কিতাগড় – ১

কিতাগড়ের আবহাওয়া থমথমে।

রাজা হেমৎ সিং ভুঁইয়ার অবস্থা সংকটজনক।

গড়ের যে-প্রকোষ্ঠে শুয়ে রয়েছেন তিনি, তারই দরজায় সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান সতেরখানি তরফের চার-সর্দার। প্রিয় রাজার জন্যে তারা উদ্বেগাকুল।

ঘরের মধ্যে রাজা ছাড়া রয়েছেন মাত্র দুটি প্রাণী। শয্যার ওপর উপবিষ্ট তাঁর স্ত্রী—সতেরখানি তরফের রাণী। আর রয়েছেন বৃদ্ধ বৈদ্য রাজু পাঁওলিয়া। সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী তিনি—সবাই জানে সেকথা। তিনি যদি অভয় দেন, চোয়ার-সর্দাররা নিশ্চিন্ত মনে ফিরে যেতে পারে আপন আপন কাজে। কিন্তু উঁকি দিয়ে দেখেছে তারা, তাঁর মুখও গম্ভীর-বিষণ্ন। রাণী সে মুখের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রয়েছেন। তাতে আশ্বাসের কোনো চিহ্ন খুঁজে না পেয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছেন। সর্দারদের চওড়া বুক কয়টি কেঁপে উঠছে কান্নার আওয়াজ শুনে।

তবু ক্ষীণ আশা রয়েছে এখনো। রাজু পাঁওলিয়া তাঁর মুখ খোলেননি। কোনোরকম মন্তব্য এ-পর্যন্ত করেননি তিনি। কান্নার মধ্যেও রাণীর দৃষ্টি তাই নিষ্পলক। সর্দাররাও তাই বাইরে দাঁড়িয়ে এখনো।

বৈদ্য যদি শুধু বলেন,—চেষ্টা করব, তাহলেও বুকে পাওয়া যায় অসীম বল। এই কথাটুকু, শুনলেও রাণীর মুখে হাসি দেখা দেবে।

বাইরে সূর্য ডুবছে। কিছুক্ষণ পরেই শ্রীশ্রীকালাচাঁদ জিউর মন্দিরের ঘণ্টা বেজে উঠবে কিশোর পুরোহিতের বলিষ্ঠ হাতে। বৃদ্ধ পুরোহিত নরহরি বাবাজী বরাহভূমের রাজদরবারে গিয়েছেন পনের দিন আগে। মন্দিরের পুজোর ভার তাই গোবিন্দের ওপর। সুষ্ঠুভাবে সে-কাজ করে চলেছে গোবিন্দ।

পাশেই কিতাডুংরি পাহাড়ের ওপর কিতাপাটের পীঠস্থান। সেখান থেকে ভেসে আসছে ‘টামাক’ আর ‘পেপড়েৎ’-এর আওয়াজ। সেখানেও পুজো হয় প্রতিদিন। শ্রাবণে সেখানে হয় উৎসব। রাজা নিজে গিয়ে পুজো দেন সেদিন।

সর্দাররা ভাবে, কালও এমনি সূর্য ডুববে—মন্দিরে মন্দিরে ঘণ্টা বেজে উঠবে—সবই হবে। অথচ তাদের প্রিয় রাজা হয়তো থাকবেন না তাদের মধ্যে। ভাবতে গিয়ে তারা চমকে ওঠে। এ যে অকল্পনীয়। কে নেবে তাদের ভার—সমস্ত সতেরখানি তরফের ভার? ত্রিভনসিং? সে তো বলতে গেলে কিশোর। তাছাড়া রাজোচিত কোনো গুণও এ পর্যস্ত তার মধ্যে দেখতে পায়নি কেউ। সে কেবল বাঁশী বাজায়। দৃঢ়হস্তে সমস্যাসংকুল এই তরফকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলার ক্ষমতা তার নেই।

সর্দারদের চিন্তাধারা একই খাদে প্রবাহিত হচ্ছিল। তাই একই সময়ে সবাই পরস্পরের মুখের দিকে চায়। সে মুখে নেই কোনো আশার আলো।

ঘরের ভেতরে শব্দ হয়।

বৈদ্য রাজু পাঁওলিয়া পালংক থেকে নেমেছেন। সর্দাররা নড়েচড়ে ওঠে।

দরজার দিকে এগিয়ে আসেন বৈদ্য। রাণী তাঁর পেছনে পেছনে পাগলের মতো দুচার পা ছুটে আসেন। শেষে ভূলুণ্ঠিত হন। জবাব পেয়ে গিয়েছেন তিনি। বৈদ্যের স্তব্ধ মুখের প্রতিটি রেখায় লেখা রয়েছে সেই নিষ্করুণ জবাব।

চোয়াড় সর্দারেরা চঞ্চল হয়ে ওঠে। সর্দার সারিমুর্মু এগিয়ে যায় বৈদ্যের দিকে।

রাজু পাঁওলিয়া কিছুক্ষণ স্থিরভাবে চেয়ে থাকেন সারিমুর্মুর মুখের দিকে। শেষে ধীরে ধীরে স্পষ্ট উচ্চারণ করেন,—অহই বাঞ্চাওলেনা।

কেঁপে ওঠে সবাই। জানত তারা। তবু এমন নির্মমভাবে শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিল না কেউ। মাথায় করাঘাত করে তারা। সর্দার ডুইঃ টুডু কেঁদে ফেলে। সতেরখানি তরফের বলিষ্ঠতম কালো কুচকুচে চারটে বুক হাপরের মতো ওঠানামা করে। বাঘের সঙ্গে লড়াই-করা বুকে অনুভব করে শিশুর অসহায়তা। অজগর সাপের গলা-টিপে-ধরা পেশীবহুল হাতগুলো শরীরের দুপাশে ঝুলে পড়ে নিঃশ্বাস-রুদ্ধ মৃত অজগরের মতো।

বহুক্ষণ শব্দ হয় না কোনো, হৃদ্‌স্পন্দনও যেন থেমে গিয়েছে সবার। শেষে সর্দার বুধকিস্‌কু অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,—মারাংবুরু।

সবারই মনে হয়েছে সেকথা। মারাংবুরু। কিন্তু বলতে সাহস পায়নি কেউ। বুধকিস্‌কু। বলেছে বটে, তবে কেমন ভাঙা ভাঙা। কাউকে শোনাবার উদ্দেশ্যে বলেনি সে। নিজের ভারাক্রান্ত মনের চিন্তা সহসা কথায় রূপ পেয়েছে মাত্র। বলে ফেলেই সে ভয় পেয়ে যায়।

সবাই শুনল। মারাংবুরু। চোখে চোখে চকিতে দৃষ্টি বিনিময় হল। সবগুলি চোখেই সমর্থন। সাহস পেয়ে সারিমুর্মু বলে,—মারাংবুরুর অভিশাপ।

চোয়াড় সর্দাররা চঞ্চল হয়। তাদের খোদাই করা হাতগুলো বুকের ওপর ভাঁজ হয়ে পড়ে। ভয়ংকর দেবতা মারাংবুরু। খাঁড়ি পাহাড়িতে আস্তানা তাঁর। তাঁকে ভয় না করে, সমীহ না করে উপায় নেই।

রাজা হেমৎসিংও তাঁকে অবহেলা করেননি কখনো। তবু গতকাল তিনি হঠাৎ ভুল করে বসলেন।

খাঁড়ি পাহাড়ির ওপরে মন্দির প্রতিষ্ঠার বাসনা হয়েছিল তাঁর। ভূঁইয়া বংশের প্রথম রাজা খাঁড়ে পাথরের নামে এই পাহাড়। তাই রাজার বাসনা অস্বাভাবিক নয়। পাহাড়ের ওপরে স্থান নির্বাচনের জন্যে সর্দারদেরও সঙ্গে নিলেন তিনি। যাবার পথে মারাংবুরুর আস্তানা। সেখানে রক্তস্রোত দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন রাজা। অসংখ্য কুকুর বলি দেওয়া হয়েছে দেবতার সন্তুষ্টির জন্যে। চঞ্চল হয়ে ওঠেন রাজা। অথচ এ-সমস্ত তাঁর অজানা নয়। দিকুরা প্রায়ই এসে এমন বলি দিয়ে যায়। আগে তিনি নিজেও দাঁড়িয়ে থেকে কতবার এসব দেখেছেন। কিন্তু কিছুদিন থেকে তাঁর ভেতরে একটা পরিবর্তন দেখা দিচ্ছিল, রক্ত সহ্য করতে পারছিলেন না। মাংস খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছিলেন।

সর্দাররা জানত, সবই নরহরি বাবাজীর প্রভাব। ভালো লাগেনি তাদের। রাজা বৈষ্ণব আছেন—থাকুন! কিন্তু বাড়াবাড়ি হলে রাজ্য চালানো মুশকিল। নদের মানুষ নরহরি বাবাজী শাকপাতা খেয়েও জীবন কাটাতে পারেন। কিন্তু জঙ্গল মহলে এক তরফের রাজা হয়ে হেমৎ সিং ভুঁইয়ার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তাতে তরফেরই অমঙ্গল ডেকে আনে।

মুখে অবশ্য তারা কিছুই বলেনি। রাজাকে তারা ভালোবাসে। রাজা যে তাদের প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন।

স্কন্ধচ্যুত কুকুরের দেহগুলো অতিক্রম করে রাজা পূজারীর সামনে গিয়ে বলেছিলেন—অনর্থক এত রক্তপাত কেন?

—অনর্থক? এই তো সার্থক। ফুল দিয়ে পুজো হয় গঙ্গার পলিমাটিতে, জঙ্গল মহলের পাথুরে মাটির ওপর নয়। এখানে ফুল রাখার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তাপে কুঁকড়ে শুকিয়ে যাবে। তাই রক্তের প্রয়োজন।

রাজার চোখ দুটো নিমেষের তরে জ্বলে উঠেছিল। এমন উদ্ধত জবাব তিনি প্রত্যাশা করেননি। তিনি জানতেন না যে মারাংবুরুর পূজারী মঙ্গল হেম্বরম্ বহুদিন থেকেই চটে আছেন তাঁর ওপর, আর তাঁর কুলদেবতা কালাচাঁদ জিউর ওপর।

—তবু আমি বলছি এই রক্তপাত যাতে কম হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন।

—সম্ভব নয়। মারাংবুরু স্বপ্নে কাকে কি আদেশ দেন, আমি তা কি করে জানব? রক্তের তৃষ্ণা যদি জাগে তাঁর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তা ঠেকাতে পারবে না।

—তাহলে আমাকেই হস্তক্ষেপ করতে হবে।

—আপনি? বন্ধ করবেন?

—হ্যাঁ।

ঠিক সেই সময় বিকট শব্দে একটা কুকুর ডেকে ওঠে মারাংবুরুর গুহার ভেতর থেকে

—শুনলেন? ও চেষ্টা করবেন না। সর্বনাশ হবে আপনার। মঙ্গল হেম্বরম্ হো হো করে হেসে ওঠে! রাজার হুকুম যেন ছেলেমানুষের আবদার।

—হোক্ বলি বন্ধ করতেই হবে।

—চেষ্টা করুন। হেম্বরমের কথায় বিদ্রূপের খোঁচা।

রাজা খাঁড়ি পাহাড়িতে ওঠেন। সর্দারদের বুক ধক্ করছিল। সাংঘাতিক লোক এই মঙ্গল হেম্বরম্। রাজা তাঁকে এমনভাবে না বললেই ভালো করতেন। অনেক দিকু এই পূজারীকেই সাক্ষাৎ মারাংবুরু বলে ভাবে। বলির সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে তিনি কুকুরের রক্ত পান করেন তাতে না ভেবে উপায়ও নেই। আগুনে সেদ্ধ কুকুরের মাংস সবাই খায়। কিন্তু কাঁচা মাংস চামড়া সমেত কামড়ে ধরার কথা ভাবা যায় না। পূজারী আর এই দেবতার পক্ষেই তা সম্ভব।

এই সব অমঙ্গল চিন্তায় সর্দারদের বুক যখন কাঁপছিল, ঠিক তখনি ঘটল দুর্ঘটনা। পাহাড়ে ওঠার পথে একটা বড় পাথর গড়িয়ে পড়ল রাজার মাথার ওপর। মুখ থুবড়ে পড়ে যান তিনি। ধরাধরি করে তাঁকে কিতাগড়ে নিয়ে এল সর্দাররা। সেই থেকে তিনি অজ্ঞান।

.

রাজ পাঁওলিয়া শেষ জবাব দিয়ে গেলেন—অহই বাঞ্চাওলেনা—রাজা বাঁচবেন না।

রাণী ভূলুণ্ঠিত—অচৈতন্য। শয্যার ওপরে রাজা শায়িত।

সারিমুর্মু ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ঘরের ভেতরে। পেছনে যায় বুধকিস্‌কু, ডুইঃ টুডু আর বাঘরায় সোরেণ। এ-সময়ে লজ্জা সরমের কথা ভাবতে গেলে চলে না। রাণীর মর্যাদার অবমাননা তারা করছে না। শেষ সময়ে রাজার পাশে দাঁড়াতেই হবে তরপের সর্দারদের সেটাই নিয়ম। হেমৎ সিং-এর শিয়রের কাছে এসে দাঁড়ায় তারা। প্রদীপ নিভু নিভু তবু যদি শেষ মুহূর্তে একবার দপ্ করে জ্বলে ওঠে। অন্তিম বাসনা যদি কিছু থেকে থাকে রাজার

ত্রিভন কোথায়? যুবরাজ ত্রিভন সিং? এতক্ষণে সর্দারদের মনে পড়ে যায় তার কথা। এই সময়েও কি সে বসে রয়েছে কোনো শালবনের নীচে অথবা নির্জন কোনো ঝরণার ধারে! এখনো কি সে তন্ময় হয়ে বাঁশী বাজিয়ে চলেছে? বাবার এ-অবস্থা দেখেও কেমন করে অনুপস্থিত থাকতে পারে সে, ভেবে পায় না কেউ। বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে অতগুলো মতো –সতেরখানি তরফের মাথা। চিন্তায় কপাল কুঁচকে ওঠে তাদের।

অন্য তিন তরফ সতেরখানিকে এবারে অনেক পেছনে ফেলে যাবে। এগিয়ে যাবে পঞ্চ সর্দারী—তিনসওয়া—ধাদকা। বরাহভূমের রাজদরবার থেকে সতেরখানির রাজার কাছে আসবে না আর মর্যাদার আমন্ত্রণ। বিপদের সময়ে এ-রাজ্যের গুরুত্ব আর বুঝবেন না বরাহভূমের মহারাজা। পঞ্চ খুঁটের সভার এক খুঁট অনাদৃতই থেকে যাবে। জঙ্গল মহলের ভাগ্যবিধাতা এবার থেকে এক খুঁটকে বাদ দিয়ে চার খুঁট। রাজধানী বাটালুকা গ্রাম এখন থেকে শালবনের অন্ধকারে পচে পচে মরবে। মরবে কিতাগড়—আর প্রজারা। সতেরখানির রাজার হাতে আর শোভা পাবে না তারওয়াড়ী—কাপি—আঃ—ফিরি। বাঁশী—বাঁশী থাকবে রাজার হাতে। কর্মের অভাবে প্রজাদের পেশী যাবে ঢিলে হয়ে। উদ্দীপনা আর বীরত্বের অভাবে তাদের বুক যাবে ধ্বসে। বহিঃশত্রুর আক্রমণে পাহাড়ে পাহাড়ে আগুন জ্বলবে—আর রাজা বাঁশী বাজিয়ে পাখীদের মন ভোলাবেন। চার সর্দার মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে- বাঁশীওয়ালাকে রাজা করবে না তারা।

.

প্রদীপ সত্যিই জ্বলে উঠল শেষ বারের মতো। সর্দাররা এক সাথে ঝুঁকে পড়ে শয্যার ওপর। রাজা চোখ মেলেন। কাকে যেন খোঁজেন তিনি।

রাণীর তখনো মূর্ছা ভাঙেনি।

—কাকে চান রাজ? আমরা সবাই আছি। কিছু বলবেন? ডুইঃ টুডুর গলার স্বর কেঁপে ওঠে। সে-স সর্বকনিষ্ঠ সর্দার। বাঘরায় সোরেন তার চেয়ে সামান্য বড়।

—ত্রিভু—। রাজা অনেক কষ্টে উচ্চারণ করেন।

সর্দাররা চুপ।

—নেই? বাঁশী বাজায়? রাজার মুখের ওপর অপূর্ব স্নেহের হাসি চকিতে খেলে গিয়ে আবার মিলিয়ে যায়।

—যুবরাজ ছেলেমানুষ রাজা। সর্দাররা সাহস পায় রাজার হাসি দেখে।

একটু চুপ করে থাকেন রাজা। বোঝা যায় শক্তি সঞ্চয় করছেন তিনি। শেষে বলেন—ওকেই রাজা করবে?

—আপনার হুকুম! সর্দারদের প্রতিজ্ঞা যেন দুলে ওঠে এর মধ্যেই

—না। তোমাদের পছন্দ। রাজার ছেলে হলেই রাজা হওয়া যায় না।

যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে থেমে যান রাজা। চোখ বন্ধ করেন তিনি।

প্রদীপ বোধ হয় এবারে নিভবে। সর্দাররা নির্বাক। নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তারা। রাণীর দেহ তখনও নিশ্চল।

কালাচাঁদ জিউএর মন্দিরের ঘণ্টা এইমাত্র থামল। সমস্ত বাটালুকা গ্রাম জুড়ে নেমে এসেছে অন্ধকার। শালবনের ছায়ায় সে অন্ধকার আরও গাঢ়-আরও ভয়ংকর। সেই অন্ধকারকে সামান্য আলোকিত করে তুলতে অসংখ্য বাক্‌জনু ব্যর্থ প্রয়াসে ঘুরে ঘুরে মরছে। ঘরের ভেতরে বাতি এনে রেখে যায় একজন দাসী। সেই আলোতে চার সর্দারের দীর্ঘ ছায়া পড়ে পেছনের দেয়ালে।

রাজা আবার চোখ মেলেন। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তাঁর। তবু কি যেন বলতে চান।

—আপনি কথা বলবেন না রাজা। কষ্ট হবে। সারিমুর্মু বলে।

—একটু। ত্রিভুকে গড়ে তোলো। ঠকবে না।

—আমরা জানি রাজা। আপনার রক্ত তার শরীরে। তাই হবে—তাই হবে। বুকি ব্যস্ত হয়ে বলে।

—সব শরীরেই এক রক্ত বুধ। মানুষের রক্ত।

—এবারে চুপ করুন রাজা। বাঘরায় সোরেণ এতক্ষণে মুখ খোলে। সে সভয়ে চেয়ে দেখে রাজার মাথার একপাশ দিয়ে নতুন রক্ত গড়িয়ে পড়ছে—তাজা টাটকা রক্ত। মারাংবুরুর ঠাঁই-এর দৃশ্য তার মনে পড়ে। এমন রক্ত সেখানে দেখেছিল সে।

.

সুবর্ণরেখা নদীর তীরে দাহকার্য সমাপ্ত হল। ত্রিভনসিংহ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে তারই অতি পরিচিত মানুষটি ধীরে ধীরে কেমন ভস্মীভূত হয়ে যায়। তার একমাত্র বন্ধু আর পৃথিবীতে নেই। তার একাকীত্বের একমাত্র সাথী ছিলেন রাজা হেমৎ সিং। পুত্রের মন একা তিনিই চিনতেন। আর সবাই তার বিরুদ্ধে—পছন্দ করে না কেউ। এমন কি তার নিজের মাকেও ফেলা যায় সে দলে। নিজের ছেলেকে কখনো কাছে ডাকেননি তিনি—কোনোদিন দুটো মিষ্টি কথাও বলেননি ভুলে। শুধু ধর্ম—নরহরি দাস আর কালাচাঁদ জিউ। পৃথিবীর সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নেই তাঁর। শেষের দিকে অবশ্য রাজাকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলেন। কারণ রাজাও তাঁরই মতো খাঁটি বৈষ্ণব হয়ে উঠেছিলেন। মায়ের কথা ভেবে চোখে জল আসে ত্রিভনের। অন্যের মায়েদেরও তো সে দেখে।

সর্দারদের মনেও স্থান নেই ত্রিভনের। তারা বলে সে নাকি ভূঁইয়া বংশের কলঙ্ক। তারা চায় তাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সে-ও শিকার করুক, তীর ধনুক ছুঁড়ুক। বনে জঙ্গলে সে ঘোরে, সর্দারদের চেয়ে বেশীই ঘোরে। তবে একা একা। আর তীর ধনুকে সে যে কতখানি সিদ্ধহস্ত সে খবর রাখতেন শুধু তার বাবা। কিতাডুংরি পাহাড়ে কিতাপাটের মন্দিরের পাশে দাঁড়িয়ে রাজা হেমৎ সিং-এর কাছে বহুবার সে পরীক্ষা দিয়েছে। প্রতিবারই বিস্মিত হয়েছেন রাজা পুত্রের অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ দেখে। তাই ত্রিভন পাগলের মতো বাঁশী নিয়ে ঘুরে বেড়ালেও তিনি বলতেন না কিছু। হাসতেন।

.

চিতাভস্ম থেকে রাজার অস্থি সংগ্রহ করে অনুষ্ঠান সহকারে রাখা হয় রাজ পরিবারের অস্থিশালায়। বিরাট এক পাথর চাপানো হয় তার ওপর। সতেরখানি তরফের প্রথম রাজা খাঁড়ে পাথর, তৎপুত্র যুঝার সিং ভূঁইয়া—তাঁরই পাথরের পাশে রাখা হল হেমৎ সিং ভুঁইয়ার অস্থি। ত্রিভন মনে মনে ভাবে, যদি কোনোরকম অঘটন না ঘটে তবে এরপর স্থান পাবে তারই অস্থি। পিতার সমাধির দিকে চেয়ে তন্ময় হয়ে পড়েছিল ত্রিভন। ঠিক সেইসময় একখানা বলিষ্ঠ হাতের স্পর্শ কাঁধের ওপর অনুভব করে সে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে বৃদ্ধ সর্দার সারিমুর্মু চেয়ে রয়েছে তার দিকে।

—কি সর্দার?

—জরুরী কথা রয়েছে।

—বলুন।

—বাইরে আসতে হবে একটু। অন্য সবাই অপেক্ষা করছে সেখানে।

তিন সর্দার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। ত্রিভন লক্ষ করে, রাজার মৃত্যুতে সবাই তারা শোকাহত। অথচ কিসের চিন্তায় যেন অস্থির।

ডুইঃ টুডু ধীরে ধীরে বলে—সতেরখানি তরফের রাজাকে আমরা হারিয়েছি ত্রিভন সিং। সিংহাসন শূন্য। কিন্তু বেশীদিন তো এভাবে ফেলে রাখা যায় না। সমাজের গোলমাল রয়েছে, বাইরের বিপদও আছে। আমরা, সর্দারেরা চাই, একজন যোগ্য ব্যক্তি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিংহাসনে বসে আমাদের নিশ্চিত করুন। রাজার মৃত্যুতে আমরা মর্মাহত। তবু আপনাকে ডাকতে হল শুধু এইজন্যেই।

ডুইঃ খুব সুন্দর ভাবেই কথাগুলো উচ্চারণ করল। অন্যান্য সর্দাররা মনে মনে প্রশংসা না করে পারে না। তার ভেৰে উঠতে পারছিল না, আজকের দিনেই কিভাবে ত্রিভনকে কথাগুলো বলা যায়। ডুইঃ-এর গান-বাঁধা সার্থক। কথায় যাদু সত্যিই তার আয়ত্তে।

নিজের অজ্ঞাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ত্রিভন। শেষে বলে—কি করতে হবে আমাকে?

—পরীক্ষা দিতে হবে আপনাকে। প্রমাণ করতে হবে যে সতেরখানি তরফের রাজা হবার উপযুক্ত আপনি। সারিমুর্মু এবারে পরিষ্কার করে বলে।

—বেশ। পরীক্ষা নিন। আমি প্রস্তুত।

—অত সহজ নয় ত্রিভন সিং। দুমাস সময় দিলাম। আমরাই শিক্ষা দেব এই দুমাস। তবে ওই বাঁশী ছাড়তে হবে আপনাকে।

ত্রিভনের চোখে মুখে দৃঢ়তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে বলে—বাঁশী আমি ছাড়ব না। যে পরীক্ষা করতে চান আপনারা এখনি করতে পারেন।

সর্দাররা পরস্পরের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে। রাজা হেমৎ সিং-এর শেষ কথা তাদের কানে বাজে। তাঁর অন্তরের বাসনা ছিল, ত্রিভনই সিংহাসনে বসুক। সর্দাররাও চায় তাই। রাজাকে তারা ভালোবাসত। কিন্তু অর্বাচীন কিশোরের হঠকারিতায় সে সুযোগ বুঝি নষ্ট হয়।

ডুইঃ টুডু সামনে এগিয়ে এসে তর্জনী তুলে বলে—ত্রিভন সিং! খেয়ালের বশে এতদিন চলেছেন। আর তা সম্ভব নয়। আমরা যা বলছি, সেই অনুযায়ী কাজ করুন। খাঁড়ে পাথরের বংশের মর্যাদাই রক্ষিত হবে তাতে।

জ্বলে ওঠে ত্রিভন সিং। কঠোর দৃষ্টিতে সর্দারদের দিকে চেয়ে বলে—খাঁড়ে পাথরের বংশের মর্যাদা আপনারাই রাখছেন না সর্দার। পরীক্ষার জন্যে তাই দুই মাস সময় দিচ্ছেন। ওপর থেকে একথা শুনে খাঁড়ে পাথর লজ্জায় মুখ ঢাকছেন। মুখ ঢাকছেন সদ্য লোকান্তরিত রাজা হেম সিং। আপনারা তাঁর যোগ্য সর্দার বলে বড়াই করেন? ছি ছি!

চোয়াড় সর্দারদের মুখগুলো হয় পাণ্ডুর। গৌরবের পদপ্রান্তে এগিয়ে আসা এক কিশোর বংশীবাদকের কাছ থেকে এমন কঠিন ভাষা তারা প্রত্যাশা করেনি। মনে হল যেন হেমৎ সিং নিজেই সেই কথার চাবুক চালাচ্ছেন তাদের ওপর। এমন কথা বলা কোথায় শিখল ছেলেটা? সে তো চুপ করেই থাকে সারাদিন।

সারিমুর্মু, বুধকিস্‌কু, বাঘরায় সোরেন, ডুইঃ টুডু—সবাই চেয়ে থাকে ব্যক্তিত্বপূর্ণ এক কচিমুখের দিকে—যে মুখে এতদিন ভাবাবেগ আর তন্ময়তা ছাড়া কিছুই নজরে পড়েনি তাদের

সূর্য তখন মাথার ওপরে। শালবনের পাতার ফাঁক দিয়ে রশ্মি চুঁইয়ে বাটালুকা গ্রামের মাটিতে আলোর আলপনা এঁকে দিয়েছে। অদূরে কিতাডুংরি অতীতের বড় ঘটনার মতো আজকের ঘটনারও নীরব সাক্ষী।

—আপনারা কি ক্লীব হয়ে গেলেন সর্দার? অমন চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? গ্রামে গ্রামে ঢাউরার ব্যবস্থা করুন। এখনি—এই মুহূর্তে কিতাপাটের মন্দিরের পাশের শালগাছের সবচেয়ে ভালো ডাল কেটে নিয়ে ছয়জন লোক ঘুরে আসুক সতেরখানি তরফের প্রতিটি গ্রামে। ঢাউরা শুনে লোক এসে জড়ো হোক কাল এখানে। তাদের সামনে আমার পরীক্ষা হবে।

সারিমুর্মু মুখ খোলে এবারে। বলে-অত লোকের প্রয়োজন নেই। আমরা তাদের প্রতিনিধি আমাদের সামনে দিলেই চলবে।

—বেশ। তবে এখনি হোক। বলুন কি করতে হবে।

—আজ আপনি সুস্থ নন। মন খারাপ আপনার। কালকে ব্যবস্থা করলেই চলবে।

—আবার ভুল করলেন সর্দার। মৃত্যুতে যত দুঃখই থাকুক না কেন, সতেরখানির লোকেরা তাতে চঞ্চল হয় না। প্রতি পদে তারা দেখতে পায় মৃত্যুর হাতছানি। বৃদ্ধ হয়েছেন আপনি। তাই এত ভুল। আপনার সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা নিরাপদ নয়।

সারিমুর্মুর মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। রাগে না লজ্জায় বুঝতে পারে না সে। এভাবে অপদস্থ হবার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি। এতখানি বয়স হল, কেউ কখনো এভাবে বলেনি তাকে। প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে হয় তার। মৃত রাজার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে মনে মনে,—পারলাম না রাজা তোমার আদেশ মানতে। দায়ী তোমার ছেলেই।

একটা ধনুক আর তীর এনে ত্রিভনের সামনে রাকে সারিমুর্মু।

—কি করতে হবে? ত্রিভন প্রশ্ন করে।

—ওই যে মুন্‌গা গাছ দেখছেন, অতদূর আপনার তীর পৌঁছবে কি?

—চেষ্টা করতে পারি।

—যদি পৌঁছায় তবে গাছের গোড়াটাকে লক্ষ্য করে মারুন।

মুহূর্তের জন্যে ত্রিভন কপালের ওপর বাঁ হাতখানা আড়াল দিয়ে গাছটাকে লক্ষ্য করে। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হ’য়ে ওঠে। মুখে ভেসে ওঠে মৃদু হাসির তরঙ্গ। সর্দারদের দিকে চেয়ে সে বলে—গাছের ডালে একটা পোতাম বসে আছে না?

চার-সর্দার চেয়ে থাকে বহুক্ষণ। শেষ দেখতে পায় পোতামটিকে। একমনে ডেকে চলেছে সে।

—কিন্তু ওটাকে তো মারা সম্ভব নয় ত্রিভন সিং। বাঘরায় বলে ওঠে।

—আমি ওটাকেই মেরে দিচ্ছি। নিয়ে এসো তোমরা। গম্ভীর গলায় ত্রিভন কথা বলে। সর্দারদের প্রথম ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে তীরধনুক হাতে তুলে নেয় সে।

রাগে কেঁপে ওঠে সর্দাররা। বিদ্রূপ করছে হেমৎ সিং-এর পুত্র। মাটির দিকে চেয়ে তারা পাথরের ওপর ঘন ঘন পা ঘসে।

—গেলে না? সতেরখানি তরফের সর্দাররা কি আজকাল নিজেদেরই রাজা বলে ভাবতে শুরু করেছে।

—পোতামকে মারা কখনই সম্ভব নয়। ঠাট্টা করছেন আপনি। ফল পেতে হবে। চীৎকার করে ওঠে বুধকিস্‌কু।

—চুপ। তর্ক শিখেছে সর্দাররা। এগিয়ে যাও তুমি বুধকিস্‌কু। হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি। নিয়ে এসো মৃত পোতামকে।

দাঁতে দাঁত চেপে মুহূর্তের জন্যে স্থির দৃষ্টিতে চায় বুধ উদ্ধত যুবকের দিকে। শেষে ছুটে যায় মুগা গাছের দিকে। সেই সঙ্গে ছোটে ত্রিভনের তীর।

সর্দাররা দেখে ঠিক জায়গাতেই পৌঁছেছে তীর। তবে পাখীটা মরেছে কিনা ঠাহর করতে পারে না। তবু তারা অবাক হয় ত্রিভনের ধনুকের হাত দেখে।

একটু পরেই তারা দেখে বিহ্বল বুধকিস্‌কুকে—রক্তমাখা পোতাম তার হাতে। ভয়ে কাঁপতে থাকে তারাই। কে এই অদ্ভুত যুবক? এ তো সেই বাঁশীওলা নয়—এর মুখ চোখের কঠোরতা আর ব্যক্তিত্ব যে মৃত রাজাকেও হার মানায়

—আর কিছু পরীক্ষা করতে চাও?

—আমাদের ক্ষমা করুন রাজা। ডুইঃ টুডু এগিয়ে গিয়ে তার হাতের তারওয়ারী রাজার পায়ের সামনে সমর্পণ করে। বাঘরায় সোরেন রাখে তার কাপি। সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় সতেরখানির চার-সর্দার।

বাঁ-হাতের আগুনে-পোড়া জাতি চিহ্ন ‘সিকে’র ওপর ডান হাত স্পর্শ করে সারিমুর্মুর সঙ্গে সঙ্গে তারা সবাই এক সঙ্গে উচ্চারণ করে—আমরা আমাদের ‘সিক’ স্পর্শ করে ঘোষণা করছি, রাজা হেমৎ সিং ভুঁইয়ার মৃত্যুর পর তাঁর যোগ্যপুত্র ত্রিভন সিং ভুঁইয়াকে সতেরখানি তরফের রাজা নির্বাচিত করা হল। আমরা, সতেরখানি তরফের সমস্ত আদিবাসী, তাঁর প্রতি আজীবন বিশ্বস্ত থাকব।

—সর্দার সারিমুর্মু, বুধকিস্‌কু, ডুইঃ টুডু, বাঘরায় সোরেণ, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, সতেরখানির মর্যাদা আমি প্রাণ দিয়ে রক্ষা করার চেষ্টা করব।

চার সর্দার রাজার সামনে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে।

—তবে একটা কথা সর্দার, বাঁশি আমি বাজাব

—নিশ্চয়ই বাজাবেন। ডুইঃ টুডু বলে উঠে। সে নিজে গান বাঁধে।

শেষ রাতে যে সর্দাররা শিশুর মতো কেঁদেছিল সুবর্ণরেখা নদীর তীরে, মধ্যাহ্নের শেষ প্রহরে তারাই আবার প্রাণখোলা হাসি হেসে ওঠে হো হো করে।

.

কাঁটারাঞ্জা পাহাড়ের উচ্চতা যেখানে সমতলে এসে মিশেছে, সেখানে ছিয়ানব্বই বছরের বৃদ্ধ পারাউ মুর্মুর কুঁড়েঘর। রাজা খাঁড়ে পাথরের জীবনের শেষ দুবছর এই বৃদ্ধকে চার তরফের সমস্ত অধিবাসীই চিনত। সে সময়ে খাঁড়ে পাথরের ডান হাত ছিল সর্দার পারাউ মুর্মু। সর্দারের নেতৃত্বে সতেরখানির চোয়ার বাহিনী সুদূর ধলভূম পর্যন্ত আক্রমণ করে জঙ্গলমহলকে দিয়েছিল এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। বরাহভূমের রাজা বিবেকনারায়ণের পিতামহ অনেক চেষ্টা করেছিলেন এই দুর্দান্ত সর্দারকে বশে আনতে—কিন্তু পারেননি। শেষে তিনি নিজে এসেছিলেন কাঁটারাঞ্জার কোল-ঘেঁষা এই ক্ষুদ্র কুটিরে। সঙ্গে এনেচিলেন বৃদ্ধ খাঁড়ে পাথরকে

বিস্মিত দৃষ্টিতে সেদিনের যুবক পারাউ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে, ছুটে গিয়ে দুই রাজার সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেছিল।

—কি অপরাধ করেছি মহারাজ।

মহারাজের হয়ে রাজা খাঁড়ে পাথর জবাব দিয়েছিলেন—জঙ্গল মহলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে মহারাজা ব্যাকুল হয়েছেন পারাউ।

—আমাকে উনি ওঁর কাজে লাগাতে চান?

—না। উনি শুধু চান, তুমি শান্ত হও।

—সেকথা আমাকে বলে লাভ কি রাজা? আপনার হুকুমের চাকর আমি। আপনিই ব্যবস্থা করুন।

—তা জানি। কিন্তু শান্তির জন্যে যে উনি কতটা আকুল সে কথা তোমাকে জানাতে চান বলেই তোমার বাড়ীতে আমাকে নিয়ে এসেছেন।

বরাহভূমের মহারাজা দরিদ্র মুর্মুর গৃহস্থালীন খুঁটিনাটি চেয়ে চেয়ে দেখছিলেন। এত বড় সর্দার অথচ বাড়ীর আঙিনায় পা দিলেই তার সমস্ত সম্পত্তির হদিশ এক নজরে জেনে নেওয়া যায়—যার মূল্য খুবই সামান্য

পারাউ মুর্মু মহারাজার মনোভাব বুঝল। হেসে বলল, সে,—হ্যাঁ মহারাজ এই হলো একজন সর্দারের সংসার। সতেরখানির সাধারণ প্রজাদের অবস্থা এর থেকেই আপনি অনুমান করতে পারবেন। মহুল, জোনার আর কদুয়া—তাও মেলে না এদের ভাগ্যে। তাই আমরা অশান্ত। শান্ত থাকতে কি আমাদেরও সাধ হয় না? কিন্তু পেটে যখন জ্বালা ধরে, ছেলে-মেয়েগুলো যখন দিনের পর দিন না খেয়ে শুকিয়ে যায়, যখন পেটের জ্বালা মাথায় গিয়ে ওঠে। আর শান্ত থাকতে পারি না আমরা।

বরাহভূমরাজ নিরুত্তর।

খাঁড়ে পাথর বলেন—শুনলেন মহারাজ? আমার সঙ্গে শত আলোচনা করেও যা বুঝতেন না, পারাউ সর্দারের এক কথায় বুঝেছেন নিশ্চয়। সমস্ত সতেরখানি তরফ যেন কথা বলল এই মুহূর্তে।

—বুঝেছি রাজা। তবু বলছি শান্ত থাকতে। আপনি জানেন বোধ হয়। টোডরমল্লের রাজস্ববিভাগের মধ্যে জঙ্গলমহলের নামমাত্র উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এখানে থেকে রাজস্ব আদায়ের কল্পনা এ-পর্যন্ত কেউ করেনি। কারও দৃষ্টিও এদিকে পড়েনি। কিন্তু বরাবর যদি এখানে আগুন জ্বলে, মুসলমানদের দৃষ্টি এদিকে পড়বেই। তখন কদুয়া জোনারও কারও ভাগ্যে জুটবে না। আজ আপনি আমাকে বছরে দিচ্ছেন ২৪০ টাকা। তখন এর একশো গুণ দিলেও বোধহয় ওদের পেট ভরবে না।

—আপনার কথা ভাববার মতো। খাঁড়ে পাথর গম্ভীর হয়ে বলেন।

চিন্তান্বিত দুই রাজা চলে গিয়েছিলেন সেদিন পারাউ মুর্মুর আঙিনা ছেড়ে।

কিন্তু এরপরও পারাউ শান্ত থাকতে পারেনি। অল্পদিন পরেই খাঁড়ে পাথরের মৃত্যু হল। যুঝার সিং হলেন রাজা। অন্যায়ের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখানো বৃদ্ধ খাঁড়ে পাথরের পক্ষে সম্ভব হলেও যুবক যুঝার সিং-এর ধমনীর রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। সেই সঙ্গে পারাউ মুর্মুরও।

ঘটনাবহুল জীবন এই পারাউ মুর্মুর। অনেক যুদ্ধ দেখেছে—অনেক করেছে। শেষে অম্বিকানগরের সঙ্গে এক খণ্ডযুদ্ধে ডান হাতখানা হারায়। সেই থেকে আর সে কিতাগড়ে যায়নি। লাভ নেই। সাঁওতাল, মুণ্ডা আর ভূমিজ অধ্যুষিত সতেরখানি তরফের রাজধানী বাটালুকার রাজপুরী কিতাগড়ে অক্ষমের স্থান নেই। জীবন ধারণের অত্যাবশ্যক তাগিদে যেখানে প্রতি মুহূর্তে অস্ত্র ধরতে হয়, সেখানে অক্ষম হয়ে বসে থেকে অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বেশীদিন সম্মান বজায় রাখা সম্ভব নয়।

তাই পুত্র রাজমুমুকে পাঠিয়েছিল সে যুঝার সিং-এর কাছে। অনুরোধ করেছিল, রাজুকে যেন তার সামর্থ্য প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয়। যুঝার সিংও দ্বিধাবোধ করেননি সে অনুরোধ রক্ষা করতে। প্রধান সর্দারের পুত্র প্রথমে সুযোগেই যাতে সর্দারের আসন দখল করতে পারে—সে ইচ্ছে তাঁরও ছিল। এক মাসের মধ্যে সুপুর রাজের বিরুদ্ধে হলো অভিযান। রাজমুর্মু তার নেতৃত্ব পেল।

সেদিনের কথাকে মনে হয় যেন কালকের কথা। পারাউ প্রায়ই বসে বসে ভাবে। সূর্যকে তখনো দেখা যায়নি। সমতলের দিগন্তের—কাঁটারাঞ্জার চূড়াটুকু শুধু লাল হয়ে উঠেছে সবে। পারাউ একটা বাঁশের খুঁটি মাটিতে পুঁতবার চেষ্টা করছিল একহাতে—গরু বাঁধার জন্যে। ছাব্বিশ বছরের সুঠাম যুবক ঘর থেকে বাইরে এল ঠিক সেই সময়। গায়ের হলুদ রঙের আঙরপ আর মাথায় লাল দাংড়ি। কাঁধে ছিল তার বল্লম—হাতে ঢাল।

পারাউ মুর্মু একদৃষ্টে চেয়ে চেয়ে দেখছিল ছেলের বীরের রূপ।

রাজু মৃদু হেসে প্রণাম করে বলেছিল-চালা কানাইঞ।

—ওকথা বলতে নেই। বল্ ‘আসি’।

—আসি বাবা।

—কিতাপাটের আশীর্বাদে তুই জিতবি—নিশ্চয়ই জিতবি। সর্দার হবি তুই। কিতাপাট তোর সঙ্গে সঙ্গে থাকবেন।

আবার একটু মৃদু হেসেছিল রাজু। ঘরের দরজার দিকে একবার চোরা চাহনি চেয়েছিল। সেখানে আড়ালে দাঁড়িয়ে তার বউ। ছেলে সাওনা তখনো ঘুমের অচেতন।

সেই বিদায়ই শেষ বিদায়।

আর ফেরেনি রাজু। যুদ্ধে জিতেও সে যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে রইল। কিতাপাট তাকে সর্দার হতে দেননি–রক্ষাও করেননি।

নাতি সাওনা মুর্মু মরেছিল ভালুকের হাতে। তার ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ পাওয়া গিয়েছিল মারাংবুরুর ঠাঁই-এর কাছে। দাদুকে বৈদ্য ওষুধ খেতে বলেছিল-তাই গাছ-গাছড়ার খোঁজে সে গিয়েছিল খাঁড়ে পাহাড়িতে। পথে রাত হয়েছিল। হাত ছিল খালি। টাঙি নিয়ে গেলে একশো ভালুকও সাওনার কাছে ভিড়তে পারত না। বাপের মতোই সে ছিল শক্তিমান-দাদুর মতো তারও ছিল চওড়া বুক।

ব্যাটার বউ আর নাত-বউ গিয়েছে। মরে বেঁচেছে তারা সেবারের ‘হাওয়া-ছক’-এর মহামারীতে। কিন্তু সেই সঙ্গে সাওনার মেয়েটাকে নিয়ে গেলেই পারত। সেটাকে যে কেন ফেলে গেল, কিতাপাটই একমাত্র জানেন সেকথা। বুড়োকে আর যে কত পরীক্ষাই করবেন তিনি।

সাওনার মেয়ে লিপুর। বুড়ো ভেবেছিল বাঁচবে না। কিন্তু মরলও তো না। বেশ ডাগর হয়ে উঠেছে। চোদ্দ বছর বয়স হল। এ-বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ে দেওয়াই উচিত, কিন্তু প্ৰাণ যে চায় না। আর কয়দিনই-বা। থাকুক সে-কদিন।

.

সেদিন বুড়ো বসেছিল চিন্তায় বিভোর হয়ে। অতীতের স্মৃতি তোলপাড় করছিল তার মনে এমন সময় লিপুর ছুটে আসে হাঁপাতে হাঁপাতে। খবর দেয়, তাদের গাই কুঙ্‌কীর বাছুর হয়েছে মাঠের মধ্যে।

—কি বিয়োলো? এঁড়ে না বক্‌না।

—এঁড়ে। লিপুর ঠোঁট উল্টোয়।

—মন খারাপ হল নাকি রে?

—হবে না? এতোদিনে একটা বাচ্চা হলো, তাও এঁড়ে।

—এঁড়ে কি খারাপ?

—বড় হলে দুধ দেবে?

—দুধ না দিলেও মাঠ চষবে।

—কে নিয়ে যাবে মাঠে—আমি?

—না। তোর যে একটা এঁড়ে আসবে? সে।

—ধ্যেৎ।

—চল দেখিগে। পারাউ হাসতে হাসতে লিপুরের গায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। শরীরটা তার বড় বেশী নুইয়ে পড়েছে। মাজাটাকে বেশীক্ষণ সোজা করে রাখা যায় না। ভারসাম্য বাজায় রাখতে লাঠিতে ভর দিয়ে চলতে হয়

বাচ্চাটা অনেক আগেই হয়েছে। বাছুরের গা চেটে চেটে পরিষ্কার করে ফেলেছে কুঙ্‌কী। গা শুকিয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে পায়েও বেশ জোর হয়েছে বাচ্চাটার। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাঁটে মুখ লাগিয়ে কেমন চুষছে। তবে এখনও মাঝে মাঝে সামনের পা দুটো ভেঙে যাচ্ছে—ফকে যাচ্ছে।

পারাউ মুর্মু চেয়ে চেয়ে দেখে।

—রঙটা তো ভালোই হয়েছে। সে বলে।

—ভালো না ছাই। লাল রঙ ভালো নাকি? মায়ের মতো কালো হলেই তো ভালো হত। ঠিক শুকোলদের ষাঁড়ের মতো দেখতে হয়েছে।

—বাপেরই মতো হয়েছে।

—এদের আবার বাপ থাকে নাকি?

পারাউ সর্দার হাসে। লিপুর বড়ই ছোট—বয়সের চেয়েও। মেয়েসঙ্গী তার কেউ নেই।

বাছুরটাকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ীর দিকে এগোয় লিপুর। কুঙ্‌কী ব্যতিব্যস্ত হয়ে পেছনে পেছনে ছোটে।

অনেক কাজ আজ লিপুরের। সাঁঝে শালকাঠের গুঁড়িতে আগুন দিতে হবে। মশায় যাতে কষ্ট না পায় এরা। ঘাস কেটে দিতে হবে। আজ আর কাঁটারাঞ্জার কালো পাথরের পাশে যাওয়া হবে না। দুঃখ আর আনন্দের এক অদ্ভুত অনুভূতি তার ছোট্ট মনে খেলা করে বেড়ায়।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *