কবি – ১৪

কবি – ১৪

বিগত রাত্রিটা প্রায় বিনিদ্র চোখেই সে যাপন করিয়াছিল। কিছুতেই ঘুম আসে নাই। ভোরে উঠিয়াই সে ঝুমুর দলের আস্তানা হইতে বাহির হইয়া পড়িল। একটা প্রকাও দীঘিকে মাঝখানে রাখিয়া দীঘির চারিপাশে মেলা বসিয়াছে। রাসপূর্ণিমায় রাসোৎসব মেলা; দীঘির পূর্ব দিকে রাধাগোবিনের মন্দির; পাশেই সেবাইত বৈষ্ণব বাবাজীর আখড়া; মুখ হাত ধুইয়া নিতাই সেই রাধাগোবিন্দের মন্দিরে গিয়া বসিল। রাসমঞ্চে অষ্টসখীপরিবৃতা রাধাগোবিন্দকে তাহার বড় ভাল লাগিল। সেখানেই বসিয়া সে গান রচনা আরম্ভ করিয়া দিল। রাধাকৃষ্ণের যুগল-রূপের স্তবগান। প্রথমে গুন গুন করিয়া গানখানি রচনা শেষ করিয়া—বেশ গলা ছাড়িয়া গান আরম্ভ করিল। মিষ্ট গলার গানে বেশ কয়েকজন লোকও জমিয়া গেল। আখড়ার মোহন্তও বাহির হইয়া আসিলেন।
নিতাই গাহিতেছিল—
“আশ মিটায়ে দেখ রে নয়ন যুগল-রূপের মাধুরী!”
মোহন্ত, চোখ বুজিয়া ঘাড় নাড়িয়া তাল দিতে দিতে একজনকে বললেন–খোল আন তো বাবা।
মোহন্ত খোল লইয়া নিজেই সঙ্গত আরম্ভ করিয়া দিলেন। গান শেষ হইলে বলিলেন— তোমার কণ্ঠটি তো বড় ভাল! পদাবলী জান বাবা?
নিতাই পদাবলী কথাটা বুঝিল না। বিনীত ভাবে প্রশ্ন করিল—আজ্ঞে! —মহাজন পদাবলী বাবা–চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাসের পদ? নিতাই হাত জোড় করিয়া বলিল—প্রভু, অধীনের অধম নীচ কুলে জন্ম। এ সব কি করে জানব বাবা?
হাসিয়া মোহন্ত বলিলেন–জন্ম তো বড় নয় বাবা, কর্মই বড়, মহাপ্রভু আমার আচণ্ডালে কোল দিয়েছেন।
মুহূর্তে নিতাইয়ের চোখ দুইটা জলে ভরিয়া উঠিল, বলিল—কর্মও যে অতি হীন প্রভু; ঝুমুর দলে—বেশ্যাদের সঙ্গে থাকি, কবিগান করি।
—কবিগান কর?
–আজ্ঞে হ্যাঁ প্রভু।
—যে গান তুমি গাইলে, সে কি তোমার গান?
মাথা নত করিয়া সলজ্জ হইয়া নিতাই বলিল—আজ্ঞে হ্যাঁ।
মোহন্ত সাধুবাদ দিয়া বলিলেন—ভাল ভাল! চমৎকার গান! তারপর বলিলেন–কর্ম তোমার তো অতি উচ্চ কর্মই বাবা। তোমার ভাবনা কি! যারা কবি, তারাই তো সংসারে মহাজনা, তারাই তো সাধক। কবির গানে ভগবান বিভোর হন। চণ্ডীদাসের পদাবলী শুনে মহাপ্রভু ভাবে বিভোর হয়ে নাচতেন।
টপ্‌ টপ্‌ করিয়া কয়েক ফোট জল নিতাইয়ের চোখ হইতে ঝরিয়া পড়িল, সে বলিল— কিন্তু সঙ্গ যে অতি নীচ সঙ্গ বাবা, বেশ্যা–
মোহন্ত হাসিয়া হাত তুলিয়া ইঙ্গিতে নিতাইকে বাধা দিলেনা, বলিলেন—প্রভুর সংসারে নীচ কেউ নাই বাবা। নিজে, পরে নয়—নিজে নীচ হলে সেই ছোঁয়াচে পরে নীচ হয়। নীল চশমা চোখে দিয়েছ বাবা? সূর্যের আলো নীলবর্ণ দেখায়। তোমার চোখের চশমার রঙের মত তোমার মনের ঘৃণা পরকে ঘৃণ্য করে তোলে। মনের বিকারে এমন সুন্দর পৃথিবীর উপর রাগ করে মানুষ আত্মহত্যা করে মরে। আর বেশ্যা? বাবা, চিন্তামণি বেশ্যা—সাধক বিল্বমঙ্গলের প্রেমের গুরু। জান বাবা, বিল্বমঙ্গলের কাহিনী?
নিতাই বিল্বমঙ্গলের কাহিনী জানিত। গ্রামের বাবুদের থিয়েটারে বিল্বমঙ্গল পালা সে দেখিয়াছে। সে বলিল—হ্যাঁ। কাহিনীটা সব তাহার মনে পড়িয়া গেল।
মোহন্ত সস্নেহে বলিলেন—তবে?
নিতাই ফিরিয়া আসিল—অদ্ভুত এক মন লইয়া। ঝুমুর দলের মেয়েগুলি গানবাজনায় নাচে মুরে তালে পারদর্শিনী বলিয়া কবিয়াল নিতাই বাহিরে তাহদের খাতির করিত, কিন্তু মনের গোপন কোণে ঘৃণাই সঞ্চিত ছিল। আজ এই মুহূর্তে সেটুকুও যেন মুছিয়া গেল। মনটা যেন তাহার জুড়াইয়া গিয়াছে। ফিরিবার পথে বার বার তাহার চোখে জল আসিল। কাপড়ের খুঁটে সে চোখ মুছিল-আর মনে মনে বাবাজীকে প্রণাম করিল। মনে মনে সংকল্প করিল গোবিন্দের প্রসাদের সঙ্গে সে বাবাজীর প্রসাদকণাও চাহিয়া লইবে।
ঝুমুর দলের আস্তানায় আসিয়া সে অবাক হইয়া গেল। মনে হইল, এও বুঝি গোবিন্দের রূপা।
আশ্চর্য! আজিকার প্রভাতের এই স্থান ও পাত্র-পাত্রীগুলির রূপের সহিত গতরাত্রির স্থান ও পাত্র-পাত্রীগুলির এতটুকু মিল নাই। সমস্ত স্থানটা গোবরমাটি দিয়া অতি পরিপাটীরূপে নিকাইয়া ফেলা হইয়াছে। গাছতলায় একটি কলার পাতায় অনেকগুলি ফুল, মেয়েগুলি স্নান সারিয়া জলসিক্ত চুল পিঠে এলাইয়া দিয়া শান্তভাবে বসিয়া আছে; সকলের পরনেই লালপাড় শাড়ী—একটি নিবিড় এবং গভীর শান্ত পবিত্রতার আভাস যেন সর্বত্র পরিস্ফুট।
বসন্ত পিছন ফিরিয়া বসিয়া ছিল, নির্মল ও ললিত বসিয়া ছিল এইদিকে মুখ ফিরাইয়া। তাহার অভ্যর্থনা করিয়া বলিল—বেশ মানুষ যা হোক তুমি। এই এত বেলা পর্যন্ত কোথা ছিলে বল দেখি?
বসন্ত মুখ ফিরিয়া চাহিল। নিতাই মৃদু হাসিল। বসন্ত মুখ ফিরাইয়া লইল এবং পরক্ষণেই রান্নাশালে চলিয়া গেল। নিতাই আসিয়া নির্মলা ও ললিতার কাছে বসিয়া বলিল–বাঃ, ভারি ভাল লাগছে কিন্তুক; চারিদিক নিকানে, তোমর সব স্নান করেছ, লালপেড়ে কাপড় পরেছ—
হাসিয়া নির্মলা বলিল—আজ যে লক্ষ্মীপুজো গো দাদা!
—লক্ষ্মীপূজো?
—হ্যাঁ। পূর্ণিমা বেরস্পতিবার, আমাদের বারমেসে লক্ষ্মীপূজো আজ।
নিতাই অবাক হইয়া গেল। এতদিন মেলামেশা করিয়াও এ কথাটা সে জানিত না। ইহাদেরও ধর্মকর্ম আছে। সে প্রশ্ন করিল—কখন হবে লক্ষ্মীপূজো?
—সেই সন্ধ্যেবেলায়। আজ তোমার পালা আরম্ভ হতে সেই ল’টার আগে লয়।
প্রৌঢ়া বলিল—বাবা আমার ভক্তিমন লোক। ভাল লোক।
ললিত বিচিত্র হাসি হাসিয়া বলিল—লোক ভাল, কিন্তু পাল্লা মোগলের। খানা—
প্রৌঢ়া ইঙ্গিত করিয়া বলিল—চুপ।
বসন্ত আসিয়া দাঁড়াইল, তাহার হাতে একটি গ্লাস। গ্লাসটি বাড়াইয়া দিয়া বলিল—লাও।
নিতাই তাহার মুখের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিল—কি?
মুখ মচকাইয়া বসন বলিল—মদ লয়, ধর!
নিতাই গ্লাসটি লইয়া দেখিল—সদ্য প্রস্তুত ধূমায়িত চা। ললিত হাসিয়া বলিল—বুঝে-মুঝে খেও ভাই জামাই; বশীকরণের ওষুধ দিয়েছে।
বসন্ত চলিয়া যাইতেছিল, সে ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া মুখ বাঁকাইয়া বলিল—আগুন পোড়ারমুখে।
নিতাই হাসিয়া কথাটা নিজের গায়ে লইয়া বলিল—তাই দাও ভাই, কয়লার ময়লা ছুটে যাক। আগুনের পারা বরণ হোক আমার। জান তো?
“আগুনের পরশ পেলে কালো কয়লা রাঙা বরণ।”
ললিত খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিল—যাও কেনে, আগুনের শীষ তো জ্বলছেই, গায়ে গায়ে পরশ নিয়ে আগুন ধরিয়ে নিয়ে এস।
বসন্তের চোখে ছুরির ধার খেলিয়া গেল, কিন্তু পরমুহূর্তে সে হাসিয়া বলিল—মদ জ্বলে দেখেছিস? বলিয়া নিজের দেহখানা দেখাইয়া সে বলিল—এ হ’ল মদের আগুন। বলিয়া সে ঘরের মধ্যে চলিয়া গেল।
নিতাইয়ের মনে পড়িল গত রাত্রির কথা; সে হাসিল। ইহার মধ্যে নিতাই বসন্তের হইয়া গিয়াছে। বসন্ত জানিয়াছে নিতাই তাহার।

মেয়েদের সেদিন সমস্ত দিন উপবাস। সে উপবাস তাহারা নিষ্ঠার সহিত পালন করিল। সন্ধ্যায় ফলমূল, সন্দেশ, দুধ, দই, নানা উপচারে ও ফুল, ধূপ, দীপ নানা আয়োজনে পরম ভক্তির সহিত তাহারা লক্ষ্মীপূজা করিল। পূজা শেষে প্রৌঢ়াকে কেন্দ্র করিয়া এক একটি সুপারি হাতে ব্ৰতকথা শুনিতে বসিল। নিতাই অদূরেই বসিয়া ছিল। অপর পুরুষগুলি দূরে মদ্যপান করিতে বসিয়াছে। মদ খাইতে থাইতেই তাহার রাত্রির আসরের জন্য সাজসজ্জা করিতেছে। বেহালাদার বেহালার পরিচর্যায় ব্যস্ত; বার্নিশের শিশি, তার, রজন লইয়া বসিয়াছে। দোহারটা ঢুলীর সহিত তাল লইয়া তর্ক বাধাইয়াছে। হাতে তাল দিতেছে, আর বলিতেছে—এই—এই— এই ফাক। বাজনদার আপন মনেই বাজাইয়া চলিয়াছে। সে দোহারের কথা গ্রাহ্যও করিতেছে না। –
মহিষের মত লোকটা মদের ঝোঁকে বিমাইতেছে। সম্মুখে জ্বলিতেছে ধুনী। অগ্নিকুণ্ডে মোটা মোটা কাঠের চ্যালা গুঁজিয়া দেওয়া হইয়াছে। ধোঁয়ার সঙ্গে লাল আগুনের শিখা জ্বলিতেছে। লোকটা ঝুমুর দলের পাহারাদার। চুপ করিয়া বসিয়া আছে। অদূরে মেয়েদের আসর। তাহারই কেন্দ্রস্থলে বসিয়া প্রৌঢ়া ব্ৰতকথা বলিতেছিল।

* * *

ব্ৰতকথা শেষ হইল। হুলুধ্বনি দিয়া সকলে লক্ষ্মীকে প্রণাম করিল। তারপর প্রসাদ লইয়া চলিয়া গেল যে যাহার আপন ঘরে। অর্থাৎ ওই খড়ের কুটরিতে। প্রৌঢ়া পুরুষদের ডাকিয়া বলিল—যাও সব, প্রসাদ লাও গা। অর্থাৎ নাও গে যাও।
নিতাই একটা গাছতলায় বসিয়া ছিল। বসন নিজের ঘরে ঢুকিবার মুখে দুয়ারে দাঁড়াইয়া তাহাকে ডাকিল—শোন।
—আমাকে বলছ?
–হ্যাঁ।
আজ এই নিষ্ঠাবতী বসন্তর কাছে যাইতে নিতাইয়ের এতটুকু সঙ্কোচ হইল না। ঘরে ঢুকিয়া সে পরমাত্মীয়ের মত স্বেহমধুর হাসি হাসিয়া বলিল—কি বলছ বল।
বসন্ত তাহার মুখের দিকে চাহিয়া অকস্মাৎ চোখ নামাইয়া মৃদু মিষ্ট স্বরে বলিল—একটু প্রসাদ খাও। বলিয়াই সে পরিপাটি করিয়া ঠাঁই করিয়া একখানি পাতায় ফলমূল সন্দেশ সাজাইয়া দিল। বসনের এই নূতন রূপ দেখিয়া নিতাই মুগ্ধ হইয়া গেল; সেই বসন এমন হইতে পারে!
নিতাই আসনের উপর বসিয়া পড়িল। থাইতে খাইতে বলিল—জয়-জয়কার হোক তোমার।
বসন বসিল—এক টুকরো পেসাদ রেখো যেন।
চকিত হইয়া নিতাই বলিল—পেসাদ?
—হ্যাঁ, নাগরের পেসাদ খেতে হয়। সে হাসিল। বসনের মুখে এমন হাসি নিতাই কখনও দেখে নাই। সে অবাক হইয়া তাহার মুথের দিকে চাহিয়া রহিল। বসন জিনিসপত্র গুছাইবার অজুহাতে তাহার দিকে পিছন ফিরিল। গুনগুন করিয়া সে গান করিতেছিল। নিতাই সে গান শুনিয়া মুগ্ধ হইয়া গেল।
‘তোমার চরণে আমারই পরাণে লাগিল প্রেমের ফাঁসি,
জাতিকুলমান সব বিসর্জিয়া নিশ্চয় হইনু দাসী।‘
বা! বা! বা! এমন গান! নিতাই উৎকর্ণ হইয়া শুনিতেছিল।
‘কহে চণ্ডীদাস—‘
—কি? কি? বসন! চণ্ডীদাস কি?
দুই হাত কপালে ঠেকাইয়া প্রণাম করিয়া বসন বলিল—মহাজনের গান—চণ্ডীদাসের পদ যে।
—চণ্ডীদাসের পদ তুমি জান?
—জানি। বসন্ত-হাসিল।
—আমাদের গানের খাতায় কত পদ নেথা আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *