ক্ষমা – ১০

দশ

নির্দিষ্ট দিনে সকাল সাড়ে ন’টার সময় নাদিম গাজীপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে দেখল, অল্প দূরে রোজ দাঁড়িয়ে আছে। এই সময়ে আসার কথা সে গতরাতে ফোন করে রোজকে জানিয়েছিল।

রোজও মাকে এই সময়ে নাদিমের আসার কথা সকালে জানিয়ে তাকে রিসিভ করতে এসেছে।

নাদিম এগিয়ে এসে রোজের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, সবকিছু ঠিক আছে তো?

রোজ হাসি মুখে বলল, হ্যাঁ, ঠিক আছে। তারপর জিজ্ঞেস করল, রিকশা নেব, না এটুকু পথ হেঁটে যাবে?

নাদিম বলল, রিকশায় যেতে আপত্তি নেই; কিন্তু তোমাদের কেউ দেখে ফেললে কী হবে?

রোজ বলল, ঠিক বলেছ। চল, হেঁটেই যাই। তারপর তাকে ঘরে নিয়ে এসে নিজের রুমে বসতে বলে বেরিয়ে যাচ্ছিল।

নাদিম খপ করে তার একটা হাত ধরে টেনে জড়িয়ে ধরে আদর দিতে দিতে বলল, স্বামীর সঙ্গে দেখা হলেই আগে সালামি দিতে হয় জান না?  

রোজ লজ্জা পেলেও আদরের প্রতিদান দিয়ে বলল, প্লিজ, এবার ছাড়, তোমার আসার কথা মাকে জানাতে হবে।

আরও কয়েকটা আদর দিয়ে নাদিম তাকে ছেড়ে দিল।

আয়েশা খাতুন মেয়ের মুখে জামাই-এর আসার কথা শুনে কাজের মেয়েকে নিয়ে নাস্তা বানাচ্ছিলেন।

রোজ রান্না ঘরের দরজার কাছে এসে বলল, মা, ওকে নিয়ে এসেছি।

আয়েশা খাতুন জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় বসিয়েছিস?

রোজ বলল, আমার রুমে।

আয়েশা খাতুন বললেন, ঠিক আছে, তুই যা, আমি আসছি। মেয়ে চলে যাওয়ার পর হাত মুখ ধুয়ে ভালো করে গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে মেয়ের রুমে। যাবার সময় তাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে। আছিস কেন? আমার সঙ্গে ভেতরে চল।

রোজ বলল, তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি, তারপর মায়ের সঙ্গে রুমে ঢুকে নাদিমকে বলল, মা।

নাদিম বসে ছিল, উঠে সালাম দিয়ে এগিয়ে এসে কদমবুসি করে বলল, আপনাদের না জানিয়ে আমরা যা করেছি তা অন্যায়। তাই ক্ষমা চাইছি। বলুন মা, আমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

আয়েশা খাতুন নাদিমকে দেখে ও তার কথা শুনে খুব খুশি হলেন। সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ছেলেমেয়েরা অন্যায় করলে মা-বাবাদের তো ক্ষমা করতেই হয়। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুক। দোয়া করি, তিনি যেন তোমাদেরকে সুখী করেন। তারপর মেয়েকে বললেন, আয়, নাস্তা নিয়ে আসবি।

নাস্তা খাওয়ার পর নাদিম চলে যাবে আয়েশা খাতুন মেয়ের মুখে শুনে বললেন, তা হয় না কি? বল, মা দুপুরে খেয়ে যেতে বলেছে।

দুপুরে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ওরা যখন স্মৃতিসৌধে পৌঁছাল তখন বেলা পাঁচটা। হেঁটে হেঁটে গল্প করার সময় রোজ বলল, কই, তোমার বন্ধু তো তার বৌকে নিয়ে এলেন না?

নাদিম বলল, এখনও সময় আছে আসতে পারে। দাঁড়াও ফোন করি। তারপর ফোন করতে মামুন বলল, দোস্ত, আজ একটা মিটিং আছে, প্রতিমন্ত্রী আসবেন, আমাকে পুলিশ নিয়ে ওখানে থাকতে হবে। কিছু মনে করিস না।

নাদিম বলল, মনে করার কী আছে? তুই তো আর ইচ্ছে করে আসছিস না। তারপর সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।

রোজ জিজ্ঞেস করল, উনি কী বললেন?

নাদিম মামুনের আসতে না পারার কারণ বলল।

সন্ধে হয়ে যেতে ওরা স্মৃতিসৌধের কাছে লেকের পাড়ে মাগরিবের নামায পড়ে গায়ে গা ঠেকিয়ে গল্প করছিল।

এমন সময় দু’জন পুলিশ এসে নাদিমকে বলল, সন্ধে হয়ে গেছে তবু এখানে রয়েছেন কেন? খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছেনও দেখছি। নিশ্চয় কোনো কুমতলব আছে। চলুন থানায় চলুন।

নাদিম বলল, আমাদেরকে দেখে কি সেরকম মনে হয়?

পুলিশদের একজন বলল, আজকাল ভদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরাও ফষ্টি নষ্টি করে। চলুন, বেশি কথা বলবেন না।

নাদিম বলল, আমরা স্বামী-স্ত্রী।

কোনো প্রমাণ আছে?

কাবিননামা কি সব সময় সঙ্গে রাখতে হবে?

শাহিন ও শিউলিও আজ বেড়াতে এসে একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে এতক্ষণ গল্প করছিল। সেখানেই মাগরিবের নামায পড়ে ফেরার সময় লেকের পাশে পুলিশ কারও সঙ্গে কথা কাটাকাটি করছে দেখে শিউলিকে বলল, চলতো দেখি কী ব্যাপার? তারপর কাছে এসে রোজের সঙ্গে নাদিমকে দেখে সালাম বিনিময় করে বলল, তোরাও আজ এখানে বেড়াতে এসেছিস? তারপর পুলিশদেরকে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার বলুনতো ভাই?

পুলিশ বলার আগে রোজ বলল, আমরা এখানে নামায পড়ে গল্প করছিলাম, ওঁরা এসে আজে বাজে প্রসঙ্গ তুলে থানায় নিয়ে যেতে চাচ্ছেন।

ততক্ষণে নাদিম মামুনকে ফোন করে ঘটনাটা জানাতে মামুন বলল, পুলিশদেরকে মোবাইলটা দে।

নাদিম মোবাইলটা একজন পুলিশের হাতে দিয়ে বলল, কথা বলুন।

পুলিশটা মোবাইল নিয়ে হ্যালো বলতে মামুন নিজের ও নাদিমের পরিচয় দিয়ে বকাবকি করে যা বলার বলে ওদের কাছ থেকে চলে যেতে বলল।

পুলিশটা কাচুমাচু হয়ে বলল, ঠিক আছে স্যার। তারপর মোবাইল ফেরত দেয়ার সময় নাদিমকে বলল, আগে বলবেন তো আপনি মামুন স্যারের বন্ধু। এই কথা বলে তারা সেখান থেকে চলে গেল।

পুলিশরা চলে যাবার পর রোজ শিউলিকে বলল, শাহিনের সঙ্গে তোকে এখানে দেখে খুব অবাক হচ্ছি।

শিউলি হাসিমুখে বলল, অবাক হবার এখনও অনেক বাকি। আমাদের কথা শোনার আগে তোদের কথা বল, সন্ধে হবার পরও তুই প্রেমিকের সঙ্গে এখানে রয়েছিস কেন? জানিস না, সন্ধের পর এখানে তারাই থাকে, যারা

পুলিশকে টাকা খাইয়ে যা ইচ্ছে তাই করে? তোদেরকে সেইরকম মনে করে পুলিশরা টাকা খাওয়ার জন্য থানায় নিয়ে যেতে চাচ্ছিল।  

রোজ বলল, সরি, তোকে বলা হয়নি, কিছুদিন আগে আমরা গোপনে কাজি অফিসে বিয়ে করেছি। সেজন্যে ক্ষমা চাইছি। বল ক্ষমা করেছিস?

শিউলি বলল, একটা শর্তে ক্ষমা করতে পারি।

রোজ বলল, শর্তটা বল।

শিউলি বলল, আমরাও গত শুক্রবারে কাজি অফিসে বিয়ে করেছি। অবশ্য বিয়ে করার পর নানা-নানিকে জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে দোয়া চেয়ে নিয়েছি। বিয়ের আগে কয়েক মাস দু’জনে প্রেম সাগরে সাঁতারও কেটেছি। এসব কথা জানাইনি তোকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য। তবু ক্ষমা চাইছি। তুই যদি আমাদের ক্ষমা করিস, তা হলে আমিও তোকে ক্ষমা করব।

শিউলির কথা শুনে রোজ এত অবাক হল যে, কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না।

তাই দেখে শাহিন রোজকে বলল, তুই শিউলিকে নিয়ে একদিন আমাকে সারপ্রাইজ দিবি বলেছিলি; আর আমি তাকে বিয়ে করে আজ তোকে সারপ্রাইজ দিলাম। আর তুই তোর প্রেমিককে বিয়ে করলি অথচ আমাকে জানালি না, এটা করা কি তোর ঠিক হয়েছে?

রোজ কিছু বলার আগে নাদিম বলল, আপনাদের ও আমাদের অভিযোগ বলুন আর যা কিছু বলুন সবকিছু এক। অতএব এখন আর আমরা কেউ-ই ক্ষমা চাওয়া-পাওয়ার কথা তুলব না।

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *