কবি – ০৯
জলের বুক ক্ষুর দিয়া চিরিয়া দিলেও দাগ-পড়ে না, চকিতের মতন শুধু একটা রেখা দেখা দিয়াই মিলাইয়া যায় আর ক্ষুরটাও জলের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া যায়। তেমনি একটি মৃদু হাসি নিতাইয়ের মুখে দেখা দিয়া ওই তরঙ্গময়ী কৃশতনু মেয়েটার কলরোল-তোলা হাস্যস্রোতের মধ্যে হারাইয়া গেল। নিতাইয়ের হাসি যেন ক্ষুর; কিন্তু ওই মেয়েটা যেন আবেগুময়ী স্রোতোশ্বিনী, তাহাকে কাটিয়া বসা চলে না। মেয়েট বরং নিতাইয়ের হাসিটুকুর জন্য তীক্ষ্ণতর হইয়া উঠিল। সে কিছু বলিতে যাইতেছিল। কিন্তু তাহার পূর্বেই নিতাই সবিনয়ে সমস্ত দলটিকে আহ্বান জানাইয়৷ বলিল—আসুস, আসুন, আসুন।
নিতাই বাড়ীর মধ্যে আগাইয় গেল—সকলে তাহার অনুসরণ করিল। নিতাইয়ের বাসা —রেলওয়ে কুলি-ব্যারাক। লাইন কনস্ট্রাকশনের সময় এখানেই ছিল ইঞ্জিনীয়ারিং বিভাগের বড় অফিস, তখনকার প্রয়োজনে এই সমস্ত ব্যারাক তৈয়ারী হইয়াছিল, এখন সব পড়িয়াই আছে। দিব্য তকতকে সিমেন্ট বাধানো খানিকট বারান্দা, এক টুকরা বাঁধানে আঙিনা; সেই দাওয়া ও আঙিনার উপরেই দলটি বসিয়া পড়িল।
দলটি একটি ঝুমুরের দল। বহু পূর্বকালে ঝুমুর অন্য জিনিস ছিল, কিন্তু এখন নিম্নশ্রেণীর বেশ্যা গায়িকা এবং কয়েকজন যন্ত্রী লইয়াই ঝুমুরের দল। আজ এখান, কাল সেখান করিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়, গাছতলায় আস্তা্না পাতে, কেহ বায়না না করিলেও সন্ধ্যার পর পথের ধারে নিজেরাই আসর পাতিয়া গান-বাজনা আরম্ভ করিয়া দেয়। মেয়ের নাচে, গায়—অশ্লীল গান। ভন্ভনে মাছির মত এ রসের রসিকরা আসিয়া জমিয়া যায়।
আসরে কিছু কিছু পেলাও পড়ে। রাত্রির আড়াল দিয়া মেয়েদের দেহের ব্যবসাও চলে। তবে ইহাই সর্বস্ব নয়, পুরাণের পালাগানও জানে, তেমন আসর পাইলে সে গানও গায়। যন্ত্রীদের মধ্যে নিতাইয়ের ধরণের দুই-একজন কবিয়ালও আছে, প্রয়োজন হইলে কবিগানের পাল্লায় দোয়ারকিও করে, আবার সুবিধা হইলে নিতাইয়ের মত কবিয়াল সাজিয়াও দাঁড়ায়।
দলটি ঘরে ঢুকিয়া উঠানে দাঁড়াইয়া বলিল—বাঃ! গাছতলায় পথের ধারে আস্তানা পাতিয়া যাহারা অনায়াসে দিন রাত্রি কাটাইয়া দেয়, এমন বাঁধানে আঙিনা ও দাওয়া পাইয়া তাহাদের কৃতাৰ্থ হইবার কথা–কৃতার্থই হইয়া গেল তাহারা। খুশী হইয়া তালপাতার চ্যাটাই বিছাইতে শুরু করিল। দীর্ঘ কৃশতনু মুখরা মেয়েটি কেবল সিমেন্ট বাঁধানো দাওয়ার উপর উঠিয়া সটান উপুড় হইয়া শুইয়া পড়িল, ঠাণ্ডা মেঝের উপর মুখখানি রাখিয়া শীতল স্পর্শ অনুভব করিয়া বলিল—আঃ! তাহার সে কণ্ঠস্বরে অসীম ক্লান্তি ও গভীর হতাশার কারুণ্য। সে যেন আর পারে না
—বসন! মেয়েদের মধ্যে একজন প্রৌঢ় আছে, দলের কর্ত্রী, সে-ই বলিয়া উঠিল—বসন, জ্বর গায়ে ঠাণ্ডা মেঝের উপর শুলি কেন? ওঠ, ওঠ।
মেয়েটির নাম বসন্ত। বসন্ত সে কথার উত্তর দিল না, কণ্ঠস্বর একটু উচ্চ করিয়া বলিল— কই হে, ওস্তাদ না ফোস্তাদ! চা দাও ভাই।
নিতাই চায়ের জল তখন চড়াইয়া দিয়াছে, সে বলিল—এই আর পাঁচ মিনিট। কিন্তু তোমার জ্বর হয়েছে—তুমি ঠাণ্ডা মেঝের ওপর শুলে কেন? একটা কিছু পেতে দো?– মাদুর?
বসন্ত চোখ মেলিল না, চোখ বুজিয়াই খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল, বলিল—ওলো, নাগর আমার পীরিতে পড়েছে। নগর শুধু নাগর নয়, পথের নাগর, দেখবামাত্র প্রেম! দরদ গলার গলায়। সঙ্গে সঙ্গে তাহার তরুণী সঙ্গিনীর দলও খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
ঠাকুরঝির সেই নতুন মগটিতে চা ঢালিয়া নিতাই সেই মগটি বসন্তের মুখের সম্মুখে নামাইয়া দিয়া বলিল—বুঝে খেয়ো, চায়ের সঙ্গে যোগবশের রস দিয়েছি। কবিয়াল নিতাই রসের কারবারী, রসিকতার এমন ধারালো প্রতিদ্বন্দ্বিতার পাত্ৰ পাইয়া সে মুহূর্তে মাতিয়া উঠিল।
চায়ের গন্ধ পাইয়া ও স্টিলের মগের শব্দ শুনিয়া তৃষ্ণার্তের মত আগ্রহে বসন্ত ইতিমধ্যেই উঠিয়া বসিয়াছিল, সে মুখ মচকাইয়া হাসিয়া নিতাইয়ের মুখের দিকে বড় বড় চোখ দুইটা মেলিয়া চাহিয়া বসিল—বল কি নাগর। পীরিতে কুলোল না, শেষে যোগবশ!
অপর সকলকে চ পরিবেশন করিতে করিতে নিতাই গান ধরিয়া দিল—
“প্রেমডুরি দিয়ে বাঁধতে নারলেম হায,
চন্দ্রাবলীর সিঁদুর শ্যামের মুখচাঁদে!
আর কি উপায় বৃন্দে—এইবার এনে দে এনে দে—
বশীকরণ লতা— বাঁধবে ছাঁদে ছাঁদে।”
গানটা কিন্তু নিতাইয়ের বাধা নয়, নিতাইয়ের আদর্শ কবিয়াল তারণ মোড়লের বাধা গান; নিতাইয়ের মুখস্থ ছিল।
ঝুমুর দলের মেয়ে, সমাজের অতি নিম্নস্তর হইতে ইহাদের উদ্ভব, আক্ষরিক কোন শিক্ষাই নাই; কিন্তু সঙ্গীতব্যবসায়িনী হিসাবে একটা অদ্ভুত সংস্কৃতি ইহাদের আছে। পালাগানের মধ্য দিয়া ইহারা পুরাণ জানে, পৌরাণিক কাহিনীর উপমা দিয়া ব্যঙ্গ শ্লেষ করিলে বুঝিতে পারে, প্রশংসা সহানুভূতিও উপলব্ধি করে। নিতাইয়ের গানের অর্থ বসন্ত বুঝিতে পারিল, তাহার চোখ দুইটা একেবারে শাণিত ক্ষুরের মত ঝকমক করিয়া উঠিল। কিন্তু পরক্ষণেষ্ট মুখ নামাইয়া চায়ের কাপে চুমুক দিল।
পুরুষদলের একজন বলিল—ভাল। ওস্তাদ, ভাল!
অল্পজন সায় দিল—হ্যাঁ, ভাল বলেছ ওস্তাদ।
—হ্যাঁ। ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া অন্য একটি মেয়ে বলিল—হ্যাঁ, ময়না বলে ভাল। নিতাইয়ের গানের অন্তর্নিহিত ব্যঙ্গ, এক বসন্ত নয়—মেয়েদের সকলেরই গায়ে লাগিয়াছিল। সঙ্গে সঙ্গে বসন আবার বলিয়া উঠিল—“উনোন ঝাড়া কালে কয়লা–আগুন তাতে দিপি দিপি! ছেঁকা লাগে!”
নিতাই হাসিয়া বলিল—না ভাই, ছেঁকা কি দিতে পারি! আর তোমার সঙ্গে আমার কি পীরিত হয়, না হতে পারে? তুমি ফোঁটা ফুল আমি ধুলো। ফুলের পথের নাগর তো ধুলো —বলিয়াই গুনগুন করিয়া ধরিয়া দিল—
ফুলেতে ধূলাতে প্রেম হয় নাকো ফুল ফোটার কালে!
ফুল ফোটে সই আকাশমুখে চাঁদের প্রেমে হেলেদুলে।
ধূলা থাকে মাটির বুকে, চরণতলে অধোমুখে।
ফুল ঝরিলে করে বুকে
সেই লেখা তার পোড়া কপালে।
বল বটে কিনা?
বসন্ত বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। লোকটা কি?
প্রৌঢ় বিচারকের মতো স্মিতহাসি হাসিয়া বলিল—তা তোদের হার হল বাছা। জবাব তোরা দিতে নারলি। তা বাবা কি এ সব গান মুখে মুখে বেঁধে সুর দিয়ে গাইছ?
নিতাই সবিনয়ে বলিল—খানিক আদেক চেষ্টা করি। দু’চারটে আসরে কবি-গানও করেছি। গানটা আমার বাঁধাই বটে।
প্রৌঢ় বলিল—পদখানি তো বড় ভাল বাবা!
নিতাই হাতজোড় করিয়া কপালে ঠেকাইয়া বলিল—তাঁর দয়া।
বসন্ত কোন কথা বলিল না, চা-টুকু নিঃশেষে পান করিয়া মগটা নামাইয়া দিয়া আবার সে মাটিতে লুটাইয়া শুইয়া পড়িল। রাজা সেই মুহূর্তে ঘরে ঢুকিল, তাহার দুই হাতে হাঁড়িমালসা, বগলে শালপাতার বোঝা। মিলিটারী রাজা—হুকুমের সুরেই ব্যবস্থা জানাইয়া দিল—ভেইয়া লোক, ও-হি বটতলামে জায়গা সাফ হো গিয়া, আব খানা-উনা পাকা লিজিয়ে।
এক সময় রাজাকে একা পাইয়া নিতাই চুপি চুপি প্রশ্ন করিল—রাজন, এই সব খরচপত্র করছ—
রাজার সময় অত্যন্ত কম এবং সংসারে গোপনও কিছু নাই। সে বাধা দিয়া স্বাভাবিক উচ্চকণ্ঠেই—বলিল—সব ঠিক হ্যায় ভাই, সব ঠিক হ্যায়। বেনিয়া মামা আট আনা দিয়া, কয়লাওয়ালা চার আনা, মুদী আট আনা, মাস্টারবাবু আট আনা, গুদামবাবু আট আনা, গাডবাবু আট আনা, মালগাড়ীকে ‘ডেরাইবর’ আট আনা, হামারা এক রুপেয়া; বাস, জোড় লেও। তুমার এক রুপেয়া—উলোককে আড়াই রুপেয়া, বারো আনাকে চাউল ডাউল। বাস, হে গিয়া।
সঙ্গে সঙ্গেই সে চলিয়া গেল, ওদিকে শাণ্টিং লাইন হইতে একখানা গাড়ী কুলিরা ঠেলিয়া প্রায় পয়েণ্টের কাছে লইয়া গিয়াছে।
নিতাই গাছতলায় আসিয়া দাঁড়াইল; ভ্রাম্যমান সম্প্রদায়টি ইতিমধ্যেই অত্যন্ত ক্ষিপ্ৰ নিপুণতার সহিত গাছতলায় সংসার পাতিয়া ফেলিল; উনান পাতিয়া তাহাতে আগুন দিল, একটি মেয়ে জল আনিল, একজন তরকারি কুটিতে বসিল, প্রৌঢ় উনানের সম্মুখে বসিয়া মাটির হাঁড়ি ধুইয়া ফেলিয়া চড়াইয়া দিল কিছুক্ষণের মধ্যে। পুরুষেরা তেল মাখিতে বসিল; মেয়েদের স্নান তখন হইয়া গিয়াছে, সকলেরই ভিজা খোলা চুল পিঠে পড়িয়া আছে, প্রান্তে একটি করিয়া। গেরো বাঁধা। সেখানে ধারে কাছে কেহ নাই কেবল সেই কৃশতনু গৌরাঙ্গী ক্ষুরধার মেয়েটি। নিতাইকে ডাকিয়া প্রৌঢ়া তাহাকে সাদরে সম্ভাষণ করিয়া বলিল—ব’স বাবা, ব’স।
পুরুষ কয়জন প্রায় একসঙ্গেই বলিয়া উঠিল—তাই তো, আপনি দাঁড়িয়ে কেন গো? বসুন!
উনানে একটা কাঠ গুঁজিয়া দিয়া প্রৌঢ়া বলিল—খাসা গলা আমার বাবার। তারপর মুখের দিকে চাহিয়া স্মিতহাসি হাসিয়া বলিল—এই ‘নাইনেই’ থাকবে বাবা? না, কাজকম্মও করবে—এও করবে?
–এই ‘নাইনেই’ থাকবারই তো ইচ্ছে; তা দেখি।
বিয়ে-টিয়ে করেছ? ঘরে কে আছে?
—বিয়ে! নিতাই হাসিল, হাসিয়া বলিল–ঘরে মা আছে, বুন আছে; মা বুনের কাছেই থাকে। আমি একা।
—তবে আমাদের দলে এস না কেনে?
নিতাই কিন্তু এ কথার উত্তর চট করিয়া দিতে পারিল না। সম্মতি দিতে গিয়া মনে পড়িয়া গেল রাজাকে—মনে পড়িয়া গেল ভূঁইচাঁপার শ্যামল সরস ডাটাটির মত কোমল শ্ৰীময়ী ভক্ত মেয়েটি —ঠাকুরঝিকে। সে চুপ করিয়াই রহিল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া প্রৌঢ় আবার প্রশ্ন করিল—কি বলছ বাবা?
—বাবা ভাবছে তোমার মনের মানুষের কথা। সঙ্গে সঙ্গে খিল-খিল হাসি। নিতাই পিছন ফিরিয়া দেখিল, ভিজা কাপড়ে দাঁড়াইয়া সদ্যঃস্নাতা বসন্ত। মেয়েটা স্নান করিয়া চুল গা মোছে নাই, চুল পর্যন্ত ঝাড়ে নাই। ভিজা চুল হইতে তখনও জল গড়াইয়া পড়িতেছে। নিতাই অবাক হইয়া গেল।
—বউ কেমন হে? বশীকরণের লতায় ছাঁদে ছাঁদে বেঁধেছে বুঝি!
নিতাই এতক্ষণে সবিস্ময়ে বলিল—জ্বর গায়ে তুমি চান ক’রে এলে?
—ধুয়ে দিয়ে এলাম। চন্দ্রাবলীর প্রেমজ্বর কিনা! বলিয়াই সে খিলখিল করিয়া হাসিয়া ভাঙিয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে সিক্তবাসের স্বচ্ছতার আড়ালে তাহার সুপরিস্ফুট সর্বাঙ্গও হাসিয়া উঠিল। নিতাইয়ের লজ্জা হইল।
প্রৌঢ়া বলিল—তাই তো বটে! চান করে এলি? ছাড়, ছাড়, ভিজে কাপড় ছাড় বসন। তুই কোন দিন মরবি ওই ক’রে।
বিচিত্র হাসিয়া বসন বলিল—ফেলে দিও টেনে। তা ব’লে চান না ক’রে থাকতে পারি না। চান না করলে—মা-গো! গায়ে যা বাস ছাড়ে।
একটি তরুণী মুচকি হাসিয়া বলিল—চুল ফেরে না লতায় পাতায়, তা বল!
বসন হাত দিয়া মাথার চুলে চাপ দিতে দিতে বলিল-আমার তো আর কেশ দিয়ে নাগরের পা মুছতে হয় না, তা চুল না ফিরিয়ে করব কি?
বহুপরিচর্যাই ইহাদের ব্যবসা, কিন্তু নারীচিত্তের স্বভাবধর্মে একটি বিশেষ অবলম্বন ভিন্নও ইহারাও থাকিতে পারে না; সঙ্গের পুরুষগুলির মধ্যেই দলের প্রত্যেক মেয়েটিরই প্রেমাম্পদ জন আছে। সেখানে মান-অভিমান আছে, সাধ্য-সাধনাও আছে। কিন্তু বসন্তের প্রেমাম্পদ কেহ নাই, সে কাহাকেও সহ্য করিতে পারে না। কেহ পতঙ্গের মত তার, শাণিত দীপ্তিতে আকৃষ্ট হইয়া কাছে আসিলে মেয়েটার ক্ষুরধারে তাহার কেবল পক্ষচ্ছেদই নয়, মর্মচ্ছেদও হইয়া যায়। তাই বসন্ত সঙ্গিনীকে এমন কথা বলিল। ফলে ঝগড়া একটা বাঁধিয়া উঠিবার কথা; আহত মেয়েটি কণা তুলিয়াও উঠিয়াছিল; কিন্তু দলের নেত্রী প্রৌঢ়া মাঝখানে পড়িয়া কথাটা ঘুরাইয়া দিল। হাসিয়া বলিল-ও বসনা, শোন শোন, দেখ আমাদের ওস্তাদকে পছন্দ হয় কিনা!
তাহার কথা শেষ হইল না, বসস্তের উচ্চ উচ্ছল হাসিতে ঢাকা পড়ির গেয়। নিতাই ঘামিয়া উঠিল। প্রৌঢ়া ধমক দিয়া বলিল—মরণ! এত হাসছিস কেনে?
হাসি থামাইয়া বসন্ত বলিল—মরণ তোমার নয়, মরণ আমার!
— কেন?
—মা গো! ও যে বড় কালো; মা–গ!
সকলে নির্বাক হইয়া রহিল।
বসন্ত আবার বলিল—কালো অঙ্গের পরশ লেগে আমি সুদ্ধ কালো হয়ে যাব মাসী। মুখ বাঁকাইয়া সে একটু হাসিল, তারপর আবার বলিল—যাই, শুকনো কাপড় পরে আসি। ‘নিমুনি হ’লে কে করবে বাবা! সে হেলিয়া দুলিয়া চলিয় গেল।
একটি মেয়ে বলিল—মরণ তোমার;.গলায় দড়ি।
প্রৌঢ়া ধমক দিল—চুপ কর বাছা। কোঁদল বাঁধাস নে। মেয়েটি একেবারে চুপ করিল না, আপন মনেই মৃদুস্বরে গজগজ করিতে আরম্ভ করিল। নিতাই আপন মনে মুচকি মুচকি হাসিতেছিল। হাসিতেছিল ওই গৌরগরবিনীর রকম সকম দেখিয়া। মেয়েটা ভাবে তাহার ওই সোনার মত বরণের ছটায় দুনিয়ার চোখ ধাঁধিয়া গিয়াছে। সবাই উহাকে পাইবার জন্য লালায়িত। হায়! হায়! হায়!
প্রৌঢ়া আবার কথাটা পাড়িল—বলি হাঁ গো, ও ছেলে!
—আমাকে বলছেন?
—হ্যাঁ। ছেলেই বলবো তোমাকে। অন্য লোক বলে—ওস্তাদ। রাগ করবে না তো বাবা?
—না-না। রাগ করব কেনে! মাসীর এ কথাটি তাহার বড় ভাল লাগিল।
—কি বলছ? এই ‘নাইনেই’ যখন থাকবে, তখন এস না আমাদের সঙ্গে।
—না। নিতাইয়ের কণ্ঠস্বর দৃঢ়।
সকলেই চুপ করিয়া রহিল। নিতাই উঠিল—তা হলে আমি যাই এখন; আমাকেও রান্নাবান্না করতে হবে।
—ওহে কয়লা-মাণিক! বসন্তর কণ্ঠস্বর। নিতাই ফিরিয়া চাহিল। ইতিমধ্যেই বসন্ত বিন্যাস করিয়া চুল আঁচড়াইয়াছে—বিন্যাস করিবার মত চুলও বটে মেয়েটার। ঘন একপিঠ দীর্ঘ কালো চুল! কপালে সিঁদুরের টিপ, পরনে ধপধপে লাল নক্সিপাড় মিলের শাড়ী।
বসন্ত হাসিয়া বলিল—তোমার নাম দিয়েছি ভাই কয়লা-মাণিক। কা্লো মাণিক কি বলতে পারি? সে হাতজোড় করিয়া কালো-মাণিককে প্রণাম করিল।
নিতাই হাসিয়া বলিল—ভাল ভাল! তা বেশ তো! ময়লা-মাণিক বলতেও পার।
—সে ওই কয়লাতেই আছে। বসন্ত মুখ বাঁকাইয়া হাসিল।
নিতাই বলিল-তা আছে কিন্তু ময়ে—ময়ে—মিল নাই। ওতে কথাটা মিষ্টি হয়। গানের কান আছে তাই বললাম। কালা হলে বলতাম না। বল কি বলছ?
—আমার একটি কাজ করে দেবে?
—কি, বল?
—চার পয়সার মাছ এনে দেবে? আমার আবার মাছ নইলে রোচে না। দেবে এনে?
—দাও। নিতাই হাত পাতিল। কিন্তু বসন্ত পয়সা দিতে হাত বাড়াইতেই সে আপনার হাতখনি অল্প সরাইয়া লইল, বলিল—আলগোছে ভাই, আলগোছে।
—কেনে? চান করতে হবে নাকি? মেয়েটার ঠোঁটের কোণ দুইটা যেন গুণ দেওয়া ধনুকের মত বাঁকিয়া উঠিল।
নিতাই হাসিয়া বলিল—কয়লার ময়ল লাগবে ভাই, তোমার রাঙা হাতে।
বসন্তের হাতের পয়সা আপনি খসিয়া নিতাইয়ের হাতে পড়িয়া গেল। মুহূর্তে ধনুকের গুণ যেন ছিঁড়িয়া গেল। তাহর অধরপ্রান্ত থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। পরমুহূর্তেই সে কম্পন তাহার বাঁকা হাসিতে রূপান্তর গ্রহণ করিল। দেখিয়া নিতাইয়ের বিস্ময়ের আর সীমা রহিল না। মনে হইল মেয়েটা যেন গল্পের সেই মায়াবিনী। প্রতিদ্বন্দ্বী সাপ হইলে সে বেজী হয়; বিড়াল হইয়া বেজীরূপিণী তাহাকে আক্রমণ করিলে বেজী হইতে সে হয় বাঘিনী। কান্না তাহার বাঁকা হাসিতে পাণ্টাইয়া গেল মুহূর্তে। হাসিয়া সে বলিল—সেই জন্যে আলগোছে দিলাম।
জেলে-পাড়ার পথে নিতাইয়ের মনে গান জাগিয়া উঠিল। নূতন গান। মনে মনে ভাবিয়া সে ওই মেয়েটার একটা তুলনা পাইয়াছে। শিমুলফুল। গুন-গুন করিয়া সে কলি ভাঁজিতে আরম্ভ করিল—আহা!
‘আহ!—রাঙাবরণ শিমুলফুলের বাহার শুধু সার।’