ছায়াঘাতক – ৪৫

পঁয়তাল্লিশ

মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছে ঘর্মাক্ত রানা ও কেন্সিংটন। রানার কাঁধে ভারী হোল্ডঅল। পিছু নিয়ে টলতে টলতে তাল মেলাতে চাইছে কেন্সিংটন। পায়ের নিচের বালি একসময়ে হয়ে গেল বেলেমাটি। একটু পর হলদে হয়ে যাওয়া ঘাসের চাপড়া হলো সবুজ ও ঘন। একটা ঢাল বেয়ে ওঠার পর নিচে বাড়িঘরের ছাত ও আঁকাবাঁকা রাস্তা দেখল ওরা। সামনেই ছোট একটা গ্রাম। জনবসতি ছাড়িয়ে দেখা যাচ্ছে পাম গাছের সারি ও নীল নদের নীল জল। নদে ভাসছে ছোটবড় নৌকা ও বার্জ।

পরিশ্রমের ধকলে নীরব হয়েছে কেন্সিংটন। সেজন্যে অন্তর থেকে খুশি রানা। কিছুক্ষণ পর ঢাল বেয়ে নেমে প্রথম সারির বাড়িগুলোর কাছে পৌঁছল ওরা। এবার কাজে নামতে হবে ভেবেচিন্তে। প্রায় এক শ’ মাইল রুক্ষ, ঊষর মরুভূমির মাঝ দিয়ে ড্রাইভ করতে হলে চাই নিখুঁত প্ল্যান। রানা ভেবেছিল আসওয়ান থেকে সংগ্রহ করবে সাপ্লাই। তবে ওখানে সিকিউরিটি কঠোর হবে বলে তা আর এখন সম্ভব নয়। সুতরাং এ গ্রাম থেকেই জোগাড় করতে হবে প্রয়োজনীয় সমস্ত মালামাল।

বাড়িঘর ও দালানের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে ধুলোময় রাস্তা। কিছু বাড়ি সেই প্রাচীন আমলের। বাদামি ত্বকের রানার সঙ্গে ফর্সা কেন্সিংটনকে দেখে কৌতূহলী চোখে খেয়াল করছে কেউ কেউ। গ্রামের মাঝে চারকোনা বড় একটা স্কয়্যার। ওখানেই বসেছে বাজার। মার্কেট বলতে কয়েক সারিতে কিছু দোকান। পুরুষদের পরনে সাদা, বাদামি ও বেগুনি জোব্বা। মাথায় মরুভূমিতে চলার উপযুক্ত উষ্ণীষ। উট, দুম্বা ও ছাগল বিক্রি করতে হাজির হয়েছে বিক্রেতারা। পুরনো একটা ট্রেইলার থেকে ফোর্ক ব্যবহার করে নিচে ফেলা হয়েছে একগাদা খড়। ওই স্তূপ থেকে নিয়ে মুখে শুকনো খাবার পুরছে এক পাল খচ্চর। গ্রামের ব্যবসাকেন্দ্রে দরদাম নিয়ে চলছে বিক্রেতা ও ক্রেতার তুমুল বিতর্ক। চারপাশে হৈচৈ। সেসবের সঙ্গে যোগ দিয়েছে উট ও গাধার ডাক। মাঝে মাঝে একটা দুটো ট্রাক পাশ কাটিয়ে না গেলে বা বাজারের পাশে কয়েকটা মোটরসাইকেল না থাকলে, যে-কেউ ভেবে নিতে পারবে, সে ফিরে গেছে হাজার দুয়েক বছর আগে।

ভিড়ের ভেতর দিয়ে এগোল রানা ও কেন্সিংটন। বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ দেখে পিছু নিয়েছে একদঙ্গল কিশোর। বিক্রির জন্যে সবার হাতে কোনও না কোনও জিনিস। বারবার ছেলেগুলোর দিকে তাকাচ্ছে কেন্সিংটন। রানা বুঝতে পারছে, ইতিহাসবিদের মনে হচ্ছে সে হঠাৎ করে হাজির হয়েছে অন্য কোনও গ্রহে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা উটের পেছনে চাপড় দিতেই ঘুরে কেন্সিংটনের চোখে-মুখে একগাদা থুতু ছিটিয়ে দিল জন্তুটা। আরবি ভাষায় ইতিহাসবিদের বাপ-মার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করল উটের মালিক।

কেন্সিংটনের বাহু চেপে ধরে তাকে সরিয়ে নিল রানা। সহজ সুরে বলল, ‘উট বা গাধাকে বিরক্ত করলে লাথি মেরে বুক-পেট সমান করে দেবে।’

‘আমিও ওদের ওপর খুব বিরক্ত, শার্টের আস্তিন দিয়ে থুতু ভরা মুখ মুছল কেন্সিংটন।

তার হাত ধরে সাপ্লাইয়ের দোকান লক্ষ্য করে চলল রানা। একটু দূরেই বড় মুদি দোকান। ওটাই আবার জেনারেল স্টোর। দোকানদারের কাছ থেকে বড় এক জার মধু, আধ কেজি চা, বড় একটা ব্যাগ ভরা ছাগলের শুকনো মাংসের ফালি, বাদাম ও শুকনো ফল কিনল রানা। কেন্সিংটনকে বলল, ‘মরুভূমিতে খুব দ্রুত পচে যায় তাজা খাবার।’

মধুর দিকে চেয়ে আছে কেন্সিংটন। কী কারণে ওটা কেনা হলো জানতে চাইবে, এমন সময় দোকানের মালিকের সঙ্গে আরবিতে আলাপ জুড়ল রানা। ওর কথা শুনে হেসে ঝড়ের বেগে জবাব দিল লোকটা।

কথা শেষে দোকান থেকে বেরিয়ে গ্রামের অন্যদিকে চলল রানা। জানতে চাইল কেন্সিংটন, ‘এত কী বলল লোকটা?’

‘বলেছি মরুভূমিতে ভালভাবে চলবে এমন একটা গাড়ি কিনতে চাই,’ বলল রানা। ‘জবাবে বলল, গ্রামের ওদিকে গ্যারাজ খুলেছে তার চাচাতো ভাই উমর।’

‘আমরা আসলে কোথায় আছি?’

‘যে-কোনও শহর থেকে হাঁটা পথে অন্তত তিন দিন দূরে। কাজেই আগের চেয়ে দ্রুত পা চালান।

একঘণ্টা পর অফিসের পেছনের ছাউনির নিচে বসে নতুন বন্ধু উমরের সঙ্গে লেবুর শরবতে চুমুক দিল রানা। এইমাত্র বুঝিয়ে দিয়েছে একতোড়া মিশরীয় পাউণ্ড। বিক্রির জন্যে তিনটে অফ-রোড ভেহিকেল রেখেছিল উমর। সেগুলোর ভেতর থেকে লিবিয়ার পুরনো একটা মিলিটারি টয়োটা জিপ বেছে নিয়েছে রানা। গাড়িটা ধরতে গেলে প্রাচীনই। গাঢ় সবুজ রঙের। তুবড়ে যাওয়া বডিতে নানান ধরনের ক্ষত। কিন্তু মরুভূমিতে চলার জন্যে ওটার আছে উঁচু সাসপেনশন, বালির উপযুক্ত নতুন চাকা, বনেটের নিচে বাড়তি একটা চাকা, যন্ত্রপাতি ভরা টুলবক্স, ভাঁজ করা মিলিটারি কোদাল আর ধাতব আটটা বড় আকারের জেরিক্যান। মরুভূমিতে অকটেনের অভাব হলে কোথাও রিফিউয়েলিং স্টেশন পাবে না, কাজেই উমরের কাছ থেকে ফিউয়েল নিয়ে রানা জিপের ট্যাঙ্ক তো কানায় কানায় ভরেইছে, তার ওপর অকটেন দিয়ে ভরেছে আট জেরিক্যান।

আরও একঘণ্টা রানা ব্যয় করল নানান সাপ্লাই সংগ্রহে। সেগুলোর ভেতর থাকল প্লাস্টিকের এক লিটারের বারাকা মিনারেল ওঅটরের ষোলোটা বোতল, বেল্টে ঝোলানো যায় এমন দুটো ক্যান্টিন, কমপাস, ম্যাচ, লাইটার, কমপ্যাক্ট সলিড ফিউয়েল স্টোভ, দুটো ছোট অ্যালিউমিনিয়ামের কড়াই, টিনের দুটো মগ এবং মরুভূমিতে রাতের শীত ঠেকাবার জন্যে উপযুক্ত ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি কম্বল। এক মসলা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নিল ছোট কয়েক কৌটা জেরেনিয়াম ও ল্যাভেণ্ডার তেল। ওগুলো কাজে আসবে মশা ও অন্যান্য পতঙ্গ তাড়াতে। সব কেনা প্রায় শেষ। তবে রয়ে গেছে জরুরি দুটো জিনিস। এবার ঢিলা করে তৈরি সুতির দুটো টিউনিক আর দুটো বেদুঈন হেডস্কার্ফ কিনল রানা।

ওগুলো পরলে আমাকে গাধার মত দেখাবে,’ নালিশের সুরে বলল কেন্সিংটন।

‘এমনিতেই ওরকম লাগছে,’ জবাবে বলল রানা। ‘মরুভূমির সূর্য থেকে মাথা না ঢাকলে স্রেফ মরবেন।’ পিকআপ জিপের পেছনে শেষ কয়েকটা জিনিস তুলল ও। ধুম্ করে বন্ধ করল টেইলগেট।

‘বরফের মত ঠাণ্ডা এক পাইন্ট বিয়ারের বদলে যে কাউকে খুন করতে রাজি আছি,’ দুঃখ করে বলল কেন্সিংটন।

‘এই গ্রাম মুসলিমদের। কোথাও বার পাবেন না। তা ছাড়া, এই গরমে অ্যালকোহল গিললে একঘণ্টার ভেতর শুকিয়ে যাবে শরীরের সব পানি। ফলে কষ্ট পেয়ে মরবেন। হিশুর সময় খেয়াল রাখবেন। বেশি হলদে হলে বুঝবেন এখনই পানি খেতে হবে। নইলেই বিপদ। আরেকটা কথা মনের ভেতর ভাল করে গেঁথে নিন, আপনি অসুস্থ হলে কোনও শহরে নিতে পারব না। যেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়বেন, সেখানেই শেষবারের মত দেখা হবে আমাদের। এরপর আপনার লাশ নিয়ে মহাভোজে মেতে উঠবে মরুর মাকড়সা।’

‘এতগুলো ভাল কথা বলার জন্যে ধন্যবাদ, বন্ধু, খুব গম্ভীর হয়ে গেছে কেন্সিংটন।

‘এখানে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কাজেই নিজের দেখভাল নিজেই করবেন,’ টয়োটার ড্রাইভিং সিটে উঠে দরজা আটকে নিল রানা। চালু করল ইঞ্জিন। প্যাসেঞ্জার সিটে চেপে বসল কেন্সিংটন। সে ভালভাবে দরজা আটকে নেয়ার আগেই রওনা হলো রানা।

মরুভূমিতে দুপুরে বের হওয়া মানেই নরকে গিয়ে পড়া। সুযোগ থাকলে আরও চারঘণ্টা পর সন্ধ্যায় রওনা হতো রানা। কিন্তু সেই উপায় ওর নেই। এরই মধ্যে ওর চেয়ে ঢের এগিয়ে আছে জমির শেখ।

দক্ষিণ-পশ্চিমে টয়োটার নাক তাক করেছে রানা। কিছুক্ষণের ভেতর অনেক পেছনে পড়ল নীল নদের তীরের সবুজের রেখা। সামনে ধূ-ধূ বালির সাগর, তার মাঝ দিয়ে গেছে পাকা সড়ক। জানালা খুলে রেখেছে ওরা। যে দমকা হাওয়া ঢুকছে, একেবারেই উনুনের আঁচের মত তপ্ত। ল্যামিনেটেড মানচিত্র দিয়ে নিজেকে বাতাস দিচ্ছে কেন্সিংটন। ক্লান্তিতে এলিয়ে বসেছে সিটে। মাথার চুলের গোড়ায় জমছে ঘামের বিন্দু। কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ল সে। ড্রাইভিঙে পূর্ণ মনোযোগ দিল রানা।

প্রথম ঘণ্টায় কোথাও কোথাও দেখল বিশাল আকারের ট্রাকের বহর। অন্য কোনও গাড়ি চোখে পড়ল না। সাবধানে কয়েকটা মিলিটারি পেট্রল পাশ কাটাল রানা। পথ রোধ করল না কেউ।

পরের ষাট মিনিট ঘুমের ঘোরে থাকল কেন্সিংটন। ইঞ্জিনের পুরো গতি তুলল রানা। কিন্তু বিকেলের দিকে পাকা সড়ক ফুরিয়ে গেল, শুরু হলো সরু কাঁচা রাস্তা। ওদের চারপাশে থাকল শুধু বালির প্রান্তর। ফিউয়েলের খরচ কমিয়ে আনার জন্যে গাড়ির গতি কমিয়ে দিল রানা। ঝিম মেরে পড়ে থাকল কেন্সিংটন। মাঝে মাঝে দু’একটা কথা হলো দু’জনের। পরের ঘণ্টায় সামনে থেকে এল মাত্র তিনটে গাড়ি। বিছানো চাদরের মতই মসৃণ মরুভূমির বালি। বহু দূরে গিয়ে মিশেছে দিগন্তে। সাগরে জাহাজ ন্যাভিগেট করার মতই হয়ে উঠল গাড়ি চালনা। কোথাও কোনও দৃশ্যমান ল্যাণ্ডমার্ক নেই। সহজেই পথ হারাতে পারে। বারবার কমপাস দেখে দক্ষিণ- পশ্চিমে চলেছে রানা।

একটু পর বহু দূরে দিগন্তের কাছে দেখল ছোট্ট একটা বিন্দু। ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠল জিনিসটা। উত্তপ্ত সূর্যের ঝিলমিলে আলো ভেদ করে রানা দেখল, ওটা একটা আর্মড ল্যাণ্ড রোভার। হেডলাইট জ্বেলে ওদেরকে থামতে বলা হলো। গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে কয়েকজন সৈনিক। কোমরের কাছ থেকে ধরেছে সাবমেশিন গান।

‘কারা এরা?’ ভীত কণ্ঠে জানতে চাইল কেন্সিংটন।

‘ইজিপশিয়ান আর্মি,’ বলল রানা।

‘আমাদেরকে থামাচ্ছে কেন? গ্রেফতার করবে?’

‘হয়তো।

‘আমরা তা হলে কী করব?’

চুপ করে থাকল রানা। থামিয়ে ফেলেছে টয়োটা।

ধীর পায়ে এসে রানার দরজার সিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল সৈনিকদের দলনেতা। সে অফিসার। চোখে রে-ব্যান সানগ্লাস। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম।

‘ওয়ালাইকুম সালাম,’ মাথা দুলিয়ে সম্মান দেখাল রানা।

মৃদু হাসল অফিসার। ‘কোথা থেকে এসেছেন?’

‘আমি বাংলাদেশ থেকে, আর আমার বন্ধু ব্রিটেন থেকে, বলল রানা। ‘টুরিস্ট।’

‘উত্তর দিকে জঙ্গিদের সঙ্গে আমাদের ঝামেলা হচ্ছে। মরুভূমির ভেতর বিদেশি লোক পেলে খুন করবে। আমরা কি আপনাদেরকে কাছের শহরে এস্কোর্ট করে পৌঁছে দেব?’

‘লাগবে না, আপনার কথা শোনার পর ভুলেও উত্তর দিকে যাব না,’ নরম স্বরে বলল রানা।

কাঁধ ঝাঁকাল অফিসার। হাতের ইশারা করল সৈনিকদের উদ্দেশে। তিন মিনিট পর ল্যাণ্ড রোভারে উঠে পড়ল সবাই। জিপগাড়িটা দূরে চলে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা।

‘আরেকটু হলে ধরা পড়তাম,’ একবার পেছনে রাখা অস্ত্র ও গুলি ভরা হোল্ডঅলের দিকে তাকাল কেন্সিংটন।

‘এর পরের বিপদটা হয়তো আরও গুরুতর হবে,’ বলল রানা।

আবারও এগিয়ে চলল টয়োটা পিকআপ জিপ দক্ষিণ- পশ্চিমে। আকাশে জ্বলন্ত সাদা বলের মত ঝলমলে সূর্য। নানান কৌশলে মেতেছে খেয়ালি আলো। সামনে গভীর গর্ত বা খাদ আছে কি না, বোঝার উপায় নেই। বিশাল বালির ঢিবির রাজ্যে ঢুকে সমতল জমিন ভেবে আরেকটু হলে খাড়া দেয়ালের মত বালির ঢিবিতে ঢুশ দিতে গিয়েও সামলে নিল রানা। কয়েক মিনিট পর কেন্সিংটন নিশ্চিত হলো, দূরে ওটা গ্রাম। যদিও কিছুক্ষণ পর ওরা দেখল, আশি গজ দূরের জিনিসটা খালি একটা জেরিক্যান।

নরম, ভুসভুসে বালির ঢিবিগুলো হয়ে উঠল ছোটখাটো পাহাড়ের মত। পিছলে যেতে লাগল জিপের চাকা। ঢাল বেয়ে ওঠার সময় যে-কোনও মুহূর্তে রানা ও কেন্সিংটন সহ কাত হয়ে পড়বে গাড়ি। সেক্ষেত্রে প্রাণে বাঁচলে নিচে খাদ তৈরি করে ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে আবারও হয়তো জিপটা সিধে করবে ওরা। আর কপাল মন্দ হলে, সূর্যের খর তাপে পুড়ে ধীরে ধীরে বরণ করবে কষ্টকর, করুণ মৃত্যু।

ক্রমেই পাথুরে হলো জমিন। সামনে স্যাণ্ডস্টোনের একের পর এক রিজ। তার ভেতর দিয়ে গেছে এবড়োখেবড়ো গভীর নালার মত ট্র্যাক। কয়েক ফুট পর পর পাথুরে মাটির সঙ্গে ধুম্‌ করে লাগছে গাড়ির সাসপেনশন। ছিটকে পড়তে গিয়েও সামলে নিচ্ছে ওরা। নীরবে ড্রাইভ করছে রানা। সিট দু’হাতে চেপে ধরে টিকে আছে কেন্সিংটন। উঁচু জমিতে গুঁতো খেয়ে বা গভীর নালায় পড়ে গুঙিয়ে উঠছে ওরা। ঠিক এই ধরনের জমির জন্যেই তৈরি টয়োটা জিপ। নিষ্ঠুরের মত গাড়িটাকে প্রচণ্ড পরিশ্রম করাচ্ছে রানা। ভাল করেই জানে, নীরবে অত্যাচার সহ্য করবে মিলিটারি ভেহিকেল।

ওদের গতি মন্থর। তিলতিল করে হাত ফস্কে বেরিয়ে যাচ্ছে মূল্যবান সময়। সাদা থেকে সোনালি হলো সূর্যটা। টুপ করে ডুবল দিগন্তে। দ্রুত কমছে জ্বলন্ত মরুভূমির তাপ। সন্ধ্যা নামতেই টয়োটা জিপ থামাল রানা। মাটিতে নেমে আড়মোড়া ভেঙে নিল ওরা। বেল্টে ঝুলন্ত ক্যান্টিন থেকে বড় কয়েক ঢোক পানি খাওয়ার পর রানা টের পেল, স্বাভাবিক হয়ে উঠছে শুকনো মুখ ও গলার ভেতরটা। ‘আজ রাতের মত এখানেই থামব,’ বলল কেন্সিংটনকে। ভাল হতো সারারাত এগোতে পারলে, কিন্তু চিরকালই অভিযাত্রীরা বলে এসেছেন— ভুলেও মরুভূমিতে রাতে চলবে না কেউ। তা ছাড়া, বড় ক্লান্ত রানা। ওর বিশ্রাম দরকার।

‘কী করে যে এত দ্রুত ঠাণ্ডা নামে,’ বলল কেন্সিংটন, ‘আমার তো মনে হচ্ছে চরম শীতে হঠাৎ করেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে হিটার।’

চামড়ার ঝুলি থেকে ছাগলের শুকনো মাংস ও ফল নিয়ে গাড়ি থেকে একটু দূরে বসল ওরা। নীরবে খাবার সেরে নিতে গিয়ে শুনল মরুভূমির থমথমে নীরবতা। কবরে হয়তো এমনই পরিবেশ। সর্বক্ষণ হাতের কাছে এফএন রাইফেল রেখেছে রানা। আরও নামছে তাপমাত্রা। সলিড ফিউয়েল স্টোভ জ্বেলে টিনের মগে চা তৈরি করল রানা। বলার মত কিছু নেই কেন্সিংটনের। চা শেষে সামনে পেছনে দুলতে লাগল সে। ভাল করে গায়ে ছাগলের চামড়ার কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। সময় লাগল না ঘুমিয়ে পড়তে।

আরও দু’ঘণ্টা পর ঘুম এল রানার। আকাশে সূর্যের লাল ও সোনালি রশ্মি চোখে পড়তেই আবারও জেগে উঠল। উঁচু ঢিবিগুলোর মাঝে কালো সব ছায়া। নেমেছে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। সীমিত পানি থেকে সামান্য খরচ করে মুখ-হাত ধুয়ে নেয়ার সময় রীতিমত হি-হি করে কাঁপল রানা। কেন্সিংটনের কোমরে গুঁতো দিতেই জেগে গেল সে। কাত হয়ে আড়মোড়া ভেঙে রানার দিকে তাকাল।

‘আপনাকে একটা জিনিস শিখতে হবে,’ বলল রানা।

‘কী সেটা?’

কেন্সিংটনের কম্বলের পাশে .৩৮ ক্যালিবারের রিভলভার ফেলল রানা। ‘শিখে নেবেন কীভাবে গুলি করতে হয়।’

উঠে দাঁড়িয়ে আপত্তির দৃষ্টিতে রানাকে দেখল ইতিহাস- বিদ। কুঁচকে গেছে ভুরু। ‘আপনাকে না বলেছি, আমি গোলাগুলি পছন্দ করি না?’

‘আপনাকে গোলাগুলির জন্যে তৈরি থাকতে হবে,’ বলল রানা। ‘আমরা এখানে দুধভাত খেলতে আসিনি। হয় শিখে নেবেন গুলি করা, নইলে রিভলভারটা দিয়ে গুলি করব আপনার নিতম্বে।’

চোখ সরু হয়ে গেল কেন্সিংটনের। পড়ে গেছে দ্বিধার ভেতর। ‘সত্যিই আপনি গুলি করবেন?’

‘হয়তো। আবার গুলি না-ও করতে পারি।’ পানির একটা খালি বোতল নিয়ে কয়েক গজ দূরে বালির ভেতর ফেলল রানা। তর্জনী দিয়ে দেখাল বোতলটা। ‘এবার ওটাকে গুলি করুন।’

‘আমার আপত্তি আছে,’ বিড়বিড় করলেও ছোট্ট রিভলভার তুলে নিল ইতিহাসবিদ। ‘ভীষণ আপত্তি।’ চোখ বুজে আন্দাজে বোতলের দিকে রিভলভারের নল তাক করল সে।

‘এক চোখ খুলে টার্গেট দেখুন,’ বলল রানা।

ডান চোখ খুলে বোতলের দিকে রিভলভার ঘোরাল কেন্সিংটন। কাঁপা গলায় বলল, ‘জানব কী করে এটার ভেতর গুলি আছে?’

‘সিলিণ্ডার আর ফ্রেমের মাঝ দিয়ে দেখুন। ওই যে দেখা যাচ্ছে তামার কার্ট্রিজের রিম। দেখতে পেয়েছেন? গুড। এবার বোতলের দিকে নল তাক করে ট্রিগার টিপে দিন। হ্যামার বা সেফটির বালাই নেই। টান দিন ট্রিগারে। পারবেন। এমন কী, যে উটটা থুতু মেরেছিল আপনার দিকে, সে-ও পারবে।’

চোখে আগুন নিয়ে রানাকে দেখল কেন্সিংটন। মুখ বিকৃত করে নল তাক করল সে পানির বোতলের দিকে। মনোযোগ দিতে গিয়ে বের করেছে আধ হাত জিভ। তারপর গায়ের জোরে টিপে দিল ট্রিগার।

নীরবতা ভেঙে কড়াৎ আওয়াজে গর্জে উঠেছে রিভলভার। গলার কাছে লাগতেই একদিকে ছিটকে গেল বোতল। লাফিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেছে কেন্সিংটন। হাতে আলগা ভাবে ধরেছে রিভলভার। তার মনে হয়েছে, মুঠোর ভেতর কামড়ে দিয়েছে জিনিসটা। ‘হায়, যিশু! আরেকটু হলে মরে যেতাম!’

‘সামান্য রিকয়েল, কেন্সিংটন। সিলিণ্ডারের ভেতর আরও চারটে গুলি আছে। ঠিকমত তাক করে বোতলে লাগান।’

আরও চারবার ট্রিগার টিপল কেন্সিংটন। বাম হাতের আঙুল গুঁজে দিয়েছে কানের ফুটোর ভেতর। দ্বিতীয় ও তৃতীয় গুলি লাগল না বোতলে। চতুর্থ গুলি খানিকটা সরিয়ে দিল বোতলটাকে। পঞ্চমটা ফুটো করল বোতলের পেট।

‘খারাপ নয়,’ বলল রানা। ‘জমির শেখ স্থির দাঁড়িয়ে থাকলে ভয় পেতে হবে তাকে।’

‘মানুষকে গুলি করব, এ কথা শুনতেও চাই না,’ বলল কেন্সিংটন।

তার হাত থেকে রিভলভারটা নিয়ে সিলিণ্ডার খুলল রানা। বের করল পাঁচটা গুলির খালি খোসা। ওগুলো পকেটে রেখে আবারও রিভলভারে ভরল পাঁচটা তাজা গুলি। সিলিণ্ডার ক্লিক আওয়াজে আটকে অস্ত্রটা আবার ধরিয়ে দিল কেন্সিংটনের হাতে। নিজের ঊরুর পকেটের ওপর চাপড় দিয়ে বলল, ‘সবসময় সঙ্গে রাখবেন। আমিও তা-ই করেছি।’

‘সামনে জমির শেখের সঙ্গে দেখা হবে, তাই না?’ নার্ভাস সুরে জানতে চাইল কেন্সিংটন।

‘যে-কোনও সময়ে,’ বলে জিপের দিকে পা বাড়াল রানা। ‘বোতলটা কুড়িয়ে নিন। আমরা এখানে এসেছি, তার প্রমাণ রাখা উচিত নয়। জলদি করুন। এবার রওনা হব।’

ছেচল্লিশ

আকাশ বেয়ে অনেক ওপরে উঠেছে সূর্য। নতুন করে ফিরেছে নরকের প্রচণ্ড তাপ। খিদে না লাগলেও দৈহিক শক্তি ধরে রাখতে শুকনো ফল ও শুষ্ক মাংস খেল রানা ও কেন্সিংটন। তিনঘণ্টা পর বিশ্রামের জন্যে থামল একগাদা পাথরের খণ্ড ও কাঁটাঝোপের মাঝে। ছায়া খুঁজে নিয়ে বসে মৃদু উষ্ণ পানি দিয়ে গলা ভেজাতে গিয়ে বুঝল, ওই পানি আসলে স্বর্গের সুধা। রোদ থেকে বাঁচতে মাথার চারপাশে বেদুঈন স্কার্ফ জড়িয়ে নিয়েছে রানা। ওকে অনুকরণ করেছে কেন্সিংটন। চুপচাপ মানচিত্রে চোখ বোলাল বিসিআই এজেন্ট। এরপর ফোনের জিপিএস লোকেটর ব্যবহার করে কষে নিল কিছু হিসাব।

‘আমরা তা হলে এখন কোথায়?’ জানতে চাইল কেন্সিংটন।

‘লেক নাসের পেছনে ফেলে চলেছি দক্ষিণ-পশ্চিমে। আশপাশেই কোথাও আছে আবু সিমবেল।’

‘আবু সিমবেল,’ আউড়াল কেন্সিংটন। ‘ওখানেই আছে দ্বিতীয় রামসেসের বিশাল মন্দির।’

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘তার চেয়েও জরুরি তথ্য হচ্ছে, পৌছে গেছি সুদানিয সীমান্তের কাছে। এরপর আরও সতর্ক হতে হবে। সীমান্ত রক্ষীদের গুলিতে না মরলেও বিপদ আসতে পারে বিদ্রোহীদের তরফ থেকে। একবার কিডন্যাপ হলে, ধরে নেবেন খুন হয়ে গেছি আমরা। মুক্তিপণ পেলেও জিম্মিকে প্রাণে বাঁচতে দেয় না ওরা।’

ফ্যাকাসে হলো কেন্সিংটনের মুখ। টু শব্দ করল না। ল্যামিনেটেড মানচিত্র হাতে উঠে দাঁড়াল রানা। উত্তর থেকে বইছে মৃদু হাওয়া। বেদুঈন স্কার্ফ সরাতেই ওই ঝিরঝিরে বাতাসে একটু ঠাণ্ডা হলো মাথার তালু। ঢালু অথচ সমতল একটা পাথরের চাতালে উঠে সামনের জমিন দেখল রানা। এলাকাটা রুক্ষতার দিক থেকে প্রায় মঙ্গল গ্রহের মত। সবুজের চিহ্ন নেই। ফাঁকা পড়ে আছে মাইলের পর মাইল। জমির শেখের কথা মনে পড়ল ওর। অন্তত পাঁচ ঘণ্টা এগিয়ে আছে লোকটা। হয়তো এরই মধ্যে সঠিক এলাকায় পৌঁছে খুঁজছে গুপ্তধন। রানার মনের আয়নায় দেখা দিল রূপসী লিণ্ডা। অদ্ভুত মিষ্টি হাসিটা এখন কেমন যেন ম্লান।

টয়োটার কাছ থেকে আর্তচিৎকার শুনে চটকা ভাঙল রানার। ঝট্ করে ঘুরে দেখল, দুই হাঁটুর মাঝে ডানহাত রেখে দুলে দুলে নেচে চলেছে কেন্সিংটন। ব্যথায় লাল হয়েছে মুখ।

ঢালু চাতাল বেয়ে দৌড়ে নেমে তার কাছে পৌঁছুল রানা। ‘কী হয়েছে?’

ফ্যাকাসে চেহারায় ডানহাত দেখাল কেন্সিংটন। হাতটা থরথর করে কাঁপছে। রক্তাক্ত।

‘সাপ?’ জানতে চাইল রানা।

চোর-চোর চেহারা করল কেন্সিংটন। ‘কাঁটা বিঁধেছে।’

‘বসে পড়ন।’

ইতিহাসবিদ থপ করে বসতেই তার হাতের তালু পরীক্ষা করল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, ‘শক্ত হয়ে বসুন। ব্যথা লাগবে।’ কাঁটার ওপরের দিক শক্ত করে ধরল রানা, তারপর হ্যাঁচকা টানে তুলে নিল মাংসের গভীর থেকে।

করুণ আর্তনাদ ছাড়ল কেন্সিংটন। কাঁটাটা কাছ থেকে দেখল রানা। দৈর্ঘ্যে ওটা কমপক্ষে এক ইঞ্চি। কাঁটা দূরে ফেলে রক্তাক্ত ফুটো পরীক্ষা করে দেখল রানা।

ব্যথায় হাত টেনে নিতে চাইল ইতিহাসবিদ। ‘বাদ দিন! ঠিক হয়ে যাবে! কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখলেই…’

মাথা নাড়ল রানা। ‘মরুভূমির পরিবেশে সামান্য ক্ষতও খুব দ্রুত পচতে শুরু করে।’

‘কিছুই তো করার নেই। আপনি তো আর ওষুধ কেনেননি।’

‘কিনেছি,’ টয়োটার পাশে গেল রানা। কী যেন খুঁজছে চামড়ার ঝুলির ভেতর। একটু পর ফিরল মধুর জার হাতে।

‘আপনি আমার হাতটা পাউরুটি ভেবেছেন যে মধু মাখিয়ে নিয়ে চিবিয়ে খাবেন?’ বিরক্ত হয়ে বলল কেন্সিংটন। ‘মধু দিয়ে কী হবে?’

জারের ঢাকনি খুলে ভেতরে তর্জনী ঢোকাল রানা, তারপর মধু মাখা আঙুলটা বোলাল কেন্সিংটনের ক্ষতের ওপর। বলল, ‘তা হলে দেখছি আমাদের মিস্টার লেকচারার প্রাচীন মিশর সম্পর্কে সবকিছু জানেন না।’

‘ঠাট্টা বাদ দিন তো!’

‘পেনিসিলিন নয়, মানুষের আবিষ্কার করা সেরা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ওষুধ হচ্ছে মধু,’ বলল রানা। ‘সেটা হাজার হাজার বছর আগেই জানত মিশরীয়রা।’ জারের ঢাকনি আটকে নিল ও। ‘এবার কাপড় দিয়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দেব। এরপর কাঁটা নিয়ে আর খেলতে যাবেন না।

একটু পর আবার শুরু হলো দীর্ঘ যাত্রা। শেষ বিকেলে ওরা পেরোল অনির্ধারিত সীমান্ত। দু’জন এখন হয়ে গেছে সুদানে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। আশপাশে কোথাও দেখা গেল না আর্মি পেট্রল। আছে শুধু দিগন্ত জুড়ে বালির সাগর ও ছোটবড় পাথরের দ্বীপ। মাথার ওপর আগুন ঢালছে সাদা সূর্য। যেন শেষ নেই এই দীর্ঘ যাত্রার। নাচতে নাচতে, দুলতে দুলতে, লাফ দিতে দিতে এগিয়ে চলল ওরা। পিৎযার অভেনের মত গরম টয়োটার ভেতরটা, ধীরে ধীরে একেকজন হয়ে উঠল প্রায় সেদ্ধ মানবমূর্তি। সন্ধ্যা নেমে যাওয়ার পর আবারও এল বরফের মত ঠাণ্ডা রাত। পাথুরে উপত্যকাগুলো থেকে এল পালকে পাল শেয়ালের হুক্কা হুক্কা।

পরের ভোর থেকে শুরু হলো আবারও এগিয়ে চলা। পেরোল আরেকটা দিন। মাঝে গাড়ি থামিয়ে খাবারের জন্যে বা বিশ্রামের সময় বারবার মোবাইল ফোনের জিপিএস মিলিয়ে দেখল রানা। নতুন করে ঠিক করে নিল হিসাব। মানকাউয়ার অভিযাত্রা ছিল প্রথমে দক্ষিণে, তারপর পশ্চিমে। কিন্তু আড়াআড়ি ভাবে এগিয়েছে রানা। এভাবে জ্যামিতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছুনো খুব কঠিন। তবে প্রাচীন মানচিত্রের কো-অর্ডিনেট্স-এর কারণে রানা বুঝল, ওরা প্রায় পৌঁছে গেছে সঠিক এলাকায়। খুব কাছেই কোথাও আছে ওই গুপ্তধন। মনে মনে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে রানা।

কিন্তু আসলে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন মানকাউয়া তাঁর সাধের ধন?

শেষ বিকেলে শুকনো এক নদীর খাতে ঢুকল ওদের টয়োটা। এই খাত হয়তো এমনই আছে লাখ লাখ বছর ধরে। এঁকেবেঁকে গেছে শুকনো নদী। ক্রমেই ওপরে উঠেছে দু’দিকের পাথুরে পাড়। আরও কিছুক্ষণ যাওয়ার পর নদী খাত হলো সরু, গভীর ক্যানিয়ন। এখন আর ঘুরে অন্যদিকে যাওয়া অনর্থক। চরম বিরক্তি নিয়ে এগিয়ে চলল রানা। সামনে বাঁক নিয়েছে ক্যানিয়ন। জিপ নিয়ে ওদিকে পৌঁছেই ব্রেক কষে থামল ও।

ঘুমের ঘোরে ঝিমাচ্ছে উইলিয়াম কেন্সিংটন। গাড়ি থেমেছে টের পেতেই জড়ানো কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘কী হলো?’

জবাব দিল না রানা।

ক্যানিয়নের সাড়ে তিন শ’ গজ দূরে আকাশে মাথা তুলেছে পাথুরে, উঁচু এক কালো রিজ। ওটার কোনও চূড়া নেই, মাথা সমতল ও মসৃণ। তবে রিজের মাঝে ভি আকৃতির বিশাল এক ফাটল। ওদিক দিয়ে চোখে পড়ে বহু দূরের দিগন্ত। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দৃশ্যটা দেখল রানা। তারপর কপালের ওপর হাত রেখে তাকাল সোনালি বলের মত সূর্যের দিকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে বলে দ্রুত নেমে আসছে সুয্যি মামা সরাসরি ফাটলের দিকে। বড়জোর দশ মিনিট পর ঢুকে পড়বে ইউ আকৃতির খাঁজের মাঝে।

প্রাচীন আমলে দিগন্ত বোঝাতে যে হায়ারোগ্লিফ ব্যবহার করেছেন মিশরীয় প্রধান পুরোহিত মানকাউয়া, ওই খাঁজ বা ফাটল দেখতে ঠিক তেমন!

রানার মনে পড়ল, সে-রাতে ভাদিমের স্টাডিরুমে ঠিক এ কথাই বলেছিল ও। সাধারণ কোনও সিম্বল বোঝাতে চাননি মানকাউয়া। আক্ষরিক অর্থে দেখাতে চেয়েছেন, ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে আখেনাতেনের কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া সম্পদ।

‘কেন্সিংটন, আমরা বোধহয় পৌঁছে গেছি।’

‘কী? কোথায়?’

‘সামনে দেখুন।

দূরে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকাল ইতিহাসবিদ। এক সেকেণ্ড পর বুঝল সব। ‘হায়, আমার পবিত্র যিশু! আপনি ঠিকই বলেছেন, রানা! আমরা পৌছে গেছি সঠিক জায়গায়!’ সূর্যের সোনালি গোলক আর ইউ আকৃতির ফাটলের দিক থেকে চোখ সরাতে পারল না সে। তবে কয়েক মুহূর্ত পর দরজা খুলে লাফ দিয়ে নামল গাড়ি থেকে। ‘হ্যাঁ, এটাই তো সেই ল্যাণ্ডমার্ক! এখানেই আছে ধর্মদ্রোহী ফেরাউনের চুরি যাওয়া গুপ্তধন! ওই রিজের ভেতর বা নিচে পাব সব! ওখানে নিশ্চয়ই কোনও গুহা বা সুড়ঙ্গ আছে!’

রিজের দৃশ্যটার দিকে চেয়ে মোহাবিষ্ট মানুষের মত পা বাড়াল কেন্সিংটন।

‘থামুন,’ পেছন থেকে ডাক দিল রানা, ‘অপেক্ষা করুন।’

‘কেন?’ স্বপ্নালু কণ্ঠে বলল ইতিহাসবিদ।

ষাট ফুট দূরে বালির মেঝেতে আঙুল তাক করল রানা, ‘ওদিকটা দেখুন।’

রিজের দিকে যাওয়ার পথে পড়বে জায়গাটা। ওখানে বালিতে একটা গর্ত। পাশে মরুভূমির প্রাণী ফেনেক শেয়ালের লাশ। বোধহয় মারা পড়েছে গতকাল। ছিন্নভিন্ন দেহ। পচতে শুরু করেছে মাংস। তার চারপাশে মেঘের মত ঘন হয়ে ভনভন করে উড়ছে অসংখ্য মাছি। ছড়িয়ে পড়া বালি ও পাথরের সঙ্গে মিশে আছে টুকরো টুকরো কালো ধাতু।

‘ল্যাণ্ড মাইন,’ মন্তব্যের সুরে বলল রানা।

‘ল্যাণ্ড মাইন?’

‘বছরের পর বছর এই এলাকা ছিল রণক্ষেত্র। মাইন পুঁতে রাখলেও পরে আর সরিয়ে নেয়নি কেউ।’

ঘুরেই পা টিপে টিপে আবারও গাড়ির পাশে পৌঁছুল কেন্সিংটন। জিপে উঠে ধুম্ করে আটকে নিল দরজা। হাঁফাচ্ছে এক শ’ মাইল দৌড়ে আসা ম্যারাথনের প্রতিযোগীর মত। ‘হায়, যিশু! আরেকটু হলে খুন হয়ে যাচ্ছিলাম! এ তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার!’

‘আফ্রিকা এমনই,’ বলল রানা।

‘কোথায় থাকতে পারে এসব মাইন?’

‘যে-কোনও জায়গায়,’ বলল রানা। ‘কেউ বলতে পারে না আমাদের চারপাশে নেই। পা দেয়ার আগে বোঝার উপায় থাকবে না।’

‘তা-ই? তা হলে এখন কী করতে হবে?’

‘সেটাও কি খুলে বলতে হবে?’

‘তা হলে এটা কী হলো,’ করুণ সুরে বলল কেন্সিংটন। ‘এত দূর এসে শেষে ফিরে যাব? দেখতে পাব না আখেনাতেনের গুপ্তধন?’ হঠাৎ মাথা নাড়ল সে। ‘ক্যানিয়নের একদিকের দেয়াল ধরে এগিয়ে গেলে?’

মাথা নাড়ল রানা। ‘দু’দিকের দেয়াল অনেক খাড়া। পাশ দিয়ে যেতে পারে যে-কেউ, তাই ওসব জায়গায় মাইন পুঁতে রাখার কথা ভাববে যে-কোনও দক্ষ সৈনিক। বাকি থাকল মাত্র একটা কাজ।’

‘সেটা কী? ফিরে যাব? নাহ্! সেটা হতে পারে না।’ প্রায় কেঁদে ফেলল কেন্সিংটন।

‘এক এক করে মাইন খুঁড়ে তুলতে হবে,’ বলল রানা। ‘মনে মনে প্রার্থনা করতে হবে, বড় কোনও মাইনে যেন পা না পড়ে।’

হাঁ হয়ে গেল কেন্সিংটন। ঢোক গিলল। ‘বড়ও আছে?’

‘ওগুলো পঁচিশ কিলোগ্রামের হাই-এক্সপ্লোসিভ, সলিড ধাতুর কেসিঙের ভেতর থাকে,’ বলল রানা। ‘ফস্কা বালি থেকে তুলে আনা খুব কঠিন। তা ছাড়া, কয়েক বছর পড়ে থাকার পর এর মতিগতি হয়ে ওঠে দুর্বোধ্য। ওগুলোর বিশ্রী একটা বদভ্যাস হচ্ছে সামান্য কারণে যখন তখন আচমকা বিস্ফোরিত হওয়া।’

কথা শুনে গাল কুঁচকে ফেলল কেন্সিংটন। ‘এ তো ভাবাই যায় না! তা হলে তো মরেই যাব!’

রানা কিছু বলার আগেই ক্যানিয়ন ভরে গেল ইঞ্জিনের আওয়াজে। কারা যেন গুলি করছে ‘কড়াৎ! কড়াৎ!’ শব্দে। দেরি না করে টয়োটা জিপ থেকে নেমে বড় একটা পাথরের বোল্ডারের আড়াল নিল রানা ও কেন্সিংটন।

সাতচল্লিশ

পেছনের বাঁক ঘুরে এইমাত্র হাজির হয়েছে দুটো অফ-রোড ট্রেইল মোটরসাইকেল। পরক্ষণে এল তৃতীয়টা। বিন্দুমাত্র গতি না কমিয়ে এবড়োখেবড়ো জমিতে ঝড়ের বেগে চলেছে তিন চালক। টু-স্ট্রোক ইঞ্জিনের ফ্যাট-ফ্যাট আওয়াজ জোর প্রতিধ্বনি তুলছে ক্যানিয়নের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে। গতি আরও বাড়াচ্ছে তিন চালক। দুই মোটরসাইকেলের পেছনে বেদুঈনদের পোশাক পরা একজন করে আরোহী। শরীর মুচড়ে একহাতে উযি সাবমেশিন গান থেকে গুলি করছে পেছনের কাদেরকে যেন লক্ষ্য করে।

ওয়ালথার হাতে পাথরের বোল্ডারের আড়াল থেকে রানা দেখল, এইমাত্র ওদেরকে পাশ কাটিয়ে তীর বেগে রিজের দিকে গেল তিন মোটরসাইকেল। ছোট ইঞ্জিনের ফ্যাট-ফ্যাট শব্দের ওপর দিয়ে এল অন্য আওয়াজ। ওটা একবার শুনলে ভুলবে না কেউ। তীক্ষ্ণ, উঁচু সার্বক্ষণিক ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ। অনেক দিন ওটা শোনে না রানা। আড়ষ্ট হয়েছে দেহের প্রতিটি পেশি। অনিবার্য হামলার জন্যে পেছনের বাঁকের দিকে চুপ করে চেয়ে রইল রানা।

বাঁক ঘুরে হাজির হলো মস্ত এক ট্যাঙ্ক। ওটা যেন ধূসর- সবুজ রঙের ইস্পাতের তৈরি কোনও ডাইনোসর। ক্যাচক্যাচ আওয়াজে ঘুরছে ক্যাটারপিলার। ক্যানিয়নের ভেতর প্রতিধ্বনি তুলছে প্রচণ্ড শক্তিশালী ইঞ্জিনের গর্জন। যন্ত্রদানবটার ওজন ছেচল্লিশ টন। না থেমে অনায়াসেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে তিন ফুট চওড়া কংক্রিটের দেয়াল। প্রস্থে বারো ফুট। দৈর্ঘ্যে বিশ ফুটেরও বেশি। এগোবার পথে প্রচণ্ড চাপ দিয়ে মুহূর্তে গুঁড়ো করছে ক্যানিয়নের মেঝেতে পড়ে থাকা পাথরগুলোকে। এদিক ওদিক ঘুরছে ট্যাঙ্কের ১০৫ এমএম স্বয়ংক্রিয় কামানের বিকটদর্শন নল। রানার মনে হলো, ওটা যেন চারপাশ দেখে নিচ্ছে। পরক্ষণে গর্জে উঠল কামান।

বুম্‌ম্‌ম্! আওয়াজে থরথর করে কেঁপে উঠল ক্যানিয়নের দু’পাশের দেয়াল। চোখে দেখা না গেলেও এক্সপ্রেস ট্রেনের মত ‘হুইশ’ আওয়াজে ক্যানিয়নের মাঝ দিয়ে গেল হাই- এক্সপ্লোসিভ শেল। ওটা ফাটল নিরেট পাথরের দেয়ালে লেগে। চারপাশে ছিটকে গেল ধোঁয়া ও আগুন। গভীর গর্ত থেকে হুড়মুড় করে নিচে নামল ছোটবড় পাথরের খণ্ড। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আকাশে ভেসে উঠল পেছনের মোটরসাইকেল। দুমড়ে-মুচড়ে কয়েক পাক খেয়ে দূরে গিয়ে পড়ল। চালক ও আরোহী আছড়ে পড়েছে পাথরের দেয়ালের ওপর।

রানার পায়ের কাছে চিত হয়ে শুয়ে পড়েছে কেন্সিংটন। দু’হাতে চেপে ধরেছে দুই কান। ভীষণ ভয়ে বিকৃত হয়েছে চেহারা। ওপর থেকে ওদের দেহে ঝরঝর করে নামল পাথরের কুচি, বালি ও ধুলো। অসহায় রানা দেখল, এইমাত্র লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মৃত চালকের কাছ থেকে সরে গেল মোটরসাইকেলের আরোহী। হাতে উষি। ওটা দিয়ে গুলি করল ট্যাঙ্কের দিকে। জবাবে খ্যাট-খ্যাট আওয়াজে গর্জে উঠল যন্ত্রদানবের হেভি মেশিন গান। ছুটতে গিয়েও মাঝ থেকে দু’টুকরো হলো মোটরসাইকেল আরোহী। মুহূর্তে সাদা জোব্বার জায়গায় জায়গায় দেখা দিল লাল ছোপ।

কী ঘটছে, বুঝে গেল রানা। বেদুঈন মিলিশিয়া বিদ্রোহী আর সুদানিয মিলিটারির যুদ্ধের মাঝে পড়েছে ওরা। তবে এবার ভারসাম্য নেই দুই পক্ষের। হাসতে হাসতে শত্রুপক্ষকে শেষ করছে আর্মি।

ক্যানিয়নের দূরে ঝড়ের বেগে পালিয়ে যাচ্ছে অন্য দুই মোটরসাইকেল। সামনের দ্বিচক্রযান হঠাৎ করেই উড়ে গেল। ভাঙা জঞ্জাল ও মানুষের দেহের ছিন্নভিন্ন টুকরো বৃষ্টির মত ঝরল ক্যানিয়নের মেঝেতে। এদিক থেকে গুলি হয়নি, ওই মোটরসাইকেলের চাকার নিচে বিস্ফোরিত হয়েছে কোনও পুঁতে রাখা মাইন।

আবারও গর্জন ছাড়ল কামান। মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে ক্যানিয়নের এক দেয়ালে লেগে বিস্ফোরিত হলো শেল। ওই ভাঙাচোরা জায়গাটা ঢেকে গেল ধুলো, বালি ও ধোঁয়ায়।

রিজের দিকে ছুটল অবশিষ্ট মোটরসাইকেলের চালক। ফাটলের মাঝে নেমে এসেছে সূর্য। ঠিক যেমন লেখা হয়েছে মানকাউয়ার মানচিত্রের গ্লিফে।

ক্যানিয়নের মাঝ দিয়ে তুমুল বেগে চলেছে ট্যাঙ্ক। টার্গেটে লক্ষ্যস্থির করতে গিয়ে খ্যার-খ্যার আওয়াজে ঘুরছে টারেট। আবারও কান ফাটানো শব্দে গর্জে উঠল কামান। মোটর- সাইকেলের কয়েক ফুট সামনে রিজের গায়ে লাগল শেল। ভীষণ দুলে উঠল দ্বিচক্রযান। তবে কীভাবে যেন সামলে নিল চালক। গতি না কমিয়ে ভেগে যেতে চাইছে। আবারও গর্জন ছাড়ল মেশিন ক্যানন। এবার মোটরসাইকেল থেকে উড়াল দিয়ে রক্তাক্ত পুতুলের মত চালক গিয়ে পড়ল ক্যানিয়নের দূরের মেঝেতে। কাত হয়েছে মোটরসাইকেল। ছেঁচড়ে গিয়ে আগুনের ফুলকি তুলে কয়েক পটকান খেয়ে থামল।

অপ্রতিরোধ্য ভাবে চলেছে ট্যাঙ্ক। মাত্র কয়েক মুহূর্তে পৌঁছুল টয়োটা পিকআপের পেছনে। রানা বুঝল, ওটাকে পাত্তা দেবে না ট্যাঙ্কের ড্রাইভার। সত্যিই কমল না গতি। বারো ফুট চওড়া শরীর নিয়ে জিপের ওপর চেপে বসল ক্যাটারপিলার ট্র্যাক। কাত হয়ে ওপরে উঠল ছেচল্লিশ টনি ট্যাঙ্কের বামদিক, তারপর সামনের ভঙ্গুর ডিমের মত বাধা পিষে এগোল। ট্যাঙ্কের চালক পাত্তাই দেয়নি জিপগাড়িটা। রানা দেখল, চেপ্টে যাওয়া মোচড়ানো ধাতু ছাড়া ওখানে আর কিছুই নেই!

ভীষণ আতঙ্ক নিয়ে রানার দিকে তাকাল কেন্সিংটন। ট্যাঙ্কের ইঞ্জিন ও ক্যাটারপিলারের আওয়াজের ওপর দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘শেষ হয়ে গেলাম আমরা!’

রানা কিছু করার আগে পকেট থেকে .৩৮ রিভলভার বের করেই ট্যাঙ্কের দিকে তাক করল ইতিহাসবিদ।

গুলি করা হলে কী ঘটবে, ভাল করেই জানে রানা। পিস্তল হাতে কেউ ট্যাঙ্কের সঙ্গে লড়তে গেলে সেটা হবে গুলতি দিয়ে খেপা ষাঁড় ঠেকানোর চেষ্টার মত। পুরু আর্মার প্লেটে লেগেই পিছলে অন্যদিকে যাবে .৩৮ ক্যালিবারের বুলেট। আঁচড়ও পড়বে না ট্যাঙ্কের গায়ে। কিন্তু ভেতরের ক্রুরা ঠিকই শুনবে ওই আওয়াজ। কী ঘটছে দেখতে থামাবে ট্যাঙ্ক। রানা ও কেন্সিংটনের দিকে ঘুরবে টারেট। আর তারপর মাত্র দুই সেকেণ্ডে মেশিন গানের শত শত গুলিতে খতম হবে ওরা।

কিন্তু অসম্ভবও সম্ভব হয় কখনও কখনও। কেন্সিংটন ট্রিগার টিপে দিতেই গান টারেটের ধুলো ওড়াল .৩৮ রাউণ্ড। আর ঠিক একই সময়ে বিশাল আগুনের কুণ্ড তৈরি করে বিস্ফোরিত হলো দানবীয় ট্যাঙ্ক। কর্কশ ধাতব আওয়াজে ওটার গা থেকে উপড়ে নানাদিকে ছিটকে পড়ল ভারী আর্মার প্লেট।

প্রাণভয়ে পাথরের বোল্ডারের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল রানা ও কেন্সিংটন। থরথর করে কাঁপছে জমিন। নানাদিকে ছিটকে গেল শ্যাপনেল, বিচ্ছিন্ন ক্যাটারপিলার ট্র্যাক ও শত শত পাথর। ঠাস্ করে খুলে গেছে টারেটের হ্যাচ। নিচের গর্ত থেকে বেরোল কমলা রঙের আগুনের হলকা ও কালো ধোঁয়া। হ্যাচে উঠতে গিয়েও প্রচণ্ড যন্ত্রণায় দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে আবারও ট্যাঙ্কের ভেতর পড়ল জ্বলন্ত এক সৈনিক। দ্বিতীয় বিস্ফোরণে মাউন্ট থেকে ছিঁড়ে পড়ল টারেট। মৃত্যুর আগমুহূর্তে ক্যানিয়নের বালির মেঝেতে ডেবে গেল যান্ত্রিক দানবটা।

‘এক গুলিতে খতম করেছি শালাদের!’ খুশিতে রিভলভার বাতাসে নাচাল কেন্সিংটন।

কয়েক মুহূর্ত পাথরের মত থম মেরে থেকে রানা বুঝে নিল, আসলে কী ঘটেছে। ইতিহাসবিদের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনার মন খারাপ হবে, কিন্তু ওই ট্যাঙ্ক ধসিয়ে দিয়েছে বড় ধরনের ল্যাণ্ড মাইন।’ ওর ধারণা, ওটার ভেতর ছিল অন্তত পঞ্চাশ কেজি হাই-এক্সপ্লোসিভ। ওরা দু’জন টয়োটা নিয়ে আর একটু এগোলে মুহূর্তে মিলিয়ে যেত বাতাসে। কপাল জোরে বেঁচে গেছে ওরা। আস্তে করে শ্বাস ফেলল রানা।

‘ঘটনা যা-ই হোক, ভাবতে ভাল লাগছে আমার গুলিতেই এতবড় গাড়ি নষ্ট হয়েছে,’ বলল কেন্সিংটন। পাথরের বোল্ডারে উঠে দাঁড়াতে গেল সে, তবে বাহু ধরে তাকে বাধা দিল রানা।

‘একমিনিট। আরেকটু হলে খুন হতাম। আবার কী করে বসবেন, তার ঠিক নেই। রিভলভারটা ফেরত দিন।’ লোকটার হাত থেকে অস্ত্রটা প্রায় কেড়েই নিল রানা।

চুপচাপ বসে দু’মিনিট অপেক্ষা করল ওরা। তারপর পেরিয়ে গেল তৃতীয় মিনিট। জ্বলন্ত ট্যাঙ্কের লকলকে আগুনের পত-পত আওয়াজ ছাড়া মরুভূমি একদম নীরব। একটু পর রানা নিশ্চিত হলো, আশপাশে নেই সুদানি আর্মার্ড ডিভিশনের আরও ট্যাঙ্ক, আর্মার্ড ভেহিকেল বা সৈনিকবাহী লরি।

চতুর্থ মিনিট পেরোবার পর বুঝল, জীবিত মানুষ বলতে বিশাল এ এলাকায় রয়ে গেছে ওরা মাত্র দু’জন। পাথরের বোল্ডারের ওদিক থেকে বেরিয়ে ধোঁয়া ভরা রণক্ষেত্র দেখল রানা। একটু দূরে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়েছে টয়োটা। ওটা থেকে এমন কিছু নেই যেটা সংগ্রহ করতে পারবে। অস্ত্র, গুলি ও দরকারি সব ইকুইপমেন্ট… সব গেছে। ক্যানিয়নের বালির মেঝেতে কালচে ছোট ছোট দাগ। ওখানে পড়েছে বোতলের সব পানি। একটু পর সব শুষে নেবে তপ্ত বালি। কোথাও যাবে, সে সাধ্য নেই ওদের। কারণ কোনও ভেহিকেল নেই। বেল্টে ঝুলন্ত ক্যান্টিনে আছে অতি সামান্য পানি। ওটা একবার ফুরিয়ে গেলে নিদারুণ তৃষ্ণা নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে।

সকালে মরুভূমির মত বুক-গলা শুকিয়ে গেলে তখন ভাববে কী করা যায়, স্থির করল রানা। আপাতত রাতের আঁধার নামার আগেই খুঁজে নিতে হবে নিরাপদ কোনও আশ্রয়। নিশ্চয়ই ধারেকাছে কোথাও আছে জমির শেখ। ব্যস্ত হয়ে খুঁজছে গুপ্তধন। ওরও উচিত একই কাজ করা।

চোখ-মুখ থেকে ধুলো ঝাড়ল রানা। কেন্সিংটনের উদ্দেশে বলল, ‘চলুন, যাওয়া যাক।’ ক্যানিয়নের মেঝেতে নেমে রিজের দিকে চলল ওরা। ষাট গজ যাওয়ার পর পৌঁছুল এক মোটরসাইক্লিস্টের পাশে। মৃত বেদুঈনের একে-৪৭ রাইফেলের ফিতা কেটে দিয়েছে মেশিন গানের একটা বুলেট। অস্ত্রটা পড়ে আছে কয়েক ফুট দূরে। সামনে বেড়ে ওটা তুলে নিল রানা। বাঁটে লোহার পিনের কারুকাজের ভেতর বসিয়ে নেয়া হয়েছিল ছোট কিছু মুক্তা। শাপনেলের আঘাতে বাঁকা হয়েছে ব্যারেল। কাজে লাগবে না অস্ত্রটা।

মূল্যহীন অস্ত্র ক্যানিয়নের মেঝেতে ফেলে তিক্ত মনে এগোল রানা।

রিজের ফাটলের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে সূর্য। কাঁপতে কাঁপতে ঝিলমিল করছে সোনালি গোলকের ওপরের অংশ। সরাসরি সামনে থেকে কড়া রশ্মি আসছে না বলে আকাশছোঁয়া পাথুরে টিলার রুক্ষ দেহ স্পষ্ট দেখল রানা।

আর দেখল বলেই হঠাৎ করে থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

কিছুক্ষণ আগেও রিজের গোড়ায় কালো ওই গুহামুখ ছিল না। ট্যাঙ্কের শেষ গোলার আঘাতে উড়ে গেছে সামনের অংশ। দেখা যাচ্ছে এবড়োখেবড়ো কালো গভীর একটা গর্ত। বহুকাল আগে পাথর ধসে বা বালিঝড়ে ঢাকা পড়েছিল ওটা।

রানার মত কেন্সিংটনও দেখতে পেয়েছে গুহামুখ। পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। পরক্ষণে ছুটে গেল গুহার দিকে। পায়ের নিচে ফস্কা বালি ও আলগা পাথর। কিছুই পাত্তা না দিয়ে ঢালু জায়গাটা বেয়ে গুহামুখের দিকে উঠল ওরা। আগে ওখানে পৌঁছুল রানা। সাবধানে উঁকি দিল ওদিকের অন্ধকারে।

‘একটা টর্চ দরকার,’ হাঁফাতে হাঁফাতে বলল কেন্সিংটন।

ঢালু জায়গা বেয়ে দৌড়ে নেমে গেল রানা। থামল গিয়ে মোটরসাইক্লিস্টের লাশের পাশে।

পেছন থেকে জানতে চাইল কেন্সিংটন, ‘ওখানে কী করছেন?’

জবাব না দিয়ে বালি থেকে নষ্ট একে-৪৭ রাইফেল নিল রানা। দেরি হলো না লাশের জোব্বার একটা অংশ ছিঁড়তে। কাপড়টা দীর্ঘ ফালি করে দশটা টুকরো করল রানা। পকেটে গুঁজল নয়টা ফিতা। অন্য কাপড়টা জড়িয়ে নিল রাইফেলের নলে। আবারও চলে গেল গুহামুখে কেন্সিংটনের সামনে। প্যান্টের পকেট থেকে লাইটার নিয়ে আগুন দিল রাইফেলের নলে জড়ানো ফালি করা কাপড়ে। জ্বলে উঠতেই মিটমিটে আলো ছড়াল ওর তৈরি মশালটা। পাথুরে গুহায় ঢুকে সাবধানে এগোল ওরা। একটু পর বুঝল, সাধারণ গুহা নয়। সামনে গেছে আঁকাবাঁকা দীর্ঘ সুড়ঙ্গ।

‘আমরা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছি,’ মন্তব্য করল কেন্সিংটন।

মাথা দোলাল রানা। ভূগর্ভে নেমেছে সুড়ঙ্গ। ফুরিয়ে এল কাপড়ের ফালি দিয়ে তৈরি সলতে। আরেকটা কাপড় রাইফেলের নলে পেঁচিয়ে আবারও আগুন জ্বেলে নিল রানা। নীরবে হেঁটে চলেছে ওরা।

পাথুরে সুড়ঙ্গের অনেক গভীর থেকে এল দীর্ঘ, নিচু গুমগুম আওয়াজ। ওপরের ছাত থেকে ঝরঝর করে ঝরল ধুলো ও বেশ কিছু ছোট পাথর। থমকে দাঁড়িয়ে গেল রানা। পাহাড়ি ধস হবে সেই ভয় পাচ্ছে।

পেরিয়ে গেল ভীতিকর কয়েক মুহূর্ত। থেমে গেল ধুলোবালির পতন। আবারও স্বাভাবিক হলো রানার শ্বাস- প্রশ্বাস। বিড়বিড় করে বলল, ‘মনে হচ্ছে ট্যাঙ্কের শেলের আঘাতে ওপরের রিজের ক্ষতি হয়েছে।’

এঁকেবেঁকে নিচে গেছে সুড়ঙ্গ। প্রাকৃতিক ভাবেই তৈরি। তবে রানা খেয়াল করল, কোথাও কোথাও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে চওড়া করা হয়েছে সুড়ঙ্গ। ওর মনে হলো, রিজের নিচে এক্সপিডিশন করেন প্রধান পুরোহিত মানকাউয়া। সেসময়ে বিশ্বস্ত অনুচরদেরকে দিয়ে আরও ভেতরে কোথাও লুকিয়ে ফেলেন গুপ্তধন। ভাল করেই জানতেন, যতই চেষ্টা করুন ধর্মদ্রোহী ফেরাউন, কখনও এই সুড়ঙ্গের হদিস পাবেন না তিনি।

‘আমার মনে হচ্ছে চিরকাল ধরে হাঁটছি,’ ফিসফিস করে বলল কেন্সিংটন।

‘সামনেই বাঁক,’ জানাল রানা।

কয়েক গজ যেতেই অবসান হলো সংকীর্ণ সুড়ঙ্গের। সামনে চওড়া জায়গা। নিভু নিভু মশালে আরেক ফালি কাপড় জড়িয়ে নিল রানা। আগের চেয়ে বেশি আলো দিল আগুনের শিখা। মাথার ওপর রাইফেল তুলে ধরতেই চমকে গেল ওরা।

‘হায়, যিশু! দেখুন কাণ্ড,’ বিড়বিড় করল কেন্সিংটন।

চুপ করে ওপরের দিকে চেয়ে রইল রানা।

আটচল্লিশ

বিশাল গুহার ছাত বহু ওপরে। আগুনের টিমটিমে আলোয় অবিশ্বাস্য, শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য দেখছে ওরা। জায়গাটা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ক্যাথেড্রালের চেয়েও বড়। কমলা শিখা পড়ে ঝিকমিক করছে নানা রঙের পাথুরে অপূর্ব সব শিল্প। তবে মানুষ তৈরি করেনি ওগুলো।

‘অকল্পনীয়,’ কয়েক পা সামনে বাড়ল কেন্সিংটন।

‘সাবধান,’ বাহু ধরে তাকে থামিয়ে দিল রানা। নিচের দিকে তাক করল রাইফেলের মশাল। একটু দূরেই শেষ হয়েছে মেঝে। ওখান থেকেই শুরু গভীর খাদ।

ওদিকে চেয়ে শ্বাস আটকে ফেলল কেন্সিংটন। ‘ওরেব্বাপরে!’

ওদের কয়েক ফুট দূরের গভীর খাদের নিচে ঘুটঘুটে আঁধার। তলা থেকে উঠেছে স্ট্যাল্যাগমাইট, একেকটা তীক্ষ্ণধার তলোয়ারের মত। একবার ওপর থেকে ওখানে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে খুন হবে যে-কেউ। রাইফেলের মশাল ওপরে তুলল রানা। মৃদু শিখার কমলা আলোয় ওরা দেখল, ছাতেও একই ধরনের বর্শার সারি। এদের বলে স্ট্যাল্যাকটাইট।

‘ওগুলো যেন প্রকাণ্ড কোনও দানবের দাঁত,’ ভীত কণ্ঠে ফিসফিস করল কেন্সিংটন। ‘জায়গাটা অনেকটা হাঙরের মুখের মত।’

‘হাঙর না, কুমির,’ মন্তব্য করল রানা। ‘আপনি দেখছেন জলদেবতা কুমির সোবেকের দাঁত। মনে নেই, ‘বারো ঘণ্টা জোর কদমে হেঁটে গেলে পাবে দিগন্ত। তারপর সোবেকের দাঁতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেলেই আছে সব। তাতেই অগ্রাহ্য করা হবে আমারনার ধর্মদ্রোহী পাষণ্ডকে।’’

রানার কথা বুঝতে পেরে চমকে গেল কেন্সিংটন। দূরে আঙুল তাক করল। ‘কিন্তু এই ফাটল তো অনেক চওড়া। পেরোব কী করে?’

কয়েক পা এগিয়ে খাদের কিনারায় থামল রানা। মশালের আবছা আলোয় ওর চোখে পড়ল, সামনে কী যেন। খেয়াল করতেই দেখল, অন্ধকার, গভীর খাদের ওপর দিয়ে গেছে দড়ির ঝুলন্ত সেতু। একটু সরে শক্ত হাতে পুরু দড়ি চেপে ধরল রানা। জিনিসটা শুকনো। মনে হলো না আচমকা ছিঁড়বে। ‘চলুন, যাওয়া যাক,’ বলল রানা।

‘জীবনেও না,’ আঁৎকে উঠল কেন্সিংটন। ‘দড়িটা তো হাজার হাজার বছর আগের। আমাদের ওজন নিতে পারবে না।

সেতুর ওপর রানা পা রাখতেই মড়মড় করে উঠল মেঝের কাঠের সরু খণ্ড। বয়সের কারণে ধূসর। গুহার ভেতর বিশ্রী কড়কড় আওয়াজ ছাড়ল প্রাচীন দড়ি। তবে ঠিকই ওজন নিচ্ছে রানার। আরেক পা এগোল ও। ঝুলছে খাদের ওপর। কেন্সিংটনের দিকে ঘুরে তাকাল রানা। ‘আপনি কি আসছেন?’

দ্বিধার ভেতর পড়ল ইতিহাসবিদ।

আরেক পা এগোল রানা। ‘তা হলে একাই গিয়ে আবিষ্কার করি গুপ্তধন।’

‘জীবনেও না!’ সব ভয় ভুলে দড়ির সেতুর কাঠের খণ্ডে পা রাখল কেন্সিংটন। মড়মড় আওয়াজ ছাড়ল সেতু। অন্ধকারে দুলছে এদিক ওদিক।

পেছনে ক্যাথেড্রালের মত জায়গাটা থেকে এল ভারী গুমগুম আওয়াজ। রানা ও কেন্সিংটনের মাথার ওপর ঝুলছে লাখ লাখ টন পাথর। একবার এবড়োখেবড়ো ছাতের দিকে তাকাল রানা। ভয় লেগে উঠল ওর। খারাপ কিছু হয়েছে হাজার হাজার বছরের গুহার ছাতের। ট্যাঙ্কের শেলের প্রচণ্ড আঘাত নড়িয়ে বা সরিয়ে দিয়েছে কাঠামো ধরে রাখা কিছু পাথর। তাতে হয়তো বড় কোনও ক্ষতি হবে না। অথবা, যে- কোনও সময় নামবে পাথর-ধস। সেক্ষেত্রে চিরকালের জন্যে এখানেই সমাধি হবে ওদের। ঘটনা যাই হোক, আসলে কী ঘটবে তা এই মুহূর্তে বোঝার উপায় নেই। সুতরাং, কাপুরুষের মত পালিয়ে না গিয়ে ওর উচিত এগিয়ে যাওয়া।

‘আমার মনে হচ্ছে হেঁটে চলেছি নরকের দিকে,’ কাঁপা গলায় জানাল কেন্সিংটন।

‘সত্যিই হয়তো তা-ই,’ বলল রানা।

ওপর থেকে এল পাথরের ঘর্ষণের গুমগুম আওয়াজ। ছাত থেকে খসে পড়ল ছোট কিছু পাথর। সেগুলোর একটা ফাটিয়ে দিল নিচের একটা স্ট্যাল্যাগমাইটের বরফ। অন্যগুলো হারিয়ে গেছে বহু নিচের গহ্বরে। তলা থেকে কোনও আওয়াজ এল না।

অবশ্য কয়েক সেকেণ্ড পর কানে এল অন্যরকম আওয়াজ। দূরে বয়ে চলেছে উচ্ছল জলধারা। রানার মনে পড়ল, সাহারা মরুভূমি যখন সবুজ স্বর্গের মত ছিল, সেসময়ে ওটার তলা দিয়ে বয়ে যেত পাতাল নদী।

দড়ির সেতু পেরুনো যেন হয়ে উঠল অনন্তযাত্রা। শেষ নেই এর। তবে কিছুক্ষণ এক পা এক পা করে এগোবার পর ওরা প্রায় পৌঁছুল ওদিকের পাড়ের কাছে। শেষ কয়েক কদম দৌড়ে এগোল কেন্সিংটন। মশালের আলোয় রানা দেখল, দরদর করে ঘামছে লোকটা। বড় একটা হাঁফ ছেড়ে বলল, ‘শেষপর্যন্ত পার হতে পেরেছি! অনেক ধন্যবাদ, যিশু!’

‘এখনই এত ধন্যবাদ না দিয়ে ফেরার পর দেবেন,’ বলল বেরসিক রানা।

‘এ কথা মনে না করিয়ে দিলেও পারতেন!’

জবাব না দিয়ে সামনের সুড়ঙ্গে ঢুকল রানা। রাইফেলের নলে আবারও আরেক ফালি কাপড় জড়িয়ে আগুন জ্বেলে নিল।

সামনের পথ প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ নয়। নিরেট পাথর কেটে তৈরি দীর্ঘ করিডোর। দু’পাশের দেয়ালে ফিকে হওয়া অদ্ভুত সব চিত্র মিশরীয় বলে মনে হলো না রানার।

‘জানি না কারা খুঁড়েছে এই প্যাসেজ,’ বলল কেন্সিংটন। ‘তবে কাজটা মানকাউয়ার নয়।’

‘আপনি শিয়োর?’

‘হ্যাঁ, একদম। ইমেজগুলো দেখুন। আগে কখনও এ ধরনের চিত্র দেখিনি। কোনও স্কলার দেখেনি। বহুকাল আগের

কোনও সভ্যতা তৈরি করেছিল। এই সুড়ঙ্গ। নুবিয়ান বা অন্য কোনও জাতি। তাদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, আর জানবও না। তবে কী করে এই জায়গা খুঁজে বের করলেন মানকাউয়া, ভাবতে গিয়ে অবাক লাগছে।’

জোর একটা গুমগুম আওয়াজের প্রতিধ্বনি শুনে ঝট্ করে ঘুরে তাকাল ওরা। ওদের বামের দেয়ালে খুব ধীরে তৈরি হচ্ছে লম্বাটে একটা ফাটল। নষ্ট হয়ে গেল অনেকগুলো চিত্র।

‘ব্যাপারটা ভাল লাগছে না,’ বিড়বিড় করল কেন্সিংটন। ‘ধসে পড়ছে গোটা পাহাড়।’

আরও চল্লিশ গজ যাওয়ার পর থামল প্যাসেজ। সামনে নিরেট পাথরের দেয়াল। চারপাশে প্রাচীন আমলের মাকড়সার ঝুল ও ধুলোবালি।

‘এটা ধরুন,’ রাইফেলের মশাল কেন্সিংটনের হাতে ধরিয়ে দিল রানা। সরাতে লাগল ফুটবলের মত বালি ভরা ঝুল। একটু পর ওর চোখে পড়ল পাথরের চাপড়ার মাঝে সামান্য ফাটল। ‘এদিকে আরও কিছু ছবি আছে। মনে হচ্ছে, এগুলো ইজিপশিয়ান।’

কেন্সিংটন সামনে বেড়ে চোখ সরু করে আগুনের আলোয় দেখল খোদাই করা কিছু হায়ারোগ্লিস্ ও চিত্র।

‘হায়ারোগ্লিফ্ পড়তে পারছেন?’ জানতে চাইল রানা। চোয়াল ঝুলে গেছে ইতিহাসবিদের। ‘হায়, ঈশ্বর!’

‘ঈশ্বরের সঙ্গে পরে কথা বলবেন, কী বুঝলেন সেটা বলুন,’ অধৈর্য সুরে বলল রানা।

ঘুরে ওকে দেখল কেন্সিংটন। ‘পরিষ্কার লিখে দিয়েছে: ‘আমুন এখন সন্তুষ্ট। অগ্রাহ্য করা হবে আমারনার ধর্মদ্রোহী পাষণ্ডকে। উপযুক্ত সঠিক স্থানে ফিরিয়ে দেয়া হবে সমস্ত ধনদৌলত।’ আমরা পেয়েছি গুপ্তধন! দেয়ালের ওদিকেই আছে!’

‘চলুন, নিজ চোখে দেখা যাক।’

‘কিন্তু ওদিকে ঢুকব কী করে?’

‘দেয়াল ফুটো করে,’ বলল রানা। কেন্সিংটনের হাত থেকে জ্বলন্ত রাইফেলটা নিয়ে ওটার বাঁট দিয়ে গায়ের জোরে দেয়ালে ঘা দিল ও। শক্ত কাঠের সঙ্গে পাথরের সংঘর্ষে ভারী আওয়াজ উঠল সুড়ঙ্গের ভেতর। এক ইঞ্চির দশ ভাগের এক ভাগ সরে গেছে পাথরের একটা চাপড়া। আবারও ওখানে রাইফেলের বাঁট নামাল রানা। তাতে নিভে গেল সাধের মশাল। চারপাশে নামল ঘুটঘুটে অন্ধকার। ‘পিছিয়ে দাঁড়ান, কেন্সিংটন,’ সতর্ক করল রানা। না দেখেও গায়ের জোরে আঘাত হানল দেয়ালের আগের জায়গায়। ঝরঝর করে খসে পড়ল কী যেন। পাগলের মত একের পর এক ঘা দিচ্ছে রানা। মড়াৎ শব্দে রাইফেলের বাঁট ভেঙে খসে পড়ল মেঝেতে। প্যান্টের পকেট থেকে আরেক ফালি কাপড় নিল রানা। জড়িয়ে নিল রাইফেলের নলের মুখে। লাইটার দিয়ে আবারও জ্বেলে নিল কাপড়।

মৃদু আলোয় যা দেখল, না হেসে পারল না। পাশের দেয়ালের নিচে তৈরি হয়েছে গর্ত। ওদিক দিয়ে ক্রল করে এগোতে পারবে মাঝারি আকারের লোক। নিচু হয়ে বসতেই রানা অনুভব করল, ভেতরের চেম্বার থেকে বেরোচ্ছে উষ্ণ হাওয়া। মশালের আলোয় ভাসছে লক্ষ-কোটি সূক্ষ্ম ধূলি-কণা।

‘এবার বোধহয় বড়লোক না হয়ে উপায় থাকল না,’ বলল কেন্সিংটন। ‘হুররে!’

বড় করে দম নিয়ে ক্রল করে গর্তের ওদিকের অন্ধকারে ঢুকল রানা। সোজা হয়ে বসে মশালের আলোয় দেখল চারপাশে ভাসছে কুয়াশার মত মিহি ধুলো।

হাঁসফাঁস করে গর্তের ভেতর দিয়ে এপাশে চলে এল কেন্সিংটন। লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করল, ‘কী দেখলেন, রানা?’

‘কিছুই দেখলাম না,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা।

কিন্তু ধুলো থিতু হতেই চারপাশের সবই চোখে পড়ল ওদের।

কুয়াশার মত আবছা দৃশ্য ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়েছে। ছায়ার ভেতর অদ্ভুত সব প্রাণীর মূর্তি। ওপরে মশাল ধরে ঘরের আরও ভেতরে এগোল রানা। অবশ্য ক’পা গিয়েই থমকে গেল। আটকে ফেলেছে দম। চোখ পিটপিট করে আবারও দেখল, অন্ধকার এই বিশাল কক্ষে বৃত্ত তৈরি করে বসে আছে কিছু মূর্তি। ঘোলাটে আলোয় নিখুঁত সেগুলোর অভিব্যক্তি। ঝিকঝিক করছে সোনার অঙ্গ। এসব মূর্তি মানুষের নয়, তারা নানান পশু-দেবতা। তাদের ভেতর আছে বাজপাখির মত চঞ্চুবিশিষ্ট রা দেবতা। আছে বেড়াল দেবী বেস্টেট। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে রেখেছে কুমিরের মত দেখতে জলদেবতা সোবেক। সারসের মত দেখতে দেবতা থোথ-এর মাথা। অত্যাচারী ফেরাউন আখেনাতেনের ভয়ে দূর দেশের এই কক্ষে অন্ধকারে আশ্রয় নিয়েছে পলাতক দেব-দেবীরা।

তাদের পায়ের কাছে অন্তত দশ ফুট উঁচু হাজার হাজার অমূল্য আর্টিফ্যাক্টের স্তূপ। অনায়াসেই ভরে যাবে বিশালায়তন কোনও মিউযিয়াম। একটা স্তম্ভমূলের ওপর দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টি মেলে রানা ও কেন্সিংটনের মতলব বোঝার চেষ্টা করছে সোনার তৈরি প্রমাণ সাইযের এক শেয়াল। চারপাশে সোনার কারুকাজ করা ডালা, ফুলদানী, অদ্ভুত সুন্দর সব কাপ, রঙিন দেব-দেবীর ছবি আঁকা পাথরের শবাধার, ভেতরে ঝিলিক মারা সোনার কয়েন, নানান ধরনের রত্ন, স্বর্ণের কবচ, দুল, আঙটি, কাঁকন ও মুকুট ছাড়াও রানা দেখল সোনার বাজপাখি, অ্যাস্ ও সোনার ঢাল। যেদিকে চোখ গেল, ঝিকঝিক করছে সোনার তৈরি অপূর্ব সুন্দর শৈল্পিক সব নিদর্শন। কয়েক হাজার বছরের ভেতর এগুলো স্পর্শ করেনি কেউ।

কর্কশ আওয়াজ বেরোল কেন্সিংটনের গলা চিরে। দৌড়ে গিয়ে সোনার তৈরি জিনিসপত্রে ভরা একটা ডালার ভেতর : ভরল হাত। দুই মুঠোয় তুলল বেশ কিছু আর্টিফ্যাক্ট। ওগুলো ঘষছে নাকে-মুখে আর বলছে, ‘পেয়েছি! পেয়েছি! আমি পেয়েছি! বড়লোক হয়ে গেছি!’ ডামবেলের মত ভারী, মস্ত এক সোনার বালা নিয়ে ওটার দিকে মোহ ভরা চোখে চেয়ে রইল। ওটা রেখে খপ করে ধরল সোনার একটা নেকলেস। গলায় ধরে বুঝতে চাইল তাকে মানাবে কি না। নেকলেস রেখে সোনার চকচকে কয়েনের ভেতর ডুবিয়ে দিল কনুই পর্যন্ত। মুঠো ভরে প্রাচীন মুদ্রা তুলে চোখের সামনে নিয়ে দেখতে লাগল। একেবারে বিহ্বল। আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঝনঝন করে ‘এত! পড়তে দিল কয়েনগুলোকে। ফিসফিস করল, অবিশ্বাস্য! সব তোমার, কেন্সিংটন!’

নিভু নিভু মশালের আলোয় রানা দেখল, মস্তবড় কক্ষের এক কোণ থেকে আরেক কোণে পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছে ইতিহাসবিদ। এটা স্পর্শ করছে, তো পরমুহূর্তে ওটা। ভুলেই গেছে ওরা আটকা পড়েছে মরুভূমির ভেতর একটা টিলার গভীরে। অস্ত্র বলতে কিছুই নেই। সভ্য জগতে ফেরার মত যানবাহন নেই। ক্যান্টিনের ভেতর রয়েছে সামান্য পানি। আগামীকাল চরম তৃষ্ণায় ফেটে যেতে চাইবে বুক। এদিকে এরই ভেতর হয়তো সুড়ঙ্গের মুখে পৌঁছে গেছে সুদানিয আর্মির শত শত সৈনিক ও অফিসার। অথবা হাজির হয়েছে বিদ্রোহী বেদুঈন মিলিশিয়াদের কোনও দল। কাউকে কিছু বলে লাভ হবে না। প্রাণ নিয়ে এখান থেকে রানা ও কেন্সিংটনকে বেরোতে দেবে না তারা।

সোনার বড় একটা মূর্তির গায়ে ঠেস দিয়ে মশাল রাখল রানা। পকেট থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে তুলতে লাগল চারপাশের ছবি। কাজটা শেষ হতেই ব্যবহার করল ভিডিয়ো ক্যামেরা মোড। কক্ষের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তুলছে ছবি। পুরো তিন শ’ ষাট ডিগ্রির ভিডিয়ো করল ও।

একরাশ আর্টিফ্যাক্ট থেকে লোভী চোখ তুলে জানতে চাইল কেন্সিংটন, ‘এসব করে কী হবে?’

‘প্রমাণ,’ বলেই সোনার একটা ভাণ্ডের ওপর থেকে একফুট দৈর্ঘ্যের সোনার একটা বাজপাখির দেব-মূর্তি নিল রানা। ওটা গুঁজে রাখল বেল্টে। ‘এবার পাহাড় ধসে পড়ার আগেই, চলুন, বেরিয়ে পড়ি।’

ভুরু কুঁচকে ফেলল কেন্সিংটন। ‘কিন্তু এগুলো? এসব ধনদৌলত…’

‘আমরা ওগুলো নিতে আসিনি,’ বলল রানা। ‘শুধু খুঁজে বের করতে এসেছি। জিনিসগুলো আমাদের নয়।’

‘আপনি কি বদ্ধ পাগল?’ বিস্মিত চোখে ওকে দেখল কেন্সিংটন। ‘হাতের মুঠোয় সব পেয়েও ছেড়ে দেবেন?’ রেগে গিয়ে ভুরু কুঁচকে বিসিআই এজেন্টকে দেখছে সে।

যে কাজে এসেছি, সেটা শেষ, এবার চলুন,’ গম্ভীর হয়ে গেছে রানা।

‘কীসের এত কাজ? এসব ফেলে চলে যাব? আমি কি আপনার মত উন্মাদ নাকি?’

গম্ভীর গুমগুম শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠল ছাত, মেঝে ও দেয়াল। আবারও থেমে গেল আওয়াজটা।

‘আমরা বরং বেরিয়ে গিয়ে আলাপ করি,’ বলল রানা। ‘নাকি আপনি চান লাখ লাখ টন পাথরের নিচে চাপা পড়তে?’

‘আমি বলি কী, পাহাড় ধস হওয়ার আগেই আমাদের উচিত যত বেশি সম্ভব আর্টিফ্যাক্ট নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া।’

‘সোনার কয়েন বা অন্যকিছু পকেট পুরতে এখানে আসিনি,’ বলল রানা। ‘জলদি চলুন।’ নলের মুখে আরেক ফালি কাপড় জড়িয়ে নিল ও। কাঁপা কাঁপা আবছা আলোয় দেখল দুঃখে একদম ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ইতিহাসবিদ।

দেয়ালের গর্তের মাঝ দিয়ে ক্রল করে প্যাসেজে বেরিয়ে এল ওরা। ফিরে চলল দড়ির সেতুর দিকে। সোবেকের দাঁতের জায়গাটা পেরোবার সময় রানা দেখল, বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে কেন্সিংটন। খাদ পার হয়ে ওদিকে পৌঁছে সুড়ঙ্গ- মুখের দিকে চলল রানা। একেবারেই পাত্তা দিচ্ছে না কেন্সিংটনকে। মনের ভেতর ঘুরছে অন্য চিন্তা।

কীভাবে পাড়ি দেবে নিষ্ঠুর মরুভূমি!

যোগাযোগ করতে হবে জন ব্রাউনের সঙ্গে।

জানিয়ে দিতে হবে ওরা পেয়েছে আখেনাতেনের গুপ্তধন।

আরও কিছু কাজ সেরে নিতে হবে ওকে।

ঢালু পথ বেয়ে ওপরে চলেছে রানা। পেছনে নাক দিয়ে ফোঁস-ফোঁস শব্দ তুলে আসছে কেন্সিংটন। এরই ভেতর পেছনে পড়ে গেছে সে। একটু পর সুড়ঙ্গ-মুখের কাছে মৃদু ঢালু জায়গাটায় পৌছে গেল রানা। এদিকের বাতাস তাজা ও শীতল। ওদের পাতাল অভিযানের ফাঁকে কখন যেন নেমেছে রাত। একটু দূরে সুড়ঙ্গ-মুখে পড়েছে চাঁদের রুপালি আলো।

থমকে দাঁড়িয়ে কেন্সিংটনের জন্যে অপেক্ষা করল রানা। তিন মিনিট পর লোকটা পৌঁছুতেই পকেট থেকে ৩৮ ক্যালিবারের রিভলভার বের করে তার হাতে দিল ও। ‘এটা নিজের কাছেই রেখে দিন। মনে কোনও কষ্ট নেবেন না। ঠিক আছে?’ সুড়ঙ্গ-মুখের দিকে এগোল রানা।

পেছন থেকে. অদ্ভুত কর্কশ স্বরে বলে উঠল কেন্সিংটন, ‘ওখানেই থামুন, রানা!

আরও কয়েক পা হেঁটে থেমে গেল রানা। খুব ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। চোখে কৌতূহল।

আগের জায়গায় পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে গেছে, কেন্সিংটন। হাতে উদ্যত রিভলভার। নল তাক করেছে রানার কপালের দিকে।

‘কী করছেন?’ বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইল রানা।

‘পিস্তলটা বের করে মেঝেতে রাখুন,’ চাপা স্বরে নির্দেশ দিল কেন্সিংটন। ‘খুব ধীরে। চালাকি করলে সঙ্গে সঙ্গে খুন হবেন।’

দ্বিধায় পড়ল রানা। তারপর সাবধানে তর্জনী ও বুড়ো আঙুল ব্যবহার করে কোমরে গোঁজা ওয়ালথার নিল। নামিয়ে রাখল পায়ের কাছে।

‘ভাল, এবার পাশে মোবাইল ফোনটাও রাখুন,’ মৃদু হাসল লোভী ইতিহাসবিদ। ‘পরে ওটা আমার কাজে লাগবে।’

পিস্তলের পাশে ঠাঁই পেল মোবাইল ফোন।

‘দেব-মূর্তি দিয়েই বা কী করবেন? ওটাও থাকুক ওগুলোর সঙ্গে,’ রানার বেল্টে গুঁজে রাখা সোনার মূর্তির দিকে চক্‌চকে চোখে চেয়ে আছে লোকটা।

বেল্ট থেকে মূর্তিটা নিল রানা। আর্টিফ্যাক্টটা মেঝেতে নামাতেই ভারী একটা ঠুং আওয়াজ হলো।

‘এবার সরে যান ওগুলো থেকে।’

কয়েক পা সরল রানা। ‘আপনি কিন্তু মস্তবড় ভুল করছেন।

‘যা করার ভেবেচিন্তেই করছি। দুঃখিত। তবে গুপ্তধনের খোঁজ কাউকে দেবেন, তা হতে দেব না। এসব শুধুই আমার।’

চুপ করে থাকল রানা।

‘ভাবলেন কীভাবে এত কষ্ট করেছি শুধু খ্যাতির জন্যে?’ মাথা নাড়ল কেন্সিংটন। ‘আপনার ধারণা, ওই খ্যাতি পাওয়ার জন্যে এসেছি আমি? না, রানা, খুব ভুল ভেবেছেন। মডাক বা আমি অ্যাকাডেমিক জার্নালে নাম তুলতে চাইনি। আপনার মত তো বুদ্ধ নই আমি যে…!’

‘বুঝলাম, ভুল করে আপনাকে ভালমানুষ ভেবেছি।’

‘আমি ভালমানুষ তাতে কোনও ভুল নেই। তবে নিজের স্বার্থ বুঝব না, এত বড় গাধাও নই। কাজেই এবার চিরবিদায় নেবেন আপনি। সত্যি, আমি সরি, রানা!’

‘মনে হচ্ছে না আপনি দুঃখিত। কেন মিথ্যা বলছেন?’ কাঁধ ঝাঁকাল মোটা ইতিহাসবিদ। ‘ঠিকই বলেছেন। কোনও দুঃখ নেই আমার মনে।’

‘কিন্তু এদিকে যে দুটো ঝামেলা হয়ে গেল?’ বলল রানা। ‘মরুভূমির ভেতর আটকা পড়েছেন। এখান থেকে প্রাণ নিয়ে বেরোবেন কী করে?’

‘জীবনটাই নানান চান্সের সমন্বয়। একটা না একটা পথ বের করে নেব। পরের সমস্যাটা কী, বলুন তো দেখি, রানা?’

‘ওটা আপনাকেই বুঝে নিতে হবে।’

‘ঠিক আছে। পরে বুঝে নেব। রানা, মারা যাওয়ার আগে প্রার্থনা করতে চান ঈশ্বরের কাছে?’

‘না, আপাতত নয়,’ বলল রানা।

মাথা দোলাল কেন্সিংটন। ‘বেশ। পরপারে ভাল থাকুন, রানা। গুড বাই। বড়লোক করে দিলেন বলে ধন্যবাদ।’

এবার চোখ বুজে নেয়নি সে, হাসতে হাসতে টিপল ট্রিগার। টার্গেট এতই কাছে, গুলি ফস্কে যাওয়ার উপায় নেই। রানা দেখল ঘুরছে রিভলভারের সিলিণ্ডার। ওপরে উঠছে ইণ্টারনাল হ্যামার। বুলেটের প্রাইমারের ওপর খট্ শব্দে পড়ল ফায়ারিং পিন।

সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ-মুখে জোরাল শোনাল আওয়াজটা। খট্!

রিভলভারের দিকে ঝট করে তাকাল কেন্সিংটন। আবারও টিপে দিল ট্রিগার। সিলিণ্ডার ঘুরে যাওয়ায় আবারও উঠল খট্ আওয়াজ।

চুপচাপ কেন্সিংটনের দিকে চেয়ে আছে রানা। চোখে-মুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। ‘আমি তো দেখছি এখনও বেঁচে আছি, বলল ও মৃদু কণ্ঠে। ‘দ্বিতীয় সমস্যাটা কী, সেটা কি বুঝতে পেরেছ, কেন্সিংটন?’

পর পর কয়েকবার ট্রিগার টিপে শুধু ‘খট্’ ‘খট্’ ‘খট্’ আওয়াজ পেল মোটা ইতিহাসবিদ। আতঙ্ক নিয়ে দেখল রিভলভারটা।

‘ট্রিগার টিপে লাভ হবে না, কেন্সিংটন,’ প্যান্টের পকেটে হাত ভরে কী যেন বের করল রানা। মুঠো খুলে দেখাল। ওখানে তামার কয়েকটা কার্ট্রিজ। ‘এটাই ছিল তোমার দ্বিতীয় সমস্যা। আগেই খালি করেছি রিভলভার।’

পিংপং বলের মত বড় হয়ে উঠল লোকটার দুই চোখ।

‘তোমাকে ভাল লোক ভেবেছিলাম, আসলে তুমি তা নও, বলল রানা, ‘আগেই বুঝেছি, গুপ্তধন পেলে যে-কোনও সময়ে চোখ উল্টে নেবে। যতই বড়লোকদের ওপর ঝাল ঝাড়ো, আমার চোখে পড়েছে, ভাদিমের ভিলা বা ফেরারির দিকে কোন্ দৃষ্টিতে চেয়েছিলে। এটাও মনে হয়নি খ্যাতির জন্যে এত কষ্ট করে আফ্রিকায় এসেছ। কাজেই সতর্ক না হয়ে পারিনি। নিজের স্বার্থেই শিখিয়ে দিয়েছি কীভাবে রিভলভার চালাতে হয়। এ-ও শিখিয়েছি, সিলিণ্ডার আর ফ্রেমের মাঝে তাকালে দেখা যায় গুলির রিম। ওতে বোঝা যায় অস্ত্রে গুলি আছে। কিন্তু তোমাকে এ কথাটা বলিনি, খালি গুলির খোসাও দেখতে আসল গুলির মতই দেখায়। খালি গুলির খোসা পাওয়ার জন্যে তোমাকে দিয়ে কয়েকটা গুলি করিয়ে নিয়েছি। আর এই সুযোগে গুলি করা প্র্যাকটিস করলে তুমি। ভাবলে, ঠিক সময়ে খতম করবে আমাকে। যাক্ গে, আমার কথাই ঠিক হলো। তুমি পড়লে সহজ এক ফাঁদে। মাথায় ঢুকছে আমার কথা, কেন্সিংটন?’

মুখ-চোখ কুঁচকে জবাব খুঁজছে ইতিহাসবিদ। কয়েক সেকেণ্ড পর তুতলে উঠে বলল, ‘আ…আমি মজা করেছি। আগেই তো জানি ভেতরে গুলি নেই।’

‘তা-ই?’

‘না… হ্যাঁ। আমি মনে করেছি…..

কড়াৎ শব্দে গর্জে উঠল রাইফেল। কেন্সিংটনের মাথার তালুর ওপরের অংশটা উড়ে গেল মুড়ি রাখার টিনের ঢাকনির মত। সুড়ঙ্গের দেয়ালে ছলাৎ করে লাগল একরাশ রক্ত। হাঁটু ভেঙে ধুপ্ করে মেঝেতে পড়ল বিশ্বাসঘাতক ইতিহাসবিদ। মেঝেতে পড়ে ঠং-ঠনাৎ শব্দে দূরে সরে গেল রিভলভার।

চমকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল রানা।

সুড়ঙ্গের মুখে চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে তিনজন লোক। তাদের একজনের হাতে একেএস অটোমেটিক ওয়েপন। ওটার মাযল থেকে এঁকেবেঁকে ওপরে উঠছে ধোঁয়া।

লোক তিনজনের মুখ দেখতে পাচ্ছে না রানা। মাঝের জনের দিকে তাকাল। এক মুহূর্ত পর বুঝল, লোকটা জঙ্গি– নেতা জমির শেখ!

ঊনপঞ্চাশ

নিঃশব্দে হাসল জমির শেখ। ‘যাক, আবারও দেখা হলো।’ মেঝেতে চাঁদের আলোয় পড়ে থাকা সোনার মূর্তির ওপর স্থির হলো তার চোখ। সামনে বেড়ে ছোঁ দিয়ে মূর্তিটা তুলল। চোখে বিজয়ীর দৃষ্টি। ‘তুমি দেখছি সবসময় এক পা এগিয়ে থাক।’ মৃদু হাসল। ‘জীবনে বহুত মানুষ খুন করেছ। আমার সত্যিকারের উপযুক্ত প্রতিযোগী। আজকাল খুব কমই পাওয়া যায় এ ধরনের লোক।’ হাতের ইশারায় উইলিয়াম কেন্সিংটনকে দেখাল জমির। ‘আর সেজন্যেই চাইনি ওই হোঁৎকা গাধাটা তোমাকে খুন করুক। ওই আনন্দ শুধু আমার প্রাপ্য।’

‘তোমার হাতে খুন হব শুনে খুব সম্মানিত বোধ করছি,’ শুকনো গলায় বলল রানা।

মুঠোর ভেতর শক্ত করে মূর্তিটা ধরল জমির। ‘তবে এত সম্মান পাওয়ার আগে, তুমি দেখিয়ে দেবে কোথা থেকে এল এই জিনিস।’

‘গুপ্তধন দেখালেও মরব, না দেখালেও, তা-ই না?’ বলল রানা। ‘সেক্ষেত্রে জায়গাটা চিনিয়ে আমার কী লাভ? তার চেয়ে মন দিয়ে শোনো আমার কথা। সাহায্য চাইলে একটা চুক্তি করো।’

‘মানুষ মরবে, তবে কীভাবে, তার ভেতর অনেক ভেদ আছে,’ বলল জমির শেখ। ‘কোনও কোনও মৃত্যু খুব সহজ। আবার এমনও আছে, যন্ত্রণা হবে সহ্যের অতীত। আশা করি আমার কথা বুঝতে পেরেছ?’

জবাব দিল না রানা। দু’ধরনের মৃত্যু থেকে যে-কোনও একটা বেছে নিতে বলা হয়েছে। এখন রাজি না হলে ধীরে ধীরে কষ্ট পেয়ে মরবে। অথবা, আদায় করতে পারবে সামান্য বাড়তি সময়। কপাল ভাল হলে সুযোগও জুটতে পারে বাঁচার। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করল না রানা। ‘ঠিক আছে, জমির। দেখিয়ে দেব কোথায় আছে গুপ্তধন।’

মাথার ইশারা করতেই জমিরের হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো দুটো কালো, মোটা ম্যাগলাইট ফ্ল্যাশলাইট। তার একটা রানার দিকে ছুঁড়ল জমির শেখ। ‘পথ দেখাও।’

খপ্ করে টর্চ ধরল রানা।

‘তাবির, চোখ রাখবি এই শুয়োরের বাচ্চার ওপর। কাদের, আমার পিছু নাও।’

চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে মেঝেতে জড় হওয়া রক্তের পুকুর। কেন্সিংটনের লাশ টপকে আবারও সুড়ঙ্গের গভীরে চলল রানা। এখন ওর হাতে শক্তিশালী টর্চ। দেখছে সুড়ঙ্গের অনেক দূর পর্যন্ত। ওর পিঠে একেএস রাইফেলের নল ঠেকিয়ে পিছু নিয়েছে তাবির। বয়স তার পঁচিশের মত। পেশিবহুল শরীর। তাবিরের পেছনে আসছে জমির। তাকে অনুসরণ করছে কালো রঙের ছোটখাটো কাদের।

চুপচাপ হাঁটছে সবাই। সুড়ঙ্গের প্রতিটা খাঁজ-ভাঁজ দেখছে টর্চের উজ্জ্বল সাদা আলোয়। রানার পিঠে খোঁচা দিচ্ছে অ্যাসল্ট রাইফেলের মাযল।

সুড়ঙ্গের ভেতর গমগম করে উঠল জমিরের কণ্ঠ: ‘জানো, রানা, ওই গুপ্তধন পেলে চিরকালের জন্যে পাল্টে দেব আমি এই দুনিয়া? ঠেকাতে পারবে না কেউ।’

‘ট্রেনে হামলা করে তো খুন করলে নিরীহ অনেক মানুষ। সাধারণ জঙ্গিদের মত খুন করে আর পোষাচ্ছে না তোমার?’

‘আমি যেটা করব, সেটা দেখে যেতে পারবে না তুমি, ‘ বলল জমির। ‘তবে যারা দেখবে, বাকি জীবনেও ভুলবে না।’

‘কালাশনিকভ রাইফেল আর সেমটেক্স কিনতে গিয়ে বিক্রি করবে চুরি করা আর্টিফ্যাক্ট,’ বলল রানা। ‘এটা নতুন কিছু নয়। ধরে নেয়ার কোনও কারণ নেই যে এতে বদলে যাবে পৃথিবী। শেষ পর্যন্ত পালাতে হবে তোমাকে। ঢুকবে গিয়ে ছুঁচোর গর্তে। আর মরবেও ওখানে।’

‘কালাশনিকভ বা সেমটেক্স বাচ্চাদের খেলনা, রানা,’ বলল জমির। ‘আমি অন্য কিছু করব। শুনবে?’

‘আমাকে না বললে পেটের ভাত হজম হচ্ছে না তোমার?’

কর্কশ হাসল জমির। ‘কেমন হয় রিয়াদ, ওয়াশিংটন, তেল আবিব, তেহরান আর লণ্ডন শহর আণবিক বোমার আঘাতে গুঁড়িয়ে দিলে?’

গড়গড় করে বলতে লাগল জমির, কীভাবে সংগ্রহ করবে আণবিক মিসাইল আর তারপর কী করবে ওগুলো দিয়ে।

হাঁটতে গিয়ে একবার হালকা হোঁচট খেল রানা। চুপ করে আছে।

কথা ফুরিয়ে আসতেই খুশি খুশি স্বরে বলল জমির, ‘এবার তো বুঝতে পারলে, কার সঙ্গে লাগতে এসেছিলে?’

‘আমার মনে হয় না সফল হবে তুমি,’ বলল রানা।

‘কেন সফল হব না? কে পাহারা দেবে রিয়াদ? ওটা ধুলোয় মিশে গেলে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে না সৌদি আরব? আমেরিকা আর ইজরায়েল এগিয়ে আসবে না তাদের পরম মিত্র বাদশাজাদাকে সাহায্য করার ছলে প্রাণের শত্রু অবাধ্য ইরানকে ধ্বংস করার মহান ব্রত নিয়ে? ঠিক তখনই ওয়াশিংটন ডিসি ও তেল আবিবে বোমা পড়লে কার দোষ হবে শুনি? ইরানের না? কাজেই তেহরানে ফাটবে চতুর্থ বোমা। প্রভুভক্ত ইংল্যাণ্ড ছুটে যাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে। ঠিক তখনই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেব আমি লণ্ডন শহর। কী বুঝলে?

চুপচাপ হাঁটছে রানা। মনে মনে বলল, ‘তুমি সফল হবে না, জমির। কারণ তোমাকে সফল হতে দেব না আমি কিছুতেই। এসবের আগেই আমার হাতে মরবে তুমি।’

‘চুপ করে কী ভাবছ?’ জানতে চাইল জমির।

‘নিজের দেশ ছাড়া আর কোনও দেশের কথা ভাবছি না, বলল রানা। ‘দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ী; মাথানষ্ট ইসলামি, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান জঙ্গি— কারও প্রতি আমার কোনও সহানুভূতি নেই। তবে কোটি কোটি সাধারণ নিরীহ মানুষের সর্বনাশ করে দেবে তোমার মত একটা ইঁদুরের হাগু, সেটা আমি হতে দেব না।’

‘তুমি কি জানো, এসব বলছ বলে এখনই তোমাকে খুন করতে পারি?’ থমথমে কণ্ঠে বলল জমির।

‘তা হলে সামনের জটিল সুড়ঙ্গে ঢুকে ঘোরাঘুরিই সার হবে, বাকি জীবনেও খুঁজে পাবে না আখেনাতেনের গুপ্তধন,’ গম্ভীর স্বরে জানিয়ে দিল রানা। ওদিকে আছে শত শত নকল দরজা আর প্যাসেজ।’ ভাবার জন্যে সময় লাগবে ওর। খুঁজে বের করতে হবে কীভাবে রক্ষা পাবে জমিরের খপ্পর থেকে। এক বছরেও আসল সুড়ঙ্গ চিনবে না। খুন করো আমাকে, তারপর বাকি জীবন কেঁদে বেড়াও ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে।’

প্রচণ্ড রেগে গেলেও চাপা স্বরে বলল জমির, ‘তুই মরবি, মাসুদ রানা! চুপ করে হাঁটতে থাক!’

ভাবছ তোমাকে ভয় পাই?’ মৃদু হাসল রানা। ‘আমি মরলে বাদুড়ের বমিও খুঁজে পাবে না। আর গুপ্তধন পাবে না বলেই তোমাকে পাত্তা দেবে না রাশান আণবিক মিসাইল বিক্রেতারা। আর কখনও যোগাযোগই করতে পারবে না তাদের সঙ্গে। তারপরও বেশি বাড়াবাড়ি করলে ব্যবস্থা নেবে তারা। মরার আগে ভয়ের চোটে তোমার নোংরা পাতলুনের ভেতর ছ্যার-ছ্যার করে প্রস্রাব করে দেবে তুমি।’

জবাব দিতে মুখ খুলল জমির, কিন্তু তখনই এল গুমগুম আওয়াজ। থরথর করে কেঁপে উঠেই আবার স্থির হলো মেঝে। পরক্ষণে সুড়ঙ্গের গভীর থেকে এল বজ্রপাতের মত বিকট কড়াৎ আওয়াজ। টর্চের উজ্জ্বল সাদা আলোয় রানা দেখল, মেঝেতে তৈরি হচ্ছে বুড়ো আঙুলের সমান মোটা একটা ফাটল। ওটা চলে গেছে বহু দূরে। ছাত থেকে ঝরঝর করে পড়ছে ধুলো, বালি ও ছোট ছোট পাথর।

‘কী হচ্ছে এসব?’ এক সেকেণ্ডের জন্যে আত্মবিশ্বাসী ভাবটা উধাও হয়েছে জমিরের কণ্ঠ থেকে।

‘একটা কথা বলতে মনে ছিল না,’ ছোট পাথরের টুকরোগুলোর মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল রানা, ‘ট্যাঙ্কের কামান দাগার ফলে নড়বড়ে হয়ে গেছে গোটা পাহাড়। যখন তখন মাথার ওপর ধসে পড়বে ছাতটা। শেষে হয়তো পৌঁছুতেই পারবে না গুপ্তধন পর্যন্ত।’ এবার মিথ্যা বলেনি ও।

নিজেকে সামলে নিয়েছে জমির। তিক্ত হাসল। ‘তা হলে তো হাতে বেশি সময় নেই। আরও জোরে হাঁটো।’

তাড়া দেয়ার জন্যে রানার কোমরে রাইফেলের মাসলের খোঁচা দিল তাবির। সুড়ঙ্গে বাঁক নিল ওরা। টর্চের আলোয় পরিষ্কার দেখল সামনেই চওড়া ফাটল। এদিক থেকে ওদিকে যেতে হলে পার হতে হবে দড়ির পলকা সেতু।

‘এগোতে থাকো,’ বলল জমির।

ছাত থেকে ঠুস-ঠাস করে চারপাশে পড়ছে পাথর। আরও অস্থিতিশীল হয়েছে চারপাশ। নানাদিকে দেখা দিয়েছে ফাটল। ধীরে ধীরে চওড়া হচ্ছে ওগুলো। যে-কোনও সময়ে এখন বিশাল সব পাথর নিয়ে মাথার ওপর নামবে আস্ত টিলা।

কোমরে জোর একটা খোঁচা খেয়ে দড়ির সেতুর ওপর পা রাখল রানা। সত্যি কথাই বলল, ‘জানি না চারজনের ওজন নেবে কি না।’

‘তুই সামনে এগো,’ ধমকে উঠল জমির।

চুপচাপ পা বাড়াল রানা।

তাবিরের বাড়তি ওজনে কট-কট আওয়াজ ছাড়ল দুলন্ত দড়ি। সেতুতে উঠেছে জমির। তার পেছনে কাদের।

এগোতে গিয়ে শ্বাস আটকে ফেলেছে রানা। এদিক ওদিক যাচ্ছে ওর টর্চের আলো। দূরে শুধু গাঢ় অন্ধকার।

গভীর খাদের ওপর দিয়ে দুলতে দুলতে চলেছে ওরা। নিচে ছোরার ডগার মত তীক্ষ্ণ সব স্ট্যাল্যাগমাইট। রানার পিঠে রাইফেলের নল। লড়তে হবে সশস্ত্র তিনজন জঙ্গির সঙ্গে। উপায় নেই যে অন্ধকারে লুকিয়ে পড়বে কোথাও। আগে কখনও এমন ধরনের বিপদে পড়েছে কি না, মনে পড়ল না রানার। আরেক পা যেতেই মাথার ওপরে শুনল জোরালো কর্কশ ঘর্ষণের আওয়াজ। টর্চের আলো ওপরে তাক করতেই দেখল, ওদের দিকে সাঁই করে নেমে আসছে কালো রঙের বিশাল কী যেন!

স্ট্যাল্যাকটাইট!

চুনা পাথরের নিরেট একটা খণ্ড!

একদিক ছোরার ডগার মত তীক্ষ্ণ। অপর দিক শতবর্ষী ওক গাছের গুঁড়ির মত বিশাল মোটা!

দৈর্ঘ্যে চোদ্দ ফুট!

সেতুর কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে গহ্বরে নামল ওটা। দুই সেকেণ্ড পর নিচ থেকে এল ওটা স্ট্যাল্যাগমাইটের উপর আছড়ে পড়ার বিকট আওয়াজ। থরথর করে কেঁপে উঠল চারপাশ। ভীষণ দুলতে লাগল দড়ির সেতু। দু’হাতে দড়ি ধরে নিজেকে সামলে নিতে চাইল রানা। আরবি ভাষায় কার যেন মা তুলে গালি দিল কাদের। গলা কাঁপছে ভয়ে।

আবারও ছাত থেকে নামল আরেকটা ভারী পাথর। আকারে জিপগাড়ির চেয়েও বড়। চার ফুট দূর দিয়ে যাওয়ার সময় ওটার তৈরি বাতাসের ঝাপটা লাগল রানার গায়ে। নিচ থেকে এল শক্তিশালী বোমার মত বুক কাঁপানো প্রচণ্ড আওয়াজ। তীক্ষ্ণ সব স্ট্যাল্যাগমাইটের ওপর পড়ে কোটি টুকরো হয়েছে পাথরের বোল্ডার। ছাত থেকে মাঝারি, শিলাবৃষ্টির মত ঝরঝর করে ঝরছে ছোটবড় পাথরের খণ্ড আর ধুলো। রানা ও তাবিরের মাঝে পা রাখার সরু সব কাঠের খণ্ডের ওপর পড়ল কামানের গোলার মত এক পাথর। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে তাবির। হাত থেকে খসে পড়েছে অস্ত্র। সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে টলমল করছে সে।

ওই আঘাতে ভীষণ দুলছে গোটা সেতু। নিচে তাকাল রানা। আবছা আলোয় দেখল, খুলে যেতে শুরু করেছে প্রাচীন আমলের পাকানো দড়ি। ভারী ওজনের চাপে ঘুরতে ঘুরতে ফাটছে বাইরের দিকের সুতলিগুচ্ছ। নিচের সুতলির ওপর চাপ পড়ছে আরও অনেক বেশি

ওরা সেতু পেরোতে পারবে না, বুঝে গেল রানা।

কড়াৎ!

ছাতের দিকে তাকাল সবাই।

আর্তচিৎকার ছাড়ল কাদের।

ছাত থেকে সরাসরি সেতুর ওপর পড়ছে আরও একটা বিশাল স্ট্যাল্যাকটাইট। ওটার রুক্ষ, এবড়োখেবড়ো চোখা ডগা ঝড়ের বেগে নামতে দেখল রানা। পরক্ষণে বেল্টে ম্যাগলাইট গুঁজেই কনুইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে নিল রেলিঙের দড়িটা। আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেতুর মাঝে।

মস্ত একটা হাঁ করে ছাতের দিকে চেয়ে আছে কাদের। তার মুখের ওপর নামল পাথরের দানবীয় গজাল। প্রথম আঘাতে খুলে গেল চোয়ালের হাড়। বুক, পেট ও নিতম্ব চিরে দেহটা দুই টুকরো করে দিয়ে স্ট্যাল্যাকটাইট পড়ল সেতুর মেঝেতে। পাতলা সুতোর মত পট্ করে ছিঁড়ল দড়ির সেতু।

শুরু হলো পতন। কানের পাশে ঝড়ের মত শোঁ-শোঁ আওয়াজ। প্রাণপণে ধরেছে দড়ি। কিছু ভাবার সময় নেই। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর প্রচণ্ড বেগে গহ্বরের একদিকের দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খেল ছেঁড়া সেতু। বুক থেকে সব বাতাস বেরিয়ে গেল রানার। শুধু মনে থাকল, শক্ত করে ধরে রাখতে হবে দড়ি। ঝুলছে গহ্বরের ভেতর। কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করে পরিষ্কার করতে চাইল মাথা। সারাশরীরে ভীষণ টনটনে ব্যথা।

বেল্ট থেকে টর্চ নিয়ে ওপরে আলো তাক করল রানা। ডানহাতের কনুইয়ে দড়ি পেঁচিয়ে ঝুলছে ও। ছেঁড়া সেতু হয়ে উঠেছে দোদুল্যমান দড়ির বিপজ্জনক মই। রানা যেন বড়শিতে আটকা পড়া মাছ।

নিচে টর্চের আলো ফেলতেই ধক করে উঠল ওর হৃৎপিণ্ড।

দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ওকে দেখছে জমির শেখ। রানার মতই সেতুর দড়ি ধরে টিকে গেছে জঙ্গি-নেতা। এখন উঠে আসছে ওর দিকেই। দু’জনের মাঝে জড়িয়ে পেঁচিয়ে ঝুলছে তাবির। দেয়ালে সেতু আছড়ে পড়ার সময় চুরমার হয়েছে মাথার খুলি। অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে তার অস্ত্র।

একহাতে ঝুলতে ঝুলতে মৃত জঙ্গির বেল্ট ধরে হ্যাঁচকা টান দিল জমির শেখ। দড়ির প্যাচ খুলে ডিগবাজি খেয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল তাবির। কয়েক সেকেণ্ড পর রানার কানে এল থ্যাচাৎ আওয়াজ। চোখা কোনও স্ট্যাল্যাগমাইটের ডগায় গেঁথে গেছে যুবকের লাশ।

তীব্র ঘৃণা নিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে রানার দিকে উঠছে জমির শেখ। ধাপ বেয়ে ওঠার গতি অবিশ্বাস্য। দুই হাত যেন গাড়ির পিস্টন। কয়েক সেকেণ্ড পর খপ করে ধরতে গেল রানার গোড়ালি। তবে ডান পায়ে তার মুখে লাথি দিতে চাইল রানা। মাথা সরিয়ে নিয়েছে লোকটা। হাত চলে গেল বেল্টে, একটানে বের করল ধারাল কমব্যাট নাইফ। রানার পায়ে পৌঁচ বসাতে চাইল। কিন্তু মাংসে ফলা বসার আগেই ঝট করে পা গুটিয়ে নিল রানা। পরক্ষণে লাথি মারল জমিরের কাঁধে। পিছলে সেতুর কয়েক ধাপ নিচে নেমে গেল লোকটা। গর্জে উঠেছে প্রচণ্ড রাগ ও ব্যথায়। ওপরে ছুঁড়েই আবার খপ্ করে ধরল ছোরা। ঝিলিক দিয়ে উঠল ওটা। বুড়ো আঙুল, তর্জনী ও মধ্যমা দিয়ে ধরেছে অস্ত্রটার ডগা। পেছনের দিকে নিল কনুই। পরক্ষণে সরাসরি ছোরা ছুঁড়ল রানাকে লক্ষ্য করে।

বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে রানার দিকে এল ছোরা। মুখোমুখি হয়ে অস্ত্রটা ছুঁড়লে তীব্র বেগে ঢুকত ওর বুকে। কিন্তু নিচ থেকে উঠতে গিয়ে হারিয়ে গেল ওটার বেশিরভাগ গতি। একপাশে সরে ছোরা এড়িয়ে গেল রানা। ওর মাথার এক ইঞ্চি দূরে কালো পাথরে লেগে ফুলকি তুলে ডিগবাজি দিয়ে ওটা হারিয়ে গেল নিচের অন্ধকারে। দুলতে দুলতে উঠে এসে রানার বুক-পেটে বামহাতে ঘুষি বসাল জমির। তার হাতের কবজির ওপর গায়ের জোরে ভারী ম্যাগলাইটের বাড়ি দিল রানা। ব্যথা পেয়ে ক্রুদ্ধ গর্জন ছাড়ল লোকটা। লড়তে চাইছে হিংস্র জানোয়ারের মত। গভীর গহ্বরের ভেতর পরস্পরের দিকে ঘুষি ছুঁড়ছে ওরা।

কিন্তু তখনই পট্ আওয়াজে ছিঁড়ে গেল দড়ি।

পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে শুরু হলো দু’জনের পতন। কানের পাশে আবারও ঝোড়ো হাওয়ার শোঁ-শোঁ আওয়াজ।

চট্ করে পেরোল দুটো সেকেণ্ড। পেরোল তৃতীয় সেকেণ্ড… চতুর্থ… তারপর রানা টের পেল আছড়ে পড়েছে একটা স্ট্যাল্যাগমাইটের ওপর। কপাল ভাল, ওটার চোখা ডগায় পড়েনি। ত্রিকোণ পাথর বেয়ে পিছলে নেমে যেতে লাগল ও। ত্বক ও মাংসে কামড় বসাচ্ছে রুক্ষ পাথর। রানাকে একহাতে জড়িয়ে ধরেছে জমির, অন্যহাতে এখনও ঘুষি মেরে চলেছে পাগলের মত। খেয়াল নেই দু’জনেই ওরা সাঁই-সাঁই করে নামছে সাক্ষাৎ মৃত্যুর দিকে!

তারপর আছড়ে পড়ল ওরা গহ্বরের নিচে।

জোর এক ঝপাৎ আওয়াজে পানির গভীরে তলিয়ে গেল রানা। ওপর থেকে পানিতে পড়ে প্রায় অবশ হয়েছে দেহ। কিন্তু এক ঢোক শীতল পানি গিলে প্রাণপণে সাঁতার কেটে ভেসে উঠতে চাইল। কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে ভীষণ ভয় চেপে ধরল ওকে। কালো পানিতে সাঁতার তো কাটছে, ওপরের দিকে উঠছে, নাকি চলেছে নিচের দিকে? পঞ্চম সেকেণ্ডে বুঝল, হাতে এখনও ম্যাগলাইট। ওটার আলো পৌঁছে গেছে জল সমতলে। দ্বিগুণ উৎসাহে দুই পা ও ডানহাতের স্ট্রোকে উঠতে লাগল রানা। মাত্র কয়েক মুহূর্ত পর পানি ভেদ করে ভেসে উঠল ওর মাথা ও কাঁধ।

কয়েক ফুট দূরেই ভেসে উঠেছে জমির শেখ। সাঁতরে এসে দু’হাতে চেপে ধরল রানার গলা। ভেসে থাকার জন্যে প্রাণপণে দু’পা নাড়ছে বিসিআই এজেন্ট। গায়ের জোরে জমিরের নাকের ওপর ঠাস্ করে নামাল ভারী টর্চ। ভীষণ ব্যথা পেয়ে কাতরে উঠল লোকটা। এবার তার মাথার ওপর প্রচণ্ড জোরে নামল রানার হাতের ভারী টর্চ।

দু’জনকে টেনে নিয়ে চলেছে পাতাল নদীর খরস্রোত। লড়তে লড়তে ভেসে চলেছে ওরা। গুহার ছাত থেকে কাছেই পড়ল পাথরের মস্তবড় আরেক চাঁই। জোরালো ঝপাস্ শব্দে চারপাশে ছিটকে গেল পানি। ভারী পাথরের তৈরি উঁচু ঢেউয়ের ধাক্কায় নাক-মুখ তলিয়ে গেল রানা ও জমির শেখের। জলমগ্ন রুক্ষ পাথরে লেগে ছড়ে যাচ্ছে হাত-পা। প্রচণ্ড স্রোত দু’জনকে নিয়ে গেল সংকীর্ণ আরেক সুড়ঙ্গে। তলিয়ে গিয়েও কয়েক সেকেণ্ড পর ভেসে উঠল রানা। নতুন করে বাতাস নিল বুক ভরে। ম্যাগলাইট ঘুরিয়ে আলো ফেলল চারপাশে।

সাঁতরে হাঁচড়েপাঁচড়ে ওর দিকেই আসছে জমির, হাতে সোনালি কী যেন। ওটা দিয়ে গায়ের জোরে বাড়ি মারল রানার কাঁধে। আঘাতটা এক ইঞ্চি দূরে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ভাঙত রানার কলারবোন। হাতের অস্ত্রটা আবারও ওপরে তুলল জমির। ওটা সোনার তৈরি সেই বাজপাখির মূর্তি। সরাসরি নামল রানার মাথা লক্ষ্য করে। বামহাতে ব্লক করল রানা, পরক্ষণে ডানহাতে জমিরের কবজি মুচড়ে কেড়ে নিল দুর্মূল্য আর্টিফ্যাক্ট। ওটা দিয়েই জোরাল গুঁতো লাগিয়ে দিল জঙ্গি- নেতার পাঁজরে। ছিটকে পিছিয়ে গেল লোকটা। বড় একটা হাঁ মেলেছে ভীষণ ব্যথা পেয়ে।

এদিকে বহু গুণ বেড়ে গেছে পাতাল নদীর তলস্রোত। রানাকে যেন টেনে তলায় নিতে চাইছে ভয়ঙ্কর কোনও জলদানব। গায়ের সমস্ত শক্তি খাটিয়ে ভাসতে চাইছে ও। কিন্তু একহাতে ফ্ল্যাশলাইট, অন্য হাতে মূর্তি। সাঁতার কাটা কঠিন। টর্চ ছেড়ে দিলে চারপাশে নামবে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ওদিকে সোনার মূর্তিটা চাই প্রমাণ হিসেবে। বিশ্বাসঘাতক জন ব্রাউনকে ওটা না দেখালে মুক্ত করতে পারবে না ও লিণ্ডাকে।

তলিয়ে যাচ্ছে রানা, এমন সময় পায়ের নিচে ঠেকল কর্কশ পাথুরে মেঝে। একটু দূরেই ওপরে উঠেছে চোখা একটা পাথর। দুই কনুই দিয়ে ওটা আঁকড়ে ধরল রানা। ওকে ঘিরে ছুটে চলেছে সাদা ফেনা তোলা তীব্র স্রোত। বেদম কাশছে রানা। গিলে ফেলেছে কয়েক ঢোক পানি। কয়েক মুহূর্ত পর নিজেকে সামলে নিয়ে পাতাল নদীর ওপর আলো ফেলল রানা। স্রোতে খড়কুটোর মত ভেসে যাচ্ছে জঙ্গি-নেতা জমির শেখ। প্রাণপণে সাঁতরে উঠতে চাইছে তীরে। আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়েছে দুই চোখ। সামনে পিচ্ছিল একটা পাথর ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। প্রচণ্ড স্রোত ঝড়ের বেগে নিয়ে চলেছে তাকে।

রানা দেখল কোথায় গিয়ে পড়বে লোকটা। সামনে ওটা সাধারণ জলপ্রপাত নয়। চোখা পাথরে ভরা পাতাল নদীর মাঝে পঁচিশ ফুট জায়গা জুড়ে ভয়ঙ্কর এক ঘূর্ণিপাক। প্রচণ্ড ভাবে ঘুরতে ঘুরতে লাখ লাখ টন পানি শোঁ করে উধাও হচ্ছে পৃথিবীর গভীরে, সোজা পাতালে।

চুপ করে চেয়ে রইল রানা। ঘূর্ণিপাকের বাইরে গিয়ে পড়ল জমির শেখ। কালো ঘুরন্ত পানির ভেতর ছোট্ট পুতুল। হাজার হাজার বছর ধরে বইছে এই পাতাল নদী। মসৃণ করেছে দু’দিকের খাড়া পাথুরে পাড়। স্রোত বাড়ি মেরে তুলছে সাদা ফেনা। নদীর মধ্যে মাথা উঁচু করেছে চোখা সব পাথরের খণ্ড, ছোরার মতই ধারাল। তারই একটার ওপর গিয়ে পড়ল জমির শেখ। প্রচণ্ড যন্ত্রণা পেয়ে হাঁ করে প্রাণপণে আর্তনাদ ছাড়ল। তবে পানির তীব্র গর্জনে কিছুই শুনল না রানা। লোকটা ভেসে গিয়ে ঠাস্ করে পড়ল আরেক পাথরের ওপর। তার মুখে ও দাঁতে টকটকে লাল রক্ত দেখল রানা। পাথর থেকে খসে তুমুল বেগে স্রোতের সঙ্গে ঘুরতে লাগল জমির। আরও ক’টা পাথরে ছিটকে পড়ে ক্ষত-বিক্ষত হলো সে। এখন আর আর্তচিৎকার ছাড়ছে না। ক্ষুরের মত ধারাল আরেক পাথরে হ্যাঁচকা টানে তাকে ফেলল স্রোত। জমিরের আশপাশের পানি এখন লালচে।

আরও ক’বার পাক খাইয়ে তাকে ঘূর্ণির কেন্দ্রে নিয়ে গেল খরস্রোত। পরক্ষণে স্যাৎ করে তলিয়ে গেল লোকটা পৃথিবীর অতল গহ্বরে।

চিরকালের জন্যে বিদায় নিয়েছে নির্মম জঙ্গি-নেতা জমির শেখ।

টর্চের আলোয় চারপাশ দেখল রানা। এবার এই গাড্ডা থেকে ওঠার পথ খুঁজতে হবে ওকে।

.

পেরিয়ে গেছে প্রায় তিন ঘণ্টা।

টলতে টলতে সুড়ঙ্গ-মুখের কাছে পৌঁছুল হতক্লান্ত রানা। এবড়োখেবড়ো পাথরের মেঝেতে জোরালো হয়েছে চাঁদের আলো। আকাশে লক্ষ-কোটি জ্বলজ্বলে নক্ষত্র। ওদিকে চেয়ে ভাবল রানা, একটু আগেও জানত না আবার শ্বাস নিতে পারবে মুক্ত পৃথিবীর হাওয়ায়।

বসে পড়ল সুড়ঙ্গ-মুখের কাছে। সারাশরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। পাতাল নদীর সুড়ঙ্গ পেরিয়ে পাহাড়ি গহ্বরের দেয়াল বেয়ে উঠতে গিয়ে দু’হাতের তালুতে এখন ছোটবড় কয়েক শ’ ছড়ে যাওয়ার দাগ। পাতাল নদীর উজানে এগোবার সময় বহুবার মনে হয়েছে, প্রবল স্রোত টেনে নিয়ে ফেলবে ওই ঘূর্ণিপাকে। আর সুড়ঙ্গ থেকে বেরোতেই শুরু হলো পাহাড়ি দেয়াল বেয়ে সোবেকের গুহায় ওঠার সংগ্রাম। এখন ঘুমিয়ে পড়তে পারলে খুব ভাল হতো। কিন্তু সরে যেতে হবে ওকে এই এলাকা থেকে যতটা সম্ভব দূরে।

মুখ বিকৃত করে উঠে দাঁড়াল রানা। স্খলিত পায়ে পেরোল কেন্সিংটনের মৃতদেহ। একটু দূরে ছায়ায় পেল ওর রেখে যাওয়া স্মার্ট ফোন ও পিস্তল। আবারও বেল্টে অস্ত্রটা গুঁজল রানা। পকেটে রাখল মোবাইল ফোন। একবার ভাবল, ফোনের ভেতর রয়ে গেছে অমূল্য আর্টিফ্যাক্টগুলোর প্রমাণ। চাঁদের আলোয় সোনার মূর্তিটা একবার দেখে নিয়ে কোমরের বামদিকে গুঁজল।

এখনও পড়ে আছে মেলা কাজ।

বিশাল মরুভূমি পেরিয়ে পৌঁছুতে হবে মিশরীয় সীমান্তে। এমন কোথাও থামতে হবে, যেখানে মোবাইল ফোনের সিগনাল আছে। যোগাযোগ করবে জন ব্রাউনের সঙ্গে। এ ছাড়া ফোন দেবে আরও কয়েক জায়গায়।

সুড়ঙ্গ-মুখ থেকে বেরিয়ে ঢালু জমি বেয়ে ক্যানিয়নের মেঝেতে নামল রানা। পাশ কাটাল কালো স্তূপ হয়ে পড়ে থাকা মোটরসাইক্লিস্টের লাশ। একটু পর পিছনে পড়ল ধ্বংস হয়ে যাওয়া ধূমায়িত ট্যাঙ্ক। প্রতি পা ফেলার সময় কুঁচকে যাচ্ছে রানার চোখের কোণ। যে-কোনও সময়ে বিস্ফোরিত হবে লুকানো কোনও মাইন।

ক্যানিয়নের বাঁক নিয়ে আরও কিছুটা হাঁটার পর, হঠাৎ করেই থমকে দাঁড়াল রানা। ক্যানিয়নের এক ধারে দেখতে পেয়েছে কালো একটা অবয়ব।

কয়েক সেকেণ্ড ওটা দেখার পর মৃদু হাসি ফুটল রানার মুখে। প্রায় দৌড়ে এগোল। খুশি হয়ে উঠেছে মনটা।

একমিনিট পেরোবার আগেই জমির শেখের কালো নিসান গাড়ির ড্রাইভিং সিটে চেপে বসল রানা। ইগনিশনে চাবি রেখে গেছে জঙ্গিরা। অয়েল গেজ দেখে বুঝল, ফিউয়েল ট্যাঙ্ক এখনও প্রায় ভরা। ঘুরে পেছনে তাকাতেই দেখল, পেছন সিটের ওদিকে অকটেনের কয়েকটা জেরি ক্যান। এত দূরে এসে তেলের অভাবে পড়তে চায়নি জঙ্গি-নেতা।

ইঞ্জিন চালু করে সরু ক্যানিয়নে সাবধানে জিপ ঘুরিয়ে নিল রানা। ফিরে চলল মিশর সীমান্তের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *