কি পেলাম – ৫

০৫.

হারুন বিদেশ চলে যাওয়ার দশ বার দিন পর একদিন রোকেয়ার সেজ দেবর হোসেন কয়েকখানা চিঠি নিয়ে এসে বলল, বড় ভাইয়া দিয়েছে। তারপর একটা চিঠি রোকেয়ার হাতে দিয়ে বলল, এটা তোমার।

রোকেয়া তখন সংসারের কাজ করছিল। চিঠিটা বুকের কাছে ব্লাউজের ভিতর রেখে তাড়াতাড়ি হাতের কাজ শেষ করল। তারপর নিজের রুমে এসে পড়তে শুরু করল।

ওগো আমার হৃদয়ের রানী,

পত্রের প্রারম্ভে তোমাকে জানাই আমার অন্তরের প্রেম, প্রীতি ও ভালবাসা। তারপর তোমার রঙ্গিন গোলাপি ঠোঁটে আমার চুমো দিলাম। এখন রাত একটা। বাইরে ঝিরঝির বাতাস বইছে। ইচ্ছা করছে সেই বাতাসে ভর করে তোমার কাছে চলে যাই। কিন্তু তা

সম্ভব নয় বলে তোমাকে পাওয়ার জন্য মনের মধ্যে তুফান বইছে। প্রাণপ্রিয়া রোকা, এই সুদূর বিদেশে আমি নিঃসঙ্গ। তোমার স্মৃতি ও ভালবাসা আমার হৃদয় জুড়ে রয়েছে। প্রতি রাতে ঘুমোবার সময় তোমার মিষ্টি মধুর মুখের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি। তারপর বুকের উপর চেপে ধরে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি। আমার প্রতিটা শ্বাস-প্রশ্বাসে তোমার ভালবাসার গন্ধ পাই। তুমি আমার শরীরের রম্ভে রম্ভে মিশে রয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ভুলে থাকতে পারি না। তোমার স্মৃতি আমাকে যেন অতল সাগরে ডুবিয়ে নিয়ে যায়। আবার তোমার ভালবাসা আমাকে সেখান থেকে তুলে এনে সবর করার সবক দেয়। তখন আমার মন শান্তিতে ভরে যায়। তোমাকে ছেড়ে এসে আমার দিন কাটতে চায় না। মনে হয় এক একটা দিন যেন এক একটা মাস। আমি যেমন তোমাকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভালবাসি, তুমিও তেমনি আমাকে ভালবাস। তাই এত বিরহ ব্যথার মধ্যেও বিশ্বজগৎ আমার কাছে পরম রমণীয় ও লোভনীয় বলে মনে হয়। তুমি আমার সার্থক সহধর্মিনী। প্রিয়তমা রোকা, কেমন আছ জানাবে। তুমি যে আমার জীবন মরণের সাথি। দোওয়া করি আল্লাহপাকের দরবারে, তিনি যেন তোমাকে সব কিছু সহ্য করার শক্তি দেন। সুখে থাক, ভাল থাক, সুস্থ থাক ও আনন্দে থাক, আল্লাহ পাকের কাছে এই কামনা করে শেষ করছি। তার আগে আর একবার তোমার রঙ্গিন ঠোঁটে চুমো দিলাম। পত্রের উত্তরের অপেক্ষায় দিন গুনব।

ইতি
 তোমারই পাগল হারুন।

রোকেয়া চিঠিটা দুতিনবার পড়ল। প্রতিবার পড়ার সময় চোখের পানিতে বুক। ভাসাল। পড়ে যেন তার তৃপ্তি মিটছে না। যতবার পড়ে ততবার পড়তে ইচ্ছা হয়। তারপর চিঠির উপর অসংখ্যবার চুমো খেয়ে বালিশের তলায় রেখে দিল। এখনি চিঠির উত্তর লেখার জন্য তার মন উতলা হয়ে উঠলেও মনকে শক্ত করে রুম থেকে বেরিয়ে এল। ভাবল, বেশিক্ষণ রুমে থাকলে শাশুড়ী দুনিয়া ফাটিয়ে ফেলবে। রাতে ঘুমোবার আগে লিখবে ভেবে সংসারের কাজে মন দিল।

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর রোকেয়া স্বামীর চিঠির উত্তর লিখতে বসল।

ওগো আমার প্রাণপ্রিয় স্বামী,

প্রথমে তোমার পবিত্র কদমে শতকোটি সালাম জানাচ্ছি। তারপর ভালবাসার সন্দেশ পাঠালাম। গ্রহণ করে ধন্য করো। আশাকরি আল্লাহ পাকের রহমতে তুমি ভালো আছ। আমিও তাঁরই করুণায় ভালো আছি। বাড়ির অন্যান্য সব সংবাদ কুশল জানিবে।

প্রিয়তম, তোমার চিঠি পড়ে যে কত আনন্দ, কত সুখ ও শান্তি পেলাম, তা আল্লাহ পাক জানেন। আমার কলমের অত শক্তি কি আছে যে তোমাকে তা লিখে জানাব? চিঠির মধ্যে যে এত মধু থাকে তা আগে কোনোদিন জানতাম না। চিঠি পড়ার সময় অনাবিল এক খুশির আমেজে সমস্ত তনুমন শিউরে উঠেছে। ওগো জীবন সর্ব, তোমার প্রতি আমার ভালবাসার কোনো সীমা নেই। হৃদয় উজাড় করে তোমাকে ভালবেসেছি! বাপের বাড়ির অনাহূত ফুল আর আমি নই। তোমার হাতে আল্লাহ পাকের ইশারায় আমি দলিত ও মথিত হয়েছি। আমি বড় ভাগ্যবতী মেয়ে। তোমার মত স্বামী পেয়ে আমি ধন্য। সত্যি প্রিয়তম, তোমাকে একদণ্ড ভুলে থাকা আমার পক্ষে কোনোকালেও সম্ভব নয়। অতীতের মধুময় সময়গুলোর কথা মনে পড়লে একদিকে যেমন খুব. আনন্দ পাই, অপরদিকে তেমনি দুঃখে ও বেদনায় মনটা কেঁদে উঠে। যে স্বামীর সঙ্গে দিনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছি। সে আজ কোথায় কোন সুদূর বিদেশে। আবার কবে সেই মধুময় দিন ফিরে আসবে তা আল্লাহপাককে মালুম। প্রিয়তম, ঘন ঘন চিঠি দিয়ে এই তাপতীর প্রাণ শীতল করো। একা একা আমার মোটেই ভালো লাগছে না। একটা দুঃখ ও শূন্যতা আমাকে সব সময় গ্রাস করে রেখেছে। লক্ষ্মীটি বল, কেন তুমি আমাকে এভাবে একা ফেরে গেলে? বিদেশের মায়ায় আমাকে ভুলে আছ কি করে?

মনের অস্থিরতায় ও আবেগে এবং বিরহ জ্বালা সহ্য করতে না পেরে অনেক কিছু লিখে তোমার কাছে হয়তো অপরাধী হয়ে গেলাম। স্ত্রী মনে করে স্বামীগুণে ক্ষমা করে দিও। আল্লাহপাকের কাছে তোমার সার্বিক মঙ্গল কামনা করে এবং পরিশেষে তোমার পুরুষ্ট ওষ্ঠে কয়েকটা কিস দিয়ে বিদায় নিলাম। আল্লাহ হাফেজ।

ইতি
তোমার পাগলী রোকা।

হারুন বিদেশ যাওয়ার আগে বেশ কয়েকটি এয়ারমেল খাম টিকিটসহ কিনে ঠিকানা লিখে রোকেয়ার হাতে দিয়ে বলেছিল, আমাকে চিঠি দিতে তোমার যেন কোনোরকম অসুবিধে না হয়, সেই জন্যে নিয়ে এলাম। রোকেয়া সেগুলো নিজের বাক্সে রেখে দিয়েছিল। রাত্রে চিঠি লিখে পরের দিন হোসেনকে দিয়ে পোস্ট করাল।

হারুন বিদেশ চলে যাওয়ার দুমাস পর একদিন রোকেয়ার এক চাচি শাশুড়ী রোকেয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, বৌমা তুমি কি পোয়াতী?

রোকেয়া লজ্জা পেয়ে কিছু বলতে পারল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

উনি আরো দুতিনবার জিজ্ঞেস করার পরও রোকেয়া লজ্জায় বলতে পারল না।

তখন উনি বললেন, বৌমা, তুমি যদি কিছু না বল, তাহলে আমরা বুঝব এই সন্তান হারুনের নয়।

এই কথা শুনে রোকেয়ার জ্ঞান হারাবার উপক্রম হল। কোনো রকমে সামলে নিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, হারুন জানে?

রোকেয়া আবার মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ জানে।

 উনি বললেন, তোমার শাশুড়ী আমাকে জিজ্ঞেস করতে বলেছিল; তাই করলাম। আমার উপর তুমি যেন আবার মনে কষ্ট নিও না। এই কথা বলে তিনি চলে গেলেন।

রোকেয়া বসে বসে চোখের পানি ফেলতে লাগল। এতদিনে সে বুঝতে পারল, একমাত্র শাশুড়ী ছাড়া এ বাড়ির সবাই তাকে ভালবাসে। দেবররাও তাকে ভালবাসে। মেজ দেবর শামসু বড় ভাইয়ের বিয়ের সময় দেশে ছিল না। বড় ভাই বিয়ে করেছে জেনে ভাবিকে আলাদা করে চিঠি দিয়েছে। সেই সঙ্গে কিছু টাকাও ভাবির নামে পাঠিয়েছে। অন্যান্য দেবররা ভাবিকে এটা সেটা কিনে দেয়। রোকেয়ার নানা শ্বশুর আনসার উদ্দিন প্রতি সপ্তাহে একবার নাত বৌকে দেখতে আসেন। সে গর্ভবতী হয়েছে জানার পর কোনোবারে চাটনি, আবার কোনোবারে আচার কিনে নিয়ে আসেন। কোনো সময় এসে যদি দেখেন রোকেয়া বাপের বাড়ি গেছে, তাহলে তিনি রোকেয়াকে দেখতে সেখানে যান। একবার রোকেয়া বাপের বাড়ি থেকে নানার বাড়িতে বেড়াতে গেল।

আনসার উদ্দিন মেয়ের বাড়িতে এসে শুনলেন, রোকেয়া বাপের বাড়িতে গেছে। তখন তিনি সেখানে গেলেন।

রোকেয়ার ছোট বোন জুলেখা পান সরবত দিয়ে বলল, মেজ আপাতত এখানে নেই; নানার বাড়ি গেছে।

আনসার উদ্দিন রসিকতা করে বললেন, সে গেছে তো কি হয়েছে, আমি তাকে নিতে আসি নাই; তোমাকে নিতে এসেছি।

জুলেখা ওঁর রসিকতা বুঝতে না পেরে ভয় পেয়ে সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে গেল।

আনসার উদ্দিন হাসতে হাসতে রোকেয়ার আব্বা শাহেদ আলীকে বললেন, তোমার মেয়ের কাণ্ড দেখ, আমার কথায় ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। তারপর তিনি রোকেয়ার নানার বাড়িতে গেলেন।

তাকে দেখে রোকেয়া ও তার নানার বাড়ির সবাই অবাক। রোকেয়া সালাম দিয়ে কদমবুসি করে জিজ্ঞেস করল, নানাভাই কেমন আছেন? নানি কেমন আছেন? তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসলেন না কেন?

আনসার উদ্দিন সালামের উত্তর দিয়ে দোয়া করে বললেন, আমরা সবাই ভালো আছি। আর তোমার নানিকে নিয়ে আসার কথা যে বললে, সে কেন আসবে? সে মেয়ে মানুষ, আর তুমিও মেয়ে মানুষ। তেমাকে দেখে সে ইন্টারেস্ট পাবে না। তুমি নাত জামাই হলে অন্য কথা ছিল।

রোকেয়ার মামাতো বোন মনোয়ারা বলল, আপনি তাহলে নাত-বৌকে দেখে ইন্টারেস্ট উপভোগ করতে এসেছেন?

এই কথায় সবাই হাসতে লাগল। আনসার উদ্দিন হাসতে হাসতে বললেন, তোমার পরিচয়টা পেলে উত্তর দিতে সুবিধে হত।

রোকেয়া বলল, ও মনোয়ারা, আমার মামাতো বোন।

আনসার উদ্দিন একবার মনোয়ারার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, অপূর্ব।

রোকেয়া বলল, কি অপূর্ব?

আনসার উদ্দিন বললেন, কি অপূর্ব, তা তোমার বোঝা উচিত ছিল। যখন বুঝতে পারছ না তখন আমিই বলি, মনোয়ারা বিবিকে দেখে তোমার প্রতি আমার ইন্টারেস্ট চলে গেল। এবার থেকে ওকেই দেখতে আসব।

উনার কথা শুনে আবার সবাই হাসতে লাগল। মনোরা হাসি থামিয়ে বলল, বেল পাকলে কাকের কি?

আনসার উদ্দিন বললেন, তোমার কথা অবশ্য ঠিক। তবে ঐ যে লোকে বলে, খাওয়ার চেয়ে দেখা ভালো। তারপর রোকেয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি ভাই আবার মনে কষ্ট নিও না। তুমিও অপূর্ব। তোমাদের দুজনকে দেখে সমান ইন্টারেস্ট পাচ্ছি। এখন বল, হারুন তোমাকে বেশি ভালবাসে, না আমি তোমাকে বেশি ভালবাসি? আর আমাদের দুজনের মধ্যে কাকে তুমি বেশি ভালবাস?

রোকেয়া হাসতে হাসতে বলল, আপনারা দুজনে আমাকে যেমন সমান সমান ভালবাসেন তেমনি আমিও আপনাদের ভালবাসি।

আনসার উদ্দিন বললেন, উঁহু, উত্তরটা ঠিক হল না। আমি বেশি ভালবাসি। তাই এই বুড়ো বয়সে প্রতি সপ্তাহে তোমাকে হারুনদের বাড়িতে দেখতে যাই। আজ সেখানে না পেয়ে তোমার বাপের বাড়িতে এসেছিলাম। সেখানেও না পেয়ে এখানে অনেক কষ্ট ভোগ করে এসেছি। আর হারুন তো সেই যে গেল এতদিনের মধ্যে একদিনও এল না।

রোকেয়া হাসি চেপে রেখে বলল, আসবার রাস্তা থাকলে প্রতিদিন আসত।

আনসার উদ্দিন হাসতে হাসতে বললেন, তোমরা আজকালের মেয়ে। তোমাদের সাথে কি আর যুক্তি তর্কে পারব ভাই।

নাস্তা খেয়ে তিনি চলে আসতে চাইলে, রোকেয়া ছাড়ল না। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করিয়ে বিকেলে চা খাইয়ে তবে ছাড়ল।

শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়-স্বজনদের ভালবাসা পেয়ে রোকেয়া শাশুড়ীর শত লাঞ্ছনা গঞ্জনা ভুলে যায়। তার উপর হারুন প্রতি মাসে তিন-চারখানা করে চিঠি দিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেয়। এতকিছু সত্ত্বেও রোকেয়ার এমন দিন কাটেনি, যেদিন সে শাশুড়ীর লাঞ্ছনা-গঞ্জনা খেয়ে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়নি। হনুফা বিবি বৌয়ের সঙ্গে মিষ্টি মুখে কথা বলা তো দূরের কথা, নরম মেজাজে ও বললেন না। সব সময় রুক্ষ্ম মেজাজে বলেন।

রোকেয়ার বড় ভাই জাভেদ এক বছর পর বিদেশ থেকে এসে রোকেয়াকে নায়ারে নিয়ে এল। রোকেয়ার বিয়ের সময় সে দেশে ছিল না।

রোকেয়া মা বাবাকে সালাম করে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

মেহেরুন্নেসা মায়ের মুখে বিয়ের দিনের রোকেয়ার শাশুড়ীর ব্যবহারের কথা শুনেছিলেন। এখন মেয়েকে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তোর শাশুড়ী কি তোর সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে?

রোকেয়া ভাবল, সত্য কথা বললে মা-বাবা মনে খুব ব্যথা পাবে। কান্না থামিয়ে চোখ মুখ মুছে বলল, না মা, তিনি তেমন কিছু বলেন না। তোমাদের জন্য প্রাণ জ্বলছিল তাই।

রোকেয়ার নানি রহিমন বিবি দুদিন হল মেয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন। তিনি এতক্ষণ সেখানে ছিলেন না। এই মাত্র এলেন। রোকেয়া তাকে সালাম করতে দোয়া করে বললেন, তুই যে বললি, তোর শ্বাশুড়ী তোকে কিছু বলে না, কথাটা কি ঠিক? তুই না বললেও আমরা জানি। বিয়ের দিনে তোর শাশুড়ী যে কষ্ট দিয়েছে এবং যেসব কথা বলেছে, তাতেই বুঝেছি সে কি রকম মেয়ে। সেই দিনই বুঝতে পেরেছি তোকে চিরকাল অশান্তি ভোগ করতে হবে। তারপর মেয়ে জামাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমিও তোমার শ্বশুর আজিজের কথায় এই কাজ করে খুব অন্যায় করেছি। আর তাকেই বা দোষ দেব কি? সে তো আর হারুনের মায়ের স্বভাব জানত না, হারুনকে জানত। তবে হারুন খুব ভালো। সে দেশে থাকলে আলাদা কথা ছিল। ওর শাশুড়ী খুব জঘন্য ধরনের মেয়ে। তার মত মেয়ে আমি আর দেখিনি।

শাহেদ আলী বললেন, কি আর করার আছে আম্মা। লোকে যে বলে, জাতের সাপ গর্তে মজে, আর অজাতের সাপ ছোবল মারে। রোকেয়ার শাশুড়ীর কথা শুনে তার প্রমাণ পেলাম। তারপর মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, শোন মা রোকেয়া, তোর শাশুড়ী তোর সাথে যতই খারাপ ব্যবহার করুক না কেন, কোনোদিন তার কথার উত্তর করবি না। আর রাগ করেও থাকবি না। নিজের মায়ের মত মনে করবি।

মেহেরুন্নেসা মেয়েকে এক সময় কাছে বসিয়ে বুঝিয়ে বললেন, তোর শাশুড়ী তোর উপর যতই অত্যাচার করুক, তবু তুই রা করবি না। ছোটলোকের মেয়ের মত তার সাথে ঝগড়া করে বাপ-দাদার মুখে চুন-কালি দিবি না। জেনে রাখ মা, মানুষ মাটির উপর কত অত্যাচার করে, কাটে, পিটায়, বাড়িঘর করার সময় কত কিছু করে। তবু মাটি কোনো প্রতিবাদ করে বলে না, কেন তোমরা আমার উপর এত অত্যাচার করছ? কেন বলতে পারে না জানিস? তার কথা বলার মুখ নেই বলে। তেমনি তুইও মাটির মত থাকবি।

রোকেয়া বলল, দোয়া কর আম্মা, আমি যেন তোমাদের উপদেশ মেনে চলতে পারি। তোমরা আমার শাশুড়ীর কথা যাই শুনে থাক না কেন, তবু আল্লাহ আমাকে অনেক সুখে রেখেছেন। আমার শ্বশুর বাড়ির সব আত্মীয়-স্বজন আমাকে ভালবাসে। শুধু আমার শাশুড়ী আমাকে দেখতে পারে না। সবাইয়ের থেকে আমার নানা শ্বশুর আমাকে বেশি ভালবাসেন। মাঝে মাঝে উনি আমাকে ওঁদের বাড়িতে নিয়ে যান।

মেহেরুন্নেসা বললেন, দোয়া করি মা, আল্লাহ তোকে সুখী করুক।

রোকেয়ার বান্ধবী লাকি রোকেয়া এসেছে শুনে তার সঙ্গে দেখা করতে এল। রোকেয়াকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, তোর সাথে অনেক দিন পর দেখা হল। সত্যি তোর জন্য এতদিন আমার মন জ্বলছিল।

রোকেয়া বলল, লাকি, তুই আমাকে দেখে অভিনয় করছিস। যদি প্রাণ জ্বলত, তাহলে নিশ্চয় আমাকে দেখতে যেতিস। স্কুলে যাস, অথচ আমাদের বাড়িতে যাস না। স্কুল থেকে আমাদের বাড়ি মাত্র পনের বিশ মিনিটের রাস্তা।

লাকি বলল, সত্যি বলছি, বিশ্বাস কর, যেতে খুব মন চায়। শুধু তোর বরের কথা চিন্তা করে যাইনি। তাছাড়া পরীক্ষার পর স্কুলে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

স্কুলে যাওয়া না হয় শেষ হয়েছে। কিন্তু আমার বরের কথা বললি কেন? সে কি তোকে খেয়ে ফেলত?

আহা তা কেন, ঐ যে বিয়ের আগে তোর সঙ্গে যে সব কথা বলেছিলাম, সে সব তুই যদি তোর বরকে বলে থাকিস? তাই লজ্জায় যেতে পারি নি।

রোকেয়া হেসে উঠে বলল, সেসব কথা বুঝি বরকে বলা যায়? ঐ যে লোকে বলে, চোরের মন পুলিশ পুলিশ। দেখছি তোর মনও তাই।

লাকিও হাসতে হাসতে বলল, তোর বরটা কেমন বলবি?

আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় মনের মত পেয়েছি। তবু খুব ভয় ভয় করে। কি করে ঐ বাড়িতে আজীবন কাটাব।

ভয় করবে কেন? মনের মত যখন স্বামী পেয়েছিস তখন আর চিন্তা কিসের?

তোর কথা ঠিক; কিন্তু আমার শাশুড়ী বড় কঠিন মেয়ে। তার মনে এতটুকু দয়া মায়া নেই। আর বিবেক বিবেচনা বলতেও এতটুকু নেই। দোয়া করিস, আল্লাহ যেন শাশুড়ীর বিপদ থেকে আমাকে রক্ষা করেন।

তাতো করবই। আচ্ছা রুকু, তোর দেবররা কেমন? তারা তোকে ভালবাসে?

রোকেয়া কথাটার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বলল, হ্যাঁ তারা আমাকে খুব ভালবাসে। আমার মেজ দেবর বিদেশে থাকে। আমাকে চিঠি দেয়। টাকাও পাঠায়। তুই যদি রাজি থাকিস, তাহলে বল, তার সঙ্গে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করি। আমরা দুজনে অনেক আগে সেই রকম তো ওয়াদা করেছিলাম।

লাকি বলল, তা করেছিলাম। কিন্তু তোর মেজ দেবর ভালো হলে কি হবে, তোর শাশুড়ীর কথা আমরা যা শুনেছি এবং তুইও যা বললি, তাতে করে সেই ওয়াদা রক্ষা করতে পারব না। জেনেশুনে কেউ আগুনে হাত দেয়? আচ্ছা, তোর শাশুড়ী যে তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, হারুন ভাই জানে না?

রোকেয়া বলল, জানবে না কেন? সে কি তার মাকে চিনে না? তবে শাশুড়ীর দুর্ব্যবহারের সব কথা আমি তাকে জানাই না। আমাকে কাঁদতে দেখলে অথবা আমার মন খারাপ দেখলে যখন জিজ্ঞেস করে তখন অল্পকিছু হলেও বলতে হয়। কারণ সে ঘরে এলেই তার মা তাকে আমার নামে মিথ্যে করে নানান কথা বলে। সেই সময়। জিজ্ঞেস করলে আমি সত্য ঘটনা বলি। তখন সে আমাকে বুঝিয়ে বলে, কি করব বল, হাজার হোক মা তো? তোমার হয়ে মায়ের সাথে ঝগড়া করলে লোকে ছিঃ ছিঃ করবে। সবকিছু সহ্য করে যাও। আল্লাহ একদিন না একদিন তার ফল দেবেন। তিনি কোরানপাকে বাবা মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন।

লাকি বলল, হারুন ভাই অবশ্য ঠিক কথা বলেছে। দোয়া করি, আল্লাহ তোকে শাশুড়ীর অত্যাচার তেকে রেহাই দিক, সবকিছু সবর করার ক্ষমতা দিক। তারপর বিদায় নিয়ে যাওয়ার সময় বলল, পরে আবার আসব। তুইও যাস।

দিন পনের পর রোকেয়ার সেজ দেবর হোসেন এসে রোকেয়াকে নিয়ে গেল। কয়েকদিন পরে আনসার উদ্দিন মেয়ের বাড়ি এলেন।

রোকেয়া কদমবুসি করে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করল।

আনসার উদ্দিন দোয়া করে এবং ভালো-মন্দ খবরা-খবর বলে বললেন, আমার মন বলছে, তোমার মেয়ে হবে। আল্লাহ যদি মেয়ে দেন, তাহলে তার নাম রাখবে আশা।

তার কথা শুনে রোকেয়া ও সেখানে যারা ছিল, সবাই হাসতে লাগল। হোসেন বলল, নানা, এত নাম থাকতে এই নাম রাখতে বলছেন কেন?

আনসার উদ্দিন বললেন, কেন রাখতে বললাম শোন, আশা যখন বিয়ের লায়েক হবে তখন সব ছেলেরা আশা করবে আশাকে বিয়ে করব, বুঝেছ?

হোসেন হাসতে হাসতে বলল, নানা ভাইয়ের যেমন কথা; আশা নাম রাখলেই শুধু আশা করবে, আর অন্য নাম রাখলে করবে না বুঝি?

আনসার উদ্দিন বললেন, তুমি এখন ছোট। তাই আমার কথার মানে বুঝতে পারছ না। বড় হলে ঠিকই বুঝবে। এখন শুধু এটুকু বলছি, ঐ নাম রাখলে বেশি আগ্রহী হবে।

সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত নানার সঙ্গে গল্প গুজব করে সবাই ঘুমাল। পরের দিন ফজরের সময় সবাই উঠে নামায পড়ল। হোসেন নানাকে নামায না পড়ে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে জাগাবার জন্য গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে গিয়ে বুঝতে পারল, শরীর বরফের মত ঠাণ্ডা, আর হাত পা শিক হয়ে রয়েছে। ভয় পেয়ে মায়ের কাছে গিয়ে সে কথা জানাল।

হানুফা বিবি শুনে তাড়াতাড়ি করে এসে আব্বা আব্বা বলে কয়েকবার ডেকে গায়ে হাত দিয়ে বুঝতে পারলেন, মারা গেছেন। তিনি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করতে লাগলেন। ঐ অলক্ষণে বৌয়ের জন্য এরকম হল। নচেৎ বাবা আমার কাল একদম ভালো ছিল। অনেক দিন কোনো অসুখ-বিসুখ ছিল না। হঠাৎ কি করতে কি হয়ে গেল গো আল্লাহ।

হানুফা বিবির চিৎকারে বাড়ির সবাই সেখানে এল। রোকেয়াকে দেখে হানুফা বিবি বললেন, তুই আমার বাপকে মেরে ফেলেছিস। এক্ষুনি বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে। তোর মুখ আমি আর দেখতে চাই না।

রোকেয়া নানা শ্বাশুর মারা গেছে শুনে ভীষণ দুঃখ পেয়ে কাঁদছিল। আর ভাবছিল, এ বাড়ির মধ্যে সব থেকে বেশি যিনি আমাকে ভালবাসতেন, তাকে আল্লাহপাক তুলে নিলেন। দীলে দীলে তাঁর রুহের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করছিল। শ্বাশুড়ীর কথা শুনে আরো বেশি দুঃখ পেয়ে চিন্তা করল, হায়রে মানুষের মূর্খতা? ওঁর পেটে যদি এলেম থাকত, তাহলে এ রকম কথা বলাতো দূরের কথা, এরকম ভাবতেও পারতেন না। তখন তার একটা হাদিসের কথা মনে পড়ল, তালিবুল এলেম ফরিদাতুন আলা কুলে মুসলিমিন অর্থাৎ মুসলমান নর-নারীর উপর জ্ঞান অর্জন ফরয।

ততক্ষণে খবর পেয়ে আশেপাশের বাড়ির মেয়ে পুরুষ অনেকে এসেছে তারা হানুফা বিবির কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। তাদের মধ্যে ওর এক চাচাতো বড় জা বললেন, হারুনের মা, তুমি একি কথা বলছ?ইনার মৃত্যু আল্লাহপাকের হুকুমে হয়েছে। তুমি শুধু শুধু বৌকে দোষারূপ করছ? কারুর মৃত্যুর জন্য কাউকে এভাবে দায়ী করা ঠিক নয়। যখন দুচারজন এসব বলতে নিষেধ করল তখন বৌকে দোষারূপ করা থেকে বিরত হলেন।

আনসার উদ্দিন মারা যাওয়ার ষোল সতের দিন পর রোকেয়া একটা মেয়ে প্রসব করল। বাড়ির সবাই খুশি হয়ে বলাবলি করতে লাগল, এই বাড়িতে প্রায় ত্রিশ বছর পর আল্লাহ মেয়ে দিল। আমাদের বাড়িতে কোনো মেয়ে ছিল না যে, একটু আদর করব। কিন্তু হানুফা বিবি খুশি হতে পারলেন না। বললেন, এতদিন মেয়ে হয়নি ভালই ছিল। মেয়ে বিয়ে দিতে যখন মোটা টাকা খরচ হবে তখন কত ধানে কত চাল বুঝবে। ওঁর কথার কেউ কান দিল না।

আকিকার দিন সবাই নাম রাখল রুকসানা বেগম।

রুকসানা যখন দুমাসের তখন হারুনের মেজ ভাই শামসু বিদেশ থেকে এল। সে ভাইজী হয়েছে জেনে অত্যন্ত আনন্দিত হল।

রোকেয়াকে দেখে এবং তার ব্যবহারে শামসু খুব সন্তুষ্ট। তাকে বলল, তোমার মত ভাবি পেয়ে আমি ধন্য। চিঠিতে যখন ভাইয়ার বিয়ের কথা জানতে পারলাম তখন মনে মনে তোমার মতো ভাবিই আশা করেছিলাম।

রোকেয়া বলল, আমিও তোমার মতো দেবর পেয়ে ধন্য হলাম। এখন বলত ভাই, আমি তো তেমন সুন্দরী নই, তবু কেন আমাকে তোমার ভালো লাগল?

শামসূ বলল, কে বলেছে তুমি সুন্দরী নও। শুধু গায়ের চামড়া সাদা হলেই কেউ সুন্দরী হয় না। সুন্দরী হওয়ার জন্য সাদা রং ছাড়া আর যেসমস্ত জিনিসগুলো দরকার, তা তোমার মধ্যে বিদ্যমান। তার উপর তোমার গুণাবলী তোমাকে আরো সুন্দরী করে তুলেছে।তাই তো নানাভাই তোমাকে অত ভালবাসতেন। তিনি যে রকম রসিক ছিলেন, তুমিও সেইরূপ রসিক। নানাভাইকে জীবিত দেখতে পেলাম না, এটাই যা দুঃখ। তার মতো রসিক মানুষ জীবনে দেখিনি। তারপর রোকসানাকে আদর করতে করতে বলল, মামণি তুমিও তোমার মায়ের মতো গুণবতী হও, এই দোয়া করি।

শামসু আসার প্রায় পাঁচ ছ মাস পর হারুন হঠাৎ বিদেশ থেকে এল।

রোকেয়া তখন যোহরের নামায পড়ছিল। নামাযের মধ্যে স্বামীর আগমন টের পেল। নামায শেষ করে রুমে গিয়ে সালাম দিয়ে কদমবুসি করে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ?

হারুন সালামের জবাব দিয়ে স্ত্রীকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে কিছুক্ষণ নিথর হয়ে রইল। তারপর দুগালে অসংখ্য চুমো খেয়ে বলল, এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, সত্যি সত্যি তোমাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খাচ্ছি কি না?

রোকেয়াও চুমোর প্রতিদান দিয়ে বুকে মাথা রেখে বলল, হ্যাঁ গো সত্যি। নামায। পড়ার সময় তোমার আসার খবর টের পেয়ে দুরাকায়াত শোকরানার নামায পড়েছি। তুমি একটু ছাড়, রোকসানাকে নিয়ে আসি।

হারুন তাকে আবার কয়েকটা চুমো খেয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল, যাও তাড়াতাড়ি নিয়ে এস।

রোকেয়া রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দোলনা তেকে ঘুমন্ত রোকসানাকে নিয়ে ফিরে এল। তারপর স্বামীর কোলে দেওয়ার সময় বলল, এই নাও তোমার মেয়ে রোকসানা। আল্লাহপাক আমার মনের বাসনা পূরণ করে মেয়ে দিয়েছেন। সে জন্যে তার পাক দরবারে শুকরিয়া জানিয়েছি।

হারুন মেয়েকে চুমো খেয়ে আদর করতে করতে বলল, রোকা, তুমি আমাকে হারিয়ে দিলে। তবে হেরে গিয়েও খুব আনন্দ লাগছে। কারণ আমাদের বাড়িতে কোনো ছিল না।

রোকসানা জেগে গিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে দিল। এক বছরের মেয়ে কিছু বলতে পারছে না। এক সময় আম্মু বলে রোকেয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে ভ্যা করে কেঁদে উঠল।

রোকেয়া কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলল, কাঁদছ কেন আম্মু, তোমার আব্দুকে চিনতে পারছ না? রোকসানার কান্না থেমে যেতে স্বামীকে বলল, চল খেতে চল।

হানুফা বিবি প্রথম থেকেই ছেলে বৌকে এক সাথে বেশিক্ষণ থাকা পছন্দ করেন না। তাই হারুন ঘরে থাকলে রোকেয়া যখন কাছে আসত তখন বড় গলায় বলতে থাকেন, দিনের বেলা স্বামী ঘরে এলেই তার কাছে যেতে হবে নাকি? এমন নির্লজ্জ মেয়ে কখনো দেখিনি। এদিকে সংসারের কাজ ওল ওল, ভ্যান ভ্যান করছে। সে সব করবে কে?

প্রথম প্রথম রোকেয়া এই কথা শুনে লজ্জায় বাঁচত না। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে আসত। পরে দিনের বেলা হারুন ঘরে থাকলে হঠাতে আসত না।

একদিন হনুফা বিবি রোকেয়াকে বললেন, তুই সকালে গোসল করতে এইদিক দিয়ে যাবি না। তোর নাপাক দৃষ্টি আমার ছেলেদের উপর পড়ে। তাই তাদের অসুখ লেগেই থাকে। তোকে এনে আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে। তুই অপয়া সর্বনাশী মেয়ে।

রোকেয়া শুনে লজ্জা তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে গেল।

হারুন বাড়িতে আসার কয়েক দিন পর একদিন মাকে বলল, আজ তোমাদের বৌকে নিয়ে একটু বেড়াতে যাব।

হানুফা বিবি রেগে গিয়ে বললেন, তাহলে সংসারের কাজ করবে কে? আমাকে কি তোরা বাদী পেয়েছিস নাকি? আমি কোনো কাজ করতে পারব না।

হারুন বলল, তুমি এমন কথা বলছ কেন আম্মা? তুমি কাজ করতে যাবে কেন? তোমাদের বৌ সব কাজ করে দিয়ে যাবে।

হানুফা বিবি আর কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।

হারুন রোকেয়াকে বলল, তুমি চটপট সব কাজ সেরে ফেলে তৈরি হয়ে নাও, আমি একটু বাইরে থেকে আসছি।

রোকেয়া তখন চিন্তা করল, বেড়াতে না যাওয়াই ভালো। গেলে শাশুড়ী আজ আবার অনেক কথা শোনাবে। আবার ভাবল, স্বামীর কথা না শুনলে সে মনে কষ্ট পাবে।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে হারুন বলল, রোকা, তুমি আমার কথা শুনবে না?

রোকেয়া চিন্তা করে ঠিক করল, শাশুড়ীর বকুনি খাবে সেও ভালো, তবু স্বামীর মনে কষ্ট দেবে না। বলল, ঠিক আছে, তুমি কোথায় যাবে বলছিলে যাও। আমি ততক্ষণে কাজ সেরে তৈরি হয়ে নিচ্ছি।

সেদিন হারুন একটা স্কুটার ভাড়া করে রোকেয়াকে নিয়ে প্রথমে বদরপুরে শ্বশুর বাড়ি গেল। শ্বশুর শাশুড়ীকে সালাম করে কুশল বিনিময় করল। তারপর নাস্তাপানি খেয়ে ছোট শালা বাহাদুরকে সঙ্গে নিয়ে চাঁদপুর টাউনে এল। মার্কেট ঘুরে ঘুরে হারুন মায়ের ও স্ত্রী জন্য দুটো শাড়ী ও দুটো ব্লাউজ এবং দুজোড়া জুতো, আব্বার জন্য একটা লুঙ্গী ও পাঞ্জাবী, রোকসানার দুসেট জামা ও জুতো, ছোট ভাইদের ও বাহাদুরের জন্যে একটা করে প্যান্ট ও শার্টের পীস এবং জুলেখার জন্য থ্রিও পীস কিনল। তারপর ভাত খাওয়ার জন্য একটা হোটেলে ঢুকল।

খাওয়ার শেষ পর্যায়ে বাহাদুর বলল, দুলাভাই, আইসক্রীম খাওয়াতে হবে। হারুন মেসিয়ারকে ডেকে চারটে পোলার দিতে বলল।

রোকেয়া মেসিয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলল, না না তিনটে দিন। তারপর স্বামীর দিকে চেয়ে বলল, চারটে কি হবে? রোকসানা আইসক্রীম খেতে পারবে না। যদি খায় আমার থেকে খাওয়াব।

খাওয়া-দাওয়ার পর তারা বাড়ি রওয়ানা দিল। ফেরার পথে প্রথমে শ্বশুর বাড়িতে এল। জুলেখা থ্রিপীস দেখে মহাখুশী। মেহেরুন্নেসা মেয়ে জামাইকে থেকে যেতে বললেন।

হারুন ও রোকেয়া কিছুতেই রাজি হল না।

মেহেরুন্নেসা বললেন, তাহলে রাতে খাওয়া-দাওয়া করে যাও।

রোকেয়া জানে, এমনি শাশুড়ীতে আসতে দিতে চেয়েছিল না। তার উপর রাত। করে বাড়ি ফিরলে কিছু বলতে বাকি রাখবে না। সেই কথা ভেবে বলল, না আম্মা, আমাদেরকে এক্ষুনি চলে যেতে হবে। তারপর মিথ্যে করে বলল, তোমার জামাইয়ের কাছে আজ সন্ধ্যের সময় কয়েকজন লোক দেখা করতে আসবে।

মেহেরুন্নেসা বললেন, তাহলে তোদেরকে তো আটকাতে পারি না। তারপর জামাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা একটু জিরিয়ে নাও। আমি নাস্তা তৈরি করে নিয়ে আসি।

নাস্তা খেয়ে তারা যখন বাড়ি ফিরল তখন প্রায় সন্ধ্যে।

হানুফা বিবি তোদেরকে দেখে চিৎকার করে হারুনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মাকে বাঁদীগিরী করতে দিয়ে বৌ নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে ফুর্তি আমোদ করে এলি। আল্লাহ-এর বিচার করবে।

হারুন মায়ের কথায় রাগ করল না। মাকে খুশি করার জন্য বলল, আম্মা, তুমি শুধু শুধু রাগ করছ। সংসারে কাজ করলে কেউ বাদী হয় না। বরং বাদীগিরী করার জন্য রোকেয়াকে বিয়ে করে এনেছি। তারপর মায়ের হাত ধরে ঘরে এনে তার, আব্বার ও ভাইদের কাপড়-চোপড় ও জুতো যা কিছু কিনে এনেছে, সেগুলোর প্যাকেট হাতে দিয়ে বলল, দেখ দেখি এগুলো তোমার পছন্দ হয় কি না?

হানুফা বিবি একটা একটা সবগুলো দেখে খুশি হলেন। বললেন, রোকসানা ও তার মায়ের জন্য কিছু কিনিসনি?

হারুন বলল, হ্যাঁ কিনেছি। তারপর সেগুলোও খুলে দেখাল।

 হানুফা বিবি আর কিছু না বলে কাপড়-চোপড় নিয়ে চলে গেলেন।

এইভাবে চার পাঁচ মাস পার হয়ে গেল। এবার হারুন বিদেশ চলে যাবে। তাই একদিন রোকেয়াকে বলল, আজ বেড়াতে যাব। তুমি ঘরের সব কাজ এমন ভাবে-করে ফেলবে, আম্মা যেন কিছু বলতে না পারে।

রোকেয়া সংসারে সব কাজ ঠিকমত করে বেড়াতে যাবার জন্য তৈরি হল। হানুফা। বিবি তা জানতে পেরে ভীষণ মুখ খারাপ করে গালাগালি করতে করতে বললেন, এমন ছোটলোকের মেয়ে জীবনে দেখিনি। লজ্জা শরম বলতে কিছু নেই। স্বামীকে যাদু করে চুষে খেয়ে ফেলতে চায়। তাকে ভেড়া বানিয়ে বাইরে নিয়ে ফুর্তি করে। ঘরে ফুর্তি করে পোষায় না। হস্তিনী মেয়েরা এই রকম হয়। এই মেয়ে আমার ছেলেকে শেষ না করে। ছাড়বে না। এ রকম যে করবে তা আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। তাই তখন বৌ করতে অমত করে ছিলাম। এখন আমার ঘাড়ে সংসারের কাজ ফেলে দিয়ে স্বামীকে নিয়ে নবাবের বেটী ফুর্তি করতে বেরোচ্ছে।

হানুফা বিবি যখন এইসব বলছিলেন তখন হারুন ও রোকেয়া নিজেদের রুমে ছিল। রোকেয়া স্বামীকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, প্রিয়তম তুমি রাগ করো না, আজ আমি বেড়াতে যাব না।

হারুন এতক্ষণ মায়ের কথা শুনে খুব রেগে গিয়েছিল। এতদিন তার অনেক কথা সহ্য করতে পারলেও আজ পারল না। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, আম্মা, তুমি এসব কি শুরু করলে বলতো? রোকেয়াকে কি পেয়েছ? সব সময় এরকম করলে সে এখানে টিকবে কি করে? তুমি যে ওকে এভাবে বলছ, ওতো এখন এ বাড়ির বড় বৌ, এরকম করে বললে আমাদের বংশের ইজ্জত যাবে না?

হানুফা বিবি রাগের সঙ্গে বললেন, তুই বৌয়ের হয়ে এত যে শাউকড়ি করছিস, ঘরের কাজ কে করবে শুনি?

হারুন বলল, তোমাদের শুধু কাজ আর কাজ। সে তো তোমার কথামত সংসারের সব কাজই করে। আজও সব কাজ সেরে দিয়ে যাচ্ছে। তোমাদের বৌ তো যেতেই চায় না। আমি তাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছি।

হানুফা বিবি এই কথার জবাব দিতে না পেরে আরো রেগে গিয়ে বললেন, দেখ হারুন, আমাকে বেশি রাগাবি না।যা, যেখানে তোদের মন চায় যা। দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে।

হারুন, চুপচাপ ফিরে এসে রোকেয়া ও রোকসানাকে নিয়ে বেড়াতে বেরুল।

বদরুদ্দিন এখন বেশ সুস্থ। তিনি সুস্থ অবস্থায় বা অসুস্থ অবস্থায় ছেলে বৌ কিংবা সংসার নিয়ে কোনোদিন মাথা ঘামান নি। আজ ছেলে বৌ বেড়াতে বেরিয়ে যাবার পর স্ত্রীকে বললেন, ওরা আজকালের ছেলেমেয়ে, একটু আধটু বেড়িয়ে ফুর্তি করবে। তাছাড়া এটাই তো ঐসব করার বয়স। তাতে তুমি বাধা দিতে যাও কেন?

হানুফা বিবি বেশ অবাক হয়ে স্বামীর দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, কি ব্যাপার? তুমিতো কোনোদিন সংসারের কোন কিছু নিয়ে মাথা ঘামাওনি। আজ যে হঠাৎ ছেলে বৌয়ের জন্য দরদ উথলে উঠল? ঐ সর্বনাশী মেয়েটা হারুনকে। শেষ করে দিচ্ছে। তা দেখতে পাওনি? আমার ছেলের কিছু হলে, আমিও বলে রাখছি, ওকেও আমি শেষ করে দেব। তুমি এসব নিয়ে আর কোনোদিন কথা বলবে না।

বদরুদ্দিন স্ত্রীকে ভালভাবেই চেনেন। সে যে নিজের গায়ে চিরকাল চলে এসেছে তা। জানেন। বিয়ের পর প্রথম প্রথম স্ত্রীর এই খুঁয়েমীর জন্য মারধর করতেন। তাতে হিতে বিপরীত হয়েছে। হানুফা বিবির গ আরো বেড়ে গেছে। তাই তিনি স্ত্রীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক ছাড়া আর কোন সম্পর্ক রাখেন নি। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে মধুর সম্পর্ক তা কোনোদিন ছিল না। আর আজও নেই। হানুফা বিবি নীরেট মুখ। তিনি মধুর সম্পর্ক। টম্পর্ক কি নিজে যেমন জানেন না, তেমনি অন্য কারোদেরে যে থাকতে পারে তাও জানেন না। তাকে বদরুদ্দিন কোনোদিন কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাননি। তাই ছেলে বৌকে বেড়াতে নিয়ে গেলে রেগে যান। এখন তাদের হয়ে স্বামীকে ঐ কথা বলতে শুনে তিনি তাকে ঐসব বললেন। আর বদরুদ্দিন ও তাই স্ত্রীর কথা শুনে চুপ করে গেলেন।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *