(পঞ্চাশ)
দুঃসংবাদটা এল দুপুরবেলায়৷ নার্সিং হোমে সবে ডাক্তার বলে গেছে, এ বার আপনি বাড়ি যেতে পারেন৷ সনকা গোছগাছ করে নিচ্ছে৷ মন্টু নীচে গেছে নার্সিং হোমের বিল মেটাতে৷ সেইসময় মোবাইলে অঘোরের ফোন, ‘স্যার আপনি কি এখনও নার্সিং হোমে?’
চন্দ্রভানু বললেন, ‘এই এখুনি বাড়ির দিকে বেরব৷ ছোটখোকার কি খবর? কদ্দূরে আছে?’
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে অঘোর বলল, ‘খবর ভাল নয় স্যার৷ আমাদের সাতটা ট্রলার পালান সর্দার আটকে দিয়েছে৷ তার একটায় ছোটবাবু আছেন৷’
কথাটা শুনে ঘামতে শুরু করলেন চন্দ্রভানু৷ জলডাকাত পালান সর্দার ট্রলার আটকে দিয়েছে! বিপদের উপর বিপদ৷ সত্যিই দুঃসংবাদ৷ গত দশ-বারো বছর ধরে নদীপথে এইভাবেই পালান অত্যাচার চালাচ্ছে৷ এর আগেও চন্দ্রভানুর ট্রলার আটকেছে সে৷ টাকা পাঠিয়ে সেই ট্রলার ছাড়িয়েছেন চন্দ্রভানু৷ এইবার ভয়ের ব্যাপার, একটা ট্রলারে ছোটখোকা আছে৷ মুক্তিপণ না পাঠালে পালান খুনখারাপিও করতে পারে৷ চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘পালান কি তোকে ফোন করেছিল?’
অঘোর বলল, ‘না সে করেনি৷ আমাদেরই ট্রলারের সারেঙ বনমালীকে সে রায়দীঘিতে পাঠিয়ে দিয়েছে৷ দশ লাখ টাকা চাইছে মুক্তিপণ হিসেবে৷ টাকাটা পাঠাতে হবে বনমালীরই হাত দিয়ে৷ কী করব স্যার?’
‘পালানের নাম করে বনমালী আবার দু’নম্বরী করছে না তো? টাকাটা নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে না তো?’
‘না স্যার, ওর হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন ছোটবাবু৷ আপনাকে লেখা৷ গৌরকে দিয়ে নার্সিং হোমে পাঠিয়ে দিচ্ছি৷ স্যার, বনমালী দু’নম্বরি করার ছেলে নয়৷ ওকে যে টর্চার করা হয়েছে, তা ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷ এখন আপনি বলুন, পুলিশকে কি ইনফর্ম করব? পালান অবশ্য বলে পাঠিয়েচে, পুলিশকে জানালে ছোটবাবুর লাশ জলে ভাসিয়ে দেবে৷’
পালানের নামটা বোধহয় সনকার কানে গেছে৷ মুখ দেখে ও বুঝে নিয়েছে৷ হাতের কাজ থামিয়ে ও জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েচে গো? পালান ডাকাত আমাদের ট্রলার আটকেচে না কি? কী হবে?’
উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই চন্দ্রভানু৷ পালান সর্দার পুলিশকে জানাতে মানা করেছে৷ জানালে সত্যিই ছোটখোকার লাশ জলে ভাসিয়ে দিতে পারে৷ ও করতে পারে না, হেন কাজ নেই৷ কী বলবেন, চন্দ্রভানু বুঝে উঠতে পারলেন না৷ অহল্যাটাও আজ কঙ্কণদীঘিতে নেই৷ কাল রাতে হঠাৎ ও ফোনে বলল, জরুরি কাজে ওকে না কি একবার কলকাতায় যেতে হবে৷ আজ ভোরেই ও ব্যস্ত হয়ে কলকাতার দিকে রওনা হয়ে গেছে৷ তবে বলে গেছে, বিকেলের আগেই ফিরে আসবে৷ ফোনে অহল্যার সঙ্গে একবার পরামর্শ করা দরকার৷ তাই অঘোরকে তিনি বললেন, ‘আমি পাঁচ মিনিট পরে তোকে জানাচ্ছি, কী করতে হবে৷ পুলিশকে তো নয়ই, এখন কাউকেই তুই কিছু জানাবি না৷’
‘না স্যার, কাউকে কিছু বলিনি৷’
মন্টু নীচ থেকে উঠে এসেছে৷ সনকা বোধহয় ওকে কিছু বলেছে৷ উদ্বেগভরা গলায় মন্টু জিজ্ঞেস করল, ‘কী শুনচি চাঁদ? সত্যি?’
ঘাড় নেড়ে সোফায় বসে পড়লেন চন্দ্রভানু৷ তার পর বললেন, ‘অহল্যা মায়ের সঙ্গে তুই একবার কথা বল মন্টু৷ আমার মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেছে৷ উফ, বাবা মহাদেব আর কত পরীক্ষা নেবেন, কে জানে?’
সনকা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে৷ কান্না জড়ানো গলাতেই বলল, ‘বাবা মহাদেব নন, বলো মা মনসা৷ ওঁর পুজো কইরলে আমাদের এত বেপদে পড়তে হত না৷’
শুনে দাবড়ে উঠলেন চন্দ্রভানু, ‘ওই নামটা তুমি আমার সামনে আর উচ্চারণ করবে না৷ করলে কিন্তু ভাল হবে না৷ আমার মাথায় আগুন জ্বলছে৷’
মন্টু শান্ত গলায় বলল, ‘তুই থাম দিনি চাঁদ৷ বেপদের সময় মাতা গরম করলে চলে?’
ফোনে অহল্যাকে ধরার চেষ্টা করছে মন্টু৷ কিন্তু লাইন ব্যস্ত বলে পাচ্ছে না৷ মিসড কল দেখে খানিকক্ষণ পরে ফোন করল অহল্যাই৷ বলল, ‘খবরটা আমি পেয়ে গেছি বাবা৷ আপনি টেনশন নেবেন না৷ তেমন হলে আমি পালানের সঙ্গে নিজে কথা বলব৷’
খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো, চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এখন কোথায় মা?’
‘আমি রায়দীঘির কাছাকাছি এসে গেছি বাবা৷ আর মিনিট দশেকের মধ্যে নার্সিং হোমে পৌঁছে যাব৷’
অহল্যার গলায় যতটা ভয় আশা করেছিলেন, তার বিন্দুমাত্র নেই৷ স্বামী কিডন্যাপড হয়েছে, তার লাশ পড়ে যেতে পারে, জানা সত্ত্বেও একটা মেয়ে এ রকম নিরুদ্বেগে থাকতে পারে কী করে? এই প্রজন্মের মেয়েরা কী ধাতু দিয়ে তৈরি? চন্দ্রভানু নিজের মনকেই প্রশ্ন করলেন, ছোট বউমা খবর পেল কার কাছ থেকে? অঘোরের কাছ থেকে নিশ্চয় নয়৷ তা হলে? মেয়েটা বলল বটে, টেনশন নেবেন না৷ কিন্তু, এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে তিনি হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন কী করে? বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা হঠাৎ চন্দ্রভানুর মনে হল, ছোট খোকাকে গুম করার পিছনে ওই শয়তানী মাগীটা নেই তো? পরক্ষণেই ভাবলেন, না না, তা কী করে হবে৷ পালান সর্দারের সঙ্গে তরিতার যোগাযোগ হবে কী করে?
মাথাটা হঠাৎ ঘুরতে শুরু করেছে৷ শরীরটা কেমন যেন ছেড়ে দিচ্ছে৷ কোনও রকমে উঠে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন চন্দ্রভানু৷ চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে আসছে৷ ডাক্তার টেনশন নিতে মানা করেছিলেন৷ কিন্তু ছোটখোকার খবরটা শুনে তিনি শান্ত থাকেন কি করে? তাঁর দুই ছেলেই চরম বিপদে৷ তা হলে গুরুজির সেই ভবিষ্যদ্বাণীই কি ফলতে যাচ্ছে? গুরুজি বলেছিলেন, ‘তুই সন্তানহারা হবি চাঁদ৷ তোর সব ধনসম্পত্তি চলে যাবে৷ তোর পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে এক নারী৷ যত তাড়াতাড়ি পারিস তার সঙ্গে আপোষ করে নে৷’ সেই নারী যে তরিতা, তাতে কোনও সন্দেহ নেই৷ ক্রোধের আগুনে চন্দ্রভানু জ্বলতে শুরু করলেন৷ তরিতার গলা টিপে ধরার জন্য তাঁর হাত নিসপিস করতে লাগল৷
আশ্চর্য, তখনই তিনি বুঝতে পারলেন, নার্সিং হোমের বেডের সামনে কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে৷ চোখ মেলে তাকাতেই চন্দ্রভানু দেখলেন, তরিতা৷ এক নজরেই মেয়েটাকে চিনতে পারলেন তিনি৷ পিচখালি নদীর বুকে জলকেলি করতে দেখা ওই মুখ তিনি ভুলবেন কী করে? গলায় পেঁচানো একটা বিরাট ময়াল সাপ৷ মেয়েটার সাহস দেখে চন্দ্রভানু অবাক হয়ে গেলেন৷ আরে, মরার ইচ্ছে হয়েছে না কি? বাঘের গুহায় ঢুকে ইয়ার্কি মারতে এসেছে! তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি? কী মনে করে?’
‘তোকে একটা খবর শোনাতে এলাম রে চাঁদ৷ কাল দুপুর থেকে তোর বাবাইকে পাওয়া যাচ্ছে না৷’
শুনে বিচলিত হলেন না চন্দ্রভানু৷ কাল সকালেই কলকাতার স্কুল থেকে ফোন করেছিল বাবাই৷ ও জানতে চাইছিল, নার্সিং হোম থেকে কবে ছাড়া পাবেন৷ এরই মধ্যে সে নিখোঁজ হয়ে গেল কী করে? ওদের স্কুলে মারাত্মক কড়াকড়ি৷ লাগোয়া হোস্টেল, যখন তখন হুট করে কেউ বাইরে যেতে পারে না৷ বাড়ির লোকদেরও পার্মিশন নিয়ে দেখা করতে হয়৷ তরিতা শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছে৷ চিৎকার করে তিনি বলে উঠলেন, ‘মিথ্যে কথা৷’
‘ তা হলে খোঁজ নিয়ে দ্যাখ৷ স্কুল থেকে তোর বাবাইকে বেড়াতে নিয়ে গেছিল সল্ট লেকে নিকো পার্ক বলে একটা জায়গায়৷ ফেরার বাসেই না কি ওঠেনি৷ স্কুলে হুলুস্থুল পড়ে গিয়েছে ওকে নিয়ে৷’
চন্দ্রভানু দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ‘তোর কথা বিশ্বাস করি না৷ আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস৷’
‘বিশ্বাস করা বা না করা তোর উপর৷ শোন মূর্খ, তোর বড় ছেলেটার যে ফাঁসি হবে, তাতে আমি নিশ্চিত৷ ছোট ছেলেটার লাশও পড়ল বলে৷ মা মনসার কোপ পড়েছে এ বার বাবাইয়ের উপর৷ তোর বংশে বাতি দেওয়ার লোক থাকবে না৷’
‘পারবি না৷ কিছুতেই আমার ক্ষতি তুই করতে পারবি না৷ শোন মাগী, বয়েস আমার যা-ই হোক না কেন, বংশ বৃদ্ধির ক্ষমতা এখনও আমার মধ্যে রয়েছে৷ আমার বংশ নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না৷’
‘গোয়ার্তুমি করে তোর কোনও লাভ হবে না চাঁদ৷ তোকে ভিখিরি করার আগে আমি একটা সুযোগ দেবো৷ বাসন্তীতে আমি বিরাট করে মা মনসার পুজো করছি৷ সনকা আর অহল্যাকে নিয়ে সেখানে তুই আয়৷ তোর সব দুর্দশা দূর হয়ে যাবে৷’
কী আস্পর্ধা!! মাগী হুমকির সুরে কথা বলছে৷ তুই কে রে আমাকে সুযোগ দেওয়ার? মনে মনে কথাটা আওড়ানোর সঙ্গেসঙ্গে চন্দ্রভানু একটু অবাকও হলেন৷ তরিতা অহল্যাকে চিনল কী করে? হয়তো ওর নামটা কারও মুখে শুনে থাকবে৷ শালী যা নয়, তাই বলে যাচ্ছে৷ বালিশের তলার পিস্তলটা রাখা আছে৷ চট করে সেটা বের করে, পাল্টা হুমকি দেওয়ার সুরে চন্দ্রভানু বললেন, ‘এটা কী, জানিস নিশ্চয়৷ এতে ছ’ছটা গুলি আছে৷ বাঁচতে যদি চাস, এখখুনি চলে যা৷’
পিস্তল দেখে তরিতা মিটিমিটি হাসছে৷ চোখে চোখ রেখে কয়েক সেকেন্ড পর ও বলল, ‘সাপ দেখিয়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস? ওটা হাত থেকে ফেলে দে চাঁদ৷ নইলে এখুনি তোকে কামড়ে দেবে৷’
সাপ! সাপ এল কোত্থেকে? নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রভানু দেখলেন, আরে পিস্তলটা গেল কোথায়? তার বদলে মুঠোয় একটা সাপ ধরে রয়েছেন তিনি৷ সঙ্গেসঙ্গে সাপটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন চন্দ্রভানু৷ মেয়েটা ম্যাজিক জানে বোধহয়৷ ম্যাজিক দেখিয়েই লোকজনকে ভড়কাচ্ছে৷ না, ওকে ছেড়ে দেওয়া যায় না৷ হাতের কাছে রয়েছে স্যালাইনের বোতল৷ সেটা তুলে তরিতার দিকে ছুঁড়ে মারলেন চন্দ্রভানু৷ দেওয়ালে লেগে বোতলটা খানখান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল৷ আর সেই শব্দে বিছানায় উঠে বসলেন তিনি৷ তাকিয়ে দেখলেন, ঘরে অহল্যা আর মন্টু অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে৷ তরিতা কোত্থাও নেই! আরে, এতক্ষণ তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন না কি? কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলেন? এই তো একটু আগে কঙ্কণদীঘিতে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলেন৷ অবসন্নবোধ করায় শুয়ে পড়েন৷
চন্দ্রভানুর তখনই মনে পড়ল, ছোটখোকার কথা৷ বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল৷ অহল্যা কী খবর নিয়ে এল? জিজ্ঞেস করলেন, ‘পালানের সঙ্গে কথা বলতে পারলে না কি ছোট বউমা?’
অহল্যা বলল, ‘বলেছি বাবা৷ আমার সঙ্গে তর্কাতর্কি হয়ে গেল৷ আমি বললাম, একটা পয়সাও আমরা তোমায় পাঠাব না৷ তুমি যা ইচ্ছে, তাই করতে পারো৷’
‘সে কী! না, না৷ কাজটা তুমি ভাল করোনি৷’
‘জয়ব্রত আপনাকে যে চিঠিটা পাঠিয়েছে, সেটা গৌর এনে দিয়েছে বাবা৷ পড়ে বুঝলাম, পালান চট করে কোনও অ্যাকশন নেবে না৷ ওর সম্পর্কে আমি খোঁজখবর নিয়েছি৷ সজনেখালিতে ও চিফ মিনিস্টারের কাছে গিয়েছিল শেল্টারের জন্য৷ উনি কোনও ভরসা দেননি বলে শুনেছি৷ ফলে, পালান এখন নিজেই দ্বিধাদ্বন্ধের মধ্যে রয়েছে৷’
‘কিন্তু ও যদি ছোটখোকার কোনও ক্ষতি করে দেয়…?’
‘দেখিই না কী করে৷ আমার মনে হয় না, লাশ ফেলার মতো ঝুঁকি ও নেবে৷ স্রেফ চমকাচ্ছে৷ ওকে আমি একটা দিন সময় দিয়েছি৷ জয়ব্রতকে যদি ফেরত না পাঠায়, তা হলে পালানের কপালে দুঃখ আছে৷ ওর পার্মানেন্ট ঠিকানা যাতে ভবানী ভবনের লক আপে হয়, তার ব্যবস্থা আমি করে দেব৷’
অহল্যার কথাগুলো এমন জোর দিয়ে বলল, শুনে ভরসা পেলেন চন্দ্রভানু৷ না, মেয়েটার সাহস আছে বটে৷ একেবারে তাঁর ভাষায় কথা বলছে৷ ছোট বউমাকে অ্যাদ্দিন তিনি চিনতে পারেননি কেন, ভেবে আফসোস হতে লাগল চন্দ্রভানুর৷ পারলে ও-ই পারবে তরিতাকে ঢিট করতে৷ তরিতার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই চন্দ্রভানুর হঠাৎ বাবাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল৷ বললেন, ‘একটু আগে একটা আশ্চর্য স্বপ্ন দেখলাম মা৷ তরিতা বলে মেয়েটা স্বপ্নে দেখা দিয়ে আমায় বলল, বাবাই না কি কাল দুপুরে কিডন্যাপড হয়েছে৷’
অহল্যা নির্লিপ্তমুখে বলল, ‘ও সত্যিই উধাও হয়েছিল বাবা৷’
‘কী বলছ তুমি মা?’
‘ঠিকই বলছি৷ খবরটা আমি কাল সন্ধেতেই পেয়েছিলাম৷ স্কুল থেকে ফোন এসেছিল আপনার মোবাইলে৷ প্রিন্সিপ্যালের মুখে খবরটা শুনেও আপনাকে জানাইনি৷ কেননা, জানালে আপনি টেনশনে ভুগতেন৷ তাই সক্কালবেলাতেই আমি বেরিয়ে গেছিলাম৷ ওকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসেছি৷’
‘বাবাই এখন কোথায়?’
‘নীচের লনে ওর ঠাম্মার সঙ্গে খেলা করছে৷’
ঠাম্মা মানে সনকা৷ চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবাইকে তুমি কোথায় খুঁজে পেলে মা?’
‘আর বলবেন না৷ পাগল ছেলে৷ ও যখন নিকো পার্কে অন্য স্টুডেন্টদের সঙ্গে রাইড করছিল, তখন হঠাৎ অঙ্কুশবাবুর সঙ্গে ওর দেখা হয়ে যায়৷ আমি কার কথা বলছি, নিশ্চয় বুঝতে পারছেন৷ হারপেটোলজিস্ট অঙ্কুশ মিত্র৷ সেইসময় ওর এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য অঙ্কুশবাবু না কি নিকো পার্কে গেছিলেন৷ হঠাৎ দু’জনের মধ্যে দেখা হয়ে যায়৷ অঙ্কুশবাবু না কি কবে বাবাইকে কথা দিয়েছিলেন, বাড়িতে নিয়ে গিয়ে অনেক ধরনের সাপ দেখাবেন৷ নিকো পার্কে বাবাই জেদ ধরে বসে, দেখাতেই হবে৷ অঙ্কুশবাবুও ছেলেমানুষের মতো ওকে নিয়ে দয়াপুরে নিয়ে যান৷ রাতে বাবাই কাউকে ফোন করতে সাহস পায়নি৷ আমাকে জানায়, কী অন্যায় করেছে৷ আমি আজ দয়াপুরে গিয়ে ওকে নিয়ে এলাম৷’
মন্টু এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল৷ এ বার বলল, ‘আমায় একন বল দিনি চাঁদ, মা তরিতা খপরটা পেলেন কী করে? তোকে আমি আগেও কয়েচি, ওনার মধ্যে অলৌকিক ক্ষমতা আচে৷ তুই বিশ্বেস কইরতে চাসনে৷ এ বার কি কইবি?’
চন্দ্রভানু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তুই থামবি৷ ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে৷’
অহল্যা বলল, ‘না বাবা, এতটা তাচ্ছিল্য করবেন না৷ আমারও মনে হয়, ভদ্রমহিলার মধ্যে সত্যিই একটা আলাদা ক্ষমতা আছে৷ শুনলাম, চিফ মিনিস্টারের মতো স্ট্রং পার্সোনালিটির লোককেও উনি বশ করে ফেলেছেন৷ হতে পারে, সত্যিই মা মনসার ভড় হয় ওঁর উপর৷ ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে হচ্ছে৷ মন্টুকাকা, আপনাকে বলে রাখলাম, উনি যদি কাছাকাছি কোথাও আসেন, তা হলে আমাকে একবার নিয়ে যাবেন? আমি সামনে থেকে ওঁকে জাজ করতে চাই৷’
কথাটা চন্দ্রভানুর মনঃপূত হল না৷ তিনি বললেন, ‘তুমি কেন ওর কাছে যাবে মা? যে মেয়েটা আমার এত ক্ষতি করে যাচ্ছে, আগ বাড়িয়ে তার সঙ্গে তুমি দেখা করতে যাবে কেন?’
অহল্যা খুব শান্ত গলায় বলল, ‘আমার ধারণা আপনার সঙ্গে মিলবে না বাবা৷ আমার মতটা একেবারে উল্টো৷ আমার পলিটিশিয়ান বাবার কাছে আমি একটা জিনিস শিখেছি, যারা বিরোধী , তাদের দূরে সরিয়ে রাখাটা ভুল কনসেপ্ট৷ বাবা বলেন, শত্রুতা কখনও জিইয়ে রেখো না৷ চিরদিন কেউ কারও শত্রু থাকতে পারে না৷ কাকে কখন তোমার কাজে লাগবে, তুমি নিজেও জানো না৷ শত্রুদের নিজের ক্যাম্পে টেনে আনাটাই একরকম ভিক্টরি৷’
মন্টু সায় দিল, ‘ছোট বউমা ঠিক কইচে৷’
ছোট বউমা আরও কী বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় নার্সিং হোমের একজন স্টাফ এসে বলল, ‘স্যার, অমর মণ্ডল বলে একজন এসেছেন৷ পাঠিয়ে দেবো?’
অমর মণ্ডল নার্সিং হোমে দেখা করতে এসেছে! শুনে মাথায় দপ করে রাগ চড়ে গেল চন্দ্রভানুর৷ আবার কী ক্ষতি করার মতলব নিয়ে এসেছে, কে জানে? তিনি বললেন, ‘না না, ব্যাটাচ্ছেলেকে আমার কাছে পাঠাবেন না৷’
অহল্যা বলে উঠল, ‘ভদ্রলোক কে, আপনার কী ক্ষতি করেছেন… আমি জানি না৷ তবুও বলছি, আমার মতে অমরবাবুকে আসতে দেওয়া উচিত৷ শোনাই যাক না, কী বলতে চান?’
অহল্যা যা বলে, ভেবে-চিন্তে বলে৷ চন্দ্রভানু তাই চুপ করে গেলেন৷ মন্টু সায় দিল, ‘আমিও বলি, আসুগ না৷ দাঁড়া, আমি নীচেগে, ওকে নে আসচি৷’
মন্টু লাফিয়ে উঠে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল৷ ওর ব্যস্ততা দেখে চন্দ্রভানু বললেন, ‘তুমি জানো না ছোট বউমা, এই অমর মণ্ডল এই বাঁদাবনে আমার নামে কী দুর্নাম ছড়াচ্ছে৷ এই যে এবার চিফ মিনিস্টার আমাকে এত ইগনোর করে গেলেন, তার মূল কারণ, এই বদমাসটা৷ ওঁর কান ভাঙিয়েছে৷ জানো মা, এই লোকটাই এখন তরিতার রাইট হ্যান্ড৷’
থামিয়ে দিয়ে অহল্যা বলল, ‘আপনি এত এক্সাইটেড হবেন না বাবা৷ দেখুনই না, লোকটাকে আমি কীভাবে হ্যান্ডেল করি৷’
‘আমার মন মেজাজ ভাল নেই ছোট বউমা৷ ছোটখোকাটার এই অবস্থা৷ আবার কী দুঃসংবাদ শোনাতে আসছে অমর মণ্ডল, কে জানে?’
অহল্যা খুব শান্ত গলায় বলল, ‘দুঃসংবাদই যে উনি দিতে আসছেন, আপনি জানলেন কী করে? আপনি কোনও কথা বলবেন না বাবা৷ শুধু চুপচাপ শুনে যাবেন, কেমন?’
ইদানীং অহল্যার কথা উড়িয়ে দিতে পারছেন না চন্দ্রভানু৷ ওকে বলেই দিয়েছেন, তরিতাকে শায়েস্তা করতে না পারলে তিনি শান্তি পাবেন না৷ আর এই শায়েস্তা করার কাজটা অহল্যা করবে বলেছে৷ এই নার্সিং হোমে বসেই সেদিন কথা হচ্ছিল৷ ও জানতে চেয়েছিল, এত টেনশনের কারখটা কী? চন্দ্রভানু খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন৷ মেয়েটা খুব বেশি কথা বলে না৷ ওর মুখ দেখে বোঝাও যায় না, মনে মনে কী ভাবছে৷ সব শুনে অহল্যা শুধু বলেছিল, ‘বাবা, আপনি খুব লাকি৷ ছেলে আর ছেলের বউ মিলিয়ে আপনার চার-চারটে বাড়তি হাত৷ ছেলেরা সবাই বাধ্য৷ বউমারা সবাই আপনার মেয়ের মতো৷ আমাদের চারজনের উপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দিন৷ দেখবেন, হতাশ হবেন না৷’
পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে মন্টু বলল, ‘এই দ্যাক চাঁদ, অমরদা তোর জন্য কী নিইয়ে এয়েচে৷’
অমর মণ্ডলের হাতে ফুলের তোড়াটা দেখে চন্দ্রভানু একটু অবাকই হলেন৷ অর্কিডের তোড়া, রঙিন ফিতে দিয়ে সাজানো৷ জাপানে ফুলের দোকানে এ রকম তোড়া অনেক দেখেছেন৷ এর অনেক দাম৷ কলকাতার নিউ মার্কেট ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না৷ বিজনেসের ব্যাপারে জাপান থেকে যাঁরা আসতেন, তাঁদের জন্য কিনে আনত জয়গোপাল৷ রায়দীঘিতে ফুলের এই তোড়া অমর মণ্ডল পেল কী করে? এ সব কথা ভাবার মাঝেই এগিয়ে এসে অমর মণ্ডল বলল, ‘চিফ মিনিস্টারের কানে গেছে, আপনি নার্সিং হোমে৷ তাই আপনার আরোগ্য কামনা করে উনি আমাকে পাঠালেন৷ এই নিন দাদা, উনি আপনাকে একটা চিঠিও দিয়েছেন৷’ কথাগুলো বলে একটা খামও এগিয়ে দিল সে৷
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না চন্দ্রভানু৷ চিফ মিনিস্টার পাঠিয়েছেন! এই তো ক’দিন আগে উনি এমন ভাব করে গেলেন, পার্টিতে তাঁর কোনও জায়গা নেই৷ মাঝে এই ক’দিনে এমন কী ঘটল, উনি পুরো বদলে গেলেন? চিঠিটা হাতে নিয়ে অহল্যা চোখ বোলাচ্ছে৷ পড়া শেষ করে হাসিমুখে বলল, ‘থ্যাঙ্কস অমরবাবু৷ আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই৷ আমি অহল্যা৷ চন্দ্রভানুবাবুর ছোট বউমা৷ ধন্যবাদ জানিয়ে আমরাও সিএম-কে একটা চিঠি দিতে চাই৷ কার হাতে পাঠাব?’
অমর মণ্ডল বলল, ‘মহেশপুরে আমার অফিসে পাঠিয়ে দিও মা৷ আমি নবান্নতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করব৷ খুব ভাল লাগল মা তোমার কথা শুনে৷’
কথাগুলো বলে অমর মণ্ডল উঠে দাঁড়ালেন৷ চিফ মিনিস্টার কী চাল দিচ্ছেন, চন্দ্রভানু বুঝতে পারলেন না৷ একদিকে, ফুলের তোড়া পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন৷ অন্যদিকে, তরিতাকে নমিনেশন দেওয়ার খবরটা চাউর করে দিয়ে , উনি বুঝিয়ে দিতে চান, ইলেকশনে দাঁড়ানোর কথা স্বপ্নেও ভেবো না৷ তা হলে কি চিফ মিনিস্টার জেনে গেছেন, এ বার ইলেকেশনে তিনি ক্যান্ডিডেট হতে চান? ঝন্টু কয়াল ছাড়া আর কাউকেই মনের ইচ্ছে চন্দ্রভানু জানাননি৷ শুয়োরটা নিশ্চয়ই গাবিয়ে বেরিয়েছে৷
‘আচ্ছা দাদা, আজ তা হলে আসি৷’ কথাটা বলে দরজার দিকে এক পা বাড়িয়ে তার পর পিছন ঘুরে অমর মণ্ডল বললেন, ‘আমার কিন্তু একটা আব্দার আছে, বলি৷’
অহল্যা জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপারে বলুন না?’
‘ডিসেম্বরে মা তরিতা ওঁর এভিএস ইউনিটটা ইনাগোরেট করতে চান৷ সেদিন যদি দাদা দয়াপুরে পায়ের ধুলো দেন, তা হলে আমরা খুব খুশি হবো৷ সিএম আসবেন বলে দিয়েছেন৷ মাস আড়াই আগেই আপনাকে বলে রাখলাম, তখন কিন্তু দাদা না করতে পারবেন না৷’
মন্টু খুশি হয়ে বলল, ‘সে তো খুব ভাল কতা অমরদা৷ আমি কইচি, চাঁদ সেদিন যাবে৷’
মন্টুর দিকে কড়া চোখে তাকালেন চন্দ্রভানু৷ তাঁর হয়ে কথা দেওয়ার অধিকার মন্টুকে কে দিয়েছে? নাহ, মন্টু বড্ড বেশি নাক গলাচ্ছে৷ মন্টুকে আজই তিনি দাবড়ানি দেবেন৷ তাতে যদি পঁয়তাল্লিশ বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়, তাতে কিছু আসে-যায় না৷
(একান্ন)
কাল রাত থেকে মিঃ স্তেফান এডবেরির সঙ্গে চ্যাট করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তরিতা৷ কিন্তু কিছুতেই পাচ্ছেন না৷ আজ বেলা দশটার সময় ল্যাপটপ খুলে তিনি দেখতে পেলেন, এডবেরি পিং করেছেন৷ মায়ামিতে এখন অনেক রাত৷ তরিতা ঠাট্টা করে লিখলেন, ‘আজকাল ইনসোমনিয়াতে ভুগছেন না কি?’
ও প্রান্ত থেকে এডবেরি লিখলেন, ‘হা হা হা… আমার হাতে এখন এত কাজ যে, পৃথিবীটা যদি আরও স্লো সূর্যের চারপাশে ঘুরত, দিনটা তিরিশ ঘণ্টার হত, তা হয়তো ঘুমোনোর জন্য খানিকটা সময় বের করতে পারতাম৷’
‘আপনার জন্য হয়তো মঙ্গল গ্রহটাই সঠিক জায়গা৷’
‘না ডিয়ার, ওখানে সাপের অস্তিত্ব আছে কি না, এখনও আমরা জানি না৷ আর আপনি তো জানেনই, সাপ ছাড়া আমি নিজে আমার অস্তিত্ব কখনও কখনও টের পাই না৷ যাক গে, একটা সুখবর দেওয়ার জন্য আপনাকে পিং করেছিলাম৷’
‘চিন কি আমাদের প্রোডাক্ট নিতে রাজি হয়ে গেছে?’
‘আরে না না৷ আপনার রেকর্ডটা অক্ষুণ্ণ রয়ে গেল স্নেক লেডি৷ আপনার রেকর্ডটা সামান্থা জেনকিন্স ভাঙতে পারলেন না৷’
দেখে হাসলেন তরিতা৷ আমেরিকায় মায়ামির সার্পেন্টেরিয়ামে সাপেদের ঘরে একশো দশদিন কাটিয়ে একটা রেকর্ড করে এসেছিলেন তিনি৷ সেটা ভাঙার চেষ্টা করেছিল সামান্থা বলে একটা মেয়ে৷ তাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘সামান্থা পারল না কেন?’
‘বলা হচ্ছে বটে, জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ার জন্য৷ কিন্তু আসল কারণটা তা নয়৷ ভিতরের খবর, রেটিং কম হওয়ার জন্য টিভি চ্যানেলই শো বন্ধ করে দিয়েছে৷ সবাই তো আপনার মতো চার্মিং নয়৷’
‘ইস, মেয়েটার জন্য আমার খারাপ লাগছে৷’
‘আর আমার ভাল লাগল শুনে যে, আপনার এভিএস ইউনিটের কাজ মসৃণভাবে চলছে৷’
শুনে তরিতা একটু অবাকই হয়ে জানতে চাইলেন, ‘কার কাছ থেকে জানলেন?’
‘মিঃ কল্যাণ দাশগুপ্ত বলে একজনের কাছ থেকে৷ রিসেন্টলি মায়ামিতে বামপন্থী পার্টিদের বিশ্ব সম্মেলন হয়ে গেল৷ ইন্ডিয়াকে রিপ্রেজেন্ট করতে এসেছিলেন মিঃ দাশগুপ্ত৷ আমার এক ভারতীয় বন্ধুর বাড়িতে ওর সঙ্গে আলাপ হল৷ ওখানেই আড্ডা মারার সময় উনি আমায় আপনার কথা বললেন৷’
কল্যাণ দাশগুপ্ত… মানে অহল্যার বাবা৷ অহল্যা আজকাল প্রায়ই পাখিরালায় আসছে৷ অথচ জানায়নি, ওর বাবা মায়ামি গিয়েছিলেন৷ জানালে মিঃ এডবেরির জন্য কয়েকটা সিল্কের পাঞ্জাবি উপহার পাঠাতে পারতেন তরিতা৷ তিনি জানেন, সিল্কের তৈরি পোশাক এডবেরি খুব পছন্দ করেন৷ তরিতা চটপট লিখলেন, ‘মিঃ দাশগুপ্ত ঠিকই বলেছেন৷ ডিসেম্বরেই ইউনিট চালু করে দিচ্ছি৷ একটা কথা আপনাকে আগে জানানো হয়নি৷ রিসেন্টলি আমি জানতে পারলাম, হাজার বছর আগে আমাদের এখানে সাপের বিষ দিয়ে কিছু ওষুধ তৈরি হত৷ সেটা ভেষজ পদার্থ মিশিয়ে৷ সেই ওষুধ না কি ইউরোপেও যেত৷’
‘ভেরি ইন্টারেস্টিং তরিতা৷ হ্যাঁ,হ্যাঁ, ভারতের প্রাচীন আয়ুর্বেদ চিকিৎসা শাস্ত্রের কথা আমি টয়েনবির লেখায় পড়েছি৷ আপনি শিগগির আমাকে বিশদ জানান৷ এখনকার পৃথিবীতে প্রান্তিক মানুষদের জন্য ভেষজ ওষুধ খুবই প্রয়োজন৷ দামে সস্তা হবে৷ সেইসঙ্গে শরীরের পক্ষে কম ক্ষতিকারকও৷’
‘আমি একজন আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞের সন্ধানে আছি৷ পেলে আপনাকে সঙ্গেসঙ্গে জানাব৷’
‘প্লিজ জানাবেন৷ আর হ্যাঁ, ইউনেস্কো থেকে একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ আপনার ওখানে যেতে চান৷ উনি ব্রাজিলের লোক৷ শুনেছেন, আপনি যেখানে ইউনিটটা করছেন, সেখানে না কি রয়াল বেঙ্গল টাইগার ঘুরে বেড়ায়? টাইগার দেখতে তো যাবেনই, সেইসঙ্গে আপনার ইউনিটের প্রোগ্রেসও দেখে এসে উনি আমাদের রিপোর্ট দিতে পারবেন৷ কবে পাঠানো যায়, বলবেন?’
‘এনি টাইম৷ উইন্টার ইজ বেটার৷’
‘ও কে তরিতা৷ হ্যাভ আ নাইস ডে৷’
‘গুড নাইট৷’ বলে তরিতা ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলেন৷ তিনি নিশ্চিন্ত, যাক… বিষহরি মায়ের বিষহরণ ওষুধের কথা অবশেষে মিঃ এডবেরিকে জানাতে পারলেন৷
ঘরের বাইরে বেরিয়ে তরিতা দেখলেন, ঝকঝকে রোদ্দূর উঠেছে৷ দূরে কোথাও থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে৷ বেশ কয়েকদিন হল, এই মিস্টি আওয়াজটা তিনি পাচ্ছেন৷ ভেবেছিলেন, কোথাও পুজো- টুজো কিছু হচ্ছে৷ কিন্তু গোলাপি জানাল, খাক বাজানোর মহড়া চলছে গাঁয়ের বাড়িতে বাড়িতে৷ কালী পুজোর সময় এই অঞ্চল থেকে ঢাকিরা কলকাতায় রোজগার করতে যায়৷ তার আগে কয়েকদিন বাড়িতে মকশো করে নেয়৷ দিল্লি আর আমেরিকায় থাকার জন্য বহুবছর কালীপুজো দেখার সুযোগ পাননি তরিতা৷ মাঝে গোলাপি এসে বলছিল, দয়াপুর বাজারের কাছে বড় করে পুজো হয়৷ সেখানে চাঁদা দিতে হবে৷ তরিতার ইচ্ছে, পুজোর সময় দু’দিন দয়াপুরে ‘মনসা ভবন’-এ গিয়ে থাকবেন৷ যাতে পুজো দেখতে পারেন৷
এডবেরির সঙ্গে চ্যাট করতে বসার জন্য ব্রেকফাস্ট করা হয়নি৷ তরিতা ডাইনিং হলের দিকে যাওয়ার কথা ভাবছেন, এমন সময় নেত্রা এসে বলল, ‘দিদি, খেয়াঘাট থেকে অহল্যা ফোন করেছিল৷ বলল, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এখানে এসে যাবে৷ তুমি কি ব্রেকফাস্ট করে নেবে? না কি ওর সঙ্গে করবে?’
তরিতা বললেন, ‘ও আসুক৷ একসঙ্গে করা যাবে৷’
‘অহল্যা বলল, দিল্লির আয়ুর্বেদ রিসার্চ সেন্টারের সঙ্গে কথা বলেছিল৷ ওরা না কি বলেছে, সাপের বিষ থেকে ভেষজ ওষুধ তৈরি সম্পর্কে একটা রিসার্চ পেপার ওদের কাছে আছে৷ ওদের ওয়েবসাইটে সেটা পাওয়া যাবে৷’
‘তা হলে তো খুবই ভাল কথা৷ অহল্যাকে বলতে হবে, যাতে একটা প্রিন্ট আউট বের করে আমাকে দেয়৷ হ্যাঁ রে, আয়ুর্বেদাচার্য বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রীর খোঁজ পাওয়া গেল?’
‘অহল্যাকে জিজ্ঞেস করিনি৷ ও এলে তুমি না হয় জিজ্ঞেস করে নিও৷’
‘কাল বিকেল থেকে গোলাপির পাত্তা নেই কেন রে?’
‘গোলাপির গায়ে জ্বর দেখে এলাম৷ ঘরে শুয়ে আছে৷ বিয়ের পর দয়াপুর থেকে ফিরে এল৷ তার পর থেকে দেখছি, ওর শরীরটা খারাপ৷ সিজন চেঞ্জের সময় তো৷ জ্বর বাঁধিয়ে বসেছে৷ বলাই গোসাবা থেকে ডাক্তার ডেকে আনতে গেছে৷ ওকে নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না৷’
শুনে বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে এলেন তরিতা৷ মনসা ঢিবির স্মৃতি মাথায় নিয়ে৷ জীবনে তিন-তিনবার মা মনসার দর্শন পেলেন তরিতা৷ এমন সৌভাগ্য ক’জনের হয়? প্রথমবার দেখেছিলেন, এই বাঁদাবনেই কোনও এক নদীর খাঁড়িতে৷ গুরুমাদের সঙ্গে লঞ্চে করে আশ্রমের ওরা কয়েকজন সাইটসিয়িং করতে গিয়েছিলেন৷ লঞ্চের ইঞ্জিন খারাপ হয়ে গেছিল সেই রাতে৷ দ্বিতীয়বার মাকে তিনি দেখেন সাগরদ্বীপের আশ্রমে থাকার সময়৷ উমা মায়ের অত্যাচার তখন তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না৷ স্বপ্নে দেখা দিয়ে মা মনসা তাঁকে অভয় দিয়েছিলেন৷ আর শেষবার দেখলেন, এই সেদিন মনসা ঢিবিতে৷ তিনবারই মায়ের আলাদা আলাদা রূপ৷ কথাটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তরিতার৷
বিষহরির মন্দিরে তাঁকে দেখামাত্রই মা মনসা বলেন, ‘তরিতা আয়, আমি তোর জন্যই অপেক্ষা করে আছি৷’
শুনে সাষ্টাঙ্গে প্রখাম করেছিলেন তরিতা৷ সঙ্গেসঙ্গে চোখ বুঁজে মনসাস্তব শুরু করেন৷ মাথায় হাত দিয়ে মা মনসা তখন বলেন, ‘তোর মঙ্গল হোক মা৷ নাগ জাতিকে রক্ষা করার জন্য তুই যা করলি, তাতে তোর কোনও ইচ্ছেই অপূর্ণ থাকবে না তরিতা৷’
হাতজোড় করে তরিতা বলেছিলেন, ‘আমি তো আপনারই আদেশ পালন করেছি মা৷’
‘তোর জন্য আর একটা আদেশ আছে তরিতা৷ সাগরদ্বীপে মহেশ্বরজির আশ্রমে, শিবের মন্দিরের পাশেই আমার একটা বড় মন্দির বানাবি তুই৷ লোকে আমায় পুজো করে ফণী মনসা ঝোপের পাশে, সিজ ডালের নীচে, উঠোনে, ঘরে ঘরে৷ মন্দিরে আমার অধিষ্ঠান খুবই কম৷ এই দায়িত্বটাই তোকে নিতে হবে৷’
‘কিন্তু, সাগরদ্বীপের আশ্রমে আমি মন্দির প্রতিষ্ঠা করব কী করে মা?’
‘তোর সৎমা উমা আজ খানিক আগে দেহ রাখলেন৷ খবরটা তুই দয়াপুরে ফিরে গিয়ে পাবি তরিতা৷ খুব শিগগির মহেশ্বর বিবাগী হয়ে কনখলের আশ্রমে চলে যাবে৷ সাগরদ্বীপে আশ্রমটা তোর হাতে দিয়ে যাবে৷ তোর হাতে এখন অনেক কাজ মা৷’
‘আশীর্বাদ করুন মা, মানুষের ভালর জন্য যাতে কিছু করে যেতে পারি৷’
‘আমার আশীর্বাদের হাত সবসময় তোর মাথায় থাকবে তরিতা৷ শোন, তোকে কিছু বলার আছে৷ প্রতিশোধ স্পৃহা মানুষকেই নয়, দেবদেবীকেও অপ্রিয় করে তোলে৷ জেদাজেদি করতে গিয়ে একটা সময় চাঁদের প্রতি আমি খুব অন্যায় করেছিলাম৷ লোকে আমাকে কুটিলা বলে অসম্মানও করেছে৷ কিন্তু, চাঁদ পুজো না করলে মর্ত্যে আমার পুজোর প্রচলন হত না৷ তোর ক্ষেত্রেও তাই৷ চন্দ্রভানু যতদিন তোর বিরোধিতা করবে , ততদিন কিন্তু তুই মানুষের ভালর জন্য কোনও কিছু করতে পারবি না৷’
‘আমাকে কী করতে হবে মা?’
‘তোকে কিছু করতে হবে না৷ যে করবে, সে তোর আশপাশেই আছে৷’
‘কার কথা বলছেন, অহল্যা?’
‘চাঁদ সওদাগরের সঙ্গে আমার বিরোধ মিটিয়ে দিয়েছিল ওর পুত্রবধূ বেহুলা৷ তোর সঙ্গেও চন্দ্রভানুর সম্পর্ক ভাল করে দেবে ওর পুত্রবধূ অহল্যা৷ এটাই ভবিতব্য৷ তোর মনে থাকে যেন৷’
‘মনে থাকবে মা৷’
‘ আর শোন, এখানে তোদের থাকার মেয়াদ শেষ৷ একটু পরেই এই ঢিবির আশপাশটা শ্বাপদসঙ্কুল হয়ে যাবে৷ তোরা তাড়াতাড়ি লঞ্চে ফিরে যা৷ লঞ্চে ওঠার আগে পর্যন্ত কেউ পিছন ফিরে তাকাবি না৷’
শুনে নেত্রাকে নিয়ে দ্রুত মন্দির থেকে নেমে এসেছিলেন তরিতা৷ জাহাজঘাটা পৌঁছনো পর্যন্ত আর পিছন ফিরে তাকাননি৷ লঞ্চে ওঠার পরই ঢিবির দিকে তাকিয়ে ওঁরা দেখেন, সেখানে ঘন অন্ধকার৷ পূর্ণিমার চাঁদ কালো মেঘে খাকা পড়ে গেছে৷ জাহাজঘাটা থেকে লোকজন সব উধাও৷ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জাহাজগুলোকে আর দেখা যাচ্ছে না৷ আশপাশে জঙ্গল থেকে বাঘের ডাক ভেসে আসছে৷ পারের কাছে আগুনের ভাঁটার মতো গোল গোল অশরীরী কিছু দেখা যাচ্ছে৷ আকাশ চিরে উড়ন্ত পাখির কর্কশ ডাক শুনে গা হিম হয়ে গেছিল সবার৷ অশনিসংকেত বুঝে সারেঙ হিমাংশু দ্রুত ইঞ্জিন চালু করে দিয়েছিল৷
… দরজায় টকটক শব্দ৷ দরজা খুলে অহল্যাকে দেখে তরিতা হাসিমুখে বললেন, ‘আয়, ভেতরে আয়৷ তোর জন্যই ব্রেকফাস্ট না করে আমি বসে আছি৷ কঙ্কণদীঘির খবর কি, বল?’
জুতো খুলে বাইরে রেখে অহল্যা ঘরের ভিতর ঢুকে এল৷ পায়ে হাত দিয়ে প্রখাম করে বলল, ‘দিদি, আর না৷ মানুষটার যা হাল হয়েছে, তা চোখে দেখা যায় না৷’
মানুষটা… মানে চন্দ্রভানুর কথা বলছে৷ শুনে তরিতা বললেন, ‘ ভাঙবে, তবু মচকাবে না৷ এই শোন , সেদিন নার্সিং হোমে চন্দ্রভানু বুঝতে পারেনি তো, তোর সঙ্গে অমরবাবুর আগে থেকেই আলাপ ছিল?’
‘না দিদি৷ তবে, চিফ মিনিস্টারের নাম করে আপনি যে ফুলের তোড়াটা পাঠিয়েছিলেন, সেটা কিন্তু কাজে লেগেছে৷ পরে আমি আর মন্টুকাকা মিলে ওঁকে অনেক বুঝিয়েছি৷ দুই ছেলের শোকে এখন ওঁর পাগল হওয়ার মতো অবস্থা৷ আমি বলি কী, এ বার ছেলে দু’টোকে আপনি ফিরিয়ে দিন৷’
‘কী মুশকিল, একজন জেলে, অন্যজন ডাকাতের পাল্লায়৷ আমার কী রোল তাতে?’
‘আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবেন না দিদি৷ আমি ইনভেস্টিগেট করেছি৷ আপনি ভয় দেখিয়েছেন বলেই না রমজান পুলিশের কাছে স্টেটমেন্ট দিয়েছে, জয়গোপালদার কথায় ও রামলিঙ্গমকে খুন করেছে৷ রমজানের বউয়ের কাছে আপনিই তো খবর পঠিয়েছিলেন, কথা না শুনলে সাপ পাঠিয়ে নির্বংশ করে দেবেন৷ সত্যি কি না বলুন? রমজানের স্টেটমেন্ট অবশ্য ধোপে টিঁকবে না৷ শুধু ভোগান্তি হবে জয়গোপালদার৷ বাড়তি কিছুদিন ওঁকে জেলের ভিতর থাকতে হবে৷’
‘আরেববাস, তুই তো দেখছি, অনেক খবর রাখিস৷’
‘আমার জয়ব্রত কী অন্যায়টা করল, বলুন তো? অঙ্কুশের কাছ থেকে ফোন নাম্বারটা নিয়ে নেত্রাদি যে পালান সর্দারকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছিল, আমি তা জানি দিদি৷ ইদানীং ও জেল খাটার ভয়ে জলডাকাতি ছেড়ে দিয়েছিল৷ কিন্তু, নেত্রাদির কথাতেই জয়ব্রতকে সেদিন পালান কিডন্যাপ করে৷ বোকাটা জানে না, আগেকার মতো দিন আর নেই৷ যেন কোথাও লুকিয়ে থাকলে ওকে আর ধরা যাবে না! আরে, জয়ব্রতর কাছে স্মার্ট ফোন আছে৷ জিপিএস মারফত আমি জেনেও গেছি, পালান সর্দার সাতটা ট্রলার কোথায় লুকিয়ে রেখেছে৷ শ্বশুরমশাইকে আমি অবশ্য কিছু জানাইনি৷ কিন্তু পুলিশকে জানিয়ে দিলে পালানের কপালে দুঃখ আছে৷ পুলিশ রেইড করলে খুনখারাপি হবে৷ নদীর জলে কয়েকটা লাশ ভাসবে৷ সেটা আমি চাই না৷ দিদি আপনি, আমার সামনেই পালানকে ফোন করে বলবেন, জয়ব্রতকে যেন আজই ছেড়ে দেয়৷ আমি শ্বশুরমশাইকে কথা দিয়ে এসেছি, যে করেই হোক, জয়ব্রতকে আজ-কালের মধ্যে ফিরিয়ে আনব৷’
মা মনসার কথা মনে পড়ছে তরিতার৷ এই অহল্যাই না কি মিডিয়েটরের কাজ করবে৷ তাই প্রশ্রয়ের সুরে তিনি বললেন, ‘তুই যে আমার কাছে আসিস, তোর সঙ্গে যে আমার অনেক দিনের পরিচয়, চন্দ্রভানু সেটা জানে?’
‘না দিদি, উনি জানেন না৷ বলে মরি আর কী৷ জয়ব্রতর সঙ্গে আমার বিয়েটা উনি অনেকদিন পর্যন্ত মেনে নিতে পারেননি৷ কেননা, প্রেমের বিয়ে৷ সেই কারণে এতদিন আমাকে দূরে দূরেই রেখেছিলেন৷ কেন জানি না, ইদানীং উনি আমার উপর খানিকটা সদয় হয়েছেন৷’
সদয় তো হবেনই৷ মা মনসা যে তাই চান৷ তরিতা বললেন, ‘বেশ, তোর কথা যদি আমি মেনে নিই, তা হলে আমার কী লাভ হবে?’
‘আমেরিকা থেকে এখানে কি আপনি সওদা করতে এসেছেন, না মানুষের কল্যাণ করতে? লাভ-ক্ষতির কথা আসছে কেন দিদি? আপনি পালান সর্দারকে কাজে লাগিয়েছেন ভেবে নিয়ে আমার শ্বশুরমশাই অলরেডি লক্ষণ সর্দারের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা ভাবছেন৷ বাঁদাবনে পালানের রাইভাল হল এই লক্ষণ৷ সে আরও ডেঞ্জারাস ডাকাত৷ বালি দ্বীপে থাকে৷ পাখিরালা থেকে হ্যান্ডশেকিং ডিসট্যান্স৷ আপনার এখানে তো সিকিউরিটি বলে কিছুই নেই৷ যে কোনওদিন আপনাদের বিপদে ফেলে দিতে পারে সে৷’
‘শ্বশুরমশাইয়ের হয়ে তুই কি আমায় ভয় দেখাচ্ছিস অহল্যা?’
‘আমায় ভুল বুঝবেন না দিদি৷ আপনাদের লড়াইটা এখানেই থামিয়ে দিন৷ তা হলে দু’জনের পক্ষেই মঙ্গল৷ না হলে আমাকে চিফ মিনিস্টারের দ্বারস্থ হতে হবে৷ আপনি বোধহয় জানেন না, এককালে আমার বাবার সঙ্গে এখানকার চিফ মিনিস্টারের সম্পর্কটা খুব সুন্দর ছিল৷ সজনেখালিতে সিএমকে অবশ্য আমি আমার পরিচয়টা দিইনি৷ তবে তা দিতে হতে পারে, যদি শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে আপনার বিরোধটা না থামে৷’
‘তুই কি জানিস, ওঁর উপর আমার কেন এত রাগ?’
‘জানতে চাই না দিদি৷ এটুকু জানি, লড়াইটা আপনিই শুরু করেছিলেন৷ আপনার কি কোনও দরকার ছিল, সোনাখালিতে ওঁর ফার্ম হাউসে নদীর লোনা জল ঢুকিয়ে দেওয়ার? কাজটা আপনি যাকে দিয়ে করিয়েছিলেন, তার নামটাও আমি জানি৷ সুকুর আলি৷ সে নিজে আমার কাছে তা স্বীকার করেছে৷ আচ্ছা, শ্বশুরমশাইয়ের ওই ফার্ম হাউসটা তো আপনিও কাজে লাগাতে পারেন দিদি৷ ফার্ম হাউসে দুমূর্ল্য সব গাছগাছড়া আছে৷ আপনি যদি সাপের বিষ আর ভেষজ মিশিয়ে নতুন ওষুধ তৈরির প্রোজেক্ট নেন, তা হলে স্বচ্ছন্দে আমাদের ফার্ম হাউসটা কাজে লাগাতে পারেন৷ ওটা দেখাশুনা করে জয়ব্রত৷ ফার্ম হাউসে কী কী গাছ আছে, তা নিয়ে একটা বুকলেট আমি ওকে তৈরি করে দিয়েছিলাম৷ চান তো, এনে দেখাতে পারি৷ আমার বিশ্বাস, বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী ওষুধ তৈরির জন্য যে গাছের কথা বলবেন, সেটা আমাদের ফার্ম হাউসে আছে৷ ’
আরে বাঃ, কথাটা তো মন্দ বলেনি অহল্যা৷ তবুও ওকে বাজিয়ে দেখার জন্য তরিতা বললেন, ‘তুই কি জানিস, চন্দ্রভানু আমার কী ক্ষতি করেছে? এভিএস ইউনিটের প্রোডাকশন অ্যাদ্দিনে চালু হয়ে যেত, চন্দ্রভানু বাগড়া না দিলে৷ ওর ভয়ে কেউ আমাদের জমি দিতে চায়নি৷’
‘অতীতের কথা ছাড়ুন না দিদি৷ আগামী দিনের কথা ভাবুন৷ শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে যদি আপনার ঝামেলাটা মিটে যায়, তা হলে আপনার একটা লাভ হবে মনে হয়৷ পার্লামেন্ট ইলেকশনে আপনি দাঁড়ালে আমি চিফ এজেন্ট-এর কাজটা আমি করে দিতে পারব৷ সেইসঙ্গে পাবলিসিটি দেখার কাজটাও৷ বাবার হয়ে আমি দু’বার এই কাজটা আমি করেছি৷ আমার অভিজ্ঞতা আছে৷’
মেয়েটা তো অনেকদূর ভাবে৷ তরিতা মনে মনে প্রশংসা করলেন অহল্যার৷ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি শুনেছি, চন্দ্রভানুরও না কি ইচ্ছে ছিল, এবার ইলেকশনে দাঁড়ানোর? ঝন্টু কয়াল সেদিন আমায় বলে গেল, আমি যাতে জিততে না পারি, সেজন্য লোকবল নিয়ে না কি ও তৈরি থাকবে? আচ্ছা, খবরটা শোনার পর, আমার উপর ওঁর রাগ হয়নি?’
‘ঝন্টু কয়ালদের কথা বিশ্বাস করবেন না দিদি৷ এরা হল উলুখাগড়া৷ দেখবেন, আপনাকে বলতে আসবে, আপনার চিফ এজেন্ট হতে চায়৷ আর চিফ এজেন্ট হয়ে আপনাকে হারিয়ে দেওয়ার কাজটা ও দায়িত্ব নিয়ে করবে৷ শুনুন, আমি যদ্দূর জানি, শ্বশুরমশাইয়ের রাগ আপনার উপর নয়৷ উনি চটেছেন মহেশ্বরজির উপর৷ গতবার ওঁকে ইলেকশনে টিকিট জোগাড় করে দেবেন, আশ্বাস দিয়ে উনি প্রচুর টাকা আদায় করেছিলেন৷ কাজের কাজ কিছুই হয়নি৷ বছরখানেক পর শ্বশুরমশাই দিল্লির এক নেতার কাছে জানতে পারেন, মহেশ্বরজি ওকে ধোঁকা দিয়েছিলেন৷ তাই জেদ করে এ বার নিজের চেষ্টায় উনি ইলেকশনে নামার কথা ভাবছিলেন৷ আমার মাথায় অন্য প্ল্যান আছে দিদি৷ এ বার রাজ্যসভায় বেশ কয়েকটা সিট খালি হবে৷ তার একটায় যাতে শ্বশুরমশাই নমিনেট হন, সিএমকে দিয়ে তার আমি চেষ্টা করব৷ তা হলে শ্বশুরমশাইয়ের কোনও আক্ষেপ থাকবে না৷’
‘বাববা, তুই এতদূর ভাবতে পারিস? তুই নিজে কেন পলিটিক্সে নামলি না অহল্যা?’
‘দিদি, ছাড়ুন আমার কথা৷ পালান সর্দারকে ফোনটা লাগান৷ জয়ব্রতকে এখানে পাঠিয়ে দিতে বলুন৷ ও না আসা পর্যন্ত আমি কিন্তু ধর্ণা চালিয়ে যাব৷’
হেসে তরিতা বললেন, ‘টেবলের উপর মোবাইলটা আছে৷ আমায় এগিয়ে দে৷’
( বাহান্ন)
সকালবেলায় খবরটা দিল জয়ব্রত, ‘বাবা, মনে হচ্ছে, দাদার জামিন আজই হয়ে যাবে৷’
সবে চায়ের কাপটা সনকা এনে দিয়েছে৷ বারান্দায় রোদের মধ্যে আরাম চেয়ারে বসে মণি নদীর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন চন্দ্রভানু৷ এমন সময় এই সুখবর৷ জামিন আবেদনের শুনানি আছে আজ বসিরহাট কোর্টে৷ অহল্যাকে নিয়ে জয়ব্রত কাল দুপুরেই পৌঁছে গেছে সেখানে৷ কলকাতা থেকে অ্যাডভোকেট বিমল মুখার্জিকে বসিরহাটে নিয়ে যাওয়ার কথা দয়াশঙ্করের৷ নববুই দিন হয়ে গেছে৷ পুলিশ এখনও চার্জশিট দেয়নি৷ এমনিতে জয়গোপালকে আটকে রাখার কোনও যুক্তি নেই৷ খবরটা আন্দাজ করতে পারছিলেন৷ তবুও, চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘জামিন হবে, বুঝলি কীভাবে? না আঁচালে বিশ্বেস নেই৷’
‘না, বাবা৷ এ বার হয়ে যাবে৷ জজসাহেবের সঙ্গে অহল্যা কাল রাতে দেখা করেছে৷ জেএনইউ-তে পড়ত ওর এক বন্ধু তৃপ্তি, জজসাহেব তার দাদু৷ উনি কথা দিয়েছেন, জামিন দিয়ে দেবেন৷’
শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন চন্দ্রভানু৷ বললেন, ‘অ্যাপিলটা কত নম্বরে আছে৷’
‘তা জানি না৷ তবে মনে হয়, বেলা দু’টোর আগে হবে না৷ কঙ্কণদীঘিতে ফিরতে ফিরতে আমাদের রাত্তির হয়ে যাবে৷ দাদাকে নিয়ে আমি আর অহল্যা সোজা তোমাদের কাছে যাব৷ মাকে বলে দিও৷’
চায়ের কাপটা রেখে সনকা তখনও চলে যায়নি৷ কথাবার্তা শুনে আন্দাজ করেছে, ফোনটা জয়ব্রতর৷ তাই দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ ওকে শুনিয়েই চন্দ্রভানু বললেন, ‘সামনেই তোর মা দাঁড়িয়ে আছে৷ ধর, দিচ্ছি৷’ বলে চন্দ্রভানু ফোনটা এগিয়ে দিলেন সনকার দিকে৷
মা আর ছেলের মধ্যে কথা হচ্ছে৷ কাপের চায়ে চুমুক দিলেন চন্দ্রভানু৷ নার্সিং হোম থেকে ফিরে আসার পর দুধ-চা খাওয়া বারণ৷ লাল চা… লিকার চা বানিয়ে আনে সনকা৷ ওর হাতে যাদু আছে৷ যা বানায়, তা-ই সুস্বাদু হয়ে ওঠে৷ তাই লিকার চা-তেই এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছেন চন্দ্রভানু৷ চায়ে দ্বিতীয় চুমুক দেওয়ার পর তিনি আড়চোখে একবার তাকালেন স্ত্রীর দিকে৷ এই সকালেই স্নান সারা, পরনে লাল পাড় গরদের শাড়ি৷ মাতৃ-রূপ যেন ফেটে পড়ছে৷ সম্ভবত এবার মন্দিরের দিকে যাবে৷ গত তিনটে মাস সনকা যা সেবাযত্ন করেছে, তার তুলনা নেই৷ নানা ঘটনায় তিনি এমন ভেঙে পড়েছিলেন, আর উঠে দাঁড়াতে পারবেন কি না, নিজেরই সন্দেহ ছিল৷ সনকা তুলে দাঁড় করিয়েছে৷ জীবনে এই প্রথম সনকার ভালবাসা টের পাচ্ছেন চন্দ্রভানু৷ সেইসঙ্গে আফসোসও করছেন, ওর গায়ে হাত তুলেছিলেন কী করে?
জয়ব্রতর সঙ্গে কথা শেষ করে মোবাইল সেটটা এগিয়ে দিয়েছে সনকা৷ ফিসফিস করে বলল, ‘নাও, তোমার সনে ছোট বউমা কতা কইবে৷’
খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, সনকাকে টেনে এনে জড়িয়ে ধরার৷ ইচ্ছেটাকে দমন করে চন্দ্রভানু সেট হাতে নিয়ে বললেন, ‘বলো বউমা৷ আর কী খবর৷’
ও প্রান্ত থেকে অহল্যা বলল, ‘বাবা, ভাগ্যিস, বুদ্ধি করে তৃপ্তিকে আমি কলকাতা থেকে নিয়ে এসেছিলাম৷ না হলে আজও দাদার জামিন হত না৷ ওকে আর ওর হাসবেন্ডকে কঙ্কণদীঘিতে নিয়ে যাচ্ছি৷ কাল ওরা মেলা দেখতে চাইছে৷ গেস্ট হাউসের একটা রুম যেন ওদের জন্য রাখা থাকে৷’
গেস্ট হাউসের কয়েকটা রুম ভর্তি হয়ে গেছে৷ চন্দ্রভানু বললেন, ‘ভাল করেছ মা৷ মন্টুকে আমি বলে রাখছি, অঙ্কুশের পাশের ঘরেই যেন ব্যবস্থা করে রাখে৷ শোনো মা, ভাগ্যিস তুমি অঙ্কুশকে কঙ্কণদীঘি পাঠিয়েছিলে৷ কাল দুপুরে ও পাইথনের বাচ্চাটাকে খুঁজে বের করেছে৷’
‘আমি পাঠাইনি বাবা৷ আপনি যখন আমায় বললেন, এখনও পাইথনের একটা বাচ্চাটা গ্রামে দেখা যাচ্ছে, তখন তরিতাদিদিই জোর করে অঙ্কুশকে কঙ্কণদীঘি পাঠালেন৷ আমি জানতাম, ও ধরতে পারবে৷’
‘ছেলেটাকে তোমার শাউড়ি মায়ের খুব মনে ধরে গেছে৷ উনি চাইছেন, ওর সঙ্গে আত্মীয়তার একটা সম্পর্ক পাতাতে৷ বড় বউমার বোনের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন৷ কথাটা কি তুমি পাড়তে পারবে?’
শুনে অহল্যা খুব হাসছে৷ বলল, ‘মাকে বলে দিন, যেন চেষ্টা না করে৷ অঙ্কুশের পাত্রী ঠিক করাই আছে৷ এখন ওদের মধ্যে মান-অভিমানের পালা চলছে৷ তরিতাদিদি ঠিক করেছেন, কাল পুজো হয়ে যাওয়ার পর চার হাত যাতে এক করা যায়, সেই চেষ্টা করবেন৷’
‘উনি আজকাল ঘটকালিও করেন না কি?’
‘তরিতদিদি কেমন মানুষ, কাল দেখলে আপনি টের পাবেন বাবা৷ এখন ছাড়ি৷ আমরা একটু বেরব৷ এখানে ইছামতীর ওপারে সংগ্রামপুর বলে একটা জায়গায় তিনশো বছরের পুরনো একটা কালীমন্দির আছে৷ খুব জাগ্রত৷ আগেরবার এসে দাদার জন্য আমরা মানত করে গেছিলাম৷ একটু পরেই ওই মন্দিরে যাব৷’
‘ঠিক আছে মা৷ জয়গাপালের জামিনটা হয়ে গেলে আমাকে ফোনে জানিয়ে দিও৷’
ও প্রান্ত থেকে লাইনটা কেটে যাওয়ার পর চন্দ্রভানু লক্ষ করলেন, বারান্দার অন্যদিকে দাঁড়িয়ে মন্টু কথা বলছে সনকার সঙ্গে৷ অহল্যার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বুঝতেই পারেননি, মন্টু কখন এসেছে৷ কাপে শেষ চুমুক দিয়ে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ রে মন্টু, পুজোর আয়োজন সব সারা?’
দূর থেকেই মন্টু বলল, ‘চইলছে৷ বউঠানের কাছ ঠেনে ট্যাকা নিইতে এয়েছি৷ শোন চাঁদ, রায়দীঘি থানার ওসি কইছে, কাল হাজার পাঁচেক লোক হবে৷ তোর কী দরগার ছেল, এত্ত বড় কইরে পুজো করার? সবটাতে তোর বাড়াবাড়ি৷ অমরদা সঙ্গে না থাইকলে আমি সামলাইতে পারতাম না ভাই৷’
কথা বলতে বলতে মন্টু ঘরে ঢুকে গেল সনকার সঙ্গে৷ ওর এত বিরক্তি প্রকাশ করার কী হল, চন্দ্রভানু বুঝতে পারলেন না৷ শিবরাত্তিরের সময় তো এর থেকেও বেশি লোক কঙ্কণদীঘিতে আসে৷ তাঁর বাড়িতে এই প্রথম মনসা পুজো হচ্ছে৷ বড় করে করবেন না? অহল্যা মাথায় ঢুকিয়েছে, ‘এটাই পাবলিক রিলেশন বাড়ানোর বেস্ট উপায় বাবা৷ সারা জেলায় যত মনসা পুজো কমিটি আছে, তাদের কর্তাদের ইনভাইট করুন৷ হারাধন পালাকারের কাছে লিস্টটা আছে৷ তরিতাদিদির কাছে শান্তি বলে একটা মেয়ে কাজ করে৷ সেও আমাদের হেল্প করতে পারবে৷ সবার নাম-ধাম তার কম্পিউটারে আছে৷ অসুবিধে নেই, ইনভিটেশনটা ফোনে ফোনে শান্তিই করে দিতে পারবে৷’
অহল্যার ক্ষমতা চন্দ্রভানু টের পান, যখন তিনি নার্সিংহোমে৷ আগের দিন মেয়েটা বলে গেল, চবিবশ ঘণ্টার মধ্যে যদি পালান সর্দার জয়ব্রতকে ফেরত দিয়ে না যায়, তা হলে ওর কপালে দুঃখ আছে৷ সত্যি সত্যিই, পরদিন সন্ধেয় জয়ব্রতকে সঙ্গে নিয়ে অহল্যা কঙ্কণদীঘিতে হাজির৷ চোখ-মুখে যুদ্ধজয়ের ছাপ৷ এসেই বলল, ‘এই দেখুন বাবা, আপনার ছেলেকে ফিরিয়ে এনেছি৷ এখন বাড়ি চলুন তো৷ নার্সিং হোমে থাকার আর দরকার নেই৷’
আরও আশ্চর্যের কথা, পরদিন ভোরেই অঘোরের ফোন, ‘স্যার, আমাদের সাতটা ট্রলার ফিরে এসেছে৷ রায়দীঘির ঘাটের একটু দূরে সব দাঁড়িয়ে আছে৷ কী করে হল এ সব স্যার?’
‘মাঝি মাল্লারা ফিরে এসে কিছু বলেনি?’
‘বলবে কী করে? পালান সর্দারের লোকেরা তো ওদের নামতেই দেয়নি৷ এখনও সবাইকে আটকে রেখেছে৷ শুধু আখতার বলে একজনকে পাঠিয়ে বলেছে, চাঁদবাবু যদি মা মনসার পুজো করতে রাজি থাকেন, তা হলে ট্রলারগুলো ঘাটে পাঠিয়ে দেব৷ না হলে, ট্রলারের সব মাছ নদীতে ফেলে ফিরে যাব৷’
‘এ সব কথার মানে? পালান সর্দার কী ভেবেছে? আমি মরে গেছি? বালি দ্বীপে খবর দিয়ে লক্ষণ সর্দারকে ডেকে আন৷ ভাল লোকজন নিয়ে যেন আসে৷ পালানকে আমি নদীর চরায় পুঁতে দেবো৷’
অঘোর বলল, ‘সেটা করা কি ঠিক হবে স্যার? পালান সর্দার অস্তর টস্তর নিয়ে রেডি হয়ে এসেছে৷ ওর সঙ্গে মারামারি করতে গেলে মাঝখান থেকে আমাদের লোসকান হবে৷ এত কাছে নিয়ে এসেও ইলিশগুলো আমরা আড়তে তুলতে পারব না৷ ভাল করে ভেবে বলুন স্যার৷ ছোটবাবু কিন্তু এখনও ট্রলারে৷’
চন্দ্রভানু বলতে যাচ্ছিলেন, ছোটবাবুকে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না৷ সে এখন বাড়িতে৷ কিন্তু পরক্ষণে তাঁর মনে হল, না পাঁচকান করা ঠিক হবে না৷ তখনই অহল্যার কথা মনে হয়েছিল চন্দ্রভানুর৷ মেয়েটা বাড়িতেই আছে৷ ওর সঙ্গে কথা বলে নেওয়া দরকার৷ সঙ্গেসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘পালানকে তুই খবর দে, চাঁদবাবু কী করবে, ঘণ্টাখানেক পরে জানাবে৷’
আধ ঘণ্টার মধ্যে মন্টুকেও ডেকে এনেছিলেন চন্দ্রভানু৷ কনফারেন্স রুমের দরজা বন্ধ করে চার-পাঁচজন মিলে আলোচনায় বসেছিলেন৷ পালানের হুমকি শুনে আঁতকে উঠেছিল ছোটখোকা, ‘পালানের কথা মেনে নিন বাবা৷ ও যদি ইলিশ ফেলে দেয়, তা হলে আমাদের কয়েক কোটি টাকা লস হয়ে যাবে৷’
চন্দ্রভানু রেগে বলেন, ‘এ কথা তুই বলছিস কী করে ছোটখোকা? শিবের ভক্ত হয়ে আমি মা মনসার পুজো করব?’
মন্টু বলেছিল, ‘একনও তুই জেদ ধরে থাইকবি চাঁদ৷ এতসব বেপদ হয়ে গেল, একনও তোর শিখখে হল নে? তুই কেমন ধারা নোক রে? তোকে কে কয়েচে, শিবের পুজো করলে মা মনসার পুজো করা যাবে নে? কোন পুঁথিতে নেখা আচে৷ মা মনসা তো শিবেরই কন্যে৷ তাঁর পুজো করলে শিব রুষ্ট হবেন কেন?’
অনেকক্ষণ ধরে তর্ক চলেছিল৷ হঠাৎ চন্দ্রভানু লক্ষ করেন, অহল্যা চুপ করে আছে৷ শান্ত গলায় তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি কিছু বলছ না কেন মা? আমি যে ধর্মসংকটে পড়েছি৷’
অহল্যা বলেছিল, ‘ট্রলারগুলো ছাড়িয়ে নিন বাবা৷ পালানকে বলে পাঠান, পুজো আপনি করবেন৷ তরিতা দিদির সঙ্গে একটু আগেই আমি ফোনে কথা বলেছি৷ উনি বললেন, তোর শ্বশুরমশাইকে বল, উনি যদি মা মনসার পুজো করেন, তা হলে জয়গোপালকেও আমি জেল থেকে বের করে আনব৷ আপনি যদি জেদ ধরে থাকেন, তা হলে আমার সব চেষ্টা মাঠে মারা যাবে৷ আপনি ব্যাবসা করে খান৷ ব্যাবসাই আপনার ধর্ম৷ সেই ধর্ম পালন করার কথা আগে ভাবুন বাবা৷ আমার তাই মনে হয়৷’
অনেকক্ষণ দোমনা করে সেদিন শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেছিলেন চন্দ্রভানু৷ তবে শর্ত রেখেছিলেন, ডান হাতে তিনি শিবের পুজো করেন৷ সেই হাতে মনসার পুজো করতে পারবেন না৷ মনসাকে যদি ফুল দিতেই হয়, তা হলে তিনি দেবেন বাঁ হাতে৷ সেই পুজো বাড়ির শিবমন্দিরের ভিতরই হচ্ছে আগামী কাল৷ আগে শিবের পুজো হবে৷ তার পর মা মনসার৷ হারাধন পালাকার বলেছেন, তাতে কোনও অসুবিধে নেই৷ শিব হলেন পৌরাণিক দেবতা৷ তাঁর বন্দনা আগে হওয়াই উচিত৷ মন্টু তখন বলে উঠেছিল, ‘অ্যাদ্দিনে তোর সুমতি হল রে চাঁদ৷ দেকিস, তোর সব বেপদ কেটে যাবে৷’ বাবা মহাদেবের ইচ্ছেয় কি না, চন্দ্রভানু জানেন না, সত্যিই বিপদ কেটে যাওয়ার লক্ষণ টের পেয়েছিলেন তিনি৷ পরদিনই দিল্লি থেকে অমিত শ্রীবাস্তব ফোন করে জানান, জাপানের ফিসারিজ কর্পোরেশন বাগদা চিংড়ির চুক্তিটা বাতিল করছে না৷ ওরা ফের নতুন করে মাল পাঠাতে বলেছে৷
শীতে এই অসময়ে মনসা পুজো হয় না৷ হয় শ্রাবণ-ভাদ্রে৷ কিন্তু হারাধন পালাকার নাকি বলেছেন, মায়ের পুজো ভক্ত বছরের যে কোনও সময়ে করতে পারে৷ পুজোর কথা জানাজানি হওয়ার পর থেকে একটা অদ্ভুত সাড়া পড়ে গেছে কঙ্কণদীঘিতে৷ এই প্রথম হচ্ছে বলে৷ এর আগে তাঁর ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে মনসার পুজো করতে পারত না৷ হপ্তা দুয়েক আগে কলকাতার কুমারটুলি থেকে শিল্পী এনে কুড়ি ফুট উঁচু প্রতিমা বানানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে মন্টু৷ একশো আটটা সাপের চালচিত্রের মাঝে পদ্মাসনা মনসা৷ মহেশপুর থেকে শোলাশিল্পীদের নিয়ে এসে মণ্ডপ সাজিয়েছে অমর মণ্ডল৷ তেরোদিন আগেই তরিতা পাঠিয়ে দিয়েছে হারাধন পালাকারকে৷ তিনি রোজ মনসা পালা করে যাচ্ছেন৷ শীতের রাত্তির, তা সত্ত্বেও প্রায় হাজার তিনেক লোক বসে সেই পালা শুনছে৷
কাল রাতে বেহুলা-লখিন্দরের গল্প শুনিয়েছেন হারাধন পালাকার৷ খানিকক্ষণ আসরে গিয়ে বসেছিলেন চন্দ্রভানু৷ বেহুলা সম্পর্কে অনেক কিছুই তিনি জানতেন না৷ শুনতে খারাপ লাগছিল না৷ …নেতি ধোপানি বেহুলাকে সেজুয়া পর্বতে নিয়ে গেল৷ দেবকন্যাদের সঙ্গে তাকে নাচতে বলল৷ নৃত্যসভায় ছিলেন শিব৷ বেহুলার নাচ দেখে শিব কামমোহিত হয়ে তাকে কুপ্রস্তাব দিলেন৷ শুনে চন্দ্রভানু চমকে উঠেছিলেন৷ শিব পারলেন কী করে? সত্যি, না কি হারাধন পালাকার মনগড়া গপ্প শোনাচ্ছেন৷ আসর ছেড়ে উঠে আসার কথা তিনি ভাবছেন , পালায় বেহুলা তখন আত্মপরিচয় দিয়ে বলল, ‘আমি যে তোমার বরদাসী… তোমার নাতনি৷ আমায় কুপ্রস্তাব দেওয়া তোমার সাজে না৷ তোমার কাছে আমি বিচার চাইতে এসেছি৷ মনসা কালনাগিনীকে পাঠিয়ে আমার লখিন্দরকে মেরে ফেলেছে৷ তুমি আমার স্বামীকে বাঁচিয়ে দাও৷’ শুনে শিব খুব লজ্জা পেয়ে গেলেন৷ এর পর নারদকে দিয়ে ক্রুদ্ধ শিব ডেকে পাঠালেন মনসাকে৷ মনসা এসে বেহুলার অভিযোগ অস্বীকার করলেন৷ কিন্তু বেহুলা কালনাগিনীর লেজের অংশটুকু দেখিয়ে বললেন, ‘এই দেখো, মা মনসা যে কালনাগিনীকে লোহার বাসরে পাঠিয়ে ছিলেন, এটা তার প্রমাণ৷’
আজ পালার শেষ দিনে হারাধন পালাকার শোনাবেন, চাঁদ শেষ পর্যন্ত কেন মনসা পুজোয় রাজি হল, সেই কাহিনী৷ বারান্দায় বসে চন্দ্রকান্ত স্থির করে নিলেন, পালার শেষ অংশ পুরো সময় বসে তিনি দেখবেন৷ বহুদিন আগে মন্টু একবার বলেছিল, ‘চাঁদ সওদাগরের জেবনে যা যা ঘইটেছেল, তোর জেবনেও তা-ই ঘইটছে৷’ মন্টু যা বলেছিল, এখন তো সব মিলে যাচ্ছে৷ নামের মিলই শুধু নয়৷ মা মনসার বিরোধিতা করতে গিয়ে চাঁদ সওদাগরের মতো তাঁকেও বিরাট ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছে৷ মনসা পুজো করার পরে সব ফিরে পেয়েছিল চাঁদ সওদাগর৷ তিনিও কি সব ফিরে পাবেন? সেই লক্ষণ অবশ্য দেখা যাচ্ছে৷ চাঁদের সপ্তডিঙ্গার মতো তাঁর সাতটা ট্রলারও সমুদ্র থেকে ফিরে এসেছে৷ ছেলেরাও সম্ভবত আজ বিকেলের মধ্যে ঘরে ফিরবে৷ ফার্ম হাউস নিয়ে যে সমস্যাটা হয়েছিল, সেটাও মিটে যাবে বলে মনে হয়৷ অহল্যা বলছিল, তরিতা বলে মেয়েটা পাঁচ বছরের জন্য ফার্ম হাউসটা লিজ নিতে চায়৷ কে এক আয়ুর্বেদাচার্য আছেন, তিনি সম্মতি দিলে৷ ভদ্রলোক না কি সোনাখালিতে গেছিলেন৷ কিন্তু, এখনও কিছু জানাননি৷
তরিতার সঙ্গে এখনও সামনাসামনি কথা হয়নি চন্দ্রভানুর৷ কিন্তু সে যে একের পর এক সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছে, তিনি তা বুঝতে পারছেন৷ অহল্যার মাধ্যমে একটা মিটমাট হওয়ার পর থেকে জটগুলো কেটে যাচ্ছে৷ সবথেকে বড় কথা, সনকার মুখে হাসি ফুটেছে৷ ভানুমতিকে নিয়ে পুজোর আয়োজনে সে মেতে রয়েছে৷ ওর বয়স যেন আরও কমে গেছে৷ বিয়ের পর পর পশ্চিম জটায় থাকার সময় প্রতি রাতে সনকার শরীর নিয়ে যতটা উদ্দাম হতেন তিনি, ইদানীং ততটাই হয়ে উঠছেন৷ নার্সিং হোমে ডাক্তার একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মিসেস-এর সঙ্গে সেক্স-টেক্স হয়?’ চন্দ্রভানু পাল্টা জিজ্ঞেস করেন, ‘কেন বলুন তো?’ ডাক্তার তখন বলেন, ‘টেনশন কাটানোর সবথেকে বড় উপায় হল সেক্স৷’ ডাক্তারের টোটকাটাই মনে ধরে গিয়েছে চন্দ্রভানুর৷
নার্সিং হোম থেকে ফিরে আসার পর একটা রাতও তিনি সনকাকে ছেড়ে দেননি৷ একেক রাতে দু’তিনবার যৌনসম্পর্ক করার পরও তিনি ক্লান্ত হননি৷ মন্টু ব্যাটাচ্ছেলের পুঁথিগত বিদ্যে ততটা নেই৷ কিন্তু সেক্স নিয়ে ও বহুদিন আগে যা বলেছিল, চন্দ্রভানু এখন দেখছেন, সেটা সত্যি৷ সোনাখালির গেস্ট হাউসে মাল খেতে খেতে মন্টু বলেছিল, ‘বউয়ের সঙ্গে সেক্স করে যা তৃপ্তি পাওয়া যায় চাঁদ, তা আরও কারও কাছ থেকে পাওয়া যায় না৷’ কথাটা কখনও সখনও মনে পড়লে চন্দ্রভানু হাসতেন৷ বিশেষ করে সত্যবতীর শরীর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার পর৷ তার মানে মন্টু তখনই জানত, সত্যবতীর সঙ্গে তাঁর যৌনসম্পর্ক আছে৷ আশ্চর্য, ইদানীং আর সত্যবতীর কথা মনেই পড়ে না চন্দ্রভানুর৷ না পড়ারই কথা৷ সনকা যে আনন্দটা এখন দিচ্ছে, তা কোনওদিন সত্যবতীও দিতে পারেনি৷
নূপুরের আওয়াজ শুনে চন্দ্রভানু চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেন, বড় বউমা জয়িতা কাছে এসে দাঁড়িয়েছে৷ মাঝে কিছুদিন মুখ শুকনো করে ঘুরে বেরাচ্ছিল৷ আজ ঝলমল করছে৷ নরম গলায় চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘মা, কিছু বলবে?’
‘নীচে ব্রেকফাস্ট টেবলে আপনার জন্য সবাই ওয়েট করছেন বাবা৷ মা আপনাকে নিয়ে যেতে বললেন৷’
ব্রেকফাস্ট করার কথা ভুলেই গেছিলেন চন্দ্রভানু৷ আরাম কেদারা থেকে উঠে বললেন, ‘নীচে আর কারা আছেন মা?’
‘উকিলবাবু এসেছেন৷ আমার বাবা, অমর মণ্ডল, ঝন্টু কয়ালও আছেন৷ পাখিরালা থেকে মা তরিতা এখনও এসে পৌঁছননি বাবা৷ উনি না কি বিকেলের দিকে আসবেন৷’
‘আর বাবাইসোনার সর্পগুরু? তিনি কোথায়?’
জয়িতা হেসে বলল, ‘অঙ্কুশের কথা বলছেন? সে বোধহয় গেস্ট হাউসেই আছে৷ এ বার দেখছি, খুব মনমরা৷ ছেলেটার কী হয়েছে কে জানে? তার ঘরে ব্রেকফাস্ট পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বাবা৷ একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি৷ সাগর দ্বীপ আশ্রমের দেবিকা বলে একটা মেয়েকে মা তরিতা পাঠিয়ে দিয়েছেন৷ সে আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে দাঁড়িয়ে আছে৷’
দেবিকাকে সঙ্গেসঙ্গে চিনতে পারলেন চন্দ্রভানু৷ মহেশ্বরজির আশ্রমের মেয়ে৷ রিসেপশনে বসে, গেস্ট হাউস সামলায়৷ কিন্তু, তাকে তরিতা পাঠাবে কেন, তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না৷ মেয়েটাকে তরিতা চিনলই বা কী করে? বেশ কিছুদিন আগে নার্সিং হোমে বসেই চন্দ্রভানু খবর পেয়েছেন, উমা মা দেহ রেখেছেন৷ মহেশ্বরজি আশ্রম ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন কনখলে৷ আশ্রমে এখন খুব ডামাডোল চলছে৷ মহেশ্বরজির উপর রাগে চন্দ্রভানু ঠিকই করেছেন, আশ্রম নিয়ে মাথা ঘামাবেন না৷ নিশ্চয়ই আশ্রম চালানোর জন্য এখন টাকাপয়সার দরকার৷ সেই কারণেই হয়তো দেবিকা এসেছে৷ উচ্ছন্নে যাক ভণ্ড লোকটার আশ্রম৷ একটা পয়সাও তিনি দেবেন না৷ কিন্তু কথাগুলো ঝন্টু কয়াল বা অমর মণ্ডলের সামনে বলা উচিত হবে না৷ ভেবে নিয়ে চন্দ্রভানু বললেন, ‘মেয়েটাকে উপরে নিয়ে এসো মা৷ এখান থেকেই বিদেয় করে দিই৷’
মিনিট দুয়েক পর মেয়েটাকে নিয়ে উপরে উঠে এল জয়িতা৷ ওর যৌবন দেখেই সারা শরীর শিরশির করে উঠল চন্দ্রভানুর৷ যেন কোনারক মন্দিরের দেওয়াল থেকে নেমে আসা যক্ষিণী৷ কই, এতদিন ধরে তিনি আশ্রমে যাতায়াত করছেন৷ কখনও তো মেয়েটাকে এত সেক্সি লাগেনি? বড় বউমা সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাই নিজেকে সামলে চন্দ্রভানু বললেন, ‘কী বলার আছে, তাড়াতাড়ি বলো৷’
দেবিকা হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বলল, ‘মা তরিতা আমাকে আপনার কাছে পাঠালেন স্যার৷’
‘শুনেছি৷ কিন্তু কী কারণে, আমি বুঝতে পারছি না৷ আশ্রমের জন্য টাকা পয়সা আমি দিতে পারব না৷’
‘আমি টাকা চাইতে আসিনি স্যার৷ গুরুজি কনখলে যাওয়ার আগে আশ্রমের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন মা তরিতার উপর৷ সে কথা জানাতেই আমি ওঁর কাছে পাখিরালায় গেছিলাম৷ কিন্তু মা তরিতা বললেন, আশ্রমের দায়িত্ব উনি নিতে পারেন, যদি আপনি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হন৷ স্যার, আপনি রাজি হলে, তবেই উনি দায়িত্ব নেবেন৷’
কথাটা শুনে চমকে উঠলেন চন্দ্রভানু৷ বললেন, ‘উনি এই কথা বলেছেন!’
‘হ্যাঁ স্যার৷ উনি আরও বললেন, মহেশ্বরজির উচিত ছিল আশ্রমের দায়িত্ব চন্দ্রভানুবাবুর উপর দিয়ে যাওয়া৷ কেননা, আশ্রমের জন্য উনি যা করেছেন, তার তুলনা নেই৷ স্যার, আশ্রমে এখন আমরা প্রায় একশোজন মেয়ে৷ আপনাদের মতো কেউ মাথার উপর না থাকলে আশ্রমটাই দখল হয়ে যাবে হোটেলওয়ালাদের হাতে৷ আশ্রমের জমিতে ওরা এনক্রোচ করা শুরু করেছে৷ প্লিজ স্যার, আপনি আমাদের বাঁচান৷’
হোটেলওয়ালাদের হাতে আশ্রম দখল হয়ে যাবে শুনে চন্দ্রভানুর মাথায় ঘণ্টা বাজতে লাগল৷ গঙ্গাসাগর মেলা, কপিল মুনির মন্দির, শিবভক্তদের তীর্থস্থান, সারা ভারতের পুণ্যার্থীদের সমাগম৷ মহেশ্বরজির আশ্রমের ওই বিশাল জায়গা৷ প্রতিটি কোণ তিনি হাতের তালুর মতো চেনেন৷ যে রিসর্ট বানানোর কথা তিনি ভাবছেন, সেটা হেনরি আইল্যান্ডসে না করে, সাগরদ্বীপে করলে কেমন হয়? দ্রুত কথাগুলো ভেবে নিলেন চন্দ্রভানু৷ নাহ, অহল্যা ফিরে এলে ওর সঙ্গে একবার আলোচনা করা দরকার৷ ও সবসময় বলে, ব্যাবসাই আপনার ধর্ম৷ কী এসে গেল, শিব মন্দিরের পাশে যদি একটা মনসা মন্দির বানিয়ে দেওয়া যায়? এমন মনসা মন্দির, যা দেখার টানে, শ্রাবণ-ভাদ্র পুরো দুটো মাস ভক্তরা সাগরে ছুটে যাবেন৷ পাল্টা এই প্রস্তাবটা দিলে তরিতাও নিশ্চয়ই খুশি হবে৷
দুটো মন্দিরের পাশে তাঁর রিসর্ট! ধর্মের সঙ্গে পর্যটন ব্যাবসার মিশেল৷ দারুণ আইডিয়া৷ অহল্যা নিশ্চয় অরাজি হবে না৷ ভেবে নিয়ে চন্দ্রভানু বললেন, ‘তরিতার প্রস্তাবটা আমি একটু ভেবে দেখি মা৷ উনি তো আজই কঙ্কণদীঘিতে আসছেন৷ সামনাসামনি বসে তখন না হয় কথা বলে নেওয়া যাবে৷ আর শোনো, আজ তোমাকে সাগরে ফিরে যেতে হবে না৷ কাল আমার এখানে ধুমধাম করে মা মনসার পুজো হচ্ছে৷ তুমি না হয় কাল পুজোর পর, পরশু সাগরে ফিরে যেও, কেমন?’
( তিপ্পান্ন)
বেলা দশটা-সাড়ে দশটার সময় জয়জিৎ এসে ডাকল, ‘কুশ আঙ্কল চলো, ঠাম্মা তোমায় ডাকছে৷ এখনই পুজো শুরু হবে৷’
অঙ্কুশ জিজ্ঞেস করল, ‘উনি এখন কোথায়?’
‘মন্দিরে৷ মনসা পুজোর জোগাড়যন্তর করছে৷’
শুনে নিশ্চিন্ত হল অঙ্কুশ৷ যাক, চন্দ্রভানুবাবুর স্ত্রীর আসার কোনও সম্ভাবনা নেই৷ উনি ডাকতে এলে অঙ্কুশ এড়িয়ে যেতে পারত না৷ ভদ্রমহিলার মধ্যে একটা মা মা ভাব আছে৷ নিজের মাকে তো অঙ্কুশ দেখার সুযোগ পায়নি৷ মায়েরা বোধহয় চন্দ্রভানুবাবুর স্ত্রীর মতোই হন৷ এ বার নিয়ে বারচারেক ও কঙ্কণদীঘিতে এল৷ সত্যি বলতে দ্বিধা নেই, ভদ্রমহিলার ব্যবহারে অঙ্কুশ মুগ্ধ৷ জয়জিৎকে ও জিজ্ঞেস করল, ‘তোর ঠাম্মা আর কী বলল রে?’
‘কাল তুমি না কি ঘর থেকেই বেরোওনি৷ ঠাম্মা আমায় বলল, বাবাই যে কোরেই হোক, তুই কুশ আঙ্কলকে ধরে নিয়ে আসবি৷ কিন্তু, ঘরে বসে থেকে তুমি কী করছিলে গো?’
সত্যিই, কাল দুপুর থেকে গেস্ট হাউসের ঘরে নিজেকে আটকে রেখেছে অঙ্কুশ৷ ব্রেকফাস্ট করে ডাইনিং হল থেকে বেরতেই এমন একজনকে ও দেখে ফেলেছিল, যার মুখোমুখি হতে ও চায় না৷ কাল দুপুরেই কোনও না কোনও ছুঁতোয় ও কঙ্কণদীঘি থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল৷ কিন্তু বিকেলের দিকে আসার কথা ছিল তরিতা ম্যাডামের৷ তাই তাঁকে না জানিয়ে চলে যাওয়াটা খুব খারাপ দেখাত৷ তরিতা ম্যাডামকে একবার মুখ দেখিয়েই ও চলে এসেছে৷ সেইসময় ম্যাডামকে ঘিরে বসে আছেন অনেকে৷ তরিতা ম্যাডাম হেসে হেসে কথা বলছেন চন্দ্রভানুবাবুর সঙ্গে৷ অঙ্কুশ নিশ্চিন্তবোধ করেছিল, যাক, ম্যাডামের সঙ্গে চন্দ্রভানুবাবুর বিরোধ তা হলে মিটে গেছে৷ ঘরে ফিরে আসার পর আর বেরয়নি অঙ্কুশ৷ জয়জিৎকে ও বলল, ‘ঘরে বসে টিভি দেখছিলাম রে৷ অ্যানিমাল প্লানেট চ্যানেল৷ পাইথনদের নিয়ে ভাল একটা প্রোগ্রাম দেখাচ্ছিল৷’
পাইথনের কথা শুনে জয়জিৎ বলে উঠল, ‘কুশ আঙ্কল, কুলিক না… সকালের দিকে ঘুমোচ্ছিল৷’
এ বার কঙ্কণদীঘিতে এসে অঙ্কুশ পাইথনের যে বাচ্চাটাকে ধরেছে, তার কথা বলছে জয়জিৎ৷ সাপেদের নাম দেওয়া যায় কি না, সেদিন জয়জিৎ জানতে চেয়েছিল৷ তা হলে পাইথনের বাচ্চাটার একটা নাম দেবে ও৷ হারাধন পালাকারের মনসা মঙ্গল শুনে অঙ্কুশ অনেক ধরনের সাপের নাম জানতে পেরেছে৷ যেমন অনন্ত, বাসুকি, কম্বল, কর্কোটক, ফণী, মহাফণী, আড়াইরাজ, শঙ্খ, কুলিক, মণি, কালীনাগ, চিরানিয়া, তক্ষক৷ এই নামগুলোর মধ্যে কোনও একটাকে অঙ্কুশ বেছে নিতে বলেছিল৷ কুলিক নামটা জয়জিতের পছন্দ হয়েছে৷ বাচ্চাটা এখন রাখা আছে, শিব মন্দিরের ভিতর একটা কাচের বাক্সে৷
ঠাম্মা ধরে নিয়ে যেতে বলেছে৷ তাই, জয়জিৎ ওর হাত ধরে টানতে শুরু করেছে৷ কিন্তু মন্দিরে যাওয়ার ইচ্ছে অঙ্কুশের একেবারে নেই৷ জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিলে বেচারি খুব কষ্ট পাবে৷ মনে মনে জুতসই একটা কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টায় ছিল অঙ্কুশ৷ চট করে পাচ্ছিল না৷ তখন বাঁচিয়ে দিল ওর মোবাইল ফোন৷ হঠাৎ বাজতে শুরু করল৷ হাত ছাড়িয়ে অঙ্কুশ বলল, ‘জয়জিৎ তুই যা৷ ঠাম্মাকে গিয়ে বল, কুশ আঙ্কল ফোনে কথা বলে বাথরুমে ঢুকবে৷ স্নান-টান করে তার পর আসবে৷’
খুশি মনে জয়জিৎ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল৷ সেট কানে দিয়ে অঙ্কুশ জিজ্ঞেস করল, ‘কে বলছেন?’
ও প্রান্ত থেকে কে যেন বলল, ‘মোবারকভাই, সালাম আলেইকুম৷ আমি আইসরফ বইলছি৷ আইজ গাঘোরের মধ্যেই আমার দুডো কেউটে চাই৷ পাওয়া যাবে?’
ওহ, সেই লোকটা…মাসকয়েক আগে যে একবার পিয়ারাতে ফোন করেছিল৷ সাপ কেনা-বেচার বেআইনি ব্যাবসা করে! আগেরবার লোকটাকে অঙ্কুশ ভয় দেখিয়েছিল, সাপ নিয়ে বেআইনি ধান্ধা বন্ধ না করলে, ফোন নাম্বারটা পুলিশকে দিয়ে দেবে৷ শুনে সঙ্গেসঙ্গে আসরফ বলে লোকটা ফোনের লাইন কেটে দিয়েছিল৷ পরে অবশ্য আসরফের কথা অঙ্কুশ ভুলে গিয়েছিল, পিয়ারাতে পাইথন নিয়ে গোলাপি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ায়৷ কিন্তু, ও বুঝতে পারল না, এটা ওর নতুন নাম্বার৷ আসরফ পেল কী করে? ওর পুরনো আর নতুন নাম্বার… ভুল করেও মোবারকের সঙ্গে মিলে যেতে পারে না৷ তা হলে সাপ কেনার নাম করে কি কেউ ওকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে? কে হতে পারে? সুমন্ত মণ্ডল, না কি অন্য কেউ!
আসরফকে ফের ভয় দেখানোর ইচ্ছেটাও অঙ্কুশের এখন নেই৷ উত্তর না দিয়ে ও ফোনের লাইন কেটে দিল৷ সঙ্গেসঙ্গে ঠিক করে নিল, কারোর ফোন ও আর ধরবে না৷ যতক্ষণ কঙ্কণদীঘিতে থাকবে, স্রেফ নিজেকে নিয়েই ভাববে৷ কিন্তু নিজেকে নিয়ে কী ভাববে, সেটাই ও ভেবে উঠতে পারছে না৷ ভাবনার শুরুতেই ওর গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে৷ হার… জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ওকে হারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে৷ এটাই অঙ্কুশ মেনে নিতে পারছে না৷ কোন হারটা নিয়ে ভাববে, সেটাও স্থির করতে পারছে না৷ সবার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল৷ জেঠামশাই… যাঁর মুখের উপর কোনওদিন ও কথা বলেনি, তাঁকেও অঙ্কুশ ছেড়ে দেয়নি৷ জয়জিৎ চলে যাওয়ার পর সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে ওর মনে হল, রামকৃষ্ণ মিশনে পড়া ওর মতো একটা ছেলে হঠাৎ এত দুর্বিনীত হতে পারে কী করে?
গোলাপির বিয়ের রাত থেকেই ভাবনাটা ও শুরু করল৷ পিঙ্কি বউদি যা নয় তাই বলে তো খেতে চলে গেল৷ অযথা দোষারোপে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে অঙ্কুশ আর বাসর ঘর পর্যন্ত যেতে পারেনি৷ উপরতলায় উঠে নিজের ঘরে চলে যাবে কি না, ঠিক করতে পারছিল না৷ সেইসময় গণেশ এসে বলল, ‘দাদাবাবু, আবনাকে এগবার কাছারি ঘরে যেতি হবে৷ আবনার দাদামশাই আবনাকে দেকতে চাইচেন৷’
দাদামশাই! মানে মায়ের বাবা সদানন্দ বসু! তাঁকে দেখার প্রচণ্ড ইচ্ছেটা অঙ্কুশ এতদিন চেপে রেখেছিল৷ আসলে দাদামশাইয়ের বাড়িতে যাওয়ার সাহসটাই সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি৷ তাই গণেশকে ও জিজ্ঞেস করল, ‘উনি কখন এলেন?’
‘এগটু আগে৷ আবনার জেঠামশাইরা রিসর্টে চইলে যাওয়ার পরই এলেন৷ ওনাদিগের সনে বাবা কতা কইচেন ৷ আমাকে কইলেন, আবনাকে নে যেতে৷’
মনের কষ্ট চাপা দিয়ে গণেশের সঙ্গে দ্রুত পা চালিয়ে কাছারি ঘরে গেছিল অঙ্কুশ৷ নীচের তলায় বিরাট একটা হলঘর৷ ওখানে নতুন কর্পোরেট অফিস হবে৷ রিনোভেশনের কাজ শুরু হয়নি৷ এখনও চৌকিজাতীয় কিছু পুরনো আসবাব রয়ে গেছে৷ তাতে সাদা চাদর পাতা৷ ঘরে ঢুকেই অঙ্কুশের চোখে পড়ল, একজন বয়স্ক মানুষ চৌকির উপর বসে আছেন৷ মাথার চুল শনের মতো সাদা৷ পরনে সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি৷ চোখে পুরু কাচের চশমা৷ হাতে পুরনো আমলের একটা ছড়ি৷ চোখ-মুখ থেকে যেন আভিজাত্য ফুটে বেরুচ্ছে৷ দেখেই অঙ্কুশ বুঝতে পেরেছিল, উনিই সদানন্দ বসু৷ মানুষটার পাশে আরও কয়েকজন বিভিন্ন বয়সি পুরুষ ও মহিলা বসে ছিলেন৷ তাঁরা গ্রামেরই লোক৷
ওকে ঢুকতে দেখে নিবারণদা বলে উঠেছিল, ‘এই লেন বড়কর্তাবাবা৷ আবনার নাতি এইসেচেন৷ আর কুশ দাদাবাবু, এই লেন আবনার দাদামশাই৷ ’
উত্তেজনায় দাদামশাই চৌকি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন৷ অঙ্কুশ তখন পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিল৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ও বুঝতে পেরে গেছিল, দাদামশাই চোখে দেখতে পান না৷ স্পর্শ করার জন্য তাঁর দুটো শীর্ণ হাত ওর মুখের সামনে ঘোরাফেরা করছিল৷ সেই হাত দুটো অঙ্কুশ ধরতেই চশমার ফাঁক দিয়ে অশ্রুধারা নেমে এসেছিল দাদামশাইয়ের৷ ঘরঘরে গলায় উনি বললেন, ‘শেষ যেবার দেকেছিলুম, ত্যাখন তোর বয়েস একবছরও হয়নি বাবা৷ এমন সময় এলি, যখন চোখের জোর চলে গ্যাছে৷’
পাশে বসা এক মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘অঙ্কুশ, আমি তোমার মামিমা৷ শুনলুম, বেশ কিছুদিন তুমি দয়াপুরে আছ৷ আমাদের সঙ্গে একবার যোগাযোগ করলে না কেন বাবা?’
অঙ্কুশ প্রণাম করে বলেছিল, ‘করব ভেবেছিলাম৷ কিন্তু শুনেছি, আপনারা কেউ এখানে থাকেন না৷’
‘ঠিকই শুনেছ৷ আমরা থাকি সল্ট লেকে৷ কিন্তু তোমার দাদামশাই আমাদের কাছে যাননি৷ উনি ভিটেমাটি আঁকড়ে আছেন৷ তোমার মায়ের শোক উনি এখনও ভুলতে পারেননি৷ আরেকজন তো চলেই গেলেন আমাদের ছেড়ে৷ তোমাকে দেখার তাঁর কত ইচ্ছে ছিল৷’
দাদামশাই জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বাবা, তোর বড়মায়ের শ্রাদ্ধের পর, তোকে না কি রূপেন-নৃপেনরা পিয়ারার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে?’
রূপেন মানে জেঠামশাই৷ নৃপেন হলেন বড়কাকা৷ অঙ্কুশ বলল, ‘না, দাদামশাই, কথাটা সত্যি নয়৷ আমিই চাকরি নিয়ে দয়াপুরে চলে এসেছি৷’
‘ওরা লোক তো ভাল নয়৷ আমার ফুলের মতোন মেয়েটাকে কম কষ্ট দিয়েছে? তোর মাকে শেষপর্যন্ত তো মেরেই ফেলল৷’
মামিমা বলে উঠলেন, ‘থাক বাবা, বিয়ে বাড়ি এসে ওই পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ কী? চুপ করুন৷’
দাদামশাই বললেন, ‘কেন চুপ করব বউমা? পালান ডাকাতকে কে সেদিন এ বাড়িতে পাঠিয়েছিল? এই রূপেন আর নৃপেন৷ অনেক পরে দারোগাবাবু নিজের মুখে স্বীকার করেছিলেন নগেন লাহিড়ির কাছে৷ ওই রাত্তিরে ওদের টার্গেট ছিল রাজলক্ষী৷ চিনতে না পেরে দ্বিজেনকেও ওরা মেরে ফেলে৷ মিত্তিরবাড়ির ওদের আমি ক্ষমা করব কোনওদিন? তুইও ওদের ক্ষমা করিস না বাবা৷’
কথাগুলো বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন দাদামশাই৷ হাঁফানির টান উঠেছিল৷ একটু পরে নিজেই শান্ত হয়ে দাদামশাই বলেছিলেন, ‘আমাকে ভ্যান রিকশায় তুলে দে নিবারণ৷ রাজলক্ষ্মীর কথা মনে করে, এ বাড়িতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে৷ আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা কর৷ অঙ্কুশকে নিয়ে তুই একবার আমার ওখানে যাস৷ ওর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে৷ ওর জানা উচিত কাদের কাছে অ্যাদ্দিন ও মানুষ হয়েছে৷’
মনে পড়ছে… গেস্ট হাউসের সোফায় বসে সেদিনকার সব কথাই অঙ্কুশের মনে পড়ছে ৷ দাদামশাই চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ ওর সঙ্গে গল্প করেছিলেন মামিমা৷ ওর মামা রামানন্দ বসু পিডবলিউডি-র বড় অফিসার৷ মামিমা যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ান৷ উনি অবশ্য মাকে দেখার সুযোগ পাননি৷ কেননা, মা মারা যাওয়ার পর মামা বিয়ে করেন৷ কথায় কথায় মামিমা বলেছিলেন, ‘শাশুড়ি মায়ের মুখে শুনেছি, তোমার মা না কি রূপে লক্ষÃ# আর গুণে সরস্বতী ছিলেন৷ ওঁর একটা বড় ছবি আছে দয়াপুরের বাড়িতে৷ যদি দেখতে চাও তো, কালই চলে এসো৷’ অঙ্কুশ ঠিকই করে রেখেছিল, ছবিটা কপি করে মোবাইল ফোনে রেখে দেবে৷ কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি৷
বিয়ের পরদিন যখন গোলাপি শ্বশুরবাড়ির দিকে রওনা হচ্ছে, সেইসময় জেঠামশাইয়ের ফোন, ‘আমরা কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি রে কুশ৷ তুই এলি না যে?’
মনের মধ্যে প্রচণ্ড রাগ৷ তবুও সেটা চেপে রেখে অঙ্কুশ বলেছিল, ‘সময় পেলাম না জেঠামশাই৷’
‘জু থেকে পাঠানো চিঠিটা তা’লে কার কাছে রেখে যাব?’
‘ চিঠিটা আপনি রিসর্টের রিসেপশনে রেখে যান৷ পরে আমি কালেক্ট করে নেবো৷’
‘তা হলে একদিন পিয়ারায় আসিস৷ হাজার হলেও তোর সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক৷ আমরা অস্বীকার করি কী করে বল৷’
কথাটা শুনে অঙ্কুশ আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি৷ বলে ফেলেছিল, ‘আমি কিন্তু সম্পর্কটা আর রাখব না জেঠামশাই৷ আমার মাকে আপনারা যা টর্চার করেছেন, তাতে আপনাদের সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক আছে… ভাবতেই ঘেন্না হচ্ছে৷’
‘কী বলছিস তুই কুশ! কার সঙ্গে কথা বলছিস, খেয়াল আছে?’
‘ভাল মতোন খেয়াল আছে৷ দ্য গ্রেট রূপেন মিত্তির৷ আমার মাকে খুন করার জন্য যিনি পালান সর্দারকে হায়ার করেছিলেন৷ দাদামশাইয়ের কাছে আমি সব শুনেছি৷ ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছি, ভবিষ্যতে যেন আর কোনওদিন আপনাদের মুখ দেখতে না হয়৷ ’
‘ওই পাগলটা কী বলল, আর সেটাই তুই বিশ্বাস করে নিলি?’
‘ফর ইয়োর ইনফর্মেশন, দাদামশাইয়ের কথা শুনে নয়৷ আমার বাবা দ্বিজেন মিত্তির নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন ৷ কাল রাতে, আলমারি থেকে সেগুলো উদ্ধার করে আমি পড়ে ফেলেছি৷ ডায়েরির প্রতি পৃষ্ঠায় আপনাদের দুর্ব্যবহারের কথা বাবা লিখে রেখে গেছেন৷ নরকেও আপনাদের ঠাঁই হবে না৷ যাক সে কথা, আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই৷ ’
বলে ফোনের লাইনটা কেটে দিয়েছিল অঙ্কুশ৷ কথাগুলো মুখের উপর বলতে পারলে আরও খুশি হত৷ বিশেষ করে, সৌম্যদা আর পিঙ্কি বউদির সামনে৷ মিত্তির ফ্যামিলির এই ভণ্ড মানুষগুলোর দম্ভ তা হলে গুঁড়িয়ে দেওয়া যেত৷ কিন্তু যতটুকু বিষ খেলেছে, অঙ্কুশ জানে, তার জ্বালা সামলাতেই জেঠামশাইয়ের অনেকগুলো দিন কেটে যাবে৷ যেমন, বহুদিন ওর কেটে যাবে, বাবার লেখা ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলো স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে৷ বাবা লিখেছে, বড়মা আর জেঠামশাই যেদিন মায়ের কোল থেকে ওকে কেড়ে নিতে আসেন, সেদিন মা দু’জনের হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেছিল৷ এই জেঠামশাই না কি সেদিন মাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন! বড়মা না কি সেদিন এও বলেছিলেন, ‘আমার ছেলেটাকেও তুই ছেড়ে দে ডাইনি, যত টাকা চাস দেবো৷’ লেখাটা মনে পড়ায় একটা চিনচিনে রাগ অঙ্কুশের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে৷ বাথরুমে গিয়ে ও চোখ-মুখে জল দিয়ে এল৷ তার পর এই শীতেও ফুল স্পিডে পাখা চালিয়ে শরীরটাকে ও ছেড়ে দিল বিছানায়৷
চোখটা বুঁজে আসতেই ওর কানে ভেসে এল হারাধন পালাকারের গলা৷ আসরে বসে উনি দরাজ গলায় পালা গাইছেন৷ সর্পদংশনে মৃত লখিন্দরের ভেলা সাজানো হচ্ছে৷ তার বর্ণনা দিচ্ছেন হারাধন পালাকার৷ ভেলায় শুইয়ে দেওয়া হয়েছে লখিন্দরকে৷ ঘাটে দাঁড়িয়ে বিলাপ করছেন সনকা আর চাঁদ সওদাগর৷ বেহুলাকে তাঁরা নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছেন, সে যেন মৃত স্বামীর সঙ্গে ভেলায় উঠে না বসে৷ এমন সময় দমকা হাওয়ায় শুধু লখিন্দরকে নিয়েই সেই ভেলা স্রোতের টানে ভেসে গেল৷ লখিন্দরের বদলে হঠাৎ ভেলায় নিজেকে দেখতে পেল অঙ্কুশ৷ ওর সারা শরীর অবশ৷ কিন্তু দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়নি৷ ও দেখল, দয়াপুরের টাইগার ক্যাম্প রিসর্টের ঘাট ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে৷ ঘাটে অনেকেই দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ তাদের মধ্যে অঙ্কুশ চিনতে পারল দাদামশাই, নিবারণদা, গোলাপি আর উষসীকে৷ গোলাপি জোরে জোরে কাঁদছে৷ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে উষসী৷
লখিন্দরের মতো ভেলায় ভেসে যাওয়ার ইচ্ছেটা বেশ কয়েকদিন ধরে চাগাড় দিচ্ছে অঙ্কুশের মনে৷ বিশেষ করে, আলিপুর জু-য়ের পাঠানো চিঠিটা পড়ার পর থেকে৷ ‘অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, চিড়িয়াখানার অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টরের পদে আপনাকে নেওয়া যাচ্ছে না৷’ চিঠিটা যাতে অন্য কারও চোখে না পড়ে, সেই কারণে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে অঙ্কুশ হেরোভাঙা খালে ফেলে দিয়েছে৷ অ্যান্টি ভেনম সিরামের জন্য গোটা তিরিশ বিষধর সাপ ধরে এনে পোষা হচ্ছে মনসা ভবনে৷ একটার বিষ সংগ্রহ করে অঙ্কুশ নিজের কাছে রেখেও দিয়েছে৷ লখিন্দর হওয়ার ইচ্ছে হলেই ও সেই বিষচূর্ণ গলায় ঢেলে দেবে৷ কিন্তু এমনই হতভাগ্য, ও সেই সুযোগটাই পাচ্ছে না৷ তরিতা ম্যাডাম হঠাৎ ওকে পাইথনের বাচ্চা ধরার জন্য কঙ্কণদীঘিতে পাঠালেন৷ না হলে অঙ্কুশ দয়াপুরে হয়তো ইচ্ছেটা পূরণ করে ফেলত৷
কলিং বেলের মিষ্টি আওয়াজ হচ্ছে৷ চোখ খুলে অঙ্কুশ দেখল, দেওয়াল ঘড়িতে বেলা একটা বাজে৷ দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই জয়জিৎ বলল, ‘কুশ আঙ্কল, তুমি এখনও চান করোনি? ঠাম্মা যে তোমাকে ফের ডাকতে পাঠাল৷ পুজো শেষ হওয়ার মুখে৷’
জয়জিতের পাশেই দাঁড়িয়ে তেইশ-চবিবশ বছরের একটা মেয়ে৷ তাকে আগে কখনও দেখেছে বলে অঙ্কুশ মনে করতে পারল না৷ পরনে হালকা গোলাপি জামদানি শাড়ি৷ কোঁকড়ানো চুল কাঁধের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷ প্রসাধন না করলেও অনেক মেয়েকে সুন্দরী দেখায়৷ এই মেয়েটি সেইরকম৷ কিন্তু, রূপর্চ্চায় যে অভ্যস্ত, এক পলক দেখেই তা বুঝতে পারল অঙ্কুশ৷ ঘরে একটা সুন্দর পারফিউমের গন্ধ ভেসে বেরাচ্ছে৷ সম্ভবত সেটা ওর গা থেকে আসছে৷ অঙ্কুশ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই মেয়েটা মিষ্টি গলায় বলল, ‘আমি রণিতা ৷ জয়জিতের মাসি৷ আপনার সঙ্গে দু’একটা কথা বলা যাবে?’
নামটা শোনা শোনা বলে মনে হচ্ছে৷ চন্দ্রভানুবাবুর স্ত্রী সম্ভবত এরই কথা বলেছিলেন৷ এই মেয়েটারই বাবা বড়মায়ের শ্রাদ্ধের দিন ওদের পিয়ারার বাড়িতে গিয়ে দেখা করেছিলেন জেঠামশাইয়ের সঙ্গে৷ কথাটা মনে পড়ায় সঙ্গেসঙ্গে অঙ্কুশ দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এসো৷’
ঘরে পা দেওয়ার আগে রণিতা বলল, ‘বাবাই, তুই পুজোর ওখানে চলে যা৷ তোর সঙ্গে যে আমি এখানে এসেছি, তা যেন কেউ জানতে না পারে৷’
ঘাড় নেড়ে জয়জিৎ চলে যেতেই দরজা বন্ধ করে রণিতা বলল, ‘ আপনাকে বিরক্ত করার জন্য সরি অঙ্কুশদা৷ কেউ এসে পড়তে পারে৷ তাই চট করে কথাটা বলে ফেলি৷ আপনি জানেন কি, আমার বাবা আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন? আমি কিন্তু এ বিয়েতে রাজি না৷’
শুনে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল অঙ্কুশের৷ আবার হার! কোনও রকমে ও বলল, ‘কথাটা তুমি ওঁকে জানিয়ে দিচ্ছ না কেন?’
‘বাবা আমার কথা মানবেন না৷ আমিও বাবার অবাধ্য হতে পারব না৷ সবথেকে ভাল হয়, আপনি যদি আমায় রিজেক্ট করেন৷ হাতজোড় করে বলছি, প্লিজ আপনি এই বিয়েতে রাজি হবেন না৷ আমি একজনকে ভালবাসি ৷ তার সঙ্গে আমার রিলেশন পাঁচ বছরেরও বেশি৷ তাকে আপনি ভাল করে চেনেন৷ তার নাম বিরসা সেন৷ খুব নামকরা ফোটোগ্রাফার৷’
বিরসা সেন… মানে জয়ের কাগজের সেই চিফ ফোটোগ্রাফার! পালান সর্দারের ইন্টারভিউ নিতে যাওয়ার দিন গাড়িতে যার সঙ্গে ওর আলাপ হয়েছিল? ঝড়খালির কাটা জঙ্গলে কয়েক মিনিটের জন্য যে উধাও হয়ে গেছিল? বাঘের পেটে গেছে মনে করে, ও আর জয় যাকে নিয়ে মারাত্মক ভয় পেয়েছিল? ছেলেটা অবশ্য জয়ের মতো চলিয়াত নয়৷ অত্যন্ত ভাল ছেলে৷ বর্ধমানের কোন এক গ্রাম থেকে তোলা সাপের ছবি পাঠাবে বলেছিল৷ পরে কিন্তু সেই ছবিগুলো পাঠিয়েছিল৷ বিরসার নামটা শুনে জোর করে মুখে হাসি টেনে এনে অঙ্কুশ বলল, ‘ওকে আমি ভাল করে চিনি৷ কনগ্রাটস রণিতা৷ তুমি চিন্তা কোরো না৷ গ্যারান্টি দিচ্ছি, আমার সঙ্গে তোমার অন্তত বিয়ে হচ্ছে না৷ কিন্তু, একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না৷ বিরসা তো পাত্র হিসাবে খারাপ নয়৷ তোমার বাবা রাজি হচ্ছেন না কেন?’
বিরসার প্রশংসা শুনে রণিতার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ বলল, ‘ বাবা মনে করেন, কাগজের রিপোর্টার মানেই খুব অসৎ৷ কাকে দেখে বাবার এই ধারণাটা হয়েছে, জানি না৷ বিরসা আপনাকে বলেছে কি না জানি না৷ ও কিন্তু দৈনিক বাংলা কাগজের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে৷ রিসেন্টলি আমরা দু’জন মিলে একটা ভেঞ্চারে নেমেছি৷ কর্পোরেট হাউসের জন্য স্রেফ কমার্সিয়াল কাজ করব৷ বিরসার যা হাতযশ, তাতে সাকসেসও পাচ্ছি৷’
অঙ্কুশ বলল, ‘ঠিক ডিসিশন নিয়েছ৷ বিরসা খুব ক্রিয়েটিভ মাইন্ডের৷ ওর তোলা কিছু ছবি আমার কাছেও আছে৷ কিন্তু তুমি এতসব কথা আমাকে বলছ কেন?’
‘বাবা শুনেছেন, আপনার সঙ্গে বিরসার পরিচয় আছে৷ চালাকি করে হয়তো উনি আপনার কাছে জানতে চাইবেন, বিরসা কেমন ছেলে৷ প্লিজ আপনি ওর সম্পর্কে এমন কোনও কথা বলবেন না, বাবা যাতে খুঁত খুঁজে পান৷’
বুকের ভিতরের ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হল৷ অঙ্কুশ বলল, ‘তুমি নিশ্চিন্ত থাক রণিতা৷ তেমন কিছু আমি বলব না৷’
‘থ্যাঙ্কস অঙ্কুশদা৷ আমাকে বাঁচালেন৷ যদি অনধিকার র্চ্চা বলে না মনে করেন, তা হলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?’
‘কী জানতে চাও বলো৷’
‘ উষসীর সঙ্গে আপনার বিয়েটা হল না কেন? যতদূর জানি, ও আপনাকে খুব ভালবাসত৷ আপনার বাড়ির লোকদেরও না কি অমত ছিল না৷’
‘ভালবাসত’ কথাটা বুকে এসে ধাক্কা মারল৷ অঙ্কুশ বলল, ‘ওকে তুমি চেনো?’
‘ভাল মতো চিনি৷ বিরসার সূত্রেই ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব৷ বিরসা আর উষসী একই ফোটোগ্রাফার’স অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বার৷ আপনাকে নিয়ে রোজই আমাদের মধ্যে কথা হত৷ ইন ফ্যাক্ট, আজ দেখার অনেক আগে থেকেই আপনাকে আমি চিনি৷ আপনি কেমন মানুষ অঙ্কুশদা? মুখ ফুটে মনের কথাটা ওকে জানাতে পারলেন না? অথচ উষসী কত আশা করে বসে ছিল৷ ওকে এভাবে কষ্ট দিতে আপনি পারেন না৷ জানি, আপনি খুব লাজুক প্রকৃতির৷ কিন্তু নিজেকে বদলে ফেলুন অঙ্কুশদা৷’
জানে… নিজের দুর্বলতার কথা অঙ্কুশ সব জানে৷ ভেবে অনেক বিনিদ্র রজনী ও কাটিয়েছে৷ ব্যর্থতা নিয়ে অনেক কাটা-ছেঁড়াও করেছে৷ কিন্তু রণিতার সামনে সেই প্রসঙ্গ তুলে লাভ কী? ক্লান্ত গলায় অঙ্কুশ বলল, ‘এ সব কথা থাক রণিতা৷ তুমি এখন যাও৷ আমার ঘরে কেউ তোমাকে দেখে ফেললে পরে এমব্যারাসিং সিচুয়েশনে পড়বে৷’
‘যাচ্ছি অঙ্কুশদা৷ কিন্তু যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাই৷ উষসীকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ৷ জয়ের সঙ্গে ওর বিয়ের উদ্যোগটা নিয়েছিলেন আপনার পিঙ্কি বউদি৷ আপনার উপর রাগে৷ উষসীকে উনি এমন আইডিয়াও দিয়েছিলেন, আপনার সঙ্গে আমার বিয়েটা ঠিক হয়ে গেছে৷ আর টাকাপয়সার লোভে আপনি তাতে রাজি৷ পিঙ্কি বউদি জানতেন না, উষসী আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড৷ ওর কপাল ভাল, জয়দার সঙ্গে ওর বিয়েটা শেষপর্যন্ত ভেস্তে গেছে৷ জানেন, আজ পুজোর সময় মা মনসাকে অনেক ডেকেছি৷ আমার বিশ্বাস, খুব শিগগির ভাল কিছু ঘটবে৷’
কথাগুলো বলে রণিতা বাইরে বেরিয়ে গেল৷ ঘরে ভেসে থাকা সুগন্ধটাও নিয়ে চলে গেল৷ দরজা বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত ঢাক-ঢোল আর কাঁসরের আওয়াজ শুনতে পেল অঙ্কুশ৷ পুজো বোধহয় শেষ পর্বে৷ দরজা বন্ধ করে পিছন ঘুরতেই আয়নায় নিজেকে দেখতে পেয়ে ও চমকে উঠল৷ গায়ের রঙ তামাটে হয়ে গেছে৷ চোখের কোণে কালি৷ কয়েক সেকেন্ড নিজের দিকে তাকিয়ে ও বিড়বিড় করে বলে উঠল, ‘লুজার… ইউ আর অ্যাবসোলিউটলি আ লুজার৷’ দু’হাতে মুখ খেকে ও বিছানায় বসে পড়ল ৷ ঘরের মধ্যে ওর দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল৷ হঠাৎ অঙ্কুশ ঘামতে শুরু করল৷
তখনই বিদ্যুৎ চমকের মতো অঙ্কুশের মাথায় প্রশ্নটা এল, বেঁচে থেকে আর লাভ কী? আলমারিতে ওর কিট ব্যাগটা পড়ে আছে৷ তার ভিতরে কাগজের প্যাকেটে রয়েছে বিষের পাউডার৷ প্যাকেটটা নিয়ে সন্ধেবেলায় স্বচ্ছন্দে ও মণি নদীর ঘাটে চলে যেতে পারে৷ শীতের সন্ধ্যায়, ওখানে এখন সারি সারি ডিঙি বাঁধা থাকে৷ ভাঁটার টানে জলে দোলে৷ একটা ডিঙির বাঁধন খুলে স্রোতের টানে ভেসে যেতে কোনও বাধা নেই৷ তার পর মাঝনদীতে গিয়ে বিষের পাউডার গলায় ঢেলে… ছইয়ের তলায় শুয়ে পড়ার অপেক্ষা৷ লখিন্দরের মতোই চিত হয়ে ও ভেসে যাবে নেতি ধোপানি ঘাটের দিকে৷ মাত্র ঘণ্টাদুয়েকের প্রতীক্ষা৷ অন্ধকারে ওর নির্জীব দেহটা কারও চোখে পড়বে না৷ আর চোখে পড়লেও অসুবিধে নেই৷ বাঁদাবনের নদীতে মৃতদেহ নিয়ে এমন কত ডিঙিই তো ভেসে যেতে দেখা যায়৷ হারাধন পালাকার সেদিন গাইছিলেন, ভেলায় তোলার আগে মৃত লখিন্দরকে সুগন্ধি দিয়ে স্নান করানো হয়েছিল৷ শুদ্ধ বস্ত্র পরানো হয়েছিল৷ কথাটা মনে হতেই অঙ্কুশ বাথরুমে গিয়ে ঢুকল৷
পুনশ্চ মণি নদীর ঘাটে যাবে বলে তৈরি হচ্ছে অঙ্কুশ৷ এমন সময় দরজায় নক করার শব্দ৷ জয়জিৎ নিশ্চয়ই নয়৷ তা হলে ও ডোর বেল টিপত৷ তা হলে চন্দ্রভানুবাবুর স্ত্রী, না কি পাখিরালার কেউ? পুজোমণ্ডপে ওকে না দেখে হয়তো খোঁজ করতে এসেছেন৷ চন্দ্রভানুবাবুর স্ত্রী হলে মুশকিল৷ ভদ্রমহিলাকে অঙ্কুশ অ্যাভয়েড করতে পারবে না৷ ওর লখিন্দর হওয়ার ইচ্ছেটা তা হলে আরও দু’একদিন পিছিয়ে যাবে৷ কিন্তু, তরিতা ম্যাডাম যদি ওকে ডাকার জন্য কাউকে পাঠিয়ে থাকেন, তা হলে অঙ্কুশ সাফ জানিয়ে দেবে, এভিএস ইউনিটে চাকরি করার ইচ্ছে ওর নেই৷ কঙ্কণদীঘি থেকে এখনই ও চলে যাচ্ছে৷ মনস্থির করে অঙ্কুশ দরজা খুলল৷ বাইরে উষসীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও চমকে উঠে বলল, ‘তুমি!’
গতকাল ব্রেকফাস্টের পর গেস্ট হাউসে ফিরে আসার সময়ই অঙ্কুশ দেখেছিল, উষসী গাড়ি থেকে নেমে আসছে৷ পাছে ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, সেই কারণে সারাটা দিন আর ঘর ছেড়ে বেরয়নি৷ সাগরদ্বীপে দয়াশঙ্করবাবু বলেছিলেন, চন্দ্রভানুবাবু না কি উষসীর উপর মারাত্মক খেপে আছেন৷ পাইথনের ছবি কাগজে ছাপিয়ে দেওয়ার জন্য৷ তা হলে কী এমন ঘটল যে, উষসী ফের এ বাড়িতে! কে-ই বা ওকে আমন্ত্রণ জানাল? অনেক ভেবেও অঙ্কুশ কূলকিনারা পায়নি৷ অবাক হয়ে ও উষসীর দিকে তাকিয়েই রইল৷ পরনে লাল পাড় গরদের শাড়ি৷ এলো চুল কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে৷ ফর্সা কপালে হোমের টিকার টান৷ উষসীর এই রূপ অঙ্কুশ আগে কখনও দেখেনি, এই বেশেও৷ ভিতরে ভিতরে ও দুর্বল হয়ে পড়ল৷ পিয়ারায় যেদিন ও প্রথম উষসীকে দেখেছিল, ঠিক সেইদিনকার মতো৷
ঘরে ঢুকে উষসী বলল, ‘একটা জিনিস তোমায় ফেরত দিতে এলাম৷ তুমি এখানে থাকবে, সেটা তরিতাদিদিই ফোন করে আমাকে বলেছিলেন৷ এর বেশি কিছু জানতে চেও না৷’ কথাটা বলতে বলতে আঁচলের আড়াল থেকে নবরত্ন হারের বাক্সটা বের করে আনল উষসী৷
তখনই রণিতার কথাগুলো অঙ্কুশের মনে পড়ল৷ ‘আপনি কেমন মানুষ অঙ্কুশদা? মুখ ফুটে মনের কথাটা একবার ওকে বলতে পারলেন না? অথচ কত আশা করে বসে ছিল ও৷ নিজেকে বদলে ফেলুন অঙ্কুশদা৷’ কথাটা মনে পড়ায় আচমকাই অঙ্কুশের মুখ থেকে গলগল করে বেরিয়ে এল, ‘হারটা ফেরত নেওয়ার জন্য তো তোমায় দিইনি৷ বড়মা তোমার জন্যই রেখে গেছিলেন৷’
উষসীর দিকে তাকিয়ে মণি নদীর ঘাটে যাওয়ার ইচ্ছেটা হঠাৎ উবে গেল অঙ্কুশের মন থেকে৷ লখিন্দর হওয়ার তাগিদটাও৷ যেন উত্তরটা রণিতাকেই দিচ্ছে, এমনভাবে ফের ও বলল, ‘সব মানুষ কি মুখ ফুটে সবকথা বলতে পারে? সবাই তা পারে না৷ হ্যাঁ, একদিন এই গেস্ট হাউসেই আমি তোমায় কথাটা বলতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু সেদিন তুমি বাচ্চা পাইথনদের ছবি দেখাতে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লে, আমি সুযোগই পেলাম না৷’
উষসী মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ গয়নার বাক্সটা হাতে নিয়ে অঙ্কুশ খুলে ফেলল৷ তার পর নবরত্ন হারটা বের করে বলল, ‘এই হারটা তোমাকে ছাড়া আর কাউকে মানাবে না উষসী৷ কাছে এসো৷ মায়ের হারটা তোমায় পরিয়ে দিই৷ উপর থেকে মা নিশ্চয় আমাদের আশীর্বাদ করবেন৷’