কিতাগড় – ৩

পরদিন বাঘরায় সোরেণের সঙ্গে দেখা হয় ছুট্‌কীর।

—যাক, এসে গিয়েছে। আর একটু দেরী হলে এই বনের গাছগুলো আর দেখতে না।

—কেন, কি হল! ছুট্‌কী অবাক হয়।

—সব গাছ উপড়ে ফেলতাম। এখন থেকে বসে আছি নাকি!

—সকাল থেকে?

বাঘরায় হো হো করে হেসে ওঠে—সতেরখানির সর্দাররা কি অত ফেলনা? তাদের কত কাজ। সামান্য এক মেয়ের জন্যে অত সময় নষ্ট করার সময় কোথায়?

—আমি সামান্য?

—কে বলল সে কথা? বাঘরায় ঘাবড়ায়

—তুমিই তো বললে।

—না না। আমার কাছে তুমি অসাধারণ। কিন্তু সতেরখানির তুলনায়?

—সাধারণ। কৃত্রিম গাম্ভীর্যে ছুটকীর মুখ থমথম করে।

—এই দেখো। রাগ করলে? আর কখনো বলব না। মারাংবুরুর শপথ করছি।

—চুপ। ছুট্‌কী আঁতকে ওঠে।

—কেন?

—ও নাম মুখে আনো কেন? ভয় করে।

কিছুটা পথ এগিয়ে যায় তারা। কেউ আর কথা শুরু করতে পারে না। মনে মনে আফশোস করে বাঘরায়—কুক্ষণে মারাংবুরুর নাম মুখে আনতে গিয়েছিল।

শেষে একসময়ে ধীরে ধীরে প্রশ্ন করে বাঘরায়—ডুইঃ এসেছিল?

—হ্যাঁ। কালকে।

—ও।

—কেন? কিছু বলেছে? ছুট্‌কীর চোখে আগ্রহ।

—না। আজ সকালে শিকারে চলে গেল। বাঘ না মেরে ফিরবে না।

—কাকে সঙ্গে নিল।

—একা।

—একা বাঘ মারা যায় নাকি?

—ডুইঃ পারে।

বন্ধুর ওপর অগাধ বিশ্বাসটুকু ছুটকী লক্ষ্য করে। সে ভেবেছিল, কালকের ঘটনা বলবে বাঘরায়কে। কিন্তু তাতে সে শুধু আঘাতই পাবে। ডুইঃ যে কেন হঠাৎ শিকারে চলে গেল একথা জলের মতোই স্পষ্ট বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। অথচ বাঘ রায়কে বলার সাহস হল না তার।

—ডুইঃ একটা পাগল। অতবড় চেহারা, অমন সাহস—শক্তিও কত। কিন্তু সব সময় কিসের স্বপ্ন দেখে। আর গান বাঁধে।

—সত্যিই কি ওর নিজের তৈরি গান?

—হ্যাঁ। আমিও বিশ্বাস করতাম না আগে। তোমাকে শুনিয়েছে?

—অনেক। ছুট্‌কী অন্যমনস্ক হয়।

—ডুইঃ নিজের বাঁধা গান ছাড়া গায় না।

দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে ছুট্‌কী। কালকের চোখের জল আজকেও আবার যেন বার হয়ে আসতে চায়। ব্যথা অনুভব করে কিন্তু সে অসহায়। কিতাপাট জানেন তার মন। তবু বন্ধুগর্বে গর্বিত বাঘরায়ের উজ্জ্বল চোখের দিকে চেয়ে সে কেঁদে ফেলে।

—ওকি কাঁদছ কেন?

—ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি। শিকারেও সেই জন্যই গিয়েছে। এখানে থাকতে পারছে না!

—তবে তুমি—

—হ্যাঁ। তোমাকে—

—ডুইঃএর ভাগ্য খারাপ। বাঘরায় আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। দূরে খাঁড়ি পাহাড়ির উপর জমাট কালো মেঘ। এগিয়ে আসছে বাটালুকার দিকে। কিছুক্ষণ পরেই শুরু হবে শালগাছের দাপাদাপি। গাছ ভাঙার শব্দে। ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে লতাপাতা, পাখির বাসা—মরবে সাজারু, মরবে সাপ, ইঁদুর।

মেঘ দেখে চিনতে পারে বাঘরায় তার ধরন। সে ছুট্‌কীর হাত চেপে নিজের কাছে টেনে আনে।

—ঝড় আসছে।

—হুঁ। ছুট্‌কী বাঘরায়ের একেবারে কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়। তার মাথা বাঘরায়ের বুক স্পর্শ করে।

—আজ আর কিতাপাটের মন্দিরে যাওয়া হবে না। গেলে ভাল হত। ডুইঃএর জন্যে প্ৰাৰ্থনা করতাম। আমাদের জন্যেও—

বাঘরায় অভাবনীয় আনন্দের মধ্যেও দুঃখ অনুভব করে। নিজেকে কখনো ডুইঃএর চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে ভাবেনি—এখনো ভাবে না। অথচ জিতল সে।

শালবনের মাথা ধীরে ধীরে নড়ে ওঠে। দূত পাঠিয়েছেন পবন দেব। শুকনো পাতা ঝরতে শুরু করে।

—বাড়ি যাও ছুট্‌কী।

—তুমি?

—আমি যাচ্ছি খাঁড়ি পাহাড়ির দিকে। ডুইঃকে খুঁজতে হবে।

—সেকি? ভীষণ ঝড় উঠছে। দেখছ না কিরকম পাক খেতে খেতে এগিয়ে আসছে মেঘ? বাঘরায় হাসে—ডুইঃও তো পড়বে এই ঝড়ের মুখে।

ছুট্‌কী চুপ করে থাকে।

নাচন শুরু হয় সারা বনস্থলীতে। শুকনো পাতা ঘুরতে ঘুরতে আকাশে ওঠে। লালমাটিতে চারদিক ছেয়ে যায়। কিতাডুংরি পাহাড় আর দেখতে পাওয়া যায় না। বন্য জন্তুরা ছুটে চলে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। উড়ন্ত পাখীরা আছড়ে পড়ে গাছের ডালে।

ছুট্‌কী বাঘরায়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে-কিতাপাট সাক্ষী—তুমি ছাড়া আমার আর কিছু নেই।

—জানি, তবু আমাকে যেতে হবে ছুট্‌কী। আমার বন্ধুও আছে।

ধুলোর ঘূর্ণীর মধ্যে মিলিয়ে যায় বাঘরায় সোরেন।

ছুট্‌কী স্তব্ধ হয়ে সেদিকে চেয়ে থাকে।

.

বাঘ শিকার করা হয়নি ডুইঃএর। আঘাতের প্রথম চোটে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল সে। বন্ধুর সুখের পথে কাঁটার মতো বিরাজ করা লজ্জাকর বলে মনে হয়েছিল তার কাছে। আশু উপায় উদ্ভাবনের জন্য পাগল হয়ে ঘর ছেড়ে এসেছিল সে। সঙ্গে অবশ্য লোক দেখানো তীর ধনুক আর বল্লাম নিতে ভোলেনি।

দু’দিন উদভ্রান্তের মতো চলতে চলতে সে এসে পৌঁছেছিল, আমদা পাহাড়ি গ্রামে। তবুও সমস্যার সমাধান হয় না। বরং যত ভাবে ততই মনে হয়, বাটালুকা ছাড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সতেরখানি তরফকে সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। রাজার পাশে পাশেই থাকতে হবে তাকে আজীবন। অথচ তারই সামনে বাঘরায় আর ছুটকী ঘুরে বেড়াবে একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে—উৎসব পার্বণে কোমর জড়িয়ে ধরে পরম পরিতৃপ্তিতে নাচবে—এও যে অসহ্য। হ্যাঁ, অসহ্য। বন্ধুত্বের মর্যাদা দিয়েও একথা সে মন থেকেই বলতে পারে। ছুট্‌কীকে পর বলে ভাবতে তার প্রাণটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। যদিও বাঘরায়ের ওপর কিছুমাত্র ঈর্ষাও নেই তার।

ডুইঃ একটা পলাশ গাছের গোড়ায় বসে ভেবে চলে। দু’দিন কিছু খাওয়া হয়নি তার। থলির ভেতরে করে শূয়োরের মাংস নিয়ে আসার কথা মনেও হয়নি।

পেছন ফিরে খাঁড়ি পাহাড়ির দিকে দৃষ্টি ফেলে। অনেক দূরে—ঠিক মেঘের মতো দেখাচ্ছে ওর চূড়াটা। তারও আগে বাটালুকা। এই দুপুরে ছুট্‌কী কী করছে? গরুকে খেতে দিচ্ছে হয়তো। কিংবা ঘরের দেয়ালে আলপনা আঁকছে। জল আনতেও ছুটতে পারে। কাজ না পেলেই জল আনার অছিলায় বাড়ির বাইরে চলে আসে সে। শালবনের ধার দিয়ে ছোট ঝরণাটার পাশে এসে বসে থাকে চুপ করে।

ভাবতে গিয়ে বুকের ভেতরে ধ্বক করে ওঠে। বাঘরায় হয়তো গিয়ে মিলেছে ঝরণার ধারে ছুট্‌কীর সঙ্গে। তার সম্বন্ধেই হয়তো কথা বলছে দুজনা। ছুট্‌কী নিশ্চয়ই সব বলেছে। বাঘরায় ও বুঝেছে যে সে পালিয়ে এসেছে।

হঠাৎ দূরের একটা টিলার দিকে দৃষ্টি পড়ে ডুইঃএর। মানুষের ভীড় সেখানে। একটা তাঁবুও পড়েছে। চমকে ওঠে সে। একি যুদ্ধের আয়োজন—কিংবা উৎসব? এতবড় উৎসব হলে বাটালুকায় নিশ্চয়ই খবর পৌঁছত। রাজার অজ্ঞাতে কোনো উৎসবই হতে পারে না। তাছাড়া এরা তাঁবুই বা পেল কোথায়? কিতাগড় ছাড়া সতেরখানিতে তাঁবু নেই।

তীব্র কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে যাই ডুইঃ। পথে একজন লোক একমনে বসে ধনুকের ছিলা তৈরী করছিল। ডুইঃ তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।

—বসো। লোকটি গম্ভীরভাবে বলে। ডুইঃএর দিকে চাইবার প্রয়োজন বোধ করে না সে।

—ওখানে ভীড় কিসের ভাই?

লোকটি কোনো কথা বলে না। চুপচাপ নিজের কাজ করে চলে।

—আমার কথাটা শুনলে? ডুইঃ আবার বলে ওঠে।

তবু নিরুত্তর লোকটি। ছিলাটা মোলায়েম করার জন্যে খুব সূক্ষ্মভাবে হাত চালায় সে—যেন একটা কবিতা রচনা করছে। পাশে ধনুক ছিল। ডুইঃ সেদিকে চেয়ে দেখে। একটু আশ্চর্যই হয় সে। এত নিপুণ কাজ এই প্রথম দেখল। কিতাগড়ের অস্ত্রাগারেও এমন জিনিস আছে বলে মনে হয় না। একে বাটালুকায় নিয়ে যেতে পারলে রাজা ত্রিভন সিং নিশ্চয়ই খুব খুশী হবেন। এ-যুগের অর্জুন তিনি—ডুইঃএর সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। ধনুক তৈরির এমন লোক পেলে রাজা মাথায় করে রাখবেন।

কিন্তু বাটালুকার কথা মনে হতেই ছুট্‌কীর কথা বিরাট পাথরের মতো তার মস্তিষ্ককে আবার চেপে ধরে। মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে তার। খাঁড়ি পাহাড়ির ওপরে গিয়ে, সেখান থেকে যদি লাফিয়ে পড়া যায় তাহলে মৃত্যু অনিবার্য—কিন্তু তাতে ডুইঃ টুডুর নাম ডুববে। সর্দারের মৃত্যু ওভাবে হওয়া উচিত নয়। সুবর্ণরেখায় ডুবেও নয়।

লোকটি ছিলা প্রস্তুত করে ধনুকের সঙ্গে বাঁধে। ডান হাতের আঙুল দিয়ে একটা টঙ্কার দেয়।। শেষে আড়মোড়া ভেঙে আরামসূচক একটা শব্দ করে বলে—কি বলছিলে? ভীড়? তোমার কি মনে হয়?

ডুইঃ অবাক হয়। লোকটা তবে কালা নয়। কাজের সময়ে কথা বলাকে প্রয়োজন বলে বোধ করে না। স্বয়ং রাজা এলেও হয়তো বলত না।

সে প্রশ্ন করে—মহুয়া উৎসব নাকি?

—আর কিছুদিন যাক, টের পাবে কিসের উৎসব।

—তার মানে?

—নাগা সন্ন্যাসী। লোকটি পাশ থেকে একটা তীর তুলে নিয়ে ধনুকে লাগিয়ে ওপরের আকাশে ছুঁড়ে দেয়।

ডুইঃ টুডু চমকে ওঠে। নাগাদের কথা সে আগেও শুনেছে। রাজা হেমত সিংএর আমলেও এসেছিল তারা। খুব ধুরন্ধর আর যুদ্ধবাজ। পাকাপোক্ত একটা মতলব নিয়েই আসে তারা। রাজ্য জয় করায় উদ্দেশ্য হয়তো তাদের থাকে না। কিন্তু লুটপাটকে ব্রত বলে ভাবে। সেই সঙ্গে কিছু কিছু স্ত্রীলোকও অদৃশ্য হয়। মন্দিরও গড়ে তোলে বিনা অনুমতিতে। তাতে প্রতিষ্ঠা করে বিগ্রহ।

ডুইঃ ভাবে বাটালুকা ছেড়ে যাওয়া ভাগ্যে নেই। ফিরতেই হবে। রাজার কানে পৌঁছে দিতে হবে দুঃসংবাদ।

—তুমি এদের কখন দেখেছে ভাই।

—এই তো ভোরবেলা। রাত্রে গা-ঢাকা দিয়ে এসেছে ব্যাটারা। ওদের দেখেই তো ধনুক তৈরি করতে বসেছি।

—অতক্ষণ ধরে একটা ধনুক তৈরি করে লাভ? এখন যে অনেক ধনুকের প্রয়োজন। –তাও পারি, কিন্তু আমার একার জন্যে একটাই যথেষ্ট। এই যে রাস্তা দেখছ, গাঁয়ে যাবার এটাই একমাত্র পথ। ওই যে শালবন দেখা যাচ্ছে, রাতেরবেলায় ওরই একটার মাথায় উঠে বসে থাকব। কোনো কুমতলব যদি গাঁয়ে যাবার জন্যে পা বাড়ায় ওরা তাহলে একজনকেও আর আস্তানায় ফিরে যেতে হবে না।

—কিন্তু একা কতক্ষণ ঠেকাবে?

—যতক্ষণ পারি। লোকটি উদাস স্বরে বলে।

—তার চাইতে চল না আমার সঙ্গে কিতাগড়ে। আরও অস্ত্র তৈরী করে দেবে তুমি। চোয়াড় দলের হাতে শোভা পাবে সে-অস্ত্র। তোমার ধনুকের টংকারে নির্মূল হবে এরা।

—ইচ্ছে হয়। কিন্তু তা যে সম্ভব নয় সর্দার।

—আমাকে চেন তুমি? বিস্মিত ডুইঃ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।

—হ্যাঁ। কিতাডুংরির উৎসবে দেখেছিলাম এক বছর আগে। তুমিই না ধমকে উঠেছিলে আমার চোখে জল দেখে।

—ঠিক মনে পড়ছে না। ডুইঃ ভাবতে চেষ্টা করে।

—পড়বে না মনে। সামান্য ঘটনা কিনা। কিন্তু রাজার সেই বিচার আমার বুক ভেঙে দিয়েছে। ঝাঁপনী এখন বাটালুকায় সংসার পেতেছে। সেখানে কি যেতে পারি আমি? এখনো তো পাথর হয়ে যাইনি।

—সব কথা খুলে বল ভাই। রাজার কোন্ বিচার তোমার জীবনকে মাটি হতে দিল।

—সে বিচারেই রাজার হাতে খড়ি। আমি রান্‌কো কিস্‌কু। ঝাঁপনী আমারই ঘরে ছিল। সেখান থেকে, আমার বুক থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল ওরা। আমি ঘর ছাড়লাম।

এবারে ডুইঃএর মনে পড়ে। এক বছর আগের ঘটনা হলেও রাজা ত্রিভনের প্রথম বিচার বলে সে ভুলে যায়নি। রান্‌কো কিস্‌কুর সেদিনের মুখ তার স্পষ্ট মনে আছে। তারুণ্যে ঢলঢলে ছিল সে মুখ-চোখে সব কিছু অস্বীকার করার চাহনি। উদ্ধত মস্তকের ঝাঁকড়া চুল বার বার কেঁপে উঠেছিল। আরও মনে পড়ে কার অসহায় কান্নার কথা। চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়েছিল রান্কোর—সে কান্না ডুইঃএর কাছে কাপুরুষোচিত বলে বোধ হয়েছিল। সতেরখানির মূর্তিমান কলঙ্কের দিকে চেয়ে তার মস্তকে আগুন জ্বলেছিল। সেদিন তার চিৎকার কিতাডুংরির মন্দিরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরেছিল।

আর আজ? আজ তো রান্‌কোকে কাপুরুষ বলে মনে হচ্ছে না। শুকনো মুখ থেকে তারুণ্যের শেষ চিহ্নটুকু যেন অদৃশ্য হয়েছে। চিনতে কষ্ট হয়েছে তাই। কিন্তু সে মুখের প্রতিটি রেখার আঁকা রয়েছে এক বিরাট নিভৃত সাধনার স্বাক্ষর।

ডুইঃএর বুকের ভেতরে বাষ্প জমে ওঠে। সে রান্‌কোর হাত দুটো চেপে ধরে বলে, আমাকে ক্ষমা কর ভাই।

—সে কি সর্দার! ক্ষমা কেন?

—সেদিন তোমার চোখের জল দেখে আমি সহ্য করতে পারিনি। আজকে আমার চোখও শুকনো নেই।

রান্‌কো সর্দারের মুখের দিকে ক্ষিপ্রদৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তাইতো –এ মুখ তো তার অজানা নয়। কিছুক্ষণ ঝিম্ ধরে বসে থাকে সে। চেয়ে থাকে একটা উড়ন্ত বনুম্ বারাড়িং-এর দিকে। কাছের দুধিলোটা আর দাত্রার ঝোপের মধ্যে সে মধুর লোভে ঘুরে ঘুরে মরছে।

বহুক্ষণ সেদিকে চেয়ে থেকে সে ডুইঃএর দিকে ঘাড় ফিরিয়ে ম্লান হেসে বলে—বুঝেছি সর্দার।

ডুইঃ রান্‌কোর ধনুকটা দৃঢ়ভাবে ধরে বলে—তবু আমি ফিরে যাচ্ছি বাটালুকায়। দেশের কাছে আর সবই যে তুচ্ছ। তোমাকেও যেতে হবে তাই। ‘না’ ব’লো না।

.

মাথার খোঁপায় গুলাঞ্জের বাহার। বাহুতে বকুল ফুলের বালা, গলায় হাতির দাঁতের মালা—করপল্লবে ধরা রয়েছে প্রস্ফুটিত পরায়নী। অপেক্ষা করছে লিপুর—তীব্র ব্যাকুল অপেক্ষা নতুন নাম রাখবে ত্রিভন—সেই নামেই ডাকবে তাকে।

সূর্যের তেজ ধীরে ধীরে কমে আসে। শালগাছের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। লিপুর অপেক্ষা করে তবু। শালবনের মর্মর ধ্বনিতে যেন কান্নার আওয়াজ শুনতে পায় সে। পরায়নীর সতেজ মৃণাল অনেকটা হেলে পড়েছে, বকুল ফুলের সাদা রঙ ধীরে ধীরে হলদে হয়ে উঠছে। মাথায় চাঁপা ফুলের আগের গন্ধ আর নেই। লিপুরের পা ব্যথা করে! আর কতক্ষণ? চকচকে কালো পাথরটার ওপর হেলান দেয় সে। পিতামহীর রেশমের পুরোনো ওড়না দিয়ে আলগোছে মুখের ঘাম মুছে ফেলে। বড় যত্নের ওড়না। খাঁড়েপাথরের রাণী ওটা উপহার দিয়েছিলেন পারাউএর পুত্রবধূকে।

সে বোধহয় আর আসবে না। এই এক বছরে কখনো এমন হয়নি। কথা দিয়ে সে কথা রেখেছে। ঠিক যে সময়টিতে আসবে বলেছে তখনি ঘোড়ার খুরের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়েছে কাঁটারাঞ্জার পাথরে পাথরে।

নতুন নাম রাখার মানে লিপুর জানে। শুকোলের দিদির কাছে একবার গল্প শুনেছিল—তখন জেনেছে। অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতেই নারীকে নতুন নাম দেয় পুরুষ। সে অধিকারের একমাত্র পরিণাম পরিণয়।

সেদিন বোধহয় খেয়ালের বশে কথা দিয়ে ফেলেছিল ত্রিভন। পরে নিশ্চয়ই ভেবে দেখেছে। বুঝতে পেরেছে, এ অসম্ভব। কোনো চোয়াড় সর্দারের বাড়ীর মেয়ে রাণী হতে পারে না—অন্ততঃ হয়নি কখনো। তাছাড়া নরহরি বাবাজীকে বলতে শুনেছে সে, ধাকা আর পঞ্চসর্দারী তরফের রাজার কাছ থেকে প্রতি মাসেই দূত আসছে উপঢৌকন নিয়ে। দুই রাজারই মেয়ে রয়েছে।

অনুশোচনা হয় লিপুরের। ভুল করেছে সে। কিন্তু সে তো জানত না যে রাজার ছেলে বাঁশী বাজায়। তবু কিতাডুংরির সেই উৎসবের পর থেকে সে তো চেয়েছিল নিজেকে এই কালো পাথরের কাছ থেকে সরিয়ে নিতে। ও-ই হতে দেয়নি। রাজার মতো মেজাজ না দেখিয়ে আগের মতোই পাগলামী শুরু করেছিল। ভালোই লেগেছিল সেদিন। কিন্তু এই ভালোলাগাটাই যে শেষ কথা নয়—সেটুকু বুঝবার মতো বুদ্ধি তখনো হয়েছিল না তার। আজ হয়েছে। এই ভালো লাগা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হলে আত্মহত্যা ছাড়া দ্বিতীয় পথ নেই। দিনের পর দিন ঘোড়ায় চড়া শিখতে, ধনুক-হাতে তীর নিক্ষেপ করতে ঘর্মাক্ত রাজার মুখ মুছিয়ে দিতে যে উষ্ণ পরশ যে পেয়েছে, যে-উষ্ণতা তার রক্তের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে গিয়েছে। দেহের রক্ত ঠাণ্ডা হিম না হয়ে গেলে তা থেকে পরিত্রাণ নেই।

—এত তন্ময়?

চমকে ঘাড় ফেরায় লিপুর। ত্রিভন হাসছে।

—ঘোড়া কই? গলা কেঁপে ওঠে লিপুরের।

—আনিনি।

—আমাকে জব্দ করতে?

—ছিঃ। আজকের দিনে!

—সত্যিই নতুন নামে ডাকবে আমায়?

—হ্যাঁ, ধারতি?

—ধারতি?

—কেন, পছন্দ হল না!

—তুমি যে নামে ডাকবে—তাই পছন্দ। লিপুর হাতের পরায়নীর পাঁপড়ি গোনে।

ত্রিভনের বুকের ভেতরে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। এই মুহূর্তে যেভাবে কথা বলল লিপুর, এতদিনের পরিচয়ে সে-ভাব প্রকাশ পায়নি কখনো। সে চেয়ে দেখে কিশোরীর কালো মুখে লজ্জা-মধুর হাসি। জীবনে হঠাৎ একটা বড় ধাপ এগিয়ে না গেলে কিশোরীর মুখে এমন হাসি ফোটে না।

মুখ নীচু করে লিপুর। ত্রিভনের উজ্জ্বল পাদুকা তার দৃষ্টিতে পড়ে। অপূর্ব ভঙ্গীতে মাটিতে লুটিয়ে সে পাদুকা জোড়ায় মাথা ছোঁয়ায়। হাতের পরায়নী রাখে সেখানে। দুটি গুলাঞ্জ খসে পড়ে মাথা থেকে।

ত্রিভন দু’হাতে উঠিয়ে নেয় লিপুরকে। পদ্মফুলটি আবার তার হাতে তুলে দেয়। খসে-পড়া চাঁপা দুটি সযত্নে গুঁজে দেয় তারা খোঁপায়। মিষ্টি হেসে বাহুর বকুল ফুলের বালা মৃদু স্পর্শ করে। ঝুঁকে পড়ে তার ঘ্রাণ নেয়।

হঠাৎ ছিটকে দূরে সরে যায় আজকের ধারতি। ত্রিভনের নতুন স্পর্শে সে যেন প্রথম সত্যের আলো দেখতে পেল। চোখে মুখে ফুটে ওঠে নিদারুণ আতঙ্ক আর অসহায়তা। ত্রিভন রাজা—সতেরখানি তবক তার রাজ্য। সে তো সত্যিই কাঁটারাঞ্জার বাঁশীওলা নয়। তবে? তিনপুরুষ আগের এক সামান্য সর্দার বংশের মেয়েকে সে যদি নিজে থেকে একটা নামও দেয়। তার অর্থ কি আরও গভীর হতে পারে? না—না—এ মারাত্মক ভুল। এই ভুলকে মেনে নিয়ে কৃতাৰ্থ হয়ে সে কি শুধু আজীবন কোনো নাম-না-জানা লোকের সন্তান মানুষ করতে করতে আজকের ঘটনা স্মরণ করবে? না।

ত্রিভন? সে তো রাজা। রাজাদের কত খেয়ালই হয়। অনুগ্রহ করে নতুন নাম দিয়েছে তাকে। এর চেয়ে গভীরভাবে কিছুই হয়তো তলিয়ে দেখেনি। নাম রেখে সে যে সূচনার সৃষ্টি করল, তার পরিণতির কথা নিশ্চয়ই ভাবেনি। রাজবংশের কেউ কখনো তা ভাবে না।

লিপুরের মনের মধ্যে চিতা জ্বলে। ফাঁড়ি পাহাড়ির অরণ্যে যখন দাবানল জ্বলে উঠবে তখন তার মধ্যে নিজেকে সঁপে না দিলে এ আগুন নিভবে না।

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে।

—কি হল ধারতি? ত্রিভন বিহ্বল।

—কেন দিলে এই নাম। কি করব এ নিয়ে আমি? কোথায় যাব?

—কোথাও না।

—তবে? কেমন করে আমি সহ্য করব?

—আমি যেমন করে সইব। হাসি ফোটে ত্রিভনের মুখে।

—তুমি রাজা। তোমার রাজ্য আছে, চোয়াড় আছে—যুদ্ধ আছে। তোমার কত কাজ। তুমি রাণী পাবে—রাজারা মেয়ে দেবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছেন। আমি কি করব?—জল-ভরা চোখে সে ত্রিভনের দিকে চায়।

—তুমি? তোমার ঘর আছে—ঘরের কাজ আছে। তোমার কুঙ্‌কী আছে—যদিও সে অনেক বড়ো হয়েছে। এছাড়া আরও একটা জিনিস আছে। পারাউ সর্দারকে কেউ আগে থাকতেই বলে রেখেছে নিশ্চয়ই তোমার জন্যে।

কঠিন সত্যি কথা বলে দিয়েছে রাজা ত্রিভন সিং ভুঁইয়া। বাঁশীওলার কাছে এমন কথা শুনতে পাওয়া সম্ভব নয়। লিপুরের পা কাঁপতে থাকে। স্বপ্নকে স্বপ্ন বলে জানতে শুরু করেছিল মাত্র সেদিন থেকে—যেদিন বুঝল ত্রিভনের প্রতি তার আকর্ষণের একটা গভীর দিক রয়েছে। তবু তো স্বপ্নকে ভাঙতে দিতে চায়নি। নিজেকে ফাঁকি দিয়ে হয়তো মনে একটা আশা পোষণ করত—স্বপ্নও তো সত্যি হতে পারে।

আজ বুঝল, তা হয় না। যা সত্যি তাই সত্যি। দিনের আলোর মতো নির্লজ্জ স্পষ্ট। শালগাছের দোদুল্যমান পাতা সে আলোতে লুকোচুরি খেলতে সাহস পায় না। কাঁটারাঞ্জার শেষ প্রান্ত থেকে শুরু হয়েছে যে কঠিন অনুর্বর বিস্তীর্ণ মাঠ, তাতে সূর্যের আলো পড়ে যেমন কোনো বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে না—এও তেমনি।

লিপুর হাতের পরায়নী ফেলে দেয়। মাথার চাঁপাফুল তুলে নিয়ে পাগলের মতো ছিটিয়ে দেয় চারদিকে। কাজ নেই গুলাঞ্জের বাহারে। বকুলের বালা খুলতে খুলতে যখন সে ছুটতে শুরু করে তখন ত্রিভন দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে।

—না—না। আমি পারব না। আমাকে মরতে দাও।

—তুমি একেবারে পাগল ধারতি।

—ছেড়ে দাও, তোমার পায়ে পড়ি।

—কেন? ত্রিভন আরও শক্ত করে চেপে ধরে তাকে।

—আমাকেও যে তাহলে মরতে হয় ধারতি।

—কেন? ছিঃ, তুমি সুখে থাক।

—তুমি ছাড়া সুখ কই?

—এ তো দু’দিনের জন্যে।

—দু’দিন পরেও। চিরকাল—। ত্রিভনের চোখ নেমে আসে ধারতির চোখের ওপর।

—ন্-না। মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে অস্বীকার করতে গিয়ে সে অবসন্ন হয়ে পড়ে। চোখ ছাপিয়ে নতুন করে জল গড়িয়ে পড়ে।

—ধারতি, তুমি কি আমাকে নতুন করে চিনছ?

বুক চিরে ধারতির দেখাতে ইচ্ছে করে ত্রিভনকে সে চেনে কিনা। কিন্তু সবার ওপর সে রাজা। তাই তো গোলমাল হয়ে যায়।

ময়ুরের ডাক ভেসে আসে দূর থেকে। কাঠঠোকরা পাশের পলাশ গাছটাকে অবিশ্রান্তভাবে ঠুকে চলেছে। রৌদ্র সরে গিয়ে দূর প্রান্তরের গাছগুলোর মাথায় রাঙা হয়ে আটকে রয়েছে।

ধারতি ধীরে ধীরে বলে—চিরকাল?

—হ্যাঁ ধারতি।

—কিন্তু তা যে হয় না।

—হয় না ব’লো না—হয়নি। এবারে হবে।

—সবাই যে তোমাকে পাগল বলবে।

—বলুক।

—তোমার বিরুদ্ধে যাবে তরফের সবাই।

—না। তারা বুঝবে আমি তাদেরই মতন। রাজা হয়ে সিংহাসনে বসে দেবতা হয়ে যাইনি।

—কি জানি। আমার ভীষণ ভয় করছে।

—ভয়? আনন্দ হচ্ছে না?

—তোমার যদি কোনো অনিষ্ট হয়?

ত্রিভন হাসে। বলে-তুমি আছো। তুমি রক্ষা করবে। সবই তো শিখিয়েছি তোমাকে।

—আমি বুঝি সবার সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারি।

—দরকার হলে পারবে না?

ধারতির মুখে কেমন পাহাড়ী কঠোরতা দেখা যায়—প্রপাতের মতো যা সুন্দর অথচ ভয়ঙ্কর। সে দূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ধীরে ধীরে বলে—পারব।

সন্ধ্যা নেমে আসে। বাড়ীর কথা মনে ছিল না ধারতির। বৃদ্ধ পারাউ হয়তো নিজের কুঙ্‌কীকে টেনে উঠোনে এনেছে। গেল বছরের লাল রঙের বাছুরটা মরে যাবার পর কুঙ্‌কীর আর বাচ্চা হয়নি। পারাউ বলে, আর নাকি হবে না—বয়স নেই। কুঙ্‌কী বুড়ো হয়েছে। তার কালো গায়ের অনেক লোম সাদা হয়ে গিয়েছে। আগের মতো চমকে কালো আর দেখায় না তাকে।

—ধারতি, এর পর কয়েকদিন আমাদের দেখা হবে না।

—কেন?

—আমি বাইরে যাব। হয়তো যুদ্ধ করতে হবে।

—কোথায়?

—আমদা পাহাড়ীতে পাঁচশ নাগা সন্ন্যাসী এসে উপদ্রব শুরু করেছে। ভালো কথায় তারা যাবে না। আমার অনুমতি না নিয়ে বাঁধ খুঁড়তে শুরু করেছে।—অত্যাচার করারও চেষ্টা করছে। একি সহ্য করা যায়?

—না। ধারতির কষ্ট হয় ত্রিভন চলে যাবে শুনে। কিন্তু যুদ্ধ করবে শুনে আনন্দ হয়। যুদ্ধবিগ্রহ অতি সাধারণ জিনিস। এ সবে উৎসাহ দেওয়াই তাদের বংশের রীতি।

ত্রিভন ধারতির উত্তরে খুশী হয়। বলে তোমার কষ্ট হবে?

—হুঁ। খুব।

—তবে যেতে বলছে যে?

—যুদ্ধে যাবে না? তাই হয় নাকি? কিতাপাটকে প্রণাম করে যেও।

—তা যাবো। আমাদের কালাচাঁদ জিউকেও প্রণাম করব। কিন্তু তুমি আমাকে সাজিয়ে দেবে তো?

ধারতির চোখে জল আসে। বলে—আমি যে গরীব। কোথায় পাব রাজার সাজ!

ত্রিভন অপ্রস্তুত। এমন জবাব পাবে আশা করেনি। দু’হাত দিয়ে তার গাল দুটো চেপে ধরে বলে—এমনি ঠাট্টা করছিলাম। রাণী হয়ে সাজিয়ে দিও।

ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানায় ধারতি। তার মুখের দিকে চেয়ে আনন্দে ত্রিভনের বুক ভরে ওঠে।

—চল। বাড়ী যাবে।

কালো পাথর ছেড়ে দুজনে চলতে শুরু করে।

.

চোয়ার বাহিনীর জৌলুষ দেখতে বাটালুকার অধিবাসীরা পথের দু’ধারে ভেঙে পড়ে। কিতাডুংরির পাহাড় থেকে সেই যাত্রা শুরু হয়। অনেক পথ অতিক্রম করে আমদা পাহাড়ীতে তার শেষ হবে। কিতাপাটের মন্দিরে রাজ্যের ফুল এনে জমা করা হয়েছিল দেবতার পায়ে উৎসর্গের জন্য। সেই উৎসর্গীকৃত ফুল প্রতিটি চোয়াড়ের শিরস্ত্রাণ আর ঝাঁকড়া চুলে শোভা পায়। কপালে তাদের রক্তচন্দনের ফোঁটা।

তাঁবু, খাদ্য আর হাণ্ডীর কলসী নিয়ে প্রথমে চলে ভারবাহীর দল। দলটা বেশ বড়। অন্য রাজ্য আক্রমণের সময়ে এ-সবের প্রয়োজন হয় না।—পথ চলতে চলতে লুণ্ঠন করে সংগ্রহ করাই চিরাচরিত নিয়ম। নইলে সৈন্যদলের দ্রুতগতি বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে—বিশেষ করে জঙ্গলমহলের এই অংশে কিন্তু এ-যুদ্ধযাত্রা নিজেরই রাজ্যের মধ্যে নাগা সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে। লুঠপাটের প্রশ্ন ওঠে না এখানে। নাগারা বাইরের শত্রু। আমদাপাহাড়ীতে আস্তানা গেড়ে আশেপাশের অঞ্চলের দুর্গতি এনেছে ইতিমধ্যেই। রাজা ত্রিভনের সুস্পষ্ট নির্দেশ—দলের জন্যে যেন কানাকড়িও চাওয়া না হয় সে অঞ্চলের লোকদের কাছে। তাই এত আয়োজন। ভারবাহী দলের পেছনে বল্লমধারী সৈন্যরা চলেছে হই-হল্লা করতে করতে। এদের দলপতি বাঘরায় সোরেণ। তারপরেই তীরন্দাজের দল। এদের হাতের অধিকাংশ ধনুকই নতুন। রান্‌কো কিস্‌কুর নিপুণ হস্তের ছাপ তাতে। তিনদিন তিনরাত্রি না খেয়ে সে একটানা খেটে সৈন্যদের চাহিদা মিটিয়েছে। চারজন লোক অবশ্য তাকে সাহায্য করেছে। কিন্তু সে সাহায্য শুধু আয়োজনের। আসল কাজ রান্‌কোর নিজের হাতের। পুরস্কারও সে পেয়েছে। কিন্তু বুক আগের মতোই ফাঁকা তার। সৈন্যদের কেউ খোঁজ রাখে না—এমন কি রাজা ত্রিভন সিংও জানে না যে, নিস্পৃহভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করেও রান্‌কো নিজের সৃষ্টি সৈন্যদের হাতে কেমন শোভা পায়, তা দেখবার জন্যে ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে নেই। কিতাপাটের মন্দিরে যখন রাজ্যের সবাই সমবেত হয়েছিল—তার ঝাঁপানীও যখন অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অবাক বিস্ময়ে দেখছিল বিরাট সমারোহ, তখন রান্‌কো উদাসভাবে বাটালুকার পাথুরে মাটির পথ ধরে এগিয়ে চলছিল, সবকিছু পেছনে ফেলে সুবর্ণরেখার তীর বেয়ে।

তীরন্দাজের দলপতি ডুইঃ টুডু। হাতে ধনুক, পিঠে তৃণ আর কোমরে তরবারি। প্রায় সবার কোমরেই তরবারি। অনেক সময়ে তীর ধনুক কোনো কাজে লাগে না। তখন তরবারি নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। নইলে যুদ্ধে জেতা যায় না।

রাজা ত্রিভন-সিং চলছিল সবার পেছনে ঘোড়ায় চড়ে সবকিছু লক্ষ্য করতে করতে। যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে সে-ই যাবে সবার সামনে। দলপতি সে। ত্রিভনের উন্নত বক্ষ গর্বে আরও স্ফীত।

ভীড়ের অধিকাংশই শিশু ও স্ত্রীলোক। সৈন্যদলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিও তাই পথের দুই ধারে। কোথাও আড়চোখের চাহনি—মুচকি হাসি, কোথাও হাতের ইসারা। ত্রিভনের চোখ সবার ওপর ঘুরে ঘুরে ফিরছিল। শেষে এক মহুয়া গাছের গোড়ায় চোখ আটকে যায় তার। ভীড়ের পেছনে সবার অলক্ষ্যে ধারতি দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে একাকী। ঘোড়ার পিঠ থেকে ত্রিভন দেখলেও পদাতিকদের নজর যাবার উপায় নেই সেদিকে। মালা হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ধারতি। ত্রিভনের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই মালাটি গলায় পরিয়ে দেবার ভঙ্গি করে নম্রভাবে প্রণাম করে সে। বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে ত্রিভনের। এর চেয়ে বড় যুদ্ধসাজ সে চায়নি—কল্পনাও করেনি। তার মুখে হাসি ফোটে। ধারতির মুখেও সে হাসির সংক্রামণ। সে হাসিতে আনন্দের সঙ্গে বিষাদও মাখানো রয়েছে।

ডুইঃ টুডুরও নজর পড়ে সামনের দিকের এক জায়গায়। ছুট্‌কী দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে অপূর্ব সাজে সেজেছে সে। ডুইঃ লক্ষ্য করে বল্লমধারী সৈন্যরা পাশ দিয়ে যাবার সময় বাঘরায়কে দেখে হাতের ইশারা করে ছুট্‌কী। আর বাঘরায়ের পেশীবহুল হাতের বল্লমটা আকাশের দিকে অনেকটা উঠে যায়। বন্ধু তার ভাগ্যবান

মাথা নিচু করে ডুইঃ। সবার মতো জনতার দিকে উৎসুকভরা দৃষ্টি নিয়ে চাইবার কোনো কারণ খুঁজে পায় না সে। এত লোকের মধ্যেও নিজেকে বড় একা মনে হয় তার। শুধু তাকেই উৎসাহ দেবার অভিনন্দন জানাবার কেউ নেই ছুট্‌কীর কাছ দিয়ে যাবার সময় তার বুকের ভেতরটা ঢিপ্ ঢিপ্ করে। সে অন্যমনস্কের মতো বিপরীত দিকে চেয়ে থাকে।

—সর্দার।

চমক লাগে ডুইঃ-এর। ছুট্‌কী ডাকছে। চোখাচোখি হয়।

—তোমাদের অপেক্ষায় থাকব সর্দার। ছুট্‌কীর কণ্ঠস্বর যেন ভেজা-ভেজা। এই আর্দ্রতা নিশ্চয়ই বাঘরায়ের পাওনা। বড় বেশী কাতর হয়েছে ছুট্‌কীর মতো শক্ত মেয়েও।

—আজকের দিনে অমন অভিশাপ দিও না। সামনের দিকে এগিয়ে যায় ডুইঃ। ফিরে তাকায় না। তার কথায় ছুট্‌কীর মনে সাড়া জাগাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবু বিবেক তাকে বিব্রত করে। জবাবটা ওভাবে না দিলেও হত। বলতে পারত যে, বাঘরায়কে কখনো সে তার আগে বিপদের মুখে যেতে দেবে না। ছুট্‌কীর কথা ভেবেই যে সে শুধু বাঘরায়ের নিরাপত্তা চায় তা নয়—বাঘরায় তার বন্ধু।

বনজঙ্গলের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে একহাজার চোয়াড় বাহিনী যখন আচমকা এসে নাগা সন্ন্যাসীদের সম্মুখীন হল, তখন সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। তীরন্দাজের একঝাঁক তীর যখন তাদের কিছু লোককে আহত করল তখন তারা প্রথম বুঝল, যে আট দশজন নাগা বিচ্ছিন্নভাবে থেকে রাজসৈন্যের আগমনের ওপর নজর রাখছিল তারা কেউ-ই এই বন্য শিকারীদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। রক্ষা পেলে, এ-দুর্দশা হতো না। নাগা সন্ন্যাসীরা কৌশলী, বীর যোদ্ধা হলেও তাদের এ-অভিজ্ঞতা ছিল না যে জঙ্গলমহলের অধিবাসীদের অনুভূতি হরিণের চেয়েও তীব্র, এদের চোখ বন্য বেড়ালের চেয়েও তীক্ষ্ণ। অরণ্যের সামান্য অস্বাভাবিকতাও এদের নজর এড়ায় না। তবু হয়তো এক-আধজন ঠিক সময়ে এসে খবর দিতে পারত। কিন্তু আশেপাশের অধিবাসীরা নতুন রাজার অভিযানের কথা শুনেছিল দূরের এক হাটে। সেখানে ঢাউরা দেওয়া হয়েছিল চোয়াড় বাহিনীতে যোগ দেবার জন্যে, তাই এই কয়েকদিন উদ্‌গ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করছিল আর বাঘের মতো অনুসরণ করছিল প্রতিটি নাগাকে। রাজার বাহিনী এগিয়ে এলেই তারা এক একজনকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে টেনে বার করে উন্মাদের মতো পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। উন্মাদ তারা সাধে হয়নি। অজগর সাপের মতোই নির্বিরোধী আর শান্ত তারা। কিন্তু পেটের ক্ষিদে আর অত্যাচার কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। নাগা সন্ন্যাসীরা যতদিন ধরে এসেছে—জোর করে লুণ্ঠন চালিয়েছে। মন্দির প্রতিষ্ঠা করবে নাকি তারা। ফলে এর মধ্যেই ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব আর হাহাকার।

তীরবিদ্ধ হয়ে কিছু লোক পড়ে যেতেই নাগারা বুঝল, তাদের প্রথম কর্তব্য হল উন্মুক্ত টিলা থেকে সরে গিয়ে কিছুর আড়ালে আশ্রয় নেওয়া। যুদ্ধকে তারা ভয় করে না—ভালোবাসে। সামনাসামনি যুদ্ধ করার নেশা যথেষ্ট রয়েছে তাদের। কিন্তু তীরের সামনে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা আর মৃত্যুকে আদরে আহ্বান করা একই কথা। তারা জানে আড়ালে গেলে চোয়াড়রা এগিয়ে আসতে বাধ্য হবে। তখন যুদ্ধে লাফিয়ে পড়া অনেক সহজ। তীরন্দাজের কোনো কাজ থাকবে না সে সময়। দুই পক্ষ মিলে হবে একাকার। শক্তি পরীক্ষার প্রকৃত সুযোগ মিলবে তখন!

তবু দুশো গজ দূরে দণ্ডায়বান শত্রুসৈন্যেরা সংখ্যা দেখে তারা স্পষ্ট বুঝতে পারে, তাদের দলের একটি প্রাণীও আর বেঁচে ফিরে যেতে পারবে না। ধনুক থাকলে তবু লড়া যেত। বল্লম আর তরবারি এমন কিছু সহায়ক হবে না। নাগা সর্দার অনুতাপে মাথার চুল ছেঁড়ে। এ তারই কর্মফল। সন্ন্যাসীর বেশে একবছর আগে এসেছিল সে এ-দেশে। তখন মারাংবুরুর পূজারীর কাছ থেকে জেনে গিয়েছিল যে নতুন রাজা শুধু বাঁশীই বাজায়। কিন্তু সে যে অসি ধরতেও সমান ওস্তাদ একথা কে জানত? মারাংবুরুর পূজারীও একথা জানত না। হিমৎ সিং ভুঁইয়ার মৃত্যুর পর বাটালুকার ঘটনার দ্রুত পট-পরিবর্তনের কোনো সংবাদ সে রাখত না-রাখা প্রয়োজন বোধ করেনি। কাঁটারাঞ্জার শালবনের মধ্যে সে যখন কোনো পাশবিক বৃত্তি চরিতার্থের জন্যে উন্মত্ত তখন গাছের আড়াল থেকে দেখেছিল ত্রিভনের হাতে বাঁশী—শুনেছিল তার সুর। আর দেখেছিল ত্রিভনের পাশে এক কিশোরীকে, রাঙামাটির ছাপ যার সর্বাঙ্গে। মঙ্গলের চোখ ধ্বক ক করে উঠেছিল প্রতিহিংসায়। হেমৎ সিং-এর কাছে হেয় হবার আগুন তখনো তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারছে। তাই পিতার কর্মফল পুত্রের ওপরও যাতে অভিশাপের মতো গিয়ে পড়ে তার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে সে। দিকুদের চোখে আঙুল দিয়ে সে দেখিয়ে দিতে পারবে মারাংবুরুর হাতের শাস্তি কত ভয়ংকর—প্রত্যক্ষ। তবু সেদিন কিছু করতে সাহস পায়নি মঙ্গল। তবে চেষ্টা ছেড়ে দিল না। তারই পরিণাম নাগা-সর্দারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন

কিছু ভুল হয়েছিল মঙ্গলের। এতবড় একটা ষড়যন্ত্রের প্রস্তুতি হিসাবে আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল। তার কথায় বিশ্বাস করেই নাগা সন্ন্যাসীদের আজকের এই দুর্দশা। বাঁধ খননের জন্যে রাজার অনুমতির প্রয়োজন মনে করেনি তারা। এই অনুমতি না-চাওয়ার মধ্যে রাজাকে দ্বন্দ্বে আহ্বান করার ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। ভেবেছিল, বাঁশীওয়ালা রাজা ভয় পেয়ে চুপ করে থাকবে। বিনা বাধায় উঠবে মন্দির-বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হবে। ধীরে ধীরে সতেরখানি তরফ নাগা-সর্দারের করতলে যাবে। তারপর ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে একদিন মারাংবুরুর সঙ্গে সঙ্গে মঙ্গলকেও নিশ্চিহ্ন করে দিলেই হবে।

সন্ন্যাসী-সর্দার বুঝেছে কত বড় ভুল সে করেছিল। মঙ্গলকে অভিশাপ দিতে দিতে নাগা-সন্ন্যাসীদের ডেকে সে বলে—প্রস্তুত হও। মরতে আমাদের হবেই। তবে শিয়ালের মতো পালিয়ে যেতে যেতে মরব না। মারো আর মরো। আমাদের সম্মান রাখ। দেখাও এদের, দেবতার পূজা আর মন্দির প্রতিষ্ঠা করি যেমন, তেমনি বাহুবল আর সাহসেও কম যাইনে।

সন্ন্যাসীরা তরবারি নিয়ে হুংকার দিয়ে ওঠে। তারা বুঝতে পেরেছে, ভুল করে তাদের আগুনের মধ্যে এনে ফেলেছে সর্দার। কিন্তু এখন সে সমস্ত ভেবে লাভ নেই, সম্মানটাই বড় কথা।

সর্দার বলে—একচুল জায়গাও পেছু হটবে না। দাঁড়িয়ে লড়বে। দাঁড়িয়ে মরবে। মরার আগে ওদের অন্ততঃ দুজনকে খতম করা চাই। এই আমার শেষ আদেশ।

—আমাদের বিগ্রহ? ব্যাকুল হয়ে একজন প্রশ্ন করে।

—চুলোয় যাক বিগ্রহ! আমরা যদি মরি বিগ্রহও মরবে। কি হবে ভেবে! বৈষ্ণবদের মতো হাহুতাশ করা তোমার মতো নাগা সন্ন্যাসীর শোভা পায় না।

সর্দারের কথা প্রতিটি নাগার মস্তিষ্কে ঝংকার তোলে। সর্দার কি শেষে বিগ্রহের প্রতি অমর্যাদা দেখান?

দলপতি হয়ে দলের লোকের মনের অলিগলির সন্ধান জানা আছে সর্দারের। তার কথা সবার মনে কিভাবে কাজ করল মুহূর্তে বুঝে ফেলে সে। তাই কাষ্ঠহাসি হেসে বলে—দেবতাকে রক্ষা করবে মানুষ? তিনিই না রক্ষা করেন সমস্ত জগৎকে। আজ তাঁরই জন্যে তোমরা ব্যাকুল হয়ে পড়ছ? তাঁর কি হবে সে খবর তিনি জানেন সবচেয়ে ভালোই, তোমরা ভেবে কি করবে?

সন্তুষ্ট হয় সবাই। তিনশো তরবারি একসঙ্গে ঝনঝন করে ওঠে।

ত্রিভন সিং এগিয়ে যাবার আদেশ দেয়। সহস্র তীর ছুঁড়েও আর কোনো লাভ নেই।

বাঘরায় সোরেন লাফিয়ে রাজার সামনে এসে বলে—আমাকে আগে যেতে আদেশ দিন রাজা। আমার দল নিয়ে ওদের সাবাড় করে দিয়ে আসি।

ডুইঃ টুডু বাঘরায়কে থামিয়ে চিৎকার করে ওঠে—কখনো না। আগে আমি যাব। রাজা বাঘরায়ের আগে আমাকে যেতে দিন

ত্রিভন দুই বন্ধুর দিকে চেয়ে হেসে ওঠে—এখনো ঝগড়া সর্দার। চল একসঙ্গে যাই।

প্রতিবাদ জানায় ডুইঃ—ক্ষমা করবেন রাজা। আমার কিছু বলার আছে।

—বল।

—শত্রু হলেও ওরা যোদ্ধা। শত্রুকে সামনা সামনি যুদ্ধের সুযোগ দেওয়াই তো বীর রাজার কাজ। জানি, আমরা ওদের পিষে মেরে ফেলতে পারি। তবু ওদের বুঝতে দিন, সতেরখানির লোকেরা কাপুরুষ নয়। বছরের ছয়মাস আধপেটা খেয়ে থাকলেও শক্তিতে কম যাই না।

ত্রিভনের দৃষ্টিতে প্রশংসা ঝরে পড়ে। ডুইঃ-কে তার আলিঙ্গন করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সময় বড় কম।

সে বলে—তাই হোক। তাই হোক। তুমি আগে যাও ডুইঃ—তোমার দল নিয়ে।

সম্মুখে তরবারি রেখে আভূমি নত হয়ে রাজাকে প্রণাম করে ডুইঃ। তার সারা মুখে ফুটে ওঠে বিজয়ীর হাসি। বাঘরায়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে—চলি ভাই।

—সে আবার কি কথা?

—এমনি বলছি। চোখের জল মুছে ফেলে ডুইঃ সবার অজ্ঞাতে।

সামনে এগিয়ে গিয়ে ডুইঃ তরবারি উঁচু করে ধরে—সূর্যের আলোয় সেটা ঝকমক করে ওঠে। ইঙ্গিত করে সে নিজের দলকে।

ত্রিভন আর বাঘরায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে ডুইঃ-এর দল এগিয়ে যেতেই নাগা সন্ন্যাসীরা তাদের আশ্রয় থেকে বার হয়ে আসে। অস্ত্রের ঝনঝনানি ছাড়া বহুক্ষণ আর কিছুই ঠাহর করা যায় না। ধুলোয় ছেয়ে যায় সেখানকার আকাশ। আহতদের আর্তনাদ বাতাসে ভেসে আসে।

—কিছুই বুঝতে পারছি লা বাঘরায়। দুইদল মিশে যে একাকার হয়ে গেল?

—আমি যাব রাজা?

—না, অপেক্ষা কর। ডুইঃ ক্ষুণ্ণ হতে পারে।

বাঘরায় কিন্তু ছটফট করে। ডুইঃএর শেষ কথাটি যেন তার মনে সন্দেহের বীজ বুনে দিয়ে গিয়েছে। তাছাড়া বন্ধুর চোখে সে যেন জলও দেখেছে। হয়তো চোখের ভুল। হয়তো বা সূর্যের দিকে দৃষ্টি পড়ে অমন হয়েছিল। তবু অশান্ত হয়ে ওঠে সে। মনের মধ্যেই এই ধারণা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার যে নিজের ওপর প্রতিশোধ নিতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে ডুইঃ মরণের মুখে। বন্ধুর আনন্দের পথে কাঁটা হয়ে থাকতে চায় না।

—আমি যাই রাজা।

—না। ত্রিভনের স্বর দৃঢ়। দৃষ্টি তার যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে।

একজন চোয়াড়কে ছুটে আসতে দেখে তারা। ব্যাকুল বাঘরায় দৌড়ে যায় তার কাছে।

—কি খবর?

—ভালো বলব কি খারাপ বলব বুঝতে পারছি না সর্দার।

হেঁয়ালী রাখ, তাড়াতাড়ি বল। চঞ্চল হয় বাধরায়, চোয়াড়টি বলে—নাগারা প্রায় সবাই শেষ হয়েছে রাজা। একশোজনও বোধহয় বেঁচে নেই। কিন্তু আমাদের যে সর্বনাশ হল।

বাঘরায়ের হৃদপিণ্ড যেন থেমে যায়। দু’হাত দিয়ে নিজের বুক চেপে ধরে। না শুনেও সে বুঝতে পারে কী সে সর্বনাশ।

—কি হ’য়েছে। ত্রিভনের প্রশ্নে উদ্বেগ

সর্দার ডুইঃ টুডুর ডানহাতে কাটা পড়েছে।

বাঘরায়ের সামনে সমস্ত পৃথিবী ঘুরতে থাকে। সে বসে পড়ে মাটিতে।

কি করে হল? ত্রিভন অবিচল।

—সর্দার যে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নিজে হাতে কম করে তিরিশজনকে মেরেছেন। শেষে নাগা সর্দারকে খুঁজে বার করার জন্যে ক্ষেপে উঠলেন। আমি পাশে ছিলাম সব সময়েই। বাধা দিয়েছিলাম—ফল হল না। নাগা সর্দারকে খুঁজে বার করলেন শেষ পর্যন্ত। মরবার আগে সে আমাদের সর্দারের ডান হাতখানা নিয়ে গেল।

বাঘরায়! ত্রিভন ডাকে।

—আমাকে একা যেতে দিন রাজা—আমি একাই যাই। বাঘরায়ের চোখের জল গড়িয়ে পড়ে।

—না, আমিও যাব।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *