ক্ষমা – ৭

সাত

আজ শিউলির দুটো ক্লাস ছিল। একটা নটায় আর একটা বারটায়। মন দিয়ে দুটো ক্লাসই করতে পারল না। কেবলই শাহিনের কথা মনে পড়ছে আর চিন্তা করছে, কীভাবে মনের কথা তাকে জানাবে।

প্রথম ক্লাস করার সময় রোজ তার অন্যমনস্কতা বুঝতে না পারলেও দ্বিতীয় ক্লাস করার সময় বুঝতে পারে; কিন্তু তখন কিছু না বলে ক্লাস শেষ হবার পর বলল, কী ব্যাপার বলতো, আজ তোকে খুব অন্যমনস্ক লাগছে? শরীর খারাপ?

শিউলি বলল, মনটা ভালো নেই, তাই শরীরটাও যেন কেমন কেমন লাগছে।

রোজ বলল, মনে হয়, শাহিনকে নিয়ে খুব টেনসানে ভুগছিস। রাতেও ঘুমোতে পারিস না।

শিউলি বলল, তুই ঠিক বলেছিস। শাহিন আমার হৃদয়ের স্পন্দনের সঙ্গে সব সময় স্পন্দিত হচ্ছে। তাকে নিয়ে ভাববো না তো কাকে নিয়ে ভাববোর তারপর বলল, তুইতো ভার্সিটির বাসে বাড়ি যাবি, আর দেরি করিস না, বাস চলে যাবে।  

রোজ ঘড়ি দেখে বলল, মনে করিয়ে দিয়ে ভালো করলি। বাস ছাড়তে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাই, “তুই যদি বলিস, তা হলে তোর ভালবাসার কথা শাহিনকে বলতে পারি।”  

শিউলি বলল, খবরদার বলিব না। যদি বলিস, তা হলে চিরকালের জন্য বন্ধুত্ব হারাবি। তুই তো একটু আগে বললি, আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড। সেই সম্পর্ক যদি রাখতে চাস, তা হলে ওয়াদা কর, “আমার ব্যাপারে শাহিনকে কিছু বলবি না।

রোজ বলল, আমি তোর ভালর জন্য কথাটা বলেছি। তুই যখন নিষেধ করছিস তখন আর বলব না ওয়াদা করলাম। এবার আসি রে…বলে সালাম বিনিময় করে চলে গেল।

রোজ চলে যাবার পরও শিউলি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর লাইব্রেরির দিকে এগোল, যদিও তখনও দু’টো বাজতে পৌনে একঘণ্টা বাকি। লাইব্রেরিতে ঢুকে ঘুরে ঘুরে বই দেখার সময় হঠাৎ দেখতে পেল, শাহিন একটা বই খুলে নোট করছে। তাকে দেখেই শিউলির মনে আনন্দের ঝড় বইতে শুরু করল। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে মুখের দিকে চেয়ে রইল। কতক্ষণ চেয়ে ছিল তার খেয়াল নেই। যখন চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল তখন খেয়াল হতে চোখ মুছে আবার চেয়ে রইল।  

প্রায় আধ ঘণ্টা পর শাহিন নোট শেষ করে বইটা বন্ধ করার সময় শিউলিকে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে ভীষণ আনন্দিত হল; কিন্তু তা প্রকাশ না করে সালাম দিয়ে বলল, আপনি? কখন এলেন?

শিউলি সালামের উত্তর দিয়ে ঘড়ি দেখে বলল, আধ ঘন্টা আগে।

শাহিন বলল, এতক্ষণ বসে আছেন? আমাকে ডাকলেই পারতেন।

শিউলি বলল, আপনার ডিস্টার্ব হবে ভেবে ডাকিনি।

ঘড়ি দেখে শাহিন বলল, আমি কিন্তু আপনাকে দুটোর সময় আসতে বলেছিলাম। দুটো বাজতে এখনও পনের মিনিট বাকি।

আগে এসেছি বলে কি অসন্তুষ্ট হয়েছেন?

না-না, তা কেন? চলুন বাইরে গিয়ে কোথাও বসি।

লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে শাহিন বলল, কী যেন জরুরি প্রয়োজনীয় কথা বলবেন বলেছিলেন?

সেকথা এখানে বলা যাবে না।

বেশতো, যেখানে বলা যাবে সেখানেই চলুন।

আজ শাহিনকে বাসায় নিয়ে আসবে বলে ড্রাইভারকে না নিয়ে শিউলি নিজেই ড্রাইভ করে এসেছে। শাহিনকে গাড়ির কাছে নিয়ে এসে সামনের গেট খুলে দিয়ে বলল, উঠুন।

শাহিন চিন্তা করতে লাগল উঠবে কিনা।

অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে শিউলি বলল, কই, উঠুন। তবু যখন শাহিন চুপ করে রইল তখন মিনতি স্বরে বলল, প্লিজ উঠুন। বিশ্বাস করুন কোনো খারাপ। জায়গায় নিয়ে যাব না অথবা কোনো খারাপ উদ্দেশ্যেও নিয়ে যাব না।

তার কথাগুলো শাহিনের কানে কান্নার মতো শোনাল। গাড়িতে উঠে গেট লাগিয়ে দিল।  

শিউলি ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি ছেড়ে দিল। মিরপুরে একটা দোতলা বাড়ির গেটের কাছে এসে হর্ন বাজাল।

একটু পরে ছোট গেট খুলে দারোয়ান বেরিয়ে এসে সালাম দিয়ে বড় গেট খুলে দিল।

শিউলি সালামের উত্তর দিয়ে গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকে বারান্দার সামনে পার্ক করল। তারপর নেমে শাহিনের দিকে গেট খুলে দিয়ে বলল, নেমে আসুন।

গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির পরিবেশ দেখে শাহিনের মন জুড়িয়ে গেল। অনেকখানি জমির মাঝখানে বাড়িটা। রাস্তার একপাশে ফুলের বাগান। অন্য পাশে খেলার মাঠ। বাকি জমিতে নানারকম ফলের বাগান।

শিউলি বলল, পরিবেশটা খুব সুন্দর, তাই না?

শাহিন বলল, সত্যিই খুব সুন্দর। শহরের মধ্যে এরকম বাড়ি আছে জানতাম না।

ভেতরে চলুন বলে শিউলি তাকে দোতলার বারান্দায় নিয়ে এসে দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসল।

শাহিন লক্ষ্য করল, নিচের পুরো বারান্দায় দামি কার্পেট বিছান। সিঁড়িতে ও উপরের বারান্দাতেও তাই। দোতলায় এসে চারপাশে চাইতে তার মনে হল, সে যেন অন্য এক অপূর্ব জগতে চলে এসেছে। শিউলিকে তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে দেখেও তার চোখে পানি টলটল করছে দেখে কিছু বলতে যাচ্ছিল, দু’জন আয়াকে আসতে দেখে থেমে গেল।

আয়া দুটো দু’গ্লাস লাস্যি নিয়ে এসে সালাম দিয়ে গ্লাস দুটো টেবিলের উপর রেখে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

শিউলি চোখ মুছে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কলিং বেল বাজালে লাঞ্চ রেডি করবে। এবার তোমরা যাও। তারা চলে যাবার পর একটা গ্লাস নিয়ে শাহিনের দিকে বাড়িয়ে বলল, নিশ্চয় এতক্ষণে পিপাসা লেগেছে।  

শাহিনের সত্যিই খুব পিপাসা লেগেছে। গ্লাসটা নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, আপনিও নিন।

হ্যাঁ, নিচ্ছি বলে শিউলি অন্য গ্লাসটা নিয়ে বলল, আপনি আগে শুরু করুন।

শাহিন বড় বড় মার্কেটে অনেকবার লাস্যি খেয়েছে; কিন্তু এই লাস্যির সঙ্গে সেসবের তুলনা হয় না। খালি গ্লাস টেবিলের উপর রেখে বলল, এবার বলুন, কী বিশেষ প্রয়োজনীয় কথা বলার জন্য আমাকে এখানে নিয়ে এলেন।  

ততক্ষণে শিউলিরও খাওয়া শেষ হয়েছে। সেও খালি গ্লাসটা টেবিলে রেখে বলল, তার আগে এই হতভাগীর একটা অনুরোধ রাখবেন বলুন।

শাহিন বলল, রাখার মতো হলে ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় রাখব। তবে দয়া করে এমন অনুরোধ করবেন না, যা রাখা সম্ভব নয়।

শিউলি বলল, কী বিশেষ প্রয়োজনীয় কথা শোনাবার জন্য এখানে এনেছি, তা বলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার কোনো কথার বা কাজের প্রতিবাদ করবেন না এবং কোনো কৈফিয়ৎও চাইবেন না বলুন।

শাহিন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে, আপনার অনুরোধ রাখব, কিন্তু যদি ইসলামের পরিপন্থি কিছু বলেন বা করেন, তা হলে রাখতে পারব না।

শিউলি বলল, কোনো মুমিন বান্দা বান্দি ইসলামের পরিপন্থী কিছু করতে বা বলতে পারে না।  

শাহিন বলল, তা হলে আর কোনো কথা নেই।

শিউলি বলল, আসুন আমার সঙ্গে। তারপর তাকে নিয়ে একটা রুমে এসে একদিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ঐ যে এটাচড বাথরুম আর ঐ যে আলনায় নামাযের মাশাল্লা। জোহরের নামায পড়ে নিন। আমিও পাশের রুমে পড়ব বলে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।  

শাহিন রুমের চারপাশ চেয়ে দেখল, একপাশে স্টিলের ডবল খাট। খাটে পরিপাটি করে বিছানা পাতা। মাথার দিকে একটা ছোট টেবিল, তার উপর ল্যান্ডফোন। অন্যপাশে দু’টো এক সিটের সোফা। সোফার সামনে একটা টি টেবিল আর পাশে একটা স্টিলের আলমারি। তার পাশে বুক সেলফ ও ড্রেসিং টেবিল। সব আসবাবপত্র খুব দামি বলে মনে হল শাহিনের। বাথরুম থেকে অজু করে এসে নামায পড়ে সোফায় বসে চিন্তা করতে লাগল, এটা কাদের বাড়ি, দু’জন আয়া ছাড়া অন্য কোনো লোকজনও নেই। কেনই বা এখানে নিয়ে এল? বাড়ির নাম জেসমিন ভিলা। কে এই জেসমিন? এমন সময় শিউলির গলা পেয়ে চিন্তা ছিন্ন হয়ে গেল।

পর্দা সরিয়ে শিউলি বলল, আসুন খুব ক্ষিধে পেয়েছে।

খাওয়ার পর শিউলি জিজ্ঞেস করল, শুয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নেবেন, না বারন্দায় চেয়ারে বসবেন?

শাহিন বলল, বারান্দায় বসব।

দুজনে বারান্দায় বসার পর শাহিন বলল, আমাকে এবার ফিরতে হবে। বিকেলে একটা টিউশনি করি। যা আলাপ করার তাড়াতাড়ি করুন।

শিউলি বলল, সেজন্যে চিন্তা করবেন না। আমার ড্রাইভার আপনাকে। সময় মতো পৌঁছে দেবে। তারপর বলল, প্রায় দু’বছর আগে বাসে ওঠার সময় যে ঘটনা ঘটেছিল, তা কি আপনার মনে আছে?

শাহিন বলল, আছে।

শিউলি বলল, বড় হবার পর থেকে স্বপ্ন ছিল, যে আমার জীবনসঙ্গী হবে, সে যেন আমার মনের মতো হয়। আপনি কী মনে করবেন জানি না, সেদিন বাসে উঠার ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ আমাকে আমার সেই স্বপ্নের মানুষকে দেখান। তখন থেকে আপনার স্মৃতি আমার হৃদয়ের স্পন্দনের সঙ্গে স্পন্দিত হচ্ছে। তারপর থেকে আপনাকে অনেক খুঁজেছি; কিন্তু পাইনি। বেশ কয়েকমাস পরে একদিন ভার্সিটিতে যখন বান্ধবী রোজের সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন রোজ আপনাকে ডেকে ঘরে ফেরার কথা জিজ্ঞেস করতে দ্বিতীয়বার আপনাকে দেখি এবং জানতে পারি আপনি রোজের খালাত ভাই। তারপর ওর কাছে আপনার বায়োডাটা জেনেছি। এটাই ছিল আমার জরুরি আলাপ। এরপর যদি আমাকে নিরাশ করেন, তা হলে, কথাটা শেষ না করে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, প্লিজ শাহিন, আমাকে ফিরিয়ে দিও না বলে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠে আবার বলল, তোমাকে এখানে এনে হয়তো অন্যায় করে ফেলেছি, দয়া করে ক্ষমা করে দাও।

শিউলি তাকে যে ভালবাসে শাহিন বুঝতে পেরেছিল; কিন্তু সেই ভালবাসা যে এত গভীর তা জানতো না। সেও তাকে ভীষণ ভালবাসে; কিন্তু নিজের যোগ্যতার কথা চিন্তা করে শিউলিকে জানাতে সাহস হয়নি। তা ছাড়া রোজের কাছে তার পরিচয় জেনে ভেবেছে, শিউলিকে পাওয়া মানে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে রাজকন্যাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখা। তাই তার ধারে কাছে ঘেঁষেনি। এখন তার কথা শুনে ও তাকে কাঁদতে দেখে এতদিনের সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। এক সময় তার চোখেও পানি এসে গেল। সামলে নিয়ে চোখ মুছে চেয়ারটা টেনে কাছে নিয়ে এসে চিবুক ধরে ভিজে গলায় বলল, ক্ষমা চাইছ কেন? বরং এখানে নিয়ে এসে আমাকে ধন্য করেছ। আজকালের ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রেম ভালবাসার ঘটনার পরিণতি দেখে শুনে প্রেম ভালবাসাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতাম। তা সত্ত্বেও সেদিন বাসে উঠার ঘটনার সময় তোমাকে দেখে ভীষণ মুগ্ধ হলাম। সেই থেকে আমিও তোমাকে একদণ্ড ভুলতে পারিনি। এর মধ্যে রোজের কাছে যখন শুনলাম, তুমি খুব বড়লোকের মেয়ে তখন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। এখন কি মনে হচ্ছে জান? তোমার প্রেম হয় আমাকে পাগল করে দেবে, নচেৎ মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে।

শাহিনের কথা শুনতে শুনতে শিউলি এত আনন্দিত হল যে, তার মনে হল, হয় সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে, নচেৎ হার্টফেল করবে। তারপর শাহিনের শেষের কথা শুনে হার্টফেল না করলেও চেয়ারে হেলান দিয়ে জ্ঞান হারাল।

শাহিন তা বুঝতে পেরে টেবিলের রাখা জগ থেকে পানি হাতের দু তালুতে নিয়ে তার মুখে ঝাঁপটা দিতে লাগল ও মাঝে মাঝে তার মাথা ধরে নাড়া দিতে দিতে নাম ধরে ডাকতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যে শিউলি জ্ঞান ফিরে পেয়ে সোজা হয়ে বসে ওড়না দিয়ে মুখ মোছার সময় বলল, ছি-ছি, হঠাৎ কী করতে কী হয়ে গেল। নিশ্চয় ভয় পেয়েছিলেন?

শাহিন বলল, প্রথম দিকে আমরা আপনি করে বললেও মাঝখানে থেকে তুমি করে বলেছি। এখন আবার আপনি করে বলছ কেন? তুমি করেই বল।

শিউলি বলল, ঠিক আছে, তাই বলব। এখন ভয় পেয়েছিলে কিনা বললে না তো?

শাহিন বলল, তা অবশ্য একটু পেয়েছি। তারপর জিজ্ঞেস করল, এর আগেও এরকম হয়েছে না কি?

শিউলি মৃদু হেসে বলল, না, হয়নি। তবে এর আগে যদি তুমি এরকম কথা বলতে, তা হলে হয়তো বলে থেমে, গেল।

শাহিন এতক্ষণ শিউলির প্রেম সাগরে সাঁতার কাটতে কাটতে নিজের সত্ত্বা হারিয়ে ফেলেছিল। শিউলির কথা শুনে সজ্ঞানে ফিরে এসে বলল, আমরা দু’জনেই যেমন খুব ছেলেমানুষি করে ফেললাম। তেমনি ইসলামের আইনের পরিপন্থী কাজও করে ফেললাম। সে জন্যে আমাদেরকে তওবা করে আল্লাহর কাছ ক্ষমা চাইতে হবে।

শিউলি বলল, হ্যাঁ, আমাদের নিশ্চয় তাই করতে হবে।

শাহিন জিজ্ঞেস করল, এত বড় বাড়িতে তুমি একা থাক?

শিউলি, বলল, আমার নানা-নানিও থাকেন। তা ছাড়া দু’জন আয়া, চার পাঁচজন কাজের লোক ও একজন দারোয়ান আছে।

এটা তা হলে তোমার নানার বাড়ি।

হ্যাঁ।

বাড়ির নাম জেসমিন দেখলাম। উনি কে?

আমার মা।

তোমার মা বাবা কোথায় থাকেন?

আমার মা নেই। ছয় সাত বছর আগে মারা গেছেন। আমাদের বাড়ি চট্টগ্রামের মীরশরাই গ্রামে। বাবা বড় ব্যবসায়ী। চট্টগ্রাম টাউনেও আমাদের একটা বাড়ি আছে। তিনি সেখানে থাকেন।

তোমার নানাজি কী করেন?

উনিও বড় ব্যবসায়ী। মা ওদের একমাত্র সন্তান ছিলেন। আর কোনো ছেলে সন্তান হয়নি। তাই এখনও নিজের ব্যবসা নিজেই চালাচ্ছেন।

তোমার মা মারা যাবার পর বুঝি নানা-নানির কাছে চলে এসেছ?

ঠিক ঐ কারণে আসিনি। মা মারা যাবার কিছুদিনের মধ্যে বাবা তার অফিসের পি.এ. কে বিয়ে করেন। আমার একটা বড় ভাই আছে। সে যে বছর বিদেশে পড়াশোনা করতে যায়, সে বছর মারা যান। আমি তখন ক্লাস টেনে পড়তাম। সম্মা আমাকে ভালো নজরে দেখতেন না। সামান্য ব্যাপার নিয়ে আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন। বাবা আমাকে ভীষণ ভালবাসতেন। পি.এ. কে বিয়ে করার পর যেন কেমন হয়ে গেলেন। সৎমার দুর্ব্যবহারের কথা বললে উল্টে বাবা আমাকে বকাঝকা করতেন। বুঝতে পারলাম, সম্মা বাবাকে এমনভাবে ক্যাপচার করেছেন যে, বাবা ওঁর বিরুদ্ধে কিছু বলতে বা করতে পারবেন না। তবু সহ্য করে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট বেরোবার পর যখন কলেজে পড়তে চাইলাম তখন সন্মা রাজি হলেন না। বাবাকে বললেন, মেয়েকে আর লেখাপড়া করাবার দরকার নেই। আমার ভাইপোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দাও। বাই দা বাই, সত্য ভাইপোকে বিয়ের পরপর বাবার অফিসে ম্যানেজারের পোস্টে লাগিয়েছেন।

বাবা শুনে বললেন, শিউলি ভালো ছাত্রী। মাধ্যমিক পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। তা ছাড়া ওর বিয়ের বয়স এখনও হয়নি। আমরা চাইলেও ও কিছুতেই বিয়েও করবে না আর লেখাপড়া বন্ধও করবে না।

সৎমা বললেন, মেয়েকে বেশি লেখাপড়া করিয়ে কী হবে? এই তো আমি। এম.এ.পাস করেও হেসেল ঠেলতে হচ্ছে। অথচ ওঁকে একদিনও আমি হেসেলে যেতে দেখিনি। দু’জন কাজের মেয়ে আছে, তারাই সবকিছু করে। আসলে ওঁর উদ্দেশ্য হল সবকিছু করায়াত্ত করা। এরই মধ্যে শহরের বাড়িটা নিজের নামে করে নিয়েছেন।  

সৎমার কথা শুনে বাবা বললেন, আর অন্তত দু’টো বছর পড়ে উচ্চ মাধ্যমিকটা পাস করুক।

সৎমা বললেন, বুঝেছি তুমি মেয়েকে কিছু বলতে পারবে না, আমাকেই বলতে হবে।  

আমি আড়াল থেকে ওঁদের কথা শুনে বাবার উপর মনে খুব কষ্ট পেলাম। চিন্তা করে ঠিক করলাম নানা-নানির কাছে চলে যাব। ওঁদেরকে সৎমায়ের দুর্ব্যবহারের কথা বলে পড়াশোনা করার কথা বলব। এক ছুটির দিন সত্য গাড়ি নিয়ে মায়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলেন। বাবাকেও যেতে বলেছিলেন। বাবার শরীর খারাপ থাকায় যাননি। এক সময় বাবার রুমে গেলাম। উনি তখন শুয়ে ছিলেন। আমি পাশে বসে বাবার চুলে বিলি কাটতে লাগলাম।  

বাবা ঘুমাননি। এমনি চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন। আমি চুলে বিলি কাটতে চোখ খুলে বললেন, কিছু বলবি মা?

বললাম বাবা, আমার মনে হয় তুমি আমার জন্য খুব দুশ্চিন্তা কর। তাই সব সময় তোমার মন খারাপ দেখি।

বাবা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁরে মা, তুই ঠিক বলেছিস। আমি বোধ হয় দ্বিতীয় বিয়ে করে ভুল করে ফেলেছি। ওযে তোর সঙ্গে এরকম। দুর্ব্যবহার করবে কখনও ভাবিনি। এই কথা বলে বাবা চোখ মুছলেন।

বললাম, না না, দ্বিতীয় বিয়ে করে ভুল করনি। আমার মনে হয় অফিস স্টাফকে বিয়ে না করে অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করলে ভালো হত। যাই হোক, যা হবার হয়েছে। কয়েকদিন ধরে চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সুযোগের অভাবে বলতে পারিনি।

বাবা বললেন, বেশ তো এখন বল, তোর মা বাসায় নেই।

বললাম, সেদিন আমার ব্যাপারে তোমরা যা কিছু আলাপ করেছ, শুনেছি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি ঢাকায় নানুবাড়িতে থেকে লেখাপড়া করব। আমি চলে গেলে তোমার খুব কষ্ট হবে জেনেও সজ্ঞার কারণে কথাটা বলতে বাধ্য। হলাম। সেজন্যে ক্ষমা চাইছি। তারপর বাবার দু’পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, তুমি আমাকে বাধা দিও না বাবা। আরও বললাম, তুমি আমার জন্য দোয়া করো, “আমি যেন উচচ শিক্ষা নিতে পারি ও তোমার মনের কষ্ট দূর করতে পারি।  

বাবা আমার গায়ে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে ভিজে গলায় বললেন, তোর সিদ্ধান্ত খুব ভালো আমার কষ্ট হলেও দোয়া করছি। “আল্লাহ যেন তোর মনের আশা পূরণ করেন।

তারপর একদিন নানুর বাড়ি বেড়াতে আসার নাম করে চলে এলাম।

শাহিন জিজ্ঞেস করল, তোমার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ আছে?

হ্যাঁ, আছে। আমি প্রায় প্রতিদিন ফোন করে বাবার খোঁজ-খবর নিই। বাবাও মাঝে মাঝে ফোন করে আমার ও নানা-নানুর খোঁজ-খবর নেন। কোনো কারণে ঢাকায় এলে এখানে এসে উঠেন।

তোমার নানা-নানিকে দেখছি না কেন?

নানা তো ব্যবসা চালান আর নানি ওঁকে সাহায্য করার জন্য অফিসে যান। আজ তোমাকে নিয়ে আসার কথা বলে ওঁদের থাকতে বলেছিলাম। বললেন, ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীদের নিয়ে আজ একটা মিটিং আছে। তাই থাকতে পারব না। অন্য একদিন নিয়ে আসিস। তখন তোর পছন্দ করা পাত্রটাকে শুধু দেখব নয়, বাজিয়েও দেখব মাকাল ফল কিনা।

শাহিন জিজ্ঞেস করল, তুমি আমার সম্পূর্ণ পরিচয় জান?

শিউলি বলল, হ্যাঁ, রোজের কাছে জেনেছি।

শাহিন বলল, একটা কথা ভেবে খুব অবাক হচ্ছি, মেয়েরা সাধারণত সুন্দর, স্বাস্থ্যবান ও বড়লোকের ছেলেদেরকে ভালবাসে। আমার তো ওগুলোর কোনোটাই নেই, তবু কেন আমাকে ভালবাসলে?

যেসব মেয়েরা এরকম ছেলেদের ভালবাসে তারা স্বার্থান্বেষী। তারা প্রেম ভালবাসা কী জিনিস জানে না। আমি তাদের দলে নই।

আমার পরিচয় তোমার নানা-নানিকে জানিয়েছ?

হ্যাঁ, জানিয়েছি।

জেনে কিছু বলেন নি?

বলেছেন, আমরা কিছু বললে তুই তো শুনবি না। তবু একদিন নিয়ে আসিস দেখব তোকে কতটা ভালবাসে।

আমি তোমাকে ভালবাসি, একথা জানলে কী করে?

আমি অনেক কিছু এমনিই জানতে পারি?

শাহিন মৃদু হেসে বলল, দুষ্টুমি করা হচ্ছে?

শিউলিও মৃদু হেসে বলল, দুষ্টুমি নয়, সত্যি বলছি।

তোমার বাবার দ্বিতীয় বিয়ের কথা, সৎ মায়ের দুর্ব্যবহারের কথা ও এখানে চলে এসে পড়াশোনা করছ, এসব কথা তোমার ভাইয়া জানে?

হ্যাঁ, আমি জানিয়েছি। শুনে বলল, তুই খুব ভালো কাজ করেছিস। তারপর থেকে ভাইয়া প্রতি মাসে বেশ কিছু করে টাকা পাঠায়। তা ছাড়া বাবাও প্রতিমাসে টাকা পাঠান।

আমার কথা তোমার ভাইয়াকে বলেছ?

সেই বাসের ঘটনার পরপর জানিয়েছি।

শুনে কী বললেন?

বলল, আজকাল গ্রামের গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা ভার্সিটিতে পড়তে এসে বড়লোকের মেয়েদেরকে বিয়ে করার জন্য প্রেম করে। দেখিস, সেরকম কিছু যেন না হয়।

ভাইয়ার কথা শুনে তুমি কিছু বলনি?

শিউলি হেসে উঠে বলল, তাও শুনতে চাও? ঠিক আছে বলছি, বললাম ঐ ছেলে আমার সঙ্গে প্রেম করা তো দূরের কথা আমাকে পাত্তাই দেয় না।

শাহিন বলল, রোজ তোমাকে আমার সম্পর্কে কতটুকু জানিয়েছে জানি না। অন্য একদিন সবকিছু জানাব। তারপর দাঁড়িয়ে বলল, এবার আমাকে যেতে হবে।

শিউলি বলল, প্লিজ, আর অল্পক্ষণ বস, চা বা কফি দিতে বলি।

শাহিন বলল, বসতে পারছি না বলে ক্ষমা চাচ্ছি।

শিউলি কলিং বেল টিপতে একজন আয়া এসে সালাম দিল।

সালামের উত্তর দিয়ে শিউলি বলল, ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বল। মেহমানকে পৌঁছে দেবে।

না-না, আমি বাসে চলে যেতে পারব বলে শাহিন সিঁড়ির দিকে এগোল। শিউলি তার পিছনে যেতে যেতে বলল, গাড়িতে না গেলে আমার মনে খুব কষ্ট হবে।

শাহিন আর আপত্তি না করে, গাড়িতে উঠল।

গেট লাগিয়ে দিয়ে শিউলি ছলছল চোখে বলল, কবে তোমার সবকিছু শোনাবে?  

শাহিন বলল, আল্লাহ যেদিন রাজি হবেন। আর শোন, তোমার ও আমার কোনো কিছুই রোজকে জানাবে না। তারপর সালাম বিনিময় করে ও আল্লাহ হাফেজ বলে ড্রাইভারকে গাড়ি ছেড়ে দিতে বলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *