কিতাগড় – ৮

ত্রিভন অবাক হয়ে রাজাদের কথা ভাবে। শিবিরের বাইরে তাদের আসতে দেখা গেল না একবারও। ভয় পেয়েছি নাকি? তীরের ভয়?

ভয়টা অমূলক নয়। তৈরী হয়েই ছিল ত্রিভন। তাঁবুর বাইরে একবার এলে ফিরে যেতে হবে না। তবু নিজের দলের দুর্গতি দেখেও বাইরে আসার প্রয়োজন বোধ করল না? এ আবার কেমন রাজা? এদের বাপরাও বোধ হয় এমন ছিল। তাই দিনের পর দিন প্রজারা সুখনিদির কড়ি গুনে এল অথচ সতেরখানির দিকে তেড়ে আসার মতো বুকের পাটা হয়নি রাজাদের। রান্‌কোর দিকে দৃষ্টি ফেলে ত্রিভন। চোয়াড়দের দিকেও তাকায়। তারাও বোধহয় একই কথা ভাবছে। সঙ্কোচে মুখ লাল হয়ে ওঠে তার। সে নিজেও যে রাজা।

—আপনিও তো আমাদের রাজা। রান্‌কো বলে ওঠে।

ত্রিভন চমকায়।

—কত তফাৎ। তাই আমাদের চোয়াড়দের সঙ্গে ওদের লোকের এত তফাৎ। রান্‌কো দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

জবাব দেয় না ত্ৰিভন।

শত্রুদের পেছনের দলের কাছে সংবাদ পৌঁছেছে। দূর থেকেও একটা আলোড়ন অনুভব করা যায়। প্রস্তুতির আলোড়ন। এগিয়ে আসবে এবারে।

—কি করবেন রাজা?

—দেখব।

—তীর ছুড়ে ফল হবে?

—না। কেউ যেন একটা তীরও না ছোড়ে।

চোয়াড়েরা রাজার আদেশে গা-ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

রান্‌কো বুঝতে পারে না তাদের পরবর্তী কার্যক্রম। প্রশ্ন করতে সাহস পায় না রাজাকে গভীর চিন্তার ছাপ রাজার মুখে। সে শুধু পেছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে।

সে দেখতে পায়। পেছনের দল এগিয়ে আসছে—এগিয়ে আসছে শ্যামসুন্দরপুর আর অম্বিকানগরের রাজার তাঁবুর দিকে। অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে।

—রাজা।

—ধৈর্য হারিও না সর্দার। আরও একটু দেখো।

—ওরা এগিয়ে এলে রাজারা বন্দুক ব্যবহারের সুযোগ পাবেন।

—জানি।

—এ পক্ষ থেকে তখন সাড়া না পেলে আরও এগিয়ে আসবে।

—জানি।

—তখন? পালিয়ে যাব আমরা? সতেরখানির চোয়াড়রা?

—না। পেছু হটে যাবে। সম্মুখ যুদ্ধ যেখানে সম্ভব নয়, সেখানে পিছিয়ে যাওয়াকে কাপুরুষতা বলে না।

—কিন্তু কতদূর? কিতাগড় পর্যন্ত?

—না। বেশীদূর নয়। হয়তো এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, এখান থেকেই দেখবে অত বড় দল পাগলের মতো ছুটে চলেছে নিজের রাজ্যের দিকে

—সে কি করে সম্ভব?

—হাঁ সর্দার। বিজলী আমাকে ছেড়ে গেল বলে তোমাকে সে কথা বলার অবসর পাইনি। তুমি কি জান, বুধকিস্‌কু এসেছে আমার সঙ্গে?

—কোথায়? না!

—সুখনিদি আদায় করতে গিয়েছে। অনেকদিন আরামে ঘুমিয়েছে অম্বিকানগর আর শ্যামসুন্দরপুরের লোকেরা। এবারে পাওনা দিক।

কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রান্‌কো। মস্তিষ্ক তার দ্রুত কাজ করে চলে। তার পরই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে—রাজা। সত্যিই রাজা। আমার রাজা।

—এ কি সর্দার

—রাজা।

শান্ত সমুদ্র যেন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। হাওয়া ছকের মতো মুহূর্তে তা ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি চোয়াড়ের মনে প্রাণে দেহে।

বৃদ্ধ চোয়াড়টি মাথার চুল ছেড়ে। বোকা—আকাট বোকা সে। নইলে, রাজার সঙ্গে এসে, কিস্‌কু সর্দারকে চলে যেতে দেখেও কেন সে বুঝল না? রাজার এই কৌশল অন্ততঃ তার ধরে ফেলা উচিত ছিল। বৃথাই যুদ্ধ করেছে যুঝার সিংএর আমল থেকে। বৃথাই তার চুলগুলো দেখতে শণের মতো হয়েছে। অন্য চোয়াড়দের কাছে মুখ দেখাবার উপায় রইল না।

গুড়ুম—মুড়ুম—

ঢলে পড়ে বৃদ্ধ চোয়াড়। এলোপাথাড়ি গুলির একটি এসে সোজা তার বুকে বেঁধে। অসাবধান ছিল সে। শত্রুদের পেছনের দল কখন যে রাজাদের তাঁবুর সামনে পৌঁছেছে, কখন যে রাজারা নিজেদের নিরাপদ ভেবে সাহসী বীরের মতো তাঁবু থেকে বার হয়ে আন্দাজে গুলি ছুড়লেন- দেখেনি সে। কারও কাছে আর মুখ দেখাতে হল না তার। মরে বেঁচে গেল, যুঝার সিং-এর আমলের বহু যুদ্ধের যোদ্ধা। ঠোঁট দুটো তার বারকয়েক থর থর করে কেঁপে থেমে যায়।

ত্রিভন আড় চোখে, একবার চেয়ে দেখে। শান্তির কোলে আশ্রয় নিয়েছে চোয়াড়। সবাইকেই হয়তো এভাবে যেতে হবে। আজ না হোক দুদিন পরে।

—রাজা।

—বল সর্দার।

—ওকে চেনেন?

—না।

—ওর ছেলে নাগাদের সঙ্গে যুদ্ধে মারা গিয়েছিল। ওর নাতি বেঁচে থাকল শুধু।

ত্রিভন আর একবার চায় মৃতের মুখের দিকে। খানিকটা রক্ত বার হয়ে এসেছে ঠোটের দুপাশ বেয়ে।

—নাতিটা যুদ্ধে আসেনি তো?

—না। কোনোদিনই পারবে না যুদ্ধ করতে। খোঁড়া—জন্ম থেকেই, আর বোবা।

—আর কেউ নেই?

—না।

গুড়ুম গুড়ুম—

ত্রিভন হেসে ওঠে। রান্‌কো অর্থ বোঝে না সে হাসির।

—রাজাদের কাণ্ড দেখেছ সর্দার। এক জায়গায় দাঁড়াচ্ছে না। পাছে তীর গিয়ে লক্ষ্যভেদ করে।

—বন্দুক ছোড়ার সময় একবার চেষ্টা করুন না রাজা।

—মাথা দুটো আড়ালে থেকে যাচ্ছে। বুকও। সামান্য আহত করে লাভ কি?

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। এক পাও এগিয়ে এল না। শত্রুরা। রাজারা ভরসা পায় না। যাদের তীরের আঘাতে এতগুলো লোক ধরাশায়ী হল তারা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না। নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে—অপেক্ষা করছে অতি নিকটে আরও মারাত্মক রকমের আঘাত হানার জন্যে। সামনের বনটা দিনের আলোতেও রাজাদের মনে বিভীষিকার সৃষ্টি করছে।

হঠাৎ তাদের মধ্যে একটা ব্যস্ত ভাব দেখা যায়। উত্তেজিত হয়ে ছুটোছুটি শুরু করে তারা। পেছনের আর একদল সৈন্য তাঁবুর সামনে এগিয়ে আসে। হাত পা নেড়ে চিৎকার করে কি সব বলতে শুরু করে। ভীড়ের মধ্যে দুই রাজা আর তাদের বন্দুককে দেখতে পাওয়া যায় না।

—খবর এসে পৌঁছেছে। ঠোঁট কামড়ায় ত্ৰিভন।

—হাঁ রাজা। রান্‌কোর চোখদুটো উজ্জ্বল।

—ধনুক নিয়ে তৈরী থাকতে বল সবাইকে। হুকুম পাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকে যেন কম করে চারটে তীর ছুড়তে পারে।

চোয়াড়ের দল প্রস্তুত হয়।

বৃদ্ধ চোয়াড়ের মৃতদেহ তখনো নরম। রান্‌কো তার ধনুক তূণ নিয়ে নিজের পাশে রাখে।

—শত্রুদের পরিষ্কার করার সাধ ছিল এর—দেখে যেতে পারল না। মৃতের মাথা স্পর্শ করে আস্তে আস্তে উচ্চারণ করে রান্‌কো।

রাজাদের তাঁবুর খুঁটি টেনে উপড়ে ফেলা হয়। সৈন্যরা তাদের জিনিসপত্তর পিঠে বেঁধে নেয়। ঠিক সেই সময়ে চার ঝাঁক তীর গিয়ে বেশ কিছুসংখ্যক লোককে মাটিতে ফেলে দেয়। আর্তনাদ ওঠে শত্রুদের মধ্যে। কান্নার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। আহতদের কান্না। যারা মরেছে, তাদের বলার কিছুই নেই, কিন্তু আহতেরা ফিরে যেতে চায় নিজের দেশে—স্ত্রীপুত্রের কাছে। সুখনিদি দিতে না পেরে তারা হয়তো অপরিসীম অত্যাচার সহ্য করছে।

বিস্মিত চোয়াড়রা দেখে, আহতরা পড়েই রইল। কেউ তাদের তুলে নিয়ে গেল না। দুই রাজা যে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত সেখানে এই অমানুষিক অবিবেচনা ঘটতে দেখে তারা চমকে ওঠে।

শত্রুরা দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় ধীরে ধীরে। আহতেরা হাত পা ছুড়ে কাঁদে।

—চল রান্‌কো দেখে আসি ওদের। যদি কিছু সাহায্য করতে পারি।

—বৃদ্ধের মৃতদেহটা?

—হ্যাঁ, গাঁয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা কর এখুনি।

রান্‌কোর আদেশে পাঁচজন বলিষ্ঠ চোয়াড় সামনে এগিয়ে আসে। বৃদ্ধকে তারা চেনে। বিষণ্ণ-মুখে একটি শিশু শালগাছ কেটে নিয়ে বৃদ্ধের মৃতদেহ সযত্নে তার সঙ্গে বেঁধে ফেলে। শালপাতা হাতে নিয়ে তার বুক আর মুখের শুকিয়ে যাওয়া রক্তটুকু মুছে নেয়। চোয়াড়ের দল স্তব্ধ হয়ে চেয়ে দেখে। চোখ তাদের চিক্‌চক্ করে ওঠে।

—বিজলী? রান্‌কো প্রশ্ন করে।

—ও এখানেই থাকবে সর্দার। এখানেই ওর সমাধি। যদি কোনোদিন সুসময় আসে—পাথর খোদাই করে অমর করে রেখে যাব ওকে। আর যদি সে সুযোগ না পাই, তবে বিস্মৃতির মধ্যে ডুবে যাবে ওর নাম, ওর মৃত্যুস্থান—এমনকি সতেরখানির একদিনের ইতিহাস।

ধারতি দু-চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে রাজার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। দুই রাজা যেখানে রাজ্য আক্রমণ করেছে, সেখানে এত তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ হওয়া সম্ভব নয়। একটি অমঙ্গলের আশঙ্কায় তার বুকের ভেতর কাঁপতে থাকে।

কিতাগড়ের ওপর থেকে সে চোয়াড়দের সঙ্গে ফিরতে দেখেছে রাজাকে। পায়ে হেঁটে আসছিল রাজা। বিজলী কোথায়? শত্রুদের বল্লমের খোঁজ বোধহয় সহ্য করতে পারেনি এই বয়সে। কিন্তু রাজার গায়ে তো কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। ঘোড়াকে মেরে ফেলে, রাজাকে ছেড়ে দিতে পারে না তারা। তবে কি পালিয়ে এল সতেরখানির রাজা ত্রিভন সিং ভূঁইয়া? চোখ তুলে সোজা দৃষ্টি ফেলে রাজার ওপর। সে মুখে তখনো কোনো কথা নেই। শুধু একটা ম্লান হাসি লেগে রয়েছে।

—বিজলী কোথায়?

—সে নেই। রেখে এলাম। ত্রিভনের চোখ ছলছল করে ওঠে।

—আর তুমি পালিয়ে এলে? চিৎকার করে ওঠে ধারতি।

—ধারতি!

রাজার আর্তনাদে স্তব্ধ হয় রাণী। দেখতে পায় এক অপরিসীম যন্ত্রণায় রাজার মুখ বিকৃত সে টলছে।

—কি হল তোমার? অমন করছ কেন?

কথা বলতে পারে না ত্রিভন। শুধু ইসারায়, জানায়, কিছুই হয়নি তার। ধারতি বিশ্বাস করে না। দুই হাতে জড়িয়ে ধরে ত্রিভনকে।

অনেকক্ষণ চলে যায়। জীবনের সব চাইতে বড় আঘাতকে সামলে নেয় ত্রিভন। ধারতি তাকে কাপুরুষ ভাবে, তাকে অবিশ্বাস করে। এর চাইতে বড় আঘাত আর কি হতে পারে পৃথিবীতে।

—আমি অন্যায় করেছি রাজা। ক্ষমা কর।

—ক্ষমার কথা ওঠে না রাণী।

—আমার মাথার ঠিক নেই। কেমন যেন হয়ে গিয়েছি।

—খুবই স্বাভাবিক। তাছাড়া অত যত্নে যুদ্ধের বেশে সাজিয়ে দিলে—দুদিনের মধ্যে ফিরে আসব না বলে নয়। আমি রাণী হলে আমারও মাথার ঠিক থাকত না।

—তুমি অমনভাবে বলছ কেন?

—লিপুর, এতদিন পরে তুমি আমাকে এইটুকু চিনলে?

চোখের জলের বাঁধ ভাঙে লিপুরের। রাজা চেয়ে থাকে শুধু। কোথায় যেন একটা বিরাট ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে—সে ফাটলকে আগের মতো করে তোলা খুবই দুঃসাদ্য ব্যাপার।

ধারতি একসময় ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। রাজার সামনে এসে তাকে প্রণাম করে বলে—বিদায় দাও বাঁশীওলা।

—কোথায় যাবে?

আঙুল তুলে ওপর দিকে দেখিয়ে দেয় ধারতি।

—আত্মহত্যা করবে তুমি?

—অন্য পথ আছে?

—আমি তো ক্ষমা করেছি তোমাকে।

—ক্ষমা পেয়ে বেঁচে থাকা যায় না। যতদিন ক্ষমার প্রশ্ন ওঠে না ততদিনই শুধু বাঁচা যায়। –শোন ধারতি, তুমি শুধু লিপুর নও, তুমি রাণীও। তাই একটা অবিশ্বাস মুহূর্তের জন্যে হলেও তোমার মনে স্থান পেয়েছিল। সেটা সত্যি নয়, শুধু একটা দুঃস্বপ্নের মতো। কালই এর প্রভাব হয়তো থাকবে না।

—থাকবে রাজা। যতদিন বাঁচব, ততদিন থাকবে।

—ভুল রাণী। কাঁটারাঞ্জার যে মেয়েটিকে আমি সমস্ত প্রাণ ঢেলে ভালোবাসি তার মন নিয়ে জিনিসটা ভাবতে চেষ্টা কর। তোমার ভুল বুঝতে পারবে। রাণীর মন নিয়ে ভেবো না।

—সে ভাবে না ভেবে তো পারছি না।

—তাই বা ভাবছ কই? তুমি জান, সময় ঘনিয়ে আসছে। অজগরের চাপে বিজলীর অপমৃত্যুই তার ইঙ্গিত দিচ্ছ। অম্বিকানগর আর শ্যামসুন্দরপুরের রাজারা দেশে ফিরে গেলেও, দুদিন পরে সব রাজা একসাথে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে তা তুমি জান। তখন? আমি তো আর ফিরব না। লালসিং-এর দায়িত্ব কে নেবে?

রাণীর চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ত্রিভনের কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে—ভুলে যাও বাঁশীওলা। কাঁটারাঞ্জার পাথরের ওপর বসে এমন কত অন্যায়ই তো করেছি। কই, আঘাত তো পাওনি কখনো। সতেরখানির রাণী আমি, কিন্তু তোমার তো লিপুরই। ত্রিভনের মনে হয় ফাটলটা এর মধ্যেই অনেকখানি জুড়ে গেল। রাণীকে বুকের কাছে টেনে নেয় সে।

.

সীমান্ত ছেড়ে রান্‌কো একদিন কিতাগড়ে ফিরে আসে। ত্রিভন বিস্মিত হয়। সর্দারহীন চোয়াড়দের একা ছেড়ে আসার মতো কি কারণ ঘটল? রান্‌কোর মুখের দিকে চেয়ে কোনো বিপদের আভাস পাওয়া যায় না। বরং প্রফুল্লই মনে হয় তাকে।

সারিমুর্মু একা এসে বসে এখন কিতাগড়ে। সব সময়ই বিষণ্ণ সে। নিজের ওপর বিরক্ত। এই বিরক্ত-ভাব বুধকিস্‌কু চলে যাবার পর থেকে বিতৃষ্ণায় পরিণত হয়েছে। রোজই রাজাকে সে একবার করে অনুরোধ করে কোনো একটা কাজ দেবার জন্যে। রাজা প্রতিবারই বলেছে তাকে যে তারা কাজ একেবারে শেষ সময়ে—কিতাগড় রক্ষার ভার। এ-কথায় সন্তুষ্ট হয়নি সারিমুর্মু। তার ধারণা রাজা তার ওপর নির্ভর করতে পারে না বলেই ওভাবে ভুলিয়ে রাখছে

রান্‌কোকে দেখে সারিমুর্মু আনন্দ চেপে রাখতে পারে না। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে—সর্দার।

—সর্দার। জবাব দেয় রান্‌কো।

—আমি সর্দার নই। আমি ফালতু। মুমুসর্দারের চোখ ছলছল করে ওঠে।

—তুমিই সর্দার। কিতাগড়ের আসল সর্দার।

একটু সন্তুষ্ট হয় যেন সারিমুর্মু। রান্‌কোর চোখে বা কথার কৃত্রিমতার চিহ্ন নেই। সে আবেগের সঙ্গেই কথাগুলো বলে।

—হাতে ওটা কি? সারিমুর্মু প্রশ্ন করে রান্‌কোর হাতের থলির দিকে চেয়ে।

—এই জন্যেই তো আসতে হল। রান্‌কো রাজার সামনে এগিয়ে গিয়ে সন্তর্পণে থলিটা নামায়। শব্দ হয়।

—টাকা? ত্রিভন প্রশ্ন করে।

—হাঁ রাজা।

—কোথায় পেলে?

—সুখনিদি।

—তার মানে?

—ত্রিভন আর সারিমুর্মু একসাথে চমকে ওঠে। বুধকিস্‌কু কি তবে মৃত?

—সর্দার বুধকিস্‌কুর কোনো বিপদ হয়নি রাজা!

—সে কোথায়?

—সীমান্তে।

—তাকে রেখে তুমি চলে এলে?

—কিছুতেই এলো না। হাতে পায়েও ধরেছি। বলল, নাঃ, এখানেই থাকব। যদি ভাগ্যে থাকে এখানেই মরব।

—হঠাৎ এ পরিবর্তন কেন?

—মনে হয় অম্বিকানগর আর শ্যামসুন্দরপুরের প্রতি ঘরে বাঘরায় সোরেণের নাম শুনেছে। আমরা কিছুই খবর রাখি না রাজা, কিন্তু বাঘরায় সোরেণ ও-সব অঞ্চলে বিখ্যাত।

সারিমুর্মুর বুক দুলে ওঠে। কেন যেন তার চোখ ঝাপসা হয়। ছুট্‌কীর কথা মনে পড়ে হতভাগী—সত্যিই হতভাগী।

সুখনিদির টাকা গুণে দেখার সময় কিছুক্ষণের জন্যে বিমর্ষতা ত্রিভনের মনকে আচ্ছন্ন করে। কত অত্যাচার সয়েই না টাকাগুলো দিতে হয়েছিল সাধারণ লোকদের। কিন্তু উপায় কি? সতেরখানির লোকেরাও আনন্দে নেই। অনেক দুঃখ, অনেক যন্ত্রণা তারা সহ্য করছে দিনের পর দিন। তাদের জন্যেই এই সুখনিদির একান্ত প্রয়োজন। দীর্ঘদিন ধরে কত পুরুষ বাইরে রয়েছে, তাদের পরিবারের ভার রাজাকেই নিতে হবে।

—বুধসর্দারের সব লোক ফিরেছে?

—দুজন ফেরেনি। বড় বেশী লোভে পড়েছিল তারা।

—হুঁ। অস্বাভাবিক নয়। মানুষ তারা।

.

কিতাগড় থেকে বিদায় নিয়ে রান্‌কো নিজের কুটিরের দিকে রওনা হয়। অনেকদিন অযত্নে পড়ে রয়েছে সর্দার পারাউ মুর্মুর বাস্তুভিটে। যে কয়দিন বাটালুকায় থাকবে সংস্কার করবে সে। কিন্তু আবার তো যেতে হবে। শিগগিরই ডাক আসবে। সুখনিদির খবর বরাহভূমে পৌঁছতে বেশী দেরি লাগবে না। এবারে তরফের সবাইকেই হাতিয়ার ধরতে হবে। সালহাই হাঁসদাও বোধ হয় বাদ পড়বে না!

রান্‌কো একসময়ে দেখে নিজের অজান্তে সালহাই হাঁসদার বাড়ীর কাছাকাছি এসে পড়েছে। ঝাঁপনীর চিন্তা অবচেতন মনে কাজ করে চলেছিল একথা আগে বোঝেনি। কিন্তু বাড়ীর ভেতরে গিয়ে তো ঢুকতে পারে না। ঝাঁপনী বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে এমন আশা করাও বৃথা

কয়েকটি ছেলেমেয়ে খেলা করছিল শূয়োরের পালের পাশে। ঝাঁপনীর ছেলেমেয়ে। কতগুলো হয়েছে কে জানে। বোধ হয় প্রতি বছরই হয়েছে। কত বছর বিয়ে হয়েছে যেন? ত্রিভন সিং যতদিন রাজা হয়েছেন। কিতাডুংরিতে ঝাঁপনী আর তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণই রাজার জীবনের প্রথম বিচার।

ছেলেমেয়েগুলোর একটা হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ীর ভেতর থেকে সালহাইএর হুঙ্কার শোনা যায়। বাচ্চাটা তবু কেঁদে চলে। রান্‌কো তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দেয়। এবারে সালহাই আসবে নিশ্চয়, এসে বাচ্চাগুলোকে ঠেঙাতে সুরু করবে।

কিন্তু না, সালহাই নয়। পেছনে ফিরে রান্‌কো চেয়ে দেখে ঝাঁপনীই এসেছে, কাঁদুনে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়েছে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে রান্‌কো। ঝাঁপনী দেখুক তাকে! কিন্তু তাকায় না ঝাঁপনী বাচ্চাটির চোখ মুছিয়ে দিতে ব্যস্ত। ধমক দেয় অন্যগুলোকে। শেষে বাড়ীর ভেতরে চলে যায়। দীর্ঘশ্বাস বার হয় রান্‌কোর বুক ভেঙে। চলতে শুরু করে সে। অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হবে তাকে।

.

নিজের কুটিরের সামনে এসে অবাক হয় রান্‌কো। এমন সুন্দরভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রেখেছে কে? রাজা কি অন্য কাউকে ব্যবহার করতে দিয়েছেন তার অনুপস্থিতে! তাহলে তো তিনি জানিয়ে দিতেন খবরটা। তবে বোধহয় শুকোলরা দেখাশোনা করে। শত হলেও পারাউ সর্দারের ভিটে—সতেরখানিকে তীর্থস্থান। তার ওপর আবার রাণীর জন্মস্থান এটা।

উঠোনে এসে দাঁড়ায় রান্‌কো। ঝক্‌ঝক্ করছে সমস্ত উঠোন—দাওয়া—দেয়াল। কালই যেন গোবর দিয়ে লেপে রেখে গিয়েছে। মনে মনে লজ্জিত হয় রান্‌কো। সে এখানে থেকেও এমন নিখুঁতভাবে রাখতে পারে না। না থাকাই ভালো তার। পারাউমুর্মুর স্মৃতিটুকু দীর্ঘদিন স্থায়ী হবে।

দাওয়ার ওপর উঠে শুয়ে পড়ে রান্‌কো। বড় ক্লান্ত। সীমান্তের দিবারাত্রির সজাগ প্রহরী ছিল সে অন্য চোয়াড়দের পালা করে বিশ্রামের সুযোগ দিলেও, নিজের জন্যে সে বিশ্রামের অবসর খুব কমই খুঁজে পেয়েছে। অতবড় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে অবসর পাওয়া সম্ভব নয়।

ঘুমিয়ে পড়ে রান্‌কো। ঝাঁপনীর কথা ভাববারও অবসর দেয় না মস্তিষ্ক

সে ওঠে বেলা গড়িয়ে গেলে। হয়তো আরও ঘুমোতো—রাত্রি এসে ভোরও হয়ে যেতে পারত। কিন্তু প্রচণ্ড তৃষ্ণায় ঘুম যায় ভেঙে। গলা শুকিয়ে উঠেছে।

কলসি নিয়ে এখন ঝর্ণার যেতে হবে। একথা মনে করতেই অবসাদ অনুভব করে আবার। খাবারেরও ব্যবস্থা করতে হবে একটা কিছু। খাবার না হলে তবু কাটাতে পারবে। কিন্তু জল তার চাই—ই।

দাওয়ার একপাশে মাটি দিয়ে তৈরী উঁচু জায়গাটায় কলসি রয়েছে। ওখানেই থাকে বরাবর। পারাউমুর্মুর আমল থেকে। সে কাছে গিয়ে হাত দিয়ে দেখে, কানায় কানায় ভর্তি কলসী। অবাক হয় একটু। ভেবে পায় না এইরকম জল-ভরে রেখে গিয়েছিল কি না। নিশ্চয়ই তাই। শুকোলরা বাড়ী পরিষ্কার রাখতে পারে, কিন্তু কলসীতে জল তুলে রেখে দেবে না। এতদিনের জল খাওয়া যায় না ভেবে, সে দুহাত দিয়ে তুলে দাওয়ার ওপর নিয়ে আসে কলসীটাকে। উপুড় করে জলটুকু ফেলে দিতে গিয়ে বাধা পায়।

ঝাঁপনী দাঁড়িয়ে রয়েছে উঠোনের মাঝখানে—পাথরের মূর্তির মতো

—ঝাঁপনী!

—তুমি!

কলসি ছেড়ে রান্‌কো দুহাত বাড়িয়ে দেয়। ছুটে এসে ঝাঁপনী আছড়ে পড়ে তার বুকের ওপর।

—জানতে না? অনেকক্ষণ পরে রান্‌কো প্রশ্ন করে।

—না।

—তবে কেন এলে।

—আসি তো।

—রোজ?

—প্রায়ই। জল ফেলছ কেন? কালই ভরে রেখে গিয়েছি।

অবাক হয় রান্‌কো। ঝাঁপনীর মুখখানাকে তুলে ধরে চেয়ে থাকে তার চোখের দিকে। চোখ বন্ধ করে ঝাঁপনী।

রান্‌কো অনুভব করে অনেক রোগা হয়ে গিয়েছে ঝাঁপনী। কিতাডুংরির নাচের সময়ের কথা ছেড়ে দিলেও, ধলভূম থেকে ফিরে আসার পরেও অদম্য-স্বাস্থ্যের বেয়াড়াপনা অনুভব করত ঝাঁপনীকে জড়িয়ে ধরলে। সে স্বাস্থ্য আর নেই। তার দুহাতের মধ্যে কেমন যেন গলে পড়েছে। শরীরের মাংস ঢিলে। চাপ দিলে হাড়ে ব্যথা লাগবে।

চাপ দেয় না রান্‌কো। আলগোছে ধরে রাখে। ছেড়ে দিলে পড়ে যাবে ঝাঁপনী। মনে হয় ঘুমোচ্ছে। দিনে রাতে বাচ্চাগুলোর আর সালহাই এর জন্যে বিশ্রাম পায় না। চোখের কোলের গভীর কালো রেখাই তার প্রমাণ, নাকের পাশ দিয়ে হাসির ভাঁজটা কেমন যেন কান্নার ভাঁজের মতো দেখায়। নিজের গালের সঙ্গে তার গালটা চেপে ধরে রান্‌কো।

—আর পারি না। ঝাঁপনীর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

সান্ত্বনা দিতে পারে না রান্‌কো।

—রাজা এমন বিচার কেন করলেন।

—আমরা মানুষ বলে।

—এবার থেকে ফিরে এসে আমাকে খবর দিও। রোজ রোজ আসতে পারি না। শুকোলরা দেখেছে।

সন্ধ্যা হয়। কাঁটারাঞ্জার ফেউ ডেকে ওঠে। ঝাঁপনীর হাত ধরে রান্‌কো পথে নামে। নিরাপদে পৌঁছে দিতে হবে তাকে।

—কাঠ নেওয়া হল না। বকবে ও।

—বলবে, বেঁধে রেখে এসেছ। ভারী বলে আনতে পারনি।

—ও যদি নিজে আনতে চায় কালকে?

—তবে বলো, পেটে ব্যথা বলে আনতে পারনি আজ।

ঝাঁপনী হাসে। রান্‌কোও হাসে।

—আজ আমাকে দেখতেই পেলে না। রান্‌কো বলে।

—কখন?

—ঘরে ফেরার আগে তোমার বাড়ীর দিকে গিয়েছিলাম।

—সত্যি? আমি কি করছিলাম!

—বাচ্চাটার কান্না থামাচ্ছিলে।

ঝাঁপনী লজ্জা পায়। ধীরে ধীরে বলে,—তুমি তোমার ঝাঁপনীকে দেখোনি তখন। সালহাই হাঁসদার বউকে দেখেছিলে।

রান্‌কোর বুকে সূচ বেঁধে।

.

রান্‌কোর বিশ্রামলাভের সুযোগ মিলল না বেশীদিন। ত্রিভনেরও নয়। সমস্ত সতেরখানি তরফের প্রতিটি চোয়াড়ের বিশ্রামের সুযোগ নষ্ট হল। চোয়াড় ছাড়াও সাধারণ পুরুষদেরও ঢাউরা শুনে এসে দাঁড়াতে হল কিতাগড়ের সামনের মাঠে।

একটি মাত্র দুঃসংবাদের জন্যে এতখানি ওলট পালট ঘটে গেল খাঁড়ে পাথরের বংশধর ত্রিভন সিং ভুঁইয়ার সতেরখানি তরফে।

সর্দার বাঘরায় সোরেণ মৃত।

বীরের মতো যুদ্ধ করতে করতে নিহত হয়নি বাঘরায়। মৃত্যু এসেছে ধীরে ধীরে এক পা এক পা করে। ঠিক বাটালুকায় নিজের কুটিরে ছুটকীর পাতা শয্যায় শুয়ে যে ভাবে মৃত্যুর কল্পনা করত সে একসময়ে। পার্থক্যের মধ্যে কুটিরের চালের পরিবর্তে ওপরে ছিল উন্মুক্ত আকাশ। আর ছুট্‌কীর অশ্রুসিক্ত মুখের বদলে চোয়াড়দের ঝুঁকে পড়া মুখের অবাধ জলরাশি। শিশুর মতোই কেঁদেছিল চোয়াড়রা। বাঘরায়ের শেষ সময়ে। রাজাকেও তারা এমনভাবে ভালোবাসতে পারেনি। সর্দারকে ভালোবেসে নিজেদের ঘর সংসার ভুলতে বসেছিল তারা।

অসুখে ভুগে মৃত্যু হল বাঘরায়ের। অসুখ নিয়েই দিনের পর দিন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল সে বরাহভূম-রাজকে। শেষে স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ল। খড়ের বিছানায় আশ্রয় নিয়ে শেষ দিনের জন্যে অপেক্ষা করতে হল তাকে।

রাজা কাঁদল, রাণী কাঁদল, রান্‌কো কাঁদল। কিন্তু সারিমুর্মুর চোখে জল দেখা গেল না। সোজা কিতাগড়ে এসে বুক ফুলিয়ে বলল—এবারে কাজের ভার দিন রাজা।

—কি কাজ?

—বাঘরায়ের কাজ—আমার ছেলের ফেলে রাখা কাজ।

—বড় দেরি হয়ে গিয়েছে সর্দার।

—কেন রাজা?

—বরাহভূমে আর কোনোদিনও যেতে পারবে না চোয়াড়রা। বাঘরায়ের মৃত্যুতে পথ পরিষ্কার হয়েছে বরাহভূমের রাজার। তিনি এগিয়ে আসছেন—দল বেঁধে এগিয়ে আসছেন।

—এখনো আমাকে ভুলোতে চেষ্টা করছেন রাজা? আমি কি এতই অপদার্থ? সারিমুর্মু উন্মত্তের মতো চেঁচিয়ে ওঠে। তার বার্ধক্যের শিরা-ওঠা হাত থরথর করে কাঁপে।

—মিথ্যা বলছি না সর্দার। মিথ্যা বলার সময় নেই। সংবাদ পেয়েছি আমি। ধলভূম, সুপুর আর বরাহভূম-প্রস্তুত তারা। অম্বিকানগর আর শ্যামসুন্দরপুর পথে যোগ দেবে।

—তবে আমি কি করব? আমার কি কোনো কাজ নেই?

—যে কাজের জন্যে রেখেছি তোমাকে, সেই কাজই করবে। সে-দিন খুবই কাছে। হ্যাঁ, এখন আমি স্পষ্ট করেই বলতে পারি সে-দিনের আর দেরি নেই।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *