এক
সকাল ন’টা বেজে পঁয়ত্রিশ। ঢাকা এয়ারপোর্টে সগর্জনে ল্যাণ্ড করল একটা বৃহদাকার পি. আই. এ. জেট বিমান। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে লাগল যাত্রীরা। বাইরে নানা বয়সের নারী-পুরুষ অপেক্ষা করছে। বিমান থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় আসাদুজ্জামানের চোখ-মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। সে দেখল অদূরে তার জন্যে অপেক্ষা করছে তার ভাই, বোন, ছোট চাচা, বন্ধু শফি আর পুরানো চাকর হায়দার। মাকে দেখা গেল না। বোধহয় ভিড়ের আড়ালে পড়ে গেছেন।
তিন বছরের জন্যে বিলাতে গিয়েছিল জামান। কেমিস্ট্রিতে পি. এইচ. ডি. ডিগ্রী নিয়ে সবেমাত্র আজ সে দেশের বুকে ফিরে এল।
‘এই যে তোমরা সব…’ জামান হাসিমুখে এগিয়ে যায়। ছোট বোন লিলির মাথায় হাত দিয়ে আদর করে। সালাম করে বড় ভাই কামরুজ্জামানকে আর ছোট চাচাকে। বন্ধু শফি হাসতে হাসতে বলে, ‘তোর স্বাস্থ্য অনেক ভাল হয়েছে, জামান। এখন তোকে আর ঝুলের লাঠি বলে কেউ ঠাট্টা করতে পারবে না।’
‘রঙটা বেশ ফর্সা, ধবধবে হয়েছে…’ কামরুজ্জামানের কথার স্বরে স্নেহের আভাস। বলেন, ‘এখানে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। চল…গাড়িতে গিয়ে ওঠা যাক।’
মা তাহলে আসেননি। জামানের অভিমান উথলে উঠল।
তিন বছর ধরে মাকে দেখবে বলে এই মুহূর্তটির জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে সে অথচ মা এয়ারপোর্টেই এলেন না। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে, ‘মা ভাল আছেন তো?’
সহসা কেউ একথার জবাব দিল না। লিলি চোখ ফিরিয়ে নিল। কামরুজ্জামানের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো শফির। ছোট চাচা কাঠের মত শক্ত হয়ে উঠলেন।
অবাক হয়ে জামান বলল, ‘তোমরা কথা বলছ না কেন? মায়ের কি অসুখ?‘
কামরুজ্জামান বললেন, ‘না, মা ভালই আছেন।’
‘তাহলে তিনি এলেন না যে?’
বিব্রত হয়ে উঠলেন কামরুজ্জামান। কী বলবেন ভেবে আমতা আমতা করতে লাগলেন। শফি বলল, ‘জামান, আগে বাড়ি চল…সব কথা শুনবি!’
‘তার মানে?’
জামান ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু একটা দুঃসংবাদ আঁচ করে তার বুক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। সে বলে, ‘ছেলেমানুষী কোরো না তোমরা। মায়ের কী হয়েছে বলো।’
ওরা গাড়ির কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। কামরুজ্জামান বলেন, ‘আসাদ, তুই গাড়িতে ওঠ…সব বলছি।’
ছোট চাচা বলেন, ‘হ্যাঁ, জামান, তুই গাড়িতে আগে ওঠ। কামরু, তুই গাড়ি চালা। আমি আসাদকে সব কথা বুঝিয়ে বলছি।’
‘না, না…তুমি ওকে ঠিকমত বলতে পারবে না। তুমি খামোকা ওকে খেপিয়ে দেবে…’
ছোট চাচা বললেন, ‘তুই মিথ্যে ভয় করছিস, কামরু। আসাদ ভেঙে পড়ার ছেলে নয়। সব কথা তাকে খুলে বলাই উচিত।’
এই প্রথম দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল কামরুজ্জামানের চোখ থেকে। লিলি অনেকক্ষণ আগে থেকেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
‘আজিমপুর হয়ে যা…’ ছোট চাচা শান্ত কণ্ঠে বললেন। কামরুজ্জামান নিঃশব্দে চোখ মুছে অনেকটা শান্ত হয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসেন। পাশে লিলি। পেছনে ছোট চাচা, জামান আর শফি।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
জামান সবই আন্দাজ করতে পারল। তার বুক ভেঙে গেল দারুণ দুঃখে। মা নেই। মা মারা গেছেন!
কিছু বলতে হলো না। তার বুক ঠেলে উঠতে লাগল কান্না।
ছোট চাচা বলেন, ‘মা তো তোর সঙ্গে দেখা করার জন্যে আসতে পারলেন না, জামান, তুই-ই চল মায়ের কবর জিয়ারত করবি।’
উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়ল জামান। কেউ বাধা দিল না। শফি শুধু জামানের হাতটা চেপে ধরে। কান্না চেপে কোনমতে জামান বলে, ‘মায়ের অসুখের কথা আমাকে জানালে পারতে।’
‘আসাদ…’
ছোট চাচার গলা খশখশ করে উঠল, ‘তোর মায়ের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। তোর মাকে খুন করা হয়েছে।’
গাড়িটা বাঁক ঘোরার সময় আর একটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগতে লাগতে কোনরকমে বেঁচে গেল। জামানের শরীরের সব ক’টা ইন্দ্ৰিয় তছনছ হয়ে গেল একটা তীব্র যন্ত্রণায়। সে প্রথমে চমকে উঠল, তারপর দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইল।
ছোট চাচা নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলে যান, ‘মাস দুই আগের কথা। সেদিন শুক্রবার। সকালবেলা লিলি তোর মায়ের ঘরে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। উত্তর দিকের জানালার শিক গলানো। ঘরে কেউ নেই। বাড়ির সর্বত্র খোঁজা হলো। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবার কাছে খোঁজখবর নেয়া হলো। তোর মাকে পাওয়া গেল না। অনুমান করা হলো জানালার শিক গলিয়ে ভেতরে যে বা যারা ঢুকেছিল এটা তাদেরই কীর্তি। সারা বাড়িতে শোকের ঝড় উঠল। ঠিক এর দু’দিন পর তোর মায়ের মৃতদেহ পাওয়া গেল গুলশান এলাকার একটা বিলের ধারে। সারা শরীর কাটাচেরা, রক্তাক্ত।’
জামান মাথাটা এলিয়ে দেয় পেছনের গদিতে। সভয়ে তার কাঁধ চেপে ধরল শফি। জামান বাধা দিল না। কয়েক মিনিট মৃতের মত পড়ে রইল পেছনে হেলান দিয়ে। গাড়ি ছুটে চলেছে হাতিরপুলের উপর দিয়ে। কামরুজ্জামানের হাত দুটো একবার কেঁপে উঠল।
চোত মাসের রোদ, এরই মধ্যে চারদিকে ধবধব করছে। গাড়ি এসে থামল আজিমপুর গোরস্তানের গেটে। নিঃশব্দে সবাই নেমে এল গাড়ি থেকে। জামানকে শফি ধরতে যাচ্ছিল। জামান অস্থির গলায় বলল, ‘I am allright. Shafi. Please don’t worry.’
বোরকা পরা ক’জন মহিলা গেটের পাশে কোরান শরীফের আয়াত পাঠ করছে। দু’জন বুড়ো ভিখারী ভিক্ষা চাইছে আল্লার নামে। লোবান আর আতরের গন্ধ পাওয়া গেল। রোদের ভেতরে ছোট-বড় অসংখ্য কবর সারা পরিবেশটাকে বিষণ্ণ আর নির্জন করে তুলেছে।
হাত তুলে সবাই দোয়া প্রার্থনা করল হতভাগিনী মায়ের জন্যে। জামান কবরের কাছে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ মায়ের মিষ্টি-হাসির স্নেহ-ভরা মুখটা স্মরণ করল। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে আস্তে আস্তে বলল, ‘মা, তোমার খুনের প্রতিশোধ আমি নেবই। তোমার নামে প্রতিজ্ঞা করলাম।’