কিতাগড় – ১০

১০

লালসিংকে বুকে আঁকড়ে ধরে ধারতি কিতাডুংরির দিক চেয়ে থেকে এক সময়ে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। পাশে মুৎনী দাঁড়িয়ে। রাণীর কাছ-ছাড়া এক দণ্ড হয় না সে। কারণ সে জানে তাদের পালাতে হবে। রাজা এসে একবার বললেই ছুটবে তারা বন জঙ্গল পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে। রাস্তাঘাট সব দেখে এসেছে সে সারিমুর্মুর সঙ্গে গিয়ে। রাণীকে সেই পথ দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নিয়ে যাবার ভার তার ওপর—সম্পূর্ণ তার ওপর। কোনো সর্দার বা চোয়াড় যাবে না সঙ্গে। মনে মনে গর্ব অনুভব করে মুৎনী! সেই সঙ্গে এক দুঃসহ ব্যথা তার বুকের মধ্যে বাসা বাঁধে! রাজাকে ছাড়তে হবে। প্রথম অনুভব করে মুৎনী, রাজাকে দেখে তার বড় আনন্দ হত।

ধারতিকে দেখে মুৎনী অনুভব করে। সময় যত এগিয়ে আসছে ততই যেন রাণী কেমন হয়ে যাচ্ছে। যাবার জন্যে পা বাড়িয়েই আছে, অথচ মনটা যেন বেশী করে বাঁধা পড়েছে এখানে। মুৎনী জানে না যে এ যুদ্ধে ত্রিভনকে মরতেই হবে, তার ধারণা তারা সারিগ্রামে যাবার কিছুদিন পরে রাজাও গিয়ে মিলবেন তাদের সঙ্গে।

ধারতি চেয়ে থাকে।

কিতাপাটের ঠাঁই। মন্দিরটা চোখে না পড়লেও মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। কয়েক বছর আগের সেই বিচারের দিন অসংখ্য নরনারীর মধ্যে সেও সেদিন ছিল সামান্য এক কিশোরী। কারও নজরে পড়েনি সে। রাজার প্রথম বিচার দেখে সবাই যখন আনন্দে মেতে উঠেছিল, তার ছোট্ট বুকখানাও খুশীতে ভরে উঠেছিল সে সময়। কিন্তু তার পরই এক সহ্যাতিরিক্ত বিষাদে আচ্ছন্ন হয়েছিল সে। তার বাঁশীওলা রাজা—একথা ভাবতে চোখদুটো ভরে উঠেছিল জলে। বাঁশীওলা যেমন আপন হতে পারে রাজা তো তা পারে না। রাজারা কত দূরে—তাদের শুধু দেখা যায়, ছোঁয়া যায় না। সেদিন বাড়ী ফেরার পথে ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে হোঁচট খেতে হয়েছিল কতবার। কতবার শুকোলের দিদির গালাগালি বর্ষিত হয়েছিল তার ওপর।

তারপর।

দ্রুত পরিবর্তন ঘটল জীবনে। লিপুর থেকে ধারতি। ধারতি থেকে রাণী। বাঁশীওলার বাঁশীর সুর শুনতে পেল রাজার কথায়। সে সুরের ঝংকার শয়নে স্বপনে জাগরণে। এমনি সময়ে আর একবার গিয়েছিল কিতাডুংরিতে। নতুন রাজার অধীনে সতেরখানির বীরত্ব সুপুর, ধলভূম আর বরাহভূমকে দেখবার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিল প্রতিটি অধিবাসী। সেই উৎসবে যে ছন্দপতন ঘটেনি তা নয়। বাঘরায়ের দীর্ঘশ্বাস সবার মনে বিষাদের ছোঁয়াচ লাগিয়েছিল। তবু তারই মধ্যে রান্‌কো সর্দার ফিরে পেয়েছিল হারানো সোনার কাঠি। পেয়ে পাগল হয়েছিল।

এছাড়া শ্রাবণের উৎসবে প্রতিবারই সে গিয়েছে কিতাডুংরিতে—ত্রিভনের পাশে পাশে আবার হয়তো যাবে সে কোনো এক সুদূর ভবিষ্যতে। কিন্তু তখন ত্রিভন থাকবে না। শুধু ত্রিভন কেন, আজ যারা সতেরখানির গর্ব, তার কেউ-ই থাকবে না সেদিন। থাকবে এই লালসিং। বড় হবে সে। মস্ত বড়—দেহে, মনে নামে। যে অনুপ্রেরণায় উত্তরাধিকারী হবার সৌভাগ্য হল তার, সে অনুপ্রেরণা অনেক উঁচুতে তুলবে তাকে। নিশ্চয়ই তুলবে। সেই সঙ্গে সতেরখানি উঠবে—তার রোগ শোক আর ক্ষিদে নিয়েও কাঁপিয়ে দেবে বরাহভূমরাজ বিবেকনারায়ণ কিংবা তাঁর বংশধরকে।

—পারবি তো লাল? ধারতি শিশু লালসিং-এর মাথাটা নিজের কাঁধের ওপর চেপে ধরে।

মুৎনী চঞ্চল হয়ে ওঠে। রাণীর রকম-সকম তার ভালো লাগে না।

ধারতি লালসিংকে কোল থেকে নামিয়ে তার দু-হাত ধরে মুখের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চায় মুখের প্রতিটি রেখা কঠোর হয়ে ওঠে।

—তোকে পারতেই হবে লাল। নইলে আমি কথা দিয়েছি তোর বাবাকে—বিষ দেব। বিষ মিশিয়ে দেব তোর খাবারে। দুধের মধ্যে মহুয়ার ফুল সেদ্ধ করে যে ক্ষীর তৈরী হবে সে ক্ষীর খেয়ে লুটিয়ে পড়বি তুই।

—রাণী! চীৎকার করে ওঠে মুৎনী। ভয়ে কাঁপে সে।

—কে? মুৎনী? কি হয়েছে তোর?

—কি বলছেন রাণী?

—ঠিক বলছি। তোকেও বলে রাখি মুৎনী। মন দিয়ে শোন্। লাল বড় হবার আগেই যদি মরি আমি, তুই মানুষ করবি ওকে। ওর বাবাকে দেখছিস্? ঠিক অমনি ভাবে? যদি মানুষ না হয়—বিষ দিবি।

—রাণী!

—ভয় পাচ্ছিস্? সতেরখানির মেয়ে হয়ে ভয় পাস্?

—না। কিছুতেই ভয় পাই না। কিন্তু লালের মুখের দিকে চেয়ে দেখুন তো একবার। কী সুন্দর। মুৎনী কেঁদে ফেলে।

—ফুলের মধ্যে পোকা থাকে মুৎনী! দেখিস্ কি কখনো?

—দেখেছি রাণী। কিন্তু লালকে অমন ভাবতে পারেন? মুৎনী কখনো এভাবে কথা বলে না। সে কথাই বলে না কোনোদিন। শুধু হুকুম তালিম করাই তার কাজ। ধারতি আজ প্রথম দেখল মুৎনী ঠিক বালিকা নয়। সবার অলক্ষ্যে এরই মধ্যে কৈশোরের সীমা অতিক্রম করেছে? মুখ তার বুদ্ধিদীপ্ত। মনে মনে খুশী হয় ধারতি। ভাবে, সারিগ্রামে গেলে মুৎনীই হবে তার একমাত্র সান্ত্বনা—তার বন্ধু, তার সাথী।

—লালসিংকে অমন ভাবি না মুৎনী। কিন্তু সবচেয়ে যা খারাপ হতে পারে তার জন্যেও মনে মনে প্রস্তুত থাকতে হয়।

—কিন্তু এত ভাবছেন কেন রাণী। রাজা নিজেই তাঁর ছেলেকে মনের মতো গড়ে নেবেন।

—ধারতি বুঝতে পারে বুদ্ধিমতী হয়েও আসল জিনিসটিই ধারণা করতে পারেনি মুৎনী। রাজার সঙ্গে তার অনেক আলোচনাই মুৎনীর কানে যায় হয়তো। কিন্তু এই বিষয়ে আলোচনা কোনোদিন সে শোনেনি।

ধীরে ধীরে বলে ধারতি—রাজা আর ফিরবেন না।

—কেন? ধারতি স্পষ্ট দেখতে পায় মুৎনীর মুখ একেবারে রক্তশূন্য।

—ফিরতে নেই তাঁকে!

—উনি যে বলে গেলেন আবার আসবেন।

—আসবে। এখানে আসবে। কিন্তু সারিগ্রামে যাবে না কোনোদিনও। সেখানে লাল থাকবে, তুই থাকবি, আর আমি—

মুৎনী ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে রাণীর দিকে চেয়ে থাকে। মস্তিষ্ক যেন তার কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে সহসা।

.

বাটালুকায় সূর্য ডোবে। সন্ধ্যা ঘনায়। শেষে রাত হয়। এমন অন্ধকার রাত বুঝি কখনো নামেনি সতেরখানির বুকে। অঙ্গের সমস্তটুকু কালিমা ঢেলে দিয়ে রিক্ত হতে চাইছে রাত্রিদেবী।

স্তব্ধ কিতাগড়। সে স্তব্ধতার সাক্ষী আরও অসংখ্য ঘটনার সাক্ষ্যবহনকারী কিতাডুংরি পাহাড় সাক্ষী শাল-মহুয়ার বন—আকাওনা, দুধিলোটার অসংখ্য ঝোপ।

মাঝে মাঝে শুকনো শালের পাতায় সারিমুর্মুর চোয়াড়দলের সজাগ প্রহরীর পা পড়ে খস্থস্ আওয়াজ উঠছে। সে আওয়াজে প্রহরী নিজে চমকায়।

শিয়াল ডাকে না আজ। ফেউএর ডাকও শোনা যায় না। সজারু, ছুঁচো আর সরীসৃপরাও বুঝি বিবর থেকে বার হয়নি।

এক অখণ্ড বিভীষিকা বিরাজ করছে। প্রতিটি নরনারীর বুক জোনাকীর আলোর মতো দপদপ করছে—এক এগিয়ে আসা বিপদের আশঙ্কায়।

ধারতি তখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে জানালার ধারে। মুৎনী ছায়ার মতো তার পাশে। লালসিংকে একটু রাণীর কোল থেকে নিয়ে মেঝের ওপর শুইয়ে দিয়েছে মুৎনী। সে ঘুমোচ্ছে। ভুইয়া বংশের অবশিষ্ট ও-ই থাকবে হয়তো। কিংবা নাও থাকতে পারে। যেমন থাকবে না হয়ত কিতাগড়। বহু বছর পরে লোকে যখন শ্রাবণের বারিধারার মধ্যে এপথ দিয়ে এগিয়ে যাবে কিতাপাটের ঠাঁই-এর দিকে তখন এর ধ্বংসস্তূপে তাদের মনে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি জাগাবে মাত্র। ইতিহাস জানবে যারা—তারা শুধু কিতাগড়ের শ্রেষ্ঠ রাজা ত্রিভনে বিক্রমের কথা ভেবে শ্রদ্ধায় মাথা নত করবে।

আর যদি লালসিং বেঁচে থাকে—সাহস, বিক্রম, আর আত্মসম্মানে সে যদি সার্থক হয়ে ওঠে, তবে হয়তো কিতাগড়ের ধ্বংসস্তূপ দেখার দুর্ভাগ্য হবে না কারও। পরিবর্তে তারা দেখবে বরাহভূমরাজের প্রাসাদের চেয়েও বিশালতর এক প্রাসাদ। আর সেই প্রাসাদের আশেপাশে সতেরখানির অসংক্য সুখী প্রজাদের আনাগোনা—খালি-পেটে দিন কাটানোর ক্লিষ্টতায় বিন্দুমাত্র ছাপ যাদের মুখে নেই।

—রাণী? রাজা—মুৎনী এক অপূর্ব দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ত্রিভনের দিকে।

—কই? ধারতির সমস্ত তন্ময়তা মুহূর্তে চূর্ণবিচূর্ণ হয়।

ত্রিভন এগিয়ে আসে তড়িৎপদে।

—এখনি যাও লিপুর। লাল কই? ঘুমোচ্ছে? তুলে নাও। সময় নেই।

মুৎনী কোলে তুলে নেয় লালকে। কেঁদে ওঠে শিশু।

—আর দেখা হবে না? ধারতির চোখের কোলে দুফোঁটা অশ্রু টল্ করে।

—না লিপুর।

মুৎনীর কোল থেকে ঘুমন্ত শিশুকে নিয়ে আদর করে আবার ফিরিয়ে দেয় ত্রিভন। মুৎনীর সামনেই রাণীর চিবুক তুলে ধরে বলে—আমার লিপুর। জানি তোমার মনের অবস্থা কি।

আমারটাও তুমি বুঝছ। কিন্তু সবার ওপরে সতেরখানির সম্মান। সময় নষ্ট করতে পারি না। লালসিং যেন আমার সাধ পূর্ণ করে। যদি দেখ, ওর চেয়েও যোগ্য কেউ দেখা দিয়েছে সতেরখানির মাটিতে—তবে তাকেই এনে রাজা করো। বংশের দোহাই দিয়ে রাজা হয় বরাহভূম, অম্বিকানগর, সুপুর আর ধলভূম রাজ্যে—যারা কথায় কথায় আমাদের বিদ্রূপ করে। এখানে তা চলতে দিও না। এই আমার শেষ দাবী।

মূর্ছিত হল না ধারতি। বাটালুকার মেয়ে সে। ত্রিভনের কাছে শিক্ষা পাওয়া মেয়ে। মুৎনীর কোল থেকে লালসিংকে নিয়ে ত্রিভনের চোখের দিকে সোজা দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,–তোমার দাবী জীবন নিয়ে রাখতে চেষ্টা করব বাঁশীওলা।

রাতের অন্ধকারে কিতাগড়ের বাইরে আসে তারা। চোয়াড়বাহিনীর মধ্যে একটা এ্যস্তভাব লক্ষ্য করে ধারতি।

—ওরা এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে কেন রাজা?

—ওই দেখ। আঙুল দিয়ে দেখায় ত্রিভন

দেখতে পায় ধারতি বহুদুরে শালবানের ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য মশালের আলো। এগিয়ে আসছে সে আলো। রান্‌কোর দল পরাস্ত হয়েছে শেষপর্যন্ত।

—রাজা।

—কে?

সারিমুর্মুর আবির্ভাব ঘটে অন্ধকারের ভেতর থেকে।

—কি সর্দার?

—ওই যে আলো দেখছেন, ওর অনেক কয়টাই এসে পৌঁছতে পারবে না। আর একটু দাঁড়ালে দেখবেন একটার পর একটা মশাল কেমন মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। চমৎকার দেখতে লাগবে।

—তবু আসবে ওরা

—হ্যাঁ আসবে। আসবেই! আমাদের লোক নেই।

—রাজা! মুৎনীর কণ্ঠস্বর। বিস্মিত হয় ত্রিভন। জীবনে এই প্রথম মুৎনী তাকে নিজে থেকে সম্বোধন করল।

—বল মুৎনী।

—আমাকে কোনো আদেশ করলেন না।

—রাণীর আদেশই আমার আদেশ। রাণীর কথা মেনে চলো।

—রাজা, এতদিন যে বোবার মতো মুখ বুজে কাজ করে এসেছি সে কি শুধু রাণীর দিকে চেয়ে?

—তবে?

—পৃথিবীতে অন্য পুরুষকে তো চিনি না চিনতেও চাই না।

—মুৎনী? চিৎকার করে ওঠে ধারতি।

—যত পারেন আমাকে ভর্ৎসনা করবেন রাণী। দিন তো পড়েই রয়েছে। ইচ্ছে হলে আমাকে হত্যা করবেন—ভালুকের সামনে ফেলে দেবেন। সহ্য করব। কিন্তু রাজাকে যে আজ বলতেই হবে। তিনি তো ফিরবেন না।

—মুৎনী, তুই বড় হয়েছিস! সারিমুর্মুর কথায় বিস্ময়।

—বয়সের চেয়ে ও অনেক বড়। ধারতির স্বর বিষণ্ণ।

ত্রিভন গম্ভীর হয়ে বলে—শোন মুৎনী, তুমি যা দিয়েছ, তার বদলে তো আমি কিছু দিতে পারি না। দেবার নেই কিছু। তবে যেটুকু সময় আর অবশিষ্ট আছে আমার জীবনে এর মধ্যে ধারতি আর লালের সঙ্গে সঙ্গে তোমাকেও মনে রাখব।

মুৎনী কেঁদে ওঠে। কিতাগড়ের স্বাভাবিক অবস্থা থাকলে জীবনেও যা বলতে সাহস পেত না, এই সংকট মুহূর্তে তা বলে ফেলে পরিবর্তে যা পেল তাও অভাবনীয়। সহ্য করতে পারে না সে।

—চলি ধারতি। কেঁদো না মুৎনী।

সারিমুর্মুকে নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ত্রিভন শেষবারের মতো।

যুদ্ধের সাজে সাজিয়ে দেবার সময় পাওয়া গেল না। ভালোভাবে একটু কথাও বলা গেল না। থ’ হয়ে একটু দাঁড়িয়ে থাকে ধারতি। চোখ দুটো মুছে ফেলে। শেষে মুৎনীর পিঠে আলগোছে হাত রেখে বলে—চল মুৎনী।

.

দু’দিন দু’রাত বনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলে ওরা। সোজা পথে যাবার উপায় নেই, ধরা পড়ার সম্ভাবনা। নইলে সারিগ্রামে পৌঁছতে এতটা দেরি লাগে না।

অসংখ্য সিড়ির কামড়ে গা ফুলে উঠেছে ওদের। লালসিং প্রথম দিন খুব কেঁদেছিল। তারপর থেকে আর কাঁদছে না। কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে। মুৎনী সঙ্গে করে যে খাবার এনেছিল তার জন্যে সেটা ফুরিয়েছে। আজ সারিগ্রামে না পৌঁছতে পারলে তাদের সঙ্গে শিশুকেও অনাহারে থাকতে হবে।

একটা ফাঁকা জায়গায় এসে হাজির হয় তারা। চারদিকে ঝোপ। সহসা কারও দৃষ্টিতে পড়ার সম্ভাবনা নেই। ঘাসের ওপর লালসিংকে সন্তর্পণে শুইয়ে দেয় মুৎনী।

—রাণী।

—বল্ মুৎনী।

—এতক্ষণে বোধহয় সব শেষ হয়ে গিয়েছে। মুৎনীর চোখের পাতা ভিজে ওঠে!

—হ্যাঁ। কেউ নেই আর আমাদের। ধারতির চোখ শুকনো। কিসের এত কঠোর প্রতিজ্ঞায় জ্বলজ্বল্ করে।

—রাণী।

—বল্ মুৎনী।

—যদি শত্রুরা হেরে যায়।

—তাহলে রাজাকে তোর হাতে তুলে দেব আমি।

কেঁপে ওঠে মুৎনী। রাণীর মুখে এমন কথা সে কল্পনাও করেনি। অবশ শরীর নিয়ে স্থির হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। শেষে বুঝতে পারে রাণীর মনোভাব। রাণীর প্রতি শ্রদ্ধায় তার মন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। রাজার জীবন যে তার কাছে কতখানি সে উপলব্ধি করে।

মুৎনী বলে—ভুল বুঝবেন না রাণী। রাজা এলে আমিই চলে যাব।

মুৎনীর ছোট্ট মাথাকে বুকের কাছে টেনে আনে ধারতি। দু’চোখের জল ফোঁটা ফোঁটা করে ঝরে পড়ে তার মাথায়।

সেই সময় একটু দূরে এক ঝোপের আড়ালে একজনের কান্না শুনতে পায় তারা। গুমরে কেঁদে চলেছে কোনো স্ত্রীলোক।

মুৎনী উঠে যায়। উঁকি দিয়ে দেখে উত্তেজিত হয়ে চাপা গলায় বলে—ঝাঁপনী কাঁদছে রাণী।

—সে কি? এখানে?

—বোধ হয় পালিয়ে এসেছে। ডাকবো?

—আর কেউ নেই? ছেলেপেলে?

—না।

—ডাক্ তবে।

মুৎনী আড়ালে চলে যায়।

কিতাডুংরি পাহাড়ের সেই উৎসবের দৃশ্য ধারতির চোখের সামনে ভেসে ওঠে! রান্‌কো ধলভূম আক্রমণ করার আগে তাকে পেয়ে পাগল হয়ে উঠেছিল এই ঝাঁপনী। কিতাডুংরির নায়ক রান্‌কো। রাজার প্রথম বিচারের বলিও সে। সেদিন বালিকা লিপুর ছিল রাজার পক্ষে। তাই রান্‌কোর প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতিও জাগেনি। আজ এতদিন বাদে সার কথা বুঝেছে ধারতি। ভুল ভেঙেছে তার। তাই মুৎনী রাজাকে ভালোবেসেছে জেনেও সে তার প্রতি অসন্তুষ্ট হতে পারেনি। ভালোবাসার দোষ কোথায়? মুৎনীর হাতই বা কতটুকু এতে। ভালোবাসার কাছে সবাই অসহায়। অন্তর থেকে তাই মুৎনীর অসহায়তাকে আশ্রয় দিতে ইচ্ছে করছে তার।

লালসিংকে খাঁটি বিচার করা শিখিয়ে দিতে হবে। মনে মনে ইচ্ছে থাকলেও ত্রিভন যা বাইরে দেখাতে পারেনি—লালসিং তাই দেখাবে।

ধারতি দেখে মুৎনীকে পেছনে ফেলে পাগলের মতো ছুটে আসছে ঝাঁপনী। কিন্তু বলার অবসর দেবার আগেই সে আছড়ে পড়ে রাণীর পায়ের ওপর। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে ধারতি! কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? অমন যে কেঁপে কেঁপে উঠছে ঝাঁপনীর শরীর, তাও আপনিই শান্ত হবে একটু পরে। মনও সান্ত্বনা খুঁজে নেবার চেষ্টা করবে কালক্রমে। যদি তা না পারে তবে এক কঠিন সহিষ্ণুতার আবরণে শেষদিন পর্যন্ত ঢেকে রাখবে অশান্ত মনকে।

লালসিং একটু কেঁদে ওঠে ঘুমের ঘোরে। মুত্রী তার গায়ে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দেয়। একভাবে মুখের দিকে চেয়ে থাকে অতটুকু শিশুর। ধারতি বুঝতে পারে অত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছে মুৎনী। এতদিন দেখবার প্রয়োজন হয়নি—এখন ওই দেখেই বাঁচতে হবে তাকে। যদি তার কচিমনের প্রথম ক্ষত ভরাট না হয়ে ওঠে—তবে লালসিংএর মধ্যে ত্রিভনের সাদৃশ্য মিলিয়ে মিলিয়ে দেখবে চিরটা কাল।

—সব শেষ হয়ে গেল রাণী। আচমকা আর্তনাদ করে ওঠে ঝাঁপনী। লালসিং পর্যন্ত জেগে ওঠে সে আর্তনাদে।

ধারতি ঠোঁট চেপে ধরে দাঁত দিয়ে। সে বুঝতে পারে এরপর কি বলবে ঝাঁপনী। তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করে,–তোমার ছেলেপেলে কোথায় ঝাঁপনী?

—জানিনা। বাপের সঙ্গে পালিয়েছে তারা। ভীতুর ঝাড় সব।

—তুমি যাওনি?

—না। যেতে বলেছিল বিধুয়া হেঁড়েল। ঝাঁটা তুলেছিলাম মুখের সামনে। ভয় পেয়ে আমাকে ফেলেই পালালো। ঝাঁপনীর নাক-মুখ এত দুঃখেও ঘৃণায় কুঁচকে ওঠে।

—এদিকে কোথায় যাচ্ছো তুমি?

—সারিগ্রামে। সর্দার বলল, আপনারাও যাবেন ওখানে। সারিগ্রাম থেকেই সে একদিন আদর করে নিয়ে গিয়েছিল নিজের বাড়ীতে। তাই এখানেই ফিরে আসতে বলেছে।

সারিগ্রাম আর কতদূরে?

—ওই তো দেখা যাচ্ছে।

কিছুদূরে পাতায় ছাওয়া এক কুঁড়েঘর থেকে কুণ্ডলীকৃত ধোঁয়া ওপর দিকে উঠছে। আঙুল দিয়ে সেদিকে দেখায় ঝাঁপনী।

—ওখানেই তোমার বাড়ী?

—হ্যাঁ রাণী। কিন্তু এখন বাড়ীও নেই—কেউ নেই। কেউ ছিল না বলেই ওর সঙ্গে চলে গিয়েছিলাম। আজ কেউ নেই বলেই আবার ফিরে এসেছি। ওর শেষ আদেশ।

—শেষ আদেশ?

—হ্যাঁ রাণী। পেছন থেকে শত্রু মারতে মারতে বাটালুকাতেই ফিরে এসেছিল ও সীমান্ত থেকে।

—দেখা হয়েছিল?

—হ্যাঁ। ঝাঁপনী কেঁদে ওঠে।

—এখানে কখন এলে?

—একটু আগেই। কিতাগড়ের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে পেতনীর মতো অন্ধকারে ঘুরে বেড়িয়েছি ওকে পাবার আশায়।

মুৎনীর মাথা ঘুরতে থাকে। ধারতির শরীর শক্ত হয়ে ওঠে। সব জানে ঝাঁপনী। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনতে হবে তার কাছে। সহ্য করা কঠিন হলেও শুনতে হবে।

—সারিগ্রামে আসতে বলেই কি রান্‌কো সর্দার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল?

—না-না-না। ওই তার শেষ কথা। সতেরখানির মাটিতে, পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে সে আর কিছু বলবে না কোনোদিনও। কিতাগড়ের নিচে সারিমুর্মুর দেহের পাশে জমে উঠেছিল পঁচিশজন শত্রুর মৃতদেহ। ঠিক তারই পরে দেখতে পেলাম ওকে। বুকে বল্লমের গভীর ক্ষত—আমি শেষ দেখা দেখতে পাব বলেই হয়তো বেঁচেছিল। আমাকে এখানে আসতে বলবে বলেই হয়তো। তারপরই—

হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায় ঝাঁপনী। দৃশ্যটা নিশ্চয় তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। সে পাথরের মতো বসে থাকে।

—বল, বল ঝাঁপনী! থামলে কেন? ধারতি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। মুৎনী ছুটে কাছে এসে ঝাঁপনীকে ধরে পাগলের মতো ঝাঁকি দিয়ে বলে—রাজা-রাজা কোথায়?

তিনি কোথায় পড়ে আছেন জানি না। অনেক খুঁজেছি আমি। পাইনি। তবে তাঁর কথা শুনেছি প্রতিটি আহত চোয়াড়ের মুখে—আহত শত্রুর মুখেও।

—শত্রুরাও বলল? তুমি সত্যি বলছ ঝাঁপনী? ধারতি উৎসুক হয়ে ওঠে। ব্যথার পরিবর্তে আনন্দ ঝরে পড়ে তার কথায়।

—হ্যাঁ রাণী। বরাহভূমের এক সৈনিক মরার আগে জল চাইল। দেখে কেমন কষ্ট হল। জল এনে মুখে দিতেই সে শুধু বলল,—তোমাদের রাজাকে যদি আমরা পেতাম—

ধারতির মনের ভেতরটা তোলপাড় করে। পৃথিবীসুদ্ধ লোককে ডেকে শুনাতে ইচ্ছে করে তার কথা কয়টি।

—রাজাকে পেলে না? মুৎনী বলে ওঠে।

—না।

—আমি যাব।

—কোথায়? ঝাঁপনীর স্বরে বিস্ময়।

—রাজাকে খুঁজতে।

—পাওয়া যাবে না তাঁকে।

—আমি পাবোই। রাণী, আমি যাই।

—ছিঃ মুৎনী। আমি তো অমন করছি না। ওর দেহখানার ওপর আমার টান কি হঠাৎ কমে গেল?

—রাণী। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মুৎনী।

—জানি রে। তবু এখন যাওয়া হবে না তোর। আরও বড় কর্তব্য রয়েছে যে সামনে। সামান্য ভুলের জন্যে সব নষ্ট করবি শেষে। লালকে যদি খুঁজে পায় ওরা?

মুৎনী নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।

—শোন্ মুৎনী। রাজার দেহখানা সতেরখানির সবার কাছেই অতি আদরের। মনে হয় কোনো চোয়াড় লুকিয়ে রেখেছে। শত্রুরা চলে গেলে ভালোভাবে সৎকারের জন্য।

লালসিং কাঁদতে শুরু করে। তিনজনকেই উঠে দাঁড়াতে হয়। সারিগ্রামে না পৌঁছলে লালুসিংকে খেতে দেওয়া যাবে না। লালসিং-সারা সতেরখানির ভবিষ্যতের আশা-ভরসা।

.

রান্‌কো সারিগ্রামে এসে নতুন ঘর তৈরীর ব্যবস্থা করে গিয়েছিল লালসিং-এর জন্যে। সাধারণ কুঁড়েঘর—ধারতি অবাক হয়ে দেখে পারাউমুর্মুর কুঁড়ে ঘরের সঙ্গে আশ্চর্য সাদৃশ্য রয়েছে। হয়তো তার কথাই মনে হয়েছিল রাঙ্কোর—কারণ সে-ই থাকবে লালসিং-এর সঙ্গে। চেয়ে চেয়ে দেখে ধারতি।

রাত্রির জন্যে অপেক্ষা করে সে। আকুল হয়ে তখন সে নিশ্চিন্ত মনে কাঁদতে পারবে। ঠোঁট দুটো যদিও বারবার কেঁপে উঠছে—বুকে জমে রয়েছে অফুরন্ত বাষ্প। তবু অপেক্ষা করতে হবে।

আর একটু। সন্ধ্যে হয়ে এল। আর একটু রাজা। এখনো শেষ হয়নি আজকের কর্তব্য। লাল ঘুমোক্—মুৎনী আর ঝাঁপনীকে ঘুমোতে দাও আগে—তারপর।

রাজা—কাঁটারাঞ্জার কালোপাথরের রাজা। মায়াভরা সেই আয়ত চোখদুটোর স্বপ্ন যে স্বপ্নই থেকে গেল শুধু। ধাকা, পঞ্চসর্দারী, তিন সওয়া চেয়ে চেয়ে দেখেছে আজ বিধ্বস্ত সতেরখানিকে। তাদের মনে আজ কি প্রতিফলিত হচ্ছে কেউ জানে না। হয়ত দুঃখই পাচ্ছে তারা। তারা তো বরাহভূমের লোক নয়, সুপুর ধলভূমেরও নয়। সতেরখানির অধিবাসীদের মতো তারাও মহুল, জোনার আর কদুয়া খেয়ে অধ্যেক পেট ভরিয়ে দিনের পর দিন অমানুষিক পরিশ্রম করে চলেছে। তাদের ছেলেমেয়েরাও কথায় কথায় রোগে ভোগে—মারা যায়। সতেরখানির ব্যথা তারা মর্মে মর্মে বুঝবে। মুখে কিছু না বললেও মন থেকে তারা সবটুকু সহানুভূতি ঢেলে দেবে কিতাগড়ের ওপর। আর আফশোষ করবে এই ভেবে–সম্মানের জন্য আজ যে বিপর্যয় ঘটল ঠিক তার বিপরীত কিছু ঘটতে পারত, যদি সময়মতো পঞ্চখুঁটের চারখুঁট শক্তভাবে হাত মেলাতে পারত।

ধারতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

রাজা—এখনো সময় হয়নি। ঝাঁপনীর চোখে ঘুম নেই। শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে সে। তারও বুকে যে একই জ্বালা। সব জ্বালাটুকু তো সহজে যাবে না তার। হতভাগী মুৎনীও রাস্তার দিকে চেয়ে বসে রয়েছে এই ভর সন্ধ্যেবেলায়। সে বিশ্বাস করে না, তুমি নেই তার কচি মন হতাশার মধ্যেও আশা দেখাতে চায়। কাঁটারাঞ্জার লিপুর যেমন দেখতে চাইত একসময়ে। যদি পার সান্ত্বনা দিও ওকে।

আর যদি পার প্রতি রাত্রে একবার করে অন্তত দেখা দিও তোমার লিপুকে। শুনিও তাকে তোমার বাঁশের বাঁশী—যেমন শোনাতে শালবনের ছায়ায় বসে-যেমন শুনিয়েছিলে বিয়ের নিস্তব্ধরাতে রাশি রাশি ফুলের মধ্যে বসে। নইলে লালসিংকে দেখেও বুক বাঁধতে পারবে না সে।

সারিগ্রামের এক চোয়াড় ফিরে আসে দুদিন পর। সর্বাঙ্গে তার আঘাতের চিহ্ন। সেই আঘাত নিয়ে সে স্ত্রীর কাঁধে ভর দিয়ে অনেক কষ্টে রাণীর সামনে এসে উপস্থিত হয়।

—তুমি যুদ্ধ করেছ? কিতাগড়ে ছিলে? বলতে পার রাজা কোথায়? একদমে মুৎনী আকুল হয়ে প্রশ্ন করে চেয়ে থাকে আহত চোয়াড়ের মুখের দিকে।

লোকটি মুৎনীর দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টি ফেলে ক্লান্ত শরীরে কোনোরকমে হাতখানা উঠিয়ে আকাশের দিকে দেখায়।

—নেই। রাজা নেই?

চোয়াড়টি চুপ করে থাকে।

মূর্ছিত হয়ে পড়ে যায় মুৎনী। ঝাঁপনী ছুটে এসে তার মাথাটা কোলে তুলে নেয়। নিজে মেয়ে হয়ে সে বালিকার অন্তরের গোপন ব্যথার সন্ধান পেয়েছে অতি সহজেই।

চোয়াড়টি ধীরে ধীরে ধারতিকে বলে,—রাণীমা, রাজা মিশে রয়েছেন সতেরখানির আকাশে বাতাসে, পাহাড়ে, মাটিতে আর সুবর্ণরেখার জলে।

—পেয়েছিলে তাঁকে? সন্ধান পেয়েছিলে?

—আমি পাইনি, কিন্তু আর একদল চোয়াড় পেয়েছিল তাঁর দেহ। শত্রুরা যখন দেহখানাকে নষ্ট করার জন্যে প্রস্তুত সেই সময় দলটি ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিনিয়ে নিয়েছিল আমাদের রাজাকে। ওই রাত্রেই তারা বাটালুকা থেকে অনেক দূরে সুবর্ণরেখার ধারে শেষ কাজটুকু করেছিল।

চোয়াড়টি তার স্ত্রীকে ইঙ্গিত করতেই মেয়েটি আস্তে আস্তে আঁচল থেকে শালপাতায় জড়ানো কাঁচা মাটিতে তৈরী একটি গোলাকার পাত্র এগিয়ে দেয়।

বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে রাণী। এবারে কাঁদতে হবে। মুৎনী এখন দেখতে পাবে না। কিন্তু আরও যে জানতে হবে। রাজার কথা জানা হলেই সতেরখানির রাণীর সব জানা শেষ হয়ে যায় না। ধৈর্য ধরতে হবে তাই।

—রাণীমা, খুব কম লোকই জানে যে আপনি এখানে রয়েছেন। আমিও জানতাম না। যারা দাহকার্য শেষ করেছিল, তারাই আমি সারিগ্রামের লোক শুনে আমার হাতে অস্থি দিয়ে বলেছিল যে আপনি এখানে রয়েছেন। তারা রান্‌কো সর্দারের বিশ্বস্ত অনুচর। সর্দারের এইটুকু নির্দেশই ছিল শুধু তাদের ওপর যে রাজার দেহ যেন নষ্ট না হয়।

—ঝাঁপনী। তোমার রান্‌কো কত মহৎ একবার দেখ ঝাঁপনী। ধারতি কেঁদে ফেলে এতক্ষণে।

ঝাঁপনী রাণীর দিকে চেয়ে মুৎনীর মাথাটা ধরে আবেগে থরথর করে কাঁপতে থাকে।

চোয়াড়টি চুপ করে বসে থাকে। ঢুলতে থাকে কিছুক্ষণ।

শেষে একসময়ে চেঁচিয়ে ওঠে—রাণীমা, আর একটু শুনতে হবে।

ধারতি চোখ মুছে ফেলে। শুনতে হবে। সব শুনতে হবে। সে যে রাণী।

—বচ্ছিগাদা রাণীমা—বচ্ছিগাদার কথা।

—বচ্ছিগাদা!

—হাঁ বচ্ছিগাদা সুপুরের রাজা কিতাগড় লুঠ করলেন, কালাচাঁদ জিউকে তুলে নিলেন মন্দির থেকে—তবু সন্তুষ্ট হলেন না।

রাণীর বুকের ভেতরে আগুন জ্বলে ওঠে। সে আগুনে চোখের জল যায় শুকিয়ে। কঠোর স্বরে বলে—কালাচাঁদ জিউকে লুট করছেন সুপুররাজ?

—হাঁ। কিন্তু তাতেও আশা মেটেনি।

—কেন?

—লালসিংকে খুঁজে পাওয়া গেল না বলে। ভূঁইয়াবংশকে শেষ করা গেল না বলে। ক্ষেপে গেল তারা। তাই বচ্ছিগাদা—

—বচ্ছিগাদা।

—হাঁ। হুকুম হল শিশুরা যাতে এক ফোঁটা দুধও না পায়—লালসিং যাতে শুকিয়ে মরে তার ব্যবস্থা করতে হবে। আশেপাশের সমস্ত গ্রামের গোরু-বাছুর মোষ-ছাগল গৃহস্থদের বাড়ি থেকে টেনে বার করে এনে জড়ো করা হল বাটালুকার এক ঢিপির উপর।

—তারপর?

—তারপর বল্লম দিয়ে নিষ্ঠুরের মতো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারল তাদের। নিঃশব্দে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তারা, টু শব্দ পর্যন্ত করল না। শুধু বাছুরগুলো একটু ডেকে উঠেছিল, আর ছাগলগুলো! আমি শালগাছের ওপরে উঠে আগাগোড়া সব দেখেছি। দেখেছি ওই সব জল্লাদদের কাজ। জীবগুলো কেমন অসহায় ভাবে চেয়ে থেকে মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করছিল তাও দেখেছি।

—ওরা হিন্দু না?

—হাঁ, রাণীমা, ওরা হিন্দু। শুনি নাকি বৈষ্ণব। কিন্তু লালসিংকে যে গোরুর দুধ দেবার সম্ভাবনা আছে সে গোরু ওদের কাছে দেবতা নয়—অপদেবতা।

ধারতির চোখের পলক পড়ে না। সে দেখে চোয়াড়টির আহত স্থানগুলি দিয়ে নতুন রক্ত বার হয়ে আসছে। তার স্ত্রী ভীত হয়ে উঠেছে। স্বামীর মাথাটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরেছে সে।

—শোন বীর। তুমি সুস্থ হও। তারপর এসো এখানে। তোমাদের লালসিংএর ভার তো তোমাদের ওপর। তোমরাই ওকে মানুষ করে তুলবে। তারপর সময় যখন আসবে, চূড়ান্ত আঘাত হানবে শত্রুদের ওপর। বচ্ছিগাদার প্রতিশোধ—চাই-ই চাই।

—বচ্ছিগাদা আজ সবার মুখে রাণী। চিরকাল সবার মুখে থাকবে এ নাম। বাটালুকার ওই ঢিপিটা কুখ্যাত হল ও-নামে। সতেরখানির শিশুদের সমস্ত দুধ শুষে নিয়েছে ওই ঢিপি

—না, না। বাটালুকাকে আমি চিনি। সে বিশ্বাসঘাতক নয়। সে শুধু অসহায়। এত যে অত্যাচার, এর মধ্যেও শিশুরা বাঁচবে। মায়ের বুকের দুধের মধ্যে বাঘের দুধের শক্তি পাবে তারা। তারপর যেদিন তারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে প্রতিশোধ নেবে, সেদিন বচ্ছিগাদার ওই অসহায় ঢিপি সমস্ত দুধটুকু নিংড়ে বার করে দিয়ে নিশ্চিত হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *