৮
একটু বেলাবেলিই বাড়ি ফিরলেন গোপাল মনোহর বালযোগী। বেলা বলতে একটা সওয়া-একটা হবে। মন্দাকিনী আর আহিরা পায়ে-পায়ে এগিয়ে যেতেই গোপাল মনোহর মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে পরম স্নেহে ওর মাথার ঘন কৃষ্ণ চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিলেন। কাঁচা-পাকা কদম ছাঁট চুলের সুঠাম শরীরের মানুষটা হাসতে হাসতে বললেন, আহিরা আনেক্কাপল্লীতে থাকলে অন্য কথা। কিন্তু মেয়েটা আমার বাড়িতে এলো আর আমিই বাড়ি ছাড়া হলাম—সমস্ত কাজের মধ্যেও মনটা সারাক্ষণই উন্মুখ হয়েছিল শুধু এই ফিরে আসার জন্য।
ছোট্ট মেয়ের মতো বাবার আদর পেয়ে খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠলো আহিরা। কিন্তু প্রাথমিক কর্তব্যটুকু সে ভুলে গেল না। প্রথমেই রান্নাঘরে ছুটে গিয়ে বাবার জন্য এক গেলাস জল নিয়ে এলো। গোপাল মনোহরের ছাড়া জামা ও গেঞ্জিটা ঘরে নিয়ে গেল। দাওয়ায় ফিরে এসে বললো, বাবা তোমাকে এখন স্নানের জল তুলে দিই?
তোলাতুলির আর কী আছে রে আহিরা? গোপাল মনোহর চমৎকার হাসি ছড়িয়ে বললেন, আমি তো কূয়োতলাতে যাবোই। দু’বালতি জলও কী তুলে নিতে পারবো না? আমাকে এখনও অতোটা কুঁড়ে বা বুড়ো কোনোটাই ভাবিস না। তারপরেই পরিতৃপ্তির সঙ্গে আরও উচ্চারণ করলেন, অবশ্য তুই বাড়ি এলে আমাকে ওই কাজটা থেকে একেবারেই অথর্ব করে দিস।
ওই সময়ে মন্দাকিনী স্বামীকে কিছু একটা বলবার জন্য উসখুস করছিলেন। মা যে এখন সংসারে এটা লাগবে, ওটা কিনতে হবে বলে কোনো আলোচনার মধ্যে ঢুকবেন না তা তো জানা কথা। মন্দাকিনী কোন কথাটা বলার জন্য উদ্গ্রীব সেটা বোঝার জন্য পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই। আহিরা ঠিকই অনুমান করতে পেরেছে। আর এখানেই তার আপত্তি। বাবা ব্যবসার কারণে এই ক’দিন বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করে সবে বাড়ি ফিরেছেন। এই সময়ে সাত্যকি সংক্রান্ত কোনো কথা বলাটা কি ঠিক? বাবা স্নান-খাওয়া সেরে নিয়ে আগে একটু বিশ্রাম নিন। তারপরে না হয় ধীরে সুস্থে বলা যাবে। আহিরা তাই একটু ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে উঠলো, মা তুমি ততোক্ষণে বাবার ভাতটা বাড়তে থাকো। আমি আসন পেতে দিচ্ছি। তারপরেই গোপাল মনোহরের দিকে চোখ ফিরিয়ে হেসে ফেললো। আদুরে গলায় জানতে চাইলো, বাবা তুমি কি এই দাওয়ায় বসে বসেই স্নান করবে?
ইঙ্গিতটুকুর মধ্যে না বোঝার কিছু নেই। গোপাল মনোহর মেয়ের ওই ধরনের আধিপত্যপূর্ণ শাসনকে না মেনে পারেন না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন, এই যাই মা। এরপরেও না উঠে উপায় আছে? দাওয়াতে টানানো দড়ির ওপর থেকে গামছাটা তুলে নিয়ে গোপাল মনোহর প্রশান্ত হাসি নিয়ে উঠোনে নামতে নামতে বললেন, আমার আহিরা মায়ের মতো মা আর কটা ঘরে আছে! কিন্তু তোরা আমাকে আজ যেন বড়ো বেশি তাড়া লাগাচ্ছিস। কেন রে? তা ছাড়া একটু আগেই বললি আমার আসন পেতে দিবি, তোর মা’ও যেন ভাত বাড়তে থাকে—এ সবের মানে কী? আমি একা একা তোদের ফেলে রেখে কবে খেয়েছি? দুটো দিন বাড়ি ছিলাম না তাতেই আমাকে আলাদা দৃষ্টিতে দেখা শুরু করে দিলি?
ওই সময়ে নীরবে এবং সন্তর্পণে মা ও মেয়ের একবার চোখাচোখি হয়ে গেল। আহিরার হঠাৎ মনে হলো, তারা কি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ব্যস্ততা দেখিয়ে নিজেদের আগেভাগে প্রকাশ করে ফেলেছে? বাবার সন্দেহ বাড়ানো ঠিক নয়। এই মুহূর্ত থেকেই আরও স্বাভাবিক হতে হবে। এবং আরও সংযত। আহিরা মৃদু হেসে পরিস্থিতির সামাল দিতে বলে উঠলো, খাবো তো এক সঙ্গেই কিন্তু তোমাকে আগে স্নানে না পাঠালে সেটা সম্ভব কী? আর একবার যদি গল্পে বসে যাও তোমাকে ওঠানো যাবে?
সেটা অবশ্য ভুল বলিসনি। গোপাল মনোহর হাসতে হাসতে কূয়োতলার দিকে পা বাড়ালেন।
মন্দাকিনী চলে গেছেন রান্নাঘরে। গোপাল মনোহর স্নানে। তিনজনের আসন পেতে এবং ঘটি, গেলাসে জল টল ভরে আহিরা ডুবে গেল অন্য এক চিন্তায়। খাওয়া-দাওয়ার পর বাবাকে কলকাতার ব্যাপারটা অবশ্যই জানাবে। কিন্তু তার আগে সে সাত্যকির জন্যই উতলা হয়ে উঠলো। রামেশ্বরম থেকে তো ওর সকাল-সকালই এখানে ফিরে আসার কথা ছিল। অন্তত চলে আসার আগে আহিরার সঙ্গে শেষ মুহূর্তেও সেই রকমই কথা হয়েছে। অথচ এই এতোটা বেলা পর্যন্তও সাত্যকি এলো না। এটা নিশ্চয়ই একটা চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। কেন না রামেশ্বরম শহরে ছেলেটা গতকালই জীবনে প্রথম পা রেখেছে। এবং ওখানে সময় কাটানোর মতো পরিচিত ওর কেউ নেই। রাজামুন্দ্রি থেকে সুমিঠ্ঠাগুরম আসার পথে যে বৃদ্ধ মানুষটার সঙ্গে আলাপ হয়েছে তার সঙ্গে শুধু একবার দেখা করবে। নিতান্তই এক সৌজন্যের সাক্ষাৎকার। তারপর হোটেল কাবেরীতে রাতটুকু কাটিয়ে ভোরবেলাতেই চলে আসবে সুমিঠ্ঠাগুরমে। মোটামুটি এই হলো হিসেবের ছক। সেখানে এখন বেলা একটা চল্লিশের মতো বাজে। চিন্তা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। আহিরা মেনে নিল যে সাত্যকি যদি খুব দেরি করেও ঘুম থেকে ওঠে, আটটা হোক, নটা হোক— তার বেশি আর কতো হতে পারে? রামেশ্বরম থেকে এখানে বাসে সময় লাগবে চল্লিশ মিনিটের মতো। সুতরাং হেসে খেলে বেলা সাড়ে দশটা, এগারোটার মধ্যে সাত্যকির এসে যাওয়া উচিত ছিল।
আহিরার মনে দুশ্চিন্তা এ বারে বাড়তে লাগলো। কী হতে পারে? এই দেরির পিছনে তো নিশ্চয়ই একটা কারণ আছে। এবং কারণটা যে ভালো হতে পারে না সেটা বোঝাই যাচ্ছে। এমন তো নয় যে কোনো বাজে লোকের পাল্লায় বা ফাঁদে পড়েছে? অথবা অন্য কোনো বিপদ? আহিরা আসলে চিন্তা করেও কূলকিনারা পাচ্ছে না। দুপুরে ভোজনালয়ে ভাত খাবার সময়ে সাত্যকি একবার বলেছিল, শরীরটা যেন কেমন লাগছে।
কী রকম লাগছে? আহিরার গলায় যথেষ্ট উৎকণ্ঠা ছিল।
না, না ভয় পাবার মতো কিছু নয়। সাত্যকি কোনোরকম গুরুত্ব না দিয়ে বলেছিল, আসলে এই ক’দিন ধরে সামনে বাস জার্নির ধকলটাই বোধহয় আর সহ্য হচ্ছে, না। আমি তো এ ভাবে কখনও যাতায়াত করিনি তাই হয়তো একটু ….. তা ছাড়া ওই মাস্তানটাকে ঠ্যাঙ্গাতেও কম শক্তি ব্যয় হয়নি। ওসবে আমি অভ্যস্ত নই। কিন্তু কী করবো বলুন—ছেলেটা দুম করে এমন চালালো, তারপরেও হাত গুটিয়ে থাকার অর্থ হলো আত্মমর্যাদার মেরুদন্ডটা ওর হেফাজতেই তুলে দেওয়া। যাক গিয়ে সে সব কাহিনী…….আপনার সঙ্গে খাচ্ছি, গল্প করছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি এই আনন্দে ওই একটু আধটু শরীর খারাপের কে পরোয়া করে?
আমার সঙ্গে এই ঘোরাঘুরিটুকুর মধ্যে
থামলেন কেন বলুন?
আপনি আনন্দ পাচ্ছেন?
পেলেও বলা যাবে না! সাত্যকির খোলামেলা উত্তর, দেখুন মুখোশ পরে এবং নিজেকে গুটিয়ে রেখে একজন দরের মানুষ প্রতিপন্ন করার মধ্যে যে কৃত্রিমতা স্বীকার করছি আমার তা নেই। কিন্তু সহজ এবং স্বাভাবিকভাবে আমার যেটা উপলব্ধি হবে সেটা বলার ওপরেও কী আপনি বিধিনিষেধের হুকুম জারি করবেন?
আমি কিছুই জারি করছি না।
আমিও এক বুক বিষাদ নিয়ে আপনার সঙ্গে ঘুরছি না—সাত্যকির হাসিতে উচ্ছ্বাসের জলকণা। এবং রামেশ্বরমের আজকের এই ছবিটা আজীবন আমার স্মৃতিতে থাকবে। আপনি কী আমাকে কিছু বলবেন?
আহিরা তখন কিছু বলেনি। কেমন যেন একটা ভালোলাগার হলুদ মেখে সারাক্ষণ বিভোর হয়েছিল। একা একা সুমিঠ্ঠাণ্ডরমে ফিরে আসার সময় মানে ড্রাইভার যখন বাসে স্টার্ট দিচ্ছে সেই সময়ে বিষণ্ণ সুরে প্রথমে বলেছিল, আসছি তা হলে! উত্তরে সাত্যকি বললো, আসুন। তারপরেই বাসটা ডিপো ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে আহিরা মরিয়া হয়ে সেই ‘কিছু’-টা বললো, আপনাকে যেন কাল সকালেই আমাদের উঠোনে দেখতে পাই।
সাত্যকি হেসে চেঁচিয়ে বললো, আপনি তো ঝাঁটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। একবার এসেই দেখুন না অবশ্যই আসবো।
সকাল সকাল সেই সাত্যকি কোথায় এলো? বেলা এখন প্রায় দুটো বাজতে চললো, এখনও যখন এলো না, মনে হয় আজকে আর আসবে না।
ওদিকে আহিরা আজ খুব ভোরে উঠে তার দৈনন্দিনের কাজটা মোটামুটি সেরে নিয়েছে। গরু এবং ছাগল অর্থাৎ লক্ষ্মী ও লীলার দুধ দুইয়ে ওদের খেতে দেবার আগেই সারা রাতের ঝরা পাতার উঠোনটা ঝাঁট দিয়েছে। অর্থাৎ সাত্যকি যেন কোনো ভাবেই ওর হাতে ঝাঁটা মাটা না দেখে। যদিও রামেশ্বরমে কয়েক ঘণ্টা এক সঙ্গে কাটানোর মধ্যে সাত্যকি অন্তত বার দুয়েক বলেছে, ‘আমি চিত্রকর হলে ঝাঁটা হাতে আপনার অবশ্যই একটা অসাধারণ ছবি আঁকতাম। নাম দিতাম, ঝাঁটার সৌন্দর্য যার হাতে খোলতাই হয়।’ তা সে সব পাট চুকিয়ে রান্নাঘরের কাজে মন্দাকিনীকে সাহায্য করে আহিরা স্নানটা সেরে নিয়েছে। প্রথমে হলুদ রংয়ের শাড়ি পরার ইচ্ছে হলেও শেষ পর্যন্ত মহীশূর সিল্কের গাঢ় সবুজ রংয়ের শাড়ি, ব্লাউজই বেছে নিয়েছে। চোখে কাজল দিয়েছে অনেকটা পুরু করে। পিঠ ছড়ানো ও ছাপানো খোলা চুলের বাহার। মাথায় জুঁইয়ের মালা। নাকে সামান্য একটু বড়ো ধরনের নাকছাবি। এবং দুই হাতে কাচের চুড়ির সবুজ চ্ছটায় আহিরা তখন আবাহনী। আবিষ্কারের নেশায় রীতিমতো আবিষ্ট। কিন্তু বেলা বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে তার নেশা কাটতে লাগলো। আর যাইহোক এই অবেলায় সাত্যকি আসবে না এটা নিশ্চিত। বাবা এবং সাত্যকি— দু’জনকে এক সঙ্গে কীভাবে সামলাবে তারও একটা মহড়া দিয়ে রেখেছিল আহিরা। এমনকী বাবা যাতে না ভেবে বসেন, সাত্যকির জন্যই তার ওই নতুন সাজ, তারও একটা ব্যাখ্যা নিজের কাছে তৈরি ছিল। কিন্তু না বাবা কিছু তাকে জিজ্ঞেস করলেন, না সাত্যকি এলো! এই অবস্থায় সবচেয়ে বেশি অস্বস্তি হতে লাগলো আহিরারই। কোনো কাজেই সে নিজেকে মিশিয়ে দিতে পারছে না। বাবার টানে বাবার কাছে লেপটে থাকলেও চোখ দুটোও যেন মাঝে মাঝেই উঠোনের কঞ্চিবেড়ার গেটের দিকে উদাসী হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছিলো। আহিরা অধ্যাপিকা। আহিরা ব্যক্তিত্বময়ী এক আলোকশক্তিকা। তবুও সবার আগে সে একজন মেয়ে যার বয়স মাত্রই চব্বিশ। অনাঘ্রাত সেই চব্বিশের মৃগনয়না বিশেষ একজনকে দেখার আকাঙ্ক্ষায় ঘনঘন গেটের দিকে না তাকিয়ে কী সে তবে রামায়ণ পাঠে মন বসাবে?
সাত্যকির দিকে মন পড়ে থাকার আরও একটা বড়ো কারণ হলো ওর মার্জিত ব্যবহার। আগাগোড়া শালীনতার নিয়ম মেনে অথচ ছোট্ট ছোট্ট আবদার করে কী সারল্যের সঙ্গেই না নিজের দাবিগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করেছে! এই শিল্প করায়ত্ব করার ক্ষমতা সবার থাকে না। প্রথম দৃষ্টিতে প্রেম বলে একটা প্রচলিত কথা আছে। যদিও আহিরা তাতে বিশ্বাসী নয়। সে ওসব মানে না। বস্তুত প্রথম দৃষ্টিতে দেখার থেকেও সাত্যকির সঙ্গে রামেশ্বরমে আধবেলা মেলামেশাতেই ওর মনে মৃদু ভাবে হলেও একটু উথালপাথাল শুরু হয়ে গেছে। এই উথালপাথাল করে দেওয়া লোকটাই কী সেই বিশেষ একজন যাকে……. আহিরা অতো শতো জানে না। একে যদি কেউ প্রেম বলে বলতে পারে। তবে কৈশোরে, যৌবনে চলার পথে অনেক ছেলের সঙ্গেই তো আলাপ-পরিচয় হয়। এর মধ্যে শুধুমাত্র একজনকে দেখেই কেন মনে হয় ও আমার! এই মনে হওয়াকে আহিরা অবশ্যই প্রেম বলতে রাজি আছে। আর রাজি আছে সাত্যকিকে ঢালাও প্রশংসাপত্র দিতে—শিশুর বায়না নিয়ে চব্বিশ বছরের একটা ছেলে যে ভাবে মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে সেই সুষমায় মুগ্ধ হতেই হবে।
.
স্নান টান করে গোপাল মনোহর দাওয়ায় এসে বসলেন। খালি গা, পরনে নীল- সাদা চেক চেক লুঙ্গি। মাথার চুল বেয়ে তখনও জল গড়াচ্ছে। গোপাল মনোহরের ওটাই বৈশিষ্ট্য। কিছুতেই শুকনো করে মুছবেন না। আহিরা ততোক্ষণে রান্নাঘর থেকে খাবার-দাবারগুলো দাওয়ায় এনে পরক্ষণেই আবার ছুটে গেছে মায়ের কাছে। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। মা যেন নিজের মুখটা বন্ধ রাখেন অর্থাৎ কলকাতা প্রসঙ্গে কোনো আলোচনাই খেতে বসে নয়, এটা যেন মাথায় থাকে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই মন্দিকিনী স্বামীর প্রিয় খাবার রসম করলা-মশাল্লা ঝটপট বানিয়ে বাটিতে রাখতে রাখতে হেসে মেয়ের কথার উত্তর দিলেন, মাথায় থাকবে।
গোপাল মনোহর, মন্দাকিনী, আহিরা—তিনজনে এক সঙ্গে খেতে বসে তখন কতো কথা, কতো গল্প। টুকরো টুকরো হাসির সেই সব উজ্জ্বল দৃশ্য পারিবারিক বন্ধনের আদর্শ বিজ্ঞাপন হতে পারে। গোপাল মনোহরই কথা বলছিলেন। রাজামুন্দ্রি, শাহবাগ ও কাঁকিনাড়া শহরে এ বারে ব্যবসাটা ভালোই হয়েছে। হায়দরাবাদ, সেকেন্দ্রাবাদের জন্যও প্রচুর অর্ডার আছে। কিন্তু সমস্যাটা ওই একটা জায়গায়, পঞ্চাশ শতাংশ বাকিতে দিতেই হবে।
সবাই যখন বাকি রেখেই ব্যবসা করছে তোমাকেও তো তাই করতে হবে। এখানেই আমার আপত্তি মন্দাকিনী। গোপাল মনোহর সাফ সাফ বললেন, সবাই কী করছে না করছে তা দেখে আমাকে চলতে হবে এটা মানতে পারলাম না। আমি চলবো আমার নিজস্ব পদ্ধতি ও পরিকল্পনায়। উৎপাদনের ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমি আমার পণ্যের দাম ফেলি। নগদা নগদি কারবার। এখন যদি আমি এক বছর বাদে বাকি টাকাটা পাই তা হলে তো মালপত্রের দাম বাড়িয়ে রাখতে হয় যা আমার মনঃপূত নয়। অতএব যেমন চলছে সে ভাবেই চলুক। ধারবাকির মধ্যে ঢুকলেই জটিলতা বাড়বে। সুতরাং কী দরকার ওসবের? একটু থেমে গোপাল মনোহর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে গদগদ কণ্ঠে বলে উঠলেন, আরে রসম করলা-মশাল্লাটা তো দারুণ হয়েছে! অনবদ্য!
তা হলে আরেকটু নাও। মন্দাকিনী হাতায় করে বেশ কিছুটা তুলতেই বাধা পেলেন। কিছুতেই স্বামীর পাতে দিতে পারলেন না।
গোপাল মনোহর হাসতে হাসতে বললেন, আরে বাবা ভালো বলার অর্থ এই নয় যে আমার থালায় আরও বেশি করে ঢালো। আমি তোমার রান্নার প্রশংসা করেছি, তোমাদের বঞ্চিত করে স্বার্থপরের মতো একা একা নিজের উদর ভরাতে নয়। যাক গিয়ে ওসব কচলা কচলি, এ বারে শোনো একটা ঘটনা। ব্যাপারটা মজার না দুঃখের কী বলবো নিজেই বুঝতে পারছি না। ওই সময়ে আহিরা ও মন্দাকিনী দু’জনেই গোপাল মনোহরের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
গোপাল মনোহর খেতে খেতে বলতে লাগলেন, শাহবাগ শহরে এক মহাজনের গদিতে বসে আছি। ফেনায় ভরা ঠাণ্ডা পানীয় সবার হাতে হাতে। ঝকঝকে নতুন মোটরবাইক থেকে আরও ঝকঝকে একটা ছেলে নামলো। কতো আর বয়স হবে? পঁচিশ, ছাব্বিশ, বড়ো জোর সাতাশই হোক, তার বেশি নয়। মাথার চুল থেকে পা পর্যন্ত পুরুষোচিত সৌন্দর্যে ভরা। আমি তো ওকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমার আহিরা মায়ের পাশে দারুণ মানাবে। মুশকিল হলো, ছেলেটা কী পাস, কতোদূর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে সে সব জানবো কেমন করে? প্রথমেই তো কাউকে জিজ্ঞেস করা যায় না, এই যে ভাই তুমি কী পাস করেছো আমাকে একটু বলবে? তা আমি তক্কে তক্কে রইলাম। কিছুতেই এই ছেলেটাকে ছাড়া নেই।
শেষে শুনলে ও বিবাহিত এই তো—আহিরা হেসে ফেললো।
ধুস বলতে পারলি না।
টুকতে গিয়ে ও এম. এ পাশ করতে পারেনি এই তো?
মন্দাকিনী মজার গলায় বললেন, পরীক্ষার হল থেকেই বুঝি তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে?
আরে মন্দাকিনী, তেমনটা হলে তো আমি ওকে সঙ্গে নিয়েই বাড়ি ফিরতাম।
সে কী গো! মন্দাকিনী চোখ কপালে তুলে বলে উঠলেন, ও কী তা হলে বি. এ. পাসটাও করেনি?
আহিরা প্রাণ খুলে হাসলো, নিশ্চয়ই ইংরেজিতে ব্যাক ছিল।
তা হলেও আমি ওকে ফ্রন্টফুটে খেলতাম।’ গোপাল মনোহর আর কথা বাড়ালেন না। জানিয়ে দিলেন, ছেলেটা লেখাপড়াই জানে না। আমার সামনে বসে মহাজনের কাছ থেকে তিরিশ হাজার টাকা নিয়ে দিব্যি বুড়ো আঙ্গুলটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো, ‘লগাইয়ে কালি যিতনা আপকো মন চাহে।’ দৃশ্যটা কল্পনা করতে পারছো? উজবুকটার তো কোনো বিকারই নেই। খ্যাঁ-খ্যাঁ, হ্যাঁ-হ্যাঁ করে সমানে হেসেই চলেছে। অথচ …জানিস আহিরা আমার বুকের মধ্যে কেমন একটা খচখচানি শুরু হয়ে গেছে। ওই সময়টা রীতিমতো আমার কষ্ট হচ্ছিলো।
আর সেই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নির্ঘাত তুমিও ছেলেটার পেছনে…
কী করবো বলো? অমন সুন্দর একটা ছেলে টিপসই দিচ্ছে ভাবা যায়? গোপাল মনোহর রাখঢাক না করে পরিষ্কার বলে উঠলেন, আমার জিজ্ঞেস করার মধ্যে অন্যায়টা তোমরা কোথায় দেখলে? আহা, একটা ব্যাপার বোঝার চেষ্টা করো তোমরা—আমি কী ছেলেটাকে কোনো কটু কথা বলতে পারি, না আমার সেই অধিকার আছে? আমি যথেষ্ট সহানুভূতির সঙ্গেই ওকে জিজ্ঞেস করলাম, অক্ষর জ্ঞানটা কেন হলো না ভাই? বুঝলি আহিরা, ছেলেটা কিন্তু আমার ভেতরের কষ্টটা বুঝতে পেরেছিল। প্রচন্ড রাগে এবং এক অক্ষম আক্রোশে সরাসরি বলে ফেললো, বরাহের বাচ্চা নামে আমার একজন বাবা আছে। বাপ নয় লোকটা আসলে পাপ। যখন যেখানে যে মেয়েকে ভালো লাগছে এন্তার বিয়ে করেছে। আর আমার ভাইবোনের সংখ্যা সব মিলিয়ে মাত্র উনিশজন। লোকটার চাকরি কী? না বাস গুমটির বিড়ি ফোঁকা এক স্টার্টার। আমরা মানে আমি চারদিন বাদে একদিন এক মুঠো ভাত পেতাম, লেখাপড়া শেখা তো অনেক দূরের ব্যাপার স্কুলেই কোনোদিন যাইনি।
যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন….
গোপাল মনোহরকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে কৃষ্ণমাচারী নামের ঝকঝকে ছেলেটা সাফসাফ বলে দিল, আপনি কি আমাকে এখন নতুন করে শুরু করতে বলছেন? সম্ভব নয়।
অসম্ভবও নয়।
ওসব হলো কেতাবি কথা। কৃষ্ণামাচারীর চাঁচাছোলা উত্তর, এই সাতাশ, আঠাশ বছর বয়সে তিন বছরের বাচ্চাদের সঙ্গে কিন্ডারগার্টেনে গিয়ে ঢুসোচুসি করতে বলছেন?
বেশি বয়সে ওভাবে কেউ ভর্তি হতে যায় না। আসল কথা হলো…..
দেখুন মশাই, এখন আর আমাকে আসল-নকল বুঝিয়ে কোনো লাভ নেই। আমি টাকা গুণতে শিখে গেছি ব্যস।
খুব ভালো কথা। তার সঙ্গে আর একটা মাত্র জিনিস আমি তোমায় শেখাবো। তোমার পুরো নামটা কী বলো?
কৃষ্ণমাচারী মারান।
কে আর আই………. ইংরেজিতে পুরো নামটা কাগজে লিখে গোপাল মনোহর ওর সামনে ফেলে দিলেন। গভীর গলায় বললেন, সবার আগে এই অক্ষরগুলোর চেহারা চিনে ক্রমাগত লিখে যাও। যেমন ভাবে লিখেছি তুমিও তার ওপর দিয়ে ঠিক সে ভাবে হাত ঘুরিয়ে যাও……তারপর …… তারপর বই, কাগজ, পত্রপত্রিকা ইত্যাদি পড়তে না পারলেও তোমার নামটা অন্তত সই করতে পারবে। এবং বলার ব্যাপারটা হলো এই যে, মাত্র সাঁইত্রিশ মিনিটের চেষ্টায় কৃষ্ণমাচারী মারান নামের নিরক্ষর যুবকটি গোপাল মনোহরের কাগজটা আর না দেখেই অবলীলায় নিজের নাম সই করে চলেছে। যদিও অত্যন্ত কাঁচা আঁকাবাঁকা, অসমান হাতের লেখা, কিন্তু লিখছে। তেড়িয়ে বেঁকিয়ে হলেও লিখছে।
বুঝলে মন্দাকিনী, ওর সেই আনন্দটুকু যদি দেখতে…….. গোপাল মনোহর ভাত খাবেন কী, ঘোর লাগা গলায় বলতে লাগলেন, তারপর কৃষ্ণমাচারী কী করলো জানো? ‘ফাঁড় দো ও কাগজাদ’ বলে মহাজন চিন্নাস্বামীকে অনুরোধ করে সেটা বাতিলের ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে নতুনভাবে লেখালো। শুরু হলো ওর নতুন অধ্যায়। স্বর্গীয় এক হাসি ছড়িয়ে কৃষ্ণমাচারী ওর নামটা সই করেই আমার পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। কৃতজ্ঞতায়, আনন্দে ছেলেটার চোখ দুটো তখন জলে টলমল করছে। সেই দৃশ্য দেখলে মন্দাকিনী তুমি ওকে সঙ্গে করেই বাড়ি নিয়ে আসতে।
তোমার মতলবটা কী বলো তো? মন্দাকিনী খেতে খেতেই স্বামীকে জেরা করে বলে উঠলেন, তুমি নিশ্চয়ই ওকে বাড়িতেও আসতে বলেছো?
তা তো বলেছিই।
আমি এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম।
এতে ভয় পাওয়া-পাওয়ির কী আছে? গোপাল মনোহর এ বারে আহিরার দিকে তাকিয়ে অমলিন হাসলেন। তারপর চোখ ফেরালেন স্ত্রীর দিকে। সোজাসুজিই বললেন, তোমরা কি আমাকে এতোই আহম্মক ভাবো? আমার এম. এ. পাশ মেয়েটার সঙ্গে……
একটা জেট গাড়ির সঙ্গে একটা বয়েল গাড়ি জুড়ে দেবো এটা ভাবলে কী করে? দেশে কী শিক্ষিত ছেলের আকাল পড়েছে না কি? রাজামুন্দ্রির গোবিন্দবাবু তাঁর ছেলের জন্য আমাকে কম ধরেছেন! ওঁর ছেলেটা বড়ো চাকরি করে। বি. এসসি. পাসও………..
মন্দাকিনী হাসতে হাসতে জানতে চাইলেন, তা হলে আটকাচ্ছে কোথায়?
আরে ও বি. এসসি পাসটা করেছে দু’বারের চেষ্টায়। গোপাল মনোহরও সমান হেসে জানালেন, চেষ্টা করে দ্বিতীয়বারে পাস করা একজন ছেলের হাতে কী আমার এই আহিরাকে তুলে দেওয়া যায়?
আচ্ছা বাবা…………কথাটা শেষ না করেই আহিরা হাসতে লাগলো।
কী বলবি বল?
তোমার হিসেব হচ্ছে, আগে একবারও ফেল করা চলবে না।
ঠিক তাই।
ধরো, কেউ একজন প্রথমবারেই পাস করলো। কিন্তু চমৎকার টুকলিবাজি করে। সেক্ষেত্রে কী হবে বাবা? তার তো শিক্ষাই সম্পূৰ্ণ নয়।
এই সব বেয়াড়া প্রশ্ন করার কোনো মানে হয়? গোপাল মনোহর উত্তাল হেসে বলে উঠলেন, চারদিন পরে বাড়ি ফিরেছি। আমাকে আগে খেয়ে উঠতে দে- তারপর সিলেবাসের বাইরে প্রশ্ন করে আমাকেও ফেল করার দলে ফেলে দিস!