ক্ষমা – ৫

পাঁচ

প্রায় বছর খানেক আগে শিউলি একদিন ভার্সিটির বাসে উঠার সময় অন্যমনস্ক থাকার কারণে শাহিনের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। শিউলি নিজের গাড়িতে ভার্সিটিতে যাতায়াত করলেও সেদিন গাড়ি নিয়ে আসেনি।

শাহিনের মনে হল মেয়েটা তাকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছে। সে একটু ধার্মিক টাইপের ছেলে। তাই বেশ বিরক্ত হয়ে রাগের সঙ্গে কিছু বলতে যাচ্ছিল; কিন্তু তার মুখের দিকে চেয়ে থেমে গেল। তার তখন মনে হল এত সুন্দর মুখ আর কখনও দেখেনি। তাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

এদিকে শিউলি নিজের ভুল বুঝতে পেরে দু’হাত জোড়া করে মিনতির স্বরে বলল, প্লীজ, ক্ষমা করে দিন।  

শিউলির গলার মিষ্টিস্বর শাহিনের মুগ্ধতা আরও বাড়িয়ে দিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে একপাশে সরে গিয়ে বলল, আপনি আগে উঠুন,

আমি কিছু মনে করিনি।

সেদিনের পর থেকে শাহিন শিউলিকে আর দেখেনি। ভার্সিটিতে গেলেই তার কথা মনে পড়ে এবং সময় পেলেই চারদিকে চেয়ে তাকে খোঁজার চেষ্টা করে। তারপর পড়াশোনার চাপে আস্তে আস্তে তার কথা ভুলে গেলেও মাঝে মাঝে মনে পড়ে।

শিউলিও কিন্তু সেদিন শাহিনের চোখে মুগ্ধতা দেখে তাকে ভুলতে পারেনি। তাই ভার্সিটিতে গেলে তার চোখ শাহিনকে খুঁজে বেড়ায়।

আজ শাহিন লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে বারান্দায় রোজের সঙ্গে শিউলিকে কথা বলতে দেখে স্থান কাল ভুলে তার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।

শিউলিও প্রায় এক বছর পর শাহিনকে দেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল।

শাহিনকে রোজ দেখতে পায়নি। কারণ সে তার পিছন দিকে। শিউলি কথা বলতে বলতে থেমে যেতে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছন ফিরে শাহিনকে দেখতে পেয়ে বলল, এই শাহিন, তোর ক্লাস শেষ হবে কটায় রে?

এতক্ষণ শাহিন বাস্তবে ছিল না। রোজের কথা শুনে সামলে নিয়ে বলল, কেন বলতো?

রোজ বলল, একসঙ্গে বাসায় ফিরতাম।

শাহিন বলল, আমার লাস্ট ক্লাস চারটেয় শেষ হবে।

রোজ বলল, তাহলে আর কী? তুই যা।

শাহিন শিউলির মুখের দিকে একবার চেয়ে নিয়ে চলে যেতে যেতে ভাবল, মেয়েটা মনে হয় রোজের সঙ্গে পড়ে অথবা বান্ধবী।

শিউলিকে শাহিনের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে রোজ তাকে বলল, কীরে, ওর দিকে চেয়ে কী দেখছিস?

শাহিনকে দেখে শিউলির মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছিল। রোজের কথা শুনতে না পেলেও বাস্তবে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা তোর কাজিন না কি?

রোজ ওদের দুজনের চাহনি দেখে যা বোঝার বুঝে গেছে। তাই শিউলির কথা শুনে মৃদু হেসে বলল, একথা কেন জিজ্ঞেস করছিস আগে বল।

না, মানে ওনাকে তুই করে বললি কিনা।

হ্যাঁ, ও আমার খালাত ভাই। তোর সাথে পরিচয় আছে না কি?

পরিচয় বলতে যা বোঝায় তা নেই। তবে প্রায় বছর খানেক আগে বাসে ওঠার সময় অন্যমনস্কতায় ওনাকে ধাক্কা দিই। অবশ্য তখনই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি। তারপর আর দেখা হয়নি।

তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, শাহিনের কথা প্রায় ভাবিস। তাই এতদিন পর দেখা হতে তার দিকে মুগ্ধ… তারপর শিউলিকে বড় বড় চোখ বের করতে দেখে বলল, আরে, রেগে যাচ্ছিস কেন? একটু ইয়ার্কি করলাম আর কী। চল, ক্লাসের সময় হয়ে গেছে।

শিউলির কথা রোজকে জিজ্ঞেস করতে শাহিনের মন চাইলেও রোজ কিছু ভাবতে পারে ভেবে করেনি।

এদিকে রোজ ভেবেছিল, শাহিন তাকে শিউলির কথা জিজ্ঞেস করবে। সাত আট দিন পার হয়ে যেতেও যখন জিজ্ঞেস করল না। তখন একদিন তাকে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, সঠিক উত্তর দিবি তো?

শাহিন বলল, আমি কখনও মিথ্যা বলি না। কী জানতে চাচ্ছিস বল।

শিউলি নামে কোনো মেয়েকে চিনিস?

না।

কয়েকদিন আগে ভার্সিটির লাইব্রেরির সামনে যে মেয়েটা আমার সঙ্গে ছিল তাকে চিনিস?

ঠিক চিনি না, তবে একবার মাত্র দেখেছি। তারপর এক বছর আগে বাসে ওঠার সময় যা ঘটেছিল তা বলে বলল, ঐদিন লাইব্রেরির বারান্দায় তোর সঙ্গে দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম এই যা।

তার কথা শুনে রোজ বুঝতে পারল, শিউলির কথা শাহিনও ভাবে। তাই জিজ্ঞেস করল, কেন, অবাক হয়েছিলি কেন?

কী উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে শাহিন আমতা আমতা করে বলল, না। মানে…বলে থেমে গেল।

রোজ বলল, থাক, আর বলতে হবে না। শিউলি তোকে ধাক্কা দিয়ে তোর মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে তাই না?

শাহিন একটু রাগের সঙ্গে বলল, কী আজে বাজে কথা বলছিস? রোজ বলল, কথাটা বাজে হলেও সত্যি। তা না হলে তুই রেগে যেতিস । তারপর তার মনের কথা জানার জন্য বলল, সাবধান করে দিচ্ছি, শিউলি উচ্চ বিত্ত ধনী হিন্দু পরিবারের মেয়ে। ওর এক ভাই মেজর। ওর রূপের ফাঁদে অনেকে পড়েছে; কিন্তু যখন তার আসল পরিচয় পেয়েছে তখন কেটে পড়েছে। যদি তোর মনে ওকে নিয়ে কিছুর শিকড় গজিয়ে থাকে, তা হলে এক্ষুনি উপড়ে ফেল। নচেৎ অন্যদের মতো তোরও অবস্থা হবে।  

শাহিন রেগে উঠে বলল, তুই সামান্য জিনিস নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করছিস। এটা তোর কাছে আশা করিনি। তারপর তার কাছ থেকে চলে গেল।

তার কথা শুনে রোজের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বিড় বিড় করে বলল, তোর রাগটাই প্রমাণ করে শিউলি তোর মনে দাগ কেটেছে এবং তাকে নিয়ে তুই ভাবিসও।

.

নাদিম গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে আসার দুদিন পর রোজকে ফোন করল।  

রোজ ফোন রিসিভ করে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, আমার বায়োডাটা যে কাজের জন্য নিয়েছ, সেই কাজ করেছ?

নাদিম বলল করেছি।

পজেটিভ, না নেগেটিভ।

পজেটিভ। এবার তোমারটা বল।

রোজ অল্পক্ষণ চুপ করে বলল, আমিও করেছি। তবে তুমি যদি পজেটিভ না নেগেটিভ জানতে চাও, তাহলে বলব দু’টোই।

নাদিম হেসে উঠে বলল, দুষ্টুমি হচ্ছে? পজেটিভ নেগেটিভ এক সঙ্গে হয় কী করে?

অনেক ক্ষেত্রে হয়।

যেমন?

যেমন ইলেকট্রিক তারে পজেটিভ নেগেটিভ না থাকলে বাতি জ্বলে না। আরও একটা উদাহরণ দিচ্ছি, বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় যে সব মেয়েরা প্রতিযোগিতা করে, তাদের কেউ-ই তেমন সুন্দরী নয়। তবু তাদের মধ্যে কেউ না কেউ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়।

ওটা মিডিয়ার কলকাঠি। এখানে ঐ বিষয়ের তুলনা দেয়া তোমার ঠিক হয় নি। যাকে বলে “কীসে কী, পান্তা ভাতে ঘি।” প্লিজ, সিরিয়াসলি বল।

রোজ এবারে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

নাদিম অধৈর্য গলায় বলল, এতক্ষণ চুপ করে থেকে কী ভাবছ?

ভাবছি অনেক কিছু।

নিশ্চয় আমার সম্পর্কে খারাপ কিছু শুনেছ?

যদি বলি হ্যাঁ।

শোনা কথা যাচাই না করে বিশ্বাস করতে নেই। আমাদের নবী করিম (স) বলেছেন, “কোনো কথা শোনার পর সত্যি মিথ্যা যাচাই না করে যে প্রচার করে, সে মিথ্যাবাদী।” তাই বলব, ভালোমন্দ যাই শুনে থাক না কেন, কাউকে দিয়ে যাচাই কর।

এবার একটা কথা বলি?

বল।

বিশ্বাস করবে তো?

সে আমার ব্যাপার, তুমি বল।

তোমার খালাত ভাই শাহিন আমাদের গ্রামে গিয়ে লোকজনের কাছে যা জেনেছে সেটাই সত্য। আর ফেরার সময় গ্রামের শেষ প্রান্তে যে ছেলেটা আমার সম্পর্কে যা কিছু বলেছে তা সত্যি নয়।

তার কথা শুনে রোজ চিন্তা করল, তা হলে কি আমার অনুমানই ঠিক, নাদিমই তাকে মিথ্যে করে ঐসব বলেছে? তবু বলল, শাহিনের সঙ্গে তো তোমার পরিচয় নেই, তাকে চিনলে কী করে? আর সে যে আমার খালাত ভাই, তাই বা জানলে কী করে?

মানুষ চেষ্টা করলে অনেক কিছু জানতে পারে। যাই হোক, এখন আমার কথা বিশ্বাস করলে কিনা বল?

তা হলে সেদিন তুমিই শাহিনকে নিজের সম্পর্কে ঐসব কথা বলেছ?

তোমার কী মনে হয়?

আমার মনে যাই হোক, তোমার মুখে শুনতে চাই।

যদি বলি হ্যাঁ?

এরকম দুষ্টমি করা তোমার উচিত হয়নি। সেদিন শাহিনের মুখে তোমার কথা শুনে খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য আমার মন বলেছে, “তুমিই নিজের সম্পর্কে ঐসব বলেছ।

তা হলে এবার আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হতে পারে তাই না?

রোজ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, আমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে বুঝি?

আমাকে দেখতে তোমার ইচ্ছে করছে না?

করছে।

তা হলে বল, কবে, কখন এবং কোথায় আমাদের দেখা হবে?

রোজ অল্পক্ষণ চিন্তা করে বলল, ছুটির দিন ছাড়া তোমার তো অসুবিধে, তাই সামনের শুক্রবার বেলা দশটার সময় গাজীপুর গোলচাক্কির কাছে তুমি আসবে। ঐ সময় আমি ওখানে থাকব।

নাদিম বলল, আজ শুক্রবার, আবার আট দিন পরে শুক্রবার। এতদিন ধৈর্য ধরতে পারব না। তাই বলছিলাম, কাল বা পরশু দিন হলে ভালো হয়। আর অসুবিধের কথা যে বললে, তা ঠিক নয়। যে কোনো দিন আমি আসতে পারব। অবশ্য তোমার যদি কোনো অসুবিধে থাকে, তা হলে অন্য কথা।

রোজ বলল, আমার কোনো অসুবিধে নেই। তোমার অসুবিধের কথা ভেবে আগামী শুক্রবারের কথা বলেছি। তোমার যখন কোনো অসুবিধে নেই বলছ তখন পরশুদিন ঐ সময়ে ওখানে এস।

নাদিম বলল, ঠিক আছে আসব; কিন্তু তোমাকে চিনবো কী করে?

রোজ বলল, তোমাকে চিনতে হবে না। আমিই তোমাকে চিনে নেব। তাই কীভাবে তোমাকে চিনবো, সেকথা চিন্তা করে বল।

নাদিম বলল, আমি ছাই কালারের ফুলপ্যান্ট ও শার্ট পরে আসব। আর আমার ডান হাতের কব্জিতে একটা লাল রুমাল জড়ান থাকবে।  

ঠিক আছে, বলে রোজ বলল, এবার রাখি মা ডাকছে। তারপর সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।

পরের দিন এক সময় রোজ শাহিনকে জিজ্ঞেস করল, রবিবার তোর প্রথম ক্লাসটা ক’টায়?

শাহিন বলল, বারটায়। তারপর বলল, তোরও ঐ সময় ক্লাস আছে না কি?

আমার প্রথম ক্লাস দশটায়। তবে আমি ঐ দিন ভার্সিটি যাব না।

তুই ক্লাস মিস করবি ভাবতেই পারছি না। তা ভার্সিটি যাবি না কেন?

নাদিমকে দশটার সময় গোল চাক্কির কাছে আসতে বলেছি দেখা করার জন্য। তুই আমার সঙ্গে গিয়ে অল্প দূর থেকে তাকে দেখে বলবি, ওদের গ্রাম থেকে ফেরার সময় গ্রামের শেষ প্রান্তে যে ছেলেটা নাদিমের সম্পর্কে যা কিছু মন্তব্য করেছিল, সেই ছেলে কী না। যদিও বুঝতে পেরেছি ঐ ছেলেটাই নাদিম, তবু সিওর হবার জন্য তোকে থাকার কথা বললাম।

শাহিন বলল, কিন্তু তুই নাদিমকে চিনবি কী করে?

রোজ বলল, ও এ্যাস কালারের ফুলপ্যান্ট ও শার্ট পরে আসবে। আর তার ডান হাতের কব্জিতে লাল রুমাল জড়ান থাকবে। যদি নাদিম সেই ছেলে হয়, তা হলে তুই ভার্সিটি চলে যাবি। আর যদি না হয়, তা হলে ভার্সিটি না গিয়ে আমাদেরকে ফলো করবি। নাদিম কোনোরকম দুর্ব্যবহার করলে শুধু আমাদের কাছে আসবি। বাকি যা কিছু করার আমি করব।  

শাহিন জানে রোজ কংফু ক্যারাটে পারদর্শী। তাই তার কথা শুনে বলল, তুই যখন যা করার করবি বললি তখন আর আমি গিয়ে কী করব?  

রোজ বলল, তুই বোকার মতো কথা বলছিস কেন? নাদিমই যে সেই ছেলেটা জানার জন্য তোকে যাবার কথা একটু আগে বললাম না? এখন বল, যা বললাম তা করবি কিনা?

শাহিন বলল, তা করব না কেন? দরকার পড়লে আমি তোকে সাহায্য করব।

রোজ হেসে উঠে বলল, মনে হয় আমরা যা ভাবছি তেমন কিছু ঘটবে না। তবু সাবধান হওয়া উচিত ভেবে বললাম।

.

রবিবার পৌনে দশটার সময় নাদিম গাজিপুর গোল চাক্কির কাছে বাস থেকে নেমে অপেক্ষা করতে লাগল। সে জানে রোজ বোরখা পরে। তাই বোরখাপরা মেয়ে দেখলেই মনে করে এই বুঝি রোজ আসছে।

ঠিক দশটার সময় শাহিনকে নিয়ে রোজ গোল চাক্কির অল্প দূরে এসে সি.এন.জি থেকে নামল। তারপর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে এদিক ওদিক চেয়ে একটা ছেলেকে ছাই কালারের প্যান্ট-শার্ট পরা ও তার ডানহাতের কব্জিতে লাল রুমাল জড়ান দেখে বুঝতে পারল, ঐ ছেলেটাই নাদিম।

শাহিনও তাকে দেখতে পেয়ে চিনতে পারল, এই ছেলেটাই সেদিন নাদিমের সম্পর্কে অনেক আজে বাজে কথা বলেছিল।

তাকে নাদিমের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে রোজ বলল, মনে হচ্ছে, তুই নাদিমকে চিনতে পেরেছিস?

শাহিন বলল, হ্যাঁ, পেরেছি। সেদিন তুই ঠিকই অনুমান করেছিলি। এবার তা হলে ভার্সিটি যাই? শুধু শুধু ক্লাস মিস করা ঠিক হবে না।

রোজ বলল, তাই যা। শাহিন বাসে উঠা না পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর নাদিমের কাছে এসে সালাম দিল।

নাদিম অন্যদিকে চেয়েছিল, তাই রোজের কণ্ঠস্বর শুনে তার দিকে ফিরে সালামের উত্তর দিল। তারপর মুখে নেকাব রয়েছে দেখে তার চোখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।

রোজ আগেই নাদিমের সুঠাম দেহ, বলিষ্ঠ শরীর ও ফর্সা টকটকে সুন্দর মুখ দেখে ভীষণ খুশি হয়েছে। তাকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে সেও মুখের নেকাব সরিয়ে তার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।

রোজ মুখের নেকাব সরাতে নাদিম তার মুখ দেখে মুগ্ধ হল। সামলে নিয়ে বলল, আল্লাহর কাছে যেমনটা আশা করেছিলাম, ঠিক তেমনই তুমি। সেজন্য তার পাক দরবারে শতকোটি শুকরিয়া জানাচ্ছি।

নাদিমকে দেখে রোজেরও তার মতো অবস্থা। সে থেমে যেতে বলল, আমি তোমার সম্পর্কে যা ভেবেছিলাম, ঠিক তেমনই তুমি। সেজন্য আমিও আল্লাহ পাকের দরবারে শতকোটি শুকরিয়া জানাচ্ছি।

নাদিম বলল, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলাপ করবে, না অন্য কোথাও যাবে? দেখছ না, রাস্তার লোকজন আমাদের দিকে চেয়ে আছে?

রোজ বলল, তার আগে বল কিছু খাবে না কি?

নাদিম বলল, আমি নাস্তা খেয়ে বেরিয়েছি, তুমি কিছু খাবে কিনা বল?

আমিও নাস্তা খেয়ে বেরিয়েছি। এখন খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা না ভাবলেও চলবে। তারপর রোজ একটা খালি সি.এন.জি থামিয়ে উঠে বসে নাদিমকেও উঠতে বলল।

নাদিম উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে?

রোজ বলল, গেলেই জানতে পারবে।

তাতো পারব, জায়গাটার নাম বল।

জায়গাটার নাম হানকাটা। তারপর ড্রাইভারকে হানাকাটা যেতে বলে নাদিমকে জিজ্ঞেস করল চেনো নাকি?

এর আগে এদিকে তো আসিনি চিনব কী করে? জায়গাটা খুব বিখ্যাত বুঝি?

বিখ্যাত না হলেও ওখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ খুব ভালো। তা ছাড়া ওর পাশেই স্বপ্নভিলা জায়গাটাও অতি সুন্দর। ওখানে ঐ নামে একটা তিলাও আছে। দেখলে তুমি মুগ্ধ হবে। প্রতিদিন অনেক দূর থেকে লোকজন বেড়াতে আসে।

গাজীপুর গোলচাক্কি থেকে হানকাটা প্রায় পাঁচ ছয় কিলোমিটার। ওখানে পৌঁছে নাদিম সি.এন.জি-র ভাড়া দিতে গেলে রোজ ভাড়া দিয়ে বলল, আজকের যাবতীয় খরচ আমার। কারণ আমি তোমাকে আসতে বলেছি। তুমি যেদিন আমাকে কোথাও আসতে বলবে অথবা বেড়াতে নিয়ে যাবে, সেদিনের সব খরচ তুমি না হয় দেবে।

রোজের কথা শুনে নাদিমের প্রেসটিজে লাগল। সি.এন.জি চলে যাওয়া পর্যন্ত চুপ করে রইল। তারপর বলল, আজ আমাদের জীবনের প্রথম সাক্ষাতের দিন। তাই তোমার কথা মেনে নিলাম। তবে ভবিষ্যতে আর কখনও এরকম কথা না বললে খুশি হব।

রোজ বলল, মনে হচ্ছে আজকের খরচের কথা বলতে তুমি অপমান বোধ করেছ। বিশ্বাস কর, তোমাকে অপমান করার জন্য বলিনি। তারপর ছলছল চোখে বলল, তবু ক্ষমা চাইছি। বল, ক্ষমা করে দিয়েছ?

নাদিম তার চোখে পানি দেখে বলল, তোমার কথার উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে ভুল করেছি। তাই আমিও ক্ষমা চাচ্ছি। বল, ক্ষমা করে দিয়েছ?  

রোজ চোখ মুছে বলল, আমার মনে হয়, আমরা কেউ-ই ভুল করিনি। তবু বলব আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুক। তারপর বলল, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখি চল।

হাঁটতে হাঁটতে এক সময় রোজ বলল, জান, গত পরশু ফোনে কথা বলার পর থেকে আজ তোমাকে দেখার আগে পর্যন্ত কী যে টেনসানে ছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এমনকি গত দুরাত একফোঁটা ঘুমোতেও পারিনি।

নাদিম বলল, এখনও টেনসান আছে নাকি?

রোজ মৃদু হেসে বলল, না নেই। বরং বলে থেমে গেল।

থেমে গেলে কেন, বাক্যটা শেষ কর।

বরং যা আশা করেছিলাম, আল্লাহ তার থেকে বেশি দেখালেন।

আমি কিন্তু এতটুকু টেনসান ফিল করিনি। কারণ আমার মন সব সময় বলেছে, ইনশা আল্লাহ নিরাশ হব না। তাই তো তোমাকে দেখেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছি এবং বাসায় গিয়ে দুরাকায়াত শোকরানার নামায পড়ার নিয়ত করেছি।

তোমাকে দেখে আমিও তাই নিয়ত করেছি। একটা কথা বলব কিছু মনে করবে না বল।

মনে করার কী আছে? তুমি নিশ্চিন্তে বল ।

রোজ বলল, তোমার ফুলপ্যান্টের ঝুল টাখনুর উপরে কেন? টাখনুর নিচে পরতে পার না? কেমন গেঁও গেঁও লাগছে।

নাদিম মৃদু হেসে বলল, আফটার অল আমি তো গ্রামেরই ছেলে, গেঁও গেঁও তো লাগবেই।

রোজ বলল, দুষ্টুমি না করে আসল কারণটা বল।

নাদিম বলল, তুমি বোধ হয় হাদিসের বই পড়নি। পড়লে জানতে পারতে, পুরুষদের টাখনুর নিচে যে কোনো পোশাক পরা হারাম। তারা সব সময় টাখনুর উপরে পরবে। আর মেয়েরা সব সময় টাখনুর নিচে, এমন কী জমিনে লুটিয়ে পরবে এটাই ইসলামের আইন। কিন্তু খুব দুঃখের বিষয় আজকাল ছেলে, যুবক ও বয়স্ক লোকেরা টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে কাপড় পরছে। আর শুধু নামায পড়ার সময়টুকু টাখনুর উপরে কাপড়ের ঝুল গুটিয়ে নেয়। নামায পড়া শেষ হলেই গুটানো কাপড় খুলে টাখনুর নিচে করে দেয়। তাদের অনেকে জেনে ও না জেনে এই কাজ করে থাকে। তাদের জানা উচিত, নামাযের পরপরই ইসলামের আইন অমান্য করেছে। টাখনুর নিচে কাপড় পরা সম্পর্কে আমাদের নবী করীম (স) বলেছেন, “পায়ের নিচে পায়জামার যে অংশ ঝুলিতে থাকে, উহা দোযখের অগ্নিতে অবস্থিত।  [হযরত আবু হোরাইরা (রাঃ)-বুখারী, মুসলিম]

আর একটা জিনিস দেখে খুব অবাক লাগে, ছেলেরা প্যান্টের ঝুল এতবেশি ঝুলিয়ে পরে যে, তা পায়ের গোড়ালির নিচে থাকে। যা নাকি কিছুদিনের মধ্যে ঐ অংশটা গোড়ালির চাপে ছিঁড়ে যায়। অপর দিকে মেয়েদের পায়জামার স্কুল টাখনুর উপরে থাকে। যা নাকি ইসলামে নিষেধ। আসল কথা কি জান, মুসলমান ঘরের ছেলেমেয়েরা যেমন কুরআন হাদিসের জ্ঞান অর্জন করে না, তেমনি তাদের মা-বাবারাও তাদেরকে কুরআন হাদিসের শিক্ষা দেয়নি এবং সেভাবে মানুষও করেনি। সবার মনে রাখা উচিত, যখন কোনো জাতি সৃষ্টিকর্তার আইন মেনে না চলে এবং নিজেদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে অন্য জাতির সবকিছুর অনুকরণ ও অনুসরণ করে তখন সেই

জাতির উপর, বিশেষ করে মুসলমান জাতির উপর আল্লাহ গযব পাঠিয়ে দেন। অথবা তাদের উপর এমন শাসনকর্তা চাপিয়ে দেন, যে নাকি তাদের উপর অত্যাচারের স্টিম রুলার চালাতে থাকে। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে নাদিম বলতে শুরু করল, তুমি যে বললে আমি টাখনুর উপরে কাপড় পরেছি বলে আমাকে গেঁও গেঁও লাগছে, কথাটা খুবই সত্যি। আর আল্লাহ পাক এটাই চান। কারণ টাখনুর নিচে কাপড় পড়লে মনে অহঙ্কার আসে। হাদিসে আছে-রসুল (সা) বলেছেন, “আল্লাহ পাক বলেন, অহঙ্কার আমার পোশাক। কেউ যেন আমার পোশাক ধরে টানাটানি না করে।” [হযরত আবু হোরাইরা (রাঃ)-মেশকাত]

রাহাজানি, যেনা, চুরি, ডাকাতি করলে ও মদ খেলে খুব বড় গুনাহ হয়, আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন, কিন্তু পুরুষরা টাখনুর নিচে কাপড় পরলে, যতই তারা নামায-রোযা-হজ যাকাত পালন করুক না কেন, পরকালে আল্লাহ তাদেরকে সরাসরি জাহান্নামে দেবেন। এটাও হাদিসের কথা। তাই বলব কোনো পুরুষেরই টাখনুর নিচে কাপড় পরা উচিত নয়। হাদিসে আরও আছে, “যার অন্তরে এক সর্ষে পরিমাণ অহঙ্কার থাকবে, সে জান্নাতে যাবে না।” [হযরত আবু হোরাইরা (রাঃ)-মেশকাত]

রোজ বলল, আমি কোনো হাদিসের বই পড়িনি, তাই এসব জানি না।

নাদিম বলল, এবার থেকে অবসর সময়ে কুরআনের ব্যাখ্যা ও হাদিসের বই পড়বে। যদি এইসব পড়, তা হলে ইসলামের বিধি-নিষেধ যেমন জানতে পারবে তেমনি মেনে চলার প্রেরণা পাবে। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমাদের বাড়ির সবাই নামায রোযা করে?

রোজ বলল, হ্যাঁ, করে। তবে বাবাকে ও শাহিনকে দেখেছি নামায পড়তে যাবার সময় প্যান্টের ঝুল টাখনুর উপরে করে নেয়। আবার নামায পড়ার পর টাখনুর নিচে করে দেয়।

নাদিম বলল, একটু আগে আমি তো সেই কথাই বললাম। তুমি কিন্তু হাদিসের কথা বলে তোমার বাবাকে ও শাহিনকে ঐরকম করতে নিষেধ করবে।

রোজ বলল, নিশ্চয় করব। তারপর বলল, অনেকক্ষণ হাঁটলাম, ক্লান্তি লাগছে। চল ঐ গাছটার ছায়ায় বসি।

ওরা বসেছে, এমন সময় পনের ষোল বছরের একটা ছেলে বালতিতে কয়েকটা কোকের বোতলসহ এসে বলল, ঠাণ্ডা কোক আছে, দেব সাহেব?

নাদিম রোজের মুখের দিকে একবার চেয়ে নিয়ে ছেলেটাকে বলল, দুটো দাও।

ছেলেটা দুটো কোক দিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলে নাদিম বলল, দাম নিয়ে যাও, আমরা এখানে বেশিক্ষণ থাকব না।

ছেলেটা দাম নিয়ে চলে যাবার পর কোকের পাইপে কয়েকটা টান দিয়ে রোজ বলল, তোমাদের নিশ্চয় চাষবাস আছে?

নাদিম বলল, শুধু আছে নয়, সবকিছুই চাষাবাস হয়। শুধু মুদিমাল, মানে নুন, তেল ও অন্যান্য মসলাপাতি বাজার থেকে কেনা হয়। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমাদের চাষ-বাস নেই?  

রোজ বলল, আছে। তবে সবকিছু বর্গা দেয়া হয়।

নাদিম বলল, আমাদেরও তাই। মনে হচ্ছে সবকিছুর চাষ-বাস হয় শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলে। ঘাবড়াবার কিছু নেই। চাষের ফসলাদি ওঠানর জন্য ও সংসারের কাজের জন্য কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা আছে। তোমাদেরও নিশ্চয় তাই আছে?

রোজ হেসে উঠে বলল, হ্যাঁ আছে।

ততক্ষণে কোক পান শেষ হয়েছে। বোতল রেখে নাদিম বলল, পাশে কোথায় যেন স্বপ্নভিলা না কী আছে বলেছিলে, চল না দেখতে যাই।

রোজ বলল, হ্যাঁ চল। তারপর কিছুক্ষণ হেঁটে এসে বলল, ঐ যে একটা বাঁশের ঘর দেখছ, ওটাই স্বপ্নভিলা।

নাদিম দেখল, একটা বেশ বড় বিলের পাশে বাড়িটা। ওটার পাশে কয়েকটা বাঁশের বেঞ্চ রয়েছে। ওদের মতো কয়েকজন ছেলেমেয়ে বেঞ্চে বসে গল্প করছে। আবার অনেকে হাঁটাহাঁটি করছে। একটা ফাঁকা বেঞ্চ দেখে নাদিম বসে রোজকেও বসতে বলল। রোজ বসার পর বলল, জায়গাটা সত্যিই খুব সুন্দর। তারপর রোজকে জিজ্ঞেস করল, তুমি যে এতক্ষণ বাড়ির বাইরে রয়েছ ঘরে ফিরলে মা বাবার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে না?

রোজ মৃদু হেসে বলল, বাবা অফিসে। আর মা জানে আমি ভার্সিটি গেছি।

 তা হলে আজ তোমার ক্লাস মিস করিয়ে ক্ষতি করে দিলাম?

এক আধ দিন ক্লাস মিস করলে তেমন ক্ষতি হবে না। আমার কাছে এই ক্ষতি ক্ষতিই না। বরং সে তুলনায় অনেক বেশি লাভ হয়েছে। তারপর রোজ জিজ্ঞেস করল, তোমার যে অফিস মিস করালাম, ক্ষতি হবে না?

তোমার কথাতেই উত্তর দিই, “এই ক্ষতি ক্ষতিই না, বরং সে তুলনায় অনেক বেশি লাভ হয়েছে।”

রোজ হেসে উঠে বলল, অনেক বেলা হয়েছে, চল এবার ফেরা যাক।

গাজীপুর টাউনে ফিরে এসে রোজ বলল, আগে হোটেলে খেয়ে নিই। তারপর তোমাকে বিদায় দেব।

নাদিমকে বিদায় দেয়ার সময় রোজ ছলছল চোখে বলল, ঢাকায় পৌঁছেই ফোন করবে। তোমার ফোন না পাওয়া পর্যন্ত মনে শান্তি পাব না।

তার চোখে পানি দেখে নাদিম বলল, চোখ মুছে ফেল বলছি। বিদায় বেলায় তোমার কান্না মুখ না, হাসি মুখ দেখতে চাই।  

রোজ রুমালে চোখ মুছে কান্নামুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আবার কবে তোমাকে দেখতে পাব ভেবে শুধু যে কান্না পাচ্ছে, এতে আমার দোষ কোথায়?

এমন সময় বাস এসে গেছে দেখে নাদিম বলল, আল্লাহর কাছে সবর করার তওফিক চাও। আর যাতে আমরা একত্রে থাকতে পারি সেজন্যে দোয়া চাও। তারপর সালাম বিনিময় করে বলল, আসি, আল্লাহ হাফেজ।

নাদিম ঢাকায় এসে রোজকে ফোন করে পৌঁছানোর খবর দিয়ে বলল, এখন রাখছি, রাতে আবার ফোন করব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *