ক্ষমা – ৬

ছয়

আজ শাহিন বেলা দুটোর সময় ভার্সিটির লাইব্রেরিতে একটা বই জমা দিয়ে অন্য একটা বই নিয়ে বেরিয়েই শিউলির সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লাগতে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি তাকে সাইড দিতে গেল, কিন্তু তবু ধাক্কাটা জোরে না হয়ে হালকাভাবে হল।  

শিউলি অন্যমনস্ক হয়ে একটু দ্রুত হাঁটছিল। তাই কোনো দিকে খেয়াল ছিল না। ধাক্কা লাগতে সরি বলে মুখের দিকে তাকিয়ে শাহিনকে দেখে লজ্জা পেয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না, একটু অনমনস্ক ছিলাম। প্লিজ, ক্ষমা করে দিন।

শাহিন কিছু না বলে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল।

তাই দেখে শিউলিও তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। কেউ এদেরকে দেখলে ভাববে, একজোড়া প্রেমিক প্রেমিকা অনেক দিন বিরহের পর একে অপরকে দেখে বাস্তবজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

প্রথমে শাহিন সামলে নিয়ে সালাম দিয়ে বলল, ক্ষমা চাইছেন কেন? আমি কিছু মনে করিনি।  

শিউলি কিন্তু তার কথা শুনতে পায়নি। সে একইভাবে চেয়ে রইল।

শাহিন ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার হাতের বইটা ধরে নাড়া দিয়ে বলল, মনে হয় আমাকে চিনতে পারছেন না?  

এবার শিউলি বাস্তবে ফিরে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?

সালামের উত্তর দিয়ে শাহিন বলল, প্রথমে আমি সালাম দিয়েছিলাম উত্তর দেননি।

শিউলি ওয়াআলায়কুমুস সালাম বলে বলল, আজ যে আমার কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না। সকাল থেকে মনটা খুবই বিচলিত।

কারণ, জানতে পারি?

কারণটা জানতে হলে সময়ের দরকার। এখন আপনার ক্লাস নেই তো?

না।

তা হলে আসুন বলে শিউলি হাঁটতে শুরু করল।

শাহিন তার সঙ্গে না গিয়ে চিন্তা করতে লাগল, ওর সঙ্গে জড়ানো কি ঠিক হবে? তখন তার রোজের কথা মনে পড়ল, “শিউলি সম্ভ্রান্ত ও ধনী হিন্দু পরিবারের মেয়ে। ওর এক দাদা, মানে বড় ভাই মেজর। রূপে মুগ্ধ হয়ে ওর সঙ্গে অনেকে প্রেম নিবেদন করতে চেয়েছিল; কিন্তু পরিচয় পেয়ে ফিরে গেছে।”  

শিউলি কিছুদূর গিয়ে শাহিন আসছে না বুঝতে পেরে তার কাছে ফিরে এসে অবাক কণ্ঠে বলল, কী ব্যাপার দাঁড়িয়ে রয়েছেন যে আমার বিচলিত হবার কারণ শুনবেন না? এনিথিং রং?

হঠাৎ শাহিনের মনে হল, রোজ আমার সঙ্গে কৌতুক করার জন্য শিউলির সম্পর্কে মিথ্যে বলেনি তো? যাচাই করে দেখা যাক।

তার মুখের দিকে চেয়ে শিউলি বলল, কী এত ভাবছেন বলুন তো।

না, ও কিছু না বলে শাহিন বলল, চলুন, কোথায় যেন নিয়ে যাবেন। বললেন।

শিউলি তাকে আর্টস বিল্ডিং-এর পিছনে একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে এসে বসে শাহিনকেও বসতে বলল। তারপর বলল, তখন কেমন আছেন জিজ্ঞেস করেছিলাম উত্তর দেন নি।

শাহিন আলহামদুলিল্লাহ…ভালো আছি বলে বলল, একটু অনমনস্ক ছিলাম, তাই আপনার কথা শুনতে পাইনি। আপনি কেমন আছেন বলুন?

শিউলি বলল, আলহামদুলিল্লাহ, আমিও ভালো আছি।

সে হিন্দু কিনা জানার জন্য শাহিন জিজ্ঞেস করল, আলহামদুলিল্লাহ শব্দের অর্থ জানেন?

শিউলি বলল, মুসলমান ঘরের মেয়ে হয়ে আলহামদুলিল্লাহ শব্দের মানে জানব না, ভাবলেন কী করে?

শাহিন অবাক কণ্ঠে বলল, আপনি মুসলমান?

শিউলিও অবাক কণ্ঠে বলল, কেন, আপনার কি মনে হয় অন্য জাতের মেয়ে? অন্য জাতের মেয়েরা কি বোরখা পরে? সালাম দেয়?

শাহিন বুঝতে পারল, রোজ তাকে ঘোল খাইয়েছে। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে আমতা আমতা করে বলল, না, মানে একজনের কাছে শুনেছিলাম, আপনি মুসলমান না। আর বোরখা পরার কথা যে বললেন, আজকাল বখাটেদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অন্য জাতের কোনো কোনো মেয়ে বোরখা ব্যবহার করে এবং অনেকে সালামও দেয়।  

শিউলি বলল, তা না হয় মানলাম; কিন্তু আমি মুসলমান না, একথা কে বলেছে এবং কোন জাতের বলেছে?

শাহিন বলল, কে বলেছে তা বলা যাবে না, তবে কোন জাতের বলেছে তা। বলছি, আপনি সম্ভ্রান্ত ধনী হিন্দু পরিবারের মেয়ে। আপনার এক দাদা, মানে বড় ভাই মেজর।  

শিউলি বেশ জোরে হেসে উঠে বলল, যে এসব বলেছে, সে কোনো কারণে আপনাকে ঘোল খাইয়াছে।

শাহিন মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ, এখন আমারও তাই মনে হচ্ছে। তারপর বলল, প্লিজ, এত জোরে হাসবেন না। হাদিসে আছে, আমাদের নবী করিম (সঃ) বলেছেন, “বেশি জোরে হাসলে হৃদয় মরে যায় এবং মুখমণ্ডলের উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়।”

শিউলি বলল, আল্লাহ মাফ করুক, আমি এই হাদিসটা জানতাম না। তারপর বলল, কথাটা যেই বলুক তার নিশ্চয় কোনো উদ্দেশ্য আছে। যাই হোক, আমি যে মুসলমান এখন নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন?

শাহিন বলল, হ্যাঁ, পেরেছি।

শিউলি বলল, এ প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে রোজের কথা বলুন। ও আজ আসেনি কেন বলতে পারেন?

শাহিন কখনও মিথ্যা না বললেও আজ রোজের কারণে বলল, ওর না কী দশটায় একটা ক্লাস ছিল। তাই আমার থেকে দু’ঘণ্টা আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে।

শিউলি কপাল কুঁচকে বলল, আজ আমাদের প্রথম ক্লাস ছিল বারটায়, ওতো ক্লাসে আসেনি। মনে করেছিলাম, আসতে দেরি হয়েছে বলে হয়তো লাইব্রেরিতে ঢুকেছে। তাই খুজতে এসে আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। পথে কোনো বিপদ হয়নি তো?

শাহিন হাসি চেপে রেখে বলল, দাঁড়ান ওকে ফোন করি। তারপর কয়েকবার ফোন করে বুঝতে পারল, রোজ মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে।

সে কথা জানাতে শিউলি আতঙ্কিত স্বরে বলল, আমার যেন মনে হচ্ছে, নিশ্চয় পথে কিছু না কিছু হয়েছে। কারণ ও শুধু শুধু ক্লাস মিস কখনও করেনা। আমার নাম্বার বলছি সেভ করে নিন। বাড়িতে গিয়ে ওর খবর জানাবেন।

শাহিন তার নাম্বার সেভ করার পর বলল, চলুন, এবার উঠা যাক।

শিউলি বলল, আরও কিছুক্ষণ বসুন, এত তাড়া কিসের? আপনার নাম্বারটা বলুন সেভ করে নিই। আপনি যদি রোজের খবর জানাতে ভুলে যান, তা হলে আমি আপনাকে ফোন করব।  

শাহিন বলল, আমার নাম্বার সেভ করার দরকার নেই। বাড়িতে গিয়ে আপনি রোজকে ফোন করবেন।

শিউলি বলল, আপনিই তো বললেন, বোজ মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে, পরে যদি চালু করতে ভুলে যায়। তাই আপনার নাম্বারটা সেভ করা থাকলে আপনাকে ফোন করে ওর খবর জানবো।

শাহিন তার মুখের দিকে চেয়ে নাম্বার বলল।

শিউলি নাম্বার সেভ করে নিয়ে তার দিকে চাইতে চোখে চোখ পড়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড সেও তার চোখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, কী দেখছেন?

শাহিন লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, আসি, আল্লাহ হাফেজ।

শিউলিও দাঁড়িয়ে উঠে আল্লাহ হাফেজ বলে জিজ্ঞেস করল, আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না যে?

শাহিন চলতে শুরু করে বলল, অন্য একদিন দেব।

শিউলি দ্রুত এগিয়ে এসে তার পথরোধ করে বলল, আপনাকে পাওয়াই যায় না, অন্য একদিন বলবেন কেমন করে?

শাহিন বলল, আমার নাম্বার তো নিলেন, পেতে অসুবিধে হবে না। কথা শেষ করে পাশ কেটে দ্রুত হেঁটে চলে গেল।

শিউলি তার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে ভাবল, আমি যেমন ওকে নিয়ে ভাবি, ও-ও নিশ্চয় আমাকে নিয়ে ভাবে। আড়াল হয়ে যেতে নিজের গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল।  

শাহিন বিকেলে একটা টিউসনি করে। আজ ভার্সিটি থেকে ফিরে টিউসনি করল। তারপর মসজিদ থেকে আসরের নামায পড়ে ঘরে এল। কাজের মেয়ে। চা নাস্তা নিয়ে এলে তাকে রোজ ফিরেছে কিনা জিজ্ঞেস করল।

কাজের মেয়ে বলল, আপা কিছুক্ষণ আগে ফিরেছে।

শাহিন বলল, তাকে আমার কাছে আসতে বল।

রোজ ঘরে ফিরে চা নাস্তা খেয়ে নিজের রুমে বসে বসে আজকের অভিসারের কথা ভাবছিল। এমন সময় কাজের মেয়ে এসে বলল, শাহিন ভাই আপনাকে ডাকছে।

তার কথা শুনে রোজের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। শাহিনের রুমে এসে বলল, কেন ডেকেছিস বল।

শাহিন বলল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনবি, না বসবি?

রোজ বসে বলল, এবার বল।

শাহিন বলল, দুটো কারণে তোকে ডেকেছি। প্রথম কারণটা তুই জানিস। আর দ্বিতীয় কারণটা অবশ্য জানিস না। তুই প্রথমটা বলার পর আমি দ্বিতীয়টা বলব।  

রোজ বলল, বড় ভাই হয়ে ছোট বোনের অভিসারের কথা শুনতে চাওয়া কি উচিত? তবু বলছি, নাদিমের সবকিছু পজেটিভ। এর বেশি কিছু বলতে পারব না। এবার দ্বিতীয় কারণটা তুই বল।

শাহিন বলল, তুই শিউলির ব্যাপারে আমার কাছে মিথ্যে বলেছিস কেন?

প্রমাণ করতে পারবি?

অফকোর্স। শিউলি আজ নিজে আমাকে বলেছে, সে মুসলমান পরিবারের মেয়ে। আর তার একটা মাত্র ভাই। সে বিদেশে সেটেল্ড। মেজর হবে কী করে?

মিথ্যে করে বলার কারণ আছে।

কারণটা বলতো শুনি।

বললে বিশ্বাস করবি তো?

সেটা আমার ব্যাপার, তুই বল।

তোকে একটা সারপ্রাইজ দেব বলেছিলাম মনে আছে?

তা থাকবে না কেন?

ঐ সারপ্রাইজটার জন্য শিউলির ব্যাপারে তোকে মিথ্যে বলেছিলাম।

বুঝলাম না, হেঁয়ালি না করে সোজা কথায় বল।

তুই যে শিউলিকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিস এবং তার কথা ভাবিস। সেকথা বুঝার পর শিউলির মনের খবর নেয়ার চেষ্টা করে জানতে পারলাম সেও তোকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে এবং তোর কথা ভাবে। শিউলির মনের খবর তোকে জানিয়ে সারপ্রাইজ দেব বলে যাতে তুই তার কাছে না ঘেঁষিস সেজন্যে তার সম্পর্কে মিথ্যা করে ঐসব বলেছিলাম। তবে একটা কথা সত্যি বলেছি, সেটা হল ও খুব বড়লোকের মেয়ে ও নাতনি।

ওরকম মিথ্যে বলা তোর উচিত হয়নি। আর শোন, কোনো মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তার কথা ভাবলেই যে, তাকে একান্ত করে পেতে হবে, এরকম যারা চিন্তা করে তাদের দলে আমি নই। আর একটা কথা মনে রাখবি, তুই প্রেম করে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস, সেটা তোর নিজস্ব ব্যাপার। আমাকে সেরকম ভাববি না। যাই হোক, আজ শিউলি তোকে দেখতে না পেয়ে লাইব্রেরিতে খুঁজতে এসে আমার সঙ্গে দেখা হতে তোর কথা জিজ্ঞেস করল। তারপর যা কিছু কথা হয়েছে, তা থেকে যতটুকু বলা উচিত ততটুকু বলে বলল, আমাকে তোর আর সারপ্রাইজ দেয়া হল না, তাই না?  

হ্যাঁ, তাই। তারপর জিজ্ঞেস করল, আমি যে তোকে ওর সম্পর্কে ঐ সব বলেছি, সেসব ওকে বলেছিস না কি?

ও জিজ্ঞেস করেছিল, আমি বলেছি বলা যাবে না।

আজ ভার্সিটি কেন যাইনি বলেছিস না কি?

না, বলিনি।

ধন্যবাদ জানিয়ে এবার আসি বলে রোজ সেখান থেকে চলে এল।

.

মসজিদ থেকে এশার নামায পড়ে এসে শাহিন পড়তে বসল। এমন সময় মোবাইল বেজে উঠতে নাম্বার দেখে বুঝতে পারল শিউলি করেছে। রিসিভ করে সালাম বিনিময় করে বলল, আমারই আগে ফোন করা উচিত ছিল। উচিত কাজটা করিনি বলে ক্ষমা চাইছি।

শিউলি বলল, উচিত অনুচিত ভাবিনি, রোজের খবর বলুন।

ওর খবর ভালো। ভার্সিটি যাওয়ার কথা ঘরে বলে গেলেও অন্য কোথায় যেন গিয়েছিল।

কোথায় গিয়েছিল জিজ্ঞেস করেন নি?

জিজ্ঞেস করলেও বলবে না, তাই করিনি। কাল আপনি জিজ্ঞেস করলে আপনাকে নিশ্চয় বলবে।

শিউলির মনে হল, ও হয়তো আজ নাদিমের সঙ্গে দেখা করার জন্য ভার্সিটি যায়নি। তাই যদি হয়, তা হলে কাল সবকিছু জানা যাবে।  

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে শাহিন বলল, মনে হচ্ছে কিছু যেন ভাবছেন?

শিউলি বলল, না, মানে রোজের কথাই ভাবছিলাম।

তা হলে এবার রাখি?

এত তাড়া কিসের? আমার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না বুঝি?

না, তা কেন? ভাবলাম, রোজের খবর জানার জন্য ফোন করেছিলেন, তার খবর জানার পর কথা বললে হয়তো বিরক্ত হবেন। তাই ফোন রাখার কথা বলেছি।

যদি বলি বিরক্ত না হয়ে বরং অন্য কিছু হচ্ছে?

শাহিন এই কথার অর্থ বুঝতে পেরে মনে মনে খুশি হলেও তা যাতে প্রকাশ না পায় সেজন্যে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

কী হল? ফোন ধরে কেউ এতক্ষণ চুপ করে থাকে?

কী বলব বুঝতে পারছি না বলে চুপ করে আছি।

তা হলে আমি বলি?

বলুন।

কাল, না-না, পরশু আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। অভাগীর এই আশা কি পূরণ করবেন?

জেনেছি আপনি খুব বড়লোকের মেয়ে ও বড়লোক নানার একমাত্র নাতনি। আপনি যদি অভাগী হন, তা হলে আপনার তুলনায় আমি তো নিতান্ত এক হতভাগ্য ছেলে।

আমি খুব বড়লোকের মেয়ে একথা কার কাছ থেকে জেনেছেন? নিশ্চয় রোজ বলেছে?

যেই বলুক না কেন, কথাটা অস্বীকার করতে পারবেন?

সত্যকে অস্বীকার করব কেন? তবে একথা মনে হয় জানেন না। রাজার মেয়েরও দুঃখ থাকে।

দুঃখ কমবেশি সব মানুষের আছে। তবে যারা আল্লাহ ও তার রাসুল (সাঃ)-এর আদেশ মোতাবেক চলে, তাদেরকে আল্লাহ দুঃখ সহ্য করার তওফিক দেন। আর তারা দুঃখকে দুঃখ বলে মনে করে না।

কথাগুলো আমিও জানি।

তা হলে নিজেকে অভাগী বলছেন কেন?

শুধু ধন-ঐশ্বর্য থাকলেই কেউ ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী হয় না। মানুষের এমন কিছু চাওয়া পাওয়া থাকে, যা না পেলে দুর্ভাগা বা অভাগী হয়। অনুগ্রহ করে যদি পরশু দিন আমার সঙ্গে দেখা করেন, তা হলে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করব।

তার এই কথারও ইঙ্গিত বুঝতে পেরে শাহিন বলল, ভাগ্য যিনি লিখেছেন, তিনি ছাড়া আর কেউ কে ভাগ্যবতী ও ভাগ্যবান জানে না। দেখা করার কথা

যে বললেন, প্রয়োজন থাকলে নিশ্চয় দেখা করব।

শিউলি বলল, প্রয়োজন না থাকলে কেউ কারও সঙ্গে দেখা করে বুঝি?

করে।

যেমন?

অনেকে সময় কাটাবার জন্য, অনেকে আড্ডা দেয়ার জন্য, আবার অনেকে বলে… শাহিন থেমে গেল।

শিউলি বলল, শেষের কথাটা না বলে থেমে গেলেন কেন?

কথাটা বললে আপনি মাইন্ড করবেন; তাই থেমে গেলাম।

কথা দিচ্ছি মাইন্ড করব না, আপনি বলুন।

কাউকে কারও ভালো লাগলে দেখা করার কথা বলে প্রেম নিবেদন করে।

আমার সম্পর্কে আপনার ধারণা কোনটা, প্রথম, দ্বিতীয় না তৃতীয়টা?

বলা যাবে না।

কেন বলা যাবে না?

তাও বলা যাবে না।

ঠিক আছে, না বললে তো কিছু করার নেই। এবার প্রেম সম্পর্কে আপনার ধারণা বলুন।

তা জেনে আপনার কী লাভ?

লাভ অলাভের কথা ভেবে কথাটা বলিনি, বলেছি আপনার ধারণা জানার জন্য।

শাহিন কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, প্রেম খুব পবিত্র শব্দ। সেটা মানবিক হোক আর আধ্যাত্মিক হোক। কিন্তু বর্তমানে এই পবিত্র শব্দকে অপবিত্র জায়গায় ব্যবহার করা হচ্ছে।

আমি মানবিক প্রেমের ধারণা জানতে চাই।

আজকাল ছেলেমেয়েরা যে প্রেম করছে, তাকে পবিত্র প্রেম বলে না। তাই এরকম প্রেম ইসলামে নিষিদ্ধ। শুধু তাই নয়, সাবালক ছেলেমেয়েদের মধ্যে মেলামেশা করাও নিষিদ্ধ। এমন কী স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটিতে কো এডুকেশনে আমরা যে লেখাপড়া করছি, তাও নিষিদ্ধ। তবে ছেলে মেয়েরা যদি আলাদা আলাদা ভাবে এবং মেয়েদের মেয়ে শিক্ষিকা ও ছেলেদের পুরুষ শিক্ষক শিক্ষা দান করে, তাহলে ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। আর মেয়েরা অবশ্যই হিজাব পরে শিক্ষাঙ্গনে যাবে। ইসলামের এই আদেশ উপেক্ষা করার ফলে যে কত অঘটন ঘটছে, সেসব আমাদের সমাজে অহরহ দেখছি ও প্রতিদিন খবরের কাগজেও ছাপা হচ্ছে।

শিউলি বলল, আপনার কথাগুলো খুব দামি এবং ওগুলো আমিও জানি। আমি বিশেষ প্রয়োজনে দেখা করতে চাচ্ছি।  

শাহিন বলল, ঠিক আছে, আগামী পরশু দিন বেলা দুটোর সময় লাইব্রেরিতে আসুন দেখা হবে।

শিউলি ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, এতক্ষণ ফোনে কথা বলে আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম। তাই ক্ষমা চাইছি। আশা করি, ক্ষমা করে দেবেন। তারপর সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।

পরের দিন শিউলি অফ পিরিয়ডে রোজকে জিজ্ঞেস করল, কাল ক্লাস মিস করলি কেন?

রোজ কিছু না বলে তার মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টিমিষ্টি হাসতে লাগল।

কীরে, মিটিমিটি হাসছিস কেন? আমার কথার উত্তর দিবি তো?

তার আগে বল, কাল শাহিনের সঙ্গে তোর কী কী কথা হয়েছে?

শিউলি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, আমি আগে প্রশ্ন করেছি, তাই আমার প্রশ্নের উত্তর আগে দিবি। তারপর তোর প্রশ্নের উত্তর দেব।

রোজ কীভাবে কথাটা শুরু করবে চুপ করে চিন্তা করতে লাগল।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শিউলি বলল, তুই যখন বলতে পারছিস না তখন আমিই বলি?

রোজ বলল, নিশ্চয় কাল তোকে শাহিন বলেছে?

না, শাহিন ভাই বলেন নি। আমি এমনই অনেক কিছু বলতে পারি।

রোজ ভ্রু কুঁচকে বলল, শাহিন কবে থেকে তোর ভাই হল রে?

শিউলি বলল, বান্ধবীর ভাইকে ভাই বলা দোষের নাকি?

তা অবশ্য দোষের না। এবার অনেক কিছু কী বলতে পারিস বলতো শুনি।

নিশ্চয় নাদিম সাহেব কাল তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন?

রোজ অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস।

শিউলি বলল, তা হলে দেরি না করে ফলাফল বলে ফেল।

রোজ মৃদু হেসে বলল, আল্লাহর রহমতে তার সবকিছু ভালো।

আলহামদুলিল্লাহ বলে শিউলি বলল, শুধু ভালো, আর কিছু নয়?

রোজ বলল, প্রথম সাক্ষাতে যা মনে হয়েছে তাই বললাম। বাকি আমার তকদীর।

এবার নাদিম সাহেবের অনুভূতির কথা বল।

দু’জনের অনুভূতি একই।

শুনে খুশি হলাম। দোয়া করি, আল্লাহ পাক তোদের মন-মানসিকতাও যেন একই করেন। কি জানিস, সবকিছু ভালো হলেও মন যদি কারও ভালো না হয়, তা হলে দাম্পত্য জীবনে দুজনকেই অনেক অশান্তি ভোগ করতে হয়। তা কোথায় ও কীভাবে তোদের দেখা সাক্ষাৎ হল?

দেখা সাক্ষাতের প্রোগ্রাম ও কোথায় কিভাবে তা হল, সেসব জানিয়ে রোজ বলল, হানকাটা ও স্বপ্নভিলায় গিয়ে অনেকক্ষণ আলাপ করেছি।

ওঁর ফটো চেয়ে নিসনি?

নিয়েছি। ও-ও আমার একটা ফটো চেয়ে নিয়েছে। তারপর রোজ ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে নাদিমের ফটো বের করে শিউলির হাতে দিল।

শিউলি অনেকক্ষণ ধরে ফটোটা দেখে ফেরত দেয়ার সময় বলল, তুই খুব ভাগ্যবতী। এরকম ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

কথাটা বললি কী করে?

আল্লাহ যাকে সেরকম দেখার চোখ দিয়েছেন, সে বাস্তবে দেখে হোক অথবা তার ফটো দেখে হোক সবটা না হলেও কিছুটা অন্তত বলতে পারে।  

দোয়া করিস, আল্লাহ যেন ওর সবকিছু ভালো করেন।

এই দোয়াতো একটু আগেই করলাম। আবার করছি, আল্লাহ যেন তোদরকে দোনো জাহানে সুখী করেন।

আমিন বলে রোজ বলল, শাহিনের সঙ্গে কাল তোর কী কথা হয়েছে এবার বল।

তোরা প্রেমিক-প্রেমিকা তাই তোদের কথা জানতে চেয়েছি। আমরা তো তোদের মতো না, তবু জানতে চাচ্ছিস কেন?

রোজ বলল, আমার তো মনে হচ্ছে, তাদের মনে অনেক আগে প্রেমের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে এবং এতদিনে সেটা কাণ্ড ও ডালপালা বিস্তার করার পথে অগ্রসর হচ্ছে।  

শিউলি বলল, তোদের ব্যাপারে আমি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লেও ঢিলটা ঠিক জায়গায় লেগেছে; কিন্তু তোর ঢিলটা ঠিক জায়গায় লাগেনি।

ঠিক জায়গাতেই লেগেছে, তবে তুই স্বীকার করছিস না।

কী জানি হয়তো তোর কথা ঠিক।

সেইতো স্বীকার করলি, তা হলে এত ভূমিকা করার কী দরকার ছিল–বলে রোজ বলল, সত্যি করে বলতো, তুই শাহিনকে ভালোবাসিস কি না?

শিউলি তার কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, শাহিন ভাই কোনো । মেয়েকে ভালবাসে কিনা জানিস?

রোজ বলল, সে কথা পরে বলব, আগে আমার কথার উত্তর দে।

শিউলি দীর্ঘ নিঃশ্বাস চেপে রেখে বলল, ভালবাসি কিনা বলতে পারব না, তবে ওঁর কথা একদণ্ডের জন্যও ভুলতে পারি না।

রোজ হেসে উঠে বলল, আরে বোকা, কেউ কাউকে ভালবাসলে তার কথা সব সময় মনে পড়ে।

তোর কথা কতটা সত্যি জানিনা। এবার আমার কথার উত্তর দে।

রোজ মৃদু হেসে বলল, জানি। আর সেই মেয়েটা হল তুই।

কথাটা শুনে শিউলির সমস্ত তনু-মনুতে আনন্দের শিহরণ বয়ে গেল। সামলে নিয়ে বলল, সত্যি বলছিস, না ইয়ার্কি করছিস?

রোজ বলল, যখন থেকে হাদিস পড়ে জানতে পারলাম “মিথ্যে বলা হারাম। এমন কী ইয়ার্কি করেও মিথ্যা বলা নিষেধ তখন থেকে সব ধরনের মিথ্যে বলা ছেড়ে দিয়েছি।

শিউলি জিজ্ঞেস করল, উনি যে আমাকে ভালবাসেন জানলি কী করে?

রোজ বলল, তোর সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলেছে, তাতেই বুঝেছি সে তোকে ভালবাসে।

কিন্তু উনি তো আমাকে পাত্তাই দেননি।

এটাই তো তোকে ভালবাসার লক্ষণ।

বুঝলাম না, হেঁয়ালি না করে খোলাখুলি বল।

ছেলেদের মধ্যে অনেকে হ্যাংলা থাকে, যারা নাকি মেয়েদের পিছে ঘুর ঘুর করে ভালবাসার প্রসাদ পাওয়ার জন্য। শাহিন তাদের দলের না, তা ছাড়া ও ধর্মের বিধি বিধান মেনে চলে। তাই শুধু তোকে নয়, অন্য কোনো মেয়েকেও পাত্তা দেয় না। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তাই বলছি, তুই যদি সত্যি সত্যি ওকে মনে প্রাণে ভালবেসে থাকিস, তাহলে তোকে অগ্রণীভূমিকা নিতে হবে।  

শিউলি ছলছল চোখে বলল, আমি যে ওঁকে কতটা ভালবেসে ফেলেছি, সে কথা আমি ও আমার অন্তর্জামি জানেন। তারপর চোখ মুছে বলল, তুইও তো নাদিম সাহেবকে ভালবেসেছিস, তা হলেতো বুঝতে পারছিস আমার মনের অবস্থা।

রোজ বলল, তুই দুশ্চিন্তা করিস না। আমি সিওর সে তোকে ভালবাসে।

কী করে সিওর হলি বলবি তো?

অনেক আগে শাহিন নিজে আমাকে বলেছে, “বছর খানিক আগে একদিন বাসে ওঠার সময় তোকে দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছে। তারপর থেকে তোক নিয়ে ভাবে। একটু আগে বললাম না, তুই অগ্রণীভূমিকা নিলেই বুঝতে পারবি আমার কথা সত্যি না মিথ্যে।

শিউলি বলল, ঠিক আছে এবার চল, ক্লাসের সময় হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *