কিতাগড় – ৭

ধারতির কথাই ঠিক। ছেলে হয় তার। লাল সিং পৃথিবীর আলো দেখতে পায় কিতাগড়ের এক ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে। সতেরখানিতে আবার আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। প্রায় অর্ধেক পুরুষ সুপুর, ধলভূম আর বরাহভূমের সীমান্তে যুদ্ধ করলেও উৎসবে যেন ভাঁটা পড়ে না। ঢাউরা শুনে কিতাগড়ের চারপাশে ভীড় জমে। নাচে তারা, গায় তারা। টামাকতিরিও বাজিয়ে আনন্দ কোলাহল করে।

—দেখুন রাজা, সব দুঃখের মধ্যেও আনন্দকে ভুলি না আমরা। বুধকিস্‌কু জনতার দিকে চেয়ে বলে ওঠে।

—যে রাজা আমাদের গর্ব, সেই রাজার ছেলেকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে সতেরখানির সবাই। সারিমুর্মু বলে।

—লাল সিংকে দেখাবার ব্যবস্থা করতে হয়। ত্রিভন চিন্তিতভাবে বলে।

—হ্যাঁ। এই কিতাগড়ের ওপর মুৎনীর কোলে তাকে দেখাবার ব্যবস্থা করুন। সারিমুর্মু বলে।

—মুৎনী পারবে? ফেলে দেবে না তো?

—না রাজা। রাণীকে জিজ্ঞাসা করুন—তিনিও রাজী হবেন। ওর বুদ্ধি আর ব্যবহার সবই পরিণত। সারিমুর্মুর কথায় দৃঢ়তা।

—কি করে এত কথা জানলে সর্দার।

—ও তো আমার ওখানেই ছিল। তখন আরও ছোট ছিল। ছুট্‌কী ওকে কিতাগড়ে দিতে বলেছিল।

রাজপুত্রের দর্শন পেয়ে জনতা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। আরও জোরে বেজে ওঠে টামাক্ জনতার কলরব বৃদ্ধি পায়। গর্বিতা মুৎনীর কোলে ঘুমন্ত রাজপুত্র চমকে ওঠে। তার চারদিনের অভিজ্ঞতার মধ্যে এমন কখনো শোনেনি সে।

ঠিক সেই সময়ে একসঙ্গে বহুলোকের চিৎকার ভেসে আসে শালবনের আড়াল থেকে, যার ধার ঘেঁষে প্রধান সড়ক চলে গিয়েছে সতেরখানির সীমার দিকে।

কিতাগড়ের কলরব থেমে যায় সে চিৎকারে। রাজার মুখে কথা নেই। সর্দাররা মূক, জনতা নিশ্চল। কেউ বুঝে উঠতে পারে না, কিসের চিৎকার।

মুৎনীর কোলে লাল সিং ঘুমের মধ্যে হেসে ওঠে।

রাঙা ধুলো উড়তে দেখা যায় শালবনের ওপাশে। বিরাট জনতা এগিয়ে আসছে।

সর্দারদের মুখে দুর্ভাবনার রেখা। ত্রিভন লাল সিং-এর হাসি দেখছিল।

—রাজা? সারিমুর্মু বলে।

—বল সর্দার।

—কারা এরা?

—শত্রু নয়।

—কি করে বুঝলেন?

—লাল সিং হাসছে।

চুপ করে থাকে সারিমুর্মু। কপালের ওপর হাত রেখে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে—আপনার অনুমানই বোধ হয় সত্যি।

—কেন? বুধকিস্‌কুর মনে তখনো অস্বস্তি।

—শত্রু অমন জানান দিয়ে আসে না বুধ। বিশেষ করে যখন তারা প্রধান ঘাঁটি দখল করতে আসে।

—তবে কি আমাদেরই লোক? ফিরে এলো?

—তাই মনে হচ্ছে।

রাজপুত্রের দর্শনার্থী, জনতা একদৃষ্টে চেয়ে থাকে কিতাগড়ের ওপরের রাজা আর সর্দারদের মুখের দিকে। তারা দেখে-সেসব মুখে কোনো আদেশ লেখা নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা ক’রে তারা নিজেরাই সামান্য যে দু’চারখানা অস্ত্র সঙ্গে করে এনেছিল তাই নিয়ে সারিবদ্ধ হ’য়ে দাঁড়ায় কিতাগড়ের সামনে।

ত্রিভন হাত নেড়ে শান্ত হতে বলে তাদের।

দোলায়মান মন নিয়ে তবু তাঁরা দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবে রাজা তাদের শক্তিহীন জেনে নিরস্ত্র হতে বলছেন। কিন্তু তাদের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। শেষ রক্তবিন্দু শরীরে থাকা পর্যন্ত ঠেকাতে হবে শত্রুদের। বিনা বাধায় তারা এসে কিতাগড় দখল করবে সে যে মরণের চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক। বাঁকের মুখে এসে পড়েছে তারা। একটু পরেই দেখা যাবে। বাঁকটা খুবই কাছে। সবার মনে উদ্বেগ আর উত্তেজনা।

সহসা সারিমুর্মু চিৎকার করে ওঠে,—রান্‌কো—। আবেগে থরথর করে কাঁপে তার পরিণত দেহ।

তাই তো? সবার বিহ্বল চোখের দৃষ্টি আটকে যায় জনতায় সামনে রান্‌কোর ওপর। আরও এগিয়ে এলে দেখতে পাওয়া যায় রান্‌কোর মুখে উল্লাসের হাসি। এ-হাসি পরাজয়ের হাসি নয়। ত্রিভনের বুক দুলে দুলে ওঠে। রান্‌কোকে আলিঙ্গনের জন্যে উতলা হয় সে।

কিতাগনের জনতা রাজা আর সর্দারের মতোই আনন্দিত হয়। প্রথমে তারা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে কিন্তু পরমুহূর্তেই থেমে যায়। তারা দেখতে পায় রান্‌কো হাসতে হাসতে এলেও, যত বড় দল নিয়ে সে বিদায় নিয়েছিল, ঠিক তত বড় দল আর নেই। কে পড়ে থাকল সেই নির্বান্ধব দেশে? সবাই পড়ে থাকলে সান্ত্বনা ছিল। কিন্তু অধিকাংশই ফিরে এল। এলো না কে? এতদিনের বেঁধে রাখা অনেকগুলো বুক একসঙ্গে কেঁপে ওঠে।

রান্‌কোর দল প্রথমে শুধু রাজা আর সর্দারদেরই দেখেছিল। কিতাগড়ে নীচের ভীড় তাদের চোখে পড়েনি, তাই ভীড় দেখে থমকে দাঁড়ায় তারা। কোন দুঃসংবাদ? বাঘরায়ের দলের কোন দুসংবাদ কি এসে পৌঁছেছে তাদের আগে? কিন্তু তাহলে রাজা আর দুই সর্দারের মুখ খুশীতে অমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কেন? তবে কি কেউ আগে এসে জানিয়ে দিয়েছে তাদের আগমনবার্তা

একটু পরেই দুইদল মিশে এক হয়ে যায়, আসল খবর পায় রান্‌কোর দল। আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে তারা।

ভীড়ের মধ্যে হুটোপুটি লেগে যায়। ফিরে আসা চোয়াড় বাহিনীর মধ্যে আত্মীয়স্বজনকে খোঁজার তৎপরতা দেখা যায়।

ত্রিভন জানে হাসি আর কান্নার এক দৃশ্য দেখা যাবে এখনি। যুদ্ধে গেলে কি সবাই ফিরতে পারে? কখনো কি হয়েছে এমন পৃথিবীর কোথাও? যা এসেছে তাই যে কল্পনাতীত। এত ফিরবে বলে আশা করেনি কেউ। যারা এখনি ডুকরে কেঁদে উঠবে তারাও নয়।

কিতাগড়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে রান্‌কো গলা চড়িয়ে বলে—রাজপুত্রকে কি আমরা দেখতে পাবনা রাজা?

মুৎনী লালসিংকে কৌশলে একটু ঘুরিয়ে ধরে। কেঁদে ওঠে লাল সিং।

ভীড়ের মধ্যে কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। খবর পেয়ে গিয়েছে অনেকেই। মাটিতে গড়িয়ে পড়ে যুবতী, বৃদ্ধ, প্রৌঢ়া। তাদের লোক ফেরেনি। ফিরবেও না কোনোদিন। ঘর তাদের কতদিনের জন্যে অন্ধকার হয়ে গেল কেউ বলতে পারে না।

ত্রিভনের চোখে বাষ্প। মনে আবার সংঘাত সৃষ্টি হয়—দেশের সম্মানের জন্যে মৃত্যু বড়, না অপমান সয়ে শান্তিতে থাকাই বড়

—আসুন রাজা, সারিমুর্মু ডাকে। বাঘরায়ের কথা মনে পড়ে তার। ছুট্‌কীর স্বামী বাঘরায়। সে কেমন আছে কে জানে। অতদূর থেকে রান্‌কো ফিরে এলো, অথচ সে এলো না। সে তো প্রায় ঘরের দুয়োরের যুদ্ধ করছে। আগে তারাই ফিরে আসা উচিত ছিল। তবে সে নিশ্চয়ই বেঁচে রয়েছে। বেঁচে না থাকলে, দলের লোক ফিরে আসত।

বাঘরায়ের দলের দুজন মাত্র চোয়াড় একদিন ফিরে এসে দাঁড়াল কিতাগড়ে। সারিমুর্মুর কথা বন্ধ হয়। রান্‌কোর চোখে বিষাদ। বুধকিসকু বিচলিত। ত্রিভনের চোখে বিরাট জিজ্ঞাসা।

ধীরে ধীরে রাজার সামনে এগিয়ে যায় দুই চোয়াড়। থমথমে আবহাওয়ার মধ্যে আভূমি নত হয়ে রাজাকে প্রণাম করে।

—বাঘরায়? ত্রিভনের গলার স্বর অস্ফুট।

সারিমুর্মু আপ্রাণ চেষ্টায় সেই কথাটাই জানতে চায়। কিন্তু কে যেন তার টুটি চেপে ধরেছে। বুধকিস্‌কু আর রান্‌কোও তাই জানতে চায়, অথচ সাহস পায়নি। সারিমুর্মুর মাথাটা সামনে ঝুঁকে পড়ে। সে উপলব্ধি করে, রাজার প্রশ্নের যে জবাব মিলবে তা সে সহ্য করতে পারবে না—কিছুতেই নয়। বাঘরায় এরই মধ্যে সত্যিই যে তার সত্যি ছেলে হয়ে উঠেছে জানত না সে।

—তিনিই পাঠিয়েছেন রাজা।

—সর্দার? ত্রিভন চিৎকার করে ওঠে সারিমুর্মুর দিকে চেয়ে।

রান্‌কো ছুটে সারিমুর্মুর পাশে গিয়ে তাকে ঝাঁকিয়ে বলে—ওরা কি বলল, শুনেছ সদর?

—না। একটু ঘুম পেয়েছিল বোধ হয়।

—বাঘরায় পাঠিয়েছে ওদের।

দুজন চোয়াড়ের একজন বুক ফুলিয়ে বলে—সব যুদ্ধেই জিতেছি আমরা। সুপুররাজের রাজ্যে এনেছি অশান্তি। আমাদের রুখতে পারেনি কেউ। সর্দার আমাদের সবার বুকে অদ্ভুত সাহস এনে দিয়েছেন।

—বলিনি রাজা? বাঘরায় আপনার সেরা সর্দার? সারিমুর্মু এতক্ষণে আনন্দে ফেটে পড়ে।

—আমি জানি সর্দার।

—আমরাও জানি। রান্‌কো কথাটা বলে বটে, কিন্তু দুর্ভাবনা হয় তার বাঘরায়ের জন্যে। কিতাডুংরির পাহাড়ের ঘটনা মনে পড়ে তার। ঝাঁপনীর সঙ্গে উন্মত্তের মতো নৃত্যের সময় সহসা এক সময় বাঘরায়কে লক্ষ্য করেছিল সে। তার দৃষ্টিতে ছিল শূন্যতা। সে দৃষ্টির অর্থ খুবই পরিষ্কার

লোক দুটি বলে—সুপুররাজ আমাদের সঙ্গে সন্ধি করেছেন। ব্যবহারও করেছেন খুব ভালো। তাই বেশী কিছু করা গেল না।

—বাঘরায় ফিরল না কেন? তার লোকজন?

—তিনি ফিরবেন না। খবর পাওয়া গিয়েছে যে সন্ধি করলেও সুপুররাজ গোপনে বরাহভূমে দূত পাঠিয়েছেন। সব রাজা মিলে একজোট হবার চেষ্টা করছেন। সতেরখানির দিকে এগিয়ে আসবেন তাঁরা। সর্দার তাই দলবল নিয়ে লুকিয়ে রয়েছেন বরাহভূমের কাছাকাছি। সেরকম কিছু দেখলেই আবার আক্রমণ চালাবেন। যদি ঠেকাতে নাও পারেন, সংবাদটা অন্ততঃ পৌঁছে দেবেন কিতাগড়ে।

—তুলনা হয় না বাঘরায়ের। ত্রিভন বলে।

—বাঘরায় আমাদের গর্ব রাজা। বুধকিস্‌কু বলে ওঠে।

রান্‌কো বলে—সে আর দেশের মাটিতে পা দেবে না।

—কেন? ত্রিভনের প্রশ্ন।

—সারিমুর্মু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে রান্‌কোর মুখের দিকে।

—পৃথিবীতে তার কেউ নেই

—আমি আছি—ওর বাবা। সারিমুর্মু আধা-বিশ্বাসের স্বরে বলে।

—ওটা হল কথার কথা। ছুট্‌কী যেদিন থেকে নেই, বাঘরায়ও নেই সেদিন থেকে। এটাই হল আসল সত্যি।

একটা থমথমে আবহাওয়া নেমে আসে কিতাগড়ের দরবারে। রান্‌কোর কথাকে উড়িয়ে দিতে পারে না কেউ। ধ্রুব সত্যকে হৃদয়ঙ্গম করে বোবা হয়ে যায় সবাই। যে লোকটি দেশের জন্যে বিস্ময়কর কাজ করে চলেছে, সে একটি শক্তিমাত্র। বাঘরায় নয়!

চোয়াড় দুজনার একজন বলে—আপনার কথাই ঠিক সর্দার। আমিও যেন এখন বুঝতে পারছি। অনেক আগেই তিনি ফিরতে পারতেন—আপনারও আগে। লুঠ করে আমরা যা পেয়েছিলাম পনেরো দিনে সতেরখানি তা শেষ করতে পারত না। লুঠের মাল নিয়ে দলের সবাইকে ফিরে আসতে বললেন তিনি। সঙ্গে রাখলেন শুধু পাঁচজন চোয়াড়কে। বললেন, যুদ্ধ তাঁর শেষ হয়েছে—এবার শুধু সংবাদ পাঠাবার পালা। কিন্তু কেউ ছাড়তে চাইল না তাঁকে। অনেক বুঝিয়েও তিনি তাদের রাজী করাতে পারলেন না। তাই লুঠের মাল লুকিয়ে রাখতে হল পাহাড়ের এক গুহায়।

—কেউ আসতে চাইল না? সারিমুর্মু বলে। সে যেন বিশ্বাস করতে পারে না কথাটা।

—না।

—ঘরের কথা ভুলে গেল তারা? বুধ বলে এবারে।

—সর্দারের চোখের দিকে চাইলে আপনারাও ভুলতেন। তিনি তো মানুষ নন—সাধু। কালাচাঁদ জিউ-এর চোখ দেখেননি? ঠিক তেমনি চাহনি তাঁর। আমরাও আসতে চাইনি। জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু থাকব না। আবার ফিরে যাব।

সারিমুর্মু শিশুর মতো কেঁদে ওঠে।

ত্রিভন ধীরে ধীরে বলে—বরাহভূমরাজ যদি বাঘরায়ের মতো একজনকে পেতেন তাহলে হয়তো মুর্শিদাবাদ দখল করতে পারতেন।

সর্দাররা চিন্তিত। তারা ত্রিভনের কথার অর্থ বোঝার চেষ্টা করে। এর মধ্যে হঠাৎ মুর্শিদাবাদের প্রশ্ন ওঠে কেন ভেবে উঠতে পারে না। মুর্শিদাবাদ নামটা তাদের জানা। রাজার কাছ থেকেই জেনেছে। শুনেছে সেখানকার ওলট-পালটের কথা। সাদা মুখরা নাকি দখল করেছে সে রাজ্য—সমস্ত দেশটাই। কিন্তু অত বড় বড় কথা তারা মাথায় ঢোকাতে চায় না। মুর্শিদাবাদের যা-ই হোক—তাদের কিছু এসে যায় না। সতেরখানি বাঁচলেই তারা তুষ্ট। তারা জানে, যেখানেই যা ঘটুক না কেন, সতেরখানির দিকে হাত বাড়াবে না কেউ। বাড়িয়েছেন শুধু তাদের খুবই চেনা-জানা বরাহভূমরাজ। তাও আবার সেই ভণ্ড বৈষ্ণবটার প্ররোচনায়।

—সর্দাররা চুপ যে—।

—না, এমনি আপনার কথা শুনছি। রান্‌কো যেন লজ্জিত হয় একটু।

—কেন যেন আমি একটু বেশী ভাবি। তোমরা কান দিও না। আমাদের স্বার্থ শুধু সতেরখানি।

বাঘরায়ের লোকেরা বিদায় নেয়।

খাঁড়েপাহাড়িতে দাবানল জ্বলে উঠল একরাত্রে। সমস্ত পাহাড়টা যেন জ্বলেপুড়ে থাক্ হয়ে গেল। স্তব্ধ হয়ে চেয়ে দেখল সতেরখানির অধিবাসী। অমাবস্যার সে-রাতে খাঁড়ে পাহাড়ির আশেপাশে পূর্ণিমা। সে পূর্ণিমায় স্নিগ্ধতার পরিবর্তে প্রচণ্ড দাহ। বন্য পশুপক্ষীর আর্তনাদে দিগ্বিদিক প্রকম্পিত। বন্যবরাহ, বাঘ, হরিণের ছোটাছুটি গ্রামের রাস্তায়।

বরাহভূমের ইতিহাসে এতবড় দাবানলের কথা কেউ শোনেনি। সামান্য পাহাড়ের বনজ শক্তির পরিচয় দেন সেদিন বুঝতে পারল সবাই।

এরপর থেকে উৎপাত বেড়ে গেল বাঘ-ভালুকের। গরু মোষ খোয়া যেতে লাগল হরদম। ত্রিভন বিচলিত। সর্দাররা হতভম্ব।

রান্‌কো বলে—ওরা বরাহভূম রাজের পক্ষ নিয়েছে রাজা। আমাকে একদল চোয়াড় দিন!

—যুদ্ধ করবে নাকি? বুধ বলে।

—হ্যাঁ। যুদ্ধই তো। হয় মারতে হবে, না হয় তাড়াতে হবে।

—কি ভাবে তাড়াবে?

—টামাকের সাহায্যে। পঞ্চাশটা টামাক একসাথে বেজে উঠবে—সেই সঙ্গে একশো পুরুষের চিৎকার। টিকতে পারবে না ওরা। গাঁয়ের পর গাঁ তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে সীমান্ত পার করে দিয়ে আসব।

—তুমি সত্যিই বুদ্ধিমান রান্‌কো।

অভিযান চলে বন্য জন্তুর বিরুদ্ধে। একের পর এর গ্রাম এগিয়ে চলে তারা—রাতের অন্ধকারে। একশোটা মশালের আলোয় রহস্যঘন হয়ে ওঠে বন।

সাতদিনের মধ্যে সব অত্যাচার বন্ধ। নিশ্চিন্ত হয় প্রজারা। নিশ্চিন্ত হয় রাজা ত্রিভন।

সাতদিনের একটানা পরিশ্রমের পর ক্লান্ত রান্‌কো এগিয়ে চলে পারাউ মুর্মুর কুঁড়েঘরের দিকে—যেখানে এককালে দেশের রাণীর শৈশব অতিবাহিত হয়েছে।

কিতাগড়ে খবর এসেছে সুপুরের দল বরাহভূমরাজের সঙ্গে মিশতে চেষ্টা করছে। বাঘরায় খবর পাঠিয়েছে। বিশ্রাম নেই—রান্‌কো ভাবে হয়তো আর মিলবে না বিশ্রাম

রান্‌কো আঙিনায় এসে দাঁড়ায়। দাওয়ার দিকে চেয়ে চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। ঝাঁপনী বসে ছিল দাওয়ার ওপর। রান্‌কোকে দেখে ম্লান হাসি হাসে সে। যুদ্ধ থেকে ফেরার পর ছয়মাস কেটেছে, রান্‌কো দেখা করেনি তার সঙ্গে। সুযোগ পায়নি।

—সালহাই যদি টের পায়?

—সেজন্যে যাওনি বুঝি এতদিন?

—হাঁ।

—তুমি ভীতু। কাপুরুষ।

—তোমার খুব সাহস।

—হ্যাঁ। তোমাদের চেয়ে। এতদিনে চিনতে পারলেন না?

—খবর কি বল। দেখে তো মনে হচ্ছে—

ঝাঁপনীর মুখ রাঙা হয়ে ওঠে। সে খুঁটি ধরে উঠে দাঁড়ায়। শরীর ভারী। জোর করে হেসে বলে—তাই, কি হয়েছে?

—কিছু না। এমনি।

—চোখ দুটো অমন নিভে গেল কেন?

—তোমার কষ্ট দেখে। এত কষ্ট করে হেঁটে এসেছ দেখে মায়া হচ্ছে।

—আর কিছু না?

—পথ রেখেছ?

ঝাঁপনী নিজের হাত কামড়ায়। সালহাই এর ওপর রাগে তার সর্বাঙ্গ জ্বলতে থাকে। বিধুয়া হেঁড়েলটা শুধু একটা জিনিষই জানে। ঠিক যেন এক ধেড়ে শুয়োর। সারাদিন খায়দায় আর গড়াগড়ি যায়।

—চল ঝাঁপনী পৌঁছে দিয়ে আসি।

কেঁদে ফেলে ঝাঁপনী। প্রথমে আস্তে আস্তে। তারপরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। রান্‌কো তার পিঠের ওপর হাত রাখে!

—না। ঝাঁপনী হাত সরিয়ে দেয় পিঠ থেকে।

—কেন?

—আমার দোষ? তুমি শুধু আমার দোষ দেখো। পৃথিবীর সবাই তাই দেখে। আমি কি করব বলতে পারো?

—কিছুই করবে না। অন্যায় তো করোনি।

—হ্যাঁ করেছি। কী অন্যায় করেছি জানি না। তবু মনে হয় করেছি।

—মাথা খারাপ হয়েছে তোমার। চল।

একটু শান্ত হয় ঝাঁপনী। চোখের জল মুখে ফেলে বলে—তুমি আবার যাবে নাকি?

—হ্যাঁ। আমাদের এখন বিশ্রাম নেই ঝাঁপনী। বাঘরায় খবর পাঠিয়েছে। নতুন খবর।

—সে কি করছে ওখানে? খবর না পাঠিয়ে নিজে লড়ুক।

—ছিঃ ঝাঁপনী, অমন স্বার্থপরের মতো কথা বল না। আট মাস বনে-জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে শত্রুদের বাধা দিয়ে আসছে বাঘরায়। নইলে অনেক আগেই বড় যুদ্ধ বাধত। বাঘরায়ের দলের লোক কমে এসেছে। অসুখ-বিসুখ আর উপোসে পরের জমিতে দাঁড়িয়ে কতদিন বাধা দেওয়া যায়? তবু সে সময়মত খবর পাঠিয়েছে।

আর কিছু বলতে সাহস পায় না। ঝাঁপানী। বলে লাভ নেই। ইচ্ছে হচ্ছিল তার, রান্‌কোকে দুহাত দিয়ে চিরকালের জন্যে বন্দী করে রাখে। মরলে দুজনা একসঙ্গে মরবে। দুজনার বাহুবদ্ধ মৃতদেহ দেখে সবাই বুঝবে কি ছিল তারা। রাজা ত্রিভনের বিচারকে কিভাবে তুচ্ছ করেছে।

রান্‌কো ঝাঁপনীর হাত ধরে বাড়ীর বাইরে নিয়ে আসে। দূরে খাঁড়ে পাহাড়িকে দেখা যাচ্ছে ধূসরবর্ণ। কিছুদিন আগেও ওটা ছিল ঘন সবুজ। মারাংবুরু কি জেগে উঠলেন আবার?

.

ধারতি অন্যমনা। সম্মুখে শিশুপুত্র লালসিং হামা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তবু লক্ষ্য নেই। সে বেশ বুঝতে পারে একটা অনিবার্য দুঃসময় এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। খাঁড়ে পাহাড়ির দাবানলের মতো আর একটা ভীষণতম দাবানল গ্রাস করতে ছুটে আসছে সমগ্রী সতেরখানি তরফকে রক্ষা নেই কারও। মানুষ তো পশু নয়। পশুর মতো পালিয়ে যেতে পারে না। কেউ আগুনের হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্যে। সেটা ভীরুতা। আর এই দাবানলের প্রথম আহুতি হবে কিতাগড়ের রাজপরিবার। ধারতি ত্রিভনকে চেনে,—নিজেকেও। লালসিং কেঁদে ওঠে। হাঁ করে কাঁদে সে। দাঁত দিয়ে নিজের জিভ কামড়েছে বোধ হয়। মুৎনী পাশে কোথাও ছিল। ছুটে এসে কোলে নেয় তাকে।

মুৎনীর দিকে চেয়ে থাকে ধারতি। আশ্চর্য মেয়ে। দেখতে পাওয়া যায় না তাকে, অথচ তার উপস্থিতি অনুভব করা যায় প্রতিটি মুহূর্তে। ছায়ার মতো সঙ্গে সঙ্গে ফেরে। ধারতি অবাক হয়ে দেখে, বেশ বড় হয়েছে মুৎনী। এতদিন চোখেই পড়েনি। সুন্দর ডাগর হয়ে উঠেছে। এই বয়সেই কাঁটারাঞ্জায় প্রথম ঘোড়ার পিঠে উঠেছিল সে। মুৎনীর কি সে অনুভূতি হয়েছে?

ত্রিভন এসে সামনে দাঁড়ায়। রাজার মুখ যেন দিন দিনই বিষাদে ভরে উঠেছে। এ-বিষাদ অকারণ নয়। তাই কখনো কোনো প্রশ্ন করেনি সে।

—তুমিও শেষে ভাবতে সুরু করলে ধারতি।

—না ভেবে থাকতে চেষ্টা করি—পারি না। একটু থেমে ধারতি আবার বলে,–একটা কাজ করলে কেমন হয় রাজা।

—বল।

—ওরা এগিয়ে এলে শুধু তুমি আমি আর লালসিং গিয়ে বাধা দেব ওদের। প্রতিহিংসা গ্রহণের সুযোগ পেয়ে ওরা সতেরখানিকে আর নষ্ট করবে না।

—সেকথা যে আমি ভাবিনি—তা নয়। কিন্তু সে শুধু কল্পনা। সতেরখানিকে তুমিও জান, আমিও জানি। রাজাকে তারা শেষপর্যন্ত নেপথ্যে রাখার চেষ্টা করবে। দেখলে না, রান্‌কোর কৌশল? যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়েও যেতে পারলাম না। ছুটল সে আগে ভাগে।

ধারতি চুপ করে থাকে। ত্রিভন ঠিক কথাই বলেছে। এতক্ষণ সে শুধু অলস কল্পনাই করে চলেছিল। যা অসম্ভব তা ভাবা বাতুলতা। সতেরখানির একটি প্রাণীও রাজাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে ঘরের কোণায় লুকোবে না।

—বাঘরায় কি আর কোনো সংবাদ পাঠিয়েছে রাজা?

—না। বেঁচে আছে কিনা তাও বুঝছি না। একটা বড় রকম ঝুঁকি নেবে বলে জানিয়েছিল। বরাহভূমের রাজধানী আক্রমণ করবে রাতের অন্ধকারে।

—তুমিও কি সর্দারের সঙ্গে সঙ্গে পাগল হলে। এ যে অসম্ভব।

—কিন্তু বাধা দেব কেমন করে? সে তো কারো কথাই মানবে না। তা ছাড়া এক জায়গায় তো থাকে না বাঘরায়। রান্‌কো আগেই চলে গিয়েছে। নইলে বলে দিতাম তাকে খুঁজে বার করতে। অবিশ্যি দেখা হলে সে এমনিতেই ধরে রাখবে বাঘরায়কে।

—রান্‌কো সর্দারের এ অভিযানের উদ্দেশ্য কি?

—সে তার চোয়াড়দের ছোট ছোট দলে ভাগ করে ছড়িয়ে দেবে সীমান্তে। তারা তীক্ষ্ণ নজর রাখবে। শত্রুরা এলেই যাতে আমি সংবাদ পাই।

—লাভ হবে কি খুব?

—যতটা হয়। কিতাগড়ের পতন কিছুটা বিলম্বিত হবে।

—কিতাগড়ের পতন কি অনিবার্য?

—হ্যাঁ। মনকে প্রবোধ দিয়ে লাভ নেই। একটু ভুল আমি করেছিলাম। ভেবেছিলাম এই সব রাজারা একজোট হবে না কখনো। ছোটখাটো ব্যাপারে তাদের ঝগড়া বেধেই ছিল। এখন দেখছি এরাও একজোট হতে পারে।

—যদি সন্ধি কর?

—-বলছ?

—না। এমনি কথার কথা। যদি সন্ধি কর তবে কি তারা শান্ত হবে?

—না। প্রতিশোধ নেবেই তারা। নরহরি আছে ইন্ধন যোগাতে।

—আমারও তাই মনে হয়।

—তুমি কি সন্ধির কথা ভেবেছ?

—মাত্র একবার ভেবেছি। কাল লালসিংকে ইচ্ছে করে না খাইয়ে রেখেছিলাম। প্রথমে সে জেদের কান্না কাঁদল। খেতে পাওয়াটা যেন তার অধিকার। তাও যখন পেলো না, তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। দেখে বড় কষ্ট হয়েছিল। শুধু সেই সময়ে একবার ভেবেছিলাম সন্ধির কথা।

—তুমি সাংঘাতিক মেয়ে লিপুর।

—কী?

—লিপুর।

—হঠাৎ?

—বলতে পারি না।

—কাঁটারাঞ্জার কথা তোমারও মনে পড়ছে তবে!

—হাঁ। সব সময়।

—আমারও। তখন লালসিং ছিল না। তোমার রাজ্যও ছিল না। শুধু ছিল তোমার বাঁশীটা।

—আর? লিপুর ছিল।

মুৎনী ফিরে আসে। লালসিং-এর কান্না থেমেছে। তাকে সামনে রেখে আবার মিলিয়ে যায় মুৎনী। অপেক্ষা করে আড়ালে। ঠিক সময়ে আবার আসবে।

সামনে এলো সে কিছুক্ষণ পরেই। ত্রিভনের পায়ের দিকে চেয়ে বলে—সর্দার বুধকিস্‌কু দেখা করতে চান।

—বুধকি? এসময়ে?

—জরুরী দরকার।

বুধকিস্‌কুকে রীতিমত উত্তেজিত বলে বোধহয়। পিঠের ওপর দুহাত ফেলে সে দ্রুত পায়চারী করছিল।

—কি হয়েছে সর্দার?

—সর্বনাশ।

—এগিয়ে আসছে বরাহভূম? বাঘরায় পারেনি ঠেকাতে?

—বরাহভূম নয়। যারা একা এগোবে বলে কখনো মনে হয়নি—তারাই। শ্যামসুন্দরপুর আর অম্বিকানগরের রাজারা সীমান্তে এসে পড়েছেন। রান্‌কোর দলের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধেছে। ঠেকিয়ে রেখেছে রান্‌কো।

—কোথায় খবর পেলে?

—লোক এসেছে। আহত সে। বদ্যি রাজু পাঁওলিয়ার বাড়ীতে তাকে পাঠিয়েই আমি চলে এসেছি।

—হুঁ। শ্যামসুন্দরপুর আর অম্বিকানগর বোধহয় ‘সুখনিদির’ কথা ভুলে গিয়েছে। বাবা বৈষ্ণব হয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলেন বলে আমি চালু করিনি।

—ভালো ব্যবহার করার দিন আর পৃথিবীতে নেই রাজা। কবে দেখবেন হয়তো ধাক্কা, তিনসওয়া আর পঞ্চসর্দারীও এগিয়ে আসছে।

—এ সময়ে অন্ততঃ তারা আসবে না। পঞ্চখুঁটের তিনখুঁট তারা। তারা জানে সতেরখানিকে এভাবে পেছন থেকে ছোরা মারলে, তারাও বাঁচবে না। বরাহভূমরাজ সবকয়টি তরফই কুক্ষিগত করে নেবেন।

—তবে তারা আমাদের সাহায্য করছে না কেন?

—বরাহভূমের বিরুদ্ধে যেতে চায় না তারা। ওদের কেউ আমাদের মতো অবস্থায় পড়লে আমরাও হয়তো যেতাম না সাহায্যের জন্যে।

—কিন্তু এখন কি করবেন রাজা।

—যুদ্ধ করব। আমার সঙ্গে তুমি যাবে। সুখনিদির ব্যবস্থা আবার করতে হবে। রান্‌কোর দলে মিলে আমি দুই রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করব। তুমি সেই সুযোগে তাদের রাজ্যে ঢুকে পড়বে। এতক্ষণে বুধকি হেসে ওঠে। তার চোখদুটো চক্‌চক্ করে ওঠে। সে বলে—আমি চলি রাজা। প্রস্তুত হয়ে নি। চোয়াড়দের ডাকতে হবে।

—কত লোক আছে এখন?

—আজই সে হিসেব করেছি। তিনশ সত্তর।

—অনেক আছে। যাও।

ত্রিভন ফিরে আসে আবার ধারতির কাছে। ধারতি তখনো একইভাবে চুপ করে বসেছিল।

—বিদায় নিতে এলাম রাণী।

—কেন?

—যুদ্ধে যাচ্ছি।

—আমার ওপর কিছু নির্দেশ আছে?

ত্রিভন হেসে ফেলে বলে—না, সেদিন এখনো আসেনি।

—তবে কি বরাহভূমের রাজারা আসছেন না?

—না। ত্রিভন সমস্ত ঘটনা খুলে বলে।

—এই রাজারা কেন আসছেন?

—মনে হয় বাঘরায়ের জন্যে বরাহভূম-রাজ এগোতে পারছেন না। তাই গোপনে শ্যামসুন্দরপুর আর অম্বিকানগরে খবর পাঠিয়েছিলেন। এরা আমাদের আক্রমণ করলে তাঁর সুবিধে হবে।

—এখনি যাচ্ছো নাকি?

—বুধকিস্‌কু ফিরে এলে।

—চল। ধারতি উঠে দাঁড়ায়।

—কোথায়?

যুদ্ধের সাজে সাজিয়ে দেব। এর পরে নিশ্চয়ই আর সুযোগ পাবো না। এবার তবু একটু সময় আছে।

ত্রিভন রাণীকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলে—আমারও সেই সাধ ছিল মনে মনে।

—নাগা সন্ন্যাসীদের সঙ্গে যুদ্ধে যাবার সময় একটা ফুলের মালা গেঁথেছিলাম।

—দেখেছি আমি।

—সেটা এখনো রয়েছে। শুকিয়ে গিয়েছে।

—আশ্চর্য।

—আশ্চর্য কেন? ফেলে দেব?

—না। তা বলিনি।

কিছুক্ষণ নীরব। দুজনের মনে একই স্মৃতি।

—বিয়ের দিনের কথা মনে আছে? ধারতি বলে।

—হুঁ ।

—তীর ছুড়তে ছুড়তে তুমি এগিয়ে যাচ্ছিলে, আর সেই তীর কুড়িয়ে এনে আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম। আমার মাথায় ছিল কলসী। এতদিনে সার্থক হল। বুড়ো দাদু দেখছে ওপর থেকে।

—আমাকে যুদ্ধে পাঠাতে এত সাধ তোমার সেকথা আগে তো বলনি ধারতি।

—সাধের কথা কখনো মুখ ফুটে বলতে হয়?

—অনেক আগে আমি চলে যেতাম এমন জানলে।

—তখন তো যাবার প্রয়োজন হয়নি। বাঘরায় আর রান্‌কোর মতো সর্দার থাকতে কেনই বা যাবে তুমি?

—তবু যেতাম।

—পাগলই আছো এখনো।

—ত্রিভন হাসে।

সুখনিদি। সুখে নিদ্রা যাবার আশ্বাস পেয়ে শ্যামসুন্দরপুর আর অম্বিকা নগরের অধিবাসী ত্রিভনের পিতা হেমৎ সিংকে প্রতি বছরে কিছু টাকা তুলে দিত। সেই টাকা পেতেন বলেই খুব অভাবের সময়ও রাজ্য দুটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেননি তিনি। তবে তিনিই আবার সুখনিদি কর বন্ধ করে দেন। বৈষ্ণব হয়ে এসবকে নোংরামি বলে মনে হয়েছিল তাঁর। তাঁর মৃত্যুর পর সর্দার সারিমুর্মু কথাটা তুলেছিল আবার। কিন্তু ত্রিভন চায়নি জিনিসটাকে চালু করতে। প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে এমন একটা তিক্ত সম্পর্ক না থাকাই ভালো।

ভুল হয়েছিল ত্রিভনের। বুধকিস্‌কু ঠিকই বলেছে। ভালো ব্যবহারের দিন আর নেই। লোকে সেটাকে ভাবে দুর্বলতা। ভেবে তার সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করে। এ পৃথিবী দাপটের। শক্তি যতটুকুই থাক। তার চেয়েও বেশী দেখাতে হবে দাপট। তবেই সমীহ করবে সবাই

ঘোড়ার পিঠে সীমান্তের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে কথাগুলো ভাবছিল ত্রিভন। সঙ্গের চোয়াড় বাহিনী নিঃশব্দে অনুসরণ করে থাকে।

বুধকিস্‌কুর দলও সঙ্গে সঙ্গে চলছিল। সর্দারের দিকে চেয়ে বিস্মিত হয় ত্রিভন। প্রৌঢ়ত্বের বিন্দুমাত্র ছাপও উপলব্ধি করা যায় না তার চলায়। নবীন এক যুবক যেন এগিয়ে চলেছে মহা উৎসাহ নিয়ে। কিতাগড়ে তার দিকে চাইলে এতটা নির্ভরশীল বলে কখনই মনে হতো না। ক্ষেত্র না পেয়ে শুকিয়ে যেতে বসেছিল এত বড় একটা শক্তি।

রান্‌কোর উপদলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় সীমান্তের কাছাকাছি এসে। রাজাকে শত্রুদের গতিবিধি জানিয়ে দেয় তারা। আরও জানায় যে, সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে রান্‌কো শত্রুদের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে ব্যাপৃত হয়েছে। প্রতিটি মুহূর্তে সে সাহায্য আশা করে। কারণ শত্রুরা যদি একবার জানতে পারে যে বিপক্ষে তাদের মুষ্টিমেয় চোয়াড়, তাহলে ঝড়ের মতো এগিয়ে আসবে।

বুধকে আরও ডাইনে চলে যেতে বলে ত্রিভন। সেখান থেকে চুপে চুপে পার হয়ে ঢুকতে হবে দুই রাজার রাজ্যে। বিদায় নেবার আগে রাজার সামনে নতজানু হয় বুধ। কষ্ট হয় ত্রিভনের। নাতির মুখ দেখার বড় সখ সর্দারের। পুত্রবধূ গর্ভবতী। যদি আর না ফেরে। ছেলে তার বাটালুকাতেই রয়েছে সারিমুর্মুর দলে। বয়সে একেবারে কচি।

কিন্তু বুধ-এর মুখে কোনোরকম বিষাদের চিহ্ন দেখা যায় না। সে হেসে বলে—সুখনিদির প্রথম কিস্তি নিয়ে ফিরব রাজা।

—সর্দার বুধকিস্‌কুর কাছে তা মোটেই অসম্ভব নয়।

—এতটা আশা আমার ওপর বরাবরই ছিল রাজা?

—না। মিথ্যে কথা বলে লাভ কি সর্দার। তোমাকে আজ প্রথম চিনলাম।

—আমার সৌভাগ্য। থুরথুরে বুড়ো হয়ে সুবর্ণরেখার ধারে মিলিয়ে গেলে নিজেকেই ঠকাতাম ত্রিভন একদৃষ্টে চেয়ে থাকে সর্দারের অভিজ্ঞ-কঠোর মুখের দিকে। বুধকে সব সর্দারের মধ্যে একটু সরল আর মোটা বুদ্ধির বলে ধারণা হত। তার মুখে এমন ভাবগম্ভীর কথা মোটেই প্রত্যাশা করেনি সে।

—তোমার কথা সত্যি।

—চলি রাজা।

—এসো সর্দার।

দলের চোয়াড়দের ইঙ্গিত করে বুধকিস্‌কু ডান দিকে এগিয়ে যায়। ত্রিভনের দল জানে না বুধ কোথায় গেল তার লোকজনদের নিয়ে। সুখনিদির কথা গোপন রাখা হয়েছিল সাধারণ লোকের কাছে। বুধ তার দলের কাছে প্রকাশ করবে সীমান্ত পার হবার পর

বুধ অদৃশ্য হবার আগে অবধি তার দিকে চেয়ে থাকার লোভ হয় ত্রিভনের। কিন্তু সময় নেই। রান্‌কো তার সাহায্য চায়। সে সামান্য লোক নিয়ে দুই রাজার বিরুদ্ধে লড়ছে। হয়তো সে বিপদে পড়েছে।

বিজলীর লাগামে ঝাঁকি দিয়ে বলে, চলরে বিজলী।

সেদিন গভীর রাতে রান্‌কোর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ মেলে ত্রিভনের। রান্‌কোর চোখে মুখে নিদারুণ ক্লান্তি আর দুর্ভাবনার ছাপ। সে রাজাকে দেখে আনন্দিত হলেও সেটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পেল না।

প্রথম কথাই সে বলে,—কত চোয়াড় রয়েছে আপনার সঙ্গে?

—কত দরকার তোমার?

—দেড়শো জন হলেই হবে, যদি তাদের ধনুক থাকে।

—আছে।

—থাক্। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রান্‌কো।

—এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন তোমাকে সর্দার?

—অম্বিকানগরের রাজা দুটো বন্দুক এনেছেন সঙ্গে। শুনলাম বরাহভূমরাজ দিয়েছেন তাঁকে? ভীষণ শব্দ হয়।

—সত্যি? ত্রিভনের কপাল কুঁচকে ওঠে।

—হ্যাঁ রাজা।

—তাতে কতজন মারা গেল?

—পাঁচ। আরও যেত। মনে হয় বন্দুক ছোঁড়ার হাত নেই ওদের। তার চেয়ে আমার তৈরী ধনুক অনেক ভালো। অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে অতবড় দল। ভয় পেয়েছে। ভেবেছে অনেক চোয়াড় লুকিয়ে রয়েছে বনের মধ্যে।

—শুনলাম সামনাসামনি লড়াই হয়েছে আজ?

—হ্যাঁ। শুধু একবার। তখনই আপনার কথা মনে হয়েছিল। কিন্তু ভুল করেছে ওরা। আমার পুরো দলটাকে দেখে ওরা মনে করেছিল ছিট্‌কে পড়া সামান্য কয়জন চোয়াড় আমরা। আমিও ওদের সেই ধারণা বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। অবহেলার ভাব দেখিয়েছিলাম। পাঁচজন চোয়াড় তখনি পড়ল বন্দুকের গুলিতে।

—সাদামুখদের সঙ্গে বরাহভূমরাজের সাক্ষাৎ হয়েছে বলে মনে হয়।

—কেন রাজা?

—বন্দুকটা তারাই চালু করেছে।

—কামান?

—কামানও তাদের। তবে আগেও ছিল এদেশে। বরাহভূমরাজের রয়েছে দুটো।

—দেখেছি। যদি তাই নিয়ে আসেন তিনি।

—পাহাড় ভেঙে আসতে কামান ভাঙবে। যদিও বা এসে পৌঁছায় গোলাগুলো শালগাছের গুঁড়িতে আটকে যাবে।

—এত সব কি করে জানলেন রাজা?

—বাবা বলেছেন। কামানের গল্প বাবাই করতেন। অনেক বার বরাহভূমে গিয়েছেন তিনি।

—যদি ইতিমধ্যে আরও কামান তৈরী করেন বরাহভূমরাজ? ছোট ছোট কামান নিয়ে আসায় অসুবিধা হবে না।

—সে উপায় আর নেই সর্দার। কারিগরটি অনেক আগে মারা গিয়েছে। এসব কারিগর সহজে মেলে না।

রান্‌কো ভাবে, রাজার ছেলে রাজা হলে কতকগুলো সুবিধে পাওয়া যায়—যা নিজের রাজ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক।

হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে একটা চিৎকার শোনা যায় কোনো চোয়াড়ের। অল্প দূরেই রয়েছে লোকটি অথচ ঠাহর পাওয়া যায় না। ত্রিভন আর রান্‌কো সচকিত হয়। গোপনে শত্রুরা আক্ৰমণ করল নাকি? তা তো সম্ভব নয়। একটি মশালও জ্বালাবার হুকুম নেই। সমস্ত বনভূমি ঘুটঘুটে। শত্রুদের পক্ষে তাদের অবস্থিতি জানবার বিন্দুমাত্র উপায় নেই।

দুইজনে সাবধানে এগিয়ে চলে অন্ধকারে গা মিসিয়ে। চোয়াড়দের মধ্যে অধিকাংশই নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে শুকনো শালপাতা বিছিয়ে। রান্‌কো যাদের সামনে গেল ধাক্কা দিয়ে তুলে দিল, চমকে উঠে পাশের ধনুক আর তীর আঁকড়ে ধরে তারা।

—সর্দার। চিৎকার শোনা যায় একটু দূরে।

—কে? চাপা গলায় জবাব দেয় রান্‌কো

—এইদিকে। বিজলী—

ত্রিভনের হৃদপিণ্ড লাভাতে থাকে। বিজলীর কথা সে একেবারে ভুলে গিয়েছিল। কোথায় যে তাকে রাখা হয়েছে তাও জানে না। একজন চোয়াড়ের জিম্বায় দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিল সে।

—কি হয়েছে বিজলীর। ত্রিভন উত্তেজিত হয়ে বলে।

সর্বনাশ রাজা। সাপ।

ছুটে যায় দুজনে বিজলীর কাছে। চারটে মশাল জ্বলে ওঠে চকমকির আগুনে।

দৃশ্য দেখে পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে তারা। কিছু সময়ের জ্যেন শরীরের সমস্ত শক্তি অন্তর্হিত হয়।

বিজলীর দুই চোখ ঠিকরে বার হয়ে আসছে। তবু তার চেষ্টার বিরাম নেই। মুক্তির চেষ্টা।

—বিজলী। কোনোরকমে উচ্চারণ করে ত্রিভন।

চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে বিজলীর। রাজার ডাক সে শুনেছে। কিন্তু প্রভুকে চেয়ে দেখবার মত শক্তি নেই তার। তবু বোধহয় নিশ্চিন্ত হয় সে। রাজা যখন এসেছে নিশ্চয়ই সে বাঁচবে। আবার ফিরে যাবে কিতাগড়ে। রাণী তাকে আদর করবে। রাজা লুকিয়ে লুকিয়ে রাণীকে সঙ্গে নিয়ে তার পিঠে উঠে বসবে।

অজগর তার গলাকে আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরে ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছে।

—সর্দার। রাজার কণ্ঠস্বর আর্তনাদের মতো শোনায়।

—রাজা।

—ধনুকে কোনো কাজ হবে না সর্দার। বিজলীর গায়ে লাগতে পারে। তোমার তলোয়ারটা দাও।

রান্‌কো কোমর থেকে সেটা নিয়ে রাজার হাতে দিতেই ত্রিভন বিদ্যুৎ-গতিতে ছুটে যায়। রান্‌কো দেখে অজগরটা মাথাকে সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে লক্লকে জিভ বার করছে। তার ঝিমিয়ে পড়া চোখ দুটোয় অপরিসীম হিংস্রতা।

—যাবেন না রাজা।

কিন্তু সেই মুহূর্তেই দেখে সে অজগরের মাথা দেহচ্যুত হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। তার প্রাণহীন দেহ চূড়ান্তভাবে বিজলীকে চাপ দিয়ে ধীরে ধীরে আলগা হয়ে আসছে। এতক্ষণ পর্যন্ত বিজলী নিজের পায়ের ওপরই দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সাপটা মরে যাবার পর সে মাটিতে আছড়ে পড়ে।

ত্রিভন তার মাথা দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে চোখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। সে চোখে কোনো বাষা নেই।

—কষ্ট হচ্ছে রে বিজলী!

বিজলী কোনোরকম সাড়া দেয় না। তার শ্বাসও পড়ে না।

—সর্দার, এ তো নিশ্বাস নিচ্ছে না।

—আর নেবে না রাজা। ঘোড়া একবার মাটিতে পড়লে আর ওঠে না।

দৃষ্টি ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসে বিজলীর। চোখ দুটো কেমন যেন গাঢ় নীল হয়ে আসে। শেষে বারকয়েক হাত পা ছুঁড়ে নিশ্চল হয়ে যায় বিজলী সতেরখানির মাটির ওপর।

শিশুর মতো কেঁদে ওঠে ত্রিভন।

পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয় সে। বিজলী তার যত প্রিয়ই হোক না। কেন, সবার ওপরে সতেরখানি। বিজলীর জন্যে সে আর ধারতি কিতাগড়ে বসে পরে চোখের জল ফেলবে—এই যুদ্ধক্ষেত্রে নয়। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সর্দারের দিকে চেয়ে বাষ্পহীন কণ্ঠে সে বলে,—ভাল হল রান্‌কো। তোমাদের পাশে এসে দাঁড়ালাম। একই সঙ্গে মাটিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করব আমি। এতদিন উঁচুতে থেকে নিজেকে নীচু করে রেখেছিলাম।

রান্‌কোর দৃষ্টিতে এই অসাধারণ সংযমী পুরুষটির প্রতি অন্তরের সমস্ত শ্রদ্ধা ঝরে পড়ে।

.

পরদিন ভোরবেলা বনের আড়াল থেকে ত্রিভন দেখে দুই রাজার সৈন্যসামন্ত রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিশ্চিন্ত হয়ে তারা অভিযান চালাবে। হাসি পায় ত্রিভনের নিজের চোয়াড়দের মুখের দিকে চায় সে। অনাহারের ছাপ সে মুখে। অথচ কতখানি দৃঢ়তা। দেশকে রক্ষা করার অদম্য স্পৃহা তাদের কষ্টসহিষ্ণু করে তুলেছে। ও-পক্ষের সৈন্যদের সে বালাই নেই। পরের রাজ্যে তারা ঢুকবে—মজা করবে। ঘর সংসারের চিন্তা নেই। বউ ছেলেদের অনেক পেছনে শান্তির রাজ্যে রেখে এসে নিশ্চিন্ত তারা। এদের দৃষ্টি শুধু সামনে। নতুন কিছু করার আনন্দ এরা মশগুল। পেট খালি থাকলে সে আনন্দ মাটি হয়ে যায়। তাই সাত সকালেই রান্নার আয়োজন।

ওদের শান্তির সংসারে এতক্ষণে বোধহয় আগুন লেগেছে। হনুমানের লংকাকাণ্ড। খবর ওরা আজই পাবে। তখন কি করবে? ফিরে গিয়ে বুধকিস্‌কুর দলকে জব্দ করতে পারবে না। এমনভাবে দলবদ্ধ থাকা আর সম্ভব হবে না তখন। নিজের নিজের ঘরের দুর্ভাবনায় ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে এই দল। হয়তো হাতিয়ার ফেলে রেখেই পাগলের মতো ছুটবে। বুধ-এর গায়ে আঁচড়ও পড়বে না।

রান্‌কোকে কাছে ডাকে ত্ৰিভন।

—ধনুক ছুঁড়তে হবে সর্দার। আমাদের লোক শুকিয়ে থাকবে আর ওরা ভর-পেটে যুদ্ধ করবে—আমি ঠিক সহ্য করতে পারছি না। তাছাড়া এটাই সুযোগ

—সবাই প্রস্তুত রাজা।

—দুই রাজা কোথায় আছেন?

—পেছনের তাঁবুতে।

—ওরা এত অসাবধান কেন? পাহারার জন্যেও কোনো দলকে রাখেনি।

—আমাদের বোধহয় অবহেলা করছে। বরাহভূম ওদের পেছনে।

—তাঁবু তো একটা দেখছি। দুই রাজাই কি ওতে আছেন?

—সেটাই সম্ভব।

—আমি শুধু ওখানে তীর ছুড়ব। এগোতে বল। কোনোরকম শব্দ না হয়।

এগিয়ে চলে চোষাড়ের দল—অজগর সাপ যেভাবে এগোয়। খুব ধীরে ধীরে। শব্দ করে না কেউ। কাসি পেলে একমুঠো গাছের পাতা ছিঁড়ে মুখের ওপর চেপে ধরে। বিছুটিতে সারা শরীর ফুলে ওঠে, তবু কোনো চাঞ্চল্য নেই।

ধনুকের নাগালের মধ্যে এসে থামতে নির্দেশ দেয় ত্রিভন। তার হুকুমে প্রতিটি চোয়াড়ের ধনুক থেকে একটি করে তীর নির্গত হয়। নাগা সন্ন্যাসীদের কথা মনে পড়ে যায় ত্রিভনের। ঠিক সেই একই অবস্থা। এ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। কামান রাখার মতো ক্ষমতা সতেরখানির কোনোদিনও হবে না।

নিক্ষিপ্ত তীর সোজা গিয়ে বুকে লাগে যাদের তারা অবাক হবার অবকাশ পায় না। কিন্তু আহতেরা মুহূর্তের জন্যে যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে হাঁ করে চেয়ে থাকে। আশেপাশের এক গাদা মৃত্যুপথযাত্রীর আর্তনাদ শুনেও তাদের খেয়াল হয় না যে পেছু হটতে হবে। তাই দ্বিতীয় ঝাঁকের তীরে তাদের মধ্যে কিছু কিছু মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে।

ত্রিভনের লক্ষ্য রাজাদের তাঁবু। কিন্তু কেউ-ই বার হয় না সেখান থেকে। নিষ্ফলতা পীড়া দেয় তাকে। রান্‌কোর চোখে চোখ পড়তে ম্লান হাসে সে।

শত্রুসৈন্যেরা রাজার শিবিরের সামনে গিয়ে ভীড় করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানেও তীর ধাওয়া করায় আরও পেছনে গিয়ে মাটির ওপর শুয়ে পড়ে তারা।

চোয়াড়ের দল হেসে ওঠে নিঃশব্দে।

—চল সর্দার, পরিষ্কার করে দিয়ে আসি। হাসতে হাসতে বলে বৃদ্ধ এক চোয়াড়।

—চুপ। নিজের কাজ কর। ধমক দেয় রান্‌কো

বৃদ্ধের মুখ ম্লান হয়। অনুতৃপ্ত রান্‌কো তার পিঠের ওপর হাত রেখে বলে,–সামনে গেলে তোমারাই পরিষ্কার হয়ে যাবে ভাই। ওদের দুটো বন্দুক আছে

—সেটা আবার কি?

রান্‌কো বুঝিয়ে বলে। আগের দিনের ঘটনার কথাও জানিয়ে দেয় সেই সঙ্গে।

—কোথায় সে জিনিস?

—বোধহয় রাজাদের কাছে। তাছাড়া পেছনে ওদের আর একটা দল রয়েছে। এগিয়ে গেলে পেছনের দল হাতিয়ার নিয়ে ছুটে আসবে। তখন? সংখ্যায় ওরা অনেক বেশী।

—ভুল হয়েছিল সর্দার।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *