দাবিদার – ১৫

পনেরো

পরদিন সকাল।

জুলিয়া রবার্টস জনের জন্য নিজ কামরায় অপেক্ষা করছিল। ওর সঙ্গে আবার দেখা হয়ে ভাল লাগল জনের।

‘খবর কী?’ জানতে চাইল জুলিয়া। ওর মুখটা একটু শুকনো দেখাচ্ছে। চোখের নীচে কালি। যেন ভাল ঘুম হয়নি।

জুলিয়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল জন। ‘সব ঠিক আছে। আমরা চল্লিশটা গরু জোগাড় করেছি।’

স্বস্তির লম্বা একটা শ্বাস ফেলল জুলিয়া। ‘কোনও ঝামেলা হয়নি তো?’

‘নাহ। বার্টের কোনও লোকই ছিল না ওখানে।’ জুলিয়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল জন। ‘কী ব্যাপার? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে।’

মাথা নাড়ল জুলিয়া। ‘দুঃখিত। আমি…মানে…নানান দুশ্চিন্তায় ঠিক মত ঘুমাতে পারিনি রাতে। কত কিছুই তো ঘটতে পারত।’

‘কিন্তু ঘটেনি তো।’ হাসল জন। রাতে চমৎকার একটা ঘুম দিয়ে শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। খুব সহজে কাজটা সারতে পেরেছে বলে মনটা অনেক খুশি। সব কিছু যদি এরকম পরিকল্পনা মাফিক ঘটে…

‘তো,’ বলল ও, ‘নাশতা-টাশতা কিছু দেবে, নাকি অভুক্ত রাখবে?’

ঘন কালো ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল জুলিয়ার। ‘এটাকে নিজের বাড়ি বলে ভাবতে শুরু করলে নাকি, মিস্টার?’

জনের মুখের হাসিটা দপ করে নিভে গেল। ‘তুমি চাইলে আমি চলে যেতে পারি।’

‘না,’ দ্রুত বলল জুলিয়া। হাত নেড়ে বসার ইঙ্গিত করল ওকে। ‘নাশতা আনাচ্ছি তোমার জন্য। ম্যাগি?’

ম্যাগি নীচতলায় যাওয়ার পর একটা চেয়ারে বসে পড়ল জন। সিগারেট ধরাল। ‘আমি সার্কেল ইউ-তে আমার ভাগটুকু পেয়ে গেলে কি করব, জানো?’

‘কী করবে?’ টেবিল পরিষ্কার করছে জুলিয়া। ওকে কেমন অস্থির লাগছে।

‘বার্টের সাথে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করব। আমার প্রাপ্য অংশটুকু ওর আর পিটারের কাছে ন্যায্য দামে বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে একটা রানশ কিনে নেব।’

ওর দিকে মুখ তুলে চাইল জুলিয়া। ‘কোথায়?’

‘উত্তর নিউ মেক্সিকোতে সুন্দর কিছু জায়গা আছে। জমির দামও সস্তা। অ্যাপাচিদের ওখান থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পর জমির দাম বেড়ে যাবে। তার আগেই…। মেক্সিকান গাভীর সাথে ভাল জাতের ষাঁড়ের ব্রিড করলে দারুণ এক গরুর পালের মালিক হয়ে যাবে যে-কেউ…’

জুলিয়ার চোয়াল শক্ত হলো। ‘তুমি আসলে দিবাস্বপ্ন দেখছ, জন, রুক্ষ গলায় বলল সে।

গম্ভীর মুখে মাখা ঝাঁকাল জন। ‘জানি। তবে এসব করতে চাইবার পিছনে আমার নিজস্ব কিছু যুক্তিও আছে। অ্যান্ড্রিউর উপর শুধু প্রতিশোধ নয়, আমি একজন মৃত মানুষের শেষ ইচ্ছাও পূরণ করছি।’

চেয়ার ছাড়ল ও। অদ্ভুত এক আবেগ ভর করেছে ওর ভিতরে। হেঁটে জানালার সামনে গেল। ‘একদিন এ দেশটাতে আর হানাহানি, রক্তপাত থাকবে না। একদিন নির্ভয়ে রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে পারবে মানুষ। আত্মরক্ষার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে হবে না তাকে। সুন্দর একটা দেশ হবে এটা। আমি সেই সময়ের সাক্ষী হতে চাই।’ পিস্তলে হাত রাখল জন। ‘হতচ্ছাড়া জিনিসটা বহন করে-করে আমি ক্লান্ত। শান্তিতে থাকতে চাই এখন। নিরুপদ্রব একখণ্ড জমি চাই সেজন্য।’ ঘুরল সে, হেঁটে এল জুলিয়ার কাছে। হাত ধরল ওর। ‘সঙ্গিনী চাই একজন, চির-জীবনের সাথী হবে যে আমার।’

জুলিয়াকে চুমু খেল জন।

এক মুহূর্তের জন্য সাড়া দিল জুলিয়া। জনের ওষ্ঠে সেঁটে থাকল ওর অধর। কঠিন দেহে লেপটে রইল নরম শরীরটা। পরমুহূর্তে ধাক্কা মেরে ওকে সরিয়ে দিল জুলিয়া।

ওর মুখ থেকে, যেন শুষে নেয়া হয়েছে রক্ত। কাগজের মত সাদা। ঠোঁট সরে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে দাঁত। শীতল ক্রোধে গনগনে আগুনের মত জ্বলছে চোখ জোড়া।

এহেন প্রতিক্রিয়ায় ভড়কে গেল জন। চোখ পিটপিট করে বলল, ‘জুলি…জুলি…’

মস্ত একটা দম নিল জুলিয়া। আঁটসাঁট বডিসের নীচে ফুলে উঠল গর্বোদ্ধত দুই বক্ষ। ‘যে মানুষটাকে আমি ভালবাসতাম, কুকুরের মত গুলি খেয়ে মরেছে সে,’ নিচু গলায় হিসিয়ে উঠল সে। ‘চাই না, আবার ওরকম কিছু ঘটুক…বুঝতে পেরেছ?’

রাগে ফুঁসছে জুলিয়া।

কিন্তু ক্রুদ্ধ চেহারায় আরও সুন্দর লাগছে ওকে জনের। আরও বেশি করে পেতে ইচ্ছা করছে। জুলিয়ার দিকে এক কদম এগিয়ে গেল ও।

হাত তুলে বাধা দিল ওকে জুলিয়া। ‘না!’ চিৎকার দিল। ‘এখনই বিষয়টার ফয়সালা করে ফেলা দরকার। আমরা দু’জনে একত্রিত হয়েছি শুধু একটা কারণে। বার্ট অ্যান্ড্রিউর উপর আমি শোধ নেব, আর তুমি তাতে আমাকে সাহায্য করবে। আমার কাছে তুমি একজন সাহায্যকারীর বেশি কিছু নও। বুঝতে পেরেছ? স্রেফ একজন সাহায্যকারী।’

জুলিয়ার কথাগুলো ঘুসির মত লাগল জনের কাছে। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। এখন দুটো কাজ করতে পারে সে-জুলিয়ার শত আপত্তি অগ্রাহ্য করে বুকের মধ্যে টেনে নিতে পারে ওকে। অথবা চলে যেতে পারে এখান থেকে। আর কোনও দিন ফিরে আসবে না।

দুটো ইচ্ছাই দমন করল জন। মনের সবটুকু ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করল নিজেকে।

‘ঠিক আছে,’ শীতল শোনাল ওর কণ্ঠ। ‘তোমার কথাই সই। তোমার কথা মতই সব চলবে।’

ষোলো

টম ফোর্ডকে যতই লক্ষ করছে জন, স্বীকার করছে, সত্যি লোকটা নিজের কাজে সেরা। এখন ও বুঝতে পারছে, গরু চুরিতে কেন রাসলারদের বেগ পেতে হচ্ছে না।

যেরকম সুসঙ্ঘবদ্ধ ভাবে কাজ করে ফোর্ড, এই কৌশলে অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেও গোটা একটা খামার খালি করে ফেলা সম্ভব।

জনের ভূমিকাটা এখানে স্পটার আর এক্সট্রা হ্যাণ্ডের।

বাকি কাজ, অর্থাৎ গরু-বাছুর তাড়িয়ে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটা ফোর্ডের মাথা-ব্যথা। রাসলিং-এ সে এক মুহূর্তও বাজে সময় নষ্ট করে না।

শুধু রাতের বেলাতেই অপারেশন সীমাবদ্ধ রাখছে না ফোর্ড। বার্টরা যখন টের পেয়ে গেল, সার্কেল ইউ-র গরু-বাছুরের পাল অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, পাহারা বসল রাতের বেলায়।

ফোর্ড আর জন মিলে বুদ্ধি খাটিয়ে দিনের বেলাতেও রেইড শুরু করল। দুপুরের দিকে এমন একটা সময় বেছে নিল রেইডের জন্য, যখন রাত জাগরণের ক্লান্তিতে সার্কেল ইউ রাইডাররা নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে।

একবার খুবই বিপজ্জনক একটা কাজ করে ফেলল জন। অন্ধকারের সুযোগে সরাসরি ঢুকে পড়ল সার্কেল ইউ-র হৃৎপিণ্ডে। মানে, হোম রানশে।

ফোর্ড তার লোকজন নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে রেঞ্জের বাইরে।

রাতের অন্ধকারে গাঢ় ছায়া হয়ে সার্কেল ইউ-র তিনটা খড়ের গাদায় এক-এক করে আগুন ধরিয়ে দিল জন দেশলাই কাঠির সাহায্যে।

দাউ-দাউ জ্বলে উঠেছে আগুন, আলোকিত করে তুলেছে আঁধার; খামারের রাইডাররা তখনও বুঝে উঠতে পারেনি, কী ঘটছে।

তাদের হাউকাউ আর বিভ্রান্তির সুযোগে সত্তরটা গরুর একটা পাল নিয়ে চম্পট দিল ফোর্ড ও তার দল। যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল সবাই।

এ ঘটনা জন উইলিয়ামসের জন্য ছিল রুদ্ধশ্বাস এক অভিজ্ঞতা। ভাবলে নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য লাগে।

‘সত্যি তুমি দারুণ!’ এ ঘটনার পরে টম ফোর্ড প্রশংসার সুরে বলল জনকে। ‘দারুণ আর স্মার্ট। আমার সাথে যোগ দেবে? তুমি আর আমি মিলে গোটা খামার…

মাথা নাড়ল জন। ‘এক হাজার গরু,’ সংক্ষেপে সারল। ‘সার্কেল ইউ থেকে এই পরিমাণ গরুই নিতে চাই আমি। এর অর্ধেকটা সরাতে পারলেও ভাগ্যবান মনে করব নিজেকে। কোটাটা পূরণ হয়ে গেলে যে যার পথ দেখব। সৌভাগ্যই বলতে হবে, এখন পর্যন্ত কোনও গোলাগুলি কিংবা খুনোখুনি হয়নি-আমাদের পক্ষ থেকেও নয়, সার্কেল ইউ থেকেও নয়।’

‘ভাগ্য? ভাগ্য-টাগ্য কিছু নয়। শোনো, তোমার মত আমিও রক্তপাত পছন্দ করি না। ব্যবসার জন্য বিষয়টা ক্ষতিকর। তবে লড়াই যদি বেধেই যায়, সেজন্য আমরা প্রস্তুত। আপাতত যেভাবে করছি, সেভাবেই করতে থাকব। একান্ত বাধ্য না হলে ঝামেলায় জড়াব না কোনও।’

ফোর্ডের কথা শুনে স্বস্তি পেল জন। সব সময় একটা ভয় ওকে তাড়িয়ে বেড়ায়-না জানি কখন রাইডারদের পাতা ফাঁদে পড়ে।

সার্কেল ইউ-র লোকদের প্রতি ওর কোনও আক্রোশ নেই। নিজেদের কাজ করছে ওরা; নিজেদের গরু রক্ষার জন্য লড়াই করেছে।

কিন্তু এ লোকগুলোর সঙ্গে যদি সংঘর্ষ বাধে, ওদের রক্তে রাঙাতে হবে জনের হাত।

আজ হোক, কাল হোক, লড়াই একটা হবেই।

এ ব্যাপারে নিশ্চিত জন। ভাবতেই গা হিম হয়ে আসে, রাতের অন্ধকারে গুলি ছুঁড়ছে ও, আর তা গিয়ে লেগেছে পিটারের গায়ে।

মুখের উপর মুখোশটা টেনে নিল জন।

সব রাসলারই মুখোশ পরেছে।

মুখোশ মানে কালো ব্যাণ্ডানা। শুধু চোখ দুটো দেখা যায়।

দিন হোক বা রাত-কোনও ঝুঁকিতে যেতে রাজি নয় ফোর্ড।

নিচু, ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে শুধাল সে, ‘সবাই রেডি?’

হ্যাঁ-সূচক অস্পষ্ট বিড়বিড় ধ্বনি ভেসে এল রাইডারদের কাছ থেকে।

‘তা হলে চলো সবাই।‘

ঘুরঘুট্টি অন্ধকার রাত।

আজকের রেইডটা এ যাবৎ কালের সবচাইতে সহজ রেইড বলে মনে হচ্ছে জনের। পঞ্চাশটা গরুর একটা পালের উপর সারা দিন লক্ষ রেখেছে সে। কোথাও কোনও গার্ড চোখে পড়েনি।

কারণটা অবশ্য দুর্বোধ্য নয়। উন্নত জাতের গরু নয় ওগুলো।

নাদুস-নুদুস, তাগড়া গরুর উপর নজর রেখেছে সার্কেল ইউ।

রানশের সব জায়গায় পর্যাপ্ত ঘাস পাওয়া যায় না। রোগাভোগা গরুগুলোকে তাই ছেড়ে দেয়া হয়েছে, যাতে তারা নিজেরাই ঘাস খুঁজে খেতে পারে।

তাঁরাইডারদের ভুতুড়ে সারিটা একটা ড্রতে নেমে এল, তারপর ছড়িয়ে পড়ল সমতল ভূমিতে।

সামনে কালো-কালো বিন্দু দেখতে পেল জন।

ওগুলো গরু। ঘুমাচ্ছে।

ফোর্ডের লোকেরা নিঃশব্দে শুরু করে দিল কাজ। গরুগুলোকে বিরক্ত না করে দাঁড় করাল তারা, সারি তৈরি করল ওগুলোর, তারপর ড্রর দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগল।

রাতের এ অভিযানে গরুগুলোর মেদ-চর্বি একটু ঝরে যাবে বটে, তবে টমের খামারে পর্যাপ্ত ঘাস রয়েছে। বিক্রির আগে ঘাস খাইয়ে মোটা-তাজা করে নেবে সে গরুগুলোকে।

সামনের দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল জন, পিছিয়ে চলে এল ফোর্ডের কাছে।

রাইডারদের দ্রুত পথ চলার নির্দেশ দিচ্ছে সে।

‘সব ঠিক আছে?’ জিজ্ঞেস করল জন।

‘মনে তো হচ্ছে,’ ঘোঁত-ঘোঁত করে জবাব দিল ফোর্ড।

‘এগুলো নিয়ে আমরা প্রায় আড়াই শ’ গরু জোগাড় করেছি, তা-ই না?’

‘তিন শ’র কাছাকাছি,’ শুধরে দিল ফোর্ড। ‘মনে হচ্ছে, কাজটা সামনে আর এত সহজ হবে না।’ নড়েচড়ে বসল সে স্যাডলে। ‘এখন পর্যন্ত ভাগ্য যথেষ্টই সহযোগিতা করেছে আমাদের-’ থেমে গেল।

‘কী হলো?’ উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল জন।

‘ঠিক বুঝতে পারছি না,’ বিড়বিড় করল ফোর্ড। ‘তবে কিছু একটা…’ স্পারের গুঁতো মেরে ঘোড়াটাকে আগে বাড়তে নির্দেশ দিল সে। জনকে নিয়ে চলে এল তার রাইডার বাহিনীর পাশে।

‘কার্ট,’ একজনকে উদ্দেশ্য করে বলল ফোর্ড। ‘ডক আর জো কোথায়?’

গা মোচড়াল কার্ট। ‘কী জানি। একটু আগেও তো এখানেই ছিল।’

‘ড্যাম ইট!’ গর্জে উঠল ফোর্ড। জনকে নিয়ে পুরো পালটা একবার চক্কর দিল।

কিন্তু নিখোঁজ লোক দুটোকে পাওয়া গেল না।

‘কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে।’ ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল ফোর্ড। ‘ডক আর জো আমার পুরানো কর্মচারী। বেশ অভিজ্ঞ লোক। না বলে-কয়ে কোথাও যাবে না ওরা। ওদের দায়িত্ব ছিল গরুর পালটাকে পাহারা দেয়া। আমি ‘ থেমে গেল ফোর্ড। শিরদাঁড়া টান-টান হয়ে গেছে নিচু শিসের আওয়াজ শুনে।

শব্দটা আসছে কাছের এক অনুচ্চ টিলা থেকে।

ওই তো ওরা!’ এক টানে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ফেলল টম।

আবার ভেসে এল শিসের আওয়াজ।

জনকে নিয়ে শব্দের উৎসমুখে ছুটল ফোর্ড।

‘এখানে, বস!’ অন্ধকার থেকে জানান দিল একজন।

ঘোড়া থামাল ফোর্ড।

‘ডক? জো?’

‘এই যে আমরা।’ আঁধার ফুঁড়ে বেরিয়ে এল দুই ছায়ামূর্তি। একজনকে পাকড়াও করেছি।’

ফোর্ড আর জন ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল।

‘কাকে পাকড়াও করলে?’ জানতে চাইল ফোর্ড।

‘সার্কেল ইউ-র লোক,’ জবাব দিল একজন।

‘আমরা গরুর পাল নিয়ে আসার সময় লোকটাকে দেখে, ফেলি। আমি ওকে ডাক দিই, সেই সুযোগে জো পিছন থেকে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, খোলসা করল অপরজন। ‘আমরা কোনও অস্ত্র ব্যবহার করতে চাইনি।’

‘ভালই করেছ,’ বলল ফোর্ড। ‘শক্ত করে বেঁধেছ তো মুখ?’

‘একদম,’ জবাব দিল জো। ‘দুই হাতও কষে বেঁধেছি। ঘোড়াটাও আমাদের জিম্মায়।’

‘ঘোড়ায় তোলো ওকে,’ নির্দেশ দিল ফোর্ড, ‘আমাদের সাথে নিয়ে চলো। কড়া নজর রাখবে, যাতে পালাতে না পারে। …আর কাউকে দেখেছ?’

‘নাহ। ও ব্যাটা কসম খেয়ে বলছে, আর কেউ ছিল না ওর সাথে।’

দাঁত কিড়মিড় করে বলল ফোর্ড, ‘ব্যাটা কি তা হলে রাতের বেলা একাকী ঘুরঘুর করছিল রেঞ্জের মধ্যে? উঁহুঁ। ওর সাথে অন্য কেউ থাকতে বাধ্য।‘

‘বন্দুক ঠেসে ধরেছিলাম পেটে। বলল, ও ছাড়া নাকি আর কেউ নেই। শহরে গিয়েছিল মৌজ করতে। মদ খেয়ে টাল হয়ে ফিরছিল। এ সময় আমাদের রাস্তায় পড়ে যায়।‘

‘সেই কথাই যেন সত্যি হয়। ওর দলের কোনও লোক যদি আমাদের উপর হামলা করে, তবে সবার আগে এই মাতালটাকে গুলি করবে। এখন নিয়ে চলো ওকে। পরে ওর ব্যবস্থা করা যাবে।’

জন জানতে চাইল, ‘ওকে নিয়ে কী করবে তুমি?

‘জবাই করব,’ সাফ-সাফ বলল ফোর্ড। এ ছাড়া আর কী করব? গুলি করলে তো শব্দ হবে।’

ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল জন। ‘না!’ কর্কশ গলায় বলল।

নিজের ঘোড়ার পিঠে ঝাঁকি খেল ফোর্ড। কী? বিস্মিত দেখাচ্ছে তাকে। জন কিছু বলার আগেই জানোয়ারটাকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল সে। ‘চলো, হে। পরেও এ নিয়ে কথা বলা যাবে। আগের কাজ: গরুগুলোকে গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া।’

সতেরো

দুই ঘণ্টা ধরে গরুর পাল ঠেলে এগোনোর পর সার্কেল ইউ রেঞ্জ থেকে মাইল দশেক দূরে, একটা ক্যানিয়নের কাছে চলে এল ওরা।

ভোর হতে এখনও ঘণ্টা তিনেক বাকি। পাল নিয়ে কেটে পড়ার জন্য যথেষ্ট সময়। তারপরও নষ্ট করা যাবে না একটি মুহূর্তও।

কি ক্যানিয়নের ওই গোলকধাঁধায় ছড়িয়ে রয়েছে বড়-বড় পাথর আর লাভার স্তরের বাধা। ট্রেইল প্রায় নেই বললেই চলে।

আন্দাজে ভর করে চলতে হবে।

যে দু’জন সার্কেল ইউ-র লোকটাকে পাকড়াও করেছে, তাদের পিছন পিছন আসছিল জন। বন্দি আর তার আটককারীদের উপর শ্যেন দৃষ্টি রেখে।

বন্দি লোকটা ঘোড়ার পিঠে।

ঠাণ্ডা মাথায় কাউকে খুন হতে দেখার কথা ভাবতেই পারে না জন। কাঠপুতুলের মত স্রেফ দাঁড়িয়েও থাকতে পারবে না।

হত্যাকাণ্ড যে হবে, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। ব্যাডল্যাণ্ডসে ঢোকার সময়ই টম ওকে বলেছিল, ‘বিজনেস ইজ বিজনেস। আর এ ব্যবসায় কেউ মুখ খুলতে পারে, এমন কাউকে ছেড়ে দেয়া যায় না। আমরা এর লাশ এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখব যে, বাজ পাখিরাও তার সন্ধান পাবে না। জানতে পারবে না কেউ, লোকটার কী হলো।’

আঠারো

টম ফোর্ড হাত তুলতেই থেমে গেল দলটা।

ক্যানিয়নের ধারে দাঁড়িয়ে একটা আরেকটার গায়ে গা লাগিয়ে ঠেলাঠেলি করছে গরুগুলো।

বন্দিকে নিয়ে দুই রাসলার চলে এল অন্ধকারে।

আবছা দেখল জন, বন্দির মুখে কাপড় বাঁধা। চেহারাটা চেনা যাচ্ছে না।

ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে এল ফোর্ড। হুকুম দিল, ‘আগুন জ্বালো।’

গন্ধকের ঝাঁঝাল গন্ধ ধাক্কা মারল জনের নাকে।

একটা দেশলাই কাঠি জ্বলে উঠল।

আলোয় এক মুহূর্তের জন্য দেখতে পেল জন বন্দিকে।

আতঙ্কে বিস্ফারিত চেহারা। কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে

চাইছে চোখ। ব্যাণ্ডানা দিয়ে মুখটা বেঁধে রাখা হয়েছে।

নিভে গেল আলো।

এক পলক দেখেই লোকটাকে চিনতে পেরেছে জন। ক্লাইড।

সার্কেল ইউ-তে যেদিন প্রথম গিয়েছিল, এ লোকই পিছন থেকে ওর পিঠে ঠেসে ধরেছিল বন্দুক।

আর সেই সুযোগে ঘুসি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল ওকে বার্ট।

‘না!’

‘জো,’ বলল ফোর্ড, ‘তুমি করো কাজটা।’

শরীরের প্রতিটা পেশি আর স্নায়ু শক্ত হয়ে গেল জনের।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ফোর্ড। ‘এক মিনিট, জো।’ জনের দিকে ফিরল। ‘ওদিকটায় চলো। কথা আছে তোমার সাথে।’

ঘোড়া নিয়ে গরুর পাল থেকে খানিকটা দূরে সরে এল ওরা দু’জন। এখান থেকে কথা শোনা যাবে না ওদের।

‘শোনো,’ ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে হিংস্র গলায় বলল ফোর্ড। ‘এখানে আমি তোমার বস, বুঝতে পেরেছ? ওরা সব আমার লোক। আমার আস্তানা আর কন্ট্যাক্টগুলো ব্যবহার করছ তুমি। ঝুঁকিও আমরাই নিচ্ছি। আর আমি যা করছি, বুঝেশুনেই করছি। এর মধ্যে তোমার নাক গলানোর দরকার নেই।’

‘বুঝতে পেরেছি,’ গলার স্বর শান্ত রাখল জন। ‘তবে এখানে কোনও খুনোখুনি চলবে না।’

‘ধুত্তোর!’ খেঁকিয়ে উঠল ফোর্ড। ‘ওই হারামজাদা জানে, সংখ্যায় আমরা কতজন। জানে, কোন্ পথে গরুর পাল পাচার করা হচ্ছে…’

‘কিন্তু তারপরও আমি তোমাকে সমর্থন করতে পারছি না।’

‘ও আমাদের চিনে ফেলেছে।’

‘এত অন্ধকার…চিনবার কথা নয়। তা ছাড়া মুখোশ পরে আছি সবাই।’

‘শোনো,’ বলল ফোর্ড, ‘ওকে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে পারব না। ছেড়ে দেয়াও সম্ভব নয়। রেঞ্জের সবাইকে খেপিয়ে তুলবে ও। বোলতার ঝাঁকের মত আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে সবাই।’

রেঞ্জের সবাই অনেক আগে থেকেই খেপে আছে, বলল জন, ‘জুলি আমাকে বলেছে, গোটা রাজ্য থেকে ভাড়াটে বন্দুকবাজ নিয়ে আসছে বার্ট। আর্মির মত একটা বাহিনী গড়ে তুলছে সে।’

‘এর মধ্যে ওকে ছেড়ে দিলে ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে?’

‘তাই বলে তুমি ওকে শুয়োরের মত জবাই করবে, আর বাজ পাখির খাবার হিসেবে ফেলে রাখবে লাশ, এ আমি হতে দেব না।’

‘তা হলে করবেটা কী, শুনি?’ ফোর্ডের কণ্ঠে শেষ। খরখরে গলায় বলল, ‘এই তুমিই কিন্তু বুটস হবসকে মেরেছিলে—’

‘একজন তোমাকে খুন করতে যাচ্ছে, তখন তাকে হত্যা করা এক কথা, আর ঠাণ্ডা মাথায় কাউকে জবাই করা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।‘

কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল ফোর্ড। তারপর মুখোমুখি হলো জনের।

আড়ষ্ট হয়ে গেল জন। একটা বন্দির জন্য ফোর্ড আর তার লোকদের সঙ্গে কোনও রকম সংঘর্ষে জড়াতে চায় না সে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, লড়াই অনিবার্য। ….একজনের বিরুদ্ধে দশজন-খুবই বিশ্রী ব্যাপার-তিক্ত মন নিয়ে ভাবছে ও। তবে সবার আগে ফোর্ডকে খতম করলে…

ও কী ভাবছে, বুঝতে পেরেই যেন রণে সে যেন রণে ভঙ্গ দিল ফোর্ড।

তার ঘোড়ার খুর খটখট আওয়াজ তুলল পাথরে।

।ওকে ছেড়ে দা… ক্রুদ্ধ শোনাল কণ্ঠ।

জোর প্রতিবাদ জানাল ফোর্ডের লোকজন।

এক ধমকে তাদেরকে চুপ করিয়ে দিল ফোর্ড। ‘বললাম না, ওকে ছেড়ে দিতে!’ বন্দিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এবারের মত জানে বেঁচে গেলে। তবে মুখটা বন্ধ রাখতে না পারলে বহুত খারাবি আছে তোমার কপালে। তোমার জায়গায় আমি হলে সার্কেল ইউ-তে কোনও দিন ফিরে যেতাম না। ফ্লেচার’স হোল থেকে বহু দূরে চলে যেতাম, যেখানে কেউ আর আমার টিকিটিরও খোঁজ পাবে না। বোঝা গেছে আমার কথা?’

অস্পষ্ট স্বরে কী বলল লোকটা, বোঝা গেল না।

ফোর্ড হুকুম দিল, ‘ওর হাতের বাঁধন খুলে দাও।’

কোল্টের বাঁটে হাত, উত্তেজনা নিয়ে দেখছিল জন, ফোর্ড কী করে। শুনতে পেল, কেউ একজন বন্দির ঘোড়াটার পাছায় সপাটে চড় বসিয়ে ‘হাইয়া!’ বলে চিৎকার দিল।

চড় খেয়ে লাফিয়ে উঠল ঘোড়াটা। ক্যানিয়ন ধরে ছুটতে শুরু করল সওয়ারিকে নিয়ে।

পাথরে আওয়াজ উঠল-খটাখট খটাখট।

জনের কাছে এল ফোর্ড। ‘সন্তুষ্ট?

মাথা ঝাঁকাল জন। ‘হুঁ। ধন্যবাদ।‘

‘যখন গোটা একটা বাহিনীর সাথে ফাইট করতে হবে, তখন আর ধন্যবাদ দেবে না।’ জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি বেণ্ট’স ক্রসিং-এ ফিরছ?’

‘সেরকমই ইচ্ছা।‘

‘ঠিক আছে। যোগাযোগ রেখো।‘

ঘোড়া নিয়ে ঘুরল ফোর্ড। ঘাউ করে উঠল: ‘অলরাইট! সারি বাঁধো গুরুগুলোকে।‘

ঘোড়ার পিঠে বসে রইল জন। দেখল, গরুর পাল নিয়ে চলতে শুরু করেছে ফোর্ডের লোকজন।

ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল সে। ঢুকে পড়ল একটা সাইড- ক্যানিয়নে। তারপর দীর্ঘ, ঘোরানো পথ ধরে ফিরে চলল শহরে।

উনিশ

ভোরের আলো ফুটি-ফুটি করছে।

বেণ্ট’স ক্রসিং-এর উপান্তে, ভাঙা, পরিত্যক্ত দুর্গটার সামনে হাজির হলো জন।

এমনিতে রাতের বেলা ফোর্ডের সঙ্গে রেইডে বেরোলে ভোর হওয়ার আগেই সাধারণত ফিরে আসে শহরে, জুলিয়ার স্যালুনের উপরতলায় তার জন্য নির্দিষ্ট ছোট ঘরটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে নেয়। তবে আজ ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। বন্দি লোকটাকে নিয়ে বাদানুবাদই ওকে দেরি করিয়ে দিয়েছে। ক্লান্ত ঘোড়াটাকে নিয়ে বেন্ট’স ক্রসিং-এ ঢোকার সাহস পায়নি কেউ দেখে ফেলার ভয়ে—বিশেষ করে, ক্লাইডকে ছেড়ে দেয়ার পর।

হয়তো ইতোমধ্যে অ্যান্ড্রিউকে বলে দিয়েছে সে, সর্বশেষ গরু চুরির ঘটনাটা কখন, কীভাবে ঘটেছে।

প্রাচীন এ দুর্গে দিব্যি লুকিয়ে থাকা যায়। জানবে না কেউ। ঘোড়াটাকে একটা ঝর্না থেকে পানি পান করিয়েছে পেট পুরে। কাজেই, খুব শীঘ্রি ওটাকে খাবার না দিলেও চলবে। দুপুর কিংবা বিকেলের দিকে কোনও আস্তাবলে গিয়ে জানোয়ারটার খাওয়ার ব্যবস্থা করবে জন।

অল্প কয়েকটা ভাঙাচোরা বক্সস্টল চোখে পড়ল ওর দুর্গে। এর একটাতে লুকিয়ে রাখল জন ঘোড়াটাকে। ভাঙা কিছু কড়ি-বর্গার পিছনে ফাঁকা একটা জায়গা খুঁজে পেল। কম্বল পেতে শুয়ে পড়ল ওখানে।

প্রচণ্ড ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও শোয়া মাত্র ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে এল না নিদ্রাদেবী।

নানান দুশ্চিন্তায় ঘুম আসছে না জনের।

পুরো ব্যাপারটা দিন-দিন তিক্ততার দিকে মোড় নিচ্ছে। চুরি করা তিন শ’ গরুর কথা ভাবল ও।

অর্ধেক বিক্রি করতে পারলেই কোর্টের খরচটা উঠে আসবে। পুরো এক হাজার গরু জোগাড়ের চেষ্টা করতে গেলে কী হবে?

নিশ্চয়ই অজানা থাকবে না ওদের, কারা রয়েছে এর পিছনে।

একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অনিবার্য। আর কারও-না-কারও প্রাণ যাবে।

ফোর্ডের লোকদের নিয়ে চিন্তিত নয় জন, অ্যান্ড্রিউর লোকজন কিংবা পেশাদার বন্দুকবাজ মারা গেলেও ওর কিছু যায়-আসে না। এমনকী নিজেকে নিয়েও ভাবছে না ও। ও শুধু দুশ্চিন্তা করছে সার্কেল ইউ-র সাধারণ রাইডারদের নিয়ে, যারা স্রেফ নিজেদের কর্তব্য পালন করছে।

জনের সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ পিটারকে নিয়ে। লড়াই বাধলে পিটার তাতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য।

যাক গে, এসব নিয়ে পরেও ভাবা যাবে। এখন একটু না ঘুমালেই নয়।

চিত হয়ে শুল জন। কান পর্যন্ত টেনে দিল কম্বল। স্যাডলের সিটটাকে বালিশ বানিয়েছে। হ্যাট চাপা দিল চোখের উপর। একসময় নিদ্রাদেবী ওর চোখে মাখিয়ে দিল ঘুমের অঞ্জন। ছাড়া-ছাড়া, স্বপ্নহীন ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল জন উইলিয়ামস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *