গাত্রহরিদ্রা – ১০

১০

কলকাতা অফিসে ট্রান্সফার হওয়ার পর গোপাল মনোহরের সঙ্গে খুব অল্প দিনের মধ্যেই দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে উঠলো নিখিল মৈত্র নামে একটি স্থানীয় ছেলের। দু’জনেই তখন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের তরতাজা ঝকঝকে যুবক। কী অফিসে আর কী বাইরে দু’জনে যেন দু’জনের কাছেই অপরিহার্য হয়ে উঠলো। কেউ কারও কাছ থেকে আলাদা নয়। ব্যাপারটা এই রকম দাঁড়ালো—খাওয়া দাওয়া, ওঠা-বসা, ঘোরা-ফেরা সব তো এক সঙ্গে বটেই এমনকী কাউকে যদি কখনও একটু একা দেখা গেছে তৎক্ষণাৎ অপর মানুষের কণ্ঠে বিস্ময় ফুটে উঠেছে, তুমি একা যে! তোমার ছায়া কোথায়?

নিখিলরা তখন থাকতো চেতলা পার্কের পেছনে। বাড়িতে ওর মা, বাবা তো ছিলেনই, আর ছিল দুই দাদা, এক দিদি, ছোটভাই এবং এক বোন। গোপাল মনোহর থাকতো লেক রোডে ওর এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে। আসলে আত্মীয়- টাত্মীয় ওসব কিছু নয়। টাকার বিনিময়ে দেশোয়ালি একজনের কাছে স্থান পাওয়া। তবে লেক রোডের সেই বাড়িতে নিখিলের অবাধ যাতায়াত ছিল। সেদিক দিয়ে কোনো অসুবিধের সৃষ্টি হয়নি। আর নিখিলদের চেতলা পার্কের বাড়িতে গোপাল মনোহরের স্থান ছিল নিখিলেরও ওপরে।

একবার দশেরা উৎসবের শেষে বিজয়ওয়াড়া থেকে মায়ের হাতের তৈরি খাঁটি ঘি আর পেস্তা-বাদামের ‘সাবরি লাড্ডু’ নিয়ে কলকাতায় ফিরেছিল গোপাল মনোহর। নিখিলদের বাড়ির সবাই সেই লাড্ডুর স্বাদ পেয়ে কী যে খুশি এবং তৃপ্তি পেয়েছিল সেটা মুখের কথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। নিখিল এবং নিখিলের বোন ইরা শুধু একটা মাত্র কথা বলেছিল, তুমি আবার কবে বিজয়ওয়াড়ার পট্টভিনগরে যাচ্ছো? আর নিখিল তো সত্যি সত্যিই একবার বিজয়ওয়াড়াতে গিয়েই হাজির হয়েছিল। গোপাল মনোহরের মা’কে প্রণাম করে প্রথমেই যা বলেছিল তা হলো, আপনি আমাকে যদি খেতে না দেন আমি আপনার বিন্দুমাত্র নিন্দে করবো না। কিন্তু সাবরি লাড্ডু না দিলে পাড়া মাথায় করে ছাড়বো।

বন্ধুত্বের সাঁকো পেরিয়ে গোপাল মনোহর আর নিখিল এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যেখান থেকে ফেরার কোনো উপায় ছিল না। ‘ফেরা’ বলতে প্রশ্নই ছিল না সম্পর্কে চিড় ধরার। দু’জন দু’জনকে যে ভাবে বুঝতো, বিশ্লেষণ করতো এবং আরও উত্তাপ মাখার মানসিকতা নিয়ে সূক্ষ্ম এক অনুভূতিতে কাছাকাছি এসে এক স্রোতে মিশে যেতো সেটা ছিল সম্পূর্ণভাবেই ভেতরের টানের ব্যাপার। সেই টানে কোনো ফাঁকি ছিল না। অথচ সেই মধুর এবং মনোরম সম্পর্কই কতো সহজে, কতো অনায়াসে পলকা সুতোর মতো ছিঁড়ে গেল! ওদের মাঝখানে শান্ত এক সুষমা নিয়ে নিরুচ্চার ভাবে এসে দাঁড়ালো বিজয়া। এবং সেই তৃতীয়জনকে ঘিরেই গেলাসের গায়ে বিন্দু বিন্দু জলকণার মতো ধীরে ধীরে জমতে লাগলো দূরত্বের প্রস্তরখন্ড।

এক্সপোর্ট কর্পোরেশনে গোপাল মনোহর আর নিখিলের উপরওয়ালা ছিলেন চক্রবর্তী সাহেব। অফিসের নিয়ম নীতিতে তিনি ছিলেন যেমন বিশ্বাসী এবং কঠোর, সেই সঙ্গে কাজের বাইরে ছিলেন তেমনই এক আনন্দপ্রিয় মিশুকে মানুষ। অফিসের কাজগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে বা চতুরতার সঙ্গে দু’দিন পিছিয়ে রাখার ব্যাপারে গোপালমনোহর এবং নিখিলের বিন্দুমাত্র সায় ছিল না। চমৎকার আন্তরিকতা নিয়ে তারা প্রতি দিনের কাজ প্রতি দিনেই শেষ করতো বলে চক্রবর্তী সাহেব ওই দুই বন্ধুর ওপর যথেষ্টই খুশি ছিলেন। হঠাৎ একদিন তিনি দু’জনকেই তাঁর লেক রোডের বাড়িতে বিকেলের চায়ের আসরে নিমন্ত্রণ করে বসলেন। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, সরকারি, আধা-সরকারি সব অফিসেই যে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের কাজের ওপর নির্ভর করে পুরো অফিসটা চলে এক্ষেত্রেও সেই কাজের অগ্রগতির দুই তরুণ পুরোধাকে কাছে ডেকে একান্ত আলাপের সূত্রে ওদের ইচ্ছেশক্তিকে চাঙ্গা করে রাখা।

সেদিন চক্রবর্তী সাহেবের বাড়িতে গোপাল মনোহর আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। কেন না তার বাড়ি থেকে সেই পথটুকু ছিল হেঁটে গেলেও পাঁচ ছ’মিনিটের বেশি সময় লাগার মতো দূরত্বের নয়। আধ ঘণ্টা পরে হাজির নিখিলও। চক্রবর্তী সাহেব তাঁর স্ত্রী কমলার সঙ্গে অফিসের দুই জুনিয়র অফিসারের আলাপ-পরিচয় ইত্যাদি করিয়ে দিয়ে এক মুখ হাসি ছড়িয়ে পরিষ্কারই বলে ফেললেন, এই দু’জনের সাহায্যের ওপরেই আমি এখন অনেকটা নির্ভরশীল। আর সিনিয়র যারা রয়েছে কাজের চেয়ে তাদের ধ্যান-জ্ঞান প্রমোশনের দিকেই বেশি। আমি নিখিল আর গোপাল মনোহরের …. মানে ওদেরকে আরও দায়িত্ব দিতে চাই। পারবে না তোমরা?

নিশ্চয়ই পারবো। নিখিল আর গোপাল মনোহর একই সঙ্গে যেন মন্ত্র উচ্চারণ করলো।

দুই তরুণ সহকর্মীর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে চক্রবর্তী সাহেব এ বারে আরও পরিষ্কার করে একটা কথা ঘোষণা করলেন, তোমাদের কাছে পেয়ে আমি খুশি। আরও খুশি হবো মাঝে-মধ্যে এমনভাবে চলে এলে। কিন্তু বিন্দুমাত্র খুশি হবো না বাড়িতেও অফিসের আলোচনা করলে। অতএব অফিসে পদমর্যাদার জোব্বাটা এই মুহূর্তে খুলে রেখে আমরা সবাই এখন শুধু মানুষ। তোমরা কী বলো?

আপনি ঠিকই বলেছেন। নিখিলের সলজ্জ উত্তর।

অফিস আর বাড়ি যখন আলাদা সুতরাং ওই দু’জায়গার ভূমিকাও দু’রকমভাবে পালন করতে হবে। গোপাল মনোহরের কথার মধ্যে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো সন্ধ্যাপ্রদীপের স্নিগ্ধ রূপের পরশ বুলিয়ে বছর কুড়ি, একুশের একটি মেয়ে।

চক্রবর্তী সাহেব সস্নেহ হাসি নিয়ে বলে উঠলেন, এটি আমার কন্যা বিজয়া। যার অতিরিক্ত শাসনে আমি বাড়ির চেয়ে বাইরে থাকতেই ভালোবাসি। আর মামণি, এরা হলো আমার দুই সহকর্মী। গোপাল মনোহর বালযোগী এবং নিখিল মৈত্র।

পরিচয়, নমস্কারের পালা ইত্যাদি শেষ হলে গোপাল মনোহর হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো বলে উঠলো, স্যার, অতিরিক্ত শাসনটা কী রকম? আপনাকে কি মেয়ের কাছে রাতদিন বকুনি খেতে হয়?

কথাটা শুনে হো-হো করে হেসে উঠলেন চক্রবর্তী সাহেব। নিঃশব্দ হাসির বিদ্যুৎরেখা বিজয়ার দুই ঠোঁটেও। শিশুর সারল্য নিয়ে গোপাল মনোহরের কৌতুকপূর্ণ জিজ্ঞাসা তাকেও চঞ্চল করে তুললো। সেই সঙ্গে অদ্ভুত এক উন্মাদনাও। প্রশ্নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিজয়া হাসির ঢেউ তুলে ছোট্ট গলায় বললো, কথা না শুনলে বাবাকে কড়া বকুনি দিতেই হয়।

আপনি কী সবাইকেই খুব বকাঝকা করেন?

হুঁ, তা করি।

কেউ দোষ না করলেও?

দোষ না করলে খামোকা কাউকে বকাবকি করতে যাবো কেন?

তার মানে আপনি প্রথম থেকেই কারও ত্রুটি ধরার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন যাতে মনের সুখে দাবড়ানো যায়!

ব্যাপারটা সেই রকমের হয়ে যাচ্ছে কী না আমি জানি না। তবে তা হলেও আমার কিছু করার নেই। বিজয়ার চোখ পাকিয়ে অথচ আশ্চর্য এক ঝিলিক তুলে বলার ধরনে কমলা, নিখিলও হাসতে লাগলো। কমলা পরে মেয়েকে অনুযোগে সুরে বললেন, তুই প্রথম দিনেই যা সব শুরু করলি গোপাল মনোহর হয়তো সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করবে। ও যা সরল ছেলে……

না, না, ব্যাপারটা আমি উপভোগ করতে পেরেছি। গোপাল মনোহরের আবার বালকসুলভ স্বীকারোক্তিতে ঘরের সবাই হাসির রংমশাল জ্বেলে সারা বাড়িটাকেই আলোকিত করে তুললেন।

সেই সময়ে বিজয়া একবার গোপাল মনোহরের মুখের দিকে তাকালো। ও যে নিপাট ভালো ছেলে তা ওর কথার মধ্যেই সেটা বারবার বুঝিয়ে দেয়। এক ধরনের শিশু আছে যাদের দেখলেই ভালো লাগে। গোপাল মনোহরও অনেকটাই তাই। বিজয়া নিখিলের চোখের দিকে তাকিয়ে খুব আস্তে জিজ্ঞেস করলো, আপনি ওঁকে সারাক্ষণ আগলে রাখেন কীভাবে?

গোপালকে আগলাতে হয় না। নিখিল মৃদু গলায় উত্তর দিল, ওর ব্যবহারই ওকে আগলাবার জন্য সবাইকে কাছে ডেকে নেয়।

দারুণ বলেছেন তো! বিজয়া খুশির আবীর ছড়িয়ে বললো, আসলে আপনারা দুই বন্ধু কেউ কারও থেকে কম নন। দু’জনেই দু’জনকে চিনতে পেরেছেন বলেই আপনাদের মধ্যে এত বন্ধুত্ব! গভীরতার এই স্নিগ্ধতা অবশ্যই মনকে ছুঁয়ে যায়।

দিন, সপ্তাহ, মাসের পর মাস—এইভাবে ঋতু পরিবর্তনের চাকা ঘুরে অনায়াসেই একটা বছরকে পার করে দিল। এই সময়টা যে কীভাবে কাটলো গোপাল মনোহর বা নিখিল কেউই খুব বেশি একটা টের পেল না। বিজয়ার উপস্থিতি, ওর চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত কথা, ওর সঙ্গে সুচারুভাবে মেলামেশার উত্তাপ সময়কে পাল তোলা নৌকার মতো তীরবেগে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। এই সব কিছু সত্যের মধ্যে নিখিল আরও একটা সত্য আবিষ্কার করলো, বিজয়া যেন গোপাল মনোহরকেই একটু বেশি পছন্দ করে। নিখিলকে যদি তার ওই আবিষ্কারের সপক্ষে যুক্তি দিতে বলা হয়, তেমন করে সে কিন্তু কোনো কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না। তবে সূক্ষ্ম এক দৃষ্টিতে তা অনুভবের আয়নায় অবশ্যই ধরা পড়ে।

আসল ব্যাপারটা হলো, চক্রবর্তী সাহেব এবং গোপাল মনোহরের আত্মীয়ের বাড়ি মোটামুটি একই জায়গায়। ফলে বিজয়া এবং গোপাল মনোহরের দেখা-সাক্ষাৎ বাড়ি ছাড়াও লেক মার্কেটে কেনা-কাটার সময়েও মাঝেমধ্যেই যোগাযোগের ব্যাপারটা হতে লাগলো। এবং অবশ্যই সে সব লুকিয়ে রেখে গোপন করার মানসিকতাও নেই। ফলে অফিসে গিয়ে গোপাল মনোহর অনায়াস ভঙ্গিতে হুবহু ছবিটা তুলে ধরেছে তার একমাত্র বন্ধু নিখিলের কাছে। নিখিল প্রতিটা কথা শুনেছে, বন্ধুর সঙ্গে ঠাট্টা পরিহাস করেছে, আবেগ নিয়ে উদারতা দেখিয়েছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সব হারানোর বেদনা নিঃশব্দে পান করে নীলকণ্ঠ সেজে থেকেছে। আসলে প্রথম দিন থেকেই তার ধারণা এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় সে পিছিয়ে রয়েছে এবং ক্রমশই যেন আরও পিছিয়ে পড়ছে অথচ বিজয়ার মধ্যে কোনো পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ কিছুতেই আনা যাবে না। সে যেন প্রকৃত অর্থেই দু’জনেরই সমান বন্ধু। নিখিলের মানসিকতায় ফাটল ধরছে ঠিক এইখানেই।

আরও ছটা মাস কখন যে অদৃশ্য হয়ে গেল বোঝা গেল না। এ বারে কিন্তু এটা পরিষ্কার বোঝা গেল বিজয়া গোপাল মনোহরের কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসে, ওর সঙ্গে সময় কাটাতেই তার বেশি আগ্রহ। ইতিমধ্যে দু’দিন সে সিনেমা দেখার প্রোগ্রাম করেছে গোপাল মনোহরের সঙ্গে। এ ছাড়া চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া, জাদুঘর, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, বেলুড়, দক্ষিণেশ্বর ইত্যাদি জায়গাগুলো ঘুরে দেখার ব্যাপারটা তো আছেই। বিজয়া যে নিখিলকে স্পষ্টই দূরে সরিয়ে রাখতে চায় এই ঘটনাগুলো কি তারই প্রতিচ্ছবি নয়?

নিখিলের বুকে একই সঙ্গে দুটো আঘাতের ব্যথা। বিজয়া ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। এটা তো প্রথম থেকেই ছিল, সবার ওপরে যেটা তা হলো, গোপাল মনোহরের বিস্ময়কর আচরণ। অফিস ছুটি হওয়ার পর তারা একই সঙ্গে রাসবিহারী পর্যন্ত আসতো। এখন ফেরার ব্যাপারটা যেন চুপিসাড়েই হয়ে যাচ্ছে। গোপাল মনোহর কখন যে বেরিয়ে পড়ছে নিখিল তা জানেই না। শুধু তাই নয়, ছুটির দিনে কোনো প্রোগ্রাম করতে চাইলে গোপালের স্পষ্ট উত্তর, বাড়িতে একটু কাজ রয়েছে। বেরুনো যাবে না। অথচ নিখিল দেখেছে, ওই দিনই ও বিজয়াকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করে কেনা-কাটায় ব্যস্ত থেকেছে। গোপাল কেন তাকে এইভাবে এড়াতে চাইছে? বিজয়া যাই করুক, তাদের দুই বন্ধুর মধ্যে বিরোধিতার পাঁচিলটা না ওঠাই কাম্য ছিল। নিখিল তেমনটা ভাবলো বটে, কিন্তু সে কি অস্বীকার করতে পারে গোপালকে তারও আজকাল আর পছন্দ হচ্ছে না। এবং আরও স্পষ্টভাবে বললে বলতে হয় গোপালকে সে এখন হিংসেই করছে। মনের দিক দিয়ে গোপাল মনোহর আর বিজয়া যতো কাছাকাছি হচ্ছে, বন্ধুর সঙ্গে নিখিলের দূরত্ব তার চেয়েও বেশি বাড়ছে। আসলে নিখিল বিজয়াকে একান্ত নিজের করে স্বপ্ন দেখেছিল অথচ মুখ ফুটে তেমন করে কখনওই সে কথা ওকে বলতে পারেনি। এই না-বলা এবং না-পাওয়ার আঘাতটা তাকে ভেতরে ভেতরে শুধু গুঁড়িয়েই দিচ্ছিলো না, সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে এক অন্য জগতে নিয়ে যাচ্ছিলো। ওই সময়ে নিখিলের দিনগুলো কাটছিল এক চূড়ান্ত অস্থিরতার মধ্যে। সে চেষ্টা করেও শান্তি পাচ্ছিলো না।

একদিন ছুটির সন্ধ্যায় বাড়িতে চুপচাপ শুয়েছিল নিখিল। গোপাল মনোহর সেদিন আসতেই নিখিলের মায়ের প্রশ্নের মুখোমুখি হলো, তুমি তো আজকাল আমাদের বাড়িতে আসোই না। নিখিলের সঙ্গে তোমার কিছু হয়েছে কী?

না তো!

তা হলে আসছো না কেন? নিখিলের মায়ের গলায় ব্যাকুলতার সুর।

এই তো এসেছি। গোপাল মনোহর হাসি ছড়িয়ে সব কিছুকে উড়িয়ে দিতে চাইলো। তারপরেই ওর ছোট্ট জিজ্ঞাসা, নিখিল নেই?

আছে। ভেতরে যাও।

মুহূর্তও দেরি করেনি গোপাল মনোহর। দ্রুত পায়ে নিখিলের কাছে পৌঁছে ও চারপাশে একবার চোখ বোলালো। বন্ধুকে দেখে নিখিল একটু অবাকই হয়েছে। ছুটির দিনে এই সময়ে ওর তো এখানে আসার কথা নয়। সময় কাটানোর জন্য অথবা সময়কে আরও মহার্ঘ করে গড়ার জন্য গোপালের অনেক বেশি উষ্ণ জায়গা, অনেক বেশি মনোরম এক উপত্যকা রয়েছে। সে সব ছেড়ে এই বাড়িতে আসার নিশ্চয়ই কোনো জোরালো কারণ রয়েছে। নিখিল খুব আস্তে জানতে চাইলো, তুই কি আমাকে কিছু বলতে এসেছিস?

গোপাল মনোহর এক দৃষ্টিতে নিখিলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সেও খুব ধীরে ধীরে কিন্তু ভরাট গলায় এক সময় বললো, নিখিল, তুই শুধু আমার কলকাতারই বন্ধু নয়, আমার জীবনেরও শ্রেষ্ঠ বন্ধু। মাঝের বেশ কয়েকটা মাস আমি একটা ঘোরলাগা নেশার মধ্যে ডুবে ছিলাম। আমার ব্যবহারে তুই যদি আঘাত পেয়ে থাকিস সেজন্য আমি অনুতপ্ত। তুই আমাকে ক্ষমা কর। গোপাল মনোহর কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই নিখিলের হাত দুটো টেনে নিয়ে গভীরভাবে চেপে ধরলো।

ব্যাপারটা কী তাই বল? নিখিল নিস্পৃহভাবে কথাটা বলতেই গোপাল মনোহর সামান্য আহত হলো। তবুও সে নিজেকে ধরে রেখে আগের মতোই উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে ফেললো, বিজয়াকে আমি ভালোবাসি। কথাটা তোকে না জানানো পর্যন্ত আমি ঠিক নিজেকেই মানিয়ে নিতে পারছিলাম না।

ভেতরের ঝড়টাকে সামাল দেবার জন্য নিখিলকে যে বিস্তর মেহনত করতে হচ্ছে তা ওর মুখের অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। পৃথিবীটাই যেন তার ওপরে ভেঙে পড়েছে এমনই হতাশ ভঙ্গিমা। যাবতীয় যন্ত্রণা, অবিশ্বাস এবং নৈরাশ্য তার সারা মুখে আষাঢ়ের কৃষ্ণ কালো মেঘের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগলো। তার মুখের রক্ত যেন শুকিয়ে গেছে। ছেঁড়া বিবর্ণপাতার মতো শূন্য, বোধশূন্য এক দৃষ্টি নিয়ে সে গোপালকে দেখতে লাগলো। এইমাত্র ও যে কথাটা শোনালো তারচেয়ে যদি মুখের সামনে গরল তুলে ধরে বলতো তুই এটা খেয়ে নে, নিখিলের কাছে শেষের কাজটাকেই সহজ মনে হতো। নিখিল কোনোরকমে জিজ্ঞেস করলো, তুই কী বিজয়াকে সে কথা বলেছিস?

না।

বিজয়া তোকে কিছু জানিয়েছে?

কিচ্ছু না।

এতোদিন ধরে তা হলে শুধু মেলামেশা করে চলেছিস?

প্রায় তাই। গোপাল মনোহর স্পষ্ট উত্তর দিল, তোর সঙ্গে যেমন মিশছি ঠিক তেমনি বিজয়ার সঙ্গেও। তবে আমরা দু’জনেই যে দু’জনকে পছন্দ করি সেটা তো লুকিয়ে রাখার ব্যাপার নয়। সেই পছন্দ থেকেই তো ভালোবাসার গন্ধ পাচ্ছি। গোপাল মনোহর সামান্য একটু সময় নিয়ে পরে আবেগের সঙ্গে জানতে চাইলো, আমি এ ব্যাপারে একটা পরামর্শের জন্য তোর কাছে এসেছি। আমি কী বিজয়াকে এখনই কিছু বলবো?

আমার পরামর্শের কী আছে? আর এখন বলবি কী তখন বলবি সেটা তোর ব্যাপার। নিখিল ওকে নিরাশ করার ভঙ্গিতে দায়সারা গোছের উত্তর দিল, তা ছাড়া আমি কোনো ঝামেলার মধ্যে পড়তে চাই না। নিজেরা যা ভালো বুঝিস ……..

তবুও তুই কি কিছুই বলবি না আমাকে?

আমার বলাবলির ব্যাপার তো এটা নয়। নিখিল আরও সোজাসুজি জানালো, এর ভালো মন্দের দায়-দায়িত্ব তোদেরকে নিতে হবে। আমাকে এ সবের মধ্যে জড়াস না। কেন না এটা অন্য পাঁচটা সাধারণ ঘটনার মতো নয়, চক্রবর্তী সাহেবের সম্মানের প্রশ্ন জড়িত। সুতরাং আমাকে নিয়ে কোনোরকম টানাটানির প্রয়োজন নেই। আমাকে রেহাই দে।

গোপাল মনোহর তবুও বললো, তুই আমার বন্ধু। আমি যখন তোরই কাছে ছুটে এসেছি, তুই আমাকে আলোর পথটা দেখাবি না?

হ্যাঁ তোকে আলোর পথ দেখাতে গিয়ে আমার পথটাকে অন্ধকারে ঢেকে ফেলি আর কী! চক্রবর্তী সাহেব যখন জানবেন আমার পরামর্শেই তুই এগিয়েছিস তখন তোর চেয়েও আমিই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবো। তা ছাড়া……

তা ছাড়া কী?

তুই …… আজ না হয় কাল তুই একদিন ট্রান্সফার নিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশের কোনো এক বড়ো শহরে চলে যাবি। কিন্তু আমাকে পড়ে থাকতে হবে এই বাংলায়। এই কলকাতা শহরেই, যেখানে সর্বেসর্বা ওই চক্রবর্তী সাহেব। তাঁর বিরাগভাজন হতে পারবো না এটা তোকে স্পষ্টই জানিয়ে দিচ্ছি।

তুই তো অনেক দূর পর্যন্ত ভাবতে পারিস!

ওটা কটাক্ষ না প্রশংসা সেটা মাথায় রাখতে চাইলো না নিখিল। গোপাল মনোহর তাকে যা খুশি বলতে পারে তাতে তার কিছুই আসে যায় না। সে শুধু বললো, দূরদৃষ্টি থাকা কি খারাপ?

ওই ঘটনার সপ্তাহ তিনেক বাদে অফিসে নিখিল একটা প্রমোশন পেল। জুনিয়র অফিসার ছিল, হলো সিনিয়র অফিসার। এবং সবচেয়ে যেটা বলার কথা তা হলো এই প্রমোশনের ফলে নিখিল তার বন্ধু গোপাল মনোহরেরও ‘বস’ হয়ে গেল।

অফিসের পেটি ক্যাশের দায়িত্ব ছিল গোপাল মনোহরের ওপর। সাধারণত হাজার ষাটেক টাকা সেখানে মোটামুটি সব সময়েই মজুত থাকে। তার হিসেব-নিকেশ এবং চাবির গোছা ইত্যাদি সবই গোপাল মনোহরের হেফাজতে। শুধু ছুটির পর সেই ক্যাশ বাক্সের চাবির গোছাটা নিখিলের কাছে জমা দিতে হয়। এটা প্রতিদিনের নিয়ম 1 শুধু তাই নয়—ওই সময়ে ক্যাশের সর্ব শেষ পরিস্থিতি অর্থাৎ টাকার অঙ্কটাও হিসেবের সঙ্গে মিলিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হয়। আর সারা দিনে বিভিন্ন প্রয়োজনে টাকার দরকার হলে নিখিলকে গোপাল মনোহরের কাছেই নোট পাঠাতে হয়। নিখিল একবার করলো কী নোট-টোট কিছুই পাঠালো না। সই-সাবুদেরও কোনো ব্যাপার রাখলো না। নিজেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল গোপাল মনোহরের কাছে। অফিসে তখন টিফিন পিরিয়ড চলছে। কেউ খেতে ব্যস্ত, কেউ কেউ ক্যারাম খেলতে। গোপাল মনোহরও চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিলো। সেই সময়েই ওই ব্যস্ততা নিয়ে নিখিল হাজির হলো। দারুণ তাড়া লাগিয়ে বললো, শীগগির হাজার কুড়ি টাকা দে। এক পার্টিকে এক্ষুণি অ্যাডভান্স করতে হবে। আমি পরে তোর কাছে নোট পাঠাচ্ছি। আর ভাউচারেও সই করে দেবো সেই সঙ্গে।

নিখিলের কথা মতো গোপাল মনোহর তাই-ই করলো। বন্ধুকে অবিশ্বাস করার ।অথবা অফিসের রীতি মেনে চলার মানসিকতা সেই মুহূর্তে তার ছিল না। জরুরি কাজে সেদিন সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল গোপাল মনোহর। নিখিলকে টাকাটা দিয়ে অফিসের অন্য একটি প্রয়োজনীয় কাজে সে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে ঘণ্টা দুয়েক পর। এবং যথারীতি ক্যাশের হিসেব মেলাবার জন্য ওই কুড়ি হাজার টাকার ব্যাপারটা তুলতেই নিখিল অত্যন্ত কঠিনভাবে পুরোপুরি অস্বীকার করলো। শুধুই কী অস্বীকার? ‘বস’ হওয়ার সুযোগ নিয়ে সে পেটি ক্যাশ থেকে কুড়ি হাজার টাকার আত্মসাতের কাহিনী সাজিয়ে গোপাল মনোহরকে দোষী সাব্যস্ত করে পরে চাকরি থেকেই বরখাস্ত করে দিল।

কুড়ি হাজার টাকা চুরি করার জন্য অফিসের লোকেরা গোপাল মনোহরকে যেমন ধিক্কার জানালো ঠিক ততোটাই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলো নিখিলের দৃঢ় চরিত্রের জন্য। গোপাল মনোহর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সুতরাং আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে অনায়াসেই সে ওকে বের করে আনতে পারতো। কিন্তু এখানেই নিখিল আদর্শ এবং নীতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পেরেছে। নিজের বন্ধুর জন্য সে দু’রকম আইন করতে না গিয়ে স্বাভাবিক পথেই এগিয়েছে। এই চারিত্রিক দৃঢ়তা সকলে দেখাতে পারে না। অফিসের বয়স্ক মানুষেরা আরও আলোচনা করলেন, এই বয়সেই নিখিল যখন এতোটা নিয়ম নিষ্ঠার প্রতি স্থির থাকতে পেরেছে—যে কিনা নিজের প্রিয় বন্ধুকেও ছেড়ে কথা বললো না, এ ছেলে প্রশাসনের আরও অনেক ওপরে উঠবে, অনেক। এমন অবিচল থাকতে পারলে সুনাম তো তার হবেই।

নিখিলের সাজানো মামলায় গোপাল মনোহর এতোই ভেঙে পড়েছিল যে সে কাউকে কিছু বলতেই পারছিল না। বলবেটা কাকে? অফিসের লোকেরা তো প্রথম থেকেই তাকে আসামী বানিয়ে রেখেছে নিখিলের প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে। অনেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছে, গোপাল মনোহর বালযোগী বন্ধুত্বের সুযোগটুকু নিয়ে ওই টাকাটা সরিয়েছিল। ভেবেছিল, নিখিল মৈত্র ওকে না বাঁচিয়েই পারে না। ওইসব শোনার পর মরুভূমির প্রান্তরে দাঁড়িয়ে কোনোরকম শ্যামল ছায়ার স্বপ্ন সে আর দেখেনি। বাড়িতে বেশ কয়েকটা দিন গোপাল মনোহর নিজেকে লুকিয়ে রাখলো। আসলে অন্য কাউকে মুখ দেখাতেই তার লজ্জা করছিল। সেই সময়টা দিন এবং রাতের পার্থক্যটুকুও বোঝা যাচ্ছিলো না। অনন্ত এক মহানিশার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে হঠাৎ একদিন ধীরে ধীরে জেগে উঠলো গোপাল মনোহর।

.

তখন দুপুর। সোজা চলে গেল চক্রবর্তী সাহেবের বাড়িতে। তার শুধু বিজয়াকে একবার দরকার। অন্তত ওর কাছে ভেতরের কথাটা খুলে বলা যেতে পারে। আর কেউ বিশ্বাস করুক না করুক বিজয়া নিশ্চয়ই তাকে চুরির আসামী ভাববে না। ব্যাপারটা সে বোঝার চেষ্টা করবে। এবং নিখিল ওই নির্মম বজ্জাতিটা কেন করলো— ভেতরের সেই অস্পষ্ট ছবিটা তার কাছে অবশ্যই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কিন্তু গোপাল মনোহরের সেই ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের পার্থক্য এতো বেশি গড়ে উঠলো যে দুঃখে, বিস্ময়ে আর অপমানে সে নিজেকে প্রায় হারিয়েই ফেললো।

চক্রবর্তী সাহেবের বাড়িতে বেল বাজাতেই কাজের কিশোর ছেলেটি এসে দরজা খুলে দিয়ে বসতে বললো।

উদ্‌ভ্রান্তের মতো গোপাল মনোহর জিজ্ঞেস করলো, বিজয়া আছে?

হ্যাঁ।

ওকে একটু ডেকে দাও।

মিনিট তিনেক সময়ও কাটে নি। বিজয়া এসে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক দৃষ্টি নিয়ে গোপাল মনোহরকে দেখতে লাগলো। যেন জীবনে এই প্রথম সে একজন চোরকে দেখছে। আসলে গোপালকে সে সত্যিই পছন্দ করতো। বিশ্বাসের সেই জায়গায় এতো বড়ো একটা ফাটল দেখা দেবে এটা ছিল বিজয়ার কল্পনারও বাইরে। শেষ পর্যন্ত নিজের অফিসেরই টাকা চুরি! এতোটা নীচে যে নামতে পারে ভবিষ্যতে সে অনায়াসেই নীচের শেষ তলাতেও পৌঁছে যেতে পারে। বাবার কাছে সে সব কথাই শুনেছে। নিখিলের ব্যক্তিত্বপূর্ণ দৃঢ়তার কথাও তার কানে পৌঁছে গিয়েছে। এই অবস্থায় গোপাল মনোহরের সঙ্গে আর কী কথা থাকতে পরে? ঘটনাটা তো বোঝাই যাচ্ছে ছেলেটা তার সামান্য একটু দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে ধরেই বাঁচতে চাইছে। কিন্তু হীন কাজের এমন একজনকে সেই প্রশ্রয়টুকু দেওয়াও হবে আর একটা অন্যায়।

গোপাল মনোহর কেনোরকম ভূমিকার মধ্যে না গিয়ে সরাসরি এবং সোজাসুজি বলে ফেললো, আমি আপনাকেই একটা কথা বলার জন্য এ ভাবে ছুটে এসেছি। যে ভাবে নিখিল আমাকে …..

আপনি টাকা চুরির কথাটা বলবেন তো?

‘টাকা চুরি।’ কথাটা গোপাল মনোহরের কানে লাগলো। আরও লাগলো বিজয়া যে ভাবে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে নির্বাসনে পাঠালো। তবুও মরিয়া হয়ে গোপাল মনোহর পরিষ্কার বললো, অফিসের টাকাটা আমি চুরি করিনি। আপনি …. আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন…

সব চোরই কিন্তু চুরি করার পর ওই একই কথা বলে। মুশকিলটা ওখানেই। তা আপনি কি এই কথাটা বলতেই ছুটে এসেছেন? বিজয়ার প্রতিটা কথায় ব্যঙ্গের সুর।

‘সব চোরই কিন্তু চুরি করার পর ওই একই কথা বলে।’ যার কাছে ছুটে এসেছে সে যদি আগে থেকেই স্থির একাটা সিদ্ধান্ত বা ধারণা নিয়ে বসে থাকে তা হলে তাকে গোপাল মনোহর কীভাবে টলাবে? কীভাবে তার চিন্তার পরিবর্তন ঘটাতে পারে? তা ছাড়া বিজয়া নামের ওই ঝকঝকে মেয়েটা যে উপেক্ষা এবং অবজ্ঞা নিয়ে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলছে এরপরেও এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটাও বেশ অপমানের। গোপাল মনোহর সমস্ত অপবাদ গায়ে মেখে ক্ষীণ কণ্ঠে তাই বললো, না, আপনাকে আমি কোনো কিছুই বলতে আসিনি।

গোপাল মনোহর চলে আসার সময়ে বিজয়ার শুধু একটা ধিক্কার ধ্বনি শুনতে পেল, ছিঃ!

ওই ‘ছিঃ’ শব্দটাই তাকে শেষ করে দিল। গোপাল মনোহর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এক অন্য মানুষ হয়ে যাচ্ছিলো। গোপালের আস্তানার মানুষটি অর্থাৎ রেড্ডি একদিন পরিষ্কার বলেই ফেললো, আমার মনে হয় এ বারে তোমার বিজয়ওয়াড়াতেই চলে যাওয়া উচিত। এই পাহাড় প্রমাণ অসম্মান নিয়ে শুধু শুধু এখানে পড়ে থেকে কী লাভ?

আমিও তাই ভাবছি। গোপালের ছোট্ট উত্তর।

এখানে থাকলে বরং আরও বিপদ হতে পারে।

বিপদ বলতে?

এই ধরো তোমাকে সাসপেন্ড করেই ছেড়ে দিয়েছে। রেড্ডি খোলাখুলিই বললো, অফিস ইচ্ছে কলে তোমাকে আদালতে নিয়ে যেতে পারে। সেটা তোমার পক্ষে আরও ক্ষতিকর।

আমার ক্ষতি যা হবার তা তো হয়েই গেছে। নতুন আর কী হবে? গোপাল মনোহর তাকে আশ্বস্ত করে আরও জানালো, আপনার আর কোনো অসুবিধে করবো না। আমি দু’চারদিনের মধ্যেই বিজয়ওয়াড়ার পট্টভিনগরে চলে যাবো।

রেড্ডি সেই সময়ে গোপাল মনোহরের কাঁধে সস্নেহে একখানা হাত রেখে যথেষ্ট আবেগের সঙ্গে উত্তর দিল, গোপাল মনোহর তুমি এখানে যতো দিন ইচ্ছে থাকতে পারো। সত্যি বলছি, আমার তাতে কোনো সমস্যা হবে না। অসুবিধেটা হবে তুমি নিজেই নিজেকে এই গ্লানির পরিবেশে আর সহ্যই করতে পারবে না। প্রতিনিয়ত তুমি হাঁসফাঁস করতে করতে এক অতল খাদে নেমে যাবে, যেখান থেকে ওপরে ওঠার আর কোনো সিঁড়িই খুঁজে পাবে না। এই অবস্থাটা না আসাই কাম্য। তোমার বয়স কম। এবং নিজের বিবেকের কাছে তুমি ঠিকই আছো। বাইরের কে তোমাকে অসৎ বললো কিচ্ছু আসে যায় না। শুধু ভেঙে না পড়লেই হলো। তাই বলছিলাম এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে ফিরে যাও নিজের জায়গায়। নতুন করে জীবন শুরু করো। তোমার কিচ্ছু হয়নি, তুমি কিছুই হারাওনি গোপাল মনোহর।

গোপাল মনোহর সারা জীবনের জন্যই কলকাতার ওপর শুধু এক বুক অভিমান নিয়েই নয়—সেই সঙ্গে তীব্র এক ঘৃণা নিয়ে এই শহর ছেড়ে তার নিজের জায়গা অর্থাৎ বিজয়ওয়াড়ার পট্টভিনগরে চলে গিয়েছিল। ‘কলকাতা’ এই নামটাই সে মুছে ফেলতে চেয়েছে বারবার। নিঃশব্দের এক কঠিন জেদে গোপাল মনোহর ইস্পাতের চেয়েও শক্ত আর ধারালো হয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে নিখিলের প্রতি বিদ্বেষ নিয়ে ফিরে গিয়েছিল। তবে বিজয়ওয়াড়াতে ফিরে যাবার আগে সে একবার নিখিলের মুখোমুখি হয়েছিল।

চেতলা পার্কের বাড়িতে নিখিলের ঘরে ঢুকে গোপাল মনোহর বিন্দুমাত্র হইচই করেনি। অভিমানে, দুঃখে জর্জরিত হয়ে ভেঙেও পড়েনি। বেশি কথা? তাও বলেনি। নিখিলের মুখের দিকে তাকিয়ে অল্প যে কয়েকটা কথা বলেছে তা হলো, বিজয়াকে পাবার জন্য তুই অনেক নীচে নেমেছিস। আমাকে বললে এতোটা নামার দরকার হতো না। তবে তুই যে কাজটা করলি, আমি তোর সঙ্গে এমনটা করতে পারতাম না। বাকি জীবনে আমাকে অপরিচিত করে রাখলি ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটার সঙ্গে। তারপরেই গলাটা আরও একটু নিচুতে নামিয়ে এবং ঘন সুরে বলেছিল, চলি রে নিখিল, তোর সঙ্গে আর আমার কখনওই দেখা হবে না। সে ইচ্ছেও নেই। তবে বাকি জীবনে একটু অন্তত ভাবিস, কার সঙ্গে কী করলি!

সেই নিখিল আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অনুতাপের আগুন বুকে নিয়ে ওর ছেলেকে পাঠিয়েছে তার কাছে। নিশ্চয়ই তাই। ক্ষমা………ক্ষমা চাওয়া ছাড়া নিখিলের আর কিছু চাইবার নেই। কিন্তু ওকে কি ক্ষমা করা যায়? আজকে নাকি ওর ছেলে সাত্যকির আসার কথা ছিল। ছেলেটা কেন এলো না তা নিয়ে গোপাল মনোহরের কোনো মাথাব্যথা নেই। প্রশ্নটা হলো, ছেলেটা এসে বলবেটা কী? এতো বছর বাদে ওসব নাটুকেপনা তাঁর ভালো লাগে না। কেন না জোড়া লাগাবার মন নিয়ে বা আশা নিয়ে তিনি কোনোদিনই বসে ছিলেন না।

হঠাৎ একটা চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন গোপাল মনোহর। নিখিল তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বের সীমারেখা মুছে ফেলেছিল শুধুমাত্র একটাই কারণে। বিজয়াকে নিজের করে পেতে। ওর সঙ্গে কি বিজয়ার বিয়েটা হয়েছে? আর বিয়েটা যদি হয়েই থাকে নিখিল কি ওকে একজন নিরপরাধীকে চোর সাজানোর কাহিনীটা বলবে? খুব সম্ভব নয়। বলতে পারে না। তা হলে তো নিখিলই বিজয়ার কাছে ছোট হয়ে যাবে।

রাত তখনও শেষ হয়নি। আহিরা ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় পা রাখতেই একজনকে বসে থাকতে দেখে প্রথমে একটু চমকে গিয়েছিল। পরে নজর দিতেই বুঝতে পারলো বাবা কেমন যেন একটা ঝিম মেরে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন। আহিরা পায়ে পায়ে এগিয়ে গোপাল মনোহরের গা ঘেঁষে বসে কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো, বাবা তুমি এখানে বসে আছো যে?

ঘুম আসছে না রে!

কতোক্ষণ ধরে জেগে আছো?

প্রথম রাত থেকেই। গোপাল মনোহর ক্লান্ত গলায় বললেন, আমাকে একটু চা খাওয়াতে পারিস মা। মাথাটা বড্ড ভার ভার লাগছে। আচ্ছা রাত এখন কতো হয়েছে বলতো?

তিনটের কাছাকাছি।

তা হলে থাক। গোপাল মনোহর চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, আমি ভেবেছি ভোর হয়ে এসেছে। না রে আহিরা, তোকে আর কষ্ট করে চা বানাতে হবে না।

গোপাল মনোহরের কথাগুলো শুনে আহিরা বাবার মুখের দিকে তাকিয়েই রইলো। প্রথমে কোনো উত্তর দিল না। পরে করুণ এক চিলতে হাসি ঠোঁটের দুই কোণে ধরে রেখে বললো, আমার কষ্টের কথা ভেবে তুমি চা খাবে না—এক রাতের মধ্যেই তুমি আমাকে এমন পর করে দিলে বাবা? বুঝতে পারছি তোমার ভেতরে কোনো কিছুর আলোড়ন চলছে। নয়তো নিজের মেয়ের সঙ্গে এতোটা সৌজন্যর প্রকাশ কেউ……

কথাটা ওই অর্থে নিস না। গোপাল মনোহর পরম স্নেহে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, তুই আমার মেয়ে বলেই তো তোর কষ্ট যাতে না হয় সেদিকটাও আমার দেখা কর্তব্য। সব সময়ে কি স্বার্থপর হওয়া উচিত?

তা যেমন নয়, তেমনি আত্মসুখী হওয়াও ঠিক নয়। আহিরা মৃদু হেসে উত্তর দিল, যতো অসময়ই হোক না কেন—বাবাকে এক কাপ চা করে দিতে কোনো মেয়েরই আপত্তি থাকার কথা নয়। তুমি একটু বোসো, আমি এক্ষুণি চা করে আনছি।

আহিরা পাশ থেকে উঠে গেলে গোপাল মনোহর আবার এক শূন্য বসন্তের রুক্ষ প্রান্তরে এসে দাঁড়ালেন। নিখিলের ছেলেটা আজ যে কোনো কারণেই হোক আসেনি। কিন্তু কালকে তো আসবে। ওই দিন না এলে তার পরের দিন নিশ্চয়ই আসবে। অর্থাৎ আজ হোক, কাল হোক সাত্যকি আসবেই। গোপাল মনোহর একবার ভাবলেন, ছেলেটাকে পরিষ্কার বলে দেওয়া ভালো, ঘটনাটা যে সময়ের তুমি তো তখন পৃথিবীর আলোই দেখোনি। সুতরাং তোমার সঙ্গে কথা বলে কতোখানি বোঝাপড়ায় আসা যায়? বরং তুমি তোমার বাবাকে একবার পাঠিয়ে দিয়ো। লজ্জা বলে তার শরীরে অবশিষ্ট যদি কিছু থেকে থাকে, সে নিশ্চয়ই আমার সামনে এসে দাঁড়াবে না। আশা করি, তুমি তখন তোমার বাবাকে অবশ্যই চিনে নিতে পারবে। কিন্তু…….গোপাল মনোহর চিন্তার স্রোত আবার অন্য খাতে বইতে লাগলো। নিখিল যতোই ভুল বা অন্যায় করুক না কেন, ওর ছেলেটা তো কোনো দোষ করেনি। ওকে ওসব কথা শোনানোর কী যুক্তি থাকতে পারে? একের অপরাধে অপরের শাস্তি এই নীতিতে গোপাল মনোহরের আস্থা নেই। এবং ব্যাপারটা যে আরও জটিল হয়ে উঠবে সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই। সাত্যকি নামের ছেলেটাকে না পারবেন ফেলতে, না পারবেন ঠিক মতো গ্রহণ করতে।

চিন্তার স্রোত নতুন এক বাঁক নিল। গোপাল মনোহর স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তিনি নতুন করে আর ফেলে দেওয়া জামার উষ্ণ ঘ্রাণ নিতে চান না। অর্থাৎ পুরনো প্রসঙ্গের তিক্ততার স্বাদ নিয়ে কী লাভ? সুতরাং সাত্যকির মুখোমুখি না হওয়াই ভালো। ও এলে ওকে বরং জানিয়ে দেওয়া যাক, ব্যবসার প্রয়োজনে তিনি আবার বেরিয়ে পড়েছেন, ফিরতে মাস খানেক লাগবে। গোপাল মনোহর পর মুহূর্তেই ভাবলেন, ছেলেমানুষি চিন্তা। এক মাস হোক আর এক বছর হোক, সাত্যকি তার সঙ্গে কথা না বলে ছাড়বে না। আঠাশ-তিরিশ বছর পর যখন নিখিল ওর মনের ভাঙাগড়ার ছবিটা ছেলের মাধ্যমে একটা সমঝোতায় এসে উজ্জ্বল করে গড়ে তুলতে চাইছে তখন দেখা সে করবেই।

আহিরা চা নিয়ে আবার গোপাল মনোহরের পাশে এসে বসলো। ওঁর হাতে চায়ের কাপটা তুলে দিয়ে এক মুখ হাসি ছড়িয়ে বললো, বাবা, আমার কিন্তু একটুও কষ্ট হয়নি।

কথাটা তুই এখনও মনে রেখেছিস?

তুমি কথা শোনাবে আর আমি বলতে পারবো না! আরও চমৎকার হেসে আহিরা বললো, ওসব কথা বাদ দাও। একটু আগেই বলছিলে, তোমার মাথাটা ভার ভার লাগছে। আমি তোমার কপাল, মাথা টিপে দেবো বাবা?

না, তোকে আর ক……… গোপাল মনোহর ‘কষ্টের’ কথাটা বলতে গিয়েও মেয়ের ভয়ে থেমে পড়লেন। কিন্তু তিনি যেটা বলতে চাইছিলেন সেই ভাবটা তো আর গোপন রইলো না। তিনি তাই আহিরার মুখের দিকে চেয়ে ধরা পড়ার লজ্জায় হেসে ফেললেন।

আহিরা কিন্তু তার বাবাকে সহজে ছেড়ে দিল না। রাগ না হলেও একটু রাগ রাগ ভাব এ বারে দেখাতেই হয়। সে তাই কৃত্রিম রাগের ছটায় রাগ-রাগিনীর গাম্ভীর্য এনে বললো, আবারও তুমি কিন্তু সেই কষ্টের কথাই তুললে?

আমি তো কষ্টের কথা বলিনি।

বলোনি? ‘ক’-পর্যন্ত বলে থেমে পড়েছিলে শুধু।

ওটা আসলে আমি বলতে চেয়েছিলাম, তোকে আর কোনো কথা………

কথা?

হ্যাঁ-হ্যাঁ গোপাল মনোহর মৃদু হেসে বললেন, আমার অসুবিধের কোনো কথা তোকে ভাবতে হবে না।

ঠিক এই কথাটাই তুমি বলতে চেয়েছিলে তাই না?

অধ্যাপিকাদের সঙ্গে কথা বলার ওই এক বিপদ—গোপাল মনোহর এ বারে পুরোপুরি আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে নিষ্পাপ হেসে বললেন, আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের প্রতিপদেই নাজেহাল হতে হয় শুধুমাত্র কথায় না পেরে ওঠার জন্য। আমি তোর সঙ্গে আর কখনও তর্ক করবো না।

এই সুবোধ বালকটি প্রথম থেকে হলে তো কোনো ঝামেলাই ছিল না। আহিরা সামান্য একটু হাসলো মাত্র। তারপরেই বাবার পাশে আরও ঘন হয়ে বসে মাথা, কপাল পরম মমতায় টিপে দিতে লাগলো।

মিনিট আটেক সময় নিস্তরঙ্গ এক স্রোতের মতো নিঃশব্দের উজান বেয়ে চলে গেল। চা খেয়ে এবং মেয়ের সেবার স্পর্শ পেয়ে গোপাল মনোহর সত্যি সত্যিই একটু আরাম পেলেন। মাথার জটটা খুলে গিয়ে ক্রমশই যেন হালকা হয়ে আসছে। এ বারে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করা যেতে পরে। গোপাল মনোহর কোমল সুরে বললেন, যা, মা এবারে তুই শুয়ে পড় গিয়ে।

তোমার মাথা ধরাটা কমেছে বাবা?

অনেকটা।

তা হলে তুমি আর এখানে বসে থেকো না। তুমিও শুয়ে পড় যাও—আহিরা আকাশের দিকে তাকিয়ে শুকতারার অবস্থানটা একবার দেখলো। পাখিদের কণ্ঠস্বর কানে আসছিল। দু’একটা ওড়াওড়িও করছে। আহিরা স্নিগ্ধ গলায় আরও বললো, কিন্তু বাবা আর কতোক্ষণই বা ঘুমাবে? ভোর তো হয়েই এলো।

গোপাল মনোহর সে কথার কোনো উত্তর না দিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ধ্যান গম্ভীর পাহাড়ের মাথায় আকাশটা যেন চাঁদোয়ার মতো টাঙানো রয়েছে। পাহাড়ের কোলের ঘন এবং দীর্ঘ বনরাজিকে মনে হচ্ছে সেই চাঁদোয়ার কারুকাজ করা ঝালর। বাড়ির চারপাশের বড়ো বড়ো গাছগুলোকে এই মুহূর্তে অকৃত্রিম বন্ধু ছাড়া আর কিছুই ভাবা যাচ্ছে না। ঝিরঝিরে একট শীতল বাতাস বইছিল। সেই বাতাসের সঙ্গে সখ্যতা পাতিয়ে সদ্য ঘুম ভাঙা পাখিরা সঙ্গীতময় স্নিগ্ধ পরিমন্ডল সৃষ্টি করে চলেছে। সে এক আশ্চর্য কলরব অথচ যেন নির্জন জগৎ।

গোপাল মনোহর মেয়ের দিকে চোখ ফেরালেন। খুব আস্তে আস্তে বললেন, ভোরের এই মুহূর্তটা ভাবা যায় না! কী যে ভালো লাগে না আমার…….. অথচ দ্যাখ, এই সময়টা আমরা রোজই পেতে পারি কিন্তু ঘুম থেকেই বড়ো একটা ওঠা হয়ে ওঠে না। প্রতি দিন আমরা এই ভাবে কতো কী যে হারাচ্ছি……….গোপাল মনোহর বিড়বিড় করে আরও কী যেন বলতে বলতে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন।

আহিরা কিন্তু ঘরে গেল না। দেওয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে সে এ বারে আরও নিশ্চিন্ত হয়ে বসলো। গোপাল মনোহর তাঁর ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর মুহূর্তেই আহিরার মনে হলো, বাবাকে কলকাতার ব্যাপার নিয়ে সে আর একটাও প্রশ্ন করবে না। করাটা উচিত হবে না। কেন না সামান্য যেটুকু জিজ্ঞেস করেছে তাতেই গোপাল মনোহরের পুরো রাতটা শেষ হয়ে গেল শুধু না ঘুমিয়েই। তাঁর মনের ভেতরে নিশ্চয়ই কোনো কষ্ট লুকিয়ে রয়েছে যেটা তিনি মেলে ধরতে চান না। যার ফলে দু’চোখের পাতা এক করতেই পারলেন না। কিন্তু ……. আহিরা নিজে কেন ঘুমাতে পারছে না? গত দুটো রাত তো সে ঠায় জেগেই রয়েছে। ওর মনের ভেতরে কীসের কষ্ট? একটা আবছা ছবি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো। ওটা কি ছবি না মুখ? মুখ! সাত্যকি মৈত্র নামের বছর চব্বিশ-পঁচিশের একটা ছেলের মুখ। সমবয়সী একজন মেয়েকে কীভাবে সম্মান দেখাতে হয় সেটা সে খুব ভালো করেই জানে। সেই সঙ্গে রুচিস্নিগ্ধ এক আন্তরিকতায় মনকে সারাক্ষণই সজীব ও সতেজ করে রাখে। এবং কিছুটা আনমনাও। এই যেমন আহিরা কিছুতেই একটুও শান্তি পাচ্ছে না। সাত্যকির না-আসা নিয়েই তার যাবতীয় দুশ্চিন্তার শাখা-প্রশাখা কোমল মনের একেবারে গভীরে বিস্তার করে পাকাপাকিভাবে আশ্রয় নিয়েছে। ব্যাপারটা হয়তো এতো দূর গড়াতোই না। আসলে ছোট্ট ছোট্ট ঘটনাগুলো মনকে দারুণভাবে নাড়া দেয়- যে ঘটনাগুলোর মধ্যে অনুভূতির সূক্ষ্মতা, চেতনার ব্যঞ্জনা মিশে থাকে। অতএব যে ছেলেটা কথা দিয়েও আসতে পারলো না, তার জন্য তো কষ্ট একটু হবেই। এই স্বাভাবিক ব্যাপারটাকে আহিরা অস্বীকার করবে কেন? তার মনের অবস্থা এখন এই রকম যে, মা, বাবা কেউ যদি তাঁকে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেন তো আহিরা অনায়াসেই বলে দিতে পারবে, সাত্যকির জন্য চিন্তা হচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *