দাবিদার – ২৫

পঁচিশ

ভোর হয়েছে। মাথার উপরের ছোট জানালার ফোকর দিয়ে ভেসে আসা আলোর রেখা দেখে অনুমান করল জন।

নাশতা নিয়ে হাজির হলো মার্শাল। বোবকে দিল নাশতার ট্রে। তারপর বরাবরের মত চলে গেল।

সেলের দরজার ফাঁক দিয়ে ট্রেটা জনের দিকে ঠেলে দিল বোব। ‘পেট পুরে খাও,’ বলল ঠাট্টার সুরে। ‘যতটা পারো।’

‘মার্শাল কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল জন। ‘তার সাথে আমার কথা আছে।’

‘মার্শাল? ও তো নেই।’ একটা টেবিল টেনে নিয়ে এল বোব। টেবিলে বসে হুমহাম নাশতা খেতে লাগল। কতদিন

যেন খাবার দেখেনি চোখে। খাওয়ার ফাঁকে বলল, ‘মার্শালের হঠাৎ মনে পড়েছে, শহরের বাইরে কাজ আছে তার। তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল। বলেছে, সারা দিনে আর ফিরবে না। তোমার উপর কড়া নজর রাখতে বলল। সে তো আমি রাখবই। তারপর রাত নামবে। আবার কিছু পয়সা কামানোর সুযোগ পাব।’

ধীরে সুস্থে খাচ্ছে জন।

তা হলে আজই সেই দিন।

মার্শাল শহরের বাইরে চলে গেছে নিজেকে নিষ্কলুষ রাখতে।

ওকে পাহারা দিয়ে রাখবে বোব, বার্ট সন্ধ্যার পরে এসে আরও কুড়ি ডলার দেবে বাঁদরটাকে।

ব্যস, কাজ শেষ।

গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইছে না জনের। আজ রাতে, অলৌকিক কোনও ঘটনা না ঘটলে, ফাঁসি ওর অনিবার্য।

‘জানো,’ বলে চলল বোব, ‘জেনে সত্যি আশ্চর্য হয়েছি, এ শহরের কত লোক ক্লাইড ব্রেনানকে পছন্দ করে। জীবিত অবস্থায় এতটা জনপ্রিয় ছিল না ও। অবশ্য মরার পরেই বোঝা যায়, কে কতটা জনপ্রিয়। অনেকেই দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না। ক্লাইড, কোনওই সন্দেহ নেই, বেণ্ট’স ক্রসিং-এর সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ আজকে। তোমার আসলে অন্য কাউকে মারা উচিত ছিল। তা হলে হয়তো জনতা এতটা উত্তেজিত হয়ে উঠত না। মার্কেটের সমস্ত রশি যদি আজ বিক্রি হয়ে যায়, মোটেই অবাক হব না।’

চুপ করে রইল জন। বলল না কিছুই।

‘জানো, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারার মধ্যে অন্য রকম মজা আছে,’ বকবক করেই যাচ্ছে বোব। ‘বহু লোককে ফাঁসিতে ঝুলতে দেখেছি আমি। ওরা একটা ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করবে, আর তোমাকে ঝুলিয়ে দেবে। ফাঁসির গেরো ঠিকঠাক বাঁধা হলে ঝুলিয়ে দেবার পর আসামির ঘাড়টা ভেঙে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যুবরণ করে। তবে বিনা বিচারে যাদের ফাঁসি দেয়া হয়, তাদের মরণ এত সহজে ঘটে না। অনেক সময় ফাঁসির গেরোটা পর্যন্ত তৈরি করার প্রয়োজন বোধ করে না তারা। যেন-তেন একটা ফাঁস বানায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে ছটফট করতে করতে মারা যায় আসামি। আবার অনেক সময় ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দেয়া হয় ফাঁসির আসামিকে। ফাঁসের রশি বাঁধা থাকে গাছের ডালে। ঘোড়াটাকে তাড়িয়ে দিলে শূন্যে ঝুলে পড়ে আসামি। গলায় ফাঁস এঁটে তীব্র যাতনায় হাত-পা ছুঁড়তে থাকে হতভাগা লোকটা। নীল হয়ে ওঠে গায়ের চামড়া। অনেকক্ষণ সময় লাগে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যেতে। খুবই যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু।’ মাংসের বড় একটা টুকরো মুখে ফেলে কচরমচর চিবুতে লাগল বোব। ‘আমি দেখেছি, এই প্রক্রিয়ায় দশ মিনিটও লেগে গেছে কারও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে। আর যদি সে সৌভাগ্যবান হয়, জনতা হয়তো ওর উপর টার্গেট প্র্যাকটিস করে, দ্রুত পাঠিয়ে দেয় নরকে।

তীব্র ঘৃণা নিয়ে বোবের দিকে তাকিয়ে রইল জন। ‘তা হলে ওরা আজ আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে, তা-ই না?’

‘ঝোলালে অবাক হব না,’ মাংস চিবুতে চিবুতে জবাব দিল বোব।

‘বোব,’ বলল জন, ‘তুমি কি জানো, তুমি একটা ভোঁদড়? তোমার মত নিকৃষ্ট প্রাণী জীবনে দেখিনি আমি। কেন যে তুমি দু’পায়ের বদলে চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে হাঁটছ না, বুঝতে পারছি না। তুমি বরং প্রার্থনা করো, যাতে ওরা আজই ঝুলিয়ে দেয় আমাকে। যদি না ঝোলায়, আর কোনও ভাবে আমি যদি মুক্তি পেয়ে যাই, প্রথম সুযোগেই তোমাকে বুটের তলে সাপ পিষে মারার মত মারব।’

খ্যাক-খ্যাক হেসে উঠল বোব। ‘যতই বাজে কথা বলো, লাভ হবে না। মাথা গরম করে তোমার উপর আর চড়াও হচ্ছি না আমি। এখন তোমাকে মেরে ফেললে মিস্টার অ্যান্ড্রিউর সাথে বেঈমানি করা হবে। তা আমি করব না। তবে একটা কথা বলি, শোনো-ওরা যখন তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে, আমিও ওদের সাথে হাত মেলাব।’

জনের দিকে পিছন ফিরে বসল সে। চেটেপুটে সাফ করতে লাগল প্লেট।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও খাবারটুকু পেটে চালান করল জন। খাবার খেলে শক্তি হবে শরীরে।

কেউ ওকে বিনা বাধায় এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারবে না, কোনও ভাবেই না।

সিধে হলো রোব। হাতের চেটো দিয়ে মুছে নিল মুখ। তারপর প্লেট আর কাপ তুলে নিল হাতে।

এমন সময় ঠাস করে খুলে গেল মার্শালের অফিসের দরজা।

ঝট করে বাসন-কোসন নামিয়ে রেখে শটগানের দিকে হাত বাড়াল বোব। হঠাৎই শরীরের পেশিতে ঢিল পড়ল তার। ‘অহ, তুমি! কেমন আছ, পিটার?’

‘মর্নিং, বোব। ঠিক মত আটকে রেখেছ তো ব্যাটাকে?’

‘একদম।’

‘গুড। রাত আসুক, তারপর ব্যাটা বুঝবে, সার্কেল ইউ-র লোককে পিছন থেকে গুলি করে মারার পরিণাম কী ভয়ঙ্কর হতে পারে।’

পিটারের গলা শুনে উঠে দাঁড়িয়েছিল জন। সেলের দরজার সামনে এসে লোহার গরাদ চেপে ধরল মুষ্টিতে।

ক্ষীণ একটা আশা জেগে উঠেছিল মনে। কিন্তু পিটারের কথা শুনে আশার আলোটা নিভে গেল দপ করে।

ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে না। তবে কথা শোনা যাচ্ছে পরিষ্কার।

‘আমি আর বার্ট—দু’জনেই ওর উপর যার-পর-নাই বিরক্ত,’ বলল পিটার, ‘সে আমাদের খামারে তার দাবি আছে বলে একটা আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে বসে এমনিতেই অন্যায় করেছে। আর যখন আমাদের গরু চুরি করে আমাদেরই লোককে গুলি করে মেরে ফেলল, তখন ওর উপর থেকে সমস্ত সহানুভূতি চলে গেছে। ওর উপর নজর রাখার জন্য তোমাকে কত টাকা দিচ্ছে বার্ট?’

‘মিস্টার অ্যান্ড্রিউ আমাকে কুড়ি ডলার দিয়েছে। পরে আরও বিশ ডলার দেবে বলেছে।’

‘বেশ। এটা আমার তরফ থেকে।’ বিশটা ডলার বাড়িয়ে ধরল পিটার। ‘নাও।’

দারুণ মন খারাপ করে দরজার সামনে থেকে চলে এল জন।

খুব ভাল ভাবেই পিটারের ব্রেন ওয়াশ করেছে বার্ট।

ছেলেটা এখন তাকে সৎ-ভাই হিসেবে পরিচয় দিতেও রাজি নয়, সার্কেল ইউ-তে যে জনের ন্যায্য অধিকার রয়েছে, তাও মানছে না।

কিন্তু এর শোধ নেয়ার কোনওই সুযোগ নেই জনের।

‘সে তোমার দয়া, মিস্টার উইলিয়ামস। আমি তো সব সময়ই বলি সার্কেল ইউ-র মত চমৎকার আউটফিট দ্বিতীয়টি চোখে পড়েনি আমার। তোমরা তোমাদের কর্মচারীদের উপর অনেক খেয়াল রাখো।’

‘তা তো রাখিই।’

পিটারকে এবার দেখতে পেল জন।

বোব যে টেবিলে নাশতা খেয়েছে, তার উপর উঠে বসেছে ছেলেটা। কফিপটটা তুলে নিয়ে ঝাঁকাল। ‘কফি নেই আর?’

‘দুঃখিত। মাত্রই শেষ হয়ে গেল।’

‘অসুবিধে নেই। তুমি একটু কষ্ট করে রাস্তার ওপাশের দোকান থেকে কফি নিয়ে আসবে আমার জন্য? আমি এখনও নাশতা করিনি। ভাবলাম, এসে একবার দেখে যাই, পাখিটা আছে, নাকি উড়ে গেছে।’

বোব ইতস্তত গলায় বলল, ‘কিন্তু আমার উপর হুকুম রয়েছে…

পিটার রায়ট গানটা তুলে নিল। হ্যামার টেনে তাক করে ধরল সেলের দিকে। ‘গতকাল আমরাই ওকে ধরে এনেছি। কিছুতেই পালাতে পারবে না ও।’

‘ঠিক আছে,’ বলল বোব। ‘তুমি ছাড়া যদি অন্য কেউ হত-আচ্ছা, আমি তিন মিনিটের মধ্যে আসছি।’ কফিপটটা নিয়ে রওনা হয়ে গেল সে।

দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বোব, জনের দিকে তাকিয়ে ভিলেনের হাসি দিল পিটার। ‘কি, ভাল ঘুম হয়েছিল তো রাতে?’

‘ক্লাইড ব্রেনানকে খুন করিনি আমি,’ সিধে হতে হতে বলল জন। ‘আর কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক, তুমি অন্তত -’

দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল বোব।

সঙ্গে সঙ্গে টেবিল থেকে লাফ মেরে নেমে পড়ল পিটার। শটগানের হ্যামার নামাল। ‘আমি জানি না, আমার কী বিশ্বাস করা উচিত,’ দ্রুত গলায় বলল সে, কাঁপছে কণ্ঠ। ‘আমি শুধু এটুকু জানি-আজ ওরা তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে। গত রাতে বার্ট গোটা রানশে রটিয়ে দিয়েছে, তুমি কাপুরুষের মত ব্রেনানকে পিছন থেকে গুলি করে হত্যা করেছ। সে এখন নেকটাই পার্টির জন্য লোকজন জড়ো করতে ব্যস্ত।’

‘আমাকে ফাঁসিতে ঝুলতে দেখলে তুমি খুশি হবে?’ মৃদু গলায় জানতে চাইল জন।

সেলের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল পিটার। ‘আমি তোমাকে ধরে এনেছিলাম এই সন্দেহে যে, তুমি আমাদের একজন লোককে খুন করেছ। কিন্তু আশা করেছিলাম, বিচার হবে তোমার, এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবে তুমি। কল্পনাই করিনি, পরদিনই ফাঁসিতে ঝোলাতে চাইবে তোমাকে।’

হঠাৎ নিজের শার্টের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিল পিটার। ‘এই নাও,’ জুলিয়ার গোল্ডপ্লেটেড কোল্টটা নিয়ে এসেছে ও। ‘ছয় রাউণ্ড গুলি ভরা আছে এর মধ্যে।’

পিস্তলটা নিয়ে শার্টের ভিতরে গুঁজে রাখল জন।

শীতল ইস্পাতের স্পর্শ শান্তির পরশ বুলাল দেহে।

অবশেষে একটা সুযোগ পাওয়া গেছে—গোটা শহরের বিরুদ্ধে মাত্র ছ’টা কার্তুজ। তবু সুযোগ তো বটে।

শরীরে উষ্ণতা অনুভব করল জন। ‘পিটার,’ বলল ও। ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।’

ওর চোখে চোখ রাখল পিটার। ‘ধন্যবাদ আমাকে দিয়ো না,’ শান্ত গলায় বলল। ‘মরিস উইলিয়ামসকে দাও। তুমি তার ছেলে হতে পারো, না-ও হতে পারো। কিন্তু আমি কোনও ঝুঁকি নিতে চাই না।’ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল সে। ‘শুধু একটাই অনুরোধ-এখান থেকে চলে যাও। আর কখনও ফিরে এসো না!’

‘হয়তো ফিরব। হয়তো ফিরব না। কোনও রকম প্রতিশ্রুতি দিতে পারছি না তোমাকে।’

জন আর পিটার একে অন্যের দিকে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। দু’জনের চেহারাতেই বিষণ্নতার ছাপ।

তারপর বেড়ালের মত এক লাফে টেবিলের উপর উঠে পড়ল পিটার, আবার টানল শটগানের হ্যামার।

‘ওয়েল,’ খেঁকিয়ে উঠল সে। ‘একটা ব্যাপার নিশ্চিত জেনো-তুমি আর সার্কেল ইউ-তে কোনও ঝামেলা পাকাতে পারবে না।’

ওর মুখ থেকে কথাগুলো মাত্র বেরিয়েছে, ঝপাং করে অফিসের দরজা খুলে গেল। মেঝেয় শোনা গেল বোবের বুটের আওয়াজ।

‘সব ঠিক আছে তো?’ কফিপট হাতে দেখা গেল তাকে। ধোঁয়া ওঠা পট আর একটা কাপ নামিয়ে রাখল টেবিলের উপর।

‘সব ঠিক আছে,’ বলল পিটার। রায়ট গানের হ্যামার নামিয়ে ফিরিয়ে দিল ওটা বোবকে। ‘আবার ও তোমার বন্দি।

‘বেশিক্ষণের জন্য নয়।’ হাসল বোব। ‘এ শহর তো এখন ভিমরুলের চাক হয়ে আছে। আর এক ঘণ্টা পর আমাদের কারোরই ওর উপর নজর রাখার দরকার পড়বে না।’

‘যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই ভাল,’ কাপে কফি ঢালতে ঢালতে বলল পিটার। জিভ পোড়ানো তরল পদার্থটা এক ঢোকে শেষ করে কাপটা নামিয়ে রাখল টেবিলে। ‘শোনো, বোব, যদি কখনও জেলের চাকরিটা ছেড়ে দাও, সোজা সার্কেল ইউ-তে চলে এসো। তোমার মত লোকের জন্য আমাদের দরজা সব সময় খোলা।’

‘ধন্যবাদ।’ হে-হে করে হাসল নরবানর। ‘তবে কোনও কয়েদির উপর নজর রেখে যদি দিনে ষাট ডলার কামাই করা যায়, সেই চাকরিটাই বেশি লাভজনক নয় কি?’

ছাব্বিশ

সেলের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে জন। ধড়াস-ধড়াস করছে কলজে।

জনতাকে তা হলে সংগঠিত করা হচ্ছে!

একদমই সময় নেই হাতে।

কোনও বুদ্ধিও আসছে না মাথায়।

বোবের দিকে তাকাল জন।

ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে লোকটা কফিপটের দিকে। ‘আশ্চর্য! কফি আনতে পাঠাল আমাকে, অথচ এক কাপ কফিও ঠিক মত খেল না!’

বুক ভরে দম নিল জন। ‘এক কাপ দেবে আমাকে?’

শয়তানি হাসি হাসল বোব। ‘যদি না জানতাম, এক ঘণ্টার বেশি নেই তোমার আয়ু, আমার বগলের ঘামও চাটতে দিতাম না তোমাকে। কিন্তু ওরা তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় যেন অভিযোগ করতে না পারো যে, এক কাপ কফি চেয়েও পাওনি, সেজন্য শুধু কাপ নয়, পুরো কফিপটটাই তোমাকে দিয়ে দিলাম।’

এক হাতে শটগান ধরে রেখে আরেক হাতে কফিপট নিয়ে সেলের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল বোব। জনের দিকে বন্দুক তাক করে রেখে সেলের তালা খুলল। তারপর ঝুঁকে তুলে নিল পটটা। অল্প খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে সেটা এগিয়ে দিল জনের দিকে। ‘এই নাও।’

পটের দিকে হাত বাড়াল জন। তারপর হঠাৎ এক হাতের তালু ঢুকিয়ে সজোরে ঠেলা মারল পটের নীচে।

ঠেলার চোটে পটের ঢাকনি খুলে গিয়ে গরম কফি চলকে পড়ল বোবের চোখে-মুখে।

হাত থেকে কফিপট ফেলে দিল লোকটা। থাবা দিয়ে ঢাকল চোখ। যন্ত্রণায় চেঁচাতে চেঁচাতে পিছু হটল।

ওর ‘অন্ধত্বের’ সময়টুকুর সদ্ব্যবহার

সদ্ব্যবহার করল জন। বিদ্যুদ্গতিতে ঝাঁপ দিল সেলের দরজা লক্ষ্য করে। চোখের পলকে বেরিয়ে এল কারাপ্রকোষ্ঠ থেকে। শার্টের ভিতর থেকে বের করে ফেলেছে পিস্তলটা।

বোবের মোটা কবজিতে পিস্তলের বাঁট দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করল জন।

হাড় ভাঙার গা গোলানো শব্দের সঙ্গে শটগানটা ছিটকে পড়ল লোকটার হাত থেকে। ব্যথায় হাউমাউ করে উঠল সে। হাত বাড়াল পিস্তলের দিকে। কিন্তু গরম কফি চোখে ঢুকে যাওয়ায় এখনও কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না।

পিস্তলের কাছে তার হাত পৌঁছানোর আগেই নিজের অস্ত্রটা আবার উঁচু করে ধরল জন। সবেগে নামিয়ে আনল ঘন চুলে ঢাকা বোবের খুলির উপর।

পিস্তল বের করার আর সুযোগ হলো না বোবের। বিকট আর্তনাদ বেরিয়ে এল ওর গলা দিয়ে। নাক দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে এল রক্ত।

চার হাত-পা ছড়িয়ে মেঝের উপর ব্যাঙের মত উপুড় হয়ে পড়ল বোব। একদম ঠাণ্ডা।

হাঁপাচ্ছে জন। উত্তেজনায় অল্প-অল্প কাঁপছে। ঝুঁকল সে। বোবের গানবেল্ট খুলে নিল কোমর থেকে। বেল্ট থেকে খুলে নিয়ে ওয়েস্টব্যাণ্ডে গুঁজল কোল্ট পিস্তলটা। তারপর বেল্টটা কোমরে জড়িয়ে সোনালি পিস্তলটা সেঁধিয়ে দিল হোলস্টারে।

এখনও নিঃশ্বাস নিচ্ছে বোব, বেঁচে আছে। তবে যে মারটা খেয়েছে, সুস্থ হতে বহু দিন লাগবে ব্যাটার।

খুশি মনে অফিসের দরজার দিকে পা বাড়াল জন। ফ্রন্ট ডোরের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল

কাছেই একটা হিচর‍্যাক চোখে পড়ল। তাতে স্যাডল সহ দুটো ঘোড়া বাঁধা।

এর মধ্যে একটা সরেল। পাছায় সার্কেল ইউ-র ছাপ। ভাবল জন, পিটারই হয়তো ওর জন্য রেখে গেছে ঘোড়াটা।

জলদি ভাগতে হবে এখন। তবে খুব বেশি তাড়াহুড়ো করা যাবে না।

দরজাটা হাট করে খুলল ও। নেমে এল সাইডওঅকে। কয়েক কদম পরেই হিচর‍্যাক।

আলাদা করে বাঁধা লাগাম। সহজেই খুলে নিল জন। ঘোড়ার পিঠে উঠে বসা পর্যন্ত পুরো কাজটা করল ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে, যদিও রাস্তার মাথায় বিশ-তিরিশজন লোকের একটা জটলা লক্ষ করছে।

জোরে-জোরে কথা বলছে লোকগুলো। মন্থর গতিতে হেঁটে আসছে মার্শালের অফিসের দিকে।

একজনের হাতে কুণ্ডলী পাকানো রশি।

অবশ্য একদিক থেকে ওর পলায়ন সহজই করে দিয়েছে লোকগুলো। রাস্তা প্রায় ফাঁকা।

স্যাডলে উঠে বসল জন। সরেলটার মুখ ঘুরিয়ে নিল রাস্তার দিকে। তারপর স্পার দিয়ে গুঁতো মারল ঘোড়ার পেটে।

এমন সময় ওকে দেখে ফেলল ওরা। সরেল দৌড় শুরু করেছে, সমবেত জনতার মাঝ থেকে কে একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরি, ওই দেখো, কে যায়!’

আরেকজন গলা ফাটল, ‘ওটা তো জন! পালাচ্ছে ব্যাটা!’

রাস্তা ধরে তীর বেগে ছুটে সরেল।

ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনটা দেখে নেয়ার ঝুঁকি নিয়ে ফেলল জন। পিছনের লোকগুলো ঘোড়ার জন্য ছোটাছুটি করছে। বন্দুক নিয়েও এসেছে কেউ-কেউ।

ঘোড়ার পিঠে কুঁজো হলো জন। লাগাম দিয়ে জোরে বাড়ি মারল জানোয়ারটাকে।

সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের গুলির শব্দ শোনা গেল। ওর মাথার উপর দিয়ে বাতাসে শিস কেটে বেরিয়ে গেল বুলেট।

রাস্তার মাথায় চলে এসেছে জন, সরেলটাকে চট করে তির্যক ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে দিল দালানকোঠার আড়ালে।

উন্মত্ত জনতা আর ওর মাঝখানে এখন প্রাচীর সৃষ্টি করেছে কয়েকটা দালান।

অবশ্য একটু পরেই ঘর-বাড়ির আড়াল থেকে আবার খোলা রাস্তায় উঠে এল ঘোড়াটা।

পিছন ফিরে দেখল জন, জনতা এবার ঘোড়ায় চেপে ধাওয়া শুরু করেছে। খুব একটা দূরে সরতে পারেনি ওদের কাছ থেকে। এখন ওর বাঁচা-মরা সম্পূর্ণটাই নির্ভর করছে সরেলের গতি আর শক্তির উপর।

সাতাশ

জন এখন নিশ্চিত, পিটারই ঘোড়াটা ওখানে রেখে গিয়েছিল।

নইলে ভাগ্য ওকে এতটা সহায়তা করত না।

ওর আর ধাওয়াকারীদের মাঝে দূরত্ব ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাঝে মাঝেই ওরা জনকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। যদিও সেগুলো ওর ধারে-কাছেও পৌঁছাচ্ছে না।

চলন্ত অবস্থায় গুলি ছুঁড়ে অভ্যস্ত নয় ওদের কেউই।

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। সরেলটা যখন জনকে সিক্সগানের আওতার বাইরে নিয়ে এল, ঘোড়া থামিয়ে গুলি করার বুদ্ধিটা এল কারও মাথায়।

সাঁ করে একটা বুলেট চলে গেল জনের মাথার পাশ দিয়ে। পিছন ফিরে তাকাল জন।

দুই ধাওয়াকারী ঘোড়া থেকে নেমে পড়েছে। হাঁটু ভাঁজ করে ওকে টার্গেট করার চেষ্টা করছে কারবাইন দিয়ে।

ঝট করে সরেলটাকে ঘুরিয়ে নিল জন। তারপর এঁকেবেঁকে দৌড় করাতে লাগল। এতে দৌড়ের গতি কমে এলেও রক্ষা পেল গুলির কবল থেকে। বুলেটগুলো ছুটে এলেও মিস করল টার্গেট।

পাহাড়ে যেতে হবে ওকে। ঢুকতে হবে ব্যাডল্যাণ্ডসে। এ ছাড়া লোকগুলোকে খসানোর কোনও রাস্তা নেই।

জনের স্যাডলে কোনও কারবাইন নেই। একটা মাত্র সিক্সগান দিয়ে ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না সে।

তীরগতিতে ছুটছে সরেল।

জনতা এখনও পিছু ছাড়েনি। তবে পিছিয়ে পড়ছে ক্রমেই।

নীলচে পর্বতমালা ফুটে উঠল জনের সামনে।

পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল সরেল।

পাইন বনের একটা খাড়া ঢাল বেছে নিল ও কভারের জন্য। এখানে এসে ঘোড়াটাকে দাঁড় করাল ও, দম নেয়ার সুযোগ দিল। তারপর সোনালি পিস্তলটা বের করে পর-পর তিন রাউণ্ড গুলিবর্ষণ করল অনুসরণকারীদের লক্ষ্য করে। লোকগুলোকে হত্যা করার কোনও ইচ্ছা নেই জনের, স্রেফ ভয় দেখাতে চাইছে, যাতে ওদের গতি মন্থর হয়ে আসে।

ওর ছোঁড়া গুলি লেগেছে একটা ঘোড়ার গায়ে।

লাফ মেরে উঠে সওয়ারিকে পিঠ থেকে ফেলে দিল জানোয়ারটা।

ধাওয়াকারীরা কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে পড়ল। লাগাম টেনে দাঁড় করাল যার-যার ঘোড়া।

গুলিবিদ্ধ ঘোড়াটা পাগলের মত লাফালাফি করছে।

সামনে আর এগোতে পারছে না ওরা।

সুযোগটা কাজে লাগাল জন। সরেলের পেটে জোর গুঁতো দিল।

ঢাল বেয়ে এগোতে লাগল প্রাণীটা।

চুড়োয় উঠে বেদম হাঁপাতে লাগল ঘোড়া।

কিন্তু ওটাকে কোনও দয়া দেখাল না জন। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল সে এবার। লক্ষ্য: নীচের একটা পাথুরে ড্র। ওটা চেনে সে। গোটা ফ্লেচার’স হোলই এখন ওর হাতের তালুর মত চেনা হয়ে গেছে।

ওই ড্র ধরে এগিয়ে গেলে এবড়োখেবড়ো জমিনে পৌঁছবে। জায়গাটা লোকচক্ষুর অন্তরালে।

ওর বিরুদ্ধে চিরুনি-অভিযান চালানোর সম্ভাবনা কম। গ্রে হাউণ্ড যেমন কয়োটির পিছনে লেগে থাকে, ওর পিছে তেমনি ওরা লেগে থাকবে বলে মনে করে না জন। কারণ, অত্যন্ত দুর্গম এ এলাকার প্রতিটি বাঁক আর মোড়ে চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হওয়ার ভয় রয়েছে অনুসরণকারীদের। এত বড় ঝুঁকির মধ্যে ওরা যাবে না বলেই ধারণা জনের।

লোকগুলো এখনও ওর পিছে-পিছে আসছে রিজ ধরে।

তাদের হই-হট্টগোল শুনতে পাচ্ছে জন। ও এখন ঝোপঝাড় মাড়িয়ে যাচ্ছে।

ঝোপগুলো ওর পিছনে মোটা একটা পর্দা তৈরি করছে। মুখে বাড়ি মারছে ডালপালা, কাঁটাঝোপ থাবা দিচ্ছে গালে।

একটা হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছে জন। চামড়ায় কাঁটার আঁচড় আর ডালের গুঁতো খেয়েই ছুটতে হচ্ছে ওকে।

একটা সময় বুঝতে পারল, অনুসরণকারীদের আর ওকে দেখে ফেলার ভয় নেই।

ক্ষুদ্রাকৃতির একটা ড্রতে মোড় নিল ও।

ক্লান্ত সরেল এগিয়ে চলল পাথরের উপর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে।

বাঁক নিল জন। অসংখ্য ড্র আর গিরিখাতের গোলকধাঁধার মাঝ দিয়ে চলে ঢুকে পড়ল সরু এক ক্যানিয়নে।

এই ক্যানিয়ন ওকে পৌঁছে দেবে নদীর ধারের প্রকৃত ব্যাডল্যাণ্ডসের কাছে।

ওখানে গিয়ে ঘোড়াটাকে পানি খাওয়াতে পারবে ও। ঘোড়াটা হাঁপাচ্ছে। ফুলে-ফুলে উঠছে নাকের পাটা। সরেলের পিঠ থেকে নেমে পড়ল জন। একটা পাথরের সঙ্গে লাগাম বেঁধে নিয়ে পায়ে হেঁটে এগোল ক্যানিয়নের গা বেয়ে। খানিকটা এগিয়ে খাড়া করল কান।

নাহ, ধাওয়াকারীদের কোনও সাড়াশব্দ নেই।

তবে ও জানে, বার্ট অ্যান্ড্রিউ সহজে হাল ছাড়বার পাত্র নয়। সে জনের খোঁজে প্রত্যেকটা লোককে লেলিয়ে দেবে। পাগলা নেকড়ের পিছনে শিকারির ধাওয়া করার মত গোটা এলাকা চষে বেড়াবে ওরা।

টম ফোর্ডের কাছে যাওয়া ছাড়া এ মুহূর্তে অন্য কোনও রাস্তা নেই!

আটাশ

ফোর্ডের এলাকায় চলে এসেছে জন উইলিয়ামস। ঘোড়া চালাচ্ছে ধীর গতিতে। সতর্ক ভঙ্গি। চেহারা চিন্তিত।

ফোর্ডের কাছ থেকে সে লাল গালিচা সংবর্ধনা আশা করছে না। বিশেষ করে, যে মানুষটি ক্লাইড ব্রেনানকে হত্যা করে ওকে ডাবল-ক্রস করেছে, তার কাছ থেকে তো উষ্ণ অভ্যর্থনার চিন্তাই করা যায় না

ফোর্ডের রানশে পৌঁছে গেল ও কোনও বাধা ছাড়াই। সমতল ভূমিতে ঘাস খাচ্ছে গবাদি পশুর দল।

এ গরুগুলো একসময় সার্কেল ইউ-র ছিল। কিন্তু এখন

ডাবল ডায়মণ্ড ব্র্যাণ্ড বহন করছে শরীরে। খুরের উপর হিরের ছাপের দাগ এখনও শুকোয়নি। দগদগ করছে ঘা।

ওরা ওকে আসতে দেখল।

লম্বা কাঠের লগ বিল্ডিং-এর সামনে এসে থামল জন। নামল। ফোর্ডকে দেখল-দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়।

পিছনে জনাকয়েক লোক।

‘কী খবর, জন?’ তালঢ্যাঙা রাসলার জিজ্ঞেস করল। ‘এখানে কী মনে করে?’

‘তোমার সাথে কথা আছে,’ জবাব দিল জন। ‘আমার ঘোড়াটাকে একটু দানাপানি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করো।’

‘ম্যাক,’ ডাকল ফোর্ড। মাথা ঝাঁকিয়ে ইশারা করতেই এক লোক এগিয়ে এসে সরেলটার লাগাম ধরে টেনে নিয়ে গেল কোরালের দিকে।

জনের দিকে দৃষ্টি ফেরাল ফোর্ড। ‘অনেক চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে এসেছ মনে হচ্ছে।’

‘আসতে হয়েছে। বেণ্ট’স ক্রসিং-এর জেল ভেঙে পালিয়েছি।’

শরীর শক্ত হয়ে গেল ফোর্ডের। ‘কী করেছ?’

‘কিছুই না।’

ওকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়ার জন্য একপাশে সরে দাঁড়াল ফোর্ড। তারপর পিছন-পিছন এগোল।

ওর লোকেরা ঠায় তাকিয়ে আছে জনের দিকে।

‘ধারণা করছি,’ ধীরে বলল জন, ‘সার্কেল ইউ-র লোকটাকে সেরাতে তোমরা ছেড়ে দেয়ার পরে কেউ ওকে হত্যা করেছে। পিছন থেকে গুলি। রেঞ্জের ধারে ফেলে রাখা হয়েছিল লাশ, যাতে সহজেই চোখে পড়ে। ওই খুনের দায় আমার উপর চাপিয়ে দিয়ে আমাকে গ্রেফতার করেছিল মার্শাল। শহরের কিছু লোক মিলে ফাঁসিতে ঝোলাবার মতলব করছিল আমাকে। তার আগেই জেল ভেঙে পালিয়েছি।’

‘তুমি কি বলতে চাইছ, আমাদেরই কেউ গুলি করেছে?’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল টম।

‘তা-ই বললাম নাকি?’ ধমকে উঠল জন। ‘চুপচাপ বসে আছি স্যালুনে, এমন সময় সেখানে ঢুকল বার্ট আর মার্শাল।’

‘আই সি।’ একটা টেবিলে গিয়ে বসল ফোর্ড। মদের একটা বোতলের ছিপি খুলল। ‘এখানে এসে বসো। পান করতে করতে কথা বলি।’

ফোর্ডের মুখোমুখি বসল জন, তবে টেবিলের নীচে পা রাখল না। বসেছে দেয়ালের দিকে পিঠ করে।

ফোর্ড ওর দিকে বোতলটা ঠেলে দিল।

ঢকঢক করে মদ গিলল জন।

ভয়ানক পরিশ্রান্ত সে। তরলটা ওর ক্লান্তি কিছুটা হলেও লাঘব করল।

ফোর্ড গ্লাসে মদ ঢেলে দিতে চাইলে মাথা নেড়ে মানা করল জন। আর খাবে না।

‘ঠিক আছে,’ কিছুক্ষণ বিরতির পর বলল ফোর্ড। ‘সত্যি কথাটাই বলি। আমিই জোকে পাঠিয়েছিলাম ওই লোকের মুখটা চিরতরে বন্ধ করে দিতে।’ শীতল চোখের চাউনি স্থির হয়ে আছে জনের চোখে। ‘জো যখন লোকটার নাগাল পায়, ততক্ষণে সে সার্কেল ইউ-র এলাকায় ঢুকে পড়েছে। তখন আর ওকে লুকিয়ে ফেলার সময় ছিল না।’

‘আমি কিন্তু এটা একদমই চাইনি,’ কর্কশ শোনাল জনের গলা।

ফোর্ড দীর্ঘশ্বাসের মত শব্দ করে বাতাস টানল। ‘জন, একটা ব্যাপার আমাদের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত। প্রস্তাবটা তুমিই এনেছিলে, প্ল্যান-প্রোগ্রামও সব তোমার, আর পরিকল্পনা মাফিক ভাল কাজও দেখিয়েছ। কিন্তু গরুর পাল কীভাবে খেদিয়ে আনতে হয়, সে ব্যাপারে তুমি কিছুই জানো না, একদম অ্যামেচার। আর আমি একজন প্রফেশনাল। নিজের কাজ বুঝি। আমার কাজের মূল নীতি হচ্ছে: অপারেশনের সামান্যতম তথ্যও যেন বাইরের কেউ না জানে। সেরাতে আমি তোমার সাথে সংঘর্ষে জড়াতে চাইনি, কারণ তোমাকে আমি পছন্দ করি। তুমি চমৎকার একজন মানুষ। ওই ব্যাটা ছাড়া পেলে সব কথা চাউর করে দিত। এ ঝুঁকি আমি নিতে পারি না। সেজন্য ওর মুখ বন্ধ করতে হয়েছে। এ ব্যবসায় দয়া-মায়া দেখিয়েছ কি মরেছ।’

চুপ করে রইল জন।

‘তুমি এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছ,’ আবার বলল ফোর্ড। ‘সেদিন যদি আমাকে আমার মত কাজ করতে দিতে, তা হলে তোমার এ দশা হত না।’ ড্রিঙ্ক ঢেলে নিল সে। ‘পরের বার আমার উপরে একটু আস্থা রেখো।’

‘সেই সময় আর কখনও আসবে না,’ বলল জন।

শিরদাঁড়া টান-টান হয়ে গেল ফোর্ডের। ‘মানে?’

‘মানে হলো, আমার যা দরকার, তা পেয়ে গেছি।’

ফোর্ডের ভুরু কুঞ্চিত হলো। ‘আমার পাইপলাইন কিন্তু এখনও পূর্ণ হয়নি। আরও দুই-তিন শ’ গরু খুব সহজেই নিয়ে আসতে পারব।’

‘সংঘর্ষ ছাড়া ওগুলো তুমি আর আনতে পারবে না,’ বলল জন। ‘ফ্লেচার’স হোল এখন বোলতার বাসায় পরিণত হয়েছে। প্রতিটা গরুর জন্য রক্তাক্ত মূল্য দিতে হবে তোমাকে। অথবা রক্ত ঝরবে অন্য কারও।’

এক মুহূর্ত নীরব রইল ফোর্ড। ‘তুমি তা হলে বার্ট অ্যান্ড্রিউর সাথে আর যুদ্ধ করতে চাইছ না?’, বলল সে অবশেষে। ‘ভয় পেয়েছ?’

‘শোনো,’ ঝাঁঝিয়ে উঠল জন। ‘আমি এর মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিলাম, কারণ অধিকারবলে সার্কেল ইউ-র এক- তৃতীয়াংশের মালিক আমি। আমার ভাগের জিনিস নিয়ে আসার জন্য তোমাকে ভাড়া করেছিলাম। একে আমি চুরি বলব না। কাজটা ভুল ছিল, তাও বলব না। কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় যখন কাউকে পিছন থেকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়, কিংবা শুয়োরের মত জবাই করার কথা ওঠে-’

‘তখন তোমার মনটা নরম হয়ে যায়,’ ওর কথা শেষ করে দিল ফোর্ড।

‘তখন আমি ঘটনার রাশ টেনে ধরি,’ মসৃণ গলায় বলল জন। ‘কাজেই, এখন আমাদের থামতে হবে। আর কেউ খুন হয়ে যাওয়ার আগেই।’

‘আমার ছেলেরা ডরপোক নয়।’

কান দিল না জন। ‘এ পর্যন্ত ভাগ্য আমাকে সহায়তা করেছে। তিন শ’ গরু, দামও ভাল-তিন হাজার ডলার। আর ব্রেনান ছাড়া কেউ হতাহতও হয়নি। ব্রেনানের মৃত্যুর জন্যও আমি দায়ী নই। চেয়েছিলাম, কিছু টাকা জোগাড় করে আদালতে মামলা লড়ব, আর আমার ভাগের অংশটা পেয়ে যাব। তখন কেউ আর সেটা কেড়ে নিতে পারত না। কিন্তু তুমি আমার সে সুযোগ নষ্ট করে দিয়েছ। তুমি এর মধ্যে খুনখারাবি ঢুকিয়েছ, যার কারণে আমি এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কাউকে মুখ দেখানোর জো নেই। আদালতে মামলা করা দূরে থাক। কাজেই, অপারেশন এখানেই খতম।’

দীর্ঘক্ষণ জনের দিকে তাকিয়ে থাকল ফোর্ড। তারপর কাঁধ ঝাঁকাল। ‘ঠিক আছে, তুমি যা বলো। তা, কী করবে এখন?’

স্বস্তি অনুভব করল জন। ও ভাবেইনি, এত সহজে রাজি হয়ে যাবে ফোর্ড।

‘ভাবিনি এখনও,’ বলল ও।

চাইলে আমাদের সাথে যোগ দিতে পারো,’ প্রস্তাব দিল ফোর্ড। ‘এদিকে, দক্ষিণে একটা বেসিন আছে। ওখানে ঢু দেয়ার ইচ্ছা ছিল। অপারেশন চালানোর এখনই উপযুক্ত সময়।’

‘না, ধন্যবাদ। ঠোঁট কামড়াল জন। ‘তুমি তো বললেই, আমি একজন অ্যামেচার। তা-ই থাকতে চাই।’

‘তা হলে কী করবে?’ পালিয়ে বেড়াবে এভাবে? তোমার ভাগের অঙ্ক অ্যান্ড্রিউকে ভোগ করতে দেবে?’

সিধে হলো জন। ‘না, তাও করব না,’ ওর কণ্ঠ কর্কশ আর তিক্ত। ‘অ্যান্ড্রিউর সাথে আমার লড়াই এখনও শেষ হয়নি। ওর কাছে আমার একটা পাওনা আছে। ওই দেনা শোধ না হওয়া পর্যন্ত লড়াইয়ের অবসান হবেও না। অ্যান্ড্রিউ আমাকে যে নরকযন্ত্রণা দিয়েছে, ওকে তার কয়েক গুণ বেশি যন্ত্রণা না দিয়ে রেঞ্জ ছাড়ছি না আমি।’

‘কাজটা কি তুমি একা করবে?’

‘হ্যাঁ। একা,’ জনের কণ্ঠে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।

.

কিছু জিনিসপত্র দরকার ছিল জনের। ফোর্ডের কাছ থেকে পেয়ে গেল সব। খাবার। সিক্সগানের জন্য অতিরিক্ত কার্তুজ। শেল আর খাপ সহ একটা কারবাইন। কম্বল। লোকটাকে বেশ বন্ধুবৎসল মনে হচ্ছে।

‘তোমাকে তো বললামই,’ জনকে বলল ফোর্ড, ‘আমি একজন বিজনেসম্যান। তোমার ভাগের টাকাটা যখনই আমার হাতে চলে আসবে, জানিয়ে দেব তোমাকে।’ সার্কেল ইউ রেঞ্জের পিছনে, পাহাড়ের মধ্যে একটা গাছের ফোকরকে ওরা পোস্ট অফিস হিসেবে ব্যবহার করবে। ‘এর মধ্যে যদি আর কিছুর দরকার হয়, জানিয়ো আমাকে।’

‘জানাব।’

ঊনত্রিশ

ফোর্ডের আউটফিট আর তার কাছ থেকে দূরে সরে পড়তে পারছে বলে মনে মনে খুশি জন। এদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর থেকে নিজেকে অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা লাগছিল। পরিস্থিতিই হয়তো এরকম অনুভূতির জন্য দায়ী।

ভাবল জন, মরিস উইলিয়ামস যদি আর ক’টা দিন বেঁচে থাকত, কিংবা আরও আগেই ও যদি সার্কেল ইউ-তে চলে আসতে পারত, তা হলে ঘটনা নিশ্চয় অন্য রকম হত।

মারামারি, খুনখারাবি, আইনের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো-এসব কিছুই ঘটত না।

শুধু যদি সময়টা ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করত!

কিন্তু ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরতে পারেনি ও। এখন পরিকল্পনা মাফিক কাজ সারতে হবে।

তিন শ’ গরু বিক্রির অর্ধেক টাকা কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসবে হাতে। তার জন্য ধৈর্য ধরতে হবে কয়েকটা দিন

গরুর গায়ে বসানো নতুন ছাপের ঘা শুকাতেও তো সময় লাগবে।

টাকাটা নিতে বিবেকের কোনও দংশন অনুভব করবে না জন।

ওটা তো আসলে ওরই ন্যায্য হিস্যার অর্থ। যদিও ওই স্বল্প পরিমাণ টাকা দিয়ে নিউ মেক্সিকোতে জমি কেনা সম্ভব হবে না।

দুই সপ্তাহ…এক মাস টাকাটা হাতে পেতে যদ্দিন লাগছে, তদ্দিন এখানেই অপেক্ষা করবে জন। সময়টা কাজে লাগাবে বার্ট অ্যান্ড্রিউর জীবন নরক করে ছাড়তে।

টাকাটা হাতে পাবার পর…

এখান থেকে চলে যাবে সে। দক্ষিণ আমেরিকাতে যেতে পারে। ওখানে নতুন ভাবে শুরু করবে সব কিছু।

কিংবা অচেনা-অজানা কোনও জায়গায়।

তবে, তিক্ত মন নিয়ে ভাবল জন, যেতে হবে ওকে একা। স্বপ্ন দেখত, ফ্লেচার’স হোল ছেড়ে যাওয়ার সময় সঙ্গী হয়েছে জুলিয়া।

কিন্তু সে স্বপ্ন এখন ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে।

জুলিয়া যদি ওর কাছে আসেও, ওকে সঙ্গে যাওয়ার অনুরোধ করার অধিকার নেই জনের, ‘ভালবাসি’ কথাটা বলার অধিকারও হারিয়েছে। কারণ, জন এখন আউট-ল আর অ্যান্ড্রিউ কোনও ভাবেই চাইবে না, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাক সে।

হয়তো সেটা হতেও দেবে না।

এসব কথা শুকনো এক ঝর্নার ধারে ছোটখাট এক গুহায় শুয়ে ভাবছিল জন।

এখন থেকে ভাবনা-চিন্তার প্রচুর সময় পাচ্ছে ও। করার মত কাজ তো তেমন কিছু নেই।

গোপন এই আস্তানা থেকে সহসা কোথাও যাচ্ছে না ও। জন জানে, অ্যান্ড্রিউ ওর খোঁজে দুনিয়া চষে ফেলছে। দক্ষ লোকজন লাগিয়ে দিয়েছে অনুসন্ধানে। লাভ নেই।

তল্লাশি করে জনের টিকিটিরও সন্ধান পাবে না ওরা। হতোদ্যম ও হয়রান হয়ে পড়বে। ভাববে, ফ্লেচার’স হোল ছেড়ে চলে গেছে ও।

তারপর আস্তে-ধীরে সব কিছুই যখন স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করবে, ঠিক তখনই আঘাত হানবে জন উইলিয়ামস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *