(পনেরো)
মোবাইল ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বাজছে৷ সোফায় আধশোয়া অবস্থায় ছিল অঙ্কুশ৷ ডিনারের পর তন্দ্রা মতো লেগে এসেছিল৷ অভ্যেসমতো ডান হাত বাড়িয়ে টেবল থেকে ও মোবাইল সেটটা তুলে আনতে গিয়েছিল৷ কবজির কাছটা তখনই টনটন করে উঠল৷ অঙ্কুশ এখনও মাঝে মাঝে ভুলে যাচ্ছে, ওর ডান হাতে প্লাস্টার৷ ডান হাত দিয়ে কোনও কাজই ও করতে পারছে না৷ সঙ্গেসঙ্গে বাঁ হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে ও দেখল, পর্দায় জয়ের নাম৷ বেশ কিছুদিন হল, জয় ফোন করেনি৷ নিশ্চয় কোনও খবর নিয়ে ব্যস্ত৷ ফোনটা কানের কাছে ধরে ও বলল, ‘কী খবর রে জয়? তোর কোনও পাত্তা নেই৷’
‘অঙ্কুশ, তোর জন্য একটা ভাল খবর আছে৷ সুমন্ত মণ্ডলের লাইসেন্স ক্যানসেল করে দিচ্ছে বিকাশ ভবন থেকে৷ খবরটা আজ আমি করেছি৷ তোকে বলেছিলাম না, লোকটার ভান্ডা ফোঁড় করে দেবো? ওর স্নেকপার্ক নিয়ে আমার একটা লেখাতেই কাজ হয়ে গিয়েছে৷’
ভান্ডা ফোঁড় কথাটা অঙ্কুশ আগে কারও মুখে শোনেনি৷ তবুও, মানেটা ও আন্দাজ করে নিল৷ মুখোশ খুলে দেওয়ার মতো কিছু হবে৷ খবরটা শুনেই সোফায় সোজা হয়ে বসে অঙ্কুশ জিজ্ঞেস করল, ‘সুমন্ত মণ্ডলের লাইসেন্স কি চিফ ওয়ার্ডেন ক্যানসেল করে দিয়েছে? না, করবে৷’
‘গভর্মেন্ট অর্ডার বেরিয়ে গিয়েছে৷ জানি না, বাস্টার্ডটা এখনও হাতে পেয়ে গিয়েছে কিনা৷ কালই আমার সঙ্গে কথা হচ্ছিল ভবানী পুরকায়স্থের সঙ্গে৷ চিফ ওয়ার্ডেন… তোকে উনি চেনেন৷ উনিই বললেন, স্নেক পার্ক নিয়ে অনেকদিন ধরে আমরা কমপ্লেন পাচ্ছিলাম৷ আমরা ঠিক করেছি, কারও ব্যক্তিগত পজেশনে আর সাপ রাখতে দেবো না৷ কারও লাইসেন্স আর রিনিউ করব না৷’
তার মানে পিয়ারাতেও অঙ্কুশ আর ওর পোষ্যপুত্তুরদের রাখতে পারবে না৷ এটা ওর পক্ষে ভাল খবর কিনা ও বুঝতে পারল না৷ চিফ ওয়ার্ডেন যদি ওর লাইসেন্স আর রিনিউ না করেন, তা হলে অতগুলো সাপের দায়িত্ব কে নেবে? একটা পাইথনকেই রাখার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিল না ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট! এতগুলো সাপ রাখবেটা কোথায়? সরকার যদি ওর পোষ্যপুত্তুরদের ভার নেয়, তা হলে অবশ্য অঙ্কুশের কোনও আপত্তি নেই৷ কেননা, এমনিতেই ও একটু দ্বিধার মধ্যে রয়েছে৷ আলিপুর চিড়িয়াখানায় অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টরের পোস্ট খালি আছে৷ খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে ও অ্যাপ্লাই করেছে৷ ওর যা কোয়ালিফিকেশন, তাতে চাকরিটা হয়ে যাওয়ার কথা৷ যদি হয়ে যায়, তা হলে পোষ্যপুত্তুরদের নিয়ে ও খুব অুসবিধেয় পড়ে যাবে৷ আর সময়ই দিতে পারবে না তখন ওদের জন্য৷ দ্রুত এসব কথা ভেবে নিয়ে অঙ্কুশ প্রশ্ন করল, ‘স্নেক পার্কের সাপ কোথায় রাখবেন, ভবানীবাবু কিছু বললেন?’
‘আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ উনি বললেন, রাজারহাটের ইকো ট্যুরিজম পার্কে৷ তুই বোধহয় খবরের কাগজে পড়েওছিস… মাসখানেক আগে এই পার্কটার ইনোগোরেশন হয়েছে বিশাল জায়গা নিয়ে৷ ভবানীবাবুরা ঠিক করেছেন, ওখানেই একটা স্নেকপার্ক করবেন৷ যাতে পার্কটার আকর্ষণ বাড়ে৷ শোন, তোর কথা আমি ওঁকে বলে রেখেছি৷ ওঁরা একটা অ্যাডভাইসরি কমিটি করছেন, তাতে তুই থাকবি৷ তোকে আগেভাগে জানিয়ে রাখলাম৷ পরে আবার ওদের না বলে দিস না যেন৷’
‘খবরটা জানার পর সুমন্ত মণ্ডলের রিঅ্যাকশন নিসনি?’ ‘দরকার নেই৷ তোকে তো বলেইছি, আমার রিপোর্ট পাবলিশ হওয়ার পর লোকটা আমায় হুমকি দিয়েছিল, মানহানির মামলা করবে৷ আমার সঙ্গে সেদিন প্রচুর কথাকাটাকাটি হয়েছিল৷ তিন হপ্তা হয়ে গেল, এখনও অবশ্য উকিলের কোনও নোটিশ পাইনি৷ আমি জানি, ফোন করলেও লোকটা এখন কথা বলবে না৷ ভাবলাম, খবরটা তোকে জানানো উচিত৷ তাই ফোন করলাম৷ যাক গে, তুই এখন আছিস কেমন বল?’
‘এখনও হাতের প্লাস্টার কাটেনি৷ কাল ডাক্তারবাবু বললেন, আর এক সপ্তাহ লাগবে৷ তবে মাথার ঘা শুকিয়ে গিয়েছে৷ মাথায় আর এক্সরে করার দরকার নেই৷ ভাই জয়, ওই সময়ে তুই পাশে এসে না দাঁড়ালে, ঠিকঠাক ডাক্তারের কাছে না নিয়ে গেলে, আমি খুব মুশকিলে পড়ে যেতাম৷ বেলভিউতে ডাক্তারবাবু কাল তোর খোঁজ করছিলেন৷ আমি তোর কোনও হদিশ দিতে পারলাম না৷’
‘আরে, তোকে একটা কথা জানাতে পারিনি৷ দিনদশেকের জন্য আমি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলাম৷ অস্ট্রেলিয়ার ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্ট কলকাতার নামী কাগজের দু’তিনজন সাংবাদিককে ওদের দেশে নিয়ে গিয়েছিল৷ ওদের দেশ সম্পর্কে লেখানোর জন্য৷ তাতে আমিও ছিলাম৷ ওরা শুনেছে, বাঙালিদের অনেকে নাকি পুজোর সময় ইউরোপ ট্যুর করতে যায়৷ ইউরোপে না গিয়ে এখান থেকে লোকে যাতে অস্ট্রেলিয়ায় বেড়াতে যায়, ওদের সরকার সেই চেষ্টাই করছে৷ ফিরে এসে সেই লেখা নিয়ে আমি ব্যস্ত ছিলাম রে৷ সেই কারণে, তোর খোঁজ নিতে পারিনি৷’
‘ইস, তুই যদি আগে আমাকে বলতিস, তা হলে অস্ট্রেলিয়া থেকে তোকে কিছু ইনফর্মেশন নিয়ে আসতে বলতাম৷ আমাদের লাইনেরই কিছু ইনফর্মেশন৷’
‘অসুবিধে নেই৷ তোর কী জানার দরকার, আমায় মেল করে দে৷ অস্ট্রেলিয়া হাই কমিশনের প্রেস অফিসারের সঙ্গে আমার ভালরকম যোগাযোগ হয়ে গিয়েছে৷ তাঁর সঙ্গে তোর যোগাযোগ করিয়ে দেব৷ এখন ছাড়ি কেমন? দেখি, পারলে কাল বিকেলের দিকে তোর বড়িতে যাব৷’
শুনে অঙ্কুশ বলল, ‘আমি কিন্তু পিয়ারার বাড়িতে নেই৷ আজ সকালেই কঙ্কণদীঘিতে এসেছি৷ কাল মহেশপুর বলে একটা জায়গায় যাব৷ ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে৷ কাল বিকেলে আমার সঙ্গে তোর কিন্তু দেখা হবে না৷’
‘ঠিক আছে, তা’লে নেক্সট উইকে যাব৷’
জয় ফোনটা ছেড়ে দেওয়ার পর সোফায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল অঙ্কুশ৷ ফোমের নরম সোফা, নিশ্চয়ই খুব দামি৷ চন্দ্রভানুবাবুর এই গেস্ট হাউসের সবকিছুই দামি৷ সোফায় শুয়ে এত আরাম লাগছে, উঠে গিয়ে বিছানায় শুতে ইচ্ছে করল না অঙ্কুশের৷ কঙ্কণদীঘিতে ফের এত তাড়াতাড়ি ওকে আসতে হবে, ও ভাবতেও পারেনি৷ কিন্তু, চন্দ্রভানুবাবুর ডাকে ওকে ফের আসতে হল৷ ইতিমধ্যে পিয়ারাতে গোলাপির ধরে আনা ফিমেল পাইথনটাও এখানে রেখে গিয়েছেন জীবনবাবু৷ পাইথন দুটোকে পুষবেন বলে চন্দ্রভানুবাবু জানতে চেয়েছিলেন, এনক্লোজার কীভাবে বানাবেন৷ ওঁর লোকজনকে অঙ্কুশ সব বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিল৷ এর মধ্যে সেই এনক্লোজার তৈরি হয়ে গিয়েছে৷ সেটা দেখানোর জন্য চন্দ্রভানুবাবু ওকে এখানে নিয়ে এসেছেন৷ দুপুরে এনক্লোজার দেখে তো অঙ্কুশ অবাক! যতটা বলে গিয়েছিল, তার থেকেও ভাল৷ দুটো পাইথনই আরামে থাকবে বলে ওর মনে হয়েছে৷ কিন্তু, একটু আগে জয় যে খবরটা দিল, তাতে শিবের জীবকে চন্দ্রভানু নিজের কাছে রাখবেন কী করে, অঙ্কুশ ভেবে পেল না৷ হ্যাঁ, টাকাপয়সা দিয়ে সরকারী লোকজনকে উনি ম্যানেজ করতে পারেন৷ এখানে কে আইন মানছে বা মানছে না… তা নিয়ে বিকাশ ভবনের কোনও মাথাব্যথা নেই৷ যত জুলুম ওদের উপর!
তিন সপ্তাহ আগে এই কঙ্কণদীঘি থেকে পিয়ারায় ফেরার পথেই মারাত্মক এক মোটর দুর্ঘটনার মধ্যে পড়ে অঙ্কুশ৷ সন্ধেবেলায় মথুরাপুরের কাছাকাছি হঠাৎই ওদের গাড়ি… উল্টোদিক থেকে আসা একটা ট্র্যাককে এড়াতে গিয়ে সরাসরি ধাক্কা মারে শিরীষ গাছে৷ অঙ্কুশ ছিটকে গিয়ে পড়েছিল রাস্তায়৷ ওর মাথায় চোট লেগেছিল৷ কবজিতে ফ্র্যাকচারও হয়৷ পরে ও শুনেছে, ড্রাইভার নাকি সঙ্গেসঙ্গে মারা গিয়েছিল৷ যে সুইফট গাড়িতে অঙ্কুশ ফিরছিল, সেটা চন্দ্রভানুবাবুর৷ ব্রেক ফেল করার কথা বলা হলেও অঙ্কুশের তা বিশ্বাস হয়নি৷ গাড়িতে ও আর ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ ছিল না৷ দুর্ঘটনার ঠিক আগে ড্রাইভারের মুখে আঁতকে ওঠার আওয়াজ শুনে অঙ্কুশ সামনের দিকে তাকিয়েছিল৷ আবছা অন্ধকারের মধ্যেও একটা অদ্ভুত দৃশ্য ওর চোখে পড়েছিল৷ ড্যাশবোর্ড বেয়ে দুটো সাপ উঠে আসছে৷ দ্রুতবেগে ছুটে যাওয়া গাড়িতে কী করে এটা সম্ভব, আজও অঙ্কুশ তার উত্তর খুঁজে পায়নি৷ সম্ভবত চোখের সামনে জ্যান্ত দুটো সাপ দেখে ভয়ে সেদিন ড্রাইভার গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে৷ আর তখনই গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়৷
পুলিশকে অবশ্য অঙ্কুশ এ কথা জানায়নি৷ জানালে ওরা বিশ্বাস করত কিনা, সন্দেহ৷ কিন্তু, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই, ও ভুল দেখেছিল৷ মথুরাপুরের রাস্তায় দুর্ঘটনার পর অঙ্কুশকে চারদিন নার্সিং হোমে থাকতে হয়েছিল৷ পরে অঙ্কুশ শুনেছে, ট্রেকারের যাত্রীরা রাস্তায় ওকে পড়ে থাকতে দেখে নাকি পুলিশে খবর দেয়৷ সেই সময় অঙ্কুশের জ্ঞান ছিল না৷ রাতে পুলিশের কাছে খবর পেয়ে সৌম্যদারা মথুরাপুর থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ওকে নিয়ে যায় বারুইপুরের এক নার্সিং হোমে৷ ওই সময়টায় জয় ওর জন্য খুব করেছিল৷
বেলভিউ নার্সিং হোমের এক নিউরোলজিস্টকে পর্যন্ত জয় নিয়ে গিয়েছিল বারুইপুরে৷ তিনি এক্স রে প্লেট দেখে আশ্বাস দেন, মাথার আঘাত তেমন গুরুতর নয়৷
দুর্ঘটনার পর থেকে পিঙ্কি বউদির গার্জেনগিরি অনেক বেড়ে গিয়েছে৷ মাঝে ভুবনেশ্বরে একটা ওয়ার্কশপে যাওয়ার কথা ছিল অঙ্কুশের৷ পিঙ্কি বউদি যেতে দেয়নি৷ কঙ্কণদীঘিতেও আসতে দিতে চাইছিল না৷ কিন্তু, জয়জিতের মুখ চেয়ে শেষপর্যন্ত রাজি হয়ে যায়৷ ছেড়েছে একটা শর্তে, দিনের বেলার মধ্যে ফিরে আসতে হবে৷ বউদি জানেও না, কাল ফেরার পথে অঙ্কুশ মহেশপুরে ঢুঁ মারবে৷ ও ঠিক করে রেখেছে, গোলাপির বাবা নিবারণদাকে একবার রিকোয়েস্ট করে দেখবে৷ যদি রাজি হয়ে যায়, তা হলে কালই মেয়েটাকে ও পিয়ারায় নিয়ে যাবে৷ এই সুযোগ… এখন সঙ্গে নিয়ে গেলে বড়মা রাগ করবেন না৷
রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে৷ এসি বন্ধ করে অঙ্কুশ পাখা চালিয়ে দিল৷ এসি চালানো থাকলে ও ঘুমোতে পারে না৷ ঠান্ডায় ওর মাথা ধরে যায়৷ ঘর এখন ঠান্ডা হয়ে রয়েছে এসি-র কল্যাণে৷ পাখার হাওয়ায় চট করে ঘুম চলে আসবে৷ ডিভান থেকে একটা বালিশ তুলে নিয়ে এসে আলো নিভিয়ে সোফায় ও শুয়ে পড়তে যাবে, এমন সময় ফের ওর ফোন বেজে উঠল৷ অন্ধকারের মধ্যে মোবাইলের পর্দায় ও অভ্রের নামটা দেখতে পেল৷ ‘সেফ’ বলে একটা এনজিও আছে৷ তার মেম্বার অভ্র৷ গড়িয়ার দিকে থাকে৷ সেফ-এর কোথাও কোনও প্রোগ্রাম থাকলে ওকে খবর-টবর দেয়৷ দু’একবার ওদের অনুষ্ঠানে নিয়েও গিয়েছে অভ্র৷ কিন্তু, এত রাতে কোনওদিন ও ফোন করেনি৷ সুইচ অন করতেই ও প্রান্ত থেকে অভ্র বলল, ‘কুশদা, এত রাতে বিরক্ত করার জন্য সরি৷ আপনার সঙ্গে দু’মিনিট কথা বলা যেতে পারে?’
অঙ্কুশ বলল, ‘এত সংকোচ করার দরকার নেই৷ বলো৷’
‘রাজারহাটে আমরা একটা সার্ভে করতে যাচ্ছি৷ মে মাসের ছয় থেকে নয় তারিখ পর্যন্ত৷ আপনি কি আমাদের সঙ্গে যেতে পারবেন?’
এখনও দিনদশেক দেরি৷ ততদিনে হাতের প্লাস্টার কাটা হয়ে যাবে৷ অঙ্কুশ বলল, ‘আগে শুনি তোমাদের সার্ভেটা কী নিয়ে?’
‘খুব ইন্টারেস্টিং৷ রাজারহাটে নিউ টাউন হওয়ার পর থেকে প্রচুর প্রাণী উদ্বাস্তু হয়ে গিয়েছে৷ আমরা সার্ভে করছি, কোন কোন স্পিসিস লুপ্ত হয়ে গিয়েছে, ওই অঞ্চল থেকে৷ আগে যারা ছিল, তারাই বা এখন কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে? রাজারহাটে এখনও যে অঞ্চলগুলো অরিজিনাল অবস্থায় রয়েছে, মূলত সেখানেই আমরা সার্ভেটা করব৷ আপনার মতো লোক থাকলে আমাদের খুব সুবিধে হয়৷’
‘আমার কিন্তু খুব বেশি আইডিয়া নেই৷ ওখানে একটা প্রিলিমিনারি সার্ভে হয়েছিল৷ তখন শুনেছি, এখনও বারো ধরনের সাপ ওই অঞ্চলে আছে৷ তোমাদের এই সার্ভেটা হবে কোন অঞ্চলে?’
‘ঠিক ইকো ট্যুরিজম পার্কের উল্টোদিকে৷ তিনটে দিন ক্যাম্প করে আমরা ওখানে থাকব৷ প্রাণীগুলোকে যাতে সংরক্ষণ করা যায়, তার জন্য আমাদের একটা রিপোর্ট তৈরি করতে হবে৷’
শুনে মনে মনে হাসল অঙ্কুশ৷ নগরায়নের জন্য যে সব প্রাণী নিজেদের বাসস্থান থেকে উৎখাত হয়ে গিয়েছে, তাদেরই আবার ধরে নিয়ে এসে হয়তো ইকো ট্যুরিজম পার্কে আদর করে রাখা হবে৷ এটা কী ধরনের ভাবনা?
কথা আর না বাড়িয়ে অভ্রকে ও বলল, ‘দু’তিনদিন পর ফোন কোরো৷ যেতে পারব কি না, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে তা নিয়ে একবার কথা বলে নিতে হবে আমাকে৷ এখন ছাড়ি, কেমন?’
সারাটা দিন ওর সাপ নিয়ে চিন্তায় বা দুঃশ্চিন্তায় কাটে৷ ইদানীং ঠিক ঘুমোতে যাওয়ার আগে অঙ্কুশ খানিকটা সময় উষসীকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে৷ তাতে সারাদিনের ক্লান্তি ওর দূর হয়ে যায়৷ নিছকই একতরফা ভাবনা৷ তাতে ওর কিছু আসে-যায় না৷ উষসীর সঙ্গে ওর শেষ দেখা হয়েছিল, যেদিন ও নার্সিং হোম থেকে ফেরে৷ তিন্নি ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল পিয়ারায়৷ কথাবার্তা কিছু হয়নি৷ কেননা, পিঙ্কি বউদি একদিনেই ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার দায়িত্বটা নিয়ে ফেলেছিল৷ সেদিন উষসীর পরনে ছিল ডোরা কাটা হালকা রঙের তাঁতের শাড়ি৷ ওকে ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার বলে মনে হচ্ছিল না৷ আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের মতোই খুব ঘরোয়া লাগছিল৷ একটা সময় পিঙ্কি বউদি ওকে মূল বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বড়মা আর জেঠিমা-কাকিমাদের সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দেয়৷ ক’নে দেখানোর কাজটা মনে হয়, ওইদিন সেরে ফেলে৷
টিটোটা এত পাজি, সেদিন কী বুঝেছিল কে জানে? অঙ্কুশের মোবাইলে উষসীর একটা ছবি তুলে রেখেছিল ও৷ এর পিছনে পিঙ্কি বউদিরও মস্তিষ্ক থাকলেও থাকতে পারে৷ সেই ছবি সেভ করা আছে৷ ঘুমোতে যাওয়ার আগে অঙ্কুশ মাঝে মাঝে সেই ছবিটাকে দেখে৷ অভ্রর সঙ্গে কথা বলে টেবলে মোবাইল সেটটা রাখার আগে ও একবার উষসীকে দেখে নিল৷ তখনই ওর আফসোস হল, আজ কঙ্কণদীঘিতে আসার কথা কেন ফোন করে ও উষসীকে জানাল না? বললে হয়তো সঙ্গে আসতে রাজি হয়ে যেত৷ কেননা, সেদিনই ও বলেছিল, ওর বাবা এখন ভাল আছেন৷
উষসীর কথা ভাবার ফাঁকেই চোখে তন্দ্রামতো লেগে এল৷ তখনই করিডোরে পায়ের শব্দ শুনতে পেল অঙ্কুশ৷ সেদিনকার মতো দয়াশঙ্কর নাকি? দরজায় টকটক শব্দ৷ তার পরই চন্দ্রভানুবাবুর গলা, ‘অঙ্কুশবাবু জেগে আছেন নাকি?’
সোফা ছেড়ে উঠে অঙ্কুশ দরজা খুলে দিল৷ হাতে দোনলা বন্দুক, বাইরে থেকে চন্দ্রভানুবাবু বললেন, ‘একটা আশ্চর্য জিনিস যদি দেখতে চান, তা হলে আমার সঙ্গে আসুন৷’
অঙ্কুশ বলল, ‘কোথায় যেতে হবে?’
‘পাইথনদের এনক্লোজারে৷ রোজ রাতে পাইথন দুটো উধাও হয়ে যাচ্ছে৷’
অবিশ্বাসী গলায় অঙ্কুশ বলল, ‘ তা কী করে হবে? নিশ্চয় আপনার কোনও ভুল হচ্ছে৷ অতবড় দুটো পাইথন যাবে কোথায়? তিনদিকে ঘেরা দেওয়াল৷ ইচ্ছে করলেও যে ওরা লুকোতে পারবে না৷’
‘তা হলে নিজের চোখেই দেখবেন চলুন৷ আমার সিকিউরিটি গার্ডরা গত দু’দিন ধরেই আমাকে বলছিল৷ তখন আমি নিজেও বিশ্বাস করিনি৷ কিন্তু, আজ এখানে আসার আগে নিজের চোখে দেখে এলাম৷ পাইথন দুটো কোথাও নেই৷’
‘চলুন, তা হলে দেখে আসি৷’
চন্দ্রভানুবাবুর শিবমন্দিরটা বাড়ির মধ্যে৷ কিন্তু, পাইথনদের এনক্লোজার পাঁচিলের বাইরে কয়েক গজ দূরে৷ মন্দিরের দিককার দরজায় সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে৷ ওদের দেখে কোলাপসিবল গেট খুলে দিল৷ মিনিট কয়েক হেঁটে চন্দ্রভানুবাবুর সঙ্গে অঙ্কুশ এসে দাঁড়াল পাইথনদের এনক্লোজারের সামনে৷ সেখানে ঘন অন্ধকার৷ নদীর দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস বইছে৷ শোনা যাচ্ছে, জলের কলকল শব্দ৷ সিকিউরিটি গার্ড আলো জ্বেলে দেওয়ার পর গ্লাস ফাইবারের ফাঁক দিয়ে অঙ্কুশ ভিতরের দিকে উঁকি মারল৷ নাহ, সত্যিই পাইথন দুটোকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না৷ দুপুরে একবার এসে ও এনক্লোজারটাকে ভাল করে দেখে গিয়েছে৷ ভিতরে দুটো মাঝারি উচ্চতার গাছ, আর এদিক ওদিক ঝোপঝাড় আছে৷ উপরের দিকটায় খানিকটা অংশে লোহার মোটা জাল আর অ্যাসবেস্টাসের চাল৷ পালিয়ে যাওয়া কোনওমতেই সম্ভব নয়৷
সিকিউরিটি গার্ডের হাত থেকে টর্চটা চেয়ে নিয়ে অঙ্কুশ এনক্লোজারের ভিতর ঢুকে এল৷ ভাল করে খুঁজে দেখা দরকার৷ চন্দ্রভানুবাবু ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ এ বার বিশ্বাস হল তো আপনার৷ পাইথন দুটো ম্যাজিক জানে মনে হয়৷ শিবরাত্তির দিনও একটা পাইথন হঠাৎ মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল৷’
রেটিকিয়ুলেটেড পাইথন নিশাচর৷ কোথায় ঘাপটি মেরে রয়েছে, তা দেখার জন্য টর্চের আলো এদিক সেদিক ফেলতে লাগল অঙ্কুশ৷ তখনই ঝোপের কাছে ওর নজরে পড়ল সাদা সাদা ডিমগুলোকে৷ হাঁসের ডিমের থেকে দেড়গুণ সাইজের বড়৷ ষাট-সত্তরটা তো হবেই৷ ফেসবুকে ছবি দেখে পুর্ণের সর্পমিত্র কারমারকর তা হলে ঠিক আন্দাজ করেছিলেন৷ মে মাসের শেষদিকটায় এরা প্রচুর ডিম পাড়ে৷ ডিম পাহারা দেয় ফিমেল পাইথন৷ তার মানে ফিমেল পাইথনটা ধারে- কাছে কোথাও রয়েছে৷ ওকে বিরক্ত করা উচিত হবে না৷ এক্ষুনি বাইরে বেরিয়ে যাওয়া দরকার৷ না হলে জীবন বিপন্ন হতে পারে৷ কথাটা মুখ দিয়ে বেরনোর আগে পাশ থেকে অঙ্কুশ আঃ বলে একটা যন্ত্রখাকাতর শব্দ শুনল৷ তাকিয়ে দেখে লোহার জাল থেকে দ্রুত নেমে এসেছে বিরাট একটা হাঁ৷ এক পলকের মধ্যে চন্দ্রভানুবাবুকে পেঁচিয়ে ধরেছে মেল পাইথনটা৷ শূন্যে তুলে নিয়েছে৷ তার লেজের দিকটা লোহার জালে গিঁট দেওয়া৷ এতক্ষণ তা হলে গাছ বেয়ে উঠে পাইথনটা উপরের জালের সঙ্গে লটকে ছিল৷ সেই কারণেই নীচ থেকে ওকে দেখা যাচ্ছিল না৷
কী ভাবে চন্দ্রভানুবাবুকে ও বাঁচাবে, অঙ্কুশ বুঝতে পারল না৷
(ষোলো )
বেলা ন’টার সময় নেত্রা এসে খবর দিল, ‘দিদি, হারাধন পালাকার রিসেপশনে বসে আছেন৷ তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান৷’
কাল রাত একটা পর্যন্ত মা মনসার পালাগান করেছেন ভদ্রলোক৷ গাঁয়ের শ’পাঁচেক মানুষ শেষ পর্যন্ত বসে শুনেছে সেই পালাগান৷ উদয়শঙ্করবাবু ঠিকই বলেছিলেন৷ হারাধন গায়েনের পালাগান শুনে তরিতা বেশ প্রসন্ন৷ ভদ্রলোকের একটা অশেষ গুণ, মনসা-মাহাত্ম্য সরল কথায় লোকের মনে ঢুকিয়ে দিতে পারেন৷ গলাটাও খুব সুরেলা৷ ভদ্রলোক তিনটে অল্পবয়সি মেয়েকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন৷ তাদের পোশাক আসাক, সাজগোজ আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে তরিতার মনে হয়েছে, ভক্তিমতি মেয়ে৷ পুজো-আচ্চা করেই দিন কাটায়৷ বাজনদারদের এক পাশে তারা বসেছিল৷ আজ নাকি নেচে গেয়ে পারফর্ম করবে৷ পুরো পালাটা নাকি তেরো দিনের একটা প্যাকেজ৷ পারিশ্রমিক আর মেয়াদ অনুযায়ী, সেই পালা ছোট-বড় করে শোনান হারাধন পালাকার৷
কাল ঘুমোতে গিয়েছেন রাত দুটোর সময়৷ তাই আজ একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠেছেন তরিতা৷ স্নান সেরে নিয়েছেন৷ হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিচ্ছিলেন৷ নেত্রার কথা শুনে এলোচুলেই তিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন৷ কোমর পর্যন্ত কোঁকড়ানো চুল৷ আমেরিকায় কখনও এলোচুলে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে সাহেবরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত৷ মিয়ামিতে সেই স্নেক লেডি শো-য়ের সময় টিভি চ্যানেলের লোকজন ওঁকে বেণীবাঁধা অবস্থায় চাইতেন৷ তাতে নাকি সাপের এফেক্ট আসত৷ আরও অনেক বেশি সেক্সি দেখাত৷ শুনে মনে মনে হাসতেন তরিতা৷
কাল বিকেলে গোসাবা থেকে দয়াপুরে এসেই হারাধন পালাকার নাকি একবার দেখা করতে চেয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে৷ কিন্তু তরিতা তখন ব্যস্ত অ্যান্টনি গোমসের সঙ্গে কথা বলতে৷ তাই দেখা করেননি৷ আজ রিসেপশনে পৌঁছে তরিতা দেখলেন, হারাধন পালাকার একা আসেননি৷ তাঁর সঙ্গে তিনটি মেয়েও এসেছে৷ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হারাধন অবাক চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে৷ তার পর শরীর ঝুঁকিয়ে হাতজোড় করে প্রণাম জানিয়ে বিড়বিড় করে মনসাবন্দনা করতে লাগলেন, ‘আস্তিকস্য মুনের্মাতা ভগিনী বাসুকেস্তথা৷ জরৎকারু মুনেঃ পত্নী মনসা দেবী নমোহস্ততে৷’
হাত তুলে আশীর্বাদের ভঙ্গি করলেন তরিতা৷ উল্টোদিকের সোফায় তিনি বসতেই মেয়ে তিনটি কাছে এসে গড় হয়ে প্রণাম করল৷ খুশি হয়ে তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরা কারা হারাধনবাবু?’
হারাধন পালাকার হাতজোড় করে আছেন৷ বললেন, ‘আমাকে বাবু বলবেন না মা৷ আপনিও বলতে হবে না৷ আমার অপরাধ হবে৷ এরা আমার পালিতা কন্যা৷ গোসাবায় আমার মনসা মন্দির আছে৷ সেখেনে এরা প্রতিপালিত হচ্ছে৷ আমার সঙ্গেই পালা গান গায়৷ বেহুলা-লখিন্দরের পর্বটা করে৷ আমরা সেটা করি যাত্রার ঢঙে৷ আপনার কাছে আমি জানতে এলাম মা, পালাগান এখেনে ক’দিন করতে হবে?’
তরিতা বললেন, ‘ক’দিন করলে ভাল হয়?’
‘তিনদিন হলে আমার পক্ষে খুবই ভাল হয়৷ ভাদ্দর মাস পর্যন্ত আমাদের প্রচুর বায়না৷ সেই ক্যানিং থেকে হিঙ্গলগঞ্জ পর্যন্ত আমায় ছোটাছুটি করতে হবে৷ উদয়শঙ্করবাবু পরিষ্কার করে আমায় কিছু বলেননি৷ তাই জানতে এলাম৷’
‘শুনলাম, তুমি নাকি টাকা পয়সা কিছু নিতে চাওনি?’
‘ছলনা করবেন না মা৷ ভক্ত কি মায়ের কাছে টাকা চাইতে পারে? আপনার পালা শেষ করে তবেই আমি বায়না নেব অন্যত্র৷ বলুন, কতদিন এখেনে পালা গাইতে হবে৷’
হারাধন শুধু পালাকারই নয়, মূল গায়েনও৷ চট করে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললেন তরিতা৷ বললেন, ‘তিনদিনের পালায় তুমি কত টাকা নাও?’
‘হাজার কুড়ি টাকা মা৷ প্রতিদিন তিনঘণ্টার প্রোগ্রামের জন্য৷ বাজনদারদের পয়সা দিয়ে নিয়ে আসতে হয়৷ খোল, বাঁশি, হারমোনিয়াম আর খঞ্জনী যারা বাজাতে এসেছে, তারা খুব গরিব ঘরের৷ শিল্পী মানুষ, তাদের অন্য কোনও রোজগারও নেই৷ তারা ছাড়া, আমার দলে দোহার আছে আরও তিনজন৷ আমি এবার তাদের সঙ্গে আনিনি৷ তাদের কাল পাঠিয়েছি লাহিড়িপুরে৷ ওখানে বিরাট মনসামেলা হয় মা জননী৷ এই দয়াপুরে মনসামেলার কথা আগে কখনও শুনিনি৷ অন্তত, আমাকে কখনও কেউ বায়না করেনি৷ সেই কারণে প্রথমে আসতে চাইনি৷ কিন্তু, এখেনে এসে বুঝলাম, না এলে সাক্ষাৎ মায়ের দর্শন পেতাম না৷’
‘তোমাকে যদি সারা বছরের জন্য বায়না করি… তা হলে রাজি হবে?’
‘কথাটা মানে বুঝলাম না মা৷ আমি মুখ্যসুখ্য মানুষ৷ আমাকে বুঝিয়ে দিন৷’
‘প্রতি মাসে তোমাদের আমি মাইনে দেব৷ আমি যেখানে যেতে বলব, তোমাদের সেখানে গিয়ে গাইতে হবে৷ যাতায়াত, থাকা খাওয়ার খরচ সব আমার৷ তুমি যে সব জায়গায় অলরেডি বায়না নিয়ে ফেলেছ, সেখানে গিয়ে গাইতে পারো৷ তবে অর্গানাইজারদের বলবে, টাকাপয়সা দিতে হবে না৷’
মাস মাইনের কথা শুনে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন হারাধন পালাকার৷ পালিতা কন্যাদের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে উনি বললেন, ‘আপনার ইচ্ছেটা কী বলুন তো মা জননী?’
‘সর্বত্র যাতে মনসা পুজো ছড়িয়ে পড়ে, তার ব্যবস্থা তোমাকে করতে হবে৷’
‘বাদাবনে সর্পভীতির জন্য, এমনিতেই লোকে মা মনসার ভক্ত৷ তবে কিনা পুজোর ইচ্ছে থাকলেও অনেকে টাকাপয়সার অভাবে করতে পারে না৷ আপনি আদেশ করলেন, আমি চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখব না মা৷ ভাদ্দর মাসের শেষ দু’দিন আর পয়লা আশ্বিনএই অঞ্চলে প্রচুর মনসামেলা হয়৷ সেই গদখালি থেকে নফরগঞ্জ পর্যন্ত অনেক জায়গায়৷ অর্গানাইজারদের নাম আর ফোন নাম্বার সব আমার কাছে আছে৷ আপনি চাইলে আমি দিতে পারি৷’
‘আমাকে নয়৷ নেত্রাকে সেইসব নাম আর মোবাইল নাম্বার দিয়ে দেবে৷ ও তাদের সঙ্গে কথা বলে রাখবে৷ কিন্তু, আমি চাই, যে সব জায়গায় মনসা পুজো হয় না, সেখানেও তোমায় পুজোর ব্যবস্থা করতে হবে৷’
‘করব মা জননী৷ কিন্তু একটা কথা বলে রাখি৷ রায়দীঘি, কঙ্কণদীঘি এলাকায় আপনার আদেশ পালন করা বোধহয় সম্ভব হবে না৷’
‘কেন সম্ভব হবে না?’
‘ওই অঞ্চলে শিবভক্ত বেশি৷ যাঁর কথায় লোকে ওঠে বসে, তিনি মনসা পুজো করতে দেবেন না৷’
‘কে সেই লোকটা?’
‘মা, তাঁর নাম চন্দ্রভানু৷ এই সোন্দরবনে দোর্দন্ডপ্রতাপ তাঁর৷ আর আছে টাকার অহংকার৷ সঙ্গে থানা পুলিশ আর লোকলস্কর৷’
নামটা শুনেই জ্বলে উঠলেন তরিতা৷ কিন্তু, ক্রোধ প্রকাশ না করে বললেন, ‘তোমাকে সে সব নিয়ে ভাবতে হবে না৷ রায়দীঘি আর কঙ্কণদীঘির কাছাকাছি কোনও একটা জায়গার নাম তুমি আমায় বলো৷ যেটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম৷ মা মনসার পুজো করলে, সেই খবর এই চন্দ্রভানু বলে লোকটার কানে পৌঁছবে৷’
‘আছে একটা জায়গা… মহেশপুর৷ শোলাশিল্পের জন্য খুব বিখ্যাত৷ বাইরের বহু ব্যাপারীর যাতায়াত সেখেনে৷ মহেশপুরের পঞ্চায়েত প্রধান অমর মন্ডল আমার খুব পরিচিত৷ তাঁর মেয়ের বিয়ে হয়েছে আমাদের গোসাবায় চণ্ডীপুরে৷ তাঁর সঙ্গে কথা বললে মা সেখেনে মেলা করা যেতে পারে৷ ওই অঞ্চলে একটিই মাত্তর মানুষ, যিনি চন্দ্রভানুকে পছন্দ করেন না৷’
‘তার সঙ্গে আগে তুমি কথা বলো হারাধন৷ টাকাপয়সা নিয়ে ভেবো না৷ ভাদ্দর মাসের আগেই আমি ওখানে মেলা করতে চাই৷ যেন খুব জাঁকজমক করে হয়৷ দরকার হলে আমি নিজে যাব সেই পুজোয়৷ দেখি, কে আমায় আটকায়? আর কিছু বলবে?
‘আসল কথাটাই তো হল না মা জননী৷ এখেনে পালাগান ক’দিন করতে হবে আমাকে৷’
‘তুমি শান্তি আর শোভার সঙ্গে কথা বলে নাও৷ গাঁয়ের লোকেরা কী চায়, সেটা জানো৷’
তখনই শান্তির গলা শুনতে পেলেন তরিতা, ‘গাঁয়ের লোকেরা খুব খুশি ম্যাডাম৷ আশপাশের গাঁয়ে ছড়িয়ে গিয়েছে খবরটা৷ সুধাংশুপুর থেকে আসার সময় আমাকে অনেকে আজ জিজ্ঞেসও করলেন, পালাগানের কথা৷ আমি বলি কী, তিনদিনই চলুক পালাগান৷ বৃষ্টিবাদলার কারণে সেটাই পাঁচদিনে গিয়ে দাঁড়াবে৷ রিসর্টে দু’তিনটে ফ্যামিলি ওভারস্টে করে গেলেন পালাগান শুনবেন বলে৷’
শান্তি যে রিসেপশনে এসে… বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে কথা শুনছে, সেটা লক্ষ করেননি তরিতা৷ কেননা, বাঁ চোখে তিনি ভাল দেখতে পান না৷ গাঁয়ের মুরুবিবদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য, একটু পরে তিনি ডেকে পাঠাতেনই শান্তিকে ৷ আজকাল গাঁয়ের মানুষরা চট করে শহুরে লোকদের বিশ্বাস করতে চান না৷ হঠাৎ ঘটা করে মনসা পুজো কেন, মতলবটা কী, এই প্রশ্ন উঠতেই পারে৷ কাল রাতে মুরুবিবদের অনেকেই ওঁকে চাক্ষুষ করেছেন৷ কেউ কাছে এসে আলাপ করার আগ্রহ দেখাননি বটে, কিন্তু তাঁদের চোখমুখ দেখে তরিতার মনে হয়েছে, যথেষ্ট কৌতূহলী৷
কাল শোভাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন বলে তরিতা নিজেও কারও সঙ্গে যেচে আলাপ করতে যাননি৷ ঠিক করেই রেখেছেন, আজ কথা বলবেন মুরুবিবদের সঙ্গে৷ ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেবেন, তিনি এনজিও দিদিমণি নন৷ দয়াপুরে থাকতে এসেছেন৷ সোফা ছেড়ে ওঠার সময় তিনি বললেন, ‘হারাধন, তা’লে ওই কথাই রইল৷ পালা তিনদিনই হবে৷ শোভার কাছ থেকে টাকাপয়সা তুমি নিয়ে যেও৷’
‘তাই হবে মা জননী৷’ বলে আর একবার শরীর ঝুঁকিয়ে জোড়হাতে নমস্কার করে হারাধন পালাকার বেরিয়ে গেলেন৷
রিসর্টের রুম থেকে ট্যুরিস্টরা অনেকে বেরিয়ে আসছেন৷ বেলা দশটায় একটা লঞ্চ ট্রিপ আছে৷ রিসর্টের লোকেরাই লঞ্চে করে পরপর দু’দিন ট্যুরিস্টদের নিয়ে যান আর সজনেখালি আর দো বাঁকিতে৷ দুটো জায়গাতেই টাইগার ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে৷ ট্যুরিস্টরা বাঘ দেখার আশায় যান সেখানে৷ বাঘ নাকি প্রায়ই জল খেতে আসে দো বাঁকি আর সজনেখালির জঙ্গলে৷ ঘণ্টা চারেকের ট্রিপ৷ রিসর্টে এসে দ্বিতীয় দিন তরিতা দো বাঁকি ট্রিপে গিয়েছিলেন৷ মাতলা নদীর ওই বাঁকটা ভরা কোটালের সময় ভয়ঙ্কর৷ সমুদ্রের মতো বিশাল ঢেউ৷ অপর প্রান্ত দেখা যায় না৷ দো বাঁকির টাওয়ারে উঠে ছিলেন তিনি আর নেত্রা৷ কিন্তু বাঘ চোখে পড়েনি৷ খুব মজাও লেগেছিল একটা কথা ভেবে৷ চিড়িয়াখানায় বাঘ থাকে লোহার গারদের ভিতর৷ মানুষরা তাকে দেখে বাইরে থেকে৷ কিন্তু বাদাবনে ঠিক উল্টো৷ মানুষ থাকে লোহার জালে ঘেরা টাওয়ারে৷ বাঘ ঘুরে বেড়ায় নীচে জঙ্গলে!
‘শান্তি, তুই একবার ডাইনিং হল-এ আয়৷ তোর সঙ্গে কথা আছে৷’ বলে তরিতা ডাইনিং হলের দিকে পা বাড়াচ্ছেন, এমন সময় বয়স্ক এক ভদ্রলোক তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন৷ বয়স সত্তরের কাছাকাছি হবে৷ বোধহয় কিছু বলতে চান৷ কিন্তু একটু ইতস্তত করছেন৷ সেটা লক্ষ করে তরিতা বললেন, ‘ আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন?’
ভদ্রলোক নমস্কার করে বললেন, ‘ আমি কমলেশ চৌধুরী৷ জুলজি পড়াতাম, এখন রিটায়ার্ড৷ সাগর দ্বীপে এখন রিসার্চ করি৷ এই সুন্দরবনের তো বায়োডাইভার্সিটির কোনও তুলনা নেই৷ কত ধরনের রেয়ার স্পিসিস রয়েছে, তা এখনও অজানা৷ এই বয়সেও আমি সেটা জানার চেষ্টা চালাচ্ছি৷ সে যাক, কাল রাতে আপনাদের পালাগান দেখলাম ম্যাডাম৷ আমার কিন্তু রয়ানির মতো লাগল না৷’
ভদ্রলোক সম্ভবত তাঁকে রিসর্টের কেউ ভেবে নিয়েছেন৷ কাল রাতে পালাগানের আসরে দেখে থাকবেন৷ রয়ানি কথাটার মানে তরিতা ঠিক বুঝতে পারলেন না৷ সরাসরি সেটা জানতে না চেয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কেন. আপনার এ রকম মনে হল?’
‘ম্যাডাম আমার জন্ম পূর্ববঙ্গের খুলনায়৷ দেশভাগের পর এদিকে এসেছি৷ ওপার বাংলায় ঘরে ঘরে মনসা পুজো হয়৷ ছোটবেলায় রয়ানির খঙে মা মনসার পালাগান প্রচুর শুনেছি৷ এখানে পালাগান হচ্ছে শুনে… বহু বছর পর কাল তাই শুনতে গিয়েছিলাম৷ কিন্তু, সত্যি বলতে কী, রয়ানির ক্লাসটাই আলাদা৷ এখনও চোখে লেগে রয়েছে ম্যাডাম৷ মূল গায়েনের পরনে ধুতি, কোমরে বাঁধা গেরুয়া অথবা বাসন্তী রঙের উত্তরীয়৷ কপালে চন্দনের ফোঁটা, হাতে চামর৷ মঞ্চের চার পাশে ঘুরে ঘুরে তিনি গেয়ে যাচ্ছেন৷ তার দু’পাশে দু’জন শ্রীখোল বাদক৷ রঙীন গেঞ্জি আর ধুতি পরে খোলবাদ্যের তালে তাঁরা নাচছেন৷ আসরের একপাশে একজন বাঁশি বাজাচ্ছেন, একজন হারমোনিয়াম ও একজন খঞ্জনী৷ এঁরাই দোহারের কাজটা করতেন৷ ধুয়া ধরতেন৷ কখনও কখনও মূল গায়েনের সঙ্গে সংলাপ আদান-প্রদান করে আখ্যান বর্ণনায় বৈচিত্র্য আনতেন৷ এই ধারাটাই রয়ানি৷ সেই বৈচিত্র্যটা এখানে দেখতে পেলাম না ম্যাডাম৷’
তরিতা হেসে বললেন, ‘আজ রাতে দোহাররা থাকবেন৷ দেখলে আপনার ভাল লাগবে৷ কিছু মনে করবেন না৷ একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করি৷ আপনি দয়াপুরেও রিসার্চের কাজে এসেছেন নাকি?’
‘না, না৷ আমার এক সুইডিশ বন্ধু এসেছেন গোটেনবার্গ থেকে৷ উনিও জুলজিস্ট৷ কখনও বাঘ দেখেননি৷ সেই কারণেই ওকে সঙ্গে নিয়ে আমার এই রিসর্টে আসা৷ দেখি, কপালে ব্যাঘ্র দর্শন আছে কি না? আচ্ছা, চলি৷ রাতে যদি বার্বিকিউতে আসেন, তা হলে ফের দেখা হবে৷’
কথাগুলো বলেই কমলেশ চৌধুরী পা বাড়ালেন গেটের দিকে৷ বায়োডাইভার্সিটি কথাটা কানে লেগে রইল তরিতার৷ পরে এ নিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলা যাবে৷ সত্যিই তো সুন্দরবনে কী নেই! সাপেরই প্রজাতি আছে বাইশ ধরনের৷ তার মধ্যে ছয় প্রজাতির সাপ বিষধর৷ এই সর্পকুলের সুলুক সন্ধান তাঁর চাই-ই৷ এই বাদাবনে তিনি এমনি এমনি আসেননি৷ অনেক ভেবে-চিন্তে তরিতা তাঁর প্রোজেক্টের স্থান নির্বাচন করেছেন৷ কথাটা মনে নাড়াচাড়া করতে করতে তিনি ডাইনিং হলে ঢুকে এলেন৷ সকালের দিকে তিনি ফলের রস আর এক টুকরো টোস্ট ছাড়া আর কিছু খান না৷ রিসর্টের ম্যানেজারকে সে কথা প্রথম দিনই বলে রেখেছিলেন৷ কোণের দিকে একটা চেয়ারে বসে তরিতা দেখলেন, ট্যুরিস্টরা অনেকেই ব্রেকফাস্ট করতে এসেছেন৷ খেতে খেতে কেউ কেউ আলোচনাও করছেন কাল রাতে দেখা মা মনসার পালাগান নিয়ে৷
খবরের কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতে তরিতা শুনতে লাগলেন তাঁদের কথাবার্তা৷ তাঁর সামনের টেবলেই বসেছে পাঁচজনের একটা গ্রুপ৷ সদ্য বিয়ে হওয়া এক দম্পতি রয়েছে তাদের মাঝে৷ হাজবেন্ড ছেলেটা বলল, ‘ মা মনসার জন্মবৃত্তান্ত শুনে আমার হাসি পাচ্ছিল মউ৷ সম্ভব নাকি? শিবের বীর্য পদ্মপাতার নাল দিয়ে পাতালে চলে গেল৷ সেই বীর্য নিয়ে কে একজন পুতুল বানালেন৷ আর তার পরই জন্ম হয়ে গেল মনসার! বিশ্বাস করা যায়?’
শুনে গম্ভীর হয়ে গেল মউ বলে মেয়েটি৷ বলল, ‘ঠাকুর দেবতা নিয়ে ঠাট্টা কোরো না মৈনাক৷ কাল রাত থেকে তুমি একই কথা বলে যাচ্ছ৷ আমার ভাল লাগছে না৷’
মাঝবয়সি এক ভদ্রলোক বসে আছেন দলটাতে৷ তিনি বললেন, ‘মউ ঠিকই বলেছে মৈনাক৷ তোমরা হনিমুন করতে এসেছ, এই আলোচনাটা বাদ দাও৷ যাও, দো বাঁকিতে ঘুরে এসো৷ ’
মৈনাক চুপ করে যাওয়ার পাত্র নয়৷ বলল, ‘মউ একটা শিক্ষিত মেয়ে৷ কেন মঙ্গলকাব্যের গাঁজাগপ্প ও সত্যি বলে ধরে নেবে, এটাই আমি বুঝতে পারছি না সুজনদা৷’
মাঝবয়সি ভদ্রলোক… সুজনদা বললেন, ‘দোষটা মঙ্গলকাব্যের নয়৷ পুরাণে অন্য রকম ব্যাখ্যা দেওয়া আছে৷ মনসা হলেন প্রকৃতির অংশ৷ সে বিরাট একটা বিষয়৷ কাল রাতে মনসার যে আখ্যান তুমি শুনেছ, সেটা বিপ্রদাস পিপলাইয়ের লেখা৷ মনসামঙ্গল কাব্যের ইতিহাস কি তুমি জানো?’
মৈনাক বলল, ‘জানব কী করে? আপনি বাংলা সাহিত্য পড়ান৷ আপনি জানতে পারেন৷ আমি যদ্দূর জানি, মনসা পৌরাণিক দেবী নন, উনি লৌকিক দেবী৷’
‘এ নিয়ে ভিন্নমত আছে মৈনাক৷’ সুজনের গলায় ঈষৎ বিরক্তি, ‘কী দরকার তোমার এখন এসব নিয়ে কথা বলার? লঞ্চ ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে৷ তোমরা শিগগির ফেরিঘাটে যাও৷’
মৈনাক ছেলেটার উপর রাগ হচ্ছে তরিতার৷ মুখের সামনে থেকে কাগজটা সরিয়ে তিনি দেখতে পেলেন, মউ বলে মেয়েটা রেগে উঠে দাঁড়িয়েছে৷ ডাইনিং হল ছেড়ে… ফেরিঘাটের দিকে না গিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে রিসর্টের ভিতরে৷ তার মান ভাঙানোর জন্য মৈনাকও পিছু পিছু রিসেপশনের দিকে যাচ্ছে৷ ছেলেটা বলতে বলতে যাচ্ছে, ‘চলে যেও না মউ৷ তোমায় এট্টু রাগাচ্ছিলাম বউ৷’ কবিতার ছন্দে কখনো কাউকে মান ভাঙাতে শোনেননি তরিতা৷ শুনে হেসে ফেললেন৷ মুহূর্তে তাঁর রাগ গলে জল হয়ে গেল৷
ফলের রস আর টোস্ট কাউন্টার থেকে নিয়ে এসেছে শান্তি৷ টেবলের উপর ট্রে-টা রেখে ও বলল, ‘ম্যাডাম, এক্ষুণি আপনি রুমে যাবেন না৷ ক্লিনাররা আপনার রুমে দুটো সাপ ঢুকতে দেখেছে৷ লোক আসছে, ওদের বের করে দিতে৷’
শান্তির চোখমুখে উদ্বেগ দেখে হাসলেন তরিতা৷ বললেন, ‘থাক না, ওরা ঘরে থাক৷ সাপ হচ্ছে নিরীহ প্রাণী৷ ওদের তোরা ডিসটার্ব করিস না৷ মা মনসা পাঠিয়েছেন৷ নেত্রাকে গিয়ে বল, ওদের যেন খাতির যত্ন করে৷’ কথাগুলো বলে নিশ্চিন্তে ফলের রসে চুমুক দিলেন তরিতা৷
(সতেরো)
স্বপ্নেরও মানে আছে৷ গুস্তাভ মিলারের বইতে পড়েছিল অঙ্কুশ৷ কঙ্কণদীঘি থেকে বাড়ি ফেরার সময় ও ঠিক করে রেখেছিল, মিলারের বইটা খুঁজে বের করবে৷ কাল রাতে দেখা অদ্ভুত স্বপ্নটার মানে জানার চেষ্টা করবে৷ মনোবিজ্ঞানী গুস্তাভ মিলার দশ হাজার স্বপ্নের ব্যাখ্যা লিখে রেখে গিয়েছেন৷ তার মধ্যে সাপ সম্পর্কিত স্বপ্ন ও তার তাৎপর্য নিয়ে একটা অংশ রয়েছে৷ অঙ্কুশ কিছুতেই ভুলতে পারছে না, দশ ঘণ্টা আগে চন্দ্রভানুবাবুর গেস্ট হাউসে দেখা সেই দুঃস্বপ্নের কথা৷ রেটিকিয়ুলেটেড পাইথনটা চন্দ্রভানুবাবুকে জড়িয়ে শূন্যে তুলে নিয়েছে৷ মৃত্যুভয়ে উনি আর্তনাদ করছেন৷ আর নীচ থেকে অসহায় চোখে ও তাকিয়ে রয়েছে৷ সেই দৃশ্যটা এখনও ওর চোখের সামনে ভাসছে৷ অঙ্কুশ ভাবতেই ও শিউরে উঠছে, সত্যিই যদি পরিস্থিতিটা এ রকম হত, তা হলে কী করত?
ঘুম ভেঙে সোফায় উঠে বসেছিল অঙ্কুশ৷ দরদর করে ঘামছিল৷ বুঝতে ওর অনেক সময় লেগেছিল, সত্যি এমন কিছু ঘটেনি৷ বড়মায়ের মুখে অঙ্কুশ শুনেছে, ভোরবেলার স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়৷ জানলার দিকে চোখ যেতেই ও দেখেছিল, ভোর হয়ে গিয়েছে৷ পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে আশপাশের গাছ থেকে৷ নদীর ধার থেকে ভটভটির আওয়াজ ভেসে আসছে৷ তার মানে, মণি নদীতে ফেরি সার্ভিস চালু হয়ে গিয়েছে৷ অঙ্কুশের তখন ইচ্ছে হয়েছিল, কাউকে কিছু না জানিয়ে গেস্ট হাউস থেকে পালিয়ে যায়৷ পাইথনটা যদি চন্দ্রভানুবাবুর কোনও ক্ষতি করত, তা হলে কঙ্কণদীঘি থেকে ও আর ফিরতে পারত না৷ কেউ বিশ্বাসই করত না, গভীর রাতে উনিই অঙ্কুশকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন পাইথনদের এনক্লোজারে৷
চন্দ্রভানুবাবু ওকে বিকেলের আগে ছাড়তে চাননি৷ কিন্তু, ব্রেকফাস্ট করেই অঙ্কুশ বেরিয়ে এসেছে৷ বলেছে, হাতের প্লাস্টার কাটার জন্য ওকে বেলভিউতে যেতেই হবে৷ ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে বেলা দুটোর সময়৷ ওর খুব ইচ্ছে ছিল, ফেরার পথে মহেশপুর থেকে গোলাপিকে পিয়ারায় নিয়ে যাবে৷ কিন্তু, গাড়িতে ওঠার পর অঙ্কুশ মত বদলায়৷ মহেশপুরে নামলে চট করে ও বেরিয়ে আসতে পারত না৷ গোলাপির বাড়ির লোকেরা দুপুরে না খাইয়ে-দাইয়ে ওকে ছাড়ত না৷ ফলে অনেক বেলা হয়ে যেত৷ ড্রাইভার মারফত নিশ্চয়ই সেই কথাটা চন্দ্রভানুবাবুর কাছে পৌঁছে যেত৷ মিথ্যে কথাটা ধরা পড়ে যেত৷ আর তাতে উনি অসন্তুষ্ট হতেন৷
বেলা একটা নাগাদ পিয়ারাতে পৌঁছে অঙ্কুশ আর বাড়ির ভিতর খোকেনি৷ বারমহল থেকেই ফোনে পিঙ্কি বউদিকে ফেরার খবরটা দিয়েছে৷ যাতে লাঞ্চ পাঠিয়ে দেয়৷ তার পর জামা-কাপড় বদলে আলমারি খুলে গুস্তাভ মিলারের বইটা ও বের করে এনেছে৷ কাল রাতে যে স্বপ্নটা ও দেখেছে, তার মানে জানার জন্য৷ সোফায় বসতে গিয়ে হঠাৎ অঙ্কুশের চোখে পড়ল, একটা লাউডগা সাপ সোফায় কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে৷ দেখেই অঙ্কুশের মনে পড়ল, এই সাপটাকে দিন কুড়ি আগে ও গাছ থেকে নিয়ে এসেছিল, ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের সময় পিঙ্কি বউদিকে চমকে দেবে বলে৷ সেদিন ডিনারের পর সাপটা কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছিল অঙ্কুশের মনে নেই৷ তবে এটা মনে আছে, চোখের সামনে লাউডগার কালো সাদা হাঁ মুখ দেখে পিঙ্কি বউদি চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠেছিল৷ তার পর তিনদিন আর ওর সঙ্গে কথা বলেনি৷ পিঙ্কি বউদি ভাগ্যিস সেই সময় বিরিয়ানির প্লেট শেষ করে ফেলেছিল!
লাউডগাটাকে আলাদা করে রাখার কোনও বাক্স ওর ঘরে নেই৷ তাই সাপটাকে বাগানে ছেড়ে দিয়ে এল অঙ্কুশ৷ কাল রাতে বোধহয় ভাল বৃষ্টি হয়েছে এই অঞ্চলে৷ ভিজে সবুজ ঘাস চিরে লাউডগাটা ক্ষিপ্রগতিতে এঁকেবেঁকে চলে গেল তুরুকতোববা গাছটার দিকে৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল৷ ফিরে এসে সোফায় বসে গুস্তাভ মিলারের বইতে মন দিল অঙ্কুশ৷ পাতা উল্টে সাপের স্বপ্ন সম্পর্কিত অংশটা বের করে ও পড়তে শুরু করল৷ ‘যদি কোনও মহিলা স্বপ্ন দেখেন, মৃত সাপ তাকে কামড়িয়েছে, তা হলে বুঝতে হবে, কোনও বন্ধুর দ্বারা তিনি প্রতাড়িত হবেন৷’
‘যদি কেউ স্বপ্নে দেখেন, দুটো বা তার বেশি সাপ পরস্পরকে জড়িয়ে রয়েছে, তা হলে তার মধ্যে সৌভাগ্য আর অনিশ্চয়তার দ্বন্দ্ব পরিস্ফুট হবে৷’
‘স্বপ্নে কোনও সাপকে কেউ মারতে দেখলে, শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে তার জয় অবশ্যম্ভাবী৷’
‘স্বপ্নের মধ্যে সাপ কাউকে কামড়াচ্ছে এমনটা দেখতে পেলে, বুঝতে হবে, তার উপর অশুভ শক্তি প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে৷’
পড়তে পড়তে আসল অংশটায় এল অঙ্কুশ৷ এই তো মিলার লিখেছেন, ‘স্বপ্নে যদি দেখা যায়, সাপ কোনও ব্যক্তিকে জড়িয়ে ধরে আছে, তা হলে তা সেই ব্যক্তির নিরাপত্তাহীনতা ও অশুভ শক্তির কাছে আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দেয়৷’
বারদুয়েক লাইনগুলো পড়ে অঙ্কুশ হতাশ হল৷ মিলারের এই ব্যাখ্যাটা ওর মনঃপুত হল না৷ তা কী করে হয়? সত্যি বলতে কী, দ্বিতীয়বার কঙ্কণদীঘিতে গিয়ে চন্দ্রভানুবাবুর ক্ষমতা সম্পর্কে ওর খানিকটা আইডিয়া হয়েছে৷ উনি এমন মানুষ, যার ভয়ে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়৷ উনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন কেন? অশুভ শক্তির কাছে আত্মসমর্পণই বা করতে যাবেন কোন দুঃখে? সকালেই ব্রেকফাস্টের টেবলে ঘণ্টাখানেক সময় অঙ্কুশ কাটিয়েছে চন্দ্রভানুবাবু ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে৷ ভদ্রমহিলাই বরং বেশি আতঙ্কে রয়েছেন বলে ওর মনে হয়েছে৷ সাপ সম্পর্কে এমন ভয় জন্মেছে যে, অন্তত বারতিনেক উনি বললেন, ‘আপনি যদি এখানে এসে থাকেন, তা হলে আপনাকে কত পারিশ্রমিক দিতে হবে অঙ্কুশবাবু?’ শুনে অঙ্কুশের হাসি পেয়েছিল৷ মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা চাইলেও বোধহয় ওঁরা রাজি হয়ে যেতেন৷
কথাটা পিঙ্কি বউদি শুনলে হয়তো বলবে, ‘এ মা, তুমি রাজি হয়ে গেলে না কেন কুশ? পঞ্চাশ হাজার টাকা, কম নাকি? চিড়িয়াখানায় চাকরিটা পেলে তুমি এর অর্ধেকও রোজগার করতে পারবে না৷’
কথাটা যে সত্যি, তা অঙ্কুশও জানে৷ কিন্তু, চন্দ্রভানুবাবু বা তাঁর স্ত্রীর কথাবার্তায় ও বুঝতে পারেনি, ওঁরা ঠিক কী চান? মঙ্গলকাব্যের সেই চাঁদ সওদাগরের মতো, হাতে হেঁতালের লাঠি নিয়ে সাপকে ভয় দেখাবে… ওই বাড়ির চার পাশে ঘুরে বেরাবে… এটা তো হতে পারে না৷ হারপেটোলজিস্ট হিসেবে ওর যথেষ্ট সুনাম হয়েছে৷ বাইরে থেকেও লোকে এখন ওকে ডাকাডাকি করে৷ কঙ্কণদীঘিতে চলে গেলে ও একেবারে আটকা পড়ে যাবে৷ নানা জায়গায় ওয়ার্কশপ বা সেমিনারে আর যেতে পারবে না৷ তা ছাড়া, সবথেকে বড় সমস্যা ওর পোষ্যপুত্তুরদেরই বা কী হবে?
গুস্তাভ মিলারের বইটা টেবলে রেখে অঙ্কুশ চন্দ্রভানুবাবু আর তাঁর স্ত্রীর কথাই ভাবতে লাগল৷ ভদ্রমহিলাকে ও এই প্রথম দেখল৷ এককালে যে অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন, দেখে এখনও তা বোঝা যায়৷ অত্যন্ত মিষ্টভাষী৷ কথা বললে মাতৃস্নেহের আন্দাজ পাওয়া যায়৷ দয়াশঙ্করের মুখে ও শুনেছে, উনি কঙ্কণদীঘি অঞ্চলেরই মেয়ে৷ অঙ্কুশ একটু অবাকই হয়েছে জেনে, আজীবন যিনি বাদাবনে কাটিয়েছেন, তাঁর এত সর্পভীতি কেন? বাড়িতে সাপের উৎপাত, জয়জিৎকে কামড়ানো, বেদেদের আসা… সব মিলিয়ে ভদ্রমহিলার নাকি মনে হচ্ছে, এর পিছনে একটা দৈবীশক্তির প্রভাব রয়েছে৷ ব্রেকফাস্ট শেষ করে চন্দ্রভানু কিছুক্ষণের জন্য টেবল ছেড়ে উঠে গিয়েছিলেন ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলার জন্য৷ সেই ফাঁকে ভদ্রমহিলাকে ও একবার জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনারা অহেতুক এত ভয় পাচ্ছেন কেন?’
ভদ্রমহিলা বলেছিলেন, ‘ভয় পাচিচ অন্য কারণে বাবা৷ তোমাকেই বলচি৷ পাঁচকান কোরো না কো৷ এমনকী, আমার কত্তার সামনেও কক্ষনো উচ্চারণ করো না৷ মা মনসা আমাকে স্বপ্নে দেখা দিইচিলেন৷ নিত্যি তাঁর পুজো করতে বলেচেন৷ কিন্তু, এ বাড়িতে বাবা মা মনসা পুজো করা যাবে না কো৷’
অঙ্কুশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেন করা যাবে না?’
‘বাড়ির কত্তা যে চান না৷ উনি শিবভক্ত৷ শিব ছাড়া আর কাউকে পুজো করবেন না৷ মা মনসার উপর ওঁর খুব রাগ৷ মা মনসা নাকি কুলীন দেবদেবীদের মধ্যে পড়েন না৷ কোনও দেবীর গর্ভে জন্মাননি৷ তা হলে কেন তাঁর কাচে মাথা নোয়াবেন?’
‘শুধু এই কারণেই রাগ?’
‘আরও একটা কারণ আছে বাবা৷ আমার খুড়শউর সাপের কামড়ে মারা গেচিলেন৷ সেই থেকে আমার শউর আর কত্তা সাপ আর মা মনসাকে দু’চোখখে দেকতে পারেন না৷ শউরমশাই সাপের বিষ নামানোর মন্তর জানতেন৷ আমার কত্তাকেও সেই মন্তর শিখিয়ে গিয়েচেন৷ দু’জনে মিলে যে কততো সাপ মেরেচেন, তা লেকা-জোকা নেই৷ নেহাত স্বামী মহেশ্বরজি সহায়৷ তাই মা মনসা এখনও শিখখে দেননি৷’
মন্তর দিয়ে কী করে সাপের বিষ নামানো সম্ভব, অঙ্কুশের তখন তা বোধগম্য হয়নি৷ ভদ্রমহিলা এর পর যা বলেছিলেন, তা আরও আশ্চর্যজনক৷ একবার চন্দ্রভানুবাবুর কাকা নাকি রায়দীঘিতে শঙ্খ লাগা অবস্থায় দু’টি সাপের একটিকে মেরেছিলেন৷ স্ত্রী সাপটি তখনকার মতো পালিয়ে যায়৷ কিন্তু পরে সেই স্ত্রী সাপটিই বদলা নেওয়ার জন্য… বাড়ি চিনে এসে ছোবল মেরে যায়৷ সাপ চরিত্র সম্পর্কে অঙ্কুশের যতটুকু ধারণা, তার সঙ্গে এই প্রতিশোধস্পৃহা খাপ খায় না৷ এ সব গল্পকথা৷ সাপের স্মৃতিশক্তি খুবই কম৷
কিন্তু, এই স্বামী মহেশ্বরজিটা কে? যাঁর কৃপাদৃষ্টি আছে বলে মা মনসা কূপিত হননি? প্রশ্নটা করতেই হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে চন্দ্রভানুবাবুর স্ত্রী বলেছিলেন, ‘উনি ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরুষ৷ সাক্ষাৎ শিব৷ আমরা ওঁরই শিষ্য বাবা৷ ওঁর পরামর্শ ছাড়া আমার কত্তা এক পাও এগোন না কো৷’
অঙ্কুশ বলেছিল, ‘তা হলে এই বিপদে আপনারা তাঁরই শরণাপন্ন হচ্ছেন না কেন?’
‘স্বামী মহেশ্বরজি এখন সাগরের আশ্রমে নেই৷ পাথরপ্রতিমায় এক শিষ্যের বাড়িতে অধিষ্ঠান করচেন৷ শিবরাত্তিরের দিন উনি এখেনে পায়ের ধুলো দিয়েচিলেন৷ সেদিনইপেরথম পাইথনটা আমাদের শিবমন্দিরে দেখা গেচিল৷’
‘মা মনসার স্বপ্নাদেশ আপনি তার আগে পেয়েছিলেন, না পরে?’
‘পরে৷ জানো বাবা, আমার বাপের বাড়িতে সবাই বিষহরির ভক্ত ছেল৷ ভাদ্দর মাসে ঘটা করে পুজো হত৷ বে হয়ে আসা ইস্তক আর মায়ের পুজো করিনিকো৷ বাপের বাড়িতে গে যে পুজো দে আসব, তার উপায় নেই ৷ কেউ যে বেঁচে নেই৷ পষ্ট বুঝতে পারচি, মা মনসা কূপিতা হয়েছেন কোনও কারণে৷ আমার এই ভরা সংসার ছারখার হয়ে যাবে৷ তুমি ছিলে বলে আমার জয়জিৎকে ফিরে পেইচি বাবা৷ তুমি আমাদের এখেনেই চলে এসো৷ যদি তোমার অন্য কোনও অসুবিধে না থাকে৷’
ভদ্রমহিলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ওদের পিয়ারার বাড়িতে আর কে কে আছেন৷ অঙ্কুশ কী করে৷ এখনও বিয়ে করেনি কেন? তার পরই বলেছিলেন, ওঁর বড় বউমার এক বোন আছে৷ সে খুব সুন্দরী এবং শিক্ষিতা৷ কলকাতায় আলিপুরে থাকে৷ বেয়ান মশাই প্রচুর দেবেন থোবেন৷ সেই মেয়ের জন্য পাত্তর খোঁজা হচ্ছে৷ ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এ সব শুনে অঙ্কুশ আর লাঞ্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায়নি৷ ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন চন্দ্রভানুবাবু৷ ঘরে ঢুকে ব্যস্ততার সঙ্গে বলেছিলেন, ঘণ্টখানেকের মধ্যেই তিনি হিঙ্গলগঞ্জের ভেড়িতে যাবেন৷
‘বসে বসে কার কথা ভাবছ গো কুশ ঠাকুরপো?’ চোখটা বুঁজে ছিল বলে অঙ্কুশ দেখতে পায়নি, কখন পিঙ্কি বউদি ঘরে এসে ঢুকেছে৷ গলা শুনে চোখ খুলে ও দেখতে পেল, হাতে খাবারের থালা নিয়ে বউদি দাঁড়িয়ে৷ চোখাচোখি হতেই মুচকি হেসে বউদি জিজ্ঞেস করল, ‘কার ধ্যান করছ?’
ধরেই নিয়েছে, পেটে খিদে নিয়ে… বসে বসে ও উষসীর কথা ভাবছে! এই মুহূর্তে ইয়ার্কি মারতে ভাল লাগছে না অঙ্কুশের ৷ ও সত্যি কথাটাই বলল, ‘জয়জিতের ঠাকুরমার কথা৷’
শুনে সিরিয়াস হয়ে গেল পিঙ্কি বউদি৷ থালাটা টেবলের উপর রেখে বলল, ‘কেন, কী হয়েছে ওঁর?’
‘মনসাভীতি৷ ভদ্রমহিলার ধারণা হয়েছে, মা মনসা ওঁর উপর মারাত্মক রেগে রয়েছেন৷ ওঁর সুখের সংসার নষ্ট করে দেবেন৷’
‘ওহ, তাই বলো৷ আমি ভাবলাম, উনি বোধহয় অসুস্থ৷ যাক গে, এ বার খেয়ে নাও৷ সেজ কাকিমা আজ পুঁইশাকের চ্চচড়ি রান্না করেছেন, কুমড়ো আর ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে৷ দু’দিন রাজবাড়ির রান্না খেয়ে এলে৷ আজ তোমার মুখে রুচবে কিনা, খেয়ে দ্যাখো৷ নিজে খেতে পারবে, না আমি খাইয়ে দেব?’
হাতে চোট পাওয়ার পর নার্সিং হোমে পিঙ্কি বউদি দু’দিন চামচে করে ওকে খাইয়ে দিয়েছিল৷ বাড়ি ফেরার পর থেকে রোজ খাবার নিয়ে এসে একবার করে জিজ্ঞেস করে, খাইয়ে দেবে কিনা৷ কিন্তু, এই ক’দিনে বাঁ হাতে চামচে করে খাওয়াটা অঙ্কুশ রপ্ত করে ফেলেছে৷ চেয়ারে বসার আগে আড়চোখে ও দেখল, হাসি হাসি মুখে পিঙ্কি বউদি তাকিয়ে রয়েছে৷ এই হাসিটা ওর চেনা৷ এর পরই বউদি উষসীর প্রসঙ্গ তুলবে৷ তার আগেই ও ছক্কা মারল, ‘তোমাকে একটা খবর দেওয়ার আছে বউদি৷ চন্দ্রভানুবাবুর স্ত্রী আমার জন্য এক রাজকন্যার সন্ধান দিয়েছেন৷ তোমাকে জানিয়ে রাখলাম৷ পরে কিন্তু আমায় দোষ দিও না৷’
মুহূর্তে হাসিটা বদলে গেল আশঙ্কায়৷ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে পিঙ্কি বউদি বলল, ‘তার মানে? এ বার কি সেই রাজকন্যা দেখাতেই ওরা ডেকে নিয়ে গেছিলেন তোমাকে?’
খাওয়া শুরু করে অঙ্কুশ বলল, ‘আমার তো তাই মনে হল৷’
‘তুমি কী বললে?’
‘চন্দ্রভানুবাবুর স্ত্রী বললেন, ওঁর বেয়াই মানে আমার হবু শ্বশুর অনেক কিছু দেবেন-থোবেন৷’ নির্ভেজাল মিথ্যেগুলো বলতে লাগল অঙ্কুশ, ‘একমাত্র মেয়ে, বুঝতেই পারছ৷ কলকাতায় সাউথ সিটি হাউসিং কমপ্লেক্সে ফ্ল্যাট, সেটা আবার তিরিশ তলার উপরে৷ প্লাস একটা স্করপিও গাড়ি৷ পঞ্চাশ ভরি গয়না দেবে৷ ভদ্রলোকের নাকি বিরাট ব্যবসা, প্রচুর সম্পত্তি৷ তাঁর অবর্তমানে সব কিছুর মালিক হবে মেয়ে৷’
‘তা হলে বিয়ের পর কি আর তুমি পিয়ারাতে থাকবে? নিশ্চয়ই সাউথ সিটিতে চলে যাবে?’
‘ভদ্রমহিলা তো সেই রকমই শর্ত দিলেন৷ আমি অবশ্য হ্যাঁ বা না কিছু বলিনি৷ তোমার সঙ্গে পরামর্শ না করে আমি একচুলও এগোব না৷’
‘থাক, আমার সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে না৷’ এবার স্পষ্ট ক্ষোভ বেরিয়ে এল পিঙ্কি বউদির গলায়, ‘ আমি তোমার কে? কথাগুলো বড়মা শুনলে কষ্ট পাবে… এই আর কী৷ কিন্তু, তুমি চলে গেলে তোমার পোষ্যপুত্তুরদের কী হবে?’
‘ভেবে রেখেছি বউদি৷ সল্ট লেকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের পার্কে দিয়ে আসব৷ তা যদি না হয়, তা হলে বেদে-দের ডেকে পোষ্যপুত্তুরদের বিলিয়ে দেব৷ আসলে কঙ্কণদীঘির ওঁরা আমার সঙ্গে একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক করতে চান৷ যাতে ওঁদের দরকারে যখন তখন পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারি৷’
‘তুমি কিন্তু ভুল করছ কুশ ঠাকুরপো৷ টাকাপয়সার লোভে এমন একটা মেয়েকে ঘরে আনতে যাচ্ছ, যার সঙ্গে আমাদের খাপ খাবে না৷ তুমি এত বদলে গেলে কী করে গো?’
পিঙ্কি বউদি এখনও উষসীর প্রসঙ্গ তোলেনি৷ যাতে তোলে সেই কারণে নিরীহ মুখ করে অঙ্কুশ বলল, ‘জীবনে টাকাপয়সার কিন্তু খুব দরকার বউদি৷’
‘তার থেকেও বড় দরকার শান্তি৷ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক৷ বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করে তুমি কিন্তু জীবনেও ভালবাসা পাবে না৷ বুঝতে পারছ না কেন ঠাকুরপো, ওঁরা তোমাকে কিনে নিতে চাইছেন? আমি তোমায় বলছি, পরে মিলিয়ে নিও… বাড়ি-গাড়ির সুখের থেকে অনেক বড় হচ্ছে ভালবাসা৷’
শুনে প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে অঙ্কুশের৷ সেটা চাপতে গিয়ে বিষম খেল ও৷ ওকে কাশতে দেখে জলের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে পিঙ্কি বউদি মৃদু ধমক দিল, ‘এত তড়বড় করে খাচ্ছ কেন ঠাকুরপো?’
কাশি থামতেই অঙ্কুশ ফের খাওয়ায় মন দিল৷ পিঙ্কি বউদি উল্টো দিকের চেয়ারে বসে পড়েছে৷ খানিকটা দমে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে৷ জানলার দিকে আনমনা হয়ে তাকিয়ে৷ বউদিটা এত সরল মনের যে, ওর সব কথা বিশ্বাস করে নিয়েছে৷ খানিকটা মায়া হওয়ায় অঙ্কুশ প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করল, ‘বউদি, তিন্নি কি কাল অথবা আজ এখানে এসেছিল?’
‘কাল সকালে এসেছিল৷ তোমার পোষ্যপুত্তুরদের সেবা করে গিয়েছে৷ ওর সঙ্গে উষসীও এসেছিল৷ ও জানত না, তুমি পিয়ারাতে নেই৷ একটা জরুরি দরকারেই এসেছিল মেয়েটা৷ যাক গে, সে কথা তোমাকে শুনিয়ে আর লাভ কী? কত কী ভেবে রেখেছিলাম, তা তো আর ফুলফিলড হবে না!’
খাওয়া থামিয়ে অঙ্কুশ বলল, ‘কী দরকার বউদি৷ বলো না, যদি কাজে লাগতে পারি৷’
‘ওই যে হর্স শু ক্র্যাব…রাজ কাঁকড়া, যার ছবি তোলার জন্য তোমার সঙ্গে কঙ্কণদীঘিতে যেতে চেয়েছিল মেয়েটা… সেই রাজ কাঁকড়ার ছবি ইমিডিয়েটলি তুলে ওকে পাঠাতে হবে কোন এক রিসার্চ অর্গানাইজেশনের কাছে৷ ওই ধরনের কাঁকড়ার রক্ত দিয়ে নাকি যে কোনও ওষুধের এক্সপায়ারি ডেট পরীক্ষা করা যায়৷ উষসী বলছিল, সেই পরীক্ষার সময় হর্সশু ক্র্যাবের নীল রক্ত যদি সাদা হয়ে যায়, তখনই বোঝা যায়, সেই ওষুধের এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে গিয়েছে৷’
‘কিন্তু, হর্সশু ক্র্যাব তো এখন কঙ্কণদীঘিতে আর পাওয়া যাবে না বউদি৷ ছবি তুলতে গেলে এখন যেতে হবে আরও দক্ষিণে হেনরি আইল্যান্ডসে৷ শুনেছি, বাদলার এই সময়টায় সী বিচে প্রচুর হর্সশু ক্র্যাব দেখতে পাওয়া যায়৷ কিন্তু মুশকিল হল, ওখানে জনবসতি বলে কিছু নেই৷ ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টের দুটো গেস্ট হাউস অবশ্য আছে৷ আগে থেকে বুক করে না গেলে ওখানে থাকা যাবে না৷’
‘দেখো না ভাই, যদি উষসীকে নিয়ে যেতে পারো৷ মেয়েটা এত মিষ্টি যে…’
হেনরি আইল্যান্ডসে গেলে উষসীর সঙ্গে দু’তিনটে দিন নিভৃতে কাটাতে পারবে৷ কথাটা ভাবতেই অঙ্কুশের বুকের ভেতরে আনন্দের স্রোত বয়ে গেল৷ কিন্তু, ও কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই দৌড়তে দৌড়তে ঘরে ঢুকে এল টিটো৷ ওর হাতে একটা সাদা লম্বা খাম৷ কাঁধ থেকে স্কুলের ভারী ব্যাগটা সোফার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ও বলল, ‘কুশকাকু, এই নাও, আমেরিকা থেকে তোমার একটা চিঠি এসেছে৷’
অঙ্কুশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল৷ ও বুঝতে পারল না, কে ওকে চিঠি পাঠাল আমেরিকা থেকে ?
(আঠারো)
সোনাখালির ফার্ম হাউসে এসেছেন চন্দ্রভানু৷ হিঙ্গলগঞ্জ থেকে ফেরার পথে৷ জয়ব্রত ফোন করেছিল৷ বিরাট একটা অর্ডার এসেছে জার্মানি থেকে৷ নিমপাতার গুঁড়ো পাঠাতে হবে৷ ব্যাবসা নিয়ে চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত ছেলেরা একা নেয় না৷ সব সময় তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে৷ দু’তিনদিন থাকার ইচ্ছে নিয়েই চন্দ্রভানু সোনাখালিতে এসেছেন৷ হোগোল নদীর ধারে তাঁর বিরাট ফার্ম হাউস৷ দশ একর জমি নিয়ে৷ পুরোটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা৷ নদীর দিকে একটা সুন্দর বাংলোও আছে৷ লঞ্চ থেকে নেমে সোজা সেই বাংলোয় ঢুকে যাওয়া যায়৷
বাংলোটা মনের মতো করে সাজিয়েছেন চন্দ্রভানু৷ নদীর দিক থেকে তো বটেই, স্থলপথে ঢোকার সময়ও বাহারি আলোয় বাংলোটাকে স্বপ্নপুরী বলে মনে হয়৷ মিউজিক সিস্টেম রয়েছে ছোট সুইমিং পুল সংলগ্ন অঞ্চলে৷ জলবিহার করতে করতে সুরাপান৷ প্রমোদের সব উপকরণই এখানে আছে৷ বিদেশি কোনও ক্লায়েন্ট এলে তাঁকে এই বাংলোতে নিয়ে আসেন চন্দ্রভানু৷ ঢালাও স্ফূর্তি করার সুযোগ দেন৷ স্রেফ মদিরায় যাঁদের আঁশ মেটে না, তাঁদের জন্য আছে নারীদেহও৷ সেই দায়িত্বে রয়েছে দয়াশঙ্কর৷ যার একটা ফোনে এসে হাজির হয় সুবেশা, সুন্দরী মেয়েরা৷ নিশিবাসরের পর দিনের আলোয় তাদের আর দেখা যায় না৷
আজ অবশ্য চন্দ্রভানু কোনও ক্লায়েন্ট নিয়ে আসেননি৷ কঙ্কণদীঘি থেকে ডেকে নিয়ে এসেছেন মন্টু কে৷ জয়ব্রতর সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত কথাবার্তা বলার পর ফার্ম হাউসের ভিতরে ঘুরতে বেরিয়েছেন ওঁরা দু’জন৷ এই একটিমাত্র মানুষ, যার সঙ্গে সবকিছু খোলাখুলি আলোচনা করতে পারেন চন্দ্রভানু৷ এমনকী, ব্যক্তিগত জীবনের গোপনতম কথাগুলিও৷ মন্টু ভক্তার পুঁথিগত বিদ্যে নেই, কিন্তু বাঁদাবন সম্পর্কে ওর প্রগাঢ় জ্ঞান৷ সবথেকে বড় কথা ঠান্ডা মাথার লোক এবং নিঃস্বার্থ৷ নিজের ছেলেদের যতটা তিনি বিশ্বাস করেন, তার থেকে অনেক বেশি আস্থা রাখেন মন্টু ভক্তার উপর৷
দিনের বেলায় একপ্রস্থ ঝড়-বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে৷ নদীর দিক থেকে ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে ফুলের মিশ্র সুগন্ধ৷ দিনের আলো যায় যায়৷ ফার্ম হাউসের গাছগুলির দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললেন চন্দ্রভানু৷ মহেশ্বরজির পরামর্শে, বারো বছর আগে তিনি এই ফার্ম হাউসটি বানান৷ গাছগুলো এখন বিশাল হয়ে গিয়েছে৷ অর্জুন, ছাতিম, নিম, পলাশ, শিমূল, শিরীষ, শ্বেত চন্দন, অশোক… কত রকমের গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে! সব আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার কাজে লাগে৷ ভেষজ বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে চন্দ্রভানু সেই সময় একশো প্রজাতির গাছ লাগিয়েছিলেন৷ কিছু গাছ নিয়ে এসেছিলেন বেঙ্গালুরু থেকে৷ সবই অবশ্য মিষ্টি জলের গাছ৷ অনেক সাবধানতাও নিয়েছেন যাতে নদীর লোনা জল ফার্ম হাউসের ভিতরে না খোকে৷ কার পরামর্শে মনে নেই, গেটের কাছে একটা আপ্তবাক্যও খোদাই করে রেখেছেন চন্দ্রভানু৷ ‘শরীরম আদ্যম খলু ধর্মসাধনম’৷ জীবনধর্ম সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালনের জন্য সুস্থ ও সবল শরীরই একমাত্র অবলম্বন৷ এই ভেষজ গাছগুলি সেই জীবনের সন্ধান দিতে পারে৷
মন্টুকে নিয়ে ফার্ম হাউসের চারপাশটা ঘুরছেন চন্দ্রকান্ত৷ বর্ষার সময় ফার্ম হাউসটাকে অনেক বেশি সবুজ আর জীবন্ত মনে হয়৷ হাঁটতে হাঁটতে মন্টু বলছিল, ‘অনেক ট্যাকা এর পেচনে লাগ্যেচিলি চাঁদ৷ এ বার ফেরত পাবি৷’ শুনে চন্দ্রভানু খুব খুশি৷
মন্টু কী না জানে! ঢ্যাঁড়শ গাছের মতো একটা গাছ দেখিয়ে ও বলল, ‘এটা কী জানিস? লতা কস্তুরী গাচ৷ এর বীজ খুব উবগারে লাগে৷’
তিন-চার ফুট উঁচু গাছ৷ পাতাগুলো বিভিন্ন আকারের, পাঁচ-সাত ভাগে বিভক্ত৷ ফুলগুলো হলদে, সুগন্ধযুক্ত৷ প্রচুর ফুল ফুটে রয়েছে৷ চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী উপকারে লাগে রে?’
মন্টু বলল, ‘ তোর অ্যাখুন দরগার নেই কো চাঁদ৷ আর দশ বচর পরে দরগার হবে৷ বউয়ের পাশে শুয়ে য্যাখন কিছু করতে ইচ্চে করবে না, তখন এই লতা কস্তুরীর বীজ গুঁড়ো করে মাখন আর মিচরির সঙ্গে মিশিয়ে রোজ দু’বলা করে খেলেই দেখবি… লিঙ্গ উঠে দাঁইড়েচে৷’ কথাটা বলেই মন্টু আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল, লিঙ্গ কেমনভাবে উঠে দাঁড়াবে৷ তার পরেই হাসতে লেগেছিল৷
যৌনজীবনে শীতলতা আর উত্তেজনাহীনতা কাটাতে লতা কস্তুরীর বীজ কাজে লাগে শুনে চন্দ্রভানু দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ আরে, আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি করে বিদেশে পাঠালে তো মারাত্মক চাহিদা হতে পারে! তিনি বললেন, ‘তুই ঠিক জানিস মন্টু? ও র’ম ওষুধ হতে পারে! এই গাছে কবে ফল আসে রে?’
‘অ্যাখনও দেরি আচে৷ ফুল থেকে ফল হবে গে সেই পোষ মাসে৷ সেই ফলে প্রচুর বীজ থাকে৷ লোগে এর ফলটাগে ঢ্যাঁড়শ বলে ভুল করে৷ তফাত হল গে, লতা কস্তুরীর গন্ধডা খুব সোন্দর৷’
পৌষ মাস… মানে এখনও মাস কয়েক দেরি৷ চন্দ্রভানু ঠিক করে নিলেন, জয়ব্রতকে একটা প্রোজেক্ট তৈরি করতে বলবেন৷ কোন গাছ থেকে কী ওষুধ হতে পারে, বহু দিন আগে তার একটা রিপোর্ট অবশ্য তৈরি করে রেখেছে জয়ব্রত৷ কালই সেই রিপোর্টটা নিয়ে বসতে হবে ওর সঙ্গে৷ চিংড়ি রপ্তানীর ব্যবসায় একটা ঝামেলা বেঁধেছে৷ তার ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটা জয়গোপাল দিল্লি থেকে ফিরলেই বোঝা যাবে৷ যদি কোনও কারণে ঝাড় খায়, তখন এই ফার্ম হাউসটাকেই আঁকড়ে ধরবেন চন্দ্রভানু৷ মহেশ্বরজি ঠিকই বলেন, একটা রাস্তা বন্ধ হলে, ঠিক আর একটা রাস্তা খুলে যায়৷ এই সময়টাতেই ধৈর্য ধরতে হয়৷
সন্ধের পর জয়ব্রত চলে যায় নিজের বাংলোতে৷ সোনাখালির ফেরিঘাটের কাছেই ওর সেই বাংলো৷ ওর বউ অহল্যা রোজ কলকাতায় যাতায়াত করে ব্যাবসার কাজে৷ মাঝে মাঝে সে থেকেও যায় কলকাতায় বাপের বাড়িতে৷ অহল্যার বাবা কল্যাণ দাশগুপ্ত বামপন্থী রাজনীতি করেন৷ বারদুয়েক এমপি-ও হয়েছিলেন৷ উনি অন্য পলিটিশিয়ানদের মতো নন৷ বহু বছর ক্ষমতায় থেকেও পয়সাকড়ি তেমন করতে পারেননি৷ ভদ্রলোকের সঙ্গে চন্দ্রভানুর হাই-হ্যালোর সম্পর্ক৷ অহল্যার বাবাকে তিনি পারতপক্ষে এড়িয়েই চলেন৷ পাছে এখনকার রুলিং পার্টির নেতাদের বিষনজরে পড়েন৷
সোনাখালির খেয়াঘাট আগে খুব জমজমাট ছিল৷ হোগোল নদীর উপর এখন ওভার ব্রিজ হয়ে যাওয়ার পর সোনাখালি ঘাটের গুরুত্ব খানিকটা কমে গিয়েছে৷ ফার্ম হাউসে এই সময়টায় থাকে সিকিউরিটির লোকজন৷ চন্দ্রভানু এলে খিদমত খাটার জন্য রয়ে যায় বনমালী বলে একটা ছেলে ও তার বউ উমা৷ বনমালী ড্রিঙ্কস সার্ভ করে৷ আর উমা মুখরোচক স্ন্যাক্স তৈরি করে দেয়৷ বনমালীর আরও একটা কাজ আছে৷ ফার্ম হাউসে প্রত্যহ কী হয়, সেই সব খবর চন্দ্রভানু পান ওর মুখ থেকে৷ ছেলেটার সঙ্গে স্থানীয় লোকজনেরও ভাল যোগাযোগ আছে৷
হিঙ্গলগঞ্জের ভেড়ি নিয়ে মন্টুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে চন্দ্রভানু এসে বসলেন বাংলোর গার্ডেন টেরাসে৷ দেখে ট্রে হাতে বনমালী উঠে এল৷ দ্রুত হাতে কাচের গ্লাসে স্কচ ঢালতে লাগল৷ আংটা দিয়ে কয়েকটা বরফের টুকরো গ্লাসে ফেলে দিয়ে ও একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল৷ ছেলেটার সব থেকে বড়গুণ আগ বাড়িয়ে কথা বলে না৷ জিজ্ঞেস করলে তবে উত্তর দেয়৷ সেটা জানেন বলেই চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানকার খবর কী রে?’
বনমালী বলল, ‘এমনি সব ঠিক আছে স্যার৷ তবে সাপের খুব উপদ্রব হয়েছে৷’
সাপের কথা শুনে চন্দ্রভানু একটু সতর্ক হয়ে গেলেন৷ কঙ্কণদীঘির মতো এখানেও সেই উৎপাত শুরু হল না কি! বর্ষাকালে এমনিতেই একটু বেশি সাপের দেখা পাওয়া যায়৷ এটা নতুন কথা নয়৷ বৃষ্টির জন্য গর্তে জল ঢুকে গেলে সাপ তখন বেরিয়ে আসে৷ নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে৷ কিন্তু উপদ্রব কথাটা চন্দ্রভানুর ভাল লাগল না৷ স্কচে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়েছিস?’
‘হ্যাঁ স্যার৷ তাতেও খুব একটা কাজ হয়নি৷ দু’একদিন পর সাপগুলো ফের দেখা যাচ্ছে৷ বাসন্তী থেকে একজন গুণিনকে নিয়ে এসেছিলেন জয়ব্রতবাবু৷ শঙ্খচূড়ের কামড় খেয়ে সে পালিয়েছে৷ সাপটা এমন জোরে ছোবল মেরেছিল যে, গুণিনের পায়ের হাঁড় ভেঙে গিয়েছে৷ এখন সে শিয়ালদার হাসপাতালে ভর্তি আছে৷ রাতের দিকে সিকিউরিটির লোকজন আর বাগানে বেরতে চাইছে না স্যার৷’
মন্টু জিজ্ঞেস করল, ‘ইদিগে শঙ্খচূড় এল কী করে বনমালী? বোশেখ মাসের দিগে দ্যাকা-ট্যাকা যায়৷ ত্যাখন ওর খাবারের খোঁজে বেরয়৷ অ্যাখন শঙ্খচূড়ের দ্যাখা পাওয়া তো ভাল লক্ষণ নয়?’
‘সিকিউরিটি গার্ডরা দু’তিনটে সাপ মেরেছিল৷ কিন্তু জয়ব্রত দাদাবাবু মারতে মানা করেছেন৷ সাপ মারা নাকি বেআইনি৷ জানতে পারলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে৷’
শুনে বিরক্ত হয়ে চন্দ্রভানু বললেন, ‘পুলিশের কথা ভাবার দরকার নেই৷ আমি তোদের বলে গেলাম, সাপ দেখলেই মেরে ফেলবি৷ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পুঁতে দিবি৷ আমার নাম করে গার্ডদের তুই বলে দিস৷’
‘ঠিক আছে স্যার, বলে দেবো৷ আপনাদের আর কিছু লাগবে স্যার?’
‘এখন না৷ উমাকে বলিস, ফ্রায়েড চিকেনটা ভাল হয়েছে৷ পরে আরও লাগলে বেল বাজিয়ে তোকে ডেকে নেবো৷ এখন নীচে চলে যা৷ দয়াশঙ্করের আসার কথা আছে৷ এলে এখানে পাঠিয়ে দিস৷’
অন্ধকার নেমে এসেছে৷ গার্ডেন টেরাসের নানা কোণে বাহারি আলো জ্বলে উঠেছে৷ সেই মনোরম মৃদু আলোয় বসে স্কচে চুমুক দিতে দিতে অন্য সময় আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন চন্দ্রভানু৷ কিন্তু, আজ বনমালীর কথাটা শোনার পর থেকে মনের মধ্যে একটা অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করছে৷ দুই বন্ধু মিলে চুপচাপ মদ্যপান করতে লাগলেন৷ দ্রুত তিন পেগ খাওয়ার পরও অস্বস্তির কাঁটাটা উপড়ে ফেলতে পারলেন না চন্দ্রভানু৷ চিনচিনে রাগটা ক্রমশ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে৷ চন্দ্রভানু যেখানেই যান, আত্মরক্ষার জন্য লাইসেন্সড পিস্তলটা সঙ্গে নিয়ে যান৷ গার্ডেন টেরাসে বসে তাঁর একবার ইচ্ছে হল, পিস্তল হাতে নীচে নেমে গিয়ে, খুঁজে খুঁজে সাপগুলোকে গুলি করে মারেন৷ কিন্তু, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন৷ মন্টু সঙ্গে আছে৷ ওর সামনে এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে ধারণা হয়, তিন পেগ খেয়ে তিনি মাতাল হয়ে গিয়েছেন৷ কেননা, ছয়-সাত পেগ খেয়েও তিনি সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন৷
‘দয়াশঙ্করকে কোতাও পাঠ্যেচিস নাকি চাঁদ?’ মন্টু জিজ্ঞেস করল৷
মুখ ফিরিয়ে চন্দ্রভানু বললেন, ‘হ্যাঁ৷ দয়াপুরে৷ টাইগার ক্যাম্প রিসর্টে লাগোয়া নদীতে একটা মেয়েছেলেকে চান করতে দেখেছিলুম৷ কাল তাকে তুলে আনতে বলেছি৷ দয়া আজ ব্যবস্থা করতে গিয়েছে৷’
‘তুর এই স্বভাবটা আর গেল না কো৷ ঘরে বউ, দু’দুটো বউমা, নাদি নাদনি৷ এ বার নিজেকে একটু শোধরা চাঁদ৷ নইলে বিপদে পড়বি৷ মেয়াছেলেটা কি দয়াপুরের?’
‘কিছু জানি না৷ দয়া এলে জানতে পারব৷’
কথাটা বলেই স্কচে ফের চুমুক দিলেন চন্দ্রভানু৷ চোখের সামনে স্পষ্ট তিনি দেখতে পেলেন, লঞ্চের ঢেউয়ে মেয়েটার বুকের আঁচল সরে গিয়েছে৷ পাকা ডালিমের মতো দুটো স্তন৷ দৃশ্যটা চিন্তা করে সারা শরীরে একটা শিরশিরানি অনুভব করলেন চন্দ্রভানু৷ মন্টু স্বভাব বদলানোর কথা বলছে৷ এর আগেও বেশ কয়েকবার ও কথাটা বলেছে৷ ও কি জানে, বেপরোয়া এই যৌনজীবন শুরু হয়েছিল কার সঙ্গে? সে তো ওরই বউ সত্যবতী৷ তার আগে সনকা ছাড়া আর কোনও নারীদেহ তিনি স্পর্শ করেননি৷ বাঘকে রক্তের স্বাদ দিয়েছিল সত্যবতী৷ কত রকম ছলাকলা ও জানত! পুরুষ মানুষকে তৃপ্ত করার কায়দাগুলো ছিল ওর নখদর্পণে৷ এই বাংলোতেও কয়েকটা রাত তিনি কাটিয়েছেন সত্যবতীর সঙ্গে৷ শেষবার ও এসেছিল মাস চারেক আগে৷ মন্টু তখন ঝড়খালিতে৷ সেদিন একটা অদ্ভুত আবদার করেছিল সত্যবতী৷ গর্ভধারণ করতে চায়৷ মন্টু সন্তান দিতে পারেনি৷ চন্দ্রভানু কি সেই ইচ্ছেটা পূরণ করবেন? কিন্তু, তাতে তিনি রাজি হননি৷
পশ্চিম আকাশে মেঘ জমেছে৷ মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে৷ দূর থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে৷ এদিকে, গার্ডেন টেরাসে বসে মন্টু আপন মনে গান ধরেছে৷ প্রথমে মৃদুস্বরে গাইছিল৷ ক্রমে ওর গলা খুলল,
‘হরি সকালে কর ভব পার
বেলা ডুবিলে হবে অন্ধকার…
দয়াল হরি হে৷
কিনারে চাপাইয়া নাও
নায়ের বাদাম তুলিয়া দাও
আস্তে আস্তে ভবসিন্ধু পার করিয়া দাও৷’
কী করুণ সুর! পেটে সুরার প্রভাব, তার উপর মন্টুর গায়কি৷ শুনতে শুনতে মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল চন্দ্রভানুর৷
সত্যবতীর বিরহ মন্টুকে বোধহয় পীড়া দিচ্ছে৷ দেওয়াটাই স্বাভাবিক৷ তিনিই সত্যবতীকে ভুলতে পারছেন না৷ মন্টু মন থেকে মুছে ফেলবে কী করে?
চতুর্থ পেগটা শেষ করে ফেলার পর চন্দ্রভানু দেখলেন, অপরাধী মুখ করে দয়াশঙ্কর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে৷ ওকে দেখে মন্টু গান থামিয়ে দিল৷ চন্দ্রভানু ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন, ‘ কী রে তোর এত দেরি হল?’
দয়া বলল, ‘খোঁজ নিতে গিয়ে একটু সময় লাগল স্যার৷ মেয়েটার নাম তরিতা৷ থাকত আমেরিকায়৷ মাস দেড়েক আগে রিসর্টে এসেছে৷ ক’দ্দিন থাকবে, কেউ জানে না৷’
‘একাই এসেছে, নাকি সঙ্গে কোনও পুরুষ আছে?’
‘না স্যার, কোনও পুরুষ নেই৷ সঙ্গে সমবয়সি আর একটা মেয়ে আছে৷ তাঁর নাম নেত্রা৷’
‘আর কোনও খবর? আমেরিকায় কী করত-টরত?’
‘মেয়েটা স্যার হারপেটোলজিস্ট৷ নাকি সাপ নিয়ে গবেষণা করে৷ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, মা মনসার খুব ভক্ত৷ গাঁয়ের লোকেরা বলল, রিসেন্টলি দয়াপুর গাঁয়ে ঘটা করে মনসা পুজো করেছে৷ শুধু তা-ই নয়, বাঁদাবনের সর্বত্র যাতে মনসার পালাগান হয়, তার জন্য প্রচুর পয়সা ছড়াচ্ছে৷’
হারপেটোলজিস্ট শব্দটা আগে কখনও শোনেননি চন্দ্রভানু৷ কিন্তু মেয়েটা মনসা-ভক্ত শোনার পরই তিনি ত্রোধে জ্বলে উঠলেন৷ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, লোকে দেবী পুজো করবে কেন? না না, কোনও নারীর কাছে মাথা নীচু করা উচিত না৷ মেয়েরা হল ভোগ্যপণ্য৷ কাম চরিতার্থ করার জন্যই তাদের জন্ম৷ তাদের সেরা জায়গা হল অন্দরমহলের বিছানায়৷ শাস্ত্রে বলা আছে, সন্তান উৎপাদনের জন্যই নারীর সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর৷ ফুল দিয়ে পুজো করার জন্য নয়৷ তরিতাকে উৎখাত করতেই হবে বাঁদাবন থেকে৷ তার আগে জানতে হবে, ওর পিছনে কে আছে? হঠাৎ আমেরিকা থেকে সুন্দরবনে এসেই বা ঘাঁটি গাড়ল কেন? নিছক সাপ নিয়ে রিসার্চ করার জন্য এসেছে, এটা মেনে নেওয়া ভুল৷ নিশ্চয়ই অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে৷ সেটা যাচাই করার জন্য দয়াশঙ্করকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘গাঁয়ের পঞ্চায়েত কী বলছে ওর সম্পর্কে?’
‘সেটাও একটা অদ্ভুত ব্যাপার স্যার৷ পঞ্চায়েতের মেয়ে মেম্বাররা সবাই তরিতার পক্ষে৷ কিন্তু পুরুষরা কেউ ওকে পছন্দ করছেন না৷ পঞ্চায়েত প্রধান মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন৷ দয়াপুর গ্রামেরই একজনকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি স্যার… অনন্ত মণ্ডল৷ তার মুখ থেকে অ্যাকচুয়াল পরিস্থিতিটা জানতে পারবেন৷’
মিনিট দুয়েক পর তিরিশ-বত্রিশ বছরের একটা জোয়ান ছেলেকে নিয়ে উঠে এল দয়াশঙ্কর৷ সে হাতজোড় করে বলল, ‘হুজুর, আমাদিগে বাঁচান৷ গাঁয়ের বউ-ঝিরা আর কথা শুইনছে না৷ উ মেয়েছেলেডা যাদুটোনা জানে৷ গাঁয়ের মেয়াদের বশ কইরে ফেলেছে৷’
মন্টু জিজ্ঞেস করল, ‘যাদুটোনা মানে?’
‘সব সুময় সাপের ভয় দেখাইছে৷’ বিশদ বিবরণ দিতে শুরু করল অনন্ত৷ মেয়েছেলেটা রিসর্টে আসার পর থেকে সাপের সংখ্যা হঠাৎ খুব বেড়ে গিয়েছে দয়াপুরে৷ তবে সাপেরা এখনও কারও কোনও ক্ষতি করেনি৷ গাঁয়ের মুরুবিবদের একজন নাকি দেখেছে, গভীর রাতে চাঁদের আলোয় মেয়েছেলেটা ঘুরে বেরায়৷ খেতের মাঠে প্রায়ই তাকে দেখা যায়৷ সাপের সঙ্গে নাকি কথা বলে৷ কখনও কখনও নিজেও সাপ হয়ে যায়৷ ও যেখানে যায়, ওর সঙ্গেসঙ্গে নাকি প্রচুর সাপ ঘুরে বেরায়৷ সরকারের খাস জমিতে মেয়েছেলেটা মনসার মন্দির বানানোর চেষ্টা করছে৷ গাঁয়ের মেয়েরা সবাই একজোট হয়েছে৷ দয়াপুরের ঘরে ঘরে এখন অশান্তি৷
… এই পর্যন্ত শুনে চন্দ্রভানু বললেন, ‘দয়া, দু’একদিনের মধ্যেই মনসার ঘট-ফট তুই উল্টে দিয়ে আসবি৷ আমি দেখছি, সরকারের খাস জমিতে কীভাবে ও মন্দির করে৷ কাল সকালে সাতজেলিয়ার বিডিওকে ফোনে একবার ধরে দিবি৷ যা বলার, আমি বলে দেবো৷’
অনন্ত বলল, ‘কয়েকদিন আগে গাঁয়ের মুরুবিবদের সঙ্গে মেয়েছেলেটা মিটিন কইরেছেল৷ বলেছে, পিচখালি নদীর দিকে কয়েক একর জমি কিনতে চায়৷ সেই জমিতে কী করবে, তা অবশ্য কয়নি৷ কিন্তু, হুমকি দিইয়েছে, কেউ যদি জমি বিক্রি না করে, তা হলে বিপদে পইড়বে৷’
চন্দ্রভানু উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘দয়া, খোঁজ নিয়েছিস… মেয়েছেলেটা জমি কিনতে চাইছে কেন?’
দয়াশঙ্কর বলল, ‘খোঁজ নিয়েছি স্যার৷ রিসর্টের উদয়শঙ্করবাবু বললেন, মেয়েটা একটা ল্যাবরেটরি বানাতে চায়৷ সাপের বিষ দিয়ে কী এক ওষুধ তৈরি করবে৷’
‘তাই নাকি? তা হলে গাঁয়ের মুরুবিবদের বলে দে, কেউ যাতে ওকে জমি বিক্রি না করে৷ আমার এলাকায় আমার পার্মিশন ছাড়া কোনও ল্যাবরেটরি হবে না৷’
‘তাই হবে স্যার৷ অনন্তকে তা হলে ছেড়ে দিই?’
‘হ্যাঁ, ওকে শ’পাঁচেক টাকা দিয়ে দে৷ দয়াপুরে কী হচ্ছে, সেই খবর ও যেন রোজ তোকে দেয়৷’
অনন্তকে নিয়ে দয়াশঙ্কর নীচে নেমে যাওয়ার পর চন্দ্রভানু বললেন, ‘কিছু বুঝলি, মন্টু?’
মন্টু নিস্পৃহভাবে বলল, ‘এত উত্তেজিত হওয়ার কী আচে চাঁদ? ল্যাবরেটরিডা হলে গাঁয়ের কিচু মেয়া চাগরি পাবে৷ ই সব ঝুট-ঝামেলিতে তুই কেন মাতা গলাবি ভাই? তুর বিজনেস আলাদা৷’
বলেই ফের সুর করে গান ধরল মন্টু, ‘ওরে বন্দী দেব নারায়ণ… শুনি মুণি বিপ্রগণ… ত্রিভুবনে যত দেব আছে… তবে পদ্মার চরিত্র গীত… রসে পদে চমকিত… পিতৃ মাতৃ গুরু বন্দ মাতে৷’
বাঁকা চোখে মন্টুর দিকে তাকালেন চন্দ্রভানু৷ এ তো মনসা পালাগানের নাছারী গাইছে! গানের দিকে আর মন না দিয়ে তিনি তরিতাকে শিক্ষা দেওয়ার কথা ভাবতে লাগলেন৷ সুন্দরী, শিক্ষিতা, বিদেশ থেকে আসা৷ এমন একটা মেয়েকে বশ করতে পারার মধ্যে আলাদা আনন্দ আছে৷ স্কচে চুমুক দিতে দিতে চন্দ্রভানু ঠিক করে নিলেন, পৌরুষ দেখাবেন৷ দয়াপুর থেকে এই বাংলোয় নিয়ে এসে তরিতা বলে মেয়েটাকে তিনি জোর করে আটকে রাখবেন৷ ভোগ করবেন৷ দেখবেন, সে মনসার কত বড় ভক্ত!
তখনই চন্দ্রভানুর মনে পড়ল, আরে … আসল কথাটাই তো জিজ্ঞেসই করা হয়নি৷ দয়াশঙ্কর উপরে উঠে এলে তিনি প্রথমেই জানতে চাইবেন, মেয়েটাকে তুলে আনার কী করল?
(উনিশ)
চোখের লেন্স নিয়ে একটু সমস্যায় পড়েছেন তরিতা৷ দয়াপুরের রিসর্টে আসার আগে একডজন লেন্স চেন্নাই থেকে আনিয়েছিলেন তিনি৷ এক একটা লেন্স দু’মাস করে চলার কথা৷ কিন্তু লোনা আবহাওয়ায় এসে তিনি লক্ষ করছেন, লেন্স এক মাসের বেশি ব্যবহার করতে পারছেন না৷ চোখ কড়কড় করছে, কখনও কখনও জল গড়াচ্ছে৷ খোঁচা লেগে বাঁ চোখটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল প্রায় দশ বছর আগে৷ বাইরে থেকে অবশ্য খুব একটা বোঝা যেত না৷ কিন্তু, আয়নার সামনে দাঁড়ালে মনটা খুঁত খুঁত করত৷
চেন্নাইয়ের স্নেক ইনস্টিটিউটে রিসার্চ করার সময় একজন কলিগ ওকে একজন বিখ্যাত আই স্পেশালিস্টের কাছে নিয়ে যান৷ তিনিই দু’চোখে লেন্স পরার পরামর্শটা দিয়েছিলেন৷ একেবারে কসমেটিক ধরনের৷ তাই, লেন্স নেওয়ার পর থেকে মুখশ্রীটা একেবারে বদলে গিয়েছে তরিতার৷ আরও সুন্দর লাগছে৷ একটাই ঝামেলা, দু’তিন ঘণ্টা টানা ব্যবহার করার পর লেন্স খুলে রাখতে হয়৷ লেন্সের যত্ন করতে হয়৷ তাই বাইরে কোথাও ট্রাভেল করার সময় তরিতা ফোটো ক্রোমাটিক চশমা পরেন৷ সমস্যা হল, লেন্স আর নেই বললেই চলে৷ ফের একডজন আনাতে হবে বেঙ্গালুরু থেকে৷ ওখানে নাকি এমন লেন্স পাওয়া যাচ্ছে, যা টানা এক বছরও ইউজ করা যায়৷
আজ সকালে স্নান সেরে আসার পর লেন্সগুলো লোশন দিয়ে পরিষ্কার করছিলেন তরিতা৷ এমন সময় ঘরে ঢুকে শান্তি বলল, ‘অনন্তটা খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছে ম্যাডাম৷ ওকে এবার শিক্ষা দেওয়া দরকার৷’
শান্তি প্রথম দিকে দিদিমণি বলে ডাকত৷ তরিতা ওকে ম্যাডাম বলা শিখিয়েছেন৷ লেন্সের দিক থেকে চোখ না সরিয়ে তিনি বললেন, ‘কেন, অনন্ত আবার কী করল?’
‘খুব মারধর করেছে শোভাকে৷ কাল বিকেলে অনন্ত কোথায় যেন গেছিল৷ আজ সকালে বাড়ি ফিরেই একেবারে বাঘ৷ শোভাকে ভয় দেখিয়েছে, মনসাতলায় কখনও দেখতে পেলে… কেটে টুকরো করে পিচখালি নদীতে ফেলে… কুমিরকে খাওয়াবে৷’
লেন্স দুটো লোশনে ডুবিয়ে দিয়ে মুখ তুলে তাকালেন তরিতা৷ অনন্তর এত বড় সাহস! শোভাকে জানে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে? এই বাদাবনে কাউকে মেরে ফেলাটা অবশ্য কোনও ব্যাপারই নয়৷ খবর দিয়ে পুলিশ আনানোর আগেই লাশ বেপাত্তা হয়ে যেতে পারে৷ দয়াপুরের থানাটা হল ছোট মোল্লাখালিতে৷ সেও ঘণ্টা তিনেকের পথ৷ দয়াপুর থেকে প্রথমে সাইকেল ভ্যান করে সাতজেলিয়া বাজারে যেতে হবে৷ তার পর সেখানে নদী পেরিয়ে ফের সাইকেল ভ্যানে ছোট মোল্লাখালি বাজার৷ কোস্টাল গার্ড পুলিশের থানা৷ যেতে আসতে নানা হ্যাপা৷ ভ্যানের জন্য অপেক্ষা করতে হবে৷ ফেরিঘাটে বসে থাকতে হবে৷ দয়াপুর থেকে গিয়ে ফিরে আসতে একবেলা পেরিয়ে যায়৷ সেই কারণে গ্রামে কোনও সমস্যা হলে লোকে প্রথমে পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে যায়৷
পালাগান শেষ হওয়ার দু’দিন বাদে অনন্ত একবার শোভাকে মারধর করেছিল৷ তখন ওকে রিসর্টে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তরিতা৷ কিন্তু, অনন্ত আসেনি৷ তখন একবার পুলিশে কমপ্লেন করার কথাও ভেবেছিলেন৷ কিন্তু থানা-পুলিশের কথা শুনে, শোভার শাশুড়ি বাসন্তী এসে হাতে-পায়ে ধরেছিল, ‘ছাবালডারে মাপ করে দাও মা৷’ শোভাও খানিকটা পিছিয়ে গিয়েছিল৷ গাঁয়ের মেয়েদের নিয়ে এই প্রবলেম৷ ‘পতি পরম গুরু’ ধারণাটা এখনও বদলায়নি৷ বাসন্তীকে তখনই তরিতা বলে দিয়েছিলেন, অনন্ত যদি ফের শোভার গায়ে হাত তোলে, তা হলে তিনি ছাড়বেন না৷ সেই হুমকিতে কোনও কাজ হয়নি৷ নাহ, এ বার সত্যিই একটা স্টেপ নিতে হবে৷ ঠান্ডা গলায় শান্তিকে তিনি বললেন, ‘শোভা এখন কোথায় রে?’
‘রিসেপশনে বসে আছে৷ নিয়ে আসব ওকে?’
‘যা, নিয়ে আয়৷ ওর ইনজুরি কতটা?’
‘দেখলেই বুঝতে পারবেন ম্যাম৷’ বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল শান্তি৷
টেবলে রাখা ল্যাপটপটা বন্ধ করলেন তরিতা৷ অ্যান্টি ভেনম সিরাম… এভিএস তৈরির ল্যাবরেটরি গড়ার কাজ দ্রুত এগোচ্ছে৷ অ্যান্টনি গোমস কলকাতায় ফিরে গিয়েছেন দু’দিন আগে৷ ওখানে কনসালট্যান্টদের সঙ্গে প্রাথমিক কথাও বলে রেখেছেন৷ একটা ব্লু প্রিন্ট তৈরি হয়েছে৷ সেটা আমেরিকায় স্তেফান এডবেরির কাছে পাঠাতে হবে৷ আজ সকালেই ল্যাপটপে এডবেরির সঙ্গে অনেকক্ষখ চ্যাট করেছেন তরিতা৷ উনি বলেছেন, দরকার হলে মিয়ামি থেকে দু’জন এক্সপার্টকেও উনি পাঠিয়ে দেবেন৷ অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে এডবেরি তিনজন হারপেটোলজিস্টের নাম সাজেস্ট করেছিলেন৷ অঙ্কুশ মিত্র, ডঃ সুমিত পন্ডা ও এস নায়ার৷ এভিএস প্রোজেক্টে এঁদের সামিল করতে বলেছেন উনি৷ প্রোজেক্টের পিছনে অনেক সময় দিতে হচ্ছে৷ এর মধ্যে নতুন ঝামেলা এসে জুটল৷ শোভার বর অনন্তকে শায়েস্তা করার ঝামেলা৷
ওড়িশার সুমিত পন্ডা চাকরি করেন মুম্বইয়ের একটা এভিএস তৈরির কোম্পানিতে৷ তাঁর প্রচুর অভিজ্ঞতা৷ নায়ারকেও তরিতা চেনেন চেন্নাইয়ের স্নেক ইনস্টিটিউটের সৌজন্যে৷ প্রোজেক্টে এঁদের দু’জনকে নেওয়ার ব্যাপারে তাঁর কোনও আপত্তি নেই৷ দু’জনকেই অফার লেটার পাঠিয়ে দিয়েছেন তরিতা৷ কিন্তু, অঙ্কুশ মিত্র নামটা কাঁটার মতো বিঁধছিল৷ এই সেই ছেলেটা যে, চন্দ্রভানুর নাতিকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল৷ তরিতা মনে মনে চাইছিলেন, ডঃ সুমন্ত মণ্ডলকে নিতে৷ কিন্তু, এডবেরি সিডনিতে ওই অঙ্কুশ সম্পর্কে কী শুনে এসেছেন, কে জানে? অন্তত বারতিনেক উনি লিখেছেন, ‘বুঝতে পারছি, অঙ্কুশ মিত্রকে আপনি ঠিক পছন্দ করছেন না৷ কিন্তু পরে দেখবেন, সে প্রোজেক্টের দারুণ কাজে লাগবে৷’
পরে নেত্রাও বলেছিল, ‘ছেলেটাকে চন্দ্রভানুর ক্যাম্প থেকে ভাঙিয়ে আনো দিদি৷ চন্দ্রভানু তা হলে কমজোরি হয়ে যাবে৷ মিঃ এডবেরিকে বলো, ছেলেটার সঙ্গে উনি যেন যোগাযোগ করেন মিয়ামি থেকে৷ ওকে বলেন, এখানে এসে তোমার সঙ্গে কথা বলতে৷ তা হলে তোমার ওজন অনেক বেড়ে যাবে৷’
নেত্রার পরামর্শটা মনে ধরেছিল তরিতার৷ এডবেরি নিশ্চয়ই অঙ্কুশের সম্পর্কে ভাল কিছু শুনেছেন সিডনিতে ৷ সেই কারণেই জোরাজুরি করছেন প্রোজেক্টে নেওয়ার জন্য৷ চ্যাট করার সময় এডবেরি আজ জানালেন, অঙ্কুশ মিত্রকে তিনি মেল এবং চিঠি দুটোই পাঠিয়েছেন৷ সে যে কোনও দিন দয়াপুরে হাজির হতে পারে৷ সিডিউল অনুযায়ী যদি সবকিছু সুষ্ঠুভাবে চলে, তা হলে আগামী বছরের গোড়ার দিকেই প্রোডাকসন চালু করে দিতে পারবেন তরিতা৷ একটাই সমস্যা, এখনও জমি হাতে পাননি৷ জেমসপুরের সেই ভদ্রলোক জমি বিক্রি করতে রাজি, কিন্তু রুলিং পার্টির কিছু লোক ঘোঁট পাকাচ্ছে৷ আর মাসছয়েকের মধ্যেই লোকসভা নির্বাচন৷ রাজনৈতিক ডামাডোলের মাঝে প্রোজেক্টটা যেন পিছিয়ে না যায়৷
শোভাকে নিয়ে রুমে ঢুকে এসেছে শান্তি৷ ওদের সঙ্গে নেত্রাও৷ শোভাকে দেখে চমকে উঠলেন তরিতা৷ মুখটা ফোলা ফোলা, হয়তো খুব কান্নাকাটি করেছে৷ চোখের নীচে কালশিটে, গালে আঙুলের দাগ৷ শাড়ির আঁচল সরিয়ে শোভা পিঠের দিকটা দেখাল, ‘এই দেখুন ম্যাডাম, আমায় কীভাবে মেরেছে চ্যালা কাঠ দিয়ে৷’
নেত্রা জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছিল রে? হঠাৎ অনন্তটা খেপে গেল কেন?’
‘সকালে স্নান সেরে, পুজো দিতে আমি মনসাতলার দিকে যচ্ছিলাম৷ রাস্তায় অনন্তর সঙ্গে দেখা৷ টানতে টানতে আমায় ঘরে নিয়ে এল৷ তার পর মারতে শুরু করল৷ কী বলছিল জানেন ম্যাডাম? সোনাখালিতে গিয়ে চাঁদবাবুর সঙ্গে দেকা করে এলাম৷ উনি মা মনসার ঘট লাথি মেরে ভাঙতে বলেছেন৷’
চাঁদবাবু নামটা শুনেই তরিতা একবার নেত্রার দিকে তাকালেন৷ ওহ, কাল তা হলে চন্দ্রভানু বলে লোকটার সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছিল অনন্ত! তাই এত সাহস বেড়েছে? কিন্তু, সোনাখালিতে কেন? চন্দ্রভানু তো থাকে কঙ্কণদীঘিতে! তা ছাড়া, অনন্তকে ওখানে নিয়ে গেলই বা কে? তার মানে চন্দ্রভানুর লোক দয়াপুরেও আছে৷ ক্রোধপ্রকাশের বদলে আরও ঠান্ডা গলায় তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘সোনাখালিতে কেন রে?’
‘ওখেনে যে চাঁদবাবুর বাগানবাড়ি আচে ম্যাডাম৷ ওখেনে ফুর্তি করতে যায়৷’
‘অনন্ত আর কী বলল রে?’
‘বলল, তোরা কী করে মা মনসার মন্দিরটা করিস, আমি দেখব৷ তোদের ওই মেয়েছেলেটাকে চাঁদবাবু তুলে নে যাবে৷ তার পর তোর কী হাল আমি করব, দেখিস মাগী৷’
কথাগুলো উপেক্ষা করে তরিতা বললেন, ‘তোর শাশুড়ি বাধা দেয়নি?’
‘দিয়েছিল৷ তাকেও ধাক্কা মেরে উঠোনে ফেলে দিল৷ এমন জানোয়ার৷ খেতে দিতে পারে না, একটা ন্যাতা কিনে দেওয়ারও ক্ষ্যামতা নেই, সোয়ামিগিরি ফলাচ্ছে৷ তেমন হলে আমি মীন ধরে বাঁচব৷ তবুও, ওর সঙ্গে আর ঘর করব না৷ জানেন, কী করেছে? যে খাতাটায় আমি মা মনসার পালাগান লিখছিলাম, সেটা আখায় ফেলে দিয়েছে৷ চোখের সামনে সেই খাতাটা পুড়ে ছাই হয়ে গেল৷ আমি ওকে ছাড়ব?’
শোভার চোখে আগুন দেখে মনে মনে খুশি হলেন তরিতা৷ সমাজে নারী-পুরুষের সমান অধিকার৷ এই জিনিসটা যত তাড়াতাড়ি গাঁয়ের মেয়েরা বুঝতে পারে, ততই মঙ্গল৷ সংসারে দাসীবৃত্তি করে, পড়ে পড়ে মার খাওয়ার দিন শেষ হয়ে আসছে৷ তিনি বললেন, ‘তোকে আগেরবারই আমি থানায় গিয়ে কমপ্লেন করতে বলেছিলাম৷ তুই তখন শুনলি না৷ এখন বোঝ৷’
‘আপনি যা বলবেন, এ বার আমি তাই করব মা৷’
তরিতা বললেন, ‘শোভাকে নিয়ে কী করা যায় বল তো নেত্রা? গ্রাম প্রধানের কাছে নিয়ে গেলে তো কোনও লাভ হবে না৷ লোকটা শুনবেই না৷ শুনেছি, রোজ রাতে সে নাকি অনন্তর সঙ্গে নেশা করে৷’
নেত্রা বলল, ‘আগেকোনও ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার দিদি৷ শোভা বলছিল, পিঠে মারাত্মক ব্যথা হচ্ছে৷ এখানে তো ভাল ডাক্তার নেই, সব কোয়াক৷ যেতে হবে সেই গোসাবায় হাসপাতালে৷ আমি বলি কী, আগে ওকে নিয়ে কেউ গোসাবায় চলে যাক৷ একটা বোট ভাড়া করে দিচ্ছি৷ ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে৷ আগে মেডিক্যাল রিপোর্ট আনিয়ে রাখা যাক৷ তার পর পুলিশে কমপ্লেন করা যাবে৷’
‘তা হলে তাই কর৷ কিন্তু, শোভাকে কার সঙ্গে পাঠাবি? ওর শাশুড়ি যদি সঙ্গে যায়, তা হলে ভাল হয়৷ কিন্তু সে কি যেতে রাজি হবে?’
শান্তি বলল, ‘রাজি হবে ম্যাডাম৷ শোভার বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে সে রিসেপশনে বসে আছে৷ আমি বলাইকে খবর দিচ্ছি৷ বিশ্বস্ত ছেলে৷ দু’জনকে ও-ই গোসাবায় নিয়ে যাক৷ গোসাবায় ওর অনেক চেনা-জানা আছে৷’
শোভাকে নিয়ে শান্তি বেরিয়ে যাওয়ার পর তরিতা বললেন, ‘শোভা কী বলে গেল, শুনেছিস নেত্রা?’
নেত্রা বলল, ‘শুনলাম৷ সোনাখালিতে চন্দ্রভানুর ওই বাগানবাড়ির বারোটা বাজিয়ে দিতে হবে দিদি৷ যেদিন ওদিকে ঝড়জল হবে, সেদিনই কাজটা আমি সেরে ফেলব৷’
‘আর একটা কাজ তোকে করতে হবে নেত্রা৷ অনন্তরা যে মনসার ঘট ভেঙে ফেলবে, সেই কথাটা আজ সন্ধের মধ্যেই গাঁয়ে রাষ্ট্র করে দিতে হবে৷ পারলে কাল দুপুরে মেয়েদের নিয়ে একটা মিছিল অর্গানাইজ কর৷ মা মনসা মন্দির হবে৷ কেউ আটকাতে পারবে না৷’
মুখে হাসি ফুটিয়ে নেত্রা বলল, ‘এটা খুব ভাল আইডিয়া দিদি৷ আমি যাই, শান্তির সঙ্গে কথা বলি৷’
নেত্রা বেরিয়ে যাওয়ার পর তরিতা সোফায় গিয়ে বসলেন৷ শোভার জন্য ফের একবার মনটা খারাপ হয়ে গেল৷ মেয়েটা মারাত্মক খেপে আছে৷ রাগের মাথায় ভুল করে বসতে পারে৷ না, না, ঘর ভাঙার ব্যাপারে তরিতা ওকে একদম উৎসাহ দেবেন না৷ উল্টে, ভয় দেখিয়ে যাতে অনন্তকে বাগে আনা যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে৷ প্রান্তিক সমাজের এই পুরুষগুলো আসলে কাপুরুষ৷ কোনওদিন প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়নি৷ মেয়েরা রুখে দাঁড়ালে অত্যাচার করতে সাহস পাবে না ওরা৷ সাগর দ্বীপে থাকার সময় তিনি নিজেও সেটা টের পেয়েছেন বারবার৷
জলের বাটিতে লেন্সটা ডোবানো রয়েছে৷ সেদিকে চোখ পড়ায় তরিতা একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ তিনি নিজেও একটা সময় অত্যাচারের শিকার হয়েছেন৷ ক্যানিংয়ের অনাথ আশ্রম থেকে সাগর দ্বীপে বাবার আশ্রমে যাওয়ার দু’তিনদিনের মধ্যে বাঁ চোখের দৃষ্টিশক্তি তিনি খুইয়েছিলেন৷ লেন্স ব্যবহার করেন বলে কেউ এখন অবশ্য তা বুঝতে পারেন না৷ কিন্তু তরিতা ভুলবেন কী করে সেদিনগুলোর কথা? কোনও পুরুষ নন, তাঁর প্রতি চরম দুর্ব্যবহার করেছিলেন সৎমা উমা৷ তিনি বিশ্বাসই করতে চাননি, স্বামী মহেশ্বরজির কোনও মেয়ে আছে৷ সেই সময় মহেশ্বরজি সাগর দ্বীপে ছিলেন না৷ তিনি তখন কলকাতায় কোনও শিষ্যের বাড়িতে ৷ উমা তাই তৎক্ষণাৎ বিদায় করে দিতে চেয়েছিলেন তরিতাকে৷ কিন্তু, আশ্রমেরই এক বয়স্কা মা শেষে তাঁকে বোঝান, ‘স্বামীজি না ফেরা পর্যন্ত মেয়েটা এখানেই থাক৷ কে জানে, ও সত্যি বলছে কি না?’
আশ্রমে তরিতার ঠাঁই হয় গোয়ালঘরের পাশে৷ সারাদিন তাঁকে অসম্ভব পরিশ্রম করতে হত৷ দু’বেলা দু’মুঠো খাবারও জুটত না৷ কোনও কাজে ভুল হলে উমা তাঁকে মারধর করতেন৷ একদিন তিনি ঝাঁটাপেটা করার সময় তরিতার বাঁ চোখে খোঁচা লাগল৷ চোখ ফুলে খোল৷ পরদিন থেকে চোখে কম দেখতে শুরু করলেন তরিতা৷ কেউ ডাক্তার দেখানোর কথা ভাবলেনই না৷ বাঁ চোখের দৃষ্টিশক্তি চলে গেল৷ রোজ রাতে শুয়ে তরিতা নীরবে কাঁদতেন আর ভাবতেন, পালিয়ে ফের ক্যানিংয়ে চলে যাবেন কি না৷ তখনই তাঁর সতীমায়ের কথাগুলো মনে পড়ত, ‘আশা করি তোর বাবা তোকে অস্বীকার করবেন না৷ তোকে আরও পড়াশুনো করতে হবে৷ তোর পিছনে দৈবীশক্তি আছে৷ কেউ তোর ক্ষতি করতে পারবে না৷’
সত্যি সত্যিই এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন তরিতা৷ মা মনসা তাঁর বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন৷ তাঁর মাথায় পঞ্চনাগের ফণাধরা মুকুট৷ কিন্তু মায়ের মুখটা রাগে থমথম করছে৷ মা মনসা বললেন, ‘কাঁদিস না মা৷ তোর সৎমায়ের অত্যাচার আমি সহ্য করতে পারছি না৷ ওকে আমি এমন শিক্ষা দেবো, চিন্তাও করতে পারবে না৷ কাল সাপের কামড়ে উমা যখন মরে কাঠ হয়ে যাবে, তখন তুই ওকে বাঁচিয়ে তুলবি৷ তোর কাছে একটা সাদা পাথর রেখে যাচ্ছি৷ ওর ক্ষতস্থানে তুই ওই পাথরটা একবার বুলিয়ে দিবি৷ ব্যস, তার পরই ও বেঁচে উঠবে৷ খবরদার, কেউ যেন না দেখে কী করে তুই ওকে বাঁচিয়ে তুললি৷’
ঘুম থেকে উঠে তরিতা দেখেন, তার বালিশের পাশে একটা সাদা পাথর পড়ে আছে৷ সেই পাথর শাড়ির খোঁটে তিনি বেঁধে রাখলেন৷ সকালবেলায় গোয়াল ঘর পরিষ্কারের কাজে তিনি যখন ব্যস্ত, তখনই জানতে পারলেন, মন্দিরের দিকে কোনও অঘটন ঘটেছে৷ কে যেন এসে বলল, উমা মাকে সাপে কামড়েছে৷ ফুলের সাজিতে সেই সাপ না কি লুকিয়ে ছিল৷ আশ্রমিকদের মধ্যে কেউ একজন দ্রুত ওঝা ডেকে নিয়ে এলেন৷ তিনি এসে বললেন, ‘চন্দ্রবোড়া কামড়েছে৷ বাঁচিয়ে তোলা অসম্ভব৷’ সঙ্গেসঙ্গে কান্নার রোল উঠল৷ মন্দিরে গিয়ে ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে তরিতা দেখলেন, সৎমায়ের মৃতদেহ নিয়ে বিলাপ করছেন অনেকে৷ দেহটা নীল হয়ে গিয়েছে৷ দেখে তিনি মনে মনে হেসেছিলেন৷ এই শাস্তিই প্রাপ্য ছিল৷
মহেশ্বরজি আশ্রমে নেই৷ তাঁর অনুপস্থিতিতে উমা মায়ের দেহ জলে ভাসিয়ে দেওয়া উচিত হবে কি না, এ নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, তখন তরিতা মন্দিরে ঢুকে বললেন, ‘আমি কি একবার চেষ্টা করে দেখব, মাকে বাঁচানো যায় কি না?’
বয়স্কা এক আশ্রমিক… সন্ধ্যামা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী করে বাঁচাবে মা?’
তরিতা বললেন, ‘আমি বিষহরণের মন্তর জানি৷ ক্যানিংয়ের আশ্রমে অনেকে বাঁচিয়েছি৷’
‘তা হলে চেষ্টা করে দেখো৷’
‘মন্দিরের দরজা যে বন্ধ করে দিতে হবে মা৷ আশপাশে কেউ থাকলে মন্তর কাজে লাগবে না৷’
সঙ্গেসঙ্গে মন্দির ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল৷ মন্দিরের ভিতর তরিতা সেদিন অনেকটা সময় নিয়েছিলেন৷ উমা মায়ের ক্ষতস্থানে সাদা পাথরটা ছোঁয়াতেই সেটা নীল হয়ে গিয়েছিল৷ এই অলৌকিক ঘটনা দেখে তরিতা নিজেই চমকে উঠেছিলেন৷ ধীরে ধীরে চোখ খুলেছিলেন উমা মা৷ উঠে বসেই রুক্ষ গলায় জানতে চেয়েছিলেন, ‘তুই? তুই এখানে? কে তোকে মন্দিরে ঢুকতে দিয়েছে?’
তরিতা ততোধিক রুক্ষগলায় বলেছিলেন, ‘সাপের কামড়ে তুই মরে গেছিলি৷ তোকে আমি বাঁচিয়ে তুলেছি৷ ফের যদি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিস, তা হলে পরের বার আর বাঁচাব না৷’
শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন উমা মা৷ তাঁর চোখে সেই প্রথম ভয়ের চিহ্ন দেখতে পেয়েছিলেন তরিতা৷ একটু পরে তিনি নিজেই মন্দিরের দরজা খুলে দিয়েছিলেন৷ উমা মাকে বেঁচে উঠতে দেখে আশ্রমিকরা ধন্য ধন্য করেছিল৷ সন্ধ্যামা বলেছিলেন, ‘তোকে আর গোয়ালঘরে থাকতে হবে না তরিতা৷ আজ থেকে তুই আমার ঘরে থাকবি৷’
লোকমুখে এই অত্যাশ্চর্য ঘটনার কথা শুনে মহেশ্বরজি পরদিনই সাগর দ্বীপে ফিরে আসেন৷ মেয়ে বলে তরিতাকে স্বীকারও করে নেন৷ কিন্তু, তাসত্ত্বেও তরিতার দুঃখ কষ্ট বিন্দুমাত্র লাঘব হয়নি৷ উমা মা হার স্বীকার করে নিতে পারেননি৷ সামনাসামনি সমীহ করতেন বটে, কিন্তু তরিতার পিছনে লাগিয়ে দিতেন আশ্রমের অন্যদের৷ মহেশ্বজির কাছে অভিযোগ জানিয়েও কোনও ফল পেতেন না তরিতা৷ উনি বলতেন, ‘একটু ধৈর্য ধর মা৷ অনেক বড় কাজ করার জন্য তুই এই পৃথিবীতে এসেছিস৷ সময় আসতে দে৷ তুই নারীশক্তিকে জাগ্রত করবি৷ এইসব ছোটখাট ঘটনায় মন দিস না৷’
রাতে সন্ধ্যামা শুয়ে শুয়ে আশ্রম সম্পর্কে নানা গল্প করতেন৷ তখন বলতেন, ‘মহেশ্বরজি হলেন ত্রিকালদর্শী৷ উনি যা বলেন,অক্ষরে অক্ষরে তা ফলে যায়৷ ওঁর উপর ভরসা রাখ মা৷ দেখছিসই তো, ওঁর কাছে কত মান্যগণ্য লোক ছুটে আসেন৷’
তবুও, একেক সময় বাবার উপর প্রচণ্ড রাগ হত তরিতার৷ তাঁকে স্ত্রৈণ বলে মনে হত৷ মহেশ্বরজিও তাঁর প্রতি অবিচার করেছিলেন৷ সেই কারণেই, আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর তরিতা আর সাগরদ্বীপে যাননি৷ মাঝে বেশ কয়েকবার মহেশ্বরজি ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন৷ তরিতা কথাই বলেননি৷ নেত্রাকে সাফ বলে দিয়েছেন, সাগরদ্বীপ থেকে ফোন এলে তাঁকে না দিতে৷ যতদিন উমা মা আশ্রমে থাকবেন, ততদিন সেখানে তিনি পা দেবেন না৷ আর যদি কখনও যানও, তা হলে মহেশ্বরজির সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য যাবেন৷ সেদিন উচিত শিক্ষা দিয়ে আসবেন৷