থিসিস ১.১২

বারো

থমথম করছিল সারা হলঘর। সারি সারি চেয়ারে বসে আছে অসংখ্য লোক। তাদের ভিতর নারী-পুরুষ দুই-ই আছে। হলঘরের শেষ প্রান্তে উঁচু এক মঞ্চ। মঞ্চে অন্ধকার বিরাজ করছে। ডান দিকে বড় বড় দুটো স্তম্ভের পাশে টেনে আনা হয়েছে কয়েকটা কাঁচের জার, আলমিরা আর শেলফ। কয়েকজন লোক নিঃশব্দে এগুলো টেনে নামাচ্ছে মেঝের উপর। হলঘরে মৃত্যুর মত স্তব্ধতা। হঠাৎ মঞ্চের উপর জ্বলে উঠল একটা লাল গোলাকৃতি বাল্‌ব। সকলেই সচকিত হয়ে বসল। একবার সামান্য মাথা নোয়াল সামনের দিকে। ঘরে পিন-পতন নিস্তব্ধতা। মঞ্চে ধীরে ধীরে উঠল একটি কালো ছায়া। মঞ্চ ছেয়ে গেল মৃদু আলোয়। সবারই নজর পড়ল মঞ্চে দাঁড়ানো কালো ছায়াটির উপর।

‘প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ, এই কিছুক্ষণ আগে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে যা আমাদের কল্পনারও বাইরে ছিল। আমাদের টেলিভিশন অপারেটর রহস্যজনকভাবে তার কাজ থামিয়ে দিয়েছে মিনিট কুড়ি আগে। ফলে প্রাসাদের সব যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিন্ন হয়ে গেছে। এটা কার কাজ আমি বুঝতে পারছি। যথাসময় উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আপাতত সংক্ষেপে কতগুলো কথা আপনাদের বলে রাখি। প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ, আপনারা শুনে সুখী হবেন আমাদের এতদিনের চেষ্টা সফল হতে চলেছে। বৈজ্ঞানিক ড. ক্লিন্‌সবার্গ অবশেষে মানুষকে অমর করার উপায় আবিষ্কার করেছেন। যতদিন ইচ্ছা এখন মানুষ বাঁচতে পারবে। প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ…তাকিয়ে দেখুন কাঁচের ওই জারটার দিকে। এর ভিতর রয়েছে কোটি কোটি টাকার প্রাণকোষ। মানবদেহে এ জিনিস বিশেষ উপায়ে সঞ্চারিত করতে পারলেই মানুষ রক্ষা পাবে জরা ও মৃত্যুর হাত থেকে।

কুয়াশার গলার স্বর গম্ভীর আর থমথমে হয়ে ওঠে। বলে, ‘আমরা মানুষের যৌবনকে যদ্দিন খুশি ধরে রাখতে পারব। সেই ক্ষমতাও আমরা অর্জন করেছি। ড. ক্লিন্‌সবার্গ এখন হাতে-কলমে আপনাদের সেটা দেখিয়ে দেবেন।’

সামনের সারি থেকে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ান দীর্ঘকায় ড. ক্লিন্সবার্গ। এগিয়ে যান কাঁচের জার আর স্ট্রেচারে রাখা বৃদ্ধ ইব্রাহিম চৌধুরীর অজ্ঞান দেহের দিকে। কাঁচের জার থেকে খানিকটা তরল পদার্থ সিরিঞ্জে তুলে নেন ড. ক্লিন্‌সবার্গ। তারপর সেটা সাবধানে ইনজেক্ট করেন ইব্রাহিম চৌধুরীর দেহে।

সবাই রুদ্ধ নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে। ড. ক্লিন্‌সবার্গ কাশি দিয়ে গলার স্বর পরিষ্কার করেন। তারপর বলেন, ‘মিনিট কয়েকের ভিতর এক অলৌকিক দৃশ্য আপনারা দেখতে পাবেন। ইব্রাহিম, চৌধুরী আর বৃদ্ধ নেই। তিনি নতুন যৌবন ফিরে পেয়েছেন। আরও একশো বছর বাঁচার মত শক্তি তিনি অর্জন করেছেন!

হলে উপবিষ্ট নর-নারীদের ভিতর আনন্দের মৃদু গুঞ্জরন উঠল। ঠিক এ সময় একঝাঁক বন্দুকের গুলি এসে লাগল স্তম্ভের পাশে রাখা কাঁচের জারে। মুহূর্তেই কোটি কোটি টাকার প্রাণকোষ ভর্তি জারটা ভেঙে খান খান হয়ে যায়। চাপা আর্তনাদে ভরে যায় হলঘর। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে থাকে সকলেই। গুলি এসে বিঁধেছে ইব্রাহিম চৌধুরীর গায়ে। তার মর্মান্তিক চিৎকার বেজে উঠেছে।

ঘরের ভিতর একদল সশস্ত্র লোক এসে ঢুকে পড়ে। জামান পিস্তল বের করে পর পর তিনবার গুলি করল কুয়াশার বুক লক্ষ্য করে। চাপা চিৎকার উঠল কোত্থেকে যেন। একটা হলুদ সঙ্কেত কেঁপে উঠল দেয়ালে দেয়ালে। সশস্ত্র বাহিনী গুলিবর্ষণ করতে লাগল ঘরের চারদিক থেকে। ধোঁয়া আর আর্তনাদে ভরে গেল ঘর।

‘কুয়াশা।’

জামান চেঁচিয়ে বলল, ‘এতদিনে আমি প্রতিশোধ নিলাম।’

তার গলার স্বর কাঁপছিল উত্তেজনায়। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মি. সিম্পসন। তিনি জামানের টেলিগ্রাম পেয়ে সঙ্কেত মাফিক এই পাতালপুরীতে ঢুকেছেন। তিনিই স্কিন-ওয়ালের ভিতর ঢুকে ওখানকার টেলিভিশন অপারেটরকে বন্দি করেছেন।

ধোঁয়া সরে গেলে ঘরের দিকে লক্ষ করেন মি. সিম্পসন। অবাক হন। ভোজবাজির মত উপবিষ্ট নর-নারীরা মিলিয়ে গেছে। মঞ্চের উপর শুধু দাঁড়িয়ে আছে সেই ছায়া, কুয়াশা। জামান পিস্তল হাতে এগিয়ে যায়। ছায়ামূর্তি তেমনি দাঁড়িয়ে থাকে। এক টানে কালো কাপড় সরিয়েই মি. সিম্পসন ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। ছায়ামূর্তিটা আর কিছুই নয়, একটা কাঠের ফ্রেম। ফ্রেমের ভিতর এসে দাঁড়িয়েছিল কুয়াশা। কাঁচের জারের উপর গুলিবর্ষণ হবার পরই, সম্ভবত সে সরে পড়েছে কাঠের ফ্রেম ছেড়ে অন্য কোথাও।

হলের উপবিষ্ট নর-নারীদেরও কেউ নেই। সবাই নির্বিঘ্নে সরে গেছে। শুধু বিছানার উপর পড়ে আছে অজস্র গুলিবিদ্ধ ইব্রাহিম চৌধুরীর প্রাণহীন দেহ।

মি. সিম্পসন ও জামান সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে সতর্কভাবে সেই পাতালপুরী অনুসন্ধান করেন। চারদিক নির্জন। পাতালপুরী পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। কুয়াশা নেই।

পাতালপুরী থেকে বেরোবার পথে পথে প্রহরী মোতায়েন করেছিলেন মি. সিম্পসন। কিন্তু শুধু প্রহরীদের উপর নির্ভর করতে ভরসা হলো না তাঁর। তিনি বাহিনী নিয়ে এগিয়ে চলেন প্রবেশপথের দিকে।

হঠাৎ একটা গুহার ভিতর থেকে লাউড স্পীকারের আওয়াজ এল। মি. সিম্পসন, জামান দু’জনেই চিনল কুয়াশার কণ্ঠস্বর। কুয়াশা গম্ভীর স্বরে বলল, ‘মাটির এক হাজার ফিট নিচে বসে তোমাদের স্মরণ করছি, জামান। বুঝতেই পারছ আমি আমার লোকজনদের নিয়ে সরে গিয়েছি। জামান, তোমাকে অতিথির মর্যাদা দিয়েছিলাম। তুমি সেই মর্যাদা রক্ষা করোনি। মি. সিম্পসনকে তুমিই পাতালপুরীতে ঢোকার সঙ্কেত জানিয়েছিলে। বুঝতে পারছি তোমারই মন্ত্রণায় পাতালপুরীতে ঢুকেই মি. সিম্পসন প্রথমে আমার টেলিভিশন অপারেটরকে বন্দি করেছেন। তাতে করে পুরীর সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আমি ঠিকই অনুমান করেছিলাম…এ সবই তোমার কাজ। তুমি আমার যে ক্ষতি করেছ, জামান, সে ক্ষতি আজ পর্যন্ত কোন মানুষের হয়নি। এতদিনের সাধনায় আমি যা অর্জন করেছিলাম সব তুমি নষ্ট করে দিয়েছ। কোটি কোটি টাকার প্রাণকোষ তুমি নষ্ট করেছ। আমাকে আবার গোড়া থেকে নতুনভাবে সাধনা শুরু করতে হবে। ভাবতে পারো এ কত বড় ক্ষতি আমার? মানুষকে অমর করার কৌশল আমি আবিষ্কার করেছিলাম। তুমি তা ধ্বংস করে দিলে। জামান, তোমাকে যে কোন মুহূর্তে হত্যা করতে পারি আমি। মি. সিম্পসনের কাছে জিজ্ঞেস করে দেখো, সে শক্তি আমার আছে। তুমি যে অপরাধ করেছ তত বড় অপরাধ মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে আর হয়নি। তোমার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড তোমাকে আমি এক্ষুণি দিতে পারি, জামান। আমার হাত থেকে দুনিয়ার কোন শক্তিই তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তোমাকে আমি ক্ষমা করলাম। কেন? জামান…বলেছি তো, আমি ক্রিমিন্যাল নই। আমি মানুষ। মানুষের পক্ষেই মানুষকে ভালবাসা সম্ভব। আমি তোমাকে দুঃখ দিয়েছিলাম, তাই তোমার ওপর হাত উঠল না আমার। আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। আচ্ছা, চলি। গুডবাই, জামান। গুডবাই, মি. সিম্পসন। আবার আমাদের দেখা হবে।’

কুয়াশার স্বর ডুবে গেল। নীরবে দাঁড়িয়ে রইল জামান। মি. সিম্পসনের চোখে-মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। বললেন, ‘তোমার জন্যে আমরা সত্যি গর্বিত, কুয়াশা।’

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *