(পাঁচ)
স্বামী মহেশ্বরজি মহামৃত্যুঞ্জয় যজ্ঞ শুরু করে দিয়েছেন৷ নাটমন্দিরে বসে দেখছেন চন্দ্রভানু৷ তাঁর পাশে বসে আছেন সনকা, দুইপুত্র ও পুত্রবধূরা৷ দূরদূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজনরাও এসেছেন৷ সকাল থেকে যজ্ঞের প্রস্তুতি চলছে৷ সাগরদ্বীপে নিজের আশ্রম থেকে চারজন পুরোহিতকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন মহেশ্বরজি৷ তাঁরাই যজ্ঞস্থল তৈরি করেছেন সারাদিন ধরে৷ চারটে অগ্নিকুণ্ড তৈরি করেছেন৷ যজ্ঞ সুসম্পন্ন করার জন্য কোনও কিছুতে কার্পণ্য করেননি চন্দ্রভানু৷ চন্দনকাঠ আনিয়েছেন দক্ষিণ ভারত থেকে৷ শিব পূজায় পঞ্চামৃত লাগে৷ দুধ, ঘি, মধু, দই ও চিনি৷ প্রভূত পরিমাণে সে সব আনিয়ে রেখেছেন চন্দ্রভানু পশ্চিম জটা থেকে৷ শিবলিঙ্গে জল ঢালার জন্য এই মন্দিরে গৃহবধূদের পঞ্চামৃত নিয়ে আসতে হয় না৷ পুজোর সব উপাচার মন্দির থেকেই দেওয়া হয় তাদের৷
মহেশ্বরজি ও তাঁর সঙ্গী পুরোহিতদের সেবারও কোনও ত্রুটি রাখেননি চন্দ্রভানু৷ কাল রাতেই জয়গোপালকে তিনটি হন্ডা সিটি গাড়ি দিয়ে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সাগরদ্বীপে৷ যাতে মহেশ্বরজি আজ ভোরবেলায় রওনা হতে পারেন৷ বেলা আটটা নাগাদ উনি কঙ্কণদীঘিতে পৌঁছে গিয়েছেন৷ যজ্ঞস্থল ঘুরে তখনই উনি একবার মন্দিরের ভিতরে যান৷ আয়োজন দেখে উনি খুব খুশি৷ রঙিন চাঁদোয়া দিয়ে নাটমন্দির সাজানো হয়েছে৷ মহেশপুরের কারিগরদের তৈরি শোলার কাজ খুব বিখ্যাত৷ সেখান থেকে কারিগর এনে নাটমন্দির সাজিয়েছে দয়াশঙ্কর৷ চন্দ্রভানুর বডিগার্ড কাম ম্যানেজার৷ নানা ধরনের ফুল, পাতা মন্দির ও নাটমন্দিরের শোভা চারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে৷ সুগন্ধে চারদিক ম ম করছে৷
বিশ বছর আগে বাড়ি সংলগ্ন এই মন্দিরটা চন্দ্রভানু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহেশ্বরজিরই নির্দেশে৷ একেবারে জটার দেউলের আদলে৷শিবলিঙ্গও প্রতিষ্ঠা করেছেন মন্দিরের গর্ভগৃহে৷ বিশাল শিবলিঙ্গটা তিনি পান অদ্ভুতভাবে৷ বাড়ি তৈরির সময় মাটির নীচ থেকে৷ তখন শুনেছিলেন, কঙ্কণদীঘিতে নাকি বহুকাল আগে প্রাচীন জনপদ ছিল৷ প্রাকৃতিক কোনও কারণে তা মাটির নীচে চাপা পড়ে যায়৷ পুরাতত্ত্ব বিভাগের অফিসাররা একটা সময় কঙ্কণদীঘির কয়েকটা ঢিবি খোঁড়াখুড়ি করে মূর্তি, মুদ্রা, ফলক, মাটির পাত্র ধরনের অনেক কিছু উদ্ধার করেন৷ ওঁরা চলে যাওয়ার পর বসতবাড়ির ভিটে থেকে শিবলিঙ্গটা উদ্ধার করেন চন্দ্রভানু৷ গ্রামের লোকজনের কাছে জানতে পেরে… পরে সরকারী অফিসাররা সেটাও নিতে যেতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু, চন্দ্রভানু তাঁদের বিদেয় করেন টাকাপয়সা দিয়ে৷
মন্দিরের গর্ভগৃহে যেতে হলে কয়েকধাপ সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়৷ একবার শিবলিঙ্গ প্রদক্ষিণ করে পুণ্যার্থীরা উল্টোদিকের সিঁড়ি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যান৷ পুরো মন্দিরটা তৈরি হতে প্রায় পাঁচ বছর লেগে গিয়েছিল৷ মন্দিরের চূড়াটাও তিরিশ ফুট লম্বা, শিবলিঙ্গের মতো৷ এক-দেড় কিলোমিটার দূর থেকেও লোকের চোখে পড়ে৷ মন্দিরের বাড়তি আকর্ষণ বারোফুট লম্বা নটরাজ মূর্তি৷ পাথরের এই মূর্তিটা তিনি আনিয়েছিলেন জয়পুর থেকে৷ লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা৷ গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গ রয়েছে বলে, মূর্তিটা মন্দিরের বারান্দায় স্থাপন করতে বলেছিলেন মহেশ্বরজি৷
মহেশ্বরজির জন্য এ বার শ্বেত পাথরের একটা সিংহাসন আনিয়েছেন চন্দ্রভানু৷ সকালে উনি সেই সিংহাসনে বসামাত্র বাড়ির বউয়েরা তাঁর পায়ে গঙ্গাজল ঢেলে মাথার চুল দিয়ে পা মুছে দিয়েছে৷ তার পর আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য তাঁর পায়ের তলায় সপরিবারে বসেছিলেন চন্দ্রভানু৷ তখনই বাড়ির বউদের মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র দিয়েছেন মহেশ্বরজি৷ ‘ওম ত্র্যাম্বকস যজামহে সুনান্ধিম পুষ্টিবর্ধনম, উর্বারুকসিব বন্দনামৃত্যু মুক্ষিয় মাসৃতাং৷’ এই বৈদিক মন্ত্র প্রতিদিন একশো আটবার উচ্চারণ করলে আয়ুবৃদ্ধি হয়, দারিদ্র বিনাশ হয়, কুমারী নারীর বৈবাহিক যোগ তো তৈরি হয়ই, সেইসঙ্গে কর্মহীন পুরুষের কর্মপ্রাপ্তিও সুনিশ্চিত৷ গত তিরিশ বছর ধরে চন্দ্রভানু এই মন্ত্র জপ করে ফললাভ করেছেন৷ দেশ-বিদেশ যেখানেই থাকুন না কেন, শুদ্ধ হয়ে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করতে তিনি কখনও ভোলেননি৷ শিবার্চনা করার জন্যই তাঁর এই সমৃদ্ধি৷ যখন যা মনস্কামনা করেছেন, তা পূরণ হয়েছে শিবের আশীর্বাদে৷
সঙ্গী পুরোহিতরা মন্ত্রোচারণ শুরু করে দিয়েছেন৷ অগ্নিকুণ্ডগুলি দাউদাউ করে জ্বলছে৷ পদ্মাসনে বসে আছেন মহেশ্বরজি৷ ঘৃতাহুতি দিচ্ছেন কুণ্ডে৷ তাঁর মুখে আশ্চর্য রং খেলা করছে আগুনের আঁচে৷ সেদিকে তাকাতেই সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল চন্দ্রভানুর৷ তিরিশ বছর আগের একটা দিনের কথা তাঁর মনে পড়ল৷ সনকার আবদার মেটাতে একবার সাগর দ্বীপে কপিল মুনির আশ্রমে গিয়েছেন তিনি৷ সঙ্গে ছিল মন্টু আর ওর বউ সত্যবতী৷ পুজো দেওয়ার পর মন্টুই বলেছিল, ‘চাঁদ, এখানে কাছেই থাকেন স্বামী মহেশ্বরজি৷ শুনেছি, উনি ত্রিকালদর্শী৷ নাকি কাউকে দেখলেই তার ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন৷ যাবি, তাঁর কাছে?’
চন্দ্রভানু সেদিন খুব একটা উৎসাহ দেখাননি৷ কিন্তু, মন্টুর কথায় নেচে উঠেছিল সনকা৷ বিয়ের তিন বছর পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও… তখনও ওদের কোনও সন্তান হয়নি৷ খুব মনোকষ্টে ছিল সনকা সেইসময়৷ লোকে ওকে বাঁজা বলে ধরে নিয়েছিল৷ কতই বা বয়স ওর তখন, আঠারো-উনিশের বেশি নয়৷ সনকাই জিদ ধরেছিল, মহেশ্বরজির কাছে যাবে৷ ওর মনোগত ইচ্ছাটা সেদিন চন্দ্রভানু বুঝতে পেরেছিলেন৷ আসলে সনকা জানতে গিয়েছিল, ওর সন্তান হবে কি না? কোথাও সাধুসন্ত দেখলে ও আগে সে কথা জানতে চাইত৷ তাঁদের দেওয়া মাদুলি পরত৷ নিয়ম করে উপবাস করত৷
সেদিন প্রায় আধ কিলোমিটার হেঁটে ওঁরা সবাই মহেশ্বরজির আশ্রমে পৌঁছেছিলেন৷প্রথম দেখাতেই চন্দ্রভানু বিষ্ময়াবিষ্ট হয়ে যান৷ বিকেল হয় হয়, সেই সময় আশ্রমের এক অশ্বত্থ গাছের তলায় বেদিতে বসে মহেশ্বরজি ধ্যান করছিলেন৷ তাঁর পাশেই বিশালাকার এক ষাঁড় বসেছিল৷ শুধু চন্দ্রভানুরই নয়, বাকি সবারই তখন মনে হয়েছিল, স্বয়ং মহাদেব কৈলাস থেকে নেমে এসেছেন৷ পরনে বাঘছালের বদলে লাল ধুতি৷ ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত৷ বলিষ্ঠ শরীরে আভরণ বলতে কয়েকটা রুদ্রাক্ষের মালা৷ শিবের মতো অবশ্য জটা নেই৷ তাঁর ঘন চুল কাঁধ পর্যন্ত এলিয়ে পড়া৷ গায়ের রং কাঁচা হলুদের মতো৷ মুখে অদ্ভুত প্রশান্তি৷ দেখে ওরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছিলেন নিজেদের মধ্যে৷
খানিকক্ষণ বেদির অনতিদূরে বসে থেকে ওঁরা উঠে আসছিলেন৷ হঠাৎই ধ্যানভঙ্গ করে মহেশ্বরজি চোখ খুলে বললেন, ‘কাছে আয় চন্দ্রভানু৷ তোর সঙ্গে কথা আছে৷’
শুনে চন্দ্রভানু চমকে উঠেছিলেন৷ মহেশ্বরজি তাঁর নাম জানলেন কী করে? প্রশ্নটা করারও সাহস তিনি সেদিন জোগাড় করতে পারেননি৷ মন্টু বলেছিল, উনি ত্রিকালদর্শী৷ ওঁর পক্ষে হয়তো অসম্ভব বলে কিছু নেই৷ কাছে গিয়ে প্রণাম করতেই মহেশ্বরজি বলেছিলেন, ‘আগের জন্মে তুই শিবভক্ত ছিলি৷ শিবের কিঙ্কর৷ তোর নাম ছিল চান্দু অধিকারী৷ এ কথা তোকে আমি জানিয়ে দিলাম৷ বাড়ি ফিরে গিয়ে রোজ শিবের পুজো করিস৷ তোর ভাল হবে৷’
তাঁর দেখাদেখি সনকাও গড় হয়ে প্রণাম করেছিল৷ আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে মহেশ্বরজি বলেছিলেন, ‘অত কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই মা৷ তোর মনোবাসনা খুব শিগগির পূর্ণ হবে৷ তুই সন্তানবতী হবি৷ একটা নয় রে, তোর দুটো পুত্রসন্তান হবে৷’
শুনে আনন্দে সনকা কেঁদে ফেলেছিল৷ তা দেখে মহেশ্বরজি বলেছিলেন, ‘কাঁদিস না মা৷ তোর ভাগ্যে কান্না লেখা আছে… তবে অনেক পরে৷ এখন তোদের সুদিন আসছে৷ প্রাসাদের মতো বাড়ি হবে তোদের৷ চন্দ্রভানু তোকে রাজরানি করে রাখবে৷’
চন্দ্রভানু বলেছিলেন, ‘কী করে হবে বাবা? আমি মাছের সামান্য ব্যবসা করি৷ তাও আমার লাভের ধন মহাজনের সিন্দুকেই চলে যায়৷ আমি কী করে প্রাসাদের মতো বাড়ি করব?’
‘আমার কথা কখনও মিথ্যে হয় না৷ তোদের কপালে যা লেখা আছে, আমি তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি৷ তোর বাড়িতে শিব অধিষ্ঠ হবেন৷ শিবভক্ত হিসেবে সবাই তোকে চিনবে৷ শোন, প্রতি মাসের চতুর্দশীতে তুই আমার কাছে আসবি৷ কেমন, মনে থাকবে?’
চন্দ্রভানু সেদিন ঘাড় নেড়েছিলেন৷ কিন্তু, কঙ্কণদীঘিতে ফেরার পথে অনেক ভেবেও তিনি বুঝে উঠতে পারেননি, তাঁর মতো নগণ্য এক মাছের ব্যবসায়ী কিভাবে প্রাসাদের মতো বাড়ি করবেন? দৈনন্দিন জীবনের লড়াই করতে গিয়ে চন্দ্রভানু একটা সময় ভুলেই গিয়েছিলেন মহেশ্বরজির কথা৷ চর্তুদশীতে সাগরদ্বীপে যাওয়ার কথাও তাঁর মনে ছিল না৷ তবে, রায়দীঘির বাজার থেকে সনকার কিনে আনা শিবের ছবিতে রোজ ফুল-মিষ্টি দিচ্ছিলেন৷ এইভাবেই দিন কাটছিল৷ হঠাৎ সনকা একদিন খুশি খুশি মুখে জানাল, ও গর্ভবতী৷ কথায় কথায় খবরটা মন্টুর কানে পৌঁছেছিল৷ ও উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘দেখবি, মহেশ্বরজির সব কথাই ফলে যাবে৷ চল, সামনের চতুর্দশীতে আমরা সাগরে যাই৷ খবরটা ওঁকে জানিয়ে আসি৷’
পরের চতুর্দশী পড়েছিল সোমবার৷ শিবের বার, শুভদিন৷ মন্টুকে সঙ্গে নিয়ে চন্দ্রভানু বেরিয়ে পড়েছিলেন সাগরদ্বীপের উদ্দেশ্যে৷ সনকাও সঙ্গে যেতে চেয়েছিল৷ কিন্তু, তাকে নিয়ে যাওয়ার বাস আর নৌকোভাড়াটাও দু’জনের কাছে ছিল না৷ অনেক করে বুঝিয়ে সনকাকে সেদিন ঘরে রেখে গিয়েছিলেন চন্দ্রভানু৷ ভালই করেছিলেন৷ কেননা, যাওয়ার পথে ঝড়জলে মন্টু আর তিনি সেদিন খুব নাকাল হয়েছিলেন৷ লট নম্বর আটে হারউড পয়েন্টে গিয়ে ওঁরা দেখেন, দুর্যোগে মুড়িগঙ্গা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে৷ কোনও ডিঙি নৌকো সাগরে যেতে চাইছে না৷ সেদিন মনে মনে ওঁরা ঠিকই করে ফেলেছিলেন, ফিরে আসবেন৷ কিন্তু, দুপুর নাগাদ হঠাৎ আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল৷ রোদ্দুর উঠল৷ আশ্চর্যের ব্যাপার, কলকাতার এক ভদ্রলোক ডিঙি ভাড়া করেন৷ কিন্তু, উথাল নদীতে তিনি একা যেতে ভয় পাচ্ছিলেন বলে মাঝিরা ওঁদের দু’জনকে ডেকে নেয়৷ মহেশ্বরজির কৃপা ছাড়া এটা কখনোই সম্ভব হত না!
সেদিন প্রথম দর্শনেই মহেশ্বরজি বলেছিলেন, ‘সুখবরটা দিতে এসেছিস?’
মনের ভিতর থেকেই ভক্তি উথলে উঠেছিল৷ পায়ের সামনে আছড়ে পড়ে চন্দ্রভানু বলেছিলেন, ‘বাবা, আপনি তো সবই জানেন৷ আমি পাপী, আপনার আদেশ মানতে পারিনি৷ আমাকে মাফ করে দিন৷ দিন আনি দিন খাই৷ অভাবের ঘরে সন্তান আসছে৷ তাকে প্রতিপালন করব কী করে?’
‘ভাল দিনে এসেছিস৷ দাঁড়া, তোর একটা ব্যবস্থা করে দিই৷ পাথরপ্রতিমায় থাকে আমার এক ভক্ত আজ এখানে এসেছে৷ তার নাম দ্বিজদাস নস্কর৷ ওর তিনটে ট্রলার খাটে রায়দীঘিতে৷ ও যাতে একটা ট্রলার তোকে ভাড়া দেয়, সে ব্যাপারে আমি কথা বলছি৷’
সেইসময় সদ্য ট্রলারে মাছ ধরার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে রায়দীঘিতে৷ তার অনেক ভাড়া৷ একজনের ক্ষমতায় ট্রলার ভাড়া করা সম্ভবই না৷ অন্তত দশ-বারোজনকে দরকার৷ সেই ট্রলার গভীর সমুদ্রে গিয়ে অবশ্য কয়েক টন মাছ ধরে আনছে৷ যারা যাচ্ছে, তাদের ভাল কামাই হচ্ছে৷ কিন্তু, চন্দ্রভানুর মতো ছোট ব্যবসায়ীকে কেন ট্রলার ভাড়া দেবেন দ্বিজদাস? কোন বিশ্বাসে দেবেন? চন্দ্রভানু তাই আমতা আমতা করে বলেছিলেন, ‘বাবা, ট্রলারের অনেক ভাড়া৷ আগাম সেই টাকা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই৷ তা ছাড়া, সমুন্দরে মাছ ধরতে গেলে প্রচুর লোকজনও জোগাড় করতে হবে৷ আমার যেমন অর্থবল নেই, তেমন লোকবলও৷’
শুনে মহেশ্বরজি হেসে বলেছিলেন, ‘আরে, দ্বিজদাসকে আমি বলে দিচ্ছি, তোকে আগাম টাকা দিতে হবে না৷ ফিরে এসে মাছ বিক্রি করে না হয় ভাড়া দিয়ে দিবি৷ দ্বিজদাস আমার কথা ফেলবে না৷’
সত্যি সত্যিই মহেশ্বরজি সেদিন কথা বলিয়ে দিয়েছিলেন দ্বিজদাসবাবুর সঙ্গে৷ ক্ষমতাবান লোকের সঙ্গে জানাশোনা থাকলে কী না হয়! দিন পনেরোর মধ্যেই ট্রলার নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন চন্দ্রভানু৷ প্রথমবার রওনা হওয়ার আগে মহেশ্বরজি ওঁর হাতে ছোট্ট একটা ত্রিশূলের লকেট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সবসময় এটা সঙ্গে রাখিস৷ জলে কত রকম বিপদ হতে পারে৷ মন্ত্রপূত এই ত্রিশূলটা সঙ্গে রাখলে তোর কোনও বিপদ হবে না৷ কোনও অবস্থাতেই এটা হাতছাড়া করবি না৷’
প্রথমবার ট্রিপ মেরেই চন্দ্রভানুসেবার শোধ করে দিয়েছিলেন মহাজনের সব দেনা৷ মোহনায় সেইসময় ঢুকছিল ইলিশের ঝাঁক৷ ফলে খুব বেশি গভীরে যেতে হয়নি চন্দ্রভানুকে৷ দিন পনেরোর মধ্যেই ফিরে আসতে পেরেছিলেন মাছ নিয়ে৷ পরের বার মহাজনরা ওঁর লোকজনকে ভড়কানোর অনেক চেষ্টা করেছিল৷ কিন্তু, তাতে লাভ হয়নি৷ মহেশ্বরজির আশীর্বাদে সনকা যখন পুত্রসন্তান প্রসব করল, ততদিনে ট্রলার নিয়ে সমুদ্রে তিরিশ-পঁয়ত্রিশটা ট্রিপ হয়ে গিয়েছে৷ গভীর সমুদ্রে প্রচুর মাছ৷ গাঙের মতো জাল ফেলে সেখানে হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হয় না৷ ট্রলারের খোল ভর্তি হতে সময় লাগে না৷ বরফ চাপা দিয়ে রেখে দিন দশেকের মধ্যেই প্রচুর মাছ নিয়ে ফিরে আসা যায়৷ কয়েকটা ট্রিপের পরই হাতে কিছু পয়সা জমে গিয়েছিল চন্দ্রভানুর৷ তখন তিনি মাছ রাখতে শুরু করেছেন কোল্ড স্টোরেজে৷ কলকাতায় সরাসরি মাছ চালান দিচ্ছেন পাইকার মারফত৷ সেই সময় প্রতি মাসে দু’বার করে তিনি সাগরদ্বীপে যেতেন৷ তিনি ঠিকই করেছিলেন, মহেশ্বরজির পরামর্শ ছাড়া এক পা-ও এগোবেন না৷
…নাটমন্দিরে ঢাক-ঢোল বাজার শব্দ শুনে বাস্তবে ফিরে এলেন চন্দ্রভানু৷ চন্দনকাঠের ধোঁয়া পাক খেয়ে খেয়ে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে৷ মন্দিরের বারান্দায় নটরাজ মূর্তির অনেকটাই ধোঁয়ায় দেখা যাচ্ছে না৷ মন্দিরের দিকে তাকাতেই চন্দ্রভানুর চোখে পড়ল শিব ও পার্বতী সেজে দু’জন নাটমন্দিরে এসে দাঁড়িয়েছে৷ যজ্ঞের আবহে তাদের দেখে মনে হল, সত্যি সত্যি শিব আর পার্বতী বোধহয় কৈলাস থেকে নেমে এসেছেন৷ একটু পরেই বাইরের মাঠে যাত্রাপালা শুরু হবে৷ এরা দু’জন বোধহয় শিব আর পার্বতীর ভূমিকায় অভিনয় করছে৷ শিব ছেলেটিকে বেশ মানিয়েছে৷ বেশ মাসকিউলার বডি৷ মাথায় জট, গলায় প্লাস্টিকের সাপ, রুদ্রাক্ষের মালা৷ পরনে বাঘছাল৷ পার্বতীও নববধূ বেশে৷ নানা অলঙ্কার পরে আছে৷ আজ শিবরাত্রির দিন শিব আর পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল! এই উৎসব তো সেই উপলক্ষেই! কুমারী মেয়েরা এই দিনেই তাই শিবের মতো বর চায়৷
চন্দ্রভানু লক্ষ করলেন, মহেশ্বরজি বিরক্ত মুখে একবার তাকালেন শিব-পার্বতীর দিকে৷ দরদর করে তিনি ঘামছেন৷ অগ্নিকুণ্ডের সামনে অতক্ষণ ধরে বসে আছেন, ঘামা স্বাভাবিক৷ রেগে গেলে উনি যজ্ঞস্থল ছেড়ে উঠে যেতে পারেন৷ গত তিন দশকে চন্দ্রভানু এটুকু বুঝেছেন, রেগে গেলে মহেশ্বরজি কঠিন হয়ে যান৷ তবে, ওঁর রাগ আবার খুব তাড়াতাড়ি পড়েও যায়৷ সাবধান হওয়ার জন্যই পিছনে বসে থাকা দয়াশঙ্করকে চন্দ্রভানু ফিসফিস করে বললেন, ‘যাত্রার ওই দু’জনকে এখুনি মন্দিরের বাইরে যেতে বল৷ মহেশ্বরজি বিরক্ত হচ্ছেন৷’ শুনেই পাশ থেকে দ্রুত উঠে গেল দয়াশঙ্কর৷
মন্টু সুস্থ থাকলে কখনোই এ রকম বিশৃঙ্খলা হত না৷ কিন্তু, ও এখন নার্সিংহোমের বিছানায় শুয়ে৷ গতকাল ওকে দেখতে গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছেন চন্দ্রভানু৷ ডাক্তার বললেন, চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই৷ তবে, মাস তিনেকের আগে ও নাকি সুস্থ হবে না৷ শুনে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে চন্দ্রভানুর কপালে৷ খানিকটা অসুবিধেয় পড়ে গিয়েছেন তিনি৷ বকখালিতে মন্টুর অনুপস্থিতিতে জমি রেজেস্ট্রি করা সম্ভব হবে না৷ প্রোজেক্ট কিছুদিনের জন্য পিছিয়ে দিতেই হবে৷ এ দিকে, রিসর্টের ব্লু প্রিন্ট তৈরি৷ ল্যাপটপে সেই নকশা পাঠিয়ে দিয়েছেন আর্কিটেক্ট৷ কটেজ বানানোর জন্য যে বার্মিজ টিক কাঠের অর্ডার দিয়ে এসেছিলেন চন্দ্রভানু, মায়ানমার থেকে সেই কাঠ ট্র্যাক মারফত কঙ্কণদীঘিতে আজই পৌঁছে গিয়েছে৷ এখনও আনলোড করা হয়নি৷ বিশাল সেই ট্র্যাক এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে বাড়ির পিছন দিকে মণি নদীর ধারে৷
যজ্ঞস্থলে বসে চোখ বুঁজে দেবাদিদেবকে স্মরণ করছেন চন্দ্রভানু৷ রিসর্টের কাজ যেন ভালয় ভালয় শুরু করতে পারেন৷ হঠাৎ মন্দিরের দিক থেকে গোলমালের শব্দ শুনে তিনি চোখ খুললেন৷ ঢাক-ঢোলের আওয়াজে কিছু শোনা যাচ্ছে না৷ চন্দ্রভানু দেখলেন, মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে মহিলারা ছুটে বেরিয়ে আসছেন৷ একযোগে তাঁরা কী বলছেন, দূর থেকে তা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না৷ পূজারী জগন্নাথ পণ্ডিতও বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন৷ হট্টগোলে যজ্ঞের কাজ বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়েছেন মহেশ্বরজি৷ হাত তুলে ঢাকীদের তিনি থামতে বললেন৷ নাটমন্দিরে নৈঃশব্দ নেমে এল৷ জগন্নাথ পণ্ডিত মন্দিরের নিয়মিত সেবক৷ এতক্ষণ গর্ভগৃহে ছিলেন পুণ্যার্থীদের সাহায্য করার জন্য৷ চন্দ্রভানু দেখলেন, বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি থরথর করে কাঁপছেন৷ গর্ভগৃহে কি তা হলে কিছু ঘটেছে? চন্দ্রভানু দাঁড়িয়ে পড়লেন সেটা বোঝার জন্য৷ কী ঘটেছে, নিজের চোখে দেখার জন্য দ্রুত পায়ে তিনি হাঁটতে লাগলেন মন্দিরের দিকে৷
সিঁড়ি দিয়ে উঠে বারান্দা পেরিয়ে চন্দ্রভানু গর্ভগৃহের মুখে এসে দাঁড়িয়ে যা দেখলেন, তাতে পায়ের তলার জমি কেঁপে উঠল৷ তিনি দেখলেন, শিবলিঙ্গ বেষ্টন করে রয়েছে বিরাট একটা ময়াল সাপ৷ তার মুখটা অস্বাভাবিক বড়৷ গায়ের রং জালি জালি সবেজেটে হলুদ৷ তাতে কালো বিন্দু বিন্দু আঁশ৷ বাদাবনের আবহে বড় হয়ে উঠেছেন চন্দ্রভানু৷ সারা সুন্দরবন চষে বেরিয়েছেন৷ কিন্তু, কখনও এত বড় ময়াল সাপ কোথাও দেখেননি৷ সাপটা বোধহয় বেশ কিছুদিন ধরে তৃষ্ণার্ত৷ পাত্রে রাখা গঙ্গাজল গিলে খাচ্ছে৷ গত কুড়ি বছর ধরে শিবরাত্তির উৎসব পালন করছেন চন্দ্রভানু৷ কিন্তু, কখনো এই রকম অলৌকিক ঘটনা চাক্ষুষ করেননি! কীসের ইঙ্গিত এটা, তিনি বুঝতে পারলেন না৷
গর্ভগৃহের মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন মহেশ্বরজিও৷ দৃশ্যটা দেখে তিনি উচচঃস্বরে শিবস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন৷ গমগম করছে তাঁর গলা৷ মন্দিরের ঘণ্টাগুলো হঠাৎ দুলতে শুরু করল৷ হঠাৎই মন্ত্রোচ্চারণ বন্ধ করে দিয়ে মহেশ্বরজি বলে উঠলেন, ‘তুই খুব ভাগ্যবান চন্দ্রভানু৷ স্বয়ং মহাদেব তাঁর আশ্রিতকে তোর মন্দিরে পাঠিয়ে দিয়েছেন৷ গর্ভগৃহের দরজা দুটো বন্ধ করে দে৷ আর যজ্ঞ করার দরকার নেই৷’
ওই আধ্যাত্মিক পরিবেশে কারও মনে প্রশ্নটা জাগল না, সাপটা এল কোত্থেকে?
(ছয়)
নেতাজি ক্লাবের মাঠ থেকে জগিং করে সদ্য বাড়িতে ফিরেছে অঙ্কুশ৷ এমন সময় তিন্নির ফোন, ‘ স্যার, কাগজে আজ আপনার আর আমার ছবি বেরিয়েছে৷ দেখেছেন?’
সবে সাতটা বাজে৷ এত সকালে এই অঞ্চলের বাড়ি বাড়ি কাগজ পৌঁছয় না৷ স্টেশনের কাছে অবশ্য পাওয়া যায়৷ সকালে কাগজে চোখ বোলাতেই হবে, এমন তাড়া অঙ্কুশের নেই৷ দুপুরবেলায় খাওয়া দাওয়ার পর ও খানিকটা সময় কাটায় খবরের কাগজ নিয়ে৷ বাড়িতে সবার পড়া হয়ে যাওয়ার পর, বারমহলে ওর কাছে তখনই কাগজ আসে৷ ওয়াইল্ড লাইফ সংক্রান্ত কোনও খবর থাকলে ও কেটে রেখে দেয়৷ সেমিনারে বলার সময় সেই রেফারেন্স ওর কাজে লাগে৷ তিন্নির উত্তেজনা তাই অঙ্কুশকে স্পর্শ করল না৷ ও বলল, ‘তাই নাকি? এখনও কাগজটা আমার দেখা হয়ে ওঠেনি৷ কী লিখেছে, বলো তো?’
‘স্যার ফার্স্ট পেজে পাইথনের ছবিটা বেরিয়েছে৷ আপনি আর আমি ধরে আছি৷ কাল ফোটোগ্রাফার যে ছবিটা তুলেছিল, সেটাই পাবলিশ করেছে৷’
‘সে না হয় বুঝলাম৷ কিন্তু কী লিখেছে?’
‘সেই একই কথা৷ কাল আপনি যা বলছিলেন৷ মায়ানমারের পাইথন কী করে পিয়ারাতে এল? স্যার, আপনার বন্ধু থানায় গিয়েও খোঁজ করেছেন৷ বাংলা কাগজে অতটা লেখা… পুরো আমি পড়তে পারিনি৷ একটা ইংরেজি কাগজে খবরটা দিলে ভাল করতেন৷’
তিন্নি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেয়ে৷ ওদের বাংলা কাগজ পড়ার অভ্যাস অত নেই৷ অঙ্কুশ বলল, ‘তোমার বাবা-মাকে কি কাগজটা দেখিয়েছ?’
‘হ্যাঁ স্যার, এতক্ষণ বাড়ির সববাই মিলে কাড়াকাড়িও করেছে কাগজটা নিয়ে৷ একটা রিকোয়েস্ট আছে স্যার৷ আমার এক খুড়তুতো দিদি যেতে চাইছে পিয়ারাতে৷ পাইথনটা দেখতে চায়৷ আপনি পার্মিশন দিলে ওকে নিয়ে যাব৷’
‘নিয়ে আসতে পার৷ তবে বেলা বারোটার মধ্যে৷ ডিএফও জীবনবাবু কাল আসতে পারেননি৷ আজ বিকেলের দিকে আসবেন৷ পাইথনটাকে হয়তো নিয়ে যাবেন চিড়িয়াখানায়৷ উনি নিয়ে গেলে তোমরা কিন্তু আর দেখতে পাবে না৷’
‘আমরা স্যার দশটা সাড়ে দশটার মধ্যেই পৌঁছে যাব৷ কাল কি আপনি চেক করতে পেরেছিলেন, পাইথনটা মেল না ফিমেল?’
‘ফিমেল৷ একটা ডিভাইস দিয়ে এটা চিনতে হয়৷ পরে সেটা খুঁজে পেয়েছি৷ তুমি এলে হাতে-কলমে তোমাকে দেখিয়ে দেব৷ কাল তুমি চলে যাওয়ার পর আরও একটা জিনিস আমার মাথায় এল, জানো৷ যেখান থেকেই এই পাইথনটা আসুক না কেন, একা আসেনি৷ ওর সঙ্গে একটা মেল পাইথনও ছিল৷ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেই মেল পার্টনার কোথায় গেল?’
‘এ কথা আপনার মনে হল কেন স্যার?’
‘দেখো, এটা ওদের মেটিং সিজন৷ ফিমেল পাইথন কখনো এইসময়টায় একা ট্রাভেল করবে না৷ ওর সঙ্গে বা কাছাকাছি একাধিক পুরুষ পাইথন থাকার কথা৷ আমার অনুমান যদি সত্যি হয়, তা হলে কিন্তু ডেঞ্জারাস ব্যাপার৷ সেই মেল পাইথন তা হলে এখন ফ্রি ঘুরে বেরাচ্ছে৷ যত তাড়াতাড়ি সেটাকে ইন ক্যাপটিভিটি আনা যায়, ততই মঙ্গল৷ তুমি কি বুঝতে পারছ, আমি কী বলতে চাইছি?’
‘হ্যাঁ স্যার, বুঝতে পারছি৷ কিন্তু, সেটাকে খুঁজে পাবেন কী করে?’
‘সেটাই তো মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন৷ যাক গে, তুমি এসো৷ তখন কথা বলা যাবে৷’
খবরটা ছাপানোর জন্য জয়কে ধন্যবাদ জানাতে হবে৷ ফোন ছেড়ে অঙ্কুশ বাগানের ভিতর দিয়ে হাঁটতে লাগল৷ গায়ের গেঞ্জিটা ভিজে সপসপে হয়ে গিয়েছে৷ সেটা খুলে ও হাতে নিল৷ ঠান্ডা বাতাসে ওর শরীরটা জুড়িয়ে গেল৷ হাঁটতে হাঁটতেই ওর চোখে পড়ল, একটা লতানো গাছের মধ্যে একটা লাউডগা সাপ ঝুলে আছে৷ সবুজ রঙের, তাই পাতার ফাঁকে বোঝাই যাচ্ছে না৷ আগে কখনও এই লাউডগাটা অঙ্কুশের চোখে পড়েনি৷ কৌতূহলে ও দাঁড়িয়ে পড়ল৷ তার পর কী মনে হল, হাত বাড়িয়ে সাপটাকে টেনে ও বের করে আনল৷ প্রায় দু’ ফুট লম্বা৷ রোদে চকচক করছে৷ অঙ্কুশ ঠিক করে নিল, লাউডগাটাকে সামনে রেখে আজ তিন্নির পরীক্ষা নেবে৷
ছোটবেলায় জেঠিমারা বলত, লাউডগা নাকি খুব বিপজ্জনক সাপ৷ কাছাকাছি গেলে মানুষের চোখে স্ট্রাইক করে৷ আসলে কিন্তু কথাটা একেবারেই সত্যি নয়৷ লাউডগা ক্ষীণবিষ সাপ৷ কাছে গেলে বা ভয় পেলে হাঁ করে কপাল বা চোখ বরাবর কামড়াতে আসে৷ তাই ওদের সম্পর্কে ধারণা, চোখ খুবলে খায়৷ পরে পিঙ্কি বউদির সঙ্গে মজা করবে বলে সাপটাকে হাতে ঝুলিয়ে নিল অঙ্কুশ৷ কিন্তু, রাখবে কোথায়? ওর কাছে অত ছোট খাঁচা বা বাক্স নেই৷ হঠাৎই ওর চোখে পড়ল, বাগানে শুকনো ডাবের খোল পড়ে আছে৷ কাল যখন ওর সাংবাদিক বন্ধু জয় পাইথন নিয়ে খবর করার জন্য এ বাড়িতে এসেছিল, তখন অঙ্কুশ ওকে বাগানেরই গাছ থেকে পেড়ে রাখা ডাবের জল খাইয়েছিল৷ খাওয়ার পর জয় সেটাই বোধহয় ছুড়ে ফেলেছিল৷ খোলটা তুলে নিয়ে…অঙ্কুশ লাউডগাটাকে তার ভিতরে ঢুকিয়ে দিল৷ কুন্ডলী পাকিয়ে সাপটা ঢুকেও গেল৷ অঙ্কুশ ভেবে রাখল, পরে খোলের মুখ কোনও কিছু চাপা দিয়ে রাখবে৷
জগিং করে আসার পর রোজ মিনিমাম আধঘণ্টা যোগাসন করে অঙ্কুশ৷ এই সময়টায় কেউ এলে ও বিরক্ত বোধ করে৷ সবে গদিটা পেতেছে, এমন সময় টিটো এসে বলল, ‘কুশকাকু, আমার স্যার তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে৷’
সকালে এই সময়টায় টিটো একজন প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে৷ সে থাকে গড়িয়ার দিকে৷ রণজয় না কী যেন নাম৷ বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মিশন কলেজের পাস আউট৷ অঙ্কুশকে নিয়ে ছেলেটার প্রচুর কৌতূহল৷ তাঁর আবার কী দরকার পড়ল? অঙ্কুশ তাই জিজ্ঞেস করল, ‘কী জন্য দেখা করতে চাইছে রে?’
টিটো উত্তর দেওয়ার আগেই রণজয় ঘরের ভিতর ঢুকে এসেছে৷ সে-ই বলল, ‘কুশদা, কাল আপনি যে পাইথনটা ধরেছেন, সেটা একবার দেখাবেন? কাগজে পড়লাম, সেটা নাকি বিশাল?’
পাইথনটা বাইরে খাঁচার ভিতর রাখা আছে৷ খাঁচার উপর অঙ্কুশ একটা পলিথিনের চাদর চাপা দিয়ে রেখেছে৷
বাইরে বের করতে এখন ইচ্ছে করছে না৷ তাই টিটোকে ও বলল, ‘আট নম্বর খাঁচায় ওটা আছে৷ পলিথিনের চাদর সরালেই দেখাতে পারবি৷’
…যোগাসন করে, স্নান সেরে প্রায় ঘণ্টাখানেক পর অঙ্কুশ যখন বাইরে বেরল, তখন ওর চক্ষু চড়কগাছ৷ বাগান ভর্তি লোক জড়ো হয়ে গেছে৷ নিশ্চয় কাগজে খবর পড়ে সবাই পাইথন দেখতে এসেছে৷ তাদের ম্যানেজ করছে টিটো৷ লোকে লাইন দিয়ে একদিক থেকে দেখে, অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে৷ টিভি চ্যানেলের রিপোর্টাররাও হাজির৷ তাঁরা গোলাপিকে ঘিরে ইন্টারভিউ নিচ্ছে৷ গোলাপি ব্যান্ডেজ বাঁধা বাঁ হাতটা তুলে ধরেছে৷ আর রিপোর্টারদের একজন প্রশ্ন করছে, ‘পাইথনটা যখন আপনার আঙুল কামড়ে ধরেছিল, তখন আপনার কেমন লাগছিল?’
শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল অঙ্কুশের৷ এটা একটা প্রশ্ন হল? কী রকম সাংবাদিক এঁরা? কিন্তু মিডিয়ার লোকজনের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে চলবে না৷ কড়া গলায় ও টিটোকে বলল, ‘এটা কি হচ্ছে? এত লোকজন তোকে কে ঢোকাতে বলেছে?’
গলার স্বরেই টিটোর মুখ শুকিয়ে গিয়েছে৷ ও আমতা আমতা করে বলল, ‘আমার কোনও দোষ নেই কাকু৷ গেটের বাইরে লোক জড়ো হচ্ছিল৷ বাবা অফিসে বেরনোর সময় বলে গেল, গ্রামের লোক পাইথনটাকে দেখতে চাইছে৷ একবার দেখিয়ে দে না৷’
বাবা মানে সৌম্যদা৷ শুনে অঙ্কুশের মেজাজ ঠান্ডা হয়ে গেল৷ সৌম্যদা এত ভালমানুষ, তাঁর কথা ও নিজেও তা অমান্য করতে পারত না৷ ফিসফিস করে ও বলল, ‘বাগানটা ফাঁকা করে দে৷ পোষ্যপুত্তুরদের কাল খাবার দেওয়া হয়নি৷ ওদের চান করাতেও হবে৷’
ওকে দেখে বুম হাতে একটা মেয়ে দৌড়ে এসে বলল, ‘অঙ্কুশদা, আমি চ্যানেল ওয়ান-এর রিমিতা৷ আপনার সঙ্গে দু’মিনিট কথা বলা যাবে?’
এড়িয়ে যাওয়ার জন্য অঙ্কুশ বলল, ‘কাগজে তো সবকিছু বেরিয়েই গিয়েছে৷ আমার আর নতুন কিছু বলার নেই৷’
‘আপনার কাছে আসার আগে হারপেটোলজিস্ট সুমন্ত মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলেছিলাম৷ উনি বললেন, বিদেশ থেকে সাপটা কী করে এল, সেটা নিয়ে পুলিশের তদন্ত করা উচিত৷ এর সঙ্গে সাপ চোরাচালানকারী চক্রের সম্পর্ক পাওয়া গেলেও যেতে পারে৷’
সুমন্ত মণ্ডলের নামটা শুনেই সাবধান হয়ে গেল অঙ্কুশ৷ ভদ্রলোক অনেকদিন ধরে ওর পিছনে লেগে আছেন৷ যে করেই হোক, ওর বদনাম করার চেষ্টা করেন৷ হারপেটোলজিস্ট অর্থাৎ কী না সর্পবিদ্যা বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটা সময় খুব নাম করেছিলেন সুমন্ত মণ্ডল৷ প্রায়ই কাগজে তখন ওর নাম বেরত৷ সরকারী অনেক কমিটিতেও উনি ছিলেন৷ দেশ-বিদেশে সেমিনারে যেতেন৷ অঙ্কুশ সেইসময় বারকয়েক ভদ্রলোকের কাছে গিয়েছিল৷ তখনই বুঝতে পারে, ভদ্রলোকের বেশিরভাগটাই ভাঁওতাবাজি৷ পাবলিসিটি স্টান্ট৷ অনেক পরে ও জানতে পেরেছে, সুমন্ত মণ্ডল সাপের বিষ বেআইনিভাবে বিক্রি করেন৷ ক্যানিংয়ে একবার এক সেমিনারে, ওর সঙ্গে মারাত্মক তর্ক হয়েছিল ভদ্রলোকের৷ সুমন্ত মণ্ডল কটাক্ষ করে বলেই ফেলেছিলেন, ‘এদিক ওদিক সাপের লেজ ধরে টানলেই হারপেটোলজিস্ট হওয়া যায় না৷’
শুনে অঙ্কুশ পাল্টা বলেছিল, ‘আপনি কোন ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রিটা এনেছেন, আমাকে দেখাবেন? আমি কিন্তু আপনাকে আমার সার্টিফিকেট দেখাতে পারি৷’
ভদ্রলোকের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছিল সেদিন অঙ্কুশ৷ সুমন্ত মণ্ডল তখনকার মতো চুপ করে গিয়েছিলেন৷ কিন্তু, তার পর থেকে সব জায়গায় কাঠি করে যাচ্ছেন৷ পেশাগত ঈর্ষা ছাড়া আর কিছু নয়৷ সত্যি বলতে কী, হারপেটোলজি কোনও ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো হয় না৷ একমাত্র চেন্নাইয়ের স্নেকপার্কে একটা ইনস্টিটিউট আছে, যেখানে ছয়মাসের সার্টিফিকেট কোর্স করা যায়৷ চেন্নাইয়ে গিয়ে অঙ্কুশ পড়াশুনা করে এসেছে৷ এমন অনেক কিছু জেনেছে, যা সুমন্ত মণ্ডলরা জানেন না৷ ক্যানিংয়ে সেই তর্কাতর্কি হওয়ার পর থেকে পারতপক্ষে অঙ্কুশ কোনও সেমিনারে যায় না, যেখানে সুমন্ত মণ্ডল থাকেন৷
পাইথনের ছবি কাগজে দেখে ভদ্রলোক সন্দেহের বিষ ছড়াতে শুরু করেছেন৷ তাই রিমিতাকে ও বলল, ‘সুমন্তবাবু ঠিকই বলেছেন৷ কালই আমি ডিএফওকে বলেছি, পুলিশ দিয়ে একটা ইনভেস্টিগেশন করানো দরকার৷ ডিএফও নিজেই আজ আসছেন, পাইথনটা নিয়ে যেতে৷’
আরও দু’চারটে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অঙ্কুশ বলল, ‘রিমিতা, আমার ফোন নাম্বারটা তুমি নিয়ে যাও৷ পরে দরকার হলে যোগাযোগ কোরো৷’
টিটো খুব করিতকর্মা ছেলে৷ রিমিতা চলে যাওয়ার পরই অঙ্কুশ দেখল, বাগান ফাঁকা হয়ে গিয়েছে৷ টিটো গেট বন্ধ করে দিয়েছে৷ অঙ্কুশ নিশ্চিন্ত হল, যাক এখন ও প্রাত্যহিক কাজগুলো করতে পারবে৷ গামলায় জল ভরে গম্ভীর মুখে গোলাপি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে৷ বেচারির চোখ-মুখ ফুলে আছে৷ মনে হয়, রাতে কান্নাকাটি করেছে৷ মন খারাপ হওয়ারই কথা৷ বাড়ির বড়রা কাল রাতে ঠিক করে ফেলেছেন, ওকে ওর দাদা গণেশের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে৷ বড়মা যা বলেন, সাধারণত জ্যাঠা-কাকারা তা অমান্য করেন না৷ গোলাপির উপর বড়মা খুব রেগে আছেন৷ সোমত্থ মেয়ে, ওকে আর পিয়ারাতে রাখা ঠিক হবে না৷ গণেশ একটা মোবাইল নাম্বার দিয়ে গিয়েছিল৷ পিঙ্কি বউদি সেই নাম্বারে ফোন করে তার সঙ্গে কথা বলেছে৷ গণেশ নাকি বলেছে, গোলাপির বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে৷ পাত্র ওদের দেশেরই … দয়াপুর গ্রামের৷
অন্যদিন, পোষ্যপুত্তুরদের চান করানোর সময় মস্তিতে থাকে গোলাপি৷ কিন্তু আজ মুখ গোমড়া করে রয়েছে৷ মিত্তিরবাড়ির রিপোর্টার হল টিটো৷ একফাঁকে ও একটা খবর অঙ্কুশকে জানিয়ে দিয়েছে, ‘জানো তো কুশকাকু, কাল রাত্তির থেকে গোলাপিদি কিচ্ছু খায়নি৷’ শুনে খুব খারাপ লেগেছে অঙ্কুশের৷ ও জানে, সুযোগ দিলেই গোলাপি কাল রাতের প্রসঙ্গ তুলবে৷ ওর মদত চাইবে, যাতে এ বাড়িতে থাকতে পারে৷ কিন্তু, সেই সুযোগটা অঙ্কুশ দেবে না৷ কাল রাতেই ঠিক হয়ে গিয়েছে, গোলাপিকে একা ছেড়ে দেওয়া হবে না৷ রবিবার রায়দীঘিতে যাওয়ার কথা অঙ্কুশের৷ ওখানে একটা ওয়ার্কশপে লেকচার দেবে৷ রায়দীঘি থেকে মহেশপুর খুব বেশি দূরে নয়৷ অর্গানাইজারদের পাঠানো গাড়িতেই গোলাপিকে নিয়ে অঙ্কুশ চলে যাবে৷
স্নেকহুক দিয়ে চন্দ্রবোড়াটা বের করছে গোলাপি৷ অঙ্কুশ লক্ষ করল, ও একটু অন্যমনস্ক৷ পাশ ফিরে টিটোকে কী যেন বলছে৷ আর একটু হলেই ছোবল খেত৷ সঙ্গেসঙ্গে গোলাপির হাত থেকে স্নেকহুকটা কেড়ে নিয়ে ও ধমক দিয়ে বলল, ‘এই… আবার সিরাম নেওয়ার ইচ্ছে হয়েছে নাকি রে তোর?’
সাপে কামড়ালে অ্যান্টি ভেনম সিরাম নিতে হয়, গোলাপি জানে৷ বছর চারেক আগে ওকে একবার নিতেও হয়েছিল৷ বকুনি খেয়ে ওর চোখ জলে টলটল করে উঠল৷ প্রশ্রয় দিলে কেঁদে ফেলবে৷ তাই ব্যস্ততার ভান দেখাল অঙ্কুশ৷ সাপটাকে ধীরে ধীরে জলের গামলায় নামাতে থাকল৷ কিন্তু, পাশ থেকে টিটো বলে উঠল, ‘গোলাপিদি কী বলছে জানো কুশকাকু? সাপের ছোবল খেয়ে সুইসাইড করবে৷’
শুনে চমকে উঠল অঙ্কুশ৷ কী বলছে মেয়েটা! সর্বনাশ৷ গোলাপির পক্ষে অসম্ভব কিছুই না৷ আর ও যদি সুইসাইড করে, তা হলে ঝামেলায় পড়ে যাবে অঙ্কুশ৷ সত্যিই, চন্দ্রবোড়ার ছোবল খেয়ে ও যদি কাউকে কিছু না জানিয়ে, ঘণ্টা দুয়েক ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকে, তা হলে মৃত্যু অবধারিত৷ অ্যান্টি ভেনম সিরামও ওকে তখন বাঁচাতে পারবে না৷ কয়েকদিন আগে তিন্নিকে কথায় কথায় অঙ্কুশ বলেছিল, সুইসাইড করার জন্য গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ার দরকার নেই৷ অথবা চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ার… বা গায়ে কেরোসিন খেলে আগুন লাগানোর৷ তার চেয়ে অনেক কম কষ্টের মৃত্যু হল … গোখরা বা চন্দ্রবোড়ার কামড় খাওয়া৷ ঠাট্টা করে তিন্নিকে বলা সেই কথাটা সেদিন বোধহয় মন দিয়ে শুনেছিল গোলাপি৷ সেটাই ওর মনের ভিতর ঢুকে রয়েছে৷
এ তো মারাত্মক ব্যাপার! হাতের কাজ থামিয়ে অঙ্কুশ পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘হ্যাঁরে টিটো, বাড়ির কেউ কি এ কথা জানে?’
টিটো বলল, ‘না, কেউ জানে না৷ গোলাপিদি এইমাত্তর আমায় বলল৷’
নাহ, আর চুপ করে থাকা যায় না৷ বকাবকি করলে গোলাপি আরও বিগড়ে যাবে৷ তাই নরম গলায় অঙ্কুশ বলল, ‘খবরদার এ সব পাগলামি করবি না গোলাপি৷ তোর যদি সুইসাইড করার ইচ্ছে হয়, তা হলে দাদার বাড়িতে গিয়ে করিস৷ তোর সমস্যাটা কী, আমায় বল তো?’
‘আমি মহেশপুরে যাব না৷ পরাণটাকে আমার পচন্দ না৷ গেঁজেল মউলে, ওর খুব বদনাম আচে৷’
অঙ্কুশ বুঝতেই পারল না, গোলাপি কার কথা বলছে৷ ও জিজ্ঞেস করল, ‘পরাণ আবার কে?’
‘দাদা আর বাবা যার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেচে৷’
অঙ্কুশ বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘বেশ তো, তোর যদি তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছে না হয়, তা’লে আমি গিয়ে তোর দাদার সঙ্গে কথা বলব৷ আজকাল জোর করে বিয়ে দেওয়া যায় নাকি? তোর কাকে পছন্দ বল, আমি দাঁড়িয়ে থেকে তার সঙ্গে তোর বিয়ে দেব৷’
চোখের জল মুছে গোলাপি বলল, ‘তুমি এই বুঝলে দাদাবাবু? আরে, আমি তো পোষ্যপুত্তুরদের জন্য যেতে চাইচি না৷ এদের উপর খুব মায়া পড়ে গেচে৷ আমি চলে গেলে তুমি একা এদের সামলাতে পারবে? সত্যি করে বলো তো দাদাবাবু?’
অঙ্কুশ স্বীকার করে নিল, ‘না, সত্যিই পারব না৷ কিন্তু কাল তুই এমন একটা কাণ্ড ঘটালি…’
‘কী করব বলো৷ আমার উপায় ছেল না যে৷ শিবরাত্তির উপোসের জন্য ধুতুরা ফুল পেড়ে আনতে যাচিচলুম ডোবাডিঙ্গির ধার দিয়ে৷ পোড়ো মন্দিরের সামনে গে দেকি, আশপাশের বউরা সাপ সাপ বলে হুড়োহুড়ি করচে৷ তাদের বাড়ির লোকেরা লাঠিসোটা আনতে গিয়েচে৷ জিজ্ঞেস করে জানলুম, বড় রাস্তার দিগ থেকে বিরাট বড় একটা সাপ ইদিগে এসে পোড়ো মন্দিরে ঢুকে পড়েচে৷ রাস্তার ধারে ত্যাখন বড় একটা ট্র্যাক সারাই হচিচল৷ কে নাকি দেকেচে, সাপটা সেই ট্র্যাক থেকে বেরিয়ে এসেচে৷ দাদাবাবু আমি যদি না থাকতুম, তা’লে সাপটাকে ওরা মেরে ফেলত যে৷’
কাল সারাদিন এইসব কথা গোলাপি কখনো বলেনি৷ আজ বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কাঁদছে৷ কান্নাটা ওকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলার কারণে, নাকি পাইথনটাকে মেরে ফেলার আশঙ্কায়… অঙ্কুশ বুঝতে পারল না৷ অবাক হয়ে ও গোলাপির দিকে তাকিয়ে রইল৷ গোলাপি বলল, বড় রাস্তার ধারে একটা মালবোঝাই ট্র্যাক দাঁড়িয়ে ছিল৷ তা’লে সেটাই পাইথনের ক্যারিয়ার৷ থানায় খোঁজ নিতে হবে, ওই ট্র্যাকটা ঠিক কোথা থেকে এসেছিল৷ বা কোনদিকে গিয়েছে৷ যাক, একটা আন্দাজ অন্তত পাওয়া গেল৷ কাছে গিয়ে ও বলল, ‘তুই যা করেছিস গোলাপি, একদম ঠিক৷ আমি হলেও তাই করতাম৷ কিন্তু, আমার একটা রিকোয়েস্ট তুই রাখবি? রোববার আমার সঙ্গে তুই মহেশপুরে চল৷ কথা দিচ্ছি, মাসখানেক পর তোকে আবার ফিরিয়ে আনবই৷ যা, এ বার বাড়িতে গিয়ে আগে পেটে কিছু দিয়ে আয়৷’
টিটোর সঙ্গে গোলাপি বাড়ির দিকে চলে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পর গেটের সামনে ধুলো উড়িয়ে একটা হন্ডা সিটি এসে দাঁড়াল৷ অঙ্কুশ তাকিয়ে দেখল, তিন্নি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসছে৷ ওর পিছু পিছু নেমে এল আর একটা মেয়ে৷ তিন্নির থেকে পাঁচ-সাত বছরের বড় তো হবেই৷ এ কি তিন্নির সেই খুড়তুতো দিদি নাকি? এত সুন্দরী মেয়ে অঙ্কুশের চোখে আগে কখনো পড়েনি৷ ও হাঁ করে তাকিয়ে রইল৷
(সাত)
দুপুরে খবরের কাগজটা দিতে এসে পিঙ্কি বউদি জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁ গো ঠাকুরপো, সকালে যে মেয়েটাকে নিয়ে তুমি তুরুকতোবা গাছের নীচে বসেছিলে, সে কে গো?’
ডিএফও জীবন চক্রবর্তী আসবেন বলে অঙ্কুশ রিপোর্টে একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল৷ পাইথনটাকে সল্ট লেকের বন দফতরে নিয়ে যেতে চান উনি৷ আপত্তি করেনি অঙ্কুশ৷ একটু তাড়াহুড়ো করেই পাইথনটার সম্পর্কে রিপোর্ট তৈরি করে রেখেছে ও৷ জীবনবাবু প্রথমে ঠিক করেছিলেন, পাইথনটাকে চিড়িয়াখানায় দেবেন৷ কিন্তু, আলিপুর জু-র ডিরেক্টর নাকি বলেছেন, ওঁরা দায়িত্ব নিতে পারবেন না৷ রেপ্টাইল হাউসে মেরামতির কাজ চলছে৷ কোনও জায়গা খালি নেই৷ বাধ্য হয়ে জীবনবাবু তাই কথা বলেছেন বন দফতরে৷ কিন্তু, কথাবার্তা শুনে অঙ্কুশের যা মনে হয়েছে, তাতে ওরাও পাকা কথা দেয়নি৷ আর কয়েকটা দিন সময় পেলে পাইথন সম্পর্কে ভালমতো একটা রিপোর্ট ও তৈরি করতে পারত৷ কিন্তু, সরকারী লোকজনের সঙ্গে তো আর ঝগড়া করা যায় না৷ ঝামেলা ঘাড় থেকে নামিয়ে দেওয়াই ভাল৷
পিঙ্কি বউদি যে ঘরে ঢুকেছে, আড়চোখে সেটা অঙ্কুশ দেখেছে৷ কিন্তু, বউদি প্রথমেই যে বাউন্সার দেবে, সেটা ও আন্দাজ করতে পারেনি৷ রিপোর্ট থেকে মুখ সরিয়ে অঙ্কুশ বলল, ‘কার কথা বলছ গো?’
‘ন্যাকামি কোরো না তো? তিন্নির সঙ্গে যে মেয়েটা এসেছিল, তার কথাই জিজ্ঞেস করছি৷ সেও জুলজির ছাত্রী নাকি? খুব সুন্দর দেখতে কিন্তু মেয়েটা৷’
‘তোমার থেকেও সুন্দর? আমার অবশ্য তা মনে হয় না৷’
‘থ্যাঙ্কস ফর দ্য কমপ্লিমেন্ট ঠাকুরপো৷ বলো না, মেয়েটার নাম কি গো?’
‘কী যেন বলল তখন… মানসী না শ্রেয়সী… ঠিক মনে পড়ছে না৷’
‘তাই নাকি! তিন্নি যখন তোমার সঙ্গে ওকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল, তখন পষ্ট দেখলাম মেয়েটা তোমাকে একটা নেমকার্ড দিল৷ এখন কার্ড বের করে… ঠিক নামটা আমায় বলো তো?’
‘কার্ড দিয়েছিল বুঝি? দাঁড়াও, কোথায় রেখেছি আগে একটু চিন্তা করতে হবে৷ কিন্তু, তোমার কী কাজে লাগবে, বউদি?’
‘আর একটা কার্ড ছাপানোর জন্য৷ মেয়েটার বাবা-মায়ের নাম আর বংশ পরিচয় আমায় জানতে হবে৷’
‘বুঝলাম না৷ কী কার্ড ছাপাবে বউদি? প্লিজ, যদি একটু ঝেড়ে কাশো, ভাল হয়৷’
‘শুভ প্রজাপতয়ে নমঃ৷ যেভাবে গদগদ হয়ে তুমি কথা বলছিলে, তাতে তো মনে হল, প্রেমে পড়ে গ্যাছো৷ আমার চোখকে তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না ঠাকুরপো৷ বলো, ঠিক কি না৷’
সর্বনাশ! বাড়ির ভিতর থেকে পিঙ্কি বউদি তা হলে সবই লক্ষ করেছে! মেয়েদের চোখকে সত্যিই ফাঁকি দেওয়া কঠিন৷ মেয়েরা চট করে অনেক কিছু বুঝে নিতে পারে৷ কিন্তু, ধরা দিলে পিঙ্কি বউদি সারা বাড়িতে রাষ্ট্র করে বেরাবে৷ তার পর বড়মা থেকে শুরু করে জেঠিমা-কাকিমা সবাই ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে৷ সেই পরিস্থিতি যাতে না আসে, তাই আত্মরক্ষার জন্য অঙ্কুশ বলল, ‘সৌম্যদা কবে তোমাকে বাইনোকুলার কিনে দিল বউদি? বাড়িতে বসে থেকেও সবকিছু এত পষ্ট দেখতে পাচ্ছ?’
‘পাশ কাটাবে না ঠাকুরপো৷ তোমাকে আমি ভাল রকম চিনি৷ অন্য কোনও মেয়ে হলে তুমি এত সময় দিতে না৷ বলো না গো, মেয়েটা তোমার পছন্দ? কী করে গো?’
‘ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফি৷ পাইথনের ছবি তুলে নিয়ে গেল৷ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় পাঠাবে৷ আমারও খানিকটা পাবলিসিটি হয়ে যাবে৷ স্বার্থ আছে, তাই সময় দিলাম৷’
‘বটে! তুমি বললে, আর আমিও তা মেনে নিলাম৷ তা হয় নাকি? লক্ষণ দেখে তো আমার অন্য রকম মনে হল৷ ঘরে না বসিয়ে ওকে তুরুকতোবা গাছের নীচে বসালে কেন ভাই? ওই গাছের নীচে একবার যে কাপল বসেছে, তাদের কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়েছে৷ আমি তার একজাম্পল৷ তোমার সৌম্যদা যেদিন আমায় প্রথম এ বাড়িতে নিয়ে আসে, সেদিন বিকেলে আমরা কিছুক্ষণ কিন্তু ওই তুরুকতোবা গাছের তলায় বসেছিলাম৷ তার পর আরও তিনটে কাপলকে তো দেখলাম, তাদের বিয়ে হয়েছে৷ তোমারটাও ফলবে৷’
‘ওই গাছটার তলায় বসে ঘটকালির ব্যবসা করবে বউদি? ইচ্ছে হলে আমাকেও পার্টনার করে নিতে পার৷’
‘কথা ঘুরিও না৷ তুমি কিন্তু এখনও আমাকে মেয়েটার নাম বলোনি ঠাকুরপো৷ ঠিক আছে, আমি আর জিজ্ঞেসই করব না৷’
পিঙ্কি বউদির গলায় অভিমান লক্ষ করে অঙ্কুশ বলল, ‘তিন্নিকে ফোন করো৷ ও বংশলতিকা দিয়ে দেবে৷ আর তোমার কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে কাল উষসী এলে ওকে কাকদেশান্তরী গাছের তলায় নিয়ে যাব৷ তা হলে আর কোনওদিন ফিরে আসবে না৷’
পিঙ্কি বউদির মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি৷ বলল, ‘ওহ, মেয়েটার নাম তা হলে উষসী৷ বেশ সুন্দর নামটা তো৷ কাল ফের আসবে কেন গো?’
অঙ্কুশ বলল, ‘আমাদের সঙ্গে কাল রায়দীঘিতে যাবে৷ কঙ্কখদীঘিতে ভাঁটার সময় মণি নদীর তীরে ইদানীং এক ধরনের কাঁকড়া দেখা যাচ্ছে, যা খুব রেয়ার স্পিসিস৷ জোয়ারের সময় মোহনা থেকে ভেসে ভেসে এ দিকে চলে আসছে৷ সেই কাঁকড়ার ছবি তুলতে চায় উষসী৷’
মুখ টিপে হাসল পিঙ্কি বউদি৷ গালে টোল খেল৷ এই সময়টায় বউদিকে খুব সুন্দর দেখায়৷ ঘাড় বেঁকিয়ে বউদি জিজ্ঞেস করল, ‘কী ধরনের কাঁকড়া গো? নামটা বলো না, যদি চিনতে পারি৷’
সায়েন্টিফিক নামটাই অঙ্কুশ বলল, ‘কার্সিনোসকর্পিয়াস রোটান্ডিকাউডা৷ মোহনার কাছাকাছি ম্যানগ্রোভ এরিয়ায় বেশি পাওয়া যায়৷’
‘ওহ, রাজকাঁকড়া৷ ইংরেজিতে যাকে বলে হর্সশু ক্র্যাব৷ জানি তো৷ পিছনের দিকে টেলসন আছে… সরু কাঁটার মতো, যা ওরা রাডারের মতো ব্যবহার করে৷’
বারো বছর ঘরকন্না করেও পিঙ্কি বউদি জুলজি ভোলেনি৷ শুনে অঙ্কুশ একটু অবাকই হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, রাজকাঁকড়াই৷ গোলাপিকে মহেশপুরে পৌঁছে দিয়ে তার পর উষসীকে নিয়ে আমি কঙ্কণদীঘি যাব৷ কাঁকড়ার ছবি তুলে চলে আসব রায়দিঘিতে৷ তার পর সেমিনার শেষ করে একসঙ্গে ফিরব পিয়ারাতে৷’
উষসী যে রায়দীঘি যেতে চায়, সে কথা বউদিকে অঙ্কুশ বলতে চায়নি৷ কিন্তু, ওকে নিয়ে যাতে বউদি আরও হ্যাজায়, সেই কারণে কথাটা ইচ্ছে করেই বলল৷ সত্যি বলতে কী, মেয়েটা ওর মনের মধ্যে গেঁথে বসেছে৷ চেষ্টা করেও অঙ্কুশ সরাতে পারছে না৷ মুশকিল হচ্ছে, বউদি ছাড়া অঙ্কুশের আর কেউ নেই, যার সঙ্গে ও উষসীকে নিয়ে আলোচনা করতে পারে৷ সকালে স্বল্প কথাবার্তাতেই ও বুঝে গিয়েছে, উষসী তিন্নিদের মতো অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ে নয়৷ ওর বাবা মৈনাক বসু চাকরি করতেন শিলচরে যুগশঙ্খ বলে একটা কাগজে৷ ওখানকার খুব নামকরা কাগজ৷ সদ্য রিটায়ার করে তিনি গড়িয়ায় পৈতৃক বাড়িতে ফিরে এসেছেন৷
উষসীর ইচ্ছে ছিল, বাবার লাইনে যাবে৷ তাই জার্নালিজম আর মাসকমিউনিকেশনে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রিও নিয়েছে৷ কিন্তু, কিছুদিন খবরের কাগজে চাকরি করার পর ওর ভাল লাগেনি৷ তাই এখন স্বাধীনভাবে ফোটোগ্রাফি করছে৷ কাল তিন্নিকে যখন অঙ্কুশ বলছিল, গোলাপিকে মহেশপুরে পৌঁছে দিতে যাবে, তখন রায়দীঘির কথা শুনে ফেলে উষসী৷ তখনই বলে, ও কখনও যায়নি৷ সুন্দরবনে যেতে চায়৷ অঙ্কুশ তখন না করতে পারেনি৷ ঘনিষ্ঠ হওয়ার এই অযাচিত সুযোগ, কেউ ছাড়ে কখনও?
টোপটা পিঙ্কি বউদি খেয়ে ফেলেছে৷ সারাদিন কঙ্কণদীঘিতে দু’জনে ওরা একসঙ্গে কাটাবে শুনে বউদি লাফিয়ে উঠে বলল, ‘এই সুযোগ কুশ ঠাকুরপো৷ মেয়েটাকে প্রোপোজ করে ফেলো৷ ভাল জিনিস বাজারে বেশিদিন পড়ে থাকে না৷’
অঙ্কুশ বলল, ‘সে তো তোমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি পিঙ্কি৷ ডিসেম্বরে তুমি প্রথম সৌম্যদার সঙ্গে এ বাড়িতে এলে৷ আর জানুয়ারিতে তোমাদের বিয়ে হয়ে গেল৷’
পিঙ্কি ডাকটা শুনে বউদি চটল৷ এতক্ষণ সোফায় জাঁকিয়ে বসেছিল৷ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? নাম ধরে ডাকলে কিন্তু আমি চলে যাব৷’
দু’হাতে কান ধরে অঙ্কুশ বলল, ‘সরি, ভুল হয়ে গিয়েছে বউদিমণি৷ আজ রাতে ক্যান্ডল লাইট ডিনার আমার ঘরে৷ ইনভাইট করে রাখলাম৷ কঙ্কণদীঘিতে কাল যা করতে হবে, সব তোমার পরামর্শে হবে৷’
শুনে হেসে বউদি বলল, ‘গুড বয়৷ গোলাপিকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি৷ তোমার জীবনবাবু আসার আগে কিন্তু লাঞ্চ করে নিও৷ কালকের মতো আজ এসে যেন না দেখি, খাবার ঢাকা দেওয়া আছে৷’
অঙ্কুশ ঘাড় নেড়ে বোঝাল, যথাসময়ে খেয়ে নেবে৷ পিঙ্কি বউদি বেরিয়ে যাওয়ার পর ও বারদুয়েক পাইথনকে নিয়ে লেখা রিপোর্টটায় চোখ বুলিয়ে নিল৷ নাহ, মোটামুটি ঠিকই আছে৷ পাইথনটাকে ওর কাছে আর রাখা যাবে না৷ অত বড় সাপ রাখার পরিকাঠামো ওর নেই৷ ওর কাছে পাইথনটা মারা গেলে খুব বদনাম হয়ে যাবে৷ রিপোর্টটা একটা খামের ভিতর ঢুকিয়ে অঙ্কুশ সেন্টার টেবলেই রেখে দিল৷ যাতে জীবনবাবু এলে … দিতে ভুলে না যায়৷ খাবার নিয়ে গোলাপির আসতে এখনও মিনিট দশেক লাগবে৷ সেটা আন্দাজ করে অঙ্কুশ ল্যাপটপটা হাতের কাছে টেনে নিল৷ কাল রাতে ও দেখেছে, ফেসবুকে তিন্নি পাইথনটার ছবি আপলোড করেছে৷ সেটা দেখে অঙ্কুশের ফ্রেন্ড সার্কেল রিঅ্যাকশন দিতে শুরু করেছে৷ কে কী লিখেছেন, সেটা জানার জন্য অঙ্কুশ নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলতে যাবে, এমন সময় ওর মোবাইল ফোন বেজে উঠল৷ স্ক্রিনে ও দেখল, জয়৷
সুইচ অন করেই অঙ্কুশ বলল, ‘থ্যাঙ্কস জয়৷ তোর রিপোর্টটা খুব ভাল হয়েছে৷ দারুণ ফিডব্যাক পাচ্ছি৷ আজও প্রচুর লোক পাইথনটাকে দেখতে এসেছিল৷ এমনকী, কলকাতা থেকেও৷’
ওপ্রান্ত থেকে জয় বলল, ‘শোন, একটা ফলো আপ স্টোরি করতে হবে৷ আমাদের এডিটর খুব ইন্টারেস্টেড ওয়াইল্ড লাইফ নিয়ে৷ আজই প্রথম শুনলাম, উনি নাকি সময় পেলেই স্যাংচুয়ারিগুলোতে যান৷ পাইথনটাকে নিয়ে আজ উনি আবার একটা রিপোর্ট করতে বলেছেন৷ কোন অ্যাঙ্গেলে করা যায়, বল তো?’
পাইথন কার জিম্মায় থাকবে, তা নিয়ে যে সমস্যা হতে যাচ্ছে, অঙ্কুশ সে সম্পর্কে খবরগুলো জানাল৷ তার পর বলল, ‘সন্ধের দিকে ফোন করিস৷ তা’লে লেটেস্ট খবর দিতে পারব৷’
‘পাইথনটা এল কোথা থেকে সে সম্পর্কে কিছু আন্দাজ করতে পারলি?’
‘না৷ আজ কথায় কথায় গোলাপি একটা ইম্পর্ট্যান্ট ইনফর্মেশন দিল৷ বড় রাস্তায় নাকি কে দেখেছে, একটা ট্র্যাক থেকে পাইথনটাকে বেরতে৷ থানায় ফোন করে জানতে পারলাম, সত্যিই স্পিডব্রেকার পেরনোর সময় আগের দিন ভোরে একটা ট্র্যাকের অ্যাক্সেল ভেঙে গিয়েছিল৷ ট্র্যাকটায় নাকি কাঠবোঝাই করা ছিল৷ সেই কাঠ খানিকটা নামিয়ে সকালে মেরামতির কাজ হয়েছে৷ সেইসময় রাস্তায় জ্যাম হয়েছিল বলে পুলিশও পাঠাতে হয়৷ কিন্তু, ওই ট্র্যাক থেকেই পাইথনটা বেরিয়ে এসেছিল কি না, সেটা কনফার্ম করা যায়নি৷’
প্রসঙ্গ পাল্টে জয় জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁরে, তোর সঙ্গে কি সুমন্ত মণ্ডলের শত্রুতা আছে?’
নামটা শুনেই অঙ্কুশ সতর্ক হয়ে গেল৷ কয়েক সেকেন্ড পর ও বলল, ‘কেন বল তো?’
‘আরে কাল রাতে বাড়ি ফিরে টিভি খুলেছিলাম৷ দেখলাম, চ্যাট শো-তে ভদ্রলোক তোর গুষ্টি উদ্ধার করছেন৷
সরাসরি নাম করে কিছু বলেননি৷ কিন্তু, ঠারেঠোরে এটাই বলতে চাইছিলেন, আজকালকার সো কলড হারপেটোলজিস্টরা কিছুই জানেন না৷ সব উনিই জানেন৷ মালটা কে রে?’
শুনে আর চুপ করে থাকতে পারল না অঙ্কুশ৷ যত রাগ মনের ভিতর জমা ছিল, সব উগরে দিল৷ শেষে বলল, ‘এই লোকটা ঠাকুরপুকুরের কাছে একটা জায়গায় স্নেক পার্ক করেছে৷ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের চিফ ওয়ার্ডেনের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে৷ ওখানে সাপ আছে, কুমির আর নানা ধরনের কচ্ছপও৷ দশটাকার টিকিট কিনে লোকে সেই পার্কে যায়৷ ভাল রোজগার৷ কিন্তু, লোকটা এমন অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় সাপগুলোকে রাখে যে, দেখলে তোর কষ্ট হবে৷ প্রায়ই সাপ মারা যায়৷ কিন্তু, রোস্টার ঠিক রাখার জন্য সাপুড়েদের কাছ থেকে সাপ কিনে উনি খাঁচায় রেখে দেন৷ এভাবে রিপ্লেস করা বেআইনি৷ আগে আমি সুমন্ত মণ্ডলের কাছে যেতাম৷ যদি কিছু শিখতে পারি, সেজন্য৷ পরে বুঝতে পারলাম, উনি আসলে ধান্ধাবাজ৷ সরকারী অফিসারদের খুশি রেখে সাপের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন৷’
‘তা হলে তো আমায় একবার ঠাকুরপুকুরে ঘুরে আসতে হয়৷ এমন একটা রিপোর্ট করব, লোকটার বাঁশ হয়ে যাবে৷ চ্যাট শো দেখতে দেখতে ভাই আমার রাগই হচ্ছিল৷ ওকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার৷’
‘অবশ্যই দরকার৷ আমার তো মনে হয় ঠাকুরপুকুরে স্নেকপার্কে তোর একবার যাওয়া উচিত৷ কাগজে একটু লেখালেখি হলে সরকারী অফিসাররা নড়েচড়ে বসবে৷ আসলে ওয়াইল্ড লাইফ নিয়ে সাংবাদিকদের ইন্টারেস্ট কম বলে, সুমন্ত মণ্ডলের মতো লোকগুলো করে কম্মে খাচ্ছে৷ তুই তো আমার এখানে সব দেখে গিয়েছিস৷ সুমন্ত মণ্ডলের স্নেকপার্কে গেলেই বুঝতে পারবি, আমার এখানে সাপ কত যত্নে থাকে৷’
‘ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের যে অফিস থেকে এইসব লাইসেন্স দেওয়া হয়, সেটা কোথায় তুই জানিস?’
‘সল্ট লেকের বিকাশ ভবনে৷ ওখানেই চিফ ওয়ার্ডেনের অফিস৷ এখন যিনি চিফ ওয়ার্ডেন, তাঁর নাম ভবানী প্রসাদ পুরকায়স্থ৷ তুই কি চিনিস তাঁকে?’
‘আমি না চিনলেও, উনি নিশ্চয়ই আমার নাম শুনেছেন৷ তবে ফরেস্ট মিনিস্টার যোগেন দত্তের সঙ্গে আমার চেনাশুনো আছে৷ ওঁর সঙ্গে দু’একদিনের মধ্যে আমার দেখা হওয়ার কথা৷ সুমন্ত মণ্ডলের স্নেকপার্কটা যাতে তুলে দেওয়া যায়, তার ব্যবস্থা ওইদিনই আমি করে ফেলব৷’
‘যদি তা করতে পারিস, তা’লে খুশি হব৷ আমি একদিন নিজের চোখে দেখেছি, কুমিরটাকে যে চৌবাচ্চায় লোকটা রেখেছে, সেখানে একটা লোক পানের পিক ফেলছে৷ স্নেকপার্কটা যদি আমার হত, তা’লে সেদিনই লোকটাকে আমি চৌবাচ্চায় ছুড়ে ফেলতাম৷ যা শালা, কুমিরের পেটে যা৷ যাক সে সব কথা, চ্যাট শো-তে সুমন্ত মন্ডল আমার সম্পর্কে আর কী বলল রে?’
‘বলল, তোর এখানে যে পাইথনটা পাওয়া গিয়েছে, তাকে আটকে রাখা উচিত নয়৷ জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসা উচিত৷ ওটাই ওর আসল জায়গা৷’
‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট ভুল৷ তোকে আমি লেটেস্ট রিসার্চ দেখাব৷ ওঁরা বলছেন, নিজস্ব পরিমণ্ডলের বাইরে সাপকে ছেড়ে দেওয়া মানে… তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া৷ তোকে যদি আলাস্কায় ছেড়ে দেওয়া হয়, তা হলে কি তুই বেশিদিন বাঁচবি? সাপেদেরও ঠিক তাই৷ রিসার্চ বলছে, নিজের কমফর্ট জোনের দশ- কুড়ি কিলোমিটারে মধ্যে যতক্ষণ সাপটা থাকে, ততক্ষণ ঠিক আছে৷ তার বাইরে তাকে নিয়ে গেলেই মুশকিল৷ আমাদের এখানে সাপ দেখলেই নানা জায়গা থেকে লোক আমাকে ডাকে৷ আগে সেই সাপ ধরে আমি জঙ্গলে ছেড়ে আসতাম৷ কিন্তু এখন সেটা বন্ধ করে দিয়েছি৷ লোককে এখন বোঝাই, সাপ দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই৷ সব সাপ বিষধর নয়৷ আমাদের দেশে মাত্র চার-পাঁচ ধরনের সাপ আছে, যাদের বিষ আছে৷ গোখরো, কালাচ, কেউটে, চন্দ্রবোড়া আর শঙ্খচূড়৷ তাই সাপকে দেখলেই মেরে ফেলবেন না৷ তাতে ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স নষ্ট হয়ে যাবে৷ তুই একদিন আয়, তোকে সে সব বলা যাবে৷’
‘আসব৷ এখন ছাড়ি রে৷ সন্ধের দিকে ফের তোকে ফোন করব৷’
ফোনের লাইনটা কেটে দেওয়ার পর সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে বসল অঙ্কুশ৷ যাক, এতদিনে একটা কাজের কাজ করা গেল৷ সুমন্ত মণ্ডল অনেকদিন ধরে ওকে আঁচড়াচ্ছেন৷ নানাভাবে ওকে খাটো করেছেন৷ এইবার ওকে একটা শিক্ষা দেওয়া যাবে৷ জয়ের কথা এতদিন ওর মনে পড়েনি কেন, ভেবে অঙ্কুশ আশ্চর্য হয়ে গেল৷ নামকরা কাগজের একজন সাংবাদিক হাতে থাকা মানে অনেক সুবিধে৷ সমাজের সর্বস্তরের লোকদের সঙ্গে সাংবাদিকদের জানাশুনো৷ ওরা অনেক কঠিন কাজ সহজে করে দিতে পারে৷ জয় বলল, বনমন্ত্রী যোগেন দত্তের সঙ্গে ওর পরিচয় আছে৷ একদিন জয়ের সঙ্গে গিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করে আসতে হবে৷ পিয়ারাতে একটা স্নেকপার্ক করার খুব ইচ্ছে অঙ্কুশের৷ মায়ামির সার্পেন্টেরিয়ামের কথা ও পড়েছে৷ বিল হাস্ট বলে এক আমেরিকান ভদ্রলোক একার চেষ্টায় ওই সার্পেন্টেরিয়াম তৈরি করেছিলেন৷ ভদ্রলোক নাকি নিজের শরীরটা ইমিউন করেছিলেন, সব ধরনের সাপের বিষ নিয়ে৷
‘দাদাবাবু তোমার খাবার৷’
গোলাপির কথা শুনে অঙ্কুশ দরজার দিকে তাকাল৷ গোলাপির দু’হাতে বড় দুটো থালা৷ কাছে এসে থালা দুটো সেন্টার টেবলে রেখে ও ফ্রিজের কাছে চলে গেল৷ ভিতর থেকে জলের বোতল নিয়ে এসে খুশি খুশি মুখে বলল, ‘আমাকে নিয়ে কাল সকালে কখন বেরুবে গো দাদাবাবু?’
অঙ্কুশ বলল, ‘রায়দীঘির অর্গাইনাজাররা সকাল ন’টার মধ্যে গাড়ি পাঠিয়ে দেবে বলেছে৷ মহেশপুর পৌঁছতে বেলা বারোটা হয়ে যাবে৷ তুই আজ রাতে তোর জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিবি, কেমন?’
অন্যদিন খাবার রেখে দিয়েই গোলাপি চলে যায়৷ আজ মুখ হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইল৷ ওকে জোর করে মহেশপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে সকালে কান্নাকাটি করছিল৷ হঠাৎ মেয়েটা বদলে গেল কেন? ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অঙ্কুশ জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে কিছু বলবি?’
‘দাদাবাবু, একটু আগে ঘুমিয়ে পড়েচিলুম৷ মা মনসা স্বপ্নে আমায় দ্যাখা দিয়ে বললেন, যত তাড়াতাড়ি পারিস, তুই দয়াপুরে চলে আয়৷ তোকে আমার খুব দরকার৷ না এলে তোর শরীরে কালনাগিনীর বিষ ঢালব৷’
শুনে হাঁ করে অঙ্কুশ তাকিয়ে রইল৷ ওহ, এই কারণে গোলাপির হঠাৎ ভোল বদল? ভালই হল, কাল যাওয়ার সময় অন্তত ওর কান্নাকাটি দেখতে হবে না৷ বেচারী জানেই না, মা মনসা ওকে ভয় দেখিয়েছেন বটে, কিন্তু কালনাগিনী বিষধর সাপই না৷ অন্তত বিজ্ঞান তা মনে করে না৷ কালনাগিনীর বিষে লখিন্দরের মারা যাওয়ার ঘটনাটা ঠিক হতে পারে না৷ মনে হয়, মনসামঙ্গল কাব্য যাঁরা লিখেছেন, তাঁরা এটা জানতেন না!
(আট)
নেত্রা সত্যিই পারে৷ খবরটা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে জোগাড় করে ফেলেছে৷ রিসর্টের কনফারেন্স রুমে যাওয়ার জন্য তখন তৈরি হচ্ছিলেন তরিতা৷ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হালকা মেকআপ করছেন৷ সেইসময় নেত্রা এসে বলল, ‘অসভ্য লোকটার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে দিদি৷ থাকে কঙ্কণদীঘিতে৷ ওরই পার্সোনাল লঞ্চ এমভি সনকা৷ উদয়শঙ্করবাবু বলছিলেন, সুন্দরবন অঞ্চলের খুব পাওয়ারফুল লোক৷’
ডাঃ উদয়শঙ্কর রায় হলেন টাইগার ক্যাম্প রিসর্টের মালিক প্রবীণ গর্গের ডান হাত৷ পেশায় হোমিওপ্যাথ, কিন্তু ডাক্তারি করেন না৷ রেসপন্সেবল লোক৷ ভুল খবর দেবেন না৷ নেত্রা ঠিক লোকের কাছেই খবরটা নিয়েছে৷ চোখে কাজলের হালকা টান দেওয়ার ফাঁকে তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘নামটা কি জানতে পেরেছিস?’
‘হ্যাঁ জেনেছি, চন্দ্রভানু৷ লোকটা নানা ধরনের বিজনেস করে৷ প্রচুর পয়সাকড়ি আছে৷ বউ সনকার নামেই লঞ্চ৷ শুনলাম, বউয়ের জন্মদিনে ওই লঞ্চটা উপহার দিয়েছিল৷ দুই ছেলে, দু’জনই বিবাহিত৷ নাতি-নাতনি নিয়ে ভরা সংসার৷ তবে দুই ছেলে কঙ্কণদীঘিতে থাকে না৷’
নেত্রা এখনও আসল খবরগুলো দেয়নি৷ তাই খুব ঠান্ডা গলায় তরিতা বললেন, ‘আর৷’
‘থানা-পুলিশ, সরকারী অফিসারদের কিনে রেখেছে৷ চন্দ্রভানু নাকি সব পলিটিক্যাল পার্টিকেই পয়সা দেয়৷ এসইউসি, আরএসপি, সিপিএম…৷ কিন্তু, নিজে পলিটিকসে ঢুকতে চায় না৷ কোন একটা পার্টি যেন ওকে ইলেকশনে নামাতে চেয়েছিল৷ চন্দ্রভানু রাজি হয়নি৷ শুনলাম, দিল্লির সাউথ ব্লকে লোকটার ভাল কানেকশন আছে৷ সব মিলিয়ে বেশ ইনফ্লুয়েসিয়াল এই অঞ্চলে৷’
‘আর কিছু জানতে পারলি?’
‘চন্দ্রভানু শিবভক্ত৷ ওর বাড়িতে বিরাট মন্দিরও আছে শিবের৷ রিসেন্টলি একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে সেই মন্দিরে৷ শিবরাত্তিরে নাকি একটা বিশাল সাপ…৷’
সুন্দরবন বার্তা বলে লোকাল কাগজে এই রকম একটা খবর দেখেছেন তরিতা৷ সেখানেই চন্দ্রভানুর নামটা তিনি পড়েছেন৷ তা হলে লোকটা সত্যিই ক্ষমতাশালী৷ তাড়াতাড়ি মেক আপ শেষ করে তরিতা বললেন, ‘জানি…সব জানি৷ চন্দ্রভানুকে কী করে শিক্ষা দেওয়া যায়, সেটা আগে বল৷’
‘দিদি, আগে লোকটাকে বাজিয়ে নেওয়া যাক, কত ক্ষমতাবান৷ তার পর ব্যবস্থা করা যাবে৷’
‘ওর সম্পর্কে আরও ডিটেল খবর জোগাড় কর৷ তার পর এ নিয়ে মাথা ঘামাব৷’ কথা বলতে বলতেই শাড়ির ভাঁজ শেষবারের মতো দেখে নিলেন তরিতা৷ শিফনের শাড়ি, ছাই কালারের ব্যাকগ্রাউন্ড৷ তার উপর বাদামি
কল্কা৷ আয়নার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে তিনি বললেন, ‘কেমন লাগছে রে? গ্রামের মেয়েরা আসবে, তাই হালকা টাচ দিয়ে নিলাম৷ বেশি সাজগোজ করে গেলে ওদের কাছে টানা যাবে না৷’
‘তুমি যা-ই পরো, তোমাকে সুন্দর লাগে দিদি৷ লোকে কি এমনি এমনি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে?’
‘আড়কাঠির মতো কথা বলিস না তো৷ চল, এ বার কনফারেন্স রুমে যাই৷ সবাই এসেছে?’
‘জনা পনেরো হবে৷ শান্তি বোধহয় নামটামগুলো লিখে নিয়েছে এতক্ষণে৷’
‘একটা কাজ কর, শান্তিকে বল ওদের লাঞ্চ সার্ভ করে দিতে৷ আমার দু’তিনটে ফোন করার আছে৷ কথা বলে তার পর আমি কনফারেন্স রুমে যাচ্ছি৷’
শান্তি হল রিসর্টেরই ফ্রন্ট ডেস্কের কর্মী৷ বারো ক্লাস পাস, কুড়ি-একুশ বছর বয়সি মেয়ে৷ কম্পিউটারের কাজ অল্প স্বল্প জানে৷ থাকে দয়াপুরের পাশের গ্রাম সুধাংশুপুরে৷ রিসর্টে আসার দিনই মেয়েটাকে চোখে পড়ে গিয়েছিল তরিতার৷ বেশ বলিয়ে-কইয়ে৷ গ্রামের মেয়েরা কতটা দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটায়, তা নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন তিনি৷ সেদিন অনেক অভাবের কথা বলেছিল শান্তি৷ দয়াপুরে অ্যান্টি ভেনম সিরাম তৈরির ল্যাবরেটরি করতে হলে আগে স্থানীয় মানুষদের আস্থা অর্জন করা দরকার৷ আর সেই উদ্দেশে গ্রামের অন্দরমহলে ঢুকতে পারলে ভাল হয়৷ এই কথাটা মাথায় নিয়েই তরিতা দয়াপুরে আছেন৷ সেই কারণেই শান্তিকে বলেছিলেন, গ্রামের মেয়ে-বউদের সঙ্গে কথা বলতে চান৷ এমন কিছু করতে চান, যাতে ঘরে বসেও মেয়ে-বউরা কিছু রোজগার করতে পারে৷ শুনে শান্তি খুব উৎসাহ দেখিয়েছিল৷ ও-ই দু’দিন সাইকেলে করে ঘুরে বাড়ি বাড়ি খবর দিয়ে এসেছে৷
ফোনে কথা বলে আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাংলো থেকে বেরিয়ে এলেন তরিতা৷ বেলা দেড়টা বাজে৷ রোদের তাপ আজ অনেক কম৷ পিচখালি নদীর দিক থেকে বাতাস বইছে৷ আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ৷ বিকেলের দিকে প্রায় কালবৈশাখী ঝড় আসে৷ তখন তাপমাত্রা ঝপ করে নেমে যায়৷ দয়াপুরের এই রিসর্টে আগে কখনও তরিতা আসেননি৷ রিসর্টের খোঁজ নিয়ে এসেছিল নেত্রা৷ এখানে এসে বেশ ভালই লাগছে৷ ভিতরে অনেকটা জায়গা নিয়ে সুন্দর বাগান আর জলাশয় আছে৷ নানা ধরনের মরশুমি ফুল ফুটে রয়েছে তাতে৷ ডাইনিং হলের পাশে সিমেন্টের চাতাল৷ জনা কুড়ি ট্যুরিস্টের বসার ব্যবস্থা রয়েছে৷ রঙিন আলো দিয়ে সাজানো বলে রাতের দিকে বাগানটা চমৎকার দেখতে লাগে৷ মাঝে আগুন জ্বালিয়ে বার্বিকিউও হয়৷ ট্যুরিস্টদের বড় একটা দল এসেছে আজ দুপুরে৷ ডাইনিং হলের পাশ দিয়ে কনফারেন্স রুমের দিকে যাওয়ার সময় তরিতা দেখলেন, রাতে বার্বিকিউয়ের আয়োজন চলছে৷
ডাইনিং হল থেকে লাঞ্চ সেরে গ্রামের মেয়ে-বউরা একে একে কনফারেন্স রুমে হাজির হচ্ছে৷ ভাত, ডাল, তরকারি আর মাছ৷ সঙ্গে আইসক্রিম৷ লাঞ্চে এই ব্যবস্থা করেছিল নেত্রা৷ তরিতা ভেবেছিলেন, ওদের সঙ্গে বসেই লাঞ্চ সেরে নেবেন৷ কিন্তু, তা সম্ভব হল না৷ কনফারেন্স রুমে ঢুকতেই শান্তি এগিয়ে এসে বলল, ‘যারা এসেছে, তাদের সম্পর্কে কিছু ইনফর্মেশন লিখে রেখেছি দিদি৷ ফাইলে সব পেপার রয়েছে৷ মিটিং শুরু করার আগে আপনি একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন৷’
চেয়ারে বসার আগে তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার সম্পর্কে এদের কোনও আইডিয়া দিয়েছ?’
শান্তি ফিসফিস করে বলল, ‘না, দিইনি৷ এরা জানতেও চায়নি৷ লাঞ্চের কথা শুনে চলে এসেছে৷ অনেকেই একবেলার বেশি খেতে পায় না৷ রিসর্টে খাওয়ার কথা কেউ স্বপ্নেও কোনওদিন ভাবেনি৷’
‘লাঞ্চ খেয়ে সবাই খুশি?’
‘খুউব৷ আমার মনে হয়, এরা আপনাকে এনজিও দিদিমণি ভেবে নিয়েছে৷ নানা ধরনের এনজিও কর্তারা প্রায়ই এ সব গ্রামে আসেন৷ বড় বড় বুলি দিয়ে চলে যান৷ সেই কারণে তাদের সম্পর্কে রিজার্ভেশন আছে৷ আপনাকেও এরা কতটা অ্যাকসেপ্ট করবে, বুঝতে পারছি না৷ আপনি কথা বলে দেখুন৷’
তরিতা বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি একেবারে পিছনের সারিতে গিয়ে বোসো৷ দরকার হলে ডেকে নেব৷ আর শোনো, আমি যখন মেয়েদের সঙ্গে কথা বলব, তখন তুমি নোটস নেবে, বুঝলে৷ ইম্পর্ট্যান্ট পয়েন্টগুলো লিখে রাখবে৷’
কথাগুলো বলেই শান্তির রেখে যাওয়া ফাইলটা হাতের কাছে টেনে নিলেন তরিতা৷ উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলেন৷ প্রথম পাতায় নাম লেখা আছে শোভা মণ্ডলের৷ শান্তিরই সমবয়সি, গৃহবধূ৷ স্বামী অনন্ত মণ্ডল মিস্ত্রি৷ ঘর বাড়ি তৈরির কাজের সঙ্গে যুক্ত৷ শোভার দু’বছর বয়সি একটা মেয়েও আছে৷ দয়াপুরে ওর সঙ্গে আর থাকে শ্বশুর-শাশুড়ি৷ খুব অভাবের সংসার৷ এ রকম মেয়েই তরিতার দরকার৷ পরের পাতাগুলো না উল্টে তিনি মুখ তুলে সামনের দিকে তাকালেন৷ এসি রুমে জড়সড় হয়ে বসে থাকা সব মুখ৷ সারা শরীরে অপুষ্টির চিহ্ন৷ পরনের শাড়িগুলোও মলিন৷ তরিতা লক্ষ করলেন, পিছনের সারিতে মাঝবয়সি এক মহিলা দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ একে ভরাপেট, তায় ঠান্ডা ঘর… ঘুম তো আসবেই!
সামনের দিকে তাকিয়ে তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘শোভা মণ্ডল কে?’
মাঝের সারি থেকে একটা মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ম্যাডাম আমি৷’ গায়ের রং শ্যামলা, কিন্তু খুব মিষ্টি মুখটা৷ পরনে হালকা গোলাপি সালোয়ার-কামিজ৷ চুল টানটান করে বাঁধা৷ শোভা মেয়েটা অন্যদের থেকে খানিকটা আলাদা৷ মুখটা খুব চেনা চেনা মনে হতে লাগল৷ আগে কি কোথাও দেখেছেন? নাকি কারও সঙ্গে মুখের মিল আছে? কার সঙ্গে মিল থাকতে পারে? চট করে তরিতা মনে করতে পারলেন না৷ মেয়েটার সঙ্গে কথা বললে হয়তো মনে পড়ে যেতে পারে৷ সময় নষ্ট করে লাভ নেই৷ এক একজনের সঙ্গে দশ মিনিট করে কথা বললেও প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লেগে যাবে৷ কেননা, ঘরে পনেরো জন হাজির রয়েছে৷ তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘শোভা, তুমি কদ্দূর লেখাপড়া করেছ?’
‘ক্লাস এইট পর্যন্ত ম্যাডাম৷ গাঁয়ের স্কুলেই পড়তাম৷’
‘আর পড়লে না কেন?’
‘বাবা যে কলকাতায় কাজ করতে পাঠিয়ে দিল৷ বালিগঞ্জ বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে৷’
ওহ, কলকাতায় কিছুদিন কাটিয়ে এসেছে৷ মেয়েটা এই কারণেই অন্যদের থেকে আলাদা! ম্যাডাম বলে সম্বোধন করছে৷ এই সব অঞ্চল থেকে প্রচুর মেয়ে কলকাতার দিকে কাজ করতে যায়৷ ডোমেস্টিক হেল্প৷ যাদের বাড়ি ট্রেন লাইনের ধারে, তারা অনেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারিও করে৷ শোভা বোধহয় ধরে নিয়েছে, তিনি কলকাতার৷ তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাকে কী কাজ করতে হত ওখানে?’
‘বাড়ির সব কাজ৷ ঝাড়পোছ করা, আনাজ কুটে দেওয়া৷ চা বানানো৷ ওই বাড়িতে লোক খুব কম ছিল৷ শুধু দাদু আর দিদা থাকত৷ ওদের সব কাজ আমায় করতে হত৷ দাদুর ছেলে আর ছেলের বউ বিদেশে৷ তবে ওরা মাঝে মাঝে আসত৷’
‘তোমাকে ওখানে কে নিয়ে গিয়েছিল শোভা?’
‘আমাদের গাঁয়েরই মন্মথদা৷ বালিগঞ্জে ওই বাড়িতে মন্মথদা একবার রঙের কাজ করেছিল৷ তখনই দাদু-দিদার সঙ্গে কথা হয়৷ ওরা কাজের মেয়ে খুঁজছিল৷ মন্মথদা তখন বাবাকে এসে বলল৷’
‘কতদিন ওখানে কাজ করেছিলে?’
‘তিন বছর৷ বাইরের কাজও আমি শিখে গেছিলাম ম্যাডাম৷ বাজার করে দেওয়া, ইলেকট্রিকের বিল জমা দেওয়া, টেলিফোন বা গ্যাসের অফিসে যাওয়া… সব৷ দিদা খুব ভালবাসত আমায়৷ কলকাতায় দাদু আমায় ইসকুলে ভর্তি করে দিতে চেয়েছিল৷ কিন্তু, বাবা রাজি হল না৷’
‘কেন রাজি হল না?’
‘বলল, বেশি পড়াশুনো করলে পাত্তর পাওয়া যাবে না৷’
‘কাজ ছেড়ে তুমি চলে এলে কেন?
‘কী করব? বাবা যে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলল! শুনে দাদু খুব রাগারাগি করল৷ কিন্তু, পরে আমার বিয়ের সময় বাবাকে দশ হাজার টাকা দিয়েছিল৷’
‘তোমার বর বাড়ি-ঘর তৈরির কাজ করে?’
‘হ্যাঁ, কেরালায় এর্নাকুলুম বলে কী একটা জায়গা আছে, সেখানে৷ আমার বর এখন হেডমিস্ত্রি৷’
‘কতদিন পরপর আসে অনন্ত?’
‘তা, চার-পাঁচ মাস অন্তর তো হবেই৷ একবার গাজনের সময় আসে৷ আর একবার পুজোর সময়৷ আর এলে মাসখানেক করে থাকে৷ তখন মউলেদের সঙ্গে জঙ্গলে যায়৷’
গাজনের আর দিন দশেক বাকি৷ তাই তরিতা বললেন, ‘ গাজন তো এসে গেল, তাই না? তার মানে… আর কিছুদিনের মধ্যেই তোমার বর চলে আসবে৷’
‘হ্যাঁ, ম্যাডাম৷ ক’দিন আগে আমার বর গায়েনের দোকানে ফোন করেছিল৷ বলেছে, গাজনের সন্ন্যাসী হবে৷ আমি যেন সব জোগাড় করে রাখি৷’
‘তুমি সারাদিন কী করো শোভা?’
‘কী আর করব? ঘরকন্নার কাজ করি৷ আর সময় পেলে পালা লিখি৷’
‘পালা লেখো মানে? কী ধরনের পালা?’
‘বোনবিবির পালা৷ ম্যাডাম, পালার জন্য আমি গান লিখি, সুর দিই৷ কিন্তু, ডেরেস নেই বলে করতে পারি না৷ ডেরেস আর মুকোশ বানাতে অনেক টাকা লাগবে৷ টাইগার ক্যাম্পের উদয় স্যারকে একবার পালা শুনিয়ে ছিলাম৷ ওকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন৷ আমি বলেছিলাম, আমাদের যদি ডেরেস কিনে দ্যান, তা’লে রিসটে এসে দু’অ্যাকদিন অন্তর টুরিস্টদের পালা দেকিয়ে যাব৷ টুরিস্টরা তো কলকাতায় এ সব দেকতে পায় না, ওদের ভাল লাগবে৷ আর আমাদেরও কিছু রোজকার হয়ে যাবে৷ আপনি কি বোনবিবির উপাখ্যান কখনো শুনেছেন ম্যাডাম?’
বোনবিবির কথা শুনে মুখটা কঠিন করে ফেললেন তরিতা৷ নস্যাৎ করার ভঙ্গিতে তিনি বললেন, ‘ না, কখনো শুনিনি৷ শোনার ইচ্ছেও আমার নেই৷ কিন্তু, রিসর্টে ট্যুরিস্টদের পালা দেখানোর আইডিয়াটা তোমার মাথায় এল কি করে শোভা?’
‘বালিগঞ্জে অ্যাকটা কেলাব ছিল৷ সেখানে অ্যাকবার মেলায় বোনবিবির পালা করতে গেছিল গোসাবা থেকে রাধাকান্ত গায়েনের দল৷ তাদিগের পালা শুনে পুরোটা আমি মুখুস্থ করে ফেলেছিলাম৷ শুনবেন ম্যাডাম, সেই গান?’
‘এখন না৷ শোনো, তোমায় যদি ড্রেস আর মুখোশ কেনার টাকা দিই, তা হলে কি মা মনসার পালা করতে পারবে?’
‘পারব ম্যাডাম৷ কিন্তু আমার বর পচন্দ করবে না৷ মউলে তো, তাই বোনবিবির ভক্ত৷ মা মনসার নাম শুনলে ও খেপে যাবে৷ আমায় মারধর করবে৷ আমি কিন্তু বাপের বাড়িতে মায়ের সঙ্গে মনসাতলায় যেতাম৷ আমার মা খুব মনসাভক্ত ছিল৷’
অনন্ত মনসা পুজোয় বিশ্বাস করে না শুনে মুখ লাল হয়ে গেল তরিতার৷ রাগ সামলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার বাপের বাড়িটা কোথায় শোভা?’
‘ক্যানিংয়ের রায়বাঘিনী গ্রামে৷ ওখানে বিরাট মনসাতলা আছে৷ এই শাওন মাসে ঘটা করে পুজো হয়৷ তিনদিন ধরে মেলা চলে৷’
গ্রামের নাম রায়বাঘিনী শুনে শোভার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তরিতা৷ মনে পড়ছে, মেয়েটার সঙ্গে কার মিল আছে, এ বার মনে পড়েছে৷ সেই পানপাতার মতো মুখ৷ সেই চোখ, নাক আর পুরু ঠোঁট৷ সেই দুর্গাদি… নিশ্চয়ই এই মেয়েটার কেউ হয়৷ ক্যানিংয়ের অনাথ আশ্রমের দুর্গাদি৷ বছর দশেকের বড়৷ আশ্রমের সবাই দুর্গাদিকে ভালবাসত৷ গলায় সুর ছিল, খুব ভাল প্রার্থনাসঙ্গীত গাইত৷ সেই দুর্গাদিকে নিয়ে একটা ঘটনা তরিতার স্মৃতিতে খুব উজ্জ্বল৷ দুপুরবেলায় একদিন ঝড় উঠেছিল৷ দুর্গাদিরা কয়েকজন মিলে বাগানে আম কুড়োতে গিয়েছিল৷ সেখানেই দুর্গাদিকে সাপে কাটে৷ অচেতন হয়ে ও পড়ে ছিল আমবাগানে৷ দেখতে পেয়ে ধরাধরি করে আশ্রমের মায়েরা ওকে তুলে আনেন৷ পাশেই দীঘিরহাট থেকে ওঝা ডেকে আনা হল৷ ঝাড়ফুঁক করার ফাঁকে সে জানাল, ‘কেউটে কামড়েছে গো৷ বাঁচানো খুব কঠিন হবে৷’
ওঝা চলে যাওয়ার পর আশ্রমে কান্নাকাটির রোল উঠেছিল৷ মায়েরা বলেছিলেন, ‘তুই কিছু কর তরিতা৷ পারলে তুই-ই পারবি দুর্গাকে বাঁচাতে৷’ শুনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি তরিতা৷ তিনি একাই সেদিন চলে গিয়েছিলেন আমবাগানে৷ খুঁজে বের করেছিলেন সেই সাপকে৷ ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল৷ লেজ ধরে হ্যাঁচকা টান মারতেই বেরিয়ে এসেছিল সেই চিতি সাপ৷ মোটেই বিষধর নয়৷ তার মানে… ভয়ে দুর্গাদি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল৷ হাতে ঝুলিয়ে সেই চিতি সাপ তরিতা নিয়ে আসেন আশ্রমের উঠোনে৷ সেদিনের কথা মনে পড়ায় মৃদু হাসলেন তরিতা৷
সবাইকে তিনি বলেছিলেন, সাপ বিষ ফিরিয়ে নিতে এসেছে৷ কাজটা তিনি একাই করতে চান, কেউ যেন না দেখে৷ সঙ্গে সঙ্গে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল উঠোন৷ সাপটাকে ধামায় চাপা দিয়ে রেখে… দুর্গাদির মুখে বারবার জলের ঝাপটা দিতে শুরু করেন তরিতা৷ একটু পরেই দুর্গাদি উঠে বসে৷ মা মনসার ভক্ত দুর্গাদি, উঠে তো বসবেই৷ সেদিন আশ্রমের সবাই ধন্য ধন্য করেছিলেন তরিতার৷ ওই ঘটনার কিছুদিন পরেই রায়বাঘিনী গ্রামের সুবোধ ভক্তর সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় দুর্গাদির৷
‘শোভাকে কি আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন, ম্যাডাম?’
শান্তির প্রশ্নটা শুনে সম্বিত ফিরে পেলেন তরিতা৷ মুহূর্তের জন্য আশ্রমের সেই কঠিন দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি৷ চট করে নিজেকে সামলে বললেন, ‘দুর্গাদি তোমার কে হয় শোভা?’
‘আমার মা৷ আপনি চেনেন নাকি ম্যাডাম মাকে!’ বিষ্ময় ফুটে বেরল শোভার চোখ-মুখ থেকে৷
তরিতা বললেন, ‘হ্যাঁ চিনি৷ তোমার বাবা সুবোধকেও জানি৷ ওরা এখন কোথায়?’
‘দু’জনের অ্যাকজনও বেঁচে নেই ম্যাডাম৷ গেল বচর মাতলা নদী দিয়ে ঝড়খালিতে যাচিচল৷ নৌকোডুবিতে দু’জনেই মারা গ্যাচে৷’
শুনে খারাপ লাগল তরিতার৷ তিনি বললেন, ‘মিটিং শেষ হয়ে যাওয়ার পর তুমি আমার সঙ্গে দেখা কোরো শোভা৷ মা মনসার ঘট পাতার জন্য তোমায় আমি টাকা দেব৷ রোজ তুমি ফুল চড়াবে, কেমন? অনন্ত যদি বাধা দেয়, বলবে তার খুব বিপদ হবে৷ কথাটা মনে রেখো কিন্তু৷’
শুনে শোভা ঘাড় নাড়ল৷ ফাইল থেকে দ্বিতীয় পাতাটা ওল্টানোর সময় তরিতা সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললেন, শোভা ঘট পাতুক বা না পাতুক, অনন্তকে একটা শিক্ষা তিনি দেবেনই!
(নয়)
পিঙ্কি বউদিকে যেদিন অঙ্কুশ ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে নেমতন্ন করে, সেদিন বাড়ির খাবার খায় না৷ স্টেশনের কাছে বাদশাহি খানা বলে একটা রেস্তোরাঁ আছে৷ সেখান থেকে খাবার আনিয়ে নেয়৷ বাদশাহি খানার মালিক মনিরুল বলে একটা ছেলে৷ সে আগে পার্ক সার্কাসের একটা বড় রেস্তোরাঁয় চাকরি করত৷ বিরিয়ানি তৈরিতে ওস্তাদ ছেলে৷ পিয়ারায় কোনও এক বিয়েবাড়িতে পিঙ্কি বউদি একবার ওর তৈরি মাটন বিরিয়ানি খেয়েছিল৷সেই একবার খেয়েই বউদি ফিদা হয়ে গিয়েছে৷ মন্দিরে রাধামাধব আছেন বলে চিকেন বা মাটন বিরিয়ানি অঙ্কুশদের মূল বাড়িতে ঢোকে না৷ কোনওদিন বউদির ইচ্ছে হলে… অঙ্কুশ অর্ডার দিয়ে বাদশাহি খানা থেকে বিরিয়ানি নিয়ে আসে৷ বারমহলে বসে ওরা ডিনার সেরে নেয়৷
সন্ধে সাতটার সময় বাদশাহি খানাতে ফোন করে অঙ্কুশ বলল, ‘মাটন বিরিয়ানির পাঁচটা প্যাকেট পাঠিয়ে দিস তো ভাই মণিরুল৷ আর গোটা দশেক ফিরনি৷ তুই নিজের হাতে স্পেশাল করে বানিয়ে দিবি৷’
ওদিক থেকে মণিরুল বলল, ‘কখন পাঠাব, টাইমডা বলে দ্যান৷’
‘ঠিক ন’টার সময়৷ যেন গরম গরম থাকে৷’
‘আপনের মাল কহনও ঠান্ডা পাঠেচি, ক’ন কুশভাই৷ আমি নিজে নিয়া যাবখন৷’ বলেই একটু থেমে মণিরুল ফের বলল, ‘এগডা কতা কওয়ার ছেল৷ রেতে আপনের বাড়িতে গেলে পাইথনডা দ্যাকা যাবে?’
এই রে! এত রাতে পাইথন দেখতে আসবে? এড়ানোর জন্য অঙ্কুশ বানিয়ে বানিয়ে বলল, ‘পাইথন দেখানো যাবে না ভাই৷ সন্ধে হলে ওরা ঘুমিয়ে পড়ে৷ জাগালে ভীষণ বিরক্ত হয়৷’
‘ঠিগাছে, ঠিগাছে কুশভাই, কাইল সগালে গে দেকে আসবখন৷’ বলেই লাইনটা কেটে দিল মণিরুল৷ জলজ্যান্ত এ রকম একটা মিথ্যে কথা অঙ্কুশ বলতে চাইছিল না৷ তাই ওর একটু অপরাধবোধ হতে লাগল৷ কিন্তু, এ ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না৷ ও বলল বটে, পাইথনটা সন্ধের পর ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু সাপেরা মানুষের মতো ঘুমোয় কিনা, সে সম্পর্কে ও নিশ্চিত নয়৷ কেননা, সাপেদের চোখে পাতা থাকে না৷ কিন্তু, নিশ্চয়ই সারা দিনের একটা সময়… হয় দিনেরবেলা, নয়তো রাতে… ওরা বিশ্রাম নেয়৷ সেটাই ঘুম বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে৷ রেটিকিয়ুলেটেড পাইথনরা… মানে যে ধরনের পাইথন গোলাপি ধরে এনেছে, ওরা রাতের দিকে খুব অ্যাকটিভ৷ রক পাইথনদের স্বভাব অবশ্য আলাদা৷ ওদের দেখা যায় দিনের বেলায়৷ ক্রেট জাতীয় সাপেরা, যেমন শাখামুটি আর কালাচ নিশাচর৷ কিন্তু, কেউটে বা গোখরো শিকারে বেরয় সন্ধেবেলা আর ভোরবেলায়৷
কাল সকালে মণিরুল এলে ওকে আলাদা করে পাইথনটা দেখিয়ে দেবে৷ এটা ভেবে অঙ্কুশ স্বস্তি পেল৷ সারা দিন ধরে পাইথনটাকে নিয়ে টানাপোড়েন চলেছে৷ ডিএফও জীবনবাবু নিজে অনেক দৌড়ঝাঁপ করেও কোথাও পাইথনটাকে গছাতে পারেননি৷ চিড়িয়াখানায় তো নয়ই, এমনকী সল্ট লেকের বন দফতরেও৷ সন্ধে ছ’টার সময় একবার ফোন করে উনি বললেন, ‘দু’চারটে দিন পাইথনটা যদি আপনার কাছেই থাকে, তা হলে কি আপনার খুব অসুবিধে হবে?’
অঙ্কুশ বলেছিল, ‘আমার এমনিতে কোনও অসুবিধে নেই৷ কিন্তু, সত্যি কথা বলছি, আমার ইনফ্রাস্ট্রাকচার নেই৷ এ সব পাইথন জঙ্গলে থাকে৷ ফ্রি মুভমেন্ট করার জায়গা না পেলে খুব শিগগির অসুস্থ হয়ে পড়বে৷ আমি সেই রিস্ক নিতে পারব না৷’
‘সুমন্ত মণ্ডল আমাকে ফোন করেছিলেন৷ উনি বলছিলেন, ওঁর স্নেক পার্কে পাইথনটাকে রাখতে চান৷ কী করা যায় বলুন তো মশাই?’
সুমন্ত মণ্ডলের নামটা শুনেই রাগ হয়ে গিয়েছিল অঙ্কুশের৷ কাগজে পাইথনটাকে নিয়ে দু’দিন ধরে লেখালিখি হচ্ছে বলে সাধারণ লোকের আগ্রহ বেড়ে গিয়েছে৷ তারই ফায়দা সুমন্ত মণ্ডল নিতে চান৷ ওঁর স্নেক পার্কে তা হলে ভিড় উপচে পড়বে৷ সেটা হতে দেওয়া যায় না৷ অঙ্কুশ তাই বলেছিল, ‘আমার মনে হয়, ঠিক হবে না৷ ঠাকুরপুকুরের স্নেক পার্কটা খুব অস্বাস্থ্যকর৷ এই পাইথনটা প্রায় ষোলো ফুট লম্বা৷ একে রাখার জন্য আলাদা এনক্লোজার বানাতে হবে৷ অন্তত পঁচিশ ফুট বাই তিরিশ ফুটের একটা এনক্লোজার৷ তিন দিকটায় কংক্রিটের দশ-বারো ফুটের দেওয়াল থাকা দরকার৷ বাকি একটা দিকে গ্লাস ফাইবারের দেওয়াল৷ উপরের দিকে অর্ধেকটা শেড, বাকিটা লোহার জাল দিতে হবে, যাতে রোদ-বাতাস আসতে পারে৷ এনক্লোজারের ভিতর অর্টিফিসিয়াল গাছ রাখতে হবে৷ জঙ্গলের সাপ, গাছে উঠতে ভালবাসে৷ তাতে খানিকটা ব্যায়ামও হবে৷ এই ইনফ্রাস্ট্রাকচার কি সুমন্ত মণ্ডলের ওখানে রয়েছে?’
‘না মশাই, আমার মনে হয় নেই৷’
‘তা হলে ঠাকুরপুকুরে রাখার কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন৷ পাইথনটাকে স্নেক পার্কে নিয়ে যেতে পারলে, সুমন্ত মণ্ডলের বাড়তি রোজগার হবে৷ ওখানে এখন দশ টাকা করে টিকিট৷ ওটা পনেরো টাকা হয়ে যাবে৷ ওঁর উদ্দেশ্যটা আপনাকে জানালাম৷ এ বার আপনি কী করবেন, ভাবুন মশাই৷’
‘কাল কখন আপনি ফ্রি থাকবেন অঙ্কুশবাবু?’
‘কেন বলুন তো?’
‘না, তা হলে আপনার বাড়িতে একবার যেতাম৷ পাইথনটাকে দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে৷’
‘কাল আসবেন না৷ কাল সারাটা দিন আমি বাড়ি থাকব না৷ একটা সেমিনার অ্যাটেন্ড করার জন্য সকালেই আমাকে রায়দীঘিতে যেতে হবে৷ রাতে ফিরে আসার কথা৷ পরশু সকালে আপনি জানিয়ে দেবেন, পাইথনটা কখন নিয়ে যাবেন৷’
‘ঠিক আছে, তাই হবে৷’ বলেই জীবনবাবু ফোন ছেড়ে দিয়েছিলেন৷
ধুস, জীবনবাবুকে নিয়ে আপাতত ভাবার কোনও দরকার নেই৷ বিরিয়ানির অর্ডার দিয়েই অঙ্কুশ পরপর কাজগুলো মনে মনে সাজিয়ে নিল৷ পিঙ্কি বউদি বারমহলে আসার আগেই ওকে টেবল সাজিয়ে নিতে হবে৷ বউদিকে আজ একটু চমকে দেওয়া দরকার৷ কথাটা মনে হতেই অঙ্কুশ কাজে নেমে পড়ল৷ আলমারি থেকে হালকা নীল রঙের একটা চাদর বের করে ও চট করে ডাইনিং টেবলে বিছিয়ে দিল৷ নিমন্ত্রিত তিনজন… পিঙ্কি বউদি, টিটো আর গোলাপি৷ ওরা মোট চারজন৷ চারটে সুন্দর টেবল ম্যাট পেতে, নিউ মার্কেট থেকে কিনে আনা চারটে মোটা রঙীন মোমবাতি অঙ্কুশ বসিয়ে দিল৷ বউদিরা এলে তখন মোমবাতি জ্বালাবে৷ সন্ধেবেলায় ও ভেবেই রেখেছিল, একটু অন্যরকমভাবে টেবল সাজাবে৷
পার্ক স্ট্রিটের কোনও এক রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে অঙ্কুশ একবার দেখেছিল, টেবলের ঠিক মধ্যিখানে ফুলদানি৷ তাতে খুব সুন্দর করে লতাপাতার মাঝে ফুল সাজানো রয়েছে৷ ঠিক সেই এফেক্ট আনার জন্য বিকেলেই বাগান থেকে কয়েকটা রঙিন ফুল আর লতানো গাছ ও তুলে এনেছিল৷ ফুলদানিতে সে সব সাজানোরপর হঠাৎ লাউডগা সাপটার কথা ওর মনে পড়ল৷ দু’দিন আগে সাপটাকে ধরে ও ডাবের খোলে ঢুকিয়ে রেখেছে৷ সেই লাউডগা সাপটাকে বের করে এনে অঙ্কুশ লতানো গাছের সঙ্গে সেলো টেপ দিয়ে আটকে দিল৷ রঙ সবুজ, তাই চট করে কেউ বুঝতে পারবে না, ফুল আর লতা-পাতার মাঝে একটা জ্যান্ত সাপ রয়েছে৷ দেখার পর পিঙ্কি বউদি কেমন চমকে উঠবে, সেই দৃশ্যটা কল্পনা করে অঙ্কুশ মনে মনে হাসল৷
রাত ঠিক ন’টায় ডিনার৷ এখনও হাতে দেড় ঘণ্টা সময় আছে৷ অন্যদিন এই সময়টায় অঙ্কুশ টিভি খুলে নিউজ দেখে৷ আজ ওর ইচ্ছেই করল না৷ সময় কাটানোর জন্য ও ল্যাপটপ খুলে বসল৷ ফেসবুকের অ্যাকাউন্ট খুলে ও দেখল, প্রচুর মেসেজ জমা হয়ে রয়েছে৷ পুনে আর নাসিক থেকে অন্তত পনেরোজন সর্পমিত্র ওর সঙ্গে চ্যাট করতে চান৷ সাপেদের ভালবাসেন, এমন মানুষরাই হলেন সর্পমিত্র৷ সারা দেশে এমন অনেক মানুষ আছেন৷ মহারাষ্ট্রে এঁদের সংখ্যা প্রচুর৷ এঁরা সাপ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য নানা ধরনের প্রচার করেন৷ তার একটা মাধ্যম হল ফেসবুক৷ তবে, সর্পমিত্ররা মাঝে মাঝে অতি উৎসাহী হয়ে এমন সব কাণ্ড করেন, যা অঙ্কুশের অনেক সময় ভাল লাগে না৷
এই যেমন, ক’দিন আগে ওর চোখে পড়েছিল, নাসিকের এক সর্পমিত্র কেতা নেওয়ার জন্য দু’হাতের তালুতে গোখরো রেখে ছবি পোস্ট করেছেন৷ সাপটা ফণা তুলে ধরেছে৷ দেখে অঙ্কুশ শিউরে উঠেছিল৷ ভদ্রলোকের নামও ওর মনে আছে৷ রঘুনাথ দাভে৷ যে কোনও মুহূর্তে ঘুরে গিয়ে গোখরোটা মুখে ছোবল মারতে পারে৷ সেই বোধটুকুও সম্ভবত দাভের নেই৷ এমন বেআক্কেলে! আমেরিকার একটা ড্যান্স বার-এ একবার এ রকম একটা ঘটনা ঘটেছিল৷ ওখানকার নাইট ক্লাবে মেয়ে ড্যান্সাররা গায়ে অ্যানাকোন্ডা সাপ জড়িয়ে নাচ দেখান৷ অনেকেই তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন৷ এই ছবি তোলাতে গিয়েই বিপত্তি৷ ফ্ল্যাশ বালবের আলোয় সেই সাপটা অনেকক্ষণ ধরে বিরক্ত হচ্ছিল৷ ব্যস, রেগে গিয়ে একজন মহিলার মুখে স্ট্রাইক করে৷ সঙ্গেসঙ্গে গাল দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে৷ অ্যানাকোন্ডা বিষধর সাপ নয়৷ তাই মহিলাটি মারা যাননি৷ কিন্তু, গোখরোর ছোবল খেলে মৃত্যু হলেও হতে পারে৷
ফেসবুকে মেসেজগুলো পড়তে পড়তে অঙ্কুশের খুব মজা লাগল৷ রেটিকিয়ুলেটেড পাইথন সম্পর্কে যে যতটা পেরেছেন, ওকে জ্ঞান দিয়েছেন৷ একজন লিখেছেন, ‘আপনি যে পাইথনটা পেয়েছেন, সেটা কে বলল রেয়ার স্পিসিস? সুমন্ত মণ্ডল পোস্ট করেছেন, এ রকম রেটিকিয়ুলেটেড পাইথন নাকি আলিপুরদুয়ার আর
নর্থ ইস্টের অনেক রাজ্যে প্রচুর দেখা যায়৷’ মেসেজটা পড়েই মেজাজ গরম হয়ে গেল অঙ্কুশের৷ সব সময় ওকে খাটো করার চেষ্টা! পর পর দু’দিন ও খবরের কাগজে পাবলিসিটি পেয়েছে৷ সেটা সুমন্ত মণ্ডল সহ্য করতে পারছেন না৷ অঙ্কুশের একবার মনে হল, পাল্টা মেসেজ পোস্ট করে জানিয়ে দেয়, সুমন্ত মণ্ডল যা লিখেছেন, তাতে গুরুত্ব দেওয়ার কোনও দরকার নেই৷ কিন্তু, পরক্ষণেই ও নিজেকে সামলে নিল৷ পাল্টা কিছু লেখা মানেই লোকটাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া৷
চোখ বোলানোর ফাঁকে একটা মেসেজ দৃষ্টি আকর্ষণ করল অঙ্কুশের৷ পুনে থেকে বাল কারমারকর বলে এক জন সর্পমিত্র লিখেছেন, ‘মিঃ অঙ্কুশ, আপনার পজেশনে যে পাইথনটা আছে, সেটি মায়ানমারের৷ এ সম্পর্কে আমার কোনও সন্দেহ নেই৷ আমি নিজের চোখে এই ধরনের পাইথন ওখানে দেখেছি৷ সেই সময় আমি ইন্ডিয়ান আর্মিতে কর্মরত ছিলাম৷ দেশের প্রয়োজনে তখন বর্মার জঙ্গলে আমাকে ঘুরতে হয়েছিল৷ সেই কারণেই আমি নিশ্চিত৷ কিন্তু, আপনাকে জানিয়ে রাখি, পাইথনটি একা আসেনি৷ বছরের এই সময়টা ওদের মেটিং সিজন৷ ডেফিনিটলি, ওর মেল পার্টনারও সঙ্গে এসেছে৷ তাকে খুঁজে বের করা উচিত৷ ফিমেল পাইথনটা যদি ইতিমধ্যে প্রেগনেন্ট হয়ে থাকে, তা হলে কী হবে ভাবতে পারছেন?’
সত্যিই… এই কথাটা তো অঙ্কুশের মনে হয়নি! পাইথনের পেটে ডিম আছে কি না, তা বাইরে থেকে খানিকটা আন্দাজ করা যায়৷ একসঙ্গে এরা চল্লিশ-পঞ্চাশ বা তারও বেশি ডিম পাড়তে পারে৷ সব ডিম ফুটে যে বাচ্চা বেরয়, তা হয় না৷ হাঁস বা মুরগির ডিমের মতো নয়, সাপের ডিম থলথলে হয়৷ পেট থেকে ডিম বেরনোর পর সেসব নিজের শরীরের মধ্যে কুণ্ডলী করে তা আগলে রাখে পাইথন৷ প্রায় ষাট থেকে পঁয়ষট্টি দিন নট নড়ন-চড়ন৷ তার পরই বাচ্চাগুলো বেরিয়ে আসে৷ এ সব তথ্য অঙ্কুশের জানা৷ বাল কারমারকরের মেসেজ পড়ে ওর মনে হল, ইস, ভাল করে ও লক্ষই করেনি, গোলাপির ধরে আনা পাইথনটার পেটে ডিম আছে কি না৷ থাকলে রিপোর্টে তা লিখে দেওয়া উচিত৷ পাইথনটা যেখানেই থাক না কেন, মাস দুয়েক পর সত্যিই যদি বাচ্চাগুলোর জন্ম দেয়, তা হলে সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে৷
মেসেজগুলোয় চোখ বোলাতে বোলাতে অঙ্কুশ শুনতে পেল মোবাইল ফোনটা বাজছে৷ উঠে গিয়ে ও টেবল থেকে ফোন তুলে বলল, ‘কে বলছেন?’
ও প্রান্ত থেকে জয় বলল, ‘আমি বলছি রে৷ একটা ইন্টারেস্টিং খবর আছে৷ অফিসের লাইন থেকে সেই কারণেই তোকে ফোন করলাম৷’
‘হ্যাঁ বল৷ রাতের দিকে তোকে আমিও ফোন করতাম৷’
‘শোন, আর একটা পাইথনের খবর পাওয়া গেছে৷ সেটাও রেটিকিয়ুলেটেড৷ আমার মনে হচ্ছে, তোর কাছে যে পাইথনটা আছে, তার জুটি৷’
শুনে উত্তেজনা চেপে রাখতে পারল না অঙ্কুশ৷ বাল কারমারকরের মেসেজটার কথা সঙ্গেসঙ্গে ওর মনে পড়ল৷ ভদ্রলোক তা হলে ঠিকই বলেছেন৷ ও তাই বলল, ‘তুই কী করে বুঝলি?’
‘সাউথ চবিবশ পরগণায় আমাদের যে ছেলেটা করেসপন্ডেন্ট, সেই সিরাজ মন্ডল এইমাত্তর খবর পাঠিয়েছে, কঙ্কণদীঘির নানা জায়গায় নাকি একটা বিশাল সাপকে দেখা যাচ্ছে৷ লোকজন সব খুব ভয়ে ভয়ে রয়েছে৷ সাপটার যে বিবরণ সিরাজ লিখেছে, তার সঙ্গে তোর পাইথনটা ম্যাচ করে৷ ওই সাপটাকে প্রথম দেখা গিয়েছিল শিবরাত্তির দিন চন্দ্রভানু বলে একজন বিজনেসম্যানের বাড়ির মন্দিরে৷ পরদিনই সে মন্দির থেকে উধাও হয়ে যায়৷ তার পর থেকে মাঝে মাঝে সাপটাকে আশপাশের জঙ্গলে বা নদীর ধারে কোনও গাছের ডালে দেখা যাচ্ছে৷’
‘কিন্তু তুই কী করে সিওর হলি, ওই সাপটা এর জুটি?’
‘ট্র্যাকের কথা শুনে৷ মনে আছে, গোলাপি তোকে বলেছিল, একটা ট্র্যাকের ভিতর থেকে তোর পাইথনটাকে লোকজন বেরিয়ে আসতে দেখেছে? সেই ট্র্যাকটাই তোদের পিয়ারা থেকে চন্দ্রভানুর বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছে৷ গাড়ির নাম্বারও এক৷ সিরাজ বলল, মায়ানমার থেকে ওই ট্র্যাকটা কাঠ নিয়ে এসেছে৷ চন্দ্রভানু কোথায় যেন রিসর্ট বানাবে, সেই কারণে৷ আমার মনে হয়, মায়ানমারে কাঠ লোড করার সময় পাইথন দুটো ট্র্যাকে উঠে পড়েছিল৷ আর নামতে পারেনি৷ একটা নেমেছে পিয়ারাতে, অন্যটা কঙ্কণদীঘিতে৷ তোর কথাই ঠিক৷ এ দুটো বার্মিজ পাইথন৷ কীভাবে পাইথন দুটো এখানে এল, তা নিয়ে আজ আমি স্টোরি করছি৷ দেখবি, কাল কাগজে বেরলে হই চই হয়ে যাবে৷’
‘ডিএফও জীবনবাবুকে এ সব কথা বলেছিস?’
‘না, উনি কিছুই জানেন না৷ আমি চাই কাল আমার রিপোর্ট পড়ে সব জানুন৷ ওকে জিজ্ঞেস করতে গেলে, আমার খবরটা আর এক্সক্লুসিভ থাকবে না৷ লোকটা অন্য কোনও রিপোর্টারকে দিয়ে দেবে৷ তুই বল তো, পাইথন দুটোকে নিয়ে সরকারের কী করা উচিত?’
‘ট্র্যাকটা কোথাকার, খোঁজ নিয়েছিস?’
‘মায়ানমারেরই হবে৷ তবে আমি সিওর নই৷’
‘তা হলে পাইথন দুটোকে ওই ট্র্যাকে করে মায়ানমারের জঙ্গলে ফেরত দিয়ে আসা উচিত৷ তার আগে আমি যদি একবার কঙ্কণদীঘির পাইথনটাকে দেখতে পেতাম, তা হলে ভাল হত৷’
‘ওখানে চলে যা৷ কাল তুই তো যাচ্ছিসই রায়দীঘিতে৷ ওখান থেকে কঙ্কণদীঘি খুব বেশি দূরে না৷ একবার না হয় সাপটাকে দেখে আয়৷ কোনও খবর থাকলে কাল বিকেলে জেনে নেব৷’
‘ওখানে আমি সময় পাব বলে মনে হয় না৷ তবে, চেষ্টা করব৷’
‘তা হলে এখন ছাড়ছি, অ্যা৷ কাগজের আপিসে এখন এটা পিক আওয়ার্স৷ কথা বলার সময় নেই৷’
‘ঠিক আছে৷’ কথাটা অঙ্কুশ শেষ করার আগেই লাইন কেটে দিল জয়৷ অদ্ভুত ছেলে তো! সব সময় কি ও খবরেরই চিন্তা করে? রিপোর্টাররা কি এ রকমই ব্যস্তবাগীশ হয়? পাইথন নিয়ে যে সমস্যা বাড়ছে, সে কথাটা বলার সুযোগই দিল না জয়৷
বাইরে বাগানে টিটোর গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে৷ বোধহয় গোলাপির সঙ্গে কথা বলতে বলতে টিটো বারমহলে আসছে৷ তার মানে পিঙ্কি বউদিও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে৷ আন্দাজ করে অঙ্কুশ টেবলের মোমবাতিগুলো জ্বালিয়ে দিল৷ তার পর বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল, ওর অনুমানই ঠিক৷ গোলাপি আর টিটো সিঁড়ির কাছে পৌঁছে গিয়েছে৷ পিঙ্কি বউদি একটু দূরে তুরুকতোবা গাছের কাছে৷ ঠিক ওই সময়ে ফের ওর মোবাইল ফোন বেজে উঠল৷ জয় বোধহয়৷ পঞ্জাবির পকেট থেকে সেট বের করে স্ক্রিনের দিকে চোখ দিতেই অঙ্কুশের বুকটা চলকে উঠল৷ উষসী… ফোন করেছে উষসী! ও বলল, ‘অঙ্কুশ বলছি৷’
‘আমি উষসী৷ চিনতে পারছেন? তিন্নির সঙ্গে আপনার বাড়িতে গিয়েছিলাম…৷’
অঙ্কুশ ঠাট্টা করল, ‘আমার স্মৃতিশক্তিটা খারাপ, কে বলল তোমাকে?’
‘বাধ্য হয়ে ফোনটা করলাম৷’ গলাটা কেমন যেন বিষণ্ণতায় ভরা৷ উষসী বলল, ‘আপনাদের ওখান থেকে বাড়িতে ফিরে দেখি, বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন৷ উনি এখন নার্সিং হোমে৷ কাল আপনার সঙ্গে কঙ্কণদীঘি যাওয়ার প্ল্যানটা তাই আমায় বাতিল করতে হল৷ প্লিজ, কিছু মনে করবেন না৷’
যে উৎসাহ নিয়ে অঙ্কুশ ফোনটা ধরেছিল, সেটা হঠাৎ নিভে গেল৷ আমতা আমতা করে ও জিজ্ঞেস করল, ‘কোন নার্সিং হোমে রয়েছেন আপনার বাবা?’
‘আমাদের এখানেই নিরাময় বলে একটা নার্সিং হোমে৷ গড়িয়া বাস ডিপোর কাছে৷ কেন বলুন তো?’
‘না, এমনিই জিজ্ঞেস করলাম৷ যদি কোনও কাজে লাগতে পারি, সেই কারণেই৷’
‘দরকার হলে বলব৷ খুব খারাপ লাগছে, কথা দিয়েও রাখতে পারলাম না৷ পরে কখনও যদি কঙ্কণদীঘিতে যান, আমাকে কিন্তু নিশ্চয় বলবেন, কেমন?’
অঙ্কুশের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘আমারও খুব খারাপ লাগছে৷
‘আচ্ছা, ছাড়ি তা হলে?’
ও প্রান্তে লাইনটা কেটে যাওয়ার পর অঙ্কুশের মন খুব খারাপ হয়ে গেল৷ পাশ ফিরতেই ও দেখতে পেল, হাসি হাসি মুখে পিঙ্কি বউদি ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই বউদি জিজ্ঞেস করল, ‘ফোনটা কে করেছিল, আমি কিন্তু জানি কুশ ঠাকুরপো৷ তোমার মুখ দেখেই সেটা বুঝতে পারছি৷ আমার কাছে লুকোলে খুব খারাপ হয়ে যাবে৷ উষসী, তাই না?’
অঙ্কুশ হাঁ করে তাকিয়ে রইল৷ আন্দাজ করতে লাগল, কী ধাতু দিয়ে তৈরি ওর পিঙ্কি বউদি!