থিসিস ১.৭

সাত

হাজী মুহিবুল্লার বাড়ি।

রাত এগারোটা। গলির মোড়ে ল্যাম্প পোস্ট জ্বলছে। নিচে ঘুমিয়ে আছে আপাদমস্তক কাঁথা মুড়ি দিয়ে একটা ভিখারী। গলির মোড়ে একটা বিকল ভাড়াটে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে তোবড়ানো দেহ নিয়ে। গলি নির্জন হয়ে এসেছে এতক্ষণে। বিটের পুলিস টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে চারদিকে।

মি. সিম্পসন, তাঁর সহকারী তরিক হোসেন, কয়েকজন পুলিস অফিসার আর জামান নিঃশব্দে বসে আছে হাজী মুহিবুল্লার ড্রইংরুমে।

জামানের হাতে একটা চিঠি। চিঠিটা মি. সিম্পসনের কাছে লিখেছে কুয়াশা। সংক্ষিপ্ত চিঠি। কুয়াশা লিখেছে, ‘মি. সিম্পসন, আপনি ঠিকই ধরেছেন, আমার পরবর্তী শিকার হাজী মুহিবুল্লাই বটে। আমার গবেষণা কাজের জন্যে হাজী মুহিবুল্লার মত আরও বহু লোক দরকার। আস্তে আস্তে সব লোকই সংগ্রহ করে চলেছি এবং গবেষণার শেষ পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমার কাজ আমি করে যাবই। হ্যাঁ, ব্যাঙ্ক লুটও আমার কাজ। ব্যাঙ্ক লুট করে অতি সামান্য টাকা পাওয়া গেছে। এ টাকায় আমার প্রয়োজন মেটার নয়। শিগগিরই নতুন উপায়ে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করব। আপনাদের সাধ্য থাকে বাধা দেবেন। মি. সিম্পসন, আমি আপনার উন্নত চরিত্রের একজন ভক্ত বটে। কিন্তু আমার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী আমি আপনাকে এখনও মনে করি না। ১ এপ্রিল রাত্রিবেলা আমি হাজী মুহিবুল্লাকে তার বাড়ি থেকে অপহরণ করব। পারেন তো বাধা দেবেন। আপনি আমাকে ধরার জন্যে ফিরছেন। আপনাকে একটা সুযোগ দেয়া প্রয়োজন মনে করলাম।

ইতি-কুয়াশা’

জামান চিঠি পড়ে শেষ করে সেটা মি. সিম্পসনের হাতে ফেরত দিল। মি. সিম্পসনের ঠোঁটে মৃদু হাসি। বললেন, ‘আমার বিশ্বাস কুয়াশার দিন শেষ হয়ে এসেছে। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস মৃত্যুর কারণ হয়, কুয়াশারও তাই হয়েছে।’

একজন পুলিস অফিসার, নাম মোজাম্মেল হক, বলল, ‘লোকটা, স্যর, আমার মনে হয়, ধাপ্পা মেরে আমাদের ‘এপ্রিল ফুল” করতে চাইছে।

‘কুয়াশা কখনও কোন বাজে কথা বলে না। দেখা যাক কী হয়…

‘কিন্তু, স্যর…

মোজাম্মেল হক বললেন, ‘বাড়ির চারদিকে পুলিস পাহারা, আশপাশের সব ক’টা গলির মোড়ে পুলিস, হাজী সাহেবের ঘরে পর্যন্ত দু’জন প্রহরী মোতায়েন করা হয়েছে…এ অবস্থায় কীভাবে কুয়াশা তার কাজ হাসিল করবে?’

‘ব্যাপারটা অসম্ভবই মনে হচ্ছে…

মি. সিম্পসন স্বভাবসিদ্ধ মৃদু কণ্ঠে বলেন, ‘কিন্তু কুয়াশা চিরকাল অসম্ভবকেই সম্ভব করে এসেছে। ধরুন এমনও হতে পারে আপনিই কুয়াশা… পুলিস অফিসার মোজাম্মেল হক সেজে আমাদের চোখে ধুলো দিতে এসেছেন।’

‘কী যে বলেন, স্যর…’

মোজাম্মেল হক হেসে ফেলে, ‘আপনার নিশ্চয়ই রাত জেগে চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। চা আনতে হুকুম দিই, স্যর, কি বলেন?’

‘খুবই চমৎকার প্রস্তাব।’

মি. সিম্পসন মৃদু হাসেন। জামানের দিকে তাকান। বলেন, ‘আমার কথাগুলো খুবই হালকা বটে। কিন্তু সত্যের কাছাকাছি।”

রাত বেড়ে চলল। বাইরে টুপ টুপ শিশির ঝরছে। জানালার ফাঁকে অন্ধকার আমগাছের উপর কৃষ্ণপক্ষের রক্তিম চাঁদ শেষ রাতের হাওয়ায় কাঁপছে। মাঝে মাঝে টহলদার পুলিসের হুইসেল শোনা যায়। কোথাও রাতের নির্জনতা ভেদ করে কুকুর ডেকে ওঠে। ঘুমে ঢুলু ঢুলু হয়ে আসে পুলিস অফিসার মোজাম্মেল হকের চোখ। বার বার হাই ওঠে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায়। সিগারেট টানতে টানতে মি. সিম্পসনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘রাত তো চারটে বাজতে চলল, স্যর। কোথায় আপনার কুয়াশা?’

তরিক হোসেনের দিকে তাকিয়ে মি. সিম্পসন শুধু হাসেন। মি. হক বলে, ‘চোর-ছ্যাঁচড়দের আস্ফালন একটু বেশিই হয়, স্যর। একবার আমি যখন টাঙ্গাইলের ও. সি. তখন এক ডাকাত ব্যাটা এই রকম বড়াই করে চিঠি ছেড়েছিল। আমি, স্যর, দারুণ খেপে গেলাম। ব্যাটাকে অবশ্য ‘ক্যাচ” করতে পারিনি। যদি পারতাম, খোদার কসম, স্যর, ওর হাড়গোড় আস্ত রাখতাম না। বেআদবির একটা সীমা থাকা দরকার।’

তরিক হোসেন উঠে হাজী মুহিবুল্লা যে ঘরে আছে সে ঘরের দিকে চলে গেল। জামান দেখল মি. সিম্পসন কথা বলছেন না। নিঃশব্দে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন।

জামানের অস্বস্তি লাগছিল। সে ঘর থেকে বাইরে এল। বারান্দায় পায়চারি করতে লাগল।

শফি সঙ্গে থাকলে ভাল হত। গল্প করা যেত। অবশ্য শফি এখন বহু বদলে গেছে। আগের মত গল্পগুজব জমবে না। এই নিঝুম রাত শেষ হলেই ভাল। সবটা ব্যাপারই জামানের কাছে কেবল একটা ছেলেমানুষী মনে হচ্ছে। গত রাতে মি. সিম্পসন ও তাঁর সহকারী তরিক হোসেন রাজশাহী গিয়েছিলেন। এয়ারপোর্টে গিয়ে ওঁদের সি-অফ করেছিল জামান। আজ রাত দশটায় হঠাৎ মি. সিম্পসনের টেলিফোন।

‘জামান, আমি আর তরিক ১৬৮ ডেঙ্গু খাঁ লেনে হাজী মুহিবুল্লার বাড়িতে বসে আছি। তুমি চলে এসো।’

টেলিফোন পেয়ে অবাক হয়েছিল জামান। বলেছিল, ‘ব্যাপার কী? এই না কাল আপনি রাজশাহী গেলেন?’

টেলিফোনে হাসির শব্দ পাওয়া গিয়েছিল, ‘তাতে কী হয়েছে? রাজশাহী থেকে আমি ফিরে আসতে পারি না? শোনো, জামান, হাজী মুহিবুল্লার বাড়ি আজ আক্রান্ত হবে। আমি আজ সাড়ে আটটায় প্লেন থেকে নেমে বাড়ি এসেই কুয়াশার চিঠি পেয়েছি। তুমি আর দেরি কোরো না। চলে এসো। বেশ ক’জন পুলিস অফিসারও এসেছেন। ইচ্ছা করলে তোমার বন্ধুটিকেও নিয়ে আসতে পারো। কুয়াশার নাম করে রাতটা এসো উপভোগ করি।’

হেসেছিলেন মি. সিম্পসন।

দেরি করেনি জামান। চলে এসেছে হাজী মুহিবুল্লার বাড়িতে। শফিকে সঙ্গে আনতে চেয়েছিল। শফি আসতে রাজি হয়নি। হাজী মুহিবুল্লার বাড়ি এসে মি. সিম্পসনসহ আরও দু’একজন পরিচিত অফিসারও দেখতে পেয়েছে জামান। সব দেখে-শুনে তার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে এটা কুয়াশার একটা ভাঁওতা। বিপুল পুলিস বেষ্টনী থেকে হাজী মুহিবুল্লাকে অপহরণ করা শুধু অসুবিধাজনক নয়, অসম্ভব। মি. মোজাম্মেল হকের কথাই সত্য। কুয়াশা চিঠি দিয়ে ১ এপ্রিলে একটা উঁচু দরের মজা করতে চায়।

সে পায়চারি করতে লাগল। হঠাৎ দেখল পাঁচিলের কাছে একটা লাল বাতি জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেল। জামানের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘কে?’

কোন প্রতি উত্তর এল না। শুধু মনে হলো কী একটা ভারি বস্তু যেন নিচে পড়ে গেল।

জামান কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর দ্রুত পায়ে হাজী মুহিবুল্লার ঘরের দিকে গেল। যা দেখল তাতে ভয়ে, বিস্ময়ে সে অভিভূত হয়ে রইল। দেখল পাঁচজন ষণ্ডামার্কা লোক হাজী মুহিবুল্লাকে নিয়ে ভাঙা জানালা দিয়ে সরে পড়ছে। কয়েকজন বলিষ্ঠ চেহারার দুর্বৃত্ত চারদিকে পাহারা দিচ্ছে। পুলিসের চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। দুর্বৃত্তদের একজন ছুটে এল জামানের দিকে। জামানের প্রচণ্ড একটা লাথি গিয়ে পড়ল লোকটার তলপেটে। লোকটা ‘ক্যাক’ করে একটা শব্দ করে ঘুরে গিয়ে পড়ল মাটিতে। পিছনে তাকাতেই চোখে পড়ল জনা দুই। ছুরি হাতে একজন ছুটে এল…চকিতে বাঁ পাশে সরে গিয়ে লোকটার ডান হাত মুচড়ে ভেঙে দিল জামান। নিঃশ্বাস ফেলার জো নেই। পরমুহূর্তে মুখোমুখি হতে হলো হান্টার হাতে দ্বিতীয় লোকটার। হান্টারের একটা বাড়ি লাগল জামানের কাঁধে। মাথাটা সরিয়ে নিয়েছিল বলে কাঁধে লাগল, নতুবা তখুনি মাথাটা ফেটে চৌচির হয়ে যেত। কাঁধটা অবশ হয়ে গেল… ঝিম ঝিম করতে লাগল সারা শরীর। লোকটা আবার হান্টার ওঠাতেই চোখের পলকে জামান অন্ধের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর। দুটো বিরাশি সিক্কার ঘুসি খেয়ে হান্টার ছেড়ে টলতে টলতে নেতিয়ে পড়ল লোকটা। লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। মাথা তুলে বোধহয় চেঁচাতে যাচ্ছিল, জামানের বুট সুদ্ধ পায়ের লাথি পড়ল ওর মুখে। মুখটা থেঁতলে গেল। আর কোন শব্দ পাওয়া গেল না।

হাঁপাচ্ছিল জামান। সবটা ব্যাপার তার কাছে ভৌতিক মনে হচ্ছিল। মি. সিম্পসন, মি. হক, ডজন ডজন পুলিস…কোথায় সব?

পিস্তলটা সে হাতে নিয়েছে এতক্ষণে।

কাঁধটা অবশ হয়ে আছে। জামানের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। কুয়াশা কি তাহলে এসেছে? সে মুহিবুল্লার ঘরে গিয়ে ঢুকল। মেয়েরা আছে উত্তর দিকের বড় বারান্দার ওপারের ঘরগুলোতে। বিশাল, নির্জন বাড়িতে এত বড় কাণ্ডটা হয়ে গেল, অথচ কারও সাড়াশব্দ নেই। মুহিবুল্লার ঘরে গিয়ে দেখল বিছানা শূন্য। পাশের দুটো বড় বড় জানালার শক্ত, মোটা শিকগুলো গোড়া থেকে কাটা।

কুয়াশা তাহলে তার কথা রক্ষা করতে পারল?

সে আবার ফিরে এল বারান্দা ধরে ড্রইংরুমে। ড্রইংরুমের সোফায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন মি. সিম্পসন, মি. মোজাম্মেল আর চারজন পুলিস অফিসার। মাথার উপর ফ্যানটা ঘুরছে। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে নক্ষত্রখচিত শেষ রাতের শান্ত আকাশ।

অনেক ডাকাডাকির পর মি: সিম্পসন উঠলেন। মোজাম্মেল হক উঠতেই চায় না। মোটা মানুষ…ঘুমকাতুরে। ঠেলা খেয়ে প্রথমে ভাবল বুঝি মশা কামড়াচ্ছে। সে কাঁধে একটা চাপড় লাগাল। তারপর ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে মশার গুষ্ঠি উদ্ধার করতে লাগল। বেশ কয়েকটা জোর ধাক্কার পর উঠল। চোখ রগড়াতে লাগল বিরক্ত মুখে। বলল, ‘কী, সায়েব, কী হয়েছে…চিৎকার করছেন কেন?’

জামান বলল, ‘হাজী মুহিবুল্লাকে নিয়ে গেছে…’

‘নিয়ে গেছে, বলেন কী?’

তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে পুলিস অফিসার মোজাম্মেল হক। এতক্ষণে অন্যান্য অফিসারেরাও উঠে বসেছে। মি. সিম্পসন আগেই উঠে বসেছেন, তাঁর চোখ-মুখ গম্ভীর।

মোজাম্মেল হক বলল, ‘আশ্চর্য! আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম…why? আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম কেন? কী হয়েছিল আমাদের?’ পাগলের মত পায়চারি করতে লাগল মি. মোজাম্মেল হক। বলল, ‘ও, বুঝেছি, রাত চারটের দিকে একবার চা পান করেছিলাম।’

‘আর সে চায়ের ব্যবস্থা করেছিলেন আপনি…..’ মি. সিম্পসনের গম্ভীর কণ্ঠস্বর থমথম করে ওঠে।

‘আমি!’

মোজাম্মেল হক বিভ্রান্ত হয়ে ছটফট করে। ‘…হ্যাঁ, পাশের স্টোর রুমে গিয়ে একটা পিয়নকে ডেকে আমিই চা দিতে বলেছিলাম বটে। আর দেখতে পাচ্ছি চা খেয়েই আমরা সবাই ঢলে পড়েছি ঘুমে। কিন্তু তাই বলে আমি…কী বলছেন আপনি… চা খাওয়াবার পেছনে আমার কী মতলব ছিল? আপনি কি আমাকে সন্দেহ করেন, মি. সিম্পসন?’

জামানের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে এক টুকরো তির্যক হাসি। পিস্তলটা সে তুলে ধরে মি. সিম্পসনের দিকে। বলে, ‘হ্যাণ্ডস আপ, কুয়াশা…হাত তুলে দাঁড়াও…’

মুহূর্তে ছাইয়ের মত সাদা হয়ে যায় মি. সিম্পসনের চোখ- মুখ, তার হাত আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে ওপরে ওঠে।

‘তোমার চালাকি বুঝতে একটু দেরি হলো বটে…’ জামান দাঁতে দাঁত ঘষে, ‘আর হাজী মুহিবুল্লাকে সেই সুযোগে সরিয়ে ফেলেছ! কিন্তু এবার পেয়েছি তোমাকে! নড়াচড়ার চেষ্টা কোরো না-মাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে অত তাড়াতাড়ি বাধ্য কোরো না আমাকে…’

‘কী বলছ, জামান… ‘

মি. সিম্পসন কথা বলার চেষ্টা করেন।

এদিকে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে পুলিস অফিসার মোজাম্মেল হকের মুখ। অন্যান্য অফিসারেরাও বিস্ময়ে অভিভূত।

জামান বলল, ‘আমি ঠিকই বলছি, কুয়াশা। তোমার জালিয়াতি বুঝতে আর বাকি নেই। তোমার ছদ্মবেশ ধারণের পদ্ধতিটা বৈজ্ঞানিকই বটে…একটুও সন্দেহ করার উপায় নেই। কিন্তু খুঁত একটু আছে…তোমার গলার স্বর মি. সিম্পসনের চেয়ে খানিকটা মোটা…সর্বক্ষণ সিম্পসনের ভাব-ভঙ্গি, স্বর নকল করার চেষ্টা করছ, ধাঁধাও লাগিয়ে দিতে পেরেছ আমাদের চোখে, কিন্তু দেখলে তো শেষ পর্যন্ত ধরে ফেললাম। কুয়াশা, তোমার কথাই সত্যি। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই তোমার মৃত্যু ডেকে এনেছে। অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা তোমাকে দিয়ে আর হলো না… ‘

হতভম্ব মোজাম্মেল হক বলল, ‘আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, মি. জামান!’

‘এখন কিছু বোঝার চেষ্টা করবেন না, মি. মোজাম্মেল। দয়া করে মি. সিম্পসনরূপী কুয়াশাকে বেঁধে ফেলুন। যাঁকে আপনারা মি. সিম্পসন বলে জানেন তিনি এখন রাজশাহী আছেন।’

‘আমাদের চোখে তাহলে মি. সিম্পসন সেজে ভাঁওতা দিয়েছে লোকটা! উঃ, কী আশ্চর্য…’

মোজাম্মেল হক রাগে তড়পাতে থাকে। বলে, ‘হাজী মুহিবুল্লাকে সরিয়ে নিয়েছে বটে…কিন্তু রঙের টেক্কা আমাদের হাতে। আর যাবে কোথায়?

হঠাৎ অতর্কিতে একটা লাঠির বাড়ি পড়ল জামানের কব্জির উপর। ছিটকে পড়ে গেল পিস্তলটা হাত থেকে। মেঝের উপর পড়ে চলে গেল সেটা ঘরের এক কোণে।

এই সুযোগে মি. সিম্পসন বোধহয় পালাতে চাইছিল। মোজাম্মেল হক আর পুলিস অফিসারদের হাতে চকচক করে ওঠে উদ্যত রিভলভার। সব ক’টা পিস্তলের চোখ মি. সিম্পসনরূপী দুর্বৃত্তের দিকে। হাসতে হাসতে মোজাম্মেল হক বলে, ‘Here you are, Kuasha! Don’t move.’

এই সময় ঘরে ঢুকল তরিক হোসেন। এমন অতর্কিতে ঢুকল যে সবাই হকচকিয়ে গেল প্রথমটায়। চোখের ঘোর কাটতেই একজন অফিসার রিভলভার তুলে ধরল তার দিকে। বলল, ‘You are under arrest. তোমাকে গ্রেফতার করা হলো। নড়াচড়া কোরো না…সাবধান… ‘

তরিকের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে ধীরে সুস্থে এগিয়ে গিয়ে জামানের পিস্তলটা কুড়িয়ে নিল মাটি থেকে। অফিসারটি রিভলভারের ট্রিগার টিপল তরিক হোসেনকে লক্ষ্য করে। কিন্তু ‘ক্লিক’ করে মাত্র একটা শব্দ হলো…কোন গুলি বেরোল না।

‘তোমাদের সব ক’টা রিভলভারের গুলি এখন আমার কোটের পকেটে। তোমরা সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়লে তখন ওগুলো আমি বের করে রেখেছিলাম….’

মি. সিম্পসনরূপী লোকটা হাত নামিয়ে এবার সহজ হয়ে দাঁড়ায়। এপাশে সে নিজে, ওপাশে তরিক হোসেন। দু’জনের হাতেই উদ্যত পিস্তল।

তরিক হোসেন ঘুরে দাঁড়িয়ে জামানের উদ্দেশে বলল, ‘কুয়াশাকে তুমি দেখতে চেয়েছিলে, জামান। আমি কুয়াশা! তোমাকে নিজের স্বরূপ দেখাতে পারলাম না বলে দুঃখিত…’

জামানের চোখে আগুন জ্বলে উঠল। বলল, ‘তোমার দুঃখ একদিন আমি নিজেই দূর করব, কুয়াশা। তোমার সব ছদ্মবেশ টেনে খুলে দুনিয়ার সব মানুষের সামনে তোমার মূর্তিটা তুলে ধরব। মনে রেখো, কুয়াশা, আমার হাত থেকে তোমার মুক্তি নেই। আজ হোক, কাল হোক…প্রতিশোধ আমি নেবই।’

গম্ভীর হয়ে উঠল কুয়াশা। ভারি গলায় আস্তে আস্তে বলল, ‘তোমার ক্ষতির জন্যে আমি দুঃখিত নই, জামান। সময় এলে তুমিও বুঝবে নীতি আর আদর্শ কুয়াশারও আছে। আরও বুঝবে, কুয়াশাকে ধরা যায় না।’

দু’জন লোক এসে ঢুকল ঘরে। কুয়াশার ইঙ্গিতে একে একে সকলের হাত, পা আর মুখ বেঁধে ফেলে লোক দুটো। কুয়াশা বলে, ‘মি. হক, আমরা যখন রাস্তা দিয়ে যাব তখন মোড়ের পুলিসের সঙ্গে দেখা হবে। তাদের দু’একজনকে না হয় আপনাদের কাছে পাঠিয়ে দেব। ওরা এসে আপনাদের বাঁধন খুলে দেবে। ততক্ষণ একটু কষ্ট করুন। ইতিমধ্যে দলবল নিয়ে আমরা আপনাদের আওতার বাইরে চলে যেতে পারব নিশ্চয়ই।’ তরিক হোসেনরূপী কুয়াশা আর সিম্পসনরূপী মান্নান বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

রাত এখন ফুরিয়ে গেছে। পুবের আকাশে একটু একটু রঙ ফুটতে শুরু করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *