(পঁয়তাল্লিশ)
সজনেখালির ফরেস্ট অফিসে কনফারেন্স হল-এর লাগোয়া একটা ঘরে অপেক্ষা করছেন তরিতা৷ চিফ মিনিস্টারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে বেলা আড়াইটায়৷ পাখিরালা থেকে নেত্রা আর অঙ্কুশকে সঙ্গে নিয়ে তরিতা চলে এসেছেন বেলা একটায়৷ অমর মণ্ডল আগেই বলে দিয়েছিলেন, পনেরো মিনিটের বেশি সময় পাবেন না৷ তার মধ্যেই এভিএস ইউনিটের ব্যাপারে কথাবার্তা সেরে নেবেন৷ লাঞ্চের আগেই নাকি সিএম প্রশাসনিক বৈঠকে বসবেন৷ তার পর একে একে ডাকবেন, যাঁদের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে৷ অমর মণ্ডল আরও বলেছিলেন, ‘সিএম অফিসে আমি যা বলার বলে রেখেছি৷ মা, আপনার কোনও অসুবিধে হবে না৷ ধরে রাখুন, সরকারী সিলমোহর পেয়ে গেছেন৷’
নদীর উপর গোটা পঁচিশ লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে৷ ঘাটে নামার সময় একটা চেনা লঞ্চ তরিতার চোখে পড়েছিল৷ এমভি সনকা৷ তার মানে ওই লঞ্চের মালিক চন্দ্রভানুও সম্ভবত সিএম-এর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে৷ মাস কয়েক আগে লোকটাকে এক ঝলক দেখেছিলেন তরিতা৷ চেহারাটা মনে নেই৷ ফরেস্ট অফিসে এই মুহূর্তে এত ভিড় যে লোকটা এখন তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও তিনি চিনতে পারবেন না৷ একেই কলকাতা থেকে সিএম-এর সঙ্গে সজনেখালিতে এসেছেন প্রায় পঞ্চাশজন৷ পুলিশ, কোস্টাল গার্ড… তার উপর সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজির পার্টির প্রচুর সমর্থক৷ পুরো চত্বরটা গমগম করছে৷ লঞ্চ থেকে নেমে তরিতা প্রথমে অপেক্ষা করছিলেন কুমির প্রকল্পের কাছে একটা গাছতলায়৷ ওঁকে দেখে রটে যায়, মা তরিতা এসেছেন ৷ ব্যস, স্থানীয় লোকেরা এসে প্রণাম করতে শুরু করেন৷ ওকে ঘিরে ভিড় বাড়ছে দেখে, শেষে পুলিশ এসে তরিতাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় দোতলায় কনফারেন্স হলের কাছে একটা ঘরে৷
খুব শিগগির সুন্দরবন আলাদা জেলা হয়ে যাবে৷ সেই কারণে এবার সিএম-এর এই প্রশাসনিক বৈঠকটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ কখন যে বেলা আড়াইটা বেজে গেছে, তরিতা টেরও পাননি৷ মিটিং এখনও শেষ হয়নি৷ ভাগ্যিস, নেত্রা পাখিরালার রিসর্ট থেকে গোটা কয়েক ভেজ স্যান্ডউইচ আর ফল নিয়ে এসেছিল৷ ওঁরা তা দিয়ে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করেছেন৷ সিএম-এর সামনে কী বলবেন, তরিতা মনে মনে তা ঠিক করে নিচ্ছেন৷ সত্যি বলতে কী, তিনি মনে মনে টেনশন অনুভব করছেন৷ জীবনে এই প্রথম৷ সাগর দ্বীপে থাকার সময় তিনি দিল্লি, ইউপি আর বিহারের প্রচুর নামী পলিটিশিয়ানকে দেখেছেন৷ গঙ্গাসাগর মেলার সময় মহেশ্বরজির আশ্রমে তাঁরা আসতেন, কৃপাপ্রার্থী হয়ে৷ তাঁদের দেখাশুনোর ভার মহেশ্বরজি তাঁর কাঁধেই তুলে দিতেন৷ কিন্তু, আজকের ব্যাপারটা অন্যরকম৷ সিএম অভিজিৎ চ্যাটার্জি বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন৷ অমর মণ্ডল বলেই দিয়েছেন, তাঁকে সন্তুষ্ট করা না কি কঠিন৷
সিএম-এর মিটিং বোধহয় শেষ হয়ে গেছে৷ কনফারেন্স রুম থেকে প্রচুর লোক বেরিয়ে আসছেন৷ এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে খুকে অমর মণ্ডল বললেন, ‘মা জননী, সিএম লাঞ্চ করতে বসেছেন৷ মনে হয়, আপনার ডাক আসবে সাড়ে তিনটের পর৷ পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনটা রেডি করে রাখুন৷ আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় সিএম ঝন্টু কয়ালকেও থাকতে বলেছেন৷’
ঝন্টু কয়াল ছেলেটা মিনিস্টার৷ বার তিনেক তাঁর সঙ্গে পাখিরালায় দেখা করে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে৷ কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করেনি৷ সেই কারণে ছেলেটার উপর তরিতা একটু অসন্তুষ্টই৷ তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঝন্টু কয়াল কেন?’
অমর মণ্ডল বললেন, ‘সেটা মিটিংয়ের সময়ই আপনি বুঝতে পারবেন৷ সে যাক, আপনাকে একটা খবর দিই মা জননী৷ সিএম-এর সঙ্গে দেখা করার জন্য চাঁদ বাইরে ওয়েট করছে৷ সিএম এখনও সময় দেননি৷ ঝন্টু চাঁদের হয়ে বলতে গেছিল৷ সিএম নাকি ধমকে ওকে বের করে দিয়েছেন৷’
‘চন্দ্রভানু কি জানে, আমি এখানে এসেছি?’
‘কী বলছেন মা? জানবে না? ওর লোকজন পার্টিতে কম না কি? নেহাত বড় ছেলেটা মার্ডার কেসে ফেঁসে যাওয়ায় চাঁদ এখন বেকায়দায় পড়ে গেছে৷ এই তো এখুনি দেখে এলাম, মুখ শুকনো করে গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে৷’ কথাটা বলেই হাসতে লাগলেন অমর মণ্ডল৷
তার পর কী মনে পড়ে যাওয়ায় বললেন, ‘মা, আপনার একজন ভিজিটর আছেন৷ আপনি কি অহল্যা বলে কাউকে চেনেন? ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন৷ পুলিশ ওঁকে আটকে দিয়েছে৷ আপনি কি ওঁর সঙ্গে কথা বলবেন?’
কে অহল্যা? তরিতা চট করে মনে করতে পারলেন না৷ কৌতূহলী মুখে নেত্রার দিকে তাকাতেই ও বলল,
‘ তুমি ওকে চেনো দিদি৷ দিল্লিতে আমাদের নীচের ফ্ল্যাটে থাকত৷ মেয়েটা তখন হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ত৷’
এইবার মেয়েটাকে চিনতে পারলেন তরিতা৷ ওর বাবা ছিলেন বামপন্থী দলের নেতা৷ তরিতা যখন আমেরিকা যান, তখন ওই ভদ্রলোক খুব সাহায্য করেছিলেন৷ অ্যাদ্দিন পর মেয়েটা দেখা করতে চায় কেন, তরিতা বুঝে উঠতে পারলেন না৷ বললেন, ‘ অহল্যাকে আপনি ওয়েট করতে বলুন৷ আগে সিএম-এর সঙ্গে দেখাটা হয়ে যাক৷ ফেরার সময় কথা বলা যেতে পারে৷’
সিএম-এর সঙ্গে তরিতা যখন দেখা করতে ঢুকলেন, তখন প্রায় চারটে বাজে৷ উজ্জ্বল আলোর নীচে সিএম অভিজিৎ চ্যাটার্জি বসে আছেন৷ পরনে সাদা রঙের হাফ হাতা শার্ট৷ বয়স ষাটের কাছকাছি৷ কিন্তু দেখায় কম৷ রাজ্য রাজনীতির কোনও খবর রাখেন না তরিতা৷ অভিজিৎ চ্যাটার্জি সম্পর্কে যা কিছু আইডিয়া, তা ওঁকে দিয়েছেন অমর মণ্ডল৷ ভদ্রলোক নাকি খুব অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেন৷ সামনাসামনি হওয়ার পর উদ্বেগ কেটে গেল তরিতার৷ হাসিমুখে সিএম বললেন, ‘আসুন তরিতা, বসুন৷’
তরিতা প্রতি নমস্কার করে বললেন, ‘গুড আফটারনুন স্যার৷ আমাকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ৷ দয়াপুর গ্রামে আমি একটা অ্যান্টি ভেনাম সিরাম ইউনিট খুলতে চাইছি৷ সাপের কামড়ে এই অঞ্চলের প্রচুর মানুষ মারা যান৷ সঠিক চিকিৎসা পান না…৷
থামিয়ে দিয়ে সিএম বললেন, ‘আমাদের রাজ্যে এ রকম ইউনিট কি আর কোথাও আছে?’
‘কোথাও নেই স্যার৷ এভিএস ভায়াল আমাদের মহারাষ্ট্র আর তামিলনাড়ু থেকে আনাতে হয়৷ রাজ্যের সব জায়গায় তা অ্যাভয়লেবল না৷ মারাত্মক স্কেয়ারসিটি…’
এটুকু শুনেই সিএম অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন, ‘শুনেছি, মা মনসার পুজো প্রচলন করার জন্য আপনি নাকি এই অঞ্চলে প্রচুর টাকা খরচ করেন৷’
‘ঠিক শুনেছেন স্যার৷ এটা করার উদ্দেশ্য, অ্যাওয়ারনেস বাড়ানো৷ মা মনসার পালা দেখিয়ে আমি বলতে চাই, সাপ মারতে নেই৷তাতে ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স নষ্ট হয়৷’
‘আমি অবশ্য মনসাপুজোর বিরোধী নই৷ আমরা ওপার বাংলার লোক৷ ছোটবেলায় মাকে দেখেছি, বাড়িতে মনসা পুজো করতে৷ আপনার কি মনে হয়, পুজো টুজো করে লোকের অ্যাওয়ারনেস বেড়েছে?’
‘স্যার, সুন্দরবনে আয়লার পর এমনিতেই সাপের সংখ্যা কমে গেছে৷ আরও যাতে না কমে, সে কারণেই আমি চেষ্টা চালাচ্ছি৷ অ্যাওয়ারনেস নিশ্চয়ই বেড়েছে৷ সাপে কামড়ালে এখন লোকে ওঝার কাছে যেতে চাইছে না৷ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু, এভিএস-এর এত অভাব যে…’
‘আপনাকে কি কখনও সাপে কামড়েছে?’
প্রশ্নটা শুনে একটু অবাকই হলেন তরিতা৷ যতবার তিনি এভিএস ইউনিটের কথা তুলতে যাচ্ছেন, ততবারই অভিজিৎ চ্যাটার্জি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন৷ মুখে হাসিটা ধরে রেখেছেন বলে তরিতা আন্দাজ করতে পারলেন না , ওঁর মনোভাবটা কী? বললেন, ‘বেশ কয়েকবার কামড়েছে স্যার৷ কিন্তু আমাদের শরীর ইমিউন করা আছে৷ বিষক্রিয়া চট করে হয় না৷’
‘আচ্ছা, সবথেকে বিষধর সাপ কোনটা? কেউটে, না চন্দ্রবোড়া?’
‘কোনটাই নয় স্যার৷ বিশ্বের সবথেকে বিষধর সাপ হল কালাচ৷ যা কি না, এই সুন্দরবনে প্রচুর দেখতে পাওয়া যায়৷ যার এক মিলিগ্রাম বিষ শরীরে গেলে আর প্রপার ট্রিটমেন্ট না পেলে মৃত্যু অনিবার্য৷ বিদেশ থেকে হারপেটোলজিস্টরা প্রায়ই এখানে আসেন কালাচ নিয়ে গবেষণা করার জন্য৷’
‘শুনেছি, মন্ত্রবলে আপনি সাপের বিষ তুলে নিতে পারেন? লোকে না কি সেই কারণেই আপনাকে মা মনসার অবতার বলে মনে করেন৷’
কথাটা শুনে হেসে ফেললেন তরিতা৷ বললেন, ‘না স্যার৷ মন্ত্রবলে এ সব হয় না৷ বুজরুকিতে আমি বিশ্বাস করি না৷’
‘কিন্তু আমি তো শুনেছি, সাপেরা আপনার এমন বশ যে, শূন্যে হাত ঘুরিয়েও নাকি আপনি তাদের ডেকে আনতে পারেন! এখন ডেকে আনতে পারবেন? এই কনফারেন্স হল-এ?’
এ কী ছেলেমানুষি আবদার করছেন সিএম? উনি ছাড়াও হল-এ উপস্থিত আছেন দশ-বারোজন অফিসার৷ তাঁরা সাপ দেখে ভয় পেয়ে যেতে পারেন৷ তাই তরিতা অনুরোধের সুরেই বললেন, ‘স্যার, প্লিজ আমাকে এমব্যারাসিং সিচুয়েশনে ফেলবেন না৷’
‘না, না৷ সত্যিই আমি দেখতে চাই, আপনার এই ক্ষমতাটা আছে কি না?’
‘কিন্তু এই ঘরে যাঁরা আছেন, তাঁরা শক পেতে পারেন৷’
‘না তরিতা, এই রুমে যাঁরা আছেন, তাঁরা কেউ ডরপুক নন৷’
‘স্যার, আরেকবার কথাটা ভেবে দেখুন৷’
‘তার মানে আপনার সম্পর্কে যা রটেছে, তা সত্যি নয়৷’
এর পর আর হিপনোটাইজ না করে থাকা যায় না৷ কথাটা শুনে তরিতা একবার চোখাচোখি করলেন নেত্রার সঙ্গে৷ ওদিক থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে তিনি বললেন, ‘তা হলে এক মিনিটের জন্য হলঘরের আলো বন্ধ করে দিতে বলুন স্যার৷’
তরিতা কথাটা বলার পর কনফারেন্স রুমের আলো নিভিয়ে দেওয়া হল৷ অন্ধকার হল-ঘরে মনসা স্তব শুরু করল নেত্রা৷ একটা মায়াবি সুর আনাচ-কানাচে ঘুরে বেড়াতে লাগল৷ ফের আলো জ্বলে ওঠার পর বিস্ফারিত চোখে সবাই দেখলেন, সিএম-এর টেবলে একটা কেউটে সাপ ফণা ধরে আছে৷ পাঁচ ফুটের মতো লম্বা, মাথায় সাদা চক্রাকার ছোপ৷ গায়ের রঙ হলদে, কালো আর বাদামি মেশানো৷ পেটের দিকটায় হলদেটে সাদা৷ মুখ দিয়ে হিসহিস শব্দ করছে৷ গোলাকার ফণা এদিক ওদিক দোলাচ্ছে৷ একেবারে ছোবল মারার দূরত্বে৷ পিছন থেকে কে যেন চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘বি কেয়ারফুল স্যার৷’
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ডানদিক থেকে আরও একটা সাপ টেবলে উঠে এল৷ এটি চন্দ্রবোড়া৷ তিন-সাড়ে তিন ফুট লম্বা৷ হলুদ রঙের শিকলের মতো সারি গোলাকার চাকা চাকা দাগ ঘিরে কালো রঙের বেড়৷ ফণাহীন সাপ৷ মাথাটা চ্যাপ্টা তেকোণা, মাথার উপরে ইংরেজি ভি চিহ্ন৷ জোরালো ফোঁস করে উঠল৷ দুটো ভয়ানক সাপ দেখে সিএম-এর মুখ রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছে৷ সেটা দেখে তরিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, ‘ভয় পাবেন না স্যার৷ কোনও মুভমেন্ট করবেন না৷ লাইটগুলো এক মিনিটের জন্য বন্ধ করতে বলুন৷ তা হলেই সাপ দুটো ভ্যানিশ হয়ে যাবে৷’
মিনিট দুয়েক পর ধাতস্থ হয়ে, রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে অভিজিৎ চ্যাটার্জি বললেন, ‘আই অ্যাম রিয়েলি সারপ্রাইজড তরিতা৷ নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না, আপনার সম্পর্কে যা রটেছে, তা সত্যি৷ সাপ দুটোকে হাজির করালেন কী করে? এরা কী ধরনের সাপ?’
প্রথম প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে তরিতা বললেন, ‘স্যার, ফণাহীন সাপটা হল চন্দ্রবোড়া৷ অন্যটা কেউটে৷ এদের কামড়ে শরীরে নিওরোটক্সিক এফেক্ট হয়৷ মানে স্নায়ু বিকল হতে থাকে৷ আমাদের রাজ্যে প্রচুর মানুষ এদের কামড়ে মারা যায়৷’
অভিজিৎ চ্যাটার্জি বললেন, ‘আজ বুঝলাম, বাঁদাবনে কেন আপনার পপুলারিটি, আমার থেকেও বেশি৷ ক্যানিং থেকে হিঙ্গলগঞ্জ… সর্বত্রই দেখলাম, আপনাকে নিয়ে হোর্ডিং৷ কে যেন বলল, ইলেকশনে আপনি আমার এগেনস্টে নামলে, আমি না কি জিততে পারব না৷ সত্যি না কি?’
সিএম মিটিমিটি হাসছেন৷ উনি কি পরীক্ষা করছেন? বুঝতে না পেরে তরিতা বললেন, ‘কেন আমায় লজ্জা দিচ্ছেন স্যার৷’
‘না, না৷ সত্যিই আমি জানতে চাইছি, আপনার কখনও পলিটিকসে আসার ইচ্ছে হয় না?’
‘এখনও সে রকম ইচ্ছে নেই৷ আগে এভিএস ইউনিটটা চালু করি৷ সাধারণ মানুষের খানিকটা উপকারে আসি৷ তার পর এ সব নিয়ে ভাবব৷’
‘কিন্তু আমি যে আপনাকে পার্লামেন্ট ইলেকশনে আপনাকে দাঁড় করানোর কথা ভাবছি তরিতা৷ আমি চাই, আপনার মতো কয়েকজন ডটার অফ দ্য সয়েল, শিক্ষিত মহিলা জাতীয় রাজনীতিতে আসুক৷ সুন্দরবন নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন৷ সেটা পূরণ করার জন্য যোগ্য লোক খুঁজে পাচ্ছি না৷ এমন লোক, যার মধ্যে নতুন কিছু করার ভিশন আছে৷’
‘স্যার, আপাতত আমার স্বপ্ন এভিএস ল্যাবটা চালু করা৷’
‘করুন না৷ কে আপনাকে আটকাচ্ছে? শুনুন, মাস পাঁচেকের মধ্যে ইলেকশন ডেট অ্যানাউন্স করা হবে৷ এর মধ্যে কি আপনার পক্ষে ইউনিট চালু করা সম্ভব হবে?’
শুনে চমকে উঠলেন তরিতা৷ সিএম এ কী বলছেন! কনস্ট্রাকশনের কাজ শেষ করতেই মাস তিনেক লেগে যাবে৷ শোনপুরের মেলা থেকে ঘোড়া কিনে আনার জন্য লোক পাঠাতে হবে৷ ঘোড়ার রক্ত ছাড়া সিরাম তৈরি সম্ভব না৷ অভিজিৎ চ্যাটার্জি যাতে মনঃক্ষুণ্ণ না হন, সেই কারণেই তরিতা বললেন, ‘আপনার হেল্প পেলে সম্ভব স্যার৷ আপনাকে দেখানোর জন্য একটা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন নিয়ে এসেছি৷ সেটা দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন, প্রোজেক্টটা কী পর্যায়ে আছে৷’
‘আমাকে দেখানোর দরকার নেই৷ ওটা নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারেন, নবান্নতে আসুন৷ আমার মন্ত্রীদের সঙ্গে বসে যান৷ আমি চাই, ফেব্রুয়ারির মধ্যে ইউনিটটা আপনি চালু করে দেবেন৷ যদি ফাইনান্সিয়াল কোনও হেল্পের দরকার হয়, আমাকে বলবেন৷ আপনার সঙ্গে কোঅর্ডিনেট করবে, ঝন্টু কয়াল৷ শুয়ারটা কোথায়, কেউ ওকে ডাকুন তো৷’
মুহূর্তের মধ্যে ঘরে হাজির ঝন্টু কয়াল, ‘দাদা, আমায় ডাকছেন?’
মুখ খিঁচিয়ে উঠলেন সিএম, ‘এই হারামজাদা… তোকে আমি মন্ত্রী করেছিলাম মাল কামানোর জন্য, না কি সুন্দরবনের যাতে ডেভেলপমেন্ট হয়, তার জন্য? এই ভদ্রমহিলা এত সুন্দর একটা প্রোজেক্ট নিয়ে নেমেছেন, তুই তো কোনও মিটিংয়ে এ কথা আমায় বলিসনি?’
সিএম-এর রুদ্র মূর্তি দেখে ঝন্টু কয়াল মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে৷ দেখে তরিতা বললেন, ‘মিঃ কয়াল আমার কাছে বারতিনেক এসেছিলেন স্যার৷’
কথাটা কানেই নিলেন না সিএম৷ তিতিক্ষে মেজাজে বললেন, ‘ইউনিটের জন্য তরিতা ম্যাডামের যা যা দরকার, তুই ব্যবস্থা করে দিবি৷ কেউ বাগড়া দিলে সঙ্গেসঙ্গে তার কথা এসপি-কে জানাবি৷ আর শোন, সপ্তাহে একদিন করে তুই ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করবি৷ যদি না করিস, তা হলে নেক্সট মিনিস্ট্রি রিশাফল করার সময় তোকে লাথি মেরে তাড়াব৷ কথাটা কি মনে থাকবে?’
ঝন্টু ঘাড় নেড়ে জানাল, মনে থাকবে৷ দেখে সিএম বললেন, ‘তরিতা আমি শুনেছি, আপনি লোকাল কিছু মেয়েকে আপনার প্রোজেক্টে ইনভলভ করেছেন৷ শুনে আমার খুব ভাল লাগল৷ উইমেন্স এমপাওয়ারমেন্ট বাড়াতে হবে৷ সুযোগ না পেলে তা বাড়বে কী করে? যাক গে, আপনার আর কী দরকার আমাকে বলুন৷ এখানে আমার অফিসাররা আছেন৷ সবাইকে বলে দিচ্ছি৷’
নেত্রা ফিসফিস করে পাশ থেকে বলল, ‘দিদি, ইলেকট্রিসিটির প্রবেলেমের কথাটা তোলো৷’ শুনে ঘাড় নেড়ে তরিতা বললেন, ‘স্যার, ইলেকট্রিসিটির মারাত্মক প্রবলেম৷ দিনে অন্তত দু’বার করে কারেন্ট চলে যায়৷ আমার ল্যাব-এ যাতে কন্সট্যান্ট সাপ্লাইটা থাকে তার ব্যবস্থা করুন৷’
অভিজিৎ চ্যাটার্জি বললেন, ‘তিনমাস পর এই প্রবলেমটা থাকবে না৷ সেন্ট্রাল গভর্মেন্ট পাওয়ার সাপ্লাই বাড়ানোর ব্যবস্থা করছে৷ গোসাবায় কাজ শুরু হয়ে গেছে৷ সাতদিনের মধ্যেই ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের অফিসার পাখিরালায় গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করবেন৷ আমি বলে দিচ্ছি৷ আর কিছু?’ প্রশ্নটা শেষ করেই সিএম একবার হাতঘড়ির দিকে তাকালেন৷
স্পষ্ট ইঙ্গিত সময় শেষ হয়ে গেছে৷ ‘না স্যার৷ থ্যাঙ্কস৷’ কথাগুলো বলেই তরিতা উঠে পড়লেন৷
সিএম বললেন, ‘ইলেকশনের কথাটা মাথায় রাখবেন তরিতা৷ পার্টির তরফ থেকে পরে অফিসিয়ালি সব আপনাকে জানানো হবে৷ এখন যিনি এমপি, সেই ময়ূরী ভট্টাচার্যকে আজ আমি বলে দিচ্ছি, সেকেন্ড টাইম নমিনেশনের আশা যেন না করে৷ কেমন? আপনি রাজি তো?’
সাগর দ্বীপে মহেশ্বরজির আশ্রমে দেখা হওয়া ময়ূরী ভট্টাচার্যের মুখটা তরিতার মনে পড়ল৷ মহিলার দম্ভ চূর্ণ করার এই সুযোগ তিনি ছাড়বেন না৷ কথাটা মনে হওয়ায় তিনি বললেন, ‘ভেবে দেখব স্যার৷’
কনফারেন্স হল-এর সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসার সময়ই অমর মন্ডল বললেন, ‘সিএম-এর সব কথা আমি শুনেছি মা জননী৷ আপনাকে এমপি করার জন্য আমরা জান দিয়ে দেবো৷ বাঁদাবনে চাঁদের রাজত্ব খতম হয়ে গেল আজ থেকে৷ উফ, কী যে আনন্দ হচ্ছে, কী বলব৷’
বেলা প্রায় পাঁচটা বাজে৷ রোদ সরাসরি মুখে এসে লাগছে৷ পশ্চিমদিকের ঘাটে লঞ্চ বাঁধা আছে৷ সেদিকে এগোনোর সময় মন্দিরের সামনে একবার দাঁড়ানোর কথা ভাবলেন তরিতা৷ তখনই পিছন থেকে কে যেন ডেকে উঠল, ‘তরিতাদিদি, একটু দাঁড়ান৷’
পিছন দিকে ঘুরে অহল্যাকে দেখতে পেলেন তরিতা৷ কাছে আসতে আসতে ও বলল, ‘আমি অহল্যা৷ চিনতে পারছেন আমাকে? দিল্লির সেই অহল্যা৷’
তরিতা বললেন, ‘তোমাকে চিন্তা পারব না কেন? কিন্তু তুমি এখানে?’
পায়ে হাত দিয়ে প্রখাম করে অহল্যা বলল, ‘সে অনেক কথা৷ সুন্দরবনে একটা ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসের রিসর্ট করার কথা ভাবছি৷ সেই কারণেই সিএম-এর সঙ্গে কথা বলতে এসেছি৷ উনি রাত দশটার আগে নাকি সময় দিতে পারবেন না৷ তা, আপনি এখানে কোথায় উঠেছেন তরিতাদিদি৷ দুপুরে আপনি যখন ক্রোকোডাইল প্রোজেক্টের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আপনিই দিল্লির সেই তরিতাদিদি কি না? লোকজন আপনাকে ঢিপঢিপ করে প্রণাম করছে দেখে একটু অবাকই হয়েছিলাম৷ পরে লোকাল লোকদের মুখে আপনার অনেক প্রশংসা শুনলাম৷ সত্যি, আমি ভাবিইনি, এখানে আপনার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে৷ আপনি এখন চললেন কোথায়৷’
‘পাখিরালায় একটা রিসর্টে উঠেছি৷ তুমিও আমার সঙ্গে চলো না৷ তোমার হাতে তো এখন ঘণ্টা পাঁচেক সময় আছে৷ আমার লঞ্চ আছে৷ তোমাকে আবার রাত ন’টার মধ্যে এখানে রেখে যাবে৷’
অহল্যা বলল, ‘চলুন তা হলে৷ আপনাকে আমার ভীষণ দরকার৷’
লঞ্চে ওঠার পরও তরিতা বুঝতে পারলেন না, তাঁকে অহল্যার এত দরকার কেন? নদীপথে লঞ্চ খানিকটা এগিয়েছে পাখিরালার দিকে৷ ফরেস্ট অফিসের উঁচু টাওয়ারটা ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে৷ হঠাৎ তরিতা আবিষ্কার করলেন, অঙ্কুশ লঞ্চে নেই৷ সারা দিনে একটা কথাও বলেনি৷ কেমন যেন বদলে যাচ্ছে৷ গেল কোথায় ছেলেটা?
(ছেচল্লিশ)
নেত্রাদির পিছনে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ঘাটের দিকে এগোচ্ছিল অঙ্কুশ৷ ভিড়ের মাঝে হঠাৎ ও দেখতে পেল জয়কে৷ দয়াশঙ্করের সঙ্গে কথা বলছে৷ একটু অবাক হয়েই ও দাঁড়িয়ে পড়ল৷ আরে, চন্দ্রভানুবাবুর বডিগার্ড দয়াশঙ্করের সঙ্গে জয়ের আলাপ হল কী করে? চট করে পাইথন নিয়ে সেই রিপোর্টটার কথা ওর মনে পড়ল৷ পাইথনের বাচ্চা হওয়ার রিপোর্টটা জয় ওদের কাগজে ছবিসহ বের করেছিল৷ তাতে চন্দ্রভানু মারাত্মক চটে ছিলেন৷ জয়কে এখানে পেয়ে উনি বদলা নিতে চান নাকি? দূর থেকে অঙ্কুশ দু’জনকে লক্ষ করতে লাগল৷ না, ওদের দেখে এমন তো মনে হচ্ছে না, উপ্তত্ত বাক্য বিনিময় হচ্ছে৷ বরং, দয়াশঙ্করবাবু অনুরোধের সুরেই কথা বলছেন জয়ের সঙ্গে৷
কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর যখন জয় একা কনফারেন্স হল-এর দিকে আসছে, তখন অঙ্কুশ সামনে গিয়ে বলল, ‘তুই এখানে? কবে এলি?’
জয় বলল, ‘এত অবাক হচ্ছিস কেন? চিফ মিনিস্টারের সঙ্গে এসেছি৷ পুরো ট্যুর কভার করার জন্য৷ দু’দিন ধরে কাগজে আমার রিপোর্ট বেরোচ্ছে৷ কেন, তোর চোখে পড়েনি?’
অঙ্কুশ বলল, ‘না রে, চোখে পড়েনি৷ আমি যেখানে থাকি, সেই দয়াপুরে কাগজ পৌঁছয় মাঝ দুপুরে৷ নানা কাজে এমন ব্যস্ত থাকি, কাগজে চোখ বোলানোর টাইম থাকে না৷’
‘ওহ, দয়াপুরের চাকরিটা তা হলে তুই নিয়েছিস! তোকে এত করে মানা করলাম, তুই আমার কথা পাত্তাই দিলি না? তুই একজন স্নেক এক্সপার্ট… কত ভাল ভাল চাকরি পেতে পারতিস৷ কেন দয়াপুরের মতো একটা জায়গায় তুই পড়ে থাকবি৷ না, না অঙ্কুশ, সিএমকে বলে তোর একটা হিল্লে আমি করে দিচ্ছি৷ চল, সন্ধে বেলায় আজ গানের আসর বসবে৷ তখন সিএম-এর সঙ্গে তোর আলাপ করিয়ে দেবো৷’
অঙ্কুশ বলল, ‘না রে, তার দরকার নেই৷ দয়াপুরে একটা এভিএস ইউনিট হচ্ছে৷ সেই প্রোজেক্ট নিয়ে আমি ভালই আছি৷ তোকে ব্যস্ত হতে হবে না৷’
‘এই দাঁড়া দাঁড়া৷ তরিতা বলে সেই ভণ্ড মহিলার প্রোজেক্ট নয়তো? ওই ইউনিট আদৌও হবে কি না, আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ৷ লোকাল লোকেদের আপত্তি আছে৷ তা ছাড়া ওই মহিলা সম্পর্কে নানা কথা রটেছে৷ এখানে আসার পর থেকেই শুনছি৷’
‘কী শুনেছিস তুই?’
‘মহিলাটির সঙ্গে না কি আমেরিকার ভাল যোগাযোগ আছে৷ ইউনিট করার জন্য উনি ওখান থেকেই ডলার পাচ্ছেন৷ কথাটা কি ঠিক?’
সাতপাঁচ না ভেবেই অঙ্কুশ বলল, ‘ঠিক৷ টাকাটা আসছে আমেরিকা থেকে৷ দিচ্ছে ওখানকার এক নামী ওষুধ কোম্পানি৷ ওরাই পেটেন্ট নেবে৷ কেননা, তরিতা ম্যাডাম এমন এক ধরনের এভিএস বানাচ্ছেন, যা ইউনিক৷ বিশ্বের সব দেশে সব ধরনের স্নেক বাইটিংয়ের মোকাবিলা করতে সক্ষম৷’
‘ কিন্তু আমার কাছে তো খবর আছে, উনি সাপের বিষ চোরাপথে আমেরিকায় পাঠান৷’
‘তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে জয়? কার কাছ থেকে এই ফালতু খবর পেলি?’
‘এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চের অফিসারদের কাছ থেকে৷ রিসেন্টলি প্রায় দশ কোটি টাকার সাপের বিষ ওরা উদ্ধার করেছেন ফুটশিলিংয়ের কাছে এক ট্র্যাক থেকে৷ ভূটান হয়ে সেই বিষ পাচার করার কথা ছিল প্রথমে ফ্রান্সে, তার পর আমেরিকার মায়ামিতে৷ এনফোর্সমেন্ট অফিসারদের সন্দেহ, ওই বিষ পাঠানো হচ্ছিল এই সুন্দরবন অঞ্চল থেকে৷ খবরটা আমি আজ কাগজে ফ্ল্যাশ করে দিয়েছি৷ চিফ মিনিস্টারেরও চোখে পড়েছে৷ সকালে আমাকে ডেকে উনি জিজ্ঞেসও করেছেন, সত্যি কি না? ধরা পড়ে গেলে তোর মা তরিতা না কে, তার প্রোজেক্ট ভোগে চলে যাবে৷ মনে হয়, একটা পুলিশ এনকোয়ারি হবে৷’
শূন্য চোখে জয়ের দিকে তাকিয়ে রইল অঙ্কুশ৷ কত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাগুলো বলে যাচ্ছে৷ এই একটু আগে চিফ মিনিস্টারের সঙ্গে মিটিংয়ে ও যা শুনে এল, তা কি মিথ্যে? আরে, কী ধরনের সাংবাদিক জয়? কার মুখে কী শুনেছে, যাচাই না করেই খবরটা ছাপিয়ে দিল? দশ কোটি টাকার সাপের বিষ একসঙ্গে পাচার হচ্ছে, সম্ভব না কি? জয়ের কি ধারণা আছে, সেটা কত কোয়ান্টিটির হতে পারে? তরিতা ম্যাডামের সঙ্গে মিটিংয়ে চিফ মিনিস্টার কী আশ্বাস দিয়েছেন, সেটা অঙ্কুশ বলতে যাচ্ছিল৷ কিন্তু প্রতিবাদ না করে, নিজেকে সামলে নিয়ে ও বলল, ‘তোর খবরটা ঠিক না জয়৷ তরিতা ম্যাডামের প্রোজেক্টে ইউনেস্কোর সাপোর্ট আছে৷ উনি যদি সাকসেসফুল হন, তা হলে হিউজ কোয়ান্টিটির এভিএস ইউনেস্কো কিনে নেবে৷ হোল ওয়ার্ল্ডে আমাদের ভায়াল ছড়িয়ে যাবে৷’
‘মহিলা এইসব গালগল্প তোদের কাছে করেছেন না কি? হা হা… মহিলাকে জিজ্ঞেস করিস তো, এত জায়গা থাকতে উনি সুন্দরবনের এই অঞ্চলটা বেছে নিলেন কেন? তোর মাথায় কোনও সন্দেহ জাগেনি? এটা কি মেডিসিন ফ্যাক্টরি করার আইডিয়াল জায়গা? না রে, অন্য রহস্য আছে৷ তুই জানিস না৷’
শুনে এ বার বিরক্ত বোধ করছে অঙ্কুশ৷ এমনিতেই ওর মন নানা কারণে ডিসটার্বড৷ নগেনকাকার কাছ থেকে ওর বাবা আর মায়ের মৃত্যুর কারণ জানার পর থেকে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে৷ তার উপর বেশ কয়েকদিন ধরে চেষ্টা করেও ফোনে ও উষসীকে ধরতে পারছে না৷ টিটো কেমন আছে, জানতে পারছে না৷ নার্সিং হোম থেকে ও ছাড়া পেল কি না, তাও জানে না৷ এক ধরনের হতাশা ক্রমশই ওকে গ্রাস করছে৷ তাই যতটা সময় সম্ভব, ও নিজেকে ব্যস্ত রাখছে কনস্ট্রাকশনের কাজে৷ এভিএস ইউনিট চালু করার পিছনে তরিতা ম্যাডামের অন্য কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে, অঙ্কুশের মাথায় এল না৷ জয়ের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই৷ এখান থেকে সাপের বিষ ম্যাডাম পাঠাতেই পারেন না৷ উল্টে, মিঃ এডবেরিকে উনি রিকোয়েস্ট করেছেন, ভিন্ন প্রজাতির সাপের বিষ এখানে পাঠাতে৷ বিশেষ করে, আমেরিকা আর আফ্রিকার কিছু বিষধর সাপের৷ যা কি না রিসার্চ করার কাজে লাগবে৷
অঙ্কুশ বলল, ‘একটা ভাল প্রোজেক্টের পিছনে কাঠি দিতে যাস না জয়৷ আমি তোকে বলছি, কোনও রহস্য নেই৷ তবে, অলৌকিকত্ব থাকলেও থাকতে পারে৷ আমি যতদূর জানি, তরিতা ম্যাডাম মা মনসার স্বপ্নাদেশ পালন করছেন মাত্র৷ এখানে ইউনিট করার সিদ্ধান্তটাও সেই কারণে৷ না, না, ম্যাডামের এগেনস্টে লিখে তুই ভাল করিসনি৷ মা মনসা রুষ্ট হবেন৷ তোর ক্ষতি হয়ে যাবে ভাই৷’
শুনে হা হা করে হেসে উঠল জয়৷ বলল, ‘গ্রামে গঞ্জে এসে তুই এত বদলে গেলি কী করে অঙ্কুশ? তোকে এই একবিংশ শতাব্দীর ছেলে বলে মনে হচ্ছে না৷’
‘এই প্রসঙ্গটা বাদ দে জয়৷ ভাল কথা, তোর সঙ্গে কি পালান সর্দারের কোনও যোগাযোগ আছে?’
জয় বলল, ‘কেন থাকবে না? এই তো পালান, দিন পনেরো আগে গোপনে কলকাতায় গেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে৷ ওর কাছে দুর্দান্ত একটা এক্সক্লুসিভ খবর পেয়েছি৷ ক্রাইম স্টোরি… আমাদের কাগজে ফ্রন্ট পেজ হয়েছিল৷ আট কলাম ব্যানারে৷ আসলে কী জানিস, এই ধরনের আন্ডার ওয়ার্ল্ডের লোকদের কাছ থেকে অনেক গোপন খবর পাওয়া যায়৷ যাক গে, হঠাৎ তুই পালানের কথা জিজ্ঞেস করলি কেন বল? ওর সঙ্গে কি তোর কোনও দরকার আছে?’
‘উষসীর বাবা একবার আমার কাছে চেয়েছিলেন৷ পালানের কন্ট্রাক্ট নাম্বার কি বদলেছে?’
‘নতুন একটা নাম্বার নিয়েছে৷ দাঁড়া, এখুনি উষসীর বাবাকে মেসেজ করে দিচ্ছি৷ তুই যদি কাউকে না বলিস, তা হলে তোকে একটা গোপন কথা জানাতে পারি৷’
‘কী কথা রে?’
‘পালান এই মুহূর্তে কাছাকাছি কোথাও আছে৷ চিফ মিনিস্টারের সঙ্গে ও দেখা করতে চায়৷’
‘সিএম-এর সঙ্গে ওর কী দরকার?’
‘আরে, রুলিং পার্টির শেল্টার নিতে চায় আর কী৷ বুঝতেই তো পারছিস, পুলিশের খাতায় এরা হল, মোস্ট ওয়ান্টেড পার্সন৷ কোনও পার্টির ছত্রছায়ায় না থাকলে এরা বাইরে থাকতে পারে না৷ সেটা রুলিং পার্টি হলে সবথেকে ভাল৷ আমিই ওকে ব্যবস্থাটা করে দিচ্ছি৷ সিএম-কে রিকোয়েস্ট করেছিলাম৷ উনি বললেন, দিনের আলোয় পালানের সঙ্গে দেখা করার কোনও প্রশ্নই নেই৷ তাই মাঝ রাত্তিরে একটা টাইম ফিক্সড হয়েছে৷ পালান এই ফরেস্ট অফিসে আসবে৷ তুই যদি আমার সঙ্গে থেকে যাস, তা হলে ফের পালানের সঙ্গে তোর সঙ্গে দেখা হতে পারে৷ প্রেসের জন্য এরা খুব ভাল ব্যবস্থা করেছে৷ কী রে বল, থাকবি না কি?’
অঙ্কুশ বলল, ‘না রে, পারব না৷ আমি আজই দয়াপুরে ফিরে যাব৷ আমার মামার বাড়ি দয়াপুরে৷ সন্ধের আগে পৌঁছতে পারলে ও বাড়িতে একবার যেতে পারি৷’
‘ওকে ফাইন৷ আমি চলি রে৷ সন্ধেবেলায় সিএম আমাদের ব্রিফ করবেন৷ প্রেস কনফারেন্সে আমাকে থাকতে হবে৷ ভাল কথা, তোদের এভিএস প্রোজেক্ট নিয়ে সিএম কী বললেন রে?’
জয়কে আর বিশ্বাস করতে মন চাইছে না৷ ওকে একটা কথাও বলা ঠিক হবে না৷ তাই অঙ্কুশ বলল, ‘তরিতা ম্যাডাম আজ সিএম-এর সঙ্গে একাই দেখা করেছিলেন৷ আমি তখন কনফারেন্স হল-এর বাইরে ছিলাম৷ ওঁর সঙ্গে ম্যাডামের কী কথা হয়েছে, সেটা আমি জানি না৷’
‘জানার চেষ্টা করিস তো৷ রাত আটটা নাগাদ তোকে ফোন করব, কেমন? আচ্ছা চলি৷’
জয় কনফারেন্স হল-এর দিকে পা বাড়াতেই অঙ্কুশের মনে পড়ল, ইস তরিতা ম্যাডাম ওর জন্য নিশ্চয়ই লঞ্চে অপেক্ষা করছেন৷ উনি বিরক্তবোধ করতে পারেন৷ তরিতা ম্যাডাম আজ সত্যিই ওকে অবাক করে দিয়েছেন৷ হল-এর উজ্জ্বল আলোর নীচে কেউটে সাপ ফখা ধরে আছে… দৃশ্যটা মনে পড়তেই একটা প্রশ্ন অঙ্কুশকে কুড়ে কুড়ে খেতে লাগল৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সাপটা ওখানে এল কী করে? সাধারণত চন্দ্রবোড়া, কেউটে দিনের আলোয় বেরতে চায় না৷ ওরা নিশাচর৷ ম্যাডাম কি অলৌকিক শক্তি ধরেন? না হলে সাপ দুটোকে উনি হাজির করালেন কী করে? গোলাপি মাঝে মধ্যে বলত বটে, দাদাবাবু তুমি জানো না, মায়ের কত ক্ষমতা৷ উনিই মা মনসা৷ ঘরে মাথায় পঞ্চফণা সাপের মুকুট পরে বসে থাকেন৷ তা সম্ভব না কি? এ সব কথা শুনে অ্যাদ্দিন অঙ্কুশের বিশ্বাস হয়নি৷
‘আরে অঙ্কুশবাবু, ফোনটা আপনি বন্ধ করে রেখেছেন না কি?’
পাশ ফিরে অঙ্কুশ দেখল, প্রশ্নটা করছেন অমর মণ্ডল৷ হঠাৎ ওর খেয়াল হল, সিএম-এর মিটিংয়ে ঢোকার আগে মোবাইল ফোনটা সাইলেন্ট মোডে রেখেছিল৷ হল থেকে বেরনোর পর ওর তা মনেই পড়েনি৷ ও বলল, ‘হ্যাঁ৷ কেন বলুন তো?’
‘লঞ্চে আপনাকে না দেখে মা জননী বেশ কয়েকবার আপনাকে ফোন করেছিলেন৷ আপনি ফোন তুলছেন না দেখে উনি আমায় ফোনে ধরেন৷ কখন থেকে আপনাকে খুঁজে বেরাচ্ছি৷ এই এখন চোখে পড়ল আপনি জয় সেনগুপ্তের সঙ্গে কথা বলছেন৷’
‘হ্যাঁ, ও আমার বন্ধু৷ কিন্তু জয়কে আপনি চিনলেন কি করে?’
‘চিনতাম না৷ এখানে দেখেই ওকে ভাল করে চিনি গেছি৷ দালাল টাইপের সাংবাদিক৷ সিএম-এর সঙ্গে এখানে এসে গত দু’দিন ধরে উনি যা করে বেরাচ্ছেন, কহতব্য নয়৷ আপনার বন্ধু ওকে বলে মনে হয় না৷’
‘কী করেছে জয়?’
‘মা জননীর এগেনস্টে কাগজে বিচ্ছিরি একটা আর্টিকেল লিখেছে৷ আজ সকালে কাগজটা দেখে সিএম আমার কাছে জানতে চাইলেন, কাকে আমার কাছে নিয়ে আসছেন অমরবাবু? এই তো তরিতার নামে যাচ্ছেতাই একটা রিপোর্ট বেরিয়েছে৷ মা জননীর নামে না কি অভিযোগ উঠেছে, উনি বিদেশে সাপের বিষ পাচার করেন৷ কাগজে এই খবর পড়ে সিএম মা জননীর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করে দেন আর কী৷ আমি বললাম, এ চাঁদের কীর্তি৷ আপনি পুলিশের কাছ থেকে এখুনি খোঁজ নিন৷ সাপের বিষ পাচারের খবরটা সত্যি কী না, এক মিনিটে জেনে যাবেন৷ সিএম খোঁজ নিয়ে পরে জানতে পারেন, পাচারকারীরা নর্থ বেঙ্গলের লোক৷ তাদের অ্যারেস্টও করা হয়েছে৷’
অঙ্কুশ রেগে বলল, ‘জয় এ রকম একটা মিথ্যে খবর লিখল, তার কোনও প্রতিবাদ হবে না?’
‘সিএম সে ব্যবস্থাও করেছেন৷ কাগজের এডিটরকে ফোন করে যাচ্ছেতাই বলেছেন৷ ফলটা কী হল জানেন? জয় এখনও জানে না৷ ওকে শো কজ করা হচ্ছে৷ হয়তো চাকরিটাও চলে যেতে পারে৷’
‘আশ্চর্য, জেনে শুনে এ রকম একটা মিথ্যে খবর ছাপতে গেল কেন জয়?’
‘বললামই তো, চাঁদের কীর্তি৷ পরশু রাতে চাঁদের বডিগার্ড জয়কে সোনাখালির গেস্ট হাউসে নিয়ে গিয়েছিল৷ মাল খাইয়েছে, মালও দিয়েছে৷ খবরটা জেনে সিএম এত রেগে গেছেন, অর্ডার দিয়েছেন, জয় সেনগুপ্তকে এখুনি আমার গেস্ট লিস্ট থেকে বাদ দিয়ে দিন৷ আমার প্রেস কনফারেন্সে ও যেন না আসে৷ যাক গে, ফালতু লোককে নিয়ে কথা বলে লাভ নেই৷ আপনি কী করবেন বলুন? মা জননীরা তো পাখিরালায় চলে গেছেন৷ আপনি কি ওখানে যাবেন, না কি দয়াপুরে?’
‘তা হলে তরিতা ম্যাডামের সঙ্গে আগে একবার কথা বলে নিই৷’
‘বলে দেখুন৷ একটু পরেই একটা লঞ্চ কয়েকজন গেস্টকে আনতে দয়াপুরের টাইগার ক্যাম্পে যাবে৷ ইচ্ছে করলে আপনি ওই লঞ্চে চলে যেতে পারেন৷ আমি ওয়েট করছি৷ ততক্ষণে মা জননীর সঙ্গে আপনি যা বলার বলে নিন৷’
ফোন খুলে অঙ্কুশ দ্রুত কথা বলে নিল তরিতা ম্যাডামের সঙ্গে, ‘ম্যাডাম সরি৷’
‘এখন আর সরি বলে লাভ কী?’
‘আমাকে কি পাখিরালায় যেতে হবে?’
‘এসে লাভ নেই৷ গোলাপির বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে কাল সকালেই আমি দয়াপুরে যাব৷ তা ছাড়া আমি নিজে দেখতে চাই, কনস্ট্রাকশনের কাজ কদ্দূর এগিয়েছে৷ তুমি বরং সরাসরি দয়াপুরে চলে যাও৷ কাল দুপুরে তোমার সঙ্গে দেখা হবে৷’
ফোন বন্ধ করে অঙ্কুশ বলল, ‘অমরবাবু, আমাকে দয়াপুরের লঞ্চেই তুলে দিন৷’
… মিনিট কুড়ি পর দয়াপুরে টাইগার ক্যাম্পের ঘাটে পৌঁছে অঙ্কুশ দেখল, একটাই সাইকেল ভ্যান রিকশা দাঁড়িয়ে আছে৷ ও জানে, সাত-আটজন প্যাসেঞ্জার না হলে ভ্যান রিকশা ছাড়বে না৷ ঘাটের সিঁড়িতে বসে ও পশ্চিমে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল৷ প্রায় সন্ধে ছ’টা৷ সূর্য গাছের আড়ালে নেমে গেছে৷ পুরো আকাশটায় এখন সিঁদূরে রং৷ সজনেখালির দিকে নদীর জলেও সেই রং৷ জঙ্গলের দিক থেকে পাখিরা দলে দলে উড়ে আসছে৷ আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসবে৷ ঘাটে প্রতীক্ষা করার সময় অঙ্কুশ ঠিক করতে পারল না, ও দয়াপুরের বাজারে মামার বাড়ি অবধি যাবে? না কি কনস্ট্রাকশন সাইটে চলে যাবে৷ বাড়ি সংস্কারের কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে৷ দু’একদিনের মধ্যে কলকাতা থেকে ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের জন্য মিস্ত্রিরা এসে যাবে৷ সাপ রাখার জন্য তরিতা ম্যাডাম যে হলঘরের কথা ভাবছেন, সেটা সবথেকে আগে তৈরি করার কথা উনি বলে দিয়েছেন৷
ঘাটে বসে অঙ্কুশ ভাবতে লাগল, আগে কনস্ট্রাকশন সাইটে না গিয়ে, ওর মামার বাড়িতে গেলে কেমন হয়? দাদু সদানন্দ বসুর বাড়ি খুঁজে নিতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়৷ কিন্তু, বাড়িতে এখন কে কে আছেন, সেদিন নিবারণদার কাছ থেকে তা জানা হয়নি৷ এতদিন পরে ওই বাড়িতে গেলে ওঁরা কেমনভাবে নেবেন, তা বুঝতে পারছে না অঙ্কুশ৷ সাহসটাই সঞ্চয় করে উঠতে পারছে না৷ বড়মায়ের শ্রাদ্ধে পিয়ারাতে এসেছিলেন মায়ের এক বান্ধবী৷ ইস, তখন যদি অঙ্কুশ এ সব কথা জানত, তা হলে তাঁর কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে নিতে পারত৷ ও তো তখন জানতই না, ওর বাবা-মায়ের মৃত্যুর কারণ পালান সর্দার৷ বারবার ওর মনে পড়ছে, ঝড়খালির কাটা জঙ্গলে লোকটার কাছে জয় জানতে চেয়েছিল, আপনার কোনও সন্তানাদি হয়নি? পালান তখন আক্ষেপ করে বলেছিল, ‘ডাকাইতি কইরতে গে দয়াপুরে এগবার গর্ভবতী মেয়াছেলার পেটে লাথি মেইরে পাপ কইরে ছিলাম৷ ভগমান আমায় সন্তান দিবেন ক্যান?’ সেই মেয়াছেলাটা যে ওর মা, সেটা জানার পর থেকে অঙ্কুশ আক্রোশে ফুলছে৷
কখন যে খেয়াঘাটে একটা নৌকো এসে ভিড়েছে, অঙ্কুশ টেরও পায়নি৷ ভ্যানচালকের কথায় ওর চমক ভাঙল, ‘বাবু, হেড়োভাঙায় যাবেন তো উইঠে বসেন৷’
অঙ্কুশ তাকিয়ে দেখল পাঁচ-ছ’জন প্যাসেঞ্জার সাইকেল ভ্যানে উঠে পড়েছে৷ পা ঝুলিয়ে ও ভ্যানের পিছন দিকে বসতে না বসতেই ওর মোবাইল ফোনটা বাজতে শুরু করল৷ ম্যাডাম না কি? বুক পকেট থেকে সেটটা তুলে নিয়ে ও দেখল, পর্দায় তিন্নির নাম৷ এতদিন পরে, হঠাৎ? বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর থেকে ওর সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ নেই৷ অঙ্কুশ জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছ, তিন্নি?’
‘স্যার একটা সুখবর আছে৷ সেই কারণেই ফোনটা করলাম৷ আজ আমার রেজাল্ট বেরিয়েছে৷ ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি৷ আপনি হেল্প না করলে স্যার আমি, এই রেজাল্ট করতে পারতাম না৷’
অঙ্কুশ খুশি হয়ে বলল, ‘সত্যিই ভাল খবর৷ এ বার কী করতে চাও?’
‘স্যার, বাবা বললেন, আপনার সঙ্গে একবার কনসাল্ট করতে৷ উনি চান, বিদেশে গিয়ে আমি আরও পড়াশুনা করি৷ আপনি কি আমাকে হেল্প করতে পারবেন? বাবা আপনার অ্যাড্রেসটা জানতে চাইছিলেন৷ আপনার কাছে গিয়ে সরাসরি কথা বলতে চান৷ আমারও তা হলে সুন্দরবন ঘোরা হয়ে যাবে৷’
অঙ্কুশ সহজ ভাবে বুঝিয়ে দিল, দয়াপুরে কীভাবে আসতে হবে৷ গাড়িতে করে গদখালি৷ সেখানে গ্যারাজে গাড়ি রেখে খেয়াঘাটে কোনও লঞ্চ ধরে নিলে দয়াপুর টাইগার ক্যাম্প ঘাটে পৌঁছে যাওয়া যাবে৷ আগে থেকে বলে রাখলে রিসর্টে ঘর পেতে অসুবিধে নেই৷ কিন্তু তিন্নি কোনও বিদেশি ইউনিভার্সিটির খোঁজ চাইছে৷ চট করে অঙ্কুশের মনে পড়ে গেল তরিতা ম্যাডামের কথা৷ বহু বছর আমেরিকায় ছিলেন৷ তিন্নির কথা বললে, উনি নিশ্চয় একটা না একটা ভাল সাজেশন দিতে পারবেন৷ তাই অঙ্কুশ বলল, ‘আমাকে একটু ভেবে বলতে হবে৷ তুমি বরং চলে এসো৷ তরিতা ম্যাডামের সঙ্গে তোমার আলাপও হয়ে যাবে৷ কিন্তু, তুমি আমার এই নতুন ফোন নাম্বারটা পেলে কোথায় তিন্নি?’
‘ আমি জানতাম না, আপনি পুরনো নাম্বারটা আর ইউজ করছেন না৷ তাই উষসীদির কাছে চেয়ে নিলাম৷’
‘তোমার উষসীদির খবর কি ?’
‘দিদিরও একটা দারুণ খবর আছে স্যার৷ না, না, একটা নয় দুটো৷’
‘কী খবর তিন্নি?’
‘পাইথনের বাচ্চা হওয়ার যে ছবিগুলো উষসীদি তুলেছিল, তার মধ্যে একটা আমেরিকায় ইন্টারন্যাশনাল ফোটোগ্রাফিক একজিবিশনে ফার্স্ট হয়েছে স্যার৷ আমি জানি, আপনি হেল্প না করলে দিদি ওই ছবি তুলতেই পারত না৷ ছবির পুরো সিরিজটা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল প্রচুর ডলার দিয়ে কিনে নিয়েছে৷ দিদি প্রাইজ নিতে আমেরিকায় যাচ্ছে৷ কেন, দিদি কি আপনাকে কিছুই জানায়নি?’
‘না৷ বেশ কয়েকদিন ফোনে ওকে ধরার চেষ্টা করছি৷ কিন্তু পাচ্ছি না৷ ’
‘আশ্চর্য, দিদি কিন্তু আমাকে সেদিন বলল, আপনাকে খবরটা জয়দা দিয়েছে৷’
‘যাক, প্রথম ভাল খবরটা তো শুনলাম৷ দ্বিতীয় ভাল খবরটা কী?’
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে তিন্নি বলল, ‘ উষসীদির বিয়ে৷ শুনলে আপনি খুশি হবেন৷ বিয়েটা হচ্ছে জয়দার সঙ্গে৷ কেন, জয়দার মুখে কি কিছুই শোনেননি?’
কথাটা বুকের ভিতর এসে ধাক্কা মারল অঙ্কুশের৷ এই ঘণ্টাখানেক আগে জয় সজনেখালিতে এত কথা বলল, অথচ আসল খবরটাই দিল না! ও-ই জয়ের সঙ্গে উষসীর যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল৷ পাইথনের ছবি দেওয়া-নেওয়ার সময় নিশ্চয়ই জয়ের সঙ্গে উষসীর বারকয়েক দেখা হয়৷ তার পরই বোধহয় পরিচয়টা প্রেম পর্বে পৌঁছয়৷ কিন্তু জয়ের মধ্যে উষসী এমন কী দেখল যে, এত কম সময়ে বিয়ের সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল? পরক্ষণেই অঙ্কুশের মনে হল, জয়ের মতো ছেলেরা চালিয়াতি মারতে ওস্তাদ৷ ওরা শর্টকাট রাস্তায় অনেক কম সময়ে অনেক দূরে পৌঁছতে পারে৷ কিন্তু জয়কে নিয়ে পরে ভাবা যাবে৷ ও প্রান্তে উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছে তিন্নি৷ তাই অঙ্কুশ বলল, ‘জয় আমাকে বলবে নিশ্চয়৷ আসলে কী জানো, আমি যেখানে থাকি, সেখানে ফোনের টাওয়ার মাঝে মধ্যে কাজ করে না৷ সেজন্যই হয়তো আমায় পায়নি৷ কিন্তু উষসীকে তুমি বোলে দিও, বিয়ের খবরটা শুনে আমি খুব খুশি৷’
আর একটা কথাও বলতে চাইল না অঙ্কুশ৷ বুকের ভেতরটায় মারাত্মক কষ্ট হচ্ছে৷ ফোনের লাইনটা ও কেটে দিল৷ ওর ভয় হল, পাছে আর একটা কথা বললে, ওর কষ্টটা তিন্নি বুঝতে পেরে যাবে৷
(সাতচল্লিশ)
রায়দীঘির নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছেন চন্দ্রভানু৷ ব্লাড প্রেসার একশো আশি আর একশো৷ সুগার তিনশোর কাছাকাছি৷ কঙ্কণদীঘির বাড়িতেই মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলেন৷ ডাক্তার বললেন, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট৷ নার্সিং হোমে ভর্তি করতে হবে৷ কোনও কারণে বেশি টেনশন হলে মানুষের এ রকম হয়৷ লক্ষ রাখবেন, চন্দ্রভানুবাবু যেন টেনশন থেকে শতহস্ত দূরে থাকেন৷ নার্সিং হোমে বাড়ির লোকজন আর মন্টু ভক্তা ছাড়া সনকা আর কাউকেই দেখা করতে দিচ্ছে না৷ বাইরের কোনও খবর যাতে স্বামীর কাছে না পৌঁছয়, তার দিকে কড়া নজর রাখছে৷ এমনকী, রাত্তিরবেলাতেও সনকা নার্সিং হোমে থেকে যাচ্ছে৷ আর মনে মনে মা মনসার কাছে প্রার্থনা করছে, বিপদমুক্ত করো মা৷
সজনেখালি থেকে সেদিন গভীর রাতে বাড়ি ফিরে আসার পর থেকেই চন্দ্রভানুর এই শারীরিক অবস্থা৷ চিফ মিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করার আশায়, সারাটা দিন ফরেস্ট অফিসের বাইরে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ তার অবশ্য দরকার ছিল না৷ মন্টু একবার বলেওছিল, লঞ্চে গিয়ে বিশ্রাম নিতে৷ কিন্তু চন্দ্রভানু রাজি হননি৷ বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি পার্টির লোকজনকে চিনে নিতে চাইছিলেন৷ অবস্থা যখন খারাপ হয়, তখন ব্যাঙেও লাথি মারে৷ কেউ বোধহয় রটিয়ে দিয়েছে, চাঁদবাবু আর সিএম-এর নেকনজরে নেই৷ ব্যস, আগে যাঁরা দুটো কথা বললে ধন্য হয়ে যেত, তারাই তখন মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে৷ এই অপমান মুখ বেঁজে সহ্য করেছেন চন্দ্রভানু৷ সন্ধেবেলায় কলকাতার আর্টিস্টরা জলসা করলেন৷ শেষে সিএম-এর কাছে ডাক পড়ল রাত্তির এগারোটার সময়৷ রিসর্টের প্রোজেক্টটা উনি অ্যাপ্রুভ করে দিয়েছেন৷ কিন্তু, সেইসঙ্গে সাবধান করে দিয়েছেন, জোর জবরদস্তি করে জমি নেওয়া পছন্দ করবেন না৷
এটা নিশ্চিত, সিএম তাঁর উপর কোনও কারণে চটেছেন৷ কে কানভাঙানির কাজটা করেছেন, সেটাও চন্দ্রভানু জানেন৷ মহেশপুরের অমর মণ্ডল৷ লোকটার টাকা-পয়সার জোর নেই৷ অথচ পার্টির নেতাদের হাত করল কী করে চন্দ্রভানু আন্দাজ করতে পারছেন না৷ এমনও নয়, অমর ব্যাটাচ্ছেলে কলকাতায় গিয়ে দিনরাত্তির পার্টির হেড কোয়াটার্সে গিয়ে পড়ে থাকে৷ শুয়ারটার একটা গুণ অবশ্য আছে৷ লেখাপড়া জানা৷ লেখালেখির কাজটা খুব ভাল পারে৷ অমর মণ্ডল যখন মৎস্যজীবী সমিতির ট্রেজারার ছিল, তখন চন্দ্রভানু দেখেছেন, চট করে ইংরেজিতে দু’পাতা লিখে দিতে পারত৷ এবং তা আইনি মারপ্যাঁচ দিয়ে৷ ওর আরেকটা গুণ, হান্ড্রেড পারসেন্ট সৎ৷ টাকা পয়সার বিনিময়ে কোনও কাজ করে না৷ নিজের বলতে বিশেষ কেউ নেই৷ একটা ছেলে, সে না কি বেঙ্গালুরুতে ভাল চাকরি করে৷ ফলে, ওর হাতে অখণ্ড সময়৷ লোকের আপদ-বিপদে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়৷ মহেশপুর অঞ্চলে লোকে ওর কথায় ওঠে বসে৷ শোনা কথা, শোলাশিল্পীদের আর্থিক উন্নতির জন্য ও অনেক কিছু করেওছে৷
অমর মন্ডলকে নিয়ে চন্দ্রভানু আজ পর্যন্ত তেমন মাথা ঘামাননি৷ কিন্তু, সিএম-এর সুন্দরবন সফরের পর থেকে ব্যাটাচ্ছেলে ভাবাচ্ছে৷ তরিতার সঙ্গে ওর এমন পীরিত হল কী করে, সেটা জানার জন্য খোঁজ নিতে
বলেছিলেন দয়াশঙ্করকে৷ সে পাঁঠাটা এসে বলেছিল, মা মনসার পুজোর কারণে৷ পরে মন্টুও কথাটায় সায় দিয়েছিল৷ মন্টুর সঙ্গে না কি অমর মণ্ডলের আত্মীয়তার সম্পর্ক৷ সেটা অবশ্য সত্যবতীর দিক থেকে৷ একদিন সোনাখালির গেস্ট হাউসে যৌনসম্পর্কের পর সত্যবতীর মুখ গোমড়া দেখে, কারণটা জানতে চেয়েছিলেন চন্দ্রভানু৷ তখন সত্যবতী বলে, অমরদাদা ওকে গেস্ট হাউসে ঢুকতে দেখেছে৷ অবৈধ সম্পর্কের কথাটা আর চাপা থাকবে না৷ আত্মীয়দের মধ্যে জানাজানি হয়ে যাবে৷ পরে কিন্তু তেমন কিছু হয়নি৷
নার্সিং হোমে থাকতে আর ভাল লাগছে না চন্দ্রভানুর৷ তাঁর মাথায় এখন হাজারো চিন্তা৷ জয়গোপালের জেল কাস্টোডির মেয়াদ শেষ হচ্ছে দু’একদিনের মধ্যে৷ মন্টু ছোটাছুটি করছে ল’ইয়ার বিমল মুখার্জির কাছে৷ ভদ্রলোক প্রথম দিকে যতটা ভরসা দিয়েছিলেন, তার থেকে এখন অনেকটাই পিছু হটে এসেছেন৷ বসিরহাট কোর্টের পিপি-র সঙ্গে কথা বলেও কোনও লাভ হয়নি৷ লোকটা হাজার কুড়ি টাকা গিলে বসে আছে৷ এখন বলছে, পুলিশের চার্জশিটটাই ভাইটাল হয়ে দাঁড়াবে৷ আপনারা দেখুন, জয়গোপালবাবুর নামটা যেন চার্জশিটে না থাকে৷ থানার ওসিও খেলাচ্ছেন৷ ভেড়ি চালানোর জন্য এমনিতেই লোকটার জন্য প্রতি মাসে খাম পাঠাতে হয়৷ খুনের ঘটনার পর লোকটার খাঁই দ্বিগুণ বেড়ে গেছে৷ জয়গোপাল কবে জামিন পাবে, তার নিশ্চয়তা নেই৷ বড় বউমা জয়িতার দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারছেন না চন্দ্রভানু৷
সকালের দিকে রোজই মন্টু একবার করে আসে দেখা করতে৷ আজ যখন ও এল, তখন ঘরে অহল্যা বসে ফল কেটে দিচ্ছে৷ ঘরে ঢুকেই মন্টু বলল, ‘আকাশের অবস্থা ভাল লয় রে চাঁদ৷ টিভি-র খবরে শুনলাম, সাইক্লোন হতে পারে৷’
কাল বিকেল থেকেই আকাশের মুখ ভার৷ নার্সিং হোমের ঘরে বসেই চন্দ্রভানু তা টের পেয়েছেন৷ সুন্দরবন অঞ্চলে জল-ঝড় নিত্যনৈমত্যিক ঘটনা৷ মন্টুর সঙ্গে রসিকতা করার জন্যই তিনি বললেন, ‘তোর তাতে কী৷ তুই তো আর কাঁকড়া ধরতে বেরোসনি৷’
‘না রে৷ বাইরে ফরেস্টবাবুর সঙ্গে এইমাত্তর দেকা হল৷ ওনার কে যেন ভর্তি আচেন একানে৷ উনি কইলেন, সাগর থেকে সব ট্রলারকে ওনারা ফিরে আইসতে কয়েচেন৷ দু’একদিনের মধ্যি৷’
শুনে চিন্তার ভাঁজ পড়ল চন্দ্রভানুর কপালে৷ এ বার মাঝ মরশুমে ইলিশের আকাল হওয়ায় মাছের ব্যবসা ভাল জমেনি৷ সেপ্টেম্বরের পর ইলিশ আর পাওয়া যাবে না৷ শেষবেলায় তাই সাতটা ট্রলার সঙ্গে দিয়ে তিনি ছোট খোকাকে সমুদ্রে পাঠিয়েছিলেন৷ সেও দিন দশেক আগে৷ ম্যানেজার অঘোরবাবু মাঝে একদিন খুশির খবর দিয়ে গেছেন৷ বলে গেছেন, গভীর সমুদ্রে ইলিশের ঝাঁক দেখা গেছে৷ ট্রলার ভর্তি হয়ে গেলেই একসঙ্গে সবাই ফিরে আসবে৷ অহল্যার সঙ্গে ছোট খোকার রোজই স্যাটেলাইট ফোনে কথাবার্তা হয়৷ গতকালই ছোট বউমা বলেছিল, ছোট খোকা নাকি বলেছে, ভাল ক্যাচ হয়েছে৷ গোড়ার দিকে ব্যবসায় যত লস হয়েছে, তার অনেকটাই মেকআপ হয়ে যাবে৷ কিন্তু, মন্টু এসে যা বলছে, তাতে চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে৷ সাইক্লোনের জন্য ফি বছর দু’একটা ট্রলার ডুবে যায়৷ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে৷
চন্দ্রভানু বললেন, ‘ছোট খোকার সঙ্গে কথা বলে দ্যাখ না মন্টু৷ অ্যাখন ওরা রায়দীঘি থেকে কদ্দূরে আছে? একবার ফোন করলেও তো পারিস৷’
শুনে অহল্যা বলল, ‘কাল রাতেই আমার সঙ্গে আপনার ছেলের কথা হয়েছে বাবা৷ ওরা মোহনার কাছাকাছি চলে এসেছে৷ আপনাকে চিন্তা করতে হবে না৷’
মন্টু বলল, ‘ আরে, ঝড়জলে আমরা একবার কী র’ম বেপদে পড়েছিলুম তোর মনে আছে চাঁদ? ছোট বউমাকে সেই রাত্তিরডার কতা ক’৷’
চন্দ্রভানু হাসিমুখে অহল্যার দিকে তাকালেন৷ তার পর বললেন, ‘মনে আবার থাকবে না! কী বলচিস মন্টু৷ বুঝলে ছোট বউমা, সে বহুকাল আগের কথা৷ মধু আনতে আমরা জঙ্গলে ঢুকেছিলুম৷ পেটকূলচাঁদ নদীতে নৌকো রেখে৷ সন্ধেবেলার দিকে মারাত্মক মেঘ করে এল৷ ফিরে আসার তাগিদে আমরা তাড়াতাড়ি নৌকোয় উঠে পড়লুম৷ উরি ববাস, তাপ্পরই তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল৷ আমাদের নৌকো বাইবাই করে ঘুরতে শুরু করল৷ দু’জনে মিলে কন্ট্রোলে রাখতে পারছি না৷ ঝোড়ো বাতাসে নৌকো শেষ পর্যন্ত উল্টে গেল৷ জলের টানে মন্টু একদিকে চলে গেল৷ আমি অন্যদিকে৷ আমরা ডুবেই যাচিচলাম৷ কোনও রকমে ভেসে যাওয়া একটা কাঠের গুঁড়ি আমরা ধরে ফেললাম৷ ভাসতে ভাসতে একটা সময় স্রোতের টান দেখে, বুঝতে পারলাম, আমরা মাতলা নদীতে ঢুকে পড়েছি৷’
মন্টু সংযোজন করল, ‘আকাশ চিরে বিদ্যুৎ চমকাচিচল মা৷ অঝোরে সে কী বৃষ্টি৷ অন্ধকারে ঠাওর কইরতে পাচিচলাম না, ডাঙা কদ্দূরে৷’
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে চন্দ্রভানু বলতে লাগলেন, ‘জানো বউমা, সারাটা রাত্তির কাঠের গুঁড়ি ধরে শুধু ভেসে ছিলাম৷ বাঁচার আশা ছিল না৷ পঁচিশ-তিরিশ বছর আগে মাতলা নদীর রূপ যে কী ভয়ঙ্কর ছিল, তোমরা ভাবতেও পারবে না৷ একেবারে উথাল পাথাল হয়ে মোহনার দিকে ছুটত৷ এ পারে কুলতলি থেকে ও পারে ঝড়খালি দেখা যেত না… এত্ত বিশাল৷ সে রাত্তিরে আমরা কুমিরের পেটেও যেতে পারতুম৷ বাবা মহাদেব কাঠের গুঁডিটা পাঠিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে ছিলেন৷ উফ, এখন এত বড় বড় ট্রলার, রেডিওর খবর, স্যাটেলাইট ফোন… এ সবের কথা তখন আমরা ভাবতে পারতুম না কি? মাছ ধরা তখন এখনকার মতোন ছেলেখেলা ছিল না৷ খাওয়া নেই, দাওয়া নেই৷ পরদিন আমরা কোনও রকমে কঙ্কণদীঘিতে ফিরে আসি৷’
অহল্যা জিজ্ঞেস করল, ‘পুরো সময়টা জলে ছিলেন না কি?’
উত্তরটা দিল মন্টু, ‘সেও অ্যাক আশ্চর্যির ঘটনা৷ শোনো শউরমশাইয়ের মুখে৷’
‘আশ্চর্য বলে আশ্চর্য! শেষ রাত্তিরে বৃষ্টিটা সবে ধরেছে৷ মাতলার জলে ভাসতে ভাসতে আমরা দেখি, দূরে একটা গ্রামে ঢাক -ঢোল পিটিয়ে পুজো হচ্ছে৷ প্রদীপ জ্বলছে৷ আমরা ভাবলাম, যাক, নিশ্চিন্দি৷ লোকালয় তো পাওয়া গেল৷ বোঝা যাবে, বাঁদাবনের কোন জায়গায় ছিটকে এসেছি৷ মন্টু নৌকো চালানোয় এক্সপার্ট লোক৷ কাঠের গুঁড়িটাকে নানা কায়দায় পারে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল৷ কাদা পেরিয়ে আমরা গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করলাম৷ ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয় বউমা, আমরা যতই ডাঙার দিকে এগোচ্ছি, ততই দেখি লোকালয় দূরে সরে যাচ্ছে৷ তখনই বুঝতে পারলাম, ভুতুড়ে গাঁয়ে ঢুকে পড়েছি৷’
অহল্যার কৌতূহল বেড়ে গেছে৷ জিজ্ঞেস করল, ‘এ রকম ভুতূড়ে গাঁ এখানে আছে না কি?’
‘আকচার দেখা যায়৷ আসলে কী জানো, এই বাঁদাবনে অনেকবার সুনামির মতো ঘটনা ঘটেছিল৷ গ্রামকে গ্রাম জলের তলায় চলে গেছে৷ লোকজন প্রেতাত্মা হয়ে ঘুরে বেড়ায়৷ কোর এরিয়ায় এমন অনেক আইল্যান্ডস আছে, বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে সেই লোকালয় জেগে ওঠে৷ আমরাও এ রকম একটা জায়গার পাল্লায় পড়েছিলুম৷ মন্টুই বলেছিল, চাঁদ আর বেশিদূর যাস না৷ এগোনোর মতো সাহস আর ক্ষমতাও তখন ছিল না৷ বুঝতে পেরে দু’জনেই নদীর কাছাকাছি এসে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম৷
‘তার পর কী হল বাবা?’
‘ভোরে মাছ ধরতে বেরিয়েছিল জেলেরা৷ ওরাই আমাদের উদ্ধার করে৷’
কথাটা শেষ করার পরই চন্দ্রভানু দেখলেন, পর্দা সরিয়ে সনকা ঘরে খুকছে৷ তিনজনকে গল্প করতে দেখে ওর মুখটা প্রসন্ন হয়ে উঠল৷ সকালের দিকে সনকা কঙ্কণদীঘিতে চলে যায়৷ শিব মন্দিরে পুজো-আচ্চার পর এই সময়টায় ফিরে আসে৷ উদ্বেগে সনকার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে৷ তবুও, রূপে ভাঁটা পড়েনি৷ মন্টু ঠিকই বলত, তোর ঘরে অমন সতী লক্ষী বউ থাকতে অন্যের ঘরের বউ টানাটানি করিস কেন? এর উত্তর দিতে যাওয়াই বোকামি৷ সতী লক্ষী বউদের নিয়ে ফূর্তি করা যায় না কি? ব্যাটা গাঁইয়া ভূত৷ নিজের বউটাকেই ভোগ করতে পারল না৷ অন্যের বউ কেন টানাটানি করতে হয়, ও তা জানবে কী করে?
অন্য দিনের মতোই পুজোর ফুল কপালে ছুঁইয়ে সনকা জিজ্ঞেস করল, ‘ আজ কেমন বোধ করছ৷’
‘বুকের ধড়ফড়ানিটা নেই৷ এখন বাড়ি যেতে পারলে বাঁচি৷’ মুখ ফিরিয়ে চন্দ্রভানু বললেন, ‘ এই ডাক্তারটাও হয়েছে তেমন৷ জানিস মন্টু, কাল সন্ধেবেলাতেও ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, কবে ছাড়বেন? চালাকি করে কথাটা এড়িয়ে গেল৷’
মন্টু বলল, ‘তোর এত হড়বড়ানির কী আচে? ডাক্তার যকন বুঝবেন, তখন ছাড়বেন৷’
চন্দ্রভানু বললেন, ‘চারদিকে এত সমস্যা৷ শুয়ে থাকতে ভাল লাগে, বল৷ ছেলেটা জেলে আটকে আছে৷ ব্যাঙ্ক থেকে রোজ চিঠির পর চিঠি আসছে৷ লোন শোধ করার জন্য তাগাদা দিচ্ছে৷ চিংড়ির বিজনেসটা লাটে উঠে গেল৷ ফার্ম হাউসটার কী হবে …’
চন্দ্রভানু কথা শেষ করার আগে সনকা বলে উঠল, ‘থাক, তোমাকে এ নিয়ে এখন ভাবতে হবে না৷ শোনো, উকিলবাবুকে দেখলাম, রিসেপশনে কথা বলছেন৷ হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছেন৷ মনে হয়, তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান৷’
উকিলবাবু মানে… বারুইপুরের দেবাংশুবাবু৷ শুনে মন্টুর দিকে তাকালেন চন্দ্রভানু৷ বারুইপুর থেকে এখানে? এই তো সেদিন সাপের ভয়ে আসতে চাইছিলেন না৷ উনি আবার কী দুঃসংবাদ নিয়ে এলেন? ভেবে চন্দ্রভানু বললেন, ‘মন্টু, তুই যা৷ নীচে গিয়ে উকিলবাবুকে নিয়ে আয়৷’
মন্টু উঠে যাওয়ার পর অহল্যা বলল, ‘ভদ্রলোক খুব ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার, তাই না বাবা? জানেন না, হেন বিষয় নেই৷’
‘সেদিন বারুইপুরে তুমি ওকে খুব জব্দ করেছিলে মা৷ হা হা হা…’
‘না বাবা৷ পরে আমার নিজেরই খুব খারাপ লাগছিল৷ আমার সল্ট লেকের ফুড জয়েন্টে বিকাশ চাকলাদার বলে এক ভদ্রলোক প্রায়ই উইক এন্ড-এ ফ্যামিলি নিয়ে খেতে আসেন৷ উনি বারুইপুর কোর্টে প্র্যাকটিস করেন৷ সেদিন বারুইপুর কোর্টে বোধহয় আমাকে দেখে থাকবেন৷ মাঝে আমায় জিজ্ঞেস করছিলেন, কেন কোর্টে গেছিলাম? কথায় কথায় দেবাংশুবাবুর প্রসঙ্গ উঠেছিল৷ দেখলাম, উনি প্রচণ্ড রেসপেক্ট করেন দেবাংশুবাবুকে৷ বললেন, দেবাংশুবাবু বাংলায় এমএ৷ কোন কলেজে নাকি আগে পড়াতেন৷ পরে ল’পাস করে ওকালতি শুরু করেন৷ মামলায় যাতে জিততে পারেন, সেই কারণে নানা সাবজেক্ট নিয়ে উনি প্রচুর পড়াশুনো করেন৷ ওঁর আর্গুমেন্ট না কি জজসাহেবরা খুব মন দিয়ে শোনেন…’
অহল্যার কথা শেষ হতে না হতেই দেবাংশুবাবুকে নিয়ে ঘরে ঢুকে এল মন্টু৷ ফুলের বোকে এগিয়ে দিয়ে দেবাংশুবাবু বললেন, ‘গেট ওয়েল সুন চন্দ্রভানুবাবু৷ আমি গত কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলাম, দেখতে আসব৷ কিন্তু সময় করে উঠতে পারছিলাম না৷’
চন্দ্রভানু বললেন, ‘কী দরকার ছিল, অ্যাদ্দূর ছুটে আসার? ফোনে খবর নিলেই তো পারতেন৷ আমি ভালই আছি৷’
‘কী হয়েছিল আপনার? কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, না কি হার্ট অ্যাটাক? দুটো জিনিস কিন্তু এক না৷ অনেক সময় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট আর হার্ট অ্যাটাকের মধ্যে আমরা গুলিয়ে ফেলি৷’
এই রে, দেবাংশুবাবু আবার শুরু করে দিলেন! এ বার ডাক্তারি ব্যাখ্যা দিতে শুরু করবেন৷ রোগ-ভোগ নিয়ে আলোচনা করতে মন চাইল না চন্দ্রভানুর৷ বললেন, ‘আমার কিচ্ছু হয়নি৷ মাথার উপর বাবা মহাদেব আছেন৷ সিরিয়াস কিছু হলে উনিই আমায় রক্ষা করবেন৷’
‘আপনার এই জিনিসটা আমার ভাল লাগে চন্দ্রভানুবাবু৷ দেব-দ্বিজে ভক্তি৷ শিব মাহাত্ম্য প্রচারে আপনি যা খরচ করেন, ভাবা যায় না৷’
অহল্যা জিজ্ঞেস করল, ‘কেন, আপনি দেব-দেবীতে বিশ্বাস করেন না?’
দেবাংশুবাবু বললেন, ‘একেবারে বিশ্বাস করি না, বলাটা ভুল৷ তবে অন্ধ ভক্তি বলতে যা বোঝায়, তা আমার নেই৷ শোনো মা অহল্যা, একদিকে বলা হবে, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়ম৷ আবার অন্যদিকে, তেত্রিশ কোটি দেব- দেবীকেও হাজির করানো হবে৷ এর মধ্যে আমি কোনও লজিক খুঁজে পাই না৷ তবে হ্যাঁ, যাঁরা ভক্তিশ্রদ্ধা করেন, তাঁদের প্রতিও আমার কোনও বিদ্বেষ নেই৷ আমি চন্দ্রভানুবাবুর শিবরাত্রির অনুষ্ঠানে যেতে রাজি আছি ৷ আবার মা তরিতার মনসা পুজোতেও৷’
‘মা তরিতাকে আপনি চেনেন না কি?’
‘প্রথমে বারুইপুরে একবার তাঁকে দেখি৷ কয়েকদিন আগে পাখিরালায় ভাল পরিচয় হল৷ উনি জমি সংক্রান্ত মামলায় জড়িয়ে পড়েছেন৷ সেই মামলা করার জন্য আমাকে নিয়ে গেছিলেন৷’
তরিতার মামলার কথা শুনে চন্দ্রভানু একটু নড়েচড়ে বসলেন৷ কোথাকার জমি? খবরটা জানা দরকার৷ শুয়ার দয়াশঙ্কর এ সব খবর এনে দিতে পারে না? ব্যাটাচ্ছেলে করেটা কী? দেবাংশুবাবুকে প্রশ্নটা করা ঠিক হবে কি না চন্দ্রভানু বুঝতে পারলেন না৷ পেশাদারি গোপনীয়তা বলে একটা কথা আছে৷ একজনের মামলার কথা উনি অন্যজনকে বলবেনই বা কেন? চন্দ্রভানু মনস্থির করার আগেই অহল্যা মোক্ষম প্রশ্নটা করে বসল, ‘এই যে মা তরিতা মনসা পুজো প্রচলনের জন্য এই অঞ্চলে এত টাকা খরচ করছেন, তার আসল কারণটা কি জানেন দেবাংশুবাবু?’
‘ধর্মীয় কারণটা জানতে চান, না কি আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা?’
‘আপনার অ্যাসেসমেন্টটাই আগে বলুন৷’
‘নিজের গোষ্ঠী অথবা দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা৷ হাজার বছর আগে যখন লৌকিক দেব-দেবীর কনসেপ্ট এল, তখন থেকেই এই চেষ্টাটা চলছে৷ বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন ব্রাহ্মণরা৷ সেই সময় নিজেদের এক দেবী জাগুলিকে বৌদ্ধরা ঢুকিয়ে দিলেন আমাদের সমাজে মা মনসা রূপে৷ আসলে নিজেদের দেব-দেবীদের রক্ষা করার একটা চেষ্টা৷ জল-জঙ্গলের দেশ৷ সাপের অভাব নেই৷ সর্পভীতিও মারাত্মক৷ সর্পদেবী আমদানী করতে ওদের তখন অসুবিধে হয়নি৷ যদিও এ নিয়ে অনেক মতান্তর আছে৷ মা, তোমার কি মঙ্গলকাব্য পড়া আছে?’
‘দিল্লিতে মায়ের মুখে মনসা মঙ্গলের গল্প শুনেছি৷ কেন বলুন তো?’
‘এই কারণেই জানতে চাইলাম, আমি যা বলতে চাইছি, তা তোমার বুঝতে সুবিধে হবে৷ মনসা মঙ্গলের মোদ্দা কাহিনি হল, মা মনসা আর চাঁদ সওদাগরের লড়াই৷ কাহিনিটা যদি এ কালে ঘটছে বলে ধরে নাও, তা হলে দেখবে, এখনও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে৷ তুমি যে প্রশ্নটা এইমাত্তর আমায় করলে, তার উত্তরটা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করো মা৷’
‘ঠিক বুঝতে পারলাম না৷’
‘আমাদের চারপাশে কী ঘটছে, তা দেখতে পাচ্ছ না? মা চণ্ডী, মনসা, ধর্মঠাকুরেরা মঙ্গলকাব্যের যুগে পুজো চাইতেন৷ আর এখন যাঁরা তাঁদের মতো, তাঁরা গোষ্ঠী আর এলাকা বাড়াতে চান স্রেফ ভোট পাওয়ার জন্য৷ গণতন্ত্রের যুগে পুজোর ফুল চেয়ে লাভ কী, তাই না? তার বদলে চাই একটা ভোট৷ চাপ দিয়ে একজন তাই অন্যজনকে নিজের দলে নিয়ে আসতে চাইছেন৷ যাতে ভোট বাড়ানো যায়৷ কাগজ খুললেই তো এসব খবর দেখা যায়৷ বোঝা যায়, কতটা নির্মম তাঁরা হতে পারেন৷’
দেবাংশুবাবু কী বলতে চাইছেন, চন্দ্রভানুর মাথায় তা ঢুকছে না৷ তিনি বললেন, ‘কী বলছেন, খোলসা করে বলুন না৷’
‘মা তরিতা যে এমপি ইলেকশনে নামছেন, সেই খবরটা কি আপনারা পেয়েছেন? আমি অবশ্য বলতে চাই না, উনি মা মনসার পুজো ইলেকশনে নামার লক্ষেই চালু করেছিলেন৷ কিন্তু মা মনসার পুজো করে উনি নিজের গোষ্ঠী ধীরে ধীরে বাড়িয়ে নিয়েছেন৷ আর তার ফলটা উনি ইলেকশনে পাবেন৷ কী চন্দ্রভানুবাবু, এ বার বুঝতে পারলেন?’
কথাগুলো শুনে চন্দ্রভানু বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলেন৷ মেয়েটা এতদূর এগিয়ে গিয়েছে! এমপি হওয়ার কথা তো তিনি নিজে ভাবছেন৷ তরিতা যদি এমপি হয়, তা হলে যে ওকে আর শায়েস্তা করা যাবে না! ও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে৷ না, না, এ কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না৷
(আটচল্লিশ)
লঞ্চের সারেঙ ছেলেটার নাম হিমাংশু৷ বাঁদাবনটা ভাল করে চেনে৷ নদীপথে কোন বাঁক নিয়ে কোথায় গেলে চট করে গন্তব্যে পৌঁছবে, সেটা যেন ওর মুখস্থ৷ লঞ্চের ডেক-এ চার-পাঁচজনের সঙ্গে বসে আছেন তরিতা৷ দু’দিন ধরে ঝড়-বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর, আজ প্রকৃতি যেন হঠাৎ শান্ত হয়ে গেছে৷ ঝলমলে রোদ্দুর উঠেছে৷ নদীর দু’পারে তাণ্ডবের নজির দেখতে পাচ্ছেন তরিতা৷ কোথাও বাঁধ ভেঙে গেছে, মেরামতির কাজ চলছে৷ কোথাও নদী গ্রাস করে নিয়েছে লোকালয়৷ জলের মাঝে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে রয়েছে সুন্দরী আর হেঁতাল গাছ৷ পরিত্যক্ত ঘর বাড়িও আকচার চোখে পড়ছে৷ দূরে ভগ্ন একটা মন্দির দেখিয়ে অমর মণ্ডল বললেন, ‘ওই যে মন্দিরটা দেখছেন মা জননী৷ ওখানে আগে মা মনসার পুজো হত৷ গ্রামের নাম ছিল মনসাপোঁতা৷ এখন তার চিহ্নমাত্র নেই৷’
চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে তরিতা সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মন্দিরটার রিনোভেশনের ব্যবস্থা করা যায় না অমরবাবু?’
‘আপনি আদেশ দিলে করা যেতেই পারে৷ আমাকে তা হলে পঞ্চায়েতের সঙ্গে কথা বলতে হবে৷’
‘একবার বলে দেখুন না৷’ কথাটা বলে তরিতা ফের সানগ্লাস চোখে দিলেন৷
বিকেল তিনটের সময় লঞ্চে উঠেছেন তরিতা৷ মনসা ঢিবিতে যাবেন বলে৷ গত একমাস ধরে যাব যাব মনস্থ করেও সময় বের করতে পারছিলেন না তিনি৷ দয়াপুরে এভিএস ইউনিট তৈরির কাজ ফুল সুইংয়ে চলছে বলে৷ বিরাট শেড মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে৷ জমির সংলগ্ন বড় বাড়িটার মেরামতির কাজ পুরো হয়ে গেছে৷ তিন-চারদিন ধরে ভেতরে সাজানো-গোছানোর পালা চলছে৷ ঘোড়াদের আস্তাবলও মোটামুটি রেডি৷ শোনপুর নয়, আপাতত কলকাতা মাউন্টেড পুলিশ থেকে কয়েকটা ঘোড়া কিনে এনেছেন তরিতা৷ নবান্নর অফিসারদের পরামর্শে৷ নানা অঞ্চল থেকে বিষধর সাপ ধরে আনার কাজও চলছে৷ সাপেদের রক্ষণাবেক্ষণের অভিজ্ঞতা আছে অঙ্কুশের৷ ওর উপরই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সাপদের স্বাস্থ্য ভাল রাখার৷ সত্যি বলতে কী, চিফ মিনিস্টারের সঙ্গে সেই মিটিংয়ের পর কোত্থাও কিছু আটকায়নি৷ ডেইলি লেবার পাওয়া নিয়েও কোনও সমস্যা হচ্ছে না৷ তরিতার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, সত্যি বাংলায় এইরকম একজন চিফ মিনিস্টারের দরকার ছিল৷
সারেঙ হিমাংশুকে যেদিন তরিতা বলেন, মনসা ঢিবিতে যেতে চান, সেদিন প্রথমে ছেলেটা গাঁইগুই করেছিল৷ বলেছিল, ‘সে ভয়ানক জায়গা ম্যাডাম৷ একবার দিনের বেলায় দু’জন সাহেবকে সেখানে নিয়ে গিয়ে জান খোয়াতে বসেছিলাম৷ বাঘ আর সাপের এমন উপদ্রব সেখানে৷ আর আপনি আমাকে বলছেন, রাতে নিয়ে যেতে৷ না, না ম্যাডাম, আপনি অন্য কোনও সারেঙ দেখুন৷’
তরিতা তখন হিমাংশুকে কিছু বলেননি৷ শুধু কড়া চোখে একবার তাকিয়ে ছিলেন৷ চোখে কী দেখেছিল কে জানে? তাতেই কেমন যেন মিইয়ে গেল ছেলেটা৷ আজ বেলা বারোটার মধ্যে সুড়সুড় করে পাখিরালার ঘাটে লঞ্চ ভিড়িয়েছে৷ লঞ্চে গোটা পঞ্চাশ ডাব তুলে নিয়েছে৷ কেননা, হিমাংশু জানে, তিনি ডাবের জল খেতে খুব পছন্দ করেন৷ ছেলেটার হঠাৎ বদলে যাওয়ার কারণ অবশ্য তরিতার চোখ এড়ায়নি৷ বলাই…বলাই সম্ভবত ওকে বুঝিয়েছে৷ বলাইয়ের সঙ্গে ইদানীং হিমাংশুর খুব ভাব৷ মেশিনভ্যান চালানোর সঙ্গেসঙ্গে সুযোগ পেলে বলাই আজকাল সারেঙের ঘরে ঢুকে লঞ্চ চালানো শিখছে৷ আজও মাঝে মধ্যে স্টিয়ারিং ওর হাতে দিয়ে হিমাংশু এদিক ওদিক যাচ্ছে৷
পুরো রাত আজ মনসা ঢিবিতে কাটাতে হবে৷ তাই নেত্রা, শান্তি, বলাই, অমর মণ্ডল… এমনকী হারাধন পালাকারকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তরিতা৷ অঙ্কুশকে আসতে বলেছিলেন৷ কিন্তু ও বলল, কার বিয়ের জন্য যেন উপহার আনতে যাবে৷ সেজন্য একদিন ওকে ছুটি দিতে হবে৷ সোনার উপহারটা না কি রাখা আছে বারুইপুরের কোনও এক ব্যাঙ্কের লকারে৷ ইদানীং অঙ্কুশ ভীষণ মনমরা হয়ে রয়েছে৷ তাই ওকে মনসা ঢিবিতে আনার জন্য তরিতা আর জোরাজুরি করেননি৷ আজ দলে রয়েছে নতুন একজন… সে হল অহল্যা৷ মনসা ঢিবির মিথ শুনেই অহল্যা লাফিয়ে উঠেছিল৷ ‘দিদি, আমিও আপনার সঙ্গে যাব৷ প্লিজ, আপনি না করবেন না৷’ ও আজকাল প্রায়ই আসে পাখিরালায় সলিটারি ন্যুকে৷ মেয়েটা যে চন্দ্রভানুর পুত্রবধূ প্রথমদিন তা বলেনি৷ পরে অবশ্য পরিচয় গোপন করেনি৷ অহল্যা প্রমিস করেছে, যে করেই হোক, চন্দ্রভানুকে সিধে রাস্তায় নিয়ে আসবে৷
ডেক-এ চেয়ারে বসে রয়েছেন তরিতা৷ একটা বড় চৌকিতে অন্যরা৷ অহল্যা দিল্লিতে বেড়ে ওঠা আধুনিক মেয়ে৷ কখনও বাঁদাবনে পাকাপাকি থাকেনি৷ বিয়ের পরও চাকরিসূত্রে থাকত কলকাতায়৷ পুজো পার্বণে কঙ্কণদীঘিতে যেত৷ সুন্দরবন নিয়ে মেয়েটার অসম্ভব কৌতূহল৷ মনসা ঢিবি সম্পর্কে জানার আগ্রহে অহল্যা বারবার হারাধন পালাকারকে খোঁচাচ্ছে৷ আর হারাধন পালাকার বিনয়ের সুরে বলে যাচ্ছে, ‘আমি আর কতটুকু জানি মা৷ আমার সামনে সাক্ষাৎ দেবী মা বসে আছেন৷ ওঁরা সামনে কিছু বলতে যাওয়া আমার পক্ষে ধৃষ্টতা৷’
অহল্যার নাছোড় মনোভাব দেখে শেষে তরিতাই জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘তুমি কি কখনও মনসা ঢিবিতে গেছ হারাধন?’
জোড়া হাতে নমস্কার জানিয়ে হারাধন পালাকার বললেন, ‘হ্যাঁ মা ঠাকুরণ৷ আমার একবার সে সৌভাগ্য হয়েছিল৷ মা মনসাই আমাকে টেনে নিয়ে গেছিলেন৷ একবার আঞ্জুমানপুরে মনসা পালা সেরে নৌকো করে গোসাবায় ফিরছিলাম৷ দু’বেলার পথ৷ হঠাৎ ঝড় উঠল৷ জলের টানে নৌকো আপনমনে ছুটতে লাগল৷ মাঝিরা সামাল দিতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছিল৷ মৃত্যুভয়ে আমরা কয়েকজন তো মা মনসার জপ শুরু করলাম৷ ঘণ্টাখানেক পর হঠাৎ দেখি, নৌকো ভিড়েছে পরিত্যক্ত এক দ্বীপে৷ আমরা লাফিয়ে নেমে ডাঙার দিকে দৌড়লাম৷ খানিকটা যেতেই দেখি, বিশাল একটা ঢিবির নীচে ঠাকুরবাড়ির একটা দালান৷ ভেতরে গভীর অন্ধকার৷ কিন্তু কাঁসর ঘণ্টা বাজার ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসছে৷ ধূপ ধুনোর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে৷ ভিতরে ঢোকা অবিবেচকের কাজ হবে৷ ভেবে আমরা দালানের বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলাম৷ তখনই আমার ঠাকরদার মুখে শোনা মনসা ঢিবির কথা মনে পড়ে গেছিল৷ রাত হলেই নাকি সেখানে মা মনসা স্বয়ং আবির্ভুত হন৷ ভাবামাত্রই সারা শরীর শিউরে উঠেছিল৷ কী ভাবে যে সেদিন আমরা ফিরে এসেছিলাম, এখনও মনে পড়ে না৷’
হারাধন মালাকারের সঙ্গে এই প্রথম পরিচয় অহল্যার৷ পোশাক দেখে ভেবেছিল, পুরোহিত গোছের কেউ হবে৷ কিন্তু হারাধনের কথাবার্তা শুনে মনে হয়, ও ইম্প্রেসড৷ অহল্যা জিজ্ঞেস করল, ‘মা মনসার পুরো পালাটা কি আপনার মুখস্থ?’
হারাধন মালাকার বললেন, ‘হ্যাঁ মা৷ বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের মনসাবিজয়ে ত্রয়োদশ পালা আছে৷ পুরোটাই আমার কণ্ঠস্থ৷ সুরও আমারই দেওয়া৷ পুরো পালাটা শুনতে চাইলে তেরোদিনে লেগে যাবে৷ নানা উপাখ্যান জড়ানো রয়েছে৷ কিন্তু, যে যেমন মেয়াদে চান, আমরা ছোট-বড় করে পালা করে দিই৷ বেশিরভাগ অনুষ্ঠানই তিনদিনে করতে হয় মা৷’
‘আপনার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে, মা মনসার উপাখ্যান গুলে খেয়েছেন৷ সবথেকে স্ট্রং ক্যারেক্টার কোনটা?
মা মনসা, চণ্ডী, চাঁদ সওদাগর, সনকা না কি বেহুলা?’
‘আমায় যদি বলেন, তা হলে বেহুলা৷ উপাখ্যানে অনেক পরে এসেছেন৷ কিন্তু, তাঁর ইচ্ছার কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছে মা মনসা আর চাঁদ সওদাগরকে৷ আসলে, অনেকেই জানেন না, বেহুলা ছোটবেলা থেকেই মা মনসার ভক্ত ছিলেন৷ বারবার তার উল্লেখ পাই৷ যখনই উনি বিপদে পড়েছেন, মা মনসাকে স্মরণ করেছেন৷ যেমন ধরুন, মা মনসা সাহায্য না করলে লখিন্দরের সঙ্গে বেহুলার বিয়েটাই হত না৷ আর বিয়েটা না হলে মা মনসার সঙ্গে চাঁদ সওদাগরের বিরোধ কোনও দিনই মিটত না৷ পৃথিবীতে মা মনসার পুজোরও প্রচলন হত না৷ দেবসভায় লখিন্দরের মৃত্যুর জন্য বেহুলা যেভাবে মা মনসাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন, সে এক লম্বা কাহিনি৷ ’
‘বলুন না হারাধনবাবু৷’
‘শুনতে চান, তা হলে শুনুন৷ সাহে বেণের ঘরে বিবাহযোগ্যা অপরূপ এক সুন্দরী কন্যা আছে জেনে, চাঁদ গেলেন উজানী নগরে৷ মেয়ের নাম বেহুলা৷ মেয়ে দেখানোর আগে সাহে বেখের স্ত্রী সুমিত্রা তাঁকে খাওয়াতে চাইলেন৷ তখন চাঁদ বললেন, সমুদ্রে বাণিজ্য করে ফিরে আসার পর থেকে তিনি লোহার কলাইয়ের ভাত ছাড়া আর কিছু খেতে পারেন না৷ শুনে সাহে বেণেরা অবাক৷ লোহার কলাই সেদ্ধ হবে কী করে? চন্দন কাঠ পুড়িয়ে সুমিত্রা একবার চেষ্টা করে দেখলেন বটে, কিন্তু তাতে সফল হলেন না৷ মনে মনে তিনি ঠিক করলেন, অতিথি একটা জিনিস খেতে চেয়েছেন৷ অথচ সেটা করে দিতে পারছেন না৷ তাঁর বেঁচে থেকে লাভ কী? বেহুলা এতসব জানতেন না৷ তিনি তখন শয়নকক্ষে ঘুমিয়ে৷ মায়ের ডাকে ঘুম থেকে উঠে তিনি জানতে পারলেন, গন্ধবণিক সমাজের চূড়ামণি চাঁদ নিজে বাড়ি বয়ে এসে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন৷ ভোজন মনেমতো না হলে তিনি রেগে চলে যেতে পারেন৷ ’
‘তার পর কী হল?’
‘লোহার কলাইয়ের ভাত রান্না করে দিতে হবে শুনে মনসা স্বপ্নে দেখা দিলেন ভক্ত বেহুলাকে৷ এবং রান্না করার উপায় বাতলে দিলেন৷ কুমোর বাড়ি থেকে কাঁচা সরা আর কাঁচা হাঁড়ি নিয়ে আসতে হবে৷ হাঁড়ির জল সরায় ঢেলে লোহার কলাই উনুনে বসিয়ে দিতে হবে৷ উনুন জ্বালাতে হবে আখের আড়াইটা পাতা দিয়ে৷ তা হলেই লোহার কলাই তুলতুলে ভাতের মতো হয়ে যাবে৷ স্বপ্নের কথা তো মা জানেন না৷ কী হবে, তিনি জিজ্ঞেস করায় বেহুলা বললেন, মা তুমি বৃথাই চন্দন কাঠ পোড়ালে৷ লোহার কলাই কি কখনও সেদ্ধ হয়? আর সেটা কি কখনও মানুষ খায়? এর পিছনে দৈবলীলা আছে৷ তুমি যাও, আমি রান্না করে দিচ্ছি৷ মা মনসার কথা অনুযায়ী, বেহুলা রান্না করে চাঁদ সওদাগরকে তুষ্ট করলেন৷’
‘খুব ইন্টারেস্টিং গল্প তো৷’
‘মা, বেহুলা আর লখিন্দরের বিয়ে হয়ে যাওয়ার ঠিক পরেই একটা অঘটন ঘটেছিল৷ তখনও মা মনসা বেহুলার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন৷ বিয়ের আসরে লখিন্দরের মাথার উপর যে সোনার ছাতাটা ধরে রাখা হয়েছিল, সেটা হঠাৎ ভেঙে পড়ে৷ এটা অশুভ লক্ষণ৷ দেখে সবাই হায় হায় করে উঠলেন৷ এদিকে মা মনসা তখন করলেন কী, আড়াইরাজকে পাঠালেন লখিন্দরের মাথায় ছাতা হয়ে দাঁড়াতে৷’
‘আড়াইরাজটা কে হারাধনবাবু?’
‘সে এক বিশাল সাপ৷ তার ফণাটা একশো গজের সমান৷ মা মনসা এমনভাবে তাকে পাঠালেন যে, বিয়ের আসরে লখিন্দর ছাড়া আর কেউ তাকে দেখতে পেলেন না৷ আয়নায় অত বড় সাপকে মাথার উপরে দেখে লখিন্দর মূর্চ্ছিত হয়ে পড়লেন৷ সবাই ধরে নিলেন, তিনি মারা গেছেন৷ একমাত্র বেহুলাই বুঝতে পারলেন, এ নিশ্চিত কোনও দৈবলীলা৷ তিনি মন্দিরে গিয়ে মা মনসাকে ডাকতে লাগলেন৷ তাঁর আকুতিতে মা মনসার মন গলে গেল৷ অমৃতকুণ্ডের জল দিয়ে তিনি বললেন, এই জল লখিন্দরের শরীরে ছিটিয়ে দিলে, সে উঠে বসবে৷ সত্যিই তাই হল৷ মা অহল্যা, এ রকম অনেক লীলা আছে, মনসামঙ্গল কাব্যে৷’
অহল্যা বলল, ‘এ তো রাউলিংয়ের স্টোরিকেও হার মানায়৷ এ বার কলকাতায় ফিরে গিয়ে দেখছি, ভাল করে আরও একবার মনাসমঙ্গল পড়তে হবে৷’
মা মনসা কাহিনি শুনতে শুনতে বেলা গড়িয়ে গেল৷ পূব আকাশে চাঁদ উঠল৷ পূর্ণিমার চাঁদ, গোল থালার মতো৷ মনসা ঢিবি আসার জন্য তরিতা এই পূর্ণিমার রাতটাই বেছেছেন৷ এই রাতে না কি ঢিবিতে অলৌলিক অনেক কিছু দেখা যায়৷ এর আগেও তিনি মা মনসার দর্শন পেয়েছেন৷ এ বার আসার পিছনে একটা উদ্দেশ্য তো আছেই৷ দর্শন পেলে তিনি মায়ের কাছে জানতে চাইবেন, তাঁর স্বপ্ন পূরণ হবে কি না? তা ছাড়া নির্বাচনে নিজেকে জড়াবেন কি না? ফিনফিনে জোৎস্নায় নদীর জলের দিকে তাকিয়ে তরিতা মুগ্ধ হয়ে গেলেন৷ শান্ত প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য তিনি আগে কখনও দেখেননি৷ অসংখ্য চাঁদ যেন ধরাধামে নেমে এসেছে৷ জলে চিকচিক করছে৷ মৃদু বাতাস বইছে৷ কখন যে ডেক থেকে হারাধন, অমর মণ্ডলরা নীচে নেমে গেছে, তরিতা তা টেরও পাননি৷ মুখ ফিরিয়ে তিনি দেখলেন, চৌকিতে বসে শুধু অহল্যা৷ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রয়েছে নদীর দিকে৷
সারেঙ-এর ঘরের দিকে তাকিয়ে হিমাংশুকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মনসা ঢিবি আর কদ্দূর রে?’
মুখ বাড়িয়ে হিমাংশু বলল, ‘আর বেশি দূরে না৷ সামনের জঙ্গলটা পেরিয়ে বাঁ দিকে টার্ন নিলেই মায়ের ঢিবিটা দেখা যাবে৷ কাছাকাছি গেলে আপনি টের পাবেন৷’
জঙ্গল পেরিয়ে লঞ্চ বাঁ দিকে ঘুরতেই আপনাআপনি ইঞ্জিনের শব্দ বন্ধ হয়ে গেল৷ সামনে দিকে তাকিয়ে তরিতা অবাক হয়ে গেলেন৷ এ কী, তাঁরা মোহনার কাছে পৌঁছে গেছেন না কি? সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে৷ জ্যোৎস্নায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, দূরে দু’তিনটে বড় জাহাজ নোঙ্গর করে আছে৷ তবে দেখতে এখনকার জাহাজের মতো নয়৷ পাল তোলা পুরনো দিনের জাহাজ৷ ডান দিকে জাহাজঘাটাতেও কিছু লোকজন ব্যস্ত৷ ছোট ছোট নৌকোয় তাঁরা মাল তুলে নিয়ে বড় জাহাজের দিকে যাচ্ছে৷ তরিতা বুঝতে পারলেন, এটা কোনও বন্দর৷ এই অঞ্চলে কোনও বন্দর আছে বলে তরিতা আগে কখনও শোনেননি৷ তবে কি সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশের কোনও জায়গায় তাঁরা এসে পড়লেন? তরিতা জানেন, সুন্দরবনের অর্ধেকের বেশি এরিয়া এখন বাংলাদেশের মধ্যে পড়ে৷
ইঞ্জিন বন্ধ, তবুও, লঞ্চ ছুটে যাচ্ছে জাহাজঘাটার দিকে৷ চিন্তিত মুখে তরিতা বললেন, ‘হিমাংশু, এই জায়গাটা তুই চিনিস তো?’
হিমাংশু বলল, ‘ আগে এসেছি মা জননী৷ কিন্তু এখন কেমন যেন অচেনা লাগছে৷ মনসার ঢিবিটাকে অবশ্য আমি দেখতে পাচ্ছি৷ ডাঙার দিকে তাকিয়ে দেখুন, গাছপালার ফাঁকে ঢিবিটা দেখা যাচ্ছে৷’
তখনই ঢিবিটাকে দেখতে পেলেন তরিতা৷ দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন৷ নাহ, ভারতের সীমান্তের মধ্যেই তাঁরা আছেন৷ অহল্যাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সিঁড়ি দিয়ে নীচের ডেক-এ নেমে এলেন৷ লঞ্চ জাহাজঘাটায় দাঁড়িয়ে পড়ার পর তরিতা বললেন, ‘অমরবাবু, লঞ্চে আপনারা অপেক্ষা করবেন৷ আমি শুধু নেত্রাকে নিয়ে মনসা ঢিবিতে যাচ্ছি৷ এখানে মোবাইল ফোনের টাওয়ার কাজ করে কি না জানি না৷ তাই আমরা স্যাটেলাইট ফোন নিয়ে এসেছি৷ হিমাংশু অপারেট করতে জানে৷ মাঝে মধ্যে যোগাযোগ রাখবেন৷ আর যদি দেখেন. ভোরবেলার মধ্যে আমরা ফিরে আসিনি, তা হলে আপনারা আমাদের খোঁজে নামবেন৷’
অমর মণ্ডল কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন তরিতা৷ ডাঙায় পা দেওয়ার পরই তিনি শান্তির গলা শুনতে পেলেন, ‘মা সাবধান৷’
চাঁদের আলোয় পরিষ্কার সব দেখা যাচ্ছে৷ জাহাজঘাটার উপরেই চওড়া রাস্তা৷ দু’পাশে নানা রকম দোকান৷ লোকজনে গিজগিজ করছে৷ তাদের পোশাক-আশাক দেখে তরিতা একটু অবাকই হলেন৷ প্রত্যেকের মাথায় বাহারি পাগড়ি৷ পরনে রঙিন চাপকান ও আলোয়ান৷ তাঁরা প্রত্যেকেই কথা বলছে৷ ক্রেতা আর বিক্রেতাদের মধ্যে দরদাম হচ্ছে৷ অথচ কিছুই শুনতে পেলেন না তরিতা৷ হঠাৎ যেন একটা সাউন্ডপ্রুফ স্টুডিয়োতে তাঁরা ঢুকে পড়েছেন৷ রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে কিন্তু মনসা ঢিবিটা দেখতে পেলেন না তিনি৷ তার বদলে বিরাট একটা সুদৃশ্য বাজার চোখে পড়ল৷ সোনার দরজার সামনে সান্ত্রীরা দাঁড়িয়ে৷ তাদের পাশেই গলায় সাপের শিকলে বাঁধা দু’টি বাঘ৷ তবুও, ব্যাপারীর দল নির্ভয়ে যাতায়াত করছে৷ ব্যাপারীদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশিও আছে৷ তাদের কারোর কোমরে তরোয়াল ঝুলছে, কারোর হাতে রেশমি ব্যাগ৷ কেন জানেন না, তরিতার মনে হল, তাঁরা যেন টাইম মেশিনে করে হাজার বছর পিছিয়ে গিয়েছেন৷
বাজারের ভিতরে ঢোকার সময় কেউ অবশ্য দু’জনকে আটকাল না৷ ভিতরেও অসংখ্য দোকান৷ দোকানের বাইরে ফণা ধরে অথবা কুণ্ডলী পাকিয়ে সাপেরা পাহারা দিচ্ছে৷ মনসা ঢিবি দেখতে এসে, এ কোন জায়গায় তাঁরা এসে পড়লেন? সাপগুলোও কেমন যেন অদ্ভুত দর্শন৷ বিচিত্র তাদের গায়ের রঙ৷ দীর্ঘ কয়েক বছর তিনি মায়ামির সার্পেন্টেরিয়ামে কাটিয়েছেন৷ এমন বিরল প্রজাতির সাপ কখনও তাঁর চোখে পড়েনি৷ সাপের দিক থেকে মনটা সরিয়ে এনে তরিতা দোকানের সাইনবোর্ড পড়তে শুরু করলেন৷ ‘এখানে বিষহরণ ঔষধি পাওয়া যায়৷ চূর্ণ দশ স্বর্ণমুদ্রা৷ তৈল বারো স্বর্ণমুদ্রা৷’ দেখে তরিতা বললেন, ‘নেত্রা, কী ব্যাপার বল তো? লঞ্চ থেকে মনে হয়েছিল, গাছপালার ফাঁকে ঠিক এইখানটাতেই মনসা ঢিবি আছে৷ এখানে এসে তো মনে হচ্ছে, এটা বাজার গোছের কিছু৷ এটা উদয় হল কোত্থেকে?’
নেত্রা বলল, ‘দাঁড়াও দিদি, কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখি৷’
ঘুরতে ঘুরতে একটা দোকানে ঢুকে নেত্রা বলল, ‘আমরা ভিন দেশ থেকে এসেছি৷ এই লোকালয়ের নামটা কী, জানতে পারি?’
দোকানি মৃদু হেসে বলল, ‘কুলপি৷ মা জননী, আপনারা কি কিছু খরিদ করার জন্য এসেছেন?’
তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী পাওয়া যায় এখানে? বিষহরণ ঔষধিটা কী?’
‘সাপের বিষ আর ভেষজ পদার্থ মিলিয়ে এক ধরনের ওষুধ৷ এ রকম অনেক ওষুধ পাওয়া যায় কুলপিতে৷ আমাদের বিষহরি মা তৈরি করেন এই ওষুধ৷ সাপের কামড়ে কেউ মৃতপ্রায় হলে, তাকে যদি বিষহরণ চূর্ণ পান করিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে তার রক্ত শোধিত হয়ে যাবে৷ অথবা বিষহরণ তেল মালিশ করে দিলে, তার স্নায়ু ফের সতেজ হয়ে উঠবে৷ তা ছাড়া সাপের বিষ দিয়ে তৈরি ওষুধ কর্কট রোগ নিরাময়ে লাগে৷ বিষহরি মায়ের খ্যাতি এমন ছড়িয়ে গিয়েছে যে, সারা পৃথিবী থেকে ব্যাপারীরা এখানে ওষুধ কিনতে আসেন৷’
দোকানি নিউরোটক্সিক আর হেমোটক্সিক এফেক্টের কথা বলছে৷ সুন্দরবনের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন ওষুধ বিক্রি হয়, তরিতা তা ভাবতেও পারেননি৷ সাপে কাটা লোককে এমন ওষুধ দিয়ে বাঁচানো যায় না কি? নিশ্চয় এই ওষুধে ফল পাওয়া যায়৷ না হলে বিদেশ থেকে ব্যাপারীরা কিনতে আসবেন কেন? তরিতা এবার বুঝতে পারলেন, সমুদ্রে কেন বিদেশি জাহাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ দোকানি বলল, ওষুধে বিষের সঙ্গে ভেষজ পদার্থও মেশানো হয়! ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে নিশ্চয়ই তার উল্লেখ আছে৷ কিন্তু কে এই বিষহরি মা, যিনি বিষহরণ ওষুধ তৈরি করেন? তাঁর কাছ থেকে ফর্মুলাটা জেনে নেওয়া যেতে পারে৷ সেটা জানার জন্য দোকানিকে তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমরা বিষহরি মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চাই৷ কোথায় গেলে তাঁর সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে?’
দোকানি বলল, ‘আপনারা উত্তর দিকে চলে যান৷ সেখানে একটা মন্দির দেখতে পাবেন৷ সেই মন্দিরেই মায়ের অধিষ্ঠান৷’
দোকান থেকে নেমে এসে মন্দিরের দিকে যাওয়ার সময় নেত্রা বলল, ‘দিদি, এই জায়গাটা আমার মায়াবি বলে মনে হচ্ছে৷ তুমি কি লক্ষ করেছ, চাঁদের আলোর সঙ্গে কোনও যোগসূত্র আছে৷ আকাশে চাঁদ যখনই কয়েক সেকেন্ডের জন্য মেঘে ঢাকা পড়ছে, তখনই কেন জানি না, আমার মনে হচ্ছে, ঘন জঙ্গলে কোনও ঢিবির উপর দিয়ে আমরা হাঁটছি৷ আমি মায়াবিদ্যা জানি দিদি৷ চলো, আমরা লঞ্চে ফিরে যাই৷’
তরিতা কড়া গলায় বললেন, ‘তোর মাথা খারাপ? বিষহরি মায়ের সঙ্গে দেখা না করে আমি ফিরবই না৷ আমি তো তোর সঙ্গে আছি৷ তোর ভয় কী?’
হাঁটতে হাঁটতে ওঁরা দু’জন মন্দিরের নীচে এসে দাঁড়ালেন৷ সিঁড়ি দিয়ে উঠে চাতালে পৌঁছে তরিতা যা দেখলেন, তাতে বিস্ময়াবিস্ট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ দিব্যবস্ত্র পরিহিতা, রত্নালঙ্কারে ভূষিতা এক মহিলা পদ্ম সিংহাসনে বসে রয়েছেন৷ তপ্ত কাঞ্চনের মতো তাঁর গাত্রবর্ণ৷ মাথায় পঞ্চফণা সাপের মুকুট৷ কেশরাশি কটিদেশ পর্যন্ত নেমে এসেছে৷ কিন্তু এ কী! বিষহরি মায়ের মুখটা যে অবিকল তাঁরই মতো! এ কী করে সম্ভব? কথাটা যখন ভাবছেন, স্মিত হেসে তখন বিষহরি মা বললেন, ‘তরিতা আয়৷ আমি তোর জন্যই অপেক্ষা করে আছি৷’
(উনপঞ্চাশ)
আজ গোলাপির বিয়ে৷ অঘ্রান মাসের শুরুতেই বলাই আর গোলাপির চার হাত যাতে এক করে দেওয়া যায়, সেজন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন তরিতা ম্যাডাম৷ বিয়েটা হচ্ছে দয়াপুরে কনস্ট্রাকশন সাইটের পাশে ওদের পুরনো বাড়িতে৷ বিরাট বাড়িটা রং করে প্রায় নতুনের মতো হয়ে গেছে৷ আগে নাম ছিল মিত্র মঞ্জিল৷ ফলক তুলে দিয়ে তরিতা ম্যাডাম নতুন নাম দিয়েছেন ‘মনসা ভবন’৷ গণেশ শোলা আর রঙিন রাংতা দিয়ে উঠোনটা খুব সুন্দর সাজিয়েছে৷ আলোয় ঝলমল করছে৷ দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অঙ্কুশ দেখল, বর বেশে বলাই উঠোনের দিকে হেঁটে আসছে৷ ওর পরনে কারুকাজ করা ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি আর চুনোট করা ধুতি৷ মাথায় শোলার টোপর৷ বলাইকে চেনাই যাচ্ছে না৷
ঘরে ঢুকতে যাবে, এমন সময় গাঁয়ের মেয়েরা বলাইকে বাধা দিল৷ ছড়া কেটে সমস্বরে প্রশ্ন করল, ‘কোথা থেকে এলে তুমি কোথা তোমার বাস/কোন মায়ের গর্ভে ছিলে, পূর্ণ দশ মাস৷ কোন ঘাটে পার হইলে, কিসের তরীখানি/ জবাব দিয়ে ঘরে ঢুকে বসিবেন আপনি৷’
উঠোনে মেয়েদের সংখ্যা কম নয়৷ দয়াপুরে নিবারণদার আত্মীয়স্বজন ছাড়াও গোলাপির বিয়েতে মহেশপুর থেকে গণেশের পরিচিতরা এসেছেন অনেকে৷ নিমন্ত্রিত প্রায় শ’পাঁচেক লোক৷ গাঁয়েরই ছেলে-মেয়ের মধ্যে বিয়ে৷ সেই কারণে গত দু’তিনদিন ধরে যেন উৎসব চলছে৷ বিয়ের পুরো খরচ দিচ্ছেন তরিতা ম্যাডাম৷ ছাদনাতলার পাশে চেয়ারে বসে আছেন উনি৷ তাঁর পাশে অমর মণ্ডল, ঝন্টু কয়াল, অ্যান্টনি গোমস সাহেব৷ বলাইয়ের সঙ্গে এসেছে ওর গোটা দশেক বন্ধু৷ মেয়েরা ছড়া কাটার পর তারাও উত্তর দিল, ‘স্বর্গ থেকে এলাম আমি/ মর্তে আমার বাস/ সতী মায়ের গর্ভে ছিলাম/ পূর্ণ দশ মাস৷ সোনার ঘাট পার হইলাম, রুপোর তরীখানি/ এই কথার জবাব দিয়ে এই বসিলাম আমি৷’ সঙ্গেসঙ্গে হাসির রোল উঠল৷
গোলাপির মা সন্ধ্যাদিদি বরণডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে৷ তার সঙ্গে আরও চারজন সধবা৷ বরবরণ হচ্ছে৷ তরিতা ম্যাডাম যেদিন বিয়ের কথা পাকা করতে আসেন, সেদিন গোলাপি যেন খুশিতে প্রজাপতির মতো উড়ছিল৷ বিয়ের প্রস্তাবে নিবারণদা তো আপত্তি করেইনি৷ উল্টে বলেছিল, ‘বলাইয়ের বাপ অতুল খুব ভাল মানুষ ছেল মা৷ ওরা আগে থাকইত সন্দেশখালিতে৷ কপাল মন্দ, মধু সেঁইচতে গে এগবার ওরে বাঘে নে গেল৷ অতুলের বেধবা বউ ছাবালরে নে এসে উঠল এই দয়াপুরে৷ বলাইরে মনে ধইরছে গোলাবির৷ আবনি পাকা কতা দে দেন দিনি৷ গোলাবির মায়েরও আপত্তি লাই৷’ বলাইয়ের মায়ের সামনে ওইরকম ডাকাবুকো মেয়েকেও সেদিন ক’নে বউয়ের মতো লাজুক বলে মনে হয়েছিল অঙ্কুশের৷ বরপক্ষের লোক চলে যাওয়ার পর ওর পায়ে ঢিপ করে প্রণাম করেছিল গোলাপি৷ ভাবখানা এই যে, পরাণের সঙ্গে বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার জন্য দাদাবাবু… তোমায় ধন্যবাদ৷
অহল্যাদি আজ বিকেলে গোলাপিকে ক’নের সাজে সাজিয়ে দিয়েছেন৷ শোভা কলকাতায় গিয়ে ওর জন্য বেনারসী শাড়ি কিনে এনেছে৷ শেষবার অঙ্কুশ যখন নীচ থেকে উঠে আসে, তখন দেখে এসেছে, বরের প্রতীক্ষায় গোলাপি জলের পাত্রে পা ডুবিয়ে বসে আছে৷ এটাই না কি স্ত্রীআচার৷ পোশাক বদলানোর নাম করে অঙ্কুশ উপরে উঠে এসেছিল৷ আর নীচে নামতে ওর ইচ্ছে করছে না৷ সকাল থেকেই ওর মনটা ভার হয়ে আছে৷ গড়িয়ায় আজই আরেকজনের বিয়ে… উষসীর৷ তারিখটা তিন্নির মুখ থেকে শোনা৷ বাবাকে নিয়ে দয়াপুরে দেখা করতে এসে বলেছিল৷ কথাটা ভাবলেই, অঙ্কুশের বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে৷ না, উষসীকে নিজের করে পাচ্ছে না বলে নয়৷ একটা ভাল মেয়ে জয়ের মতো ছেলের পাল্লায় গিয়ে পড়ছে, সেটাই ওর দুঃশ্চিন্তার কারখণ৷
অনেক ভেবে নিজেকেই দোষী সাব্যস্ত করে ফেলেছে অঙ্কুশ৷ কেন ও মুখ ফুটে উষসীকে মনের ইচ্ছেটা জানায়নি? কঙ্কণদীঘিতে চন্দ্রভানুবাবুর গেস্ট হাউসে থাকার সময় তো ও যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিল৷ নিজেকেই একেক সময় কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে অঙ্কুশ৷ কী দরকার ছিল, পিঙ্কি বউদির সঙ্গে চ্যাংড়ামি মারতে যাওয়ার? চন্দ্রভানুবাবুর স্ত্রীর মুখে বসিয়ে রাজত্ব, রাজকন্যা, সাউথ সিটি মলে ফ্ল্যাট, বিএমডবলিউ গাড়ি… এ সব মনগড়া গপ্প করতে গিয়েই তো ও নিজের সর্বনাশটা ডেকে আনল৷ পিঙ্কি বউদি যে ওর কথাগুলো এত সিরিয়াসলি নেবে, অঙ্কুশ ভাবতেই পারেনি৷ এমনকী, মিত্তিরবাড়ি থেকে চলে আসার দিনও জেঠামশাইকে যদি ও বলে আসত, বড়মায়ের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করার ব্যাপারে ওর কোনও আপত্তি নেই, তা হলে আজ ওকে এত আফসোস করতে হত না৷
মিত্র পরিবারে একমাত্র পিঙ্কি বউদির সঙ্গেই অঙ্কুশ মন খুলে কথা বলত৷ কিন্তু, কেন উষসীর ব্যাপারে চুপ করে ছিল, সেটা ভেবে ও আশ্চর্যবোধ করে৷ কে জানত, সম্পত্তি ভাগাভাগির পর পিঙ্কি বউদিও এত দূরে সরে যাবে? মানুষ এমন একশো আশি ডিগ্রি বদলে যেতে পারে কী করে? একটা সময় সারাদিনে একবার ওর সঙ্গে আড্ডা মারতে না পারলে, পিঙ্কি বউদির মন ভরত না৷ সেই পিঙ্কি বউদি আজকাল ওর ফোন পর্যন্ত ধরে না৷ মাঝে বিয়ের নেমতন্ন করার জন্য নিবারণদা পিয়ারায় গিয়েছিল৷ গোলাপি ওকে পাঠাতে চাইছিল না৷ তবুও, কর্তব্যের খাতিরে গণেশই জোর করে নিবারণদাকে পাঠায়৷ পিঙ্কি বউদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গোলাপির বিয়ের কথা জানতে চেয়েছিল৷ কিন্তু একবারও না কি ওর কথা জিজ্ঞেস করেনি৷ শুনে মোটেই আশ্চর্য হয়নি অঙ্কুশ৷ এটাই স্বাভাবিক৷
নিবারণদা অবশ্য একটা ভাল খবর নিয়ে এসেছে৷ টিটো না কি সুস্থ হয়ে গেছে৷ এখন ফের স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে ৷ নিবারণদাকে সেদিন পিঙ্কি বউদি জানিয়েই দিয়েছিল, গোলাপির বিয়েতে আসতে পারবে না৷ ওইদিনই গড়িয়ায় অন্য একজনের বিয়েতে ওঁকে যেতে হবে৷ সেই একজন মানে উষসী৷ বড়কাকা না কি বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও, নিবারণদার সঙ্গে কথাই বলতে চাননি৷ তবে, জেঠামশাই আর জেঠিমা বলেছেন, দয়াপুরে আসতে পারেন৷ জেঠামশাই সোনার বালা পাঠিয়ে দিয়েছেন গোলাপির জন্য৷ সেইসঙ্গে হাজার দশেক টাকা৷ কিন্তু, সন্ধে হয়ে গেল, এখনও পিয়ারা থেকে কেউ আসেননি৷
নীচ থেকে উলু দেওয়ার আর শাঁখ বাজানোর শব্দ ভেসে এল৷ অঙ্কুশ জানে, এই সময় ছাদনাতলায় ওর থাকা উচিত৷ ক’নের সাজে থাকলেও গোলাপির চোখ কিন্তু ওকেই খুঁজে বেড়াবে৷ ঘরে বসে থেকে কাজটা ও ভাল করছে না৷ অন্য কারও হয়তো চোখে পড়বে না৷ কিন্তু, তরিতা ম্যাডামের চোখকে অঙ্কুশ ফাঁকি দিতে পারবে না৷ মাঝে ম্যাডাম একদিন ওর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘ইদানীং এত মুখ গোমড়া করে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন অঙ্কুশ? তুমি কি কোনও সমস্যায় পড়েছ?’
অঙ্কুশ তখন চুপ করে ছিল৷ তরিতা ম্যাডামকে উষসীর কথা বলা ঠিক হবে কি না, ও বুঝতে পারছিল না৷ ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ম্যাডাম বলেছিলেন, ‘তোমার সমস্যার কথা আমি জানি অঙ্কুশ৷ কিন্তু, আমাকে যদি বলতে না চাও, তা হলে সমাধান করব কী করে?’ শুনে চমকে উঠেছিল অঙ্কুশ৷ ওর সমস্যার কথা তরিতা ম্যাডাম জানলেন কী করে? গোলাপি… গোলাপি কিছু বলেছে না কিউষসী সম্পর্কে? কে জানে, হতেও পারে ৷ ওকে বিশ্বাস নেই৷ দাদাবাবুর ভালর জন্য ও সবকিছু করতে পারে৷ উষসীকে যে ও মনে-প্রাণে চায়, এ কথা গোলাপি জানত৷ মহেশপুরে একদিন আড়াল থেকে ও দু’জনের ফোনালাপ শুনে ফেলেছিল!
তিন্নির মুখে উষসীর বিয়ের খবরটা শোনার পর মাঝে একদিন ছুটি নিয়ে অঙ্কুশ গড়িয়ায় গেছিল৷ বারুইপুরে ব্যাঙ্কের লকার থেকে নবরত্ন হারটা সঙ্গে নিয়ে৷ রত্নখচিত, অপূর্ব কাজ করা সোনার হারটা বড়মা ওর বউয়ের জন্য রেখে দিয়েছিল৷ নিশ্চয়ই উষসীর কথা মনে করে৷ অঙ্কুশের মনে হয়েছিল, নবরত্ন হারটা উষসী ছাড়া আর কারও গলায় মানাবে না৷ হারটার দাম প্রায় এখন প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মতো৷ গড়িয়ায় গিয়ে অঙ্কুশ শোনে, উষসী বাড়িতে নেই৷ উষসীর বাবার হাতে উপহারটা দিয়ে ও ফিরেই আসছিল৷ কিন্তু মৈনাকবাবু জোর করে বসালেন৷ অঙ্কুশ তখন কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলেছিল, ‘উষসীর বিয়ের সময় আমি সম্ভবত চেন্নাইতে থাকব আঙ্কল৷ সেজন্য উপহারটা আগে দিয়ে গেলাম৷’
মৈনাকবাবু বললেন, ‘তোমাকেই আমি খুঁজছিলাম বাবা৷ উষসীর কাছে একদিন তোমার ফোন নাম্বারটাও চাইলাম৷ ও দিতে পারল না৷ বলল, তুমি নাকি নাম্বার বদলেছ৷ নতুন নাম্বারটা ওর কাছে নেই৷’
নতুন নাম্বারে অঙ্কুশ অন্তত পঞ্চাশবার ফোন করেছে৷ ফোন উষসী না ধরলেও, ওর কাছে নাম্বারটা না থাকার কথা নয়৷ তার মানে নাম্বারটা মৈনাকবাবুকে ও দিতে চায়নি৷ সে কথা ভেবে লাভ নেই৷ অঙ্কুশ তাই বলেছিল, ‘উষসী ঠিকই বলেছে৷ কিন্তু আমাকে খুঁজছিলেন কেন আঙ্কল?’
‘উষসীর সঙ্গে যার বিয়ে হচ্ছে, সেই জয় সেনগুপ্ত শুনেছি, তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু৷ তার সম্পর্কেই কয়েকটা কথা জানতে চাই৷ ছেলেটা কেমন বাবা?’
‘হঠাৎ এ প্রশ্ন করছেন কেন আঙ্কল?’
‘তোমাকে বলতে আমার কোনও সংকোচ নেই৷ তুমি নিশ্চয় জানো, আমিও দীর্ঘদিন মিডিয়া লাইনে ছিলাম৷ সাংবাদিকের চাকরি করতাম শিলচরের একটা কাগজে৷ সেইসূত্রে, কলকাতায় আমার প্রচুর সাংবাদিক বন্ধু আছেন৷ তাঁদের কাছে জয় সম্পর্কে যেসব কথা শুনছি, তাতে তো আমার বেশ ভয়ই হচ্ছে বাবা৷’
‘কী শুনেছেন আপনি?’
‘বেসিক্যালি না কি খুব ডিসঅনেস্ট টাইপের৷ মাঝে মাঝে প্রেস ক্লাবে মদ খেয়ে অসভ্যতা করে৷ এর আগে না কি একটা বিয়েও করেছিল৷ মেয়েটার সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে কি না কেউ বলতে পারলেন না৷ উষসীকে নিয়ে আমার খুব দুর্ভাবনা হচ্ছে বাবা৷ আমার ট্যালেন্টেড মেয়েটা এ কার পাল্লায় পড়ল?’
‘জয়কে সরাসরি জিজ্ঞেস করছেন না কেন?’
‘করেছিলাম৷ ও ফুৎকারে উড়িয়ে দিল৷ আমাকে বোঝাল, এটা না কি প্রোফেশনাল রাইভালরি৷ জার্নালিস্ট হিসেবে ও নাম করেছে বলে, সবাই জেলাস৷’
‘বিয়েটা ঠিক হল কীভাবে আঙ্কল?’
‘জয়ই একদিন এ বাড়িতে এসে প্রস্তাবটা দিয়েছিল৷ দেখলাম, উষসী চুপ করে রইল৷ মনে হল, ও গররাজি নয়৷ তাই ভাবলাম, ওদের মধ্যে প্রেম-ট্রেম হয়েছে৷ কিন্তু এখন দেখছি, আমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷’
জয় কেমন ছেলে, অঙ্কুশ সেটা প্রথম টের পায় সজনেখালিতে গিয়ে৷ তার পর থেকে জয়ের ফোন আর ও ধরেইনি৷ কিন্তু মৈনাকবাবুর কাছে সেদিন জয় সম্পর্কে কোনও মতামত দেওয়া উচিত বলে ও মনে করেনি৷ দু’নম্বরি করার জন্য যে জয়ের চাকরি চলে যেতে পারে, এই খবরটা অন্তত মৈনাকবাবুর জানা উচিত৷ কায়দা করে অঙ্কুশ বলেছিল, ‘সিদ্ধান্তটা নেওয়ার আগে আপনার উচিত ছিল জয়ের অফিসে খোঁজ নেওয়া৷ অবশ্য এখনও সময় চলে যায়নি৷’ এর পর আরও দু’একটা কথা বলেই অঙ্কুশ উঠে এসেছিল৷
সেদিন রাতেই ও একটা মেসেজ পায়, ‘আপনার উপহারটা নিতে পারছি না অঙ্কুশদা৷ সেই অধিকার আমার নেই৷ সুযোগমতো ফেরত দিয়ে আসব৷’ রোজ রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অঙ্কুশ এই মেসেজটাতে চোখ বোলায়৷ আর তার অর্থ খোঁজার চেষ্টা করে৷ ‘সেই অধিকার আমার নেই৷’ তার মানে উষসী জানে, হারটা বড়মা কার জন্য রেখে গিয়েছিলেন৷ কথাটার মধ্যে কি আফসোস লুকিয়ে আছে? না কি অভিমান? ভাবতে ভাবতে ওর রাত কেটে যায়৷ অঙ্কুশ ভাল করে ঘুমোতেও পারে না৷
নীচ থেকে ফের উলু আর শাঁখের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে৷ ঘরে দমবন্ধ হয়ে আসছে৷ লোকজনের মাঝে থাকলে উষসীর কথা ভুলে থাকতে পারবে৷ ভেবে অঙ্কুশ নীচে নেমে এল৷ ছাদনাতলা থেকে গোলাপি আর বলাইকে বাসর ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ তার মানে বিয়ে শেষ হয়ে গেছে৷ ভিড়ের মাঝে হঠাৎই ওর চোখে পড়ল টিটোকে৷ ওর হাতে মোবাইল সেট৷ বিয়ের ছবি তুলে বেরাচ্ছে৷ এ কী, টিটো এল কার সঙ্গে? আশপাশে নজর বোলাতেই অঙ্কুশ একে একে দেখতে পেল জেঠামশাই, জেঠিমা আর পিঙ্কি বউদিকে৷ ছাদনাতলায় একসারিতে সবাই বসে আছে৷ দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে অঙ্কুশ জেঠামশাই আর জেঠিমাকে প্রণাম করে বলল, ‘আপনারা কখন এলেন?’
জেঠামশাই বলল, ‘দুপুরে৷ টাইগার ক্যাম্প রিসর্টে উঠেছি৷ কিন্তু এ কী, তোর চেহারাটা এত খারাপ হয়ে গেল কী করে রে কুশ? গায়ের রং পুড়ে গেছে৷ তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না৷’
ওকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছে টিটো৷ হাত জড়িয়ে ধরেছে৷ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে অঙ্কুশ বলল, ‘না, না, আমি ঠিক আছি জেঠামশাই৷ বাড়ির আর সবাই কেমন আছে?’
‘রাধামাধবের কৃপায় ভালই আছে৷’ জেঠামশাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর কি খবর বল তো? সেই যে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলি, তার পর তো আর যোগাযোগই রাখলি না৷ টিটোর এত বড় অসুখ গেল৷ তোকে দেখার জন্য রোজ রোজ ও তখন কান্নাকাটি করত৷ ওকে একবারও তুই দেখতে গেলি না? তুই কি খবর পাসনি?’
শুনে পিঙ্কি বউদির দিকে একবার তাকাল অঙ্কুশ৷ বউদি মাথা নীচু করে রেখেছে৷ রাখবেই তো৷ সেদিন যখন সৌম্যদা ফোনে বলছিল, ‘তুই আর মিত্তির ফ্যামিলিতে একজিস্ট করিস না৷ নার্সিং হোমে এলে তোর গায়ে হাত উঠে যাবে’, তখন নিশ্চয়ই পিঙ্কি বউদি সামনে ছিল৷ পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই৷ তাই অঙ্কুশ বলল, ‘খবরটা পেয়েছিলাম৷ কিন্তু তখন এখানকার প্রোজেক্টের কাজে খুব ব্যস্ত ছিলাম জেঠামশাই৷ তাই সময় করে উঠতে পারিনি৷’
‘শোন, আলিপুরের জু থেকে তোর একটা চিঠি এসেছে৷ বাড়ির কেউ জানত না, তুই কোথায় আছিস৷ ফোনে না কি তোকে কেউ পাচ্ছিল না৷ তাই চিঠিটা সেই থেকে আমার কাছে পড়ে আছে৷ আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি৷ ভাগ্যিস, নিবারণ নেমতন্ন করতে গেছিল৷ তাই জানতে পারলাম, তুই দয়াপুরে আছিস৷’
‘নিবারণদার সঙ্গে সেদিন পিয়ারায় যাব ভাবছিলাম৷ কিন্তু কী কারণে যেন আটকে গেছিলাম৷’
‘গেলি না কেন বাবা? তোর বাড়ি, যখন তোর ইচ্ছে যাবি৷ বারমহলটা তোর জন্যই রেখে দিয়েছি৷ যাক সে কথা? হ্যাঁরে, নৃপেন বলছিল, এখানকার জমিটা না কি বিক্রি করে তুই ভাল দাম পেয়েছিস? গোলাপির বিয়ের পুরো খরচা না কি তুই দিচ্ছিস? মেয়েটার এত ভাল বিয়ে হবে, ভাবতেও পারিনি৷’
নৃপেন মানে বড়কাকা৷ অঙ্কুশ বলল, ‘না জেঠামশাই৷ বিয়ের খরচ আমি দিইনি৷ খরচ করেছেন তরিতা ম্যাডাম৷ এখানে এভিএস ইউনিটটা যিনি খুলছেন৷ যার কোম্পানিতে আমি আর গোলাপি দু’জনেই চাকরি করি৷ আর একটা কথা৷ এখানকার জমিটা আমি কিন্তু বিক্রি করিনি৷ ভাল কাজে তরিতা ম্যাডামকে দান করে দিয়েছি৷’
শুনে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন জেঠামশাই৷ কয়েক সেকেন্ড পর বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, একটু আগে ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দিল গণেশ৷ উনি প্রোজেক্ট সম্পর্কে বলছিলেন বটে৷ তুই ভাল করেছিস বাবা৷ তোর বড়মা বেঁচে থাকলে খুশিই হতেন৷ মানুষের উপকারে আসা কি চাট্টিখানি কথা! নৃপেন কার কাছে কী শুনে মামলাটা করে বসল৷ এই দ্যাখ না, মামলায় আমাকেও পার্টি করেছে৷ না, উকিলবাবুকে বলে দিতে হবে, মামলা থেকে আমার নামটা যেন বাদ দেয়৷’
অঙ্কুশ কী বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় হাতজোড় করে সামনে এসে দাঁড়াল নিবারণদা৷ বলল, ‘বড়কর্তা, আবনারা খেতে চলুন৷ নইলে রিসর্টে আবনাদের ফিরতে অনেক রাত্তির হইয়ে যাবে৷’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক৷ চল, খেয়ে নিই৷’ এক পা বাড়িয়ে জেঠামশাই বললেন, ‘আমরা কাল দিনের বেলাটা আছি রে কুশ৷ পারলে একবার আসিস৷ জু-র চিঠিটা নিতে৷ তোর সঙ্গে আমারও কিছু কথা আছে৷’
শুনে কুশ ঘাড় নাড়ল৷ মনসা ভবন আর নিবারণদার বাড়ির মাঝে খানিকটা ফাঁকা মাঠ আছে৷ সেখানে বিরাট ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে৷ একপাশে ভিয়েন, অন্যপাশে চেয়ার-টেবলে খাবার জায়গা৷ জেঠামশাই আর জেঠিমা সেদিকে এগোতেই অঙ্কুশ উল্টোদিকে বাসর ঘরের দিকে হাঁটা দিল৷ ও জানে, ওর উচিত খাওয়ার সময় জেঠামশাইদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো৷ কিন্তু ওর ইচ্ছে করল না৷ ওর মাকে যাঁরা কষ্ট দিয়েছে, প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়নি, তাঁদের মধ্যে এই দু’জনও ছিলেন৷ তাঁদের খাতির করার কোনও মানে হয় না৷ কয়েক কদম এগোতেই অঙ্কুশের কানে এল, ‘ঠাকুরপো, দাঁড়াও৷ তোমার সঙ্গে কথা আছে৷’
ওকে ঠাকুরপো বলে ডাকার মতো একজনই আছে৷ সে পিঙ্কি বউদি৷ অঙ্কুশ পিছন ঘুরে বলল, ‘আমাকে আবার কী দরকার পড়ল বউদি?’
‘যাক, চিনতে পেরেছ তা হলে৷ এতক্ষণ তো না-চেনার ভান করছিলে৷’
‘দয়াপুরে এসে কিছু লোককে ইচ্ছে করেই মন থেকে আমি সরিয়ে দিয়েছি৷ তাতে বেশ ভাল আছি৷’
‘কেমন আছ, সে তো তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি৷ যাক, এটা অন্তত বলো, উষসীর এত বড় সর্বনাশটা তুমি করলে কেন?’
প্রশ্নটা সরাসরি বুকে এসে ধাক্কা মারল৷ অঙ্কুশ বলল, ‘আমি সর্বনাশ করেছি! কীভাবে?’
‘ওর বিয়েটা তুমি ভেঙে দিলে কেন?’
ধাতস্থ হতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল অঙ্কুশের৷ ও বলল, ‘তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না বউদি৷ ওর বিয়ে আমি ভেঙে দেওয়ার কে?’
‘গড়িয়ায় গিয়ে উষসীর অ্যাবসেন্সে তুমি মৈনাকবাবুর কান ভাঙাওনি? জয় সম্পর্কে খারাপ খারাপ কথা বলে আসোনি? ও কেমন ছেলে, সেটা ওর অফিসে খোঁজ নিতে বলোনি?’
শুনে চুপ করে গেল অঙ্কুশ৷ মৈনাকবাবুকে ও সত্যিই কথাটা বলেছিল৷ ওয়েলউইশার হিসেবে এই পরামর্শটা ও দিতেই পারে৷ তার জন্য বিয়েটা ভেঙে যাবে কেন? আর ও-ই বা দায়ী হবে কেন? ধৈর্য হারিয়ে অঙ্কুশ বলে উঠল, ‘বেশ করেছি৷ উষসীর ভাল চাই বলেই পরামর্শটা দিয়েছিলাম৷’
‘ওহ, তা হলে জয়ের ধারণাই ঠিক৷ জয়ের এগেনস্টে কন্সপিরেসিটা তা হলে তোমার৷ ও তোমার তরিতা ম্যাডামের বিরদ্ধে লিখেছিল বলে, কাগজের এডিটরের কাছে কমপ্লেন করার আইডিয়াটাও তা হলে তুমি দিয়েছিলে৷ ছিঃ ঠাকুরপো৷ তোমার জন্য জয়ের চাকরি চলে যাচ্ছে৷ ওর মতো ছেলের অবশ্য চাকরির অভাব হবে না৷ ও কি তুমি? ওর পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতাই তোমার নেই৷ ওকে একডাকে সবাই চেনে৷ ওর কত প্রভাব প্রতিপত্তি৷ সেই তুলনায় তো তুমি নস্যি৷ উষসীকে পাওয়ার জন্য তুমি যে এত নীচে নেমে যাবে, আমি ভাবতেও পারিনি৷ তোমাকে মিত্তিরবাড়ির ছেলে ভাবতেই লজ্জা হচ্ছে৷’
নির্মমভাবে কথাগুলো বলে যাচ্ছে পিঙ্কি বউদি৷ বুকের ভিতরটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে অঙ্কুশের৷ কোনওরকমে ও বলল, ‘উষসীরও কি এই ধারণা, বউদি?’
‘সেটা জেনে তোমার কি লাভ? তুমি তো আর ওকে উদ্ধার করতে যাচ্ছ না৷ পারলে ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিও৷ জানি না, ও তোমায় ক্ষমা করবে কি না৷’
কথাগুলো বলে পিঙ্কি বউদি আর দাঁড়াল না৷ নিবারণদার বাড়ির দিকে এগোল৷ পিঙ্কি বউদির গমনপথের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে অঙ্কুশ তাকিয়ে রইল৷