ছায়াঘাতক – ২৫

পঁচিশ

কিছুক্ষণ আগে ইন্টারপোলের তিন এজেন্টের আস্তানা থেকে বেরিয়ে এসেছে রানা। ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে মাত্র পনেরো মিনিটে পৌঁছে গেল সেফ হাউসের পাতাল গ্যারাজে। সোজা উঠে এল ফ্ল্যাটে। কোমর থেকে ওয়ালথার নিয়ে রেখে দিল বেডরুমের নিচু টেবিলের ওপর। তারপর সোফায় বসে ডুবে গেল চিন্তায়। চুপচাপ ভাবছে ক্যাকাম্যালা ক্রিকের সেই যুদ্ধের কথা। তবে একটু পর চরম বিরক্ত হয়ে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল কষ্টকর চিন্তাগুলো। কেমন এক ঘোরের ভিতর ঘুমিয়ে পড়ল ও।

দুঃস্বপ্নের মধ্যে আবারও ফিরল ক্যাকাম্যালা ক্রিক, গির্জা ও স্কুলের ছাউনির কাছে। রানা দেখল, আগুনের আলো থেকে বেরিয়ে এসেছে কেউ। তাকে লাগছে কালো ছায়ার মত। হাতে পিস্তল। সরাসরি তাকাল ওর দিকে। তারপর সামনে বাড়াল আগ্নেয়াস্ত্রটা। এবার খুন করবে ওকে।

কিন্তু রানার এত দিনের দুঃস্বপ্নে কী যেন বদলে গেছে। ওর সামনে থেমেছে দু’জন লোক। বরাবর চেহারাহীন ছিল ওরা। কিন্তু এখন পরিষ্কার দেখতে পেল ও তাদেরকে। হ্যাঁ, দু’জন তারা। একজন আফ্রিকান, অন্যজন ইউরোপিয়ান। কালো লোকটা বাচ্চা হাতির মত হোঁৎকা। পরনে খাকি ফেটিগ। হাতের ভাঁজে নতুন আর্মালাইট রাইফেল। আগুনের আলোয় চকচক করছে ওটা।

লোকটা বিদ্রোহী সৈনিক দলের সহঅধিনায়ক ক্যাপ্টেন নানাঙ্গা। বারবার নার্ভাস দৃষ্টিতে এদিক ওদিক দেখছে। খুব কাছে পৌঁছে গেছে অন্তত দুটো হেলিকপ্টার। নানাঙ্গা বোধহয় ভাবছে, অন্যদের মত জঙ্গলে পালিয়ে যাবে। দুশ্চিন্তা ভরা চেহারা যেন নীরবে বলছে: কাজটা শেষ করুন! হাতে তো সময় নেই!

পাশে যে শ্বেতাঙ্গ, সে লম্বা, চিকন গড়নের লোক। পরনে এসএএস ট্রপিকাল কমব্যাট ইউনিফর্ম। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জন ব্রাউন! জীবনে প্রথমবারের মত স্বপ্নে তার মুখ দেখল রানা। কত চেনা, অথচ বহু দূরের কেউ। আগুনের লাল আলোয় তার চোখে অশুভ দৃষ্টি। রানার মাথায় তাক করল পিস্তলের নল।

কী যেন বলল রানা, কিন্তু ওর কণ্ঠ হারিয়ে গেল হেলিকপ্টারের জোরালো আওয়াজে। নিষ্ঠুর হাসছে জন ব্রাউন।

তার পেছনে রক্তের পুকুরে পড়ে আছে আরেকজন। ডান কনুই ওপরে তুলল সে। থরথর করে কাঁপছে হাতের রাইফেল। কর্পোরাল জসিমকে দেখল রানা। খুব ফ্যাকাসে জসিমের মুখ। চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল জন ব্রাউন। কিন্তু তখনই বীর সৈনিকের বুলেট বিঁধল তার বাহুতে। জসিমকে গুলি করল ব্রাউন। কাত হয়ে মাটিতে পড়ে নিথর হলো বাঙালি সৈনিক

হঠাৎ করেই ঘুমটা ভাঙল রানার। ঝটকা দিয়ে উঠে বসল বিছানায়। দরদর করে ঘামছে। মনে পড়ল বিসিআই-এর সাইকোঅ্যানালিস্টের কথা: ‘আমরা স্বপ্নে এমন কিছু দেখতে পারি, যেটা ভুলে গেছে সচেতন মন। কাজেই স্বপ্নকে গুরুত্ব দেবেন।’

জীবনে প্রথমবারের মত দুঃস্বপ্নে পরিষ্কার শুনেছে প্রতিটা আওয়াজ। ঝকঝকে ছিল দৃশ্যগুলো। সব যেন ঘটছে ওর চোখের সামনে। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত লাগছে রানার। বহু কাল ধরে ওর মনের ভেতর লুকিয়ে ছিল জরুরি এক সত্য। আজ সিনেমার দৃশ্যের মত সব দেখিয়ে দিয়েছে মন। আসলে অসচেতন হৃদয় আগেই জানত। কিন্তু ওর চেতন মন কখনও চায়নি বাস্তবতার মুখোমুখি হতে। না বুঝে এতদিন নিজেকেই ভুল বুঝিয়েছে ও।

এটাই কঠিন বাস্তবতা, ওকে খুন করতে চেয়েছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল জন ব্রাউন!

কথাটা ভাবতে গিয়ে শ্বাস আটকে এল রানার। বুঝে গেছে, গত কয়েক বছর ধরে বাস করেছে বোকার স্বর্গে। ওকে খুন করে ফেলতে চেয়েছে যে-লোক, তার প্রতিই কৃতজ্ঞতায় উদ্বেলিত হয়েছে এত দিন! মাত্র কয়েক দিন আগেও ঋণ শোধ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল!

নিজেকে চরমভাবে ঠকে যাওয়া মানুষ বলে মনে হচ্ছে রানার। মনে পড়ল, ইন্টারপোলের স্পেশাল এজেন্ট রাফায়েলের একটা কথা: ‘আমাদের ধারণা, জন ব্রাউনের ইউনিটের কেউ সন্দেহ করে বসে তাকে।’

কঙ্গোতে ফিরল রানার মন। ব্রিটিশ এম্বেসিতে ওর পাশের ঘরেই ছিল কয়েকজন ব্রিটিশ সৈনিক। চোখের সামনে যেন এসএএস কর্পোরাল অ্যান্ড্রিউকে দেখল ও। জরুরি কী যেন বলতে এসেছিল ছেলেটা। খুব উত্তেজিত। ‘স্যর, আপনার সঙ্গে একটা ব্যাপারে আলাপ করতে চাই।’

‘নিশ্চয়ই, বলো!’ অবাক হয়ে রানা ভেবেছিল, ওকে কেন কিছু বলতে চাইছে এসএএস সৈনিক?

‘বিষয়টা খুব জটিল, স্যর,’ বলেছিল অ্যান্ড্রিউ। ‘আর আমি পুরো শিয়োরও নই। তবে…’

এমন সময় রানার ঘরে ঢুকল জন ব্রাউন। চোখ নিচু করে নিল অ্যান্ড্রিউ। কথা শেষ না করেই বেরিয়ে গেল।

অ্যান্ড্রিউর মত আত্মবিশ্বাসী সৈনিকের এ ধরনের আচরণ দেখে বিস্মিত হয়েছিল রানা। ভেবেছিল, পরে ছেলেটার কাছ থেকে জেনে নেবে, কী বলতে চায় সে। তবে সে সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি। সেরাতেই সবুজ সঙ্কেত দেয়া হয় ওদেরকে। হেলিকপ্টার করে গিয়ে নেমে পড়ে আঁধার জঙ্গলে।

এসব স্মৃতি একদম ভুলে গিয়েছিল রানা। আবারও মনে পড়ল জন ব্রাউনের নিষ্ঠুর মুখ। গুলি করার আগে একবার বিজয়ীর হাসি হেসেছিল সে। বিড়বিড় করল রানা, ‘তোমাকে তোমার প্রাপ্য শাস্তি আমি দেব, ব্রাউন!’

পরিষ্কার হয়ে গেছে ওর মগজ। পাঁচ মিনিট লাগল না ফ্ল্যাট থেকে নেমে মিনি কুপারে উঠতে। রাতের সড়কে তুমুল বেগে ইন্টারপোল এজেন্টদের বাড়ির দিকে চলল রানা। শহরের ওপর ভেসে থাকা সমস্ত ধূলিকণা মাটিতে নামিয়ে দিয়ে থেমে গেছে বৃষ্টি। আকাশে ঝিকমিক করছে হাজারো নক্ষত্র। কিন্তু কুচকুচে কালো মেঘ জমেছে রানার মনের আকাশে। ভাবছে, এবার তোমার রেহাই নেই, জন ব্রাউন!

রানা ভাবছে, একা সেইবার ইয়টে গিয়ে উঠবে, না আগে কথা বলে নেবে ইন্টারপোলের স্পেশাল এজেন্টদের সঙ্গে?

কয়েক মুহূর্ত পর সিদ্ধান্ত নিল।

শহরতলীর সেই বাড়ির গলিতে গাড়ি রেখে নেমে পড়ল রানা। দৌড়ে গিয়ে থামল নির্দিষ্ট দরজায়। কয়েকবার জোরে জোরে টোকা দিল।

এবার দরজা খুলল লিসা স্মিথ। রানাকে দেখে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ভাবিনি আপনি আর ফিরবেন। কী কারণে এলেন?’

‘আমি তোমাদের প্রতিটা কথা এখন বিশ্বাস করি,’ বলতে গিয়ে নিজেকে বোকা-বোকা লাগল রানার। ‘এখনও যদি আমার সাহায্য লাগে, তা হলে আমি তৈরি।’

মিষ্টি হাসল লিসা স্মিথ। জীবনে দ্বিতীয়বারের মত উঁচু হয়ে হালকা চুমু দিল রানার গালে। ‘আসুন। খুব খুশি হয়েছি।’

‘লিণ্ডা এখনও আছে?’ হলওয়েতে ঢুকে জানতে চাইল রানা।

মৃদু মাথা দোলাল মেয়েটা। ‘আজ রাতে এখানেই থাকবে। আগামীকাল ফিরবে স্যান রেমোয়।’

লিসার পিছু নিয়ে অপারেশন্স রুমে ঢুকল রানা। চেয়ারে বসে কফি পান করছে রাফায়েল ফক্স ও জ্যাক রনসন। অবাক হয়ে রানাকে দেখল তারা, তারপর খুশি হয়ে তাকাল পরস্পরের দিকে।

‘খুব খুশি হলাম আপনাকে দলে পেয়ে,’ বলল রাফায়েল। ‘ঘাড়ে ব্যথা দেয়ার জন্যে দুঃখিত,’ আন্তরিক স্বরে বলল রানা।

‘ওটা কিছু না,’ গাল কুঁচকে করুণ হাসি দিল দানব। ‘এ থেকে প্রমাণ হয়ে গেল আমার একটা ঘাড় আছে।’

দরজার কাছে গিয়ে গলা ছাড়ল লিসা, ‘লিণ্ডা, এসো! দেখে যাও কে এসেছে!’

কয়েক মুহূর্ত পর ঘরে ঢুকল লিণ্ডা। রানাকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল ওকে। খুশিতে চকচক করছে দুই চোখ।

‘তোমাদেরকে সন্দেহ করে অন্যায় করেছি,’ বলল রানা। ‘তবে একটু আগে বুঝেছি, এতদিন অন্ধ ছিলাম।’ লিণ্ডা ওকে ছেড়ে দিতেই লিসার দিকে তাকাল ও। ‘তোমাদের সঙ্গে যোগ দিলে আমাকে কী ধরনের কাজ করতে হবে?’

‘একটু পর বলছি,’ বলল লিসা। ‘আগে বিস্ময়টা একটু কাটিয়ে নিই।’

‘আমার কিন্তু দু’একটা শর্ত আছে,’ বলল রানা। চোখ পিটপিট করে ওকে দেখল লিসা। ‘বলুন?’

‘আমি চাই না এসবে আরও জড়িয়ে যাক লিণ্ডা ব্যাপারটা ওর জন্যে অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ।’

‘একমিনিট,’ প্রতিবাদ করল লিণ্ডা। ‘আমি এর শেষ দেখতে চাই। আগামীকাল সকালে ফিরব স্যান রেমোতে। সেইবার ইয়টে উঠে চোখ-কান খোলা রাখব। ব্রাউন যখন ব্যবসার জন্যে বাইরে যাবে, সেই সুযোগে কার্গো হোল্ডে নেমে ছবি তুলব।’

‘লিসা, রাফায়েল বা জ্যাক কিন্তু অফিশিয়াল টিম নয়, ‘ লিণ্ডাকে বলল রানা। ‘বড় কোনও বিপদে পড়লে তুমি ব্যাকআপ পাবে না। চট করে তোমাকে বের করে আনা অসম্ভব। সাগরের মাঝে ওই ইয়টে কোথাও লুকাতে পারবে না। মস্তবড় বিপদ হতে পারে।’

‘তুমিও তো বিপদে থাকবে।’

‘আগেও এ ধরনের অনেক বিপদে পড়েছি,’ বলল রানা। ‘এজন্যে ট্রেনিংও আছে। তোমার ব্যাপারটা কিন্তু তেমন নয়।’

মাথা নাড়ল লিণ্ডা। ‘ইয়টে আমার ফিরতেই হবে। জন ব্রাউনের কাছ থেকে সরে যেতে হলেও গুছিয়ে নিতে হবে আমার নিজের জিনিসপত্রগুলো।’

‘দরকারি জিনিসপত্র পরেও কিনে নিতে পারবে।’

‘বিশেষ করে দরকার আমার ডকুমেন্টগুলো।’

‘পরে প্রয়োজন পড়লেই পাবে সব ধরনের সার্টিফিকেট।’

‘তোমার কথা অনুযায়ী ধরে নিলাম ওখানে গেলাম না। কিন্তু থাকব কোথায়?

‘সে ব্যবস্থা আছে,’ বলল রানা। ‘নিরাপদ একটা ফ্ল্যাটে উঠবে। বিরক্ত করবে না কেউ।’

‘নরম্যাণ্ডিতে?’

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘আগামীকাল সকালে তোমাকে ওখানে পৌঁছে দেব।’

‘কিন্তু জন ব্রাউন সহজেই জেনে যাবে কোথায় উঠেছি, ‘ মাথা নাড়ল লিণ্ডা। ‘এভাবে পালিয়ে গেলে খুঁজে বের করে আমাকে মেরে ফেলবে।’

‘আমার তা মনে হয় না,’ বলল রানা। ‘সে ব্যস্ত থাকবে আত্মরক্ষা করতে। নরম্যাণ্ডির ওই ফ্ল্যাট নিরাপদ। তোমাকে সর্বক্ষণ পাহারা দেবে ট্ৰেইণ্ড অন্তত দু’জন কমাণ্ডো। এমন কী জন ব্রাউনের পক্ষেও সহজ হবে না হামলা করা।’ লিসার দিকে তাকাল রানা। ‘লিণ্ডাকে পৌছে দিয়ে এখানে ফিরব। তখন তৈরি করে নেব প্ল্যান।’

‘আপনি লিণ্ডাকে হিসাব থেকে বাদ দিতে চাইছেন,’ বলল লিসা। ‘কিন্তু আপনার সঙ্গে এমন কথা ছিল না। সেইবার ইয়টে ওকে আমাদের দরকার। নইলে কাজ এগিয়ে নেয়া খুব কঠিন হবে।’

‘হয় আমার প্ল্যান মত কাজ করব আমরা, নইলে মাঠে নামব একা,’ বলল রানা। ‘এর কোনও অন্যথা হবে না।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাফায়েল ও জ্যাকের দিকে তাকাল লিসা। কাঁধ ঝাঁকাল জ্যাক রনসন। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘মিস্টার রানাকে আমাদের দলে খুব প্রয়োজন।’

‘ঠিক আছে,’ রানার দিকে তাকাল লিসা। ‘আপনার কথামতই কাজ হবে। তো এরপর আমরা কী করব?’

‘লিণ্ডাকে নরম্যাণ্ডিতে পৌঁছে দিয়ে এসে প্ল্যান নিয়ে আলাপ করব আমরা।’ অপরূপা মেয়েটার হাত ধরল রানা। ‘এবার চলো।’

ছাব্বিশ

ধনীদের এলাকা হাইড পার্ক, কায়রো।

পেরিয়ে গেছে মাঝরাত, এখনও এনক্রিপ করা ফাইল নিয়ে লেগে আছে ইউডন ভাদিম। নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে তার। ঘুম নেই কয়েক দিন। বুকে ভীষণ ভয়। আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছে। রাতের পর রাত স্ক্রিনের দিকে চেয়ে থেকে ভীষণ জ্বলছে দুই চোখ। থরথর করে কাঁপছে দুই হাতের আঙুল।

যাচাই করে দেখেছে সব সম্ভাবনা। যত ঐতিহাসিক নাম মাথায় এসেছে, বা জায়গার কথা— সবগুলোকে পাসও অর্ড হিসেবে ব্যবহার করে আনলক করতে চেয়েছে ওই ফাইল। বাদ পড়েনি নানান ধরনের রেফারেন্স। এখন বোধহয় নরকে বসে টিটকারির হাসি হাসছে মডার্ক ব্রাউন। ভাদিম বুঝে গেছে, ফেরাউন আখেনাতেন থেকে শুরু করে মর্ডাকের বড় দাদুর পরদাদুর বেড়ালের নামও হতে পারে ফাইলের পাসওঅর্ড।

এত মাথা খাটিয়ে একের পর এক নাম টাইপ করেও কোনও লাভ হয়নি। এদিকে সফল হচ্ছে না বলে ক্রমেই ওর ওপর খেপে যাচ্ছে জমির শেখ। প্রাণের ভয়ে প্রায় পাগল হয়ে গেছে ভাদিম। আজ আর সহ্য করতে না পেরে গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছিল আবুসিরের পিরামিড সাইটে। চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল কড়া রোদের ভেতর কয়েক ঘণ্টা। চার হাজার বছর আগের সাহিরির প্রাচীন শহরের কোটি পাথরের খণ্ডের দিকে চেয়ে বাচ্চাদের মত ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হয়েছিল। হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছে, অলৌকিক কিছু না ঘটলে জানবে না, কী দেখেছিল মডাক ব্রাউন। মনটা একদম দমে গেছে তার।

তারপর ভাদিমের মনে পড়ল মারা যাওয়ার একটু আগে একটা কথা বলেছিল আবদুল হাসান। যেদিন ধ্বংসস্তূপ থেকে ছুটে বেরোল মডাক, ওর গায়ে ছিল ধুলোবালি। মাথা ও মুখে মাকড়সার ঝুল। এ থেকে ধরে নেয়া যায়, কোনও ভাঙা পিরামিডে ঢুকেছিল সে। পরিত্যক্ত এই শহরে তো আছে কেবল সাহিরির পিরামিড কমপ্লেক্স।

আগে কেন এ কথা মনে পড়েনি? —আনমনে ভেবেছে ভাদিম। নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে, আসলে সর্বক্ষণ ঘাড়ের ওপর খুনে জমির দাঁড়িয়ে থাকলে মাথাটা খেলবে কী করে?

প্রাচীন ফেরাউনের প্রায় ধসে পড়া সমাধির দিকে ছুটে গেছে ভাদিম। প্রথমে ঘুরে দেখেছে পিরামিড। তারপর ভাঙা পাথরের এন্ট্রান্স পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে ভেতরে। এগোতে হয়েছে হামাগুড়ি দিয়ে। শ্বাস আটকে এসেছে বদ্ধ জায়গায়। মুখে মেখে গেছে মাকড়সার ঝুল। ভেতরের চেম্বার ভেঙে পড়েছে বলে সম্ভব হয়নি কোনও আর্কিওলজিকাল খনন। কিন্তু সরু, নিচু এই শাফটের দূরে কোথাও আছে গুরুত্বপূর্ণ কোনও সূত্র। টর্চ জ্বেলে চারপাশে আলো ফেলতে ফেলতে হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরের দিকে গেছে ভাদিম।

কিন্তু সুড়ঙ্গের ভেতর মাকড়সা, ঝুল আর ভাঙা পাথর ছাড়া কিছুই নেই। হাল ছেড়ে দিতে হয়েছে শেষে।

ক্রল করে আবারও বেরিয়ে এসে এক দৌড়ে গিয়ে উঠেছে গাড়িতে। ভিলায় ফিরে আবারও বসেছে তপ্ত হয়ে যাওয়া ল্যাপটপের সামনে। তারপর থেকেই পাসওঅর্ড বক্সের দিকে চেয়ে আছে।

গভীর রাত এখন। প্রচণ্ড ভয়, মানসিক চাপ, চাপা অঙ্গারের মত রাগ, ক্ষোভ আর তীব্র হতাশা যেন চিবিয়ে খাচ্ছে ওকে।

হঠাৎ ভীষণ বিরক্তি বোধ করে উঠে দাঁড়াল ভাদিম। লাথি মেরে সরিয়ে দিল ডেস্ক চেয়ারটা। পায়চারি শুরু করল ঘরের ভেতর। একটু দূরের চেয়ারে পড়ে আছে পুরনো মিলিটারি হ্যাভারস্যাক। মাসুদ রানার কাছ থেকে ওটা কেড়ে এনেছিল জমির। কষে লাথি মেরে চেয়ারটা মেঝেতে ফেলল ভাদিম। পরক্ষণে বেদম ব্যথায় কুঁচকে ফেলল দুই গাল। বোধহয় ভেঙেই গেছে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল। মেঝেতে বসে গোঙাতে লাগল। মনে বড় চোট, সে বোধহয় সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছে! নইলে নিজের দামি সব জিনিসপত্র ভাঙছে কেন? আনমনে ভাবল, আমি কি তা হলে জমির শেখের মত হয়ে যাচ্ছি?

ভাদিমের চোখ গেল মেঝেতে পড়ে থাকা ব্যাগের ওপর ওটা থেকে অর্ধেক বেরিয়ে আছে মর্ডাক ব্রাউনের কোঁচকানো ব্লেয়ারটা।

উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে ওটার সামনে থামল ভাদিম। রেগে গেল তার এত দামি কার্পেটের ওপর বিচ্ছিরি জিনিসটা দেখে। কুঁজো হয়ে বুড়ো আঙুল ও তর্জনীর আগা ব্যবহার করে তুলে নিল ফালতু ব্লেযার। যে দৃষ্টিতে ওটাকে দেখল, যে-কেউ দেখলে বলবে, কোনও মরা ইঁদুরের লেজ ধরে নাকের কাছে নিয়ে ওটাকে দেখছে লোকটা। শালার ইংরেজের কোনও রুচি ছিল না, মনে মনে বলল ভাদিম।

আবারও ব্যাগের ভেতর গুঁজে দেবে, এমন সময় ব্লেয়ারের বুক পকেট থেকে মেঝেতে খসে পড়ল কী যেন। একটা কাগজ। আবর্জনা আর কাকে বলে! ফ্যাকাসে কালি দিয়ে লেখা ফালতু রিসিট। মুঠোর ভেতর কাগজটা মুচড়ে ওটা ফেলে দিতে গেল ভাদিম। তখনই সন্দেহ ঢুকল মনে মুঠো খুলে মোচড়ানো কাগজটা নিয়ে ধীরে ধীরে খুলল।

রিসিটের ওপর লেখা রয়েছে একটা ফোন নাম্বার।

হঠাৎ করেই ঝড়ের বেগে চলতে লাগল ভাদিমের মগজ। ভুলে গেছে সব উদ্বেগ।

ফোন নাম্বারটা ইজিপশিয়ান নয়। ব্রিটিশ। দ্রুত ডেস্কের ওপর রাখা টেলিফোনের পাশে গেল ভাদিম। ইউকের আন্তর্জাতিক কোড ডায়াল করে রিসিটের নাম্বারটায় কল দিল।

কয়েকবার রিং হওয়ার পর জবাব দিল অ্যান্সারফোন। ওদিক থেকে এল নারী কণ্ঠ। ইংরেজি বলছে। উচ্চারণ অদ্ভুত। ভাদিম ভাবল, ওই মেয়ে কি আইরিশ?

‘ইউনিভার্সিটি অভ সেইণ্ট অ্যান্ড্রিউ, ফ্যাকাল্টি অভ হিস্ট্রি,’ বলে গেল নারী কণ্ঠ। ‘এক্সটেনশন নাম্বার আপনার জানা থাকলে সেটা ডায়াল করুন। নইলে, প্লিয, অপেক্ষা করুন অপারেটরের জন্যে।’

দুই ভুরু কপালে উঠল ভাদিমের। ধক-ধক করছে বুক। ফ্যাকাল্টি অভ হিস্ট্রি। ইন্টারেস্টিং! আরেকবার কাগজের নাম্বার দেখে নিয়ে বুঝে গেল, নিচে এক্সটেনশন নাম্বার: ৪৩৫। ডায়াল করল ওই নাম্বারে।

আবারও কয়েকবার রিং হওয়ার পর জবাব দিল অ্যান্সারফোন। মন দিয়ে ভয়েস মেইলের মেসেজটা শুনল ভাদিম। তারপর নোটবুকে লিখতে লাগল একজনের নাম। কাজটা শেষ করেই ফোন দিল জমির শেখকে।

শেষপর্যন্ত জরুরি সূত্র পেয়েছে ও।

সাতাশ

রাত প্রায় বারোটা।

প্যারিসের ল্যাটিন কোয়ার্টারে প্রায় নির্জন এক রেস্তোরাঁয় ভেজিটেবলের দুটো ডিশ নিয়ে ডিনার সারল রানা ও লিণ্ডা। রানার সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে জন ব্রাউন। তবুও অবাক হয়ে টের পাচ্ছে ও, আজ হঠাৎ করেই বুক থেকে নেমে গেছে ভারী একটা বোঝা। বারবার মন বলছে, তুই আর শেকল দিয়ে বাঁধা নোস। মুক্তি পেয়েছিস তুই।

নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্যে একদল সৈনিককে খুন করিয়েছে জন ব্রাউন। যে ক্ষতি বাংলাদেশের হয়েছে, সেজন্যে এবার চরম প্রতিশোধ নেবে রানা।

‘কী এত ভাবছ?’ রানাকে আনমনা দেখে জানতে চাইল লিণ্ডা।

‘না, তেমন কিছু না,’ জানাল রানা।

বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল ওরা।

‘আমরা এখন যাচ্ছি রিট হোটেলে,’ বলল রানা।

অবাক চোখে ওকে দেখল লিণ্ডা। ‘রিট? ওখানে কেন? আমরা তো ডিনার করেছি!’

‘হোটেলে তুলে দেব তোমাকে,’ বলল রানা। ‘আগামীকাল পৌঁছে দেব নরম্যাণ্ডিতে আমার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে।’

আহত চোখে ওকে দেখল লিণ্ডা। ‘ভেবেছিলাম রাতটা আমরা কোনও ফ্ল্যাটে কাটাব।’

মৃদু হাসল রানা। ‘ফ্ল্যাট একটা আছে, তবে সেটা সেইবার বা রিট-এর মত পশ্ নয়।’

ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল লিণ্ডা। ‘আমাকে কেমন মেয়ে মনে করো, বলো তো, রানা? খালি দামি সব ইয়ট আর হোটেলে রাত কাটাই? সিডনিতে আমার ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টটা দেখলে অবাক হতে।’

‘রিট হোটেলে তোমাকে রাখার আরেকটা কারণ হচ্ছে…’

‘জানি কী বলবে,’ রানাকে থামিয়ে দিল লিণ্ডা। ‘তবে পরিষ্কার বলে দিতে পারি, আমার সমস্যা নেই তোমার সঙ্গে কোনও ফ্ল্যাটে রাত কাটাতে।’ রানার বাহুতে হাত রাখল মেয়েটা। ‘বাজে খরচ করে লাভ কী? চলো, তোমার ফ্ল্যাটে যাওয়া যাক।’

দশ মিনিট পর ওরা পৌছে গেল রানা এজেন্সির সেফ হাউসের নিচের গ্যারাজে। রানার বাহু না ছেড়ে সরু সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠল লিণ্ডা। স্বাভাবিক দরজা খুলে যাওয়ার পর সিকিউরিটি ডোর দেখে অবাক হলো। ‘নাম্বার মনে রেখো,’ বলল রানা। ‘ঢুকতে বা বেরোতে ওটা লাগবে।’ লিণ্ডা জানে না, ওরা এই ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যাওয়ার আগেই নতুন কমবিনেশন সেট করবে রানা। ওই তথ্য পৌঁছে যাবে বিসিআই হেডকোয়ার্টারে। ফলে প্রয়োজনে সহজেই এই ফ্ল্যাটে উঠতে পারবে অন্য যে-কোনও এজেন্ট।

‘এত সিকিউরিটি কেন?’ জানতে চাইল লিণ্ডা। ‘তোমার কি ধারণা এখানে ডাকাতি হবে?’

‘তা নয়,’ মৃদু হাসল রানা। ‘তবে নিরাপত্তা সবসময় জরুরি।’

‘পৃথিবীর যে-কোনও জায়গায় তোমার সঙ্গে থাকলে, নিজেকে আমার নিরাপদ মনে হবে,’ সান্তরিক স্বরে বলল লিণ্ডা।

ফ্ল্যাটে ঢুকে ভারী দরজা বন্ধ করে বলল রানা, ‘তুমি বরং গিয়ে শুয়ে পড়ো বেডরুমে।’

‘আর তুমি?’ বিস্মিত চোখে বিসিআই এজেন্টের দিকে তাকাল লিণ্ডা। I

‘আমি থাকছি লিভিংরুমের সোফায়।’

‘কষ্ট হবে না?’ রানার বাহু ধরল মেয়েটা। চোখে কাতর দৃষ্টি। ‘তার চেয়ে, চলো, বিছানাটা শেয়ার করি।

আস্তে করে মাথা নাড়ল রানা। ‘তা হয় না, লিণ্ডা।’

‘কেন হয় না? আমি তো কারও বেঁধে রাখা ছাগল নই!’

‘তবুও, আমার জবাবটা হবে ‘না’।’

কষ্ট নিয়ে রানাকে দেখল লিণ্ডা। আস্তে করে রানার বাহু থেকে সরিয়ে নিল হাত। বিড়বিড় করে বলল, ‘বেশ, বুঝলাম। তুমি অন্যরকম। তবে তোমার জন্যে বাকি জীবন অপেক্ষা করতেও হয়তো দ্বিধা করব না।’

‘গিয়ে শুয়ে পড়ো, লিণ্ডা,’ নিচু গলায় বলল রানা, ‘আগামীকাল ভোরে যাচ্ছি নরম্যাণ্ডিতে।’

মাথা দোলাল মেয়েটা। টুক করে চুমু দিল রানার গালে, তারপর চলে গেল বেডরুমে। খোলা থাকল দরজা। নিভে গেল ঘরের বাতি। বিছানা থেকে বলল লিণ্ডা, ‘ভোরে নিচে গিয়ে কিছু গ্রোসারি কিনব। সকালের নাস্তাটা আমিই তৈরি করছি।’

লিভিংরুমের সোফার দিকে পা বাড়াল চিন্তিত রানা।

.

সেইবার ইয়টের আপার ডেকে দাঁড়িয়ে আছে লিণ্ডা, হাতে অত্যাধুনিক তীরধনুক। সোনালি রোদে অদ্ভুত লাগছে ওকে। ঠিক যেন রাফেলা বার্ড। চোখের চাহনি একইরকম। রাফেলার মতই হয়তো বুকে একরাশ ভালবাসা। লিণ্ডা যেন হারিয়ে যাওয়া রানার সেই প্রেম। ওকে নিজের জীবনে পাওয়ার জন্যে কী-ই না করতে পারে রানা! বিসিআই-এর চাকরি ছেড়ে চলে যাবে বহু দূরে কোথাও। কোনও সাগরের তীরে ছোট্ট বাড়ি কিনবে। দু’জন মিলে সুখে-দুঃখে পার করবে বাকি জীবন।

হঠাৎ তীরধনুক ফেলে দৌড়ে এসে রানাকে জড়িয়ে ধরল লিণ্ডা। চুম্বকের মত আটকে গেল দু’জনের ঠোঁট। লিণ্ডা এখনও কর্নেল ব্রাউনের স্ত্রী, পিছিয়ে যেতে চাইল রানা। কিন্তু ওকে সরে যেতে দিল না লিণ্ডা। কী যেন বলছে ওর দুই চোখ। এমন সময় ইয়টের ডেকে বেরোল জন ব্রাউন। হাতে কালো অটোমেটিক পিস্তল। কর্কশ হাসল সে। ভীষণ ভয়ে রানাকে ছেড়ে কয়েক পা সরে গেল লিণ্ডা। ওর বুকে মাযল তাক করল জন ব্রাউন। সঙ্গে অস্ত্র নেই, কী করবে ভাবছে, এমন সময় ঘুম ভাঙল রানার। চোখের পাতায় পড়েছে কড়া রোদ। চট্ করে বুঝে গেল, এখন অন্তত সকাল সাড়ে সাতটা।

পাশের নিচু টেবিল থেকে হাতঘড়ি নিয়ে দেখল, বাজে প্রায় আটটা। নরম্যাণ্ডিতে রানা এজেন্সিতে পৌঁছে হয়তো দেখবে লাঞ্চে বসেছে সবাই।

সোফা ছেড়ে বেডরুমে ঢুকল রানা। বিছানায় এলোমেলো চাদর। ঘরে বা বাথরুমে নেই লিণ্ডা। ড্রইংরুমে গিয়ে ঢুকল রানা। ওখানেও নেই মেয়েটা। পুরো ফ্ল্যাট দেখতে তিন মিনিটও লাগল না ওর। ভাবছে, গেল কোথায়? তখনই মনে পড়ল, নাস্তা তৈরি করবে বলে নিচের দোকান থেকে গ্রোসারি আনবে বলেছিল লিণ্ডা। বেরিয়ে তো গেছে, তারপর বোধহয় ভুলে গেছে কমবিনেশন লকের নাম্বার। ফিরে এসে সিকিউরিটি ডোর খুলতে না পারলেও ফোন আর করেনি ওর ঘুম ভাঙবে বলে। বাইরের করিডোরেই বোধহয় দাঁড়িয়ে আছে বাদামি রঙের কয়েকটা প্যাকেট হাতে। এত দেরিতে উঠেছে বলে লজ্জা পেল রানা। দ্রুত গিয়ে সিকিউরিটি ডোর খুলল। কিন্তু হলওয়েতে কেউ নেই।

আবার ফ্ল্যাটে ঢুকবে কি না ভাবছে রানা, এমন সময় চোখে পড়ল পায়ের কাছে চার ভাঁজ করা ছোট একটা কাগজ। ঝুঁকে ওটা নিল ও। ভাঁজ খুলতেই দেখল হাতের লেখা মেয়েলি। চিঠিতে লিখেছে লিণ্ডা:

রানা,

জানি, খুব রেগে যাবে তুমি। কিন্তু অনেক ভেবে এই পথটাই বেছে নিলাম। লিসা, রাফায়েল আর জ্যাকের সত্যিই সাহায্য দরকার। সেইবার ইয়টে ফিরে যাচ্ছি। জোগাড় করব প্রমাণ। সেটাই ভাল। রাগ কোরো না, প্লিয! আমি তোমাকে ভালবাসি। দুশ্চিন্তা কোরো না। আমি খুব সতর্ক থাকব।

আমার ভালবাসা নিয়ো,
লিণ্ডা।

হঠাৎ করেই নিজের ওপর রেগে গেল রানা। ওর উচিত ছিল আরও সতর্ক হওয়া। লিণ্ডা গিয়ে পড়ছে মহাবিপদে। লিসা স্মিথের কথা মনে পড়তেই তিক্ত হলো ওর মন। ইন্টারপোল এজেন্টের মোটেই উচিত হয়নি লিণ্ডাকে এসবে জড়িয়ে নেয়া। ওদের ভাল করেই জানা আছে, কী করুণ ভাবে মারা গেছে র‍্যাচেল হার্ট!

লিভিংরুমে ফিরে মোবাইল ফোন নিল রানা। লিসা স্মিথের নাম্বারে কল দিতে গিয়েও থেমে গেল। ওর নিজেরই যাওয়া উচিত ওই বাড়িতে। লিণ্ডাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে যাবে নরম্যাণ্ডিতে। এরপর ফিরে প্ল্যান তৈরি করবে চারজন মিলে। দেরি না করে নিজের টুকটাক জিনিস ব্যাগে পুরল রানা। সোফার পাশের টেবিল থেকে নিয়ে কোমরে গুঁজল ওয়ালথার। ব্যাগ কাঁধে তুলে বেরিয়ে এল করিডোরে। সিকিউরিটি ডোরে নতুন কমবিনেশন দিয়ে নেমে এল পাতাল গ্যারাজে। দু’মিনিটও লাগল না র‍্যাম্প বেয়ে উঠে ঝড়ের বেগে রাস্তায় পড়ল ওর মিনি কুপার।

গন্তব্যে দ্রুত পৌছুতে চাইলেও তা সহজ হলো না। সামনের রাস্তায় কাত হয়ে পড়েছে এক ডেলিভারি ভ্যান। অনেকক্ষণ হলো শুরু হয়েছে দীর্ঘ জ্যাম। স্টিয়ারিং হুইলে চাপড় দেয়া ছাড়া উদ্বিগ্ন রানার করার কিছুই নেই। মেজাজটা চড়ে গেল ফরাসি ড্রাইভারদের নানান ধরনের হর্ন শুনে। একটু পর হাজির হলো পুলিশের ক্রেন। পনেরো মিনিট পর আবারও রওনা হতে পারল রানা।

সকাল প্রায় দশটা ছুঁই-ছুঁই করছে হাতঘড়ির খাটো কাঁটা, এমন সময় শহরতলীর ওই বাড়ির সামনে থামল ওর মিনি কুপার। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দরজার কবাটে থাবা দিল রানা।

শেষবার বেশ জোরে। আস্তে করে নিজে থেকেই খুলে গেল কবাট। হলওয়েতে পা রাখল রানা। ভাবছে, ইন্টারপোলের এজেন্টরা জানে ও আসবে, তাই খুলে রেখেছে দরজা। কিন্তু পরক্ষণে ব্যাপারটার অস্বাভাবিক দিকটা চোখে পড়ল ওর। এত অসতর্ক হওয়ার কথা নয় তাদের। হলওয়ে থেকে ডাক দিল রানা, ‘লিণ্ডা? আমি এসেছি!’

কোনও জবাব নেই।

‘লিসা? তোমরা কোথায়? জরুরি কথা আছে।’

প্যাসেজের শেষমাথার দরজার কাছে পৌছে গেছে রানা। কবাট সামান্য খোলা। ভেতর থেকে কোনও আওয়াজ নেই। চিন্তায় পড়ে গেল রানা। এরই ভেতর অন্য কোথাও চলে গেছে সবাই? তা হলে কি স্যান রেমোর দিকে রওনা হয়েছে লিণ্ডা? তাই হবে। ট্রাফিক জ্যামে পড়ে অনেক দেরি করে ফেলেছে ও।

আস্তে করে ঠেলতেই ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজে সরল কবাট। চৌকাঠে দাঁড়াল রানা।

226 ব্লাইও টেনে রাখা বলে ঘর অন্ধকার। কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো রানার

পায়ের নিচে কি পানি?

এল কোথা থেকে?

ছপ-ছপ আওয়াজে দরজার পাশের ইলেকট্রিকাল সুইচ বোর্ডের সামনে থামল। ওখানেই দুই সারিতে সুইচ।

ঘরে কীসের একটা বাজে গন্ধ। পুরনো তামার মত। হঠাৎ ওর মনে পড়ল গন্ধটা কীসের। দ্রুত অন করল কয়েকটা সুইচ। ঘরে জ্বলে উঠল হলদে বাতি। ঘুরে যে দৃশ্য দেখল, অজান্তেই পিছিয়ে গেল রানা। শুকনো গলার কাছে উঠে এল হৃৎপিণ্ড।

আটাশ

ঘরের ভেতর থেকে রানার দিকে চেয়ে আছে লিসা স্মিথ, রাফায়েল ফক্স ও জ্যাক রনসন। মুখ তিনটে হাঁ থাকলেও কথা বলার উপায় নেই কারও। এখন আর ধড় নেই, থকথকে রক্তে ভরা ডেস্কে সারি দিয়ে রাখা হয়েছে জবাই করা তিনটে মুণ্ড। ভিজে চুপচুপ করছে কার্পেট।

ঘরের একপাশে ছড়িয়ে আছে তিন ইন্টারপোলের এজেন্টের বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। বোঝা মুশকিল হাত-পা কোটা কার। ঘরটা যেন হয়েছে কসাইখানা। র‍্যাচেল হার্টের লাশের চেয়েও ভয়ানক অবস্থা মানুষগুলোর।

একবার ঢোক গিলল রানা। ভাবছে এবার কী করবে, এমন সময় পেছনের প্যাসেজে শুনল পদশব্দ। ঘরের আরেকদিকে দরজায় বসানো ঘোলাটে কাঁচ দিয়ে এল সাদা আলো। পেছনে থেমে গেছে পদশব্দ। আস্তে করে খুলে গেল দরজাটা। ধীর পায়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে এল কর্নেল জন ব্রাউন। হাতে কালো রঙের নাইন এমএম সিগ প্রো পিস্তল। ওটা তাক করা রয়েছে রানার হৃৎপিণ্ড বরাবর। নরম সুরে বলল, ‘হ্যালো, রানা।’

‘লিণ্ডাকেও মেরে ফেলেছ?’ জানতে চাইল রানা।

‘জানতে চাইছ আমার প্রিয় স্ত্রীটি ভাল আছে কি না?’ হাসল জন ব্রাউন।

‘হ্যাঁ, যাকে যখন তখন পিটিয়ে জখম করো….

‘কী করবে?’ মাথা নাড়ল ব্রাউন। ‘সেজন্যে খুন করে ফেলবে আমাকে? আমার মনে হয় না সে সাধ্য তোমার আছে।’

কঠোর চোখে তাকে দেখছে রানা।

মুচকি হাসল জন ব্রাউন। ‘দুশ্চিন্তা কোরো না। বেঁচে আছে ও। আপাতত।’

‘কোথায় আছে?’

‘খুব কাছেই,’ বলল জন ব্রাউন। তুড়ি বাজাল দু’বার। জোরে ধাক্কা খেয়ে প্যাসেজ থেকে ঘরের মাঝে চলে এল লিণ্ডা। পড়ে যেতে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে। মুখে লাল প্যাকিং টেপ। চোখে আতঙ্ক। পাশেই ডেস্কের ওপর কাটা তিন মুণ্ড। দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে লিার পেছনে পৌঁছুল দোহারা গড়নের এক লোক। হাতে বড় একটা ছোরা। ওটার ফলা ঠেকাল লিণ্ডার কণ্ঠনালীর ওপর। আগেও তাকে দেখেছে রানা। সেইবার ইয়টের কর্মচারী। লঞ্চের চালক।

‘নিশ্চয়ই মনে আছে গ্যারি স্যাণ্ডার্সকে?’ বলল জন ব্রাউন। ‘আমার বিশ্বস্ত সহযোগী।’

লোকটার মুখ ভাবলেশহীন। চোখে নিষ্ঠুর, শীতল দৃষ্টি।

‘কী, লিণ্ডা, বলিনি রানা আসবে?’ বন্দি স্ত্রীর দিকে তাকাল জন ব্রাউন। পিস্তলের মাযল একতিল নড়ল না বিসিআই এজেন্টের বুক থেকে। ‘তোমাকে হয়তো ভালবাসে না, তবে দায়িত্ব বলে একটা কথা আছে না?’ ঠাট্টা ভরা চোখে রানাকে দেখল সে। ‘ভেবেছিলে ইন্টারপোলের তিন এজেন্টের ব্যাপারে কিছুই জানি না, তাই না? কেন, আমার ওপর না নজর রেখেছে লিণ্ডা! আসলে সবই জানতাম। অসুস্থ বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগেই ওর হাতব্যাগে রেখেছি জিপিএস ট্র্যাকার ও ট্র্যান্সমিটার। ওগুলোর কারণে সহজেই পৌঁছে গেছি এখানে।’

‘যা করেছ, সেজন্যে শাস্তি পাবে,’ বলল রানা। ‘খুঁড়ে নিয়েছ নিজের কবর। এখন দাঁড়িয়ে আছ ওটার কিনারায়।’

‘নিজেকে কী ভাবো, মেজর?’ কঠোর চোখে রানাকে দেখল জন ব্রাউন। ‘ভুলে গেলে আমি কে? তোমার পেটের সব কৌশল হজম করেছি বহু বছর আগে। জেনে রাখো, আজও বেঁচে আছ স্রেফ আমার কারণে।

‘ষোলো সালের এপ্রিল মাসের চার তারিখের কথা বলছ?’ বলল রানা। ‘ভুলি কী করে!’

‘প্রাণে বাঁচতে দেয়াও কিন্তু বাঁচিয়ে দেয়া, রানা,’ বলল ব্রাউন। ‘মনে নেই, হাসপাতালে জ্ঞান ফিরলে পাশে ছিলাম? খারাপ কিছু তোমার মনে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে নাক-মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলতাম। সুতরাং, এটা বলতে পারি, মেরে ফেলিনি বলে তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত আমার প্রতি।’

‘কেন করলে?’ জানতে চাইল রানা। ‘ধরে নিলাম বাংলাদেশের সৈনিকদের মেরেছ নিজের নীচ স্বার্থ উদ্ধার করতে। কিন্তু নিজের দেশের সৈনিকদেরকে খুন করলে কী করে?’

কাঁধ ঝাঁকাল জন ব্রাউন। ‘আমাকে সন্দেহ করেছিল কর্পোরাল অ্যান্ড্রিউ। সে মুখ খোলার আগেই ব্যবস্থা নিয়েছি। নিজের ব্যবসার ওপর হামলা হোক, তা কে চাইবে?’

‘ব্যবসা? অর্থাৎ শত শত মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া?’

‘ক্লায়েন্টদের চাহিদা অনুযায়ী তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করি। আর কিছু না। হাজার হাজার বছর ধরে এই কাজ করেছে বহু অস্ত্র ব্যবসায়ী। আগেও এটা করেছে মানুষ, ভবিষ্যতেও করবে। পড়োনি: যুদ্ধের শেষ দেখবে শুধু মৃতরা।’

‘প্লেটো,’ বলল রানা। ‘ক্লাসিকাল ফিলোযফি কোট করে লাভ নেই। তুমি আসলে সাধারণ এক অস্ত্র চোরাচালানী।’

‘খামোকা আমাকে দোষ দিচ্ছ। আমার বিক্রি করা অস্ত্র দিয়ে মানুষ খুন না করলে, অন্য কারও কাছ থেকে অস্ত্র কিনে ওই একই কাজ করত ওঅরলর্ডরা।’

‘ভাবতে পারিনি তুমি এতটা অশুভ লোক,’ বলল রানা। টিটকারির হাসি ফুটল জন ব্রাউনের ঠোঁটে। ‘কেন, তোমার হাতে মানুষের রক্ত লাগেনি?’

‘দেশের স্বার্থে বা আত্মরক্ষার জন্যে কখনও খুন করেছি। তোমার মত একদল পশুর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিইনি।’

‘আবারও অস্ত্র ধরবে,’ বলল ব্রাউন। ‘তবে এবার তা করবে আমার জন্যে।

লোকটা কী বলতে চাইছে, বুঝতে পারেনি রানা। চুপ করে থাকল।

বাঁকা হাসল ব্রাউন। ‘কথা শুনে অবাক হচ্ছ? তা হলে শোনো, লিণ্ডাকে বাঁচাতে হলে আবার তোমাকে যেতে হবে মিশরে। খুঁজে বের করবে মর্ডাকের সেই গুপ্তধন।’ হাসিটা চওড়া হলো তার। ‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভাল করেই জানতাম লিণ্ডা কী করছে। ভেবেছ, আমার প্রিয় ছেলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তোমাকে পাঠিয়েছি মিশরে? ভুল! ও আমার ছেলে হলে কাজটা নিজেই করতাম। তবে মডাক ছিল আমার প্রথম স্ত্রীর কোনও প্রেমিকের ঔরসে জন্মানো হারামজাদা। কেউ বেইমানি করলে কখনও তাকে মাফ করি না আমি।’

অর্থটা বুঝতে পেরে চমকে গেছে রানা। নিচু গলায় বলল, ‘তার মানে জেনি ব্রাউনকে খুন করেছ তুমি?’

মৃদু মাথা দোলাল জন ব্রাউন। ‘যেদিন জানলাম, গোপনে বছরের পর বছর ধরে ওর প্রাক্তন প্রেমিকের সঙ্গে বিছানায় গেছে, বাচ্চাটা আমার নয়, তার; সেই সপ্তাহেই ওকে বিদায় করলাম। হার্ট অ্যাটাকে মরল। উপায়ই বা কী ওর? ম্যাসিভ অ্যাড্রেনালিন ওভারডোযে দুই সেকেণ্ডে ফুৎ করে নিভে গেল।’ চওড়া হাসল জন ব্রাউন। ‘কুকুরের বাচ্চা মডাককেও সরিয়ে দিতাম। আমার ধারে কাছে এলে মনে হতো হারামজাদাকে খুন করি। তবে অপেক্ষা করলাম সঠিক সময়ের জন্যে। স্থির করেছিলাম, ইয়টে কোনও এক রাতে বেশি মদ গিলিয়ে সাগরে ফেলে দেব। দুঃখজনক মৃত্যু। কিন্তু একদিন জেনে গেলাম গুপ্তধনের হদিস পেয়েছে ও। লক্ষ- কোটি ডলারের। তখন বাধ্য হয়ে বাঁচিয়ে রাখতেই হলো। যখন মিশরে মরল কুকুরের বাচ্চাটা, মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওর জন্যে নয়, গুপ্তধনের হদিস হারিয়ে যাওয়ায়।’

‘তখন আমাকে কাজে লাগাতে চাইলে,’ বলল রানা। ‘মর্ডাকের দুই খুনিকে আমি খুন করলে, তারপর থেকে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে— হয় খুঁজে বের করো গুপ্তধন, নইলে খুনি হিসেবে তোমাকে ধরিয়ে দেব পুলিশে?’

‘নিখুঁত প্ল্যান নয়, স্বীকার করছি,’ বলল ব্রাউন। ‘তারপর তুমি যখন নিজে থেকে আইনের পথে হাঁটলে, বুঝে গেলাম অন্য কোনও উপায়ে তোমাকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিতে হবে। আমি তো অন্ধ নই, রানা। দেখেছি, তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে লিণ্ডা। আর তারপর তুমি চাইলে ওকে নরম্যাণ্ডিতে নিরাপদে কোথাও সরিয়ে দিতে। তখন সুযোগ এল তোমাকে মুঠোয় নেয়ার।’

লিণ্ডার দিকে তাকাল রানা। ওর চোখে চেয়েও চাহনি নিচু করে নিল মেয়েটা। আতঙ্কে মড়ার মত ফ্যাকাসে হয়েছে মুখ। হয়তো ওর সামনেই খুন করেছে তিন ইন্টারপোল এজেন্টকে, ভাবল রানা। বেচারি বুঝে গেছে, এরপর খুন হবে ও।

‘কাজেই, মেজর রানা, এবার তোমাকেই স্থির করতে হবে, বাঁচতে দেবে কি না লিণ্ডাকে,’ বলল জন ব্রাউন। ‘ওকে বাঁচাতে হলে তোমাকে ফিরতে হবে মিশরে মিশন সফল করার জন্যে। যদি পেয়ে যাও গুপ্তধন, প্রাণে বাঁচবে লিণ্ডা। আর তুমি ব্যর্থ হলে, ওকে খুন করব খুব কষ্ট দিয়ে, তারপর ধরব তোমাকে। কাজটা শেষ করার জন্যে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেব আমি, রানা।’

‘মস্তবড় ভুল করছ, জন ব্রাউন,’ চাপা স্বরে বলল রানা। ‘এখনও কিন্তু সময় আছে পালিয়ে বাঁচার।’

‘মস্তবড় ভুল আসলে তুমি নিজে করছ, রানা,’ বলল জন ব্রাউন। ‘তোমার ওপরই এখন নির্ভর করছে লিণ্ডার জীবন- মৃত্যু। তুমি সামান্য এদিক ওদিক পা দিলে সবুজ সঙ্কেত দেব গ্যারিকে। ভুলেও ভেবো না লিণ্ডাকে নিয়ে আমি চলে যাওয়ার পর আমাকে খুঁজে পাবে। দুনিয়ার নানান জায়গায় নোঙর ফেলা বারোটা ইয়টের যে-কোনও একটায় থাকবে ও। কোনও ইয়টে অচেনা কেউ ওঠার চেষ্টা করলেই সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলা হবে ওকে।’

চোখে প্রাণ বাঁচানোর আকুতি নিয়ে রানাকে দেখছে লিণ্ডা। আস্তে করে চোখ নিচু করে নিল। বুঝে গেছে, কারও অন্যায় কোনও দাবি মেনে নেবে না রানা।

লিণ্ডার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে জন ব্রাউনের দিকে তাকাল রানা, নিশ্চুপ।

জ্যাকেটের পকেট থেকে ছোট কী যেন বের করল জন ব্রাউন। আস্তে করে ছুঁড়ে দিল রানার দিকে। খপ করে ওটা ধরল রানা। মুঠো খুলে দেখল ওটা দেড় ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের কমপিউটার পেন ড্রাইভ।

‘মর্ডাকের রিসার্চের সবই ওখানে,’ বলল জন ব্রাউন। ‘এখনও এনক্রিপ করা। ওটার ভেতরে কী আছে, সেটা জেনে নিতে হবে তোমাকেই।’ হাতঘড়ি দেখল অস্ত্র চোরাচালানী। ‘লিণ্ডাকে বাঁচাতে হলে রওনা হও, মেজর। হাতে পাবে পুরো সাতটা দিন। তবে এই এক সপ্তাহের মধ্যে মর্ডাকের গুপ্তধন আবিষ্কার করতে না পারলে ধরে নিয়ো, ভয়ঙ্কর ভাবে মারা গেছে লিণ্ডা।’

‘মাত্র এক সপ্তাহ?’ বলল রানা।

‘পুরো সাত দিন,’ বলল জন ব্রাউন। ‘যথেষ্ট। আমি অধৈর্য মানুষ, রানা। আজও ভাবলে খারাপ লাগে, ব্রিটেনের সেরা আমার ইউনিটের সঙ্গে ড্র করেছে তোমার বাঙালি সৈনিকরা। ধরে নাও, আবারও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছি। আগেও এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছ।

‘তা হলে তো আমার আর কিছুই করার নেই,’ হেরে যাওয়া সুরে বলল রানা। ভাবছে, জন ব্রাউন গুলি ছোঁড়ার আগেই ঝট করে ওয়ালথারটা বের করতে পারব? লিণ্ডাকে আগে বাঁচাতে হবে। প্রথমে গুলি করব গ্যারি স্যাণ্ডার্সকে, তারপর জন ব্রাউনকে।

চকচকে চোখে ওকে দেখছে অস্ত্র ব্যবসায়ী। ‘গভীরভাবে তোমাকে পর্যবেক্ষণ করেছি, রানা। তুমি আমার ছেলে হলে ধন্য হতাম। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, কী ভাবছ। ওই যে, কোমরের কাছে একটু ফুলে আছে। ওটা একটা ওয়ালথার পিপি। ভাবছ বিদ্যুদ্বেগে বের করবে।’ মাথা নাড়ল সে। ‘চেষ্টা করে দেখতে পার, তবে কাজটা ভুল হবে, রানা। আমি অত বড় গাধা নই যে গুলি করতে দ্বিধা করব।’ বামহাতে জ্যাকেটের পকেট থেকে দীর্ঘ নলওয়ালা অদ্ভুত এক পিস্তল বের করল ব্রাউন। ‘ভাবছ, তোমাকে কোনও ঘরে আটকে রাখলে, বা বেঁধে রেখে গেলে কোনও এক কৌশলে ছুটে যাবে? তারপর পিছু নেবে আমার? না, রানা, আসলে সে উপায় নেই।’

পিস্তলটা চিনেছে রানা। সিও২-প্রপেল্ড ট্র্যাংকুইলাইযার ডার্ট গান। মন দমে গেল ওর। বুঝে গেছে, বেরোতে পারবে না এই ফাঁদ থেকে। উপায় নেই লিণ্ডাকে সাহায্য করার।

‘তুমি যখন ঘুম থেকে উঠবে, আমরা তখন বহু দূরে,’ বলল জন ব্রাউন। ‘ডেস্কে পাবে দরকারি সবকিছু। আনন্দময় হোক তোমার মিশর ট্রিপ।’ মুখ বাঁকিয়ে হাসল সে, ‘মোবাইল ফোনে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে। আপাতত বিদায়, রানা।’

ধীরেসুস্থে ডার্ট গান তাক করল জন ব্রাউন।

আড়ষ্ট হয়েছে রানার প্রতিটি পেশি। চট্ করে একবার দেখল লিণ্ডাকে। ওর দিকেই করুণ চোখে চেয়ে আছে মেয়েটা। খুক করে কেশে উঠল জন ব্রাউনের হাতের পিস্তল।

ঘাড়ে তীক্ষ্ণ ব্যথা পেল রানা। চারপাশ থেকে হুড়মুড় করে এল একরাশ কালো আঁধার। হঠাৎ করেই মনে হলো হালকা হয়েছে ওর দেহ। রানা জানল না, এইমাত্র মানুষের রক্তে ভেজা কার্পেটে মুখ থুবড়ে পড়েছে ও।

ঊনত্রিশ

অদ্ভুত ঘোরের ভেতর ভাঙল রানার ঘুম। এইমাত্র কুচকুচে কালো আঁধার এক কূপ থেকে উঠেছে। আস্তে করে চোখ মেলল। ঘরের ভেতর হলদে বাতির ম্লান আলো। শক্ত কী যেন খড়-খড় করছে পিঠে। ব্যথা লাগতেই ডানহাত নিল ঘাড়ে। আঙুলে ঠেকল ফোলা একটা জায়গা। চারপাশে চোখ যেতেই মনে পড়ল কোথায় আছে। চট্ করে হাতঘড়ি দেখল রানা। প্রায় আড়াই ঘণ্টা অচেতন ছিল। এখন দুপুর প্রায় একটা।

এখন আর ওর নিচে রক্তাক্ত কার্পেট নেই। মেঝে কাঠের অমসৃণ তক্তা দিয়ে তৈরি। বেশিরভাগ আসবাবপত্র উধাও। অবশ্য রয়ে গেছে ডেস্ক। ওটার ওপর কাটা মুণ্ডগুলো নেই। নিজের উপস্থিতি চমৎকার ভাবে আড়াল করেছে জন ব্রাউন। নাকের কাছে হাত নিতেই সাবানের গন্ধ পেল রানা। অজ্ঞান অবস্থায় স্পঞ্জ করে ওর দেহ থেকে মুছে ফেলা হয়েছে সব রক্ত।

জানালা দিয়ে ঢুকছে পোড়া গন্ধ। উঠে গিয়ে ব্লাইও সরিয়ে দিল রানা। বাড়ির পেছনে জংলা বাগান। একটু দূরে বাড়ির বাউণ্ডারি ওয়াল। বাগানের মাঝে জ্বেলে নেয়া হয়েছে আগুনের বড় কুণ্ড। এখন নিভে যাচ্ছে। প্রায় ছাই হয়েছে আসবাবপত্র ও মোড়ানো কার্পেট।

জানালা থেকে সরে ডেস্কের সামনে থামল রানা। কোমরে হাত দিয়ে টের পেল, ওয়ালথারটা আর নেই। ডেস্কের ওপর মাত্র দুটো জিনিস। প্রথমটা সেই কমপিউটারের পেন ড্রাইভ। দ্বিতীয়টা ছোট একটা থলে। মুখ খোলা বা বন্ধ করা যায় সুতলি ব্যবহার করে। থলের ভেতরে হালকা কোনও জিনিস। সুতলি খুলে ভেতরে উঁকি দিল রানা। দুই বাণ্ডিল ব্যাঙ্ক নোট। প্রথম বাণ্ডিলে অন্তত এক হাজার ইউরো। দ্বিতীয়টাতে দশ হাজার ইজিপশিয়ান পাউণ্ড। সবদিকেই খেয়াল রেখেছে জন ব্রাউন।

কিছুক্ষণ ডেস্কের সামনে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল রানা। বুঝতে পারছে, লিণ্ডাকে বাঁচাতে চাইলে মেনে নিতে হবে ব্রাউনের কথা। সাধারণ কিডন্যাপার নয় এসএএস কর্নেল। ভাল করেই জানে, এরপর কী করবে রানা। শ্বেতাঙ্গ কোনও এজেন্ট হলে হয়তো চরম নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিত— মরলে মরুক মেয়েটা, ওর কী!

কিন্তু রানার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।

কয়েক হাজার বছর আগের গুপ্তধন খুঁজে বের করতে হাতে পাবে মাত্র সাত দিন। অথচ, এটাই জানা নেই কাজ শুরু করবে কোথা থেকে। প্যান্টের পকেটে মোবাইল হার্ড ডিস্ক রাখতে গিয়ে টের পেল, এখনও রয়ে গেছে গাড়ির চাবি। হালকা থলেটা হাতে বাড়ি থেকে বেরোল ও।

গলি ফাঁকা। থমথম করছে চারপাশ।

গাড়ির পাশে থেমে লক খুলে ব্যাক সিটে ওভারনাইট ব্যাগের পাশে সুতলিওয়ালা থলে রাখল রানা। ড্রাইভিং সিটে উঠে আটকে নিল দরজা। ধীর গতি তুলে আবারও ফিরল সেফ হাউসের নিচের গ্যারাজে।

কাটছে না সিও২-প্রপেল্ড ট্র্যাংকুইলাইযার ডার্টের ঘোর। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকল। বেশ কিছুক্ষণ পর পকেট থেকে নিল মোবাইল হার্ড ডিস্ক। ওটা একদম নতুন ও অত্যন্ত আধুনিক। রায়হান রশিদকে দেয়া যেতে পারে। ফাইল থেকে তথ্য জানতে হয়তো লাগবে দিনের পর দিন। তারপর ওই তথ্য দিয়ে কী করবে ও? তাতে কার কী লাভ? অনেক আগেই খুন হয়ে যাবে লিণ্ডা।

হাতে মাত্র সাতটা দিন!

হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তেই চমকে গেল রানা। পরক্ষণে ওর মনে হলো, ও যেন ভেসে থাকতে চাইছে খড়কুটো ধরে।

মর্ডাকের ব্লেয়ারের পকেটে ছিল সেই কাগজ। গ্রোসারি স্টোরের রিসিট। ওপরে ছিল ফোন নাম্বার। তখন মনে হয়েছে অপ্রয়োজনীয়। ফলে একদম ভুলে গিয়েছিল। তবে এখন মনে হচ্ছে, কাজেও তো লাগতে পারে!

কী যেন ছিল নাম্বার?

মনে করার চেষ্টা করল রানা। নিজের ওপর রেগে যাচ্ছে।

নাম্বারটা ছিল ব্রিটিশ ল্যাণ্ড ফোনের।

কিন্তু আর কিছুই মনে নেই!

মর্ডাকের ওই অ্যাপার্টমেন্টের দৃশ্য মনে করতে চাইল রানা।

ব্লেয়ারের বুক পকেট থেকে পড়ল কোঁচকানো কাগ ওপরে লেখা এরিয়া কোড।

এক্সটেনশন নাম্বারও ছিল।

উত্তেজিত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল রানা। গ্যারাজের ভেতর শুরু করল পায়চারি। একবার চলে যাচ্ছে পাতালঘরের শেষমাথায়, আবারও ফিরছে র‍্যাম্পের মুখে। ওপরের খোলা দরজা দিয়ে আসছে কড়া রোদ। বাতাসে ভাসছে হাজার কোটি ধূলিকণা। ওগুলোর দিকে চেয়ে হঠাৎ করেই ওর মনে পড়ল কয়েকটা নাম্বার: ৪৩৫।

হ্যাঁ, এটাই তো মনে হয় সেই এক্সটেনশন!

গাড়ির পাশে থেমে গ্লাভ্স্‌ কম্পার্টমেন্ট থেকে কলম ও প্যাড নিয়ে দ্রুত নাম্বারটা লিখল রানা।

কিন্তু এরিয়া কোড মনে নেই!

নিজেকে ধমক দিল রানা— বন্ধুরা বলে তোর নাকি ফোটোগ্রাফিক মেমোরি? নাহ্, তুই আসলে একদম গাধা!

বসে পড়ল ড্রাইভিং সিটে। চোখ বুজে ভাবতে চাইছে। জন ব্রাউনের ডার্টের কড়া ওষুধের প্রভাব তো আছেই, তার ওপর বেশি ভাবতে গিয়ে কেমন ঝিম মেরে গেল মাথাটা।

পেরিয়ে গেল প্রায় আধঘণ্টা।

বারবার মনের আয়নায় দেখা দিল অসহায় লিণ্ডা। করুণ মুখ। যেন নীরবে জানতে চাইছে: বাঁচাতে পারবে, রানা? পারবে তো? নইলে মেরে ফেলবে আমাকে পাষণ্ডটা!

‘ভয় নেই,’ বিড়বিড় করল রানা। ‘একটু অপেক্ষা করো।’

আবারও পেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ।

কিছুতেই মনে পড়ছে না এরিয়া কোড। অস্থির লাগছে রানার।

আবারও গাড়ি থেকে নেমে পায়চারি করবে কি না ভাবছে, এমন সময় হঠাৎ করেই ওর মনের পাতায় ভেসে উঠল এক সারি নাম্বার।

চট করে রানা টের পেল, ওগুলোই সেই এরিয়া কোড!

হ্যাঁ, ০১৩৩৪!

পিঠ সোজা করে সিটে বসল রানা। মোবাইল ফোন বের করে এরিয়া কোড লিখে কল দিল।

পর পর ছয়বার রিং হওয়ার পর মনে মনে হাল ছেড়ে দিল। না, এটা কোনও জরুরি ফোন নাম্বার নয়।

কায়রোর ওই ইউরোপিয়ান ড্রাগ অ্যাডিক্ট মেয়েটা হয়তো কোনও ছেলেবন্ধুর ফোন নাম্বার লিখেছে।

ভীষণ হতাশ লাগছে রানার।

অবশ্য, নবম রিঙে খুট শব্দে চালু হলো অ্যান্সারফোন মেশিন। রানা শুনল নারী কণ্ঠ: ‘ইউনিভার্সিটি অভ সেইণ্ট অ্যান্ড্রিউ, ফ্যাকাল্টি অভ হিস্ট্রি। এক্সটেনশন নাম্বার আপনার জানা থাকলে সেটা ডায়াল করুন। নইলে, প্লিয, অপেক্ষা করুন অপারেটরের জন্যে।’

ওটা কায়রোর ড্রাগ অ্যাডিক্ট মেয়েটার কণ্ঠস্বর বলে মনে হলো না রানার। এক্সটেনশন নাম্বার দিয়ে অপেক্ষা করল। কয়েকবার রিং হওয়ার পর দায়িত্ব নিল আরেকটা অ্যান্সারফোন। ‘হাই, আপনি কল করেছেন ডক্টর উইলিয়াম কেন্সিংটনের ভয়েসমেইল-এ। তবে আপাতত অফিসে নেই আমি। দয়া করে মেসেজ দিয়ে রাখুন। পরে…’

বিইপ শব্দে লাইন কেটে যাওয়ার আগেই কল কেটে দিল রানা। এখন ভাল করেই জানে, ওই নাম্বার কার। এবার হয়তো পাওয়া যাবে জরুরি কোনও তথ্য। অথবা, কিছুই না।

সিটে হেলান দিয়ে বসে ইন্টারনেটে সার্চ দিল রানা- ডক্টর উইলিয়াম কেন্সিংটন, সেইণ্ট অ্যান্ড্রিউ ইউনিভার্সিটি।

ফোনের সার্চ ইঞ্জিন সরাসরি ওকে পৌছে দিল ফ্যাকাল্টি অভ হিস্ট্রির ওয়েবসাইটে। খুঁজতেই দেখল স্টাফদের ডিরেক্টরির নিচের অংশে রয়েছে উইলিয়াম কেন্সিংটন। নামের ওপর ক্লিক দিতেই বেরোল থামনেইল ফোটো। নিচে দুই লাইনের বায়োডেটা। ছবি ফোলা চেহারার এক লোকের। সকালে শেভ করেনি। কালো লম্বা চুলগুলো এলোমেলো। প্রায় ঢেকে ফেলেছে দুই ভুরু।

এই লোক সাহায্য করতে পারবে? – আনমনে ভাবল রানা। কয়েক মুহূর্ত ভেবে আবারও কল দিল উইলিয়াম কেন্সিংটনের ফোনে।

এবার আর জবাব দিল না অ্যান্সারফোন। সরাসরি বাজছে ওপ্রান্তের ফোন। পেরোল প্রায় একমিনিট। কল কেটে দেবে ভাবছে রানা, এমন সময় কল রিসিভ করল কেউ। হাঁপাচ্ছে সে। দৌড়ে এসেছে দূর থেকে।

‘ডক্টর কেন্সিংটন?’ বলল রানা।

‘বলছি,’ ফোঁস-ফোঁস করে শ্বাস ফেলছে লোকটা।

‘ডক্টর উইলিয়াম কেন্সিংটন?’

‘হ্যাঁ, আমিই,’ খুশি-খুশি স্বরে বলল ইতিহাসের ডক্টর। ‘বলুন, আপনি কে?’

‘আপনি আমাকে চিনবেন না। কল করেছি মর্ডাক ব্রাউনের ব্যাপারে…

কেটে দেয়া হয়েছে লাইন।

লোকটার অভদ্রতা দেখে রেগে গেল রানা। আবারও কল দিল। এবার দু’বার বাজার পর রিসিভার তুলল কেন্সিংটন।

‘লাইন কেটে গিয়েছিল,’ বলল রানা।

‘না, আমিই কেটে দিয়েছি,’ এখন আর ডক্টরের গলায় ফুর্তি নেই।

‘জানতে পারি, কেন কেটে দিয়েছেন? আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।’

‘ফোন রেখে দিয়েছি, কারণ মডাক ব্রাউন নামের কাউকে আমি চিনি না।’

‘অথচ ঠিকই মনে রেখেছেন তার নাম।’

‘দেখুন, আপনি কে সেটা আমি জানি না। কী চান সেটাও জানা নেই।’ লোকটার কণ্ঠে চাপা আতঙ্ক। ‘আমার মনে হয় আপনি ভুল নাম্বারে কল দিয়েছেন।’

‘ঠিক নাম্বারেই ফোন করেছি। কেন আলাপ করতে চাই, সেটা খুলে বললে সবই বুঝতে পারবেন। বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ।’

ওপ্রান্তে চুপ করে আছে লোকটা। প্রায় তিরিশ সেকেণ্ড পর বলল, ‘আপনাকে বলার মত কিছুই নেই আমার। জীবনে কখনও শুনিনি মর্ডাক ব্রাউনের নাম।’ আবারও রিসিভার নামিয়ে রাখল উইলিয়াম কেন্সিংটন।

রানা বিড়বিড় করল, ‘বেশ। তুমি খেলতে চাইলে আমারও আপত্তি নেই।’ একবার মোবাইল ফোনটা দেখে নিয়ে ব্রিটেনের ম্যাপ বের করল। দ্রুত জেনে নিল, স্কটল্যাণ্ডের পুব উপকূলে এডিনবার্গ শহর থেকে উত্তর দিকে কোথায় সেইন্ট অ্যান্ড্রিউ ইউনিভার্সিটি।

মোবাইল ফোন পকেটে রেখে মনে মনে বলল রানা, ‘বড়জোর কয়েক ঘণ্টা লাগবে পৌঁছুতে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *