকে ধনলোভ আর পরহিংসা বিলুপ্ত হয়নি। আপনিও ওই অসভ্য দুর্যোধন-দুঃশাসনের সঙ্গে মিলে জ্ঞাতিবিরোধে নিজেকে জড়িয়েছেন। ধিক্কার জানাই আপনাকে আমি। নিন্দা জানাচ্ছি এই সভায় উপস্থিত সভাজনদের। আপনাদের কাছে একটিই কথা আমার, কুরু-পাণ্ডবের কুলবন্ধনটি ভেঙে দেবেন না আপনারা।’ 

তারপর ধৃতরাষ্ট্রের দিকে আবার ফিরল গান্ধারী। খশখশে গলায় অনেকটা আদেশের সুরে বলল, ‘যুধিষ্ঠিরদের সকল কিছু ফিরিয়ে দিন। যে অপমানটা দ্রৌপদীকে করিয়েছেন আপনি, তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করুন। পাণ্ডুপুত্রদের মুক্তি দিয়ে সসম্মানে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।’ বলে পেছন ফিরল মহিষী গান্ধারী।  যে ধৃতরাষ্ট্র এতক্ষণ সম্পদ লুণ্ঠনের ঘোরে ছিল, সেই ধৃতরাষ্ট্র সংবিতে ফিরল। অত্যন্ত কোমল কণ্ঠে দ্রৌপদীকে কাছে ডাকল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *