কবি – ১৮
সত্যই বসন এখন ভাল আছে। অনেক ভাল আছে। দেহের প্রতি যত্ন তাহার এখন অপরিসীম। মদ এখন সে খুব কমই খায়। দূৰ্বাঘাসের রস আগে নিয়মিত খাওয়া ঘটিয়া উঠিত না। এখন নিয়মিত সকালে উঠিয়াই দূৰ্বাঘাসের রসটি খাইয়া তবে অন্য কাজে সে হাত দেয়। স্বাস্থ্যও তাহার এখন ভাল হইয়াছে। শীর্ণ রুক্ষ মুখখানি অনেকটা নিটোল হইয়া ভরিয়া উঠিয়াছে, রুক্ষ দীপ্ত গৌরবর্ণে একটু শ্যাম আভাস দেখা দিয়াছে। কথার ধার আছে, জ্বালা নাই। এখুন আর সে তেমন তীক্ষ-কণ্ঠে খিলখিল করিয়া হাসে না। মুচকিয়া মৃদু মৃদু হাসে।
ললিতা নির্মলা ঠাট্টার আর বাকি রাখে না। বসন্ত যখন নিতাইয়ের কোন কাজ করে তখন ললিত নির্মলাকে অথবা নির্মলা ললিতাকে একটি কথা বলে—‘হায়-সখি,-অবশেষে ’
অর্থাৎ যে পিরীতিকে এককালে বসন্ত মুখ বাঁকাইয়া ঘৃণা করিত, সেই পিরীতিতেই সে পড়িল অবশেষে।
বসন্ত রাগে না, মুচকি হাসিয়া শুধু বলে—মরণ।
প্রৌঢ়াও হাসে। মধ্যে মধ্যে সেও দুই চারিট রহস্য করিয়া থাকে।
—বসন, ফুল তবে ফুটল। কোকিল নাম পাণ্টে ওস্তাদের নাম দে বসন ভোমরা। কোকিলও কালো, ভোমরাও কালো।
বসন্ত হাসে।
শুধু একটা সময়, বসন্ত—পুরানো বসন্ত। সেটা সন্ধ্যার পর৷ সন্ধ্যার পর হইতেই সে উগ্র হইয় উঠে। এটা তাহদের দেহের বেসাতির সময়। সন্ধ্যার অন্ধকার হইলেই ক্রেতাদের আনাগোনা শুরু হয়। মেয়ের গা ধুইয়া প্রসাধন করিয়া সাজিয়া গুঁজিয়া বসিয়া থাকে। তিনজনে তখন তাহারা বসে একটি জায়গায়। অথবা আপন আপন ঘরের সম্মুখে পিঁড়ি পাতিয়া বসে—মোট কথা এই সময়ের আলাপ-রঙ্গরহস্য সবই মেয়েদের পরস্পরের মধ্যে আবদ্ধ। পুরুষদের সঙ্গে ভাবটা যেন ছাড়াছাড়া। মেয়েরা ইঙ্গিতময় ভাষায় অশ্লীল ভাবের রঙ্গরহস্য করে নিজেদের মধ্যে।
নির্মলা মুদুস্বরে ডাকে—নি-ব, নি-স, নি-ন্ত। অর্থাৎ নি শব্দটাকে যোগ করিয়া সে ডাকে—বসন্ত।
বসন্ত উত্তর দেয়—নি-কি? মানে—কি?
ওই নি শব্দটাকে যোগ করিয়া তারপর চলে অশ্লীল রহস্য! কোন এক দিনের ব্যভিচারবিলাসের গল্প। সকলেই তাহা্রা হাসিয়া গড়াইয়া পড়ে। যেন সম্মুখের দেহব্যবসায়ের আসরের জন্য মনটাকে তাহারা শানাইয়া লয়। এই কাজ হইতে তাইাদের নিষ্কৃতি নাই। একদিকে মাসী দেয় না, অন্যদিকে চিরজীবনের অভ্যাস—সেও দেয় না। উপায় নাই।
পুরুষেরাও এ সময়ে স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র আসন পাতে। তাহদেরও যেন সাময়িক ভাবে মেয়েগুলির সঙ্গে সম্বন্ধ চুকিয়া যায়। একান্ত নির্লিপ্তের মত তাহারা বসিয়া থাকে।
নিতাই একটা নিরালা জায়গা বাছিয়া বসে, আপনার লণ্ঠনটি জালিয়া দপ্তর খোলে, লেখে, পড়ে। বসন্তের ঘরে আগন্তুকদের মত্ত কণ্ঠের সাড়া জাগে—নিতাই রামায়ণ পড়ে। কৃষ্ণলীলা পড়ে। গানও রচনা করে—
“আর কতকাল মাকাল ফলে ভুলবি আমার মন?”
অথবা—
“আমার কর্মফল
দয়া ক’রে ঘুচাও হরি—জনম কর সফল!”
কখনও সে বসিয়া ভাবে। ভাবে, বড় বড় কবিয়ালদের কথা—যাহারা সত্যকারের কবিয়াল। ঝুমুরের আসরে যাহারা গান গায় না। তেমন বায়না ইদানীং তাহার ভাগ্যেও দুই-একটা করিয়া জুটিতে আরম্ভ করিয়াছে। এইবার তাহার এ দল হইতে বাহির হইয়া পড়া উচিত। এক বাধা বসন্ত। বসন্ত যে রাজী হয় না! সে সবই বুঝিতে পারে। তবুও সে এ দল ছাড়িয়া যাইতে পারে না। আশ্চর্য! সে আপন মনেই একটু হাসে।
—কি রকম? হাসছ যে আপন মনে!
নিতাই চাহিয়া দেখে—বেহালাদার তাহার দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিতেছে। সে বসিয়া আছে অল্প দূরে। বেহালাদার বসিয়া আপনার বেহালাখানিকে লইয়া পড়িয়াছে। সুর বাঁধিতেছে। সে সুর-বাঁধা যেন তাহার ফুরাইবার নয়। সুর বাঁধিয়া একবার ছড়ি টানিয়াই আবার তার-বাঁধা কানটায় মোচড় দেয়। তার কাটিয়া যায়। বেহালাদার নতুন তার পরাইতে বসে। ছড়িতে রজন ঘষে। বেহালাখানাকে ঝাড়ে। মাঝে মাঝে বার্নিশের শিশি হইতে বার্নিশ লইয়া বার্নিশ মাথায়।
নির্মলার ঘরে কলরব উঠে।
বেহালাদার বেহালায় ছড়ি চালায়। রাত্রি একটু গভীর না হইলে—বাজনা তাহার ভাল জমে না। বারোটা পার হইলেই তাহার যেন হাত খুলিয়া যায়। একটা অদ্ভূত বাজনা সে বাজায়। লম্বা টানা একটা সুর। সুরটা কাঁপিতে কাঁপিতে বাজিতে থাকে। মধ্যে মধ্যে এমন বিষম কোমলের ধাপে খাদে নামিয়া আসে যে, শরীর সত্যই বিমঝিম করিয়া উঠে। মনে হয় যেন সমস্ত নিঝুম হইয়া গিয়াছে, চারিদিক যেন হিম হইয়া গেল। যে শোনে তাহার নিজের শরীরের হাতপায়ের প্রান্তভাগও যেন ঠাণ্ডা হইয়া গিয়াছে বলিয়া মনে হয়। মনের চিন্তা-ভাবনাও যেন অসাড় হইয়া যায়।,
দোহারটা তর্ক করে বাজনাদারের সঙ্গে।
বাজনাদারটার উপরে কোন কিছুরই ছায়া পড়ে না। তাহার কেহ ভালবাসার জন নাই। সে হা-হা করিয়া হাসে—বাজনা বাজায়। দোহারটার তর্কের জবাব দেয়। মধ্যে মধ্যে মেয়েদের ঘরে গিয়া মদ খাইয়া আসে। বেহালাদারের জন্য মদ লইয়া আসে। তারপর ঘুম পাইলেই বিছানা পাড়িয়া শুইয়া পড়ে।
দোহারটি ললিতার ঘরে গিয়া ললিতার সঙ্গে ঝগড়া বাধাইবার চেষ্টা করে।
মহিষের মত লোকটা ধুনির সম্মুখে বসিয়া থাকে। প্রৌঢ়া ঘরগুলির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখিয়া বসিয়া সুপারি কাটে। লোকজন আসিলে মেয়েদের ডাকিয়া দেখায়, দরদস্তুর করে, টাকা আদায় করে। গোপনে মদ বিক্রী করে। প্রৌঢ়ার এই সময়ে মূর্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং বিশিষ্ট। গম্ভীর, কথা খুব কম কয়, চোখের ভ্রূ দুইটি কুঞ্চিত হইয়া ভ্রূকুটি উদ্যত করিয়াই রাখে; দলের প্রত্যেকটি লোক সন্ত্রস্ত হয়। বসন্ত উগ্র হইয়া দেহের খরিদারের সঙ্গে ঝগড়া করে। প্রৌঢ়া মাসী আসিয়া দাঁড়ায়, বসন্তকে সে প্রায় ধমক দেয় –এই বসন! কি ব্যাপার? ঝগড়া করছিস কেনে?
—বেশ করছি। মদ খেতে বলছে, আমি মদ খাব না।
—এক-আধটু খেতে হবে বৈকি। তা না হ’লে হবে কেনে? নোকে আসবে কেনে?
—না আসে, না-ই এল। আমার ঘরে নোক এসে দরকার নাই।
—দরকার নাই!
—না।
—বেশ, কাল সকালে তুমি ঘর চলে যেয়ো। আমার এখানে ঠাঁই হবে না।
শুধু বসন্তই নয়, নির্মল ললিতাও মধ্যে মধ্যে ক্লান্ত হইয়া হাঁপাইয় পড়ে। তাহারাও বলে— দরকার নাই, আর পারি না। মাসীর কিন্তু ক্লান্তি নাই, সে অনড়। তাহার সেই এক উত্তর–তাহলে বাছা তোমাদের নিয়ে আমার দল চলবে না। তোমরা পথ দেখ ঝুমুর দলের লক্ষ্মী ওইখানে। ও পথ ছাড়লে চলবে না।
সকলকেই চুপ করিতে হয়, বসন্তকেও হয়। আবার এটাও আশ্চর্যের কথা যে, যে ব্যবসাটা তাহারা ছাড়িতে চায়, যে জীবনে বিষ আছে বলিয়া মনে হয়, সেই ব্যবসায় ও সেই জীবনে ভাটা পড়িয়া আসিলে, মন্দা পড়িলে তাহদেরই আর ভাল লাগে না, তাহারাই চিন্তিত হইয়া পড়ে। আপনাদের মধ্যেই আলোচনা হয়।
দূর, দূর, রোজগার নাই, পাতি নাই, লোক নাই, জন নাই—কিছু নাই। সব ভোঁ ভোঁ। সঙ্গে সঙ্গে অপর একজন বলে—ঠিক বলেছিস ভাই, ভাল লাগছে না মাইরী!
-ললিতে!
—কি?
—এ কেমন জায়গা বল তো?
—কে জানে ভাই। পাঁচটা টাকা রেখেছিলাম—নাকছবি গড়াব ব’লে, চার টাকা খরচ হয়ে গেল। বসন!
বসন চুপ করিয়াই থাকে। তাহার দেহ-মন দুই-ই ক্লান্ত। নির্মলা ললিতা আবার ডাকে। —কি লো চুপ করে রয়েছিল যে! তারপর বলে—তোর ভাই অনেক টাকা।
কোন দিন ইহার উত্তরে বসন ফোঁস করিয়া উঠে। ঝগড়া বাধিয়া যায়। কোন দিন বিষণ্ণহাসি হাসিয়া উঠিয়া যায়। মেয়েটার মতিগতি কখন যে অস্থির, কখন যে শান্ত বুঝিয়া ওঠা দায়। ঝগড়া বাধিলে নিতাইকে আসিয়া থামাইতে হয়। বসনকে ঘরে লইয়া গিয়া বুঝাইয়া শান্ত করে। শান্ত হইলে প্রশ্ন করে—কেন এমন কর বসন?
বসন বিছানায় মুখ গুঁজিয়া শুইয়া পড়িয়া বলে—জানি না।
নিতাই তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া দেয়।
খুব বেশী মন্দা পড়িলে—মাসী নূতন পথ ধরে। মেয়েদের ডাকিয়া বলে—আজ সাজগোজ কর দেখি ভাল ক’রে। গাঁয়ের বাজারে বেড়াতে যাব।
অর্থাৎ মেয়েগুলিকে বাজারের পথে পথে ঘুরাইয়া দেখাইয়া আনিবে।
মেয়েরা উৎসাহিত হইয়া সাবান লইয়া পুকুরঘাটে যায়। স্নো, সিঁদুর, পাউডার, টিপ লইইয়া সাজিতে বসে। হাঙ্গামা হয় বসনকে লইয়া। সে কোনদিন যাইতে চায়—কোনদিন চায় না। মাসী ইহার ওষুধ জানে। সে আগে হইতেই বসনকে খানিকটা মদ খাওয়াইয়া রাখে। অবশ্য মদ খাওয়াইবার জন্য অনেক ছলনা করিতে হয়, ভুলাইতে হয়।
ধোঁয়া ধপধপে কাপড় পরনে প্রৌঢ়া গালে একগাল পান পুরিয়া মেয়েদের সঙ্গে বাহির হয়। মেয়েদের এই দেহের বেসাতির উপার্জনেও প্রৌঢ়ার ভাগ আছে। এই উপার্জন তিন ভাগ হইবে। দুই ভাগ পাইবে উপার্জনকারিণী মেয়েটা, এক ভাগ পাইবে ওই প্রৌঢ়া—এই নিয়ম। গানের আসরের উপার্জনও এমনি ভাগ করিয়া বিলি হয়। আসরের উপার্জন হয় আট ভাগ— আট ভাগ হইতে—এক ভাগ হিসাবে—মেয়ে তিনটি পায় তিন ভাগ—এক ভাগ প্রৌঢ়ার—দুই ভাগ কবিয়ালের, এক ভাগ বেহালাদারের—এক ভাগ আধ ভাগ হিসাবে দোহাররা ও বাজনদার পায়। উপার্জন যে লোক হইতে হইবে না—প্রৌঢ়া তাহাকে দলে রাখিবে না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে উপার্জনের পথগুলির দিকে চাহিয়া বসিয়া থাকে। কোন দিক হইতে ক্ষীণতম সাড়া পাইলেই সে মিষ্টিমুখে সরস বাক্যে সাদর আহবান জানাইয়া বলে–কে গে৷ বাবা? এস, এগিয়ে এস। নজ্জা কি ধন? ভয় কি? এস এস। আগন্তুক আগাইয়া আসিলে সে একটা মোড়া পাতিয়া বসিতে দেয়, পান দিয়া সম্মান করিয়া বলে—পানের জন্য দু আন পয়সা দাও বাবা! দিতে হয়।
পয়সা কয়টা খুটে বাঁধিয়া তবে মেয়েদের ডাকে—ওলো বসন, নির্মলা ইদিকে আয়। বলি ললিতে, ক’ভরি সোনা কানে পরিছিস লো?
এমনি একদিন।
মাসী তাহাকে ডাকিল—বসন! শোন, একটি লোক তোকে ডাকছে লো, বলুছে সে তোকে চেনে।
বসন্ত সেদিন বলিল—আমার গা কেমন করছে মাসী। শরীর ভাল নাই।
—শরীরে আবার কি হ’ল তোর? কিছু হয় নাই, শোন ইদিকে। একটু মদ খেলেই চাঙ্গ হয়ে উঠবে শরীর। শোনা, ইদিকে আয়।
আহবান—আদেশ। উপেক্ষা করিবার উপায় নাই। বসন্ত বাহির হইয়া আসিল। পরিচ্ছন্ন বেশভূষা, গায়ে মুগন্ধি মাখিয়া একটি রীতিমত ভদ্রলোক দাঁড়াইয়া ছিল। মাসী বলিল— দেখি, তোর গা দেখি!… ওমা, গা যে দিব্যি—আমার গা তোর চেয়ে গরম। ওগো বাবা, মেয়ের আমার শরীর খারাপ, একটু মদ খাওয়াতে হবে। সহসা কণ্ঠস্বর মৃদু করিয়া হাসিয়া বলিল—আমার কাছেই আছে।
রূপোপজীবিনী নারীর আজীবনের বহু ভোগের নেশা। স্বরুচিসম্পন্ন বেশভূষা, সুশ্রী লোকটিকে দেখিয়া বসন্তের মনে অভ্যাসের নেশা জাগিয়া উঠিল। কটাক্ষ হানিয়া মুচকি হাসিয়া বসন্ত তাহাকে হাত ধরিয়া ঘরে লইয়া গেল।
মাসীও হাসিল। সে তো জানে, এ বিষ একবার ঢুকিলে—প্রেমের অমৃত সমুদ্রেও তাহাকে শোধন করা যায় না। বসন্তের শরীর ভাল হইয়া গিয়াছে।
লোকটা চলিয়া গেলে বসন্তেরও নেশা ছুটিয়া যায়। মদের নেশার প্রতিক্রিয়ার মতই একটা প্রতিক্রিয়া জাগিয়া ওঠে। নেশার ভান করিয়া সে পড়িয়া রহিল, কাঁদিল। এমন ক্ষেত্রে সে কল্পনা করে, কালই সে নিতাইকে লইয়া এখান হইতে চলিয়া যাইবে। আজও করিল। কিন্তু যাওয়া সহজ কথা নয়, কোথায় যাইবে? ওই মাসী—ওই নির্মলা—ওই ললিতা ছাড়া—কে কোথায় আপন জন আছে তাহার? এই দুনিয়া-জোড়া পথ ছাড়া ঘর কোথায় তাহদের?
দিন সাতেক পর। বসন্ত থরথর করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে আসিয়া মাসীকে বলিল—মালী!
বসন্তর কণ্ঠস্বরে মাসী চমকিয়া উঠিল। এ যে দীর্ঘকাল পরে পুরানো বসন্তর কণ্ঠস্বর – কি, বসন?
কানের কাছে মুখ আনিয়া কিস ফিস্ করিয়া বসন্ত—সেই পুরানো বসন্ত বলিল—ওষুদ, মাসী। আমার ব্যামো হয়েছে।
—ব্যামো? কাসি?
—না না না। বসন্তর চোখে ছুরির ধার খেলিতেছিল—সে দৃষ্টির দিকে চাহিয়াই প্রৌঢ়া নিজের ভুল বুঝিল,—সঙ্গে সঙ্গে হাসিয়া আশ্বাস দিয়া মাসী বলিল—তার জন্যে ভয় কি? আজই তৈরী করে দেব। তিন দিনে ভাল হয়ে যাবে, মাছটা খাস না।
ইহাদের জীবনের এই একটা অধ্যায়। এ অধ্যায় অনিবার্য, আসিবেই। মামুষের জীবনে কোন কালে কেমন করিয়া এ ব্যাধির উদ্ভব হইয়াছিল—সে তত্ত্ব বিশেষজ্ঞের গবেষণার বিষয়। ইহাদের জীবনে কিন্তু এ ব্যাধি অনিবার্য। শুধু অনিবাৰ্যই নয়, এই ব্যাধিতে জর্জরিত হইয়াই সমস্ত জীবনটা কাটাইতে হয় ইহাদের। এই জর্জরতার বিষই মানুষের মধ্যে ছড়াইতে ছড়াইতে তাহারা পথ চলে। ডাক্তারও দেখায় না, কবিরাজও না। নিজেরাই চিকিৎসা করে। ধরা-বাধা হাতুড়ে চিকিৎসা। চিকিৎসা অর্থে—ব্যাধিটা বাহ্যিক অন্তৰ্হিত হয়; কিন্তু রক্তস্রোতের মধ্যে প্রবাহিত হইয় ফেরে। ফলে ভাবী জীবনে অকস্মাৎ কোন একটা ব্যাধি আসিয়া হতভাগিনীদের জীবনটাকে পথের ধূলার উপর আছাড় মারিয়া অর্ধমৃত করিয়া দিয়া চলিয়া যায়। সে-সব কথা ইহারা ভাবে না। এইটাই যে সে-সব ব্যাধির হেতু তাহাও তাহারা বুঝে না। শুধু ব্যাধি হইলে তাহার। সাময়িক ভাবে আকুল হইয়া উঠে।
বসন্তও আকুল হইয়া মাসীর কাছে আসিয়া পড়িল। মাসী রোগের চিকিৎসা জানে। সংবাদটায় ইহাদের মধ্যে লজ্জার কিছুই নাই। শুধু ছোঁয়াচ বাঁচাইবার জন্য সাবধান হয়, রোগগ্রস্তার গামছা কাপড়ের ছোঁয়াচ বাঁচাইয়া চলিলেই হইল। তাহারই মধ্যে খানিকটা ঘৃণার বা অস্পৃশ্যতা-দোষের আভাষ ফুটিয়া উঠে।
গামছা-কাপড় সাবধান করিয়া নির্মলা ললিত আসিল।
বসন্ত কাহারও দিকে ফিরিয়! চাহিল না।
নির্মলা পাশে বসিয়া বলিল—চুল বাঁধা রাখতে নাই। খুলে দি আয়।
নিতাই, গত রাত্রের কয়েকটা উচ্ছিষ্ট পাত্র ছিল, লইয়া বাহির হইয়া যাইতেছিল।
বসন্ত নির্মলাকে বলিল—বারণ কর। সে আজ নিতাইয়ের সঙ্গে মুখ তুলিয়া কথা বলিতে পারিতেছে না।
নির্মল বলিল—দাদা-দাদী—
নিতাই হাসিয়া বলিল—কেনে ব্যস্ত হচ্ছ বসন? কিছু ভয় ক’রো না তুমি। আমার কিছু হবে না।
নির্মলা অবাক হইয়া গেল। তিন দিনের স্থলে নয়দিন কাটিয়া গেল। বসন্ত বিছানায় পড়িয়া ছটফট করিতেছিল। সর্বাঙ্গ তাহার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ফোটকে ভরিয়া গিয়াছে, দেহে কে যেন কালি ঢালিয়া দিয়াছে। গভীর রাত্রে আলো জালিয়া শিয়রে বসিয়া নিতাই বাতাস করিতেছিল। এমন ক্ষেত্রে রুগ্ণ মেয়েগুলির দুর্দশার সীমা থাকে না। ভালবাসার পাত্র পুরুষেরা তাহাদের সঙ্গ ত্যাগ করে, কেহ কেহ হয়তো দল ছাড়িয়া পলাইয়া যায়। রোগগ্রস্তা একা পড়িয়া থাকে। যেটুকু সেবা-যেটুকু যত্ন জোটে, সেটুকু করে ওই দলের মেয়েরাই। নিতাই কিন্তু বসন্তর শিয়রে বসিয়া আছে—প্রশান্ত হাসিমুথে।
সেদিন।
বাহিরে রাত্রি তখন নিঃশব্দ গতিতে প্রথম প্রহর পার হইয়া দ্বিতীয় প্রহরের সমীপবর্তী হইয়া আসিয়াছে। অকস্মাৎ রাত্রির স্তব্ধতা ভেদ করিয়া জাগিয়া উঠিল একটি সুর। জাগিয়া বসিয়াই নিতাই মধ্যে মধ্যে ঢুলিতেছিল। স্বরের সাড়ায় সে জাগিয়া উঠিল৭ একটু না হাসিয়া সে পারিল না। খেয়ালী বেহালাদার বেহালা বাজাইতেছে। আজ নির্মলার ঘরে বীভৎস উৎসবের আসর বসিয়াছে। বেহালাদারের আজ খেয়াল জাগিবার কথাই বটে। সন্ধ্যা হইতেই সে আজ এই সুর শুনিবার প্রত্যাশাও করিয়াছিল। বড় মিঠা হাত। কিন্তু অদ্ভুত মুর। বেহাগের আমেজ আছে। শুনিলেই মনে হয়, গভীর গাঢ় অন্ধকার রাত্রে সব যেন হারাইয়া গেল।
–আঃ ছি! ছি! ছি!—বসন্ত জাগিয়া উঠিয়া বলিয়া উঠিল।
চকিত হইরা নিতাই বলিল—কি বসন? কি হচ্ছে?
—আঃ! বারণ কর গো! বাজাতে বারণ কর।
—ভাল লাগছে না?
হাঁপাইতে হাঁপাইতে বসন্ত বলিল—নাঃ, নাঃ। আমার হাত-পা যেন হিম হয়ে আসছে।
ছড়ির টানে একটি দীর্ঘ করুণ সুর কাঁপিয়া কাঁপিয়া ওই রাত্রির অন্ধকারের সঙ্গে যেন মিশিয়া এক হইয়া যাইতেছে। রাত্রি যেন কাঁদিতেছে।