থিসিস ১.৪

চার

ক’দিন পরের কথা।

আসাদুজ্জামান সকাল আটটায় শফির ঘরে ঢোকে। তার পরনে একটা ছাইছাই রঙের সামার সুট। হাতে একটা ছড়ি। চোখ-মুখ প্রফুল্ল। ঘরে ঢুকে কৃত্রিম কোপে চেঁচিয়ে ওঠে সে, ‘শফি, এই বুঝি তোর বন্ধুত্ব…সেই যে বিকেলবেলা ডুব দিয়েছিস আর কোন পাত্তা নেই। জানিস এর কী শাস্তি…’

জামান ঠাট্টাচ্ছলে কথাগুলো বলছিল। কিন্তু জামানকে দেখে, তার কথা শুনে কেন যেন প্রবলভাবে চমকে উঠল শফি। তার চোখ-মুখ ছাইয়ের মত সাদা হয়ে যায়। সে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে…কোন কথা বলতে পারে না। জামান অবাক হয় এইবার। আরও কাছে এসে বলে, ‘কী রে, তোর চোখ-মুখ এরকম শুকনো কেন? কী ব্যাপার, অসুখ-বিসুখ করেছে?’

‘না, না…অসুখ-বিসুখ করেনি। ভালই আছি।’

‘বেশ, ভাল থাকলেই ভাল…’

ফুর্তিবাজ ছেলে জামান এ ব্যাপারে আর কথা বাড়ায় না। সে পকেট থেকে এক টুকরো চিঠি বের করে শফির হাতে দেয়। বলে, ‘এই দেখ, তোর মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। শ্রীমতি লিলির চিঠি। দু’দিন তুই যাসনি বলে তার মনে হচ্ছে গুলশান এলাকায় জনতা আছে, মানুষ নেই। আমার উপর শ্রীমতির আদেশ হয়েছে জীবিত অথবা মৃত শফিকুর রহমানকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তার সামনে হাজির করা চাই।’

শফি কোন জবাব দেয় না। নিঃশব্দে চিঠিটা পড়ে। লিলি লিখেছে: শফি ভাই, ভারি একটা মানুষ তুমি, যাহোক। আমাদের এমন অবস্থায় দু’দিনের ভেতর একটা সংবাদ নেয়ারও প্রয়োজন বোধ করলে না তুমি? যাকগে, কারও ইচ্ছার উপর জোর খাটাতে চাই না। যদি ইচ্ছা হয় আজ দুপুরবেলা আসতে পারো। ভাইয়া বাজার করবেন, ছোট চাচা নাকি জোগান দেবেন, আর আমি রান্না করব। সবাই মিলে একটা যাতনা ভোলার চেষ্টা করছি বোধহয় এইভাবে।

ইতি-লিলি

চিঠি পড়ে চুপ করে রইল শফি। চোখ দুটি উদাস হয়ে উঠল কেন যেন। জামান বলল, ‘নে, নে… ওঠ… আজ রোববারটা আমাদের ওখানে কাটাবি। দেরি করিসনে। ফিরতি পথে লিলির দু’একজন বান্ধবীকে আবার খবর দিয়ে যেতে হবে।’

শফির বুঝতে বাকি রইল না জামান আজ মুডে আছে। তার মানে আজ জামানের সব কথায় ঠাট্টার রঙ লাগবে। হাসি হয়ে উঠবে অট্টহাসি। জীবন-রসে ভরপুর জামানের সঙ্গে জুটে যেতে উদগ্র ইচ্ছা হলো। কিন্তু দেখতে দেখতে কেন যেন চোখ-মুখ শক্ত আর কালো হয়ে উঠল।

‘জামান, আজ আমি ব্যস্ত আছি। আজ তোদের বাড়িতে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব হবে না।

সব আনন্দ নিভে যায় জামানের। দুঃখিত হয়ে বলে, ‘খুব ব্যস্ত আছিস বুঝি? তাহলে তো তোর যাওয়া সত্যি হয় না। ঠিক হ্যায়, দোস্ত, তাহলে চলি। লিলিকে পরে তুই সামাল দিস।’

জামান চলে গেল। এক দৃষ্টে তার যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে রইল শফি। জামান সম্পূর্ণ দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার পর সে অস্থির পায়ে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। তার একটা জীবন শেষ হয়ে গেল। শুরু হলো নতুন আর এক ধরনের জীবন। সে কি ভুল পথে পা দিচ্ছে? সে কি জেনেশুনে একটা অন্যায়কে মাথা পেতে তুলে নিচ্ছে না?

শফি ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। হঠাৎ তার চেকটার কথা মনে পড়ল। চেকটা ভাঙাতে হবে বাইশ মার্চ, মঙ্গলবার সকাল দশটায়। সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত একটা ছাইরঙের ছোট অস্টিন সেদিন ব্যাঙ্কের উত্তরমুখো গেটে দাঁড়িয়ে থাকবে। বাইশ তারিখ, মঙ্গলবার। শফি থমকে দাঁড়ায় আর ভেতরে ভেতরে একটা যন্ত্রণা বোধ করে।

.

বাইশ মার্চ, মঙ্গলবার। সকাল দশটা।

দেশের বিখ্যাত ধনপতি সুখলাল মনোহারিয়ার যুবকপুত্র যদুপতি মনোহারিয়ার মার্সিডিস বেঞ্জ গাড়িটা এসে দাঁড়ায় কুমিল্লা কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের সামনে। গাড়ি থেকে হাসিমুখে নেমে আসে যদুপতি মনোহারিয়া। তার পরনে পাতলা যোধপুরী ধুতি। দামী সিল্কের পাঞ্জাবীর উপর কালো জহর কোট। গায়ে লাল পাতলা পাম্প-সু। ধুতির কোঁচাটা পাঞ্জাবীর পকেটে ঢোকানো। গেটের দারোয়ান প্রথমটা তাকে চিনতে পারেনি। চিনতে পেরে তাড়াতাড়ি সালাম ঠুকল। যদুপতি হাসিমুখে এগিয়ে গেল ম্যানেজার মি. শেখের ঘরের দিকে। ঘরে ঢুকতেই মি. শেখ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানান যদুপতিকে।

যদুপতি বলে, ‘আমার সেক্রেটারির টেলিফোন পেয়েছিলেন?’

‘পাব না কেন, স্যর? তারপর কী ব্যাপার?

‘আর বলবেন না। কয়েকটা ব্রাঞ্চ অফিস ওপেন করতে হচ্ছে। বাবা ক’দিনের জন্য করাচী গেছেন। আমাকেই সব ব্যাপারে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে।’

ম্যানেজার শেখ যদুপতিকে খুশি করার জন্য আকর্ণবিস্তৃত হেসে বলেন, ‘তা করতেই হবে। আপনিই হলেন সুখলালের বিপুল ধনসম্পদের একমাত্র উত্তরাধিকারী। হেঃ, হেঃ, কলেজ- টলেজ গিয়ে খামোকা সময় নষ্ট করে লাভ কী? তারচে’, ব্যবসাটা এখন থেকে বুঝে নিন…কী বলে, আখেরে সেটাই ভাল।’

‘তা বটে।’

যদুপতি ঘড়ি দেখলেন। একটু যেন ব্যস্ততা ফুটল চোখে- মুখে। বলল, ‘মি. শেখ…আমার চেকটা ক্যাশ করে দিন তাড়াতাড়ি। দ্য সুনার দ্য বেটার।’

‘দিচ্ছি, দিচ্ছি…’

চেকটা হাতে নেন মি. শেখ। ‘টাকার পরিমাণ একটু বেশি দেখছি। দু’লাখ টাকা…ওকে….’

মি., শেখ কলিংবেল টেপেন। তকমা আঁটা বেয়ারা এলে তিনি তার হাতে যদুপতির চেক আর ক্যাশিয়ারের কাছে একটা ব্যক্তিগত নোট দিয়ে পাঠান। হুকুম নিয়ে বেয়ারা চলে যায়।

মি. শেখ যদুপতির দিকে ফিরে তাকিয়ে বলেন, ‘মি. মনোহারিয়া…আপনার কি কোন অসুখ হয়েছিল?’

‘কেন বলুন তো?’

‘আপনার গলার স্বর একটু যেন অন্যরকম। দেখতেও একটু রোগা লাগছে।’

যদুপতির চোখে একটা অস্পষ্ট ভয়ের রেখা ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। সে বেশ খানিকটা গম্ভীর হয়ে বলে, ‘ঠিকই বলেছেন, মি. শেখ। কিছুদিন আগে অ্যাকিউট থ্রোট ট্রাবল থেকে উঠেছি। এখনও সম্পূর্ণ সেরে উঠিনি।’

‘আশা করি শীঘ্রি সেরে উঠবেন।’

মি. শেখ বিনীতভাবে হাসেন। বলেন, ‘বলুন কী খাবেন, চা না কফি?’

‘নাথিং, মি. শেখ। সব রকম ড্রিঙ্ক কিছুদিনের জন্যে পরিহার করতে আমার চিকিৎসক উপদেশ দিয়েছেন।’

‘তাই নাকি…’

মি. শেখ শুধু একটু হাসেন।

এই সময় ক্যাশিয়ার স্বয়ং বেয়ারাসহ ভেতরে ঢোকে। টাকা ভর্তি এনভেলাপটা নিয়ে হাসতে হাসতে যদুপতি বলে, ‘মি. শেখ…এবার তাহলে উঠি। Already I am late….

টাকা ভর্তি লম্বা এনভেলাপটা পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে দেয় যদুপতি। করমর্দন করে ম্যানেজার শেখের সঙ্গে। মি. শেখ যদুপতির সঙ্গে কাউন্টারের দরজা পর্যন্ত আসেন। যদুপতি ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল। আর যেন সে অপেক্ষা করতে পারছে না। যতই সে সরে পড়তে চাইছে মি. শেখ ততই নানা কথায় দেরি করিয়ে দিচ্ছেন। যদুপতি কোনমতে বিদায় নিয়ে মাত্র দরজার দিকে আসছে ঠিক এ সময় পেছন থেকে খসখসে গলায় কে যেন বলল, ‘ওই লোকটাকে আটকান, মি. শেখ। ও যদুপতি নয়। He is a fraud…‘

যদুপতি যেন এই ঘটনার জন্যে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। কথা শেষ হবার আগেই কাউন্টারে দাঁড়ানো একটা লোক চকিতে প্যান্টের পকেট থেকে ছোট্ট একটা পিস্তল বের করে আনে। পিস্তলের মুখ দিয়ে অগ্নি-বন্যা ছুটে যায় অদূরে দাঁড়ানো বন্দুকধারী সান্ত্রীর ডান কাঁধে। লোকটা আর্তনাদ করে পড়ে যায় আর চোখের পলক না পড়তেই পিস্তলটা গর্জে ওঠে দ্বিতীয় সান্ত্রীর বুক লক্ষ্য করে। তারপর যদুপতি নামধারী লোকটা আর পিস্তলধারী এক ছুটে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।

পেছনে চিৎকারের ঝড় ওঠে। যদুপতি ও তার সঙ্গী ততক্ষণে গিয়ে উঠে পড়েছে দরজার বাঁ দিকে অপেক্ষমাণ বেবী অস্টিনের ভিতর। ইঞ্জিন চালু করাই ছিল। নিমেষে গাড়ি ছুটে চলল মতিঝিল ছাড়িয়ে জনবহুল জিন্না অ্যাভিনিউর দিকে। গাড়িতে বসেই ক্ষিপ্রহাতে ছদ্মবেশটা খুলে ফেলে শফি। মুখে একটা কসমেটিক জাতীয় তেল ব্যবহার করতেই আশ্চর্যভাবে বদলে গেল মুখের রঙ, আদল। সঙ্গী লোকটা এসব কিছুই করল না। সে ধীরস্থিরভাবে বসে পাইপ টানতে লাগল। এদিকে পেছনে সিগন্যাল দিতে দিতে এগিয়ে আসছে একটা তীব্র গতি পুলিসের গাড়ি।

‘You have done well… ‘

পাইপধারী লোকটা অনুত্তেজিত গলায় বলল। তাকে বিন্দুমাত্র উত্তেজিত মনে হলো না। কে বলবে এই লোকটা একটু আগে দু’দুটো লোককে নিজের হাতে গুলি করেছে? তার ভাব দেখে মনে হয় ভরপেট খেয়েদেয়ে বাড়ি থেকে অফিসে যাচ্ছে। লোকটাকে শফি চেনে না। সেই রাতে কুয়াশা কোন ব্যাপারে দুশ্চিন্তা না করতে বলেছিল। শফি বুঝল কুয়াশার প্ল্যান মাফিক লোকটা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ছিল। যথাসময় সে শফিককে কাউন্টার থেকে উদ্ধার করে গাড়িতে নিয়ে এসেছে। উত্তেজনায় সারা শরীর তার টগবগ করে ফুটছিল। কীভাবে গাড়ি নিরাপদ স্থানে গিয়ে পৌঁছবে তা সে বুঝতে পারছিল না।

লোকটা যেন তার মনের কথা টের পেল। বলল, ‘আপনি তৈরি হয়ে থাকুন, মি. শফি। রেল গেটের পাশে আপনাকে নামিয়ে দেয়া হবে। কিছুদূর এগিয়ে একটা স্কুটার পাবেন। ড্রাইভারের পরনে দেখবেন হলুদ রঙের একটা জামা। ড্রাইভারকে আপনি ৩৩২ এই নম্বরটা বলবেন। তারপর স্কুটারে চেপে বসে আপনি সোজা আপনার বাড়ি চলে যাবেন। কেউ আপনার টিকিরও নাগাল পাবে না।’

শফি নিঃশব্দে টাকা ভর্তি এনভেলাপটা তুলে দেয় লোকটার হাতে।

শফি বলল, ‘আর আপনি?’

লোকটা পাইপের পাতলা ধোঁয়া ছেড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘আমার সম্বন্ধেও নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি আর ড্রাইভার ঠিক উতরে যাব। যাকগে, আপনি দেরি করবেন না, আপনার সময় এগিয়ে আসছে কাছেই….

পেছনে এগিয়ে আসছে পুলিসের গাড়ি। ক্ষিপ্রহাতে গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার। একটা ফলের দোকানের সামনে গাড়িটা মুহূর্তকাল থামল। শফি চকিতে নেমে এল গাড়ি থেকে। চোখের পলক না পড়তেই গাড়িটা ছুটে চলল সামনের দিকে। শফি জিনিস কেনার ভান করে এগিয়ে গেল দোকানের দিকে। তার পরনে নতুন পোশাক। রঙ আর পেন্টিং মুছে ফেলার পর তার নিজস্ব চেহারা ফিরে এসেছে। আবার সে শফিকুর রহমানে রূপান্তরিত হয়েছে। পেছন ফিরে সে ফল কিনতে লাগল।

ফল কিনে বেশ কিছুক্ষণ পর সে রাস্তার দিকে ফিরে তাকাল। পুলিসের গাড়ি অন্তত পক্ষে পাঁচশো গজ পেছনে ছিল। ইতিমধ্যে সেটা নিশ্চয়ই এগিয়ে গেছে সামনে। সে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। নতুন মনে হলো পৃথিবীটা। আর দ্বিধা না করে সে পাশের গলিটা ধরে কিছুদূর এগোল। দেখল একটা খালি স্কুটার দাঁড়িয়ে আছে পথের ধারে। ড্রাইভারের পরনে হলুদ রঙের জামা। সে স্কুটারে চেপে বসল। ড্রাইভার ফিরে তাকাতেই চাপা গলায় বলল ‘332. ‘

মুহূর্তেই বিনয়ী হয়ে উঠল ড্রাইভার। বলল, ‘কোথায় যাব, স্যর…’

একমুহূর্ত দ্বিধা করল শফি। তারপর বলল, ‘গুলশান।’ স্কুটার ছুটে চলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *