গাত্রহরিদ্রা – ১২

১২

পৃথিবীর ওপর প্রচণ্ড এক রাগ নিয়ে সূর্যটা যেন খ্যাপা পাগলের মতো উত্তাপ ছড়িয়ে চলেছে। মনে হয় কানের মধ্যে তপ্ত সীসার গরল ঢেলে দিচ্ছে গরম হাওয়া। বাতাসে এখন লু’র প্রকোপ। কিন্তু জ্বালা-যন্ত্রণা অনুভব করার সময় কোথায়? আহিরা একরাশ আতঙ্ক নিয়ে সামনের দিকে তাকালো। দু’পাশে ছোট, বড়ো, মাঝারি আকারের নিম, তেঁতুল, অর্জুন, তাল, নারকেল, আমলকি, অশোক গাছের দল আকাশের দিকে মুখ তুলে সেই আকাশকেই ঢেকে রাখতে ব্যস্ত। দু’পাশের গাছের সারির মধ্যের এই রাস্তাটুকু ধুলোমাখা হলেও চমৎকার সোজা। এবং সেই পথটুকুও নেহাত কম নয়। তারপরেই বাঁক নিয়েছে বাঁ দিকে। সুতরাং সোজা দৃষ্টিপথের মধ্যে সাত্যকিকে না পেয়ে আহিরার দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার পা দুটিও অতি মাত্রায় সচল হয়ে উঠলো। উদ্বেগের মধ্যে বোধহয় সঠিক চিন্তা আসে না অথবা মাথা ও ঠিক মতো কাজ করে না। আহিরা মোটামুটি হিসেব করে দেখলো তাদের বাড়ি থেকে সাত্যকি অন্তত মিনিট দশ-বারো আগে বেরিয়েছে। তাই যদি হয় তা হলে সে এই ছায়াঘেরা সোজা পথটুকুর মধ্যেই সাত্যকিকে দেখার আশা করছে কী করে? ওর তো এখন বড়ো রাস্তায় পৌঁছে যাওয়ার কথা।

সাত্যকিকে পাওয়া যাবে কী যাবে না—শুধুমাত্র ওই একটা চিন্তার মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ডুবে গিয়ে যে দ্রুতপায়ে আহিরা বড়ো রাস্তার কাছাকাছি পৌঁছালো তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। আসলে একটা বাস এসে থামতেই যাত্রীরা ওঠার জন্য ব্যস্ত হয়ে লাফঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে। ওই দলে সাত্যকিও ছিল। সে আহিরাকে দেখতে পায়নি। আর দেখতে পায়নি বলেই বাসে ওঠাটা ওর জরুরি হয়ে পড়েছে। দূরত্বের ব্যবধানটুকু দেখে নিয়ে আহিরা এ বারে অধ্যাপিকা নয়, একজন অ্যাথলীটের ভূমিকা নিয়ে সবার আগে পৌঁছে ফিতে ছোঁয়ার মতো পড়িমরি এক দৌড় লাগালো। শুধু তাই নয়, সেই সঙ্গে গলাও ছাড়লো, সাত্যকি যাবেন না। সাত্যকি–

বাসের ইঞ্জিনের ঘরঘর শব্দের মধ্যে বেশ কিছুটা দূর থেকে ওই ডাকটা সাত্যকির কানে পৌঁছানোর কথা নয়। পৌঁছায়ওনি। ফলে যাত্রিবাহী বাসটা শব্দতরঙ্গের সঙ্গে একরাশ ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতেই এক সময় উধাও হয়ে গেল। দৌড়ে আসার ফলে আহিরার শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে। বাতাসের উলটো-পালটা মেজাজে ওর দীঘল চুলের খোঁপা খুলে সারা পিঠ, কোমর ছাপিয়ে যেন উদ্দাম নৃত্য শুরু করে দিয়েছে। কপাল, নাকের পাটা, গলার খাঁজে ঘামের জলকণা। আহিরা তখনও হাঁপাচ্ছে। বাসটা পুরোপুরি অদৃশ্য হয়েছে একটু আগেই। সেই পথের দিকে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আহিরার চোখ দুটো এক সময় জলে ভরে উঠলো। শত চেষ্টা করেও মেয়েটা কান্না চাপতে পারলো না। এই কান্না কেন, কীসের জন্য, কার জন্য সে সব ব্যাখ্যা আহিরার কাছে নেই। বাসে উঠতে বারণ করার জন্য অথবা চলে না যাবার জন্য হৃদয় দিয়ে ‘সাত্যকি যাবেন না’ বলে সে যে ডাকটা দিয়েছিল তার মূল্য আর কোথায় রইলো? সাত্যকি তো শুনতেই পেল না সেই আহ্বান। জানতেও পারলো না আহিরা নামের একজন অধ্যাপিকা তার সমস্ত সম্ভ্রম, আভিজাত্য বিসর্জন দিয়ে কীভাবে বাসের পেছনে ছুটেছিল, ছুটেছিল তাকে ফিরিয়ে আনতে।

ওই বাসটাকে ধরার অবশ্য নানা উপায় আছে। কিন্তু তার জন্য কাছে পয়সা থাকাটাও জরুরি। হিন্দি ছায়াছবিতে ওই অবস্থায় সমাধানের জন্য যেসব কাণ্ড কারখানা দেখানো হয় বাস্তবে তা করা কী সম্ভব? তা ছাড়া সাধারণভাবে ঘাগরা, ব্লাউজ, একটা উড়নি জড়িয়ে আর একটা হাওয়াই চপ্পল পায়ে গলিয়ে হাত শূন্য হয়ে কতোদূর যাওয়া যেতে পারে? এক যদি যেশুদাস চাচা তাঁর ট্রেকার জিপ গাড়িটা নিয়ে এই মুহূর্তে এসে পড়তেন তা হলেও আহিরা একটা শেষ চেষ্টা করতো। কিন্তু কোথায় যেশুদাস চাচা? রাস্তায় কোনো জিপ গাড়িরই দেখা নেই। স্কুটার আরোহী দুই যুবক বরং তাকে রাস্তায় একা আলুথালু অবস্থায় দেখে অশ্লীলভাবে শিস দিতে দিতে চলে গেল। আর একজন বাইক চালক গাড়ি থামিয়ে পরিষ্কার জানতে চাইলো, চলে গা ক্যয়া? এরা কী ভাবে, মেয়েরা সব গাড়িতে ওঠার জন্য এক পায়ে খাঁড়া?

আহিরা বাড়ির পথ ধরলো বটে তবে তার পা দুটো যেন আর চলতেই চাইছে না। আসলে শূন্যতার এক খাদে পড়ে পায়ের সঙ্গে তার মনও ভেঙে গেছে। হাঁটার শক্তি পাবে কোথা থেকে? বাবা যে সাত্যকিকে তাড়িয়ে ছাড়লেন এটা পরিষ্কার ঘটনা। আলোচনা সেরে উঠে দাঁড়িয়েও ছেলেটা না যাওয়ার ইচ্ছেয় বারবার বলেছে, ‘আসছি তা হলে’। প্রতিবারেই বাবা পত্রপাঠ বিদায় জানিয়েছেন, ‘আসতে পারো।’ তারপরেও কোন লোকটা আর অপেক্ষা করতে পারে? মান-সম্মান বলেও তো একটা কথা আছে। তা সত্ত্বেও গোপাল মনোহরের ওপর আহিরার বিন্দুমাত্র অভিমান নেই। বাবা নিজের মতো করে যা বুঝেছেন, যে ধাক্কা খেয়েছেন, তিনি চলেছেন তাঁর সেই হিসেব অনুযায়ী। ওই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে কিছু বলার নেই। এবং সবাই যে একই ধ্যান- ধারণা, বিশ্বাস নিয়ে চলবেন সেটাও হয় না। যাঁর যাঁর বিচারের নিজস্ব একটা পদ্ধতি বা উপলব্ধি তো থাকবেই। থাকবে দৃষ্টিভঙ্গি। বাবা রয়েছেন তাঁর সেই তেজস্বিতা নিয়ে। আহিরার যেটা খারাপ লাগছে তা হলো, বাবার পা ধরে সাত্যকি তো ক্ষমাও চেয়েছে। ওইভাবে ক্ষমা চাওয়ার ওর কী দায় ছিল? ছেলেটা ওটা করেছে স্রেফ গোপাল মনোহরের যাবতীয় দুঃখকে ভুলিয়ে দিতে। ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু বাবা ওই মুহূর্তেও হৃদয়ের কাছাকাছি থাকতে পারলেন না বা থাকলেন না। সাত্যকির জন্য ওখানেই জমা হয়েছে এক বুক মায়া!

বাড়ির পথে ক্লান্ত, অবসন্ন পায়ে আহিরা হাঁটছে আর ভাবছে। ভাবছে আর সামনে পা ফেলছে। কিন্তু এগোতে পারছে কী? সে যেন এক গোলকধাঁধার মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। প্রাথমিকভাবে বাবাকে কিছুটা নিষ্ঠুর মনে হলেও ওই মানুষটার ভেতরের কান্নার শব্দ সে স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছে। সাত্যকি কলকাতা থেকে ছুটে এসে সমানে বোঝানো সত্ত্বেও প্রচণ্ড ওই চাপের মুখে দাঁড়িয়ে গোপাল মনোহর নিজের স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা নিজের ভেতরে গড়ে তোলা আত্মপ্রত্যয় সম্পর্কে পূর্ণমাত্রায় সচেতন থেকেছেন। তাঁর বোধশক্তি অন্য কারও থেকে খুব একটা কমও নয়। অতএব বাবার সমালোচনা আহিরা করতে পারবে না। এই ব্যাপারে ওই মানুষটাকে সে পুরোপুরি ছাড়ই দিচ্ছে। তবুও…. তবুও মনের কোথায় যেন একটা মেঘ জমা হচ্ছে। একটা প্রশ্নও হালকা মেঘের মতোই ভেসে বেড়ায়, বাবা কী আরও একটু উদারতা দেখাতে পারতেন না? তিক্ততার সৃষ্টি হলে কারও ভেতরে ক্রোধ জন্মানো স্বাভাবিক। কিন্তু ক্রোধান্দ হওয়াটাও কী ঠিক? আহিরা বুঝে উঠতে পারছে না, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। তবে সে যে ভেঙে পড়েছে, পড়ছে, এটা বুঝতে পারছে। সুমিঠ্‌ঠাগুরম গ্রামের সবুজ গাছ-গাছালির সজীব ছবিটাও এই মুহূর্তে তার কাছে আরও বেশি বিবর্ণ লাগছে। পৃথিবীটাই যেন ভেঙে পড়েছে আহিরার মাথায়। এই অবস্থায় বাড়িতে ফিরে সে কীভাবে সাত্যকির চলে যাওয়ার কথা বলবে? তার নিরাশ মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা যা বোঝার বুঝে নিন। আহিরা অবশ্য তার ভেতরের ঝড়কে সামলাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবে।

দাওয়াতেই জবুথবু হয়ে বসেছিলেন গোপাল মনোহর আর মন্দাকিনী। সম্ভবত এই সময়টুকুর মধ্যে ওঁরা কেউই কারও সঙ্গে কথা বলেননি। কঞ্চিবেড়ার গেট দিয়ে আহিরাকে একা ঢুকতে দেখে দু’জনে দু’জনের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। সেই দৃষ্টিতে বোধশূন্য এক শূন্যতা ছাড়া অন্য কিছুই ছিল না।

মন্দাকিনীই প্রথম কথা বললেন। উদগ্রীব কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো রে? সাত্যকি এলো না কেন?

বড়ো রাস্তায় পৌঁছাবার আগেই দেখলাম….আহিরা সামান্য একটু সময় নেওয়ার জন্য থেমেছে কী থামেনি, মন্দাকিনী যেন ঝাঁপিয়ে পড়লেন। মেয়ের মুখের দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে ফের প্রশ্ন করলেন, কী দেখলি?

দেখলাম বাসে উঠে পড়েছে। আমি তখনও অনেকটাই দূরে ছিলাম। ফলে নামিয়ে আনার সুযোগ পাইনি।

সাত্যকির চলে যাওয়াকে কেন্দ্র করে প্রথম প্রতিক্রিয়ায় মন্দাকিনীর মনে হলো, স্বামীকে বেশ কড়া একটা ধাতানি দেওয়া দরকার। লোকটার বেআক্কেলের জন্য ছেলেটা যে ভাবে চলে গেল তাতে কি কোনো বাড়ির মঙ্গল হতে পারে? গোপাল মনোহর ছাড়াও এই বাড়িতে মা গোছের তো একজন মহিলা রয়েছেন। সেই মায়ের মমতা সম্পর্কে ওই কলকাতার ছেলেটা কী ধারণা নিয়ে গেল? মা ছাড়াও রয়েছে এক সদ্য তেইশ পেরোনো কুসুম মনের অনাঘ্রাতা মেয়ে—যার ভেতরে অনেক স্বপ্ন আছে। স্বপ্ন দেখানোর সেই মেয়েটাই বা কী করলো? সাত্যকি কি ওকেও অকৃতজ্ঞ ভাবছে না? দু’দিন আগেই যার দু’হাত সবুজ কাচের চুড়িতে ভরিয়ে দিয়েছে তার কাছ থেকে অন্তত একটু প্রশ্রয় সে আশা করতেই পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হলোটা কী? সব কিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। তবে মন্দাকিনী যেটা বুঝলেন তা হলো, কোনো মতেই গোপাল মনোহরকে এই মুহূর্তে কিছু বলাটা ঠিক হবে না। যা হবার তা তো হয়েই গেছে, ওই মানুষটাকে কথা শোনানোর আর প্রয়োজন নেই। সব প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।

এখন প্রায় সন্ধ্যা। কঞ্চিবেড়ার গেটের কাছে একটা মোড়ায় গোপাল মনোহর চুপচাপ বসে। তাঁর দৃষ্টিতে, তাঁর সারা শরীরে অবসন্নতার সুস্পষ্ট ছাপ থাকলেও কোথায় যেন একটা আশার আলোও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আসলে তাঁর সারাক্ষণই মনে হচ্ছে, এই বুঝি ছেলেটা ফিরে এলো! সাত্যকি ফিরে আসতে পারে এবং সেটা ছ’ঘণ্টা পরে—এই ধারণাটা গোপাল মনোহর কোনো যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারবেন না, কিন্তু তাঁর ওই মনে হওয়ার একটা বিশ্বাস কাজ করে চলেছে। এ এক অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে পড়লেন গোপাল মনোহর। অথচ সাত্যকি যদি সত্যি সত্যিই আহিরার সঙ্গে দুপুরে ফিরে আসতো তা হলে হয়তো মনের ভেতরে কাটাকুটির এই খেলাটা কিছুতেই শুরু হতো না। একটা মানুষকে সামনে না পেলে তার মহত্ত্ব এ ভাবে বেড়ে যায়?

গোপাল মনোহরের চোখে একটা অন্য ছবি আটকে যাচ্ছে। মন্দাকিনী তো বটেই এমনকী আহিরারও একটা পরিবর্তন তাঁর নজর এড়ালো না। এমনিতে আহিরা প্রতি দিনের মতোই কুয়ো থেকে স্নানের জল তুলে দিয়েছে। খাবার জন্য আসন পেতেছে। গামছা, লুঙ্গি, তেল, সাবান এগিয়ে দিয়েছে। খেতে বসে যেমন গল্প হয় তাও করেছে। অর্থাৎ সব কিছুই ঠিকঠাক আগের মতোই চলছে। তা সত্ত্বেও কোথায় যেন একটা দূরত্বের সীমারেখাও তৈরি হয়ে যাচ্ছে। আহিরা যেন ভেতরে ভেতরে দূরের মানুষ হয়ে উঠছে। এটা উপলব্ধি করা যাচ্ছে অথচ দোষারোপ করা যাবে না। সেই সুযোগই নেই। তা হলে গোপাল মনোহর নিজের বাড়িতেই কি একা হয়ে পড়লেন? তাঁর এই ধারণাটা হওয়ার কারণ মন্দাকিনী ও আহিরার অদ্ভুত নির্লিপ্ততা দেখে। সব কিছুর মধ্যে থেকেও ওরা কোনো কিছুর মধ্যেই নেই। তাঁর সঙ্গেও আছে কী? ওই যে গোপাল মনোহর একটু আগেই ভাবলেন, সেটা অনুভব হচ্ছে, তবে কিছুতেই অভিযোগ করা যাবে না।

গোপাল মনোহর এ বারে ব্যাপারটাকে অন্যভাবে দেখতে লাগলেন। কোনো জটিলতা বা অস্পষ্টতার দেওয়াল না তুলে তিনি একেবারে খোলা মনেই ভাবনার ছবিটা মেলে ধরলেন। সাত্যকি নামের ছেলেটা বেশ ঝকঝকে সুপুরুষ। ওকে দেখলে যে কোনো মেয়ের ভালো লাগাটা স্বাভাবিক। আর কথাবার্তায় এবং আচার-আচরণে যে শালীনতাটুকু দেখিয়েছে তাতে ওকে যথেষ্ট শিক্ষিত ও রুচিশীল বলেই মনে হয়েছে। তা এমন একটা ছেলেকে নিজেদের বাড়ির আঙিনায় দেখলে কোনো মেয়ে যদি একটু দুর্বল হয়ে পড়ে সেটা কী অস্বাভাবিক? এখন প্রশ্ন হলো, আহিরা যে একটু নরম হয়ে পড়েছে এটা তিনি বুঝলেন কী করে? কারণ ওই বয়সটা তিনিও পেরিয়ে এসেছেন। তা ছাড়া সাত্যকির যেদিন আসার কথা ছিল, যদিও সে শেষপর্যন্ত আসতে পারেনি—সেদিন আহিরা কিন্তু বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিল। শুধু কী তাই? ওর সাজগোজটাও ছিল দেখার মতো। গোপাল মনোহর তো তখন না বুঝে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসা করবো করবো করছিলেন, যদিও নানা কথায় করে উঠতে পারেননি। এখন কিন্তু সেই ছবিটা বেশ স্পষ্ট। তাঁর মেয়েটা সেদিন সবুজ রংয়ের সিল্কের শাড়ি, ব্লাউজ পরে চোখে পুরু করে কাজল দিয়েছিল। পিঠ ছাপিয়ে চুল ছড়িয়ে মাথায় জড়িয়েছিল জুঁইয়ের মালা। দুই হাতে সবুজ কাচের চুড়ি, যা আগে কখনওই দেখেননি। আহিরা সেদিন নিজেকে ওইভাবে সাজিয়েছিল কি লক্ষ্মী বা লীলার দুধ দুইতে? গোয়ালঘর পরিষ্কার করতে? আহাম্মকের কাজটা তো করেছেন তিনি। নিখিলের ছেলেটাকে

ঘেঁষতে না দিয়ে……। তা ছাড়া ওর ওপর অতো খড়গহস্ত হয়ে ওঠারই বা কি দরকার ছিল? মন্দাকিনী তো সঠিক কথাটাই বলেছে. ‘একটা সম্পূর্ণ নিরপরাধ ছেলেকে যে শাস্তি দিয়ে তুমি বাড়ি থেকে তাড়ালে তার সহনশীলতার কাছে তোমার এই বয়সেও কিছু শেখা উচিত।’ মন্দাকিনী কোনো ভুল বলেনি, এ কথা গোপাল মনোহর মেনে নিচ্ছেন। এই প্রসঙ্গে স্ত্রীর আর একটা কথাও বারবার মনে হচ্ছে ‘নিখিল মৈত্রকে আমি বেশ উদার মানুষই বলবো। তিরিশ বছর বাদেও যে লোকটা কষ্ট পেয়ে ছেলেকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য পাঠাতে পারেন তাঁর ঔদার্য সম্পর্কে সম্ভবত দ্বিতীয় আর একটি কথাও বলা যায়না।’

আহিরা ওই সময়ে এক কাপ চা নিয়ে উপস্থিত হতেই গোপাল মনোহর মেয়ের মুখের দিকে এক অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন। বেশ কুণ্ঠিত গলায় বললেন, বিকেলে তো এক কাপ খেলাম। এখন না হলেও……..

তুমি তো চা ভালোবাসো বাবা, তাই নিয়ে এলাম। খাও—

একটা জলচকি বা মোড়া এনে আমার পাশে বোস। গোপাল মনোহর একটু ইতস্তত করে বলে উঠলেন, জানিস আহিরা, আমার না কিছু ভালো লাগছে না রে!

কেন বাবা?

কেবলই মনে হচ্ছে, আমি কী ভুল করলাম? ছেলেটাকে দুপুরবেলা না খাইয়ে যে ভাবে……ও তো কোনো দোষ করেনি।

সে তো চলে গেছে। সাত্যকির প্রসঙ্গে ইতি টানতে আহিরা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার আর কোনো প্রশ্ন নেই। অতো ভাবছো কেন?

নিখিলের সঙ্গেও আমার দেখা-সাক্ষাতের প্রশ্ন ছিল না। ও কেন তা হলে ক্ষমা চাইতে সাত্যকিকে পাঠালো? গোপাল মনোহর আমতা আমতা করে বলতে লাগলেন, আসলে কি জানিস, ভুল করার সময় আমরা কেউই নিজেকে ছাড়া অন্যের কথা ভাবি না। সময়ের পলিমাটি জমার পরেই বুঝতে পারি আসল গলদটা। কিন্তু ……কিন্তু কিছুতেই আমি ওকে ডাকতে ওর কলকাতায় ছুটে যাবো না। কিছুতেই না। আবার হয়তো দেখবি এই মুহূর্তে আজ যেটা ভাবছি ……

কাল সেটাকে বাতিল করতে হবে।

ঠিক বলেছিস মা, ঠিক বলেছিস। গোপাল মনোহর যেন উঠে দাঁড়াবার জন্য একটু সাহস, কিছুটা শক্তি পেলেন। সেই সঙ্গে অবশ্যই পেলেন একটু প্রেরণাও। আহিরার হাতটা ধরে বললেন, তুই আমাকে ভুল বুঝছিস না তো?

কীসের জন্য?

নিখিল আর সাত্যকির ব্যাপারটা নিয়ে ……

দেখো বাবা, তুমি এই ঘটনাগুলোকে যে ভাবে দেখে এবং বিচার করে সিদ্ধান্ত নেবে বা নিয়েছো তার সঙ্গে অন্য কারও মত যে মিলবে এমন কোনো কথা নেই। একজন মানুষের একটা পদক্ষেপ নিতে ভুল হতে পারে কিন্তু তার ব্যথাটা যাবে কোথায়?

ওই সময়ে হাসতে হাসতে যেশুদাস এসে উপস্থিত হলেন। প্রাণখোলা গলায় বলে উঠলেন, ওহে গোপাল মনোহর চলো—দাবার বোর্ড, ঘুঁটিগুলো যে আমাদের জন্য কান্নাকাটি করছে!

আমার আজকে একদম খেলার ইচ্ছে নেই যেশুদাস।

কি হলো কি তোমার?

শরীরটা ভালো লাগছে না।

এই তো একটা মেয়েদের মতো কথা হয়ে গেল—যেশুদাস নিষ্পাপ হেসে বললেন, বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে একটু রাগারাগি হওয়ার পর মান ভাঙাতে যাও নির্ঘাত শুনতে পাবে ওই একটি আপ্ত বাক্য, ‘বিরক্ত করবে না। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তুমি খেয়ে নাও, শুয়ে পড় গোছের আরও কিছু হয়তো বলবে।’ তা তুমি এই সন্ধে বেলা শরীরের দোহাই দিলে আমি ছাড়বো কেন? চলো—চলো, একটু খেলে আসি।

রাগ নয় যেশুদাস, আমি একটা দুঃখ নিয়ে বসে আছি।

তুমি তো আরও অবাক করা কথা বলছো গোপাল। এই পৃথিবীতে কোন মানুষটার দুঃখ নেই বলতে পারো? দুঃখকে জয় করার, অন্তত গায়ে না-মাখার হিম্মত দেখানোটাই বড়ো কাজ। একটু থেমে এক পলক আহিরার দিকে তাকিয়ে যেশুদাস ফের কোমল গলায় বললেন, যার ঘরে এমন একটা লক্ষ্মী-সরস্বতী এক সঙ্গে বসবাস করছে তার কি কোন দুঃখ থাকতে পারে? না সে কোনো দুঃখকে পরোয়া করে? নাও, নাও, উঠে পড়ো। আর দেরি করা যাবে না—

আহিরা বললো, চাচাজি চলে যাবেন না—আপনার জন্য চা নিয়ে আসছি।

আর চা নয় বিটিয়া। শশীকরণের ওখানে খেলতে গিয়েও অন্তত দু’কাপ চা খেতেই হবে। এতো চা-চা-র মধ্যে পড়ে তোমার এই চাচাজি আবার যেন চায়ের চারাগাছ হয়ে না যায়! কথাটা বলেই যেশুদাস হো-হো করে হেসে উঠে সুমিঠ্‌ঠাগুরমের আকাশ- বাতাস ভরিয়ে দিলেন। আসলে এক একজন মানুষের সংস্পর্শে এলে নিজস্ব অভাব কষ্টগুলো অনেকটাই দুরে সরে যায়। যেশুদাস চাচাজি তেমনই একজন মহিমার মানুষ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *