ছায়াঘাতক – ১০

দশ

পোর্ট হোল দিয়ে আসা রোদ চোখের পাতায় পড়তেই ঘুম ভাঙল রানার। বিচ্ছিরি একটা অনুভূতি হলো। টের পেল, ও বড় ক্লান্ত। চোখ গেল দেয়ালঘড়ির দিকে। পনেরো মিনিট হলো নীল সাগরের দিগন্তে নোলকের মত ঝুলছে সোনালি সূর্য। আজ অস্থির হয়ে উঠেছে সাগর। ঢেউয়ের তালে একবার উঠছে আবার নামছে সুপার ইয়ট।

কয়েক মিনিট শুয়ে থাকার পর বিছানা থেকে নামল রানা। পুরু কার্পেটের উপর বিশটা করে পাঁচ দফায় সেরে নিল এক শ’টা বুক ডন। ভাল লাগছে না কিছুই। বারবার মনে পড়ছে, কর্নেল ব্রাউন ও লিণ্ডার সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে শোনা কথাগুলো। চলে এল বিলাসী স্টেটরুমে। কিছুক্ষণ পায়চারি করে ঢুকল সুইটের বিশাল বাথরুমে। শাওয়ার নিল দশ মিনিট ধরে। শরীর মুছে রেইল থেকে এমব্রয়ডারি করা সেইবার ইয়ট লেখা নীল বাথরোবটা পরে নিজেকে আয়নায় দেখল রানা। এতক্ষণ স্নান করেও ক্লান্তি যায়নি চেহারা থেকে। ফিরে এল বেডরুমে। বেডের পাশের টেবিল থেকে ওমেগা হাতঘড়িটা তুলে পরে নিল বাম কবজিতে। মোবাইল ফোনে কল দিল নরম্যাণ্ডিতে রানা এজেন্সির নম্বরে। ওদিক থেকে ফোন ধরল রিসেপশনিস্ট নীলা দত্ত, ‘জী, মাসুদ ভাই।’

‘আমি ইতালিতে,’ বলল রানা। ‘আজই হয়তো বেশ কয়েক দিনের জন্যে যাচ্ছি কায়রো।’

‘জী, মাসুদ ভাই।’

‘সাদেককে বোলো, খুব জরুরি কোনও সমস্যা হলে যেন হেড-অফিসে যোগাযোগ করা হয়।’

‘সাদেক ভাইকে জানিয়ে দেব।’

‘গুড। পরে দেখা হবে।’ কল কেটে দিল রানা। জিন্সের প্যান্ট ও পোলো টি-শার্ট পরে ডেকে বেরিয়ে এল। ভেবেছিল, দেখা হবে লিণ্ডার সঙ্গে, কিন্তু ডেকে কেউ নেই।

নিচের ডেকে পেছনের দিকে দীর্ঘ টেবিলে দেয়া হয়েছে ব্রেকফাস্ট। সাগরের হু-হু হাওয়ায় ভেসে এল দামি কফির কড়া সুবাস। টেবিলের মাঝে বাস্কেট ভরা গরমাগরম ক্রয়স্যান্ট, পাঁ ওউ শোকোলাট ও এক জগ কমলার জুস। আশপাশে লিণ্ডাকে দেখল না রানা।

ওর পেছন থেকে বলে উঠলেন কর্নেল ব্রাউন, ‘শহরে দাঁতের ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট, তাই ভোরেই রওনা হয়েছে। সেজন্যে ক্ষমা চেয়েছে তোমার কাছে।’

ঘুরে দাঁড়াল রানা। ‘গুডমর্নিং, কর্নেল।’

মৃদু হাসলেন ব্রাউন। ‘ভোরে হেলিকপ্টারের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়নি তো?’

‘না, তা হয়নি,’ বলল রানা। ‘আপনার বিযনেস মিটিং কেমন হলো?’

‘ভাল ভাবেই সামলে নিয়েছি,’ টেবিলের দিকে ইশারা করলেন কর্নেল। ‘বসে পড়ো। তুমি বললে শেফকে দিয়ে আনিয়ে দিতে পারব বেকন, ওমলেট বা অন্য যে-কোনও কিছু। ওহ্, সরি, তুমি হয়তো বেকন খাবে না… না কি খাও?’

‘আর কিছু লাগবে না,’ চেয়ারে বসে একটা ক্রয়স্যান্ট নিল রানা। কফি ঢালল ওর কাপে।

নাস্তার ফাঁকে টুকটাক কথা হলো দু’জনের। তবে একটু পর আবারও বললেন কর্নেল, ‘আমার কাজটা করে দিচ্ছ বলে হাজার ধন্যবাদ দিয়েও শেষ করতে পারব না।’ মৃদু হাসলেন তিনি, চোখে বিষাদ। নরম কণ্ঠে বললেন, ‘সকাল এগারোটায় নিস শহরের এয়ারপোর্ট থেকে রওনা হবে তুমি। টিকেট সুইস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের। তোমার নাস্তা শেষ হলে নিচে লাইব্রেরিতে গিয়ে ফাইনাল আলাপ সেরে নেব।

কফির কাপ খালি করে উঠে পড়ল রানা। ‘আমার খাওয়া শেষ। চলুন, কথা সেরে নিই।’

লাইব্রেরিতে ঢুকে রানা দেখল, টেবিলে একটা অ্যাটাশে কেস। ওটা আগে ওখানে ছিল না। ওরা চেয়ারে বসার পর অ্যাটাশে কেস থেকে সরু একটা ফোল্ডার নিয়ে রানার দিকে বাড়িয়ে দিলেন কর্নেল ব্রাউন। ‘সব এর মধ্যেই আছে।’

ফোল্ডার খুলে ওটাতে চোখ বোলাতে লাগল রানা।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কর্নেল। ‘মর্ডাকের ভাড়া করা ফ্ল্যাটের ঠিকানা। করোনারের রিপোর্টের কপি। হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে যা জেনেছি, সেগুলো দিয়েছি।’ অ্যাটাশে কেস থেকে পুরু একটা এনভেলপ নিয়ে রানার হাতে দিলেন তিনি। ‘বিমানের টিকেট পাবে এয়ারপোর্টে।’

‘এনভেলপে কী?’ জানতে চাইল রানা।

‘পাসপোর্ট আর খরচের টাকা,’ বললেন কর্নেল।

এনভেলপের ভেতর উঁকি দিয়ে কচকচে নোট দেখল রানা।.

‘মিশরীয় কারেন্সি,’ বললেন ব্রাউন। ‘তিন লাখ ইজিপশিয়ান পাউণ্ড। মোটামুটি চল্লিশ হাজার ইউরোর সমান।’

‘এত লাগবে বলে মনে হয় না,’ বলল রানা। অনেক কমেই চলবে।’

ঘন ঘন মাথা নাড়লেন ব্রাউন। ‘প্লিয, রেখে দাও। যদি লাগে খরচ করতে দ্বিধা কোরো না।’

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘বেশ, পরে ফেরত দেব বাকি টাকা।’ ওর চোখ গেল সাইডবোর্ডে। ওখানে ফ্রেমে বাঁধানো কয়েকটা ছবি। একটাতে লিণ্ডা, স্নান করছে সুইমিংপুলে। পাশেই মর্ডাকের ছবি। ‘মর্ডাকের ছবি সঙ্গে থাকলে নানান জায়গায় ওটা দেখাতে পারব। কারও হয়তো মনে পড়বে জরুরি কোনও তথ্য।’

ছেলের একটা ছবি নিয়ে রানার হাতে দিলেন ব্রাউন। সেইবার ইয়টের ডাইনিং রুমে বসে আছে মডাক ও ব্রাউন। কী কারণে যেন লালচে যুবকের চেহারা। বোধহয় অস্বস্তি বা লজ্জার কারণেই। হাতে শ্যাম্পেইনের গ্লাস। পরনে নীল পিনস্ট্রিপ দেয়া হালকা ব্লেযার। বামহাতে ভারী সোনার ঘড়ি। সরু কবজিতে বেমানান লাগছে ওটাকে।

‘ঘড়িটা খুব দামি,’ বলল রানা। ‘ওটা পরে কায়রোয় গিয়েছিল? আপনি বলেছিলেন ওর সবই চুরি হয়ে গেছে।’

বিষাদবদনে এপাশ-ওপাশ মাথা দোলালেন ব্রাউন। ‘ওটা রোলেক্স অয়েস্টার। সবসময় পরত। উপহার দিয়েছিল ওর মা। পেছনে খোদাই করা কয়েকটা কথা আছে। ওই ঘড়ি কখনও হাতছাড়া করত না মডাক।’

চোরের লোভ হওয়ার কথা,’ বলল রানা। ‘অন্তত কয়েক ভরি সোনা আছে এতে।’

‘তা ঠিক। মডাক বেখেয়াল… মানে, মানুষ হিসেবে খুব সচেতন ছিল না। স্কলার, নিজের কাজে ডুবে থাকত। কায়রো যাবে শুনে বলেছিলাম, আমার সেফে রেখে যাও সোনার ঘড়িটা। কিন্তু মায়ের দেয়া স্মৃতি। রাজি হয়নি।’ কাঁপা শ্বাস ফেললেন কর্নেল। ওকে আরও ভালভাবে বোঝানো উচিত ছিল। সঙ্গে দামি সব জিনিস। লুটেরা বা চোরের টার্গেট হয়ে গিয়েছিল। দোষটা আমার।’

আমারও উচিত হয়নি সোনার হাতঘড়ির কথা তোলা, ভাবল রানা। মুখে বলল, ‘মনে হয় না আপনার দোষ ছিল। মানিব্যাগ, কমপিউটার, স্মার্টফোন বা দামি যে-কোনও কিছুর জন্যেই খুন হতে পারত। ধরে নিয়েছে মর্ডাক বড়লোক পশ্চিমা টুরিস্ট। অনেক কম পয়সার জিনিসের জন্যেও খুন হয় মানুষ।’ ছবিটা দেখাল রানা। ‘এটা নিতে পারি?’

মাথা দোলালেন ব্রাউন। ‘নাও। আমার কাছে কপি আছে।’

ফ্রেম থেকে ছবি খুলে এনভেলপের অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে রেখে দিল রানা। জরুরি আর কোনও তথ্য নেই। আবছা এক প্ল্যান তৈরি হচ্ছে মনের ভেতর। নিজের ব্যাগে এনভেলপ রাখল। সোজা হয়ে বসে বলল, ‘আমি রওনা দেয়ার জন্যে তৈরি।’

কেন যেন চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ব্রাউন। ‘গুড। ঠিক আছে, পোর্টো ভেক্কিয়োতে তোমার জন্যে ট্যাক্সি অপেক্ষা করবে। ওটা পৌঁছে দেবে এয়ারপোর্টে।’

লাইব্রেরি থেকে বেরোবে রানা, এমন সময় ওকে আলিঙ্গন করলেন কর্নেল। রানা টের পেল, আড়ষ্ট হয়ে আছে মানুষটার দেহ।

‘নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসি আমার স্ত্রী লিণ্ডাকে, রানা,’ নিচু গলায় বললেন কর্নেল।

কথাটা শুনে চমকে উঠল রানা। চট্ করে ভাবল, গতকাল রাতে স্টাফদের কেউ ওর কেবিন থেকে মেয়েটাকে বেরোতে দেখেছে? নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত স্বরে বলল, —তা জানি, কর্নেল।’

ওর তুলনায় আমি বুড়ো মানুষ, রানা। জানি না আমার ভেতর কী পেয়েছে। তবে এটা বলতে পারি, ওর চেয়ে বেশি আর কাউকে ভালবাসি না। আজ আপন বলতে পৃথিবীতে ও ছাড়া আর কেউ নেই।’ রানার পিঠ হালকা ভাবে চাপড়ে দিলেন তিনি। নিজেকে সামলে নিয়ে মুছে ফেললেন চোখের অশ্রু। ‘ঠিক আছে, রানা, তোমার ফোনের জন্যে অপেক্ষা করব।’

‘যোগাযোগ থাকবে, কর্নেল,’ কথা দিল রানা।

.

লঞ্চ থেকে পোর্টো ভেক্কিয়োতে নেমে অপেক্ষমাণ ট্যাক্সিতে উঠল রানা। ফ্রেঞ্চ সীমান্ত পেরিয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর পৌঁছুল নিসের খুব কাছে কোত দ্য’যুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। গাড়ির বুট থেকে ব্যাগ নিয়ে পার্কিং লট পেরিয়ে চলল এয়ারপোর্ট টার্মিনালের দিকে। ভাবছে, মর্ডাকের খুনিদের হত্যা করতে অনুরোধ করেছেন কর্নেল। ওদিকে লিণ্ডা ও তাঁর জটিল সম্পর্কে জড়িয়ে বিব্রত বোধ করছে ও। নিজেকে ফাঁদে পড়া জন্তু বলে মনে হচ্ছে ওর।

পার্কিং লটের মাঝামাঝি যেতেই দ্রুতগামী গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ পেয়ে ঝট্ করে ঘুরে দাঁড়াল রানা। চিনে ফেলল গাড়িটা। লিণ্ডার বিএমডাব্লিউ রোডস্টার স্পোর্টস্কার। চার চাকার ক্রিচ-ক্রিচ আওয়াজ তুলে ওর তিন গজ দূরে থামল ওটা। খুলে গেল ড্রাইভিং দরজা। লাফিয়ে নেমে এল লিণ্ডা ব্রাউন। উত্তেজনায় লালচে হয়েছে দুই গাল।

‘তুমি এখানে কী করছ?’ বিস্ময় লুকিয়ে জানতে চাইল রানা।

‘ভাবতে পারিনি তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না, ‘ অপরাধী সুরে বলল মেয়েটা।

‘সেই স্যান রেমো থেকে পিছু নিয়েছ?’

আস্তে করে মাথা দোলাল লিণ্ডা। ‘শুভবিদায় বলতেই এত দূর থেকে ছুটে এসেছি। মাফ করে দিয়ো, রানা। গতকাল উচিত হয়নি তোমার কেবিনে যাওয়া। আরও খারাপ করেছি তাড়া খাওয়া ইঁদুরের মত পালিয়ে গিয়ে।’

চুপ করে থাকল রানা।

‘যা বলেছি, সেটা থেকে পিছিয়ে যাব না— সত্যিই ভালবাসি তোমাকে। হয়তো এমন কোনও পথ পাব, যাতে আলাদা হয়ে গেলেও মনে কষ্ট পাবে না জন।

‘এসব কথা থাক, লিণ্ডা,’ বলল রানা। আবারও শুরু হয়েছে মনের গভীরে অস্বস্তি। ‘তুমি কিন্তু ভুল করছ। আমাকে তুমি ভাল করে চেনোও না।’

‘আমি যে ভুল করছি না, তা বলে দিয়েছে আমার হৃদয়,’ জোর দিয়ে বলল মেয়েটা। কয়েক পা এগোল। ‘কিছুটা সময় দাও আমাকে, রানা। পরের ফ্লাইটে যেয়ো?’

লিণ্ডা যে-কোনও সময়ে ওর ঠোঁটে চুমু দেবে বুঝে এক পা পিছিয়ে গেল রানা। আস্তে করে মাথা নাড়ল। ‘তা সম্ভব নয়, লিণ্ডা।’

মুখ নিচু করে নিল মেয়েটা। আরও লালচে হয়েছে দুই গাল। প্রায় ফিসফিস করল, ‘তোমার ফোন নম্বরটা দেবে? মাঝে মাঝে কথা বলতাম? বা কল লিস্টে তুলে নেবে আমার ফোন নম্বর?’

দ্বিধায় পড়েছে রানা।

সুযোগটা নিল লিণ্ডা, দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে জড়িয়ে ধরল ওকে।

আস্তে করে আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল রানা, ‘পরে দেখা হবে, লিণ্ডা।’ ঘুরে টার্মিনালের দিকে হাঁটতে লাগল ও। নিজেকে ভীষণ নিষ্ঠুর লোক বলে মনে হচ্ছে। হাঁটার গতি বাড়ল ওর। ঘুরে তাকালে দেখত, নীরবে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে মেয়েটা। একবারও পেছনে না চেয়ে টার্মিনাল ভবনে ঢুকে পড়ল রানা।

.

পার্কিং লটে দূরের এক গাড়ির ভেতর বসে আছে দুই লোক। ড্রাইভার লোকটা ভেবেছিল রানার পিছু নিয়ে টার্মিনালে ঢুকবে। কিন্তু তখনই স্পোর্টস্কার নিয়ে এল সুন্দরী মেয়েটা। এরপর থেকে পুরো ব্যাপারটা আগ্রহ নিয়ে দেখেছে তারা।

ঘাড়ে ব্রেস পরা লোকটার দিকে তাকাল হালকা শরীরের ড্রাইভার। ‘কী বুঝলে? ওই মেয়ে তো মনে হয় প্রেমে পড়েছে!’

তার সঙ্গী তিক্ত চেহারা করে বলল, ‘তাই তো মনে হচ্ছে! ক্রাইস্ট! ঘটনার ভেতর আরও প্যাঁচ পড়ল!’ ড্রাইভারের দিকে তাকাতে গিয়ে ঘাড়ে ব্যথা পেয়ে মুখ কুঁচকে ফেলল সে। ‘বলো তো দেখি, মেয়েটা কী বলল লোকটাকে?’

বড় করে শ্বাস ফেলল ড্রাইভার। ‘আমি জানব কী করে? তবে মনে হচ্ছে বলেছে: তোমাকে ছাড়া বাঁচতে চাই না!’

এগারো

নিজের পেশায় ওস্তাদ লোক ইউডন ভাদিম। ছায়াময়, কর্দমাক্ত যে সমাজে বাস করে, সেখানে সবাই মনে করে সে সত্যিকারের এক কিংবদন্তি। ফিসফিস করে ভাদিমকে নিয়ে আলাপ করে ছিঁচকে চোরের দল। তাই বলে আইনের বাইরে কিছু করে ভাদিম, তা প্রমাণ করতে পারবে না কেউ।

ইউডন ভাদিমের বয়স একচল্লিশ বছর। কনফা ব্যাচেলার। কায়রোর ধনী সমাজে স্বচ্ছন্দ চলাচল তার। দেখতে নায়কের মতই সুন্দর। লম্বা, হালকা-পাতলা শরীর। যে-কেউ বলবে, এই লোক এসেছে অভিজাত পরিবার থেকে। নিয়মিত টেনিস ও পোলো খেলে। ফাইন আর্টের সত্যিকারের সমঝদার। তার জন্যে রিযার্ভ থাকে অপেরার প্রাইভেট বক্স। লাঞ্চ ও ডিনার সেরে নেয় নাম করা সব ক্লাব বা রেস্টুরেন্টে। পৃথিবীর যে-কোনও দেশে গেলে ওঠে সেরা হোটেলে। তখন সঙ্গে থাকে অপরূপা কোনও যুবতী। কায়রোর অভিজাত নারী-সমাজে ভাদিম খুবই জনপ্রিয়, কারণ এটা এখন প্রমাণিত, শহরে আরেকজন নেই, যে কিনা বিছানায় কামিনীদেরকে ইউডনের চেয়েও বেশি প্রশান্তি দেবে। ভাদিম চড়ে টুকটুকে লাল ফেরারি গাড়িতে। বাস করে কায়রোর সবচেয়ে দামি এলাকা হাইড পার্কে। দেখার মত সুন্দর তার বিশাল নকল টুসকান ভিলা। চারপাশে দেড় একর জমি জুড়ে ম্যানিকিয়োর করা বাগান।

বে কোথা থেকে এল তার এত টাকা, সেটা একান্ত গোপনীয় বিষয়। ভাদিম কী ধরনের ব্যবসা করে কেউ জিজ্ঞেস করলে, জবাবে মিষ্টি হাসে সে। হাত নেড়ে বলে, রপ্তানী করে বিশেষ সাংস্কৃতিক মালামাল। বড়লোকদের দামি ক্লাবে ভাদিমের পেটের খবর খুঁচিয়ে বের করতে যায়নি কেউ। ধনীদের পার্টিতে সে গেলে খুশি হয় সবাই— বিশেষ করে বহু দিনের ক্ষুধার্ত মহিলারা। কাজেই তাদের কাছ থেকে বিশেষ আদর পায় ভাদিম।

আজ থেকে পনেরো বছর আগে ফ্রান্সে আর্কিওলজির নিবেদিতপ্রাণ স্কলার ছিল সে। সবসময় ক্লাসে প্রথম হতো। তারপর লেখাপড়া শেষ করে লেকচারার হিসেবে যোগ দিল সরবন ইউনিভার্সিটিতে। অথচ, বেশিরভাগ ছাত্রই ছিল বয়সে তার চেয়ে বড়। এখনকার মত বিলাসী জীবন না থাকলেও শিক্ষক হিসেবেও যথেষ্ট ভাল করছিল ভাদিম। সুন্দরী বান্ধবীকে নিয়ে বাস করত মাঝারি এক ফ্ল্যাটে। ছোট একটা গাড়ি, ছোট্ট কুকুর আর লেখাপড়া নিয়ে ভালই ছিল। পরিবারে আলাপ চলছিল, এবার বিয়েটা সেরে ফেলা উচিত ভাদিমের।

এমন জীবন পেলে বর্তে যেত বেশিরভাগ মানুষ। কিন্তু তাদের মত সাধারণ নয় ইউডন ভাদিম। জীবনের কাছ থেকে আরও বহু কিছু আশা করে সে। দু’বছর শিক্ষক জীবন কাটিয়ে একেবারে হাঁফ লেগে গেল তার।

বয়স তখন ভাদিমের সাতাশ। ইজিপ্টোলজির নেশায় একদিন কাউকে কিছু না বলে ফ্রান্স ত্যাগ করে হাজির হলো মিশরের পশ্চিম মরুভূমিতে। বুঝে গেল, সম্পদ ও খ্যাতি চাইলে বালি খুঁড়ে এক্সকেভেশন করতে হবে তাকে। এই প্রথম স্বাদ পেল অভিযানের। রক্তে মিশে গেল জিনিসটা। টের পেয়ে গেল, সারাজীবন এটাই চেয়েছে সে।

ফ্রান্সে ফিরে পরিচিত জীবনটার ইতি টানল ভাদিম। ছেড়ে দিল ইউনিভার্সিটির লেকচারারশিপের চাকরি। খুব কাঁদল তার বান্ধবী, ভেবেছিল বিয়ে করে সংসার পাতবে। কিন্তু মন গলল না ভাদিমের। এক ভোরে সংক্ষিপ্ত একটা চিঠি ডাইনিং টেবিলে রেখে ছোট্ট একটা সুটকেস নিয়ে উঠে পড়ল ব্রিটিশ এয়ারলাইন্সের এক জেট বিমানে। এরপর মিশরে নামার পর থেকে অতীতের দিকে আর ফিরেও চায়নি সে।

কায়রোর সবচেয়ে কমদামি এলাকায় ছোট্ট একটা কামরা ভাড়া নিয়েছিল ভাদিম। দেরি হয়নি নতুন ব্যবসা চালু করতে। কিছু দিনের ভেতর হয়ে গেল পেশাদার সমাধি লুঠেরা। জানত, ঠিক পথই বেছে নিয়েছে সে। মাত্র কয়েক মাসের ভেতর হয়ে গেল ধনী এক সম্মানিত লোক। এখনও তার মনে পড়ে, কবে প্রথম মিলিয়নেয়ার হলো। মনে মনে হেসেছিল, মিশরে রোজগার করা দেখা যাচ্ছে খুবই সহজ!

এত বছর পরেও ভাদিমের মনে হয়, তুড়ি মেরে পেয়ে যাচ্ছে লাখ লাখ ডলার! নিজের কাজে সেরা সে। তা ছাড়া, ভাগ্য-দেবীও ছিলেন অত্যন্ত প্রসন্ন।

ভাদিমের ধারণা, পতিতাবৃত্তির চেয়েও বেশি পুরনো তার এই পেশা। সেই হাজার-হাজার বছর আগে যখন মৃতদের সঙ্গে তাদের ধনরত্ন কবরে দিতে লাগল বোকার দল, তখন থেকেই শুরু হয়েছে তার মত সুযোগ-সন্ধানী বুদ্ধিমান মানুষের উন্নতি। ভাদিম এত বোকা নয় যে পা দেবে ইজিপশিয়ান অ্যান্টিকুইটি পুলিশের ফাঁদে। কখনও প্রাচীন শহর সাক্কারার কোনও পিরামিডের কাছে কোদাল চালাতে যায়নি। তার চালিত জটিল অপারেশন চলে খুব সতর্কতার সঙ্গে। ঝুঁকির ধারেকাছেও যায় না সে। যেসব চোরের কাছ থেকে অ্যান্টিক কিনে নেয়, তাদের সঙ্গে কখনও দেখাও হয় না তার। বহু বছর হলো মরুভূমির বালি মাড়ায়নি সে। ওয়াইনের বার, টপ রেস্টুরেন্ট বা গলফ কোর্সে সেরে নেয় নিজের ব্যবসা। পরিশ্রম না করেই আসে লাখ লাখ ডলার। সেজন্যে তপ্ত মরুভূমিতে গিয়ে হাতে তৈরি ইতালিয়ান জুতো নষ্ট করতে হয় না তাকে।

ব্যবসার জন্যে কোথায় না ঘুরে বেড়ায় ভাদিম!

রোম, এথেন্স, আঙ্কারা, বৈরুত, দামাস্কাস, দিল্লি… সেরা জিনিসের জন্যে বিরাট হাঁ করে আছে অ্যান্টিক পাইকারের দল। ভাদিমের কারণে মিশর থেকে চোরাই পথে যাচ্ছে দুর্লভ সব প্রাচীন নিদর্শন। তবে এ ধরনের কবর- লুঠেরা সে একা নয়। একদল সমাধি ডাকাত নেমে পড়েছে এই ব্যবসায়। তাদের ভেতর সরকারের কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা নেই, তা-ও নয়। বেশি দামি কিছু পেলেই তুলে দিচ্ছে আমেরিকা বা ইউরোপের প্রাইভেট কালেক্টরদের হাতে। ফেরাউনি, গ্রিক বা রোমান আমলের স্লেট প্যালেট, পটারি, চকচকে ফিগারিন, ব্রোঞ্জের ছোট মূর্তি, অ্যামিউলেট, সোনার ট্রিঙ্কেট, খোদাই করা পাথুরে মাথা, ট্যাপেস্ট্রি, এমন কী আসবাবপত্র— বাদ পড়ছে না কিছুই। মিশর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে যাচ্ছে নানান ধরনের প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নিদর্শন।

নিজে কোনও আর্টিফ্যাক্ট হাতের কাছে রাখে না ইউডন ভাদিম। তার বাড়িতে মিশরীয় কোনও শিল্পসামগ্রী নেই। উপায় নেই তাকে ফাঁসিয়ে দেবে মিনিস্ট্রি অভ কালচার বা অ্যান্টিকুইটি পুলিশ। আজ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ একবারও সন্দেহ করেনি তাকে। তবুও তারা যদি হাজির হয় ভাদিমের বাড়িতে, হয়তো খুশিই হবে সে। ভেবে রেখেছে, সেক্ষেত্রে তাদেরকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাবে নিজের চমৎকার ভিলা। তার প্রতিটা ব্যক্তিগত জিনিস আইনগত ভাবে সম্পূর্ণ বৈধ। কর্তৃপক্ষের জানার উপায় নেই, কারনাক মন্দিরে এবং শহরের আরেক প্রান্তে ভাদিমের রয়েছে শতখানেক প্রাচীন ছোট মূর্তি এবং মিং আমলের অনেকগুলো শখের ভাস। কেউ বোঝার আগেই আগামী কয়েক দিনে বিক্রি হয়ে যাবে প্রতিটি জিনিস।

কিছু দিন আগে পেয়েছে প্রাচীন শহর ডিয়ের-এল- ব্যানেট থেকে টলেমির সময়ে তৈরি সোনার একটা মুখোশ। তবে ওটা বিক্রি করে তার বদলে নিজের বাড়ির স্টাডিতে এনেছে দুর্লভ এক লুই চোদ্দ ডেস্ক। ভাদিমের ভাল করেই মনে আছে, ওই মুখোশ ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় লেনদেন। সমাধিটা ছিল মরুভূমির বালির মাত্র কয়েক ফুট নিচে। মুখোশটা সরিয়ে নেয়ার পর ওই জায়গা থেকে উধাও হয় সে। কয়েক দিন পর যখন টনক নড়ল কর্তৃপক্ষের, ততক্ষণে বিক্রি হয়ে গেছে জিনিসটা। তারা পেয়েছে শুধু শুকনো ক’টা হাড় আর ব্যাণ্ডেজ। ধুলোভরা প্রাচীন লাশের ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী নয় ভাদিম।

বারো বছর হলো এভাবেই চলছে তার ব্যবসা। কবর লুঠ করতে সময়ও লাগে খুব কম। প্রাচীন আমলেও যেমন দামি জিনিসের চাহিদা ছিল, আজও তেমনই আছে। মাঝে মাঝে ক্রিস্টি বা সদেবি-র নিলামঘরে ঈগলচক্ষু কোনও ইজিপটোলজিস্ট ধরে ফেলে চোরাই মাল। তার কথা শুনে চক্ষু চড়কগাছ হয় মিনিস্ট্রি অভ কালচারের কর্মকর্তাদের। ইন্টারপোলের সাহায্য নিয়ে কখনও ধরেও ফেলে অসতর্ক অপরাধী ডিলারকে। কিন্তু ধরা পড়ার ঝুঁকিই নেয় না ভাদিম। ফাইন আর্টের আইনসম্মত ব্যবসার আড়ালে চলে আর্টিফ্যাক্টের চোরাচালান। বেশিরভাগ সময় দামি জিনিসপত্র বিক্রি করে এমন মানুষের কাছে, যারা কখনও ওগুলো জনসম্মুখে বের করতে পারবে না— কেউ চিনে ফেললে জেলে যেতে হবে।

আসলে জীবনে যা চেয়েছে, সবই পেয়েছে ইউডন ভাদিম। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের মতই চাহিদার শেষ নেই তার। আরও চাই। আজ সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসপ্রেসো কফিতে চুমুক দিতে দিতে বহু দূরের মরুভূমির দিকে চেয়ে আছে সে। ভাবছে, ওই বালির নিচে লুকিয়ে আছে হাজারো কোটি ডলারের সম্পদ। সেখান থেকে নিজের ভাগটা বুঝে নিতে হবে ওকে। আর একবার বিরাট কোনও দান মারতে পারলে চিরকালের জন্যে অবসর নেবে। মিশরের পৌরাণিক কিছু কিংবদন্তির সম্পদ আজও রয়ে গেছে অজানা। যেমন ইমহোটেপের সমাধি। ওই ফেরাউন ছিল ইজিপ্টের প্রথমদিকের রাজা। যদিও অনেকে মনে করেন বাস্তবে সে ছিলই না। শত শত আর্কিওলজিস্ট ও ইতিহাসবিদ চেষ্টা করেছেন ওর সমাধি আবিষ্কার করতে। তবে পাওয়া যায়নি কিছুই। একবার যদি ওই সমাধি আর সম্পদ খুঁজে পায় ভাদিম, ওটা হবে সবার নাকের সামনে দিয়ে স্বর্গে পৌছে যাওয়ার মত। যে পরিমাণ আর্টিফ্যাক্ট ওখানে আছে বলা হয়, তাতে বিশবার জীবন ফিরে পেলেও দুই হাতে খরচ করে ফুরাতে পারবে না।

ইমহোটেপের সমাধির কথা ভাবতে গিয়ে মাঝে মাঝেই সারারাত পার করত ভাদিম। তবে সাত মাস আগে একটা ফোন পাওয়ার পর থেকে হঠাৎ করেই বদলে গেল তার জীবন।

ওদিকের লোকটার কণ্ঠস্বর শুনেই ভাদিম বুঝল, বড় কোনও দান এসেছে হাতের মুঠোয়। বেশিরভাগ সময় এ ধরনের ফোন কলারের কথা পুরোটা না শুনেই রিসিভার নামিয়ে রাখে। অথবা ধমকে উঠে বলে, কে দিয়েছে আপনাকে আমার ব্যক্তিগত নাম্বার! কিন্তু সেদিন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করল তার ভেতর। অন্তরের গভীরে বুঝে গেল, মন দিয়ে শুনতে হবে এই লোকের কথা।

ওই ফোনালাপের মাধ্যমে ভাদিম জানল, কোথায় দেখা করতে হবে। শহরে নয়, তারা সাক্ষাৎ করবে মরুভূমিতে। ওই লোক বলে দিয়েছে, মরুভূমি ছাড়া অন্য কোথাও মিটিং চলবে না। প্রথমে নিরাপত্তার কথা ভেবে চিন্তায় পড়েছিল ভাদিম। তবে মনটা বলে দিল, যা, গিয়ে দেখ কী বলে!

কাজেই একা জিপগাড়ি ড্রাইভ করে গরমের ভেতর গিয়েছিল সে বহু মাইল দূরে। যেখানে দেখা করার কথা, ওখানে কয়েক বছর আগেও গেছে সে। চেনে জায়গাটা। ওখান থেকে দামি কিছুই পাওয়া যায়নি। ফলে আর কখনও ওদিকে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি ভাদিম। শত শত বছর আগে ওই মন্দির লুঠ করেছে ডাকাতের দল। দর্শনীয় নয় বলে টুরিস্টরাও ওদিকে যায় না। বালির ভেতর অর্ধেক ডুবে থাকা ভাঙা মন্দির। বহু মাইলের ভেতর ওই ভাঙা দেয়াল ভরা জায়গাটা ছাড়া আর কোথাও মরুভূমিতে ছায়া পাওয়ার উপায় নেই।

ঠিক জায়গায় পৌছে গাড়ি থেকে নেমে কড়া রোদের ভেতর চারপাশে তাকাল ভাদিম। কেন যেন মনে হলো, ওপর থেকে কেউ দেখছে ওকে। ধীরে ধীরে পেরোতে লাগল সময়। অস্থির লাগল ভাদিমের। ফলে শুরু করল পায়চারি। একটু পর পর অধৈর্য হয়ে দেখল হাতঘড়ি। সূর্যের ভীষণ তাপে শুরু হলো মাথা-ব্যথা। আরও অনেকক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে তিক্ত হয়ে গেল মনটা। ঠিক করে ফেলল, যথেষ্ট হয়েছে, এবার ফিরবে কায়রোয়। জিপগাড়িতে উঠবে, এমন সময় তাপ-তরঙ্গের ভেতর দিয়ে দেখল, উঁচু বালির ঢিবি ডিঙিয়ে এদিকেই আসছে চারটে গাড়ি।

কপালে হাত রেখে ওদিকে চেয়ে রইল ভাদিম। কয়েক মিনিট পর ধুলোভরা চার জিপগাড়ি থেকে নামল দশজন লোক। তাদেরকে কারবারি বা ব্যবসায়ী বলে মনে হলো না ভাদিমের। প্রায় সবার চেহারা বলে দিচ্ছে তারা ছিল প্রাক্তন সৈনিক বা মার্সেনারি। কারও মুখে হাসি নেই। কয়েকজনের কাঁধে ঝুলছে অটোমেটিক ওয়েপন। অস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক নেই ভাদিমের। কেমন যেন ভয় লেগে উঠল তার। কে জানে, এরা হয়তো ভয়ঙ্কর ডাকাত। এমন একদল লোক, যারা বিনা দ্বিধায় ওকে খুন করবে।

কিন্তু এখন আর পালিয়ে যাওয়ার উপায় নেই!

গম্ভীর চেহারা করে অপেক্ষা করল ভাদিম।

কঠোর চেহারার দু’জন লোক এগিয়ে এসে ওকে ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিল জিপগাড়ির পাশে। দক্ষতার সঙ্গে সার্চ করল একজন। আপত্তি তুলল ভাদিম, ‘আস্তে! সুটের ভাঁজ নষ্ট হচ্ছে!’

কয়েক মুহূর্ত পর দ্বিতীয় লোকটা কর্কশ স্বরে বলল, ‘এর সঙ্গে অস্ত্র নেই।’

ভাদিমকে ছেড়ে পিছিয়ে গেল তারা।.

নিজের সম্মান ফিরে পাওয়ার জন্যে সুট থেকে ধুলো ঝাড়ল কবর-লুঠেরা।

একটা জিপের দিকে ইশারা করল দাড়িওয়ালা এক লোক।

এবার ভাদিম দেখল, ওই জিপের পেছনের সিটে বসে ধূমপান করছে এক লোক। দূর থেকে দেখছে তাকে।

আরও কয়েক মুহূর্ত পর জিপগাড়ি থেকে নেমে ভাদিমের দিকে এল লোকটা। উঁচু কপালে কোঁকড়ানো কালো চুল। পরনে খাকি প্যান্ট। জোরালো তপ্ত হাওয়ায় ফুলে উঠছে ঢিলা শার্ট। উরুর পাশে করডিউরা হোলস্টার থেকে নাক উঁচু করেছে পিস্তলের রাবারের কালো বাঁট লোকটার বামহাতে সরু একটা ব্রিফকেস। মাঝারি আকারের লোক হলেও কী যেন আছে তার ভেতর— সেটা খুব অশুভ কিছু। কালো দুই চোখের গভীরে যেন গোখরার বিষ।

চোখে চোখ রেখে ভাদিম বুঝল, স্বয়ং ঈশ্বরও জানেন না কী চলছে এর মনে!

কেন যেন ভীষণ ভয় লাগল ওর।

সাপের মত স্থির দৃষ্টিতে কোনও ধরনের অনুভূতি নেই লোকটার।

দলের অন্যরাও যেন কেঁচো হয়ে গেছে লোকটার উপস্থিতিতে।

ভাদিমের সামনে এসে থামল লোকটা। বালিতে দৃঢ়ভাবে রেখেছে বুট পরা দুই পা। উদাস দৃষ্টিতে দেখল ফ্রেঞ্চ আর্কিওলজিস্টকে। নরম কণ্ঠে বলল, ‘আমি জমির শেখ।’

ভাদিম টের পেল, অন্যরা মনোযোগ দিয়ে দেখছে ওকে। তাদের ভেতর বেসবল ক্যাপ পরা শক্তপোক্ত লোকটাকেই সবচেয়ে নীচ মনের বলে মনে হলো ওর। ওই লোকও নার্ভাস চোখে দেখছে জমির শেখকে। ন্যাড়ামাথা সরু এক লোকের ওপর চোখ পড়ল ভাদিমের। তার বুকে আড়াআড়ি ভাবে ঝুলছে দুটো অ্যামিউনিশন বেল্ট। দুই হাতে ধরেছে রাইফেল।

চোখের ইশারা করে পাথরের ভাঙা দেয়ালের ছায়ার দিকে চলল জমির শেখ। বাধ্য হয়ে পিছু নিল ভাদিম। মাথার তালু বেয়ে কুলকুল করে নামছে ঘাম। এটা যে গরমের জন্যে হচ্ছে, তা নয়। টেনশনের ফলে ঘাড় ও কাঁধে শুরু হয়েছে ব্যথা। কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে, যে- কোনও সময়ে পিঠে বিধবে বুলেট। ভেবে পেল না, কোন্ অপরাধে মরতে হচ্ছে! কার কী ক্ষতি করেছে ও? মস্তবড় কোনও ভুল করেছিল?

কিন্তু ভাদিমকে বিস্মিত করে অদ্ভুত কাণ্ড করল জমির শেখ। দেয়ালের ছায়ায় বালির ওপর বসে পড়ল। হাতে ইশারা করল পাশে বসতে। সহজ স্বরে বলল, ‘আমি জানি তুমি কে এবং কী করো। আমার ধারণা, তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে।’

লোকটার পাশে বসল ভাদিম। দ্বিধা নিয়ে বলল, ‘বুঝতে পারছি না আসলে কী চান।’

‘একটা জিনিস দেখাব।’

ব্রিফকেস খুলে ভেতর থেকে বড় ম্যানিলা এনভেলপ নিল জমির শেখ। ওটা ধরিয়ে দিল ভাদিমের হাতে। ভুরু – কুঁচকে এনভেলপের ভেতর উঁকি দিল ভাদিম। এনভেলপের ভেতরে রয়েছে বেশ কয়েকটা চকচকে রঙিন ছবি।

আশা নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে জমির শেখ। বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকাল ভাদিম; তারপর ছবিগুলো বের করে ওদিকে মনোনিবেশ করল। এসব ছবি কোনও পাথরের স্ল্যাবের। জিনিসটা প্রাচীন। হাতে খোদাই করা। ধুলোভরা স্ল্যাবের বুকে সারি সারি হায়ারোগ্লি।

‘তুমি কি ওই ভাষা পড়তে পারো?’ জানতে চাইল জমির শেখ।

আনমনে মাথা দোলাল ভাদিম। এরই ভেতর মনোযোগ দিয়েছে লেখাগুলোর প্রতি। ঘাড়ের কাছে কেমন শিরশিরে অনুভূতি হলো। শীতল স্রোত নেমে গেল মেরুদণ্ড বেয়ে। আগ্রহ নিয়ে পড়ছে সিম্বল। বুঝতে শুরু করেছে, কী লেখা আছে পাথরের স্ল্যাবে। হঠাৎ করেই ওদিক থেকে চোখ তুলে সরাসরি জমির শেখের চোখে তাকাল ভাদিম। ‘এটা কোথা থেকে…’

‘পড়ো,’ বাধা দিয়ে বলল লোকটা।

চেহারা থেকে ভীতি কেটে গেছে ভাদিমের। চুপচাপ পড়তে লাগল।

‘ওখানে কী লেখা?’ জানতে চাইল জমির শেখ।

এসব গ্লিফ্ দেখে হতবাক হয়েছে ভাদিম। কয়েক মুহূর্ত পর নিচু গলায় ধীরে ধীরে বলল, ‘এখানে লিখেছে: আমুন এখন সন্তুষ্ট। নিষিদ্ধ করা হলো আমারনার ধর্মদ্রোহী পাষণ্ডকে। সঠিক স্থানে ফিরিয়ে দেয়া হবে সমস্ত ধনদৌলত।’

খুশি হয়ে হাসল জমির শেখ। ‘তুমি শিক্ষিত মানুষ। পাথরের লিপিগুলো অনুবাদ করে দেবে।’

তার কথা শোনেওনি ভাদিম। হাতে এসব কী সেটা বুঝতে পেরে আটকে গেছে শ্বাস। শিরশির করছে সারাশরীর।

নিষিদ্ধ করা হলো আমারনার ধর্মদ্রোহী…

এতই চমকে গেছে যে ভাদিমের হাত থেকে বালির ভেতর পড়ল চকচকে কয়েকটা ছবি।

এটা হতে পারে না!

আমারনা শহর তো হারিয়ে গেছে মরুভূমির বালির নিচে।

ওটার শাসক ছিলেন ধর্মভ্রষ্ট এক ফেরাউন

প্রাচীন গল্পগাথায় লেখা আছে, ওই ফেরাউনকে সম্মান বা গুরুত্ব দেননি সেই আমলের বড় বড় পুরোহিতেরা।

তাঁরা সরিয়ে ফেলেন বিপুল পরিমাণের সম্পদ। কী নিয়ে কাজ করতে হবে, বুঝে গেছে ভাদিম। কিন্তু বর্তমান আর্কিওলজিস্ট বা ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ওই কাহিনী স্রেফ গাঁজা।

সত্যিই কি সরিয়ে নেয়া হয়েছিল লক্ষ-কোটি ডলারের সোনা আর অন্যান্য দামি রত্ন?

না-না, এটা হতেই পারে না!

কিন্তু বাস্তবে যদি সত্যি হয়?

ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করলে যেমন মাথা ঘোরে বাজে ছাত্রের, ঠিক সেভাবেই বনবন করে ঘুরছে ভাদিমের মাথা। কে জানে, সত্যিই হয়তো আছে ওই ট্রেযার! যদি পাওয়া যায়, সেটা হবে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আর্কিওলজিকাল আবিষ্কার। কিংবদন্তির গল্পে যে পরিমাণ সোনাদানার কথা লিখেছে, তার অর্ধেক পেলেও যে-কেউ বলবে, সে পেয়েছে বিশটা তুতেনখামেনের সমাধির চেয়েও বেশি ধনরত্ন!

মুখ তুলে জমির শেখের চোখে তাকাল ভাদিম। ‘এ তো অবিশ্বাস্য!’

তৃপ্তি নিয়ে হাসল জমির শেখ। ‘অন্য লোকটাও এই একই কথা বলেছিল।’

ভুরু কুঁচকে গেল ভাদিমের। ‘অন্য লোক আবার কে?’

‘তুমি দ্বিতীয়জন। তোমাকে দিয়ে যাচাই করে নিলাম। মাইণ্ড কোরো না।’

আত্মা খাঁচাছাড়া হয়ে গেল ভাদিমের। ব্যাটা বলে কী! যাকে-তাকে বলে ফেলেছে এসব? শ্বাস আটকে জানতে চাইল সে, ‘অন্য কাকে বলেছেন এই স্ল্যাবের কথা?’

‘ইজিপশিয়ান মিউযিয়ামের এক কিউরেটর,’ বলল জমির, ‘গতরাতে আমরা দেখা করেছি তার বাড়িতে গিয়ে।’

‘কু-কী?’ ভয়ানক আতঙ্কে হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে উঠল ভাদিমের। ‘কোন্ জনের কাছে গেছেন?’

‘হাদাস্‌সা।’

‘তার সঙ্গে কথা বলেছেন? সর্বনাশ!’

‘ভয় পেয়ো না। কাউকে কিছু বলবে না।’

‘কেন বলবে না?’ রীতিমত অভিমান হচ্ছে ভাদিমের। কেন যে তার কাছে আগে এল না এই লোকটা!

‘বলবে না, কারণ ওকে পছন্দ হয়নি আমার,’ সহজ সুরে বলল জমির শেখ। অলসভঙ্গিতে বসে আছে। তার চোখে তাকাল ভাদিম। পরক্ষণে বুঝল, কী বলেছে লোকটা। চোয়াল ঝুলে গেল ভাদিমের

‘কী লিখেছে?’ জানতে চাইল জমির। ‘হাদাসা কিছু বলেনি?’

‘তা বলেছে। তবে আবারও শুনব তোমার কাছ থেকে। দেখি আমাকে সাহায্য করতে পারো কি না। নইলে খামোকা চুক্তি করতে যাব না।’

‘কীসের চুক্তি?’

‘স্ল্যাব পড়ো,’ একটু বিরক্ত সুরে বলল জমির।

কাঁপা আঙুলে ছবির সিম্বল ছুঁয়ে পড়তে লাগল ভাদিম। বুঝে গেছে, এটা ওর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। সন্তুষ্ট করতে না পারলে ওকে মরুভূমির ভেতরে ফেলে যাবে এরা। কিন্তু এর চেয়েও বেশি জরুরি বিষয় নিয়ে ভাবছে সে। এসব প্রাচীন হায়রোগ্লিফের ইমেজের ভেতর রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্পদের নিশানা। ওগুলো একবার পেলে…

‘অকল্পনীয় পরিমাণের… ধনরত্নের কথা বলেছে,’ হোঁচট খেয়ে বলল ভাদিম। ‘টনকে টন সোনা তো আছেই, সেইসঙ্গে অনেকগুলো সিন্দুক ভরা রত্ন-মানিক… এই যুগে এত সম্পদ দেখেনি কেউ নিজের চোখে। …না, একমিনিট 1 ভুল পড়েছি।’ দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে ধরল ভাদিম। কঠোর চোখে তাকাল ছবির দিকে। ‘মূল্যবান সব আর্টিফ্যাক্ট আর টনকে টন সোনা।’ হতবাক হয়ে জমিরের দিকে তাকাল সে। ভীষণ ধক ধক করছে হৃৎপিণ্ড। ‘আর সেইসঙ্গে আরও অনেক কিছু।

‘এরই ভেতর তারই একটা পেয়েছি,’ সহজ সুরে বলল জমির শেখ। হাতের ইশারা করল দলের লোকদের উদ্দেশে। ‘কাদের, নওশের! ওটা নিয়ে এসো!’

প্রায় দৌড়ে জমির শেখের কালো জিপের কাছে গেল দুই স্যাঙাৎ। গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দু’জন মিলে বের করল কী যেন। ওটা দৈর্ঘ্যে তিনফুট। চটের কাপড় দিয়ে মোড়া। কাদের ও নওশের শক্তিশালী লোক হলেও তাদের কষ্ট হচ্ছে ভারী ওজন বইতে। কয়েকবার বালির ওপর দিয়ে টেনে আনল। ঝুলন্ত রাইফেল বাড়ি মারছে পিঠে। জমিরের দেখিয়ে দেয়া জায়গায় জিনিসটা রাখল। খুলে দিল কয়েকটা দড়ির গিঁঠ। ফোঁস-ফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছে তারা। ঘর্মাক্ত হাত মুছে নিল প্যান্টে।

কাপড়ে মোড়া জিনিসটার দিকে চেয়ে আছে ভাদিম। ভাবছে, ওটা কী হতে পারে!

‘কাপড়টা সরিয়ে দাও,’ ফরাসি কবর-লুঠেরাকে নির্দেশ দিল জমির।

ভাদিম একটু ঝুঁকে চটের কোনা ধরে টান দিতেই খসে পড়ল ওটা।

সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে উঠল জিনিসটা ভাদিমের মনে হলো, ওকে স্নান করিয়ে দেয়া হচ্ছে সোনালি আলো দিয়ে। হাঁ হয়ে গেল মুখ। পিটপিট করে দেখছে সামনের দৃশ্য। একবার কচলে নিল দুই চোখ। আরে, না তো, সত্যিই ভুল দেখছে না সে!

রোদে ঝলসে উঠছে বেড়ালদেবী বেস্টেট-এর সোনার মূর্তি। বিরান মরুভূমির রুক্ষ বালি ও পাথরের মধ্যে দৃশ্যটা কেমন যেন পরাবাস্তব মনে হলো ভাদিমের। কাঁপা হাতে স্পর্শ করল দেবীর স্তন। সত্যিই জিনিসটা সোনাপানি করা নয়, নিরেট সোনা দিয়ে তৈরি! ওজন প্রায় এক হাজার পাউণ্ড। পাগলের মত ব্যস্ত হয়ে দেবীর গাল ও ঠোঁটে আঙুল বোলাল ভাদিম। এত কাছ থেকে এত বড় সোনার মূর্তি আগে দেখেনি। তার ভুল না হলে কমপক্ষে তিন হাজার বছর পর মানুষের চোখ পড়েছে ওটার ওপর।

যারা তাকে চেনে, সবাই বলবে খুব নির্বিকার মনের মানুষ ভাদিম। তবে এখন ভয়ঙ্কর লোভে প্রায় পাগল হলো সে। হামাগুড়ি মেরে গিয়ে ধর্ষণকারীর মত হাত বোলাল দেবীর ঊরু ও ঊরুসন্ধিতে। খুশিতে ওর ইচ্ছে হলো হা-হা করে হেসে উঠতে। ভুলে গেল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সুটের ভাঁজ। ঝিলিক দিচ্ছে সোনার দেবীর মসৃণ ও শীতল দেহ।

জমির শেখ জানাল, কোথায় পেয়েছে ওই মূর্তি। বালির সাগরে ওই যে বহু দূরের পুরনো সেই বেদুঈন দুর্গ, সেখানেই উঠানের কূপ থেকে এসেছে এই জিনিস। ভেতরে ছিল পাথরের কুঠরি। কূপ খননের সময় আরেকটু হলে ওটা বেরিয়ে আসত। ওই কূপের ভেতর যে এক তরুণকে গুলি করে হত্যা করেছে, সে কথা সহজ সুরেই বলল জমির। এটা যেন কোনও বিষয়ই নয়। এ-ও বলল, মূর্তিটা পেয়েছে স্রেফ কপাল জোরে।

চকচকে মূর্তির দিকে ইশারা করল জমির। ‘তোমাকে দেখাব বলেই এত দূরে এনেছি। আমার ধারণা, এরকম শত শত সোনার মূর্তি আছে গুপ্ত কোনও ঘরে।’

চোখের ওপর থেকে ঘাম মুছল ভাদিম। ভাবছে, হায়রোগ্লিস্ অনুযায়ী এর হাজার গুণ বেশি ধনদৌলত লুকিয়ে আছে কোথাও!

ভাদিমের দিকে তর্জনী তাক করল জমির। ‘এবার আমাকে আরও বড়লোক করে দেয়ার জন্যে কাজ করবে তুমি।’

কথাটা শুনে হঠাৎ করেই তিক্ত হাসল ভাদিম। ‘আর তারপর? আমাকেও মেরে ফেলবেন হাদাসার মত করে?’

‘আমাকে হতাশ না করলে ক্ষতি হবে না তোমার,’ বলল জমির। ‘তবে যদি বেইমানি করো, বা কিছু লুকাতে চাও, সেক্ষেত্রে মরবে ভয়ঙ্কর ভাবে। জেনে রাখো, আমি অযৌক্তিক মনের মানুষ নই।’

কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল ভাদিম। প্রায় ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে জমির শেখের ক’জন স্যাঙাৎ। তাদের অস্ত্রগুলো দেখে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল সে, ‘বুঝতে পেরেছি।’

‘সাংস্কৃতিক সম্পদ নিয়ে আমার মাথা-ব্যথা নেই,’ বলল জমির শেখ। ‘আমার চাই কোটি কোটি ডলার। সেগুলো লাগাব জরুরি কাজে।’ সামান্য ঝুঁকে ভাদিমের চোখে সাপের দৃষ্টিতে তাকাল সে। চাহনির ভেতর কেমন অবশ করে দেয়ার মত কিছু আছে। ‘বুঝলে, এখন থেকে আমার হয়ে কাজ করবে। গুপ্তধন পেলে তোমাকে দেব দশ ভাগের এক ভাগ সোনা।’

বারো

চোদ্দ ঘণ্টা আগে দক্ষিণ ফ্রান্সের কোতে দ্য’যুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে রানাকে নিয়ে টেকঅফ করেছে ৭৪৭ জেট বিমান। আর এখন পশ্চিমে তলিয়ে যাচ্ছে ঝলমলে লাল-সোনালি সূর্য। জানালা দিয়ে বহু নিচে দিগন্তে মিশে যাওয়া মরুভূমি দেখছে রানা। আগেও বহুবার এসেছে এ দেশে। মনে পড়ল; অন্যদিকের জানালা দিয়ে চোখে পড়বে বালির সাগরের মাঝে মরূদ্যানের মত বিস্তৃত কায়রো শহর। মেগাপোলিস। আফ্রিকা বা মিডল ইস্টের সবচেয়ে বড়। জনসংখ্যা দুই কোটিরও বেশি। শহরের বুক চিরে গেছে নীল নদ। শেষবেলার সূর্যের রক্তিম আলোয় চিকচিক করছে ঢেউ। দুই তীরে হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে নানান লোকালয়। লাল ও সোনালি আকাশের পটভূমিতে মাথা উঁচু করেছে হাই রাইজ ভবন, গম্বুজ ও মিনার। উত্তর আফ্রিকার যে-কোনও শহরের চেয়ে একদম আলাদা কায়রো। এ শহর অতি প্রাচীন ও অতি আধুনিক সভ্যতার অদ্ভুত মিশেল। যেমন রয়েছে কোটি ডলারের মালিক ধনী লোক, তেমনি আছে ভীষণ গরিব লাখো মানুষ। কোনও কোনও এলাকা এতই সুন্দর, মনে হবে ওটাই স্বর্গ। আবার সামান্য দূরেই হয়তো পূতিগন্ধময় বস্তি। সাংস্কৃতিক দিক থেকে কায়রো যেমন ঐতিহ্যবাহী, তেমনি ওটাকে বলা যেতে পারে পরিবেশ নষ্টকারী নোংরা এক জঘন্য ময়লার ভাগাড়।

গতবার যখন এ শহরে এল রানা, চিনে নিয়েছিল বেশ কয়েকজন মিশরীয় লোককে। রানা এজেন্সির ছেলেরা অতি ব্যস্ত, কাজেই এবার হয়তো সেসব মিশরীয়দের সাহায্য নিতে হবে ওকে। তবে আগের কাজ আগে। ওর জানা আছে প্রথমে যেতে হবে কোথায়। একটা কাগজে ঠিকানা লিখে দিয়েছেন কর্নেল ব্রাউন। পকেট থেকে ওটা বের করে দেখে নিল রানা।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে বেরোতে নেমে গেল সন্ধ্যার আঁধার। তাপ কমতেই যেন নতুন করে জেগে উঠছে কায়রো। কয়েক লেন সমৃদ্ধ হাইওয়ে ধরে তীর বেগে চলেছে রানার ট্যাক্সি। দু’পাশে পেছনে পড়ছে শহরতলী। আরবি ও ইংরেজি বুকে নিয়ে ঝলমল করছে বিশাল সব বিলবোর্ড। ওগুলোর আলো পড়ে চিকচিক করছে নীল নদের কালো জল। শহরের মাঝ দিয়ে ধনীদের পাড়া পাশ কাটিয়ে সোজা অবহেলিত, দরিদ্র মানুষের এলাকায় ঢুকল ট্যাক্সি। সরু এক গলিতে থামল ড্রাইভার। ভাড়া বুঝিয়ে দিয়ে আরবিতে ধন্যবাদ জানিয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ল রানা।

সাহারা মরুভূমি থেকে থেমে থেমে আসছে দমকা হাওয়া। ঘুরপাক খেয়ে বাতাসে ভেসে উঠছে হাজার বছরের বালি। কিছুক্ষণ হেঁটে সাধারণ কংক্রিটের এক ফ্যাসাডে এসে থামল রানা। সামনেই অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। ওখানেই শেষবার ঘর ভাড়া নিয়েছিল মডাক ব্রাউন। ভাবাও যায় না ওই একই লোক কখনও পা রেখেছে বিলাসবহুল সেইবার ইয়টে। দোতলার জানালা দিয়ে আসছে কান ফাটানো রক মিউযিক। সেটার সঙ্গে পেরে উঠছে না বেশ কয়েকটা টিভি। আওয়াজের মিশ্রণে নরক হয়েছে জায়গাটা।

এই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে থাকত কর্নেল জন ব্রাউনের ছেলে, ঠিক যেন বিশ্বাস হতে চাইল না রানার। ভাল এক ইউনিভার্সিটির লেকচারার, তার তো টাকার এত খিঁচ থাকার কথা নয়! তা হলে এই বস্তির মত জায়গায় কেন উঠল সে? টুরিস্টদের মত মাঝারি মানের কোনও হোটেলে উঠতে পারত। তবে মর্ডাক বোধহয় ভেবেছিল দারুণ অ্যাডভেঞ্চার হচ্ছে। মনে হয়তো রোমান্টিক একটা ভাবও ছিল: আছি আফ্রিকার বুকে। একদিন আবিষ্কার করব প্রাচীন কোনও রহস্যময় সমাধি! তখন অ্যাকাডেমিক সমাজে সবাই বলবে: আরিব্বাপরে, তোমরা দেখো কী করেছে মডাক ব্রাউন!

সোনার ঘড়ি ও দামি ব্লেয়ার পরে এসব গলি ধরে হেঁটে গেলে চোর-ডাকাতের মনে হবে, ঘুটঘুটে রাতে হঠাৎ উপস্থিত হয়েছে ঝলমলে এক বাতিঘর। এমন মগা লোকই তো চাই!

বারোটারও বেশি ভাষা জানেন, দুনিয়ার যে-কোনও জায়গায় মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যেতে পারবেন জন ব্রাউন। নাহ্, সত্যি, একেবারেই বাবার মত ছিল না মডাক।

সিঁড়িঘরে ঢুকে প্রথম ধাপে পা রাখল রানা। দেয়ালে হালকা রঙের প্রলেপ দিয়ে অশ্লীল সব বাক্য মোছার চেষ্টা করেছে কেউ। তবুও ফুটে আছে সব। কয়েক ধাপ পার হয়ে দোতলায় উঠে থামল রানা। চারদিকে আঁচড় ভরা পুরনো চারটে দরজা। সেগুলোর একটা হঠাৎ খুলে গেল। রাগী চেহারা নিয়ে রানাকে পাশ কাটিয়ে নেমে গেল এক তরুণ। দরজায় এসে দাঁড়াল এক তরুণী, কাঁদছে বলে চোখ ভেজা তার।

দারুণ জায়গা, তিক্ত মনে ভাবল রানা। দরজাগুলোর নম্বর দেখে নিয়ে উঠে এল আরেক তলা। ধুপধুপ আওয়াজে বাজছে বেয গিটার, কাঁপছে দেয়াল ও মেঝে। খুব শক্তিশালী গলার গলার এক শিশু হার মানিয়ে দিয়েছে গিটারওয়ালাকে। বাচ্চার পাশের ঘরেই বোধহয় স্বামীর সঙ্গে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ঝগড়া জুড়েছে তার মা। ধুড়ুম করে বন্ধ হলো একটা দরজা। মেঝেতে পড়ে ঝনঝন করে ভাঙল কিছু। থমকে দাঁড়িয়ে কান পাতল রানা। চেঁচামেচি থেকে মনে হচ্ছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ জয়ে নেমেছে স্বামী-স্ত্রী। ধুপধুপ করে বাজছে গিটার। চেঁচিয়ে চলেছে মারাত্মক গলার শিশু। হাঁড়িপাতিল আছড়ে পড়ল। কেমন যেন উদাস হয়ে গেল রানা। বুঝে গেছে, এই বাড়িতে ওকে কেচে মোরব্বা করা হলেও, পাশের ঘর থেকে শুনবে না কেউ। আর শুনলেও পাত্তা দেবে না। যে যার তালে ব্যস্ত।

আরেক তলা উঠে এল রানা। আবারও দরজার নম্বর দেখে নিল। হ্যাঁ, এবার ঠিক জায়গায় এসেছে।

মর্ডাকের ফ্ল্যাটের দরজা আধখোলা। নিঃশব্দ পায়ে ভেতরে ঢুকল রানা। বহু দিন আগেই এখান থেকে ঘুরে গেছে পুলিশ। গরিবি হালের অ্যাপার্টমেন্ট, তবে পরিষ্কার। চারপাশ গুছিয়ে রেখেছে কেউ। বাড়ির মালিক বোধহয় আশা করছে যে-কোনও দিন ভাড়া হবে অ্যাপার্টমেন্ট।

‘আপনার জন্যে কী করতে পারি, স্যর?’ ইংরেজিতে জানতে চাইল কেউ।

ঘুরে দাঁড়াল রানা। মোটা এক লোক বেরিয়ে এসেছে কিচেন থেকে। নাভি ছুঁই-ছুঁই করছে কুচকুচে কালো দাড়ি। চোখে কেন যেন অভিযোগ। পরনের ভেস্টের ওপরে সুট জ্যাকেট। মোটা আঙুলগুলো দিয়ে ধরে রেখেছে ধাতব এক টুলবক্স। ওটার ঢাকনি খোলা। ভেতরে একটা হাতুড়ি ও রেঞ্চ। রানা বুঝে নিল, হয় এ কেয়ারটেকার, নইলে অ্যাপার্টমেন্টের মালিক। বিদেশি লোক দেখে ইংরেজিতে কথা বলছে। উদ্দেশ্য ঘর ভাড়া দেয়া।

‘ফ্ল্যাট খালি মনে হচ্ছে,’ বলল রানা।

‘ইচ্ছে হলে ভাড়া নিতে পারেন।

টুলবক্স দেখাল রানা। ‘প্লামিঙের সমস্যা আছে?’

‘না, কোনও সমস্যা নেই। ঘর ভাড়া নেবেন?’

‘হয়তো।’ ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল রানা। চলে গেল পাশের ঘরে। ওটা ছোট বেডরুম। সিঙ্গেল খাটের ওপর ম্যাট্রেস। ভাঁজ করা চাদরটা দেখল পাশের চেয়ারে। একপাশে সস্তা চেস্ট অভ ড্রয়ার। মাথার ওপর শেডবিহীন বাতি। আবারও রানার চোখ ফিরল ম্যাট্রেসের ওপর। ওখানে স্ফিঙ্কস্-এর প্রিন্ট। মর্ডাকের মত কম পয়সার টুরিস্ট হয়তো খুশি হবে। পুলিশের তোলা ছবির মতই ঘরটা। অবশ্য এখন বিছানার ওপর পড়ে নেই মর্ডাকের রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত লাশ। দেয়ালের রক্তের খয়েরি দগদগে দাগ ঢাকা পড়েছে নতুন সাদা রঙে। পরিষ্কার করা হয়েছে মেঝে।

দু’মাস পর কেই-বা বুঝবে এখানে ভয়ঙ্কর ভাবে খুন হয়েছে নিরীহ এক লোক।

‘আপনি পাবেন স্যাটেলাইট টিভি আর ইন্টারনেট,’ আপোষের সুরে বলল বাড়ির মালিক, ‘ঠকছেন না।’

মাথা দোলাল রানা। ‘কিছু দিন আগে এখানে ছিল আমার এক বন্ধু। আপনার বোধহয় মনে আছে তার কথা?’

হাতের ঝাপটায় কথাটা উড়িয়ে দিল দাড়িওয়ালা। ‘আমার তো আর খেয়ে কাজ নেই যে সবাইকে মনে রাখব।’

‘তবে যারা এখানে খুন হয়, তাদের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে?’

ভুরু ও নাক-মুখ কুঁচকে রানাকে দেখল লোকটা। ‘আপনি আসলে কে?’

‘উল্লেখযোগ্য কেউ নই,’ বলল রানা। ‘তবে এই বাড়িতে নিরীহ একজন মানুষকে ছুরি মেরে খুন করা হয়েছে জানলে কারই বা ভাল লাগবে বলুন। আপনি হয়তো দেখেছেন, আমার ওই বন্ধুর হাতে ছিল সোনার রোলেক্স ঘড়ি। খুন হয়েছে বোধহয় ওটার জন্যেই।’

দাড়িভরা মুখের অনাবৃত ত্বক লালচে হয়ে উঠল বাড়ির মালিকের। ‘আমি আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে একটা কথাও বলব না। ঘর ভাড়া নিলে নেবেন, নইলে বিদায় হবেন। অত ঝামেলা করছেন কেন?’

‘ঝামেলা করছি না, ভাবছি,’ বলে প্যান্টের পেছন পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল রানা। ওটা থেকে নিল বেশ কয়েকটা ইজিপশিয়ান পাউণ্ড। না গুনেই বাড়িয়ে দিল লোকটার দিকে। ‘আশা করি এতে একসপ্তাহ চলবে?’

চকচক করে উঠেছে লোকটার দুই চোখ। হাত বাড়িয়ে দিল টাকা নেয়ার জন্যে। কিন্তু নোটসহ হাত পিছিয়ে নিল রানা। নরম সুরে বলল, ‘আপনি এই বাড়িতেই থাকেন?’

টাকা পাবে বুঝে খুশি হয়ে হাসল লোকটা। ভেঙে গেল মনের কঠিন দেয়াল। বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে এমনই হয়। মাথা কাত করে ওপরের দিক দেখাল সে। ‘টপ ফ্লোরে থাকি।’

‘আপনিই কি লাশটা পেয়েছিলেন?’

মাথা দোলাল বাড়ির মালিক। ‘দরজা খোলা ছিল। দেয়ালে দেখলাম অনেক রক্ত।

‘কখনও আমার ওই বন্ধুর সঙ্গে অন্য কাউকে দেখেছেন? অন্য কেউ আসত এখানে?’

‘সেরকম কিছু তো মনে পড়ছে না। না, কাউকে দেখিনি। আসলে সবসময় নিজের কাজে ব্যস্ত থাকি।’

কথাটা সত্য হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। সময় বলে দেবে সব। ‘ভাড়া নিলাম অ্যাপার্টমেন্ট,’ বলে টাকাগুলো দাড়িওয়ালার হাতে দিল রানা। লোকটা বিদায় নেয়ার পর খুলে দিল জানালাগুলো। নিচে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে গাড়িঘোড়া। ব্যাগ থেকে সরু ফোল্ডার নিয়ে করোনার ও পুলিশের রিপোর্ট খুঁটিয়ে দেখল রানা। পুলিশের রিপোর্টের শেষে সই করেছে অফিসার-ইন-চার্জ। নাম এমাজউল্লাহ্। এই লোকের সঙ্গেই দেখা করেছিলেন কর্নেল ব্রাউন। ওপর মহল থেকে চাপ আসেনি বলে সাদামাটা ভাবে তদন্ত করেছে পুলিশ।

রিপোর্টগুলো রেখে আবারও মর্ডাকের লাশের ছবি দেখল রানা। রক্তাক্ত বুক ও পেটের অবস্থা খুব খারাপ। স্বাভাবিক ভাবেই ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন কর্নেল ব্রাউন। হোমিসাইডের প্যাথোলজিস্টের ধারণা, মর্ডাক খুন হয়েছে ম্যাচেটির মত ভারী ফলার কোনও ছোরার আঘাতে।

ছবি টেবিলে নামিয়ে রেখে হাতঘড়ি দেখল রানা। কাগজপত্র ও ছবি ভরল ফোল্ডারে। ব্যাগে ফোল্ডার রেখে কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে বেরোল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। দরজা বন্ধ করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে দাঁড়াল খোলা আকাশের নিচে। ওর জানা আছে, এবার কোথায় যেতে হবে।

তুবড়ে যাওয়া এক মার্সিডিস ক্যাব ভাড়া নিল রানা। ওর নির্দেশ অনুযায়ী নীল নদের পুবে হাজির হলো ড্রাইভার। ক্রমেই সরু হয়েছে এদিকের রাস্তা। চারদিকে ভাড়া দেবার বাড়িঘর আর শত শত প্রাচীন মসজিদ। এক জায়গায় ট্যাক্সি ড্রাইভারকে থামতে বলল রানা। একটু দূরেই মানশিয়াত নাসের নামের বস্তি এলাকা। ওটাকে বলা হয় আবর্জনার শহর। গাড়ি থেকে নেমে ছায়াভরা সরু গলির ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল রানা। শুনতে পেল খট খট আওয়াজ। টানা গাড়ি নিয়ে যাওয়ার ফাঁকে পা ঠুকেছে গাধা। চালকের আসনে কমবয়সী এক ছেলে। গলির দু’পাশে দশ ফুট উঁচু আবর্জনা। ওগুলোর ভেতর বিক্রিযোগ্য কিছু থাকে, তাই এসব গাড়ি আসে এই এলাকায়। মানুষের ফেলে দেয়া জিনিসের ওপর ভর করে চলছে এই ইণ্ডাস্ট্রি। ওই ছেলের ভবিষ্যৎ ময়লা ঘাঁটা, আনমনে ভাবল রানা। মুহূর্তের জন্যে চোখে চোখ পড়ল দু’জনের, তারপর অন্ধকারে হারিয়ে গেল গাধায় টানা গাড়ি।

তিন মিনিট পর পরিচিত এক দরজার সামনে পৌছুল রানা। চুন-সুরকি খসে পড়ায় দাঁত খিঁচানো ইঁট বেরিয়ে এসেছে। মর্ডাকের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের চেয়েও জীর্ণ এটা। গতবার যেমন দেখেছিল, তেমনই আছে সব। মালিকও বোধহয় বদলে যায়নি।

চোরাই জিনিস কিনতে হলে লোকে খোঁজ নেয় ইসার। কায়রোর নোংরামি ভরা সব কাজেই দুই হাতের নয় আঙুল গুঁজে রেখেছে সে। অবশিষ্ট আঙুলটা বহু দিন আগেই বোল্ট ক্রপার দিয়ে কেটে নিয়েছে তার চেয়েও হারামি কেউ। ওই ঘটনার পর থেকে বেশি গরম কিছু দেখলে ভুলেও ওটার ভেতর নাক গুঁজতে যায় না সে। মেয়েমানুষ বা অস্ত্রের ব্যবসায় অ্যালার্জি এসে গেছে। তবে এ ধরনের ব্যবসার প্রতিটি অ্যাংগেল ভাল করেই জানে ইসা। চেনে শত শত চোর-বাটপারকে। সম্পর্ক রাখে।

আবর্জনা ভরা বাইরের পরিবেশের চেয়েও দুর্গন্ধময় প্রায় ধসে পড়া অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ভেতর অংশ। সিঁড়িঘরে হলদে নোংরা বাল্ব্ যখন খুশি টিপটিপ করে জ্বলে উঠছে, আবার নিভেও যাচ্ছে। ছাতা পড়া দেয়াল বেয়ে পড়ছে ফোঁটা-ফোঁটা ময়লা পানি। একেকবারে দুই ধাপ করে সিঁড়ি টপকে ওপরে উঠতে লাগল রানা। দোতলার ল্যাণ্ডিঙে না থেমে প্রচণ্ড এক লাথি মেরে খুলল সামনের দরজাটা। ওদিকে অন্ধকার হলওয়ে।

দরজা ধুম্ করে খুলে যেতেই নিজের অফিস থেকে ছিটকে বেরোল ইসা। ডানহাতে কক করা পিস্তল। বাঁটের ওপর রেখেছে কাটা পড়া আধ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের বুড়ো আঙুল। টেকো, শুঁটকি, বুড়ো ইসাকে দেখে যে-কেউ ধরে নেবে, সে নিরীহ মানুষ। কিন্তু রানা জানে, এই পিচ্ছিল কেঁচোটা যে-কোনও সময়ে হয়ে উঠতে পারে অজগর। আর সেজন্যেই দরজা খুলে কবাটের আড়ালে অন্ধকারে অপেক্ষা করছে রানা। হলওয়েতে বেরোতেই আচমকা জোরালো এক লাথি খেয়ে উড়ে গেল ইসার হাতের পিস্তল।

রানা সিধে হতেই ওকে চিনে ফেলল ইসা। চাপা স্বরে গালি দিয়েই গোখরার মত ছোবল দিল জ্যাকেটের ভেতর। ঠিক সময়ে কোমর মুচড়ে সরে গেছে রানা। নইলে ওর পাঁজরে ঢুকত সরু ফলার ছোরা। খপ্ করে কবজি ধরে বুড়োকে ঘুরিয়ে নিয়ে আর্ম-লকে আটকে ফেলল রানা। খটাস্ করে মেঝেতে পড়ল ছোরা।

ধীর হয়ে যাচ্ছ, ইসা,’ আরবিতে বলল রানা।

টপটপ করে ঘাম ঝরছে টেকো মাথার তালু থেকে। বুড়ো বুঝে গেছে, গায়ের জোরে কাজ হবে না। অবশ্য জঘন্য গালি দেয়া তার জাতীয় অধিকার। ‘ইবলিশের বাচ্চা! কথা দিয়েছিলি আর কখনও আসবি না!’

ঠেলে নিয়ে শুঁটকি শরীরটাকে অফিসের দিকে নিল রানা। ঘাড় ধরে বসিয়ে দিল খটখটে, এক কাঠের চেয়ারে। নানাদিকে খসে পড়ছে দেয়ালের ঝুরঝুরে সিমেন্ট। ছাত থেকে ঝুলন্ত একমাত্র বা ঘিরে ভনভন করে ঘুরছে পেটমোটা কয়েকটা কালো মাছি। ইসার ডেস্কের ওপর কয়েক তোড়া ব্যাঙ্ক নোট, কয়েকটা ছবি আর অব্যবহৃত পাসপোর্ট। ডেস্কের পেছনে দেয়ালে গেঁথে রাখা হয়েছে লোহার সিন্দুক। ওটার ভেতর কী আছে জানার আগ্রহ নেই রানার।

খেপে ব্যোম হয়ে গেছে বুড়ো। তার ওপর চোখ রেখে মেঝে থেকে পিস্তলটা তুলল রানা। ওটা চেক সি-যেড ৭৫, নাইন এমএম সেমি-অটো। হাতের ভেতর সুন্দর ভাবে বসে গেল। পুরনো আমলের স্টিলের তৈরি ভারী অস্ত্র। হাই- ক্যাপাসিটি ম্যাগাযিন। ভাল ভাবে পরিষ্কার করে তেল দেয়া। নলের মুখে সাইলেন্সার। চেম্বার ও ম্যাগাযিন পরীক্ষা করল রানা। পিস্তল পুরো লোডেড।

‘আমার তো এখন মনে হচ্ছে মিথ্যাই বলেছি,’ বলল রানা। ‘আবারও তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভাল লাগছে, ইসা।’

‘আগেরবার তোর জন্যে আরেকটু হলে আমার পাছা পুড়িয়ে দিত!’ ঘোঁৎ করে উঠল বুড়ো। ‘হারামি ভেতো বাঙালি কোথাকার!’

‘আহা, এত রাগ করতে হয়?’ জিভ দিয়ে চুকচুক করে আওয়াজ করল রানা। ‘তোমার কাজই তো এমন। কিডন্যাপারদের ব্যাপারে তথ্য দিলে রাগ করবে না ওরা?’

‘আমি কি আর কিছু বলতে চেয়েছি?’ কবজি ডলছে ইসা। ‘তুই-ই তো ভেঙে দিতে চাইলি আমার ঘাড়! …তো এবার কী চাই?’

‘সহজ কাজ। দু’একটা নাম বলবে। ব্যস, তারপর বিদায় নেব। আর কখনও দেখা হবে না। খবরের জন্যে কয়টা টাকাও দেব।’

বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল ইসা। ‘আগের বারেও তথ্য চেয়েছিলি। দিয়েই মরতে বসেছিলাম আরেকটু হলে।’

‘আমি অতটা খারাপ লোক হলে এখনও তোমার নয়টা আঙুল থাকত?’ অভিমানের সুরে বলল রানা।

‘আমি চাই এই নয়টা আঙুল নিয়ে ঠিক সময়ে কবরে যেতে।’

মুচকি হাসল রানা। ‘আগেই বলেছি, এবার সহজ কাজ। একদম প্রমিজ, ইসা! এবার জানতে চাই কোথা থেকে কিনতে পারব ভাল একটা ঘড়ি।’

‘ঘড়ি? আর কিছু না তো?’

‘প্ৰমিয।’

রাগ কমেছে ইসার। আঙুল তুলে ওমেগা দেখাল। ‘তোমার হাতে তো ঘড়ি আছে।’

‘বিশেষ একটা ঘড়ি খুঁজছি। পুরো দাম দেব না ওটার জন্যে। বলো তো কোথায় পাই তেমন ঘড়ি?’

কাঁধ ঝাঁকাল ইসা। ‘কায়রোর যে-কোনও জায়গায় পাবে। লাখ লাখ মানুষের কাছে। একটা কেড়ে নিলেই হলো। আমাকে এসব জিজ্ঞেস করার মানেটা কী?’

‘ইসা, তুমি তো বুদ্ধিমান মানুষ, তাই না?’ মানিব্যাগ বের করে ওখান থেকে কয়েকটা নোট নিয়ে বুড়োর নাকে হাওয়া দিল রানা। লোভী চোখে ওগুলো দেখল ইসা। ‘আমি খুঁজছি মার্কেটে আসা কয়েক মাস আগের একটা ঘড়ি। সোনার ওয়েস্টার রোলেক্স। বিশেষ জিনিস। ওটার জন্যে টাকা দিতেও আপত্তি নেই। কোনও ঝামেলায় পড়বে না তুমি।’

সন্দেহ নিয়ে রানাকে দেখল বুড়ো ইসা। ‘ওটা চাই কেন?’

‘ব্যক্তিগত আগ্রহ বলতে পারো। ওটা ফেরত চাই।’

‘কাউকে পেটাবে না তো? বা খুন করবে না তো?’

‘কেউ গায়ে পড়ে ঝামেলা না করলে কিছুই হবে না।’ কিছুক্ষণ নীরবে কী যেন ভাবল ইসা। হাসিতে কুঁচকে গেল দুই গাল।

রানা বুঝতে পেরেছে, বুড়ো কী ভাবছে। ‘নয়টা আঙুল যখন আছে, আর অত চিন্তা কীসের? ব্যাটাকে বলে দিই সব!’

‘তোমাকে কয়েকজনের নামের একটা লিস্টি দেব,’ বলল ইসা। ‘ওই ঘড়ি এখনও কায়রোয় থাকলে, ওটার কথা বলতে পারবে ওদের কেউ।’

দশ মিনিট পর আবারও রাস্তায় নেমে এল রানা। কোমরে গুঁজে রেখেছে ইসার সি-যেড ৭৫ পিস্তল। পকেটের নোটপ্যাডে পাঁচজন লোকের নাম ও ঠিকানা। হনহন করে হেঁটে গিয়ে উঠে পড়ল অপেক্ষারত ট্যাক্সিতে। বুঝে গেছে, দীর্ঘ হবে আজকের এই রাত।

তেরো

একঘণ্টা পেরোবার আগেই পাঁচজনের লিস্ট থেকে তিনজন ঝরে গেল। যা ভেবেছে, কাজটা তার চেয়ে কঠিন মনে হচ্ছে রানার। প্রথমজনের খোঁজে গেছে নীল নদের পশ্চিমতীরে পোর্টাকেবিনে। চারপাশ যেন পাথরখণ্ডের তৈরি সাগর। চাঁদের আলোয় আকাশ-ছোঁয়া ক্রেনের ছায়া পড়েছে বহু দূরে। বড় একটা বিলবোর্ড থেকে রানা জেনেছে, নতুন উন্নয়ন কর্মের জন্যে বোমা ফাটিয়ে ধসিয়ে দেয়া হয়েছে পুরো এলাকার বাড়িঘর।

দ্বিতীয় ঠিকানায় দেখল জায়গাটা একেবারেই পরিত্যক্ত। তখন ওর মনে সন্দেহ জাগল, বোধহয় ওকে ঠকিয়ে টাকাগুলো হাপিস করে দিয়েছে ইসা। বেশ রেগেও গেল। ঠিক করে ফেলল, এই পাঁচ জায়গায় ঢু মেরে কাউকে না পেলে, আবারও গিয়ে চেপে ধরবে পাজি বুড়োটাকে। ডাহা মিথ্যা বলেছে বলে একটা একটা করে হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়বে ব্যাটার পাকা দাড়ি।

কিন্তু তৃতীয় ঠিকানায় পৌঁছে আবারও আশান্বিত হয়ে উঠল রানা। ঠিক জায়গা থেকে কয়েক শ’ গজ দূরেই নেমে পড়েছে ট্যাক্সি থেকে। বাকি পথ গেল হেঁটে। মিথ্যা বলেনি ইসা। বড় রাস্তা থেকে দূরে ছোট এক বন্ধকী দোকান। আশপাশের চোর-চোর চেহারার লোকগুলোকে দেখে ওর মনে হলো, ঠিক জায়গাতেই এসেছে। সস্তা হোক বা দামি, চোরাই সব জিনিসই কিনে নেয় বন্ধকী দোকানের মালিক জলিল। এই লোকই নাকি কায়রোর ছোটখাটো চোরাই জিনিসের সবচেয়ে বড় ডিলার। দোকানের সামনের জানালার তাকে সাজিয়ে রেখেছে ইলেকট্রিক গিটার ও ক্যামকর্ড। ইসার কথা ঠিক হলে, চোরাই মাল আছে দোতলায় হাজি জলিলের ব্যক্তিগত আস্তানায়।

দোকানের পাশেই ছোট গেট পেয়ে রানা বুঝল, খুব ঝামেলা হবে না ভেতরে ঢুকতে। পরের পাঁচ মিনিট ব্যয় করে নিঃশব্দে ঢুকল হলওয়েতে। পরের মিনিটে একবার বিইপ শব্দে বেজে উঠতে না উঠতেই দূরের কন্ট্রোল বক্সের সঙ্গে যুক্ত অ্যালার্ম কিপ্যাড উপড়ে ফেলল দেয়াল থেকে। ব্যাগ থেকে বের করে জ্বেলে নিল ম্যাগলাইট। চারপাশ দেখে ওর মনে হলো, দোকানের ভেতরটা আলিবাবার রূপকথার সেই চোরাই মালের গুহা। যদিও বেশিরভাগ জিনিসই অকাজের। ধীর গতিতে একেকটা দিক সার্চ করছে ও। একটা কাঁচের কেবিনেটের ভেতর পেল বেশ কিছু ঘড়ি। সেকোণ্ডা, টাইমেক্স, ক্যাসিয়ো, সিটিযেন…

নাহ্, দামি কিছু নেই ওখানে। থাকার কথাও নয়। খোলা ডিসপ্লেতে দামি জিনিস রাখবে না জলিল।

একটা সবুজ পর্দার ওদিকেই দোতলায় ওঠার সিঁড়ি বেল্টে গুঁজে রাখা ইসার পিস্তলটা হাতে নিয়ে নিঃশব্দে এক ধাপ এক ধাপ করে উঠতে লাগল রানা। ওপরের ল্যাণ্ডিঙের সামনেই দরজা। তলা দিয়ে আসছে হলদে আলো। খিক- খিক-হো-হো-হা-হা নকল হাসির আওয়াজ। বোধহয় ওগুলো আসছে কোনও টিভি থেকে। পশ্চিমা কমেডি শো দেখছে জলিল। আওয়াজ বাড়িয়ে রেখেছে বলে অ্যালার্মের বিইপ আওয়াজটা আর শুনতে পায়নি। অন্ধকারে হাসল রানা।

ছিহ, জলিল, সবসময় নিজের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখতে হয়!

পলকা কাঠের হালকা দরজা ভেঙে পড়ল রানার প্রথম লাথি খেয়েই।

ঘরে একা জলিল। মেঝেতে ছড়িয়ে রেখেছে ফাস্টফুডের খালি বাক্স আর কুকীর্তি শেষে ফেলে দেয়া কণ্ডোম। টিভির দিকে চেয়ে সোফায় বসে আছে লোকটা। পরনে লাল জাঙ্গিয়া। একহাতে চামচ, অন্য হাতে আইসক্রিমের বাটি। দরজা ভেঙে পড়তেই ভীষণ চমকে ঘুরে চেয়েছে সে। মুখের কালো দাড়ির মাঝ থেকে উঁকি দিয়েছে একগাদা নোংরা, হলদে, এবড়োখেবড়ো দাঁত।

ব্যাটা হরর সিনেমার দেঁতো পিশাচ ভিলেন, ভাবল রানা।

ভয় পেয়ে তার হাত থেকে পড়ে গেছে আইসক্রিমের বাটি। কয়েক পা ফেলে ঠিক জায়গায় পৌছে গেল রানা। খপ্ করে ধরল ওর কুচকুচে কালো দাড়ি। লোকটাকে হিড়হিড় করে টেনে সোফা থেকে নামিয়ে ফেলল মেঝেতে। চিত হয়ে পড়েছে জলিল। এতই বিহ্বল, টু শব্দ বেরোয়নি মুখ থেকে।

সহজ-সরলভাবে কার্যোদ্ধারে অভ্যস্ত রানা। যেভাবে ক্ষুধার্ত বাঘের ভয়ানক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জলিলের দিকে, গলা শুকিয়ে যাবে যে-কারও।

তার রোমশ বুকে একটা পা তুলে দিয়ে সি-যেড ৭৫- এর নল তাক করল বাঁকা নাকের দিকে। দেখছে ভীত চোখদুটো। ধমকে উঠল রানা, ‘অ্যাই, শালার ব্যাটা, তোকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। জবাব না দিলে তুই মরবি!’

পাঁচ মিনিট পর আবারও দমে গেল রানার মন। জলিল খলিলুল্লাহ্ কিছুই জানে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মাইল খানেক দৌড়ে আসা কুকুরের মত হাঁপাচ্ছে সে। কপাল বেয়ে কুলকুল করে নামছে ঘামের স্রোত। ভীষণ আতঙ্ক দুই চোখে। এই লোক পাশ করেছে কঠিন পরীক্ষায়। আর কিছু করার নেই। এবার যেতে হবে লিস্টের পরের ঠিকানায়।

ভাঙা দরজা পেরোবার সময় হুমকি দিল রানা, ‘খবরদার, আবারও যদি দেখেছি যেখানে সেখানে নোংরা কণ্ডোম ফেলতে…!’

হাসি চেপে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ও। গিয়ে উঠতে হবে তুবড়ে যাওয়া মার্সিডিয ক্যাবে।

.

মাঝরাত পেরোবার পর লিস্টের চতুর্থ ঠিকানার কাছে পৌঁছুল রানা। ট্যাক্সি থেমে যেতেই দ্বিতীয়বার দেখে নিল ঠিকানাটা।

না, ঠিক জায়গাতেই এসেছে।

গাড়ির দরজা খুলে বেরোতেই গায়ে লাগল রাতের ভেজা ও গরম হাওয়া। রানা ভাবতেও পারেনি ইসার কন্ট্যাক্ট এই ধরনের বাড়িতে থাকবে। মধ্যবিত্ত এলাকার শান্ত রাস্তার দু’দিকে ছোট সব বাগানওয়ালা সাদা বাড়ি। পেভমেন্টে সারি সারি গাড়ি বেশিরভাগই নতুন। এসব এলাকায় বাস করবে শিক্ষক-শিক্ষিকারা। হয়তো ধনী নয়, তবে গরিবও নয়। চারপাশে হৈচৈ, হট্টগোল নেই। নিরাপদ একটা পাড়া। ইসার মত লোক এ এলাকায় থাকলে, আশপাশের কেউ বুঝবেও না গোপনে কী করছে সে। অথবা, নির্জলা মিথ্যা বলেছে ঘাগু বুড়ো।

বাড়িটার দিকে চেয়ে রইল রানা। বাতি জ্বলছে ওপরতলায়। পর্দার ফাঁক দিয়ে আসছে সাদা আলো। ভেতরে হেঁটে গেল কে যেন। বোধহয় এবার শুয়ে পড়বে। কয়েক মুহূর্ত দ্বিধার পর ছোট্ট রটআয়ার্নের গেট ঠেলে সদর দরজায় থামল রানা। একবার বেল টিপল। পেরিয়ে গেল পুরো একমিনিট। তারপর শুনতে পেল সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে পায়ের আওয়াজ। আরবি ভাষায় কী যেন বলল এক মহিলা। একটু পর দরজার ওদিক থেকে পাতলা ধাতুর প্লেট সরিয়ে উঁকি দিল কেউ। সামান্য খুলে গেল দরজা। এখনও লাগানো সিকিউরিটি চেইন।

চৌকো ফাঁক দিয়ে মহিলার মুখ দেখল রানা। তার কপালে ও চোখের কোণে ভাঁজ। বয়স হবে চল্লিশ মত। খুব ক্লান্ত এবং ধসে যাওয়া চেহারা। চুলের একপাশে পাক ধরেছে। চোখ সরু করে সন্দেহের দৃষ্টিতে ওকে দেখল মহিলা।

তিন ইঞ্চি ফাঁক হয়েছে দরজা। পেছনের হলওয়েতে দুই কিশোর ছেলে। পরনে টি-শার্ট ও হাফ প্যান্ট। উস্কোখুস্কো চুল। একজনের বয়স তেরো, অন্যজনের পনেরো। রহস্যময় এক লোক এসেছে বুঝতে পেরে বিছানা ছেড়ে নেমে এসেছে ওরা। কঠোর চেহারা করেছে বড়জন। ভাবছে, দরকারে মাকে রক্ষা করবে। রানা বুঝল, কর্তা নেই বাড়িতে। দুই ছেলের পেছনে হলওয়েতে নানাধরনের কার্ডবক্স ও ক্রেট। ওর মনে হলো, হয় এরা বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে, নইলে উঠেছে মাত্র গতকাল। এখানে সুবিধা হবে বলে মনে হলো না ওর। আরেকবার লিস্টের ঠিকানা দেখে নিয়ে নরম সুরে আরবিতে জিজ্ঞেস করল, ‘মিসেস জামান?’

‘কে আপনি?’ জানতে চাইল মহিলা। ‘এখন তো অনেক রাত। আপনি কী চান?’

‘আপনার স্বামীর সঙ্গে আলাপ আছে, মিসেস জামান। আমি কি ভেতরে আসতে পারি?’

দ্বিধা করল মহিলা, তারপর মাথা নাড়ল। ‘আমার স্বামী এখন আর এখানে থাকেন না।’

‘তাঁকে কোথায় পাব বলতে পারেন? ব্যাপারটা জরুরি।’

‘যে কারণেই এসে থাকুন, * আপনি দেরি করে ফেলেছেন।’

‘কোথায় গেছেন?’ জানতে চাইল রানা। পরক্ষণে মহিলার চোখে গভীর কষ্ট দেখে সবই বুঝে গেল ও।

চুপ করে আছে মহিলা। নিচু হয়েছে মাথা। হাত দিয়ে মুছে ফেলল চোখের জল। দরজার সামনে এল বয়সে বড় কিশোর। টান দিয়ে খুলল সিকিউরিটি চেইন। বেরিয়ে এল ছেলেটা। চোখে রাগ ও ক্ষোভ। দরকারে লড়াই করবে। ফুলিয়ে রেখেছে শীর্ণ বুক ও দুই কাঁধ। সাহস আছে ছেলের, ভাবল রানা। বাচ্চা মানুষ, তবে প্রয়োজনে জান দেবে নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে। নিজের কিশোর বয়সের কথা মনে পড়ল রানার। মৃদু হাসল ছেলেটার দিকে চেয়ে। ‘দুঃখিত, তোমাদেরকে বিরক্ত করতে চাইনি।’

‘আমার বাবা মারা গেছেন,’ আড়ষ্ট

আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল কিশোর। ‘আপনি চলে যান। আর বিরক্ত করবেন না আমার মাকে।’

হলওয়ের দিকে তাকাল রানা। এই পরিবার বোধহয় বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছে এ বাড়ি ছেড়ে। পেছনে রেখে যাবে অতীত সুখদুঃখের স্মৃতি।

‘আপনি কে?’ ছেলের কাঁধে হাত রাখল মহিলা। ‘আপনি নিশ্চয়ই পুলিশ নন?’

‘না, তা নই,’ বলল রানা। ‘আমি একটা জিনিস খুঁজছি, যেটা হয়তো পেতে সাহায্য করতেন আপনার স্বামী।

‘অনেক দিন ধরেই অসুস্থ ছিল,’ কাঁদতে শুরু করেছে মহিলা। ‘কড়া ডায়াবেটিস। ডাক্তাররা প্রথমে এক পা কেটে ফেলল। তারপর অন্যটাও। আর এখন তো মরেই গেছে মানুষটা। জানি না কী খুঁজছেন, তবে আপনি চলে গেলে খুশি হব।’

মহিলার দুই গাল বেয়ে নেমেছে অশ্রু। মন খারাপ হয়ে গেল রানার। মাঝরাতে বিরক্ত করেছে বলে দুঃখপ্রকাশ করে ট্যাক্সির দিকে চলল ও। পেছনে শুনল দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ। স্টিয়ারিং হুইলের দিকে ঝুঁকে একহাত জানালায় রেখে বসে আছে ট্যাক্সি ড্রাইভার। রানা গাড়িতে উঠতেই বড় করে শ্বাস ফেলে ওর দিকে তাকাল সে। অলস সুরে জানতে চাইল, ‘এবার কোথায়?’

পকেট থেকে ভাঁজ করা লিস্ট বের করে দেখল রানা। বাকি রয়ে গেছে মাত্র একটা ঠিকানা।

আজিজ খন্দকার। নাইট ক্লাবের মালিক। ক্রয়-বিক্রয় তার নেশা। জিনিসটা বৈধ কি না, সেটা বড় বিষয় নয়। পকেটে কচকচে পাউণ্ড এলেই হলো।

ড্রাইভারকে ঠিকানা জানাতেই বারকয়েক হোঁচট খেয়ে রওনা হলো মার্সিডিয ট্যাক্সি।

চুপ করে চোখ বুজে গরম লেদারের সিটে এলিয়ে বসল রানা। কায়রোর ডাউনটাউন লক্ষ্য করে ছুটে চলেছে গাড়ি। লিস্টের শেষ ঠিকানায় গিয়েও কাজ না হলে নতুন করে ভাবতে হবে, এরপর কী করবে।

নানান কথা ভাবছে রানা। কিছুক্ষণ পর ওর চিন্তার ভেতর হানা দিল ড্রাইভার। ‘আমরা পৌঁছে গেছি। আমি কি অপেক্ষা করব?’

‘বেশিক্ষণ লাগবে না,’ বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল রানা।

বেনামী এক গলির শেষপ্রান্তে এসে থেমেছে ট্যাক্সি। ঝুরঝুরে একটা বাড়ির সামনে বারবার জ্বলে উঠছে ঝলমলে রঙিন সাইনবোর্ড। ছায়ার ভেতর মালপত্র ক্রয়-বিক্রয়ে ব্যস্ত একদল লোক। তাদের এড়িয়ে নাইট ক্লাবের দরজার দিকে চলল রানা। ওর সঙ্গে জুটে গেল এক মেয়ে। জানাল, কিছু টাকা দিলেই ওর সঙ্গে দারুণ সময় কাটবে রানার। মেয়েটা বোধহয় সোমালি। বয়স বড়জোর আঠারো। তাকে পাত্তা না দিয়ে নাইট ক্লাবের দরজা দিয়ে ঢুকতে চাইতেই রানাকে বাধা দিল প্ৰকাণ্ডদেহী এক লোক। তার হাতে কয়েক পাউণ্ড গুঁজে দিতেই সরে দাঁড়াল সে। গলি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে জোরালো আরবি মিউযিক।

রাত প্রায় পৌনে একটা। মাত্র জমে উঠছে পার্টি। কোনও একসময়ে এই বাড়ি ছিল ওয়্যারহাউস বা বড় গুদাম। ভেতরে অনেক মানুষের ঘাম ও অ্যালকোহলের বাজে গন্ধ। ওর মনে হলো দুনিয়ার সব দেশের মানুষ জড় হয়েছে এখানে। ধুপ-ধাপ আওয়াজ তুলছে ড্রাম। অন্তত বারোটা ভাষায় নিজেদের ভেতর আলাপ করছে কাস্টোমাররা।

ঘরের পেছনের দিকে দীর্ঘ বার। ওখান থেকে মদ বা বিয়ার নেয়ার জন্যে ধাক্কাধাক্কি করছে অন্তত এক শ’জন লোক। বারের ওপরতলায় মঞ্চে ঝিলমিলে আলোয় নাচছে স্বল্প পোশাকের তেল মাখা ক’জন নর্তকী। নানাদিকে ফেলা হয়েছে টেবিল। কোনও কোনও জায়গা কচি পাম গাছ দিয়ে ঘেরা। ওখানে ঘনিষ্ঠ হয়ে মদ্যপান করছে কপোত- কপোতীরা।

ভিড়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে বারের কাছে পৌছে গেল রানা।

ওকে দেখলেই চিনবে,’ বলেছে ইসা।

সত্যিই আজিজ খন্দকারকে চিনতে দেরি হলো না রানার। নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছে ইসা। আজিজ একমাত্র মানুষ, যে কি না ড্রিঙ্ক দিচ্ছে না কাস্টোমারদের হাতে। চকচকে এক কাউন্টারের ওপর দুই কনুই রেখে চোখ বোলাচ্ছে সবার ওপর। শীতল চোখে তৃপ্তি। প্রায় কোমর পর্যন্ত খোলা শার্টের বোতাম। লোকটার বয়স হবে চল্লিশ। হালকা হওয়া তেলতেলে চুল পনিটেইল করা। এবড়োখেবড়ো মুখে অসংখ্য ব্রণের দাগ।

কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যেতেই তার চোখে চোখ পড়ল রানার। মৃদু নড করল লোকটা। যেন নীরবে বলছে, তুমি শালা আবার আমার কাছে কী চাও?

আজিজ খন্দকারের খোলা বুক ও রোমে ভরা পুরুষ্ট দুই বাহুর ওপর থেকে ঘুরে এল রানার চোখ। ঘুরতে থাকা আলোয় পরিষ্কার দেখেছে কবজিতে সোনার রোলেক্স ঘড়ি।

কাছে যেতেই লোকটার মুখ থেকে মদ ও রসুনের গন্ধ. পেল রানা। আজিজের কানের জন্যে হৈচৈয়ের ওপর দিয়ে গলা ছাড়ল রানা: ‘তোমার সঙ্গে ব্যবসা করতে এসেছি!’

ফ্যাকাসে হয়ে গেল লোকটার মুখ। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দেখল রানাকে, তারপর ঠেস দিয়ে রাখা ভারী শরীরটা কাউন্টার থেকে সরিয়ে হাতের ইশারা করল পিছু নেয়ার জন্যে। ভিড়ের ভেতর তার পিঠের দড়ির মত পেশি দেখতে দেখতে চলেছে রানা। আজিজের সোনার ঘড়ি পরা কবজি এক মেয়ের হাতের গ্লাসে লাগতেই ছলকে পড়ল বিয়ার। ঘুরেও তাকাল না সে। ধাক্কা দিয়ে খুলল প্রাইভেট লেখা একটা দরজা। আজিজের পর ভেতরে ঢুকল রানা। পেছনে নিঃশব্দে আটকে গেল দরজা। কমে এল মিউযিকের অত্যাচার। সামনে আঁকাবাঁকা করিডোর। রানাকে কয়েক ফুট পেছনে নিয়ে চুপচাপ হাঁটছে নাইট ক্লাবের মালিক। করিডোরের একপাশে আধখোলা দরজা। ওদিক থেকে আসছে হলদে আলো। ঠেলে কবাট সরাল আজিজ।

দরজার ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী দুই লোক। ঘরের পেছনে নিচু এক টেবিলে কয়েকটা বিয়ারের বোতল। একপাশে চলছে বড় একটা টিভি। দেখানো হচ্ছে অ্যাকশন মুভি। বিস্ফোরিত হলো দুটো গাড়ি। খ্যার-খ্যার আওয়াজে চালু হয়েছে মেশিন গান।

আজিজ খন্দকারের ইশারায় করিডোরে বেরিয়ে এল দুই দানব। কঠোর চোখে দেখছে রানাকে। সবার আগে হাঁটতে লাগল নাইট ক্লাব মালিক। একটা সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল দোতলায়। আরেকটা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল আজিজ। এটা তার অফিস। চারদেয়ালে ন্যাংটো মেয়ের পোস্টার। সত্তর দশকের মাফিয়া ডনদের অফিসের ধাঁচে সাজিয়ে নেয়া হয়েছে অফিস। ডেস্কের পেছনে গিয়ে চামড়ামোড়া ভারী একটা চেয়ারে বসল আজিজ। তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে গেল দুই দৈত্য। দুই হাত ভাঁজ করেছে বুকে। চোখে কঠোর দৃষ্টি। যেন মালিক নির্দেশ দিলেই দুই হাতে ছিঁড়ে ফেলবে রানাকে।

ডেস্কের সামনে থেমে ওটার ওপর নিজের ব্যাগ নামাল রানা।

অলস চোখে ওকে দেখছে আজিজ খন্দকার। ‘তো কী চাও?’

‘দেখতে চাই তোমার হাতঘড়ি,’ সহজ সুরে বলল রানা। তিক্ত চেহারা করে ওকে দেখল আজিজ। ক্রমেই হয়ে উঠছে অধৈর্য। ‘তুমি তো বলেছিলে ব্যবসা করবে।’

‘মিথ্যা বলিনি,’ বলল রানা। ‘হাত থেকে ঘড়িটা খুলে দেখতে দাও, তা হলে খুন হবে না।’ কোমর থেকে সি-যেড নিয়ে নাইট ক্লাব মালিকের মুখের দিকে নল তাক করল ও। চোখ রেখেছে দুই দানবের ওপর। চাপা স্বরে নির্দেশ দিল:

যেখানে আছ, ওখানেই থাকো।’

অস্বস্তি নিয়ে নড়ে উঠেও থেমে গেল তারা।

‘দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াও,’ বলল রানা।

পালন করা হলো ওর নির্দেশ।

থম মেরে গেছে আজিজ।

মিউযিকের ড্রামের কারণে একটু পর পর থরথর করে কাঁপছে মেঝে। নাইন এমএম পিস্তলের ব্যারেল বেয়ে রানার চোখে এসে থামল আজিজ খন্দকারের দুই চোখ। মৃদু হাসল সে। ‘তুমি, শালা, সত্যিই সাহসী লোক। এই দুই গার্ড কিন্তু কয়েক সেকেণ্ডে তোমাকে ছিঁড়ে ফেলতে পারে।’

‘ঘড়িটা খোলো,’ সোনার রোলেক্স দেখাল রানা। ‘ওটা দেখতে চাই।’

দ্বিধায় পড়ল আজিজ। অবশ্য সেটা কাটিয়ে বলল, ‘তুমি, শালা, কি পাগল? ঘড়ি জমাবার নেশা আছে নাকি?’

জবাব দিল না রানা। ওর কঠোর চোখদুটো দেখে সোনার চেইনের ক্যাম্প খুলে ঘড়ি বাড়িয়ে দিল আজিজ।

ওটা নিয়ে পেছনের সোনালি ডালা দেখল রানা। ওখানে ইটালিক স্টাইলে লেখা: টু মডাক, উইদ লাভ ফ্রম মামি।

আজিজ খন্দকারের দিকে তাকাল রানা। লোকটার ভুরু ঘেমে গেলেও মনে হচ্ছে না ঘাবড়েছে। পিস্তলের নল কয়েক ইঞ্চি নিচে নামাল ও। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ওর দিকে কঠোর চোখে চেয়ে আছে দুই দৈত্য। ‘ঠিক আছে, এটা নিচ্ছি।’

‘নিচ্ছি মানে? নিলেই হলো?’

‘ওটা আমার দরকার।’

‘ঘড়িটা আমার। নিতে পারবে না।’

‘কিনে নিচ্ছি,’ বলল রানা। ‘তুমি যে দামে কিনেছ, তার দ্বিগুণ দেব।’

‘যদি দিতে না চাই?’

ক্লিক শব্দে সেফটি ক্যাচ অফ করল রানা।

ঘোঁৎ করে উঠল আজিজ। ‘নাকের কাছে পিস্তল ধরে আমার রোলেক্স ঘড়ি চেয়ে বসলেই হলো? তোমাকে কে বলেছে আমি বিক্রি করব?’

হাসল রানা। ‘আমাকে ডাকাত বলে মনে হচ্ছে তোমার?’

‘তা হলে তুমি কে? কোনও এক মহিলার ছেলে তার ঘড়ি ফেরত চায়, ঠিক কি না? আর আমার এখন মনে হচ্ছে তুমিই সেই মডাক।’

‘না, সে মারা গেছে,’ বলল রানা যে তোমার কাছে ঘড়িটা বিক্রি করেছে, সে-ই বোধহয় খুন করেছে।’

‘কাঁধ ঝাঁকাল আজিজ। ‘তাতে আমার কী? জিনিস বেচা-কেনার ব্যবসা করি। ব্যবসায়ী। কোনও জিনিস কেনার সময় ফালতু প্রশ্ন তুলি না।’

‘তাতে সমস্যা নেই,’ বলল রানা। ‘তবে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দেবে। আমি জানতে চাই, কে বিক্রি করেছে এটা তোমার কাছে।’

‘ভুলে গেছি।’

ডেস্কের ওপর রোলেক্স রাখল রানা। পিস্তলের নল এখন আজিজের নাকের দিকে। ব্যাগের চেইন খুলে একতোড়া নোট বের করল ও। ডেস্কের ওপর ঘড়ির পাশে থপ্ করে ফেলল। ‘ওখানে চল্লিশ হাজার ইজিপশিয়ান পাউণ্ড আছে। ঘড়ি আর খবরের জন্যে। আমার ভুল না হলে এর চেয়ে অনেক কমেই ঘড়িটা কিনেছ। যা চাইছি, সেটা দিলে চলে যাব। কারও কোনও ক্ষতি হবে না। আগামীকাল সকালে এই ঘড়ির মত আরেকটা কিনতে পারবে। … কী বলো?’

দুঃখ নিয়ে রোলেক্সের দিকে তাকাল আজিজ। ‘লিমিটেড এডিশন। এখন আর তৈরি করে না।

‘তোমার কষ্টে বুক ভেঙে যাচ্ছে আমার।’

ঘড়ির ওপর থেকে সরে টাকার ওপর স্থির হলো আজিজের চোখ। ‘মনে হচ্ছে জিনিসটা তোমার সত্যিই খুব দরকার। গোপন খবরটা দিলে কী করবে বলে ভাবছ?’

‘সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, তোমার জেনে কাজ নেই,’ বলল রানা। ‘তুমি ব্যবসায়ী। ভুলে গেলে?’

আয়েস করে হেলান দিয়ে বসল আজিজ। মুচকি হেসে বলল, ‘তোমার নিজের একটা স্টাইল আছে। দুই পায়ের ফাঁকে বিচিদুটোও মনে হচ্ছে মার্বেলের মত শক্ত। নইলে এখানে ঢুকতে গিয়ে সাহস হারাতে। তো লাগবে নাকি সুন্দরী কোনও মেয়ে? আজ থাকো রাতটা। ড্রিঙ্ক বিনে পয়সায় দেব।’

‘যা চাই, সেটা পেলেই খুশি,’ বলল রানা। ‘ তুমি শুধু ঘড়ি চোরের ঠিকানা দিলেই বিদায় হব।’

‘আমরা দু’জন হয়তো আরও বড় ব্যবসা নিয়ে আলাপ করব,’ বলল আজিজ। ‘যাক গে! ঠিক আছে, ওই শুয়োরের বাচ্চারা পচা গুয়ের চেয়েও খারাপ।’ ডেস্ক থেকে একটা নোটপ্যাড ও কলম নিল নাইট ক্লাব মালিক, খস খস করে লিখল দুটো নাম ও একটা ঠিকানা। ‘চোরাই জিনিসের ডিলার ওরা। হারামির বাচ্চারা ড্রাগ অ্যাডিক্ট। নদের ওদিকে ছুঁচোর গর্তের মত এক অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। বেশিরভাগ সময় পার করে ঘুমিয়ে। ওদের কাছে অনেক টাকা পাই। চাইলেই বলে একটা পয়সাও নেই। ইচ্ছে করলে ওদেরকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু পছন্দ হয়ে গেল সোনার রোলেক্স।’ কাঁধ ঝাঁকাল আজিজ। প্যাড থেকে কাগজটা ছিঁড়ে বলল, ‘তাতে কী, একটা ঘড়ি বৈ তো নয়।’ ঠিকানা ও নামের কাগজটা ঠেলে দিল রানার দিকে। থাবা দিয়ে নিল টাকাগুলো।

কাগজ তুলে পড়ল রানা। ‘আশা করি ঠিক তথ্যই দিয়েছ।’

‘তাতে ভুল নেই, একটা ড্রয়ার টেনে ওটার ভেতর টাকাগুলো রাখল আজিজ। ‘ওই দুটোর মাথায় কয়েকটা বুলেট গেঁথে দিলে ওদের জন্যে কাঁদবে না কেউ।’

পকেটে কাগজটা রেখে পিস্তল নামিয়ে বলল রানা, ‘কবে পেয়েছ ঘড়িটা?’

‘কয়েক সপ্তাহ আগে। রানার চোখে চেয়ে সহজ সুরে বলল আজিজ, ‘আর কোনও ঝামেলা হবে না তো?’

‘মনে হয় না,’ বলল রানা।

‘আমার সঙ্গে একটা ড্রিঙ্ক নাও? নামটা অন্তত বলবে না?’

দরজার দিকে রওনা হয়ে গেল রানা। ‘অন্য কোনও দিন।’

চোদ্দ

রাত দেড়টার পর ঠিকানা অনুযায়ী জায়গামত পৌঁছে গেল রানা। করুণ হাল বাড়িটার। পাশেই ব্রেকার্স ইয়ার্ড। চারপাশে অবহেলার ছাপ। ওকে দেখে খোলা একটা দরজার কাছ থেকে ছিটকে পালিয়ে গেল কালো একটা বেড়াল। মুখে ছটফট করছে জ্যান্ত ইঁদুর। এন্ট্রান্স হলে ঢুকেই প্রস্রাবের কড়া বাজে গন্ধ পেল রানা। টিমটিম করে জ্বলছে একটা বাতি। সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় উঠল ও। খুঁজে নিল নির্দিষ্ট দরজা। ওটা ভিড়িয়ে রাখা।

নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকতেই ভয়ানক দুর্গন্ধে পেটের নাড়ি উল্টে আসতে চাইল ওর। অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিতে ওখানেই থামল। সামনেই খাটো করিডোর। পড়ে আছে নানান আবর্জনা। ওগুলো এড়িয়ে সামনের ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল রানা। একটা সাইডবোর্ডে টিমটিম করে জ্বলছে কয়েকটা মোমবাতি। সেই হলদেটে আলোয় আবছাভাবে দেখল চারপাশ। মোম গলে নেমেছে কাঠের তক্তা ও মেঝের ওপর। ছায়ার ভেতর তীক্ষ্ণ আওয়াজে র‍্যাপ মিউযিক বাজাচ্ছে খুদে কোনও স্টেরিয়ো সেট। বদ্ধ বাতাসে বাসি মদ, ধোঁয়া আর ঘর্মাক্ত দেহের বদবু। এখানে যারা বাস করে, বোধহয় নিজেদের কাছেই কোনও গুরুত্ব নেই তাদের।

ঘরের একপাশে মেঝেতে বিছিয়ে নেয়া হয়েছে ম্যাট্রেস। মোমবাতির আলোয় ওখানে ঘুমন্ত দু’জনকে দেখল রানা। একজন পুরুষ, অন্যজন নারী। দু’জনই উদোম। জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে আট হাত-পা। পাশের মেঝেতে চাদর। উল্টোদিকে মোমবাতির কাছে টেবিলের ওপর একটা ব্লেড, মুড়িয়ে রাখা কয়েকটা মিশরীয় পাউণ্ড আর বেশ কিছু সাদা পাউডারের ছোট স্তূপ। টেবিলে মাথা রেখে নিচু টুলে বসে নাক ডাকাচ্ছে কেউ। পুরোপুরি নেশা করার আগেই ঘুমিয়ে গেছে। দুই হাত টেবিলে রেখে কপাল ঠেকিয়েছে কাঁচের ওপর। কয়েক মুহূর্ত তাকে দেখল রানা। গভীর ভাবে ধীরে শ্বাস নিচ্ছে নেশাখোর। বয়স বড়জোর বিশ। ঝাড়ুর কাঠির মত সরু। গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি।

টেবিল থেকে এক গজ দূরেই মেঝেতে শোয়া দ্বিতীয় মেয়েটা। খালি পায়ে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে ব্ল্যাঙ্কেট। পাশে থেমে তাকে দেখল রানা। এর বয়সও বড়জোর বিশ। ইউরোপিয়ান। নোংরা চুলগুলো সোনালি। একসময়ে সুন্দরী ছিল, কিন্তু ড্রাগের কবলে পড়ে হয়েছে মাঝবয়সী ডাইনীর মত। ওর বন্ধু-বান্ধবীর মতই অচেতন। পরনে হালকা ব্লেযার ও স্ট্রাইপ দেয়া প্যান্ট। শেষেরটা নেমেছে হাঁটুর কাছে সবুজ জাঙ্গিয়া সহ। কেন যেন ব্লেয়ারটা চেনা চেনা লাগল রানার। জ্বলন্ত একটা মোমবাতি নিয়ে ওটা কাছ থেকে দেখল।

ছবিতে দেখা মর্ডাকের সেই ব্লেযার, সন্দেহ থাকল না ওর। দেয়ালের কাছে গিয়ে কয়েক সেকেণ্ড পর অন করল বাতির সুইচ। হঠাৎ উজ্জ্বল আলোয় ভেসে গেল ঘর। তাতে হুঁশ ফিরল না কারও। ইউরোপিয়ান মেয়েটা হঠাৎ করেই যেন কিছু টের পেল। মেঝে থেকে আস্তে করে তিন ইঞ্চি ওপরে তুলল মাথা। ম্যাট্রেসে ঘুমন্ত দুই ন্যাংটো ভাঁড় নড়ছে না। টেবিলওয়ালাও আছে অন্য জগতে।

তীক্ষ্ণ আওয়াজের মিউযিক অফ করল রানা। চলে গেল টেবিলের কাছে। মুখটা নিল কাঁচের খুব কাছে। তারপর বড় করে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল সাদা পাউডার। ওগুলো তৈরি করেছে হালকা মেঘ। ফলে পৃথিবীতে ফিরে এল তরুণ। হঠাৎ করেই জেগে উঠে চোখ পাকিয়ে দেখল রানাকে। টলমল করে উঠে দাঁড়িয়ে চেপে ধরতে চাইল অনুপ্রবেশকারীর শার্টের কলার। আরবিতে চেঁচিয়ে উঠল, ‘মর, শুয়োরের বাচ্চা! হারামজাদা…

কবজি মুচড়ে ধরে ধাক্কা দিয়ে তাকে পিছিয়ে দিল রানা। শরীরে তিলমাত্র শক্তি নেই তরুণের। কাত হয়ে টুলে পড়ে ওখান থেকে গড়িয়ে নামল মেঝেতে। হাঁপাতে শুরু করেছে ভীষণ।

মেঝেতে ছেঁচড়ে এগিয়ে কোকেনের পাউডারে নাক গুঁজে বড় করে শ্বাস টানছে ইউরোপিয়ান মেয়েটা। হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে দাঁড় করাল রানা। একটু দূরে আর্মচেয়ার দেখে ওখানে বসিয়ে দিল। প্রায় জোর করেই খুলে নিল মেয়েটার গা থেকে ব্লেয়ার।

‘দয়া করে আমাকে পেটাবেন না,’ করুণ সুরে ইংরেজিতে মিনতি করল মেয়েটা।

‘ক্ষতি করতে আসিনি,’ বলল রানা। ব্লেযার মুচড়ে ভরল নিজের ব্যাগে। কোমরের পাশ থেকে নিল পিস্তল। ওটা দেখেই চিৎকার করে কাঁদতে লাগল মেয়েটা। সেই আওয়াজে ম্যাট্রেসে শুয়ে থাকা দুই যুবক-যুবতীর নেশা ভরা ঘুম ভেঙে গেল। হঠাৎ করেই সতর্ক হয়ে উঠেছে উলঙ্গ মেয়েটা। রানাকে দেখেই হ্যাঁচকা টানে চাদর নিয়ে মুড়িয়ে ফেলল শরীর।

‘কাপড় পরে নাও,’ তাকে বলল রানা।

মাথা দোলাল মেয়েটা। উঠে দাঁড়াতেই বেকায়দা ভাবে এদিক ওদিক পড়ল তার পা। কয়েকবার চেষ্টার পর জিন্সের টাইট প্যান্ট ও টপ পরল সে।

‘এবার কেটে পড়ো তোমরা,’ বলল রানা। ‘আর কখনও আসবে না এখানে।’

চুপচাপ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল দুই তরুণী। ঘরে রয়ে গেল শুধু রানা আর দুই তরুণ। মেঝেতে শুয়ে আনমনে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে টেবিলের পাশের তরুণ। তার পাশে থামল রানা। মুঠো করে চুল ধরে দুটো লাথি মেরে তাকে ফেলল তার সঙ্গীর পাশে। প্যান্ট পরতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সঙ্গী। কাজটা শেষ হতেই খুঁজতে লাগল শার্ট।

যমের মত দাঁড়িয়ে আছে রানা। বাম আস্তিন সরিয়ে সোনার রোলেক্স ঘড়িটা দেখাল। ওপরের দিকে ওমেগা আধবোজা চোখে সোনালি ঘড়ির দিকে চেয়ে থাকল দুই তরুণ।

‘চিনতে পারো?’ বাঁকা সুরে জানতে চাইল রানা।

জবাব দিল না কেউ। দুই তরুণের চেহারায় অপরাধের ছাপ। বুঝে গেছে, কেন হঠাৎ খেপেছে লোকটা। কমবয়সী তরুণ নার্ভাস চোখে অন্যদিকে তাকাল। ভয় বা ড্রাগের কারণে থরথর করে কাঁপছে দুই হাত।

বাইরের দরজায় গিয়ে করিডোর দেখল রানা। পালিয়ে গেছে দুই মেয়ে। দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিয়ে চাবিটা নিজের পকেটে রাখল ও। ফিরল ঘরের ভেতর। জানালার দিকে চেয়ে দেখল, ওখানে পুরু শিকের গরাদে। ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে বারান্দা বা ফায়ার এস্কেপ নেই। ঘুরে চেয়ে রানা দেখল, নেশাগ্রস্ত দুই ড্রাগ অ্যাডিক্ট চোখ পিটপিট করে দেখছে ওকে। দু’জনের একজন বিড়বিড় করে কী যেন বলছে আনমনে। এরা যে পালিয়ে যেতে পারবে না, সেটা নিশ্চিত হয়ে পুরো ফ্ল্যাট সার্চ করতে চাইল রানা।

বড় ঘরটা বাদ দিলে রয়েছে ছোট এক কিচেন। একপাশে তেলমাখা স্টোভ। দেয়ালে দেয়ালে ঘুরছে তেলাপোকা। পাশেই দুর্গন্ধ ভরা ছোট টয়লেট। কিচেনে সাইডবোর্ডে একটা ছুরি দেখল রানা। ওটা অস্বাভাবিক বড়। হাতলের সঙ্গে রয়েছে তামার হ্যাণ্ড গার্ড। বিরাট ছুরির চওড়া ফলাটা সেইবারের মতই। চামড়ার খাপও আছে। দৈর্ঘ্যে বারো বা তেরো ইঞ্চি। ছুরিটা দেখে রানার মনে পড়ল, ছবিতে দেখা মর্ডাকের ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত লাশের কথা। এই ধরনের ছুরি দিয়েই খুন করা হয়েছে যুবককে।

সাইডবোর্ডে ছুরিটা রেখে সরতেই রানার পায়ের নিচে নড়ে উঠল আলগা একটা ফ্লোরবোর্ড। লাথি মেরে ওটা সরিয়ে দিল ও। বেরিয়ে এল মেঝের বুকে আট ইঞ্চি গভীর গর্ত। ভেতরে গুঁজে রাখা হয়েছে প্লাস্টিকের একটা ব্যাগ।

গর্তের পাশে বসে পিস্তলের বাঁট ব্যবহার করে নিজের দিকে ব্যাগটা টেনে আনল রানা। ব্যাগ ওপরে তুলে মেঝেতে ছড়াল ভেতরের জিনিসপত্র। সেসবের ভেতর রয়েছে ইলাস্টিক ব্যাণ্ড দিয়ে আটকে রাখা এক তোড়া টাকা আর বেশ কিছু কাগজ। ওদিকে মনোযোগ না দিয়ে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ঝুঁকে দেখল রানা। ওগুলোতে মর্ডাকের নাম। এ ছাড়া, রয়েছে ব্রিটিশ লাইব্রেরির মেম্বারশিপ কার্ড ও ইউকের পাসপোর্ট। পিস্তলের নল ব্যবহার করে মর্ডাকের পাসপোর্ট খুলল রানা। ওর দিকেই চেয়ে আছে যুবকের চোখ।

লুঠের প্রমাণ ওখানেই ফেলে রাখল রানা। মনে আর সন্দেহ নেই, কারা খুন করেছে মর্ডাককে। একটা সন্দেহ মনে আসতেই ডানহাত ভরে দিল গর্তের ভেতর। ভাবছে, এরা অপেশাদার ডাকাত। ভেতরে হয়তো আরও কিছু লুকিয়ে রেখেছে। যে জিনিস ওর আঙুলে লাগল, সেটা কাঠের বা সিমেন্টের নয়। মসৃণ প্লাস্টিকের তৈরি। আরেকটু ঝুঁকে জিনিসটার সামান্য অংশ দেখতে পেল রানা। কালো প্লাস্টিকের ওপর রুপালি অক্ষরে লেখা প্রস্তুতকারী কোম্পানির নাম। জিনিসটা ছোট একটা ল্যাপটপ কমপিউটার।

গর্তের ভেতর থেকে মেশিনটা তুলল রানা। চোরগুলো হয়তো ভেবেছিল নিজেদের কাছেই রেখে দেবে। সম্ভাবনা খুব বেশি, ওটা মর্ডাকের। মেঝেতে ল্যাপটপ রেখে ভাবল, চালু করে দেখবে কি না ভেতরে কী আছে। কয়েক সেকেণ্ড পর চিন্তাটা বাদ দিল। এখন হাতে সময় নেই।

মেশিনটা নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকল রানা। মেঝেতে দেয়ালের পাশে শুয়ে আছে দুই ড্রাগ অ্যাডিক্ট। তাদের একজন কী যেন বলতে চাইছে। কাঁচ ঢাকা টেবিলে ল্যাপটপ রেখে বন্দি দু’জনের দিকে এগোল রানা। বেল্ট থেকে পিস্তল নিয়ে তাক করল তাদের দিকে। চাপা স্বরে আরবিতে বলল, ‘খুন করতে গেলে কেন? বুঝতে পারোনি যে মাথার ওপর বাজ পড়বে? কোকেন এতই দরকার যে খুনই করে ফেললে?’

‘আমি খুন করিনি,’ হঠাৎ করেই জবান ফিরে পেয়ে বলল কমবয়সী তরুণ। পিস্তলের দিকে চেয়ে ভয়ে কুঁচকে গেছে তার গাল। বন্ধুর দিকে আঙুল তাক করল। ‘লোকটাকে ছুরি মেরেছে ও। মানা করেছিলাম। কিন্তু সবসময় সঙ্গে ছুরিটা রাখে।’

‘তুমিও সমান দোষে দোষী,’ কঠোর সুরে বলল রানা। ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল কমবয়সী তরুণ। অন্যজন আরেক দিকে তাকাল। চোখে ভয়।

‘কাগজপত্র সহ ব্রিফকেস কোথায়?’ জানতে চাইল রানা। ‘আমি জানি, সবই লুঠ করেছ। মিথ্যা বলে লাভ হবে না।’

জবাব দিল না তারা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কমবয়সী তরুণ। কয়েক মুহূর্ত পর প্রথমবারের মত বয়সে বড়জন মুখ খুলল, ‘কাগজপত্র সব পুড়িয়ে দিয়েছি। বিক্রি করেছি ব্রিফকেস।’

আস্তে করে মাথা দোলাল রানা। আর কিছু করার নেই। এবার সময় হয়েছে নিজের কাজ শেষ করার।

বড়জনের বুকে পিস্তলের নল তাক করল ও। ক্লিক আওয়াজে অফ করল সেফটি ক্যাচ।

ভয়ে কুঁকড়ে গেল দুই অ্যাডিক্ট। দু’হাত বাড়িয়ে দিল কমবয়সী তরুণ। হয়তো ভাবছে ঠেকিয়ে দেবে শব্দের প্রায় সমান গতির নাইন এমএম জ্যাকেটেড বুলেট। গোপনাঙ্গের কাছে ভিজে উঠল তার জিন্সের প্যান্ট। প্রস্রাব করে ফেলেছে ছেলেটা। বুঝে গেছে, এবার খুন হবে। অন্তত দু’দিন গরমের ভেতর পড়ে থাকবে লাশ, তারপর পচতে শুরু করলে গন্ধ পেয়ে পুলিশে যোগাযোগ করবে প্রতিবেশীরা। খুনির খোঁজ পাবে না কেউ।

ড্রাগ অ্যাডিক্ট হত্যাকারীকে নিজে খুন করে মনে স্বস্তি পাবে না, ভাল করেই জানে রানা। কমবয়সী তরুণ বোধহয় ঠিকই বলেছে। তার বন্ধুই মর্ডাকের খুনি। ওই তরুণের চোখে-মুখে নীচতা। ধরে নিয়েছে, এবার যে-কোনও সময়ে মরবে।

প্রথমে তাকে গুলি করবে রানা। তারপর অন্যজনকে। ব্যস, শোধ হবে কর্নেল জন ব্রাউনের কাছে ওর ঋণ।

কিন্তু দুস্থ চেহারার দুই অ্যাডিক্টকে মেরে ফেললে কী লাভ কর্নেলের? আর কাজটা ওকে কেন করতে হবে?-কয়েক মুহূর্ত ভেবে পিস্তলের নল নিচু করে নিল রানা।

বিস্ফারিত চোখে ওকে দেখছে দুই মাদকাসক্ত।

আবারও সেফটি ক্যাচ অন করল রানা। চাপা স্বরে বলল, ‘ঠিক আছে, পাহাড় থেকে নামার জন্যে তৈরি হও।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *