তরিতা পুরাণ – ১০

(দশ)

‘সাপটা ধরা পড়েছে স্যার৷’

অফিস ঘরে বসে বকখালির রিসর্ট প্রোজেক্টের কাগজপত্র দেখছিলেন চন্দ্রভানু৷ এমন সময় কথাটা বলল, দয়াশঙ্কর৷ দিন পনেরো ধরে সাপটাকে দেখা যাচ্ছিল বাড়ির আশপাশে৷ দিনের বেলায় কোথায় লুকিয়ে থাকে, কেউ জানে না৷ রাতের বেলায় নাকি তাকে দেখা যায়৷ নানারকম গুজবও রটেছে সাপটাকে নিয়ে৷ কেউ বলছে কুড়ি ফুট লম্বা, কেউ পঁচিশ ফুট৷ কে একজন নাকি দেখেছে, সাপটার মাথায় বড় মণি আছে৷ রাতের বেলায় জ্বলজ্বল করে৷ মাঝে একদিন থানার ওসিও সাপটাকে দেখেছেন৷ রাস্তা পেরিয়ে একদিক থেকে অন্য দিকে যাচ্ছিল৷ হেড লাইটের আলোয় তিনি নাকি স্পষ্ট দেখেছেন, রাস্তা পেরতে সাপটা সময় নিয়েছিল প্রায় এক মিনিট৷ তার লেনথ নাকি এত বড়! ওসি-ই বলছিলেন, কলকাতার কোন কাগজে নাকি বেরিয়েছে, সাপটা এখানে এসেছে সেই ট্র্যাকে করে, যেটা কাঠ দিতে এসেছিল তাঁর বাড়িতে৷ হতেও পারে, কেননা সাপটা প্রথম যেদিন দেখা যায়, সেদিনই ট্র্যাক এসেছিল কঙ্কণদীঘিতে৷

সাপ-টাপের ব্যাপারে মন্টু ভক্তা খুব অভিজ্ঞ৷ দু’তিনদিন আগে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন চন্দ্রভানু৷ ধীরে ধীরে ওর ঘা শুকোচ্ছে৷ বিছানায় শুয়ে মন্টুও সাপের কথা শুনেছে৷ হঠাৎ ও বলল, ‘এ নিশ্চয় ময়াল সাপ৷ বাইরে থেকে কেউ নে এয়েচে৷ তুই ফরেস্টবাবুদের খপর দে চাঁদ৷ ধরে নে যাক৷’

কিন্তু, এদিকে স্বামী মহেশ্বরজি বলে গিয়েছেন, ‘সাপটাকে স্বয়ং শিবঠাকুর পাঠিয়েছেন৷ দেখিস, কেউ যেন ক্ষতি না করে৷’

চন্দ্রভানু পড়েছেন উভয়সঙ্কটে৷ গাঁয়ের কারও বাড়ি থেকে ছাগল উধাও হয়ে যাচ্ছে৷ কারও বাড়ি থেকে মুরগি৷ আর সব দোষ গিয়ে পড়ছে সাপের উপর৷ চন্দ্রভানু ভয় পাচ্ছিলেন, কেউ না আবার সাপটাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে৷ তা হলে সব কোপ গিয়ে পড়বে তাঁর উপর৷ তাই কাছাকাছি গ্রামে ঢেরা পিটিয়ে দিয়েছেন, কেউ যদি সাপের হদিশ দিতে পারে, তা হলে পুরস্কার দেবেন পাঁচ হাজার টাকা৷ আর জ্যান্ত ধরে দিতে পারলে পুরস্কার তার দশগুণ৷ অর্থাৎ পঞ্চাশ হাজার টাকা৷ চন্দ্রভানুর ইচ্ছে হয়েছে, ধরা পড়লে সাপটাকে তিনি পুষবেন৷ পুরস্কারের কথা শুনে গাঁয়ের সাহসী ছেলেরা দিনকয়েক মশাল নিয়ে খোঁজাখুঁজিও করেছে৷ কিন্তু, কোত্থাও পায়নি৷

দয়াশঙ্করের কথা শুনে তাই চন্দ্রভানু সোজা হয়ে বসলেন৷ মুখ তুলে বললেন, ‘ধরা পড়েছে মানে? অত বড় সাপ কে ধরল?’

দয়াশঙ্কর বলল, ‘পিয়ারা গ্রামের একটা ছেলে স্যার৷ এই সাতাশ- আঠাশ বছর বয়স হবে৷ ফরেস্টবাবুরা তাঁকে ডেকে এনেছিলেন৷ কী সাহস, সামান্য একটা হুক দিয়ে পাইথনটাকে ও বস্তাবন্দী করে ফেলল৷ ছেলেটার সঙ্গে অল্পবয়সি একটা মেয়েও ছিল স্যার৷’

‘তুই নিজের চোখে দেখেছিস?’

‘হ্যাঁ স্যার৷ নিজের চোখে দেখেছি৷’

‘কী নাম রে ছেলেটার, শুনেছিস?’

‘হ্যাঁ স্যার৷ অন্যরা ওকে ডাকছিল অঙ্কুশবাবু বলে৷ মেয়েটার নাম গোলাপি৷ পাইথনটা মণি নদীর ধারে একটা বটগাছের ডালে লুকিয়েছিল৷ প্রচুর লোকজন জড়ো হয়ে গেছিল সেইসময়৷ সবাই দেখেছে৷ থানার ওসিও ছিলেন৷ আপনি ওঁদের ফোন করলে সব জানতে পারবেন৷ লেজের দিকটা ঝুলছিল৷ ছেলেটা প্রথমে লেজ ধরে টানল৷ এ দিকে, পাইথনটা গাছের ডালে নিজের শরীর পেঁচিয়ে রেখেছে৷ প্রায় ঘণ্টাখানেক চেষ্টা করেও সাপটা আর থাকতে পারল না৷ শেষ পর্যন্ত হুড়হুড় করে নেমে এল৷’

‘কত ফুট হবে, কিছু বলল?’

‘ষোলো-সতেরো ফুট৷ পিয়ারার ছেলেটা ওসিকে আরও কী সব বলছিল৷ ভিড়ের মাঝে আমি শুনতে পাইনি৷ বুঝলাম, ফরেস্টবাবুরা খুব মুশকিলে পড়েছেন৷ পাইথনটাকে কোথায় রাখবেন, ঠিক করতে পারছিলেন না৷ তাই আপনার কাছে ছুটে এলাম৷’

‘আরে, আমার গোডাউন আছে কী করতে? তুই ওসিকে তখন বললি না কেন? হারামজাদাটাকে ফোনে ধর তো দয়া৷ ফরেস্টবাবু আর ওই ছেলেটাকে নিয়ে যেন আমার এখানে এখুনি চলে আসে৷ গোডাউনে বড় বড় ঘর আছে৷ একটা খুলে দিচ্ছি৷ শিব ঠাকুরের অনুচর৷ আমার মন্দিরেই প্রথম আশ্রয় নিয়েছিল৷ সাপটাকে আমি নিয়ে যেতে দেব না৷’

‘ঠিক আছে স্যার৷ আমি ফোনে ধরে দিচ্ছি৷ আপনি ওসি-র সঙ্গে কথা বলুন৷’

দয়াশঙ্কর ওসিকে ফোনে ধরার চেষ্টা করছে৷ বোধহয় টাওয়ার পাচ্ছে না৷ তাই দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে গেল৷ রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন চন্দ্রভানু৷ কাল সাগরদ্বীপে মহেশ্বরজির আশ্রমে সপরিবারে তাঁর যাওয়ার কথা৷ সাপটার ব্যাপারে কালই মহেশ্বরজির পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে৷ এ সাধারণ সাপ নয়৷ দৈবি মহিমায় হাজির হয়েছে৷ মন্ত্রে বশীভূত করে সাপটাকে মন্দিরের পাশেই রেখে দিতে হবে৷ মনে হয় না, ফরেস্টবাবুরা আপত্তি করবেন৷ সুন্দরবনের এই অঞ্চলে তিনিই শেষ কথা৷ ফরেস্টবাবুরা যখনই যা চান, তখনই চন্দ্রভানু হাত উপুড় করে দেন৷ বাদাবনে সব সময় আইন মেনে ব্যবসা করা যায় না৷ তাই সরকারী লোকজনদের হাতে রাখতেই হয়৷ নিশ্চয় তাঁরা ওঁর ছোটখাটো অনুরোধ রাখবেন৷ রিসর্টের ফাইলে ফের মন দেওয়ার আগে চন্দ্রভানুর খুব কৌতূহল হল পিয়ারার ওই ছেলেটার সম্পর্কে, যে অবলীলাক্রমে অত বড় সাপটাকে ধরেছে৷ ওকে আজই পুরস্কারের পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে দিতে হবে৷

দয়াশঙ্করের দেখা নেই৷ চন্দ্রভানু তাই ঝড়খালির রিসর্ট প্রোজেক্টের ফাইলটা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলেন৷ প্রায় দশ একর জমি দরকার রিসর্ট করার জন্য৷ জমি কেনা যে সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে, গোড়ার দিকে তা তিনি

বুঝতে পারেননি৷ এখন মনে হচ্ছে, ঝড়খালিতে সমুদ্রের ধারে একসঙ্গে এত একর জমি পাওয়া সম্ভব না৷ যেখানে সেখানে ছোট ছোট গেস্ট হাউস আর হোটেল গজিয়ে উঠেছে৷ নিজের চোখে সে সব দেখার জন্য চন্দ্রভানু কয়েকদিন আগে একবার ঝড়খালি গিয়েছিলেন আর্কিটেক্টকে সঙ্গে নিয়ে৷ জমির মালিকদের লঞ্চে ডেকে এনে তিনি কথাও বলেছেন৷ ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড রিসর্ট হবে শুনে জমির মালিকেরা এখন দেড়গুণ দাম হাঁকাচ্ছে৷ নানা রকম শর্তও দিচ্ছে তারা৷ পরিবারের অন্তত একজনকে চাকরি দিতে হবে৷ রিসর্টে চাকরি দিতে আপত্তি নেই চন্দ্রভানুর৷ তিনি জানেন, স্থানীয় লোকজনকে হাতে রাখতে না পারলে ঝড়খালিতে পর্যটন ব্যবসা চালাতে পারবেন না৷ কিন্তু, আবার এটাও ঠিক, জমির দাম কমাতে না পারলে পুরো প্রোজেক্ট বাতিল করতে বাধ্য হবেন তিনি৷

গোঁদের উপর বিষফোঁড়া…ওখানকার দু’তিন কামরার ছোটখাটো হোটেলগুলো৷ সেসব দেখে আর্কিটেক্ট প্রশান্ত পাল সেদিন বললেন, ‘আপনার রিসর্টের বিউটিই নষ্ট হয়ে যাবে, যদি এ সব কুৎসিত হোটেল ধারে- কাছে থাকে৷ আগে এ সব উৎখাতের ব্যবস্থা করুন৷’

এটা অবশ্য চন্দ্রভানুর বাঁয়ে হাত কা খেল৷ মাসল পাওয়ার দিয়ে তুলে দিতেই পারেন৷ কেউ বেগড়বাই করলে সেটা করতে হতেও পারে৷ কিন্তু, সেদিন জমির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে চন্দ্রভানুর মনে হয়েছে, গায়ের জোর খাটাতে গেলে মারাত্মক হইচই হবে৷ মন্টু অবশ্য বলেছে, সুস্থ হলেই এইসব সমস্যা ও মিটিয়ে দেবে৷ কিন্তু, সেটা কবে সম্ভব হবে, চন্দ্রভানু বুঝতে পারছেন না৷ বারবার তাঁর মনে হচ্ছে, একটা প্ল্যান-বি ছকে রাখা দরকার৷ তেমন হলে হেনরি আইল্যান্ডসে রিসর্টটা করা যেতে পারে৷ বাঁ দিকে সাগরদ্বীপ, কপিল মুণির আশ্রম৷ ডান দিকে ধানচি, বেজোড়া আর কলস দ্বীপ৷ তার খানিকটা উত্তরে কোর এরিয়ায় নেতি ধোপানির ঘাট৷ সেখানে চাঁদ সওদাগরের একটা জরাজীর্ণ মন্দির আছে৷ ভৌগোলিক দিক থেকেও হেনরি আইল্যান্ডস চমৎকার জায়গা৷ একদিকে, গঙ্গাসাগর তীর্থ৷ সারা দেশের তীর্থস্থানগুলির মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ৷ অন্যদিকে, কোর এরিয়ায় ঘন জঙ্গল… তাতে বাঘ, হরিণ, কুমির আর সাপ৷ সব মিলিয়ে একটা রোমাঞ্চকর পরিবেশ৷ দেশি-বিদেশি সব ধরনের ট্যুরিস্টকেই আকৃষ্ট করা সম্ভব৷

ফাইলপত্রে সুন্দরবনের একটা ম্যাপও রয়েছে৷ চন্দ্রভানু তলার দিকে একবার চোখ বোলালেন৷ সঙ্গেসঙ্গে পাটায়ার সী বিচের কথা মনে পড়ল৷ ওখানকার সী বিচ মন্দারমণির মতো অত বেশি চওড়া নয়৷ তবে, শহরের ধারে কয়েক কিলোমিটার লম্বা৷ পাটায়ায় প্রথমদিন সী বিচে গিয়ে চন্দ্রভানুর নজর টেনেছিল নীল জল৷ তাতে অবশ্য দিঘার সমুদ্রের মতো বড় বড় ঢেউ নেই৷ রঙিন ছাতার তলায় গিজগিজ করছে ট্যুরিস্টদের ভিড়৷ ছাতার তলায় একটা চেয়ার খালি নেই৷ থাইল্যান্ডের টাকায় একশো বাট দিয়ে এক একটা চেয়ার ভাড়া করতে হয়েছিল সেদিন তাঁদের৷ চন্দ্রভানু সেদিনই টের পেয়েছিলেন, পর্যটন ব্যবসায় লোকে কতরকমভাবেই না রোজগার করে! বালির উপর সুইমিং কস্টিউম পরে বিদেশি মেয়েরা কেউ কেউ সান বাথ নিচ্ছিল, কেউ ম্যাসাজ৷ কারও কারও ঊর্ধ্বাঙ্গ একেবারেই অনাবৃত৷

আর্কিটেক্ট প্রশান্তবাবু সেদিন হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন মেয়েদের দিকে৷ সে কথা মনে পড়তেই চন্দ্রভানু মুচকি হাসলেন৷ প্রায় সঙ্গেসঙ্গে আর একটা দৃশ্য তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল৷ দয়াপুরেব পিচখালি নদীতে স্নানরতা সেই যুবতী মেয়েটাকে তিনি দেখতে পেলেন৷ লঞ্চের ঢেউয়ে সেদিন যার বুকের আঁচল সরে গিয়ে… স্তন দুটো উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল৷ কে ওই সেক্সি মেয়েটা? সুন্দরবন টাইগার ক্যাম্প রিসর্টের কোনও টুরিস্ট নাকি? চন্দ্রভানু ভুলেই গিয়েছিলেন যে, দয়াশঙ্করকে খোঁজ নিতে বলেছেন৷ চালাক চতুর ছেলে৷ কী কারণে খোঁজ করছেন, সেটা ভালমতো জানে৷

দয়াশঙ্করের কথা ভাবতে ভাবতেই ও ঘরে ঢুকে বলল, ‘ওসিবাবুকে ফোনে আপনার কথা বলে দিয়েছি স্যার৷ বললেন, ওঁরা এক্ষুণি আসছেন৷’

‘ক’টা বাজে রে?’

‘বেলা চারটে হবে৷ আপনি কি কোথাও বেরুবেন স্যর?’

‘না৷ সন্ধেবেলায় জগন্নাথ পণ্ডিত আসবেন৷ গাজন নিয়ে উনি কী যেন বলতে চান৷ পণ্ডিতমশাই এলে তুই অ্যান্টি চেম্বারে বসিয়ে রাখিস৷ যেন কোনও অযত্ন না হয়৷’

‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার৷ একটা কথা ছিল৷ মুকুন্দ ঘোষ পিছনের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়৷ মাগন চাইতে এসেছে৷ ডেকে নেব নাকি?’

মুকুন্দ ঘোষ বাড়িতে আর মন্দিরে দুধ সাপ্লাই দেয়৷ পশ্চিম জটার দিকে থাকে৷ আগে ওর মা উমা এ বাড়িতে রাঁধুনীর কাজ করত৷ মায়ের সঙ্গে এসে মুকুন্দও এ বাড়িতে টুকটাক কাজকম্ম করত৷ মুকুন্দ ছেলেটা খুব সৎ টাইপের৷ কী মনে হয়েছিল, চন্দ্রভানুই একদিন ওকে বলেছিলেন, ‘তোকে আর ফাইফরমাস খাটতে হবে না৷ তোরা হচ্ছিস গে ঘোষেদের বংশ৷ তোকে আমি কয়েকটা গাইগরু কিনে দিচ্ছি৷ দুধ বেচে সংসার চালাস৷’ সেই থেকে দুধের ব্যবসা শুরু করেছে মুকুন্দ৷ চন্দ্রভানু শুনেছেন, ওর গোয়ালে এখন গোটা কুড়ি গাই গরু৷ দুটো বলদ৷ জমি কিনে নাকি লোক দিয়ে চাষও করাচ্ছে৷ মুকুন্দকে অনেকদিন দেখেননি৷ মাগন চাইতে এসেছে… মানে ভিক্ষে চায়৷ যদি কারও চোখে পডে যায়, সেই লজ্জায় সামনের দরজা দিয়ে আসেনি৷ খবর তা হলে ভাল নয়৷ দয়াকে তাই বললেন, ‘যা, ছেলেটাকে ডেকে নিয়ে আয়৷’

একটু পরে মুকুন্দ ঘরে ঢুকতেই চন্দ্রভানু চমকে উঠলেন৷ চুল উস্কো খুস্কো, ছেলেটা কাছা নিয়েছে৷ গলায় ঝোলানো একটা কুড়ুল৷ মুকুন্দর বুকের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রভানু বুঝে গেলেন, কী হয়েছে৷ কারও গোয়ালে গরু খোঁটা বাঁধা অবস্থায় মারা গেলে গলায় কুড়ুল কাছা নিতে হয়৷ প্রায়শ্চিত্তির করার জন্য৷ মুকুন্দ বোধহয় সেই রকম সমস্যায় পড়েছে৷ তাই চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবে হল রে?’

‘দিন দশেক আগে৷ রাতের দিকে ঝড় উটেচেল৷ গোয়াল ঘরের একটা চালা ভেঙে পড়ল৷ সকালে উটে দেকি, চালা গাই-গরুর ঘাড়ে পড়ে রয়েচে৷’ বলতে বলতে মুকুন্দ কেঁদে ফেলল৷

সুন্দরবন অঞ্চলে আবহাওয়ার এই পাগলামি নতুন কিছু না৷ এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি আচমকা কালবৈশাখী আসে৷ মুহূর্তে তছনছ করে দিয়ে যায় সবকিছু৷ মুকুন্দর গোয়ালে গাই গরুটা মনে হয় খোঁটা বাঁধা ছিল৷ সেই অবস্থায় মারা গিয়েছে৷ গো হত্যার দায় নিতে হবে গোয়ালের মালিককে৷ যত ধনীই হোক না কেন সে, কুড়ুল কাছা নিয়ে তাকে রোজ একবার করে লোকের বাড়ি গিয়ে মাগন চাইতে হবে৷ তেরো দিনের মাথায় শ্রাদ্ধও করতে হবে তাকে৷ সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে চন্দ্রভানু বললেন, ‘কাঁদিস না মুকুন্দ, প্রায়শ্চিত্তিরটা ধুমধাম করে কর৷ শ্রাদ্ধ কবে?’

‘বিষ্যুদবার৷ কিন্তু বাবু করব কী করে? কোনও বামুন যে করতে চাইচে না৷’

এটা একটা সামাজিক সমস্যা৷ কোনও উচ্চবংশীয় ব্রাহ্মণ মুকুন্দর বাড়ি গিয়ে প্রায়শ্চিত্তিরের ক্রিয়াকর্ম করতে রাজি হবেন না৷ চন্দ্রভানু তাই বললেন, ‘চিন্তা করিস না৷ মহেশপুরের হরনাথ চক্কোত্তিকে আমি বলে দিচ্ছি৷ উনিই কাজকম্ম করে দেবেন৷ এখন বাড়ির ভিতর যা৷ বউমণির কাছ থেকে সিধে নিয়ে আয়৷’

কথাটা শুনে হাতজোড় করে প্রখাম জানিয়ে মুকুন্দ অন্দরমহলে ঢুকে গেল৷ ড্রয়িংরুমে আর বসে থাকতে ইচ্ছে করল না চন্দ্রভানুর৷ তিনি উঠে বাইরের লনে এলেন৷ সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে৷ আকাশে সিঁদুররঙা টুকরো টুকরো মেঘ৷ আকাশের রঙ প্রতিফলিত হয়ে এসে পড়েছে বাগানে৷ পুরো বাগানটাকে আশ্চর্য মায়াময় বলে মনে হচ্ছে৷ বেশ কয়েক বছর আগে মহেশ্বরজির নির্দেশে চন্দ্রভানুকে দিল্লিতে গিয়েছিলেন, যোগেশ শর্মা নামে এক এমপি-র বাড়িতে৷ তখন জাপানে চিংড়ি রপ্তানীর কথাবার্তা চলছে৷ যোগেশ শর্মার বাড়ির বাগান দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন চন্দ্রভানু৷ সেদিনই মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন, কোনওদিন হাতে টাকাপয়সা এলে বাড়ির চৌহদ্দির ভিতর ওই রকম একটা বাগান করবেন৷ শিবঠাকুরের আশীর্বাদে রপ্তানীর ব্যবসাটা দু’তিন বছরের মধ্যেই ফুলে ফেঁপে উঠেছিল৷ তার পরই কলকাতার হর্টিকালচার সেন্টার থেকে লোকজন এনে তিনি বাগান সাজান৷

ব্যবসা সূত্রে বাইরে থেকে কোনও লোকজন এলে চন্দ্রভানু এই বাগানেই ডিনার পার্টি দেন৷ তার চটজলদি সব ব্যবস্থা করা আছে৷ বাগানে বসার জন্য বেশ কিছু বাহারি লোহার বেঞ্চ বসানো রয়েছে৷ সেইসঙ্গে কয়েকটা দোলনাও৷ চন্দ্রভানু দেখলেন, তাঁর নাতি-নাতনিরা কেউ দোলনায় দোল খাচ্ছে৷ কেউ খেলা করছে বাগানে প্লাস্টিকের রঙিন বল নিয়ে৷ বছরে দু’তিনবার নাতি-নাতনিরা কঙ্কণদীঘিতে আসে৷ ওদের মধ্যে চন্দ্রভানুর সবথেকে প্রিয়… বড়নাতি জয়জিৎ৷ বাড়ির বাবাইসোনা৷ বয়স দশ-এগারো, কলকাতায় ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ে, থাকে ওখানকারই হোস্টেলে৷ ছেলেটা পড়াশুনোয় খুব ভাল৷ চন্দ্রভানু ঠিক করে রেখেছেন, জয়জিৎকে তিনি ডাক্তারি পড়াবেন৷ নিজের দুই ছেলের কাউকে উচ্চশিক্ষা দিতে পারেননি৷ তার আগেই তারা ব্যবসায় ঢুকে গিয়েছিল৷

গেট দিয়ে পুলিশের জিপ আর একটা সাদা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি ঢুকে এল৷ বাগানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চন্দ্রভানু দেখলেন, থানার ওসি আর ফরেস্টবাবুরা এসে গিয়েছেন৷ ছয়-সাতজনের একটা দলকে সঙ্গে নিয়ে বাগানের দিকেই আসছে দয়াশঙ্কর৷ ড্রয়িংরুমে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করল না৷ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে, কথাবার্তাগুলো বাগানে বসেই সেরে নেওয়া যেতে পারে৷ ঠিক ওই সময়… নাতি-নাতনিদের আর্ত চিৎকার শুনতে পেলেন চন্দ্রকান্ত৷ ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি দেখলেন, ঝোপের কাছে বসে পড়েছে জয়জিৎ৷ ওর সামনে ফখা তুলে রয়েছে একটা কেউটে৷ কয়েক সেকেন্ড পরেই ফণা নামিয়ে সাপটা ঝোপের আড়ালে ঢুকে পড়ল৷ দূর থেকেই চন্দ্রভানু বুঝে গেলেন, কী ঘটেছে! খেলতে খেলতে বলটা সম্ভবত ঝোপের মধ্যে চলে গিয়েছিল৷ হাত বাড়িয়ে সেটা আনতে চেয়েছিল জয়জিৎ৷ তখনই সাপটা ছোবল মেরেছে৷

লোহার বেঞ্চে চন্দ্রভানু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন৷ কেউটে সাপের দংশন ভয়ঙ্কর৷ দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে বড়নাতিকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না৷ কেউ একজন জয়জিতের কবজিতে দড়ির বাঁধন দিতে যাচ্ছিল৷ চন্দ্রভানু দেখলেন, ফরেস্টবাবুদের সঙ্গে আসা একটা ইয়ং ছেলে লাফিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াল৷ তার পর বাধা দিয়ে বলল, ‘প্লিজ, এটা করবেন না৷ আপনারা সরে যান৷ আমাকে দেখতে দিন কী হয়েছে৷’ ওই ছেলেটাই জয়জিতের হাতে কামড়ের দাগ খুঁটিয়ে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে কি কাছাকাছি কোনও নার্সিংহোম আছে? যত তাড়াতড়ি সম্ভব একে সেখানে নিয়ে যেতে হবে৷’

ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন বলল, ‘রায়দীঘিতে আছে৷’

ছেলেটা বলল, ‘তা হলে আর সময় নষ্ট করবেন না৷ কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার সময় নেই৷ আমার সঙ্গে অ্যান্টি ভেনম সিরাম আছে৷ এর এক্ষুণি ট্রিটমেন্ট শুরু করা দরকার৷ ’

কথাটা বলেই পাঁজকোলা করে জয়জিৎকে তুলে নিল ছেলেটা৷ অ্যাম্বাসাডরের দিকে দৌড়তে লাগল৷ শূন্য দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন চন্দ্রভানু৷ বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে৷ মাথাও কাজ করছে না৷ মনে হচ্ছে না, ছেলেটার সঙ্গে তাঁরও এখন নার্সিং হোমে যাওয়া দরকার৷ তাঁর সবথেকে প্রিয়… বাবাইসোনাকে ইয়ং ছেলেটা নিয়ে যাচ্ছে৷ সে আর ফিরে আসবে কিনা, কে জানে? জীবনে বহুবার এর থেকেও অনেক বেশি বিপদে পড়েছেন চন্দ্রভানু৷ অনেকবার তাঁর নিজের জীবনও বিপন্ন হয়েছে৷ কিন্তু কখনও তিনি আশা ছাড়েননি৷ আজ কী হল, তিনি বুঝতে পারছেন না৷ গেট দিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে যেতেই চন্দ্রভানুর বুক হু হু করে উঠল৷ সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন ফরেস্টবাবু৷ তাঁর কাছে চন্দ্রভানু জানতে চাইলেন, ‘আমার নাতিটাকে যে নিয়ে গেল, কে ওই ছেলেটা?’

ফরেস্টবাবু বললেন, ‘ও-ই তো অঙ্কুশ মিত্তির৷ পাইথনটা যে আজ ধরেছে৷ আপনার নাতির কপাল ভাল যে, অঙ্কুশবাবু আজ এখানে রয়েছেন৷ দেখবেন, আপনার নাতির কোনও ক্ষতি হবে না৷’

(এগারো)

নরম সোফায় শরীরটা ডুবিয়ে দিতেই অঙ্কুশের সব টেনশন উধাও হয়ে গেল৷ উফ, সকাল থেকে পর পর যা ঘটে গেল, তা একেবারে অপ্রত্যাশিত৷ রায়দীঘিতে পৌঁছনোর পর থেকে ও এক মুহূর্ত বসার সময় পর্যন্ত পায়নি৷ নদীর ধারে পাইথনটাকে ধরার পর… জয়জিৎকে নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া৷ ঘণ্টাতিনেক উত্তেজনায় একেবারে টানটান৷ সবথেকে সংকটময় মুহূর্ত, বাচ্চা ছেলেটাকে অ্যান্টি ভেনম সিরাম দেওয়ার সিদ্ধান্তটা নেওয়া! কোয়ালিফাইয়েড ডাক্তার ছাড়া এই সিরাম দেওয়া বেআইনি৷ কিন্তু, তখন পরিস্থিতিটা এমন হয়ে গিয়েছিল, আইন নিয়ে ভাবার কোনও প্রশ্নই ছিল না৷ অঙ্কুশের সামনে তখন একটাই প্রশ্ন, কীভাবে বাচ্চাটার জান বাঁচানো যায়৷ অ্যান্টি ভেনম সিরাম দেওয়ার পদ্ধতিটা ও নিজের চোখে অনেকবার দেখেছে৷ খুব ঝুঁকির কাজ সেটা৷ কোয়ালিফাইয়ড ডাক্তাররাও আটঘাট বেঁধে, ভেবে-চিন্তে তার পর সিরাম দেন৷ কিন্তু, অঙ্কুশের যেন জিদ চেপে গিয়েছিল৷ কাম হোয়াট মে… বাচ্চা ছেলেটাকে মরতে দেওয়া চলবে না৷ চোখের সামনে একটা ছেলে মুখে গ্যাঁজলা তুলছে, তখন হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায়? তার মানে ততক্ষণে হার্ট এফেক্ট করে গিয়েছে৷

হাতের সামনে সব প্রতিশেধক জুটেও গিয়েছিল৷ প্রত্যন্ত কোনও গ্রামে ওয়ার্কশপ করতে গেলে অঙ্কুশ সঙ্গে অ্যান্টি ভেনম সিরামের পাউডার সঙ্গে করে নিয়ে যায়৷ কাচের শিশিতে যে সিরাম থাকে, সেটা নির্দিষ্ট একটা টেম্পারেচারের মধ্যে রাখতে হয়৷ বাইরে রাখলে সেটা নষ্ট হয়ে যায়৷ কিন্তু, সিরামের পাউডার যে কোনও তাপমাত্রায় রাখা যায়, তার গুণাগুণ নষ্ট হয় না৷ সেই পাউডার স্টেরাইল জলের মধ্যে মিশিয়ে নিলেই সিরাম হয়ে যায়৷ ভাগ্য ভাল, স্টেরাইল জলের কয়েকটা বোতলও আজ সঙ্গে ছিল৷ তবে, নার্সিং হোমে অঙ্কুশ অ্যান্টি ভেনম সিরাম দেওয়ার উদ্যোগ নিতেই সুপার এসে বাধা দিয়েছিলেন, ‘প্লিজ, এই রিস্কটা আপনি নেবেন না৷ কোনও মিসহ্যাপ হলে তার দায় কিন্তু আমি নেব না৷’

পাশ থেকে গোলাপি তখন ফিসফিস করে বলেছিল, ‘লোকটার কথা তুমি শুনো নাকো দাদাবাবু৷ মা মনসার নাম করে কাজে নেমে যাও৷ আমি বলচি, খারাপ কিচু হবে না৷’

মনের জোর পেয়ে অঙ্কুশ তখন সুপারকে বলেছিল, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, খারাপ যদি কিছু হয়, তা হলে পুরো দায় আমার৷’

সত্যি সত্যি, মা মনসার নাম করেই অঙ্কুশ দ্রুত ট্রিটমেন্ট শুরু করে দিয়েছিল৷ অল্প সিরাম জয়জিতের স্কিনে দিয়ে প্রথমে ও পরীক্ষা করে নিয়েছিল, অ্যালার্জি আছে কিনা৷ থাকলে ওকে স্টেরয়েড দিতে হত৷ কিন্তু, মিনিট দশেকের মধ্যেই ও বুঝেছিল, অ্যালার্জি নেই৷ তখন ও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল৷ আধ ঘণ্টার মধ্যে স্যালাইন বোতলে সিরাম চালু করে দেওয়ার পর অঙ্কুশ নিশ্চিন্ত হয়ে যায়৷ নাহ, ছেলেটা বেঁচে যাবে৷ শরীরে খুব বেশি পরিমাণ বিষ সাপটা ঢালতে পারেনি৷ অনেক সময় এমনও হয়, বিষের থলেটা পুরো ভর্তি থাকে না৷ কেউটে সাপটা পুরো বিষ ঢাললে এতক্ষণে জয়জিতের পুরো বডি প্যারালেটিক হয়ে যেত৷ ঠায় তিনটি ঘণ্টা অঙ্কুশ ওর বেডের কাছে বসেছিল৷

নার্সিং হোমের একজন এমবিবিএস পুলকেশ সাহা বাচ্চাটার হার্ট আর পালস বিট মনিটর করে যাচ্ছিলেন৷ রাত ন’টার পর সেই পুলকেশবাবুই বললেন, ‘আপনি রেস্ট নিতে চলে যান অঙ্কুশবাবু৷ আপনি এখন না থাকলেও চলবে৷ ডাঃ সফিকুল মণ্ডলের নাইট ডিউটি আছে৷ উনি বাচ্চাটাকে দেখবেন৷’

অঙ্কুশ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বাচ্চাটার ফিজিক্যাল কন্ডিশন কেমন বুঝছেন ডক্টর?’

‘চবিবশ ঘণ্টার আগে কিছু বলা যাবে না৷ হাউএভার… কাল সকালেই কলকাতার বেলভিউ নার্সিং হোম থেকে একজন এমডি-কে এখানে নিয়ে আসছেন চন্দ্রভানুবাবু৷ উনি এলে আমাদের দায়িত্ব শেষ৷’

রায়দীঘিতে পা দেওয়ার পর থেকে সবার মুখে চন্দ্রভানুর নাম শুনছে অঙ্কুশ৷ সবাই তাঁকে খাতির করেন৷ ভদ্রলোক কে, তা জানার জন্য ও জিজ্ঞেস করল, ‘চন্দ্রভানুবাবু ভদ্রলোক কে বলুন তো?’

‘সুন্দরবনের আম্বানি ধরে নিতে পারেন৷ ইচ্ছে করলে উনি লন্ডন বা আমেরিকা থেকেও কোনও প্যারাডেমিক ডাক্তারকে নিয়ে আসতে পারেন৷ ওঁর এত টাকাপয়সা আছে৷ আমাদের নার্সিং হোমের সুপার তখন কেন আপনাকে বাধা দিয়েছিলেন জানেন? আপনি কোয়ালিফায়েড ডাক্তার নন৷ বাচ্চাটার ট্রিটমেন্টে গন্ডগোল ধরা পড়লে চন্দ্রভানুবাবু আপনাকে পুঁতে ফেলতেন৷ কেউ টেরও পেত না৷’

‘তাই নাকি? আমার বিবেক কিন্তু বলছিল, বাচ্চাটাকে আনঅ্যাটেন্ডেড ফেলে রাখা উচিত না৷’

‘সেটা বোঝার মতো শিক্ষাদীক্ষা চন্দ্রভানুবাবুর নেই৷ শাস্তির খাঁড়াটা আমার ঘাড়েও নেমে আসতে পারত৷ কেননা, ওইসময় একমাত্র আমিই ডিউটিতে ছিলাম৷ ভগবানের কাছে প্রার্থনা করুন, যাতে বাচ্চাটা সুস্থ হয়ে ওঠে৷ আমাদের দেশে… দুর্ভাগ্যের ব্যাপার কী জানেন? কোনও প্যারাডেমিক নেই৷ মানে, স্নেক বাইটিংয়ে স্পেশালিস্ট ডক্টর নেই৷ পড়ানোও হয় না৷ ডাক্তারি পড়ার সময় আমরা দেড় পাতার একটা চ্যাপ্টার পড়েছি, পয়জন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে৷ তার মধ্যে মাত্র একটা প্যারাগ্রাফ স্নেক পয়জন৷ স্নেক বাইটিংয়ে মৃত্যুর হার এত বেশি হবে না কেন? তার উপর অশিক্ষা! সাপে কামড়ালে লোকে আগে মনসাতলায় যায়৷ না হলে কোয়াক ডাক্তারদের কাছে৷ যেতে বাধ্য হয়, কেননা সারা সুন্দরবন এইসব কোয়াক ডাক্তারে ছেয়ে গিয়েছে৷ একেবারে শেষ মুহূর্তে পেসেন্ট আমাদের কাছে আসে৷’

‘অথচ ঠিক সময়ে ট্রিটমেন্ট শুরু করলে স্নেক বাইটিংয়ে মরার কথা নয়৷’

‘ঠিক বলেছেন৷ আমাদের মতো ডাক্তারদের কী অসুবিধে জানেন, সাপ সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারণাই নেই৷ কোনও সাপ আমরা চিনি না৷ আপনাদের মতো হারপেটোলজিস্টরা যদি ডাক্তারির স্টুডেন্টদের নিয়ে ওয়ার্কশপ করেন, তা হলে তারা খানিকটা আইডিয়া পেতে পারে৷ স্টুডেন্টদের কথাই বা বলছি কেন, সাধারণ মানুষও অজ্ঞ ৷ এই সুন্দরবনের আরও দক্ষিণ দিকে যদি যান, তা হলে দেখবেন, মোহনার দিকে বয়ে যাওয়া নদীর উপর দিয়ে মাঝে মধ্যেই কলাগাছের ভেলা ভেসে যাচ্ছে সাপে কাটা ডেডবডি নিয়ে৷ মা মনসার নাম করে লোকেরা সেই ভেলা ভাসিয়ে দেয়৷ মনে এই আশা নিয়ে, ভেলা ভাসতে ভাসতে কোনও একদিন নেতি ধোপানির ঘাটে পৌঁছবে৷ তার পর মরা মানুষ লখিন্দরের মতো বেঁচে উঠবে৷’

‘সত্যিসত্যি বেঁচে ওঠে নাকি?’

‘জানি না মশাই৷ অনেক সময় এমনও হয়, হয়তো লোকটাকে বিষধর সাপ কামড়ায়নি৷ ভয়ে লোকটা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে৷ তাকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হল৷ জলের ঝাপটা খেয়ে লোকটা জ্ঞান ফিরে পেল৷ ব্যস, শুরু হয়ে গেল মা মনসার পুজো৷ মানুষের এমন অন্ধ বিশ্বাস, কী আর করা যাবে? সাতজেলিয়ায় লাহিড়িপুর বলে একটা জায়গা আছে৷ সেখানে তো একবার একটা এনজিও-র কর্তারা মারধর খেয়েছিলেন, ডেডবডি জলে ভাসিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে৷ কী, না… ভেলা ভাসতে ভাসতে নেতি ধোপানির মাটি ছুলেই মা মনসার কৃপায় নাকি মরা মানুষ বেঁচে উঠবে৷ মা মনসার এমন মহিমা এখানে৷’

‘নেতি ধোপানির ঘাট কতদূর রায়দীঘি থেকে?’

‘আমার কোনও ধারণা নেই৷ মনে হয়, ঝড়খালি দিয়ে যাওয়াই সুবিধে৷ শুনেছি, নেতি ধোপানি মাতলা নদীর ধারে৷ আনজুলমারি আইল্যান্ডসের উল্টো দিকে৷ জায়গাটা এখন কোর এরিয়ায়৷ ওখানে কাউকে নামতেও দেওয়া হয় না৷ তবে, লঞ্চ ট্রিপ আছে৷ পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়৷ কখনও সময় পেলে একবার দেখে আসতে পারেন৷ বেহুলার মিথটা জড়িয়ে আছে কি না৷ সেই কারণে অনেকেই ওই আইল্যান্ডসটা দেখতে চান৷ এখন থাক এ সব কথা৷ আপনি তো সেই দুপুর থেকে পেটে কিছু দেননি৷ চলুন, আমার কোয়ার্টারে৷ আমার স্ত্রীর হাতের রান্না ফেলে দেওয়ার মতো নয়৷ আপনার খ্যাতি এতক্ষণে রায়দীঘি আর কঙ্কণদীঘির অন্দরমহলেও পৌঁছে গিয়েছে৷ আমার স্ত্রীও ফিলার পাঠিয়েছে, আপনার মতো সর্পবীরকে দেখতে চান৷ চলুন, ডিনারটা সেরে আসা যাক৷’

পুলকেশবাবুর কথা শুনে অঙ্কুশ প্রাণ খুলে তখন হেসেছিল৷ রাতে পিয়ারায় আর ফিরে যেতে পারেনি অঙ্কুশ৷ চন্দ্রভানুবাবুর বডিগার্ড দয়াশঙ্কর প্রায় জোর করেই ওকে কঙ্কণদীঘির এই গেস্ট হাউসে নিয়ে এসেছিলেন৷ রাত দশটা পর্যন্ত ও এমন ব্যস্ত ছিল যে, বাড়িতে ফোন করে খবরটা দেওয়ার কথাও অঙ্কুশ ভুলে গিয়েছিল৷ একটু আগে পিঙ্কি বউদিই ফোন করে জানতে চাইল, ‘তোমার কী আক্কেল বলো তো ঠাকুরপো? এখনও ফিরলে না যে? বাড়িতে সবাই যে খুব চিন্তা করছেন৷ তুমি ঠিক আছ তো?’

অঙ্কুশ তখন জয়জিতের কথা সব জানিয়ে তার পর বলেছিল, ‘বাচ্চা ছেলেটাকে ফেলে… চলে যেতে পারলাম না বউদি৷ আমার তখন টিটোর কথা মনে হচ্ছিল৷ ছেলেটা যে ওরই বয়সি৷’

পিঙ্কি বউদি বলেছিল, ‘না, না, ভালই করেছ৷ কেমন আছে এখন ছেলেটা?’

‘স্টেবল কন্ডিশনে৷ যা রিস্ক আজ নিয়েছিলাম, একটু এদিক ওদিক হলে হাতে হাতকড়া পড়ে যেত৷ ভাগ্যিস, আসার সময় গোলাপি ব্যাগের ভিতর… অ্যান্টি ভেনম সিরামের পাউডার, স্টেরাইল ওয়াটারের বোতল আর স্টেরয়েড পুরে নিয়েছিল৷ জয়জিৎ ছেলেটা মনে হয়, তাই প্রাণে বেঁচে গেল৷ কেউটে সাপ কামড়েছে…বিনা চিকিৎসায় এখানে পড়ে থাকলে দু’ঘণ্টার বেশি বাঁচত না৷’

‘তোমার দাদা জানতে চাইছে, গোলাপিকে কি মহেশপুরে পৌঁছে দিয়েছ?’

‘আমি যেতে পারিনি৷ কিন্তু, ও মহেশপুরে পৌঁছে গিয়েছে৷ রায়দিঘির খেয়াঘাটে হঠাৎ দেখা ওর কাকার সঙ্গে৷ দু’জনকে গাড়ি করে ওর দাদার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি৷’

‘তুমি এখন কোথায় ঠাকুরপো?’

‘কঙ্কণদীঘিতে৷ যে ছেলেটাকে সাপে কামড়েছে, তার দাদুর বাড়িতে৷ বিশাল বড়লোক বউদি৷ বাড়িটা দেখলে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে৷ একেবারে রাজবাড়ি৷ ভদ্রলোকের নাম চন্দ্রভানু৷ টাইটেলটা কী তা জানি না৷ উনিই নার্সিংহোম থেকে জোর করে আমাকে ওঁর বাড়িতে নিয়ে এলেন৷’

‘তোমার কী কপাল গো ঠাকুরপো৷ আমার হিংসে হচ্ছে৷ তা, রাজবাড়িতে কি রাজকন্যের সন্ধান পেলে?’

‘এখনও পাইনি৷ তবে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা চেক পাবো বলে শুনছি৷ পাইথন ধরার জন্য রাজা চন্দ্রভানু না কি আমাকে পুরস্কার দেবেন৷ আমি এসে শুনলাম, উনি নাকি আগেই অ্যানাউন্স করেছিলেন৷’

‘আশ্চর্য, এই তোমার জীবনে উষসী উদয় হল৷ আর আজই তুমি আধলাখপতি হয়ে গেলে? নারীভাগ্যে ধন বোধহয় একেই বলে৷ কী করবে গো অত টাকা দিয়ে?’

‘তুমি ভাবতে শুরু করো৷ কাল রাতে গিয়ে আমি জেনে নেব৷’

‘তোমার টাকা… আমি ভাবব কেন ভাই? যার ভাবার কথা, তার বাবা কেমন আছে, একবার কি খোঁজ নিয়েছ? নাকি এটাও তোমায় শিখিয়ে দিতে হবে৷’

‘মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ পিঙ্কি৷ এখন ছাড়ি?’

ফোনের সুইচ অফ করার আর দরকার হল না অঙ্কুশের৷ ও পাশ থেকে ঠকাস করে রিসিভার রাখার শব্দ শুনতে পেয়েছিল ও৷ পিঙ্কি সম্বোধনটা শুনে বউদি চটেছে৷ যাক, কাল রাত পর্যন্ত আর বিরক্ত করবে না৷ মোবাইল সেটটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে অঙ্কুশ সোফায় গিয়ে বসেছিল৷ এই গেস্ট হাউসে ওকে নিয়ে এসে দয়াশঙ্কর বলেছিলেন, চন্দ্রভানুবাবু নাকি ওর সঙ্গে কথা বলতে চান৷ গেস্ট হাউসটা একেবারে মণি নদীর ধারে৷ নদীর দিকটায় ঘন অন্ধকার৷ তবে জনবিরল নয়৷ এত রাতেও মাঝেমধ্যে ভটভটি নৌকো চলাচলের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে৷ সেইসঙ্গে শোনা যাচ্ছে নিশাচর পাখির ডাক৷ ঘর খুলে দেওয়ার সময় দয়াশঙ্কর বলে দিয়েছিলেন, ‘রুমে এসি আছে৷ দরকার হলে রাতে চালিয়ে দিতে পারেন৷’

কিন্তু, ডান দিকের জানলা দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা বাতাস আসছে৷ এসি-র প্রয়োজন আছে বলে অঙ্কুশের মনে হচ্ছে না৷ ঘরটাও খুব সুন্দর সাজানো গোছানো৷ কঙ্কণদীঘির মতো জায়গায় এই রকম একটা যে গেস্ট হাউস আছে, ভাবা যায় না! চন্দ্রভানুবাবুর রুচিবোধ আছে৷ ভদ্রলোকের সঙ্গে ওর এখনও দেখাও হয়নি৷ কিন্তু, ঠাটবাট দেখে অঙ্কুশ বুঝতে পারছে, ভদ্রলোক কোটি কোটিপতি৷

অন্যদিন, রাত এগারোটার মধ্যেই অঙ্কুশ ঘুমিয়ে পড়ে৷ কিন্তু, আজ ওর চোখে ঘুম নেই৷ নতুন জায়গা বলেই বোধহয় ঘুম আসছে না৷ সোফার উল্টোদিকের দেওয়ালে একটা এলসিডি টিভি লাগানো আছে৷ হাত বাড়িয়ে সেন্টার টেবল থেকে রিমোট কন্ট্রোলটা অঙ্কুশ তুলে আনল৷ সারাদিনে টিভির খবর দেখা হয়নি৷ চ্যানেল সার্ফ করার সময় হঠাৎ ওর চোখ আটকে গেল৷ পর্দায় ডিএফও জীবনবাবুর ছবি…কী যেন বলছেন৷ সাউন্ড বাড়িয়ে দিতেই ওর কানে এল, ‘সেকেন্ড পাইথনটাকে আপাতত দুধ আর কলা খেতে দেওয়া হয়েছে৷ কলকাতা থেকে সাপ বিশেষজ্ঞ সুমন্ত মণ্ডলকে আমরা কাল কঙ্কণদীঘিতে নিয়ে যাচ্ছি৷ দুটো পাইথনকে নিয়ে কী করা হবে, সে সম্পর্কে ওঁর পরামর্শ নেওয়া হবে৷’

কথাগুলো শুনেই অঙ্কুশ টিভির সুইচ অফ করে দিল৷ জীবনবাবু তা হলে শেষ পর্যন্ত সুমন্ত মণ্ডলের খপ্পরে গিয়ে পড়লেন! ও কিন্তু বারণ করেছিল৷ ভদ্রলোক শুনলেন না৷ রাগ করার বদলে অঙ্কুশের আফসোস হতে লাগল৷ বন বা বন্যপ্রাণী সম্পর্কে যাঁদের বিন্দুমাত্র আন্দাজ নেই, তাঁরা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে কর্তা হন কী করে?

সাপ কি দুধ-কলা খায়? অশিক্ষিতের মতো কথাবার্তা৷ বাংলা ভাষায় একটা কথা চালু আছে বটে, দুধ-কলা দিয়ে সাপ পোষা৷ কিন্তু, সাপ দুধ খায় না, কলা তো দূরের কথা৷ দুধের ভিতর যে ল্যাকটোস আছে, সেটা সাপের পক্ষে টক্সিড হয়ে যেতে পারে৷ জীবনবাবুদের এসব কথা বলেও লাভ নেই৷ যাক গে… পাইথন নিয়ে ওঁরা যা ইচ্ছে, তাই করুন৷ অঙ্কুশ ঠিক করে নিল, ও আর মাথা ঘামাবে না৷ উল্টে, ওর বাড়িতে যে পাইথনটা আছে, সেটা নিয়ে যাওয়ার জন্য জীবনবাবুকে চাপ দেবে৷

রাত এখন প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে৷ নাহ, এ বার শুয়ে পড়া দরকার৷ সোফা ছেড়ে উঠে অঙ্কুশ বিছানার দিকে পা বাড়াতেই, দরজার বাইরে ও কারও পায়ের শব্দ শুনতে পেল৷ এত রাতে কে ওর সঙ্গে দেখা করতে এলেন? চন্দ্রভানুবাবু নাকি? কয়েক পা হেঁটে ও দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দয়াশঙ্করের গলা শুনতে পেল, ‘অঙ্কুশবাবু, ঘুমিয়ে পড়েছেন নাকি? দরজাটা একবার খুলবেন?’

তা হলে নার্সিং হোম থেকে কি কোনও বাজে খবর এল? ভেবে অঙ্কুশের বুকটা কেঁপে উঠল৷ তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ও বলল, ‘আপনি?’

‘স্যার আপনার কাছে পাঠালেন৷ আপনার কিন্তু কাল বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না৷’

‘কেন বলুন তো?’

‘বলছি৷ আপনার যদি আপত্তি না থাকে, ঘরে বসে কথা বলতে পারি?’

‘আসুন তা হলে৷’ দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়াল অঙ্কুশ৷

ভেতরে ঢুকে দয়াশঙ্কর বললেন, ‘আপনার উপর বউমণি কিন্তু খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন অঙ্কুশবাবু৷ আপনি এই বাড়ির অতিথি৷ সামান্য ওই ডাক্তারের বাড়িতে কেন আপনি ডিনার করতে গেলেন?’

অঙ্কুশ বলল, ‘মাফ করবেন৷ ডাঃ পুলকেশের বাড়িতে আমি যখন যাই, তখনও জানতাম না, এখানে আসতে হবে৷ কিন্তু, কাল পিয়ারাতে ফিরতে পারব না কেন, বুঝতে পারছি না৷’

‘স্যার আপনার পরামর্শ নিতে চান৷ বাড়ির সবাই খুব প্যানিকে ভুগছেন৷ বাগানে কোনওদিন সাপের উপদ্রব হয়নি৷ দেখছেন তো, কত উঁচু পাঁচিল৷ চবিবশ ঘণ্টা সিকিউরিটি গার্ড৷ স্যার বুঝতেই পারছেন না, কেউটেটা ঢুকল কী করে? মাঝে মাঝেই পাঁচিলের বাইরে কার্বোলিক অ্যাসিড ছড়ানো হয়৷’

‘সাপের পক্ষে অসম্ভব কিছু না৷ কোনও গর্ত দিয়ে চলে আসতে পারে৷ হয়তো গার্ডদের চোখে পড়েনি৷’

‘গতকাল সকালে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গিয়েছে অঙ্কুশবাবু৷ শুনলে হয়তো আপনি হাসবেন, তবুও বলি৷ বেলা দশটা নাগাদ এক সাপুড়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বিন বাজাচ্ছিল৷ সাপের খেলা দেখাতে চায়৷ বারান্দা থেকে জয়জিৎ ওকে বোধহয় দেখতে পেয়েছিল৷ নীচে নেমে গিয়ে সাপুড়েটাকে বাগানে ডেকে আনে৷ সে খানিকক্ষণ খেলা দেখিয়ে চলে যায়৷ মাঝে বাড়ি থেকে বউমণিও বেরিয়ে এসেছিলেন৷ টাকা নিয়ে সাপুড়েটা চলে যাওয়ার সময় নাকি বউমণিকে বলে গিয়েছিল, বাড়িতে মনসা পুজো কর৷ না করলে মা মনসার কোপে পড়বি৷ কথাটা তখন বউমণির মাথায় স্ট্রাইক করেনি৷ কিন্তু, শেষপর্যন্ত সত্যি সত্যিই মা মনসার কোপে পড়তে হল ৷ স্যারের সন্দেহ, সবার চোখে ধুলো দিয়ে ওই সাপুড়েটাই বাগানের ভিতর সাপ ছেড়ে দিয়ে গিয়েছে৷’

‘আমার কিন্তু তা মনে হয় না৷’

‘স্যার বললেন, কাল সকালে যদি আপনি পুরো বাগানটা একবার ঘুরে দেখেন… আর কোথাও সাপ আছে কিনা, তা হলে বাড়ির সবাই নিশ্চিন্ত হতে পারেন৷’

‘ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করব৷ কিন্তু, সাপ ধরার হুক এখন আমার সঙ্গে নেই৷ আমাকে বানিয়ে নিতে হবে৷ আর দরকার স্নেকব্যাগ৷ না পাওয়া গেলে…কোলবালিশের কভার হলেও আমার চলবে৷’

‘বাঁচালেন অঙ্কুশবাবু৷ তা হলে স্যারকে গিয়ে কথাটা আমি বলছি৷ আপনার যা দরকার, কাল সকালে আমায় বলবেন৷ আমি জোগাড় করে দেব৷ আর হ্যাঁ, স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান ব্রেকফাস্ট টেবলে৷ বেলা সাড়ে ন’টার মধ্যে৷ আপনি তৈরি হয়ে থাকবেন৷ আমি এসে নিয়ে যাব৷’

কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালেন দয়াশঙ্কর৷ হ্যান্ডশেক করে উনি বেরিয়ে গেলেন৷ লম্বা করিডোর দিয়ে উনি হেঁটে যাচ্ছেন৷ ভদ্রলোক লম্বায় প্রায় ওর সমান সমান৷ ছয়ফুটের কাছাকাছি তো হবেনই৷ পেটানো শরীর, নিশ্চয়ই রোজ ওয়েট ট্রেনিং করেন৷ ভদ্রলোক করিডোরের একবারে শেষপ্রান্তে পৌঁছে দু’ধাপ সিঁড়ি দিয়ে লনে নামলেন৷ আর তখনই একটা আশ্চর্য দৃশ্য দেখতে পেল অঙ্কুশ৷ করিডোরের রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে টাইলসের উপর উঠে এল একটা সাপ৷ তার পর আরও একটা৷ একটার পর একটা সাপ আসতেই থাকল৷ দয়াশঙ্করের গমনপথ ধরে সাপগুলো দ্রুত এগোতে লাগল৷ যেন দয়াশঙ্করকে তাড়া করার জন্য দৌড়চ্ছে৷ একটা আতঙ্কের স্রোত অঙ্কুশের বুক থেকে পা পর্যন্ত নেমে গেল৷ তাড়াতাড়ি ও দরজা বন্ধ করে দিল!

(বারো)

ফণী মনসাতলায় পৌঁছে তরিতা বললেন, ‘নেত্রা, দ্যাখ তো ধারে-কাছে শোভা আছে কিনা?’

একটা বিশাল অশ্বত্থ গাছের তলায় খানকয়েক তিরপল পাতা রয়েছে৷ তাতে বসে আছে পঁচিশ-তিরিশজনের একটা দল৷ বেশিরভাগই গাঁয়ের বউ-ঝি৷ একটু পরেই শুরু হবে ‘মা মনসার পালা’৷ গাঁয়ের মানুষ সেই পালা শুনতে এসেছে৷ গাছের নীচে রঙিন চাঁদোয়া টাঙানো হয়েছে৷ তার নীচে বড় দুটো চৌকিতে সাদা চাদর বিছানো৷ চৌকিতে দাঁড়িয়ে পালাগান গাইবেন গোসাবার হারাধন পালাকার৷ তাঁর সঙ্গে রয়েছেন তিন-চারজন বাজনদারও৷ টাইগার ক্যাম্প রিসর্টের কর্তা উদয়শঙ্করবাবুর কাছে খোঁজ নিয়েছিলেন তরিতা৷ মা মনসার পালা ভাল করতে পারে, এমন কোনও দল এই অঞ্চলে আছে কিনা৷ উদয়শঙ্করবাবু সুপারিশ করেছিলেন হারাধন পালাকারের নাম, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন ম্যাম৷ হারাধন এই অঞ্চলে খুব পরিচিত নাম৷ উনি আসছেন শুনলে গাঁয়ের লোক ছুটে আসবে৷’

বাজনদাররা বাজনা শুরু করে দিয়েছে৷ এটা গাঁয়ের লোককে জানান দেওয়া, পালা আরম্ভ হতে যাচ্ছে৷ অশ্বত্থ গাছের নীচে চার-পাঁচটা হ্যাজাক জ্বালানো হয়েছে৷ সেই আলোয় তরিতা খুঁজতে লাগলেন শোভাকে৷ নাহ, কোথাও মেয়েটাকে চোখে পড়ছে না৷ মা মনসার ঘট পাতার জন্য ওকেই টাকা দিয়েছিলেন তরিতা৷ গত পরশু পর্যন্ত খুব উৎসাহ নিয়ে পুজোর আয়োজন করেছে৷ ওইদিনই শেষবার শোভা দেখা করতে গিয়েছিল রিসর্টে৷ হারাধন পালাকারের নাম শুনে উচ্ছাসিত৷ বলেছিল, মা মনসার পালা ও নিজে অনেকটা লিখে ফেলেছে৷ সেই অংশটুকু ও হারাধনবাবুকে দেখিয়ে নেবে৷ জানতে চাইবে, ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা৷ হারাধনবাবু লোকজন নিয়ে দুপুরবেলাতে হাজির হয়েছেন আজ৷ অথচ শোভার কোনও পাত্তা নেই! মেয়েটার হল কী?

তাঁকে দেখতে পেয়ে শান্তি কাছে এসে বলল, ‘কাল থেকে শোভা আসছে না ম্যাডাম৷ আমার ঘাড়েই সব ফেলে দিয়ে গিয়েছে৷ অ্যারেঞ্জমেন্ট যে রকম চেয়েছিলেন, সেইরকম হয়েছে?’

তরিতা কঠিন গলায় বললেন, ‘মা মনসার ঘট কোথায় পাতা হয়েছে শান্তি?’

‘ওই তো’, শান্তি বলল, ‘ফণী মনসা ঝোপের পাশে৷ জায়গাটাকে লোকে বলে ফণী মনসাতলা৷ পাকাপাকি ভাবে যাতে এখেনে ঘটটা থাকে, সেই কারণেই অশ্বত্থ গাছের গায়ে এই জায়গাটা বেছে নিয়েছি৷ সরকারের খাস জমি৷ পরে মন্দির করলে কেউ আপত্তি করবে না৷’

মুখের রেখা সরল হল তরিতার৷ নাহ, শান্তি মেয়েটার বুদ্ধি আছে৷ অনেকদূর পর্যন্ত ভেবে রেখেছে৷ তরিতা তাকিয়ে দেখলেন, মাটি আর খড় দিয়ে তৈরি বেদির উপর ঘট পাতা রয়েছে৷ নানা রং আর রাংতা দিয়ে বেদিটা সাজানো৷ তার পাশেই ছোট্ট একটা উনুন৷ দেখে সন্তুষ্ট হলেন তরিতা৷ বেদিতে ফুল আর সিজ ডালও আছে৷ তা দেখে, পরের যে কথাটা মনে এল, তরিতা বলে ফেললেন, ‘পুজো হয়ে গেছে?’

‘সেই দুপুরবেলায়৷ পুরুতমশাই অনেকক্ষণ ওয়েট করলেন আপনার জন্য৷ কিন্তু, রিসর্টে গিয়ে শুনলাম, আপনি আর নেত্রা ম্যাডাম ভোরবেলায় নাকি পাখিরালায় গিয়েছেন৷ কখন ফিরবেন কেউ জানে না৷ কাল সন্ধেবেলায় যখন দেখা হল, তখনও আপনি কিছু বলেননি৷ তাই ভাবলাম, নিশ্চয়ই কোনও জরুরি কাজে গিয়েছেন৷ তাই পুরুতমশাই পুজো শুরু করে দিলেন৷ আশপাশের গ্রাম থেকেও অনেক লোক এসেছিল ম্যাডাম৷ পুজোর পর সবাইকে খিচুড়ি খাইয়ে দিয়েছি৷’

‘ভাল করেছিস৷ আমরা ফিরেছি বেলা চারটেয়৷ যাক গে, এখন বল, পালা দেখার জন্য লোকজন কি আরও আসবে? কী মনে হয় তোর?’

‘আরও লোক হবে ম্যাডাম৷ এই যাদের তিরপলের উপর বসা দেখছেন, এরা হল গাঁয়ের গরিবগুর্বো মানুষ৷ এর পরই গাঁয়ের মুরুবিবরা আসবেন৷ প্লাস, রিসর্টের টুরিস্টরা৷ তাদের জন্য আমি গোটা পঞ্চাশেক চেয়ারের ব্যবস্থা করে রেখেছি৷ এইবার চেয়ারগুলো পেতে দেব৷ আগে পেতে দিলে, চেয়ারগুলো দখল হয়ে যেত৷ গাঁয়ের দিকে রাত না হলে পালাগানের আসর ঠিক জমে না৷ তবে, আপনি যদি বলেন, তা হলে এক্ষুখি শুরু করে দিতে পারি৷’

‘না, না৷ তার দরকার নেই৷ আমি চাই, গাঁয়ের মুরুবিবরা আসুন৷ রিসর্টে যাঁরা আছেন, আগে তাঁদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর তুই৷ পাখিরালা থেকে অ্যান্টনি গোমস বলে একজন আমাদের সঙ্গে এসেছেন৷ আমার উল্টোদিকে এসি রুমে তিনি আছেন৷ দেখিস, তিনি যেন পালাগানে আসেন৷’

‘আমি এখনই লোক পাঠাচ্ছি দিদিমণি৷’

‘আর শোন, খোঁজ কর তো শোভা কেন আসেনি?’

‘মনে হয়, ওর শউর-শাউরি বোধহয় আটকে দিয়েছে৷ দাঁড়ান, শোভার বাড়ি খুব কাছেই৷ ওর বাড়িতে চাঁপাকে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি৷’ কথাগুলো শেষ হতে না হতেই ফের শান্তি বলল, ‘ওই তো শোভা এসে গেছে৷ নেত্রা ম্যাডাম ওর সঙ্গে কথা বলছেন৷ এখন আমি যাই ম্যাডাম? শুনলাম, হারাধন পালাকার নাকি টাকাপয়সা নিতে চাইছেন না৷ জোর করে ওকে টাকা গছাতে হবে৷’

শুনে মনে মনে হাসলেন তরিতা৷ দিনকয়েক আগে পালাগানের ব্যাপারে নেত্রা যখন হারাধন পালাকারের সঙ্গে কথা বলে, তখন ভদ্রলোক প্রথমেই জানতে চেয়েছিলেন, এটা সুন্দরবন টাইগার ক্যাম্পের প্রোগ্রাম কিনা? রিসর্টের প্রোগ্রাম হলে রেট বেশি৷ লোকটা দরদাম করছিল৷ শুনে নেত্রা খুব রেগে বলেছিল, ‘যান মশাই, আপনাকে করতে হবে না৷ তবে একটা কথা শুনে রাখুন, মা মনসার পালা৷ মা মনসা কূপিত হলে আপনি বাঁচবেন না৷ আপনাকেই কিন্তু, যেচে আমাদের কাছে আসতে হবে৷’ ঠিক দু’দিন পরে ভদ্রলোক যেচে নেত্রাকে ফোন করে জানান, টাকাপয়সার দরকার নেই৷ শুধু যাতায়াতের খরচ দিলেই উনি প্রোগ্রামটা করে দেবেন৷ মত বদলের কারণটা কী? পরশু রাতে নাকি উনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন৷ ঘুমনোর জন্য মশারিতে ঢোকার পর দেখেন, বালিশের পাশে গুটিয়ে রয়েছে কালাচ সাপ৷

রিসর্টের ট্যুরিস্টরা একে একে আসতে শুরু করেছেন৷ দূর থেকে তরিতা দেখতে পেলেন, তাঁদের মধ্যে অ্যান্টনি গোমসও আছেন৷ শান্তি তদারকি করছে৷ মেয়েটা বেশ করিতকর্মা৷ পালাগানের আয়োজনটা ও খুব খারাপ করেনি৷ পরে ওকে আরও বড় দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে৷ প্লাস্টিকের চেয়ারগুলো একে একে পাতা হচ্ছে৷ কাছে এসে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে শান্তি বলল, ‘এখানে বসুন ম্যাডাম৷ এখান থেকে পালাগান ভাল শুনতে পাবেন৷’

চেয়ারে বসে তরিতা বললেন, ‘শোন, তুই কিন্তু মিঃ গোমসের কাছাকাছি থাকিস, কেমন? ভদ্রলোক একটু বেখেয়ালে৷ রিসর্টে যদি তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে চান, তুই পৌঁছে দিবি৷’

আজ সকালে এই মিঃ গোমসের সঙ্গেই দেখা করার জন্য নেত্রাকে নিয়ে তরিতা পাখিরালার একটা রিসর্টে গিয়েছিলেন৷ রিসর্টের নাম সলিটারি ন্যুক৷ ভদ্রলোক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান৷ তবে, কয়েক পুরুষ ধরে কলকাতার বাসিন্দা৷ আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই চলে গিয়েছেন মেলবোর্নে৷ কিন্তু, গোমস আর ওঁর বাঙালি স্ত্রী অ্যানি… অনীতা সেখানে যাননি৷ গোমস বলতে গেলে এখন পুরোপুরি বাঙালি৷ ভদ্রলোক চাকরি করতেন বেঙ্গল কেমিক্যালসে৷ যারা একটা সময় অ্যান্টি স্নেক ভেনম সিরাম তৈরি করত৷ বেঙ্গল কেমিক্যালস এখন আর ওই সিরাম তৈরি করে না৷ চাকরি ছেড়ে দিয়ে গোমস তাই এতদিন রিসার্চ করছিলেন৷ তরিতা ওঁর সন্ধান পান এডবেরির কাছ থেকে৷ আলাপ করার উদ্দেশ্য, সুন্দরবনে তিনি যে অ্যান্টি ভেনম সিরাম ফ্যাক্টরি করতে চান, তার পুরো দায়িত্ব গোমসের হাতে তুলে দেওয়া৷ রিসার্চে ভদ্রলোক নাকি এমন একটা সিরাম আবিষ্কার করেছেন, যা বিশ্বের… যে কোনও প্রান্তে যত বিষধর সাপই হোক না কেন…তার দংশন থেকে মানুষ আর পশুদের বাঁচিয়ে দেবে৷ তরিতা শুনেছেন, সেই সিরামের কেউ পেটেন্ট নেননি৷

দু’দিন আগে গোমস পাখিরালার ওই রিসর্টে একা বেড়াতে এসেছেন৷ কেউ হয়তো বলেছে, সজনেখালির ওয়াচ টাওয়ারে বসে থাকলে বাঘ দেখা যায়৷ এডবেরির সঙ্গে কাল রাতে চ্যাট করার সময় খবরটা পেয়েই তরিতা… সময় নষ্ট না করে ভোরবেলায় নদী পেরিয়ে ছুটে যান পাখিরালা৷ এই রকম একজন সায়েন্টিস্টকে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার৷ বাঘ দেখানোর টোপ দিয়ে ভদ্রলোককে আটকে রাখা যাবে সুন্দরবনে৷ প্রথম সাক্ষাতেই তরিতা বুঝে গিয়েছেন, ভদ্রলোক একটু পাগলাটে টাইপের৷ বৈষয়িক বুদ্ধি তেমন নেই৷ চিরজীবন চাকরি করেছেন৷ নিজের দাম সম্পর্কে কোনও আন্দাজও নেই৷ ফ্লোরিডার সার্পেন্টেরিয়াম যদি গোমসের মতো লোক পেত, তা হলে লুফে নিত৷ দুর্ভাগ্য বাংলার, এমন একটা লোককে কাজে লাগাতে পারল না৷ লাঞ্চ টেবলে ওঁর সঙ্গে একপ্রস্থ কথা বলেছেন তরিতা৷ তার পর আরও কথা বলার জন্য, গোমসকে তিনি নিয়ে এসেছেন দয়াপুর টাইগার ক্যাম্পে৷ চোখের সামনে রেখে খাতিরদারি করার জন্য তো বটেই, সেইসঙ্গে পটানোর জন্যও৷

বাজনদাররা বাজনা থামিয়ে দিয়েছে৷ হারাধন পালাকারকে ডেকে চৌকিতে তুলছে শান্তি৷ এমন সময় নেত্রা পাশ থেকে বলল, ‘শোভাকে ধরে নিয়ে এলাম দিদি৷ তুমি কথা বলো৷’

ঘুরে তাকালেন তরিতা৷ অভিজ্ঞ চোখে বুঝতে পারলেন, মেয়েটা গুরুতর কোনও সমস্যায় পড়েছে৷ মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছে৷ অন্যদিন শোভাকে পরিপাটি অবস্থায় দেখেন৷ আজ চুল বাঁধেনি, খুব সস্তার একটা শাড়ি পরেই বেরিয়ে এসেছে৷ হ্যাজাকের স্বল্প আলোতেও তরিতা দেখলেন, শোভার চোখ ছলছল করছে৷ নরম গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে, পাত্তা নেই কেন তোর?’

প্রশ্নটা শুনেই চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল বেরিয়ে এল শোভার৷ ঠোঁট কাঁপতে লাগল৷ তরিতা স্পষ্টই বুঝতে পারলেন, কিছু বলতে চাইছে শোভা৷ অথচ দ্বিধা করছে৷ ফের তিনি বললেন, ‘কী হয়েছে তোর? আমায় খুলে বল৷ ভয় পাস না৷’

‘আমার খুব বিপদ ম্যাডাম৷ পরশু অনন্ত ফোন করেছিল চেন্নাই থেকে৷ আমায় খুব গাল দিল৷ বলল, তুই নাকি মনসা পালা লিখছিস? কে বলেছে, তোকে লিখতে?’

‘খবরটা ও পেল কী করে?’

‘শউরমশাই বলে দিয়েছে৷ বোধহয় গায়েনের দোকানে অনন্ত আগে ফোন করেছিল৷’

‘অনন্তকে তুই কি বললি?’

‘সত্যি কথাটাই বললাম৷ তখন ও মা মনসার নামে যা তা বলতে লাগল৷ আমি বললাম, এ সব কথা আর মুখে এনো না৷ তোমার খুব বিপদ হবে৷ ও শুনলই না৷ তেড়ে গালাগাল দিতে লাগল৷ আমায় শাসাল, দাঁড়া পরশু আমি দয়াপুরে পৌঁছচ্ছি৷ তোর হাত দুটো আমি ভেঙে দেব৷’

‘আর তাতেই তুই ভয় পেয়ে গেলি…’

 ‘না, সে কারণে নয় ম্যাডাম৷ আজ সকালে হাওড়া স্টেশন থেকে ফের অনন্ত ফোন করেছিল৷ কী বলল, জানেন?’

শুনতে শুনতে তরিতার মুখ কঠিন হচ্ছিল৷ নিঃশ্বাস চেপে তিনি বললেন, ‘কী বলল?’

‘ট্রেনে ওর সর্বস্ব চুরি হয়ে গিয়েছে৷ মাসচারেক ধরে যা রোজগার করেছিল, সব গেছে৷ বাড়ি ফেরার পয়সা পর্যন্ত ওর পকেটে নেই৷ আমাদের কী হবে ম্যাডাম? সংসার চালাব কী করে, ভেবে আমার গা হিম হয়ে যাচ্ছে৷ ভিন গাঁয়ে গিয়ে আমাকে এখন খেতমজুরের কাজ করতে হবে৷’

‘তোকে তো আমি আগেই বলেছিলাম, মা মনসার পুজোয় বাধা দিলে অনন্তর খুব বিপদ হবে৷ দয়াপুরে ও আসুক, তোর গায়ে যদি হাত দেয়, তা হলে আরও বড় বিপদ ওর জন্য অপেক্ষা করছে৷ তোকে এও বলে রাখছি, তুই দুর্গাদির মেয়ে৷ আমারও মেয়ের মতো৷ তোর যাতে খারাপ না হয়, আমি দেখব৷’

দু’হাতে মুখ খেকে শোভা ফোঁপাতে লাগল৷ এ দিকে, হারাধন পালাকার মনসা বন্দনা শুরু করেছেন৷ তরিতা কোমল গলায় বললেন, ‘কাঁদিস না শোভা৷ মা মনসাকে মন দিয়ে ডাক৷ উনিই তোকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন৷ অনন্ত যা-ই বলুক, কাল থেকে রোজ এই মনসাতলায় এসে মনসার ঘটে তুই পুজো করে যাবি৷ দেখবি, সব ঠিক হয়ে যাবে৷’

কথাগুলো বলেই তরিতা পালায় মন দিলেন৷ চৌকিতে দাঁড়িয়ে সুরেলা কণ্ঠে হারাধন পালাকার মনসা বন্দনা শুরু করেছেন৷

‘উরগো মনসা মাতা**** ত্রিজগতধাত্রী ধাতা**** যোগ-জাপ্য যোগীর নন্দিনী৷

উৎপত্তি পাতালপুরী**** বিশ্বমাতা বিষহরি****সুদ শুক্ল নির্মল ধারিণী৷

সর্বঘটে আছ তুমি****ক্ষিতিক্ষেত্র দারুভূমি****অচল অস্থির তরুলতা৷

মনসা মনের মাঝে****সকল দেবতা পুজে****মনসা মনের জানে কথা৷’

 …‘ভুজঙ্গ আসনে বসি****মুখে মন্দ মৃদুহাসি****আনন্দে আমোদ অবিরত৷

একমনে একভাবে****যে তোমার পদ সেবে****বর দেহ তার মনোমতো৷

সহিবে সকল ভার****তোমা বিনা কেবা আর****অবধি অশেষ মায়া জানে৷

সৃজন পালন হরি****ছলিবারে ত্রিপুরারি****জনমিলা পাতাল ভুবনে৷’

‘মা মনসার জনম বেত্তান্ত শুনেন গো মা ঠাকুরণরা৷’ গান ছেড়ে এ বার সরল গদ্যে পালা শোনাতে লাগলেন হারাধন৷ ‘কালীদ’য়ে একবার ফুল তুলতে গে শিবঠাকুর মদন পীড়িত হলেন৷ ঠাকুরের বীর্যপাত হয়ে গেল৷ সেই বীর্যের এমন তেজ, যত্রতত্র পড়লে আগুন লেগে যাবে৷ শিবঠাকুর ত্যাখন হাতের তালুতে নিয়ে সেই বীর্য এক পদ্মপাতায় রেখে দিলেন৷ অদূরে এক তৃষ্ণার্ত পক্ষিণী বসে ছিল৷ সে ভুল করে জলের সঙ্গে সেই বীর্য পান করে ফেলল৷ তেজময় বীর্য পেটে রাখতে না পেরে পক্ষিণী একটা সময় পদ্মপাতায় বমি করে দিল৷ মৃণাল দিয়ে তা পাতালে পৌঁছে… গিয়ে পড়ল নাগরাজ বাসুকির মাতা নির্মাণীর মাথায়৷ তিনি সেই বীর্য দিয়ে পুতুল বানালেন৷ তাকে প্রাণ দিলেন৷ নাম রাখলেন পদ্মা৷ মা ঠাকুরণ গ, পদ্মপাতায় জন্ম হয়েছিল বলে তাঁর নাম হল পদ্মা… পদ্মাবতী৷ পদ্মাকে জন্ম নিতে দেখে স্বর্গের দ্যাবতারা ধন্য ধন্য করে উঠলেন৷ শিব ঠাকুরের ঔরসে মেয়ে৷ পদ্মা কিন্তু, মায়ের কোল পেলেন না৷ তাঁর ভাই-বোনদের সঙ্গে থাকারও সুযোগ পেলেন না৷ একটু বড় হতেইপাতাল থেকে উঠে এলেন কালীদ’য়ের ফুলবনে৷ কী দুঃখের কথা মা ঠাকুরণ গ, কী দুঃখের কথা!’

ফের সুর করে গাইতে লাগলেন হারাধন পালাকার৷

‘জনম পাতালপুরী অযোনিসম্ভবা৷

নির্মাখী জননী মহাদেব তেজসভবা৷৷

আপনা-আপনি কৈলা জীবের সঞ্চার৷

বাসুকি দিলেন বিষ নাগ-অধিকার৷৷’

‘বলেন গ, মা ঠাকুরখরা, আপনারাই বলেন, শিবঠাকুর কি ন্যায্য বিচার কইরলেন মা পদ্মাবতীর সঙ্গে? মা চণ্ডীর কোলে পিঠে সুখে মানুষ হলেন তাঁর ভাই-বোনেরা৷ গণেশ, কার্তিক, লক্ষী আর সরস্বতী৷ জন্মসূত্রেই তাঁরা দ্যাবতা৷ আর মা পদ্মাবতী? পাতালরাজ বাসুকির পালিতা বোন হিসেবেই একা একা বেড়ে উঠতে লাগলেন কালীদ’য়ের পদ্মবনে৷ শুনবেন তাঁর সঙ্গীসাথী কারা… চিরনিয়া, নাইনাড়া, উদয়কাল, সিন্দুরিয়া, উদয়গিরি, ধুসরিয়া, কুইয়া, কালচিতে আর কালনাগিনী, কনকচিতি আর কুণ্ডলিয়া নামের সাপেরা৷ এ তো শিবঠাকুরের অন্যায় গ, ঘোরতর অন্যায়৷’

হারাধন পালাকারের কথকতা শুনতে শুনতে চমকে উঠলেন তরিতা৷ প্রত্যন্ত এই গাঁয়ে ধর্মভীরু এই অশিক্ষিত মানুষগুলোর সামনে শিবঠাকুরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন উনি! ভয়ডর নেই? নারীলালসায় জন্ম দিয়ে শিবঠাকুর যদি মা মনসার প্রতি অন্যায় করে থাকেন, তা হলে তাঁর প্রতিও অন্যায় করেছেন জন্মদাতা পিতা৷ গর্ভধারিণী মায়ের কোল থেকে তাঁকে কেড়ে নিয়ে উনি পরিত্যাগ করেছিলেন গভীর এক জঙ্গলে৷ কথাগুলো মনে পড়লেই তরিতার বুক জ্বালা জ্বালা করে৷ সমস্ত জগৎ সংসারের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন৷ বুঝতে পারেন, তাঁর মধ্যে এক শঠ, ক্রুর, প্রতিহিংসাপরায়ণা নারী লুকিয়ে বসে আছেন৷ নিজের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য তিনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন৷ দরকার হলে তাঁর জন্মদাতা পিতাকেও তিনি চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন৷

… কালীদ’য়ে শিব ফুল তুলতে গিয়েছেন৷ যুবতী পদ্মাবতীকে দেখে তিনি কামমোহিত হয়ে পড়েছেন৷ পদ্মা যে তাঁর নিজের মেয়ে, সেটা শিব জানেন না৷ মনসা তাঁর ভুল ভাঙিয়ে দিচ্ছেন৷ পালায় সেই পর্বই শোনাচ্ছেন হারাধন পালাকার৷ এমন সময় নেত্রা কাছে এসে চোখের ইশারা করল৷ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন তরিতা৷ একটু দূরে নিয়ে গিয়ে নেত্রা বলল, ‘কঙ্কণদীঘি থেকে এইমাত্র ফোন পেলাম দিদি৷’

শুনে ভ্রু কুঁচকে উঠল তরিতার৷ সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘চন্দ্রভানুর নাতিটা মরেছে কি না বল৷’

‘না দিদি৷ কপালজোরে বেঁচে গিয়েছে৷’

‘কে বাঁচাল? কার এমন দুর্মতি হল?’

‘পিয়ারা গ্রামের একটা ছেলে৷ তোমার মতোই হারপেটোলজিস্ট৷ সঙ্গেসঙ্গে সে নাকি বাচ্চাটাকে অ্যান্টি ভেনম সিরাম দিয়েছিল৷ শুনলাম, চন্দ্রভানুর নাতি আজ নার্সিং হোম থেকে বাড়ি ফিরে গিয়েছে৷’

‘ছেলেটাকে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা কর৷ শিগগির৷’ কথাটা বলার সময় নাকের পাটা ফুলে উঠল তরিতার৷ তপ্ত শ্বাস পড়তে লাগল৷ দাঁতে দাঁত ঘসতে লাগলেন তিনি৷

(তেরো)

বড় ছেলে জয়গোপাল বিকাল থেকেই কী যেন বলার চেষ্টা করছে৷ তা শোনার মতো আগ্রহ দেখাচ্ছেন না চন্দ্রভানু৷ বড়নাতি জয়জিৎকে খুশি করায় তিনি এখন ব্যস্ত৷ চন্দ্রভানু জানেন, তাঁর ছেলেরা সবাই খুব বাধ্য৷ যতক্ষণ না তিনি নিজে শুনতে চাইবেন, ততক্ষণ তাঁরা মুখে কুলুপ এঁটে থাকবে৷ বাবাকে তাঁরা এমন ভয় আর শ্রদ্ধা করে৷

চড়কের সন্ধেয় গাজনতলায় বসে রয়েছেন চন্দ্রভানু৷ তাঁর পাশের চেয়ারে জয়জিৎ৷ পিছনের সারিতে সনকা বসে বড় বউমা জয়িতাকে নিয়ে৷ ছোট বউমা অহল্যাকেও কলকাতা থেকে আসতে বলা হয়েছিল৷ কিন্তু সে নাকি তাঁর নিজের ব্যবসা নিয়ে এমন ব্যস্ত, কঙ্কণদীঘিতে আসার সময় পায়নি৷ কলকাতায় অহল্যা একটা ফুড চেন চালায়৷ ইদানীং কেটারিংয়ের ব্যাবসাও খুলেছে৷ স্বাধীনচেতা মেয়ে৷ দিল্লিতে বড় হয়েছে৷ ওর লাইফ স্টাইলটাই আলাদা৷ অহল্যাকে পারতপক্ষে এড়িয়ে চলেন চন্দ্রভানু৷ তবে পুরোপুরি অবজ্ঞাও করতে পারেন না৷ মেয়েটা তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ধরে৷ সাংসারিক ব্যাপারে তো বটেই, ব্যবসার ক্ষেত্রেও কখনও কখনও খাঁটি পরামর্শ দেয়৷

 নার্সিং হোম থেকে নিয়ে আসার পর এই প্রথম নাতিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছেন চন্দ্রভানু৷ কঙ্কণদীঘির বিলের মাঠে বিরাট মেলা বসে গিয়েছে৷ প্রচুর লোকের ভিড়৷ গাজনতলায় বিরাট একটা জিউলে গাছের নীচে লোহার রেলিঙ ঘেরা উঁচু বেদি৷ তার ভিতরে রয়েছে মাটির শিব-পার্বতীর মূর্তি৷ কেউ মানত করছেন গাছের ডালে লালপাড় শাড়ি বেঁধে দিয়ে৷ কেউ নিয়ে এসেছেন গামছা, বা সুতো৷ যাঁর যেমন সামর্থ্য৷ বেদির নীচ থেকে চন্দ্রভানু দেখছেন পুণ্যার্থীদের৷ পুরুতমশাই গলদঘর্ম, ভক্তদের আবদার মেটাতে গিয়ে৷ পুজো দেওয়ার পর বেদির উপর থেকে তিনি ছুড়ে দিচ্ছেন বাতাসা৷ সেই প্রসাদ নীচে ধুলোর মাঝখান থেকে হুড়োহুড়ি করে তুলে নিচ্ছেন ভক্তরা৷ তার পর ভক্তিভরে মাথায় ঠেকিয়ে মুখে পুরছেন৷ দেখে জয়জিৎ অবাক হয়ে একবার বলে ফেলেছিল, ‘এরা ধুলোমাখা বাতাসাগুলো খাচ্ছে কেন দাদান? শরীর খারাপ করবে না?’

কলকাতায় ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলে৷ ওর মনে প্রশ্নটা তো জাগবেই৷ চন্দ্রভানু বোঝানোর ভঙ্গিতে ওকে বললেন, ‘এ কথা বলে না৷ ঠাকুরের প্রসাদ, বিশ্বাস করে খেলে… কিছু হয় না৷’

কথাটা নাতির মনঃপূত হল বলে চন্দ্রভানুর মনে হল না৷ শিকড়ের টান না থাকলে যা হয়৷ শিবের মহিমা টের পাবে কী করে? সুন্দরবন হল গিয়ে শিবের দেশ৷ হিঙ্গলগঞ্জ থেকে জয়নগর— সর্বত্র প্রচুর শিবমন্দির৷ গাজনের সময় বোঝা যায়, সুন্দরবনের কত স্বল্পশিক্ষিত ও গরিব মানুষ শিবের ভক্ত৷ জয়জিৎকে হয়তো কেউ বলেনি, চৈত্র মাস হল শিব আর গৌরীর বিয়ের মাস৷ শিব বিয়ে করতে গিয়েছিলেন সন্ন্যাসীদের সঙ্গে নিয়ে৷ এই চৈত্র মাসে শিবের ব্রত নিয়ে ভক্তরা তাই সন্ন্যাস গ্রহণ করে৷ ভোলেবাবার নাম নিয়ে গ্রামে গ্রামে তারা ভিক্ষে করে বেড়ায়৷ হবিষান্ন গ্রহণ করে৷ এই যে এত শারীরিক কৃচ্ছ্রসাধন করে, তার পিছনে অবশ্য একটা প্রত্যাশা থাকে৷

যক্ষা, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি… এই সব রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া৷ সন্ন্যাস নিয়ে ভক্তরা সেরেও উঠেন৷ জয়জিৎকে তিনি বিশ্বাস করাবেন কী করে? চন্দ্রভানু নিজের চোখে দেখেছেন শিবের সেই মহিমা৷

এ বারের গাজনে মূল সন্ন্যাসী দামোদর বিন্দে৷ মৎসজীবী, বেশ বলশালী মানুষ৷ চন্দ্রভানুর ট্রলারেই মাছ ধরতে যায় সমুদ্রে৷ কঙ্কণদীঘির পরিচিত মুখ৷ খুব নিষ্ঠাভরে সন্ন্যাস পালন করে৷ কাল দামোদর ভিক্ষে চাইতে এসেছিল বাড়িতে৷ হয়তো তখনই কথায় কথায় জয়জিতের কাছে চড়কের গল্প করেছিল৷ তার পর থেকে ছেলেটা জিদ ধরেছে, চড়কের সময় গাজনতলায় আসবে৷ সদ্য অসুখ থেকে উঠেছে, তাই চন্দ্রভানু ওকে নিয়ে আসতে চাননি৷ কিন্তু, দামোদরই তখন বলে, ‘না করবেন না বড়বাবু৷ নিজের চোখে গাজন-চড়ক না দেখলে শিবমাহাত্ম্যে খোকাবাবুদের বিশ্বেস হবে কী করে?’

ওই একটি কথাতেই চোখ খুলে গিয়েছিল চন্দ্রভানুর৷ জয়জিৎকে তাই মেলায় নিয়ে এসেছেন৷ একটু আগে চড়কের অনুষ্ঠান দেখে অবাক হয়ে গিয়েছে জয়জিৎ৷ ওকে বলতে হয়েছে, কীভাবে চড়কগাছ খুঁজে আনতে হয়৷ কেন চড়ক গাছ আর চড়ক গাছের ঢাকুই কিছু দিন আগে থেকে আলাদা আলাদা পুকুরে চুবিয়ে রাখতে হয়৷ চড়ক সন্ন্যাসীরা যখন শূন্যে ঢাকুই বসানো চড়ক গাছের চারদিকে বৃত্তাকারে ঘোরে, তখন কেন পড়ে যায় না? ঝাঁপান বা হাট সন্ন্যাস কী, বাণফোঁড়ই কাকে বলে? শরীরের চামড়া ভেদ করে লোহার শলা ঢুকিয়ে রাখা সন্ন্যাসীদের দেখেও জয়জিৎ চমকে গিয়েছিল৷

চন্দ্রভানু বৃষকাষ্ঠ খোঁজার গল্পও নাতিকে শুনিয়েছেন৷ গত পরশু ভোরবেলায় সঙের মিছিল এসে দাঁড়িয়েছিল বাড়ির সামনে৷ শিব-পার্বতী, লক্ষী-নারায়ণ, রামচন্দ্র-সীতা, হনুমান, আরও সব পরিচিত দেব-দেবীর সাজে সঙ৷ মেলা লোক হয়েছিল সঙদের গ্রাম পরিক্রমার সময়৷ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে জয়জিৎ এসব কখনও দেখেনি৷ ঢাক-ঢোলের শব্দ আর মুহুর্মুহু শিবের নামে জয়ধ্বনি শুনে অবাক হয়ে ও জিজ্ঞেস করেছিল, এই দেবদেবী সাজার কারণটা কী? চন্দ্রভানু তখন বলেন, ‘বৃষকাষ্ঠের ছাই মেখে ওদের দেবদেবী সাজতে হয়৷ এটা গাজনের একটা অঙ্গ দাদুভাই৷’

‘বিষকাষ্ঠ কী দাদু?’

‘বিষকাষ্ঠ নয় দাদুভাই, বৃষকাষ্ঠ৷’ সঠিক উচ্চারণ শিখিয়ে চন্দ্রকান্ত তার পর বলেছিলেন, ‘বড়লোকদের কেউ মারা গেলে তারা বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ করে৷ সেই শ্রাদ্ধের কাঠ গাঁয়ের নানা জায়গায় পড়ে থাকে৷ মাঠ-ঘাটে, রাস্তায়, পুকুরপারে, শ্মশানে৷ অনেক কষ্ট করে গাজনের সন্ন্যাসীরা ওই কাঠ খুঁজে এনে গাজনতলায় পুঁতে দেয়৷ তার পর মাথার দিকটায় আগুন ধরায়৷ সেই আগুন জ্বলতে থাকে পয়লা বোশেখ পর্যন্ত৷ বৃষকাষ্ঠের পোড়া ছাই সন্ন্যাসীরা খুব পবিত্র বলে মনে করে৷ পাগলা-ভোলা শিবের অনুকরণে সেই ছাই সন্ন্যাসীরা গায়ে মাখে৷’

হঠাৎ জয়জিৎ জিজ্ঞেস করছিল, ‘দাদান, তুমি আর দিদান কখনও সন্ন্যাসী হয়েছ?’

চন্দ্রভানু ইতিবাচক ঘাড় নেড়েছিলেন৷ বড়নাতি কঠিন সেই দিনগুলোর স্মৃতি উসকে দিয়েছিল৷ ডুবডুবি গাঁয়ে তখন মাটির বাড়িতে থাকতেন চন্দ্রভানু৷ তিনি তিওর বা বাগদি নন৷ তবুও, তখন মহাজনের নৌকো নিয়ে প্রতিবেশী মন্টু, কাঙালিচরণ, অনাদি আর মঙ্গলদের সঙ্গে তিনি মাছ ধরতে যেতেন৷ স্রেফ পেটের তাগিদে৷ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাটুনি৷ মহাজনকে প্রাপ্য অংশটুকু দিয়ে… বিকেলে কঙ্কণদীঘির খেয়াঘাটে মাছ বিক্রি করে ওঁরা যা পেতেন, তাতে দিন গুজরান হত না৷ সেই সময়কার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল জয়জিৎ৷

এই গাজনের সময় মন্টু ভক্ত্যা মূল সন্ন্যাসী হত৷ চৈত সংক্রান্তির তিনদিন আগে থেকে সবাই মিলে কত কৃচ্ছ্রসাধন আর সংযম!

যুবক বয়সে বারপাঁচেক গাজনের সন্ন্যাসী হয়েছেন চন্দ্রভানু৷ কিন্তু, একবার একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তিনি ব্রত নেওয়া বন্ধ করে দেন৷ নিয়ম হচ্ছে, নীল পুজোর দিন গাঁয়ের বউরা উপোস ভাঙে সন্ন্যাসীদের মাথায় জল ঢেলে৷ সেই নিয়মটা পালন করার জন্য মন্টুর বউ সত্যবতী বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল তাঁকে৷ সত্যবতী তখন সদ্য বিয়ে হয়ে আসা বউ৷ শরীরটা একেবারে টাটকা ফুলের মতো৷ গায়ে-মাথায় জল ঢেলে গা মুছিয়ে দিচ্ছিল সত্যবতী৷ সেই সময় ওর নাভি, পাতলা কোমর আর ভরা স্তন দেখে তীব্র কামভাব জাগে চন্দ্রভানুর৷ সন্ন্যাসীদের অসংযমী হতে নেই৷ তাতে পাপ হয়৷ সেবার সংক্রান্তির দিন হাতেনাতে ফলও পান চন্দ্রভানু৷ রাতে বাবার মাথায় যখন তিনি ফুল চড়ান, তখন সেই ফুল আপনাআপনি আর পড়েনি৷ গাঁয়ে সবাই বুঝতে পেরেছিল, তিনি অসৈরণ কিছু করেছেন৷

তাতে অবশ্য সত্যবতী সম্পর্কে তাঁর মনোভাব বদলায়নি৷ মহেশ্বরজির কৃপাদৃষ্টি পাওয়ার পর, তাঁর হাতে যখন টাকাপয়সা আসতে শুরু করল, সেইসময় সত্যবতীকে যথেচ্ছ ভোগ করেছেন তিনি৷ মন্টুকে ট্রলারে মাছ ধরতে পাঠিয়ে দিতেন৷ আর সত্যবতীর নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য রাতে তিনি নিজে হাজির হতেন মন্টুর বাড়িতে৷ সনকা সবই বুঝতে পারত৷ কিন্তু, মুখে কখনও কিছু বলেনি৷ বিবাহিত জীবনের প্রথম দশ বছরে দুটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়ে যৌনজীবন সম্পর্কে হয়তো সনকা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল৷ দুই পরিবারের সম্পর্ক নষ্ট হোক, সনকা কখনও চায়নি৷ বিলের মাঠে এই গাজনের মেলায় প্রতিবার ওঁরা হাজির হতেন৷ গতবারও সত্যবতী আর মন্টু সঙ্গে এসেছিল৷ এবার সনকা মেলায় এসেছে৷ কিন্তু, সত্যবতী নেই৷ কথাটা ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন চন্দ্রভানু৷

বিলের ধারে নানা ধরনের দোকান বসেছে৷ আশপাশ থেকে গরম জিলিপি ভাজার গন্ধ ভেসে আসছে৷ জয়জিৎ হঠাৎ আবদার ধরল, জিলিপি খাবে৷ ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে মেলা দেখতে এসে… ঠিক এই জিদটা ধরেই বাবার হাতে চড় খেয়েছিলেন চন্দ্রভানু৷ পাঁচ নয়াপয়সায় দুটো জিলিপি৷ তখন বোঝেননি, সেটুকু খরচা করার সামর্থ্যও ছিল না খেতমজুর বাবার৷ কথাটা মনে পড়তেই চন্দ্রভানু সিদ্ধান্ত নিলেন, নাতির কোনও আবদারই তিনি অপূর্ণ রাখবেন না৷ দয়াশঙ্করকে ডেকে তিনি বললেন, ‘যা, ওকে জিলিপির দোকানে নিয়ে যা৷ দোকানিকে আমার নাম করে বলবি, যাতে ভাল করে ভেজে দেয়৷’

 দয়াশঙ্করের হাত ধরে জয়জিৎ মেলার ভিড়ে হারিয়ে গেল৷ চেয়ার ছেড়ে চন্দ্রভানু উঠে দাঁড়ালেন৷ মেলার দোকানপাটের উল্টো দিকে কাঁচা রাস্তা চলে গিয়েছে বিলের দিকে৷ পূজার অঙ্গন থেকে সেদিকে তাকিয়ে চন্দ্রভানু দেখলেন, বিলের কালো জল তিরতির করছে৷ বিলের জলে একদিকে দোকানপাটের আলোর প্রতিচ্ছবি৷ অন্যদিকে, ঘন অন্ধকার৷ কোলাহল থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্য চন্দ্রভানু বিলের দিকে হাঁটতে লাগলেন৷ সেই শিবরাত্তিরের পর থেকে তিনটে সপ্তাহ তিনি কঙ্কণদীঘিতে পড়ে রয়েছেন৷ চর্তুদিকে বিশাল ব্যবসার চরম ব্যস্ততা থেকে খানিকটা দম নেওয়ার জন্যই তিনি বছরের এই ক’টা দিন বিশ্রাম নেওয়ার মতো করে সময় কাটান৷ যাতে বাকি এগারো মাস নতুন উদ্যমে খাটতে পারেন৷

ঠিক আছে, গাজনের দু’দিন পরেই তিনি চলে যাবেন দিল্লিতে৷ বেলজিয়াম আর ফ্লান্সে বাগদা চিংড়ি আর ব্যাঙ রপ্তানীর ব্যাপারে কথা বলতে৷ তা ছাড়া, আরও একটা কারণও আছে৷ কমার্স মিনিস্ট্রি থেকে অমিতকুমার শ্রীবাস্তব তাঁকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন কলকাতার অফিসে৷ দিল্লিতে তিনি কথা বলতে চান বাগদা চিংড়ি সংক্রান্ত কী একটা রিপোর্ট নিয়ে৷ সেই চিঠিটা কলকাতা থেকে আজকালের মধ্যে নিয়ে আসার কথা বড় খোকা জয়গোপালের৷ মাঝে জয়জিৎকে নিয়ে কয়েকটা দিন খুব উৎকণ্ঠার মধ্যে কেটেছে৷ চিঠিটার কথা মনেই ছিল না চন্দ্রভানুর৷ বিলের ধারে দাঁড়িয়ে সেই কথাটা মনে পড়ায় তিনি চঞ্চল হয়ে উঠলেন৷ আরে, জয়গোপাল কি সেই চিঠির কথাই বলতে চায়? হতে পারে৷ রপ্তানীর ব্যবসায় নেমে বরাবর চন্দ্রভানু লক্ষ করেছেন, সময় যখন ভাল যায়, তখন সরকারী অফিসাররা ফোনে ফোনে কথা সেরে নেন৷ কিন্তু, দুঃসময়ের লক্ষণ হল চিঠি৷ যা কোনও নিষেধাজ্ঞার পরোয়ানা৷

চিন্তিত মুখে পঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে চন্দ্রভানু ধরলেন জয়গোপালকে, ‘আমি বিলের ধারে আছি৷ আসতে পারো৷’ সেটটা পকেটে চালান করে দিয়ে চন্দ্রভানু মনে মনে শিবকে স্মরণ করে বললেন, ‘বাবা ভোলানাথ, যেন কোনও খারাপ খবর শুনতে না হয়৷’

কোথাও বিপদের গন্ধ পাচ্ছেন চন্দ্রভানু৷ সত্যবতীর ভয়ানক মৃত্যু, মন্দিরে ময়াল সাপের আবির্ভাব ও উৎপাত, জয়জিৎকে সাপে কামড়ানো… এ সব লক্ষণ ভাল বলে মনে হচ্ছে না৷ কেন জানেন না, তাঁর মনে হচ্ছে, আরও বড় কোনও বিপদ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে৷ মাঝে একদিন বাড়িতে ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন মন্দিরের পুরোহিত জগন্নাথ পণ্ডিতকে৷ বংশানুক্রমে তাঁরা জ্যোতিষী৷ নিজের জন্মকুণ্ডলী দিয়ে চন্দ্রভানু বলেছিলেন, ভবিষ্যদ্বাণী করতে৷ জগন্নাথ পণ্ডিত অনেকক্ষণ ধরে বিচার করে তার পর আশ্চর্য একটা কথা বললেন, কেতু খুব খারাপ পজিশনে আসছে৷ আগামী দিনগুলোতে নাকি প্রবল শত্রুতার মুখোমুখি হতে হবে৷ এমন শত্রুতা যে …ধনদৌলত সবই চলে যেতে পারে৷ চন্দ্রভানু প্রশ্ন করেছিলেন, শত্রুটা কে? উত্তর দেওয়ার আগে চোখ বুজে জগন্নাথ পণ্ডিত তখন ঘামতে শুরু করেছিলেন৷ কিছুতেই বলতে চাননি৷

শেষে ইতস্তত করে বললেন, ‘তোমাকে দৈবীশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হবে চাঁদ৷ তোমার শত্রু হলেন একজন মহিলা৷ তাঁর বয়স মধ্য তিরিশ৷ অসাধারণ সুন্দরী৷ তোমাকে বশ করার জন্য উনি তোমার সঙ্গে যেচে শত্রুতা করবেন৷ আগামী দিনে তোমার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রও হবে৷ তোমাকে বাগে আনতে না পারলে উনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না৷’

কে এই মহিলা, কিসের প্রতিষ্ঠা… চন্দ্রভানু অনেক চিন্তা করেও বুঝে উঠতে পারেননি৷ ভবিষ্যদ্বাণী শুনে ঘাবড়ে যাবেন, এমন দুর্বল চিত্তের মানুষ তিনি নন৷ তবুও, জগন্নাথ পণ্ডিতের কাছে তিনি প্রতিকার জানতে চেয়েছিলেন৷ তখন পণ্ডিতজি বলেছিলেন, ‘স্বয়ং মহেশ্বরজি তোমার সহায়৷ তোমার ভাবনা কী? প্রতিকারের উপায় তিনিই বাতলে দেবেন৷ উনি পাশে থাকলে, কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না৷’ কথাটা শুনে চন্দ্রভানু ঠিকই করে রেখেছেন, দিল্লি রওনা হওয়ার আগে আর্শীবাদ নেওয়ার জন্য একবার তিনি সপরিবারে মহেশ্বরজির কাছে যাবেন৷

‘আপনাকে একটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলার ছিল বাবা৷’

জয়গোপালের গলা শুনে চন্দ্রভানু ঘুরে দাঁড়ালেন৷ সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেটা শোনার জন্যই তোমাকে ডেকে পাঠালাম৷ ’

‘দিল্লি থেকে অমিত শ্রীবাস্তবজি একটা চিঠি পাঠিয়েছেন৷ তাতে লিখেছেন, জাপান থেকে ওঁরা একটা কমপ্লেন পেয়েছেন৷ জাপানিরা নাকি আমাদের পাঠানো চিংড়ি আর ওঁদের দেশে ঢুকতে দেবেন না৷’

এই ধরনের কোনও দুঃসংবাদ আশা করেননি চন্দ্রভানু৷ প্রতিবছর আড়াই লাখ টন চিংড়ি তিনি রপ্তানী করেন জাপানের এক ফিশারিজ কর্পোরেশনে৷ সেই চুক্তির ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন অমিত শ্রীবাস্তব৷ তিন-চার বছর ধরে চিংড়ি চালান করেছেন জাপানে৷ কোনও সমস্যা হয়নি৷ হঠাৎ কী হল, বাগদা নিয়ে প্রশ্ন উঠল? চুক্তি বাতিল হয়ে গেলে প্রচুর টাকা লোকসান দিতে হবে৷ সঙ্গেসঙ্গে জগন্নাথ পণ্ডিতের সতর্কবাণী মনে পড়ল চন্দ্রভানুর৷ শ্বাসরোধ করে তিনি বললেন, ‘কমপ্লেনটা কী?’

‘ওঁরা বলছেন, আমাদের বাগদা চিংড়িতেনাকি অ্যান্টি বায়োটিক রেসিডিউ পাওয়া যাচ্ছে৷ যা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক৷ আমাদের পাঠানো বাগদা চিংড়ির গায়ে হোয়াইট স্পট ওঁরা লক্ষ করেছেন৷ সেটা ওঁরা পছন্দ করছেন না৷’

‘কিন্তু, এতদিন কেন ওঁরা কিছু বলেননি?’

‘আমাদের বিশ্বাস করে মাল নিচ্ছিলেন৷ পরে ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করে ওঁরা জানতে পেরেছেন, আমরা যে বাগদা পাঠাচ্ছি, তাতে মনোডনব্যাকুলা ভাইরাস পাওয়া গিয়েছে৷ তাই ওঁরা আর আমাদের কাছ থেকে বাগদা কিনবেন না৷’

‘আমি বুঝতে পারছি না, আমাদের চিংড়িতে অ্যান্টি বায়েটিক রেসিডিউ পাওয়া যাচ্ছে কেন?’

‘হিঙ্গলগঞ্জের ভেড়িতে হয়তো বেশি পরিমাণ অ্যান্টি বায়োটিক ইউজ করা হয়ে গিয়েছে৷ সেটা ঠিক কিনা, তা এক্সপার্টরাই বলতে পারবেন৷ কালই আমি হিঙ্গলগঞ্জে যাচ্ছি৷ বাবা, আমার মনে হচ্ছে, এটা কন্সপিরেসি৷ আমাদের বাড়বাড়ন্ত হয়তো অনেকের সহ্য হচ্ছে না৷ চিঠিটা পাওয়ার পর ফোনে আমি রামলিঙ্গমের সঙ্গে কথা বলেছি৷ উনি দোষ চাপিয়ে দিলেন অন্যদের উপর৷’

রামলিঙ্গম হলেন এক্সপোর্ট ইউনিটের অ্যাডভাইসর৷ যথেষ্ট অভিজ্ঞ মানুষ৷ তাঁকে বলির পাঁঠা করার চেষ্টা পছন্দ হল না চন্দ্রভানুর৷ বললেন, ‘হেঁয়ালি করো না৷ খুলে বলো৷’

‘রামলিঙ্গমের ধারণা, দোষটা অ্যান্টি বায়োটিক-এর নয়৷ ভাইরাস ছড়িয়েছে মীন থেকে৷ অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আমরা যে মীনগুলো ফ্লাইটে করে নিয়ে এসেছিলাম, তাতেই ভাইরাস ছিল৷ আপনি তো জানেন, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে মীন আনার ইচ্ছে আমার ছিল না৷ আমি লোকালি মীন অথবা পীন কালেক্ট করার কথা বলেছিলাম৷ কিন্তু, তখন রামলিঙ্গম আমার কথা শুনলেনই না৷’

সুন্দরবনের নদী বা খাঁড়িগুলোতে চিংড়ি মাছের মীন অর্থাৎ ছোট্ট বাচ্চা প্রচুর পাওয়া যায়৷ গাঁয়ের বউ-ঝিরা সেসব জল থেকে ছেঁচে তুলে মহাজনের কাছে বিক্রি করে৷ মহাজনরা ডোবায় সেই মীন হপ্তাদুয়েক রেখে বাচ্চাগুলোকে একটু বড় করে তোলে৷ তাকে বলে পীন৷ হিঙ্গলগঞ্জের ভেড়ির জন্য মীন আর পীন… দুটোই কিনতেন চন্দ্রভানুরা৷ ভাইরাস সংক্রমণের উৎসটা কী, সেটা আগে না জেনে জয়গোপাল দোষারোপ করছে রামলিঙ্গমকে৷ একটু বিরক্ত হয়েই চন্দ্রভানু বললেন, ‘ওকে দোষ দিও না বাছা৷ এক্সপোর্টের অর্ডারটা রিনিউ হওয়ার পর আমাদের আর্জেন্সি ছিল৷ অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে মীন উড়িয়ে না আনলে আমরা কনট্রাক্ট ফুলফিল করতে পারতাম না৷ লোকালি কত মীন তুমি জোগাড় করতে পারতে? যাক গে, এখন কী করা উচিত, বলো৷ শ্রীবাস্তবজির কাছে গিয়ে আমাকে তো একটা কিছু বলতে হবে৷ সেটা কী?’

‘আমার মনে হয়, ওঁকে বোঝাতে হবে, মারাত্মক ঝড়জলের কারণে ভেড়ির জল কন্টামিনেটেড হয়ে গিয়েছিল৷ তাই একটা লট বাগদা ভাইরাস এফেক্টেড হয়েছিল৷ সেটা আইডেন্টিফাই করে আমরা পরের ব্যাচের মীনগুলোকে কোয়ারেন্টাইনে রেখেছি৷ ভবিষ্যতে বাগদার গায়ে আর হোয়াইট স্পট দেখা যাবে না৷ জাপানের কোম্পানিটা যেন একতরফাভাবে আমাদের চুক্তি বাতিল না করে৷’

‘বুঝতে পারছ, চুক্তি বাতিল হলে, আমাদের কতটা গুডউইল নষ্ট হবে?’

‘পারছি বাবা৷ অনেকদিন আগে থেকেই আমার সন্দেহ হচ্ছিল রামলিঙ্গমের উপর৷ হায়দরাবাদের লোক৷ অত মাইনে দিয়ে ওকে রাখার কোনও দরকার ছিল না৷ আমাদের স্টেট ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টকে বললেই, ওরা টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিতে পারত৷ আমার মনে হয়, অন্ধ্রপ্রদেশের কোনও কোম্পানির কাছে টাকা খেয়ে রামলিঙ্গম আমাদের এই সর্বনাশটা করেছেন৷ দেখবেন, আমাদের কন্ট্রাক্ট এ বার হায়দরাবাদের ওই কোম্পানি বাগিয়ে নেবে৷’

‘যদি তাই হয়, তা হলে রামলিঙ্গমকে ভেড়িতেই পুঁতে দিও৷ তার আগে সিওর হয়ে নিও, ও দোষী কিনা৷ আর একটা কাজ… কাল হিঙ্গলগঞ্জে গিয়েই তুমি করবে৷ এই এক্ষুণি তুমি যা বললে, সেই কথাগুলো লিখেই… দেবাংশু উকিলকে দিয়ে একটা চিঠি ড্রাফট করাবে৷ সেই চিঠি আমি শ্রীবাস্তবজিকে দেব৷ …ঠিক আছে, এখন তুমি যাও৷ আমাকে একটু একা থাকতে দাও৷’

জয়গোপাল চলে যাওয়ার পরও, বিলের ধারে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন চন্দ্রভানু৷ তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন, জগন্নাথ পণ্ডিতের কথাই ঠিক৷ শত্রুতা, ষড়যন্ত্র তা হলে শুরু হয়ে গিয়েছে৷ কে এই শত্রু, আগে সেটাই তাঁকে খুঁজে বের করতে হবে! বাদাবনে কার এমন দুঃসাহস হল যে, চন্দ্রভানুকেও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে?

(চোদ্দো)

কলকাতা থেকে রাজেশ সাহা বলে একজন ফোন করেছিলেন৷ নেত্রা এসে বলল, তিনি না কি দয়াপুরে এসে একবার দেখা করতে চান৷ জেমসপুরে যাওয়ার জন্য তখন তৈরি হচ্ছেন তরিতা৷ ওখানে একটা জমির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে৷ জমির মালিক তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চান৷ রাজেশ সহাকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই তরিতার৷ দিন যত যাচ্ছে, ততই টেনশন বেড়ে যাচ্ছে তাঁর৷ ন্যায্য দাম দিয়ে কেনার জন্য তিনি বসে আছেন, অথচ জমি পাওয়া যাচ্ছে না৷ উত্তরের আশায় নেত্রা মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে, তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘লোকটা কী কারণে দেখা করতে চায়, জিজ্ঞেস করেছিস?’

‘পরিষ্কার করে কিছু বলেনি দিদি৷ তবে আমার মনে হল, এভিএস ইউনিট নিয়ে কোনও কথা৷’

‘ভদ্রলোক জানলেন কী করে আমরা এভিএস ইউনিট করছি?’

‘সেটাই তো আমার অবাক লাগল দিদি৷ ’

এভিএস ইউনিট তৈরি করার কথা এখানে খুব বেশি লোক জানেন না৷ মাসখানেক আগে সরকারী অনুমতি নেওয়ার জন্য তরিতা কয়েকটা জায়গায় প্রোপোজাল পাঠিয়েছেন মাত্র৷ সেখান থেকে খবরটা লিক হওয়ার সম্ভাবনা কম৷ চট করে একটা সন্দেহ মাথায় উঁকি দিল তরিতার৷ কয়েকটা জায়গায় মেল মারফৎ যোগাযোগ রাখছেন তিনি৷ যেমন এডবেরি, অ্যান্টনি গোমস৷ মেল-এ ইউনিটের প্ল্যানিং নিয়ে বিশদ আলোচনাও হয়েছে তাঁদের সঙ্গে৷ কেউ হ্যাক করছেন না তো? সন্দেহটা দূর করে ফেলার জন্য তরিতা বললেন, ‘রাজেশকে কী বললি, তুই? লোকটা কি কোনও কন্টাক্ট নাম্বার দিয়েছে?’

‘হ্যাঁ, ওর মোবাইল নাম্বারটা নিয়ে রেখেছি৷ আমি বলেছি, আমরাই পরে যোগাযোগ করে নেবো৷’

‘ওকে রিঙ ব্যাক করা যাবে? চেষ্টা করে দ্যাখ তো৷ আমি এখুনি কথা বলতে চাই৷’

‘দেখছি দিদি৷’ বলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল নেত্রা৷

সেই ফাঁকে চট করে শাড়িটা বদলে নিলেন তরিতা৷ মুখে হালকা টাচ দিয়ে নিলেন৷ সকালের দিকে চড়া রোদ্দূর ছিল৷ জেমসপুরে যাবেন কিনা তা নিয়ে ইতস্তত করছিলেন৷ শান্তিকে বলেওছিলেন, বিকেলের দিকে গেলে কেমন হয়? কিন্তু শান্তি বলল, ‘বিকেলের দিকে ট্রাই করা ঠিক হবে না৷ রোজ ওই সময়টায় ঝড়জল হচ্ছে৷ ফেরার সময় রাস্তায় আলো থাকবে না৷ মনসা পুজো করা নিয়ে একদল লোক ঘোঁট পাকাচ্ছে৷ কার মনে কী আছে, বলা যায় না ম্যাডাম৷’ পরে তরিতা ভেবে দেখেছেন, শান্তিই ঠিক৷ জমির মালিকের সঙ্গে কথা বলতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে? দিনের আলোয় ফিরে আসতে না পারলে মুশকিল৷ মাঝে একদিন এমিলিপুরে গিয়েছিলেন মনসাপুজো উপলক্ষে৷ সন্ধেবেলায় ফিরে আসার সময় নানা হাঁপা পোহাতে হয়েছিল৷ একে তো মেশিন ভ্যান ছাড়া এদিক ওদিক যাওয়ার আর কোনও উপায় নেই৷ এমিলিপুর থেকে ফেরার সময় মাঝ রাস্তায় হঠাৎ ড্রাইভার ছেলেটা বলল, তেল ফুরিয়ে গেছে৷ নির্জন মোরামের রাস্তার একদিকে ধানখেত… ঘন অন্ধকার৷ অন্যদিকে, ছাড়া ছাড়া বাড়ি… মিটমিটে আলো জ্বলছে৷ ড্রাইভার ছেলেটা ভ্যানে বসিয়ে রেখে কার বাড়ি থেকে যেন তেল আনতে গেল৷ সেইসময়টায় বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলেন তরিতা৷

ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে তরিতা দেখলেন, নেত্রার মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি৷ মোবাইল সেট এগিয়ে দিয়ে ও বলল, ‘এই নাও দিদি, অনেক কষ্টে রাজেশ লোকটাকে পেলাম৷ কথা বল৷’

তরিতা বললেন, ‘গুড মর্নিং মিঃ সাহা৷ আমি তরিতা বলছি৷’

‘গুড মর্নিং ম্যাম৷ আমি রাজেশ৷ ত্রিপুরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের সিনিয়র অফিসার৷ আমি থাকি আগরতলায়৷ আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যই কলকাতায় এসেছি৷’

শুনে একটু অবাকই হলেন তরিতা৷ আগরতলা থেকে ভদ্রলোক কথা বলতে আসছেন সুন্দরবনের এই প্রত্যন্ত গ্রামে! কী এমন দরকার? তরিতা বললেন, ‘কী ব্যাপারে কথা বলতে চান মিঃ সাহা?’

‘আমাদের কাছে খবর আছে, আপনি একটা এভিএস ইউনিট খুলতে চান৷ ত্রিপুরা গভর্মেন্টের হয়ে আমি রিকোয়েস্ট করতে এসেছি৷ যদি ইউনিটটা আপনি আগরতলায় করেন, তা হলে ভাল হয়৷ আপনাকে আমরা সব রকম সুযোগ সুবিধা দেবো৷’

‘যদি কিছু মনে না করেন, তা হলে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

‘না, না৷ মনে করব কেন? বলুন৷’

‘আমি যে ইউনিটটা খুলছি, সেই খবর আপনারা পেলেন কী করে?’

‘ম্যাডাম, সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং থেকে৷ আমাদের ওখানে প্রচুর সর্পমিত্র আছেন, যাঁরা সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং মারফৎ সারা দেশ জুড়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখেন৷ তেমনই একজন সর্পমিত্র হিমন্ত বরা আপনার ভক্ত৷ মাঝে মধ্যে উনি কাগজে আর্টিকেল লেখেন৷ ওঁর একটা লেখাতেই আমরা জানতে পেরেছি ম্যাডাম৷ ত্রিপুরায়… শুধু ত্রিপুরাতেই বা কেন, এনটায়ার নর্থ ইস্টের স্টেটগুলোতে কোথাও এভিএস ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট নেই৷ অথচ স্নেকবাইট ভিক্টিম অসংখ্য৷ চাহিদার তুলনায় এভিএস সাপ্লাই খুব কম৷ সেই কারণেই আমাদের ইন্ডাস্ট্রি মিনিস্টার চান, আমাদের রাজ্যে একটা এভিএস ইউনিট হোক৷’

শুনে খুব কৌতূহলবোধ করলেন তরিতা৷ খবরের কাগজেই পড়েছেন, ইন্ডাস্ট্রি টানার জন্য রাজ্যে রাজ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে গিয়েছে৷ তাতে ত্রিপুরার মতো ছোট্ট একটা রাজ্যও যোগ দিয়েছে ভেবে, তিনি অবাক হলেন৷ আগরতলায় গিয়ে ইউনিট খোলার কোনও ইচ্ছে তাঁর নেই৷ তবুও, একটু বাজিয়ে দেখার জন্য তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কী ধরনের সুবিধা দেবেন রাজেশ?’

‘আমাদের ল্যান্ডব্যাঙ্ক আছে৷ ইচ্ছে করলে সেখানে আপনি জমি নিতে পারেন৷ ওয়াটার আর ইলেকট্রিসিটি নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না৷ আমাদের ওখানে লেবার প্রবলেম নেই ম্যাডাম৷ সবথেকে বড় কথা, প্রোপোজাল পাঠানোর একমাসের মধ্যে যাতে সবরকম পার্মিশন পেয়ে যান, সেটা আমরা দেখব৷ আপনি চাইলে কালই দয়াপুরে গিয়ে ডিটেলে আলোচনা করতে পারি৷’

প্রস্তাবটা মন্দ নয়৷ বিশেষ করে, জল আর বিদ্যুতের সুবিধা পাওয়ার কথাটা৷ দয়াপুরের কাছাকাছি কোথাও এভিএস ইউনিট করার কথা তিনি ভাবছেন বটে, কিন্তু পরে এই দুটো নিয়ে সমস্যায় পড়তে হতে পারে৷ দয়াপুরে পানীয় জলের খুব অভাব৷ হঠাৎ হঠাৎ কারেন্ট চলে যায়৷ রিসর্টে জেনারেটর আছে বলে, সেটা তাঁরা বুঝতে পারেন না৷ তবুও তরিতা বললেন, ‘আমরা নিজেদের মধ্যে একটু আলোচনা করে নিতে চাই রাজেশ৷ পরে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে৷’

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব ম্যাডাম? এত জায়গা থাকতে আপনি সুন্দরবনের মতো একটা রিমোট প্লেস-এ ইউনিট খুলতে চাইছেন কেন?’

উত্তরটা দেবেন না বলেই তরিতা এড়িয়ে গেলেন, ‘এখনও ফাইনাল কিছু করিনি৷ আচ্ছা, ছাড়ি তা হলে৷ পরে কথা হবে৷’

লাইনটা কেটে যাওয়ার পর মোবাইল সেট নেত্রার হাতে দিয়ে তরিতা বললেন, ‘মেশিন ভ্যান কি এসে গেছে? চল, তা হলে জেমসপুরে রওনা হওয়া যাক৷’

নেত্রার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রিসর্টের বাইরে বেরিয়ে তরিতা দেখলেন, শান্তি মেশিন ভ্যানে বসে আছে৷ কিন্তু শোভা আসেনি৷ তার মানে, ওর বর অনন্ত বোধহয় দয়াপুরে এসে গেছে৷ ওকে আটকে দিয়েছে৷ শোভার জন্য মনটা কেমন করে উঠল তরিতার৷ দুর্গাদির মেয়ে বলেই ওর প্রতি একটা অপত্যস্নেহ জন্মে গিয়েছে৷

শহরে কিছুদিন থাকার জন্য মেয়েটা বেশ চটপটে৷ ওকে ল্যাবরেটরির কোনও একটা কাজে লাগানোর কথা ভেবে রেখেছেন তরিতা৷ নিজে রোজগার করতে পারলে তখন অনন্তর ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় ওকে চলতে হবে না৷ গত একমাসে গাঁয়ের অনেক মেয়ে-বউয়ের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে তরিতার৷ প্রায় সবার জীবনে একই গল্প৷ দারিদ্র, ক্ষুধা, অপুষ্টি, নির্যাতন৷ এই কারণেই বাঁচার তাগিদে প্রচুর মেয়ে শরীর বেচতে শহরে চলে যায়৷ মেয়েদের অবস্থা একটুও বদলায়নি৷

ক্যানিংয়ে অনাথ আশ্রমে থাকার সময় যা দেখেছেন, বাদাবনে মেয়েদের জীবন এখনও সেই একই রকম আছে৷ অশিক্ষা আর কুসংস্কারের শিকারই রয়ে গিয়েছে এরা৷ আর তাতেই খুশি৷ সারা জীবন শোভাকে অনন্তর অত্যাচার সহ্য করতে হবে৷ কথাটা ভাবতেই অনন্তর উপর চিনচিনে একটা রাগ হতে থাকল তরিতার৷ অনাথ আশ্রমে থাকার সময়, স্কুলের গন্ডি পেরনোর আগে একটা অলৌকিক ঘটনা না ঘটলে হয়তো তাঁর জীবনটাও শোভার খাতে বইত৷ এই বাদাবনের কোথাও কারও বউ হয়ে সংসার সামলাতেন তিনি! আর মুখ বুঁজে স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতেন!

মেশিন ভ্যানের ভটভট শব্দটা ঠিক সহ্য হয় না তরিতার৷ আরও পছন্দ করেন না বিশ্রী ধোঁয়ার গন্ধ৷ তবুও, এই অঞ্চলে যানবাহন বলতে একমাত্র মেশিনভ্যানই একটু যা জোরে যায়৷ নাকে রুমাল চাপা দিয়ে তরিতা বসে রইলেন৷ দয়াপুর বাজার ছাড়িয়ে ভ্যান ধানখেতের রাস্তার দিকে এগোচ্ছে৷ সকালের দিকে বাজারটা গমগম করে৷ এখন দু’চারজন দোকান গোটাচ্ছে৷ আটচালার তলাটা খাঁ খাঁ করছে৷ সন্ধ্যের পর একেবারে নির্জন হয়ে যায়৷ একটু আগে রাজেশ বলে লোকটা সঙ্গত প্রশ্নই করেছিল৷ ‘এত জায়গা থাকতে আপনি সুন্দরবনের মতো একটা রিমোট প্লেস-এ ইউনিট খুলতে চাইছেন কেন?’

কেন, সেটা এতদিন গোপনই রেখেছেন তরিতা৷ জেমসপুরে যাওয়ার পথে সেই দিনটার কথা তাঁর মনে পড়ল৷ এখনও স্পষ্ট সব মনে আছে৷ নেচার স্টাডি করানোর জন্য একটা লঞ্চ ভাড়া করে একবার আশ্রমের মায়েরা তাঁদের ক্যানিং থেকে কোর এরিয়ার দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ সন্ধের মধ্যেই গদখালিতে ফিরে আসার কথা ছিল৷ কিন্তু, দো বাঁকি বলে একটা জায়গায় পৌঁছে লঞ্চের সারেঙ হঠাৎ জানালেন, ইঞ্জিন গড়বড় করছে৷ জোয়ার না আসা পর্যন্ত এগনো যাবে না৷ শুনে মায়েদের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল৷ সঙ্গে ক্লাস নাইন-টেনের জনা দশেক মেয়ে৷ জনবিরল ওই জলজঙ্গলে কত রকম বিপদ ওত পেয়ে থাকতে পারে৷ সারেঙ আশ্বাস দিলেন, ‘ভয় পাবেন না মা জননীরা৷ লঞ্চ খাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছি৷ কোনও বিপদ হবে না৷’

বিকেল ফুরিয়ে গিয়ে সন্ধে এসে গেল৷ তবুও লঞ্চ নট নড়নচড়ন৷ নীচের ডেক-এ অন্ধকারে তরিতারা জুবুথুবু হয়ে বসে৷ খাঁড়ির একদিকে ঘন জঙ্গল৷ অন্যদিকে থাক থাক পলিমাটির স্তর৷ সেই কাদা পেরিয়ে কিছুদূর গেলে পরিত্যক্ত কোনও গ্রাম৷ আকাশে তারা ফুটে বেরনোর পর হঠাৎই একটা আশ্চর্য দৃশ্য দেখতে পেলেন সবাই৷ পিছন থেকে জলের স্রোতের সঙ্গে অসংখ্য প্রদীপ ভেসে আসছে৷ জ্বলন্ত সেই প্রদীপ! লঞ্চের পাশ দিয়ে প্রদীপগুলো ভেসে যাচ্ছে বড় নদীর দিকে৷ প্রদীপের আলোয় অন্ধকার আরও ঘন হয়ে উঠেছে৷ এত প্রদীপ আসছে কোত্থেকে? মায়েরা জিজ্ঞেস করায় সারেঙ বললেন, ‘বলতে পারব না মা৷ আগেও দু’একবার আমাদের চোখে পড়েছে৷ বছরে একটা মাত্র দিনেই এই অদ্ভুত ঘটনা ঘটে৷ নাগপঞ্চমীর দিনে৷ কোত্থেকে এত প্রদীপ আসে, কারা প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাসিয়ে দেয়, সেটা জানার জন্য একবার ডিঙি নিয়ে আমরা খুঁজতে বেরিয়ে ছিলাম৷ কিন্তু কিছুদূর এগনোর পর আর যেতে পারিনি মা৷’

সেই রাতে আরও বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল তরিতার৷ রাতে সারেঙ এসে বললেন, ‘ইঞ্জিন ঠিক হয়ে গেছে মা৷ কিন্তু এখন আমরা গদখালির দিকে এগোব না৷ রাতটা এখানেই কাটিয়ে ভোরের দিকে রওনা হবো৷ আপনাদের জন্য চাল-ডাল ফুটিয়ে দিচ্ছি৷’

আশ্রমের মায়েরা তাতে আপত্তি করেননি৷ রাতে খিঁচুড়ি পেটে পড়ার পর নীচের ডেক-এ প্রায় সবাই ঘুমে ঢলে পড়েছিলেন৷ গরমে ঘুম আসছিল না বলে তরিতা পা টিপে টিপে উঠে গিয়েছিলেন আপার ডেক-এ৷ উপরে উঠতেই তিনি শুনতে পেয়েছিলেন, কাছাকাছি কোথাও ঢাক-ঢোল বাজছে৷ গ্রামের দিকে তাকাতেই গাছপালার ফাঁকে তাঁর চোখে পড়েছিল, কোনও বাড়িতে বোধহয় পুজো হচ্ছে৷ প্রদীপ জ্বলছে, ধুনুচি নাচ হচ্ছে৷ দেখে তরিতা একটু অবাকই হয়েছিলেন৷ তবে যে সারেঙ বললেন, গ্রামে কোনও জনবসতি নেই! তা হলে পুজো করছেন কারা?

হঠাৎই পিছন থেকে কার কন্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন তিনি, ‘ অবাক হোস না মা৷ গাঁয়ের লোকেরা আমারই পুজো করছে৷’

ঘুরে তাকিয়ে তরিতা চমকে উঠেছিলেন৷ অপূর্ব সুন্দরী এক মহিলা৷ তাঁর মাথায় মুকুট একটা পঞ্চফণার সাপ৷

দেখেই তরিতা চিনতে পেরেছিলেন, মা মনসা৷ আকাশের তারাগুলো কি তখন আরও বেশি জ্বলজ্বল করছিল ? না কি অন্ধকার হঠাৎ ফিকে হয়ে গিয়েছিল? তরিতার মনে হয়েছিল, সত্যিই স্বর্গ থেকে মা মনসা লঞ্চের ডেক-এ নেমে এসেছেন৷ সারা শরীর কেঁপে উঠেছিল৷ গড় হয়ে তিনি প্রখাম করেছিলেন৷ আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে মা মনসা তখন বলেছিলেন, ‘তোর জীবনে এর পর কিছু অত্যাশ্চর্য কিছু ঘটনা ঘটবে৷ তোর পিতৃপরিচয়ও তুই জানতে পারবি৷ ভয় পাস না মা৷ আমার আশীর্বাদ সবসময় তোর সঙ্গে থাকবে৷

একটা সময় এই বাঁদাবনে এক ডাকে লোকে তোকে চিনবে৷ আর শোন , আমার পুজো যাতে লোকে করে, তুই সেই চেষ্টাই করে যাবি৷ তাতে তোর অভীষ্ট সিদ্ধ হবে৷’

তার পর কী হয়েছিল, তরিতার আর মনে নেই৷ পরে শুনেছেন, ভোরবেলায় তাঁর মূর্চ্ছিত দেহটা ডেক-এর উপর আবিষ্কার করেছিলেন সারেঙ৷ আশ্রমের মায়ের জানতে চেয়েছিলেন, কী হয়েছে? তরিতা কাউকেই কিছু বলেননি৷ মাসখানেক পর সত্যিই তিনি পিতৃপরিচয় জানতে পেরেছিলেন আশ্রমের কর্ণধার সতীমায়ের মুখ থেকে৷ এক গভীর রাতে কে একজন ত রিতাকে ঘুম থেকে তুলে বলেছিলেন, ‘তরিতা, চল, তোকে সতীমা ডাকছেন৷ তোর সঙ্গে উনি কথা বলতে চান৷’

তখন পনেরো-ষোলো বছর বয়স তরিতার৷ বুকটা ধক করে উঠেছিল, কী বলতে চান সতীমা? উনি তখন থাকতেন আশ্রমের দোতলায় কোণের দিকে একটা ঘরে৷ বেশ কিছুদিন ধরেই শয্যাশায়ী৷ আশ্রমিকরা তাঁর দেখা পাচ্ছিলেন না৷ একটা অনিশ্চয়তার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল আশ্রমে৷ সতীমার খারাপ কিছু হলে কে চালাবেন আশ্রম? প্রায় কুড়িজন অনাথের ভরণপোষণের দায়িত্ব কে নেবেন? প্রায়ান্ধকার সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই ঘরে ঢুকে তরিতা দেখেছিলেন, বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে রয়েছেন সতীমা৷ তাঁর শীর্ণ শরীর সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা৷

যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখটা দেখে চোখে জল এসে গিয়েছিল তরিতার৷ বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি৷ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সতীমাকে কোনওদিন শুয়ে থাকতে দেখেননি তিনি৷ সতীমা ছিলেন আশ্রমের প্রাণভোমরা৷ সর্বক্ষণ, সর্বত্র যাঁর উপস্থিতি টের পাওয়া যেত৷ সেই মানুষটা জরাগ্রস্ত, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছেন না!প্রাণবন্ত মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে৷ বিছানার চারপাশে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন অন্য মায়েরা৷ ঘরে একটাই তেলের প্রদীপ জ্বলছে৷ তার হলদেটে আলোয় তরিতার চোখে পড়েছিল, অন্য মায়েরাও নীরবে কাঁদছেন৷ ওঁকে ঘরে ঢুকতে দেখে মায়েরা বাইরে চলে গিয়েছিলেন৷ হয়তো সতীমায়ের সেইরকম নির্দেশই ছিল৷

হাত নেড়ে কাছে ডেকে সতীমা ক্ষীণস্বরে বলেছিলেন, ‘তরিতা, আমার কাছে এসে বোস মা৷ তোকে একটা জিনিস দেওয়ার আছে৷’

কথাটা বলেই কাঁপা হাতে বালিশের তলা থেকে একটা ধাতব জিনিস বের করে এগিয়ে দিয়েছিলেন উনি, ‘এই নে, এটা তোর৷ পনেরো-ষোলো বছর ধরে এটা আমি খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছি৷’

জিনিসটা চোখের সামনে তুলে তরিতা দেখেছিলেন, তামার একটা লকেট৷ একদিকে ত্রিশূলের ছাপ, অন্য দিকে সাপের৷ তরিতা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এটা কি সতীমা?’

‘তোর শেঁকড়৷ সাগর দ্বীপের জঙ্গলে যখন তোকে পাওয়া যায়, তখন এই লকেটটা তোর গলায় ছিল৷ তোর তখন মাত্তর একদিন বয়স৷ এই লকেটের সূত্র ধরে অনেক পরে তোর জন্মদাতাকে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম৷ তাঁর নাম জানানোর জন্যই তোকে আজ ডেকে পাঠালাম৷’

কে জন্মদাতা, তা নিয়ে কোনওদিন মাথা ঘামাননি তরিতা৷ আশ্রমের পরিমণ্ডলেই তিনি খুব খুশি ছিলেন৷ বাবা-মায়ের অভাব কখনও টের পাননি৷ সতীমায়ের কথা শুনে চমকে উঠেছিলেন তিনি৷ সাধারণ বুদ্ধি প্রয়োগ করেই প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কিন্তু, এত বছর পর… ওঁর পরিচয় জেনে আমার কী লাভ মা? উনি কি আমাকে স্বীকার করবেন?’

‘আমার বিশ্বাস, করবেন৷ উনি কেন তোকে পরিত্যাগ করেছিলেন, আমি জানি না৷ কিন্তু, তোর পরিচয় আমি যেদিন ওঁকে দিই, তার পর থেকে এই আশ্রম চালানোর সব দায়িত্ব উনি কাঁধে নিয়েছেন৷ সেই কারণে আমার মনে হয়, উনি তোকে ফিরিয়ে দেবেন না৷ এই লকেটটা তুই সঙ্গে নিয়ে যাস৷ আর শোন, এই আশ্রমে তুই পড়ে থাকিস না মা৷ তোর সামনে একটা ব্রাইট ফিউচার পড়ে রয়েছে৷ তুই আরও লেখাপড়া শিখে অনেক দূর এগোবি৷ তোর সঙ্গে দৈবীশক্তি আছে৷ তোকে কেউ আটকাতে পারবে না৷’

ধীরে ধীরে এতগুলো কথা বলার পর সতীমা হাঁফাতে শুরু করেছিলেন৷ চোখ বুজে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ফের উনি বলেছিলেন, ‘এই কথাগুলো তোকে বলতে পেরে আমি হালকা হয়ে গেলাম মা৷ এ বার আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারব৷ শোন, এখন আমি যা বলব, তা কিন্তু আর কাউকে বলবি না৷’

এর পরই জন্মদাতা পিতার নামটা বলে দিয়েছিলেন সতীমা৷ তিনি চুপ করে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ বিছানার পাশে বসেছিলেন তরিতা৷ এখনও মনে পড়ে, তেলের প্রদীপটা হঠাৎ নিভে গিয়েছিল৷ মায়েরা দৌড়ে ঘরে ঢুকে এসেছিলেন৷ কান্নার রোল উঠেছিল আশ্রমে৷ ঘুমজড়িত চোখে আশ্রমের ছোটরা ভিড় জমিয়েছিল সিঁড়িতে৷ মৃত্যু কী, তা বোঝার মতো বয়স হয়নি ওই কচিকাঁচাদের৷ তাদের বিহ্বল মুখগুলো দেখে প্রাণ কেঁদে উঠেছিল তরিতার৷

এখনও কানে বাজে সতীমায়ের কথাগুলো, ‘তোর জন্মদাতা পিতার নাম স্বামী মহেশ্বরজি৷ সাগর দ্বীপে গেলেই তাঁর খোঁজ পাবি মা৷’ নিজের জন্য নয়, আশ্রমকে বাঁচানোর জন্যই তরিতা একদিন হাজির হয়েছিলেন সাগর দ্বীপে৷ তখন জানতেনও না, পিতার কাছে আশ্রয় নেওয়ার জন্য কিছুকাল তাঁকে অসীম দুঃখ ভোগ করতে হবে৷ তাঁকে একটা চোখ খোয়াতে হবে৷

‘জেমসপুর এসে গেছি দিদি৷ এ বার নামো৷’

নেত্রার কথায় চমক ভাঙল তরিতার৷ ক্যানিং থেকে মনটাকে তিনি সরিয়ে আনলেন জেমসপুরে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *