ছায়াঘাতক – ২০

বিশ

দরজা ভিড়িয়ে ঘরে পা রেখেছে মাসুদ রানা। হাতে এক জঙ্গির কাছ থেকে নেয়া একেএস সাবমেশিন গান। অস্ত্রটার নল তাক করেছে জমিরের মাথার পেছনে। এত কাছের রেঞ্জে সাইট ব্যবহার করতে হবে না ওকে। ট্রিগারে হালকা চাপ দিলেই তিন গজ দূরে টার্গেটে বিধবে তিনটে গুলি। নতুন করে দেয়াল রঙ করবে বাড়ির মালিক

‘অস্ত্রটা ফেলো,’ নরম সুরে বলল রানা।

সাদা কাগজের মত ফ্যাকাসে হলো জমির শেখ। না, ঘুরেই বলল, ‘তুমি আসলে কে?’

‘অস্ত্র ফেলো,’ দ্বিতীয়বার বলল রানা। ‘নয়তো এখনই খুন হবে। তৃতীয়বার একই কথা বলব না।’ রানা দেখল, বিস্ময় কাটিয়ে খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিচ্ছে জমির। এমনি এমনি নেতা হয়নি সে। দলের যে-কারও চেয়ে প্রতিযোগী হিসেবে অনেক বেশি যোগ্য। সাবধানী, বুদ্ধিমান এবং অত্যন্ত নীচমনা। রানা নিজেও খুব সতর্ক। ট্রিগার থেকে সরল না তর্জনী। একেএস-এর গুলি ছুঁড়তে হলে ট্রিগারে চাপ দিতে হবে ছয় বা সাত পাউণ্ড। এরই ভেতর পাঁচ পাউণ্ড চাপ ট্রিগারে রেখেছে ও।

ভুরু কুঁচকে ফেলেছে জমির। ধীরে ধীরে ঘুরে দেখল রানাকে। দেহের পাশে ঝুলছে সাবমেশিন গান। হাত থেকে ওটা ছেড়ে দিল সে। পা থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে খটাস্ করে পড়ল অস্ত্রটা।

‘লাথি মেরে দূরে পাঠাও,’ বলল রানা। ‘এরপর বের করবে গুক পিস্তলটাও।’

মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল জমির। চোখে ফুটল প্রশংসা। বুটের লাথি খেয়ে খট খট আওয়াজে মেঝের ওপর দিয়ে সরে গেল সাবমেশিন গান। খুব সাবধানে রেইনকোট সরিয়ে বেল্টে ঝুলন্ত করডিউরা হোলস্টারের স্ট্র্যাপ খুলল সে। বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে ধরে হোলস্টার থেকে বের করল পিস্তল। ওটা একফুট সরিয়ে কবজি ঘুরিয়ে নিচে ফেলল। মেঝেতে পড়ে কয়েক ফুট দূরে গিয়ে থামল পিস্তল।

পুরো সময়ে একবারের জন্যে রানার চোখ থেকে নিজের চকচকে চোখ সরায়নি জমির। দৃষ্টিতে কী যেন। রানার মনে হলো, আমোদ পাচ্ছে লোকটা।

‘এবার মুখ খোলো,’ বলল রানা। ‘জানতে চাই কী কারণে মডাক ব্রাউনের রিসার্চের ব্যাপারে আগ্রহী হলে।

একেএস-এর মাযল বেয়ে উঠে রানার চোখে তাকাল জমির। দৃষ্টিতে আত্মবিশ্বাস, রাগ ও ক্ষোভ। ঠোঁটে পলকের জন্যে ফুটল একটুকরো নিষ্ঠুর হাসি। ‘আসলেই জানতে চাও, তাই না?’

‘খুশি হব তুমি বদান্যতা দেখালে।’

‘শীঘ্রিই সব জানবে,’ বলল জমির। ‘সবাই জানবে। সময় ঘনিয়ে এসেছে।’

ভুরু কুঁচকে গেল রানার। ‘কী বলতে চাও?’

হাসিটা বিস্তৃত হলো জমিরের। একটা লাশ টপকে এক পা পিছিয়ে গেল সে। সরে যাচ্ছে জানালার দিকে।

নিজেও এগোল রানা। ব্যবধান বাড়তে দেবে না দু’জনের মাঝে। সতর্ক করল, ‘আর এক পাও নড়বে না।’

কিন্তু ঠিক তখনই খট শব্দে পেছনে খুলে গেল দরজা। চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল রানা। গুলি করার জন্যে তৈরি। ভেবেছে জমিরের আরও লোক এসেছে।

না, লোকটা বাড়িওয়ালা। চোখে ঘুম। গালে খোঁচা- খোঁচা দাড়ি। পরনে ভেস্ট ও হাফপ্যান্ট। ‘মনে হলো একটা আওয়াজ….

অস্ত্র দেখে থমকে গেছে সে। চোখ লাশের ওপর। ভীষণ ভয়ে চুনের মত ফ্যাকাসে হয়েছে চেহারা।

ঝট করে জমিরের দিকে ফিরল রানা। কিন্তু অনেক বেশি বিপজ্জনক লোক জমির শেখ। পকেট থেকে কী যেন বের করেই রানার দিকে ওটা ছুঁড়ে জানালা ভেঙে ফায়ার এস্কেপের সিঁড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে।

গড়াতে গড়াতে আসছে জিনিসটা।

ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড!

বাড়িওয়ালার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা, পরক্ষণে তাকে জড়িয়ে ধরে লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল বাইরের করিডোরে। লোকটা ভারী আর থলথলে। তাল সামলাতে না পেরে পা পিছলে পড়ল রানার ওপর। মেঝেতে আছাড় খেল রানা। ওর বুকে যেন উঠেছে আস্ত হাতি।

আধ সেকেণ্ড পর বদ্ধ জায়গায় বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড। বিকট আওয়াজে কেঁপে উঠল গোটা বাড়ি। চারদিকে ছিটকে গেছে শ্যাপনেল। হাজার টুকরো হলো খোলা দরজা ও ফ্রেম। ওদিক দিয়ে বেরোল কমলা আগুনের হলকা। ধসে পড়ল করিডোরের বামদিকের দেয়াল। চারপাশে ছিটকাল সিমেন্ট ও ইঁটের টুকরো।

প্রচণ্ড আওয়াজের পর সবসময় যা হয়, চারপাশে নেমেছে থমথমে নীরবতা। রানা টের পেল, ওর দুই হাত মুখের ওপর। ওদুটো সরাতেই দেখল ধুলো আর ধোঁয়া। সারাশরীর ভরে গেছে সাদা সিমেন্টের গুঁড়োয়। হাতে ও বুকে রক্ত। চোখ সরিয়ে হাত দেখল রানা। মুঠো করল ওটা। বুঝে গেল, হাত এখনও দেহের সঙ্গেই আছে। ভীষণ ওজনের কী যেন চেপে বসেছে ওর ওপর। কঠিন হয়ে উঠেছে শ্বাস নেয়া। গা থেকে ওজনটা সরাতে চাইল রানা। ওর ওপর পড়ে আছে বাড়িওয়ালা। তার রক্তাক্ত একটা হাত দেহের পাশে।

শরীর মুচড়ে লোকটার তলা থেকে বেরোল রানা। প্রচণ্ড আওয়াজে ঝনঝন করছে দুই কান। আবছাভাবে শুনল স্মোক অ্যালার্মের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। ওটাকে ছাপিয়ে আসছে এক মহিলার কান্নার মাতম। টলমল করে উঠে দাঁড়াল রানা। মুখ নিচু করে দেখল বাড়িওয়ালাকে। মারা গেছে লোকটা। শ্যাপনেলের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে পিঠ আর মাথা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে।

কাঁপা হাতে নিজের শরীর পরীক্ষা করে দেখল রানা। মনে হলো ঠিকই আছে সব। অবশ্য, হয়তো ছেঁচে গেছে নার্ভের শেষমাথা। খারাপ ভাবে আহত হলেও অ্যাড্রেনালিনের কারণে কিছুই বুঝতে পারছে না। রক্ত সবই বাড়িওয়ালার। সামান্য ছড়েও যায়নি ওর দেহ।

ঝিঁঝির ডাকের মত বিশ্রী আওয়াজ কানে। হঠাৎ করেই জমিরের কথা মনে পড়ল ওর। লাফ দিয়ে লাশ টপকে পৌছে গেল সিঁড়ির মুখে। একেকবারে নেমে যেতে লাগল পাঁচ থেকে ছয়টা ধাপ। কয়েক মুহূর্ত পর ছিটকে বেরিয়ে এল রাস্তায়। ভিড় জমেছে নিচে। মানুষজন আঙুল তুলে দেখাচ্ছে ওপরতলার অ্যাপার্টমেন্টের ভাঙা জানালা। ওদিক দিয়ে ভক-ভক করে বেরোচ্ছে ধোঁয়া। এরই ভেতর ইমার্জেন্সি সার্ভিসের জন্যে মোবাইল ফোনে কল করছে কয়েকজন।

কেউ কেউ অবাক চোখে রানার দিকে তাকাল। ভাঙা কাঁচ মাড়িয়ে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চারপাশে তাকাল রানা।

এইমাত্র গর্জে উঠেছে গাড়ির ইঞ্জিন। ওটা ডিজেল চালিত। খুব তাড়া আছে কারও। রানা ঘুরে তাকাতেই ওর চোখে চোখ পড়ল জমিরের। ভ্যানের ভেতর বসে আছে সে। হোঁচট খেয়ে রওনা হলো গাড়িটা। সাইলেন্সার পাইপ থেকে বেরোচ্ছে কালো ধোঁয়া।

চিতার বেগে ভ্যানের পেছনে ছুটল রানা। গতি আরও বাড়ার আগেই পৌঁছুল পেছনের দরজার কালো, ধাতব হ্যাণ্ডেলের কাছে। শক্ত হাতে ওটা ধরতেই রানার মনে হলো, টান খেয়ে ছিঁড়বে কবজি ও কনুই। ক্রমেই বাড়ছে ভ্যানের গতি। দ্রুত পেছনে পড়ছে পিচঢালা পথ। লম্বা পায়ে প্রাণপণে দৌড়ে পেছনের দরজা খুলতে চাইছে রানা। একবার ভেতরে ঢুকতে পারলে সিট টপকে ঝাঁপিয়ে পড়বে জমিরের ওপর।

কিন্তু ভ্যানের পেছনের দরজা লক করা। আরও বাড়ছে গাড়ির বেগ। কর্কশ আওয়াজ তুলছে ইঞ্জিন। ভ্যানের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে পা পিছলে গেল রানার। দুই হাঁটু দিয়ে পড়ল পিচঢালা রাস্তায়। এখনও দু’হাতে ধরে রেখেছে কালো হ্যাণ্ডেল। ছেঁচড়ে চলেছে ভ্যানের পেছনে। ছিলে যাচ্ছে দুই হাঁটু। কী করে যেন আবারও উঠে দৌড়াতে লাগল। ওর মনে হলো ছিঁড়ে পড়বে হ্যাণ্ডেল ধরা হাতের আঙুল।

হঠাৎ জোরালো আওয়াজ তুলল গাড়ির হর্ন। সামনে গাড়ি দেখে একপাশে সরে গেল ভ্যান। এবার আর তাল রাখতে পারল না রানা, ছিটকে পড়ল একপাশে। আগেই হাত থেকে ছুটে গেছে কালো হ্যাণ্ডেল। বেশ কয়েকবার গড়ান খেয়ে রাস্তার ধারে থামল রানা। মুখ তুলে দেখল, দূরে চলে গেছে সাদা ভ্যান। বাঁক নিয়ে বামের রাস্তায় হারিয়ে গেল গাড়িটা।

উঠে বসে রানা দেখল, অবাক চোখে ওকে দেখছে পথচারীরা। আরবিতে বলে উঠল কেউ, ‘কী হয়েছে? ডাকাত?’

ব্যথাভরা শরীরে উঠে দাঁড়াল রানা। ভ্যান যেদিকে গেছে, সেদিকেই পা বাড়াল। ঘুরেও তাকাল না পেছনে।

অর্ধেক ব্লক পেরোতেই শুনল পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন।

হাঁটার গতি বাড়ল রানার।

একুশ

লম্বা জঙ্গি লাথি মেরেছে রানার পাঁজরে। জায়গাটা ব্যথায় টনটন করছে। ছড়ে গেছে হাত ও হাঁটু। যেন স্নান করেছে বাড়িওয়ালার রক্তে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা শার্টের। জ্যাকেট দিয়ে ওটা ঢেকে পুরো বিশ মিনিট কড়া রোদে হাঁটল রানা। সরে গেল ওই অ্যাপার্টমেন্ট ভবন থেকে অনেক দূরে।

একপাশের ফুটপাথে হকারদের দোকান দেখে ওখান থেকে কিনল একটা টি-শার্ট ও নকল একটা লিভাইস জিন্স। মুদি দোকান থেকে নিল দুই লিটারের পানির বোতল। ভাবছে, কপাল ভাল যে সঙ্গে রয়ে গেছে কিছু টাকাসহ মানিব্যাগ ও পাসপোর্ট। এরপর কী করবে এখনও স্থির করেনি রানা। নির্জন সরু এক গলি দেখে ওখানে ঢুকল। কাপড় ছেড়ে পানি দিয়ে পরিষ্কার হয়ে নিল। কাজটা শেষ করে পরল টি-শার্ট ও জিন্স। পুরনো রক্তাক্ত পোশাক মুড়িয়ে নিয়ে ভরে দিল ডাস্টবিনের ভেতর। অবশিষ্ট পানি দিয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে ফেলে দিল খালি বোতল। আবারও বেরিয়ে এল চওড়া রাস্তায়।

কয়েক মিনিট হাঁটার পর পেল একটা ক্যাফে। ফুটপাথে রয়েছে ছাতিওয়ালা কয়েকটা টেবিল ও চেয়ার। ছায়া দেখে নিয়ে একটা টেবিল দখল করল রানা। অর্ডার দিতেই বয় দিয়ে গেল কড়া, কালো কফি। পর পর তিন কাপ কফি পেটে যাওয়ার পর রানার মনে হলো, এখন ঠিকভাবে ভাবতে পারছে।

প্রথমেই ওর মনে এল মর্ডার্ক ব্রাউনের কথা। একটা ব্যাপার পরিষ্কার, বিশাল কোনও ঘটনায় জড়িয়ে গিয়েছিল সে। জমির শেখের মত লোক মাত্র একটা কারণেই আখেনাতেন প্রজেক্টের মত বিষয়ে নাক গলাবে— প্রচুর টাকার গন্ধ পেয়েছে সে। টাকা আর প্রাচীন ইতিহাস, এই দুটো মেলালে পাওয়া যায় মাত্র একটাই উত্তর: এরা খুঁজছে কোনও গুপ্তধন।

এখন কথা হচ্ছে, মডাক আসলে কতটা জানত?

মিশরে একা হাজির হয় সে। সঙ্গে কোনও রিসার্চ টিম ছিল না। নিজের কমপিউটারে রেখেছে এনক্রিপটেড ফাইল। সাধারণ কোনও অ্যাকাডেমিক এ কাজ করত না। বইয়ে মাথা গুঁজে রাখা স্কলার হলেও অনেক হিসাব নিকেশ করে জরুরি কিছু গোপন করতে চেয়েছে মডাক। তার মানেই, সে জানত কী নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু ফাঁস হয়ে যায় সব। অচেনা এক দেশে সিকিউরিটি সম্পর্কে অজ্ঞ অপেশাদার এক লোক। এমন একজন, যার ওপর চট্ করে নজর পড়বে চোর বা ডাকাতের। হতে পারে প্রজেক্টের জন্যে কারও কাছে সাহায্য চেয়েছে সে। হয়তো জরুরি কিছু বলে ফেলেছে ভুল মানুষকে। আর সেজন্যেই মর্ডাকের পিছু নেয় জমির শেখ এবং তার দল।

জমির শেখ। লোকটার চেহারা ভেসে উঠল রানার মানসপটে।

কে ওই লোক?

পেশাদার খুনি?

না, বোধহয়। হয়তো মিশরীয় কোনও জঙ্গি-নেতা। লোকটা বলেছে: ‘শীঘ্রিই সব জানবে। সবাই জানবে। সময় ঘনিয়ে এসেছে।’

আসলে কী বোঝাতে চেয়েছে সে?

বিষয়টা যা-ই হোক, ভাল কিছু হতে পারে না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। এবার স্থির করতে হবে, ও নিজে কী করবে।

উচিত কর্নেল ব্রাউনের সঙ্গে কথা বলে নেয়া।

মোবাইল ফোন বের করে ভদ্রলোকের নম্বরে ডায়াল করল রানা। তিনবার রিং হওয়ার পর ওদিক থেকে রিসিভ করা হলো কল।

‘কর্নেল, আমি, রানা,’ বলল রানা।

‘তোমার ই-মেইল পেয়েছি,’ বললেন তিনি।

‘ফাইলটা কি ওপেন করতে পেরেছেন?’

‘চেষ্টা করিনি। আগ্রহ বোধ করছি তোমার রিপোর্ট শোনার জন্যে। কী খবর, রানা? তুমি কি সফল হলে? মারা গেছে মর্ডাকের খুনি?’

কয়েক মুহূর্ত কথাগুলো গুছিয়ে নিল রানা, তারপর বলল, ‘মর্ডাকের খুনিদেরকে পেয়েছি। সাধারণ চোর। ড্রাগ অ্যাডিক্ট। যখন পেলাম, তখনও ওদের কাছে ছিল মর্ডাকের কিছু জিনিসপত্র।’

‘মারা গেছে তারা?’

‘না। ওদেরকে তুলে দিয়েছি পুলিশের হাতে।’

ওদিকে নীরবতা। পুরো বিশ সেকেণ্ড পর বললেন কর্নেল, ‘পুলিশের হাতে?’

‘খুন করিনি,’ বলল রানা, ‘এমনিতেই খুন, বেআইনী অস্ত্র আর ড্রাগসের মামলায় ফেঁসে গেছে। মিশরে ড্রাগসের জন্যে জেল হয় অন্তত পঁচিশ বছর। খুনের জন্যে ফাঁসিও হতে পারে।’ সামান্য বিরতি নিয়ে বলল ও, ‘সরি, কর্নেল। জানি, যা চেয়েছেন, তা করতে পারিনি। আসলে আর কিছু করার ছিল না আমার।’

দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেল রানা। বুঝে গেল, এরপর কী করবেন ভাবছেন কর্নেল। পেরিয়ে গেল কয়েক মুহূর্ত, তারপর বললেন তিনি, ‘হয়তো এটাই ভাল হলো, রানা। যা করেছ, সেজন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। এটা তো জানি, তোমার অন্তরটা সত্যিই সোনার মত খাঁটি।’

‘আপনাকে সতর্ক হতে হবে,’ বলল রানা। ‘আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে। মর্ডাকের রিসার্চের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে একদল বিপজ্জনক লোক। তারা মর্ডাককে খুন করেনি। তবে সুযোগ পেলেই ওর গবেষণা ডাকাতি করত। আর শেষ পর্যন্ত মেরেও ফেলত ওকে। এ কথাটা বলছি বলে দুঃখিত, কিন্তু এটাই সত্যি।’

‘অবাক হচ্ছি,’ কিছুক্ষণ পর বললেন কর্নেল। ‘তোমার কোনও ভুল হচ্ছে না তো?’

‘না, ভুল হচ্ছে না।’ পাঁজরে হাত রাখল রানা। বাড়ছে হাড়ের ব্যথা। স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নেয়া কঠিন। সংক্ষেপে বলল কী ঘটেছে ওই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে। যোগ করল, ‘মর্ডাকের প্রায় সবই আবারও ডাকাতি হয়েছে। সরি, কর্নেল।’

‘কমপিউটার নিয়ে আর ভেবো না,’ বললেন কর্নেল। ‘বড় কথা হচ্ছে, তুমি সুস্থ আছ। …যদিও জানার কৌতূহল হচ্ছে, এরা কারা।

‘জানি না,’ বলল রানা। ‘তবে মর্ডার্ক বোধহয় রিসার্চ করতে গিয়ে এমন কিছু জেনেছিল, যেটা সাধারণ অ্যাকামেডিকদের জানার কথা নয়।’

‘আমার কাছে যে ফাইল পাঠিয়ে দিয়েছ, নিশ্চয়ই সেখানে কিছু থাকবে,’ বললেন কর্নেল।

‘আমারও তা-ই ধারণা। আগে কখনও মর্ডাকের মুখে শুনেছেন আখেনাতেন প্রজেক্টের কথা?’

‘তেমন কিছু মনে পড়ছে না। ইতিহাস নিয়ে নানান বিষয়ে বলত। এই দেবতা, ওই দেবতা বা ফারাও রাজার কথা। কখনওই গুরুত্ব দিয়ে শুনিনি।’

‘তা ঠিক আছে,’ বলল রানা। ‘কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। এখনও জানি না এবার কী করব। যে বিষয়েই জড়িয়ে থাকুক মডাক, ওই লোকগুলো কিন্তু আপনার ক্ষতি করতে পারে। আপনি ওর সবচেয়ে কাছের আত্মীয়। হয়তো ধরে নেবে, কিছু জানেন। একটা মিথ্যা কথা বলেছি তাদেরকে। তবে সেটা হয়তো বেশিক্ষণ টিকবে না।

‘আসলে কী করতে চাও, রানা?’

‘ভাবছি, আরও কয়েক দিন থাকব মিশরে। খুঁজে বের করব লোকগুলোকে। তারপর তাদেরকে তুলে দেব পুলিশের হাতে। সেক্ষেত্রে কারও ক্ষতি করতে পারবে না।’

‘আমার মনে হচ্ছে, এরই ভেতর অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছ,’ বললেন কর্নেল, ‘নিজের কাজও শেষ করেছ। চিরকালের জন্যে কৃতজ্ঞ হয়ে গেছি। তোমাকে আর বিরক্ত করতে চাই না। মিলিটারিতে যা শিখেছি, কিছুই ভুলে যাইনি। নিজের দেখভাল ভাল করেই জানি। এরা যারাই হোক, ভয় পাই না। সাহস থাকলে আসুক। বুঝিয়ে দেব কর্নেল জন ব্রাউন আসলে কী।’

‘ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ কী, কর্নেল,’ বলল রানা। ‘যুদ্ধের দিনগুলো তো পেছনে ফেলে এসেছেন। নতুন জীবনে পা রেখেছেন। এগিয়ে চলুন নতুন পথে। তা ছাড়া, স্ত্রীর কথাও ভাবতে হবে আপনাকে। আপনার কিছু হলে তাঁর কী হবে? আরেকটা কথা, আপনার সঙ্গে লিণ্ডার সম্পর্ক জেনে ফেললে তাঁরও ক্ষতি করতে পারে তারা।’

জবাবে কিছুই বললেন না কর্নেল ব্রাউন।

‘আপনি তো ইয়টে আছেন,’ বলল রানা। ‘এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে ঘুরে বেড়ান। তারা চট্ করে আপনাকে পাবে না। আমার মতামত জানতে চাইলে বলব: আপাতত উষ্ণ কোনও স্বর্গ থেকে ঘুরে আসুন। মনে হয় না এদের হাত অতটা লম্বা। তবে ঝুঁকি নেয়ার মানে হয় না।’

আবারও নীরবতা। তারপর বললেন কর্নেল ব্রাউন, ‘তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ। অন্যভাবে হয়তো রক্ষা করতে পারব মর্ডাকের স্মৃতি। দেখাতে পারব ওর প্রতি সম্মান। ওর নামে কিছু টাকা দিতে পারি কোনও মিউযিয়ামে। বা ট্রাস্ট ফাণ্ড করব তরুণ রিসার্চারদের জন্যে।

‘মনে হচ্ছে এসব করাই ভাল, কর্নেল,’ বলল রানা। ‘আগে জানলে আপনার কাছে ওই ফাইল পাঠাতাম না। আমার উচিত ছিল ওটা নষ্ট করে দেয়া। আপনিও তা করতে পারেন। ডিলিট করে দিন ফাইল।’

‘তা-ই করব,’ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন ব্রাউন।

‘কথা দিন, চলে যাবেন অন্য কোনও বন্দরে?’

‘যত দ্রুত সম্ভব। প্রমিয করলাম। তুমি ঠিকই বলেছ, রানা। লিণ্ডার কথা ভাবতে হবে।’ কয়েক সেকেণ্ড পর জানতে চাইলেন কর্নেল, ‘তবে যতক্ষণ আছি, তুমি কি ঘুরে যাবে স্যান রেমো থেকে?’

রানার মনে পড়ল ওই ইয়টে থাকবে লিণ্ডা। পরিবেশটা হবে অসহ্যরকম আড়ষ্ট। জবাব দিল না ও।

‘অনেক ঝামেলার মাঝ দিয়ে গেলে, রানা। খুব খুশি হব ক’টা দিন আমার ইয়ট থেকে ঘুরে গেলে। লিণ্ডাও খুশি হবে। খেয়াল করেছি, তোমার সঙ্গ বেশ পছন্দ করে। মাঝে মাঝে মনে হয়, বেচারি এখানে বড় একা।’ সামান্য বিরতির পর বললেন কর্নেল, ‘আসলে আমি ব্যস্ত থাকি ব্যবসার কাজে। তুমি ঘুরতে এলে নিঃসঙ্গতা কাটবে ওর।’

‘পরে কখনও আসব, কর্নেল,’ বলল রানা। ‘আপনি যখন বলছেন মিশরে থাকার দরকার নেই, সেক্ষেত্রে সোজা ফিরব নরম্যাণ্ডিতে।

তোমাকে অতিথি হিসেবে না পেয়ে হতাশই হচ্ছি, ‘ বললেন কর্নেল। ‘ভাল লাগত ব্যক্তিগত ভাবে ধন্যবাদ দিতে পারলে। বুঝিয়ে বলতে পারব না, তোমার কাছে আমি কতটা কৃতজ্ঞ। জানি, অনেক কাজ ফেলে মিশরে গেছ। তার ওপর টাকাও চুরি হলো। কত গেছে বললেই পাঠিয়ে দেব। এটা আমার দায়িত্ব।’

‘টাকা লাগবে না, কর্নেল।’

‘ওটা অর্জন করেছ।’

‘তেমন কিছুই করতে হয়নি আমাকে,’ বলল রানা। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কর্নেল। ‘ঠিক আছে, রানা। তবে প্রমিয করো, যোগাযোগ রাখবে?’

‘নিশ্চয়ই,’ বলল রানা। ‘দুঃখিত, আর কোনও কাজে আসতে পারলাম না।’ কল কেটে দিল ও। কিছুক্ষণ চুপ করে ডুবে থাকল ভাবনার ভেতর। তারপর বিড়বিড় করল, ‘নরম্যাণ্ডিতে ফিরে যাওয়াই ভাল।’

.

স্টাডিতে বসে নাম করা এক আর্কিওলজিকাল বই পড়তে চাইছে ইউডন ভাদিম, এমন সময় বাইরে শুনল নুড়িপাথরের ওপর গাড়ির চাকার কর্কশ আওয়াজ। কয়েক সেকেণ্ড পর দড়াম করে খুলল ভিলার দরজা। ভেতরে ঢুকেছে জমির শেখ। মার্বেলের মেঝেতে বুটের খট খট আওয়াজ এগিয়ে আসছে। ঝটকা খেয়ে খুলে গেল স্টাডির দরজার দুই কবাট। ঘরে ঢুকেছে জঙ্গি-নেতা, বুকের কাছে ল্যাপটপ কমপিউটার। সোজা গিয়ে ডেস্কের ওপর রাখল ওটা। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে আলগা কাগজ।

‘ওটা কী?’ নার্ভাস সুরে জানতে চাইল ভাদিম। বুঝে গেল, কোনও কারণে ভীষণ উত্তেজিত জঙ্গি-নেতা।

চোখে গনগনে রাগ নিয়ে ভাদিমকে দেখল জমির। ‘ওই কমপিউটার তোমার জিয়ন কাঠি। হার্ডডিস্কে কী আছে বের করতে না পারলে মরবে তুমি।’

ল্যাপটপের ডালা খুলে মেশিনটা অন করল ভাদিম। কয়েক সেকেণ্ড পর স্ক্রিনে দেখল আর্কিওলজিকাল খননের দৃশ্য। পায়চারি করছে জমির। অন্ধ ক্রোধ ও ক্ষোভে কালো হয়েছে মুখ। বুকশেল্‌ফ্ থেকে গিবনের অত্যন্ত দামি ডিক্লাইন অ্যাণ্ড ফল অভ দ্য রোমান এমপায়ার দ্বিতীয় সংস্করণ নিয়ে ঘরের দূরে ছুঁড়ে মারল সে। দেয়ালে আছড়ে পড়ে ছুটে গেল বাঁধাই। মরা পাখির মত ঘুরতে ঘুরতে মেঝেতে পড়ল পাতাগুলো। চিৎকার করে বলল জমির, ‘ওই কুকুরের বাচ্চার কল্লা চাই!’

‘কী হয়েছে?’ জানতে চাইল ভাদিম।

‘আবার কী, খুন করেছে আমার বিশ্বস্ত তিন লোককে!’ গর্জন ছাড়ল জমির। আঠারো শতকের দামি আপহোলস্টার্ড চেয়ার তুলে মেঝেতে আছাড় দিল সে। চুরমার হলো দুর্মূল্য জিনিসটা। নানাদিকে ছড়িয়ে পড়েছে কাঠের টুকরো। ‘কুত্তীর বাচ্চা! শুয়োরের বাচ্চা! ওকে দেখে নেব আমি!’

মুখ অন্যদিকে ঘোরাল ভাদিম। ভাল করেই জানে, জমির রেগে গেলে প্রশ্ন করতে হয় না। কমপিউটারে মন দিল সে। সহজেই পেল আখেনাতেন প্রজেক্টের ফাইল। জ্বলজ্বল করে উঠল ওর দুই চোখ। ক্লিক দিয়ে খুলতে চাইল ফাইল। কয়েক সেকেণ্ড পর মুখ তুলে তাকাল। ‘ফাইল তো এনক্রিপ করা।’

‘সেটা জানি,’ কর্কশ স্বরে বলল জমির। ‘তুমি শালা আমাকে চুতিয়া ভেবেছ?’

আবারও স্ক্রিনের দিকে তাকাল ভাদিম। টের পেল, ঘাড় বেয়ে গড়াচ্ছে গরম ঘাম। দুর্বল কণ্ঠে বলল ভাদিম, ‘আমি কমপিউটার ভাল বুঝি না। এটাও জানি না কীভাবে খুলতে হয় এনক্রিপ করা ফাইল।’

প্রচণ্ড রাগে দাঁতে দাঁত পিষে ভাদিমের সামনে পৌঁছে গেল জমির। ‘তুই কোত্থেকে কীভাবে ফাইল খুলবি, সেটা তোর ব্যাপার! বুদ্ধি বের কর! শুনতে পেয়েছিস, নইলে মরবি তুই!’

দ্রুত ভাবছে ভাদিম। মনে করতে চাইছে এমন লোকের কথা, যে বা যারা এ ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারবে।

আবিদ আলী, ভাবল সে।

হ্যাঁ, আবিদ কমপিউটারে দক্ষ!

কথাটা ভাবতে না ভাবতেই মনে পড়ল অতীত। ফুৎ করে নিভে গেল আশার আলো। আবিদ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না। সে ব্যর্থ হলে গুলি করে তাকে মেরে ফেলবে জমির। বা আরও ভয়ঙ্কর কোনও ভাবে খুন করবে। এ পরিস্থিতিতে কারও সাহায্য নেয়া মানেই তাকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়া। আবদুল হাসানের কথা মনে আছে ভাদিমের। যখন তখন মনের ভেতর ভেসে ওঠে তার লাশের ছবিটা। রাতের পর রাত ধরে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে।

না, যা করার করতে হবে ওকে একা।

অসহায় চোখে জমিরের দিকে তাকাল ভাদিম। ‘পাসওঅর্ড তো হতে পারে যে-কোনও কিছু।’

‘তা হলে যে-কোনও কিছু দিয়েই ফাইল খুলে দিবি, ‘ বাচ্চাদের মত জেদি সুরে বলল জমির। ‘কাজ শুরু কর!’

বাইশ

সায়া বারোটা।

মিশর থেকে ফ্রান্সের নরম্যাণ্ডি অনেক দূরে। দীর্ঘযাত্রা শেষে একটু আগে এয়ারপোর্টে নেমেছে মাসুদ রানা। কাগজপত্র দেখিয়ে বাইরে এসে ট্যাক্সি নিয়েছে। বেশিক্ষণ লাগল না রানা এজেন্সির অফিসের সামনে পৌঁছুতে। পূর্ণিমার চাঁদের দুধসাদা আলোর বন্যা চলছে চারপাশে। ট্যাক্সি ড্রাইভারের হাতে ভাড়া ও টিপ্‌স্‌ দিয়ে বাড়ির মেইন গেট খুলল রানা। তালা দেয়া ভেতরের কলাপসিবল গেট খুলে দোতলার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতে নিল বড়জোর তিন মিনিট।

ওদের অফিস শহরের একপ্রান্তে। জায়গাটা প্রায় গ্রামের মতই। সামনে সবুজ ঘাসের বিশাল মাঠ। পাশে ঘন জঙ্গল। ওখানে হুক্কা-হুয়া আওয়াজে সঙ্গত জুড়েছে কয়েকটা শেয়াল।

স্নানের জন্যে বাথরুমে ঢুকল রানা। আয়নায় চোখ যেতেই দেখল, খুব করুণ চেহারার এক যুবক দেখছে ওকে। মনে হচ্ছে সিগারেটের আগুনে পুড়ে কাঁথায় দুটো ফুটো তৈরি হলে যেমন দেখায়, এই লোকটার চোখদুটোও ঠিক তেমনই!

আয়নাটা প্রথম সুযোগেই ভেঙে ফেলতে হবে, পোশাক ছাড়তে ছাড়তে আনমনে ভাবল রানা।

পনেরো মিনিট পর বাথরোব পরে ঢুকল কিচেনে। রুচি হলো না ক্যানের খাবার মাইক্রোআভেনে গরম করতে। তা ছাড়া, বিমানে যৎসামান্য খেয়েছে। সোজা বেডরুমে ঢুকল রানা। দু’দিনেরও বেশি ঘুমাতে পারেনি। প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল নরম বিছানায়। দু’মিনিট পেরোবার আগেই তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

‘গত দু’দিন ধরে আপনাকে ফোনে খুঁজছে এক মেয়ে,’ বলল নীলা দত্ত।

সকাল সাড়ে দশটা। একটু আগে নিজের অফিসে এসে বসেছে রানা। দু’বার মাত্র চুমুক দিয়েছে নীলার তৈরি করে দেয়া কফিতে। এক মেয়ে ওকে খুঁজছে শুনে ধক্ করে উঠেছে ওর অন্তর।

লিণ্ডা ব্রাউন নয় তো? আবারও কোন্ প্যাচে পড়বে, কে জানে!

‘গতকাল দুপুরে তিনবার ফোন করেছে,’ আরও তথ্য জোগান দিল নীলা। ‘নাম বলেছে লিণ্ডা। কথার সুর শুনে মনে হলো সে অস্ট্রেলিয়ান।’

কফিতে চুমুক দিতে গিয়েও মগ নামিয়ে রাখল রানা। ‘কী চায় সে-ব্যাপারে কিছু বলেছে?’

‘না। তবে আপনার সঙ্গে নাকি কথা আছে।’

দুনিয়ার কিছুই প্রায় ভয় পায় না রানা। তবে গলার ভেতরটা শুকিয়ে গেল ওর। দুশ্চিন্তা এল মনে: মেয়েটা বোধহয় নষ্ট করে ছাড়বে ওর সঙ্গে কর্নেল ব্রাউনের সুসম্পর্ক!

‘আবারও ফোন দিলে বলে দিয়ো আমি অফিসে নেই, ‘ বলল রানা। নীলা বিদায় হতেই ডেস্ক থেকে নিয়ে মনোযোগ দিল খবরের কাগজে।

বহু দিন ধরেই আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট নানান ধরনের হুমকি দিচ্ছেন অন্যান্য দেশের প্রায় সব প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীকে। তাঁর কথামত না চললে নাকি অর্থনৈতিক ক্ষতি করবেন। তবে গত কয়েক দিনের খবরের কাগজে এসেছে, চিনের বড় এক মোবাইল ফোন কোম্পানি আবিষ্কার করেছে ফাইভ জি টেকনোলজি। তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। ওই চিনা কোম্পানির কর্মকর্তাদেরকে জেল-জরিমানা করে ছাড়বেন। তবে এখন দেখা যাচ্ছে নিজেদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে তুলে নিয়েছেন সেই নিষেধাজ্ঞা। আসলে উপায় কী তাঁর? চিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গো-হারা হারছে আমেরিকার বিশাল ব্যবসায়িক সব সংগঠন। তবুও তো পকেটে আসছে কোটি কোটি ডলারের মুনাফা। সেটা বন্ধ হলেই আমেরিকার অর্থনীতির সর্বনাশ। কাজেই আমেরিকার ব্যবসায়ীরা চাপ দিয়েছে গোঁয়ার প্রেসিডেন্টকে। তাদেরকে খেপিয়ে দিলে প্রেসিডেন্ট নিজেই আর পায়ের নিচে মাটি পাবেন না।

অন্য একটা খবরের ওপর চোখ গেল রানার। ইন্টারপোল থেকে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। নামগুলো পড়ল রানা। তাদের ভেতর রয়েছে বাঙালি জাতির কলঙ্ক দুই টেরোরিস্ট। রানা ভাবল: সোয়া দু’ শ’ বছর ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসন ও শোষণে প্রায় ভেঙে যাওয়া কোমর মাত্র সোজা করতে শুরু করেছে ওরা, এমন সময়ে দেশের সর্বনাশ করতে উঠে পড়ে লেগেছে একদল সন্ত্রাসী দেশদ্রোহী। এখনই কঠোর ভাবে এদেরকে দমন করতে না পারলে আফগানিস্তানের মত আবারও মুখ থুবড়ে পড়বে বাংলাদেশ। খবরটা সবিস্তারে পড়তে শুরু করেছে রানা, এমন সময় বেজে উঠল ইন্টারকম।

রানা রিসিভার কানে ঠেকাতেই নীলা বলল, ‘আপনাকে ফোনে চাইছে এক মেয়ে।’

কফিতে চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, ‘নাম কী তার?’

‘লিসা স্মিথ।’

‘এই নামে তো কাউকে চিনি বলে মনে হচ্ছে না,’ বলল রানা।

‘আপনি নাকি তাকে চেনেন।’

‘ঠিক আছে, লাইন দাও, ধরছি।’ ইন্টারকমের রিসিভার রেখে বামপাশের ল্যাণ্ড ফোনের রিসিভার কানে ঠেকাল রানা। খুট্ করে একটা আওয়াজ পেল। সংযোগ দিয়েছে নীলা। ‘মাসুদ রানা বলছি।’

‘আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কিছু কথা ছিল,’ ওপ্রান্ত থেকে বলল মেয়েটা।

‘আমি তো আপনাকে চিনি না,’ বলল রানা। কেন যেন খুব পরিচিত মনে হলো মেয়েটার কণ্ঠস্বর।

‘আমাকে ঠিকই চেনেন,’ বলল মেয়োটা। ‘মনে নেই। আর নামটাও আগে কখনও শোনেননি।’

‘কী বলার, দয়া করে সংক্ষেপে বলুন,’ বলল রানা। ‘আমাকে দেখলে চিনতেন। সেসময়ে নিজের নাম বলেছি অ্যানি রবার্ট।’

ইতালির স্যান রেমোর সৈকতে হাইজ্যাকাররা হামলা করেছিল মেয়েটার ওপর। কণ্ঠস্বর এখন পরিষ্কার মনে পড়ছে রানার। মেয়েটার হোটেলে দ্বিতীয়বার গিয়ে বোকা বনতে হয়েছে ওকে। সতর্ক হয়ে উঠল রানা। ওকে কেন খুঁজছে এই মেয়ে?

‘কী বলবে বলো, আমি শুনছি।’

‘আমাদের দু’জনের দেখা হলে ভাল হতো, মিস্টার রানা, বলল লিসা স্মিথ। ‘জরুরি কিছু বিষয় আপনাকে জানাব।’

চুপ করে থাকল রানা।

‘জানি, আপনি খুব বিস্মিত,’ বলল মেয়েটা। ‘তবে নিশ্চিত থাকুন, আপনার সময় আমি একটুও নষ্ট করছি না।’

‘তুমি অ্যানি হও বা লিসা, আসলে কী চাও?’ জানতে চাইল রানা।

‘অ্যানি রবার্টস নামে কেউ নেই।’

‘তা হলে ধরে নিচ্ছি, স্যান রেমোর সৈকতে ফাঁদ পেতে আমার কাছ থেকে কিছু আদায় করতে চেয়েছ। কথাটা কি ঠিক?’

‘সামনা-সামনি আলাপ করতে চাই, মিস্টার রানা।’

‘আমি হয়তো মিথ্যুক কোনও মেয়ের কথা শুনতে চাইব না।’

‘বিষয়টা আসলে খুব জটিল। মুখোমুখি বসে সব খুলে বলব।’

‘তা হলে স্যান রেমো ছেড়ে চলে এসো এখানে,’ বলল রানা। ‘ফোন যখন করেছ; কোথায় আসতে হবে সেটাও নিশ্চয়ই জানো।’

‘মিস্টার রানা, আমরা এখন ইতালিতে নেই। আপাতত আছি প্যারিসে।’

‘প্যারিসে কেন?’

‘জরুরি কাজে।’

‘আমরা বললে, তারা আবার কারা?’

‘আমার সহযোগীরা। তাদেরকে আপনি চেনেন। দেখা হয়েছে। একজনের ঘাড়ে এখনও নেক ব্রেস। আপনিই লাথি মেরে ওর ওই হাল করেছেন।’

‘আমার উচিত ছিল ওর মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া, রেগে গেছে রানা। ‘আবার দেখা হলে তা-ই করব।’

‘আমাদের সব কথা শোনার পর আর এসব বলতে পারবেন না, মিস্টার রানা,’ দুঃখিত সুরে বলল মেয়েটা। ‘দয়া করে একবার আসুন প্যারিসে। কথা দিচ্ছি, পস্তাতে হবে না আপনাকে।

মুহূর্তের জন্যে দ্বিধায় পড়ল রানা। তারপর বলল, ‘আগেও আমাকে ফাঁদে ফেলেছ। এবার আবার কী করতে চাও?’

‘সরি, মিস্টার রানা। আমার আসলে উপায় ছিল না।’

‘আমার উপায় আছে,’ বলল রানা। ‘খামোকা সময় নষ্ট করছি।’ ক্রেডলে রিসিভার নামিয়ে রাখল ও। মেজাজটা খাট্টা হয়ে গেছে। দুই চুমুকে ঠাণ্ডা কফি শেষ করে চেয়ার ছেড়ে পায়চারি শুরু করল অফিসের ভেতর। একটু পর খচ- খচ করতে লাগল মন। জেনে নেয়া উচিত কী বলতে চায় মেয়েটা।

আবারও নিজের সিটে গিয়ে বসল রানা। ওদের এজেন্সির ল্যাণ্ড ফোনে রেকর্ড থাকে আগের পঁচিশটা ফোন নাম্বার।

শেষ নাম্বারে ডায়াল করল রানা।

প্রথমবার রিং হতেই ওদিক থেকে তুলল মেয়েটা। ‘জানতাম, আপনি কল দেবেন।’

লিসা স্মিথের কণ্ঠে স্বস্তি ও বিজয়ের আনন্দ। সামান্য ব্রিত হয়ে বলল রানা, ‘ঠিক আছে, শুনছি।’

‘কত দ্রুত প্যারিসে আসতে পারবেন, মিস্টার রানা? ব্যাপারটা খুবই জরুরি।’

হাতঘড়ির দিকে তাকাল রানা। বাজে বারোটা। ‘বিকেল চারটেয় পৌঁছে যাব।’

‘শুনেছি মোবাইল ফোনে অপরিচিত কারও কল রিসিভ করেন না। তাই আপনার অফিসে ফোন দিয়েছি। আপনি প্যারিসে পৌঁছুলে আপনার মোবাইল ফোনে জানিয়ে দেব কোন্ ঠিকানায় আসতে হবে।’

রানার মনে প্রশ্ন জাগল: ও মোবাইল ফোনে অপরিচিত কারও সঙ্গে কথা বলে না, সেটা কার কাছ থেকে জানল এই মেয়ে?

‘ঠিক আছে,’ বলে কল কেটে দিল রানা। ইন্টারকমে নীলাকে বলল, আজ আর সবার সঙ্গে বসে লাঞ্চ করবে না। ওকে যেতে হচ্ছে প্যারিসে।

ছোট্ট চাকরি জীবনে প্রথমবারের মত নাক গলাল নীলা। একসঙ্গে মাত্র ক’দিন কাজ করেই বুঝেছে, মাসুদ রানা এমনই এক মানুষ, যিনি কখনও অন্যায় বরদাস্ত করেন না। তাঁর ওপর নিশ্চিন্তে চাপিয়ে দেয়া যায় নিজের দায়। চিন্তিত কণ্ঠে বলল নীলা, ‘মাসুদ ভাই, এই তো গতকাল ফিরলেন। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুবই ক্লান্ত। আজই আবার ছুটতে হবে কেন অত দূরে?’

‘দেখি মেয়েটা কী বলে,’ বলল রানা। ‘ভেবো না, আমি সতর্ক থাকব।’

চুপ হয়ে গেল নীলা।

ইন্টারকম রেখে অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা ওপরের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরল রানা। একরাতের জন্যে কোথাও থাকতে হলে যা যা লাগবে, সেগুলো গুছিয়ে রাখা থাকে একটা ব্যাগে। ওয়ার্ডোব থেকে ওটা বের করে রাখল • বিছানার ওপর। খাটের নিচে কার্পেটের তলে ছোট্ট একটা সুইচ আছে। ওটার ওপর পায়ের মাঝারি চাপ দিল। ফলে মোনালিসার ছবি সহ ঘড়-ঘড় শব্দে তিন ফুট সরল ঘরের ডানদিকের দেয়াল। পেছনে আছে আরেকটা কংক্রিটের দেয়াল। সেটার মাঝে গেঁথে আছে ভারী একটা স্টিলের সেফ। কি-প্যাডে রানা গোপন সংখ্যা দেয়ায় একপাশে সরল ভারী ডালা। সিন্দুকের ভেতরে কয়েকটা পিস্তল ও সাবমেশিন গান। আরেক দিকে থরে থরে কয়েক দেশের ব্যাঙ্ক নোট। পাশেই জরুরি কাগজপত্র। ওর ওয়ালথার পি. পি. পিস্তল, দুটো ম্যাগাযিন ও এক বাক্স .৩৮ গুলি বের করে টেবিলে রাখল রানা। লিসা স্মিথের সঙ্গে কথা শেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এরা যেহেতু বলছে না তারা কারা বা কী চায়, সুতরাং ওর উচিত সশস্ত্র অবস্থায় যাওয়া। বারবার মনে ঘুরছে কিছু প্রশ্ন: কী চায় এই মেয়ে? মডাক ব্রাউনের রিসার্চের সঙ্গে সম্পর্ক আছে তার? এসবে জড়িত জমির শেখ?

কেন যেন তেমনটা বলে মনে হচ্ছে না ওর।

অন্য কোনও কারণে দেখা করতে চাইছে।

দুই ম্যাগাযিনে বুলেট ভরল রানা। একটা ম্যাগাযিন গেল ওয়ালথারের বাঁটের ভেতর। অন্যটা রাখল জিন্সের প্যান্টের পিছনপকেটে। বাম হাতে থাকল ওয়ালথার ও গুলির বাক্স।

সেফের ডালা বন্ধ করে কি-প্যাডে আরেক সারি নম্বর দেয়ায় আবারও ঘড়-ঘড় আওয়াজে সিন্দুকের সামনে ফিরল দেয়াল। বিছানা থেকে ব্যাগ নিয়ে কাঁধে ঝোলাল রানা। অ্যাপার্টমেন্টের দরজা লক করে নেমে এল নিচতলায়।

একপাশে গ্যারাজ। ওটার দরজা খুলতেই নীল রঙের মিনি কুপারের নাকে পড়ল কড়া রোদ। গাড়ির ভেতর ব্যাগ রেখে ড্রাইভিং সিটে চেপে বসল রানা। গ্লাভ্স্ কম্পার্টমেন্টে গেল পিস্তল ও অ্যামিউনিশন। মিনি কুপারের ইঞ্জিন চালু করে বেরিয়ে এল নরম্যাণ্ডির কালো সড়কে।

একবার হাতঘড়ি দেখল।

সোয়া বারোটা বাজে।

দ্রুত না গেলেও চারটের আগেই পৌঁছে যাবে প্যারিসে।

তেইশ

বিকেল সোয়া তিনটে। প্যারিসের আউটার রিং রোড ধরে স্লথ গতি তুলে অসংখ্য গাড়ির সঙ্গে এগিয়ে চলেছে মাসুদ রানা। আজকাল জ্যামের কারণে গাড়ি নিয়ে প্যারিসে প্রবেশ ও বেরিয়ে আসা হয়ে দাঁড়িয়েছে বড় ধরনের ঝামেলা। তার ওপর মিনি কুপার পড়েছে সিগনালে। এই সুযোগে মুখস্থ করা নাম্বারে লিসা স্মিথকে ফোন দিল রানা। মেয়েটা জানিয়ে দিল শহরতলী এলাকায় কোথায় দেখা করতে হবে। জায়গাটা ভাল করেই চেনে রানা।

‘ছয়টায় পৌছে যাবেন,’ বলেছে লিসা স্মিথ। ‘আমরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করব।’

অন্তত আরও আড়াই ঘণ্টা পর মেয়েটার সঙ্গে দেখা হবে। শহরের পুবদিকে চলল রানা। কিছুক্ষণ পর পৌঁছুল বুলেভার্ড হৌসম্যান-এ। ডানে বাঁক নিয়ে চলে এল বুলেভার্ড দে ইতালিয়েন-এ। ওখানে আছে ওর একটা সেফহাউস। শহরের কেন্দ্রে হলেও নির্জন গলির ভেতর। সাদামাটা করে সাজানো ওই ফ্ল্যাটে আগেও ক’বার থেকেছে রানা। ভবনের নিচে আণ্ডারগ্রাউণ্ড পার্কিং লট। পেছনে সরু সিঁড়িটা অব্যবহৃত। তিনতলায় ফ্ল্যাটে ঢোকার সাধারণ দরজা। তবে ওটা খুললেই সামনে পড়বে কি-প্যাড সহ আর্মার্ড সিকিউরিটি ডোর। গ্রেনেড মেরেও উড়িয়ে দেয়া যাবে না।

ফ্ল্যাটে ঢুকে বেশ শীত শীত লাগল রানার। আসবাবপত্রের ওপর হালকা ধুলোর আস্তরণ। হিটিং সিস্টেম চালু করে বেডরুম ও ডাইনিং রুম ঝেড়ে-ঝুড়ে পরিষ্কার করল পরের কয়েক মিনিট। ভাবছে, আজ রাতটা কাটাবে এই ফ্ল্যাটেই। সন্ধ্যায় গিয়ে জেনে নেবে লিসা স্মিথের বক্তব্য, তারপর আগামীকাল ফিরবে নরম্যাণ্ডির রানা এজেন্সিতে।

কিচেনের কাবার্ডে টিনের কয়েক কৌটা খাবার ও এক প্যাকেট লাভায্যা গ্রাউণ্ড কফি পেল রানা। এ ছাড়া রয়েছে তিন বোতল টেবিল রেড ওয়াইন। মাস কয়েক আগে একটু দূরের এক দোকান থেকে ওগুলো কিনেছে ও। প্যাকেট খুলে পাঁচ মিনিটের ভেতর তৈরি করে ফেলল কফি। কড়া, কালো তরল শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল সোফায় বসে। তারপর হাতঘড়ি দেখে নিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে এল।

লিসা স্মিথের দেয়া ঠিকানায় পৌছে একটু বিস্মিত হলো রানা। ওটা সরু এক গলির শেষে ছোট একতলা বাড়ি। চারপাশের বাড়িগুলোতে টেরেস থাক লেও এটায় নেই। গলির মুখে পরিত্যক্ত ফিলিং স্টেশন। বাতাসে ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজে নড়ছে জংধরা এসো সাইন। গলির ভেতর গাড়ি ঢুকিয়ে রানা বুঝে গেল, আশপাশের কোনও বাড়িতেই বাসিন্দা নেই। বোর্ডে পেরেক মেরে বন্ধ করা সব জানালা ও দরজা।

আকাশ ধূসর। যে-কোনও সময়ে নামবে বৃষ্টি। বাড়ি থেকে তিরিশ গজ দূরে গাড়ি থামাল রানা। গ্লাভ্স্ কম্পার্টমেন্ট থেকে ওয়ালথারটা নিয়ে স্লাইড টেনে চেম্বারে বুলেট পাঠাল। অফ করে নিল সেফটি ক্যাচ। পেটের কাছে বেল্টের পেছনে গুঁজল পিস্তল। থাবা দিলেই পাবে ওটা। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই টাস্-টাস্ আওয়াজে কয়েকটা বৃষ্টির বড় ফোঁটা পড়ল ওর মুখে-মাথায়।

বামের শেষ বাড়ির দরজায় থেমে টোকা দিল রানা। পেরোল কয়েক মুহূর্ত, তারপর ভেতর থেকে এল পদশব্দ। ক্যাচ-কোঁচ আওয়াজে খুলল কবাট। লোকটাকে চট্ করে চিনল রানা। সেদিন স্যান রেমোর সৈকতে যে দু’জনকে দেখেছে, তাদের ভেতর হালকা লোকটা। দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল।

‘এই ক’দিনে নতুন কোনও হ্যাণ্ডব্যাগ জুটল না?’ জানতে চাইল রানা।

কোনও কথা না বলে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল লোকটা।

‘পথ দেখাও,’ বলল রানা। লোকটা ঘুরে অন্দরমহলের দিকে পা বাড়াতেই হলওয়েতে ঢুকল ও। পেছনে আটকে গেল দরজা। বাড়ির ভেতরের অংশ বাইরের চেয়ে ভাল। তবে দেয়াল থেকে ছিঁড়ে নামিয়ে ফেলা হয়েছে ওয়ালপেপার। মেঝেতে জীর্ণ কার্পেট।

দুটো ঘর পেরোবার পর ‘আসুন,’ বলে তৃতীয় ঘরে ঢুকল লোকটা।

দরজার কাছে থেমে ভেতরটা দেখল রানা। ঘরটা কোনও অপারেশন্স রুম বলে মনে হলো ওর। খুব কম বাজেটে এখানে কাজ করছে ছোট কোনও দল। ঘরের কোণে পুরনো তিনটে আর্মচেয়ার ও একটি ডেস্ক। ওগুলো বোধহয় কেনা হয়েছে স্যালভেজ ইয়ার্ড থেকে। ডেস্কের ওপর ছড়িয়ে আছে অসংখ্য কাগজ, কয়েকটা ফোন আর একটা খর-খর আওয়াজ তোলা নোটবুক কমপিউটার। একপাশে কয়েকটা ক্যামেরা। একটার লেন্স কামানের মত লম্বা। মেঝেতে খোলা কয়েকটা অ্যালিউমিনিয়াম কেসের ভেতর অডিয়ো সার্ভেইলেন্স ইকুইপমেন্ট। ঘরের মাঝে কয়েকটা বিয়ারের খালি কৌটার ওপর ফরমিকা স্ল্যাব রেখে তৈরি করা হয়েছে নিচু টেবিল। ওটার ওপর প্লাস্টিকের কাপ ও ফাস্ট ফুডের অবশিষ্ট। ঘরের ভেতর ইন্সট্যান্ট কফি, ঘর্মাক্ত দেহ আর ভেজা কার্পেটের বোটকা দুর্গন্ধ। একমাত্র জানালাটা বন্ধ। টেনে রাখা হয়েছে ভারী পর্দা। রানার মনে হলো, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ডাকাতদল ধরতে গিয়ে যেসব পুরনো বাড়িতে আস্তানা গাড়ে পুলিশের সদস্যরা, এই বাড়ির পরিবেশটা তার ঠিক দ্বিগুণ বিষণ্ন।

এরা এখনও নিজেদের পরিচয় দেয়নি। একটা আর্মচেয়ারে বসে আছে এক লোক। আগেও তাকে দেখেছে ও। লম্বা-চওড়া শরীর, পুরুষ্টু কাঁধ। দুই হাত বুকের ওপর ভাঁজ করা। ঘাড়ে ফোমের তৈরি নেক ব্রেস। আড়ষ্ট ঘাড় ঘুরিয়ে রানাকে দেখতে গিয়ে খচ্ করে ব্যথা পেয়ে গাল কুঁচকে ফেলল সে। চোখে রীতিমত অভিমান।

জানালার দিকে পিঠ রেখে দাঁড়াল হালকা শরীরের লোকটা।

সতর্ক পায়ে ঘরে ঢুকল রানা। ‘লিসা স্মিথ কোথায়?’

‘এই যে এখানে,’ একপাশের ছোট কিচেন থেকে এল পরিচিত কণ্ঠ।

ওদিকে তাকাল রানা। ‘আবারও দেখা হলো।

‘আমাদের উপায় ছিল না,’ বলল মেয়েটা। এখন দুটো বেণী করেছে। সৈকতের সেই অসহায় ভাব বিদায় নিয়েছে ফ্যাকাসে চেহারা থেকে। পরনে জিন্স প্যান্ট, শার্ট আর নীল রঙের জাম্পার। রানার মনে হলো, এই পোশাকেই মেয়েটা কাটিয়ে দিয়েছে দু’তিন দিন। ‘এসেছেন বলে অনেক ধন্যবাদ। আমি কি আপনাকে কফি দেব?’

‘কেন দেখা করতে চাও, সেটাই বরং বলো,’ জানাল রানা।

মৃদু মাথা দোলাল লিসা স্মিথ। ‘বেশ। আপনি ব্যাখ্যা চাইতেই পারেন। একেবারে প্রথম থেকে সব বলছি। তবে, তার আগে পরিচয় করিয়ে দিই আমার কলিগদের সঙ্গে।’ চেয়ারে বসা বিশালদেহীর দিকে আঙুল তাক করল সে। ‘ওর নাম রাফায়েল ফক্স।’

খুব সাবধানে মাথা দোলাল লোকটা।

‘ঘাড়ে এত ব্যথা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হ্যাণ্ডশেক করতে হবে না,’ বলল রানা।

‘আর ও জ্যাক রনসন,’ জানালার কাছে চিকন লোকটাকে দেখাল লিসা স্মিথ। ‘আমরা আসলে আপনার সাহায্যপ্রার্থী। খুব খুশি হয়েছি যে আপনি এসেছেন। …বসুন? আমাদের কথা শেষ হতে বেশ সময় লাগবে।’

একটু দূরের আর্মচেয়ারে গিয়ে বসল রানা। সামনে বাড়িয়ে রেখেছে দুই পা। বুকের ওপর ভাঁজ করেছে দু’হাত। ‘শুরু করো। আশা করি এত দূর থেকে খামোকা ডেকে আনোনি।’

মাথা দোলাল লিসা স্মিথ। ‘কথাগুলো আপনার ভাল লাগবে না, ‘সেটা আগেই বলে নিচ্ছি। বড় ধরনের ধাক্কা খাবেন।’

‘ধাক্কার জন্যে আমি তৈরি।’

ডেস্কের কাছে চলে গেল মেয়েটা। কাগজের নিচু একটা স্তূপ থেকে নিল বাদামি এ ফোর সাইযের একটা এনভেলপ। ওটার ভেতর থেকে বের করল বড় একটা ছবি। ওটার দিকে না চেয়ে বাড়িয়ে দিল রানার দিকে।

চকচকে ছবিটা দেখল সতর্ক রানা। দৃশ্যটা ভয়ানক। ফোটোতে দেখা যাচ্ছে এক মেয়েকে। অবশ্য তাকে যদি আর মেয়ে বলা যায়। তার লাশের অবস্থা মর্ডাক ব্রাউনেরটার চেয়েও বেশি করুণ। ক্ষত-বিক্ষত, নগ্ন। কমবাইন হার্ভেস্টারের ভেতর পড়লে এমন হবে যে-কেউ।

‘আপনি দেখছেন র‍্যাচেল হার্টকে, বলল লিসা স্মিথ। ‘আমাদের দলের চতুর্থ সদস্য।’ মস্ত ঢোক গিলল সে। ‘আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল।’

ছবিটা লিসার হাতে ফেরত দিল রানা। মেয়েটার চোখে গভীর বিষণ্ণতা, চাপা রাগ ও ভয়।

পরবর্তী তথ্যের জন্যে চুপ করে অপেক্ষা করছে রানা। ‘আপনি হয়তো ভাবছেন র‍্যাচেলের এই হাল কে করল, বলল লিসা। ‘এ কথা জানাব বলেই এখানে ডেকেছি আপনাকে।’

‘বলে ফেলো,’ বলল রানা।

ছবির ওপর টোকা দিল লিসা। ‘যে-লোক ওকে এভাবে খুন করেছে, তার নাম গ্যারি স্যাণ্ডার্স। আমরা জানি না সত্যিকারের নাম কি না। অতীতে কী করেছে, সেটাও অস্পষ্ট। পুলিশের কাছে কোনও রেকর্ড নেই। তবে এটা আমরা জানি, কার হয়ে কাজ করে ও। সেই লোকের নির্দেশেই র‍্যাচেলকে হত্যা করেছে ও।’ আর যাতে ক্ষত-বিক্ষত লাশের ছবি দেখতে না হয়, তাই ডেস্কের ওপর উল্টো করে রাখল লিসা। চোয়াল দৃঢ় হয়েছে তার। চাপা স্বরে বলল, ‘গ্যারি স্যাণ্ডার্স কাজ করে কর্নেল (অব.) জন ব্রাউনের হয়ে।’

নীলাকাশ থেকে মাথার ওপর বাজ পড়লেও এত বিস্মিত হতো না রানা। বেশ কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল মেয়েটার চোখে। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘এ ধরনের গুরুতর অভিযোগ আনার আগে তোমাদেরকে জানাতে হবে, তোমরা কারা। কী চাও তোমরা? এসব কেন বলছ আমাকে?’

‘সবই খুলে বলছি,’ বলল লিসা স্মিথ। ‘তার আগে ছবিটা দেখিয়ে নিলাম। যাতে বুঝতে পারেন কী ধরনের মানুষ জন ব্রাউন। শুরু করার আগে কয়েক ধাপ পিছিয়ে যাব।’

শীতল চোখে মেয়েটাকে দেখছে রানা।

চুপ করে আছে রাফায়েল ফক্স ও জ্যাক রনসন।

তাদের দিকে আঙুল তাক করল লিসা স্মিথ। ‘মাত্র পাঁচ সপ্তাহ আগেও আমরা ছিলাম ইন্টারপোলের স্পেশাল এজেন্ট।’

চুপচাপ মেয়েটাকে দেখছে রানা।

‘আপনার বোধহয় বিশ্বাস হচ্ছে না?’

‘যে-কোনও সময়ে চেক করতে পারব,’ বলল রানা। ‘ইন্টারপোলে আমার পরিচিত ক’জন অফিসার আছে।’

‘তা আমরা জানি,’ বলল লিসা স্মিথ। ‘ইচ্ছে হলে চেক করবেন। অথবা জিজ্ঞেস করতে পারেন কাদের সঙ্গে কাজ করি। সেকশন চিফদের নাম, বা আমাদের ডিপার্টমেন্ট— সবই জানাতে পারব। লিয়নের জেনারেল সেক্রেটারিয়েটের টয়লেটের টাইল্স্ কী রঙের, জিজ্ঞেস করলে তা-ও জানাতে আপত্তি করব না।’

পরে কয়েক জায়গায় ফোন দেব, বলল রানা। ‘আপাতত ধরে নাও, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করেছি। যদিও বুঝতে পারছি না আমাকে কেন এসব বলা হচ্ছে।’

‘আমরা চাই, আপনি যেন জানেন, জন ব্রাউনকে যা ভেবেছেন, সেটা একদম ভুল। ভয়ঙ্কর সত্যটা যেন বুঝতে পারেন।’ চুপ হয়ে গেল লিসা স্মিথ। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘খুলে বলছি, জন ব্রাউন আসলে কী ধরনের মানুষ। সে একজন আর্মস্ চোরাচালানী। গত দশ বছর ধরেই এ কাজ করছে। অস্ত্র বিক্রি করে টেরোরিস্ট বা গণহত্যাকারীদের কাছে। গোটা দুনিয়ার যে-কোনও জায়গায় পৌঁছে দেয় অস্ত্রের চালান। তার দেয়া অস্ত্র ব্যবহার করে বেশ কয়েকটা দেশে নতুন করে বেড়ে গেছে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা। এটা হয়েছে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়ার মিডল ইস্টে। খুব চতুর, সতর্ক এক নির্মম অপরাধী সে। চলার পথে কাউকে বাধা ভাবলে দেরি করে না খুন করতে। আমরা তিনজন প্যারিসে এসেছি, কারণ আগামীকাল বিকেলে জর্জ ফাইভ হোটেলে আফ্রিকার এক ওঅরলর্ডের সঙ্গে অস্ত্র চুক্তি করবে সে। এ সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি। আগামীকাল ছায়ার মত তাকে অনুসরণ করব আমরা।’

চুপ করে বসে আছে রানা।

ওকে দেখছে লিসা স্মিথ, রাফায়েল ফক্স ও জ্যাক রনসন।

কয়েক মুহূর্ত পর উঠে দাঁড়াল রানা। ‘আমার মনে হয় না তোমাদের হাতে কর্নেল জন ব্রাউনের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ আছে। এরই ভেতর যথেষ্ট মিথ্যা শুনেছি।’

‘দয়া করে বসুন, মিস্টার রানা,’ অনুরোধের সুরে বলল লিসা স্মিথ। ‘অন্তত শুনে যান আমাদের কথাগুলো।’

‘আরও সময় নষ্ট করতে চাই না,’ বলে দরজার দিকে পা বাড়াল রানা।

কিন্তু তখনই শুনল পরিচিত কণ্ঠস্বর। বরফের মূর্তির মত জমে গেল রানা।

‘লিসার কথাগুলো শুনে দেখো, রানা, ও কিন্তু মিথ্যা বলছে না।’

ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল বাকরুদ্ধ রানা।

চব্বিশ

কিচেনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে কর্নেল ব্রাউনের দ্বিতীয় স্ত্রী লিণ্ডা ব্রাউন। চিন্তিত ও উত্তেজিত। এমনিতেই গ্রিক দেবী ভেনাসের মত অপরূপা, তার ওপর পরনে কালো প্যান্ট, কালো টি-শার্ট ও কালো জ্যাকেট— আরও ফরসা ও সুন্দরী লাগছে ওকে।

‘তুমি এখানে কী করছ?’ বিস্ময় কাটিয়ে জানতে চাইল রানা।

‘আমি ওদের সঙ্গেই আছি,’ তিন এজেন্টকে দেখাল লিণ্ডা। ‘জন ব্রাউনের বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহের কাজে সাহায্য করছি। তার ধারণা, আমি রোমে গেছি অসুস্থ এক বান্ধবীকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে।’

ইয়টে সেই রাতের কথা মনে পড়ল রানার। ভাবল, ইন্টারপোলের এজেন্টদের কাছ থেকে কী জেনেছে লিণ্ডা? এজন্যেই কি স্বামীর প্রতি ওর আর কোনও ভক্তি-শ্রদ্ধা নেই? জিজ্ঞেস করল ও, ‘আগে থেকেই এদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তোমার?’

মৃদু নড করল লিণ্ডা। ‘জনের বিষয়ে একতিল মিথ্যা বলছে না ওরা। জনকে যা ভেবেছ, সবই মিথ্যা বা ভুল। অর্থ-পিশাচ বলো বা রক্ত-পিশাচ, দুটো বিশেষণই ওর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়।’

‘তার সম্পর্কে আরও অনেক কিছুই আপনি জানেন না, বলল লিসা স্মিথ। ‘আজ না হয় সামান্য সময় নষ্টই করলেন। দয়া করে বসুন। সবই খুলে বলছি।’

কীসের এক ঘোরের ভেতর আর্মচেয়ারে গিয়ে বসল রানা।

‘রেগেমেগে চলে গেলেন না, সেজন্যে ধন্যবাদ,’ বলল লিসা। ‘আমরা ভাল করেই জানি, এসব মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে আপনার।’

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে বলে কমে গেছে জানালার ওদিকের আলো। দেয়ালের বোর্ডে একটা সুইচ টিপল লিসা স্মিথ। ঘরের ছাত থেকে ঝুলন্ত তারের শেষমাথায় জ্বলে উঠল দুর্বল ওয়াটের হলদে বাতি। আরও আবছা দেখাল ঘরের আসবাবপত্র।

‘একটা কথার জবাব দাও,’ বলল রানা। ‘তোমরা জানো কী করেছেন জন ব্রাউন। সেক্ষেত্রে জেলে না থেকে তিনি মুক্ত কেন?’

‘আগেই বলেছি, অত্যন্ত চতুর এবং সতর্ক লোক সে,’ জবাবে বলল লিসা। ‘সবসময় আমাদের চেয়ে এক কদম আগে হাঁটছে। কেউ প্রমাণ করতে পারেনি যে সে অস্ত্র চোরাচালান করছে। ইয়ট চার্টারের ব্যবসার আড়ালে গোটা দুনিয়া জুড়ে নানান জায়গায় অস্ত্র সরবরাহ করে। রানা, আপনি কি জানেন, একেকটা সুপার ইয়টের হোল্ডে কী পরিমাণ অস্ত্র রাখা যায়?’

‘কয়েক শ’ টন,’ বলল রাফায়েল ফক্স।

সায় দিয়ে মাথা দোলাল তার সঙ্গী জ্যাক রনসন।

‘অনেক দিন ধরেই তাকে সন্দেহ করছে ইন্টারপোল,’ বলল লিসা। ‘বদমাশটা খেয়ে নিয়েছে আমার জীবনের দুটো বছর। অথচ, তার বিরুদ্ধে জোরালো কোনও প্রমাণ পাইনি। তার ওপর দেড় মাস আগে উচ্চপদস্থ অফিসাররা বলে দিলেন, বন্ধ করতে হবে তদন্ত। আমরা নিজেরাই নাকি বেশি বাড়াবাড়ি করছি। এরপর বেআইনী কিছু করে বসলে জেলে যাব।’ তিক্ত হাসল মেয়েটা। ‘জন ব্রাউনের এসএএস ট্রেনিং কাজে লেগেছে তার। ছায়ার মত গিয়ে অস্ত্র চালান দিয়ে ভূতের মত উধাও হয়। কারও জানার উপায় থাকে না, একদিন আগেও ওখানে ছিল সে। আপনিও তো প্রায় একই ট্রেনিং নিয়েছেন, মেজর রানা। ভাল করেই বুঝবেন কী বলতে চেয়েছি।’

‘প্রথম কথা, আমি এখন মেজর নই, কাজেই শুধু রানা বললেই চলবে,’ বলল রানা। ‘দ্বিতীয় কথা, আমার ধারণা, তোমাদের কাছে প্রমাণ বলতে কিছুই নেই। তৃতীয় পয়েন্ট, সাদা কাগজের মত যার রেকর্ড, সেই মানুষটার পেছনে কেন লাগল তিনজন প্রাক্তন এজেন্ট? অথচ তোমাদের সুপিরিয়র অফিসার আগেই কেসটা গুটিয়ে নিয়েছেন। আমার তো মনে হচ্ছে, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা কাজ করছে তোমাদের ভেতর।’

মাথা দোলাল লিসা স্মিথ। ‘কথাটা মিথ্যা নয়।’ ডেস্কে রাখা ছবিটার ওপর টোকা দিল। ‘একটু খুলে বলি র‍্যাচেল হার্ট সম্পর্কে। মাত্র চব্বিশ বছর বয়স। গত সোয়া তিন মাস আগে আমাদের সঙ্গে এই কেসে যোগ দেয়। টিমে রেখেছি, কারণ ও ছিল নানান ভাষায় পারদর্শী। নিখুঁত ভাবে বলতে পারত রাশান, স্প্যানিশ এবং কয়েকটি আফ্রিকান ভাষা। ভাল সার্ভেইলেন্স অপারেটিভ ছিল। লুকিয়ে চলে যেতে পারত দুর্গম এলাকায়।’ চুপ হয়ে গেল লিসা স্মিথ। দুঃখের কালো ছায়া পড়েছে চেহারায়। ‘দেড় মাস আগে র‍্যাচেল ছিল আলজেরিয়ায়। ওখান থেকে সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট পাঠাল আমার কাছে। শেষপর্যন্ত নাকি প্রমাণ জোগাড় করতে পেরেছে। এবার আর রক্ষে নেই জন ব্রাউনের।

‘কী ধরনের প্রমাণ?’ জানতে চাইল রানা।

‘সেটা আর জানতে পারিনি,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল লিসা। ‘আর ফিরতে পারেনি র‍্যাচেল। চারদিন পর উপকূলের এক শ’ মাইল দূরে পাওয়া গেল ওর লাশ। দেখলে মনে হবে হামলা করেছে কয়েকটা হাঙর। ছবিটা তো দেখেছেন।’

কেন ধরে নিলে যে হাঙরের আক্রমণে মারা যায়নি?’ বারকয়েক মাথা নাড়ল লিসা স্মিথ। ‘হিসেব মেলে না। সাক্ষীরা বলেছে, নিজ চোখে দেখেছে, যে রাতে হারিয়ে গেল র‍্যাচেল, সে রাতে একটা স্ট্রিপ জয়েন্টে মাতাল হয়ে নেচেছে দুই লোকের সঙ্গে। ওই ক্লাব থেকে মাত্র দেড় মাইল দূরেই পাওয়া যায় ওর লাশ। অফিশিয়াল রিপোর্টে পুলিশ লিখেছে, ওই দু’জনের সঙ্গে কোথাও রাত কাটাতে গিয়েছিল। কিন্তু তা হতে পারে না।’

‘কেন হতে পারে না?’ জানতে চাইল রানা। ‘যুবতী মেয়ে, সত্যিই হয়তো ফুর্তি করতে গেছিল।’

‘ওই ক্লাবে যদি গিয়েও থাকে র‍্যাচেল, দুই লোকের সঙ্গে ওর কোথাও যাওয়ার কথা নয়,’ বলল লিসা স্মিথ ‘ওই ধরনের মেয়ে ছিল না সে।’

‘তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে?’ জানতে চাইল রানা। সরাসরি ওর চোখে তাকাল লিসা। ‘আমরা জানতাম, আমাদের ওই বান্ধবী আসলে লেসবিয়ান। কোনও ভাবেই পুরুষমানুষের সঙ্গে ফুর্তি করতে কোথাও যাবে না র‍্যাচেল। ওকে খুন করেছে জন ব্রাউন। দুই সঙ্গীর ব্যাপারটা স্রেফ গুজব। যাতে নিজেকে আড়াল করতে পারে। আগেও এ ধরনের খুন করেছে সে। তবে এবার তাকে বাগে পাব আমরা।’

চুপ করে আছে রানা। ভাবছে, এরা আমাকে ডাকল কেন? এসবে আমার ভূমিকা কী হওয়া উচিত ভাবছে?

‘তাকে হাতের মুঠোয় পেতে হলে আপনার সাহায্য লাগবে,’ বলল রাফায়েল ফক্স। ‘ইন্টারপোলের সাহায্য পাব না। আসলে আমাদের চাই এমন একজনকে, যাকে কি না বিশ্বাস করে জন ব্রাউন।’

‘তোমরা কী করে ভাবলে, কোনও প্রমাণ ছাড়াই কর্নেলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব আমি?’ বিরক্ত হয়েছে রানা। তাকাল লিণ্ডার চোখে। ‘তুমিই বা কেন এদের কথায় নাচছ?’

তিক্ত হাসল লিণ্ডা। ‘ওদেরকে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে, রানা। প্রথম যখন দেখা হলো জনের সঙ্গে, অবাক হয়েছি ওর ভদ্রতাবোধ দেখে। কিন্তু বিয়ের পর বুঝলাম, সে ভীষণ শঠ ধরনের মানুষ। ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর দানব। এত অশুভ আর কাউকে দেখিনি। মানুষের সামনে ভাল আচরণ, আর আড়ালে যখন তখন গায়ে হাত তোলা থেকে বুঝেছি, দুনিয়ায় ওর চেয়ে খারাপ কেউ হতে পারে না।’

‘দেড় মাস আগে প্রথমবারের মত যোগাযোগ করি লিণ্ডার সঙ্গে, বলল লিসা স্মিথ। ‘জন ব্রাউন আর ও যখনই তীরে নেমেছে, আড়াল থেকে চোখ রেখেছি আমরা। বুঝে গেলাম, কথায় কথায় তর্ক করে ওরা। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। ওই সুযোগটা নিলাম।’

সরাসরি রানার চোখে তাকাল লিণ্ডা। ‘মনে আছে, পাহাড়ি উপত্যকায় তোমাকে বলেছি, আমি জনের কাছ থেকে চলে যেতে চাই? কিন্তু সেসময় মর্ডাকের মৃত্যুর কারণে চলে যেতে পারিনি?’

‘হ্যাঁ, মনে আছে,’ বলল রানা।

‘মিথ্যা বলেছি। আসলে সেদিনই প্রথমবারের মত লিসা, রাফায়েল আর জ্যাক খুলে বলল, কী ধরনের পশু জন ব্রাউন। ছবিতে দেখলাম কীভাবে খুন করেছে র‍্যাচেলকে। এ ছাড়াও ছিল কিছু ফোটো। ওগুলো আফ্রিকান বাচ্চাদের। কারও হাত নেই, কারও পা নেই। জনের সরবরাহ করা অস্ত্রের গুলিতে বাকি জীবনের জন্যে পঙ্গু হয়েছে ওরা। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে গোটা গ্রাম। প্রাণে বাঁচতে পারেনি কেউ। এই ভয়ঙ্কর অত্যাচার বা নির্যাতনের পেছনে রয়েছে জন ব্রাউনের আগ্নেয়াস্ত্র। ওগুলো বিক্রি করেই আজ সে এত বড়লোক। এত কিছু জানার পর লিসাদের দলে যোগ না দিয়ে পারিনি।’

‘ওদের কথা ঠিক, সেটা ধরে নিয়েছ,’ বলল রানা। ‘কিন্তু এসব তো অসত্যও হতে পারে।’

‘আমি অত বোকা নই, রানা। ওদের সঙ্গে যোগ দেব বলার পর নিজেই গোটা সেইবার ইয়ট ঘুরে দেখি। কার্গো .হোল্ডে পেলাম অসংখ্য ক্রেট। এ ছাড়া, ছিল ধাতুর বাদামি রঙের বড় বাক্স। স্টেনসিল করে লেখা ছিল নানান ধরনের অস্ত্র ও গুলির বর্ণনা। ভেবেছিলাম একটা ক্রেট খুলব। কিন্তু সেসময়ে গলার আওয়াজ পেলাম। জন আর অন্য কেউ আসছে। লুকিয়ে পড়লাম। তাদেরকে না দেখলেও শুনলাম একটা শিপমেন্ট নিয়ে আলাপ করছে তারা। কয়েকটা ক্রেট খোলার আওয়াজ হলো। তারপর ধাতু ঘষার কেমন যেন একটা শব্দ।’

‘যেমন?’ জানতে চাইল রানা।

এরকম,’ বলে জ্যাকেটের তলা থেকে স্টেইনলেস স্টিলের অটোমেটিক .৪৫ কোল্ট পিস্তল বের করে স্লাইড টানল রাফায়েল। ঘরের ভেতর অস্বাভাবিক জোরালো শোনাল ব্ল্যাক-ক্ল্যাক আওয়াজটা।

‘ঠিক এমনই,’ বলল লিণ্ডা।

‘তুমি সাক্ষীকে প্রভাবিত করছ,’ বিশালদেহী লোকটাকে বলল রানা। লড়াইয়ের জন্যে তৈরি, দরকার হলে কোমরের কাছ থেকে ঝটকা দিয়ে বের করবে ওয়ালথার।

আবারও জ্যাকেটের ভেতর পিস্তলটা হোলস্টারে রাখল রাফায়েল।

তাকে ধমক দিল লিসা, ‘লিণ্ডাকে কথা বলতে দাও।

‘জন আর ওই লোক চলে যাওয়ার পর সাবধানে বেরিয়ে আসি। পরে আবারও গেলাম। তখন সঙ্গে ক্যামেরা। কিন্তু হোল্ডে ক্রেট বা বাক্সগুলো আর ছিল না।’

‘এটাকেই জোরালো প্রমাণ হিসেবে ধরে নিয়েছ?’ বলল রানা।

অস্বস্তির ভেতর পড়ল লিসা। নরম সুরে বলল, ‘জানি, শক্ত প্রমাণ আমরা জোগাড় করতে পারিনি। আর সেজন্যেই প্ল্যান করে আপনার সঙ্গে গিয়ে উঠি সেইবার ইয়টে। প্রায় কাউকে ওটাতে উঠতে দেয় না জন ব্রাউন। লিণ্ডা আগেই বলেছিল, আপনারা ওখানে মিটিং করবেন। তখন আপনার ব্যাকগ্রাউণ্ড ঘেঁটে দেখি আমরা। আমাদের মনে হলো, আপনি এমন এক মানুষ, যে কিনা কোনও মেয়ে বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করবেন।’

‘আমি গাধামি করেছি,’ রাগ চেপে বলল রানা।

‘আমার তো মনে হয়েছে, আপনি আসলে বাস্তব জীবনে একজন সত্যিকারের হিরো,’ বলল লিসা স্মিথ। ‘আমরা দুঃখিত যে আপনাকে ফাঁদে ফেলেছিলাম। তবে এ ছাড়া আর কোনও উপায়ও ছিল না।’

‘আমাকে বিশ্বাস করার কারণটা কী? আমিও তো জন ব্রাউনের দলের লোক হতে পারি।’

‘আমরা আরও খোঁজ নিয়েছি। আপনি আছেন বিসিআই- এ। এ ছাড়াও আপনার আছে নানান ধরনের কল্যাণমূলক অ্যাকটিভিটি। সেসব উল্লেখ করছি না। তবে এ ধরনের মানুষ ওই লোকের সঙ্গে বেআইনী সম্পর্ক রাখবে, এটা আমাদের মনে হয়নি।’

‘তোমার কথা অনুযায়ী, খুব চতুর লোক জন ব্রাউন, ‘ বলল রানা। ‘আমিও হয়তো তেমনই।’

‘আরও কিছু খোঁজ নিইনি, তা কিন্তু নয়। লিণ্ডার মাধ্যমে রেকর্ড করেছি জন ব্রাউন আর আপনার কথা। তা থেকে বুঝতে দেরি হয়নি, আপনি তার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন। কায়রোয় গিয়েছিলেন। তবে হাতে পেয়েও সেই অ্যাডিক্ট জনকে খুন করেননি। তুলে দিয়েছেন পুলিশের হাতে। এরপরেও সন্দেহ করলে হয়তো ঈশ্বরও আমাদের ওপর রেগে যাবেন।’

কড়া চোখে লিণ্ডার দিকে তাকাল রানা।

একবার মাথা নাড়ল মেয়েটা। চোখে লজ্জা। ‘সরি। তুমি আসলে ব্রাউনের সঙ্গে জড়িত নও, সেটা জানার জন্যে সার্ভেইলেন্স ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করেছি।’

‘সন্দেহজনক কিছুই পাওনি তোমরা,’ লিসা স্মিথের দিকে তাকাল রানা। ‘নইলে আমার সঙ্গে আলাপ করতে না।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেয়েটা। ‘ভাল হয় ব্রাউনের ব্যক্তিগত কমপিউটারে ঢুকতে পারলে। তাই গোপনে তার স্টাডিতে ঢুকে খুব ছোট একটা কি-স্ট্রোকার রেখেছি। ওটার ভেতর রয়েছে ট্র্যান্সমিটিং ডিভাইস। কমপিউটারে যা-ই লিখুক, ওটা পেয়ে যাব আমরা। তবে দুঃখের কথা, এখনও এক লাইনও লেখেনি সে।’

‘আরও দুঃখের কথা আছে,’ বলল রানা। ‘তোমাদেরকে যথেষ্ট সময় দিয়েছি। অথচ, কোনও প্রমাণ দেখাতে পারোনি। সুতরাং, আর সময় নষ্ট না করে এবার আমি নিজের কাজে যাব।’

‘আমরা তো আর আপনাকে এভাবে চলে যেতে দিতে পারি না,’ বলল দানবের মত প্রকাণ্ড রাফায়েল।

কঠোর চোখে তাকে দেখল রানা। ‘আমাকে বাধা দিলে লিণ্ডা ছাড়া তোমরা সবাই মরবে।’

‘কথাটা ওভাবে বলেনি রাফায়েল,’ চট করে বলল লিসা স্মিথ। ‘আসলে বলতে চেয়েছে, জন ব্রাউনের বিষয়ে আরও কিছু কথা আপনার জানা থাকা দরকার।’

‘আমার তো মনে হয় নিজেদের সেরা প্রমাণ তোমরা হাজির করেছ,’ বলল রানা। ‘তাতে সন্তুষ্ট নই আমি।’

‘আরও কিছু কথা আছে, বলল লিসা। ‘আমার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর হয়তো অন্যভাবে সব দেখবেন আপনি। …আসলে কতটা চেনেন আপনি জন ব্রাউনকে?’

‘পাশাপাশি লড়াই করেছি আমরা,’ বলল রানা। ‘তোমরা যা ভেবেছ, তার চেয়ে হাজার কোটি গুণ ভাল লোক বলেই তাঁকে চিনি।’

‘আপনার প্রাণ রক্ষা করে সে, বলল লিসা। ‘কঙ্গোর কিভুর জঙ্গল। ষোলো সালের এপ্রিল মাসের চার তারিখের কথা। …ঠিক?’

‘হ্যাঁ,’ একটু থমকে গিয়ে বলল রানা।

‘আপনি ভুল জানেন।’

কঠোর চোখে লিসাকে দেখল রানা। ‘কী বলতে চাও?’

‘আগেই বলেছি, এসব জানলে আপনার ভাল লাগবে না। নতুন করে ভেবে নিতে হবে কিছু বিষয়।’

‘সত্যটা আমি জানি,’ বলল রানা।

মাথা নাড়ল লিসা স্মিথ। ‘আপনি যা বিশ্বাস করেন তা ডাহা মিথ্যা। সেসময় এসএএস ফোর্সে জন ব্রাউন ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল। সেরাতে জঙ্গলে আপনার প্রাণরক্ষা করেনি সে। যদিও আপনি মনে করেন, সে তা-ই করেছে।’

‘তুমি তো ওখানে ছিলে না, তাই না?’ বাঁকা সুরে বলল রানা। ‘নিজ চোখে দেখেছি, নিশ্চিত খুন থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দেন কর্নেল ব্রাউন। গুলি করে মারেন বিদ্রোহী সৈনিক দলের সহঅধিনায়ক ক্যাপ্টেন নানাঙ্গাকে। তিনি বীরের মত যুদ্ধ করেন বলেই তাঁকে পুরস্কার দেন ব্রিটেনের রানি। প্রমোশন দিয়ে তাঁকে করা হয় কর্নেল।’

‘ওই ঘটনার আরেকজন সাক্ষী ছিল,’ বলল লিসা। ‘পুরো ব্যাপারটা দেখে সে। তার শরীরে গুলি লাগেনি। আপনার মত প্রায় অচেতন ছিল না সে। আপনার দেয়া সাক্ষ্যের চেয়ে তার বক্তব্য আদালতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরে নেয়া হবে।’

‘কে সে?’

‘তার নাম হিশানে মাবুম্বা। আপনারা যখন ক্যাকাম্যালা ক্রিকে যুদ্ধ করছেন, সেসময়ে তার বয়স মাত্র ষোলো বছর। ওকে নিজেদের সঙ্গে জুটিয়ে নেয় বিদ্রোহী সৈনিকদল। ওর মত আরও অনেক কিশোর বা তরুণের মাথা খেয়ে ফেলেছিল মেজর বাবুনা গুন আর ক্যাপ্টেন নানাঙ্গা। সেসময়ে গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয় ওরা। খুন করে শত শত নিরীহ মানুষকে।’

‘ভাল সাক্ষী জোগাড় করেছ,’ বলল রানা। ‘চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা! মাথাগরম ষোলো বছরের এক ছোকরা।’

‘গত চার বছরে অনেক বদলে গেছে সে। সেজন্যে আপনাকেও ধন্যবাদ দেয়া যায়। ওই যুদ্ধের পর বিদ্রোহী সৈন্যদল থেকে পালিয়ে যায় হিশানে। শপথ করে, আর কখনও এ ধরনের অন্যায়ে নিজেকে জড়াবে না। আসলে এ কারণেই ওকে খুঁজতে গিয়ে এতটা কষ্ট হয়েছে। …আমি কি খুলে বলব, সেরাতে সত্যিই কী ঘটেছিল?’

রানা নিজেও জানে না, কেন যেন ভীষণ রাগ হচ্ছে ওর। শীতল সুরে বলল, ‘বলো, শুনি।’

‘চারপাশে রণহুঙ্কার। আপনারা শেষবারের মত আশ্রয় নিয়েছেন গির্জা থেকে একটু দূরে। গুলি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে বিদ্রোহী সৈনিকরা। ওই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ দেখে খুব ভয় পেয়েছিল হিশানে। মরা এক গাছের উপড়ে যাওয়া এক গুঁড়ির পাশে গর্তের ভেতর লুকিয়ে পড়ে। পরিষ্কার দেখেছে জ্বলন্ত গির্জা আর দাউদাউ করে জ্বলা কাঠের স্কুল ছাউনি।’

রানার বুকে যেন ছুরির খোঁচার মত লাগছে লিসা স্মিথের কথাগুলো। অফিশিয়াল কোনও আর্কাইভ থেকে অনেক তথ্যই পেতে পারে মেয়েটা, কিন্তু তার জানার কথা নয় জ্বলন্ত গির্জার চারপাশের পরিবেশ। অঙ্গার হয়ে যাওয়া স্কুল ছাউনির কথা ওরা কখনও উল্লেখ করেনি ওদের রিপোর্টে। এরপর কী শুনবে ভাবতে গিয়ে বুকের ভেতরটা শুকিয়ে এল রানার।

গড়গড় করে বলতে লাগল লিসা স্মিথ: ‘আমাদের সাক্ষীর কথা অনুযায়ী, আকাশ থেকে হেলিকপ্টার নামলে পালিয়ে যেতে থাকে বিদ্রোহী সৈন্যদলের বেশিরভাগ সদস্য। …আমি কি ঠিক বললাম, মিস্টার রানা?’

‘এখন পর্যন্ত।’

‘বেশ, এবার শুনুন বাকি অংশ, বলল লিসা। ‘হেলিকপ্টার হাজির হওয়ার সময় হিশানে দেখতে পেল, আপনার ও আপনার এক সহযোদ্ধার পেছনে চলে গেছে জন ব্রাউন। পরে অফিশিয়াল রিপোর্ট থেকে’ জেনেছি, আপনার সহযোদ্ধার নাম ছিল কর্পোরাল জসিম। তবে ব্রাউনের সঙ্গে ছিল আরেকজন। সে বিদ্রোহী সৈনিকদলের সহঅধিনায়ক ক্যাপ্টেন নানাঙ্গা।’

চুপ করে শুনছে রানা। বুকে যেন জ্বলছে আগুন।

‘হিশানে দেখল, আপনার পিঠে গুলি করল জন ব্রাউন। এরপর গুলি করল কর্পোরাল জসিমকে। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল না বাঙালি সৈনিক। চুপচাপ সব দেখছিল ক্যাপ্টেন নানাঙ্গা। এদিকে আপনার খুব কাছে চলে গেল ব্রাউন। মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন আপনি। কিন্তু গড়ান দিয়ে সরাসরি চোখ রাখলেন বেইমান লোকটার চোখে। আপনার বুকে গুলি করবে বলে পিস্তল তাক করল সে।’ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবারও বলল লিসা স্মিথ, ‘যুদ্ধের বিস্তারিত তথ্য পাচ্ছেন তো? এসব কিন্তু আমাদের জানার কথা নয়, তা-ই না?’

নীরবে বসে আছে রানা।

‘তবে জন ব্রাউনের গুলিতে সঙ্গে সঙ্গে খুন হয়নি কর্পোরাল জসিম। শরীরের শেষ শক্তি ব্যয় করে ব্রাশ ফায়ার করল সে। একটা গুলি কণ্ঠায় বিঁধলে মারা পড়ল ক্যাপ্টেন নানাঙ্গা। বাহুতে গুলি লাগল জন ব্রাউনের। সে রাতে আসলে আপনাকে রক্ষা করে আপনারই অধস্তন সৈনিক বাংলাদেশ আর্মির কর্পোরাল জসিম। কাউকে সম্মান দিতে হলে তাকেই দেবেন।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা।

‘জন ব্রাউন ঘুরেই গুলি করল আহত কর্পোরাল জসিমের মাথায়। এ সময়ে জ্ঞান হারান আপনি। আপনার মগজেও বুলেট গেঁথে দিত ব্রাউন, কিন্তু তখন হেলিকপ্টার থেকে নেমে ছুটে এল প্যারাট্রুপাররা। আপনাকে আর শেষ করতে পারল না সে।’

ধকধক করছে রানার হৃৎপিণ্ড। কষ্ট হচ্ছে শ্বাস নিতে। চাপা স্বরে বলল, ‘গুলি করল কেন?’

‘বুঝলেন না? আপনারা বাংলাদেশ আর্মির অফিসার ও সৈনিক। অথচ বেশ কিছু দিন আগে সম্মানজনক প্রতিযোগিতায় জন ব্রাউনের ফোর্স অনেক কষ্ট করে ড্র করেছিল আপনাদের সঙ্গে। এটা হয়তো রাগের একটা কারণ। তবে সবচেয়ে বড় কারণ, আর্মির বড় পদে থেকেও কঙ্গোর ওই বিদ্রোহী সৈনিকদলকে বেআইনী অস্ত্র সরবরাহ করছিল সে। এই একই কাজ করেছে সে দশ বছর ধরে নানান দেশে। আপনারা যখন কিনশাসায় অপেক্ষা করছেন সবুজ সঙ্কেতের জন্যে, ওই একই সময়ে মেজর বাবুনা গুন আর ক্যাপ্টেন নানাঙ্গার সঙ্গে ব্যক্তিগত অস্ত্র চুক্তি করছে সে। চোরাই অস্ত্রের বদলে পেয়েছে প্রচুর বেআইনী হীরা।’

‘ক্যাকাম্যালা ক্রিকের অপারেশন ছিল ভয়ঙ্কর এক ফাঁদ,’ আর্মচেয়ারে হেলান দিয়ে বসল রাফায়েল। ‘আমাদের ধারণা, জন ব্রাউনের ইউনিটের কেউ সন্দেহ করে বসে তাকে। তাই নিজেকে আড়াল করতে গিয়ে আসন্ন লড়াইয়ের জরুরি তথ্য ফাঁস করে ব্রাউন। ফলে মারা গেল ব্রিটেন ও বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক একদল সৈনিক। জন ব্রাউন চেয়েছিল জীবিত একমাত্র অফিসার হতে। কিন্তু তার জাল থেকে ফস্কে যান আপনি।’

‘একটু ভেবে দেখুন, বলল লিসা স্মিথ। ‘আমাদের কথার ভেতর অযৌক্তিক কিছু আছে কি না। অস্বীকার করতে পারবেন না হিশানের দেয়া সাক্ষ্যকে। শুধু তার জবানবন্দিই যথেষ্ট ছিল জন ব্রাউনকে জেলে পাঠাতে।’ চাপা শ্বাস ফেলল মেয়েটা। ‘তবে হিশানে খোলাখুলি কথা বলতে রাজি নয়। মনে ভীষণ ভয়। প্রচণ্ড ঘৃণা করা হয় বিদ্রোহী দলে যোগ দেয়া কিশোর-তরুণদেরকে। একবার যদি প্রমাণ হয় ও ছিল ওই দলে, এলাকার মানুষ প্রথম সুযোগেই খুন করবে ওকে। ওর কপাল ভাল, মিশে যেতে পেরেছে সাধারণ গ্রামবাসীর সঙ্গে। ভুলে যেতে চেয়েছে কষ্টকর অতীত। কাজেই সাক্ষী হিসেবে রয়ে গেলেন শুধু আপনি। এমন একজন, যিনি সাহায্য করতে পারবেন আমাদেরকে।’ রানার চোখে চোখ রেখে অনুনয় নিয়ে তাকাল লিসা স্মিথ। ‘আপনি কি আমাদেরকে সাহায্য করবেন? প্লিয?’

ঘরে নেমেছে থমথমে নীরবতা। যা শুনেছে, হজম করতে কষ্ট হচ্ছে রানার। বারবার মন বলছে, এটা হতে পারে না! এসব আসলে সত্যি নয়!

আরও কয়েক মুহূর্ত পর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রানা। ‘না। আমার ধারণা, নিজেদের স্বার্থে তোমরা মিথ্যা বলছ।’ দরজার দিকে পা বাড়াল ও।

প্রায় ছুটে এসে রানার হাত ধরল লিণ্ডা। ‘রানা, একমিনিট, শোনো আমার…

ঝটকা দিয়ে মেয়েটার হাত সরিয়ে দিল রানা। ‘আমাকে আর বিরক্ত করবে না,’ বলে বেরিয়ে এল হলওয়েতে।

পেছন পেছন আসছে লিণ্ডা। কাতর সুরে বলল, ‘প্লিয, রানা! আমাদেরকে সাহায্য করো! আমি তোমাকে ভালবাসি!’

দরজার কাছে থমকে দাঁড়িয়ে গেল রানা। ‘তা-ই নাকি?’

ওর বাঁকা সুরের প্রশ্নটা যেন চড় দিয়েছে লিণ্ডার গালে।

‘একের পর এক মিথ্যা বলেছ, আমাকে ব্যবহার করেছ নিজের স্বার্থে, গুড়গুড় করে উঠল রানার কণ্ঠ। ‘এখন এমন এক লোকের পেছনে লেগেছ, যে কিনা নতুন করে জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে আমাকে।’

‘আমার আর কী করার ছিল, রানা?’ ফুঁপিয়ে উঠল লিণ্ডা।

দরজা খুলে ফেলল রানা।

‘এখন কী করবে?’ অসহায় সুরে জানতে চাইল লিণ্ডা।

‘যতটা পারি, তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যাব,’ জবাব দিল রানা। ‘ফিরে যাও এইসব ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে। তারা অপেক্ষা করছে।’ আর একটা কথাও না বলে লিণ্ডার মুখের ওপর দড়াম করে দরজা বন্ধ করল ও। বৃষ্টিভেজা রাতে গাড়ির দিকে চলেছে। প্রচণ্ড রাগে ফুঁসছে ওর বুকের ভেতরটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *