দাবিদার – ১০

দশ

ছোট নুড়ি পাথর বিছানো রুক্ষ ট্রেইল ধরে আরও মাইল তিনেক এগোল ওরা।

সরু ক্যানিয়নটা যেখানে বাঁক নিয়েছে, দু’জন গার্ডের পাশ কাটাল ওখানে। জনের পাশের গার্ডটি ওর ঘোড়ার লাগাম ধরে টেনে নিয়ে চলল।

সুবিশাল তৃণভূমির বিস্তার ওদের সামনে।

ঘাসের প্রান্তরের মাঝে বেশ কয়েকটি কাঠের ভবন আর কোরাল।

ওগুলো ছাড়িয়ে, বেশ অনেক দূরে প্রায় আবছা মত চোখে পড়ে বিশাল এক ক্যানিয়নের কাঠামো।

জন জানে, সরু কলোরাডো ওখানে সর্পিল মোড় নিয়েছে, ওদিক থেকে কারও আগমনকে অসম্ভব করে তুলেছে। এ ধরনের আউটফিটের জন্য এর চেয়ে নিরাপদ জায়গা হয় না, ভাবছে ও। একসঙ্গে রানশ আর দুর্গের কাজ করছে।

জনের পাশের লোকটা দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘ভাবছি বুটস হবসের কথা। ওই লড়াইতে সে মারফির পক্ষে ছিল, ঠিক না?’

‘হুম,’ জবাব দিল জন। ওর মনের ভিতরে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে।

এ লোক বুটস হবসের প্রসঙ্গ বারবার তুলছে কেন?

হবসের মত নিষ্ঠুর আর বর্বর গানম্যান আর হয় না। লোকটার মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম, তবে অস্ত্র হাতে দুর্দান্ত গতি, বিদ্যুৎঝলকের মত। আকন্ঠ মদ গিলেও কখনও মাতাল হয় না। প্রচুর মদ্যপান কোনও দিনও প্রভাব ফেলতে পারেনি হবসের ড্রতে।

‘আর তুমি ছিলে ম্যাকসুয়েনের পক্ষে,’ বলল দেড়ে।

‘সবই জানো দেখছি।’

খিকখিক হাসল দাড়ি।

কড়া চোখে তার দিকে তাকাল জন। ‘এতে হাসির কী হলো?’

‘না, এমনি হাসছিলাম,’ বলল দাড়িঅলা, ‘মনে হচ্ছে, আজ রাতে কোনও মজার ঘটনা ঘটবে। তোমার বন্ধু বুটস হবস দুই দিন আগে এখানে এসেছে। তখন থেকে মদ গিলেই চলেছে। সেই সাথে দু’জন লোকের কথা বলছে, যাদেরকে কাছে পেলে সে নাকি ঢিট করে ছাড়ত। এদের একজন বিলি বনি। অপরজন—’ থামল সে, চোখে কৌতুক। ‘জন উইলিয়ামস।’

ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জন। বন্দুকবিহীন অবস্থায় এ মুহূর্তে নিজেকে ওর বড্ড ন্যাংটো মনে হচ্ছে। লিঙ্কন কাউন্টির ওই ঘটনার পর থেকে বুটস হবসের ছায়াও মাড়ায়নি সে। তার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিহিংসাও পুষে রাখেনি। যদিও লোকটাকে সে মোটেই পছন্দ করে না।

কিন্তু জন জানে, হবসের মনে অন্য চিন্তা। তার কাছে জন এখনও শত্রু, আর শত্রুকে দেখামাত্র গুলি করবে সে।

দাড়িঅলার দিকে ফিরল জন। ‘শোনো,’ বলল ও, ‘হবস যদি ওখানে থাকে, খালি হাতে ওখানে যেতে পারব না আমি।’

দাড়িঅলা কানে তুলল না ওর কথা। শুধু বলল, ‘ওটা টমের ব্যাপার।’

হাত তুলল সে।

হাতটা অনুসরণ করে দেখল জন, রানশহাউস থেকে এক ঘোড়সওয়ার এগিয়ে আসছে ওদের দিকে।

ওরাও লোকটার দিকে এগোল।

কাছাকাছি হওয়ার পরে জন বুঝতে পারল, অগ্রসরমান ঘোড়সওয়ারটিই টম ফোর্ড।

ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা অবস্থাতেও বোঝা যায়, খুব লম্বা আর বেজায় ঢ্যাঙা সে। কালো ঘোড়ায় চেপেছে। মাথায় উঁচু কার্নিশঅলা টুপি। উত্তর রেঞ্জের লোকেরা এ ধরনের হ্যাট পরে।

আরও কাছে আসতে চেহারাটা পরিষ্কার দেখতে পেল জন। অসংখ্য ভাঁজ মুখে। লম্বাটে চিবুক। গতপড়া গাল। বিরাট নাক। পাতলা ঠোঁট। বুদ্ধিদীপ্ত ধূসর চোখ জোড়া ঢুকে আছে কোটরে। কোমরে নিচু করে ঝুলিয়েছে কোল্ট।

ঘোড়াটা ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।

দুই নিতম্বে হাত রেখে জনের দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকাল টম ফোর্ড।

‘অলরাইট, মেস,’ অদ্ভুত গমগমে গলায় বলল সে। ‘তোমার সঙ্গীটি কে?’

‘নাম বলছে জন উইলিয়ামস,’ জবাব দিল মেস, ‘বাড়ি লিঙ্কন কাউন্টিতে। বেণ্ট’স ক্রসিং-এর জুলিয়ার কাছ থেকে তোমার জন্য একটা চিঠি নিয়ে এসেছে।’

টমের ধূসর চোখ জনের আপাদমস্তক নিরীখ করল। ‘জন, হাহ্? লিঙ্কন কাউন্টি? জুলিয়াকে চেনো তুমি?’

‘জুলিয়া বলেছে, তুমি নাকি কী ব্যাপারে ওর কাছে দেনা হয়ে আছ। আমি তোমার জন্য একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। প্রস্তাবটা গ্রহণ করলে দেনাটাও শোধ হবে, সেই সাথে কিছু পাবেও।’

‘চিঠিটা দেখি।’ হাত বাড়াল ফোর্ড।

শার্টের পকেট থেকে চিঠি বের করে ফোর্ডের হাতে দিল জন।

ঢ্যাঙা লোকটা দাঁত দিয়ে লাগাম চেপে ধরে ছিঁড়ে ফেলল খাম। ভুরু কুঁচকে পড়ল চিঠিটা। তারপর তার চেহারায় স্বস্তির একটা ভাব ফুটল। ‘ঠিক আছে,’ বলল সে মেসকে। ‘ওর অস্ত্র ওকে ফেরত দিয়ে দাও।’

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত জনের দিকে তাকিয়ে রইল ফোর্ড। ‘লিঙ্কন কাউন্টির জন,’ আপন মনে বলল। ‘তারপর…আমাদের অতিথিটি সম্পর্কে মেস কি তোমাকে কিছু বলেছে?’

‘বলেছে, বুটস হবস এসেছে,’ মেসের ফিরিয়ে দেয়া গানবেল্ট কোমরে বাঁধতে বাঁধতে জবাব দিল জন।

‘হুঁ,’ বলল ফোর্ড। জনের পিস্তলের দিকে তাকাল। ‘জুলির স্বামীর জিনিস ওটা, তা-ই না?’

‘ছিল,’ বলল জন, ‘জুলি আমাকে ধার দিয়েছে।’

‘বেশ, বেশ,’ বলল ফোর্ড, ‘পিস্তলটা আমি জুলির কাছ থেকে বেশ কয়েকবারই কিনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ও বিক্রি করতে রাজি হয়নি। আর তুমি কোত্থেকে এসে হাজির হলে আর সে এটা তোমাকে দিয়ে দিল!’ মুখ বাঁকাল ঢ্যাঙা। ‘হায়, নারী!’ মুহূর্তের জন্য চোখ জোড়া জ্বলে উঠল তার। পরক্ষণে শান্ত হয়ে গেল। ‘শোনো, চটজলদি আমি কোনও সিদ্ধান্ত নিই না। জুলি চিঠিতে যা লিখেছে, তার জবাব দেয়ার আগে তোমার সাথে কিছু আলোচনা করা দরকার। তা ছাড়া আছে ওই হবস।’ কণ্ঠস্বর কর্কশ শোনাল তার। ‘হারামজাদা মাতাল আর বাচাল। যাচ্ছিল টেনস্লিপ কাউন্টিতে। দিন দুই আগে আমার এখানে যাত্রাবিরতি করেছে। ওকে দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ওর সাথে বোঝাপড়া নিজেকেই সারতে হবে তোমার। বহুবার সে তোমার নাম ধরে গালাগাল করেছে। আগে হোক বা পরে, ওর সাথে টক্কর তোমার লাগবেই। তো, তুমি ওকে খুন করো কিংবা নিজেই ওর হাতে খুন হয়ে যাও, তাতে আমার কিছু আসে-যায় না। শুধু একটা কথা পরিষ্কার জানিয়ে রাখছি-আমি কিংবা আমার লোকেরা কোনও ভাবেই এর মধ্যে জড়াব না। সাহায্য করব না তোমাকে বা হবসকে। বুঝতে পেরেছ?’

‘পেরেছি,’ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল জন। ‘আমি এখানে কোনও ঝামেলা বাধাতে আসিনি। হবস আমাকে না ঘাঁটালে আমি ওর ছায়াও মাড়াব না।’

এগারো

টম ফোর্ডের থাকার জায়গাটিতে একটাই মাত্র কামরা। কামরাটা অবশ্য বিশাল।

ঘরের দেয়াল শক্ত কাঠের

আসবাব বলতে রয়েছে একখানা, স্টোভ আর বেঞ্চি সহ খানকয়েক বড় টেবিল।

জন এখানে আসার পর ঘণ্টা চার পার হয়েছে।

যত সময় যাচ্ছে, ততই ওর নার্ভগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠছে।

এখানে ঢোকার সময় দেখেছে, একটা টেবিলে কতগুলো লোক পোকার খেলতে ব্যস্ত।

এদের একজন হবস।

লোকটা প্রকাণ্ডদেহী। বুলডগের মত চেহারা। তার কোমরে দুটো পিস্তল ঝোলানো। পরনে সাধারণ কাউবয়-এর পোশাক। পায়ে ক্যাঙারুর চামড়ার বুট হাঁটু পর্যন্ত উঁচু। এই বুটের জন্যই ওর নাম হয়েছে বুটস হবস।

জন আর ফোর্ড ঘরে ঢোকার সময় খেলোয়াড়রা মুখ তুলে তাকিয়েছিল ওদের দিকে।

উইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতে যাচ্ছিল হবস, জনকে দেখে যেন জমে গেল।

‘এ হলো জন উইলিয়ামস। লিঙ্কন কাউন্টি থেকে এসেছে,’ দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে টেবিলের লোকগুলোর উদ্দেশে হেঁকে বসল টম। তারপর, ‘জন, এ হচ্ছে চার্লি ফ্র্যানিগান, ও ম্যাক জেনকিনস…’ একের পর এক নামগুলো বলে যেতে লাগল।

জন শুনছিল না। কিংবা কারও দিকে তাকাচ্ছিলও না। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল শুধু হবসের উপর।

হবস মুখের কাছে উইস্কির গ্লাস তুলে স্থির বসে আছে, অপলক চাউনি জনের দিকে, মুখে কুটিল হাসি।

‘…আর আমার মনে হয়, তুমি বুটস হবসকে চেনো,’ কণ্ঠে শ্লেষের সুর টেনে পরিচয়পর্ব শেষ করল টম ফোর্ড।

‘চিনি,’ স্বীকার করল জন। ‘হ্যালো, বুটস।’

হবস এখনও হাসছে। ‘হাউডি, জন। কোত্থেকে এলে?’

‘তুমি যে জায়গা থেকে এসেছ, সেখান থেকে,’ নিরুত্তাপ গলায় জবাব দিল জন।

‘সবাই-ই টম ফোর্ডের কাছে আসে,’ বলল হবস।

ওরা একে অন্যের দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ।

তারপর কী ভেবে নিজের কার্ডের দিকে মনোযোগ ফেরাল হবস। এক ঢোকে গ্লাসের মদটুকু গিলে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, বন্ধুগণ। এবারে কার চাল?’

খেলা শুরু হলো।

তবে খেলোয়াড়রা সব্বাই নীরব।

ঘরের ভিতরকার উত্তেজনার তাপ টের পাচ্ছে জন।

ঝামেলার আশঙ্কা করছে সবাই। ভাবছে, যত দ্রুত এখান থেকে কেটে পড়া যায়, ততই মঙ্গল।

তবে, কিছুই ঘটল না।

হবসের আচরণ দেখে মনে হলো, জনের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন নয় সে। ইচ্ছা করেই যেন ওকে গ্রাহ্য না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ফোর্ড আর জন বসল এক জায়গায়। টুকটাক কথা বলল। তবে ব্যবসায়িক আলাপ নয়।

টমকে দেখে মনে হচ্ছিল, সে যেন কিছু ঘটার অপেক্ষা করছে। জনের সঙ্গে সিরিয়াস আলোচনা শুরু করার আগে এমন কিছু প্রত্যাশা করছে ওর তরফ থেকে, যা ওর দক্ষতা আর যোগ্যতার প্রমাণ দেবে।

জনের নিজেরও অবশ্য কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। হবস ওর উপস্থিতি ভুলে থাকার ভান করলেও জন তা পারছে না। এক মুহূর্তের জন্যও স্বস্তি বোধ করছে না সে।

অবশেষে, অনেকক্ষণ পরে যখন শেষ হলো খেলা, নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল হবস। টানা মদ গিলেছে। দেখে মনে হচ্ছে-টাল। দুই হাত মাথার উপরে প্রসারিত করে উচ্চস্বরে হাই তুলল।

জন লক্ষ করল, হবস আগের চেয়ে অনেক শুকিয়েছে।

‘আজকের রাতটা আমার পক্ষে নেই,’ গম্ভীর গলায় মন্তব্য করল হবস। মেঝেয় বুটের শব্দ তুলে এগোল জনদের টেবিলে।

হবসকে ওদের দিকে এগোতে দেখে নিশ্চুপ হয়ে গেল কামরার সবাই। শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে যেন সবার।

হবসের মুখোমুখি হতে বেঞ্চিটা একটু ঘুরিয়ে নিল জন। ডান হাতটা পিস্তল থেকে দূরে রেখেছে। তবে বেশি দূরে নয়।

হাসল হবস। ‘ভয় পেয়ো না, জন,’ বলল সে, ‘আমি তোমার সাথে মারামারি করতে আসিনি। তোমাকে একটা ড্রিঙ্ক অফার করতে এসেছি শুধু। দু’জনে মিলে মদ খেতে খেতে পুরনো দিনের গল্প করব। …আমরা দু’জনেই তো এখন লিঙ্কন কাউন্টির বাইরে।’

টেবিলের এক কোণে, ফোর্ডের পাশে বসল সে।

ওর বিপরীত দিকে বসে আছে জন।

দুই হাত জড়ো করে টেবিলের উপর রাখল হবস। ‘কী দারুণ ছিল সেই দিনগুলো! মনে আছে নিশ্চয়, সেদিন যে ম্যাকসুয়েনের বাড়িটা পুড়িয়ে দিলাম? ভেবেছিলাম, তোমরাও বুঝি পুড়ে মরেছ…তুমি, বনি আর ওই মেক্স। কিন্তু তুমি গুলি করতে করতে দেয়াল টপকে পালিয়ে গেলে-’

কোনও মন্তব্য করল না জন।

‘শুনলাম, গভর্নর ওয়ালেস এখনও বিলিকে ধরার চেষ্টা করছে। সে নাকি ওকে ক্ষমা করে দেবে।’ জনের স্পর্শ না করা গ্লাসটা ওর দিকে ঠেলে দিল হবস। ‘আরে, মদ খাচ্ছ না কেন? খাও। আরেক গ্লাস কিনে দেব তোমাকে। অনেক কথা আছে তোমার সাথে।’

‘আমার এখন তেষ্টা নেই,’ শান্ত গলায় বলল জন।

কাঁধ ঝাঁকাল হবস। ‘ঠিক আছে। খেয়ো না।’ ফোর্ডের দিকে ফিরল সে। ‘টম, আরেক বোতল মদ কিনব আমি। …এই রে! আরেকটা বোতল কেনার পয়সা পকেটে আছে কি না, তাও তো জানি না।’

সামনে ঝুঁকল হবস। যেন হাত ঢোকাবে পকেটে। বাম হাতটা তার টেবিলের উপর থেকে সরে গেল।

পলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে জনকে। ওর দুই হাত টেবিলের উপর, উপস্থিত সবার দৃষ্টিসীমার মধ্যে।

হবস হয় পকেট থেকে টাকা বের করবে, নতুবা বাম হোলস্টার থেকে পিস্তল।

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল জন।

ড্র করল না ও। বদলে বিদ্যুৎ খেলে গেল শরীরে। লাফ দিয়েছে বেঞ্চ থেকে।

ও-ও লাফ মেরেছে, প্রায় একই সঙ্গে টেবিলের নীচ থেকে গর্জে উঠল হবসের পিস্তল।

একটা বুলেট বিদ্ধ হলো এক সেকেণ্ড আগে জন যেখানে ছিল, সে জায়গায়। সরে না গেলে বুলেটটা পেটে ঢুকত ওর। পরবর্তী ঘটনাগুলো ঘটল দু’সেকেণ্ডেরও কম সময়ে। টেবিলের নীচ থেকে অস্ত্র তুলেছে হবস। বিস্মিত। তখনও শূন্যে রয়েছে জন। ভারসাম্যহীন অবস্থাতেই গুলি করল।

একটা চান্স শট এটা, স্ন্যাপশট; গুলি লাগতেও পারে, না-ও লাগতে পারে।

সহজাত সতর্কতার প্রবৃত্তিতে ইতিমধ্যে লাফ মেরে সরে গেছে ফোর্ড বেঞ্চির উপর থেকে।

না সরলে মরত। জনের ছোঁড়া গুলি মাথাটা তরমুজের মত ফাটিয়ে দিত, টুকরো হয়ে যেত খুলি।

টম ফোর্ড বেঁচে গেলেও হবসের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না। জনের গুলি মাথাটা ছিন্নভিন্ন করে ফেলল তার।

আরও একবার আগুন ঝরাল হবসের হাতের অস্ত্র। স্রেফ রিফ্লেক্সের কারণে।

লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলিটা লোহার চুল্লির গায়ে বাড়ি খেয়ে কাঠের দেয়ালে সেঁধুল।

হুড়মুড় করে মেঝেয় পড়ল হবসের লাশ।

একই সঙ্গে সশব্দে মেঝেতে ল্যাণ্ড করল জন। হাতে এখনও প্রস্তুত পিস্তল। দ্রুত শ্বাস ফেলছে।

দেয়ালের গায়ে আছড়ে পড়েছিল টম। এবারে সিধে হলো। তার পাতলা মুখটা একদম ভাবলেশহীন। হবসের লাশের দিকে চাইল একবার। তারপর মুখ তুলে চাইল নিজের লোকদের দিকে।

‘ঠিক আছে,’ কর্কশ গলায় বলল সে। ‘কেউ একটা মগ আর বালতি নিয়ে এসে জায়গাটা পরিষ্কার করো।’ জনের দিকে ফিরল সে। ‘পিস্তলে তো দারুণ হাত তোমার,’ প্রশংসার সুরে বলল।

জন কিছু বলল না। বমি-বমি ভাব হচ্ছিল ওর। ঢোক গিলল।

মুচকি হাসল টম। ‘ড্রিঙ্কটা শেষ করো।’ জনের মদের গ্লাস তার হাতে।

হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিল জন। অবাক হয়ে গেল দেখে যে, একটুও হাত কাঁপছে না ওর।

চমৎকার লাগল উইস্কির স্বাদটা। ধাতস্থ হতে সাহায্য করল ওকে। হোলস্টারে ঢুকিয়ে ফেলল কোল্ট।

ড্রিঙ্ক শেষ করে গ্লাসটা ফিরিয়ে দিল সে ফোর্ডকে।

ফোর্ড এক হাতে গ্লাস, অপর হাতে টেবিলের উপর থেকে তুলে নিল মদের বোতল।

‘চলো,’ বলল সে। ‘ওরা ঘর পরিষ্কার করুক। ততক্ষণে আমরা বাইরে থেকে ঘুরে আসি।’ তার কণ্ঠে এখন জনের প্রতি সমীহের ছাপ। ‘হবসের ব্যাপারটা যেভাবে সামাল দিলে, সন্দেহ নেই, একজন যোগ্য লোক তুমি। ভাল মানুষ-বলেছে জুলি, তোমার সাথে কাজ করা যায়। ওর কথা এখন বিশ্বাস করছি আমি। ….এবার ব্যবসা নিয়ে সিরিয়াস কিছু কথা বলা দরকার। বাপের জন্মেও শুনিনি যে, কোনও লোক নিজের রানশের গরু চুরি করে…’

বারো

দুই দিন পর।

জন উইলিয়ামস আবার ফিরে এসেছে বেণ্ট’স ক্রসিং-এ ফ্লেচার’স হোল থেকে ফেরার পথে ওখানকার প্রতিটি ট্রেইল, ঝর্নার গতিপথ, ক্যানিয়ন, গিরিখাত ইত্যাদি সব কিছু মনের মধ্যে গেঁথে রেখেছে।

এলাকাটা চিনে রাখার কারণ: এটি হতে যাচ্ছে তার যুদ্ধক্ষেত্র।

লড়াই যে একটা হবে, সে ব্যাপারে ওর কোনও সন্দেহ নেই।

টম ফোর্ড ওর সঙ্গে রয়েছে।

জুলিয়াকেও গণনার মধ্যে রাখছে।

এদেরকে নিয়েই লড়াইটা করতে হবে।

শহরের দিকে তাকিয়ে এসব কথাই ভাবছিল জন।

টম ফোর্ড ওর দক্ষতা আর যোগ্যতার প্রমাণ দেখার অপেক্ষা করছিল।

বুটস হবসের সঙ্গে মারপিট জনের সে যোগ্যতা আর দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে।

টম ফোর্ড শক্তিশালী আর দক্ষ পিস্তলবাজদের শ্রদ্ধা করে। সবগুলো গুণই সে জনের মধ্যে পেয়েছে।

জনও লোকটাকে এ দু’দিনে যেটুকু চিনেছে, বুঝেছে, তাতে মনে হয়েছে, এ খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। চট করে রেগে যায় না, আর ব্যবসাটা ভালই বোঝে। চুক্তির ব্যাপারে খুব হিসেবী আর সাবধানী সে, আর এ বিষয়ে কোনও ছাড় দিতেও রাজি নয়।

একটা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ফোর্ডের। রয়েছে অস্ত্রবল, ওয়েস্টেশন-যেখানে চুরি করা গরু এনে রাখা যাবে, ব্র্যাণ্ড বসানো যাবে ওগুলোর গায়ে। বিক্রেতাও ঠিক করে দেবে টম ফোর্ড।

এত সব সুবিধা চট করে অন্য কোথাও পাবে না ভেবেই লোকটার সঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছে জন।

এখন পরবর্তী পদক্ষেপ হলো, বিষয়টা নিয়ে জুলিয়ার সঙ্গে আলোচনা।

দীর্ঘ ক্লান্তিকর একটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে জন; শরীর নোংরা লাগছে, খিদেয় জ্বলছে পেট। ঘোড়াটাকে আগে বাড়ার জন্য স্পারের গুঁতো লাগল সে।

শহরের ধুলোমাখা মূল রাস্তায় ঘোড়া নিয়ে চলেছে জন; টের পেল, অনেকেই ওকে সন্দেহের চোখে দেখছে।

বার্ট অ্যান্ড্রিউ ভালই বদনাম ছড়িয়েছে তার সম্পর্কে।

জাহান্নামে যাক সে, ভাবল জন। ও এখন যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

রবার্টস’ প্লেস-এর সামনে এসে ঘোড়া থেকে নামল জন।

ঘোড়াটা চিঁহিহি শব্দে ডেকে উঠল, মুখ ডোবাল কাছের একটা ওঅটর ট্রাফে।

জানোয়ারটা পানি খাচ্ছে, সতর্ক ভাবে দাঁড়িয়ে রইল জন, নজর বুলাচ্ছে রাস্তায়।

শহরের লোকজন এমন ভাবে ওর দিকে তাকাচ্ছে, যেন ও উদ্ভট কোনও প্রাণী।

ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে পিস্তলের বাঁটে হাত রাখল জন। রাস্তার ওপাশে জটলা করা লোকগুলোর দিকে কটমট করে তাকাল।

ওর ভয়ঙ্কর চাউনি দেখে আত্মা উড়ে গেল লোকগুলোর। দ্রুত ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল তারা।

মৃদু হাসল জন। পরমুহূর্তে মুখ থেকে মুছে গেল হাসি। বিপদের গন্ধ পেয়েছে ও। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের টানে ঘুরল। হিচর‍্যাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘোড়ার লাগাম হাতে নিয়েছিল। তাকাল রাস্তার বিপরীত দিকে।

মোটেই অবাক হলো না ও। যেন আশাই করেছিল, ওদের দেখবে।

সাইডওঅক ধরে দুই মূর্তি এগিয়ে আসছে ওর দিকে। বার্ট অ্যান্ড্রিউ আর জনের সৎ-ভাই পিটার উইলিয়ামস।

জনের কাছ থেকে ওরা এক শ’ হাত দূরে, ওর দিকে হেঁটে আসছে সরাসরি।

ঘোড়ার লাগামটা হাত থেকে খসে পড়তে দিল জন। জানোয়ারটা এখন কোথাও যাবে না।

ওঅটর ট্রাফের কাছ থেকে সরে এসে সরাসরি ওদের মুখোমুখি দাঁড়াল।

ওরা এগিয়ে আসছে; শুনতে পেল, পিটার নিচু আর উত্তেজিত গলায় বলছে: ‘আমার কথা শোনো, বার্ট। সমঝোতার কোনও রাস্তা নিশ্চয়ই আছে-’

‘চোপরাও!’ খেঁকিয়ে উঠল বার্ট।

সাইডওঅক থেকে রাস্তায় নেমে পড়ল জন। মনে হলো, ওর ডান হাতটা হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। নিশপিশ করছে অ্যাকশনের জন্য। আমি এখন ওকে খুন করতে পারি, মনে মনে বলছে জন। আমি এখন ওকে খুন করতে পারি, আর তা হলেই সব কিছুর নিষ্পত্তি হয়ে যায়।

কিন্তু যেমন তড়িৎগতিতে মাথায় এসেছিল চিন্তাটা, তেমনি দ্রুত ভাবনাটা বিসর্জন দিল জন।

বার্টকে আগে ড্র করতে হবে।

আর জন ওকে শুইয়ে দিতে পারলেও বাকি রয়ে যাবে পিটার। ও-ও যদি পিস্তল বের করে বসে? ড্র করে যদি?

বাচ্চা ছেলেটাকে গুলি করার কথা ভাবতেই কেমন যেন লাগছে জনের।

শত হলেও ওরই বাবার সন্তান পিটার।

দু’জনের শরীরে তো একই রক্ত বইছে…

পিস্তল থেকে দূরে হাত সরিয়ে নিল জন। পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে বুকে হাত বাঁধল। অপেক্ষায় রয়েছে।

ওর এক হাত সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল বার্ট।

বার্টের পিছনে পিটার।

‘তো,’ বলল বার্ট। ‘তোমার চামড়া গণ্ডারের মত পুরু, তাই না?’

চুপ করে রইল জন। বার্টের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। বার্ট ওর কটমটে চাউনিতে ভ্রূক্ষেপও করল না। শান্ত গলায় বলল, ‘মনে পড়ে, তোমাকে ফ্লেচার’স হোল ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলাম।’

‘কার আদেশ মানতে হবে, তা আমি জানি,’ বলল জন।

ফোঁস করে শ্বাস ফেলল বার্ট। ‘তোমাকে আরও একবার শিক্ষা দিতে হবে, দেখছি।’

নিজের ঘোড়ার পিঠে হেলান দিল জন। নরম গলায় বলল, ‘শিক্ষা দিতে হলে তো আবার কাউকে আমার পিছনে পিস্তল নিয়ে দাঁড়াতে হবে। তবে এবারে তার জন্য কাজটা সহজ হবে না।’

‘কেউ তোমার পিছনে পিস্তল নিয়ে দাঁড়াবে না,’ কলকল করে উঠল পিটার। ‘তুমি আমাদের কী ভাবো, অ্যাঁ?’

‘বার্টের কী দশা করব, আমি জানি,’ বলল জন, ‘তবে তোমার ব্যাপারে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নিইনি।’

‘বাজে কথা বন্ধ করো,’ ধমকে উঠল বার্ট। ‘এখনও সময় আছে। ঘোড়া নিয়ে পালাও।’

‘দুঃখিত,’ বলল জন, ‘পালাতে পারব না। এখানে এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছি। কাজ শেষ না করে কোথাও যাচ্ছি না।’

চোখ সরু হয়ে এল বার্টের। ‘বন্ধু, বড্ড চালাক তুমি,’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল। ‘অনেক হয়েছে। তোমাকে শায়েস্তা করতে—’ কথা শেষ না করেই হাতটা ঝট করে পিস্তলের বাঁটের কাছে নিয়ে গেল।

ড্র করার চেষ্টাই করল না জন। ছেড়ে দেয়া স্প্রিং-এর মত সামনে বাড়াল শরীরটা।

পিস্তল বের করতে যাচ্ছিল বার্ট, প্রবল ধাক্কা খেয়ে সাইডওঅকের কিনারে ছিটকে পড়ল।

তার উপরে পড়ল জন।

এক ঝলক দেখল সে পিটারকে। দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। কী করবে, বুঝতে পারছে না।

‘তুমি এসব থেকে দূরে থাকো!’ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে ওকে বলল জন।

হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করতে যাচ্ছিল বার্ট। জন ওর ডান হাতটা বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরল। বোর্ডওঅকে গড়ান খেল দু’জনে। তারপর পিস্তল্ বাগে পেতে শুরু হলো মারামারি।

ভালুকের শক্তি বার্টের গায়ে।

আর জন কুগারের মত ক্ষিপ্র। চাবুকের মত পাকানো ওর শরীর।

সাইডওঅকে গড়াগড়ি খেতে লাগল ওরা।

সারা জীবন রানশে কাজ করা জনের ইস্পাত-কঠিন হাতের চাপ কিছুতেই এড়াতে পারছে না বার্ট

হঠাৎ পিস্তল গর্জে উঠল বার্টের।

লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আকাশে ছুটল-গুলি।

জন ওর হাতে এমন জোরে চাপ দিল যে, ব্যথায় ককিয়ে উঠে কোল্টটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো সে।

চোখের কোনা দিয়ে একটা বুটজুতোর ডগা দেখতে পেল জন-পিটার উইলিয়ামসের জুতো-লাথি মেরে পিস্তলটা ওদের নাগালের বাইরে সরিয়ে দিল সে। বার্টের হাত ছেড়ে দিল জন, এক লাফে খাড়া হলো।

‘ঠিক হ্যায়, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। নিজের অস্ত্র ব্যবহার করার কথা ভাবছেই না।

বার্ট সেদিন ওকে অন্যায় ভাবে মেরেছিল।

আজ ওকে তুলোধুনো করে সেদিনের মারের শোধ নেবে জন। এমন মার মারবে, যাতে নিজের চেহারাটা আর চিনতে না পারে বার্ট।

‘ঠিক হ্যায়,’ আবার বলল জন। ‘এসো। আমি ড্র করব না।’ কী করছে, নিজেও হয়তো পূর্ণ সচেতন নয় সে, গোল্ডপ্লেটেড কোল্টটা হোলস্টার থেকে বের করে পিটারের হাতে তুলে দিল। ‘ধরো এটা।’ বার্টের দিকে ফিরে বলল, ‘সামনে আয়, হারামজাদা!’

রাস্তা থেকে উঠে দাঁড়াল বার্ট। কবজি ডলছে। সাইডওঅকে দাঁড়ানো সৎ-ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পিটার, ওর পিস্তলটা আমাকে দাও।’

জনের উপর থেকে পিটারের নজর সরল বার্টের দিকে। ছোট্ট মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার, তবে গাল জোড়া রক্তিম। ‘তুমি একা কী করতে পারো, পারলে দেখিয়ে দাও, বার্ট।’

লম্বা শ্বাস টানল বার্ট। রাগে বিকৃত দেখাল চেহারা। নেকড়ের হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। ‘আচ্ছা। দেখাচ্ছি তবে!’

ঘুসি পাকিয়ে ছুটে গেল জনের দিকে।

জমিনে পা জোড়া শক্ত করে গেঁথে নিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল জন। ঝট করে নিচু হলো।

বার্টের ছোঁড়া ঘুসিটা ওর কাঁধে লাগল।

প্রচণ্ড বেগ ছিল ঘুসিতে, তবে এর জন্য প্রস্তুতই ছিল জন। সে-ও ঘুসি চালাল পাল্টা। ওর প্রবল মুষ্টি আঘাত হানল বার্টের পেটে।

হুউউশ করে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে এল লোকটার মুখ দিয়ে।

আবার মারল জন। তারপর চট করে পিছিয়ে এল। বার্টের ঘুসি খেয়ে ওর ডান হাত পুরো অবশ হয়ে আছে।

চরম উত্তেজনাকর একটা মুহূর্ত একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইল ওরা, দু’জনেই সতর্ক, এবং পরস্পরের শক্তি যাচাই করে নিচ্ছে মনে মনে।

তারপর নড়ে উঠল জন। চিতার ক্ষিপ্রতায় এগিয়ে গেল।

বার্ট অ্যান্ড্রিউ লড়াকু প্রকৃতির। সে জানে, কোথায় আঘাত করতে হবে। দুই হাত ব্যবহার করে জনের শরীরে ঘুসি চালাল সে।

তবে জন বার্টের আঘাতের তোয়াক্কা করছে না। বুকে তার দাউ-দাউ প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। চেষ্টা করছে বার্টকে মোক্ষম আঘাত করার জন্য। আর মারছেও। সাপের মত তড়িৎ- ছোবল হানছে জন। তার ঘুসিগুলো নির্দয় ভাবে আছড়ে পড়ছে বার্টের নাকে-মুখে-বুকে।

মার খেয়ে পিছু হটছে বার্ট, কিন্তু এক মুহূর্তও তাকে রেহাই দিচ্ছে না জন। আরও জোরে আঘাত করছে।

হঠাৎ সুযোগ পেয়ে ভালুকের মত দু’হাতে জনকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরল বার্ট।

ভয়ঙ্কর চাপ খেয়ে চোখে সর্ষে ফুল দেখল জন। বজ্র-আঁটুনি থেকে মুক্তি পেতে ধস্তাধস্তি করতে লাগল।

যেভাবে চাপ দিচ্ছে বার্ট, মেরুদণ্ডটা জনের যে-কোনও মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে।

ডান পা দিয়ে বার্টের বাম হাঁটুতে প্রচণ্ড লাথি হাঁকাল জন। দু’জনেই দড়াম করে পড়ে গেল মাটিতে। জন নীচে, বার্ট উপরে।

এক হাত দিয়ে শত্রুর গলা টিপে ধরল বার্ট। আরেক হাতে চোখে খোঁচা দেয়ার চেষ্টা করল।

দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম জনের। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাত জোড়া চেপে ধরল সে। গলা আর চোখের উপর থেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে।

বার্টের আসুরিক বন্ধন আলগা হলো।

ধাক্কা মেরে ওকে গায়ের উপর থেকে ফেলে দিল জন।

তারপর দেখা গেল, দু’জনেই ধুলোর উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। সুযোগ পেলেই ঘুসি মারছে একে অপরকে। কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান। সারভাইভালের জন্য এ এক বুনো, নোংরা লড়াই।

বার্ট অ্যান্ড্রিউ বিশালদেহী হতে পারে, কিন্তু জনও কম যায় না। প্রচণ্ড সংগ্রামময় জীবন ওকে কঠিন আর কঠোর করে তুলেছে, লড়াইতে টিকে থাকার শক্তির অভাব নেই তার।

আর আরাম-আয়েশের জীবন যাপন বার্টের মধ্যে এনেছে আলস্য আর মন্থরতা। ফলে সহজেই হাঁপিয়ে উঠল সে।

ওদিকে জনের চেহারায় ক্লান্তির ছাপ মাত্র নেই। বার্টের পেশি যখন শিথিল, জনের বাহু তখন লৌহকঠিন।

জন টের পেল, হাল ছেড়ে দিচ্ছে বার্ট। সুযোগটা কাজে লাগাল সে। প্রবল এক ধাক্কা মেরে লোকটাকে গায়ের উপর থেকে ফেলে দিয়ে ওর গায়ে চড়ে বসল, যেন গেঁথে ফেলবে মাটির সঙ্গে। মুঠো করে চেপে ধরল চুল, শক্ত জমিনে ঠুকতে লাগল ভীষণ জোরে।

‘আমাকে খুন করবে!’ চিৎকার করে বলল ও, নিজের কণ্ঠ নিজের কাছেই অচেনা লাগল। ‘খুন করবে আমাকে! আমার রানশ থেকে আমাকেই তাড়িয়ে দেবে, না?’

ও হয়তো বার্টকে মেরেই ফেলত, যদি না পিছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর বাধা দিত ওকে। ‘জন! জন! থামো! ওকে ছেড়ে দাও!’ তারপর শুনল, ‘এই, কেউ ওকে থামাও!’

কয়েক জোড়া হাত জনকে টেনে ধরে বার্টের গায়ের উপর থেকে নামিয়ে আনল।

সিধে হলো জন। ঘুরল। যারা ওকে টেনে নামিয়েছে, তাদেরকে মারার জন্য প্রস্তুত হলো। কিন্তু দেখল, ওর দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে জুলিয়া রবার্টস।

জুলিয়ার সঙ্গে হাত লাগিয়েছে পিটারও। এখনও জনের হাত ধরে রেখেছে সে।

ঝাঁকি মেরে নিজেকে ছুটিয়ে নিল জন। তাকাল বার্টের দিকে।

ধুলোয় লুটিয়ে আছে বার্ট। অজ্ঞান। স্রোতের মত রক্ত পড়ছে নাকের জোড়া ফুটো দিয়ে

‘শান্ত হও, জন!’ মিনতি করল জুলিয়া, ‘প্লিজ, শান্ত হও।’

ধুলোমাখা শার্টের আস্তিন দিয়ে মুখ মুছল জন।

সাদা এক টুকরো কাপড় দিয়ে ওর থুতনির রক্ত মুছে দিল জুলিয়া। ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি ঠিক আছ তো?’

ধুলো আর রক্তের গন্ধ ছাপিয়েও মেয়েটার গায়ের সুগভীর গন্ধ পেল জন।

‘আছি,’ বলল ও। তাকাল পিটার উইলিয়ামসের দিকে।

সে তার সৎ-ভাইয়ের অজ্ঞান দেহের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আতঙ্কিত চোখে দেখছে জনকে।

জন টলতে টলতে এগিয়ে গেল ওর দিকে। হাত বাড়াল। ‘আমার বন্দুকটা দাও,’ দাবি করল কর্কশ গলায়।

এক মুহূর্ত দুই ভাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর ওয়েস্টব্যাণ্ড থেকে সোনালি পিস্তলটা নিয়ে নিঃশব্দে জনের হাতে গুঁজে দিল পিটার।

হোলস্টারে পুরে রাখল জন বন্দুকটা। আরও কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল সৎ-ভাইয়ের চোখে।

চোখ সরিয়ে নিল পিটার। ঝুঁকল বার্টের উপর।

জনের বাহুতে ডুবে গেল জুলিয়ার হাতের আঙুল। ‘বাসায় চলো,’ তাগাদা দিল ও। ‘পরিষ্কার হয়ে নেবে।’

তেরো

ভাল ভাবে হাত-মুখ ধুয়ে নিয়েছে জন।

আর্নিকা আর কোর্টপ্লাস্টার দিয়ে ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিয়েছে জুলিয়া।

শরীরের প্রতিটা কোষ ব্যথায় ঝিনঝিন করলেও বিশ্রাম নিলেই সুস্থ হয়ে উঠবে জন। একটু আগে মস্ত এক স্টেক আর প্লেট বোঝাই আলুভাজা পেটে চালান করে দিয়ে এখন গরম কালো কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। বলল, ‘ধন্যবাদ, জুলিয়া। তোমার জন্যই টম ফোর্ডকে পেলাম।’

‘ধন্যবাদ পরে দিয়ো,’ বিড়বিড় করল জুলিয়া। জনের বিপরীত বসেছে সে। পরনের সাদা ড্রেসটাতে দারুণ মানিয়ে গেছে ওকে। সুন্দর লাগছে দেখতে।

এমন অপরূপ কোনও সুন্দরীর সঙ্গে পরিচয় হওয়াটাও সৌভাগ্যের ব্যাপার, ভাবছে জন।

‘কী ভাবছ তুমি?’ জুলিয়াকে জিজ্ঞেস করল জন।

‘কিছু না,’ বলল জুলিয়া, ‘তোমাকে ফোর্ডের কাছে পাঠানোর পর ভাবছিলাম, ভুলই করলাম কি না। তবে তোমাকে সাহায্য করার মত আর কোনও লোকের কথা আমার মনে পড়েনি।’

‘তোমার উদ্বেগের কারণটা বুঝতে পারছি,’ বলল জন, ‘টম ফোর্ড কঠিন প্রকৃতির মানুষ। নিজের খেয়ালে চলে। তবে ওর স্বার্থের সাথে আমাদের স্বার্থের কোনও দ্বন্দ্ব তৈরি না হওয়া পর্যন্ত লোকটার উপর নির্ভর করা যায়।’ কাপ নামিয়ে রাখল সে। ‘তা ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে ওর উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় ও নেই। তার লোকবল আছে। আমাদের প্রয়োজনীয় সেট-আপের সুবিধা দেবে, বলেছে…আদালতে মামলা লড়তে গেলে আমার ভাগের গরু বিক্রি করে টাকাটা জোগাড় করতেই হবে।’ সিগারেট বানাতে শুরু করল ও। ‘আমি আমার ভাগের গরু চুরি করতে পারব। কিন্তু চাইলেই তো আর খামারের তিন ভাগের এক ভাগ আদায় করতে পারব না। কাজেই, আদালতের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া রাস্তা নেই।’

‘তুমি যেভাবে অ্যান্ড্রিউর মাথাটা মাটিতে ঠুকছিলে, ও যদি মরে যেত…নির্ঘাত ফাঁসি হত তোমার।’

‘ওর কাছ থেকে টেনে সরিয়ে এনে ঠিক কাজই করেছ,’ তিক্ত স্বরে বলল জন। ‘তুমি না থাকলে পিটার হয়তো নাক গলাতে আসত। তখন ওর সাথে মারপিট করতে হত আমাকে। আর সেটা আমি মোটেই চাই না।’

‘আমি তো তা-ই বলছিলাম,’ বলল জুলিয়া। ‘তুমি বার্টকে মেরে ফেললে পিটার স্রেফ চেয়ে চেয়ে দেখত না। ওর সাথেও তোমাকে লড়তে হত। হয়তো ওকেও মেরে ফেলতে হত তোমার। শহরের লোকজন তখন ফাঁসিতে ঝোলাত তোমাকে।’

সিগারেটের ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে জুলিয়ার দিকে তাকাল জন। ‘তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, অমন কিছু ঘটলে তুমি খুব আপসেট হয়ে যেতে।’

জবাবে জুলিয়া কিছু বলল না।

জন দ্রুত বলল, ‘তবে তুমি আমাকে বাধা না দিলে একটা মস্ত ঝামেলা থেকে রেহাইও মিলত। অ্যান্ড্রিউ যখন জানবে, তার গরু চুরি যাচ্ছে, ফোর্ডের ধারণা-বন্দুকবাজ ভাড়া করবে সে তখন, আর রক্তারক্তি একটা হবেই।’ সিধে হলো ও। ‘ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না আমার। লিঙ্কন কাউন্টি থেকে কিছুদিন আগেই মারামারি করে এসেছি। চেয়েছিলাম, এখানে এসে শান্তিতে কাটাব। কিন্তু ওই হতচ্ছাড়া অ্যান্ড্রিউটার কারণে তা আর হলো না।’

করিডরের দরজা খোলার শব্দে ঘাড় ঘোরাল জন।

জুলিয়ার বোন ম্যাগি ঢুকেছে ঘরে।

লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে রইল মেয়েটা। মুখটা সামান্য লালচে।

‘বাইরে…এক লোক এসেছে,’ বলল ম্যাগি, ‘মিস্টার উইলিয়ামসের সাথে দেখা করতে চায়।’

নিজের অজান্তেই কোমরের কাছে হাত চলে গেল জনের। ‘কে?’

‘পিটার উইলিয়ামস।’

জন আর জুলিয়া দ্রুত দৃষ্টি বিনিময় করল।

দরজার দিকে পা বাড়াল জন। ম্যাগিকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে দরজা খুলল।

বেল্টের মধ্যে বুড়ো আঙুল গুঁজে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে পিটার। দরজা খোলার শব্দে দ্রুত বেল্ট থেকে সরিয়ে নিল হাত। জনের কাঁধের উপর দিয়ে ঘরের ভিতরে তাকাল। একটু যেন অপ্রতিভ বোধ করল জুলিয়াকে দেখে।

‘তোমার সাথে একটু কথা আছে,’ মৃদু গলায় বলল সে জনকে।

‘তা হলে ভিতরে এসো,’ দরজার একপাশে সরে দাঁড়াল জন।

মাথার হ্যাট খুলে ইতস্তত করল পিটার। তবে ভিতরে ঢুকল। প্রথমে জুলিয়া, তারপর ম্যাগির দিকে তাকিয়ে মৃদু বাউ করল। ‘মিসেস রবার্টস, মিস…’

‘ম্যাগি,’ বলল জুলিয়া, ‘ও ম্যাগি পার্কার। বিয়ের আগে আমিও পার্কার ছিলাম। ও আমার বোন।’

জন লক্ষ করল, ম্যাগির দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে পিটার।

ওর চাউনির সামনে বিব্রত বোধ করল ম্যাগি, অস্ফুট স্বরে বলল কী যেন।

জনের দিকে ঘুরল পিটার। ‘আজ সকালে বার্টকে তুমি প্রায় মেরেই ফেলেছিলে।’ নরম ভাবটা একদম উধাও তার কণ্ঠ থেকে।

‘ওর পাওনা ছিল ওটা।’

‘আমি বলছি না যে, ওটা ওর পাওনা ছিল না…’ দ্বিমত করল না পিটার। ‘একটা বাকবোর্ডে করে ওকে রানশে পাঠাতে হয়েছে। অবস্থা এমন যে, ঘোড়ায় চড়তে পারবে না।’

এক মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এল ঘরে।

জন বলল, ‘তুমি কি বাকি লড়াইটুকু লড়তে এসেছ?’

ডাইনে-বাঁয়ে মন্থর গতিতে মাথা নাড়ল ছেলেটি। ‘না। আমি তোমাকে বলতে এসেছি, এখানে ঘুরঘুর করলে তোমার কপালে খারাবি আছে। বার্ট প্রতিজ্ঞা করেছে, তোমাকে দেখা মাত্র খুন করবে। আর সে যা বলে, তা করে ছাড়ে। যদি আধ ডজন গানম্যান ভাড়া করতে হয়, তবু সে কাজটা করে ছাড়বে।’

‘আর তুমি?’ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল জন।

‘আমি?’ এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধাগ্রস্ত দেখাল পিটারকে।

কোমরে পিস্তল ঝোলানো সত্ত্বেও স্রেফ একটা বাচ্চা ছেলের মত লাগছে ওকে জনের।

দুই হাতের তালু মেলে ধরল পিটার। ‘আমি আর কী করব? আমার ধারণা, তোমার ওই চিঠি আসল। আমার ভাই তুমি। বার্টও। আমরা একসাথে বড় হয়েছি। সে যদি ‘না’ বলে, তা হলে তাকে ‘হ্যাঁ’ করানোর সাধ্য আমার নেই।’ চেহারাটা করুণ দেখাচ্ছে ওর। গলার স্বরটা কেমন বিষণ্ণ শোনাল। ‘তোমার এখান থেকে চলে যাওয়াই ভাল। তুমি চলে গেলে আর ঝামেলা থাকে না। বার্টের সাথে কথা বলে আমি—’

‘বার্টের সাথে কথা বলার দরকার নেই,’ কর্কশ গলায় বলে উঠল জুলিয়া।

দ্বিধাগ্রস্ত দেখাল পিটারকে। হাতটা নড়ে উঠল ওর।

জন লক্ষ করল, তৃতীয় আরেকটা অস্ত্র ওয়েস্টব্যাণ্ডে গুঁজে রেখেছে পিটার। অস্ত্রটা দেখা মাত্র চিনতে পারল।

পিটার ওটা এগিয়ে দিল জনের দিকে। ‘আমি এসেছিলাম এটা ফিরিয়ে দিতে। সার্কেল ইউ-তে এটা তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলাম আমরা।’

জন আগ্নেয়াস্ত্রটা নিয়ে সৎ-ভাইয়ের চোখে চোখ রাখল। ‘ধন্যবাদ।’ জুলিয়ার দিকে ফিরল সে। সোনার জলের প্রলেপ দেয়া পিস্তলটা হোলস্টার থেকে খুলে নিল। ‘তোমার জিনিসটা এখন ফেরত নিতে পারো।’

ওর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল জুলিয়া। ‘আরও কিছুদিন ওটা নিজের কাছে রাখতে পারো তুমি।’

একটু ভেবে নিয়ে জন বলল, ‘সব সময়ই আমি অতিরিক্ত একটা অস্ত্র বহন করি।’ গোল্ডপ্লেটেড পিস্তলটা আবার যথাস্থানে ফিরে গেল। পিটারের দিকে ঘুরল সে। ‘তোমার সাথে কথা আছে আমার। একান্তে বলতে চাই। সময় হবে তো?’

আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল জুলিয়া। বোনের কনুই ধরল।

ম্যাগি এতক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে ছিল পিটার উইলিয়ামসের দিকে। স্পর্শে চমকে উঠে সংবিৎ ফিরে পেল।

‘চল, পাশের ঘরে যাই। কাজ আছে,’ বলল জুলিয়া তাকে।

ওরা চলে যাওয়ার পর ইশারায় পিটারকে একটা চেয়ার দেখাল জন। ‘বসো। কফি চলবে?’

মাথা ঝাঁকাল পিটার। বসে পড়ল চেয়ারটায়।

জন ওকে খানিকক্ষণ পরখ করে বলল, ‘তুমি একসাথে দুটো অস্ত্র বহন করছ। বেশির ভাগ লোকই কিন্তু একটা পিস্তল রাখে সাথে।’

হঠাৎ বালকসুলভ ভাব ফুটল পিটারের চেহারায়। ‘আমি দুটো পিস্তলই ব্যবহার করতে পারি। প্র্যাকটিসও করেছি। ডান- বাম-দু’হাতেই সমান পিস্তল চালাতে জানি।’

‘তাতে কী?’

‘মানে?’ শূন্য দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল পিটার।

‘বললাম, তাতে কী ঘোড়ার ডিম হলো? তুমি কি বোঝো না, এভাবে পিস্তল নিয়ে ঘোরাঘুরি করলে একদিন-না-একদিন কেউ এগুলো তোমাকে ব্যবহার করতে বাধ্য করবে?’

‘আমিও তো তা-ই চাই!’ উত্তেজিত ভঙ্গিতে সামনে ঝুঁকল পিটার। ‘চাই, কেউ আমার সাথে লাগতে আসুক। বাজি ধরে বলতে পারি, কিডও পারবে না আমার সাথে। তুমি তো কিডকে চেনোই। বনি। লোকে যেমন বলে, সে কি সত্যি-সত্যি ফাস্ট?’

পিটারের চোখ চকচক করছে দেখে হতাশই বোধ করল জন।

ছেলেটা আছে একটা ঘোরের মধ্যে। হিরো হওয়ার খায়েশ জেগেছে।

পিস্তলবাজ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর এরকম তরুণ এর আগেও দেখেছে জন। তাদের পরিণতি মোটেই ভাল ছিল না।

হয়তো পিস্তলবাজি করতে গিয়েই এর খেসারত দিতে হবে একদিন পিটারকে।

‘খুবই ফাস্ট,’ বলল জন শীতল গলায়। ‘তবে সুযোগ পেলে পিছন থেকে গুলি করতেও দ্বিধা করে না।’

‘উঁহুঁ, বিশ্বাস হয় না,’ ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নাড়ল পিটার।

‘আমি ওর নাড়িনক্ষত্র জানি, বলল জন, ‘ওর সাথে মিলে লড়াই করেছি। কাপুরুষের মত পালিয়ে যেতেও দেখেছি ওকে। তুমি এসব পিস্তল-ফিস্তল বাড়িতে রেখে এগুলোর কথা ভুলে যাচ্ছ না কেন? হয়তো আগামী দশ বছর পর এমন পরিবেশ সৃষ্টি হবে যে, কাউকে আর কোমরে পিস্তল ঝোলাতে হবে না।’

গনগনে চেহারা নিয়ে চেয়ার ছাড়ল পিটার। ‘আমি চাই, লোকে আমার নাম জানুক,’ রাগত গলা তার। ‘বনির মত সবাই এক নামে চিনুক আমাকে।’ বিরতি দিল। ‘যেভাবে সবাই তোমাকে চেনে।’

‘ওরা আমার নাম জানে না,’ দ্রুত বলল জন।

‘তোমার তা-ই ধারণা?’ চ্যালেঞ্জ করল পিটার। ‘আশপাশে খোঁজখবর নিয়েছি আমি। সবাই তোমাকে চেনে। সবাই বলছে, তুমি একজন টপ গানহ্যাণ্ড। দারুণ পিস্তল চালাও। অথচ এখানে দাঁড়িয়ে আমাকে লেকচার শোনাচ্ছ!’

জন বুঝতে পারল, এ ছেলেকে বুঝিয়ে কোনও লাভ হবে না। হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে হাত নাড়ল সে। ‘ঠিক আছে। যা ভাল বোঝো। তবে সাপ মারতে গিয়ে নিজেই সাপের কামড় খেয়ে মোরো না যেন।’ গলার স্বর বদলে গেল তার, ‘শোনো, আমার একটা উপকার করতে হবে।’

‘কী?’

‘মরিস উইলিয়ামস কীভাবে মারা গেছে, বলো আমাকে,’ মৃদু গলায় বলল জন।

বিষাদের কালো ছায়া পড়ল পিটারের চেহারায়। ‘আমি ও নিয়ে কথা বলতে চাই না,’ বলল সে, ‘খুব খারাপ লাগে।’

‘তবু শুনতে চাই আমি। আমাকে জানতেই হবে, কীভাবে মারা গেল বাবা।’

দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরল পিটার। ইতস্তত করছে। তারপর মেঝের দিকে ফিরিয়ে নিল চোখ। ওরা বলে, বাবার ক্যানসার হয়েছিল। রোগটা শরীরের ভিতরে জন্মায়, আর পুরো শরীরটা খেয়ে ফেলে।’

‘ক্যানসার শরীরের কী ক্ষতি করে, তা আমি জানি,’ বলল জন, ‘বলে যাও।’

‘বাবা খুব অসুস্থ বোধ করছিল। শিকাগো গিয়েছিল পরীক্ষা করানোর জন্য। ওরা ওকে ওখানে থেকে যেতে বলেছিল। বাবা থাকেনি। বাড়িতেই মরতে চেয়েছিল সে।

‘খুবই দৃঢ় মনোবলের মানুষ ছিল বাবা,’ বলে চলল পিটার। ‘ডাক্তাররা পর্যন্ত অবাক হয়ে গিয়েছিল ওর মনোবল দেখে। মৃত্যুর আগের দিন তারা বলেছিল, বাবা কমপক্ষে আরও দু’মাস টিকে যাবে।’

‘তাকে কি ব্যথা নাশক ইনজেকশন দেয়া হত?’ জানতে চাইল জন।

‘বেশির ভাগ সময়। কারণ, যন্ত্রণায় খুব চিৎকার করত বাবা।’

‘হুঁ,’ বলল জন। ভাবছে, প্রবল যন্ত্রণা সয়ে মারা যাচ্ছিল একজন বুড়ো মানুষ। ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। ডাক্তার বলেছিল, আরও দুই মাস টিকবে…কিন্তু তার আগেই মারা গেল। ‘সে কি আমার ব্যাপারে কিছু বলে গিয়েছিল?’

‘বলতেও পারে, আবার না-ও বলতে পারে,’ দ্বিধান্বিত স্বরে জবাব দিল পিটার।

‘ঠিক বুঝলাম না।’

‘মানে, বেশ কয়েকবারই বলছিল, কীসের জন্য যেন অপেক্ষা করছে সে। তারপর…’ কেঁপে গেল পিটারের গলা। ‘তারপর…মৃত্যুর আগের দিনের ঘটনা ছিল ওটা। ব্যথা কমানোর ইনজেকশনের কারণে অর্ধ-অচেতন অবস্থা তখন বাবার…আমি আর বার্ট তার পাশেই ছিলাম। কথা বলতে শুরু করল সে…আমাদের ভাইয়ের ব্যাপারে। বলছিল, আমাদের না দেখা ভাইটি নাকি শীঘ্রিই বাড়ি ফিরবে। তাকে যেন আমরা…সমাদর করি…আপন ভাইয়ের মত সম্মান করি…ভালবাসি…’

‘আর কিছু বলেছিল…কীভাবে আমি তার কাছ থেকে বিছিন্ন হয়ে গেলাম?’

‘না। আমি তাকে শুধু ওই কথাগুলোই বলতে শুনেছি। তখন প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিল সে। বার্ট ওর মুখের উপর ঝুঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বাবা, কী বলছ তুমি? তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।’ বাবা ফিসফিস করে কী যেন বলল বার্টকে। শুনতে পাইনি আমি। পরে বার্টকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বলল, ও কিছু না। বাবা নাকি ওষুধের ঘোরে প্রলাপ বকছিল। সে যা-ই হোক…পরদিন সকালে আমরা তার ঘরে গিয়ে দেখি, মারা গেছে বাবা। ডাক্তার বলল, ক্যানসারের কারণে নয়, হার্ট দুর্বল ছিল বলে স্ট্রোক করেছে।’

‘আই সি, বিড়বিড় করল জন। অকস্মাৎ ঠাণ্ডা লেগে উঠল শরীর। বারবার মনে হচ্ছে, কোথাও একটা মস্ত ভজকট রয়েছে। বাবার মৃত্যুর এ গল্প মেনে নিতে চাইছে না মন।

‘এর ক’দিন পরেই তুমি এসে হাজির হলে।’ মাথায় হ্যাট চাপাল পিটার। ‘এখন বলো, তুমি কী করতে চাও।’

‘তুমি আঘাত পাও, এরকম কিছু করব না,’ বলল জন, ‘তবে আমাকে কেউ আঘাত করতে চাইলে আমিও ছেড়ে দেব না তাকে। বাবাও হয়তো সেটাই চাইত।’

‘বেশ।’ দরজার উদ্দেশে পা বাড়াল পিটার।

‘দাঁড়াও,’ ডাকল জন।

দাঁড়িয়ে পড়ল পিটার। ঘুরল।

‘তুমি কিন্তু এসবের মধ্যে একদম জড়াবে না। বুঝতে পেরেছ? ঈশ্বরের দোহাই, ওই পিস্তল দুটো ফেলে দাও।’

জনকে এক পলক দেখল পিটার। ‘নিজেও জানি না, কী করব আমি। তবে তোমাকে তো বলেইছি…বার্টও আমার ভাই।’

ঘুরে দাঁড়াল সে। বেরিয়ে গেল দরজা খুলে।

চোদ্দ

পরবর্তী কয়েকদিন নেকড়ের মত তীক্ষ্ণ চোখে সার্কেল ইউ-র চারপাশ জরিপ করল জন উইলিয়ামস।

বেশ কয়েকবারই সার্কেল ইউ রাইডারদের দেখে ঘোড়া সহ লুকিয়ে পড়ল। গোপন মিশনে নেমেছে ও। সঠিক ভাবে জানতে হবে সার্কেল ইউ-র গরুর সংখ্যা কত। নিজের ভাগের এক- তৃতীয়াংশ চাইছে জন। কমও নয়। বেশিও নয়।

জরিপ করার পর বুঝতে পারল, এক হাজার গরু পড়বে ওর ভাগে।

চুরি করার জন্য সংখ্যাটা বেশ বড়।

টম ফোর্ড রাসলিং-এ যতই দক্ষ হোক, এক-একবারে কয়েক শ’র বেশি গরু নিয়ে যেতে পারবে না।

আর গরু চুরির ব্যাপারটা বার্ট অ্যান্ড্রিউ ঠিকই টের পেয়ে যাবে। খামারের চারপাশে কড়া পাহারা বসবে তখন।

বিপদ, ঝামেলা আর লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখে একটু দমেই গেল জন।

অন্ধকারে টম ফোর্ডের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জায়গাটায় দাঁড়িয়ে এসব কথাই ভাবছিল ও। চেহারা গম্ভীর।

জায়গাটা সার্কেল ইউ-র শেষ সীমানায়, সরু এক ক্যানিয়নের ধারে।

এখানে কিছু গরু আছে। প্রথম টার্গেট হিসেবে এগুলোই বেছে নিয়েছে জন।

এগুলো খোয়া গেলে সার্কেল ইউ রাইডাররা ভাববে, মরুভূমির দিকে চলে গেছে গরুগুলো।

কঠিন জীবন যাপনে অভ্যস্ত জন জীবিকার তাগিদে অনেক কাজই করেছে। কিন্তু রাসলিং বা গরু চুরি এই প্রথম। বুঝতে পারছে, খুব একটা সহজ নয় কাজটা। কারণ, রাসলিং সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না ও। পুরো ব্যাপারটাই ছেড়ে দিতে হবে এ ব্যাপারে ‘বিশেষজ্ঞ’ টম ফোর্ডের উপর। এ ছাড়া কোনও উপায়ও নেই।

একটা পাথরের উপর, অন্ধকারে বসে আছে জন। হাতে ঘোড়ার লাগাম। হঠাৎ ঝাঁকি দিয়ে উঁচু করল মাথা। নিঃশব্দে সিধে হলো। আদর করে হাত বুলাল ঘোড়াটার ঘাড়ে, তাকাল ওটার খাড়া করা কান বরাবর। একই সময়ে হাত দিয়ে চেপে ধরল ঘোড়ার মুখ, যাতে কোনও শব্দ করতে না পারে।

সুচালো কান দুটো খাড়াই রইল ঘোড়াটার।

নিশ্চয় টম ফোর্ড আসছে।

অস্থির চিত্তে অপেক্ষা করতে লাগল জন। যে শব্দ শুনে কান খাড়া করেছে ঘোড়াটা, সেটা ও-ও শুনতে পেল এবার- পাথরে লোহার নালের ঠুকঠুক আওয়াজ।

ক্যানিয়নে ভূতের মত উদয় হলো কয়েকটা ছায়ামূর্তি।

জনের একটা হাত পিস্তলে চলে গেল। ‘ফোর্ড?’ মৃদু গলায় জানতে চাইল ও।

প্রশ্ন আর জবাব আসার মাঝে সামান্য বিরতি। ‘জন নাকি?’ ফোর্ডের স্বাভাবিক কণ্ঠ।

পেশিতে ঢিল পড়ল জনের। ‘হ্যাঁ, আমিই।’

অন্ধকার থেকে ঘোড়াটাকে বের করে আনল সে।

টম ফোর্ডের সঙ্গী হিসেবে এসেছে জনা দশেক ঘোড়সওয়ার। পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।

স্যাডলে উঠে পড়ল জন। চলে এল ফোর্ডের পাশে।

ফোর্ড জানতে চাইল, ‘গরুগুলো কোথায়?’

‘ক্যানিয়নের বাইরে, রিজের ধারে। রিজের বাইরে ছোট একটা উপত্যকা আছে। চল্লিশটা গরু আছে ওখানে। সবগুলোই তাগড়া।’

‘মাত্র চল্লিশ?’ হতাশ শোনাল ফোর্ডের কণ্ঠ।

‘কম কী?’

নাক সিটকাল ফোর্ড। ‘আমি এর চেয়েও বড় কাজ করেছি। একসাথে দেড় শ’ গরু রাসলিং করার ক্ষমতা আমার আছে। আর তুমি মাত্র চল্লিশটা গরুর কথা বলছ…ঝুঁকির তুলনায় প্রাপ্তি খুবই কম।’

‘কোনও ঝুঁকি নেই,’ বলল জন, ‘আমি সারা দিন নজর রেখেছি। কোনও রাইডার চোখে পড়েনি।’

এক মুহূর্ত নীরব থাকল ফোর্ড। শেষে বলল, ‘ঠিক আছে। দেখা যাক কী হয়।’ লাগাম টানল সে। ‘ব্যাগগুলো পরিয়ে দাও।’ সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল কথাটা। তারপর নেমে পড়ল ঘোড়া থেকে।

প্রশংসা মাখা দৃষ্টিতে দেখল জন, কী অনায়াস দক্ষতায় কাজ করছে রাইডাররা। ওদের ঘোড়াগুলোর চার পায়ের খুরে চামড়ার জুতো পরিয়ে দিচ্ছে। বুঝতে পারল, দলটার আগমন-সংবাদ কেন টের পায়নি।

টম সহ রাইডারদের কারও বুটেই স্পার নেই। কেটে ফেলা হয়েছে, যাতে চলার সময় ঝুনঝুন শব্দ না হয়।

একই রকম চামড়ার ব্যাগ জনের হাতে দিল ফোর্ড। ‘এগুলো তোমার জন্য এনেছি।’

জন তার বে ঘোড়াটার পায়ে ওগুলো পরিয়ে দিল।

পরানোর সময় ঝামেলা করল না বে। দাঁড়িয়ে থাকল ধৈর্য ধরে। মাঝে মাঝে নাক ঝাড়ল শুধু।

‘বুদ্ধিটা ভাল,’ মৃদু গলায় বলল জন।

সবাই ওরা আবার ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসেছে।

কাঁধ ঝাঁকাল ফোর্ড। ‘ওকে। পথ দেখাও।’

আগে আগে চলল জন।

রাতের আঁধারে ভূতের মত অনুসরণ করল ওকে এক ডজন মানুষ।

উপত্যকায় গরুগুলোকে দেখতে পেল ওরা।

শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। কিংবা ঘুমাচ্ছে।

রিজের মাথায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল টম। একজন সেনাপতির মতই তার লোকদের ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিল 1

প্রথমে অর্ধবৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়ল গার্ডরা।

তারপর ‘ওদের নিরাপত্তার ছায়ায় থেকে নীচে নামল রাসলাররা। গরুর পালটাকে জাগিয়ে তুলে তাড়িয়ে নিতে শুরু করল।

এই দক্ষতা মুগ্ধ করল জনকে।

প্রত্যেকেই এরা যে-কোনও খামারে টপ হ্যাণ্ড হওয়ার যোগ্যতা রাখে।

ক্যাটল ড্রাইভের ট্রেইল বস কিংবা রাউণ্ড-আপ বসের মত সর্বত্র ফোর্ডের উপস্থিতি লক্ষ করল জন।

গার্ডরাও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছে। পয়েন্ট চেক করছে, দ্রুত ছুটে যাচ্ছে রাসলারদের আশপাশে। গরু তাড়িয়ে নিতে যেন দেরি না হয়, সেটা নিশ্চিত করার দিকে তীক্ষ্ণ নজর ওদের।

বসে-বসে কাজ দেখা ছাড়া কিছু করার নেই জনের।

রাইডার আর ঘোড়াগুলোর যেন বিড়াল-চক্ষু। চন্দ্রহীন আঁধারেও দিব্যি দেখতে পায়। অবিশ্বাস্য দ্রুততম সময়ে গরুর পালকে তাড়িয়ে সরু উপত্যকার ভিতর দিয়ে খোলা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো।

পালটাকে অনুসরণ করল জন।

ফোর্ড আর একজন রিয়ারগার্ড ওর পাশেই থাকল। মুহূর্তের জন্যও অস্ত্রের উপর থেকে হাত সরাল না ওরা।

ক্যানিয়ন পার হয়ে প্রশস্ত, খোলা জায়গাটিতে আসার পর যেন স্বস্তির শ্বাস ফেলল ফোর্ড। ‘ঠিক আছে,’ বলল সে, ‘আমরা এখন ঝামেলামুক্ত।’ প্রশংসার সুরে জনকে বলল, ‘তোমার জায়গা বাছাইটা বেশ ভাল ছিল।’

‘ধন্যবাদ,’ শুকনো গলায় বলল জন।

‘গরু বিক্রির টাকাটা পেতে কয়েক দিন দেরি হবে,’ বলল ফোর্ড, ‘আমার খরিদ্দাররা ব্র্যাণ্ডের ক্ষত না শুকানো পর্যন্ত ওগুলো নেবে না।’

‘ঠিক আছে।’

‘তাই বলে ততদিন পর্যন্ত আমরা বসে থাকব না,’ জানাল ফোর্ড। ‘চল্লিশটা গরু কিছুই না। আমি তিন-চার শ’ গরু একসাথে সামাল দিতে পারি। তুমি পালের খোঁজ করো। সেই পালে যেন কমপক্ষে এক শ’ গরু থাকে।’

‘ওরকম একটা পাল সামনেই আসছে,’ বলল জন।

‘দ্রুত কাজ সারতে হবে আমাদের,’ হুঁশিয়ার করল ফোর্ড। ‘বার্ট অ্যান্ড্রিউ টের পাওয়ার আগেই যত বেশি সম্ভব গরু হাতিয়ে নিতে, হবে। ওরা টের পেয়ে গেলেই শুরু হবে ঝামেলা। গরু চুরির সময় কাউপাঞ্চারদের সামলানো এক কথা, আর গানহ্যাণ্ডদের সামলানো আরেক কথা।’

ফোর্ডের গলার স্বরে এমন কিছু ছিল, শিরদাঁড়ায় বরফজল নামল জনের। হঠাৎ নিজের ও কাজটার প্রতি বিতৃষ্ণা আর বিবমিষা জাগল ওর। কিন্তু এমন গভীর ভাবে এর মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে যে, শেষ না দেখা পর্যন্ত পরিত্রাণ নেই।

জনের নীরবতাকে ভুল বুঝল ফোর্ড। ‘তোমাকে ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। সময় মত ঠিকই তুমি ভাগের টাকা বুঝে পাবে। তোমাকে তো বলেইছি, আমি একজন ব্যবসায়ী মানুষ। আমি আমার পার্ডনারদের কখনও ঠকাই না। তুমি আরেকটা পাল খুঁজে বের করো। তারপর একই জায়গায় খবর পাঠিয়ো।’

‘নিশ্চয়।’

‘এবারকার সংগ্রহটা নেহায়েত মন্দ নয়,’ বলল ফোর্ড, ‘ঠিকই বলেছিলে তুমি: গরুগুলো সব তাগড়া। ভাল দামই পাওয়া যাবে।’ একটা হাত বাড়িয়ে দিল সে। ‘বিদায় তা হলে।’

ওর সঙ্গে হাত মেলাল জন।

টমের হাতটা শুকনো, হাড্ডিসার আর শীতল।

গা-টা কেমন ঘিনঘিন করে উঠল ওর। ‘বিদায়,’ বলল জন। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বেণ্ট’স ক্রসিং অভিমুখে যাত্রা শুরু করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *