থিসিস ১.৯

নয়

দু’দিন পরের কথা।

রাত ন’টায় নিজের ঘর থেকে চুপিচুপি বেরোল শফি। জামান বাড়ি নেই সে জানত। তবু বারান্দা হয়ে গেটে আসার সময় অভ্যাসবশে জামানের ঘরের দিকে একবার তাকাল।

লিলি পেছন থেকে বলল, ‘আমি পিছু ডাকছি না। ঠিক সময় যেন হুজুর ফিরে আসেন সেটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।’

শফি হাসল।

লিলিও।

‘একটু দেরি হবে। চিন্তা কোরো না, লক্ষ্মী!’

‘তার মানে চিন্তায়ই ফেলে যাচ্ছ।’

শফি বলল, ‘আমি দুঃখিত, লিলি। ফিরে এসে তোমাকে জাগাব। তা যত রাতই হোক না কেন।

‘পাগল নাকি? রাতের বেলায় সাবধান, ডাকাডাকি কোরো না। ছোট চাচা ইতিমধ্যেই আমার নাম দিয়েছে শলি…’

‘শলি? মানে?’

‘মানে শফির শ, লিলির লি।’

দু’জনেই হাসে।

তারপর শফি গেট পার হয়ে রাস্তায় নামে। বাগানের ঝোপ থেকে দেয়াল টপকে জামানও নেমে আসে রাস্তায়। শফি আর লিলির সব কথাবার্তা কানে গেছে তার। শফির ব্যাপারে লিলি এখন স্পষ্ট। যদি শফি বেরিয়ে আসতে পারে কুয়াশার জাল থেকে তাহলে শফির কণ্ঠেই পড়বে তার প্রণয় মালা। কুয়াশাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া এখন জামানের সবচে’ জরুরী কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাতৃহত্যার প্রতিশোধের সঙ্গে এখন যোগ হলো লিলির স্বপ্ন। কুয়াশা যদি বেঁচে থাকে তাহলে লিলির স্বপ্ন কখনও বাস্তবায়িত হবে না। Kuasha must die.

শফি রাস্তায় গিয়ে ভাড়াটে ট্যাক্সি নেয়। ট্যাক্সি ছুটতে থাকে সাভারের দিকে। জামান আর একটা ভাড়াটে ট্যাক্সিতে করে অনুসরণ করতে লাগল। শেষ চৈত্রের বাতাসে লেগেছে বৈশাখের ঝড়ের দোলা। সাঁ সাঁ করে হাওয়া কেটে ট্যাক্সি দুটো ছুটে চলেছে ঢাকা ছাড়িয়ে শহরতলীর দিকে। ক্রমে শেষ হয়ে গেল নগর। শুরু হলো অরণ্য-লোকালয়। বড় বড় গাছপালা রাস্তার দু’পাশে।

হাওয়া কলকল করছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত। দূরে দেখা গেল একটা স্তিমিত আলো। শফির ট্যাক্সি গিয়ে সেখানে থামল। ট্যাক্সিওয়ালাকে আগেই দুটো দশ টাকার নোট দিয়ে রেখেছে জামান। শফি যখন ভাড়া গুনছে তখন জামান নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে দোকানের পেছনে। দূর থেকে যে আলোটা দেখা গিয়েছিল সেটা দোকান ঘরের হ্যারিকেন বাতির আলো। এক গম্ভীর চেহারার বুড়ো দোকানদার ক্যাশবাক্সের উপর খাতা রেখে হিসাব লিখছে।

দোকানটা মুদির। নিচে বেঞ্চির উপর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে শুকনো চেহারার বাচ্চা মত একটা লোক। শফি গিয়ে বলল, ‘তাল-মিসরি আছে, নানা?’

‘না!’

খেঁকিয়ে উঠল বুড়ো। বলল, ‘নানা বলবে তো, তাল-মিসরি কেন, কুটোটি পর্যন্ত পাবে না আমার কাছ থেকে। নানা কেন শুনি…আমি কি বুড়ো হয়ে গেছি?’

বেঞ্চিতে শুয়ে শুকনো মত লোকটা খ্যাক খ্যাক করে হাসল।

বুড়ো ধমকে উঠে বলে, ‘ওরে, ও, হারামজাদা বলাই, তুই হাসছিস কেনে শুনি?’

‘তোর কথা শুনে! শালার বলে তিন কুড়ির উপর বয়েস হলো গো, এখনও তেনি জোয়ান আছেন। খেঃ, খেঃ…

বলাই হাসতে লাগল। মাথা তুলে সে শফিকে দেখল। বলল, ‘না বুঝে নানা ডেকেছে হে। দিয়ে দাও শালার তাল-মিসরি…’

‘তোর আবার বলতে হবে নাকি, শুয়োর, আমার খরিদ্দার…কী দিতে হয় না হয় সে আমি বুঝব।’

বুড়ো এইবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় শফির দিকে। বলে, ‘কতখানি দেব গো…আধসের…’

শফি বলল, ‘না, একসের…’

বুড়ো দাঁড়িপাল্লায় তাল-মিসরি ওজন করতে করতে বলাইর উদ্দেশে বলে, ‘বুঝলি, বলাই চাঁদ…তেনার ভাগ্যি ভাল…ইস্টকে ভাল মাল আছে।’

বলাই চাঁদ কিছু না বলে গান ধরল। পেছনে দাঁড়িয়ে হতভম্ব হয়ে পড়ল জামান। ঢাকা থেকে শফি এতদূর ছুটে এল সে কি এই একসের তাল-মিসরি কেনার জন্যে? ব্যাপারটা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

তাল-মিসরি দিয়ে বুড়ো দামের জন্যে হাত বাড়ায়। শফি পয়সা দিলে বুড়ো বলে, ‘কত দিলেন গো…’

‘এক পয়সা কম দিলাম।’

দোকানের বেড়ার ফুটোয় চোখ রেখেছিল জামান। দেখল কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছে বেঞ্চে শোয়া বলাই চাঁদ। শফি তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করতে পারছি না…রাস্তাটা…’

চাপা গলায় বলাই বলে, ‘চলুন, স্যর।’

শফি মাথা নিচু করে দোকান থেকে বেরোয়। তারপর সামনে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় অন্ধকারে।

জামান একটা আমগাছের গুঁড়ির সাথে মিশে গিয়ে তাকিয়ে রইল যতদূর চোখ যায়। দেখল শফি আর বলাই চাঁদের মূর্তিটা একটা ঝোপের আড়ালে হারিয়ে গেছে।

সে আস্তে আস্তে পিছু হটে অনেকদূর এল। তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল রাস্তার দিকে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল রাস্তায়। জন-প্রাণী, গাড়ি-ঘোড়ার চিহ্ন মাত্র নেই। বহুক্ষণ পর একটা খালি ট্রাককে দেখা গেল ঢাকার দিকে ছুটে যেতে। সে চিৎকার করে গাড়িটাকে থামতে বলল। জবাবে ড্রাইভার গাড়ির স্পিড ত্রিশ মাইল থেকে বাড়িয়ে চল্লিশ মাইল করল। জামান স্পষ্ট বুঝল ড্রাইভার আর তার পাশের সঙ্গী এখন দরুদ পড়ছে। ডাকাত মনে করেছে জামানকে। জামান এত কষ্টের মধ্যেও না হেসে পারল না।

কিন্তু জামানের ভাগ্যই বলতে হবে। কিছুক্ষণ পর একটা ট্যাক্সি রাস্তা ঘেঁষে কাছে এসে দাঁড়াল। ড্রাইভার অবাক হয়ে বলল, ‘এখনতরি আপনে যান নাইক্যা, স্যর? গেরামে যাইবার লইছিলেন না? গেলেন না কেন?’

যে ড্রাইভার ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছিল, জামান দেখল কথা বলছে সেই ড্রাইভার।

জামান তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, ‘মানিকগঞ্জ টাউন এখান থেকে কদ্দূর বলতে পারো?’

‘মানিকগঞ্জ কী কইবার লাগছেন, স্যর…সাভার থনে মোড় লইয়া রাস্তা আইচে টঙ্গীর দিকে। এইটা অইল ময়মনসিং রোড, স্যর…এই এট্টু আগু বাড়াইলেই একটা পোস্ট অফিস পাইবেন। এউগা ভাতের হোটেল ভি আছে। পেট ভইরা খাইছি তয় বিল উঠছে সাত আনা!

জামান বুঝল ড্রাইভার খেতেই বাজারে গিয়েছিল। এইবার সে ঢাকা ফিরে যাচ্ছে। ট্যাক্সিতে সে উঠে বসে। বলে, ‘আমারও খিদে পেয়েছে, ড্রাইভার। বাজারে নিয়ে চলো। বাজারে পৌঁছে আগে যাবে হোটেলে তারপর পোস্ট অফিসে।’

‘ঠিক হ্যায়, স্যর…’

ড্রাইভার ট্যাক্সি চালিয়ে দেয়।

খাওয়ার পর পোস্ট অফিসে যায় জামান। সে খুশি হয়ে ওঠে। পোস্ট অফিসের লাগোয়া রয়েছে টেলিগ্রাম অফিস। সে গোটা তিনেক টেলিগ্রাম ফর্ম ক্লার্কের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে যথাসম্ভব সংক্ষেপে সব কিছু লিখে জানায় মি. সিম্পসনকে। মুদির দোকানের সাঙ্কেতিক কথাগুলোও বাদ দেয় না। টেলিগ্রামের মূল্য বাবদ মোট দাঁড়াল চল্লিশ টাকা কয়েক আনা। ক্লার্ক লোকটা এমন দীর্ঘ টেলিগ্রাম দেখা দূরে থাক, কখনও কল্পনাও করেনি। সে সবিস্ময়ে জামানের দিকে তাকিয়ে রইল। টেলিগ্রাম করতে পেরে নিজেকে হালকা লাগল জামানের। ট্যাক্সি নিয়ে আবার সে ফিরে এল মুদিখানার নিকটবর্তী রাস্তায়। ট্যাক্সিওয়ালাকে আশাতিরিক্ত বকশিশ দিয়ে সে প্রায় ছুটতে ছুটতে এল মুদিখানায়।

হয় প্রতিশোধ গ্রহণ না হয় মৃত্যুবরণ। শরীরের রক্ত-স্রোত উদ্বেল হয়ে উঠেছে। নিষ্ঠুরতম উপায়ে কুয়াশাকে হত্যা করতে চায় জামান। সারা শরীরে তার দাউ দাউ করে জ্বলছে জিঘাংসার আগুন।

শফি বোধহয় নাগালের বাইরেই চলে গেল। জামান মনে মনে আতঙ্কিত। বিপদের বন্ধু পিস্তলটা কোমরের কাছে একবার অনুভব করল হাত দিয়ে। তারপর অর্ধেক ঝাঁপ বন্ধ করা দোকানের ভেতর গিয়ে ঢুকল। মুদি তেমনি ক্যাশ বাক্সের উপর বসে হ্যারিকেনের আলোয় হাতের আঙুল গুনে গুনে হিসাব করছে গম্ভীর মুখে। দরজার কাছে একটা বেঞ্চে শুয়ে আছে বলাই চাঁদ।

‘তাল-মিসরি আছে, নানা?’

বুড়ো মুদি ফিরে তাকাল। বলাই চাঁদ বেঞ্চে শুয়ে শুয়েই গলা বার করল একবার।

মুদি রাগ করল না। কলমটা কানে গুঁজে দাঁড়িপাল্লা হাতে নিল। বলল, ‘আছে। কতখানি লেবেন?’

‘একসের…’

বলাই চাঁদ আর মুদির ভেতর দৃষ্টি বিনিময় হলো। কিন্তু কেউ কিছু বলল না। মুদি একসের তাল-মিসরি মেপে হাতে দিল জামানের। ফিসফিস করে বলল, ‘পয়সা দেন।’

জামান পাঁচ টাকার একটা নোট ছেড়ে দিল মুদির হাতের মুঠোয়। মুদি যেন হকচকিয়ে গেল। বেঞ্চ থেকে একবার মাথা তুলে দেখল বলাই চাঁদ। জামান মরিয়া হয়ে বলল, ‘এক পয়সা কম দিলাম।

‘তাই বলেন…’

গম্ভীর মুদি বুড়োর ফোকলা দাঁতে আচমকা হাসি ফুটে ওঠে। ঝট করে উঠে দাঁড়ায় বলাই চাঁদ। জামান মুখস্থ বলার মত বলে, ‘অন্ধকারে দেখতে পাব না, রাস্তাটা যদি…’

অদ্ভুত গলায় বলাই চাঁদ বলে, ‘চলুন, স্যর, দেখিয়ে দিচ্ছি।‘

চষা খেতের উপর দিয়ে, ঝোপ-ঝাড় ভর্তি জঙ্গলের পাশ দিয়ে রাস্তা দেখিয়ে তাকে নিয়ে চলে বলাই। কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ল মাঠের ভিতর কয়েকটা হিজল গাছ। হিজল গাছের নিচে দুটো শূন্য চালাঘর। রাখালেরা গরু চরাতে এসে দুপুরবেলা এখানে বিশ্রাম নেয়। চালাঘরগুলোর উঁচু ভিটের নিচেই আছে একটা অর্ধ শুষ্ক জলাশয়। তীরের এদিক-ওদিক ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া কয়েকটা শিমুল আর কড়ুই গাছ দাঁড়িয়ে আছে।

বলাই চাঁদ জলাশয়ের তীরে থামল। হাত দিয়ে দেখাল একটা বোট। বলল, ‘যান।’

এক বুক আশঙ্কা নিয়ে পা বাড়ায় জামান। চারদিকে ভৌতিক অন্ধকার। কার ইঙ্গিতে ক্ষুদ্রকায় বোটটা তীরের দিকে এগিয়ে আসছে। বোটটা তীরে থামতেই একজন মাথা তুলে দাঁড়াল। বলল, ‘আসুন।’

পেছনে তাকিয়ে জামান দেখল বলাই চাঁদ চলে গেছে। আকাশের নিচে অন্ধকার অরণ্যসঙ্কুল মাঠ, চারদিক থমথম করছে। সে নিঃশব্দে গিয়ে বোটে উঠল। বেঁটে, চওড়া কাঁধওয়ালা লোকটা জামানের হাত ধরে বোটের তলায় নিয়ে বসাল। আশ্চর্য হয়ে জামান দেখল বোটের দুই প্রান্ত বেঁকে উপরে উঠছে। ক্রমে দুই প্রান্ত মিলে গেল। ভেতরে জ্বলে উঠল হলুদ রঙের একটা আবছা আলো। বোটটা দেখতে হয়েছে গোলাকৃতি ডিমের মত। ভিতরের সেই লোকটা দাঁত বার করে হাসল জামানের দিকে তাকিয়ে কুৎসিত ভঙ্গিতে। বলল, ‘কেমন লাগছে?’

জামানের ইচ্ছে করছিল এক ঘুসিতে ওর সব ক’টি দাঁত ভেঙে দেয়। কিন্তু পড়েছি যবনের হাতে খানা খেতে হবে সাথে। কোথায় আছি, কী অবস্থায় আছি এসব না জেনে এখন কিছু করা উচিত হবে না। তাই সে রাগ চেপে ডিম্বাকৃতি সেই অদ্ভুত বোটের ভিতর বসে রইল।

কতক্ষণ এভাবে কাটল সে জানে না। বোটটা একটু একটু দুলছিল। একসময় একটা মৃদু ঝাঁকানির পর সেটা থেমে স্থির হয়ে গেল। আস্তে আস্তে পদ্মফুল যেমন পাপড়ি মেলে বোটটাও ঠিক তেমনিভাবে উপর থেকে আস্তে আস্তে মুখ হাঁ করল। দুই প্রান্ত সটান সোজা হয়ে থামল। ঠিক আগের সেই বোট।

লোকটা বলল, ‘দয়া করে আসুন।‘

জামান বুঝতে পারল না কোথায় সে আছে। মাথার উপর পাথরের ছাদ। নিচে নীল সরোবর। টলটলে পানির উপর কাগজের নৌকোর মত বোটটা ভাসছে।

বোট থেকে নেমে এল তীরে। পায়ের নিচে অসমান পাথর। আশপাশে যদ্দূর চোখ যায় আবছা আবছা অন্ধকার। অন্ধকার ভেদ করে কোত্থেকে যেন স্থানে স্থানে আলো পড়েছে।

বেঁটে, চওড়া কাঁধওয়ালা লোকটার পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করল জামান। কিছুদূর গিয়ে সঙ্কীর্ণ হয়ে এল পথ। পথের দু’পাশে শক্ত পাথরের দেয়াল। মাথার উপর নিচু ছাদ। হাত দিয়ে ছাদ স্পর্শ করা যায়। জামান বুঝল একটা গুহার ভিতর দিয়ে ওরা চলেছে। কিছুদূর গিয়ে গুহা শেষ হয়ে গেল। উজ্জ্বল আলো লেগে চোখ ঝলসে গেল তার। পাশ ফিরে জামান দেখল বেঁটে, চওড়া লোকটা নেই, ভোজবাজির মত কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে।

কিন্তু বেঁটে সঙ্গীর কথা একটুও ভাবছিল না জামান। সে চারদিকে তাকাচ্ছিল অবাক চোখ মেলে। যত দেখছিল ততই বাড়ছিল তার বিস্ময়। তার সামনে এক বিশাল উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। বেশ অনেকটা দূরে পাথরে খোদাই করা একটা অট্টালিকার একাংশ চোখে পড়ে। মাথার ওপর তেমনি পাথরের ছাদ।

জামান হেঁটে চলল সামনে। এ কোথায় সে এসে পড়ল? বার বার চোখ কচলাল, ‘এ কি স্বপ্ন না বিভ্রান্তি?’ সে সামনের দিকে হাঁটতে লাগল আর স্পষ্ট হতে লাগল অট্টালিকা। জন-প্রাণী নেই। নিথর, নিস্তব্ধ, প্রাসাদ। এ যেন রূপকথার এক রাজত্বে এসে পড়েছে জামান।

শফি কোথায়? জামান একবার ভাবল। কুয়াশার সন্ধানে সে এসেছিল। এ সবই কি তাহলে কুয়াশার কারসাজি?

সাহস হারাল না। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে ঢুকে পড়ল প্রাসাদের ভিতর। প্রাসাদের বড় বড় কক্ষগুলো নির্জন হয়ে পড়ে আছে। কোন কোন কক্ষ আসবাবপত্রে সজ্জিত। কোন কোন কক্ষে জন- প্রাণী বাস করে বলে মনে হলো। কিন্তু কক্ষের পর কক্ষ পার হয়েও কোথাও মানুষজন দেখল না জামান।

এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল জামান। যা দেখল তাতে ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠল। দেখল প্রাসাদের চত্বরে বিশালকায় এক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। উচ্চতায় কম করে হলেও দশ ফিট। সেই অনুযায়ী চওড়া। পরনে টাইট জাঙ্গিয়া। প্রশস্ত কাঁধ, দীর্ঘ ঊরু, মাংসল বুক। জামান তার সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চতায় লোকটার কোমর পর্যন্ত পৌঁছবে কিনা সন্দেহ।

লোকটা একঠায় দাঁড়িয়ে আছে সামনের দিকে তাকিয়ে। বিপরীত দিক থেকে আর একজন মানুষ হেঁটে এল। উচ্চতায় সে-ও আট ফিটের কম নয়। মুখটা তেরো-চোদ্দ বছরের কিশোরের মত কচি। তার পেছনে পেছনে এল চমৎকার সাহেবী পোশাক পরা স্বাভাবিক উচ্চতার দু’জন শ্বেতকায় লোক। ওরা এসে কী ইঙ্গিত করল। দৈত্যাকৃতি লোক দুটি মেঝের উপর উপুড় হয়ে শুল। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ লোকটি নুয়ে পড়ে ওদের মেরুদণ্ডের গিট একটা যন্ত্র দিয়ে ঠুকতে লাগল। দৈত্যাকৃতি লোক দুটো যন্ত্রণায় গোঙাতে লাগল। কিন্তু বাধা দিল না। অনড়, অচল হয়ে পড়ে রইল।

দ্বিতীয় শ্বেতাঙ্গটি ইংরেজিতে বলল, ‘শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বলতে চাও?’

‘বুঝতে পারছি না। আর একবার চেক-আপ দরকার।’

‘Growth-chart কী রকম?’

‘Encouraging.’

‘ব্যস, তাহলে ওদের ডিপার্টমেন্টাল বোর্ডিং-এ পাঠিয়ে দাও। আমাদের observation-এ থাকুক আরও মাস ছয়েক।’

‘ও-কে।’

বয়স্ক শ্বেতাঙ্গটি কী একটা ইঙ্গিত করল আর সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল দৈত্যাকৃতি লোক দু’জন। উঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ হাত-পা ছুঁড়ল। তারপর যন্ত্রণায় রক্তিম চোখ-মুখ নিয়ে গোঙাতে গোঙাতে ওরা চলে গেল প্রাসাদের বিপরীত দিকের একটা পথ ধরে।

শ্বেতাঙ্গ দু’জন যন্ত্রপাতি নিয়ে আরও কিছুক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করল। তারপর প্রাসাদের বিপরীত পথ ধরে তারাও প্রস্থান করল।

এ যেন কোন রোমাঞ্চকর নাটকের ভয়াবহ এক দৃশ্য ে জামান। সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল স্থাণুর মত।

ঠিক এ সময় করুণ কান্নার ধ্বনি ভেসে এল তার কানে। শব্দটা আসছে প্রাসাদের কোন কক্ষ থেকে। জামান সরু বারান্দা ধরে সাবধানে এগোল।

থেমে গেল কান্নার শব্দ। পরিবর্তে পুঞ্জ পুঞ্জ ধোঁয়ার মত কুয়াশা উঠতে লাগল মাটি ফুঁড়ে। আর সেই সঙ্গে চাপা ফিসফিস হাসি আর গুঞ্জনের শব্দ। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল জামানের। কোনদিকে এগোবে কিছুই বুঝতে পারল না। তার নিঃশ্বাস আটকে যেতে লাগল। এদিকে চাপা হাসি আর গুঞ্জনের শব্দটা ক্রমেই বাড়ছে। শব্দটা শেষে কোলাহলে পরিণত হলো। জামান পাগলের মত এই কুয়াশার জাল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে ছুটতে লাগল। যেখানেই যায় তুমুল হাসি আর কোলাহল, ধোঁয়া আর কুয়াশা। তখন সব ভুলে গেল জামান। পাগলের মত চিৎকার করতে লাগল। আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে এল চেতনা। জ্ঞান হারিয়ে সে লুটিয়ে পড়ল মেঝেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *