ছায়াঘাতক – ৪০

চল্লিশ

একটু আগে সন্ধ্যা নেমেছে।

কায়রোর আরেক অভিজাত এলাকা: গার্ডেন সিটি।

বেশ কয়েক বছর আগেও এই এলাকা ছিল শহরতলী। বাস করত মিশরের নামি-দামি পরিবারের বিখ্যাত ও কুখ্যাত মানুষগুলো। তবে আজকাল এই এলাকা দখল করে নিয়েছে ব্রিটিশ, ইউএস ও নানান দেশের এম্বেসি, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি ও বিশাল কয়েকটি আবাসিক আধুনিক, বিলাসবহুল হোটেল।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় নাইল হিল্টনের লবি থেকে বেরোল মাসুদ রানা ও উইলিয়াম কেন্সিংটন। পরনে কালো টুক্সেডো। রানারটা এসেছে ইউডন ভাদিমের নিজস্ব ওয়ার্ডোব থেকে। চমৎকার ভাবে ফিট করেছে ওর দেহে। কেন্সিংটনের পোশাক ভাড়া নেয়া হয়েছে নাম করা এক টেইলার্সের দোকান থেকে।

দু’দিকে পামগাছের মাঝ দিয়ে গেছে রাস্তা। রানার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে নালিশ জানাল কেন্সিংটন, ‘এসব পরে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। হয় আমার শরীরের শেপ ভাল না, নইলে টুক্সেডোটা বাজেভাবে ফিট করেছে। বলুন তো, কেমন লাগছে আমাকে দেখতে?’

‘ডাকাত মনে হচ্ছে। আরমানির দোকান লুঠ করে যা · পেয়েছেন, তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে পালিয়ে এসেছেন। তবে তাতে চিন্তার কিছু নেই। কেউ দেখবে না।’

‘পার্টিতে যাচ্ছি, আর দেখবে না?’ মাথা নাড়ল কেন্সিংটন। ‘আমার বোধহয় না যাওয়াই ভাল ছিল।’

‘তাতে পরে সমস্যা হবে,’ বলল রানা।

ওদেরকে পাশ কাটিয়ে ইউএস এম্বেসির পার্টিতে গেস্টকে নামাতে মৃদু আওয়াজে গেল রুপালি এক রোল্স রয়েস। কয়েক সেকেণ্ড পর কালো একটা বেন্টলি।

‘পুঁজিবাদী হারামজাদা সব!’ বিড়বিড় করল কেন্সিংটন।

‘কেন্সিংটন ম্যানরের মালিকের ছেলের মুখে এসব বোল- চাল মানায় না,’ বলল রানা। ‘তার ওপর আবার সে খুঁজে বেড়াচ্ছে লাখ কোটি ডলারের গুপ্তধন!’

রানার কথার জবাব দিল না কেন্সিংটন। ‘একটা কথা শুনবেন? টুক্সেডোর জন্যে অতটা অস্বস্তি লাগছে না। আসলে ভয় পাচ্ছি পার্টিতে যেতে। যখন তখন ধরা পড়ব। তখন পোঁদে দুটো লাথি মেরে ছিটকে ফেলে দেবে এম্বেসির এরিয়ার বাইরে। মনে হচ্ছে না ভাল কোনও পরিকল্পনা আপনি করেছেন। আপনার অন্তত আমাকে জানানো উচিত ওখানে পৌছে আমরা কী করব।’

জবাব দিল না রানা। একটু দূরেই ইউএস এম্বেসি ভবন। অন্ধকার রাতে বাইরে ও ভেতরে ঝলমল করছে শত শত ফ্লাড লাইট। দুই রাস্তার কোণে পোস্ট কলোনিয়াল ম্যানশন। বাগানের এদিকে লোহার তৈরি উঁচু গেট। ওটার ওপর থেকে চারপাশে চোখ রেখেছে একগাদা সার্ভেইলেন্স ক্যামেরা। সুন্দর ভাবে সাজানো বাগানে দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে পাম গাছ। মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুলছে পাতাগুলো।

ম্যানশনের বাইরে গ্র্যাণ্ড এন্ট্রান্স। ওখানে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে রাইফেল হাতে তৈরি একদল ইউএস মেরিন সৈনিক। গেটের এদিকে নির্দিষ্ট জায়গায় থামছে একের পর এক দামি গাড়ি ও লিমাযিন। সবার হাতে দাওয়াতপত্র। ওগুলো দেখে নেয়ার পর অতিথিদেরকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে একদল সশস্ত্র সিকিউরিটি গার্ড।

গেটের প্রায় কাছে পৌঁছে গেছে রানা আর কেন্সিংটন। মাত্র বিশ ফুট দূরেই ইউএস মেরিন সৈনিকরা।

‘আচরণ স্বাভাবিক রাখুন,’ বলল রানা, ‘ঠাণ্ডা রাখতে হবে মাথা।’

‘ওরা কোনও ভাবেই ঢুকতে দেবে না,’ বলল কেন্সিংটন। ‘খামোকা এলাম।’

চট্ করে এম্বেসির দেয়ালের একটু দূরে তাকাল রানা। ওখানে ছায়াভরা এক গাছের নিচে লাল এক পেরোজেও গাড়ি। ওটার পাশেই থেমেছে সিকিউরিটি টিমের দুই সদস্য। জানালা দিয়ে ভেতরে তাকাল তারা। কয়েক সেকেণ্ড পর খুলে দিল বাঘের মত দুই জার্মান শেফার্ডের বেল্টের ফিতা। আশপাশে সন্দেহজনক গন্ধ পেলে সতর্ক করবে কুকুরগুলো।

‘দেখলেন তো কেমন কড়া সিকিউরিটি?’ বিরক্ত হয়ে বলল কেন্সিংটন। সাংবাদিক ও অতিথিদের পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা। লো কাট ইভনিং ড্রেস পরেছে হাস্যরতা এক সুন্দরী মহিলা। কেন্সিংটনকে ঘেঁষে এগোল সে। ওপর থেকে সুডৌল স্তন দেখতে পেয়ে আঙুলের ওপর ভর দিয়ে আরেকটু উঁচু হওয়ার চেষ্টা করল ইতিহাসবিদ।

চুপ করে আছে রানা। চোখ কুকুরের ওপর। কয়েক সেকেণ্ড পর মালিকের কাছে ফিরল ওগুলো। পেরোজেও গাড়ির ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল সিকিউরিটির দুই লোক। কুকুরের বেল্টে ফিতে আটকে ঝলমলে আলোকিত দেয়ালের কোণ লক্ষ্য করে চলল তারা। গাড়িটা থেকে তারা বিশ গজ দূরে যেতেই নিজের মোবাইল ফোন বের করল রানা।

‘কাকে ফোন দেবেন?’ জানতে চাইল কেন্সিংটন, ‘আমার কথার জবাব দিচ্ছেন না কেন? বিরক্তি এসে গেছে আপনার রহস্যময় আচরণ দেখে। যত্তোসব পাগলামি!’

স্ক্রল করে মোবাইল ফোনের অ্যাড্রেস বুক থেকে প্রিসেট এন্ট্রি অনুযায়ী স্পিড ডায়াল করল রানা।

বিপ-বিপ আওয়াজে অটোমেটিকালি মেমোরিতে রাখা নাম্বারে কল দিল ফোন। আর তখনই কানের কাছে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো শক্তিশালী বোমা। বাজ পড়া আওয়াজে থরথর করে কেঁপে উঠেছে এম্বেসির চারপাশ। এক সেকেণ্ড পর চরকির মত ঘুরে তাকাল স্তম্ভিত মানুষগুলো। শুরু হলো প্রাণপণ আর্তচিৎকার ও ভীত ছুটোছুটি। নানাদিকে পালিয়ে যেতে চাইছে তারা। সিকিউরিটির লোক চিৎকার করে কথা বলছে রেডিয়োতে। তাদের সবার হাতে বেরিয়ে এসেছে পিস্তল। লাল পেরোজেওর পেট থেকে গলগল করে বেরোনো ধোঁয়া আঁধার করে দিয়েছে চারপাশ। এম্বেসি ভবন থেকে ছুটে বেরিয়ে গেট পেরোল একদল ইউএস মেরিন সৈনিক। সবার হাতে উদ্যত রাইফেল। তাদের চেহারা দেখে যে-কেউ বুঝবে, এটা ড্রিল নয়। সত্যিই হামলা হয়েছে এম্বেসিতে।

ভীত, সন্ত্রস্ত, ছুটন্ত মানুষগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছে সিকিউরিটির লোকগুলো। পিংপং বলের মত চোখ বড় করে রানাকে দেখল কেন্সিংটন। ‘এটা কী হলো?’

‘জঙ্গিরা হামলা করেছে!’ গলা ফাটিয়ে জবাব দিল রানা। ওকে ধাক্কা দিয়ে পাশ কাটিয়ে রেডিয়ো হাতে ছুটল সিকিউরিটির এক লোক। দূর থেকে এল সাইরেনের আওয়াজ। পেরোজেও গাড়ির আগুন নেভাতে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করছে মেরিন সৈনিকরা। কেন্সিংটনের বাহু ধরে শ’ দুয়েক মানুষের হৈ-হল্লা আর দৌড়াদৌড়ির ভেতর দিয়ে দ্রুত এগোল রানা। ইতিহাসবিদের কানের কাছে জোর গলায় বলল, ‘সঙ্গে থাকুন! হারিয়ে যাবেন না!’

কয়েক সেকেণ্ড হতভম্ব হয়ে রানাকে দেখল ইতিহাসবিদ। তারপর হঠাৎই সব বুঝে গেল। ‘ওহ্? হায়, যিশু! আপনার কাণ্ড?’

শক্তহাতে কেন্সিংটনের বাহু ধরে গেট পার করিয়ে দিল রানা। পরিস্থিতি কতটা খারাপ, তা বুঝতে চাইছে সিকিউরিটি পারসোনেল ও সৈনিকরা। কারও চোখে পড়ল না বাগানে ঢুকেছে দুই লোক। ছায়াময় উঠান পেরিয়ে একদিকের সরু এক এন্ট্রান্স দিয়ে ঢুকে পড়ল ওরা ভবনে।

কিচেনের পেছন অংশে আছে রানা ও কেন্সিংটন। আশপাশে কেউ নেই। গোটা ভবনে তীক্ষ্ণ আওয়াজে বাজছে অ্যালার্ম। নানাদিকে ছুটছে কারা যেন, বুটের আওয়াজ শুনল রানা। ওর ভুল না হলে এরই ভেতর অ্যাম্বাসেডর ও তার সুন্দরী দ্বিচারিণী স্ত্রীকে তুলে দেয়া হয়েছে দ্রুতগামী লিমোতে। কনভয় পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শহরের নিরাপদ কোথাও।

‘আমাকে কি একটু খুলে বলবেন বাইরে ওটা কী হলো?’ যে-কোনও সময়ে ধরা পড়বে, সেই ভয়ে হাঁফাতে শুরু করেছে কেন্সিংটন।

‘তেমন কিছুই না,’ বলল রানা। ‘ফাটিয়ে দিয়েছি এক আউন্স পিপি-০১। সার্বরা বলে সি-৪ প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ। বিকট আওয়াজ হলেও কারও কোনও ক্ষতি হয়নি।’

‘আপনি কি আসলেই বদ্ধ উন্মাদ?’

‘আমার তা মনে হয় না,’ বলল রানা। ‘নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, এরা যতটা ভাবে, ততটা ভাল নয় সিকিউরিটি। ওদের উপকার করলাম। সুযোগ পেল সতর্ক হওয়ার। আগামী কয়েক সপ্তাহ কাজ পেল সিআইএ। ওদের তো খুশি হওয়া উচিত।’

‘ওদের সঙ্গে তো ট্রেইণ্ড কুকুর ছিল। কী করে কাজটা করলেন?’

‘শুকনো পাকা মরিচের গুঁড়ো ভরা ঠোঙা নাকের কাছে থাকলে বেচারা কুকুরের কী দোষ?’ তাড়া দিল রানা, ‘এবার চলুন। হাতে বেশি সময় নেই।’

ইউডন ভাদিম যেভাবে বলে দিয়েছে, ঠিক সেভাবেই বিশাল এম্বেসির ভেতর দিয়ে অ্যাম্বাসেডরের ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্টের দিকে চলল রানা ও কেন্সিংটন। কেউ নেই যে দেখবে। লাল কার্পেট বিছানো হলওয়ে ও করিডোর ধরে গিয়ে পেছনদিকে সিঁড়ি পেল ওরা। তিনতলায় উঠে বুঝল, এদিকটায় অ্যালার্মের আর্তনাদ অনেক কম।

সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে উঠে হাঁফাচ্ছে কেন্সিংটন। বিড়বিড় করল, ‘মনে হয় হার্ট অ্যাটাক হবে!’

‘ডানদিকের চতুর্থ দরজা,’ বলল রানা। ‘আমার সঙ্গে আসুন।’

অ্যালার্ম বাজছে। ভাদিমের বলে দেয়া সেই চতুর্থ দরজার সামনে থামল রানা। পিছিয়ে গেল কয়েক পা, তারপর ছুটে গিয়ে প্রচণ্ড এক লাথি দিল কবাটের ওপর। মড়াৎ শব্দে ভেঙে গেল দরজা। ঘরের ভেতরের দেয়ালে গিয়ে লাগল। ফেটে গেছে চৌকাঠ। দেরি না করে ঘরে ঢুকল রানা। বাহু ধরে সঙ্গে টেনে এনেছে কেন্সিংটনকে। বাতি জ্বালতেই চোখে পড়ল চারপাশের ডিসপ্লে।

‘এটা তো দারুণ এক মিউযিয়াম,’ হাঁ হয়ে গেছে কেন্সিংটন। ভুলে গেছে হার্ট অ্যাটাকের কথা।

বিশাল ঘর। দেয়ালে লাইনিং দেয়া রক্তের মত টুকটুকে লাল ভেলভেট। ওপর থেকে ঝলমলে আলো দিচ্ছে ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি। দারুণ সুন্দর দেখাল অ্যাম্বাসেডর জিম স্প্যাডেরোর দুর্মূল্য সব মিশরীয় আর্টিফ্যাক্ট। পাঁচ হাজার বছর আগের মূর্তির পাশে দেয়ালে লেখা ওটার ইতিহাস। কাঁচের কেবিনেটের ডিসপ্লেতে প্রাচীন ফুলদানী, পটারি, অ্যালাবাস্টার জার, ভাস্কর্য, মুখোশ, প্যাপাইরি ও কিছু কারুকাজ করা পর্দা। মার্বেলের বিশাল এক মঞ্চে বসিয়ে রাখা হয়েছে রঙচঙে পোশাক পরা মিশরীয় কয়েকজন ফেরাউনকে।

‘ব্যক্তিগত সংগ্রাহকরা এসব নিজেদের কাছে রেখে দেবে এটা উচিত নয়,’ বিড়বিড় করল কেন্সিংটন। ‘এগুলো থাকবে মিউযিয়ামে। লাখ লাখ মানুষ দেখবে।’

কথাগুলো পাত্তা দিল না রানা। মাত্র একটা জিনিসের প্রতিই ওর আগ্রহ। এরই ভেতর দেখেছে, একদিকে রয়েছে জিম স্প্যাডেরোর সংগ্রহ করা বেশ কয়েকটা চেয়ার। একেকটা একেক রকম। কোনওটা ছোট, আবার কোনও-কোনওটা প্রকাণ্ড। ‘কেন্সিংটন, এবার সাহায্য লাগবে,’ বলে বড় একটা চেয়ারের সামনে থামল রানা। ওটা বাঁশের তৈরি আধুনিক চেয়ারের মতই। যে-কেউ বলবে, তৈরি করা হয়েছে কিছু দিন আগে। ‘এটাই কি না, দেখুন।

‘না, এটা না, বলল কেন্সিংটন। ‘আমরা খুঁজছি রাজকীয় কোনও চেয়ার।’

‘ওই যে একটা, ওটা?’ ডানদিকের একটা চেয়ার দেখাল রানা।

‘ওটা হতেও পারে।’

রঙ করা এক কফিনের আড়ালে কাঠের তৈরি শক্তপোক্ত, কারুকাজ করা রঙিন এক চেয়ার। ওটার চওড়া সিট ও উঁচু পিঠ পুরু চামড়া দিয়ে মোড়া। চারকোনা ফ্রেম। শক্ত করতে ব্যবহার করা হয়েছে নিচে কোনাকুনি দুটো কাঠের দণ্ড। চেয়ারটাকে একদম নতুন মনে হলো রানার। চকচক করছে। মসৃণ। যেন গতকাল তৈরি করেছে দুনিয়ার সেরা কাঠমিস্ত্রি।

চেয়ারের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল কেন্সিংটন। কারুকাজ করা খোদাইগুলো দেখছে গভীর মনোযোগে। রঙিন জায়গাগুলোতে বেশ কিছু সিম্বল। ‘হ্যাঁ, এটাই মানকাউয়ার চেয়ার,’ শ্বাস আটকে বলল সে।

‘কোনও সূত্র দেখছেন?’ জানতে চাইল রানা।

‘একটু সময় দিন,’ ঘেউ করে উঠল কেন্সিংটন। ‘ভাল করে দেখতে হবে।’

‘বেশি সময় নেই,’ বলল রানা। শুনতে পাচ্ছে, নিচে এখনও তারস্বরে বাজছে অ্যালার্ম। তবে কিছুক্ষণ পর গোটা এম্বেসি সার্চ করতে শুরু করবে সিকিউরিটির লোক। বাদ পড়বে না কোনও ঘর।

‘আমি তো কিছুই দেখছি না,’ বলল কেন্সিংটন।

টেনেহিঁচড়ে ভারী চেয়ারটাকে ঘরের মাঝে নিল অধৈর্য রানা। ‘দেখি, আমাকে দেখতে দিন।’

‘সাবধান! ওটার বয়স কিন্তু সাড়ে তিন হাজার বছর।’

‘চিন্তা করবেন না, বহু দিন জাদুঘরের জিনিসপত্র ভাঙি না।’ ঝুঁকে পড়ে চেয়ারে চোখ বোলাতে লাগল রানা। আঙুল দিয়ে স্পর্শ করছে কাঠের প্রতিটা জোড়া। সিটের চামড়াটা এখনও চমৎকার। অবশ্য খানিকটা শক্ত হয়েছে। ফাটলও ধরেছে কিছু জায়গায়। মাঝের অংশ এখনও নরম। সিটের প্রতিটা ইঞ্চি পরখ করে দেখল রানা। একটু সরে আবারও দেখল ডিযাইনগুলো। চিন্তায় পড়ে গেছে।

‘আমি তো কিছুই দেখছি না,’ আবারও বলল কেন্সিংটন, ‘এটা বোধহয় অন্য কোনও চেয়ার।’

নিচে থেমে গেল অ্যালার্ম। হঠাৎ করেই চারপাশে নেমেছে নিস্তব্ধতা। অর্থাৎ, নিয়ন্ত্রণে এসেছে নিচের পরিস্থিতি। কান পাতল রানা। দূরে কথার আওয়াজ। বোধহয় দোতলায় বা একতলায়। ধুম্ করে বন্ধ বা খোলা হলো একটা দরজা। খড়- খড় আওয়াজ তুলল রেডিয়ো। একটু পর হাজির হবে সিকিউরিটির লোক। আগের চেয়ে দ্রুত চলছে রানার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন।

‘চামড়ার ওপর যেসব ডিযাইন দেখছেন, সেগুলো থেকে কিছু বুঝতে পারলেন?’ জানতে চাইল রানা।

‘সবই আতেনিস্ট সিম্বল,’ প্রায় নালিশের সুরে বলল কেন্সিংটন। আঙুল তুলে দেখাল আখেনাতেনের সূর্যের পবিত্র গোলক।

মাথা দোলাল রানা। ‘তো এসব থেকে কী বুঝলেন?’

‘এটা বুঝলাম যে সরিয়ে নেয়া হয়েছে সত্যিকারের আর্টওঅর্ক। বা ওটার ওপর লেপে দেয়া হয়েছে নতুন রঙ।’

‘তার মানে, আসল তথ্য গোপন করতে কৌশল করেছেন মানকাউয়া?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল কেন্সিংটন। ‘তাই তো মনে হচ্ছে। প্রাচীন আমলের ধর্মের পুরোহিতের চেয়ার ছিনতাই করে নিয়ে গিয়েছিল সূর্য পূজারীরা।’ কাঁধের ওপর দিয়ে ভাঙা দরজার দিকে তাকাল সে। ‘আমাদের বোধহয় বেরিয়ে যাওয়া উচিত। কোনও লাভ হলো না এখানে এসে। মাঝখান থেকে যে- কোনও সময়ে গ্রেফতার হব।’

জবাব দিল না রানা। চিন্তিত চেহারায় বসে পড়েছে রাজকীয় চেয়ারের সামনে।

‘আমার কথা শুনতে পেয়েছেন?’ বলল কেন্সিংটন। ‘চলুন, পালিয়ে যাই। একবার ধরে ফেললে মাসের পর মাস মিশরের জেলখানায় থাকতে হবে। এত কী ভাবছেন?’

‘ভাবছি, কে জিতল, আর হারল কে। কোথায় গেল সেই গুপ্তধন?’

‘এখন এসব ভাবার সময় আছে?’ রানার দিকে চেয়ে আছে কেন্সিংটন। ‘যখন তখন খুন হব!’

‘ফেরাউনের লোকের কাছে তো মানকাউয়া বড় ধরনের বেইমান। সত্যিই এই চেয়ার হাইজ্যাক করে রঙ দিয়ে ডিযাইন লেপে দিলে সিটের পিঠে মানকাউয়ারই সিল কেন?’

ঢোক গিলল কেন্সিংটন। দ্রুত ভাবছে।

‘হিসেব তো মেলে না,’ বলল রানা। ‘এই চেয়ার তো আছাড় মেরে ভেঙে ফেলার কথা। আপনি তো ইতিহাসবিদ। ভেবে দেখুন। খ্রিস্টানদের হাত থেকে যখন জেরুজালেম কেড়ে নিল মুর জাতি, ওই এলাকায় একটা ক্রুশ আস্ত ছিল? প্রতিটি জায়গায় ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল অর্ধচন্দ্রের প্রতীক। আবার ক্রুসেডাররা যখন তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিল জেরুজালেম, চুরমার করে দিল মুরদের সমস্ত প্রতীক। যুদ্ধের নিয়মই এমন। নতুন শক্তির কাছে পরাজিত হবে পুরনো শক্তি। সবই দখল করে নেবে বিজয়ীরা। কোনও ধরনের সমঝোতা করা হবে না। এ থেকে কী বুঝলেন?’

একতলায় বেশ কয়েকজনের কণ্ঠস্বর। একটু পর সার্চ করতে করতে উঠে আসবে লোকগুলো।

‘কখনও হার মেনে নেননি মানকাউয়া,’ বলল রানা, ‘নতুন ধর্ম এলেও ত্যাগ করেননি পুরনো ধর্ম। আতেনিস্টদের প্রতীক সূর্যের ডিস্ক তিনি মেনে নেবেন কেন? সেরকম হলে হৈ-হৈ করে উঠত ফেরাউনের দলের সবাই। আমরা কিন্তু তেমন কিছু শুনিনি বা পড়িনি।’

‘আপনি আসলে কী বলতে চান?’ জানতে চাইল কেন্সিংটন।

এসব. থেকে মাত্র একটা কথাই বেরিয়ে আসে। মানকাউয়ার চেয়ার দখল করেছিল বিজয়ী আতেনিস্টদের কোনও দল। তারা মুছে দেয়নি প্রধান পুরোহিতের সিম্বল। আবার মানকাউয়ার সিম্বল তারা আঁকতেও যায়নি। নিজেই মানকাউয়া এঁকেছেন এসব সিম্বল।’ চামড়ার সিটে চাপড় দিল রানা। ‘বোকা বানিয়ে দেন শত্রুদেরকে। আমার ধারণা নিজেই নিজের চেয়ারে এঁকে নেন আতেনিস্ট সিম্বল। এটা করেন, যাতে চেয়ারটা ধ্বংস না করে ফেরাউনের লোক। মাত্র একটা কারণেই সেটা করে থাকতে পারেন তিনি— চেয়ারের ভেতর গোপনে রেখেছেন কিছু। সাধারণ কৌশল। চেয়ারের ভেতর দিয়েছেন আরেকটা সূত্র। এখন জেনে নিতে হবে ওটা কী।’

উজ্জ্বল হয়ে উঠল কেন্সিংটনের মুখ। ‘এখন তো তা-ই মনে হচ্ছে! আপনি ঠিকই বলেছেন, রানা!’

‘চামড়াটা ধরে দেখুন,’ বলল রানা। ‘নরম। বোধহয় ভেড়ার চামড়া। তবে একেবারে গরুর চামড়ার মত পুরু। এই সিট তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়েছে অন্তত পাঁচটা ভেড়ার চামড়া। আমার ধারণা, ওটার নিচেই পাব জরুরি কোনও সূত্র।’

পকেট থেকে রানাকে ছোট একটা পেন নাইফ বের করতে দেখে হাঁ হয়ে গেল কেন্সিংটন। ‘কিন্তু…. আপনি চামড়া কাটতে পারেন না!’

‘কে বলেছে পারি না। করে দেখাচ্ছি।’

‘কিন্তু এটা তো অমূল্য আর্টিফ্যাক্ট।’

‘গুপ্তধন পেলে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেব, সাবধানে চামড়ার ওপরের প্রথম স্তর কাটতে লাগল রানা। মনে মনে প্রার্থনা করছে, ভেতরের সব চামড়া যেন একসঙ্গে সেলাই করা না থাকে।

ওপরের স্তর সরাতেই নিচের চামড়ায় পরিষ্কার দেখা গেল চন্দ্রদেবতা থোথ, আইসিস, বেস্টেট ও আনুবিসের রঙিন ছবি।.. ‘পুরনো আমলের দেব-দেবী,’ বলল কেন্সিংটন। ‘এই জিনিস দেখলে খেপে যেতেন আখেনাতেন।’

চামড়ার কোথাও কোনও সূত্র দেখতে না পেয়ে আরেকটা স্তর কাটল রানা। তৃতীয় স্তরে রয়েছে পুরু চামড়া। ফাটল ধরেছে বয়সের ভারে।

আর কিছুই নেই।

হাল ছেড়ে দেবে রানা, এমন সময় ওর চোখে পড়ল দুই স্তরের মাঝে স্যাণ্ডউইচের মত কী যেন। প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। ওর মনে হলো, ওটা হলদে হওয়া প্যাপাইরাসের কোনা। একপাশে সরে বসল রানা। এটা দেখুন তো।’

উত্তেজিত হয়ে প্যাপাইরাসটা দেখল কেন্সিংটন। প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘খুব সাবধানে বের করতে হবে। আঙুলের একটু চাপ লাগলেই কিন্তু গুঁড়ো হবে।’

খুব ধীরে, অতি সাবধানে চামড়ার দুই স্তর আলাদা করল রানা। একটু পর পেল আস্ত প্যাপাইরাস। হাতে নিয়ে তালুর ওপর সাবধানে ওটা মেলে রাখল কেন্সিংটন। তার ভাব দেখে রানার মনে হলো, লোকটা ভাবছে যে-কোনও সময়ে জিনিসটা উধাও হবে।

পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রাচীন প্যাপাইরাসটা দেখল ওরা। ওপরের কোণে মানকাউয়ার সিল। মন্দির, পামগাছ, মুকুট পরা দাঁড়কাক। নিচে যত্নের সঙ্গে আঁকা রঙিন হায়ারোগ্লিফ্। ওগুলোর অর্থ জানে না রানা। তবে ঠিকই বুঝে গেল, প্যাপাইরাসের মাঝের ছবিটা কী।

‘মানচিত্র,’ শ্বাস আটকে বলল কেন্সিংটন। ‘আমরা পেয়ে গেছি!

তিলতিল করে বিপদের দিকে চলেছে ওরা। যে-কোনও সময়ে চারতলায় উঠবে সিকিউরিটির লোক। মোবাইল ফোন বের করে চট্ করে প্যাপাইরাসের কয়েকটা ছবি নিল রানা। একতলা নিচ থেকে এল বেশ কয়েকজনের কথাবার্তার আওয়াজ।

‘এই মানচিত্র সত্যিই অকল্পনীয়,’ বিড়বিড় করল কেন্সিংটন। ‘পড়তে শুরু করে সবই বুঝতে পারছি।’ আরও ভাল করে দেখার জন্যে নাক নিল হায়ারোগ্লিফসের কাছে।

‘এবার বিদায় নিতে হবে,’ কেন্সিংটনের হাত থেকে প্যাপাইরাসটা নিতে চাইল রানা। হাত সরিয়ে বাধা দিল ইতিহাসবিদ। কিন্তু তার আঙুলের সামান্য চাপে মুহূর্তে মিহি ধুলো হয়ে মেঝের দিকে রওনা হলো প্যাপাইরাস।

‘গেল!’ কাতরে উঠল কেন্সিংটন। ‘ওটা ছিল মিশরের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন মানচিত্র!’ মেঝেতে ধপ করে বসে পড়েছে সে।

‘অথচ, ইতিহাসবিদরা ওটার খবরও জানত না,’ বলল রানা। ‘যেটা জানত না, সেটা আর না জানলেই বা কী!’ টান দিয়ে কেন্সিংটনকে দাঁড় করিয়ে দিল ও। ‘যথেষ্ট হয়েছে। চলুন, বেরিয়ে যেতে হবে।’

‘কোথায় যাব?’ অসহায় চোখে রানাকে দেখল কেন্সিংটন। ‘বাড়ির ভেতর গিজগিজ করছে সিকিউরিটির লোক।’

জানালার কাছে গেল রানা। ভারী পর্দা সরাতেই দেখল, সামনে খোলা একটা ফ্রেঞ্চ ডোর। ওদিকে পাথরের মেঝের ছোট এক ব্যালকনি। রেলিঙের পাশে গিয়ে নিচে তাকাল রানা। ‘এই পথে, কেন্সিংটন।

‘অসম্ভব!’ আপত্তি তুলল ইতিহাসবিদ। ‘আমি দেয়াল বেয়ে নামতে পারব না। চারতলা নিচে সিমেন্টের চাতাল। একবার পড়লে…’

‘সেক্ষেত্রে আগের মতই সামনের গেট দিয়ে বেরোতে হবে।’

‘ধরা পড়ে যাব।’

বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে কেন্সিংটনের সামনে থামল রানা। নরম কণ্ঠে বলল, ‘ফেরাউন তুতেনখামেনের মূর্তির মত থুতনি উঁচু করে শক্ত হয়ে দাঁড়ান।

ভীষণ ভয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে ইতিহাসবিদ। ‘এবার কী হবে?’

‘কী আর হবে, একদম নড়বেন না। খুব বেশি ব্যথা দেব না।’

কথা শুনে চমকে গিয়ে কী যেন বলতে হাঁ মেলল কেন্সিংটন, কিন্তু তখনই তার থুতনির ওপর পড়ল রানার বাঘা এক ঘুষি। এত জোরে মারেনি যে হাড় ভাঙবে। তবে মাপা জিনিস, অন্তত আধঘণ্টা মহাশূন্যে ঘুরতে গেছে ইতিহাসবিদ। লোকটা কাত হয়ে পড়ার আগেই দু’হাতে তাকে ধরে ফেলল বিসিআই এজেন্ট। দেরি না করে দেহটা তুলে নিল কাঁধে। কোমর লচকে যেতে চাইল। একবার গুঙিয়ে উঠল রানা। বিড়বিড় করল, ‘ব্যাটা পাথর খায় নাকি!’

ভারী ওজন কাঁধে দরজার কাছে থেমে দু’দিক দেখল রানা। ধারেকাছে কেউ নেই। করিডোরে বেরিয়ে চলে এল প্যাচানো সিঁড়ির সামনে। ইতিহাসবিদের পা ব্যবহার করে ফায়ার ডোর খুলে নেমে এল একতলা নিচে। এই করিডোরে সারি সারি অফিস ঘর। এক জায়গার দরজায় লেখা: জেন্টলমেন।

বামে বাঁক নিয়েছে করিডোর। ওদিক থেকে আসছে কয়েকটা পদশব্দ। কাঁধ থেকে নামিয়ে কেন্সিংটনকে মেঝেতে শুইয়ে দিল রানা। লাথি মেরে খুলল টয়লেটের দরজা। অচেতন দেহটা টেনে নিয়ে রাখল টয়লেট ও করিডোরের মাঝে। পা করিডোরে, কোমরের ওপরের দিক টয়লেটের ভেতর। কেন্সিংটনের পাশে বসে দু’হাতে জোরে জোরে বুক পাম্প করতে লাগল রানা।

করিডোরের পদশব্দ এসে থামল টয়লেটের দরজার সামনে। মুখ তুলে অসহায় চোখে তাকাল রানা। ‘সিকিউরিটি!’

দরজার কাছে থেমেছে কালো পোশাক পরা এম্বেসির দুই সিকিউরিটি গার্ড। কানে রেডিয়ো ইয়ারপিস, হাতে পিস্তল। ‘এখানে কী হয়েছে?’ জানতে চাইল ডানদিকের লোকটা। ‘বিল্ডিং থেকে তো সবাইকে বের করে দিয়েছি আমরা।’

‘আমি একজন ডাক্তার, ব্যস্ত গলায় বলল রানা। ‘এই লোকের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। প্লিয, অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে ফোন দিন।’

.

মাত্র বিশ মিনিট পর জ্ঞান ফিরল উইলিয়াম কেন্সিংটনের। টের পেল, দোলনার মত দুলছে দু’দিকে। হাসপাতালের দিকে ছুটে চলেছে অ্যাম্বুলেন্স। ছাতের ওপর ওয়াও-ওয়াও আওয়াজে কাঁদছে সাইরেন। আস্তে করে চোখ মেলে তাকাল সে। বাংলা সিনেমার স্টাইলে দুর্বল স্বরে বলল, ‘আমি কোথায়? কী হয়েছে আমার?’

‘চুপ করে শুয়ে থাকুন, আপনি একটু পরেই মারা যাচ্ছেন, জানিয়ে দিল গম্ভীর রানা।

ব্যথা লাগতেই চোয়াল ও থুতনিতে হাত দিল কেন্সিংটন। তখনই মনে পড়ল সব। ঘাড় কাত করে রানাকে দেখল সে। ‘আপনি আমার চোয়াল ভেঙে দিয়েছেন! হায়, ঈশ্বর! আমি মরে গেছি!’

‘আপনি তো আর অভিনয় করবেন না, তাই আর কোনও উপায় না পেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলাম,’ বলল রানা।

চাপা একটা গোঙানির আওয়াজ শুনে বামে ঘাড় কাত করল কেন্সিংটন। বড় বড় চোখে তাকেই দেখছে এক যুবক মেডিক। স্যালাইনের লাইন ছিঁড়ে আচ্ছামত বেঁধে রাখা হয়েছে তার হাত-পা।

‘ভাল ছেলে, পিস্তল বাগিয়ে ধরে অনুরোধ করতেই দুই হাত বাড়িয়ে দিল,’ বলল রানা। ‘আর এখানে জায়গা খুব কম বলে আগেই ওর সঙ্গীকে পাঠিয়েছি ড্রাইভারের ক্যাবে।’

‘এবার আমরা কী করব?’ বোকা-বোকা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কেন্সিংটন।

‘সামনের কোনও জ্যামে নেমে পড়ব,’ বলল রানা।

চোয়াল ও থুতনি ডলতে ডলতে বিড়বিড় করল ইতিহাসবিদ, ‘আপনি একটা নিষ্ঠুর জানোয়ার!’

একচল্লিশ

রাত সোয়া দশটায় আবারও ইউডন ভাদিমের ভিলায় পৌঁছে গেল রানা ও কেন্সিংটন। কলিং বেল দিতেই সদর দরজা খুলে দিল ফ্রেঞ্চ আর্কিওলজিস্ট। ওরা ভেতরে ঢুকতেই গলা বের করে চারদিক দেখে নিল সে। ভয় পাচ্ছে, যে-কোনও সময়ে আবারও হাজির হবে জমির শেখ। দরজা বন্ধ করে রানার দিকে তাকাল ভাদিম। ‘পেলেন ওটা?’

‘পেয়েছি,’ বলল রানা। ‘এবার ম্যাপ দেখে বুঝতে হবে কোথায় আছে গুপ্তধন।

ওদেরকে নিজের স্টাডিতে নিয়ে গেল ভাদিম। চারদিকের দেয়ালের তাকে তাকে রয়েছে অজস্র বই। এ ছাড়া ঘরে আছে মস্তবড় ডেস্ক, তিন-চারটে আরামদায়ক চেয়ার ও একটা সোফা। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে মোবাইল ফোনের ইমেজ ভাদিমের ল্যাপটপে পাচার করল রানা। কমপিউটারের সঙ্গে যুক্ত করা হলো দেয়ালে ঝুলন্ত বড় এক টিভির স্ক্রিন। হাই ডেফিনিশনের কারণে ঝকমক করতে লাগল প্রাচীন মানচিত্র

‘আসলটা কই?’ জানতে চাইল ভাদিম।

‘ওটার কথা আর বলবেন না, বুক ভেঙে যায়,’ আস্তে করে মাথা নাড়ল কেন্সিংটন।

গভীর মনোযোগে ম্যাপটা দেখল ওরা। ‘এই একই হায়ারোগ্লি ছিল কূপের ভেতর ওই প্রথম মূর্তির চেম্বারে,’ একটা সিম্বল দেখাল ভাদিম। ‘এই গ্লিফের অংশে লেখা আমেনহোটেপের নাম।’

মাথা নাড়ল কেন্সিংটন। ‘কথা ঠিক। তবে ওটার আরেকটা অর্থ: ‘আমুন এখন শান্তিতে আছে।’ অথবা, ‘আমুন এখন সন্তুষ্ট।’ ওই গ্লিফ দিয়ে প্রতিশব্দ তৈরি করা যায়। কী বলতে চেয়েছে, সেটা আজ আর জানার উপায় নেই।’

‘পুরো গ্লিফের ভেতর বলা হয়েছিল: ‘আমুন এখন সন্তুষ্ট। অগ্রাহ্য করা হবে আমারনার ধর্মদ্রোহী পাষণ্ডকে। উপযুক্ত সঠিক স্থানে ফিরিয়ে দেয়া হবে সমস্ত ধনদৌলত,’’ বলল ভাদিম। ‘কাজেই আমার মনে হয় না যে দ্বিধার কোনও উপায় আছে। কংগ্র্যাচুলেশন্স! নিজেদের কাজে আপনারা সফল হয়েছেন।

‘তা বুঝলাম,’ বলল রানা। ‘তবে এবার জেনে নিতে হবে কোথায় আছে ওই গুপ্তধন।’

পরের একটা ঘণ্টা প্যাপাইরাসের ইমেজ দেখে নানান নোট নিল কেন্সিংটন ও ভাদিম। মাঝে মাঝে েেদখল হায়ারোগ্লিফসের ডিকশনারি। আলাপের মাধ্যমে স্থির করল, আসলে কী লেখা হয়েছে মানচিত্রের গ্লিফে। কাজটা শেষ হতেই ডেস্ক ছেড়ে সোফায় গিয়ে বসল কেন্সিংটন। ভুরু ও কপাল থেকে ঘাম ঝেড়ে হাতে নিল নোটবুক। গম্ভীর চেহারায় বলল, ‘এবার শোনা যাক আমরা কী জানতে পেরেছি। প্রথম থেকে সংক্ষেপে বলছি: ‘কুশের রাজ্য থেকে বেরিয়ে পাল তুলে অনুসরণ করতে হবে সাহ্-এর পথ। তা হলেই পৌঁছুবে গন্তব্যে। বারো ঘণ্টা জোর কদমে হেঁটে গেলে পাবে দিগন্ত। তারপর সোবেকের দাঁতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেলেই আছে সব। তাতেই অগ্রাহ্য করা হবে আমারনার ধর্মদ্রোহী পাষণ্ডকে।’

আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেরে চুপ থাকল রানা।

‘কোথায় যেতে হবে, সেটা পরিষ্কার করে লিখেছেন,’ হাসল ভাদিম। ‘প্রথম থেকে দেখা যাক। কুশ ছিল খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগের প্রাচীন এক সভ্যতা। বা আরও আগের। সেসময়ে বলা হতো নুবিয়াদের দেশ। নীল নদের দেশ ইজিপ্টের দক্ষিণে ছিল সেই এলাকা। ইজিপশিয়ানদের অনুকরণ করত নুবিয়ার লোকেরা। মানকাউয়ার সময়ে বা আরও আগেই ধ্বংস হয় ওই রাজ্য। তবে জ্ঞানীরা বলে মানকাউয়া ভাল করেই জানতেন, এক সময়ে ওই দেশের রাজধানী ছিল বিশাল এক নগরী। ওটার নাম ছিল কারমা। ওই নগরী ছিল নীল নদের তৃতীয় শাখা নদের তীরে। ওটা হচ্ছে যাত্রার প্রথম স্তর।’

‘ওখান থেকে পাল তুলে যেতে হবে সাহ্-এর পথে,’ তথ্য জোগাল কেন্সিংটন। ‘শুনলে যেমন জটিল লাগে, কোথায় যেতে হবে জানা থাকলে ব্যাপারটা অত কঠিন মনে হয় না। প্রাচীন ইজিপ্টের দেবতা সাহ্-এর আরেকটা নাম: ‘ওসাইরিসের জ্বলজ্বলে বিবেক’। মিশরে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সিম্বলের মাধ্যমে যে নক্ষত্রমণ্ডল দেখানো হয়েছিল, সেটা দেবতার নামেই পরিচিত ছিল। আজকাল আমরা বলি ওরিয়ন।’

‘আকাশের নক্ষত্র দেখেই নিজেদের গন্তব্য স্থির করত প্রাচীন মিশরীয়রা,’ বলল ভাদিম। ‘এ থেকে আমরা বুঝতে পারছি, ওরিয়ন যেখানে ডুবে যাবে, সেখানেই ছিল সাহ্-এর রাজ্য।’

‘তার মানে পশ্চিমে,’ বলল রানা।

‘ঠিক।’

‘কাজেই প্রাচীন নগরী কারমা থেকে বেরিয়ে পশ্চিমে যেতে হবে,’ ভুরু কুঁচকে গেছে রানার। ‘কিন্তু কতটা দূরে সেই গন্তব্য? নীল নদ থেকে বারো ঘণ্টা জোর কদমে হাঁটলে আসলে কোথায় যাব? নির্দিষ্ট কোনও দূরত্বের কথা লেখেননি। ওই এলাকা তো বিশাল।’

মাথা নাড়ল কেন্সিংটন। ‘নির্দিষ্ট মাপের কথাই বলেছেন। প্রাচীন মিশরীয়রা একঘণ্টা বলতে বোঝাত একুশ হাজার রাজকীয় কিউবিট। একেকটা রাজকীয় কিউবিট ছিল প্রায় বারো ইঞ্চি। ওই হিসাব ব্যবহার করেই তৈরি করা হয়েছে মিশরীয় রাস্তা-ঘাট আর বিশাল সব পিরামিড।’

চট করে হিসাব কষল রানা। ‘তা হলে একঘণ্টা মানে প্রায় এগারো কিলোমিটার। সেক্ষেত্রে প্যাপাইরাস থেকে আমরা জানলাম, কারমা থেকে বেরিয়ে পশ্চিমে যেতে হবে প্রায় এক শত ত্রিশ কিলোমিটার।’ হাত বাড়িয়ে ভাদিমের ডেস্ক থেকে ভারী একটা ভলিউম নিয়ে খুলল রানা। বইটা প্রাচীন মানচিত্রের। পাতা ওল্টাতে শুরু করে পেয়ে গেল নীল নদের গতিপথ। দক্ষিণের গিজা থেকে শুরু করে থিস্। তারপর আরও গিয়ে পেরিয়ে গেল আসওয়ান। নদ ঢুকে পড়েছে প্রাচীন রাজ্য নুবিয়ার ভেতর। কারমা নগরী থেকে ভাটির দিকে ওটা পশ্চিমে, অনেক দূরে। নুবিয়ার বুক চিরে যাওয়া নদের ওপর আঙুল রাখল রানা। ওদিকে আছে রুক্ষ মরুভূমি, পাথরের প্রান্তর ও পাহাড়। হাজার বছরেও বদলে যায়নি ওই এলাকা।

রানা কী ভাবছে সেটা বুঝতে পেরেছে ভাদিম। ‘আমার অবাক লাগছে, বর্ণনার ভেতর কোথাও মানকাউয়া কোনও ল্যাণ্ডস্কেপ ব্যবহার করেননি। আমাদেরকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন : ‘বারো ঘণ্টা জোর কদমে হেঁটে গেলে পাবে দিগন্ত।’’ এটা আমার কাছে খুব আবছা বর্ণনা মনে হয়েছে।’

‘দিগন্তের গ্লিফটা আমাকে দেখান,’ বলল রানা।

টিভি স্ক্রিনে আঙুল তাক করে দেখিয়ে দিল ভাদিম। ‘এই যে। ইংরেজি U-এর মত অক্ষর। পাথুরে টিলার ওদিকে সূর্যাস্ত হচ্ছে, এমন একটা ভাব প্রকাশ করে।’

কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল রানা, ‘দ্বিমুখী অর্থ প্রকাশ করতে পারে। সত্যি হয়তো কোনও জায়গার কথা লিখেছেন মানকাউয়া।

কথাটা মনের ভেতর নেড়েচেড়ে নিয়ে বলল ভাদিম, ‘সেই দিগন্তটা কী ধরনের হবে ভাবছেন?’

‘পাথুরে কোথাও ইউ আকৃতির ক্লিফ, হায়ারোগ্লিফসের নির্দিষ্ট অক্ষর দেখাল রানা। ‘সন্ধ্যায় ওই ক্লিফের ওদিকে তলিয়ে যায় সূর্য।’

‘হতে পারে,’ বলল কেন্সিংটন। ‘অস্বাভাবিক নয়।’

‘তবে ওখানে না পৌঁছে কিছুই বুঝবেন না,’ বলল ভাদিম। ‘এবার থাকল সোবেকের দাঁত,’ বলল রানা। ‘কে বা কী এই সোবেক?’

‘কুমিরের মাথাওয়ালা জলদেবতা হচ্ছে সোবেক।’ কাঁধ ঝাঁকাল ভাদিম। ‘তারপর সোবেকের দাঁতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেলেই আছে সব।’ এ বিষয়টা পরিষ্কার করেননি মানকাউয়া।’

‘আমার যা কপাল, এই ম্যাপ ধরে গেলে হয়তো গিয়ে পড়ব কুমিরে ভরা কোনও নদীতে,’ শিউরে উঠল কেন্সিংটন।

তিক্ত হাসল ভাদিম। ‘ম্যাপ ঠিক কি না তা জানতে হলে- একমাত্র উপায় ওখানে গিয়ে দেখা, নইলে কিছুই বুঝবেন না।’

‘এ তো দারুণ সুসংবাদ,’ বলল কেন্সিংটন। ‘আফ্রিকার যুদ্ধক্ষেত্র, মানুষখেকো কুমির, মরুভূমি, পাথুরে পাহাড়— অর্থাৎ নিশ্চিত মৃত্যু। খুবই সহজ ব্যাপার।’

কেন্সিংটনকে পাত্তা না দিয়ে ভাদিমের কাছে জানতে চাইল রানা, ‘কীভাবে অত দূরে গুপ্তধন নিলেন মানকাউয়া?’

‘এটা অস্বাভাবিক নয়,’ বলল ভাদিম, ‘প্রাচীনকাল থেকেই বহু দূরে গেছে মিশরীয়রা। যা ভাবা হয়েছিল, তার চেয়েও মরুভূমির অনেক গভীরে গিয়েছিল। অভ্যস্ত ছিল নদীপথে চলাচলে। মানকাউয়া আর তাঁর অনুচররা বহু দূরে নিয়েছেন ভারী সব জিনিসপত্র— এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগেই পালের ব্যবহার জানত মিশরীয়রা।’

‘ওই দু’জনকে দেখুন,’ স্ক্রিনের দুটো মূর্তি দেখাল কেন্সিংটন। ‘ওরা দুই দেবতা। একজন ওসাইরিস। অন্যজন হ্যাপি। সৌভাগ্যবান হওয়ার জন্যে তাঁদেরকে সঙ্গে নেন মানকাউয়া। গুপ্তধন উদ্ধার করার সময়েও সাহায্য করবেন তাঁরা। হ্যাপি নীল নদের দেবতা। আর নদে কতটা পানি থাকবে, সেটা নির্ধারণ করেন ওসাইরিস। আমার ধারণা, নীল নদ যখন পানিতে ভরা, সেসময়ে সোনাদানা সহ নৌকায় করে আফ্রিকার গভীরে অনুচরদের পাঠান মানকাউয়া।

‘কার্গো শিপ,’ মন্তব্য করল রানা।

মাথা দোলাল ভাদিম। ‘একেকটা বড় বজরায় নিতে পারত শত শত টন ট্রেয়ার।’

‘গন্তব্যে পৌঁছুতে লেগেছে বড়জোর কয়েক সপ্তাহ,’ বলল কেন্সিংটন।

‘আমরা ঘুরে আসব কয়েক দিনের ভেতর,’ বলল গম্ভীর রানা।

‘সুদানের পরিস্থিতি খুব খারাপ,’ সতর্ক করে দেয়ার সুরে বলল ভাদিম। ‘দেশ চালায় মিলিটারি জান্তা। জিপ গাড়ি নিয়ে সীমান্ত পাহারা দেয় সৈনিকেরা। প্রত্যেকে সশস্ত্র। গুলি করে পরে পরিচয় জানতে চায়। তার ওপর সুদানের উত্তর দিকে রয়েছে বিদ্রোহীদের কয়েকটা সশস্ত্র দল। তাদের এলাকায় পেলেই অচেনা যে-কারও সব কেড়ে নেয়। কখনও কিডন্যাপ করে নিয়ে যায় নিজেদের আস্তানায়। মুক্তিপণ দেয়া হলেও জিম্মিরা আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারে না। আইন মেনে সীমান্ত পেরোলেও ওদিকে যাওয়া মানেই দুঃস্বপ্নের ভেতর পড়ে যাওয়া। কায়রো থেকে ট্রেনে উঠে পৌঁছুতে পারবেন আসওয়ানে। ওখানে চব্বিশ ঘণ্টা চালু থাকে ফেরি। ওটার কল্যাণে লেক নাসের পার হয়ে যাবেন ওয়াদি হালফায়। সীমান্তে গিজগিজ করছে পুলিশ। সব ধরনের কাগজপত্র না থাকলে ঢুকতে দেবে না তারা। এরপর হয়তো গেলেন দেশের গভীরে। সেক্ষেত্রে যে-কোনও সময়ে মরবেন হলদে জ্বরে, টাইফয়েড বা এমন কলেরায়, যেটার কোনও টিকা নেই।’

কথা শুনতে শুনতে প্রায় একই সময়ে দুটো চিন্তা এসেছে রানার মনে। প্রথমত, দ্রুত ফুরিয়ে আসছে সময়। দ্বিতীয়ত, উদ্ধার করে নিরাপদ কোথাও সরিয়ে দিতে হবে লিণ্ডাকে। এরপর দেখবে কোথায় যায় জন ব্রাউন। ‘সুদানের ঘুষখোর কর্মকর্তা দশ দিন পর ভিসা দেবে, সেজন্যে বসে থাকব না। কোনও চেকপয়েন্ট দিয়ে ঢুকব না আমি।’

‘ব্যাপারটা কী, অত আমি আমি করছেন কেন?’ বলল কেন্সিংটন। ‘আমরা না একই দলের লোক?’

কড়া চোখে কেন্সিংটনকে দেখল রানা। ‘আপনার দায়িত্ব আপনি পালন করেছেন। সুদানে আপনাকে সঙ্গে নেব না। একাই যাব।’

‘যা খুশি বললেই হলো?’ রেগে উঠল কেন্সিংটন, ‘আমিও যাব!’

‘ভেবে দেখুন, কী ঘটতে পারে শত্রু এলাকায়। চারপাশে দশ লাখ একর মরুভূমি ও জঙ্গল। হয়তো ধাওয়া করবে সীমান্ত রক্ষীরা। আরও আছে জঙ্গি বেদুঈনের দল। যখন তখন হামলা করবে তারা।’

মস্তবড় ঢোক গিলল কেন্সিংটন। ‘তবুও যাব।’

‘অনুচিত হবে,’ বোঝাতে চাইল রানা। ‘পাহাড়ে উঠতে গিয়ে হয়তো হার্ট অ্যাটাক করবেন।’

‘কিন্তু আমাকে যদি দরকার পড়ে, তখন? যদি ডিসাইফার করতে হয় নতুন কোনও সূত্র?’

‘মিস্টার কেন্সিংটন ঠিকই বলেছেন,’ বলল ভাদিম, ‘আপনি আগে থেকে কিছুই জানেন না, ওখানে কী আছে।’

চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবল রানা। তারপর শ্রাগ করে বলল, ‘বুঝতে পারছি, কেন্সিংটনের বিষয়ে আমার আর কিছুই বলার নেই। তবে একটা কথা, যত দ্রুত সম্ভব রওনা হব।’

‘আমিও সঙ্গে যাব?’ জানতে চাইল ভাদিম।

‘আসতে চান সঙ্গে?’

‘ঠিক তা নয়,’ বলল ভাদিম, ‘আমি চাই গোটা ব্যাপারটা থেকে দূরে থাকতে। অনেক কষ্ট সহ্য করেছি। চাই জমির শেখ বিদায় হোক আমার জীবন থেকে। আপনি বলেছিলেন তার ব্যবস্থা নেবেন।’

‘তা করব,’ বলল রানা। ‘তবে প্রথমে খুঁজে বের করব ধন-রত্ন। তারপর আপনার হয়ে মোকাবিলা করব জমির শেখের।

‘আপনি কবে আসবেন, সেজন্যে কতদিন অপেক্ষা করব?’ জানতে চাইল ভাদিম। ‘এর ভেতর সে এসে আমাকে মেরে ফেললে?’

‘কায়রোয় এমন কোনও বন্ধু আছে, যার স্ত্রীর সঙ্গে আপনি বিছানায় যাননি?’ জানতে চাইল রানা। ‘আমি হলে তেমন কারও বাড়িতে উঠতাম। অথবা, দরকারে চলে যেতাম এই দেশ ছেড়ে। ছুটি নিন কিছু দিনের জন্যে। মোদ্দা কথা, এই বাড়িতে থাকবেন না।’

কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল ভাদিম, ‘ঠিক আছে। ঘুরে আসব ফ্রান্স থেকে। লিয়নে আমার বোন থাকে। আগামীকাল ভোরেই প্লেনে উঠব। চাইলে আমার বাড়িতে রাতটা কাটিয়ে যেতে পারেন।’

মাথা নাড়ল রানা। ‘না। আমরা গিয়ে উঠব রাতের আসওয়ানগামী ট্রেনে। এরপর গাড়ি নিয়ে দক্ষিণের মরুভূমি পার হয়ে যাব আবু সিমবেল। পার হব সুদান সীমান্ত। একবার ওটা পেরোলে, আর রাস্তা মাঝারি মানের হলে জায়গামত পৌঁছুব পাঁচ বা ছয় ঘণ্টায়।’

‘আবারও গাড়ি?’ গুঙিয়ে উঠল কেন্সিংটন। ‘ভাল হতো না সকালে গিয়ে বিমানে উঠে আবু সিমবেলে নেমে পড়লে? সহজ কাজ।’

অস্ত্রে ভরা হোল্ডঅলে পা দিয়ে খোঁচা দিল রানা। ‘এটা সঙ্গে নিয়ে কাস্টম্স পার করে বিমানে উঠতে পারব না।’

বেয়াল্লিশ

মাসুদ রানা আর উইলিয়াম কেন্সিংটনের গাড়িটার পেছনের লাল বাতি দূরে গিয়ে মিলিয়ে যেতেই বাড়ির ভেতর ঢুকল ভাদিম। গ্লাসে দামি শ্যাম্পেইন ঢেলে নিয়ে বসল লিভিংরুমের সোফায়। ফুরফুর করছে মন। আর বেশি দিন নেই, আবারও মুক্ত হবে সে।

রাত প্রায় একটা বাজছে, এমন সময় ফুরিয়ে গেল বোতল। অথচ, এখনও নেশা হয়নি তার। আনমনে ভাবল, ট্রেনে কি উঠতে পেরেছে মাসুদ রানা? তা যদি পেরে থাকে, সকাল নয়টার দিকে পৌঁছুবে আসওয়ানে।

নিজের কপাল দেখে নিজেই খুশি ভাদিম। ভাগ্যিস মাসুদ রানার সঙ্গে দেখা হয়েছে! জমির শেখকে একফোঁটা ভয় পায় না লোকটা। আর ক’টা দিন, তারপর কবরে যাবে জমির শালা। ওর নিজের জীবনটা হয়ে উঠবে সহজ। এরপর হয়তো আর দেখতে হবে না দুঃস্বপ্ন। একদিন হয়তো ছেড়েই দেবে অ্যান্টিকুইটি চুরির ব্যবসাটা। মস্তবড় শিক্ষা পেয়েছে। এমন মানুষ নয় যে বিয়ে করে সংসার করবে। তবে কে ওকে বাধা দেবে মিশরের সুন্দরী মহিলাদেরকে আনন্দ দিতে?

সোফা ছেড়ে ঘরের ভেতর পায়চারি করতে লাগল ভাদিম। মনের ভেতর টগবগ করছে উত্তেজনা। আপাতত পালিয়ে যেতে হচ্ছে বটে, তবে তা বেশি দিনের জন্যে নয়।

ভোরেই বিমানবন্দরে গিয়ে ফ্রান্সগামী বিমানে উঠবে সে।

কিছুক্ষণ পায়চারির পর মনটা বলে উঠল, রাতেই বা এখানে থাকার দরকার কী?

রাতেই তো ফ্রান্সের বিমানে উঠতে পারে সে!

গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ওপরতলায় উঠে বেডরুমে ঢুকল ভাদিম। বিখ্যাত কোম্পানির তৈরি দুটো সুটকেস টেনে তুলল বিছানার ওপর। ঢাকনি খুলে ঝড়ের বেগে ওগুলোর ভেতর ওয়ার্ডোব থেকে নিয়ে ভরতে লাগল দামি সব পোশাক। বিশ মিনিট পর দুই হাতে দুই সুটকেস নিয়ে নেমে এল নিচে। কিচেন থেকে নিল দুটো চাবি। একটা বাড়ির সদর দরজা লক করার, অন্যটা ফেরারি গাড়ির। ভারী দুই সুটকেস হাতে মার্বেলের হলওয়ে পার করে প্রায় পৌঁছে গেল দরজার কাছে। কবাট মাত্র দু’ফুট দূরে, মেঝেতে একটা সুটকেস রেখে ডোরনব ধরার জন্যে হাত বাড়াল ভাদিম। আর তখনই দেখল ঘুরছে ডোরনব।

দেহের সমস্ত রক্ত যেন জমে গেল তার। হাত বাড়ানো অবস্থায় স্থির হয়ে গেল শরীর।

খুলে গেল দরজা।

‘তা যাচ্ছ কোথায়?’ হাসিমুখে জানতে চাইল জমির শেখ। দরজার পাশে চৌকাঠে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল সে। হাতদুটো বেঁধেছে বুকে। হাসিটা অতি মধুর। ভিলার বাইরে চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে সাদা ভ্যান। সামনের সিটে বসে আছে জমিরের দুই লোক। তাদের একজন কাদের। অন্যজন কখনও কথা বলে না। নাম তাবির।

সুটকেস হাতে কোথায় যাচ্ছে, তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা খুঁজতে লাগল ভাদিম। কয়েক মুহূর্ত পর তুতলে উঠে জানাল, ‘আ… আমি… ড্রাই ক্লিনারের কাছে যাচ্ছিলাম… আমার কয়েকটা সুট…’

‘মাঝরাতে লণ্ডিতে?’

চুপ করে থাকল ভাদিম।

হাসিটা ম্লান হলো না জমির শেখের। বাড়ির ভেতরে পা রেখে ক্লিক আওয়াজে আটকে দিল দরজা। ‘লন্ড্রিতে না হয় পরেই গেলে? এসো, ড্রিঙ্ক নেবে।’ আদর করে ভাদিমের কাঁধ চাপড়ে দিল জমির। ‘দারুণ সুসংবাদ আছে। শেয়ার করব তোমার সঙ্গে।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুটকেস মেঝেতে নামিয়ে জমিরের পিছু নিল ভাদিম। ভীষণ ভয় লাগছে তার। হলওয়ে থেকে বেরিয়ে লম্বা ডাবল ডোর ঠেলে লিভিংরুমে ঢুকল ওরা।

হাসতে হাসতে বাতির সুইচ টিপল জমির। আলো জ্বলে উঠতেই কাশ্মিরী কার্পেট মাড়িয়ে চলে গেল ড্রিঙ্ক কেবিনেটের সামনে। ভাদিমকে বলল, ‘তুমিও তো দেখি ফুর্তি করছিলে।’ আরেকবার দেখল, টেবিলের ওপর খালি শ্যাম্পেইনের বোতল ও গ্লাস। ‘এমন কি হতে পারে, ভাদিম, আমরা একই খুশিতে ফুর্তি করছি?’

নার্ভাস হাসল ভাদিম। ‘শুয়ে পড়ার আগে এক ঢোক শ্যাম্পেইন নিয়েছি।’

ড্রিঙ্ক কেবিনেটের দরজা ঠাস্ করে খুলল জমির। হাতে নিল দুটো স্ফটিকের ব্র্যাণ্ডি গ্লাস। ক্রিস্টালের ডিক্যান্টারের মুখ খুলে কানায় কানায় ভরল দুই গ্লাসে ভিন্টেজ কনিয়াক। ‘বোসো, ভাদিম। ড্রিঙ্ক করো আমার সঙ্গে।’

আপত্তি থাকলেও জমিরের হাত থেকে গ্লাস নিল ভাদিম। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসল চেয়ারে। নার্ভাস ভঙ্গিতে হালকা চুমুক দিল ব্র্যাণ্ডির গ্লাসে। টের পাচ্ছে, অ্যাসিডের কারণে পুড়ছে স্টমাক ওয়াল। তবে দুই ধরনের মদ পেটে গেছে বলে এমনটা হচ্ছে না। হঠাৎ করেই তার মনে পড়েছে আবদুল হাসানের মৃত মুখটা।

জমির শেখ ড্রিঙ্ক দেয়ার পর এই একই চেয়ারে বসে মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করেছে বেচারা!

একটু একটু করে কাঁপছে ভাদিমের হাত।

দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ওকে দেখছে জমির। চোখে গভীর দৃষ্টি। ‘আজ এত নার্ভাস কেন তুমি, বন্ধু?’

‘নার্ভাস? না তো!’ কাঁপা হাসি দিল ভাদিম। ‘নার্ভাস হওয়ার কী আছে?’

‘আমার তো মনে হলো, বলার মত কিছু আছে তোমার।’ ঢোক গিলল ভাদিম। ‘না তো! কী বলব?’

‘হয়তো বলবে নতুন কোনও সূত্র পেয়েছ?’ বলল জমির। ‘তোমার মনে আছে আমাদের ওই প্রজেক্টের কথা, ভাদিম? আমরা না সহযোগী? গুপ্তধন পেলে বড়লোক হব আমরা।’

‘জানি, আজ হোক বা কাল, ওই গুপ্তধন আমরা পাব।’

‘আমারও তা-ই ধারণা,’ বলল জমির।

‘এবার গিয়ে শুয়ে পড়ব,’ একটু কেঁপে গেল ভাদিমের কণ্ঠ। টের পেল, দরদর করে ঘাম নেমে আসছে ভুরু বেয়ে চোখে।

‘তুমি কি জানো, কী কারণে আমি এতটা আত্মবিশ্বাসী?’ জানতে চাইল জমির।

চুপ করে থাকল ভাদিম।

‘জানতে চাইবে না, কেন আমি এত খুশি?’

ভুরু কুঁচকে ফেলল ভাদিম। ‘কেন?’

নিষেধের ভঙ্গিতে তর্জনী নেড়ে মুচকি হাসল জমির। ‘ভাদিম… ভাদিম… আমার বন্ধু…’ চোখে বরফের মত শীতল দৃষ্টি।

ভাদিমের মনে হলো বেঁচে থেকেও মরে গেছে সে।

ম্যান্টলপিসের সামনে গেল জমির। কনুই রাখল ওটার ওপর। চুমুক দিল ব্র্যাণ্ডির গ্লাসে। কয়েক মুহূর্ত পর গ্লাস ওখানে রেখে হাত বোলাল ফায়ারপ্লেসের ওপরে রাখা গম্বুজের মত অ্যান্টিক ঘড়ির ওপর। ‘এই ঘড়িটা সবসময় ভাল লেগেছে আমার। কী যেন নাম বলো তুমি এটার?’

আরেকবার ঢোক গিলে বলল ভাদিম, ‘দুর্মূল্য চাইমিং স্কেলিটন ক্লক। জেম্স কণ্ডলিফ তৈরি করেছেন আঠারো শত ষাট সালে।’ জমির ঘড়ির ওপর হাত বোলাচ্ছে দেখে আবারও বলল ভাদিম, ‘খুব দামি জিনিস।

ফরাসি আর্কিওলজিস্টের চোখে চোখ রাখল জমির। আবারও হাসল। কিন্তু পরক্ষণে বিকৃত হলো মুখ প্রচণ্ড রাগে। ম্যান্টলপিস থেকে নিয়ে ঘড়িটা মেঝেতে আছড়ে ফেলল সে। হাজার টুকরো হলো জিনিসটা।

ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ভাদিম। মেঝেতে ঘড়ির অসংখ্য টুকরো দেখে হাঁ হয়ে গেছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে রাগী গলায় জানতে চাইল, ‘এটা কী করলে?’

কিন্তু এক সেকেণ্ড পর হৃৎপিণ্ড থমকে গেল ওর।

ঘড়ির যন্ত্রাংশের ভেতর এমন একটা জিনিস আছে, যেটা ওখানে থাকার কথা নয়!

ঘড়ি নির্মাতা আঠারো শ’ ষাট সালে ওই জিনিস ওখানে রাখতেই পারেন না!

ঝুঁকে ডিভাইসটা তুলল জমির। আস্তে করে ছুঁড়ে দিল ভাদিমের দিকে। ওটা লুফে নিল ফরাসি কবর-লুঠেরা। হাতের তালুতে রেখে দেখল ছোট্ট সার্ভেইলেন্স ডিভাইসটা। ভাদিমের মনে হলো হাঁটুতে আর শক্তি নেই। যে-কোনও সময়ে ধুপ করে মেঝেতে পড়ে যাবে সে।

‘এই সাফল্যের জন্যেই মদ গিলে ফুর্তি করছি,’ বলল জমির শেখ। ‘কী কপাল, সবাই এখন আমরা জানি কোথায় আছে গুপ্তধন। হ্যাঁ, তুমি জানো, জানে তোমার নতুন বন্ধুরাও।’ এক পা সামনে বাড়ল সে। বুটের নিচে কুড়মুড় করে ভাঙছে কাঁচ। ‘মরুভূমিতে প্রথমবারের মত দেখা হলে চুক্তি করেছি। মনে নেই, ভাদিম? আমি এককথার মানুষ। তুমি যদি আমাকে সাহায্য করো, বদলে দশ পার্সেন্ট পাবে। কিন্তু বেইমানি করলে তার ফলাফল হবে খুব খারাপ। মনে নেই, ভাদিম?’

কয়েক পা পিছিয়ে গেছে ভাদিম।

পায়ে পায়ে তার দিকে এগোল জমির। ‘ব্যবসার কাজ শেষে ফেরার সময় জানলাম, তুমি বেইমানি করেছ আমার সঙ্গে। ষড়যন্ত্র করেছ। অথচ, প্রথম থেকেই আমার কোনও কাজেই আসোনি। তার ওপর, এখন এই কাণ্ড। কাজেই এবার ভেবে বের করতে হবে, কী করা যায় তোমাকে নিয়ে। কী মনে হয়, কী ধরনের মৃত্যু তোমার প্রাপ্য, ভাদিম?’

‘জমির… একমিনিট… আমি সব বুঝিয়ে বলতে পারব…’ তুতলে উঠে বলল ভাদিম। মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে বুকের কাছে তুলেছে দু’হাত। ‘ওই মাসুদ রানা এসে আমাকে হুমকি দিয়েছে। আমার আর কোনও উপায় ছিল না।’

‘তোর প্রতিটা কথা শুনেছি,’ দাঁতে দাঁত পিষল জমির। ‘তোর বাড়ির প্রতিটা ঘরে আছে আমার আড়ি পাতার যন্ত্র। সর্বক্ষণ তোকে দেখেছে অন্তত পনেরোটা মিনি ওয়েবক্যাম। তুই কি আমাকে এতই গাধা ভাবিস, ভাদিম? এসব না বুঝে পার করে দিয়েছি জীবনের এতগুলো বছর?’

দ্রুত পিছিয়ে যাচ্ছে ভাদিম। কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল হলওয়ের দিকে। বুঝে গেছে, এখনই বাড়ি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। গলা ফাটিয়ে সাহায্য চাইলে হয়তো শুনবে কেউ।

‘এবার মরবি, ভাদাইমা,’ কর্কশ হাসল জমির।

ভীষণ ভয়ে পাগল হয়ে গেল ফরাসি কবর-লুঠেরা। ঘুরে দৌড় দিতেই পায়ের নিচে পিছলে যেতে চাইল মসৃণ মার্বেল। উড়ে চলেছে সে দরজার দিকে। খপ্ করে ধরল ডোরনব। হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলল দরজা।

চাঁদের আলোয় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে আখলাক ও তাবির। পথ আটকে রেখেছে তারা!

আখলাকের হাতে সাইলেন্সারওয়ালা দীর্ঘ পিস্তল।

মারাত্মক আতঙ্কে গুঙিয়ে উঠেই ঘুরে সিঁড়ির দিকে ছুটল ভাদিম। তার পিছু নিয়েছে জমির শেখ। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে মুঠো করে ধরল পলায়নরত লোকটার কলার। হ্যাঁচকা টান খেয়ে হাঁটু গেড়ে বসল ভাদিম। আরেক টানে চিত করে ওকে মেঝেতে ফেলল জমির। কষে চড় দিতে লাগল ভাদিমের দুই গালে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে রক্তে লাল হয়ে গেল জমিরের হাতের এপিঠ-ওপিঠ।

‘মাফ… মাফ… মা…’ ফাটা ঠোঁটের ওদিক থেকে এল ঘড়ঘড়ে কণ্ঠ। ‘মাফ করে দাও, জমির! পা ধরি! ভাই… মাফ…

জমির শেখের চোখে কোনও অনুভূতি নেই। বেল্ট থেকে টেনে বের করল দু’দিকে ধার দেয়া কমব্যাট নাইফ। করুণ এক আর্তনাদ ছাড়ল ভাদিম। ‘মাফ… মাফ… করে দা…

পরের একমিনিট জীবনের সবচেয়ে কষ্টের সময় কাটাল ইউডন ভাদিম। কখনও ভাবেনি এত যন্ত্রণা পেতে হবে। ও জবাই হয়ে যাওয়ায় রক্তে ভেসে গেছে মেঝে। কিছু রক্ত ছিটকে এসে লেগেছে জমিরের চোখে-মুখে।

উঠে দাঁড়িয়ে রক্তাক্ত মুখ আস্তিনে মুছল জমির শেখ। চকচকে দুই চোখে তৃপ্তি।

হলওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে আখলাক ও তাবির।

তাদের দিকে চেয়ে সহজ সুরে বলল জমির, ‘সবাইকে জড় করো। তৈরি রাখো গাড়ি আর অস্ত্র। আমরা যাচ্ছি ট্রেন ধরতে।’

তেতাল্লিশ

একঘণ্টা আগে কায়রো ছেড়ে আসওয়ানের উদ্দেশে রওনা হয়েছে রেলগাড়ি। রাতের আঁধার চিরে এগিয়ে চলেছে। একদিকে নীল নদ, অন্যদিকে ঊষর মরুভূমি— মাঝে বাঁকা রেললাইন। ডাবল স্লিপার কম্পার্টমেন্টে ওপরের বাঙ্কে বসে আছে মাসুদ রানা। পরনে সেই টুক্সেডো। নিচের বাঙ্ক থেকে আসছে নাক ডাকার মৃদু, মোলায়েম আওয়াজ। ওটার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ট্রেনের ঝিকঝিক ঝিকঝিক শব্দ। চোখ ভেঙে ঘুম এলেও রানাকে রেহাই দিচ্ছে না দুশ্চিন্তা। খুব দ্রুত বইছে সময়। যে কাজটা হাতে নিয়েছে, সেটা শেষ করার জন্যে পাবে মাত্র সাত দিন। আর কয়েক ঘণ্টা পর শুরু হবে ওই সাত দিনের তৃতীয় দিন। জানা নেই শেষ পর্যন্ত হাতে আসবে কি না আখেনাতেনের সেই গুপ্তধন।

মনে পড়ছে লিণ্ডার আকুতি ভরা চোখ। নীরবে যেন বলছে: পারবে তো? বাঁচাতে পারবে তো আমাকে, রানা?

ভিড় করছে গত কয়েক দিনের স্মৃতি। বহু দূর পথ পাড়ি দিয়েছে। উৎরে এসেছে নানান বিপদ। সামনে কী, জানা নেই। নিজে প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারবে কি না, তা-ও অনিশ্চিত। হঠাৎ খুব বিরক্তি এল রানার মনে। এসব ভেবে মনটাকে ভারী করে লাভ কী?

মানিব্যাগ হাতে বাঙ্কের মই বেয়ে নেমে পড়ল রানা, কম্পার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে এল সরু নিয়ন বাতির করিডোরে। বামে একের পর এক কম্পার্টমেন্ট। একটু দূরে ইউনিফর্ম পরা এক গার্ড। তার সঙ্গে কথা বলছে সাদা পোশাকের এক লোক। তাকে পুলিশ বলেই মনে হলো রানার। ওর চোখ স্থির হলো লোকটার কোমরের একপাশে। একটু ফুলে আছে পিস্তল বা রিভলভার। ওর ধারণা ভুল না হলে, রেলগাড়ির সামনে আলাদা একটা সিকিউরিটি বগিতে জেগে আছে চার-পাঁচজন সাদা পোশাকের ডিটেকটিভ। জঙ্গিদের হামলা থেকে টুরিস্টদের বাঁচাতে বহু দিন ধরেই এই নিয়ম চলছে মিশরে।

করিডোর ধরে আরও কয়েক পা এগোবার পর রানার পকেটে থরথর করে কেঁপে উঠল মোবাইল ফোন।

ডিভাইসটা বের করে স্ক্রিন দেখল রানা।

জন ব্রাউন।

কল রিসিভ করতেই সরাসরি কাজের কথায় এল লোকটা, ‘পেলে ওগুলো?’

‘জেনেছি কোথায় আছে,’ নিচু গলায় বলল রানা।

‘গুড। ভালই দেখাচ্ছ। জানতাম, আমাকে ডুবিয়ে দেবে না।’

‘সত্যি ওখানে গত সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে যদি থাকেও, সুদানিয মিলিশিয়া আর বেদুঈনদের চোখ এড়িয়ে বের করে আনা খুব কঠিন কাজ হবে।’

‘ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি শুধু খুঁজে বের করো।’ মৃদু হাসল ব্রাউন। ‘বুঝতেই পারছ, খালি হাতে ফিরলে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব একটা চারকোনা বাক্স। ভেতরে থাকবে লিণ্ডার কাটা মাথা।’

চুপ করে থাকল রানা।

‘ওখান থেকে প্রমাণ হিসেবে একটা দুটো জিনিস আমার কাছে আনবে। আরও দেবে কো-অর্ডিনেটস। বাকি যা করার করব আমিই।’

‘সোনা ভরা ট্রাক নিয়ে রওনা হলে সবার চোখে পড়বে,’ মন্তব্য করল রানা।

আবারও হাসল জন ব্রাউন। ‘গোপনে জিনিস সরিয়ে নেয়া বা পৌঁছে দেয়াই আমার ব্যবসা। ভুলে গেলে, রানা, আমি এসএএসের কর্নেল ছিলাম?’

‘প্রমাণ পেলে লিণ্ডাকে ছেড়ে দেবে?’ জানতে চাইল রানা।

‘নিজের কথা রক্ষা করো। আমারটা আমি রক্ষা করব।’

‘তুমি সত্যিকারের ভদ্রলোক,’ টিটকারির সুরে বলল রানা। ‘ব্রিটিশ মিলিটারির উজ্জ্বল উদাহরণ।

রেগে গেল জন ব্রাউন। ‘বেশি বাড়াবাড়ি করবে না, রানা। নইলে ফলাফল ভাল হবে না। আশা করি দু’এক দিনের ভেতর যোগাযোগ করবে। মনে রেখো, সাত দিন ফুরিয়ে গেলে মরবে লিণ্ডা।’ কল কেটে দিল সে।

ফোন পকেটে রেখে দুলন্ত করিডোর ধরে রেস্টুরেন্টের দিকে চলল রানা। বেচা-বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে ওখানে। তবে সারারাত খোলা থাকে পাশের বার।

কায়রোর স্টেশনে মাত্র কয়েকজন যাত্রীকে রাতের এই ট্রেনে উঠতে দেখেছে রানা। বার-এ টুরিস্টদের কাউকে না দেখে বিস্মিত হলো না। সাদা জ্যাকেট পরা অ্যাটেণ্ডেন্টের চোখের নিচে কালো দুটো থলি। অর্ডার দিতেই কাউন্টারের ওপর রাখল ডাবল স্কচ উইস্কি। সোনালি তরলে হালকা চুমুক দিয়ে চুপ করে বসে থাকল রানা। একটু পর পেছনে আওয়াজ পেয়ে ঘাড় কাত করে দেখল, বার-এ ঢুকেছে আরেক যাত্রী। লোকটার বয়স হবে পঁয়ত্রিশ। পরনে ডেনিম শার্ট ও ইস্ত্রি করা জিন্স প্যান্ট। রানার পাশের টুলে বসে বিয়ার চাইল। ইংরেজি উচ্চারণ শুনে রানা বুঝল, সে কানাডিয়ান। বোধহয় বাস করে টরোন্টো শহরে। রানার মনে পড়ল, এর সঙ্গে আছে স্ত্রী এবং ছোট্ট একটা ছেলে।

যাত্রীদের ভেতর যেমন সাধারণ বিষয় নিয়ে আলাপ হয়, একটু পর কানাডিয়ানের সঙ্গেও টুকটাক কথা শুরু হলো রানার। লোকটার নাম রনি ফিশার্স। কমপিউটার সেলসম্যান। মিশরে ঘুরতে এসেছে স্ত্রী মেরি আর একমাত্র ছেলে নিকিকে সঙ্গে নিয়ে। নিকির বয়স এখন সাত। আলাপ করার সময় রানা জানাল, ও ফ্রিল্যান্সার ট্র্যাভেল জার্নালিস্ট। কায়রো টু আসওয়ান রেলরোডের ওপর আর্টিকেল লিখছে এক ম্যাগাযিনের জন্যে।

ড্রিঙ্ক শেষ হওয়ায় পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিল ওরা দু’জন। নিজের স্লিপার কম্পার্টমেন্টের দিকে চলল রানা। এক বগি থেকে পরের বগিতে যাওয়ার সময় টের পেল, ক্রমেই কমছে রেলগাড়ির গতি। কিছুক্ষণ পর প্রায় থেমেই গেল। করিডোরে ওদিক থেকে সেই গার্ডকে আসতে দেখল রানা। এখন তার সঙ্গে সাদা পোশাকের দুই গোয়েন্দা পুলিশ।

‘ট্রেনের কোনও সমস্যা?’ পাশ কাটাবার সময় জানতে চাইল রানা।

‘চিন্তার কিছু নেই, স্যর,’ বলল ইউনিফর্ম পরা গার্ড। ‘ইঞ্জিনে সামান্য সমস্যা। পরের স্টেশনে ইঞ্জিনিয়াররা অপেক্ষা করছেন। আশা করি ঘণ্টাখানেকের ভেতর স্বাভাবিক গতি পাব আমরা।

নিজের কম্পার্টমেন্টে ফিরে রানা দেখল, নিচের বাঙ্কে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে কেন্সিংটন। নিঃশব্দে ওপরের বাঙ্কে উঠে সরু ম্যাট্রেসে শুয়ে পড়ল ও। বিরক্তি বোধ করছে গতি কমে যাওয়ায়। ধীরে ধীরে ঘুরতে লাগল ঘড়ির লিউমিনাস কাঁটা। পেরোচ্ছে এক এক করে মিনিট। রানার মনে হলো, পরের স্টেশনে যেতে অনন্তকাল নিচ্ছে ট্রেন। আরও অনেকক্ষণ পর বাইরে কয়েকজনের কণ্ঠস্বর শুনল। ঠং-ঠাং আওয়াজে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে ইঞ্জিনিয়াররা। একটু পর আবারও ফোঁস আওয়াজ ছাড়ল ডিযেল ইঞ্জিন। ঝাঁকি খেল বগি। আবারও গতি তুলছে রেলগাড়ি। চুপ করে শুয়ে অন্ধকার শূন্যে চেয়ে রইল রানা। মৃদু কাঁপছে পাশের প্লাইউডের দেয়াল।

চুপ করে শুয়ে থাকল রানা। ঘুম আর এল না। তারপর আকাশে প্রথম ভোরের আলো ফুটতেই বুজে গেল চোখ। মনে হলো কোথায় যেন ভেসে চলেছে ও। রেলগাড়ির সঙ্গে মৃদু দুলছে ওর দেহ। তারপর কখন যেন হালকা ঘুমে তলিয়ে গেল রানা। স্বপ্নের ভেতর বুঝল, ও আছে কোনও ইয়টে। নাকে নোনা গন্ধ। ঝিরঝির করে বইছে শীতল হাওয়া। ঝলমল করছে সূর্য। রোদ এসে পড়ল মুখে। নীল-সবজেটে জল আস্তে করে হাত বোলাচ্ছে ইয়টের খোলে।

কার যেন কণ্ঠ শুনল রানা। ধীরে ধীরে ঘুরে তাকাল আওয়াজের দিকে।

ডেকের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে জন ব্রাউন। পেছনে দিগন্ত ছুঁয়েছে বিশাল সাগর। ব্রিটিশ লোকটার মুখে বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি। পরনে কঙ্গোর সেই ইউনিফর্ম।

ব্রাউনের বুকে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাফেলা বার্ড। ঘুমের ভেতর সামান্য মাথা নাড়ল রানা। রাফেলা বার্ড নয়, ওই মেয়ে লিণ্ডা। শক্ত হাতে পেছন থেকে ওর গলা পেঁচিয়ে ধরেছে জন ব্রাউন। মেয়েটার চোখে নিখাদ আতঙ্ক। আরেক হাতে পিস্তলের নল লিণ্ডার মাথার তালুতে ঠেকিয়ে দিল লোকটা। এবার মেরে ফেলবে মেয়েটাকে!

ছুটে গেল রানা ওদিকে। চিৎকার করল, ‘না! ছেড়ে দাও ওকে!’ কিন্তু ওর কণ্ঠস্বর বুজে এসেছে। আরও জোরে দৌড়াতে চাইল রানা। অবাক হয়ে দেখল, এত ছুটেও মাঝের দূরত্ব কমাতে পারছে না। রয়েই যাচ্ছে ব্যবধান। ইয়টের ডেক হয়েছে শত শত গজ লম্বা।

সামনে ওপরে উঠেছে ডেক। দূর থেকে দূরে যাচ্ছে লিণ্ডা আর জন ব্রাউন। ধাওয়া করে এগোতে গিয়ে ঢালু ডেকে পিছলে গেল রানা। নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। ‘না! গুলি কোরো না!’ প্রাণপণে চিৎকার করল রানা। ট্রিগারে চেপে বসেছে জন ব্রাউনের তর্জনী।

হঠাৎ করেই গুলির বিকট আওয়াজে ঝটকা দিয়ে বাঙ্কে উঠে বসল রানা। কম্পার্টমেন্টের নিচু ছাতে ঠুকে গেছে মাথা। অলস মগজে ভাবল, আসলে ওটা দুঃস্বপ্ন। কিন্তু এক সেকেণ্ড পর বুঝল, কানে ভুল শোনেনি গুলির আওয়াজ। নিচের বাঙ্কে করুণ আর্তচিৎকার জুড়েছে কেন্সিংটন। তখনই আবারও চালু হলো অটোমেটিক অস্ত্রের গুলি। বগির দেয়াল ভেদ করে উল্টোদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল অনেকগুলো গুলি। ফুটোগুলো দিয়ে এল সোনালি রোদ।

ধড়মড় করে বাঙ্ক থেকে নেমে পড়ল রানা। এখনও ঘোর কাটেনি দুঃস্বপ্নের। টলতে টলতে গিয়ে সরিয়ে দিল জানালার ব্লাইণ্ড। রেললাইন থেকে সত্তর গজ দূরে মরুভূমিতে নাচতে নাচতে চলেছে দ্রুতগামী চারটে জিপ। পেছনে বালির মেঘ। ট্রেনের সমান গতি তুলে চলেছে গাড়ি। ওগুলোর ভেতরে আটজনকে দেখল রানা। তারা টুরিস্ট নয়। সামনের কালো নিসান পেট্রলের সঙ্গে আছে স্পট ল্যাম্প ও বুলবার। পেছনেই জং ধরা এক ডজ এসইউভি। অন্যদুটোকে আর্মিতে বলা হয় ‘টেকনিকাস্’। অফ-রোড পিকআপের ক্যাবের পেছনে খোলা পিঠে .৫০ ক্যালিবারের হেভি মেশিন গান। দুই মারণাস্ত্র চালাচ্ছে মুখোশ ও কালো সানগ্লাস পরা দুই লোক। মেশিন গানের নল আবারও তাক করছে ট্রেনের দিকে। দুই সেকেণ্ড পর দুই মাযল থেকে কমলা আগুন ঝলসে উঠতে দেখল রানা। প্রায় একই সময়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ল ও।

বগির পাতলা লোহার পাত ভেদ করে নানাদিকে বিধল একরাশ গুলি। বিস্ফোরিত হয়ে ভেতরের দিকে ছিটকে পড়ল ভাঙা কাঁচ। সঙ্গে সঙ্গে কম্পার্টমেন্টের ভেতরে সগর্জনে ঢুকল বালি ভরা ঝোড়ো হাওয়া।

মেঝেতে শুয়ে পড়েছে কেন্সিংটন। মুখ থেকে বেরোচ্ছে চাপা গোঙানি। প্রায় লাফ দিয়ে উঠে তার বাহু চেপে ধরল রানা। আরেক হাতে হ্যাঁচকা টানে খুলল স্লিপার ডোর। জোর এক ঠেলা দিয়ে ইতিহাসবিদকে ফেলল করিডোরের মেঝেতে। রানাকে ক্রল করতে দেখে কয়েক সেকেণ্ড পর অনুকরণ করল কেন্সিংটন। বগির ভেতরে তুলকালাম কাণ্ড করছে শত শত গুলি। রানা ও কেন্সিংটনের চারপাশে ছিটকে পড়ছে ভাঙা – লোহার টুকরো ও জঞ্জাল।

করিডোরের ওদিকে সামনের বগির দরজা খোলা। ওদিকে আর্তচিৎকার শুনল রানা। ভীষণ ভয়ে নানাদিকে পালিয়ে যেতে চাইছে যাত্রীরা। দুই বগির মাঝের স্টিলের ব্রিজের ওপর বসে পড়েছে সাদা পোশাকের এক পুলিশ। হাতে এমপি ফাইভ। একটা জানালা দিয়ে গুলি পাঠাল আক্রমণকারীদের দিকে।

রানা খেয়াল করল, হামলাকারীদের উদ্দেশে গুলি পাঠাচ্ছে রেলগাড়ি থেকে আরও কয়েকটা আগ্নেয়াস্ত্র। বেশ কয়েকটা গুলি বুকে বিঁধতেই মেঝেতে পড়ল সাদা পোশাকের পুলিশ অফিসার। রক্তের ছিটা লেগে ভিজে গেছে পেছনের দেয়াল। মেঝেতে পড়ে গেছে লোকটার হাতের এমপি ফাইভ!

উঠে দাঁড়িয়ে আবারও দৌড়ে ওর কম্পার্টমেন্টে ঢুকল রানা। র‍্যাক থেকে টান দিয়ে নিল হোল্ডঅল। ভাঙা জানালা দিয়ে পলকের জন্যে দেখল, কালো নিসানের সামনের সিটের যাত্রীকে। এক সেকেণ্ডের জন্যে চোখে চোখ পড়ল পরস্পরের।

জমির শেখ!

নিসান জিপ আর ট্রেনের মাঝে হাজির হলো একটা পিকআপ। জমির শেখকে আর দেখতে পেল না রানা। অন্য একটা দৃশ্য দেখে চমকে গেছে। লাফ দিতে দিতে ট্রেনের সঙ্গে একই গতিতে চলছে পিকআপ। পেছনের পাটাতনে এক লোক। তার কাঁধে সোভিয়েত আমলের আরপিজি-৭ অ্যান্টি- ট্যাঙ্ক ওয়েপন। ওটার বৃত্তাকার মুখ তাক করেছে ট্রেনের পেটের দিকে। যে-কোনও সময়ে পেছনে সাদা ধোঁয়া ছড়িয়ে টার্গেটে পৌঁছুবে হাই-এক্সপ্লোসিভ মিসাইল।

টান দিয়ে হোল্ডঅলের চেইন খুলল রানা। ভেতর থেকে নিল এফএন রাইফেল। ঝড়ের বেগে মোটা ব্যারেলের নিচে লঞ্চার টিউবে লোড করল একটা ৪০ এমএম গ্রেনেড।

ওর প্রতিটা পেশিকে বারবার নির্দেশ দিচ্ছে মস্তিষ্ক: পালাও! রানা, পালাও!!

কিন্তু কিছুই পাত্তা দিল না রানা। ভাঙা জানালা দিয়ে ষাট মাইল বেগের বালিঝড়ের ভেতর বের করল রাইফেলের ব্যারেল। ঝরঝর করে খসে পড়ল জানালার ফ্রেমের ভাঙা কাঁচের টুকরো। এক সেকেণ্ড পর সাইটে পেল দ্রুতগামী পিকআপ। স্কোপের ভেতর দিয়ে গানারের চেহারা পরিষ্কার দেখল রানা। সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছে বলে বিকৃত দেখাচ্ছে লোকটার চেহারা। তৈরি সে আরপিজি-৭ দাগতে।

পাশাপাশি ছুটে চলা দুটো যন্ত্রদানব থেকে মুখোমুখি হয়েছে রানা এবং ওই লোক। বাঁচবে কেবল একজন। যে আগে ফায়ার করবে, বাঁচার সম্ভাবনা তারই বেশি। এক মিলিসেকেণ্ডে এফএন রাইফেলের লেযার রেঞ্জফাইণ্ডার পাঠাল ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম কমপিউটারের কাছে ডেটা। এলএসডি ডিসপ্লেতে ফুটল টার্গেটের স্পষ্ট ছবি। সাইট রেটিকলে দেখা গেল এলিভেশন ডায়োড এখনও লাল। রানা কয়েক ডিগ্রি ওপরে মাযল তুলতেই ডায়োড হলো সবুজ। এবার দেরি না করেই ট্রিগার টিপে দিল ও।

এফএন রাইফেল থেকে ছিটকে বেরোল আগুন। সেই সঙ্গে ধুপ আওয়াজ। আরপিজি থেকে মিসাইল রওনা হওয়ার আগেই লক্ষ্যভেদ করল ৪০ এমএম গ্রেনেড। লাফিয়ে উঠেই আবারও বালিতে পড়ে একের পর এক ডিগবাজি দিতে লাগল পিকআপ। রানার মনে হলো ওটা লাল আগুনের মস্তবড় এক ফুটবল। শেষ আরেকটা ডিগবাজি দিয়ে চিত হলো পিকআপ। একরাশ বালি চারপাশে ছড়িয়ে পিছলে গিয়ে থামল খানিক দূরে। এখনও বনবন ঘুরছে চার চাকা। দ্রুত একপাশে সরে গেছে জমির শেখের নিসান। মুহূর্তের জন্যে রানার মনে হলো, ধুলো ও ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে দেখতে পেয়েছে ভীষণ ঘৃণা নিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে লোকটা।

দৌড়ে করিডোরে বেরোল রানা। আবারও কমে যাচ্ছে ট্রেনের গতি। হয় মারা গেছে ট্রেন চালক, নইলে ভীষণ ভয়ে মাথা ঠিক নেই তার। পরের বগিতে প্রাণপণে, আর্তচিৎকার করছে সাধারণ যাত্রীরা। সাহসী এক পুলিশ অফিসার চেঁচিয়ে শান্ত করতে চাইছে অন্যদেরকে। হট্টগোলের ভেতর চেনা একটা মুখ দেখল রানা। রনি ফিশার্স। পাশেই তার স্ত্রী। আতঙ্কে সাদা হয়েছে মহিলার মুখ। বুকের কাছে ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরে আড়াল করেছে ফিশার্স। রানার হাতে রাইফেল দেখে ভীত চোখে ওকে দেখল। চিৎকার করে সবাইকে মেঝেতে শুয়ে পড়তে নির্দেশ দিল রানা। দৌড়ে এগিয়ে গেল করিডোরে পড়ে থাকা মৃত পুলিশ অফিসারের দিকে। বাহু ধরে সঙ্গে টেনে নিয়ে চলেছে কেন্সিংটনকে।

ভাঙা জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে চমকে গেল রানা। জানা নেই এবার কী করবে।

ট্রেন থেকে ষাট গজ দূরে একই গতি তুলে চলেছে কালো নিসান। ওটার পেছনে এক ডাকাতের কাঁধের ওপর আরপিজি সেভেন। জানালা দিয়ে বের করেছে অস্ত্রটা।

ওটার পেছনে সাদা ধোঁয়া দেখল রানা।

ট্রেনের এই কম্পার্টমেন্টের দিকেই আসছে মিসাইল!

দশ মিটারের পরিবৃত্ত পেরোতেই চালু হলো মিসাইলের রকেট মোটর। এঁকেবেঁকে সাপের মত এল হাই এক্সপ্লোসিভ রাউণ্ড। পেছনে রেখে আসছে সাদা ধোঁয়া। দ্রুত ব্যবধান কমছে ওটার সঙ্গে ট্রেনের।

চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই রানার

এক সেকেণ্ডের পাঁচ ভাগের এক ভাগ সময়ে বগির ভেতর ঢুকে বিস্ফোরিত হলো প্রচণ্ড শক্তিশালী বোমা।

চুয়াল্লিশ

বগির ভেতর আরপিজি সেভেনের বিস্ফোরণের গতিপথে যেটাই পড়ল, ছিন্নভিন্ন হলো সব। চারপাশে ছিটিয়ে গেল হাজার হাজার শ্যাপনেল ও আগুনের কমলা হলকা।

চারপাশে ভীষণ তাপ ও বিকট আওয়াজ। মুহূর্তের জন্যে রানা টের পেল, অস্ত্রের ব্যাগ পড়ে গেল কাঁধ থেকে, শূন্যে ভেসে উড়ে চলেছে ও। তারপর কামানের গোলার মত পিঠ দিয়ে গিয়ে পড়ল শক্ত কিছুর ওপর। ধুপ করে পড়ল মেঝেতে। ওর ওপর দিয়ে গেল আগুনের লাল-হলদে স্রোত। প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়েছে রেলগাড়ি। খুব ধীর গতি তুলে স্লো মোশন ছায়াছবির দৃশ্যের মত রেললাইন উপড়ে নিয়ে কাত হলো বগি। শুরু হলো একের পর এক কর্কশ ধাতব আওয়াজ। সেইসঙ্গে হাড় ভাঙা ঝাঁকি। চল্লিশ মাইল বেগে মাটি, বালি ও পাথরের ঢেউ তুলে এগিয়ে চলেছে লোহার বগি। দুমড়ে-মুচড়ে ফাটল ধরে ভেঙে পড়ছে সব। রানা শুধু আবছাভাবে বুঝেছে, ওপরে উঠে বিকট একটা আওয়াজ তুলে কাত হয়েছে সামনের বগি। প্রচণ্ড আরেক ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল ডানদিকে 1 পেরিয়ে গেল কয়েক মুহূর্ত। টের পেল, ধুপধাপ লাফ দিচ্ছে ওর হৃৎপিণ্ড। কানের ভেতর দ্রুতগতি রক্ত চলাচলের আওয়াজ।

বাতাসে ভাসছে শ্বাস আটকে দেয়া ঘন ধুলোবালি। এল আহতদের করুণ চিৎকার ও গোঙানির শব্দ। টলমল করে উঠে দাঁড়াল রানা। এখনও চাকার ওপর ভর করে সোজা আছে ওদের বগি। পেছনের দিক থেকে আসছে ঘন ধোঁয়া। ওখানে আগুনের লকলকে জিভ দেখল রানা। ছাত চাটতে চাটতে দ্রুত এগোচ্ছে লেলিহান কমলা শিখা।

রানার পাশেই চোখ বুজে শুয়ে আছে কেন্সিংটন। ‘আপনি ঠিক আছেন? তার বাহু ধরে নাড়া দিল রানা।

চোখ মেলে ওকে দেখল ইতিহাসবিদ। ফ্যাকাসে হয়েছে ধুলোবালি মাখা মুখ। কোঁৎ করে ঢোক গিলে কোলা ব্যাঙের স্বরে বলল, ‘বেঁচে আছি… মনে হয়।’

চারপাশের ধ্বংসস্তূপে চোখ বোলাল রানা। একটু আগে যে গার্ড শান্ত করতে চেয়েছে যাত্রীদেরকে, খানিকটা দূরেই তার লাশ। মৃতদেহ থেকে দূরে ভাঙা কাঁচের ভেতর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে রনি ফিশার্স। ডান ভুরুর ক্ষত থেকে টপটপ করে পড়ছে রক্ত। পুড়ে গেছে পোশাকের একাংশ। উঠে দাঁড়িয়ে টলমল করছে মেরি ফিশার্স। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কেটে গেছে গাল। এক সেকেণ্ড পর কাঁপা গলায় সাহায্য চাইল রানার কাছে: ‘ওকে বাঁচান! প্লিয!’ আঙুল তাক করে দেখাচ্ছে ঘন কালো ধোয়ার দিকে T

রানা চট্ করে বুঝে গেল কী বলছে মহিলা। ছিটকে পড়ার সময় হারিয়ে গেছে তার সন্তান। বেচারা এখন আছে বগির জ্বলন্ত অংশে।

হাতের রাইফেল কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে ধোঁয়ার ভেতর ঢুকল রানা। গনগনে আগুনের তাপ অনুভব করছে ওর দুই পায়ে। বগির পেছনদিক কয়েকটা ভাঁজ খেয়ে বিদঘুটে দেখাচ্ছে। ভাঙা প্লাইউডের পার্টিশন, নানান ফিটিংস্ আর তুবড়ে যাওয়া বাঙ্ক মিলে তৈরি হয়েছে স্তূপ। দাউ-দাউ আগুন ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। লাথি মেরে আবর্জনা ও প্লাইউডের পার্টিশন সরিয়ে বাচ্চা ছেলেটাকে খুঁজছে রানা। আগের চেয়েও দ্রুত বগির ভেতর ছড়াচ্ছে আগুন। ঘন ধোঁয়া। পোড়া বাজে গন্ধ। বেশি দূর চোখ চলছে না রানার। কিন্তু সামনে থেকে প্লাইউডের ভাঙা একটা পার্টিশন সরাতেই মেঝেতে ছেলেটাকে দেখল। গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে। একটু একটু নড়ছে ডানহাত।

ঝুঁকে জঞ্জালের ভেতর থেকে ছেলেটাকে তুলল রানা। ধুলোবালি ও ছাই মেখে কালো হয়ে গেছে বাচ্চার মুখ। তবে হাত-পায়ে কোথাও পোড়া দাগ বা ক্ষত নেই। ছিঁড়ে যায়নি ধুলোভরা পোশাক। ওকে বুকে চেপে ধরে ধোঁয়া ও আগুনের মাঝ দিয়ে কয়েক লাফে পৌঁছুল বগির নিরাপদ অংশে। রানা দু’হাতে বাড়িয়ে দিতেই প্রায় ছোঁ দিয়ে বাচ্চাটাকে নিল মেরি ফিশার্স। মা-ছেলে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জ্ঞান ফিরছে রনি ফিশার্সের। গুঙিয়ে উঠল। আস্তে করে উঠে বসল।

এত বড় বিপদেও ভাগ্য ভাল ওদের তিনজনের, ভাবল রানা। বগির যেদিক ভেঙেচুরে ঢুকেছে আরপিজি, সেই এবড়োখেবড়ো বড় গর্তটা দেখাল রানা। ‘এবার নামতে হবে ট্রেন থেকে।’ ধোঁয়া ভরা গর্তের ওদিক থেকে সোনালি রোদ আসছে বগির ভেতর। সামান্য দূরেই বিশাল সব ধূসর পাথরের বোল্ডার। পায়ের কাছে রুপালি বালিমাটিতে রোদে পোড়া দুবলা ঘাসের চাপড়া। রনি ফিশার্সকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল রানা। ছোট একটা দল তৈরি করে নেমে পড়ল মাটিতে। চুরমার হওয়া বগির মাঝ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে আগুন। পাথরের বোল্ডার দেখাল রানা। ‘ওগুলোর আড়ালে চলে যান সবাই।’

বালিমাটির ওপর ছেঁড়া নেকলেসের মত এলিয়ে আছে রেলগাড়ি। যে যেভাবে পারছে বগি থেকে বেরিয়ে আসছে যাত্রীরা। বিধ্বস্ত চেহারা। কেউ কেউ রক্তাক্ত। একে অপরকে সাহায্য করছে সবাই। চুরমার হয়ে উল্টে যাওয়া বগি দুটোর দিকে তাকাল রানা। এত জোরে সংঘর্ষ হয়েছে, একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িয়ে পেঁচিয়ে গেছে। জানালাগুলো দিয়ে লকলক করে বেরোচ্ছে আগুন। ভেতরে কেউ থাকলেও এখন আর নামতে পারবে না। জমির শেখের চরম নিষ্ঠুরতা দেখে রাগে মুঠো পাকিয়ে গেল রানার দুই হাত।

‘ওরা আসছে,’ কাঁপা স্বরে বলল কেন্সিংটন।

আকাশে উঠছে জঙ্গিদের বিধ্বস্ত, জ্বলন্ত পিকআপের কালো ধোঁয়া। অনেক সরে গিয়েছিল অন্য পিকআপ, কালো নিসান জিপ আর এসইউভি। এখন আবারও দ্রুত আসছে যাত্রীদের দিকে। পেছনে উড়ছে ধুলোর মেঘ। কালো নিসানের দিকে তাকাল রানা। মুহূর্তে বুঝে গেল, এবার কী করবে জমির শেখ।

যাত্রীদের একজনকেও বাঁচতে দেবে না লোকটা। বাদ পড়বে না মহিলা বা শিশুরাও। ট্রেনে হামলা করেছে শুধু ওকে খতম করার জন্যেই।

আরও নিরীহ মানুষ খুন হোক, চায় না রানা। ডাইভ দিয়ে আবারও ঢুকল জ্বলন্ত বগির ভেতর। ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে পৌছে গেল কেন্সিংটন আর ওর কম্পার্টমেন্টে। জঞ্জালের ভেতর পড়ে আছে হোল্ডঅল। হ্যাঁচকা টান দিয়ে আবর্জনার তলা থেকে ওটা বের করল রানা। ব্যাগের ভেতর থেকে নিল আরেকটা গ্রেনেড।

বালির প্রান্তরে গর্জন ছাড়তে ছাড়তে আসছে তিন গাড়ি। বামে নিসান, ড়ানে ডজ আর মাঝে .৫০ ক্যালিবারের মেশিন গান সহ পিকআপ। আগুন উগরে দিল মেশিন গান। শত শত গুলি লাগছে বিধ্বস্ত রেলগাড়ির গায়ে।

জীবিত যাত্রীদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলল রানা, ‘পাথরের আড়ালে সরে যান সবাই!’

গুলির আওয়াজে ভীষণ ভয় পেয়েছে মানুষগুলো। বালিতে বিধছে বুলেট। বিযনেস সুট পরা মাঝবয়সী এক লোক দৌড়ে গিয়ে বোল্ডারের ওদিকে যেতে চাইল। শক্ত হাতে ধরেছে অ্যাটাশে কেস। কিন্তু পেছনে খ্যাট-খ্যাট আওয়াজে গর্জে উঠেছে মেশিন গান। কয়েকটা গুলি ছিটকে এগিয়ে দিল মানুষটাকে। একবার মাথার ওপরে হাত তুলল, তারপর মাটিতে পড়ে গেল বেচারা মুখ থুবড়ে। গুলিতে ছিন্নভিন্ন অ্যাটাশে কেস থেকে নানাদিকে ছিটিয়ে গেল কাগজ।

এফএন রাইফেলের ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেমের ডায়োড সবুজ হতেই পিকআপের ওপর লক হলো রানার সাইট। ছিটকে বেরোল গ্রেনেড। তিন সেকেণ্ড পর বিস্ফোরিত হয়ে উল্টে পড়ল পিকআপ। ওটার গতিপথ থেকে সরে গেল অন্য দুই গাড়ি।

লঞ্চারে আরেকটা গ্রেনেড পুরল রানা। জমির শেখের নিসানের দিকে মাযল তাক করেই টিপে দিল ট্রিগার। কিন্তু একেবারে শেষ সময়ে বাঁক নিয়ে লাইন অভ ফায়ার থেকে সরল ড্রাইভার। গ্রেনেড গিয়ে লাগল জং ধরা ডজ গাড়িতে। ওটা যেন বাচ্চাদের খেলনা, আছাড় দেয়া হয়েছে খুব জোরে। তার ওপর বিস্ফোরিত হলো ফিউয়েল ট্যাঙ্ক। হাজার টুকরো হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে গেল জঙ্গিদের গাড়ি।

রয়ে গেছে শুধু জমির শেখের গাড়ি। তীরবেগে বাঁক নিল ড্রাইভার। মরুভূমির ভেতর দ্রুত গতি তুলতে গিয়ে গর্জে উঠল জিপের ইঞ্জিন। তুমুল বেগে ঘুরছে চার চাকা। পালিয়ে যাচ্ছে লোকগুলো। নিসানের দিকে গেল রানার হাতের এফএন রাইফেলের একরাশ গুলি। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে খালি হলো ম্যাগাযিন। হতাশ হয়ে রানা দেখল, দূর থেকে দূরে গিয়ে সকালের ধোঁয়াশার মাঝে হারিয়ে গেল কালো নিসান জিপ।

এসেছিল আটজন। ফিরছে জমির শেখ সহ তিনজন। আপাতত আর হামলা করতে আসবে না মিশরীয় জঙ্গি রাইফেল নামিয়ে নিল রানা। দ্রুত পায়ে গেল পাথরগুলোর মাঝে আশ্রয় নেয়া ভীত মানুষগুলোর কাছে। ফ্যাকাসে মুখে ওকে দেখছে সবাই। চোখে অশ্রু।

‘ওরা কি আবারও আসবে?’ জানতে চাইল এক মহিলা।

‘না,’ বলল রানা। ‘আর আসবে না।’

হঠাৎ করেই শুরু হলো নানান প্রশ্ন:

‘আমার স্ত্রীকে খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘এখন আমাদের কী হবে?’

‘আমরা আসওয়ান থেকে কতটা দূরে?’

সবার ভেতর থেকে উঠে দাঁড়ালেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এক মিশরীয় ভদ্রলোক। পরনে ধুলোভরা কোঁচকানো সুট। সরু চোখে উদাস দৃষ্টি। ওটা যেন বলে দিচ্ছে, সারাজীবন মানুষের কষ্ট দেখেছেন তিনি। বেঁচে থাকলে দেখবেন আরও অনেক। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আমি ডাক্তার। আমাকে সাহায্য করতে দিন।

গার্ডের বগি থেকে ফার্স্ট এইড বক্স সংগ্রহ করল রানা, পরের দশ মিনিটে আহতদেরকে চিকিৎসা দিলেন ডাক্তার। সুস্থরা রেলগাড়ি থেকে জোগাড় করল খাবার পানি। সব সরিয়ে রাখা হলো পাথরের বোল্ডারের ছায়ায়। এক নিহত পুলিশের রেডিয়ো ব্যবহার করে কায়রো পুলিশে যোগাযোগ করল রানা। জানিয়ে দিল, হামলা হয়েছে রাতের ট্রেনে। ওদিক থেকে ওকে জানিয়ে দেয়া হলো, এখনই রওনা হচ্ছে ইমার্জেন্সি টিমগুলো। রাইফেল ও হোল্ডঅল কেন্সিংটনের জিম্মায় রেখে একটার পর একটা দরজা খুলে পুরো ট্রেনে সার্চ করতে লাগল রানা। বাদ পড়ল না করিডোর ও স্লিপার কম্পার্টমেন্টগুলো। প্রথম যে বগি সার্চ করল রানা, সামনের বগির ওপর উঠে গেছে ওটা। ভেতরে ঢালু মেঝেতে অতিবৃদ্ধ এক লোককে পেল ও। ঘাড় ভেঙে গেছে তাঁর। ঘুমিয়ে ছিলেন, সেই সময়ে দুর্ঘটনা ঘটে। বাঙ্ক থেকে ছিটকে পড়েন নিচের ওয়াশবেসিনের ওপর। করুণ দৃশ্যটা দেখে প্রচণ্ড রাগে তিক্ত হয়ে গেল রানার মন। সাবধানে ট্রেন থেকে নেমে বৃদ্ধের লাশ মাটিতে শুইয়ে দিল।

পরবর্তী বিশ মিনিটে বিধ্বস্ত ট্রেনে পেল আহত আরও চারজনকে। তাদের তিনজন কষ্ট হলেও হাঁটতে পারবে। আরেকজন মাথায় আঘাত পেয়ে অজ্ঞান। তাকে কাঁধে তুলে ট্রেন থেকে নামল রানা। অন্য তিনজনকে দেখিয়ে দিল, পাথরের ওদিকে কোথায় আশ্রয় নিতে হবে। ওই চারজনকে ডাক্তারের কাছে পৌছে দিয়ে আবারও তল্লাশীর কাজে নামল রানা। রেলগাড়ির ভেতরে আহতদের চেয়ে বেশি মৃতরা। কন্ট্রোলের সামনে বসে গুলি খেয়েছে রেলগাড়ির ড্রাইভার। আরপিজির বিস্ফোরণে এ্যাপনেলের আঘাতে কাটা পড়েছে কাছের গার্ড। অন্যজন বগি কাত হয়ে পড়ার সময় মাথা ভেঙে মারা গেছে। গুলি খেয়ে মরেছে সাদা পোশাকের তিন পুলিশ। তাদের একজন মাঝখান থেকে দু’টুকরো হয়েছে মেশিন গানের গুলিতে। বাঙ্কে বসে থাকার সময় ওই একই গুলিবর্ষণে খুন হয়েছে যুবা বয়সী এক দম্পতি।

জ্বলন্ত দুই বগির ভেতর পুড়ছে লাশ। কিছু করার নেই। উল্টে গেছে বেশ কয়েকটা বগি। ওখানে বেঁচে নেই কেউ। লাশ উদ্ধার করতে গিয়ে মন খারাপ হবে প্যারামেডিক আর দমকলের কর্মীদের। রানা নিজে অন্যান্য বগি থেকে বের করল এগারোটা মৃতদেহ।

রেলগাড়ি থেকে সামান্য দূরে মাটিতে সারি দিয়ে মৃতদের শুইয়ে দেয়া হলো। এক মহিলা যাত্রী পেশায় নার্স। চাদর ও কম্বল দিয়ে লাশ ঢাকতে সাহায্য করল সে। যেন সরে না যায় চাদর এবং কম্বল, তাই ওগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো কিছু পাথর। চুরি হতে পারে সেজন্যে সংগ্রহ করা হলো তিন পুলিশের অস্ত্র। যেসব বগিতে পুরোপুরি আগুন ধরে যায়নি, গার্ডের বগি থেকে ফায়ার এক্সটিংগুইশার নিয়ে শিখাগুলো নিভিয়ে ফেলল রানা।

যাত্রীরা নিরাপদ এটা নিশ্চিত হওয়ার পর নিজেদের স্লিপার কম্পার্টমেন্টে ফিরল রানা। কপাল ভাল, এপর্যন্ত পৌঁছায়নি আগুন। ভাঙা কাঁচ ও জঞ্জালের ভেতর থেকে রানা খুঁজে নিল ওর মোবাইল ফোন, নগদ টাকা আর মানকাউয়ার ম্যাপের ল্যামিনেটেড ফোটোকপি। শেষের জিনিসটা তৈরি করে দিয়েছে ইউডন ভাদিম।

জিনিসগুলো খোঁজার সময় রানা ভেবেছে: কীভাবে ওদের খোঁজ পেল জমির শেখ? নিশ্চয়ই ভাদিমের মুখ খুলিয়েছে সে? সেক্ষেত্রে বোধহয় মারা গেছে ফরাসি আর্কিওলজিস্ট। এখন আর তার জন্যে কিছুই করার নেই ওর।

জমির শেখ যেহেতু ট্রেনে হামলা করেছে, এ থেকে অন্য একটা বিষয় বেরিয়ে আসে। ওই লোক জানে কোথায় আছে মানকাউয়ার গুপ্তধন। আর সেজন্যেই খতম করতে এসেছিল প্রতিপক্ষকে। ধরে নেয়া যায় এখানে আর হামলা করবে না সে। রানা নিজে হলে এরই ভেতর দলবল নিয়ে রওনা হতো সুদানের উদ্দেশে। ওর মন বলছে, ওই একই কাজ করেছে লোকটা। এখন জমির শেখের সঙ্গে ওর প্রতিযোগিতা হবে, কে আগে পৌঁছুতে পারে গুপ্তধনের কাছে।

আকাশের অনেকটা ওপরে উঠেছে সূর্য। বাড়ছে উত্তাপ। বোল্ডারের কাছে ফিরে রানা দেখল, হাত কাটা পড়া এক মহিলাকে চিকিৎসা দিচ্ছেন ডাক্তার ও নার্স মিলে। তাদের পাশে পৌঁছে বর্তমান পরিস্থিতি খুলে জানাল রানা। শেষে যোগ করল, ‘বেশিক্ষণ লাগবে না ইমার্জেন্সি টিম আসতে। আপাতত সমস্ত দায়িত্ব নিতে হবে আপনাদের দু’জনকে।’

‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’ জানতে চাইলেন ডাক্তার।

‘আমাদের একটু তাড়া আছে,’ বলল রানা।

ক্লান্ত হাসলেন ডাক্তার। ‘জানি না আপনি কে বা কী করেন, তবে আমরা কেউ বাঁচতাম না আপনি না থাকলে। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই।’

‘আমার সাধ্য থাকলে আগেই ঠেকিয়ে দিতাম হামলা, বলল গম্ভীর রানা। ওর ভাল লাগছে না বিদায় নিতে, তবে আশা করা যায় বাকি কাজ সামলে নেবেন ডাক্তার ও নার্স।

দিগন্তের দিকে তাকাল রানা। এখন আর কয়েক মাইলের ভেতর নেই নীল নদ। মিশরে বসতি ও সবুজের দেখা পাওয়া যায় শুধু ওই জলধারার আশপাশে। সামনের কোনও গ্রামে যেতে হবে ওকে। ওখান থেকে কিনবে জিপগাড়ি। তা সম্ভব না হলে চুরি করবে। পথ একটা না একটা বেরোবেই।

কেন্সিংটনের উদ্দেশে বলল রানা, ‘এবার রওনা হব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *