কবি – ১৯

কবি – ১৯

পুরা একমাস লাগিল। একমাস পর বসন্ত রোগশয্যা হইতে কোনরূপে উঠিয়া বসিল। কিন্তু বসন্তকে আর সে বসন্ত বলিয়া চেনা যাইতেছিল না। ঘৃণিত কুৎসিত ব্যাধি তাহার বিষাক্ত জিহার হিংস্ৰ লেহনে বসন্তের অনুপম দেহবর্ণের উজ্জ্বল্ররতা, লাবণ্য সব কিছু নিঃশেষে মুছিয়া গিয়াছে। তাহার দিকে চাহিয়া দেখিলে মনে হয়—সর্বাঙ্গে কে যেন কয়লার গুড়া মাথাইয়া দিয়াছে। মাথার সে চিকণ কালো দীর্ঘ চুলের রাশি হইয়া উঠিয়াছে কর্কশ পিঙ্গলাভ। শুধু বর্ণই নয়—তাহার দেহের গন্ধ রস সবই গিয়াছে। তাহার দেহে একটা উৎকট গন্ধ, রসনিটোল কোমল দেহখানা কঙ্কালসার। বসন্তের গরব-করণ রূপসম্পদের মধ্যে অবশিষ্ট আছে শুধু ডাগর দুইটি চোখ। শীর্ণ শুষ্ক মুখে চোখ দুইটা যেন আরও ডাগর হইয়া উঠিয়াছে। স্তব্ধ নিশ্চল হইয়া সে বসিয়া থাকে। চোখ দুইটা জলজল করিয়া জ্বলিতেছিল—ভস্মরাশির মধ্যে দুই টুকরা জলন্ত কয়লার মত।
সেদিন মাসী বলিল—বসন, বেশ ভাল ক’রে ‘ত্যালে হলুদে’ মেখে চান কর আজ।
বসন্ত নিম্পলক চোখে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া বসিয়াছিল, সে কোনো উত্তর দিল না, একটু নড়িল না, চোখের একটা পলক পর্যন্ত পড়িল না।
মাসী আবার বলিল—রোগের গন্ধ মরবে, অঙ্গের কালচিটে খসখসে বদছিরি যাবে, শরীরে আরাম পাবি।
বসন্ত তবু তেমনি নীরবে বসিয়া রহিল।
মাসী এবার তাহার কাছে বসিয়া তাহকে টানিয়া লইল—গায়ের কাপড় খুলিয়া দিয়া সর্বাঙ্গে হাত বুলাইয়া দিল; ললিতাকে ডাকিয়া বলিল—ললিতে, বাটিতে করে খানিক তেল গরম করে দে তো মা! আর খানিক হলুদ। তারপর সে ডাকিল নিতাইকে—বাবা! বাবা কোথা গো?
নিতাই ঘরের মধ্যে বসন্তর রোগশয্যা পরিষ্কার করিতে ব্যস্ত ছিল। বিছানাপত্রগুলি বাহিরে আনিয়া রোদে ফেলিয়া দিয়া বলিল—আমাকে বলছ মাসী?
হাসিয়া প্রৌঢ়া বলিল–বাবা মানুষের একটাই গো বাবা! সে আমার তুমি। ভাল বাবা তুমি, মেয়ে ডাকছে—বুঝতে লারছ?
হাসিয়া নিতাই বলিল—বল।
—বসনের চিরুনি আর তেলের শিশিট দাও তো বাবা, মাথায় জট বেঁধেছে—আঁচড়ে দি।
বসন্ত এতক্ষণে কথা বলিল—বিছানার দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিল—এসব কি হবে?
ঘরের মধ্যে তেলের শিশি ও চিরুনির সন্ধানে যাইতে যাইতে নিতাই বলিল—কাচতে হবে।
তীব্র তীক্ষ কণ্ঠে বসন্ত চীৎকার করিয়া উঠিল—না! বলিয়াই সে ফোপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।
সে কান্না তাহার আর থামে না।
নিতাই আশ্চর্য মানুষ! সে হাসিয়া সান্ত্বনা দিয়া বলিল–মাসী যা বলছে তাই শোন বসন। এ সব এখন তুমি ভেবো না।
বসন্ত কেবল কাঁদিয়াই চলিল।
নিতাই আবার বলিল–আমারও তো মানুষের শরীর! আমার রোগ হ’লে, তুমি সুদে-আসলে পুষিয়ে দিয়ে। আমি না হয় মহাজনের মত হিসেব ক’রে শোধ নেব। না কি বল মাসী?
সে হাসিতে হাসিতে বিছানাগুলা লইয়া চলিয়া গেল।
ললিত, নির্মলা গালে হাত দিয়া বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গেল। প্রৌঢ়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল—বসন আমাদের ভাগ্যিমানী,
রোগ-ক্লেদ ভরা বিছানা-কাপড়—সমস্ত ক্ষারে সিদ্ধ করিয়া নিতাই কাচিয়া পরিষ্কার করিল। ললিতা নির্মলা দেহোপজীবিনী। তাহদের জীবনে প্রেম শরতের মেঘ, আসে, চলিয়া যায়। যদি বা কোনটা কিছুদিন স্থায়ী হয়—তবে হেমন্তের শীতের বাতাসের মত দেহোপজীবিনীর দেহে দুর্দশার আভাস আসিবামাত্র—সেও চলিয়া যায়। নির্মলার এ ব্যাধি হইয়াছে তিনবার, ললিতার হইয়াছে দুইবার। রোগ প্রকাশ পাইবামাত্র তাহদের ভালবাসার জন পলাইয়াছে। নির্মলার একজন প্রেমিক আবার—রোগের সুযোগে—তাহার যথাসর্বস্ব লইয়া পলাইয়াছিল। আজ নিতাইয়ের আচরণ দেখিয়া তাই তাহারা অবাক হইয়া গেল। শুধু নিজেদের নয়— তাহাদের সমব্যবসায়িনীদের জীবনেও এমন ঘটনা তাহারা দেখে নাই।
বিছানা-কাপড় পরিষ্কার করিয়া ফিরিয়া নিতাই দেখিল, বসন্ত তেমনি চুপ করিয়া বসিয়া আছে। সে তাহার দিকে চাহিয়া খানিকটা আশ্বস্ত হইল। তেলহলুদ মাখিয়া স্নান করিয়া বসন্ত খানিকটা শ্রী ফিরিয়া পাইয়াছে; মাথায় চুল আঁচড়াইয়া প্রৌঢ়া একটি এলোথোপা বাঁধিয়া দিয়াছে—কপালে একটি সিঁদুরের টিপও দিয়াছে।
রোগক্লিষ্ট হতশ্ৰী বসন্ত সুস্থ হইয়ছে এবং অপেক্ষাকৃত সুস্থির হইয়ছে দেখিয়া নিতাই সত্যই খুশী হইল। বলিল -বাঃ, এই তো বেশ মানুষের মত লাগছে!
বসন্ত হাসিল। তারপর ফেলিল একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস। নিতাইয়ের কথাগুলা যেন বসন্তর ওই হাসির ধারের মুখে কাটিয়া খান খান হইয়া ওই দীর্ঘনিঃশ্বাসের ফুৎকারে কোথায় উড়িয়া গেল। বসন্তর হাসির মধ্যে যত বিদ্রুপ তত দুঃখ। তাহ দেখিয়া নিতাই বিচলিত না হইয় পারিল না।
কোনক্রমে আত্মসম্বরণ করিয়া নিতাই বলিল–আমি মিথ্যে বলি নাই বসন। তো রং ফিরেছে—দুর্বল হোক, চেহারার রোগা-রোগা ভাব গিয়েছে—বিশ্বাস না হয়, আয়নায় তুমি নিজে দেখ। সে না ভাবিয়া চিন্তিয়া আয়নাখান পাড়িয়া আনিয়া বসন্তর সম্মুথে ধরিয়া দিল।
মুহূর্তে একটা কাণ্ড ঘটিয়া গেল।
বসন্তর বড় বড় চোখের কোণ হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝরিয়া, শুষ্ক কালো বারুদের মত—তাহার দেহে যেন আগুন ধরাইয়া দিল। মুহূর্তে বিদ্যুতের মত ক্ষিপ্ৰ গতিতে নিতাইয়ের হাত হইতে আয়নাটা ছিনাইয়া লইয়া-বসন্ত তাহার দিকে ছুঁড়িয়া মারিল। সে যেন পাগল হইরা গিয়াছে। কিন্তু দুর্বল হাতের লক্ষ্য–আর নিতাইও মাথাটা খানিকটা সরাইয়া লইয়াছিল—তাই সে আঘাত হইতে বাঁচিয়া গেল। আয়নাটা ছুটিয়া গিয়া একটা বাশের খুঁটিতে লাগিয়া—তিনচার টুকরা হইয়া ভাঙিয়া পড়িল।
নিতাই একটু হাসিল। সে কাচের টুকরা কয়টা কুড়াইতে আরম্ভ করিল।
সেই মুহূর্তেই একটি কঠিন কণ্ঠস্বর রণ রণ করিয়া বাজিয়া উঠিল —বসন!
নিতাই মুখ তুলিয়া দেখিল, মাসী। গম্ভীর কঠোরস্বরে মাসী আবার বলিল—বসন!
বসন্ত তেমনি নীরবে অচঞ্চল; চোখের দৃষ্টি তাহার স্থির নিম্পলক।
—বলি, রোগ না হয় কার? তোর একার হয়েছে? জানিস—এই মানুষটা না থাকলে তোর হাঁড়ির ললাট ডোমের দুগ্‌গতি হ’ত?
বসন্ত তবু উত্তর দিল না। আর মাসীর এ মূর্তির সম্মুখে দাঁড়াইয়া উত্তর করিবার শক্তি বা সাহস হইবার তাহার কখাও নয়। এ মাসী আলাদা মাসী। নিষ্ঠুর কঠোর শাসনপরায়ণ দলনেত্রী। মেয়েরা হইতে পুরুষ—এমন কি তাহার নিজের ভালবাসার জন—ওই মহিষের মত বিশালকায় ভীষণদর্শন লোকটা পর্যন্ত প্রৌঢ়ার এই মূর্তির সম্মুখে দাঁড়াইতে ভয় পায়। নিতাইও এ স্বর, এ মূর্তির সম্মুথে স্তব্ধ হইয়া গেল, কাচ কুড়াইতে কুড়াইতে স্তব্ধ হইয়া মাসীর দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এ মূর্তি সে আজ প্রথম দেখিতেছে।
মাসী আবার কঠোরতর স্বরে ডাকিল—বসন! কথাব জবাব দিস না যে বড়!
বসন্ত এবার দাঁড়াইল, নিম্পলক চোখে স্থির দৃষ্টি মাসীর দিকে ফিরাইয়া চাহিয়া রহিল। সঙ্গে সঙ্গে নিতাই আসিয়া দাঁড়াইল—দুইজনের মাঝখানে। মাসীর চোখ দুইটা ধকধক করিয়া জ্বলিতেছে—রাত্রির অন্ধকারে বাঘিনীর চোখের মত। বসন্তর চোথে আগুন—তাহার চেতনা নাই—কিন্তু ভয়ও নাই—শুধু দাহিকাশক্তি লইয়া সে জ্বলিতেছে। নিতাই সবিনয়ে হাসিয়াও দৃঢ় স্বরে বলিল—বাইরে যাও মাসী। ছি! রোগা মানুষ—
—রোগ মানুষ! রোগ সংসারে আর কারও হয় না? ওর একার হয়েছে? ঝাঁটা মেরে—
—ছি মাসী, ছি!
—ছি কেনে—ছি কেনে শুনি?
—রোগ মানুষ। তা ছাড়া তোমার কাছে অপরাধ তো কিছু করে নাই।
—আমার দলের লোকের ওপর করেছে। এতে আমার দল থাকবে কেনে? তুমি আমার দলের লোক, কবিয়াল।
নিতাই শান্ত দৃঢ় কণ্ঠে—একটু হাসিয়াই বলিল—তা বটে। তবে বসনের জন্যেই তোমার দলে আছি মাসী। নইলে— একটু চুপ করিয়া থাকিয়া আবার বলিল—যাও, তুমি বাইরে যাও।
প্রৌঢ়া নিতাইয়ের মুখের দিকে চাহিল। এ দলের প্রত্যেকটি লোক আপনার অজ্ঞাতসারেই প্রৌঢ়ার আনুগত্য স্বীকার করিয়া লয়। দলনেত্রী এ কথাটা ভাল করিয়াই জানে। দলের সর্ববিষয়ে তাহার ব্যবস্থার অধিকার, প্রতিটি কপর্দক তাহার হাত দিয়া বিতরণের বিধি —তাহার আসন, তাহার সাজ-সরঞ্জামের আভিজাত্য, প্রত্যেক জনকে তাহার অধীন অনুগত্য করিয়া তোলে। নিজের যৌবনে—তাহার দলনেত্রীর দলের সে নিজেও এমনই করিয়া আনুগত্য স্বীকার করিয়া আসিয়াছে। তাহার দলেও এতদিন পর্যন্ত সকলেই তাহার আনুগত্য স্বীকার করিয়া আসিতেছে। আজ তাহার ব্যতিক্রম দেখিয়া সে স্তম্ভিত হইয়া গেল। এ ক্ষেত্রে তাহার দুর্দান্ত রাগ হইবার কথা, সক্রোধে ওই ভীষণদর্শন লোকটাকে আহবান করাই উচিত। কিন্তু নিতাইয়ের মুখের দিকে চাহিয়া দুইটার একটাও তাহার মনে হইল না। মনে হইল—এ লোকটি তাহার আনুগত্য কোনদিনই স্বীকার করে নাই এবং আজও সে যে তাহাকে লঙ্ঘন করিল তাহারও মধ্যে রূঢ় কিছু নাই, উদ্ধত কিছু নাই, অস্বাভাবিকও কিছু নাই। নিতাই কোনমতেই তাহার কেন অপমানই করে নাই।
তাহার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সে বলিল—আশীর্বাদ করি বাবা, তুমি চিরজীবী হও। মাসী ছেড়ে আজ তোমার সঙ্গে মা-বেটা সম্বন্ধ পাতাতে ইচ্ছে করছে। তা হ’লে শেষকালটার জন্যে আর ভাবনা থাকে না।
নিতাই হাসিয়া বলিল—মা-মাসী তো সমান কথা গো! এখন ঘরে যাও, বউ-বেটার ঝগড়া মা-মাসীকে শুনতে নাই।
আর কোন কথা না বলিয়া সে অনুরোধ মানিয়া লইল, চলিয়া গেল।
নিতাই এবার বসন্তর দিকে ফিরিয়া বলিল—ছি! রোগ শরীরে কি এত রাগ করে? রাগে শরীর খারাপ হয় বসন!
অকস্মাৎ বসন্ত সেই মাটির উপরেই উপুড় হইয়া পড়িয়া ফোপাইয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল।
সস্নেহে নিতাই বলিল–আজ সকাল থেকে এমন করে কাঁদছ কেন বসন?
বসন্তর কান্না বাড়িয়া গেল; সে কান্নার আবেগে শ্বাস যেন রুদ্ধ হইয়া আসিতেছিল।
নিতাই তাহার মাথায় সস্নেহে হাত বুলাইয়া দিয়া বলিল—কাল কলকাতায় ওষুদের দোকানে চিঠি লিখেছি। সালসা আনতে দিয়েছি তিন শিশি। সালসা খেলেই শরীর সেরে উঠবে, রক্ত পরিষ্কার হবে—সব ভাল হয়ে যাবে।
শ্বাসরোধী কান্নার আবেগে বসন্ত কাসিতে আরম্ভ করিল। কাসিয়া খানিকটা শ্লেষ্মা তুলিয়া ফেলিয়া অবসাদে নির্জীবের মত পড়িয়া রহিল। ধীরে ধীরে একটা আঙুল দিয়া কি যেন দেখাইয়া দিল।
—কি? এতক্ষণ পরে বসন্ত কথা বলিল—অদ্ভুত হাসিয়া বলিল–রক্ত।
—রক্ত?
—সেই কালরোগ। বসন্ত আবার হাসিল। এতক্ষণ ধরিয়া এই কথাটা বলিতে না পারিয়াই সে কাঁদিতেছিল। কথাটা বলিয়া ফেলার সঙ্গে সঙ্গে কান্নাও তাহার শেষ হইয়ছে।
নিতাই স্থির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিল—তোলা শ্লেষ্মার মধ্যে টকটকে রাঙা আভাস সুস্পষ্ট। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া সে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল।
বসন্ত দুই হাত দিয়া তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল—কেনে তুমি দলে এসেছিলে তাই আমি ভাবছি। মরতে তো আমার ভয় ছিল না। কিন্তু আর যে মরতে মন চাইছে না। রোগক্লিষ্ট শীর্ণ মুখে মৃদু হাসি মাখিয়া সে একদৃষ্ট্রে নিতাইয়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
নিতাইও নিজের দুই হাতের বন্ধনের মধ্যে দুর্বল শিশুর মত তাহাকে গ্রহণ করিয়া বলিল— ভয় কি? রোগ হ’লেই কি মরে বসন? শরীর সারলেই—ও রোগও ভাল হয়ে যাবে।
এবার সে এক বিচিত্র হাসি হাসিয়া বসন্ত নীরবে শুধু ঘাড় নাড়িয়া জানাইয়া দিল—না না না।
কিছুক্ষণ পরে মুখ ফুটিয়াই বলিল—আর বাঁচব না!
তারপর হঠাৎ বলিয়া উঠিল—আমি জানতাম কবিয়াল। যেদিন সেই গানু তোমার মনে এসেছে—সেই দিনই জেনেছি আমি।
—কোন গান বসন?
—জীবন এত ছোট কেনে—হায়!
ঝর ঝর করিয়া সে কাঁদিয়া ফেলিল।
নিতাইয়ের চোখেও এবার জল আসিল। সঙ্গে সঙ্গে অসমাপ্ত গানটা আবার মনে গুঞ্জন করিয়া উঠিল—
এই খেদ মোর মনে,
ভালবেসে মিটল না আশ, কুলাল না এ জীবনে
হায়! জীবন এত ছোট কেনে,
এ ভুবনে?
তারপর?
তারপর আর হয় নাই। অসমাপ্ত হইয়াই আছে। নিতাই একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিল। কবে শেষ হইবে কে জানে।
বসন্তই আবার কথা বলিল—আমি জানতে পেরেছি। বেহালাদার রাত্রে বেহালা বাজায়, আগে কত ভাল লাগত। এখন ভয় লাগে। মনে হয়, আমার আশেপাশে দাঁড়িয়ে কে যেন বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। অহরহ মনে আমার মরণের ভাবনা। মনের কথা কি মিথ্যে হয়? তার ওপর ওই গান তোমার মনে এসেছে! কি করে এল?

বসন্তের মনের কথা হইয়া উঠিল দৈববাণীর মতই সত্য, মিথ্যা নয়।
দিন কয়েক পরেই সন্ধ্যার দিকে বসন্তের গায়ে স্পষ্ট জর ফুটিয়া উঠিল। সে নিতাইকে ডাকিয়া তাহার হাতে হাত রাখিয়া বলিল—দেখ কত গরম!
নিতাই তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
বসন্ত হাসিয়া বলিল—হ্যায় জীবন এত ছোট কেনে, এ ভুবনে কবিয়াল!
কথাটা হইতেছিল একটা ছোটখাটো শহরের, শহরের নামটাই বলি না কেনা, কাটোয়া। কাটোয়ার এক প্রান্তে জীর্ণ একটা মাটির বাড়ি তাহারা ভাড়া লইয়াছিল। নিতাই বলিল— ললিতাকে একবার ডাকি, তোমার কাছে বসুক। আমি একজন ডাক্তারকে ডেকে আনি।
—না। আকুল হইয়া বসন্ত বলিয়া উঠিল—ন।
—এই আধ ঘণ্টা। আমি দণ্ডের মধ্যে ফিরে আসব।
—ন গো—না। যদি কাসি ওঠে? যদি রক্ত দেখতে পায়? তবে এই পথের মধ্যেই ফেলে আজই এখুনই পালাবে সব। যেও না, তুমি যেয়ে না।
নিতাই অগত্যা বসিল। রক্ত উঠার কথা আজও সকলের কাছে লুকানো আছে।
জ্বরটা যেন আজ বেশী-বেশী বাড়িতেছে। অন্য দিন রাত্রি প্রহরখানেক হইতেই খানিকট ঘাম হইয়া জর ছাড়ে, বসন্ত অনেকটা মুস্থ হয়। আজ ঘামও হয় নাই—সে সুস্থও হইল না। মধ্যে মধ্যে জ্বরজর্জর অসুস্থ বিহবল ব্যগ্র দৃষ্টি মেলিয়া সে চারিপাশে খুঁজিয়া নিতাইকে দেখিতেছিল—আবার চোখ বন্ধ করিয়া এ-পাশ হইতে ও-পাশে ফিরিয়া শুইতেছিল। অস্থিরতা আজ অতিরিক্ত।
নিতাই সে দৃষ্টির অর্থ বুঝিয়াছিল। তাই যতবার সে চোখ মেলিয়া তাহাকে খুঁজিল, ততবার সে সাড়া দিয়া বলিল-আমি আছি। এই যে আমি! .
রাত্রি তখন শেষ প্রচুর। নিতাই তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া দেওয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়াই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল।
রাত্রির শেষ প্রহর অদ্ভূত কাল। এই সময় দিনের সঞ্চিত উত্তাপ নিঃশেষে ক্ষরিত হইয়৷ আসে, এবং সমস্ত উষ্ণতাকে চাপা দিয়া একটা রহস্যময় ঘন শীতলতা ধীরে ধীরে জাগিয়া উঠে। সেই স্পর্শ ললাটে আসিয়া লাগে, চেতনা যেন অভিভূত হইয় পড়ে। ধীরসঞ্চারিত নৈঃশব্দের মধ্য দিয়া একটা হিমরহস্য সমস্ত সৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে, নিস্তরঙ্গ বায়ুস্তরের মধ্যে নিঃশব্দ সঞ্চারিত ধূমপুঞ্জের মত। মাটির বুকের মধ্যে, গাছের পাতায় থাকিয় যে অসংখ্য কোটি কীটপতঙ্গ অবিরাম ধ্বনি তুলিয়া থাকে, তাহারা পর্যন্ত অভিভূত ও আচ্ছন্ন হইয় পড়ে রাত্রির এই শেষ প্রহরে। হতচেতন হইয়া এ সময় কিছুক্ষণের জন্য তাহারাও স্তব্ধ হয়। মাটির ভিতরে রন্ধে রন্ধে এই হিম-স্পর্শ ছড়াইয়া পড়িতে চায়। জীব জীবনের চৈতন্য-লোকেও সে প্রবেশ করিয়া সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলিকে অবশ করিয়া দেয়। আকাশে জ্যোতির্লোক হয় পাণ্ডুর; সে লোকেও যেন হিম-তমসার স্পর্শ লাগে। কেবল অগ্নিকোণে—ধক্ ধক্‌ করিয়া জ্বলে শুকতারা —অন্ধ রাত্রিদেবতার ললাটচক্ষুর মত। সকল ইন্দ্রিয় আচ্ছন্ন-করা রহস্যময় এই গভীর শীতলতায় নিতাইকে ধীরে ধীরে চাপিয়া ধরিল। নিতাই শত চেষ্টা করিযাও জাগিয়া থাকিতে পারিল না। আচ্ছন্নের মত দেওয়ালের গায়ে একসময় ঢলিয়া পড়িল।
অকস্মাৎ তাহার চেতনা ফিরিল বসন্তের আকর্ষণে। বসন্ত কখন উঠিয়া বসিয়াছে। দুই হাত দিয়া তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া সে ডাকিতেছে—ওগো! ওগো!
সে কি আর্তবিহ্বল তাহার কণ্ঠস্বর!
—কি বসন? কি? উঠে বসলে কেনে? শোও, শোও। বসন্তর হাত দুইটি হিমের মত ঠাণ্ডা; পৃথিবীর বুক ব্যাপ্ত করিয়া যে হিমানীপ্রবাহ ভাসিয়া উঠিয়াছে, সেই হিমানীপ্রবাহ যেন সরীসৃপের মত বসন্তের হাতের মধ্য দিয়া নিঃশব্দ সঞ্চারে তাহার সর্বদেহে সঞ্চারিত হইতেছে। বসন্তর সর্বাঙ্গে ঘাম!
—বারণ কর! বারণ কর!
—কি? —বেহালা! বেহালা বাজাতে বারণ কর গো!
—বেহালা? কই? নিতাই বেশ কান পাতিয়া শুনিল। কিন্তু রাত্রির স্তব্ধ শেষ প্রহরেও— তাহাদের দুই জনের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়—আর কোন ধ্বনি সে শুনিতে পাইল না।
—আঃ, শুনতে পাচ্ছ না? ওই যে, ওই যে! কেবল বেহালা বাজছে, কেবল বেহালা বাজছে। চকিতের মত একটা কথা নিতাইয়ের মনের মধ্যে জাগিয়া উঠিল।
বসন্তর দেহের স্পৰ্শই তাহাকে সে কথাটি সম্পর্কে সচেতন করিয়া তুলিল। মণিবন্ধে নাড়ীর গতি অনুভব করিয়া নিতাই সকরুণ দৃষ্টিতে বসন্তর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল—গোবিন্দের নাম কর বসন—
—কেনে? বসন্ত তাহার বিহ্বল চোখ দুইটা নিতাইয়ের মুখের উপর স্থাপন করিয়া অস্থির কণ্ঠে প্রশ্ন করিল—কেনে?
কেন, সে কথা নিতাই কিছুতেই বলিতে পারিল না। মৃত্যুকালীন অস্থিরতার মধ্যেও হঠাৎ কয়েক মুহূর্তের জন্য শান্ত স্থির হইয়া বড় বড় চোখ আরও বড় করিয়া মেলিয়া বসন্ত প্রশ্ন করিল—আমি মরছি?
নিতাই ম্লান হাসিমুখে তাহার কপালে হাত বুলাইয়া দিয়া এবার বলিল—ভগবানের নাম— গোবিন্দের নাম করলে কষ্ট কম হবে বসন।
—ন। ছিলা-ছেঁড়া ধনুকের মত বিছানার উপর লুটাইয়া পড়িয়া বসন্ত বলিল—না। কি দিয়েছে ভগবান আমাকে? স্বামীপুত্র ঘরসংসার কি দিয়েছে? না।
নিতাই অপরাধীর মত চুপ করিয়া রছিল। ভগবানের বিরুদ্ধে যে নালিশ বসন্ত করিল, সে নালিশের সব দায়দাবী, কি জানি কেনা, তাহারই মাথার উপর যেন চাপিয়া বসিয়াছে বলিয়া সে অনুভব করিল।
বসন্ত এপাশে ফিরিয়া তাহারই দিকে চাহিয়া বলিল—গোবিন্দ, রাধানাথ, দয়া ক’রো। আসছে জন্মে দয়া ক’রো।
তাহার বড় বড় চোখ দুইটা জলে ভরিয়া টলমল করিতেছিল, বর্ষার প্লাবনে ডুবিয়া-যাওয়া পদ্মের পাপড়ির মত। নিতাই সযত্বে আপনার খুঁটে সে জল মুছাইয়া দিয়া একটু ঝুঁকিয়া পড়িয়া বলিল—বসন! বসন!
—না, আর ডেকে না। না। বলিতে বলিতেই সে আবার অধীর আক্ষেপে শূন্য বায়ুমণ্ডলে কিছু যেন আঁকড়াইয়া ধরিবার জন্য হাত দুইটা প্রসারিত করিয়া নিষ্ঠুরতম যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া উঠিল।
পরক্ষণেই সে নিতাইয়ের কোলে ঢলিয়া পড়িয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *