ঈশ্বর যখন বন্দি – ৭

লুংদোপেদরি যাবার যে বিকল্প রাস্তাটা সেদিন দেচেনের কাছ থেকে রুদ্র জানতে পেরেছিল সেই রাস্তা দিয়েই হন হন করে হাঁটছিল রুদ্র আর প্রিয়ম। ওদের অনুসরণ করছিল নরবু, চিমি, জিগমে, চিমির দাদা ওয়াংচুক আর কিছু গ্রামবাসী যারা বিনোদ বিহারী অর্থাৎ তাদের আগাইকে ভীষণ ভালোবাসত। তাদের মধ্যে জোয়ান ছেলে যেমন রয়েছে তেমনই রয়েছে বুড়ো কর্মা, যাকে হঠাৎ একদিন লুংদোপেদরিতে কাজে গিয়ে শুনতে হয়েছিল আর আসতে হবে না, পেমাজির কথা জানতে চাইলে যাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল মনাস্টারির বাইরে।

বুড়ো হয়ে গেছে কর্মা, চোখেও ভালো দেখে না, তবু কারোর বারণ শোনেনি সে।

প্রত্যেকের হাতে একটা করে ট্রেক করার লাঠি। গ্রামবাসীদের কারো কারো হাতে এক ধরনের ধারালো ছুরি। রুদ্রর পায়ে স্নিকার্স আর গলায় ঝুলছে বাইনোকুলার। চুলগুলো চুড়ো করে টান টান পনিটেল বাঁধা, হাঁটছে হনহন করে। প্রিয়মের পিঠে একটা ছোটো রুকস্যাক।

সকাল দশটা। ভ্যালি থেকে আড়াআড়ি নেমে জঙ্গলে ঢোকার আগে রুদ্র দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। ওপর থেকে দল বেঁধে নামতে গেলে মার্কের দলের চোখে পড়ে যেতে পারে ওরা। ও থেমে ওয়াংচুককে নির্দেশ দিল, সবাইকে নিয়ে ভ্যালির একদম ধারে যে পাহাড় আছে তার ধার ঘেঁষে নামতে। কীভাবে এগোতে হবে তার ম্যাপ বুড়ো কর্মা সবাইকে নিজেদের ভাষায় মুখে মুখে বুঝিয়ে দিল। নরবু প্রিয়ম চিমি আর জিগমেকে নিয়ে রুদ্র সন্তর্পণে নামতে শুরু করল জঙ্গলের দিকে। হিসেবমতো যেহেতু ওয়াংচুকরা ঘুরে ঘুরে লুংদোপেদরির পিছন দিকটায় আসবে, ওদের পৌঁছোতে রুদ্রদের থেকে আধঘণ্টা মতো সময় বেশি লাগবে, মনে মনে পুরো হিসেবটা সাজিয়ে নিচ্ছিল ও।

প্রিয়ম হঠাৎ বলে উঠল, ‘আচ্ছা, তুমি ব্যাপারটা বাবাকে জানিয়েছ তো? না হলে পরে তো উনি ভীষণ রেগে যেতে পারেন!’

রুদ্র উত্তর দিল না। সব কিছু সবাইকে জানাতে নেই সেটা অনেকদিন আগেই শিখে গেছে ও। বাবার প্রায়োরিটি হতে পারে গবেষণা, কিন্তু রুদ্রর প্রায়োরিটি বাবা নিজে।

দেখা যাক, কে জেতে!

প্রিয়ম আবার বলল, ‘দামাজির ওই কুকুরটার কথা ভুলে যেয়ো না যেন! আমার তো দেখেই কোনান ডয়েলের হাউন্ড অফ বাস্কারভিলের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।’

দুর্ভেদ্য জঙ্গল। সূর্যের আলো ঢোকেনি বললেই চলে। দিনদুপুরেও কীরকম একটা নৈঃশব্দ্য রাজত্ব করছে গোটা এলাকাটায়। তার ওপর ঝড়ে মাঝে মাঝেই বিশাল বিশাল গাছ উপড়ে পড়ে আছে। সেগুলোকে পেরিয়ে যাওয়া খুব শক্ত। একটু অন্যমনস্ক হলেই ধারালো সরু ডালে কেটে যাচ্ছে পা। লুংদোপেদরির পেছন দিকটায় এসে দাঁড়াল ওরা। এখানেই ওয়াংচুকের সঙ্গে মিট করে এগোনোর কথা। এখান থেকে সেই গুম্ফাটা পাঁচশো মিটার হবে। রুদ্র একটা বড়ো পাথরের ওপর বসল। পুরো জঙ্গলটাই গত দু—দিনের বৃষ্টিতে স্যাঁৎসেঁতে হয়ে আছে, পাথরগুলোও পিছল।

চিমি ওর ব্যাগ থেকে একটা জলের বোতল বের করল। একটু গলা ভিজিয়ে অন্যদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ম্যাম, পেমাজিকে কি কিছু করেই আর বাঁচানো যাবে না?’ ওর গলাটা ধরে এসেছে।

রুদ্র ওর দিকে তাকাল, ‘পেমাজি অনেকদিন আগেই মারা গেছেন চিমি, শয়তান মার্ক ওঁকে খুন করেও রেহাই দেয়নি।’

চিমির চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এল। নিঃশব্দে চোখ মুছল ও। গতরাতে যখন থেকে ও পুরো ব্যাপারটা শুনেছে, মাঝে মাঝেই কেঁদে ফেলেছে চিমি। পেমাজি কত ভালো ছিলেন, ওকে কত ভালোবাসতেন। ওরকম একজন শান্ত নিরপরাধ মানুষকে মেরে ফেলল ওরা। গত ক—বছরে ও কতবার গেছে একবার দেখা করার জন্য, কিন্তু কোনো—না—কোনো ছুতোয় ওকে আটকে দেওয়া হয়েছে। তবু ও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি এমন ভয়ংকর পরিণতির কথা।

নরবু বলল, ‘ওয়াংচুকরা এখনও এল না তো! জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা হারিয়ে ফেলেনি তো!’

চিমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা প্রচণ্ড বীভৎস চিৎকারে পুরো জঙ্গলের নিস্তব্ধতা চিরে খানখান হয়ে যেতে লাগল। একবার নয়, মুহুর্মুহু সেই জান্তব হুংকারে পুরো জঙ্গলটার মধ্যেই একটা অস্থিরতা দেখা দিল। রুদ্র উঠে দাঁড়াল। কোনো সন্দেহ নেই আওয়াজটা আসছে সেই গোপন গুম্ফা থেকে। প্রিয়ম হতচকিত হয়ে রুদ্রর দিকে তাকাল। রুদ্র বাইনোকুলারটা চোখে লাগাল কিন্তু অন্ধকার আর ডালপালা ভেদ করে কিছু দেখতে পেল না। ও কোনোদিকে না তাকিয়ে ছুটতে শুরু করল। গাছপালাগুলো লাঠি দিয়ে সরাতে সরাতে ছুটছিল ও।

গোপন গুম্ফাটার সামনের দিকটায় এসে রুদ্র দেখতে পেল আগের দিনের মতো সেখানে কোনো প্রহরী নেই, হাড় হিম করে দেওয়া আওয়াজটা ভেতর থেকে আসছে। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে কী করা উচিত ও ভেবে নিচ্ছিল।

প্রিয়ম আর নরবু ছুটতে ছুটতে এসে পড়েছে ততক্ষণে। রুদ্র বলল, ‘চলো, ঢুকি ভেতরে।’

প্রিয়ম রুদ্রকে আটকে মাথা নাড়ল, ‘না! আগে আমাদের পুরো দলটাকে আসতে দাও। চিমিকে ওখানে দাঁড় করিয়ে এলাম ওয়াংচুকরা এলে ওদের নিয়ে আসার জন্য। আমরা মাত্র তিনজন, ভেতরে ঢুকলে বিপদে পড়তে পারি। এটা একটা ট্র্যাপও হতে পারে। হয়তো ওরা টের পেয়েছে আমরা জঙ্গলে ঢুকেছি তাই এরকম কিছু করে আমাদের ফাঁদে ফেলতে চাইছে।’

রুদ্র ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিল। চোরের ওপর বাটপাড়ি করতে গিয়ে বাবার কোনো ক্ষতি হবে না তো!’

ঝোপের মধ্যে খানিকক্ষণ লুকিয়ে রইল ওরা। জান্তব আওয়াজটা ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছে, সঙ্গে কিছু মানুষের আর্তনাদও শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ সামনে প্রায়—ভেঙে—পড়া দরজা দিয়ে ছিটকে বাইরে এসে পড়ল একটা মানুষ! তাকে দেখেই গা শিউরে উঠল ওদের। চোখ দুটো কেউ খুবলে বের করে নিয়েছে, সারা শরীরে অজস্র ক্ষত। লোকটা কাটা ছাগলের মতো চিৎকার করছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা শরীর।

রুদ্র উঠে বেরোতে যাচ্ছিল, প্রিয়ম হাতটা শক্ত করে টেনে বলল, ‘পাগলামি কোরো না! লোকটাকে চিনতে পারছ? অ্যান্ড্রু!’

রুদ্র হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি আরেকটা রাস্তা চিনি, পেছনদিক দিয়ে ঢোকার। আমার সঙ্গে এসো। এভাবে বসে থাকলে বাবার বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে!’

বাড়িটার পেছন দিয়ে ঘুরে ঘুরে যখন ওরা পেছনদিকটায় পৌঁছোল, মানুষের আর্তনাদে কান পাতা দায় তখন। রুদ্র পেছনদিকটায় গিয়ে ভাঙা পাঁচিলের কোটরটা দিয়ে যখন ঢুকল, সামনের দৃশ্য দেখে ওর হাড় হিম হয়ে গেল। সেদিনের বেদিতে বসে থাকা মৃতদেহটা একপাশে হেলে পড়ে রয়েছে, আর তার ঠিক গলা থেকে মুন্ডুটা কেউ নৃশংসভাবে ছিঁড়ে নিয়েছে।

প্রিয়ম আর নরবু দেখে হতবুদ্ধি হয়ে গেছে, রুদ্র বলল, ‘নরবু, তুমি আর এক মিনিটও দেরি কোরো না, চিমি যদি খুঁজে না পায়? দেরি হলে সব শেষ হয়ে যাবে। তুমি গিয়ে ওয়াংচুকদের নিয়ে এসো, ততক্ষণ আমরা সামলে নেব।’ প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভয় পেয়ো না। এটাই সেই ডেডবডি দুটোর একটা। ঝটপট ব্যাগ থেকে টর্চটা বের করো।’

প্রিয়ম যন্ত্রচালিতের মতো টর্চটা বের করে দিল। রুদ্র ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করল। নরবু চলে যেতে এক হাতে টর্চ নিয়ে ও এগিয়ে গেল সিঁড়িটার দিকে। প্রিয়ম তখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে রুদ্র পেছন ফিরে বলল, ‘দাঁড়িয়ে থেকো না, প্রিয়ম। আজ তোমার জন্যেই এত বড়ো সুযোগটা পেয়েছি। তুমি কি চাও, এত কিছুর পরে বাবার বিপদ হোক? দেরি কোরো না, কুইক।’

প্রিয়ম বিমূঢ় ভাবটা কাটিয়ে রুদ্রর পেছন পেছন সিঁড়ির দিকে চলল। সিঁড়ি দিয়ে নেমেই বাঁ—দিকের যে ঘরটায় পেমাজির দেহটা ছিল সেই ঘরে ঢুকতে গিয়ে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে পড়ল রুদ্র। সামনে যে দৃশ্যটা চলছে সেটা মনে হচ্ছে ইংরেজি কোনো সায়েন্স ফিকশন মুভি থেকে উঠে এসেছে।

ধোঁয়ায় ভরে গেছে গোটা ঘরটা, এদিক—ওদিক ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। দুটো ড্রাগন, হ্যাঁ ড্রাগনই, তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে গোটা ঘরটায়। একপাশে পেমাজির ছেঁড়াখোঁড়া মৃতদেহটা পড়ে রয়েছে, অন্যদিকে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে দুটো লোক। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা ঘর। রুদ্রর নজর পড়ল শূন্য বেদিটার পেছন দিকে এক কোণে সিটিয়ে রয়েছে মরিস।

জন্তু দুটোর বিশাল ছুঁচোলো মুখ দুটোর দু—পাশের দাঁত দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, মোটা হাতির শুঁড়ের মতো লেজটা প্রবল আস্ফালনে আছড়াচ্ছে মাটিতে। টকটকে আগুনের ভাঁটার মতোর মতো চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে। বিষাক্ত সাপের মতো কিলবিল করতে করতে প্রবল আক্রোশে তছনছ করছে সব কিছু। রুদ্রর পাশে দাঁড়িয়ে প্রিয়ম আতঙ্কে জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল।

রুদ্র অসীম সংযমে নিজেকে স্থির রেখে দাঁড়িয়ে ছিল। এইরকমটাই তো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাবা কোথায়? রুদ্র তো দেচেনকে দিয়ে লিখে পাঠিয়েছিল যাতে বাবা সিঁড়ির কাছটায় থাকেন। কই বাবাকে তো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না! বাবা কি ঘরের ভেতরের সেই দরজা পেরিয়ে মাটির তলার বাকি ঘরগুলোতে রয়েছেন? কিন্তু এই দুটো জন্তুকে পেরিয়ে ও নীচে যাবে কী করে? নাকি ওরা বড়ো দেরি করে ফেলল, ওরা আসার আগেই বাবাকে…।

কোনো শব্দেই হোক, বা যে কারণেই হোক, একটা ড্রাগন মুখ ফেরাল এদিকে। বীভৎস মুখটায় একটা তীব্র হুংকার দিয়ে ছুটে আসতে লাগল এইদিকে। রুদ্র প্রিয়মকে হ্যাঁচকা টান মেরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল। শেষ ধাপটা পেরিয়ে সাতপাঁচ না ভেবে ডান দিকে ছুটল ও। ডান দিক দিয়ে কিছুটা এগিয়ে আবার ডান দিকে মোড় ঘুরলে সেই ঘরটা, যাতে বাবা থাকেন, যেখানে রুদ্রকে লুকিয়ে রেখেছিলেন বাবা। কিন্তু দরজা বন্ধ। রুদ্র জোরে করাঘাত করতে লাগল, ‘বাবা! দরজা খোলো! আমি রুদ্র! দরজা খোলো, বাবা!’

প্রিয়ম বলল, ‘দাঁড়াও, শব্দ কোরো না! দরজা বাইরে থেকে বন্ধ!’

সত্যিই তো, রুদ্র এতক্ষণ খেয়াল করেনি বাইরে থেকে ছিটকিনি দেওয়া দরজাটায়। তার মানে কি ওরা কাজ মিটতেই বাবাকে…? দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই বাবাকে মেঝেতে আবিষ্কার করল ওরা।

সুরঞ্জন উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন, হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। রুদ্র অস্ফুটে একটা আর্তনাদ করে বসে পড়ল, ‘বাবা!’

প্রিয়ম চিত করে শোয়াল বাবাকে। চোখ বোজা। রুদ্রর বুকের ভেতরে ড্রাম পেটানোর মতো আওয়াজ হচ্ছে। নিজের গালে নিজেই চড় মারতে ইচ্ছে করছে ওর। বেশি ওস্তাদি করতে গিয়েছিল ও। যাও—বা বাবা বেঁচে ছিলেন, ও এসে বাবাকে শেষ করে ফেলল? ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছিল ওর।

প্রিয়ম হঠাৎ বলল, ‘একটু জল দিতে পারবে? আছে এখানে? মনে হচ্ছে পালস আছে, কিন্তু খুব ক্ষীণ।’

রুদ্র পাগলের মতো এদিক—ওদিক চাইল, তারপর আগের দিন যেখান থেকে বাবা জল খেয়েছিলেন সেই ঘড়া থেকে এক ঘটি জল নিয়ে এসে বাবার মুখে জলের ছিটে দিতে লাগল। প্রথমে কিছু হল না, তারপর প্রিয়ম পুরো ঘটির জলটা একসঙ্গে জোরে ফেলতে সুরঞ্জন আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালেন।

রুদ্র চিৎকার করে জড়িয়ে ধরল বাবাকে, ‘বাবা! শিগগিরি ওঠো, এখান থেকে আমাদের বেরোতে হবে।’

সুরঞ্জন আস্তে আস্তে উঠে বসলেন। বললেন, ‘তুই…মানে তোরা এখানে কী করে এলি! কেউ দেখে ফেলেনি তো!’

রুদ্র বলল, ‘পরে ওসব বলব, বাবা! তুমি আগে এখান থেকে চলো শিগগির!’

সুরঞ্জন অবাক হয়ে তাকালেন, ‘কোথায় চলে যাব! তোকে বলেছি না, ওরা আমাকে কোনোদিন ছাড়বে না।’ তারপর ক্লান্ত স্বরে বললেন, ‘আমাকে এই ঘরে আটকে রেখে ওরা ড্রাগনগুলোকে টেস্ট করতে গেছে। আজ ভোর থেকে নিয়মমতো ইলেকট্রিক ইমপালস দিয়ে কেমিক্যালস পুশ করলাম, ঠিক যেরকম ম্যাপিং মার্ক দিয়েছিল। শেষ ইমপালসটা দেওয়ার ঠিক এক ঘণ্টা পর থেকে ব্রেনটা অ্যাক্টিভ হতে শুরু করার কথা। সেটুকু ওদের সবুর সইল না। মার্ক চায় না ও ছাড়া আর কেউ জন্তু দুটোকে কন্ট্রোল করুক। তাই আমাকে আটকে রেখে গেল এখানে।’ পরক্ষণেই সচকিত হয়ে বললেন, ‘তোরা এখান থেকে শিগগির পালা! যেকোনো মুহূর্তে ওরা চলে আসতে পারে।’

রুদ্র বলল, ‘তুমি তাড়াতাড়ি ওঠো আগে। আমি যেতে যেতে সব বলছি। ড্রাগনগুলো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, ওদের অর্ধেককে মেরে ফেলেছে! এখান থেকে আমাদের এক্ষুনি বেরোতে হবে।’

সুরঞ্জন এবার উঠে দাঁড়ালেন। ওরা তিনজন ঘরটা থেকে বেরিয়ে পড়ল। রুদ্র পেছনদিকটায় যাচ্ছিল, প্রিয়ম বাধা দিল, ‘দাঁড়াও, গুম্ফার সামনের দিকটায় চলো, আমাদের তাড়া করা ড্রাগনটা পেছনদিকটায় থাকতে পারে।’

ছুটতে ছুটতে সামনের দিকটায় ওরা যখন এসে পৌঁছোল তখন ভেতর থেকে মানুষের আর্তনাদ আর শোনা যাচ্ছে না, শুধুই পাশবিক হুংকার। গুম্ফার সামনের মশাল রাখার জায়গাটা রক্তগঙ্গা বয়ে গেছে। একটা ক্ষতবিক্ষত লাশকে শনাক্ত করতে পারল রুদ্র, ধনেখালির অবিনাশবাবু!

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। এতদূর পর্যন্ত ওঁকে নিয়ে এসেছিল মার্ক। টাকার লোভে অবিনাশবাবু নিজের নির্দোষ কাকাকে তো খুন করলেনই, নিজেও পাপের বলি হলেন, মাঝখান থেকে রুদ্রর স্যাংশন করা লোনের টাকাটাও মারা গেল। পরক্ষণেই এই অবস্থাতেও ব্যাঙ্কের কথা মনে পড়াতে রুদ্রর হাসি পেয়ে গেল।

অবিনাশবাবুর লাশের পাশে মরিস পড়ে আছে, একটা পা ছিঁড়ে নেওয়া, মুখে একটা অংশ খোবলানো। আর দেরি করা যায় না। ওরা সামনের দিকে ছুটতে লাগল। একবার এই পুরো জঙ্গলটা পার হয়ে ভ্যালিতে উঠে পড়তে পারলেই নিশ্চিন্ত।

রুদ্র বাবার হাতটা শক্ত করে ধরে নিয়ে ছুটছিল।

গুম্ফার সামনের অংশটায় এসে দেখা গেল নরবু ওয়াংচুকদের দলটাকে নিয়ে এসে পড়েছে। পাঁচ—ছ—জন গ্রামবাসী মিলে ছুরি দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করছে একটা ড্রাগনকে, তার গগনবিদারী আর্তনাদে বুকের রক্ত ছলকে ওঠে। জন্তুটার ছোটো ছোটো দাঁত—ওলা লেজটা থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। মাঝে মাঝেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে লাভার মতো আগুনের গোলা।

এই অবস্থাতেই রুদ্র মার্ককে খুঁজছিল। মার্ক কোথায় গেল? ওকে না শেষ করলে কাঁটাটা পুরোপুরি দূর হবে না। রুদ্র সামনের দরজাটা দিয়ে গুম্ফায় ঢুকে গেল। এদিক দিয়ে এর আগে কখনো ঢোকেনি ও। মনে মনে আলোর থেকেও দ্রুতগতিতে ও ভাবছিল, মোট তিনটে ড্রাগন আছে, একটা বাইরে আর দুটো তাহলে ভেতরে থাকতে পারে। খুব সন্তর্পণে ও এগোচ্ছিল গলিটা দিয়ে, এদিকটা আবছা অন্ধকার, তার মধ্যে ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করছে। তাড়াহুড়োয় টর্চটা বাবার সেই ঘরে ফেলে এসেছে।

গলির শেষপ্রান্তের সেই ঘরটায় উঁকি দিতে যাবার আগেই কীসে একটা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল রুদ্র। পায়ে কিছু একটা জড়িয়েছে। ছাড়াবার চেষ্টা করতে গিয়ে পারল না। ছটফট করতে করতে সামনে মুখ তুলতে ও মার্ককে দেখতে পেল। হাতে একটা রিভলভার।

মার্ক চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘তুমি নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করো, তাই না?’

এই অবস্থাতেও রুদ্র অল্প হাসল, বলল, ‘হুম, মনে করি বুদ্ধি বস্তুটা আমার সত্যিই আছে।’ একটু থেমে যোগ করল, ‘তবে আপনার মতো নয়!’

মার্কের চোখ দুটো হিংসায় জ্বলছিল, ‘তাই বুঝি! আমার রিসার্চওয়ার্কটা সামহাউ সাকসেসফুল হল না, তাই তুমি ভেবে ফেললে এই ফাঁকে বাবাকে নিয়ে পালাবে।’

রুদ্র কষ্ট করে উঠে বসল, মুখ দিয়ে আফশোসের একটা চুক চুক শব্দ করে বলল, ‘দুটো কথা ভুল বললেন আপনি। এক নম্বর, আপনার রিসার্চওয়ার্ক নয়, আপনাদের চুরি করা রিসার্চওয়ার্ক বলুন, নিরপরাধ মানুষদের নিজেদের মর্জিমাফিক খুন করে, লোককে দিয়ে জোর করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করে যেটা করেছেন সেটাকে রিসার্চ বলে আর যাইহোক শব্দটার অপমান করবেন না। আর দু—নম্বর হল, সামহাউ সাকসেসফুল হল না নয় ওটাকে আমরাই পণ্ড করেছি। আমার হাজব্যান্ড আমার কথামতো ইচ্ছে করেই ভুল ম্যাপিং করেছিল যাতে পুরো জিনিসটা ঘেঁটে যায় আর আপনাদের এত বছরের এত পরিশ্রম, এত খুনখারাপি সব জলে যায়।’

মার্কের মুখটা ওই বিকৃত ড্রাগনগুলোর থেকেও বেশি হিংস্র হয়ে উঠল। গুলি চালাতে গেল রুদ্রর দিকে তাক করে। কিন্তু তার আগেই ওর মুন্ডুটা ধড় থেকে একটানে আলাদা হয়ে গেল। পেছনে দ্বিতীয় ড্রাগনটা।

রুদ্র প্রস্তুত হয়েই ছিল। আগেই দেখতে পেয়েছে ও জন্তুটাকে, বেশি কথা বলে মার্ককে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছিল। ড্রাগনটা মার্কের ছেঁড়াখোঁড়া লাশটা পেরিয়ে এদিকে আসার আগেই ও সিঁড়ি দিয়ে ওপরদিকে ছুটতে লাগল। বাইরে বেরিয়ে এলোপাথাড়ি ছুটতে ছুটতে পা কেটে রক্ত বেরোচ্ছিল দরদর করে, তবু থামছিল না। দূরে দেখল ওয়াংচুকদের দলটা ভীতসম্ভ্রস্ত চোখে এদিকে তাকিয়ে আছে।

প্রিয়মও দেখতে পেয়েছে রুদ্র এদিকে ছুটে আসছে আর পেছনে অন্য ড্রাগনটা তাড়া করেছে। ওয়াংচুকদের দলটা দেখতে পেয়েই লাঠিসোঁটা নিয়ে প্রস্তুত হতে লাগল, নরবু আর জিগমে ছুরি নিয়ে দু—দিক থেকে এগোতে লাগল। চিমি একটা মস্ত বড়ো পাথর হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল হাতের নাগালে এলেই ছুড়ে মারবে জন্তুটার মাথায়!

কিন্তু তার আর প্রয়োজন হল না। রুদ্রর গোড়ালি যখন প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে জন্তুটা, পেছন থেকে আরেকটা ড্রাগন এসে প্রথমটাকে আক্রমণ করল। দু—জনে মিলে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে মত্ত হয়ে পড়ল। একপাশে পড়ে থাকা অন্য ড্রাগনটার মৃতদেহের পাশেই দু—জনে দু—জনকে আঘাত করে যাচ্ছিল। সারা জঙ্গল, আকাশ, গাছপালা চিরে জন্তু দুটোর আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ছিল। মিনিট পাঁচেক বাদে আস্তে আস্তে সব নিস্তেজ হয়ে গেল।

দূরের ওই গুম্ফাটাকে তখন আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করেছে। পোড়া মাংসের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল ওদের। আতঙ্ক কাটতে রুদ্রকে সবাই ধরাধরি করে তুলল। ঘামে জবজবে গেঞ্জিতে হাতের কেটে যাওয়া রক্ত মুছে ক্লান্ত চোখে ও তাকাল সুরঞ্জনের দিকে। মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি।

সুরঞ্জনও হাসলেন কিন্তু তাঁর ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছিল কষ্টে। মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ, আবার জীবনের মূলস্রোতে ফিরে যাওয়ার আনন্দ, সব ছাড়িয়ে ওঁর ভেতরের প্রত্নতত্ত্ববিদ সত্তাটা প্রবল হয়ে উঠেছিল যে মনে করিয়ে দিচ্ছিল এত বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম ব্যর্থ হল! যে প্রাণী তিনটেকে নিজের হাতে করে গড়ে তুললেন, তিলে তিলে পদ্মসম্ভবের দেখানো পথ অনুযায়ী এতগুলো বছর, এতগুলো দিন তৈরি করলেন, তারা কন্ট্রোলড হবার বদলে এরকম পিশাচে পরিণত হল? স্যারের কথা তিনি রাখতে পারলেন না! আর কোনোদিন পারবেনও না, কারণ গুহার নীচে চাপা পড়ে ওই তেঞ্জ্যুরটা হারিয়ে গেছে মাটির গর্ভে।

রুদ্র বাবার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছিল, কিন্তু ও কিছু বলল না। মনে মনে শুধু ও উচ্চারণ করল, এ ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না তোমাকে ফিরে পাওয়ার, বাবা! প্রিয়ম ঠিক যে ম্যাপিংটা বের করেছিল, সেটা মার্ক পেলে ওদের কাজ মিটে যেত। কিন্তু তোমাকে বাঁচিয়ে রাখত না। সেটাই আমার কাছে সবথেকে জরুরি ছিল।

রুদ্র এগিয়ে বাবার বুকে মাথা রাখল, ‘ঈশ্বরকে বন্দি না করাই ভালো, বাবা! কিছু জিনিস অজানাই থাক! ঈশ্বরকে বন্দি করতে গিয়ে উনি যে কোপ দেন, সেই কোপে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে!’

সুরঞ্জন কিছু না বলে মাথা নাড়লেন, তারপর রুদ্রর মাথার ওপর হাত রাখলেন।

অন্য হাতটা অনেকক্ষণ আগে থেকেই প্রিয়মের কাঁধ জড়িয়ে আছে।

সুরঞ্জন আলুর পরোটার একটা টুকরো মুখে পুরে বললেন, ‘আহা, কতদিন বাদে এমন সুন্দর রান্না খাচ্ছি। রুদ্র, বাড়ি গিয়ে ভালো মন্দ রান্না করে বুড়ো বাবাটাকে খাওয়াবি তো?’

রুদ্র বলার আগেই প্রিয়ম বলে উঠল, ‘হ্যাঁ বাবা, ঠিক পাঁচ মাস সতেরো দিন আগে ও একটা কাঁচকলার কোফতা বানিয়েছিল, ল্যাপটপটা আভেনের ওপর বসিয়ে। দারুণ হয়েছিল অবশ্য!’

রুদ্র উবু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধছিল। আর একটু বাদেই ওরা এখান থেকে বেরিয়ে পড়বে। রওনা হবে পারো এয়ারপোর্টের উদ্দেশে। লুংদোপেদরির সেই ঘটনার পর পাঁচদিন কেটে গেছে। সেদিন তার কিছুক্ষণ বাদেই পুলিশ এসে হাজির হয়েছিল, তবে গ্রেফতার করার মতো কেউই বেঁচে ছিল না। মার্ক জন্তু তিনটের অস্বাভাবিক আচরণ দেখে অবিনাশবাবু সুদেব আরও কিছু ভারতীয়, যারা কোনো—না—কোনো সময়ে ওর অপকর্মের অংশীদার হয়েছে তাদের সবাইকে কৌশলে মাটির নীচের ঘরটায় আটকে দিয়েছিল যেখানে একটা ড্রাগন ওদের দেহগুলোকে বীভৎসভাবে ছিঁড়েছে। একমাত্র কেলির সঙ্গে আসা এক চ্যালা প্যাট্রিক, সেদিন লুংদোপেদরিতেই বসে ছিল বলে বেঁচে গেছিল। তাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে।

দেচেন মাটির তলার ঘরে অচৈতন্য হয়ে পড়ে ছিল, শরীরের অর্ধেকই পুড়ে গেছিল ওর। দু—দিন বাদে বেচারা নির্দোষ মানুষটা হাসপাতালে মারা যায়। আর বেঁচে ছিল মার্কের পোষা কুকুরটা। বেচারা প্রথম দু—তিনদিন কিছু খায়নি, মনিবের জন্য কাতর স্বরে ডেকে গেছে অবিরাম। শেষমেষ ওকে পুলিশের তত্ত্বাবধানে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

পুলিশের আদেশমাফিক রুদ্রদের ক—দিন এখানে থাকতে হয়েছে। কাল লোকাল থানার ওসি মি গুরুং ওদের চলে যাওয়ার পারমিশন দিয়েছেন। যদিও তদন্তের স্বার্থে ওদের, বিশেষ করে সুরঞ্জনকে মাঝে মাঝে বারকয়েক এসে থিম্পু হেড কোয়ার্টারে হাজিরা দিতে হবে। ইন্ডিয়া আর ভুটানের পুলিশ যৌথভাবে এই পুরো ঘটনাটার তদন্ত শুরু করবে। ইন্ডিয়ার সমস্ত কাগজে নাকি অলরেডি কয়েকদিন ধরে এই খবরটা বেরোচ্ছে আর সারা দেশে যথারীতি বেশ আলোড়ন ফেলে দিয়েছে।

ক্রুদ্ধ চোখে রুদ্র প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে একটা ভস্ম করা দৃষ্টি দিল, তারপর সুরঞ্জনকে বলল, ‘কাঁচকলা নয় গো বাবা, শাহি পনির। তোমাকে বিরিয়ানি করে খাওয়াব গিয়েই। মা শিখিয়েছে আমাকে।’

সুরঞ্জন হাসছিলেন, পরক্ষণেই বললেন, ‘তোর মা—কে ফোনে পেলি?’

গত কয়েকদিন ধরেই নরবুর ফোন থেকে মা—কে ট্রাই করে যাচ্ছে রুদ্র, কিন্তু পাচ্ছে না। ল্যান্ডলাইন বেজে বেছে কেটে যাচ্ছে আর মোবাইল আউট অফ রিচ। চিন্তান্বিত গলায় রুদ্র মাথা নাড়ল। বাড়ির জন্য মনটা ছটফট করছে এবার ওর।

জিগমে গাড়ি সামনে দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করছিল। নরবু মালগুলো একে একে গাড়িতে তুলছিল। চিমি, চিমির দাদা ওয়াংচুক, চিমির মা সবাই দাঁড়িয়ে ছিল। রুদ্র হেসে চিমির হাতে হাত রাখল, ‘আবার আসব খুব শিগগিরই। তোমার আর নরবুর বিয়েতে। নিমন্ত্রণ করবে তো?’

চিমি সলজ্জ হেসে একপাশে মাথা নাড়ল, তারপর জড়িয়ে ধরল রুদ্রকে। সেদিন চিমির মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় রুদ্র অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়েছিল ওঁদের এই বিয়ের ব্যাপারে। নরবু ছেলে ভালো, চিমিকে ভালোওবাসে খুব, সেক্ষেত্রে নেপালি ভুটানিটা কোনো ইসু নয়। অবশেষে চিমির বাবা—মা মত দিয়েছেন।

প্রিয়ম আরও দু—একবার রুদ্রকে লেগপুলিং করার চেষ্টা করতে রুদ্র চাপা গলায় বলল, ‘বাবাকে বলে দেব যে তাঁর রামানুজন জামাই পাজলটা সলভও ঠিকঠাক করতে পারেনি, ভুলভাল করে পুরো রিসার্চটা পণ্ড করেছে?’

প্রিয়ম হতবুদ্ধি হয়ে বলল, ‘মানে? তুমিই তো বললে আমি যেন ভুল ম্যাপিংটা দিই মার্ককে! আমি কোথাও পণ্ড করলাম!’

রুদ্র চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আমার রান্নার নামে অপবাদ দিলে সেটাই বাবাকে বলব আমি। সুতরাং আর একবার বলে দেখো তুমি!’

চমকের তখনও অল্প বাকি ছিল। প্রিয়ম গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে এমন সময় পুলিশের একটা গাড়ি এসে ওদের সামনেটায় থামল। মি গুরুং গাড়ি থেকে নামলেন, হেসে বললেন, ‘বেরিয়ে পড়ছেন বুঝি?’

প্রিয়ম হাসল, ‘হ্যাঁ। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’

মি গুরুং হেসে বললেন, ‘দাঁড়ান, ধন্যবাদের তো এখনও বাকি আছে। সবটা শেষ হলে না হয় ধন্যবাদ দেবেন।’ বলেই গাড়ি থেকে কাউকে নেমে আসতে বললেন।

দু—জন লোকের সঙ্গে যিনি নামলেন, তাঁকে দেখে সবাই চমকে উঠল।

পূরবী এগিয়ে এসে রাগত স্বরে বললেন, ‘জানতাম আমার মেয়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন, কিন্তু তোমার কাছ থেকে তো এটা আশা করিনি, প্রিয়ম! কী করে করলে তোমরা এটা? বারো তেরো দিন হয়ে গেল একটা কোনো খোঁজ নেই, তোমরা কি চাও, চিন্তায় চিন্তায় আমি মরে যাই? কই, সে কোথায় গেল, রুদ্র?’ বাড়ির বারান্দার দিকে চোখ বোলালেন পূরবী আর হঠাৎই যেন জমে বরফ হয়ে গেলেন।

রুদ্রর পাশে চেয়ারে ওটা কে বসে আছে?

প্রিয়ম মুচকি মুচকি হাসছিল। ওরা ভেবেছিল কলকাতায় ফিরে মাকে সারপ্রাইজ দেবে, ভালোই হল ভুটানেই এই কালো অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল, ভুটানেই ইতি হল।

সুরঞ্জনও পূরবীকে দেখছিলেন। মাথার সামনের চুলে অল্প পাক ধরেছে, একটু মুটিয়েছে, কালো রিমলেস চশমায় বেশ ভারিক্কি দিদিমণি লাগছে।

পূরবী বিস্ফারিত অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সুরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। পেছন থেকে এসে রুদ্র জড়িয়ে ধরল, ‘বাবাকে খুঁজে পেয়েছি মা আমরা! আর কোনোদিনও বাবা আমাদের ছেড়ে কোত্থাও যাবে না!’

সুরঞ্জন ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে এসেছেন। আরেকটু এগিয়ে এসে পূরবীকে জড়িয়ে ধরলেন সুরঞ্জন।

তারও প্রায় ঘণ্টা দশেক পরে পারো থেকে ওরা যখন প্লেনে উঠল, রুদ্র জানলার পাশের সিটে বসে ভাবছিল, নীচের এই ছোট্ট দেশটার এককোণে আবার চাপা পড়ে থাকবে একটুকরো ইতিহাস, একজন বিজ্ঞানীর ব্যর্থ গবেষণার হতাশা মিথ হয়ে ঘুরে বেড়াবে আনাচেকানাচে।

হয়তো কয়েকশো বছর পরে আবার বিনোদ বিহারীর মতো কেউ আবিষ্কার করবে সেটা। নীচে মেঘের সারির খেলা দেখতে দেখতে বাঁ—পাশে তাকাল ও, প্রিয়ম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। সামনে তাকাল, বাবা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। পাশে মা।

এতদিন বাদে স্বস্তিতে, পরম নিশ্চিন্তে চোখ বুজল রুদ্র।

.

সহায়ক গ্রন্থতালিকা

1) Secret Buddhism : Vajrayana, Kalu Rinpoche, Clearpoint Pr.

2) Tantric Grounds and Paths : Howto Enter, Progress on, and Complete the Vajrayana Path, Geshe Kelsang Gyatso, Tharpa Publications

3) Essence of Vajrayana : The Highest Yoga Tantra Practice of Heruka Body Mandala, Geshe Kelsang Gyatso, Tharpa Publications

4) Vajrayana Buddhism : Tantra, Viajrayana, Guru, Tulpa, Charnel Ground, Yog-acara, Mahasiddha, Kukai, Mudra, Shurangama Mantra, Ganachakra

5) Baker, I. (2017). Moving towards Perfection : Physical Culture in Dzogchen as revealed in Tibet’s Lukhang Murals. Asian Medicine : Tradition and Modernity. Leiden : E. J. Brill.

6) The Body Electric : Electromagnetism and the foundation of life, Robert Becker, Gary Selden, William Morrow Paperbacks

7) Uncle Petros and Goldbach’s Conjecture : A Novel of mathematical Obsession, Apostolos Doxiadis, Bloomsbury, USA

8) The Goldbach Conjecture, Yuan Wang, World Secientific Pub Co Inc

9) Goldbach Conjecture, The Prime Solutions, Leong Ying

10) Leonhard Euler : Mathematical Genius in the Enlightenment, Ronald S, Calinger, Princeton University Press

11) Bhutanese Buddhism and its Culture, Kumagai Seiji, Vajra Books

12) Prime Numbers and Cryptography, Hans Riesel

13) বিবিধ জার্নাল সহায়তায় National Library and Archives of Bhutanঅন্যান্য সহায়তায় Google

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *