কি পেলাম – ৬

০৬.

এই ঘটনার কয়েকদিন পর বদরুদ্দিন আজ মিলাদ পড়াবার আয়োজন করেছেন। মিলাদ শেষ হতে রাত প্রায় একটা বেজে গেল। তখনো কারো খাওয়া-দাওয়া হয়নি। হঠাৎ রোকেয়া মাথা ঘুরে পড়ে গেল।

তার ছোট দুটো দেবর দেখতে পেয়ে কাছে এসে বলল, ভাবি, তোমার কি হয়েছে? অমন করে পড়ে গেল কেন?

রোকেয়া কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে বলল, কি জানি, হঠাৎ মাথাটা ঘুরে যেতে পড়ে গেলাম। তারপর উঠে আস্তে আস্তে ঘরে গিয়ে খাটের উপর শুয়ে পড়ল।

হানুফা বিবি বৌকে পড়ে যেতে দেখেছেন; কিন্তু কাছে আসেননি। তাকে শুয়ে। থাকতে দেখে বললেন, ভাত না খেয়ে ঘুম যাচ্ছিস কেন? সারাদিন তো একটা কাজও করিসনি। তবু ভাত খেতে সময় পেলি না।

রোকেয়া শাশুড়ীর কথা শুনে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ভাবল, সারাদিনএকটু বসবারও সময় পেলাম না, আর উনি বললেন কিনা, একটা কাজও করিনি। তখন তার মনে খুব কষ্ট হল। আজ আর ভাত খাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিল। আবার চিন্তা করল, ঘরে অনেক মেহমান, ভাত না খেলে শাশুড়ী আবার হয়তো গালাগালি শুরু করে দেবেন। তাই উঠে এসে ভাত খেল।

পরের দিন সকালে মেহমানরা সব চলে গেলেন। শুধু হারুনের নানি রয়ে গেলেন। রোকেয়া নাস্তা বানিয়ে সবাইকে খেতে দিল।

হারুনের সেজ ভাই মজিদ তার ডিমের সাথে খোসা লেগে রয়েছে দেখে রেগেমেগে রোকেয়াকে বলল, ভাবি, তুমি বাপের বাড়িতে কাজ করতে করতে হাতের চামড়া খুইয়ে। ফেলছ, আর এখানে এসে চালতা বেচনি হয়ে দোলনায় চড়েছ।

রোকেয়া অবাক হয়ে বলল, মজিদ ভাই, হঠাৎ তুমি আমাকে একথা বললে কেন?

মজিদ বলল,আহা দুধের বাচ্চা, কিছুই জানে না। তারপর ডিমটা দেখিয়ে বলল, এই যে ডিমের সাথে খোসা লেগে রয়েছে দেখতে পাওনি বুঝি?

রোকেয়া বলল, তুমি না জেনে এ রকম কথা আমাকে বলতে পারলে? ডিম নানি ছাড়িয়েছে।

মজিদ মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, দেখলে আম্মা, বেটীকে চাই দিয়েও ধারা যাচ্ছে না। কেমন কথার কাটান দিচ্ছে? ভাবি দিন দিন মুখরা হয়ে উঠছে।

হানুফা বিবি ঝংকার দিয়ে বলল, হবে না? তোর বড় ভাইয়ের আস্কারা পেয়ে এ রকম হচ্ছে। তারপর রোকেয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, এই বেটী, চুপ করে থাকবি। কথা। বললে ঠোঁট সেলাই করে দেব।

এতক্ষণে হারুনের নানি বললেন, তোমরা একি কাণ্ড শুরু করলে? ডিমগুলো আমি পরিস্কার করেছি। তোমাদের বৌ তখন অন্য কাজ করছিল।

হানুফা বিবি বললেন, আম্মা, তুমি আবার আমাদের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছ কেন? এসব তুমি কিছু বুঝবে না।

হারুন সেখানে নাস্তা খেতে এসেছে। ছোট ভাইয়ের কথা শুনে প্রথমে মনে করেছিল, রোকেয়ার দোষের জন্য ছেলে মানুষি বুদ্ধিতে সে ঐ রকম বলে ফেলেছে। তবু রেগে গিয়েও চুপ করেছিল। তারপর রোকেয়া ডিম ছাড়ইনি বলা সত্ত্বেও মজিদ ও মা যখন রোকেয়াকে ঐ সব বলল, তখন তাদের উপর অত্যন্ত রেগে গিয়ে বলতে গিয়েও থেমে গেল। চিন্তা করল, কিছু বলতে গেলেই কেলেংকারীর সৃষ্টি হবে। তাই রাগ দমন করার জন্য না খেয়ে রুমে চলে গেল।

সকলের নাস্তা খাওয়া হয়ে যেতে রোকেয়া থালা-বাসন ধুয়ে রেখে রুমে এল। হারুন খায়নি বলে সেও খেল না।

তাকে দেখে হারুন বলল, আমি টিকিট কেটে নিয়ে আসি, আর থাকব না। আমার মন দিন দিন বিষিয়ে উঠছে। এই বলে সে বেরিয়ে যেতে উদ্দত হল।

রোকেয়া তার দুপা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ওগো তুমি এখন যেও না। তুমি চলে গেলে আমি বুঝি শান্তি পাব? তুমি কয়েকদিন মাত্র বাড়িতে এসে আম্মার কাছে থাকতে পারছ না। আর আমি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কি করে তার সঙ্গে কাটাচ্ছি? কেন কাটাচ্ছি শুনবে? শুধু তোমার ভালবাসা পাওয়ার জন্য। তা যদি না পাই, তাহলে আমি বাঁচব কোন আশায়?

হারুন তাকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যি রোকা, তোমাকে বিয়ে করে আমি মস্ত বড় অন্যায় করেছি। সে কথা ভেবে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।

রোকেয়া বলল, তুমি অপরাধী হতে যাবে কেন? তোমার ভালবাসায় কোনো খাদ নেই। সবই আমার তকৃদির। আমার তকদিরে যা লেখা আছে, তা তুমি শত চেষ্টা করেও দূর করতে পারবে না। আর কখনো নিজেকে অপরাধী ভাববে না বল?

হারুন তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, তোমার কথাই ঠিক। তকদিরে যা লেখা থাকে তা, কেউ বদলাতে পারে না।

সেদিন দুপুরেও আম্মার উপর রাগ করে দুজনে ভাত খেল না।

বিকেলে রোকেয়া ঘরদোর ঝাড় দিতে গেলে হনুফা বিবি তার হাত থেকে ঝাড় কেড়ে নিয়ে বললেন, তোকে আর কাজ করতে হবে না।

রোকেয়া আর কি করবে? কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চা-নাস্তা করতে গেল।

হানুফা বিবি ঝাড় দেওয়ার কাজ শেষ করে রান্না ঘরে এসে রোকেয়া এসব নাস্তা বানিয়েছিল, তা উঠোনে ফেলে দিয়ে নিজে বানাতে লাগলেন।

রোকেয়া চোখের পানি ফেলতে ফেলতে রুমে এসে বসে রইল।

রাতে রান্না করতে গেলে হনুফা বিবি রাগের সঙ্গে বললেন, তোকে কাজ করতে দিই না, তবু করতে আসিস কেন?

রোকেয়া চিন্তা করল, কথা বললেই শাশুড়ী আরো রেগে যা তা করে বলবে। তাই রুমে এসে শুয়ে শুয়ে কাদল।

হারুন ঘরেই আছে। সকাল থেকে সবকিছু দেখছে; কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। ভাবছে, ভালমন্দ কিছু বলতে গেলেই দুজনকেই আম্মা গালাগালি করবে।

হারুন মসজিদ থেকে মাগরিবের নামায পড়ে এসে স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে বলল, কেঁদে আর কি করবে? কাজ যখন করতে দিচ্ছে না তখন করো না।

রোকেয়া বলল, কাজ না করলে খেতে যাব কোনমুখে?

তুমি তো ইচ্ছা করে কাজ করা বন্ধ করছ না? আম্মাই তোমাকে করতে দিচ্ছে না।

তবু কোন মুখে খেতে যাব?

হারুন আর কিছু না বলে চুপ করে বসে রইল। এশার আযান হতে রোকেয়া নামায পড়ার জন্য অজু করতে গেল।

হারুন নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে গেল।

 রোকেয়া নামাজ পড়ে বিছানায় বসে নিজের ভাগ্যের কথা চিন্তা করতে লাগল।

 হারুন নামায পড়ে ফিরে এসে তাকে শুয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল ভাত খেয়েছ?

না।

আম্মা খেতে ডাকেনি?

না।

হারুন আর কিছু না বলে তার পাশে শুয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ পরে হনুফা বিবি দরজার কাছে এসে বললেন, হারুন ভাত খাবি আয়।

সকাল থেকে রোকেয়া খায়নি বলে হারুন ও খায়নি। সে ইচ্ছে করলে হোটেলে খেতে পারত; কিন্তু রোকেয়াকে না খাইয়ে সেও খেতে পারেনি। আবার রোকেয়ার জন্য। হোটেল থেকে খাবার কিনে নিয়ে এলে, মা হুলস্থুল কাণ্ড করবে ভেবে আনেনি। এখন রোকেয়াকে না ডেকে শুধু তাকে খেতে ডাকছে শুনে মায়ের উপর প্রচণ্ড অভিমান হল। তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। সামলে নিয়ে বলল, তোমরা খেয়ে নাও, আমি খাব না।

হানুফা বিবি আর কিছু না বলে চলে গেলেন।

পরের দিন সকালে রোকেয়া কাজ করতে গেলে হনুফা বিবি বললেন, তোকে আর আমার সংসারে কোনো কাজ করতে হবে না।

জোর করে করতে গেলে যদি গালাগালি করেন সে কথা ভেবে রোকেয়া নিজ রুমে এসে বসে বসে প্রচণ্ড ক্ষিধের জ্বালায় চোখের পানি ফেলতে লাগল।

হারুন কিন্তু ঘরে নাস্তা খেল। তারপর বাইরে থেকে রুটি, কলা ও পেপসী কিনে এনে রোকেয়াকে খেতে বলল।

এভাবে এক সপ্তাহ চলল। হারুন ঘরে খাওয়া-দাওয়া করলেও রোকেয়াকে কেউ খেতে ডাকেনি এবং তাকে সংসারের কোনো কাজও করতে দেয়া হয়নি।

এই কদিন রোকেয়া এটা সেটা খেয়ে দিন কাটিয়েছে। আটদিনের দিন হারুন বলল, তুমি তোমার বাপের বাড়ি চলে যাও। এখানে থাকলে না খেয়ে মরে যাবে। শেষে আমাদের বদনাম হবে।

এই কথা শুনে রোকেয়ার মনে খুব আঘাত লাগল। চোখের পানিতে বুক ভাসাতে ভাসাতে বলল, বেশ তুমি যা চাও তাই হবে।

ঐদিন হারুন একটা স্কুটার এনে রোকেয়াকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিল।

রোকেয়ার মনে হল, এর চেয়ে তার মরণ ভালো ছিল। যেতে যেতে ভাবল, আমি হারুনের জন্য না খেয়ে এতদিন কাটালাম, তার সে কিনা তার কোনো প্রতিকার না করে উল্টো আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিল? এই জন্য কথায় বলে, যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর।

বাপের বাড়ি পৌঁছাতে সকলে রোকেয়ার শরীরের অবস্থা দেখে নানা রকম প্রশ্ন করতে লাগল।

রোকেয়া তাদেরকে তার অসুস্থতার কথা জানাল।

মেহেরুন্নেসা এক সময় মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, আসল ঘটনা কি হয়েছে বলতো।

রোকেয়া মাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদল। তারপর শ্বশুর বাড়িতে যা ঘটেছে তা সব খুলে বলল।

মেয়ের কথা শুনে মেহেরুন্নেসা কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন। তারপর বললেন, মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, করার কিছু নেই। সবর কর মা, একদিন না একদিন আল্লাহ তার ফল দেবেন। জানিস তো, সবরের গাছ খুব তিতা, কিন্তু ফল খুব মিষ্টি।

চার পাঁচদিন পর হারুন শ্বশুর বাড়ি এল।

রোকেয়া তাকে কদমবুসি করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

হারুন তাকে প্রবোধ দিয়ে বলল, সেদিন তুমি হয়তো মনে খুব কষ্ট পেয়েছ। কিন্তু আমি মায়ের বিরুদ্ধে কি করতে পারি বল? তোমাকে পাঠিয়ে দিয়ে এই কদিন আমি যে কিভাবে কাটিয়েছি তা একমাত্র আল্লাহপাক জানেন। তবুও আমার অন্যায় হয়েছে, সে জন্য মাফ চাইছি।

রোকেয়া চোখের পানি মুছে বলল, তোমার আর দোষ কি? সবই আমার কপাল। তুমি আমার কাছে মাফ চেয়ে আমাকে অপরাধী কর না।

হারুন বলল, রোকা, আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে না পেরে মাযের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করে তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। বল আমার সঙ্গে যাবে?

রোকেয়া বলল, তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে? বিয়ের পরে মেয়েদের স্বামীইতো সর্বস্ব। বাপ-মাও পর হয়ে যায়। তুমি নিয়ে যেতে এসেছ, আমি যাব না : কেন? নিশ্চয় যাব।

বিকেলে হারুন রোকেয়াকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল।

রোকেয়া ঘরে ঢুকে প্রথমে শ্বশুরকে কদমবুসি করে জিজ্ঞেস করল, আব্বা কেমন আছেন।

বদরুদ্দিন বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে বললেন, ভালো আছি মা।

তারপর রোকেয়া শ্বশুরের রুম থেকে বেরিয়ে এসে শাশুড়ীকে কদমবুসি করতে গেল।

হানুফা বিবি ছেলের সঙ্গে ঝগড়া করে সকাল থেকে রেগে আছেন। রোকেয়া কদমবুসি করতে গেল পা সরিয়ে নিয়ে বেঁঝিয়ে উঠে বললেন, আমাকে ছুঁবি না। তোর মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না। তুই এখান থেকে চলে যা।

রোকেয়া মাথা নিচু করে সেখান থেকে নিজের রুমে এসে স্বামীকে মায়ের কথা বলল।

হারুন অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি মায়ের কথায় কিছু মনে করো না।

বিকেলে রোকেয়া রাত্রের জন্য রান্না করতে লাগল।

এদিকে হনুফা বিবি বারান্দায় পাটি বিছিয়ে একদল মেয়ে নিয়ে গল্প করতে বসেছেন। উনার এক জা, যিনি রোকেয়াকে দেখতে গিয়ে অপছন্দ করেছিলেন, তিনি একসময় বলরেন, হারুনের মা, তুমি ঐ বউয়ের হাতের রানা খাও কেমন করে? হারুনকে বলে দিও ওর হাতের রান্না খেলে পাপ হবে।

হানুফা বিবি বললেন, হ্যাঁ তুমি ঠিক কথা বলেছ। হারুন ঘরে এলে আজ তাকে বলব।

উনি আবার বললেন, এই বৌ দিয়ে তোমাদের সুখ শান্তি হবে না। হারুনকে বলল, সে যেন এই বৌকে ছেড়ে দেয়। কারণ সে তোমাদেরকে পছন্দ করে না। তোমাদের এত লোকেরা ঝামেলা ও সহ্য করতে পারছে না। সে যদি একমাত্র ছেলের বৌ হত তাহলে রান্না বান্নাও করত না। হোটেল থেকে কিনে এনে খেত।

রোকেয়া তাদের এইসব কথা শুনতে শুনতে রান্নার কাজ শেষ করল। তারপর পাশের বাড়ির এক চাচাতো জায়ের কাছে গিয়ে বসল। এই জায়ের সঙ্গে রোকেয়ার একটু ভাবসাব। মাঝে মধ্যেতার কাছে গিয়ে গল্প গুজব করে।

কিছুক্ষণ পরে হারুনকে ঘরে আসতে দেখে হানুফা বিবি চুলোয় কাঠ গুঁজে দিয়ে ধোয়া করে এসে তাকে বললেন। এবার তুই নিজের চোখে দেখ, তোর বৌ আগুনে ধোয়া দিয়ে চলে গেছে, ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেবে বলে। আমি কত করে তাকে বললাম, আমাদেরকে একটু চা করে দিতে। আমার কথার কোনো দাম দিল না। ওদের ঘরে গিয়ে গল্প করছে।

হারুন মায়ের কথা শুনে রোকেয়ার উপর খুব রেগে গেল। তার কাছে গিয়ে বলল, তোমার জন্য আমি এত কথা শুনি কেন? তুমি ঘরে আগুন লাগাবে বলে চুলোয় কাঠ দিয়ে এসে এখানে গল্প করছ?

রোকেয়া বলল, একথা তুমি বিশ্বাস করলে? তারপর তার শাশুড়ী ও চাচি শাশুড়ী যা বলেছিলেন সব হারুনকে বলল।

হারুন বলল, ঠিক আছে তুমি ঘরে চল।

রোকেয়া ঘরে এলে হনুফা বিবি বললেন, তোকে কত করে বললাম একটু চা করে দিতে। তুই দেমাগ করে চুলোয় ধোয়া দিয়ে চলে গেলি।

এই কথা শুনে রোকেয়া কান্নামান্না হয়ে বলল, আম্মা, আপনারা সবাই আমাকে নিয়ে যা তা করে বলছিলেন বলে আমি না শোনার জন্য চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু চুলোয় ধোয়া দিয়ে যাইনি। কারণ রান্না তো শেষ। আর আপনি চা দিতেও বলেননি। এটা একেবারে মিথ্যে কথা।

হানুফা বিবি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে চিৎকার করে বললেন, কি আমি মিথ্যে বলেছি? তোর এতবড় সাহস? তারপর হারুনকে বললেন, কিরে তোর সামনে আমাকে মিথ্যেবাদী বলল অথচ তুই চুপ করে আছিস? এই ধরনের মেয়েকে রীতিমতো পিটালে তবে সোজা হবে।

হারুন আসল ঘটনা বুঝতে পেরে চুপচাপ সেখান থেকে চলে গেল।

হানুফা বিবি সেই জাকে বললেন, দেখছ বুবু, হারুন কিছু বলল না। বলবে কি করে? ডাইনীটা আমার ছেলেকে তাবিজ করেছে। তা না হলে ছেলে হয়ে মায়ের অপমান সহ্য করে?

এর কয়েকদিন পর হারুন বিদেশ চলে যাবে। তাই একদিন সে রোকেয়াকে নিয়ে তার বাপের বাড়িতে সকলের সঙ্গে দেখা করতে এল। সেখানে একবেলা থেকে খাওয়া দাওয়া করে হারুন সবাইকে বিদেশ যাওয়ার কথা বলে রোকেয়াকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল।

ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই হানুফা বিবি হারুনকে বললেন, তোকে কতবার বলেছি। এই বৌকে নিয়ে কোনোদিন সুখ শান্তি পানি না। তুই এই একখানা বৌ নিয়ে এত পাগল হলি কেন? আবার বলছি ওকে ছেড়ে দে। আমি এর চেয়ে সুন্দর সুন্দর দশখানা বৌ তোকে এনে দেব।

রোকেয়া শাশুড়ীর কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে হারুনকে বলল, এই সংসারে আমার সুখ শান্তি কোনোদিন হবে না। জানি না কপালে কি আছে?

হারুন তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, আম্মা যা কিছু বলুক না কেন, আমি তুমি ঠিক থাকলে কেউ কিছু করতে পারবে না। একথা আগেও অনেকবার বলেছি। এখন আবার তাই বলছি।

রোকেয়া বলল, আমি আমার সুখ শান্তি চাই না, তোমাদের সুখ শান্তি চাই। তুমি তোমার বাবা মায়ের বড় ছেলে। তারা তোমাকে কত কষ্ট করে মানুষ করেছেন। তোমার উপর তাদের কত আশা ভরসা। তুমি তাদের সুখী করার চেষ্টা কর। তাদের কথার অবাধ্য হয়ো না। আমাদের গ্রামে এক ওয়াজ মাহফিলে একজন আলেম ওয়াজ করার সময় বলেছিলেন, আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে আছে, হযরত ইব্রাহিম (আঃ) পুত্র ইসমাইল (আঃ) এর স্ত্রীর কোনো দোষ দেখে তাকে পরিত্যাগ করতে বলেছিলেন। হযরত ইসমাইল (আঃ) পিতার কথামত সেই স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন। তুমিও যদি তাই কর, তাহলে আমার কোনো দুঃখ নেই। কারণ দুনিয়াতে আমার চেয়ে কত সুন্দরী। মেয়ের ভাগ্য খারাপ রয়েছে। তাদের তুলনায় আমি অতি নগণ্য। আমি মনে করব, এটাই আমার তকৃদির।

হারুন রোকেয়ার কথা শুনে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে গেল। অনেক রাতে যখন ফিরে এল তখন রোকেয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। হারুন জানে, রোকেয়া না খেয়ে ঘুমিয়েছে। তাই সেও না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

এই ঘটনার দুদিন পর আজ হারুন বিদেশ চলে যাবে। গত দুদিন থেকে রোকেয়ার চোখ থেকে সব সময় পানি পড়ছে। কিছুতেই সামলাতে পারছে না। স্বামীর সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে রোকেয় কদমবুসি করে তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, আমি তোমার এমন পাপী ও হতভাগী স্ত্রী যে, তোমাকে দুঃখ নিয়ে বিদেশ যেতে হচ্ছে। আমাকে তুমি মাফ করে দাও।

হারুন তাকে বুকে চেপে ধরে বলল, রোকা প্রিয়তম আমার, আমিও তোমাকে অনেক দুঃখ দিয়ে বিদেশ চলে যাচ্ছি। আল্লাহপাক জানেন, আবার কবে তোমাদের মাঝে ফিরে আসব। তোমার দুঃখ কোনোদিন ঘোচাতে পাবর কি না তাও আল্লাহপাক জানেন। তুমি আমার উপর কোনো রকম মনে কষ্ট রেখ না। আমিও রাখব না! আমরা দুজনেই আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া চাইব, তিনি যেন আমাদেরকে সুখ-শান্তি দান করেন। তারপর গভীর আবেগে তার দুগাল চুমোয় চুয়ে ভরিয়ে দিতে রাগল।

রোকেয়াও চুপ করে থাকল না, সেও প্রতিদানে মেতে উঠল। রোকসানা এতক্ষণ খাটের উপর বসে মা-বাবার দিকে তাকিয়েছিল। সেদিকে হারুনের লক্ষ্য পড়তে স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে তাকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলল, রোকা, মামণির দিকে খুব খেয়াল রাখবে। আর আম্মাকে যতটা সম্ভব খুশি রাখার চেষ্টা করবে।

এমন সময় হারুনের ছোট ভাই দরজার কাছে এসে বলল, স্কুটারওয়ালা তাড়াতাড়ি যেতে বলছে।

হারুন বলল, হ্যাঁ চল যাচ্ছি। তারপর রোকসানাকে রোকেয়ার কোলে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসে আব্বা আম্মাকে কদমবুসি করে আম্মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আম্মা, তোমারে বৌকে দুমাস অন্তর বাপের বাড়ি পাঠিও।

হানুফা বিবি বললেন, ওসব আমি জানি না। তুই পারলে চিরকালের জন্য বৌকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে যা।

হারুন মেয়ের কথা শুনে মনে খুব কষ্ট পেলেও বিদেশ যাওয়ার সময় বলে প্রতিবাদ করল না। রোকেয়াকে বলল, তোমার যখন মন চাইবে তখন যেও। যে কদিন থাকতে মন চাইবে, সেই কদিন থেকে আবার নিজেই চলে এস। তারপর সে ব্রীফকেস হাতে নিয়ে বাড়ির বাইরে এসে স্কুটারে উঠল।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *