কবি – ০৫
নিতাই বাসায় আসিয়া হঠাৎ রামায়ণখানা খুলিয়া বসিল। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া গভীর মনোযোগের সঙ্গে বইখানি খুলিল। বিপ্রপদর কথায় সে মর্মান্তিক আঘাত পাইয়াছে। সে বার বার ভাবিতে চেষ্টা করিয়াছে—ব্রাহ্মণবংশের মূর্খ কি বুঝিবে! কিন্তু কিছুতেই তাহার মন শান্ত হয় নাই। তাই সে রামায়ণখানা টানিয়া লইয়া বসিল। বইখানা খুলিয়া সে বাহির করিল দস্যু রত্নাকরের কাহিনী। বহুবার সে এ কাহিনী পড়িয়াছে, কিন্তু আজ এ কাহিনী নূতন রূপ নূতন অর্থ লইয়া তাহার মনের মধ্যে সাড়া জাগাইয়া তুলিল। দুই হইতে পড়িবার পূর্বেই জানা কাহিনী তাহার মনে জাগিয়া উঠিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে তাহার চোখে জলও আসিয়াছে। চোখ মুছিয়া সে এবার পড়িতে আরম্ভ করিল।
“রামনাম ব্ৰহ্মাস্থানে পেয়ে রত্নাকর।
সেই নাম জপে ষাট হাজার বৎসর।।”
বাহির হইতে রাজা তাহাকে ডাকিল—ওস্তাদ!।
“উদাসভাবেই মুখ তুলিয়া নিতাই তাহাকে আহবান করিল—এস, রাজন এস।
রাজা আসিয়া বসিয়াই তাহাকে প্রশ্ন করিল—কেয়া হুয়া হয়। ভাই তুমার কাম কেঁও নেহি করেগা?
নিতাই হাসিয়া বলিল—শোন, আগে এই কাহিনীটা শোন।
রাজা বলিল–দুরো, ওহি লিখাপড়ি তুমারা মাথা বিগড় দিয়া।
নিতাই তখন পড়া শুরু করিয়া দিয়াছে। রাজা অগত্যা একটি বিড়ি ধরাইয়া শুনিতে বসিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে তন্ময় হইয়া গেল।
“বর দিয়া ব্ৰহ্মা গেলা আপন ভবন।
আদিকাণ্ড গান কৃত্তিবাস বিচক্ষণ।।”
পড়া শেষ করিয়া নিতাই রাজার মুখের দিকে চাহিল। রাজা তখন গলিয়া গিয়াছে। সে হাত জোড় করিয়া কপালে ঠেকাইয়া প্রণাম করিয়া বলিল—সীয়ারাম! সীয়ারাম! তারপর নিতাইয়ের তারিফ আরম্ভ হইল—আচ্ছা পঢ়তা হ্যায় তুম ওস্তাদ! বহুৎ আচ্ছা!
নিতাই এবার গম্ভীরভাবে বলিল—রাজন, এইবার তুমিই বিবেচনা ক’রে দেখ।
রাজা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল—কি?
জানাল দিয়া রেললাইনের রেখা ধরিয়া দূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া নিতাই বলিল—রত্নাকর, ধর কবি হলেন, তারপর কি তোমার তিনি ডাকাতি করতেন, না, মানুষ মারতেন?
রাজা বলিয়া উঠিল—আরে বাপ রে, বাপ রে! এইস কভি হে শকত হ্যায় ওস্তাদ!
—ত হ’লে? কাল রাত্রির কথাটা একবার স্মরণ ক’রে দেখ। চারিদিকে তো র’টে গেল কবিয়াল বলে!
—আলবৎ | জরুর!
—তবে? আর কি আমার মস্তকে করে মোট বহন করা উচিত হবে? বাল্মীকি মুনির কথা ছেড়ে দাও! কার সঙ্গে কার তুলনা! ভগবানের অংশ, দেবতা ওঁর। কিন্তু আমিও তো কবি। না হয় ছোট।
এতক্ষণে এইবার রাজা সমস্তটা বুঝিল এবং একান্ত শ্রদ্ধাম্বিত বিস্ময়ে নিতাইয়ের মুখের দিকে নির্বাক হইয়া চাহিয়া রহিল।
নিতাই বলিল—বল রাজন, আর কি আমার কুলিগিরি করা শোভন হবে? লোকে ছি ছি করবে না? বলবে না—কবি মোট বহন করছে!
—হাঁ, ই বাত ঠিক হ্যায়। কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তিত হইয়া রাজা বলিল—লেকিন একঠো বাত ওস্তাদ–
—বল? রাজার মুখের দিকে চাহিয়া নিতাই প্রশ্ন করিল।
—লেকিন রোজগার তো চাহিয়ে ভাই; খানে তো হোগা ভেইয়া!
বার বার ঘাড় নাড়িয়া নিতাই বলিল—সে আমি ভাবি না রাজন। দুরেলা না হয়, একবেলা খেয়েই থাকব, তাও যেদিন না জুটবে, সেদিন না হয় উপবাসীই থাকব। অতঃপর অত্যন্ত গভীর হইয়া কণ্ঠস্বরে বিপুল গুরুত্ব আরোপ করিয়া সে বলিল—তা ব’লে ভগবান যখন আমাকে কবি করেছেন, তখন—! নিতাই বার বার অস্বীকারের ভঙ্গীতে ঘাড় নাড়িল, অর্থাৎ না— না—না! তখন সে মাথায় করিয়া মোট আর বহিবে না।
রাজাও গম্ভীরভাবে চিন্তা করিতেছিল, সে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া এবার পরিষ্কার বাংলায় বলিল—না ওস্তাদ, ছোট কাজ আর তোমার করা হবে না। উঁ-হুঁ। নাঃ।
রাজার উপর নিতাইয়ের প্রতির আর সীমা রহিল না। গভীর আবেগের সহিত সে বলিল— তুমি আমার সত্যকার মিত্র রাজন।
—ধন্য হোগের ওস্তাদ, তুমারা মিত্র হোয়কে হাম ধন্য হোগেয়া। রাজনেরও আবেগের অবধি ছিল না।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া নিতাই এবার বলিল,—আজ বড় দুঃথ পেয়েছি রাজন।
—দুখ? কৌন দুখ দিয়া ভাই? —ওই তোমার বিপ্ৰপদ ঠাকুর। আমাকে বললে কি না—কপিবর, মানে হনুমান! আমি হনুমান রাজা?
রাজা মুহূর্তে সোজা হইয়া বসিল। তাহার মিলিটারী মেজাজ মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়াছে, সে কুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করিল নিতাইকে–জবাব কেঁও নেহি দিয়া তোম?
—জবাব জিহ্বার অগ্রভাগে এসেছিল রাজন, কিন্তু সামলে নিলাম। ব্রাহ্মণ বংশের মূর্খ বলীবর্দ অপেক্ষ কপি অনেক ভাল রাজন।
—জরুর। আলবৎ। লেকিন বলীবর্দ কিয়া হ্যায় ভাই?
নিতাই বলিল—বলদকে বলে ভাই!
তারপর নিজেই রচনা করিয়া বলিল—
“সংসারে যে সহ্য করে সেই মহাশয়।
ক্ষমার সমান ধর্ম কোন ধর্ম নয়॥”
কবিতা আওড়াইয়া নিতাই বলিল—বুঝলে রাজন, ক্ষমা করেছি আমি। একে ব্রাহ্মণ, তার রোগা লোক, তার উপর মূর্খ, ওকে আমি ক্ষমা করেছি।
রাজন মুগ্ধ হইয়া গেল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সে বলিল—সাদা বাংলায় বলিল— ভালই করেছ ওস্তাদ। তারপরই সে আবার বলিল—তাহলে কি করবে ওস্তাদ? একটা কিছু করা তো চাই ভাই। পেটের তুল্য অনবুঝ তো নাই সংসারে।
—আমি একটা দোকান করব ওস্তাদ।
—দোকান?
—হ্যাঁ, দোকান। বিড়ির দোকান, নিজেই বিড়ি বাঁধব, আর ইস্টশানের বটতলায় বসে বেচব। দু-এক বাক্স সিগারেটও রাখব।
রাজন উৎসাহিত হইয়া উঠিল—বহুৎ আচ্ছ, বহুৎ আচ্ছা হোগা ওস্তাদ! নিতাই কিন্তু এবার একটু মানভাবেই বলিল—বণিক মাতুল একটু রুষ্ট হবে আমার ওপর। কিন্তু—
—কেয়া কিন্তু? উ গোসা করনেসে কেয়া হোগা? জান্তি ভাত খায়েগা আপনা ঘরমে!
—ন রাজন। কারও ক্ষতি করতে আমার ইচ্ছা নাই। তা ছাড়া আমার হাতের পান, চা, জল এ তে কেউ থাবে না। বলিতে বলিতেই সে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল –আচ্ছা রাজন, বাঁশ কিনে যদি মোড় সাজি বেশ শৌধীন করে তৈরি করি, তা’হলে কেমন হয়?
—উ সব্সে আচ্ছা!
–কিন্তু বিপ্ৰপদ বলবে কি জানো? ডোমবৃত্তির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলবে—বেটা ডোম!
দাঁতে দাঁত ঘষিয়া রাজন বলিল—একদিন ঠেসে কান দুটো মলে দেবো বেটা বামুনের।
–না। না। না। হাজার হ’লেও ব্রাহ্মণ! রাজন, “ব্রাহ্মণ সামান্য নয়, ব্রাহ্মণে করিলে ক্রোধ হইবে প্রলয়।” শাস্ত্রের কথা ভাই। তা ছাড়া—
রাজা বাধা দিয়া বলিল—ধ্যে-ৎ! ব্রাহ্মন! সাতশো ব্রাহ্মন একঠো বক-পাখীকা ঠ্যাং ভাঙনে নেহি শকতা হ্যায়! ব্রাহ্মন?
নিতাই হাসিয়া বলিল—না-না-না। বলুক ডোম! ডোমেই বা লজ্জা কি? ডোমই বা ছোট কিসে? ডোমও মানুষ বামুনও মানুষ!
—বাস—বাস—বাস! কেয়া হরজ্। বলনে দেও ডোম। রাজনেরও আর কোন আপত্তি রহিল না।–বহুত আচ্ছা কাম, দোকান লাগাও, আওর একঠো সাদী করে ওস্তাদ! সন্সার পাতাও।
তাচ্ছিল্যের সহিত ঠোঁট উন্টাইয়া নিতাই বলিল-দূর!
—দূর কেঁও ভাই? উ হাম নেহি শুনেগা।
—আচ্ছা তার আগে একটা কাহিনী বলি শোন।
কাহিনীতে রাজনের পরম অনুরাগ, সে বিড়ি ধরাইয়া জাঁকিয়া বসিল। নিতাই আরম্ভ করিল লেজকাটা শেয়ালের গল্প। গল্প শেষ করিয়া নিতাই বলিল—তুমি লেজ কেটেছ ব’লে আমি লেজ কাটছি না রাজন!
রাজা প্রথমে অবশ্য খানিকট হাসিল, তারপর কিন্তু বলিল—উ বাত তুমারা ঠিক নেহী হ্যায়। সন্সারমে আয়কে সাদী নেহি করেগা তো কেয়া করেগা?
নিতাই এবার বলিল—তুমি ক্ষেপেছ রাজন! বিয়ে করে বিপদে পড়ব শেষে! আমাদের জাতের মেয়ে কখনও বিদ্যের মর্ম বোঝে?—কেবলই খ্যাচ-থ্যাচ করবে দিনরাত। তা ছাড়া ধরগা তোমার—; কথা শেষ হইবার পূর্বেই নিতাই ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল।
ভ্ৰ নাচাইয়া রাজা প্রশ্ন করিল—উ কেয়া বাত ওস্তাদ? ফিক করকে হাঁসতা কেঁউ?
—হাসবো না? তোমার, তেমন মনে-ধরা কনেই বা কোথায় হে? বেশ মৃদু হাসিয়া নিতাই বলিল—আমরা হলাম কবিয়াল লোক। আমাদের চোখ তো যাতে-তাতে ধরবে না রাজন!
রাজা এবার হাসিয়া গড়াইরা পড়িল। রাজার উচ্চহাসি উৎকট এবং বিকট। রাজার সে হাসি কিন্তু অকস্মাৎ আবার বন্ধ হইয়া গেল। গম্ভীর হইয়া সে বার বার ঘাড়, নাডিয়া এই সত্যকে স্বীকার করিয়াই বলিল—ঠিক বাত ওস্তাদ, ঠিক বাত বোলা হ্যায় ভাই। লঢ়াইমে গিয়া, দেখা, আ-হ-হ একদম ফুলকে মাফিক জেনানা। ইরাণী দেখা হ্যায় ওস্তাদ, ইরাণী? ওইস, লেকিন উস্সে তাজা।
রাজার কথা ফুরাইয়া গেল, কিন্তু স্মতির ছবি ফুরাইল না। সে উদাস দৃষ্টিতে জানালার ভিতর দিয়া চাহিয়া রহিল বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্রের দিকে। যেন বসরার সেই রূপসীদের শোভা— ওই ধূ-ধূ করা কৃষিক্ষেত্রে ভাসিয়া উঠিয়াছে। নিতাইও চাহিয়া ছিল জানালার ভিতর দিয়া, রেললাইনের সমান্যরাল শাণিত দীপ্ত দীর্ঘ রেখা দুইটি বাকের মুখে যেখানে একটি বিন্দুতে এক হইয়া মিলিয়া গিয়ছে, সেই বিন্দুটির দিকে। সহসা একসময় সেই বিন্দুটির উপর জাগিয়া উঠিল চলন্ত সাদা কাশফুলের মত একটি রেখা, রেখাটির মাথায় একটি স্বর্ণবিন্দু, যেন ঝকমক করিয়া উঠিতেছে মুহূর্তে মুহূর্তে চকিতে চকিতে একটি ছটা চুটিয়া আসিতেছে।
তাহাদের এই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিল রাজার স্ত্রীর তীক্ষ উচ্চ কণ্ঠ। রাজার স্ত্রী চীৎকার করিতেছে। রাজা এখানে বসির আড্ডা দিতেছে, তাই সে আপনার অদৃষ্টকে উপলক্ষ্য রাখিয়া, রাজাকে লক্ষ্য করিয়া বাছিয়া বাছিয়া শাণিত বাক্যবাণ নিক্ষেপ করিতেছে।
—ছি রে, চি রে আমার আদেষ্ট! সকালবেলা থেকে বেলা দোপর পর্যন্ত মানুষের ঘর ব’লে মনে থাকে না। অদেষ্টে আমার আগুন লাগুক, পাথর মেরে এমন নেকনকে (কপালকে) ভেঙে কুচিকুচি করি আমি।
রাজার মুখখানা ভীষণ হইয়া উঠিল, সে উঠিয়া পড়িল। নিতাই শঙ্কিত হইয়া বলিল— কোথা যাচ্ছ?
—আতা হ্যায়। আভি আতা হ্যায়। সে চলিয়া গেল।
—রাজন! রাজন! নিতাই পিছন পিছন আসিয়া দুয়ারে দাঁড়াইয়া রহিল। কিছুক্ষণ পরই রাজা ফিরিল সেই উচ্চহাসি হাসিতে হাসিতে। হাসিয়া সে মাটির উপর গুইয়া পড়িল। নিতাই প্রশ্ন করিল—হ’ল কি?
রাজার হাসিতে মুহূর্তের জন্য ছেদও পড়ে না এবং এমন টানা হাসির মধ্যে কথাও বলা যায় না। তবুও বহুকষ্টে রাজা বলিল—ভাগ হ্যায়। মাঠে মাঠে—। সঙ্গে সঙ্গে সেই উৎকট উচ্চহালি।
নিতাই বুঝিল। গালিগালাজ-মুখরা রাজার স্ত্রী রুদ্র মূর্তিতে রাজাকে আসিতে দেখিয়াই বিপরীত দিকের দরজা দিয়া বাহির হইয়া ছুটিয়া পলাইয়াছে। রাজা উঠিয়া দাঁড়াইয়া, ফিরিয়া দেখার অভিনয় করিয়া বলিল, এইসা করকে দেখ্তা; হাম এক পাঁও গিয়া তো ফিন দৌড় লাগায়। অর্থাৎ রাজাকে এক পা অগ্রসর হইতে দেখিলেই সে দৌড় দিয়াছে, আবার কিছুদূর গিয়া ফিরিয়া দেখিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে রাজা আর এক পা বাড়াইয়াছে, দৌড়িয়া যাইবার ভঙ্গি করিয়াছে, অমনি রাজার বউও ছুটিয়া পলাইয়াছে। রাজার কিলকে তাহার বড় ভয়। বলিতে বলিতে রাজা আবার হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল।
এই মুহূর্তটিতেই বাড়ীর মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল সেই ঠাকুরঝি। পরনে সেই ক্ষারে ধোয়া ধবধবে মোটা সূতার খাটো কাপড়, মাথায় পরিচ্ছন্ন মাজ পিতলের ঘটী। দ্বিপ্রহরের রৌদ্রে সেটি সোনার মত ঝকঝক করিতেছে।
নিতাই সাদরে আহবান করিল—এস ঠাকুরঝি, এস!
ঠাকুরঝি রাজাকে এমনভাবে হাসিতে দেখিয়া বিপুল কৌতুক অনুভব করিল। সকৌতুকে সে রাজার দিকে আঙ্গুল দেখাইয়া নিতাইকে প্রশ্ন করিল তাহার স্বভাবগত বাচন ভঙ্গিতে—এই, এই, জামাই এত হাসছে কেনে?
—শুধাও ভাই জামাইকে। নিতাই হাসিল।
—অ্যাই! অ্যাই! ই কি হাসি গো! এমন ক’রে হাসছ কেনে গো জামাই? সঙ্গে সঙ্গে হাসির ছোঁয়াচ তাহাকেও লাগিয়া গেল। সেও হাসিতে আরম্ভ করিল—হি-হি-হি। হি-হি-হি। অত্যন্ত দ্রুত মৃদু ধাতব ঝঙ্কারের মত হাসি।
রাজার হাসি অকস্মাৎ থামিয়া গেল। তাহার দিকে আঙ্গুল দেখাইয়া হাসার জন্য সে ভীষণ চটিয়া উঠিয়াছে। তাহার মনে হইল মেয়েটা তাহাকে ব্যঙ্গ করিতেছে। ভীষণ চটিয়া রাজা ধমক দিয়া উঠিল—অ্যাও! .
ধমক থাইয়া মেয়েটির হাসি বাড়িয়া গেল।
রাজা বলিল–আলকাতরার মত রঙ, সাদা দাত বের করে হসছে দেখ! লজ্জা নাই তোর?
এবার মেয়েটি যেন মার খাইয় স্তব্ধ হইয়া গেল। কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ থাকিরা অত্যন্ত ব্যস্তভা প্রকাশ করিয়া সে বলিল–লাও বাপু, দুধ লাও! আমার দেরি হয়ে গেল। গেরস্ততে বকবে।
রাজা বলিল—তোকেও একদিন ঠাঙানি দিতে হবে দেখছি। দিদির মত মাঠে মাঠে—? আবার সে হাসিতে আরম্ভ করিল।
ঠাকুরঝি কিন্তু এবার হাসিল না। সে নীরবে নতমুখে ঘটী হইতে মাপের মাসে দুধ ঢালিয়া গ্লাসটি পরিপূর্ণ করিয়া ধরিয়া আবার তাগাদ দিল—কই গো, কড়াই পাত।
নিতাই ব্যস্ত হইয়া দুধের কড়াটি পাতিয়া দিয়া বলিল—রাগ করলে ঠাকুরঝি? না না, রাগ ক’রো না।
ঠাকুরঝি উত্তর দিল না, মাপা দুধ ঢালিয়া দিয়া সে নীরবেই চলিয়া গেল। পিছন হইতে রাজা এবার রসিকতা করিয়া বলিল—ও, ঠাকুরঝি আমার ডাকগাড়ি গেল। বাবা রে, বাবা রে, ছুটেছে! পোঁ—ভস-ভস ভস-ভস। বাবা রে।
ঠাকুরঝি কিন্তু ফিরিয়াও চাহিল না।
নিতাই বলিল—না রাজন, এ-প্রকার বাক্য বলা তোমার উচিত হ’ল না।
কিন্তু রাজা সে কথা স্বীকার করিল না। কিসের অনুচিত? সে ফুৎকারে আপনার অন্যায় উড়াইয়া দিল—ধে-ৎ!ত
সঙ্গে সঙ্গেই সে উঠিয়া পড়িল। দেড়টার গাড়ীর ঘণ্টা দিতে হইবে। এই সময়টি নির্ণয়ে ঠাকুরঝি তাহার সিগনাল। ঠাকুরঝি দুধ দিয়া গ্রামে গেলেই সে স্টেশনের দিকে রওনা হয়, মধ্যপথেই শুনিতে পায় মাস্টার হাঁকিতেছে—রাজা!
রাজা নিত্য সাড়া দেয়, আজও দিল—হাজির হ্যায় হুজুর।
ঠাকুরঝি এবং রাজন দুজনেই চলিয়া গেল। নিতাই একটু বিষন্ন হইয়াই বসিয়া রহিল। না-না, এমন ভাবে ওই মিষ্টি মেয়েটিকে রাজনের এমন দু কথা বলা উচিত হয় নাই। সংসারে মুখ ভালবাসায়, মিষ্টি কথায়। কাল রাত্রে গাওয়া গানখানি আবার তাহার মনে পড়িয়া গেল।
“আমি ভালবেসে এই বুঝেছি—
মুখের সার সে চোখের জলে রে!”
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল। ঠাকুরঝি দুধ দিয়া গিয়াছে; চা খাইতে হইবে। সে উনান ধরাইতে বসিল। দোকানী বণিক মাতুলের মাপা চায়ে তাহার নেশা হয় না; তা ছাড়া শরীরটাও আজ ভাল নাই। গত রাত্রির পরিশ্রমে, উত্তেজনায়, অনিদ্রায় —আজ অবসাদে দেহ যেন ভাঙিয়া পড়িতেছে। মাথা ঝিমঝিম করিতেছে। কানের মধ্যে এখনও যেন ঢোল-কাঁসির শব্দ প্রতিধ্বনিত হইতেছে। আর একটু চা ন হইলে জুত হইবে না।
উনান ধরাইয়া কেতলির বিকল্প একটি মাটির হাঁড়িতে সে জল চড়াইয়া দিয়া নীরবে বসিয়া রহিল; তাহার মন আবার উদাস হইয়া উঠিল। না, রাজনের এমন কটু কথা বলা ভাল হয় নাই। ঠাকুরঝি মেয়েটি বড় ভাল। আজ সে অনেক কথা অনর্গল বলিত। বলিবার ছিল যে! গত রাত্রির কবিগান শুনিয়া ঠাকুরঝি সবিস্ময়ে কত কথা বলিত মেয়েটি অত্যন্ত দুঃখ পাইয়াছে, তাই সে কথাগুলি না বলিয়াই চলিয়া গেল। আলকাতরার মত রঙ—। ছি, ওই কথাই কি বলে। কালো? ওই মেয়ে কালো? রাজনের চোখ নাই। তা ছাড়া কালো কি মন্দ। কৃষ্ণ কালে, কোকিল কালো—চুল কালো—আহা! আহাহা! বড় মুন্দর, বড় ভাল একটি কলি মনে আসিয়া গিয়াছে রে। হায়, হায়, হায়!
“কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেনে?”
কেন কাঁদ?