গাত্রহরিদ্রা – ৯

এখন পড়ন্ত বিকেল। উঠোনের তেঁতুল গাছের তলায় শতরঞ্চি বিছিয়ে গোপাল মনোহর, মন্দাকিনী ও আহিরার বৈকালিক চায়ের আসর বসেছে। চা-পর্বের মাঝামাঝি সময়ে মন্দাকিনী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। মেয়ের কথা মতো অনেকটা সময়েই ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে এই মুহূর্তে ভেঙে পড়লেন। তবে মন্দাকিনী কোনোরকম ভূমিকা না করে একেবারে সোজাসুজি বলে বসলেন, তোমার সঙ্গে আমাদের অনেক কথা আছে।

‘আমাদের’। হালকা মেজাজে গোপাল মনোহর জানতে চাইলেন, তার মানে আহিরারও?

হ্যাঁ, আমারও। আহিরা পরিস্থিতিকে সহজ, স্বাভাবিক রাখতে মৃদু হেসে বাবার মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি কখনও কলকাতায় ছিলে?

মাছকে ডাঙায় তুললে যে অস্বস্তি, গোপাল মনোহরের এখন ঠিক সেই অবস্থা! উদাসী বাউলের শূন্যতা তাঁর দুই চোখে। সঙ্গে এক মহা বিস্ময়ের ঘোররেখা। যে ঘটনা স্ত্রী এবং মেয়ের জানার কথা নয় অর্থাৎ তিনি যেটা কখনও খুলে বলেননি তা এরা জানলো কী করে? নিঃশব্দের কবরে শায়িত মৃতদেহে প্রাণের সঞ্চার কি সম্ভব? গোপাল মনোহর পরিষ্কারই বুঝতে পারলেন, দীর্ঘ আঠাশ-তিরিশ বছর ধরে যে কথাটা তিনি সযত্নে এবং অতি সতর্কভাবে লুকিয়ে রেখেছিলেন তা আজ প্রকাশিত। তাঁর এই ক’দিন বাড়িতে না থাকার ফলে নিশ্চয়ই কোথাও কোনো ঘটনা ঘটে গেছে। ওই জিজ্ঞাসা তারই প্রতিচ্ছবি। তিনি মেয়ের দিকে চেয়ে চিন্তার ঢেউ তুললেন কপালে। ভ্ৰূ দুটোও ছোট হয়ে এলো। কারও মুখেই কোনো কথা না থাকার ফলে যেন প্রত্যেকেই উপলখন্ডে বসে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। ‘হ্যাঁ’ করার ভঙ্গিতে গোপাল মনোহর প্রথমে মাথাটা নাড়ালেন। তারপর কঠিন গলায় বললেন, আমি কলকাতায় আড়াই বছর চাকরি করেছিলাম।

আমাদের তো তুমি কোনো দিনই সেটা বলোনি। মন্দাকিনী স্বামীর চোখে চোখ রেখে স্থির এক দৃষ্টি নিয়ে অস্ফুট সুরে বললেন, আমরা তোমার কেউ নই?

কলকাতার ব্যাপারটা আমি সারা জীবনের জন্য ভুলে থাকতে চেয়েছিলাম। গোপাল মনোহর ঋজু গলায় উত্তর দিলেন, না বলার পেছনে পাপ নেই, মানে আমার নিজের কোনো অপরাধ ছিল না। ছিল বিশ্বাস, মূল্যবোধকে মাড়িয়ে এগিয়ে চলার এক সর্বনাশের খেলা। আমি সেখানে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত, বিধ্বস্ত। আর এটা তো জানা কথা, পরাজিত মানুষের কথা কেউ কখনও শুনতে চায় না। সামান্য একটু চুপ করে থেকে গোপাল মনোহর স্ত্রী এবং মেয়ে দু’জনকেই যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করে অবশেষে জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু ব্যাপারটা কী বলো তো?

কলকাতা থেকে একটা ছেলে এসেছে। আহিরা বাবাকে পুরো ছবিটা তুলে ধরার চেষ্টায় যথাসম্ভব নিখুঁতভাবে বলে উঠলো, ওর নাম সাত্যকি মৈত্র। প্রথমে আমাদের বিজয়ওয়াড়ার পট্টভিনগরের বাড়িতে গিয়েছিল। না পেয়ে সেখান থেকে আবার চলে এসেছে এখানে। আমাদের বাড়িতে ইতিমধ্যে সে দু’বার এসেছে তোমার খোঁজে। সাত্যকি তোমার সঙ্গে দেখা করবেই করবে। ও আসলে ওর বাবার কী একটা নির্দেশ নিয়েই ….

নির্দেশ টির্দেশের কথা কিছু বলেছে? গোপাল মনোহরের গলাটা হঠাৎ যেন দ্বিগুণ মোটা হয়ে গেল।

আহিরা প্রতিটা কথা কেটে কেটে বললো, তার মুখে সারাক্ষণ ওই একটাই কথা, ‘বাবার কথা মতো এখানে এসেছি জি. এম, বালযোগীর সঙ্গে দেখা করতে। সুতরাং সমস্ত কথা বা ঘটনা শুধু তোমাকেই বলবে। আমাদের ওর থেকে বেশি যেমন কিছু জানায়নি, আমরাও শুনবার কৌতূহল বা আগ্রহ দেখাইনি। তুমি বাড়িতে নেই এই অবস্থায় তাকে আর যাই হোক অতিরিক্ত প্রশ্ন করাটাও তো ঠিক হতো না।

.

সাত্যকি মৈত্র নামের ছেলেটি তা হলে নিখিলের ছেলে। গোপাল মনোহর এমনও ভাবলেন ওর সঙ্গে দেখা করবেন না। কারণ নিখিলের প্রতিনিধি হয়ে ও যা বলতে এসেছে, নতুন করে সে সব শোনার আর ইচ্ছে নেই। জীবনের প্রথম অধ্যায়ের সেই পৃষ্ঠাটা গোপাল মনোহরের ফিরে পাওয়ার বিন্দুমাত্র বাসনাও নেই। সুতরাং ওসব নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করে কী লাভ? তবে এতো বছর বাদে হঠাৎ নিখিল কেন তার ছেলেকে পাঠালো? জীবনের শেষ বেলায় এসে কি সে একটু অনুতপ্ত? হতে পারে। এবং সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। কেন না স্বেচ্ছায় অন্যায় করলে ওই ধরনের অনুশোচনা আসতেই পারে। গোপাল মনোহর নিশ্চিত, নিখিল যন্ত্রণার সেই গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নিজের ক্ষমতা নেই, সামনে এসে দাঁড়ানোর সেই সাহসও নেই, তাই নিষ্পাপ ছেলেটাকে শান্তির জন্য সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে পাঠিয়েছে। এ ছাড়া আর কোন মহান-উদ্দেশ্যে নিখিল এতোটা মরিয়া হয়ে উঠবে? সুদীর্ঘ আঠাশ, তিরিশ বছর বাদে সে নিশ্চয়ই বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা জানাতে ছেলেকে পাঠায়নি। সে এখন স্রেফ ক্ষমা চাইছে। এ ছাড়া অন্য আর কিছুই হতে পারে না। হওয়ার রাস্তাও নেই। কিন্তু গোপাল মনোহর সেদিনের সেই ঘটনার কোনো কিছুই ভোলেননি। ভুলতে পারেননি। এবং বাকি জীবনেও ভোলা সম্ভব নয়।

আগের রাতে ঘুম হয়নি, আজও ঘুম আসছে না। আহিরা দু’চোখের পাতা এক করতে পারলো না। কলকাতার ব্যাপারটা বাবা যেটুকু বলেছেন সেটা ভাসা-ভাসা এবং মুখবন্ধের আকারে সামান্য একটু চুম্বক। ভেতরের কোনো কিছুই খোলামেলাভাবে তুলে ধরা হয়নি। সেটা হয়তো জানা যেতে পারে সাত্যকি এসে বাবার মুখোমুখি হলে। কিন্তু সেই ছেলেটাই তো আজ এলো না। আহিরা অবশ্য একটা নাটক দেখার আকাঙ্ক্ষায় সাত্যকির উপস্থিতির জন্য বিন্দুমাত্র উদ্‌গ্রীব নয়। সে আসলে ওর না ফেরার ব্যাপারটা নিয়েই বড়ো বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছে। ছেলেটা তাকে বাসে তুলে দিয়ে বারবার জানিয়েছিল, ‘আমি কাল সকালেই পৌঁছে যাবো।’ সেই সকাল শেষ হয়ে দিনটাও ডুবে গেল। সে এলো না।

একটা কথা ভেবে আহিরার বেশ অবাক লাগছে। সে কিন্তু সাত্যকির ওই ‘সকাল- সকাল আসা ছাড়া’ দ্বিতীয় অন্য কোনো চিন্তা-ভাবনার মধ্যে বিশেষ ঢুকতেই পারছে না। এক ঘেয়ে একটা বিষয় নিয়েই সারাক্ষণ পড়ে আছে। সমস্যাটা হলো, সে কেন অন্য নতুন কোনো আলোচনার পথ খুঁজে পাচ্ছে না? একটা ব্যাপার নিয়েই আর কতো ভাববে? তবে অন্তত দুটো দিন তাদের বাড়িতে আসার পরিপ্রেক্ষিতে ওর দায়িত্ব কি তারা এড়াতে পারে? অথচ ‘সাত্যকির খোঁজে চললাম’ এই কথাটা বলেও বাড়ি থেকে বেরুনো যাচ্ছে না। আবার নিঃশব্দে বেরিয়ে গিয়ে রামেশ্বরমে পৌঁছানোটাও যুক্তির দিক দিয়ে বা শোভনতার দিক দিয়ে খুব একটা সমর্থনযোগ্য নয়। আহিরার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয় শুধু বাড়িতে বসে একরাশ উথালি- পাথালি ভাবনার চাপে পিষ্ট হওয়া ছাড়া।

.

চাঁদের আলো এসে আহিরার ঘরখানাকে ভাসিয়ে দিচ্ছিলো। সে জানালার ফাঁক দিয়ে নীলাভ দ্যুতি ছড়ানো আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। বিরাট হৃদয়ের আকাশটা যেন আহিরাকে কাছে ডেকে সখ্যতা পাতাতে চাইছে। উতলা এই রাতে তার নীরব মনে শুধু একটাই প্রার্থনা সাত্যকির যেন কিছু না হয়। আসলে ওর ভেতরে একটা অলক্ষুণে চিন্তার জট পাকিয়ে গেছে। উঠতি মাস্তান চারজন পরে ওকে একা পেয়ে কোনো ঝামেলা বাধায়নি তো? সেই সম্ভাবনা কিন্তু একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে আহিরা মন থেকে সে সব চিন্তা একেবারেই তাড়িয়ে ছাড়লো। সুস্থ শরীরে সাত্যকি যে আবার ফিরে আসে তাদের এই বাড়িতে। আহিরা তার হাত দু’খানা সামনের দিকে মেলে ধরলো। সবুজ রংয়ের মাখামাখিতে কাচের চুড়ির এক অপূর্ব ছটা। ঢেউ খেলানো সেই সবুজ হাতের দিকে তাকিয়ে সে নিজে নিজেই বিহ্বল হয়ে উঠলো। সাত্যকি মৈত্র নামে কলকাতার ছেলেটা এই দু’দিনে যেটুকু আন্তরিকতা ও অনুভবের ছোঁয়া রেখেছে, পরিচয় রেখেছে তাতে তাকে শুধু ভদ্র বললে খুব কম বলা হবে। সাত্যকি আসলে প্রাণশক্তিতে ভরপুর এক স্নিগ্ধ রুচির যুবক। এবং কী আশ্চর্য! আহিরা তো ওর সম্পর্কে আগের রাতেও এমনই সব ভেবেছে! ঘুরে ফিরে বারবারই একই দরজায় মাথা ঠোকানো কেন?

ঘুম নেই গোপাল মনোহর বালযোগীর দুই চোখেও। আজকের রাতটা যে তিনি ঘুমাতে পারবেন না এটা তো জানা কথা। মন্দাকিনী কী গভীর নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে! ঘুমন্ত মানুষকে দেখলে খুব মায়াবী লাগে। গোপাল মনোহর খুব আস্তে দরজা খুলে এসে বসলেন। আসলে বদ্ধ ঘরের মধ্যে নিজেকে তিনি আটকে রাখতে চাইলেন না। জ্যোৎস্নার ফিনফিনে আলোয় প্রকৃতি তখন ভেসে যাচ্ছে। চারদিকে আশ্চর্য এক মৌনতার তপস্যা। গাছ-গাছালির গন্ধে বিশেষ করে নিমফুলের গন্ধে সুমিঠ্‌ঠাগুরমের বাতাস ভরে উঠেছে। প্রকৃতির এই অকৃপণ মেজাজকে ধরে রেখে গোপাল মনোহরও উদাসী হয়ে উঠলেন। কলকাতার ছবিটা একটু একটু করে তাঁর দুই চোখে ফুটে উঠছে। স্মৃতির সেই পাতাগুলো এতো গভীরে এবং এতো যত্নে ছিল যে মনে হয় না সে সব আঠাশ, তিরিশ বছর আগের ঘটনা। মানুষ সম্ভবত বেদনার ঝাঁপিটাকে উপেক্ষা করতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *