ক্ষমা – ৮

আট

প্রথম দেখা সাক্ষাতের পর নাদিম ও রোজের মধ্যে প্রায় প্রতিদিন মোবাইলে কথাবার্তা হয়। একদিন রোজ বলল, তোমার জান এত পাষাণ কেন?  

নাদিম বলল, সারাদিন অফিসে কাজ করে ক্লান্ত হলেও না ঘুমিয়ে প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বলি, তবু আমাকে পাষাণ বলবে?

বলব বলব একশ’ বার বলব। ফোনে কথা বলা আর সামনা সামনি কথা বলা বুঝি এক কথা?  

তা অবশষ্য এক কথা নয়, কিন্তু এর বেশি কী আর করতে পারি বল। তবে এবারে বাড়িতে গিয়ে মাকে তোমার কথা জানিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করতে বলেছি।

বিয়ের কথা শুনে আনন্দে রোজের বুকের রক্ত ছলকে উঠল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, নিজের বিয়ের কথা মাকে বলতে পারলে? লজ্জা করল না?

লজ্জা তো করবেই, তবু বলতে হল। কারণ তোমার কথা মনে পড়লে অফিসের কাজে মন বসে না। তা ছাড়া ফোনে কথা বলার সময় তোমাকে একান্ত করে পাওয়ার তীব্র বাসনা হয়। তোমার হয় না?

তোমার চেয়ে বেশি হয়। তাই আজ মাকে তোমার কথা আমিও বলেছি।

তাই নাকি? তা শুনে উনি কী বললেন?

শুনে আতঙ্কিত হয়ে বললেন, কোথাকার কেমন ছেলে, তার স্বভাব চরিত্র কেমন, ফ্যামিলির স্ট্যাটাস কেমন জেনেছিস? আজকাল মোবাইল ফোনে ছেলেমেয়েরা প্রেম করার ফলে কত দুর্ঘটনা ঘটছে। সেসব কাগজেও ছাপা হচ্ছে।

বললাম, তার সবকিছুই ভালো জেনেই তোমাকে বললাম।

কার কাছে জেনেছিস? সে তো মিথ্যেও বলতে পারে? ছেলেটার ঠিকানা দে, তোর বাবাকে খোঁজ খবর নিতে বলব।

তুমি ঠিকানা দিয়েছ?

তোমার অনুমতি না নিয়ে তো দিতে পারি না। তাই বলেছি পরে দেব।

নাদিম বলল, অনুমতি দিলাম। তারপর বলল, কাল তোমাদের ভার্সিটির গেটের কাছে সকাল দশটার সময় আসব। ঐ সময়ে ওখানে থাকবে। তোমাকে নিয়ে সাভার স্মৃতিসৌধে বেড়াতে যাব।

রোজ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, সত্যি বলছ?

আল্লাহর মুমিন বান্দা-বান্দি কখনও মিথ্যে বলে না।

সরি, কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম। তা ছাড়া তোমার আসার কথা শুনে আনন্দের চোটে হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ক্ষমা করে দাও।  

এই সামান্য কথায় ক্ষমা চাওয়ার দরকার নেই। কাল আসবে কিনা বললে না যে?

ইনশাআল্লাহ আসব।

কাল যে আসবে, তোমার ক্লাস নেই?

তিনটে ক্লাস আছে।

ক্লাস মিস করলে ক্ষতি হবে না?

ক্লাস মিস করলে যতটা ক্ষতি হবে, তোমাকে মিস করলে তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি হবে।

তা হলে এখন রাখছি বলে নাদিম সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।

পরের দিন দশটার সময় আসার কথা থাকলেও রাস্তায় জ্যামের কারণে নাদিম এগারটায় সময় জাহাঙ্গীর নগর ভার্সিটির গেটে এসে পৌঁছাল।

এদিকে দেরি হচ্ছে দেখে নাদিম ফোন করে রোজকে দেরি হওয়ার কারণ বলেছে। তাই রোজ অস্থিরতা বোধ করলেও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল।

নাদিম বাস থেকে নেমে রোজকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, এক ঘণ্টা দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত। তারপর তাকে নিয়ে একটা সি.এন.জিতে উঠে ড্রাইভারকে সাভার বাস স্ট্যান্ডে যেতে বলল।

সি.এন.জি চলতে শুরু করলে রোজ বলল, তুমি তো স্মৃতিসৌধে বেড়াবার কথা বলেছিলে সাভারে যাবে কেন?  

নাদিম বলল, ওখানে তো যাবই, তার আগে সাভারে একটা কাজ আছে, সেটা সেরে যাব।

কাজটা কি খুব জরুরি?

হ্যাঁ, জরুরি।

আমাকে বলা যাবে না?

নিশ্চয় যাবে। বলছি শোন, সেই প্রথম দিন ফোনের আলাপ ও তারপর থেকে আজ পর্যন্ত যা কিছু আমরা করছি, সবটাই গুনাহের কাজ। তাই ভেবে। চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা যখন আমাদের মাকে ব্যাপারটা জানিয়েছি তখন আজই কাজি অফিসে আমরা কাবিন করব। তাই কাজি অফিসে যাচ্ছি। আমি সিওর তুমি অমত করবে না। অবশ্য তোমার মতামতকেও প্রাধান্য দেব। তুমি যদি আজ রাজি না থাক, তা হলে যেদিন বলবে, সেদিন করব। যেদিনই করি না কেন, আমাদের গার্জেনদের জানান যাবে না।

আজ এক্ষুনি কাবিন করার কথা শুনে রোজের মনে যেমন আনন্দের বান। ডাকল, তেমনি মা-বাবাকে না জানিয়ে কাজটা করতে বেশ ভয় ভয় করতেও লাগল। তাই কী করবে না করবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

নাদিম বলল, তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না?

রোজ বলল, তোমাকে অবিশ্বাস করার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়।

নাদিম বলল, ছি রোজ, এরকম কথা আর কখনও বলবে না। তারপর আবার বলল, আমাকে যখন এতই বিশ্বাস কর, তা হলে—-  

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে রোজ বলল, আমি রাজি।

আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নাদিম বলল, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমার কাছ থেকে এটাই আশা করেছিলাম। কাবিন ও বিয়ের কাজ শেষ হতে জোহরের নামাযের সময় হয়ে গেল। কাজি অফিস থেকে বেরিয়ে নাদিম বলল, আজ আর স্মৃতিসৌধে যাব না। অন্য একদিন যাওয়া যাবে। এখন খাওয়া দাওয়া করি চল। রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে এসে নাদিম বলল, চল, হোটেলে রুম ভাড়া নিয়ে নামায পড়ে বিশ্রাম নেয়ার সময় গল্প করব।  

হোটেলের রুম ভাড়া নেয়ার কথা শুনে রোজ ভাবল, নাদিম তাকে নিয়ে রাতেও থাকবে। তাই ভয়ার্ত স্বরে বলল, রাতেও থাকবে নাকি? ওদিকে মা বাবা কিন্তু ভীষণ দুশ্চিন্তা করবে।

নাদিম বলল, প্লিজ রোজ, আমাকে এতটা আন্ডার স্টিমেট করো না। আমি কি এতই অমানুষ, তোমার মা-বাবাকে দুশ্চিন্তায় রেখে তোমাকে নিয়ে হোটেলে রাত কাটাব?।

রোজ ভাবল, কথাটা বলা উচিত হয়নি। ছলছল চোখে বলল, কথাটা বলা আমার অন্যায় হয়েছে, ক্ষমা করে দাও।  

নাদিম বলল, চল, তোমাকে গোলচাক্তির কাছে নামিয়ে দিয়ে আমি ঢাকা চলে যাব।

রোজ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তোমার তুলনায় আমার বয়স শুধু কম নয়, জ্ঞানও অনেক কম। তাই তোমার কথা বুঝতে না পেরে কথাটা বলে ফেলেছি। সেজন্য ক্ষমাও চেয়েছি। তবু ফিরে যাবার কথা বলতে পারলে? ওয়াদা করছি, জীবনে আর কখনও কোনো ব্যাপারেই তোমার অবাধ্য হব না। প্লিজ, ক্ষমা করে দাও বলে চোখ মুছতে লাগল।  

নাদিম বুঝতে পারল, রোজ ঠিক কথা বলেছে। ক্ষমা চাওয়ার পর ফিরে যাবার কথা বলা ঠিক হয়নি। বলল, ফিরে যাওয়ার কথা বলে আমিও ভুল করেছি। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। তারপর চল বলে কয়েক পা এগিয়েছে এমন সময় বন্ধু মামুনকে আসতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।  

মামুনও তাদেরকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, আরে দোস্ত তুই?  

নাদিম সালামের উত্তর দিয়ে বলল, তাতে দেখতেই পাচ্ছিস। তারপর আবার বলল, তুই তো ড্যামরা থানার ওসি ছিলি, এখানে বদলি হলি কবে?

মামুন বলল, এই তিন মাস হল সাভার থানায় বদলী হয়ে এসেছি। তারপর রোজের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, পরিচয় করিয়ে দিবি না? তারপর নাদিম কিছু বলার আগে আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ল, মনে হচ্ছে কিছুদিন আগে যার কথা বলেছিলি ইনিই তিনি?

নাদিম হেসে উঠে বলল, তোর আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার অভ্যাস এখনও গেল না। অনেক ঢিল আগে বেজায়গায় লাগলেও আজকের ঢিলটা ঠিক জায়গামতো লেগেছে। হ্যাঁ, ইনিই তিনি। ঘণ্টা খানেক আগে এখানকার কাজি অফিসে আমরা বিয়ে করেছি। এখন ওঁকে ভাবি বলতে পারিস।

মামুন রোজের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, ভাবি কেমন আছেন জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না। কারণ এখনও আপনাদের বাসর রাত হয়নি। তাই বলব, চলুন, এই গরিবের আস্তানায়। সেখানে আমার গিন্নী আছে। আপনাদেরকে দেখলে খুশিতে লাফাতে লাফাতে খাতির যত্ন করবে।  

রোজের দিকে চেয়ে নাদিম বলল, তোমার আপত্তি না থাকলে বন্ধুর বাসায় যাওয়া যাক।

রোজ বলল, আমার কোনো আপত্তি নেই।

মামুন দু’রুমের ফ্লাটে ভাড়া থাকে। দু’বছর আগে বিয়ে করলেও এখনও ছেলেমেয়ে হয়নি। মামুনের বিয়েতে নাদিম গিয়েছিল। সেইদিন মামুন তার বৌয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তারপর আর এই দু’বছরের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। অবশ্য ফোনে মাঝে মাঝে উভয়ে উভয়ের খোঁজ খবর নেয়। মামুনের বৌ-এর নাম সায়মা। সায়মা খুব চটপটে ও প্রাণখোলা মেয়ে। স্বামীকে ওদের সঙ্গে ফিরে আসতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে চাইল।

মামুন বলল, নাদিমকে চিনতে পারলে না? অবশ্য চিনতে না পারারই কথা। দু’বছর আগে বিয়ের দিন ওকে একবার মাত্র দেখেছিলে যাই হোক, আমার চারজন বন্ধুর কথা তোমাকে একসময় বলেছিলাম। এ তাদের মধ্যে একজন হলেও সবার থেকে এর সঙ্গে অন্তরঙ্গ বেশি ছিল। শুধু তাই নয়, আমরা একই গ্রামের ছেলে। নিচের ক্লাস থেকে এক সঙ্গে মাস্টার্স পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। তারপর রোজের দিকে চেয়ে ইশারা করে বলল, তোমার মনে আছে কিনা জানি না, ওঁর সঙ্গে নাদিমের সম্পর্কের কথা একদিন তোমাকে বলেছিলাম। আজ ওঁরা গার্জেনদের অগোচরে ঘণ্টা দেড়েক আগে কাজি অফিসে বিয়ে করেছে। তারপর হোটেলে খেয়ে বেরিয়ে আমার সঙ্গে দেখা হতে নিয়ে এলাম। এখন তোমার কাছে দিয়ে গেলাম, তোমার যা কর্তব্য করে ফেল। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তারপর নাদিমকে উদ্দেশ্য করে বলল, দুপুরে খেতে এসেছিলাম, এবার আসি। সায়মা খুব পটু মেয়ে। আশাকরি, আমি না থাকলেও তোদের খাতির যত্নের অভাব হবে না। আর শোন, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত চলে যাবি না। তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করব। তারপর কেউ কিছু বলার আগে হন হন করে বেরিয়ে গেল।  

সায়মা তাদেরকে একটা রুমে নিয়ে এসে বলল, এটা গেস্টরুম আর আপনারা আমাদের গেস্ট। স্বাধীনভাবে এখানে গল্পটল্প করবেন, না রেস্ট নেবেন সেটা আপনাদের ব্যাপার। আমি গেলাম আপনাদের মেহমানদারির ব্যবস্থা করতে। এই বলে চলে যাবার সময় দরজা ভিড়িয়ে দিল।  

মামুন ফিরল চারটেয়। ততক্ষণে সায়মা কয়েক পদের নাস্তা বানিয়ে ফেলেছে।  

নাস্তা খেয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে নিতে পাঁচটা বেজে গেল। বিদায় নেয়ার সময় নাদিম বলল, সামনের শুক্রবার বিকেলের দিকে আমরা স্মৃতিসৌধে বেড়াতে আসব, তুই তোর বৌকে নিয়ে আসবি।

মামুন বলল, ঠিক আছে। তবে তোরা যদি সকালের দিকে এখানে আসিস, তা হলে খাওয়াটাও জব্বর হবে আর একসঙ্গে স্মৃতিসৌধে বেড়াতে যাওয়াও হবে।

নাদিম বলল, তা সম্ভব নয়, আমরা বিকেলে ডাইরেক্ট স্মৃতিসৌধে যাব। তোরা ওখানে আসবি।

মামুন বলল, সম্ভব নয় যখন তখন আর কী করা, তুই যা বললি তাই হবে। চল তোদেরকে বাসে তুলে দিয়ে আসি।

নাদিম রোজকে তাদের বাড়ির কাছে পৌঁছে দিয়ে ফিরার সময় বলল, মানুষ মাত্রই ভুল করে। আজকের এই দিনে তোমাকে কাঁদানো আমার উচিত হয় নি। সেজন্যে আবার ক্ষমা চাইছি।

রোজ অশ্রুভরা চোখে কিছু বলতে যাচ্ছে দেখে তাকে থামিয়ে দিয়ে নাদিম বলল, রাতে ফোন করব তখন যা বলার বলো। এবার ঘরে যাও এমনিই দেরি হয়ে গেছে, আর দেরি করা ঠিক হচ্ছে না। তারপর আসি বলে সালাম বিনিময় করে ফিরে আসতে লাগল।

রোজ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তার দিকে চেয়ে রইল। আড়াল হয়ে যেতে ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল। ঘরে যখন ঢুকল তখন মাগরিবের নামাযের প্রায় শেষ সময়। তাড়াতাড়ি অযু করে নামায পড়ল।

আয়শা খাতুন মেয়েকে ফিরতে দেখেছেন। তখন কিছু না বলে পরে এক সময় মেয়ের রুমে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ফিরতে এত দেরি হল কেন? এরকম দেরিতো আগে হত না। মনে হয় সেই ছেলেটার সঙ্গে আজও বেড়াতে গিয়েছিলি?

রোজ মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

আয়েশা খাতুন আতঙ্কিত হয়ে বললেন, আমার কথার উত্তর না দিয়ে কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে বলবি তো?

রোজ একইভাবে থেকে বলল, তোমাদের না জানিয়ে একটা কাজ করে ফেলেছি।

কাজটা কী বলবি তো?

বকবে না বল।

তোকে কখনও বকাবকি করেছি? এবার বল কী করেছিস।

আমরা আজ কাজি অফিসে কাবিন করে বিয়ে করেছি।

আয়েশা খাতুন কথাটা শুনে ভীষণ রেগে গেলেন। রোজ একমাত্র সন্তান, ছোটবেলা থেকে তাকে কখনও এতটুকু বকাঝকা করেন নি। বড় আদরের মেয়ে। তাই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাগ সামলে নিয়ে বললেন, আমাকে ছেড়ে দিয়ে বস।

রোজ মাকে ছেড়ে দিয়ে বসে মুখ নিচু করে চোখের পানি ফেলতে লাগল।

আয়েশা খাতুন বললেন, তুই এরকম কাজ করবি ভাবতেই পারছি না। আল্লাহ না করুক, ছেলেটা যদি চরিত্রহীন লম্পট হয়, তা হলে কী হবে ভেবে দেখেছিস? তোর বাবা জানলে কী ঘটনা ঘটবে আল্লাহ মালুম। তোর দাদা দাদিই বা কী বলবেন? আর গ্রামের লোকজন ও আত্মীয়-স্বজনরা শুনে কী মনে করবে? এসবের কোনোটাই তুই ভাবলি না?

রোজ মায়ের দু’পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বলল, একথা তুমি এখন কাউকেই জানাবে না। তা হলে কেউ কিছু বলতে পারবে না। আমার অনার্সের ফাইন্যাল পরীক্ষার পর ও তার মা-বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পাঠাবে বলেছে। আর ওর ব্যাপারে তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করবে না। ধার্মিক ফ্যামিলির ধার্মিক ছেলে। মাস্টার্স করে ঢাকায় ভালো চাকরি করে। গ্রামের অবস্থাও ভালো। তারপর কেন এখন গোপনে বিয়ে করল বলল।

আয়েশা খাতুন বললেন, তুই এসব জানলি কী করে? ছেলেটা তোকে বলেছে বুঝি?

অনেক আগে বলেছিল। বেশ কিছুদিন আগে আমি শাহিনকে ওদের গ্রামে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছিলাম। শাহিন ফিরে এসে যা বলল, সেসব ওর কথার সঙ্গে মিলে গেছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে শাহিনকে জিজ্ঞেস করতে পার।

ছেলেটার পূর্ণ বায়োডাটা তোর কাছে আছে?

আছে।

নিয়ে আয়তো দেখি।

রোজ নিজের আলমারি থেকে এনে মায়ের হাতে দিল।

আয়েশা খাতুন পড়ে বললেন, এটা আমার কাছে থাক। তারপর বললেন, তোদের বিয়ের কথা শাহিন জানে?

না।

তোর বাবা অফিসে চলে যাবার পর ওকে একদিন আসতে বলবি। দেখব ছেলেটা কেমন। তুই পড়, আমি এখন যাই বলে আয়েশা খাতুন চলে গেল।

রোজ ভেবেছিল, বিয়ের কথা শুনে মা খুব রেগে গিয়ে বকাবকি করবে, তা করল না দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল।

.

বন্ধু মামুনের গেস্টরুমে নাদিম রোজকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করেছে। তখন রোজ জীবনে প্রথম স্বামীর আলিঙ্গন ও আদরে শুধু ভয়মিশ্রিত আনন্দে কেঁপে কেঁপে উঠেছে। প্রতিদান দেয়ার শত ইচ্ছে হলেও লজ্জায় তা পারেনি। রাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও রোজের কিছুতেই ঘুম আসছে না। চোখ বন্ধ করলেই স্বামীর আদর করার কথা মনে পড়তে লাগল। এক সময় হঠাৎ তার মনে হল, আমি তাকে আদরের প্রতিদান দিইনি বলে মনে হয় ফোন করার কথা বললেও রাগ করে করল না? এমন সময় মোবাইল বেজে উঠতে বুকটা ধক করে উঠল। নাম্বার দেখে রিসিভ করে সালাম দিল।

নাদিম সালামের উত্তর দিয়ে বলল, দেরিতে ফেরার জন্য বাড়িতে কেউ কিছু বলেনি তো?

রোজ বলল, মা শুধু দেরির কারণ জিজ্ঞেস করেছিল।

তুমি কী বললে?

আমি কখনও মিথ্যা বলি না, তাই সত্য কথাই বললাম।

শুনে মা কিছু বলেন নি?

তেমন কিছু বলেননি, তবে খুব রেগে গিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। আমি কান্নাকাটি করে ম্যানেজ করে নিয়েছি। শেষে বলল, একদিন ছেলেটাকে নিয়ে আসিস দেখব।

আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নাদিম বলল, আল্লাহ আমাকে অনেক বড় দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলেন। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসার পর থেকে ঐ ব্যাপারটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। শোন, সামনের শুক্রবারে স্মৃতিসৌধে বেড়াতে যাওয়া হবে না। কারণ ওখান থেকে ফিরে আসার পর বাড়ি থেকে বাবা ফোন করেছিলেন, মায়ের শরীর খারাপ। বৃহস্পতিবার অফিস করে বাড়ি যাব। কবে বেড়াতে যাব, বাড়ি থেকে ফিরে এসে জানাব।  

রোজ জিজ্ঞেস করল, মায়ের কী হয়েছে?

নাদিম বলল, মায়ের অনেক আগে থেকে হার্টের প্রবলেম আছে, সেটা বেড়েছে।

রোজ বলল, বাড়িতে গিয়ে মা কেমন থাকেন জানাবে। তোমার বন্ধুকে একথা জানিয়েছ?

হ্যাঁ, জানিয়েছি।

আমার মা যে তোমাকে দেখতে চেয়েছে তার কী হবে?  

বেশতো যেদিন বেড়াতে যাব, সেদিন সকালে তোমাদের বাড়িতে যাব, তারপর বেড়াতে যাব।

হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে। তবে শুক্রবার আসবে না, অন্যদিন বেলা ন’টার পর আসবে। কারণ বাবা অফিসে চলে যাবার পর মা তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে।

নাদিম হেসে উঠে বলল, ঠিক আছে, তাই হবে। তারপর আবার বলল, সেদিন কিন্তু এক ঢিলে দু’পাখি মারব।

কথাটা বুঝলাম না।

অনার্স করছ অথচ এই সামান্য কথাটাও বুঝতে পারলে না?

অনার্স করার সঙ্গে এই কথার কী সম্পর্ক?

বোকার মতো কথা বলছ কেন?

ঠিক আছে, আমি না হয় বোকা, তুমি বুদ্ধিমান হলে কথাটা বলার উদ্দেশ্য বলছ না কেন?

তার মানে তুমিও আমাকে বোকা বলে প্রতিশোধ নিলে? ঠিক আছে বলছি, তোমাদের বাড়িতে গেলে তোমার মা আমাকে দেখবেন। আর আমি তোমাকে শুধু দেখব না, চান্স পেলে আদর করে মনের আশা মেটাব। এবার নিশ্চয় কথাটার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে।

রোজ হেসে উঠে বলল, দুই কোথাকার।

নাদিম বলল, দুষ্টুমি করলে আনন্দ পাওনি?

রোজ লজ্জা পেয়ে বলল, যাও, বলব না।

নাদিম বলল, এখন না বললেও তখন তোমাকেও দুষ্টুমি করাতে বাধ্য করব, কথাটা মনে রেখ।

রোজ কিছু না বলে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

নাদিম বলল, কী হল, কিছু বলছ না কেন?

রোজ বলল, কী বলব কিছু ভেবে পাচ্ছি না।

নাদিম বলল, তা হলে এবার রাখি?

রোজ বলল, এত তাড়াতাড়ি রাখতে চাচ্ছ কেন? আমার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না বুঝি?

নাদিম বলল, খুব ভালো লাগছে; কিন্তু তুমি তো কিছু বলছ না। তা ছাড়া ভোরে উঠে অফিস যাবার প্রস্তুতি নিতে হবে ভেবে বলেছি। ঘড়ি দেখলে তুমিও রাখার কথা বলতে।

রোজ তিনটে বেজেছে দেখে বলল, সত্যি, এখন আমাদের ঘুমান উচিত। তারপর সালাম বিনিময় করে আল্লাহ হাফেজ বলে লাইন কেটে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *