ঈশ্বর যখন বন্দি – ৬

প্রিয়ম আর নরবু হন্তদন্ত হয়ে চিমিদের বাড়িতে ফিরে আসছিল। পুরো চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে রুদ্র নিখোঁজ। গতকাল সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে রুদ্রকে আর দেখতে পায়নি প্রিয়ম। প্রথমে ভেবেছিল কাছাকাছি কোথাও ঘুরতে গেছে, কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎকণ্ঠাও বাড়ছিল। নরবু আর চিমি আশপাশটা খুঁজে এসেছিল, প্রিয়ম জিগমের গাড়ি করে লূংদোপেদরি গিয়েছিল, যদিও রাতের অন্ধকারে রুদ্র লুংদোপেদরি চলে যাবে, তা—ও আবার ওই দড়ির সাঁকো পেরিয়ে, এটা প্রিয়মের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি, সেদিনের সেই দারোয়ান ভেতরে ঢুকতেই দিল না। দামাজি নাকি নেই, এ অবস্থায় বাইরের কাউকে ও ঢুকতে দিতে পারবে না। রুদ্রর কথা জিগমে জিজ্ঞেস করাতে ঘাড় নেড়ে জানিয়েছিল যে কেউ আসেনি।

চিন্তায় প্রিয়মের মাথার চুল ছেঁড়ার মতো অবস্থা! তবে কি রুদ্রকেও কেউ কিডন্যাপ করল? ধনেখালিতে ওই ছেলে দুটোর হুমকি দেওয়ার কথা মনে পড়ছিল ওর বার বার। কিন্তু তাতেও খটকা লাগছিল কারণ প্রিয়মের জ্যাকেট থেকে শুরু করে রুদ্রর লম্বা গামবুট, লাঠি, টর্চ কিছুই নেই রুমে! কেউ কিডন্যাপ করলে প্রিয়মের ঘুম ভেঙে যেত আর সেক্ষেত্রে এগুলো নিশ্চয়ই সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেত না। শুধু যেটা সবচেয়ে দরকারি, মোবাইল, সেটাই ফেলে গেছে! সারাটা রাত দু—চোখের পাতা এক করতে পারেনি দুশ্চিন্তায়।

সকাল হতে—না—হতেই ও আর নরবু গাড়ি করে ছুটেছিল এখানকার পুলিশ স্টেশনে। এই পুরো এলাকার ছ—সাতটা ছোটো গ্রামের একটাই থানা, সেটা এখান থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরে। যে জিগমে কথাই বলে না প্রায়, সে—ও কাল থেকে অনর্গল কথা বলে চলেছে, কোথায় কীভাবে কী করা যায় সেই ব্যাপারে। থানাতেও কথাবার্তা ও—ই বলল। যেহেতু প্রিয়মরা বিদেশি নাগরিক, থানার যিনি প্রধান, সেই ইনস্পেকটর গুরুং খুবই গুরুত্ব দিয়ে সব শুনলেন, প্রায় এক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর বিকেলে একবার খোঁজ নিয়ে যেতে বললেন।

সকাল থেকে একফোঁটা জল—ও পেটে পড়েনি, তার ওপর এই অসহনীয় চিন্তা, প্রিয়মের পাগল পাগল লাগছিল। তাই চিমিদের বাড়িতে ঢুকতে—না—ঢুকতেই চিমি যখন ছুটে এসে বলল রুদ্র ফিরে এসেছে, ওর যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে এল!

চিমিকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, প্রিয়মরা বেরোনোর পরে পরেই রুদ্র ফেরে। কোথায় ছিল, কী হয়েছিল কিছুই বলেনি, খুব টায়ার্ড ছিল, চিমির মায়ের করে দেওয়া আলুর পরোটা খেয়ে ওপরে ঘুমোচ্ছে।

প্রিয়ম হুড়মুড়িয়ে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল ওপরে, ঘরে ঢুকে দেখল কম্বল চাপা দিয়ে রুদ্র অঘোরে ঘুমোচ্ছে। দ্রুত পায়ে ও রুদ্রর কাছে গিয়ে কপালে হাত দিল, গা অল্প গরম। মুখে বা হাতে—পায়ে কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। এতক্ষণে প্রিয়ম একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। নিঃশব্দে রুদ্রর মাথার কাছে বসে গরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। কোথায় ছিল এই গোটা একটা দিন কিছুই বুঝতে পারছিল না ও!

ততক্ষণে দরজার কাছে জিগমে, চিমি আর নরবু উপস্থিত হয়েছে। প্রিয়ম মুখে আঙুল দিয়ে সবাইকে শব্দ করতে বারণ করল।

মাথায় হাত বোলানোর সময় হাতটা একটু পেছনদিকে নিয়ে যেতেই রুদ্র ঘুমের মধ্যেই যন্ত্রণায় ‘উঃ!’ করে উঠল। এতক্ষণে প্রিয়ম খেয়াল করল মাথায় পেছনদিকটা বেশ ফুলে আছে রুদ্রর। পড়ে গিয়ে চোট পেলে যেরকম হয়। হাতটা সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল প্রিয়ম। এখন ভালো করে ঘুমোক, তারপর উঠলে এমন বকুনি দেবে, জীবনে কোথাও আর না বলে যাওয়ার সাহস পাবে না।

রুদ্রর ঘুম ভাঙল সেই বিকেলে, তখন প্রিয়ম পাশের চেয়ারে বসে একটা বই পড়ছিল। মাঝে দুপুরে খাবার জন্য মৃদুভাবে দু—একবার ডাকা হয়েছে, তবে ওর ঘুম ভাঙেনি। এতক্ষণ ঘুমিয়ে মুখ চোখ বেশ ফুলে গেছে শরীরটাও তাজা দেখাচ্ছে। প্রিয়ম ওকে জেগে উঠতে দেখে বই বন্ধ করে পাশে এসে বসল।

বকুনিটা কি এখনই শুরু করবে নাকি আরেকটু পরে, প্রিয়ম ঠিক বুঝতে পারল না।

রুদ্র অন্যমনস্কভাবে কিছুক্ষণ জানলা দিয়ে দূরের লুংদোপেদরির চূড়ার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমাদের ভুটান আসা সাকসেসফুল প্রিয়ম। বাবাকে খুঁজে পেয়েছি আমি।’

শেষ কথাটায় প্রিয়ম এত হতচকিত হয়ে গেল যে বকুনির শুরুটা পুরো ভুলে গেল। ঘুমের ঘোর এখনও কাটেনি নাকি?

ও গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘মানে!’

রুদ্র ছলছলে চোখে গত দু—রাতের সমস্ত ঘটনার ইতিহাস বিশদে বলল প্রিয়মকে। প্রিয়ম শুনে তো স্তম্ভিত। এত বড়ো বিপদের ঝুঁকি নিয়েছিল রুদ্র! ও কিছুক্ষণ বিস্ময়ে কথা বলতে পারল না! তারপর বলল, ‘সাপ থেকে ড্রাগন! এ তো পুরো গ্রিম ব্রাদার্সের রূপকথা। বাবাকে চিনতে তোমার কোনো ভুল হয়নি তো?’

রুদ্রর মুখটা ম্লান হয়ে উঠল, ‘বাবাকে চিনতে ভুল করব আমি! কী যে বলো তুমি। কাল সারাটা রাত আমি আর বাবা কথা বলেছি। বাবার চেহারা কত ভেঙে গেছে, মনে হচ্ছে যেন কত বয়স!’

প্রিয়ম বলল, ‘তার মানে ট্রেন থেকে যে লোকটা আমাদের ফলো করে যাচ্ছিল, এখানে এসে আর দেখতে পাচ্ছি না, সে—ই আরেকটা পার্টনার বলদেব?’

রুদ্র সায় দিয়ে বলল, ‘সুদেব। কিন্তু তার সঙ্গে এখন মার্কের ঠিকঠাক বনিবনা হয় না। তাই সে আমাদের হিতৈষী না অনিষ্টকারী সে—ব্যাপারে এখনও শিয়োর নই আমি।’

প্রিয়ম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘চলো, এখানকার পুলিশ ফোর্স নিয়ে যাই, ওই দামা বেটাকে অ্যারেস্ট করে বাবাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি।’

রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘অত সহজ নয়। কী গ্রাউন্ডে পুলিশ অ্যারেস্ট করবে মার্ক মানে ওই দামাকে? পেমাজিকে যে ওরা খুন করেছে তার কোনো প্রমাণ আমরা এই মুহূর্তে পুলিশকে দিতে পারব না, আমি ওই গোপন গুম্ফার হদিশ কাউকে দিতে চাই না।’

প্রিয়ম অবাক হয়ে গেল, ‘কেন?’

রুদ্র বলল, ‘কারণ, জঙ্গলের ওই গুম্ফায় গেলে পেমাজি আর ওই লোকটার মৃতদেহ পেয়ে পুলিশ হয়তো ওদের গ্রেফতার করবে, বাবাও মুক্তি পাবেন, কিন্তু তাতে আমার উদ্দেশ্য সাধন হবে না। ওই মার্কের নেটওয়ার্ক অনেক বড়ো। অবিনাশ চৌধুরী পর্যন্ত ওদের দলের লোক। মার্ক নিজে অ্যারেস্ট হলেও ওর দলের অন্য পাণ্ডারা, যারা লন্ডনে আর ইন্ডিয়ায় বসে আছে, তারা বাবাকে ছাড়বে না। আমি চাই না বাকি জীবনটাও বাবাকে হারানোর ভয়ে কাটাতে হোক আমাকে। বাবা লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াক। তাই পুরো জিনিসটা সমূল বিনাশ করতে হবে।’

প্রিয়ম বলল, ‘আমরা শুধু দু—জন আর ওরা এতজন, পুলিশের হেল্প না নিয়ে কী করে আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে এটা?’

রুদ্র চিন্তান্বিতভাবে বলল, ‘আমি একটা রাস্তা ভেবেছি। সেই অনুযায়ীই এগোতে হবে আপাতত। কিন্তু তাতে তোমার প্রচুর হেল্প লাগবে।’

প্রিয়ম বলল, ‘কী রাস্তা?’

একদিনে তিনবার ফ্লাইট চেঞ্জ করতে হল। প্রথমে সকাল বেলায় কলকাতা এয়ারপোর্টে নামা, তারপর ওখান থেকে বাগডোগরা, সবশেষে পারো এয়ারপোর্ট। কেলির এই নিয়ে তিন—চারবার আসা হলেও প্যাট্রিকের এদিকে আসা এই প্রথম। ভুটানের পারো বিমানবন্দরটা এমনিই ছবির মতো সুন্দর, মেঘমুক্ত ঝকঝকে নীল আকাশ, পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছোটো ছোটো চোখ জুড়োনো ভ্যালি, তার মাঝে একফালি ধানের শিসের মতো এয়ারপোর্ট, তার ওপর প্যাট্রিক এই প্রথম হিমালয় দেখছে। সে তো একেবারে বাকরুদ্ধ!

উত্তেজনায় তার মুখ নিয়ে মাঝে মাঝেই বিচিত্র সব শব্দ বেরিয়ে আসছে। কেলি সে তুলনায় অনেক নিস্পৃহ। বৈজ্ঞানিকদের বেশি উচ্ছ্বাস দেখানো মানায় না। চোখ বুজে সিটে হেলান দিয়ে ও ভাবছিল আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগসুবিধে। ও কেমন সুন্দর পুরো তেঞ্জ্যুরটা ছবি তুলে মার্ককে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিল, কিন্তু বাবা বা দাদুর আমলে কত শক্ত ছিল ব্যাপারগুলো! তেঞ্জ্যুরটা সত্যি করে মার্ককে দেখাতে নিয়ে এলে তো এতক্ষণে এয়ারপোর্টেই ও ধরা পড়ে যেত!

পারোতে মার্ক নিজে অপেক্ষা করছিল ওদের জন্য, সঙ্গে মরিস। দেখা হতেই ওদের গাড়ি ছুটল উরার দিকে। কেলি মনে মনে হিসেব কষছিল। পাঁচ—ছ দিনের থাকার প্ল্যান ওর, তার মধ্যেই পুরো কাজটা শেষ করতে হবে, নিদেনপক্ষে শেষ অধ্যায়টা শুরু করে দিতে হবে। এর মধ্যে ওই আর্কিয়োলজিস্টকে দিয়ে পুরো ইন্টারপ্রিটেশনটা শেষ করে কাজ শুরু করে দিতে হবে। লোকটা বড্ড গোঁয়ার, যারা টাকার লোভে ভোলে না, তাদেরকে নিয়ে পদে পদে ঝামেলা।

কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। যদ্দিন না এই পুরো ব্যাপারটা শেষ হচ্ছে, মালটাকে পৃথিবী থেকে সরানো যাবে না। হঠাৎ কী মনে পড়তে ও মুখ ঘুরিয়ে মার্কের দিকে তাকাল, ‘আচ্ছা, পরশু ফোনে বললে ওই আর্কিয়োলজিস্টের মেয়ে নাকি এসেছিল মনাস্টারিতে, সত্যি?’

মার্ক বাইরে যখন আসে, মনাস্টারির বেশভূষা ছেড়েই আসে, অন্য কেউ দেখলে বুঝতেই পারবে না যে ও—ই লুংদোপেদরির দোর্দণ্ডপ্রতাপ দাওয়া লামা। সিগারেট থেকে একটা লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘হুম। বাবাকে খুঁজতে এসেছিল।’

কেলি পকেট থেকে একটা বড়ো চুইংগাম বের করে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বলল, ‘মেয়েটাকে আটকে রেখে ওই আর্কিয়োলজিস্টকে চাপে রাখলে হয় না?’

মার্ক মাথা নাড়ল, ‘এই মোটা দাগের বুদ্ধির জন্যই তোমার দ্বারা আর কিছু হল না! লেবু বেশি কচলালে তেতো হয়ে যায় জানো তো! সুরঞ্জনকে এমনিই আমরা এই আট বছর ধরে প্রচুর চাপ দিয়েছি, এর মধ্যে আবার মেয়েকেও কিডন্যাপ করলে পাখি উড়ে না গেলেও ডিম পাড়া বন্ধ করে দিতে পারে, সেক্ষেত্রে ক্ষতি হবে আমাদেরই। তা ছাড়া লুংদোপেদরি অবধি যখন আসতে পেরেছে, আর যাই হোক মেয়েটা মোটেই বোকা নয়।’

কেলি মুখটা গোমড়া করে বাইরের দিকে তাকাল। প্যাট্রিকের মুখের বিদ্রূপের হাসিটা ওর চোখ এড়ায়নি। মার্ক দাদুর আমল থেকে রয়েছে, সুযোগ পেলেই খোঁটা মারতে ছাড়ে না। কেলির নাকি কোনো বুদ্ধিই নেই, এত বড়ো একটা দল চালানোর কোনো যোগ্যতাই নাকি ওর নেই। যতই কাজ করুক, হিসেবমতো তো কেলি—ই এখনও দলের মালিক! ঠিক আছে, কাজটা ভালোয় ভালোয় উতরে যাক, সবসময়ে ওকে সবার সামনে হেয় করা বুঝিয়ে দেবে ও।

মার্ক আবার বলল, ‘জন্তুগুলো পুরোপুরি রেডি এনার্জি এমিট করবার জন্য, যেটা আমাদের এই তিন নম্বর তেঞ্জ্যুর অনুযায়ী করতে হবে। তারপর কীভাবে কী করতে হবে সে—ব্যাপারে সুরঞ্জন প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে বেশি সময় লাগবে না, অ্যাটলিস্ট বইয়ে তাই লেখা আছে, বড়োজোর একদিন। তারপর কাজ মিটে গেলে সুরঞ্জনকেও না হয় ওই পেমা লিংপার মতো করে রেখে চলে যাব।’

উরা পৌঁছোতে পৌঁছোতে রাত হয়ে গেল। লুংদোপেদরি পৌঁছে মার্ক বলল, ‘আজ রাতটা রেস্ট নিয়ে নাও, কাল সকালে ওখানে যাব, মোটামুটি ব্যবস্থাপনা করতে করতে কালকের দিনটা কেটে যাবে, পরশু দিন আসল কাজ শুরু করব আমরা।’

কেলি ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় ফুটছিল। উত্তেজিত হলেই ওর বেশি করে খিদে পেয়ে যায়, এটা ও আগেও খেয়াল করে দেখেছে। পাথরের বড়ো বাটিটার পুরো দুধটা একচুমুকে খেয়ে নিল ও। অলরেডি গত দু—তিন মাস ধরে ও খোঁজখবর নিয়ে চলছে পেটেন্ট কীভাবে নিতে হয়, কোথায় প্রথমে জানাতে হয় এইসব ব্যাপারে। সারা পৃথিবী জানতে পারলে কেলির সম্মান কোথায় যাবে, সেটা ভাবতেই এই ঠান্ডার মধ্যেও ওর গায়ে শিহরন খেলে গেল। বলল, ‘আচ্ছা শেষ অবধি কী হবে বলো তো? মানে এত এনার্জি শরীরে রাখবার ফলে ওরা কী ডেলিভার করবে আমাদের?’

মার্ক কাঁধ নাচিয়ে বলল, ‘সেটা আমিও জানি না। সেটাই আমাকে কাল সুরঞ্জন জানাবে।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘ইন্ডিয়া থেকে ওই বিনোদ বিহারীর রিলেটিভ অবিনাশও কালকের মধ্যে এসে পড়বে। সুদেব তো কয়েকদিন আগেই এসে গেছে। দুটোকেই গুপ্তধন আর মোটা টাকার টোপ দেখিয়ে আনাচ্ছি।’

কেলি ভ্রূ কুঁচকে তাকাল, ‘ওদেরকে আবার এর মধ্যে ডাকা কেন!’

মার্ক প্রচ্ছন্ন তিরস্কারের দৃষ্টিতে কেলির দিকে একঝলক তাকাল, তারপর বলল, ‘তোমার কি মাথায় কিছুই থাকে না? কয়েকদিন আগেই তো ফোনে বললাম, পদ্মসম্ভবের লেখা অনুযায়ী পুরো প্রসেসটা করতে সময় লাগবে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। কিন্তু এই প্রসেসটা একবারও আজ অবধি টেস্ট হয়নি, এমনকী পদ্মসম্ভব নিজেও পরীক্ষা করে দেখবার সময় পাননি, তৃতীয় তেঞ্জ্যুরে পুরো জিনিসটাই লেখা আছে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে। আমরা একবার যদি টেস্ট করে দেখি আমরা সাকসেসফুল হয়েছি, এখানে আর পড়ে থাকব কেন? দেশে ফিরে যাব, গিয়ে বড়ো করে প্রেস কনফারেন্স করব। ওখানে ডামি একটা ল্যাব বানাতে হবে, যাতে আমরা দেখাব কীভাবে জন্তুটাকে আমরা তৈরি করেছি। আর এখানে নিশ্চয়ই কোনো উইটনেস রেখে যাব না, যারা আমাদের মার্ডার বা অন্য সব কিছু জানে? তাই সবাইকে একসঙ্গে ডেকে শেষ করে দিতে হবে। সুরঞ্জন, অবিনাশ, সুদেব থেকে শুরু করে চাকরগুলোকেও। এরা অনেক কিছু জেনে ফেলেছে।’

কেলি মাথা নাড়ল।

মার্ক বলে চলল, ‘এখন শেষটা করতে হবে এমনভাবে যাতে এখানকার পুলিশ টের না পায় আর ইন্ডিয়ার পুলিশ এরা ভুটান এসেছিল জানতে পারলেও কোনো হদিশ না পায়। তার একটাই উপায়, সবকটাকে ওই পেমা লিংপার মতো করে যুগ যুগ ধরে জঙ্গলের মধ্যে রেখো দেওয়া!’

সুরঞ্জন বললেন, ‘মার্ক, আমি গত চারদিন ধরে তিন নম্বর তেঞ্জ্যুরটা নিয়ে পড়ে আছি। কিন্তু এটার ইন্টারপ্রিটেশন আগের দুটোর মতো অত সহজ হবে না।’

সকাল হতেই মার্ক কেলিকে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে মাটির তলায় গুম্ফায় এসেছিল। কেলি ওই মমির মতো মৃতদেহ দেখে বার বার ভয় পাওয়াতে বাধ্য হয়ে ওরা ওপরে উঠে দিনের আলোয় এসে বসেছে। এখানে বসে থাকা লাশটাকে মরিস পাঁজাকোলা করে নীচে নিয়ে গেছে।

মার্ক সুরঞ্জনের চোখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা সত্যি নাকি সুরঞ্জনের এটা একটা চাল, সেটা বোঝার চেষ্টা করল, সরু চোখ করে বলল, ‘কেন প্রোফেসর?’

সুরঞ্জন এই প্রশ্নের জন্য মনে মনে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন, অল্প গলা ঝেড়ে বললেন, ‘তুমি যেকোনো কিন কোড বা ডাকিনী স্ক্রিপ্ট পড়তে পারা এরকম কোনো এক্সপার্টকে দিয়ে আমার কথা ভেরিফাই করে নিতে পারো। ডাকিনী স্ক্রিপ্ট এখানে একটু পেঁচিয়ে লেখা হলেও আসল সমস্যাটা যে কেউ বুঝবে। তুমি এ দু—দিন ছিলে না, তাই তোমাকে বলতে পারিনি।’

কেলির গত কয়েক মাসের সুখস্বপ্নে হঠাৎ এরকম বাধা পড়তে ও বেজায় চটে যাচ্ছিল মনে মনে। তীরে এসে তরি ডোবাবে নাকি এই লোকটা! তার ওপর কথা বলার সময় লোকটা ওর দিকে তাকাচ্ছেই না, মার্কের দিকে তাকিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। লোকটা কি জানে না যে দলের আসল মাথা কে? মাথাটা ঝট করে গরম হয়ে গেল ওর।

উঠে দাঁড়িয়ে সুরঞ্জনের জামার কলার চেপে ধরে গালে একটা সজোরে চড় কষাল, ‘আমার সঙ্গে কোনোরকম চালাকির চেষ্টা করলে তোমাকে শেষ করে দেব, ভুলে যেয়ো না আমি পৃথিবী কাঁপানো ক্রমওয়েল গ্যাং—এর একমাত্র মালিক!’

মার্ক এসে হ্যাঁচকা টান মেরে কেলিকে সরিয়ে দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। মুখে রাগ গনগন করছে। বয়সে কেলির প্রায় দ্বিগুণ হলেও তার নিয়মিত ব্যায়াম করা পেটাই শরীর, কেলির মতো থপথপে নয়। চিৎকার করে বলল, ‘কেলি! আমি তোমাকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি! এই এলাকায় তুমি যদি আর একবারও আমার পারমিশন ছাড়া কাউকে শাসন করো, আমি কিন্তু তোমার হাল খারাপ করে দেব। শুধুমাত্র অ্যালফ্রেডের ছেলে বলে তোমাকে আজ আর বেশি কিছু বললাম না, কিন্তু আর কোনোদিন এর পুনরাবৃত্তি হলে আমি তোমাকে তো শেষ করবই, অ্যালফ্রেডকেও জানাব। তখন দেখব তোমার দিনরাত হাজার হাজার ডলার ওড়ানো কোথায় যায়!’

ফুটো—হয়ে—যাওয়া গ্যাসবেলুনের মতো চুপসে গেল কেলি। চুপচাপ উঠে বসল বেদিটায়। মার্ক সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করল না, সুরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, বলো, প্রোফেসর। কী বলছিলে। কীসের সমস্যা?’

সুরঞ্জনের শরীরে যতটা না লেগেছিল, তার থেকে হাজার গুণ বেশি আঘাত লেগেছিল মনে। একটা অসভ্য লোক তাঁর গায়ে হাত তুলছে আর সেটা তাঁকে চুপচাপ হজম করতে হচ্ছে। মার্কের সঙ্গে এতদিন কাজ করার সময় মার্ক প্রতি পদে তার প্রভুত্ব বজায় রাখলেও সুরঞ্জনকে অসম্মান কোনোদিনও করেনি। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘আমি ইতিহাসের লোক। এই গবেষণাটা চালাবার জন্য হার্ডকোর সায়েন্সের লোক থাকা দরকার। তবুও এতদিন রুডলফের হেল্প নিয়ে আমি মোটামুটি উতরে গেছি। কিন্তু এই তেঞ্জ্যুরে যা লেখা আছে সেটা সলভ করা আমার অসাধ্য। এতে তোমার বিশ্বাস না হলে আমাকে মেরে ফেলতে পারো, কিন্তু তোমাকে সত্যিটাই বললাম।’

মার্কের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল ও আর অবিশ্বাস করছে না। চিন্তান্বিত অবস্থায় কেলির পাশে বসে পড়ে বলল, ‘পুরো ব্যাপারটা খুলে বলো আমাকে।’

সুরঞ্জন বললেন, ‘শেষ তেঞ্জ্যুরটা পড়ার আগে পর্যন্ত আমার মনে হয়েছিল পদ্মসম্ভবের মূল গবেষণাটা ছিল বাজ পড়ার সময় আকাশ থেকে লক্ষ লক্ষ ভোল্টের কারেন্ট টেনে এনে প্রাণীদেহে সঞ্চিত করে পরে সেটা প্রয়োজনমতো কাজে লাগানো। কিন্তু থার্ড পুথিটার পাঠোদ্ধার করতে শুরু করার পর বুঝতে পারলাম, এটা ওঁর গবেষণার একটা পার্ট ছিল মাত্র। ওঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল শরীরে অত কারেন্ট সঞ্চয় করে রাখার পর পরিবর্তিত প্রাণীগুলোকে কন্ট্রোল করা, মানে নিজের ইচ্ছামতো তাদেরকে দিয়ে কাজ করানো।’

মার্ক বিস্মিত হয়ে বলল, ‘কন্ট্রোল করা বলতে? বুঝতে পারলাম না।’

সুরঞ্জন বললেন, ‘বুঝতে না পারাটাই স্বাভাবিক। এই ২০১৬ সালেই ব্রেন কন্ট্রোল ইন্টারফেস একটা একেবারেই নতুন রিসার্চের বিষয়, মাত্র ত্রিশ বছর হল এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে, সেখানে আজ থেকে তেরোশো বছর আগেকার এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এই ব্যাপারে ভেবেছিলেন, শুধু তাই নয় এতটা এগিয়েছিলেন ভাবতেই আশ্চর্য লাগে। আমিও তো ব্যাপারটা জানতামই না, রুডলফ ব্যাখ্যা করল আমাকে। আর অদ্ভুতভাবে ওঁর এগোনোটা একদম ঠিক লাইনে ছিল।’

মার্ক বলল, ‘কীরকম?’

সুরঞ্জন বললেন, ‘বলছি। যেকোনো জীবন্ত প্রাণী, সে মানুষ হোক বা কোনো জন্তু, তাদের প্রতিটা কাজ, গতিবিধি, চিন্তা এগুলো প্রত্যেকটাই একেকটা ইলেকট্রিক ইমপালস বা বৈদ্যুতিক ঘাত ছাড়া কিছুই নয়। ধরো আমি একটা রাস্তা দিয়ে চলছি, আমি বাঁ—দিকে যাব না ডান দিকে যাব এই সিদ্ধান্ত নেওয়া, আমাদের দুঃখ হলে কান্না, আনন্দ হলে হাসি, রাগ বা হতাশা সব ব্যাপারেই একেকটা ইলেকট্রিক ইমপালস আমাদের ব্রেনের সেরিব্রাল কর্টেক্সে বিশেষ বিশেষ নিউরোনে কিছ কেমিক্যালকে স্টিমুলেট করে এই কাজগুলো করায়।

‘এখন পদ্মসম্ভবের থিয়োরি অনুযায়ী, বাইরে থেকে যদি ইলেকট্রিক ইমপালস সেই নিউরোনগুলোতে পুশ করা যায় তাহলে সেই প্রাণীটার ব্রেনকে পুরোপুরি কন্ট্রোল করা সম্ভব। অর্থাৎ বাইরে থেকে একটা প্রাণীর ব্রেনকে চালনা করা যাবে। মডার্ন সায়েন্সে ব্রেন কন্ট্রোল ইঁদুর বা গিনিপিগের ওপর করা গেলেও সেরকম প্রোগ্রেস কিছুই হয়নি এখনও।

পদ্মসম্ভব লিখেছেন এই যে আমরা সাপগুলোর মধ্যে কয়েক লক্ষ ভোল্টের কারেন্ট পুশ করে সেগুলোর মধ্যে শক্তিসঞ্চয় করেছি, ওদের ব্রেন কিন্তু সেই প্রথম দিনই ডেড হয়ে গেছে।’

মার্ক বাধা দিয়ে বলল, ‘সে কী করে হয়, মাথা নাড়ে, তাকায়, খায় আর ব্রেন ডেড কী করে হয়?’

সুরঞ্জন বললেন, ‘ওদের গোটা শরীরটা ডেড হয়ে গেছে আমি বলিনি, আমি বলেছি ওদের ব্রেন ডেড হয়ে গেছে। হার্টটা ওদের শরীরের পাম্প হিসেবে কাজ করছে। ওদের ব্রেন এখন পুরো ফাঁকা, শূন্য। এই ব্রেনটাকে এই ভেকেন্ট পজিশনে আনার জন্যই অত ভোল্টের কারেন্ট পুশ করা, আট বছর ওয়েট করা। ওদের ব্রেনে সেরিব্রাল কর্টেক্সে এখন যা খুশি প্রোগ্রামিং করে দেওয়া যায়। পদ্মসম্ভব এই থার্ড পুথিটাতে ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে বাইরে থেকে ইলেকট্রিক ইমপালস প্রয়োগ করে কোন নিউরোনে কতটা কেমিক্যাল স্টিমুলেট করতে হবে, যাতে আমরা ওদের পুরো মস্তিষ্কটা বাইরে থেকে চালনা করতে পারি। অর্থাৎ আমরা যখন যেটা বলব, সে সেটাই করবে এরকম ধরনের। তাই শুধু শক্তি বিকিরণ কেন, যা বলব তাই করবেও।’

কেলি শুনতে শুনতে উত্তেজনার চূড়ায় পৌঁছে যাচ্ছিল। এ যে সামান্য জল চেয়ে পুরো সমুদ্র পেয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার! ব্রেন কন্ট্রোল মেকানিজম সম্পর্কে ও বছর কয়েক আগে কোনো একটা ফিজিক্স ম্যাগাজিনে পড়েছিল। ব্যাপারটা সম্পর্কে ওর বিশাল ধারণা না থাকলেও মডার্ন ফিজিক্সে যে এটা বহুলচর্চিত বিষয় সেটা ও ভালোমতোই জানে। মার্কও মনে মনে বেশ উত্তেজিত কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে বলল, ‘তারপর?’

‘এখন পদ্মসম্ভব একটা জেনেরিক ফাঁকা ব্রেনের ছবি এঁকেছেন এই তেঞ্জ্যুরে, তাতে বিশেষ বিশেষ কয়েকটা পয়েন্ট চিহ্নিত করা রয়েছে যার একেকটায় একেকরকম কেমিক্যাল পুশ করতে হবে বাইরে থেকে ইলেকট্রিক ইমপালস দিয়ে। এখন কোন পয়েন্টে কোন কেমিক্যালটা ইনজেক্ট করতে হবে ব্রেনের ওপর পুরো কন্ট্রোল পাওয়ার জন্য, সেই ম্যাপিংটা উনি একটা অঙ্কের পাজল দিয়ে বুঝিয়ে গেছেন। সেই ম্যাপিং পাজলটা সলভ করতে পারলে তবেই ঠিকঠাক এগোনো সম্ভব। যেহেতু পদ্মসম্ভব নিজেও প্রক্রিয়াটা শেষ করে যেতে পারেননি, তাই বেশি কিছু বোঝাও যাচ্ছে না। এখন সেকেন্ড তেঞ্জ্যুর অনুযায়ী ইলেকট্রিক ইমপালস আকাশের বজ্রবিদ্যুৎ থেকে নিয়ে পুশ করেছি বলে বোধ হয় পরের কাজগুলো ঠিকঠাক করে দিতে পারব কিন্তু ওই জটিল পাজল সলভ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এটার জন্য কোনো অঙ্কের লোক দরকার। আর সেটা খুব তাড়াতাড়ি কারণ আট বছর শেষ হতে আর মাত্র তিনদিন বাকি, তার মধ্যে অ্যাপ্লাই না করলে হয়তো পুরো জিনিসটাই ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে।’ সুরঞ্জন বক্তব্য শেষ করলেন।

মার্ক চুপ করে রইল। ভাবার জন্য ওর এখন সময় দরকার। এখানে রুডলফ ছাড়া শিক্ষিত লোক কেউই তেমন নেই, ও নিজেও অঙ্কে খুব একটা পটু নয়। তাহলে কি বাইরে থেকে লোক নিয়ে আসতে হবে? উফ, যত মনে করছে আর বাইরের কাউকে ইনক্লুড করবে না, সেই তালিকা বেড়েই চলেছে। আর সেটাই—বা এত তাড়াতাড়ি কীভাবে সম্ভব? কাকে পাবে ও তিনদিনের মধ্যে? মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কেলির কথায় ওর চিন্তার জল ছিঁড়ল। ও শুনল কেলি সুরঞ্জনকে বলছে, ‘আমাকে পাজলটা একবার দাও, আমি সলভ করে দিতে পারি। ম্যাথস—এর পাজল সলভ করা আমার হবি।’

মার্ক পাত্তা দিল না। কেলির দৌড় ওর ভালোমতোই জানা আছে।

প্রিয়মের যখন জ্ঞান ফিরল তখন প্রথমে ও কিছু দেখতেই পেল না। ক্রমে হালকা আলো হালকা অন্ধকারে চোখটা সয়ে যেতে বুঝতে পারল একটা স্যাঁৎসেঁতে পাথরের ঘরে ও শুয়ে আছে। ঘরের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ। ঘরের ভেতরে কিছুই প্রায় নেই, দুটো ছোটো খাট পাতা, তাতে পরিপাটি করে বিছানা করা, আর একপাশে একটা ছোটো কুলুঙ্গি। একটু দূরেই একটা ছোটো গোল জানলা, সেটা দিয়ে বাইরে চোখ মেলে চুপ করে বসে আছে রুদ্র। কী হয়েছিল সেটা প্রিয়ম মনে করার চেষ্টা করল।

দুপুর বেলা লুংদোপেদরির সেই থুম্পডেন বলে চাকরটা এসে রুদ্রর হাতে একটা চিরকুট ধরিয়েছিল, যাতে লেখা ছিল দামাজি রুদ্র আর প্রিয়ম দু—জনের সঙ্গেই একটা বিশেষ প্রয়োজনে দেখা করতে চেয়েছেন, কিন্তু খুব গোপনে। রুদ্র কাউকে কিছু না জানিয়ে প্রিয়মকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। তারপর অনেক হেঁটে নদী—পাহাড়—সেই দড়ির সাঁকো—ঝরনা পেরিয়ে ওরা দু—জনে লুংদোপেদরি পৌঁছেছিল। আসার সময় নরবু আর চিমিকে বলে এসেছিল পাঁচদিনের মধ্যে ওরা না ফিরলে যেন পুলিশে খবর দেওয়া হয়।

প্রথমে দামাজির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলেছিল, তারপর আর কিছু মনে পড়ছে না।

প্রিয়মকে জেগে উঠতে দেখে রুদ্র এদিকে ফিরল। অল্প হেসে বলল, ‘শরীর ঠিক আছে?’

প্রিয়ম মাথা নেড়ে বলল, ‘এটা কোথায়?’

রুদ্র বলল, ‘এটা মোস্ট প্রোব্যাবলি লুংদোপেদরিরই কোনো একটা ঘর। তোমার মনে পড়ছে, আমরা আসার পর থুম্পডেন এক ধরনের শরবত জাতীয় জিনিস এনে দিয়েছিল? খুব সম্ভবত ওতে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল। আমরা প্রায় দেড় দিন ঘুমিয়েছি, অ্যাটলিস্ট আমার ঘড়ি তাই বলছে। এখন সকাল ন—টা।’

রুদ্র কথা বলতে বলতেই হাসছিল, প্রিয়ম সেটা লক্ষ করে বলল, ‘এতে হাসির কী আছে? এ তো টেশনের ব্যাপার, আমাদেরও কি এখানে সারাজীবন আটকে রাখবে নাকি?’

রুদ্র আবার হেসে বলল, ‘হাসব না? তিমিমাছ টোপ গিলেছে। ঠিক যেরকমটা ভেবেছিলাম সেরকমই হচ্ছে। এবার আমাদের ঠিক করে এগজিকিউট করতে হবে গোটা ব্যাপারটা। তোমায় যা যা বলেছিলাম সব মনে আছে তো?’

প্রিয়ম উত্তর দেবার আগেই দরজায় একটা ঘড়ঘড় শব্দ হল। দরজার হাতলের চাকাটা কেউ ঘোরাচ্ছে। এই দরজার গায়েও নানারকম কারুকার্য করা, কিন্তু অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না সেগুলো। দরজাটা ফাঁক হতে বাইরের দিনের আলো এসে পড়ল ঘরে। দামাজি আর সঙ্গে আর একটা মোটা লোক ঢুকল। দ্বিতীয় লোকটার পরনে সাধারণ শার্ট প্যান্ট, লামার পোশাক নয়। দামাজি ঢুকে একপাশে রাখা প্রদীপটা জ্বাললেন, তারপর সোজাসুজি রুদ্রর দিকে তাকালেন। ঝকঝকে ইংরেজিতে বললেন, ‘ম্যাডাম রুদ্রাণী, একটা জরুরি দরকারে আপনাদের এখানে ডেকেছি। তবে দরকারটা অবশ্য ঠিক আপনার সঙ্গে নয়, আপনার হাজব্যান্ডের সঙ্গে।’

রুদ্র প্রস্তুত হয়েই ছিল, বলল, ‘আপনাদের এখানে বুঝি কৌশলে ডেকে এনে ওষুধ খাইয়ে অচৈতন্য করে আটকে রেখে হেল্প চাওয়া হয়? আপনাদের কালচারে এটাই রেওয়াজ বুঝি মি দাওয়া লামা?’ একবার ভাবল ‘মার্ক’ নামটা উচ্চারণ করে চমকে দেবে, পরমুহূর্তেই নিজের জিভকে সংবরণ করল।

রুদ্রর এরকম কাটা কাটা কথা শুনে দামাজির লুকিয়ে রাখা নৃশংস ধূর্ত চোখ দুটো একবার জ্বলেই আবার নিভে গেল। মুখে মেকি হাসি টেনে বললেন, ‘মাফ করবেন ম্যাডাম, কিন্তু ওষুধ খাওয়াব কেন! আপনারা নিশ্চয়ই খুব টায়ার্ড ছিলেন। আটকে রাখা কথাটা বলে লজ্জা দেবেন না, আপনারা আমাদের অতিথি, আর আমরা গুরু রিনপোচের অনুগামীরা অতিথির মধ্যে বুদ্ধেরই রূপ দেখি। ব্যাপারটা মিটে গেলেই আমরা আপনাদের সসম্মানে উরায় পৌঁছে দিয়ে আসব।’

প্রিয়ম উঠে বসে বলল, ‘কী ব্যাপার বলুন তো?’

দামাজি আরেকটু এগিয়ে এলেন, সঙ্গে পাশের মোটাটাও। প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শুনেছি আপনি অঙ্কে ভালো? বেশ কিছু রিসার্চ পেপারও রয়েছে? একটা পাজল আপনাকে সলভ করে দিতে হবে। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, আমাদের মনাস্টারির প্রধান পেমাজি এতই বুড়ো হয়ে গেছেন, যে ওঁর স্মৃতিশক্তি প্রায় লোপ পেয়েছে, একটা জিনিস উনি সিন্দুকে লুকিয়ে রেখেছিলেন, তখন সমাধানটা মনে করতে পারছেন না, এদিকে জিনিসটা আমাদের খুবই জরুরি। আপনাকে ওই পাজলটা সলভ করে দিতে হবে।’

রুদ্র দামাজি ওরফে মার্কের অম্লানবদনে মিথ্যে কথাগুলো শুনতে শুনতে চমৎকৃত হয়ে যাচ্ছিল। যে পেমা লিংপাকে খুন করে মমি বানিয়ে রেখেছে বছরের পর বছর ধরে, দরকারের সময় তাঁকে টেনে আনতে একটুও গলা কাঁপল না। মনে মনে ঠিক করল, এমন শাস্তি একে দেবে যে বাছাধন সারাজীবনেও ভুলবে না!

প্রিয়ম বলল, ‘কিন্তু আপনাদের বৌদ্ধ স্ক্রিপ্টে লেখা পাজল আমি কীভাবে সলভ করব! আর আমি অঙ্কের বিশাল কিছু দিগগজ নই, জাস্ট একটু—আধটু চর্চা করে থাকি।’

দামাজি বললেন, ‘ওসব নিয়ে ভাববেন না। আমরা আপনাকে ইংলিশে ট্রান্সলেট করেই পাজলটা দেব। আর পেমাজি নিজেও শখের গণিতজ্ঞ ছিলেন, তাই আশা করি আপনার ভালোই লাগবে পাজলটা নিয়ে মাথা ঘামাতে।’

পাশের মোটা কুমড়োর মতো লোকটা এতক্ষণ চুপ ছিল, হঠাৎ বলে উঠল, ‘এমন কিছু কঠিন নয় পাজলটা। আমার সময় নেই তাই, না হলে সলভ করে দিতাম। একটা ব্রেনের কিছু পয়েন্ট হাইলাইট করা আছে, তার সঙ্গে কিছু কেমিক্যাল সেট দেওয়া আছে, কোনটা কোন পয়েন্ট…’

দামাজি মাঝপথে গর্জে উঠলেন, ‘তুমি থামবে? কী আজেবাজে বকে চলেছ! যাও ভেতরে গিয়ে রেস্ট নাও।’

কুমড়োটা মিইয়ে গেল। দামাজি প্রিয়ম আর রুদ্রর দিকে ফিরে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, ও আমার পরিচিত, অঙ্কটা একটু—আধটু বুঝত বলে ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু সম্প্রতি মাথার একটু গোলমাল দেখা দিয়েছে। তবে মূল ব্যাপারটা ভুল বলেনি, ধরুন একটা সেট দেওয়া আছে (a, b, c, d, e….) এরকম বেশ কয়েকটা নাম্বারের, আর আরেকটা সেট আছে (p, q, r, s, t…) অন্য কয়েকটা নাম্বারের। এই দুটোর মধ্যে প্রথম সেটের কোন নাম্বারের সঙ্গে দ্বিতীয় সেটের কোন নাম্বারের ম্যাচিং হবে, তার কয়েকটা সূত্র দেওয়া আছে, সেগুলো দিয়ে আপনাকে ঠিক ম্যাচিংগুলো বের করতে হবে। বোঝা গেল?’

রুদ্র তীক্ষ্নস্বরে বলল, ‘দেখুন, আমরা এখানে ঘুরতে এসেছিলাম, আমাদের পারমিটও করানো রয়েছে মাত্র কয়েকদিনের জন্য, তার মধ্যে এইসব ঝামেলায় আমরা নিজেদের জড়াব কেন?’

দামাজির ভেতর থেকে মার্কের কুটিল রূপটা আরও একবার উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল, মৃদু হেসে বললেন, ‘আমাদের দরকারটা খুব সিরিয়াস বলেই আপনাদের ডেকেছি। আপনার হাজব্যান্ডকে একটু চেষ্টা করতে দিন না! আমাদের এই সুন্দর দেশে ঘুরতে এসেছেন আর এইটুকু না হয় উপকার করলেন! আর আমরা আপনাদের বন্দি করে রাখিনি মোটেই, আপনি তো ক—দিন আগেই এই মনাস্টারি ঘুরতে এসেছিলেন, দু—দিন থাকুন ঘুরে দেখুন, আমাদের লোকেরা আপনাদের সমস্ত যত্ন—আত্তি করবে, তার মধ্যে না হয় আপনার হাজব্যান্ড পাজলটা সলভ করুন।’

সকাল সাড়ে ন—টার সময় হঠাৎ বেল বাজতে পূরবী একটু অবাকই হলেন। এসময় তো কারুর আসার কথা নয়। কাজের লোক কাজ সেরে চলে গেছে, পূরবীও প্রায় রেডি, এবার খেয়ে নিয়েই কলেজ বেরিয়ে পড়বেন। আইহোলে উঁকি মেরে দেখলেন দরজার ওপারে পুলিশ অফিসার সুকুমারবাবু সিভিল ড্রেসে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। পূরবী তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলেন।

সুকুমারবাবু ঢুকে সোফায় বসে পড়ে বললেন, ‘যাক, ঠিক টাইমে এসেছি, আমি ভাবছিলাম আসতে আসতে আপনি আবার কলেজে বেরিয়ে পড়বেন না তো! এক গ্লাস জল খাওয়ান না পূরবীদি!’

পূরবী ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে জগ থেকে গ্লাসে জল ঢেলে নিয়ে এসে সুকুমারবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে উৎসুক চোখে চেয়ে রইলেন, মুখে কিছু বললেন না।

সুকুমারবাবু এক চুমুকে জলটা শেষ করে বললেন, ‘আমাদের অনুমান একদম ঠিক ছিল পূরবীদি! আপনার মেয়ে—জামাই ভুটানেই আছে।’

পূরবীর বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল তবু কোনো কথা বললেন না।

সুকুমারবাবু বলে চললেন, ‘আমরা তো ভুটানের ইন্ডিয়া এমব্যাসিতে যোগাযোগ করেছিলাম, তো ওরা খোঁজখবর নিয়ে জানাল ওরা দু—জন নাকি ইস্ট ভুটানে বুমথাং—এর দিকে গেছে, তারপর আর কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না। শেষ পারমিট করিয়েছে থিম্পুতে, বুমথাং যাওয়ার। তারপর আর বোঝা যাচ্ছে না কোথায় গেছে। কিন্তু কাল ওখান থেকে খবর পেলাম ওখানকার রিমোট একটা গ্রাম কী নাম বলল ঠিক মনে পড়ছে না, সেখানকার লোকাল থানায় নাকি দু—দিন আগে আপনার জামাই মিসিং ডায়েরি করেছিল আপনার মেয়ের নামে। রুদ্রকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।’

পূরবী ধপ করে বসে পড়লেন। শিরার মধ্যে রক্ত চলাচল দ্রুত হতে শুরু করেছে, বাঁ—দিকের বুকেও চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছিলেন। মাথার দু—পাশের শিরা দুটো দপদপ করছিল। অনেক কষ্টে বললেন, ‘তারপর?’

সুকুমারবাবু বললেন, ‘তারপরের ব্যাপারটাই খুব অদ্ভুত। কাল সকালে ওই থানা থেকে খোঁজ নিতে গিয়ে শোনে, পরের দিন নাকি আপনার মেয়ে ফিরে এসেছিল। যে হোটেলে ওরা ছিল তারা জানিয়েছে, পরের দিন থেকে আবার দু—জনেই নিখোঁজ। এমনকী ওরা ফুন্টশোলিং থেকে যে গাড়ি ভাড়া করে ঘুরছিল, সেই গাড়ির ড্রাইভারকে পর্যন্ত হোটেলেই রেখে দিয়ে গেছে। আবার যাওয়ার সময় হোটেলওলাকে বলে গেছে পাঁচদিনের মধ্যে না ফিরলে যেন পুলিশে খবর দেয়। এ কি লুকোচুরি খেলা চলছে নাকি ওদের মধ্যে?’

পূরবী কোনোদিন যা করেননি, সেটা করে ফেললেন। স্থান—কাল—পাত্র ভুলে চেঁচিয়ে কেঁদে ফেললেন, ‘আপনি ওদের বাঁচান, সুকুমারবাবু! না হলে ওরাও সুরঞ্জনের মতো…’ আর কথা শেষ করতে পারলেন না, কান্নায় ভেঙে পড়লেন পূরবী।

সুকুমারবাবু একটু থতোমতো খেয়ে বললেন, ‘আরে, আপনি এত ভেঙে পড়ছেন কেন পূরবীদি! আগে থেকেই ধরে নিচ্ছেন কেন যে ওরা বিপদে পড়েছে? হয়তো কাউকে কিছু না জানিয়ে কোনো অ্যাডভেঞ্চারে গেছে, এই বয়সের বাচ্চাদের তো এরকম শখ হয়েই থাকে, দু—দিন বাদেই হয়তো ফিরে আসবে। যে গ্রাম থেকে ওরা নিখোঁজ হয় সেখানকার থানা ওই হোটেলের লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। অন্য দেশ বলেই এত প্রোটোকল না হলে আমাদের খুঁজে বের করতে এক ঘণ্টাও লাগত না! এত চিন্তা করবেন না!’

পূরবী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আপনি পুরো ব্যাপারটা জানেন না সুকুমারবাবু।’

সুকুমারবাবু ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘পুরো ব্যাপার মানে?’

পূরবী কাঁদছিলেন। এতদিন চুপ করে থাকার যখন এই ফল, স্বামী তো ফিরে এলই না, উলটে মেয়েটাও চলে গেল, আর চুপ করে থাকার কোনো মানে হয় না।

রুদ্র বলল, ‘কী সাংঘাতিক লোক! আমি ভেবেছিলাম আমাদের এনে হয়তো বাবার সঙ্গে দেখা করিয়ে ইমোশনাল সুড়সুড়ি দিয়ে কাজটা উদ্ধার করার চেষ্টা করবে, এ তো দেখছি সে পথ মাড়ালই না! কত বড়ো শয়তান শুধু ভাবো, একই কাজে আমার বাবাকে আটকে রেখেছে, আবার আমাদেরও, এদিকে আমরা কেউ কারোর মুখও দেখতে পাচ্ছি না। শুধু নিজের কাজ হাসিল হলেই হল!’

প্রিয়ম একটু দূরে খাটের ওপর বসে খাতায় আঁকিবুঁকি কাটছিল। পাজলটা নিয়ে ও তন্ময় হয়ে রয়েছে। এখন দুপুর তিনটে। দামাজিকে বারংবার অনুরোধে দরজাটা খোলাই আছে, কিন্তু মুশকো এক লামা দরজার চৌকাঠে সারাক্ষণ বসে আছে। এটা যে দামাজির সেই পোষা গুন্ডা দুটোর একটা তা নিয়ে রুদ্রর কোনো সন্দেহই নেই। এরা লামাদের পবিত্র পোশাককে নিজেদের কাজে ভালোই ব্যবহার করে চলেছে।

এই ঘর থেকে বেরোনোর কোনো প্রভিশন নেই। এমনকী দুপুরের খাওয়া সারতে হয়েছে এই ঘরেই। খাওয়া বলতে দুটো করে আলুর পরোটা আর একধরনের মারাত্মক ঝাল আচার। লাগোয়া ছোটো একফালি বাথরুম। দেখেই বোঝা যায় বাথরুমটা নতুন করা, মনাস্টারির অন্যান্য ঘরগুলোর মতো শতাব্দীপ্রাচীন নয়। পুরো মনাস্টারিতেই এটা লক্ষ করেছে রুদ্র, কিছু কিছু জায়গা নতুন করে তৈরি করা। ও জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। এখান দিয়ে বাইরের দালানের পদ্মসম্ভবের ওই বিশাল মূর্তিটা স্পষ্ট দেখা যায়। এই একটা মানুষের জন্য যত হাঙ্গামা, মানুষটা আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতিতে তাঁর আবিষ্কারের উল্লেখযোগ্য ছাপ রাখতে চেয়েছিলেন, সেটা তো পারলেনই না, উলটে ওঁর মৃত্যুর প্রায় তেরোশো বছর পরেও মানুষের মধ্যে তাঁর কাজ নিয়ে লড়াইয়ের শেষ নেই। নিশ্বাস ফেলে ও প্রিয়মের দিকে তাকাল, ‘বুঝছ কিছু? অনলাইনে কত পাজল কনটেস্টে তো নিমেষের মধ্যে উত্তর বের করে ফ্যালো, আর এখানে পুরো একদিন কেটে গেল তবু কিছু করতে পারলে না!’

প্রিয়ম অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘আরে দাঁড়াও, ম্যাপিং পাজল এমনিই খুব শক্ত হয়, তার ওপর এরকম একটা সেনসিটিভ ব্যাপার! নার্ভ এমনিই দুর্বল হয়েছে।’

রুদ্র বলল, ‘এই পাজল সলভ করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাবাকে উদ্ধর করার চাবি। এটাই আমার শেষ অস্ত্র, এটা ব্যর্থ হলে আর কোনো উপায়ই থাকবে না।’

প্রিয়ম উত্তর দিল না। এখান থেকে একটা পুরোনো হলদে হয়ে যাওয়া খাতা দেওয়া হয়েছে, তাতে দাগ কেটে যাচ্ছে অবিরাম। খানিকক্ষণ কিছু লিখছে, আবার কেটে দিচ্ছে, তারপর আবার হিজিবিজি আঁক কষছে। রুদ্র উঠে দাঁড়াল। কাঁহাতক এভাবে বসে থাকা যায়? দরজার দিকে এগোতেই মুশকো গুন্ডাটা খর চোখে ওর দিকে তাকাল। ও বলল, ‘মনাস্টারিটা ঘুরে দেখতে চাই।’

মুশকো মাথা নাড়ল, হবে না। রুদ্রর রোখ চেপে গেল। এরা কী ভেবেছে কী! ওর বাবাকে আটকে রাখবে, স্বামীকে আটকে রাখবে আর যা—নয়—তাই করবে! ভেতরের মেজাজটা অনেকদিন পর আর কন্ট্রোল করতে পারল না ও। চিৎকার করে আঙুল উঁচিয়ে বলল, ‘হবে না মানে? তুমি কে না বলার? মি দামা নিজে আমাদের বলেছেন আমরা চাইলে পুরো মনাস্টারিটা ঘুরে দেখতে পারি। তুমি গিয়ে ভেরিফাই করে নাও! আর শোনো ফারদার এরকম করলে না তোমার মজা বের করে দেব। চুপচাপ যাও আর কাউকে ডেকে নিয়ে এসো যে আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরাবে।’

রুদ্রর রুদ্রমূর্তি দেখে মুশকো একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চিৎকার করে কাউকে ডাকল। প্রথমে কারুর সাড়া পাওয়া গেল না, তারপর যে এল তাকে দেখে রুদ্র একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। দেচেন। বেচারাকে সেদিন ও খুব পিটিয়েছিল। ও—ই বা চোরের মতো পালাচ্ছিল কেন? রুদ্র কী করে বুঝবে যে এ—ই সেই বিনোদ বিহারীর চাকর আর বর্তমানে বাবা আর ওর মধ্যে একমাত্র কানেকশন? ও আড়ে আড়ে চাইল।

ওকে দেখেই দেচেনের মুখে এখনও স্পষ্ট ভয়ের চাপ। মুশকোর কথায় রুদ্র ওর পিছু নিল।

আগে প্রথম যেদিন লুংদোপেদরি এসেছিল ওরা, সেদিনের মতো দেচেন বাইরে থেকে ঘরগুলো দেখাচ্ছিল। কিন্তু সবসময় সন্ত্রস্ত একটা ভাব, এই বুঝি রুদ্র বেফাঁস কিছু বলে ফেলে। রুদ্র সে—পথ হাঁটলই না। চুপচাপ ও এদিক—সেদিক বেড়াচ্ছিল। বিশাল দালানটার চারপাশেই বাড়ি, তার মাঝে মাঝে অজস্র সরু সরু গলি ঢুকে গেছে বাড়ির ভেতর দিকে, তার দু—পাশে ঘর। রুদ্র লক্ষ করল, কিছু কিছু গলি একদমই নতুন, এখনকার ইটের গাঁথনি, এরকম একটা গলিতে কিছু একটা চোখে পড়তে ও দেখল ইলেকট্রিকের প্লাগ পয়েন্ট, তা থেকে একটা মোবাইলের চার্জারের তার ঝুলছে। পদ্মসম্ভবের মূর্তিটা ডান দিকে রেখে একটূ পিছিয়ে গেলেই বাঁ—দিকে একটা ঘর, তার ঠিক পেছনেই একটা ছোটো ছাউনি, তাতে মার্কের সেই বিশাল কুকুরটা বাঁধা। ওদের দেখেই দু—বার গগনবিদারী চিৎকার করল। রুদ্র দেখল দেচেনের মুখটা শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছে। তবু কুকুরটার ছাউনি দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে বুড়ো মানুষটা। কিছুটা অবাক হয়ে, কিছুটা কৌতূহলে রুদ্রও এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল। এদিকটা বেশ অন্ধকার। আলো—আঁধারিতে বিশাল আকারের কুকুরটার চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎ আকাশে শব্দ, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, কড় কড় কড়াৎ শব্দে কাছাকাছি বাজ পড়ল কোথাও।

সেই এক ঝলক আলোর ঝলকানিতে রুদ্র স্পষ্ট দেখল, ত্রস্ত হাতে পাংশু মুখে দেচেন একটা চিরকুট গুঁজে দিচ্ছে ওর হাতে।

.

সুরঞ্জন বললেন, ‘আর কিন্তু একদমই সময় নেই হাতে। কাল আট বছর পূর্ণ হচ্ছে। পদ্মসম্ভবের লেখা অনুযায়ী আট বছর পূর্ণ হবার সঙ্গে সঙ্গে ওই কেমিক্যালগুলো পুশ করতে হবে ইলেকট্রিক ইমপালস দিয়ে। না হলে এতদিন ধরে ব্রেনের মধ্যে যে ভ্যাকুয়াম সৃষ্টি হয়েছে সেটা নষ্ট হয়ে যাবে।’

রুডলফ বলল, ‘হ্যাঁ, মার্ক। প্রোফেসর ঠিকই বলছে। যেরকম বলা হয়েছে আমরা কেমিক্যালগুলো ঠিক সেরকমভাবে তৈরি করে রেখেছি কিন্তু সেগুলোও চব্বিশ ঘণ্টার বেশি রেখে দেওয়া যাবে না। কালকের মধ্যে ওই ম্যাপিংটা না পেলে এতদিনের সব কাজ পণ্ড! আর তার থেকেও বড়ো কথা, জন্তু দুটো অতিপ্রাকৃত হয়ে উঠতে পারে!’

মার্ক চুপ করে বসে ছিল। কপালে চিন্তার ভাঁজ ক্রমশই চওড়া হচ্ছিল। তার ওপর রুডলফের শেষ কথাটা শুনে ও মুখ তুলে তাকাল, ‘অতিপ্রাকৃত মানে!’

রুডলফের বদলে সুরঞ্জন এবার উত্তর দিলেন, ‘মানে, পদ্মসম্ভব বার বার সাবধানবাণী করে গেছেন সময়ের মধ্যে ওদের ব্রেনে কেমিক্যালগুলো ইঞ্জেক্ট না করলে ওরা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। শরীরে অত লক্ষ ভোল্টের শক্তি, এদিকে এমিট করতে পারছে না, কী করবে সেটা উনিও ঠিক করে বলতে পারেননি। শুধু তাই নয়, একটা কেমিক্যালও যদি সেরিব্রাল কর্টেক্সের ভুল পয়েন্টে পুশ করা হয়, সেক্ষেত্রেও উনি এটাই লিখেছেন মহাপ্রলয় নেমে আসবে, প্রাণীগুলো অতিপাশবিক হয়ে উঠবে। এ নিয়ে উনি এটাও বিলাপ করেছেন যে সত্যিই কি মহাশক্তিমান ঈশ্বরকে বন্দি করে ফেলেছেন তিনি? আমার মনে হয় উনি নিজেও শেষ পরীক্ষাটা করবেন কি না তা নিয়ে দোলাচলে ছিলেন!’

মার্ক কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ইচ্ছে করেই আজ ও কেলিকে সঙ্গে আনেনি এই জঙ্গলের গুম্ফায়। ঘটে বুদ্ধি তো নেই—ই, উলটে এই প্রোফেসরের মেয়ে জামাইয়ের আসার কথা বেফাঁস বলে দিলে আরেক ঝামেলা। পেটেন্টটা একবার মিলুক না, তারপর কেলিদের এই পুরুষানুক্রমিক গ্যাঙের কী করে বারোটা বাজাতে হয় ওর সেটা ছকাই আছে। নেহাত নিয়মিত ডলার সাপ্লাইয়ের জন্য ওকে রাখা!

ও রুডলফের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রুডলফ, তুমি আমার সঙ্গে এসো। প্রোফেসর, তুমি নিজের কাজে যাও, আমি দেখছি কী করা যায়।’

জঙ্গলের মধ্যে দ্রুতগতিতে লুংদোপেদরির দিকে হেঁটে আসছিল মার্ক আর রুডলফ। বেশিদূর যেতে হল না, মাঝপথে মরিসের সঙ্গে দেখা। ও উলটো দিক থেকে দৌড়ে আসছিল। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল প্রিয়ম মার্ককে ডাকছে।

মার্ক রুডলফকে নিয়ে যখন রুদ্রদের ঘরে ঢুকল, তখন প্রিয়ম ক্লান্ত হয়ে ওর খাটটায় শুয়ে ছিল। চোখেমুখে মানসিক ক্লান্তির ছাপ সুস্পষ্ট। খাদের একপাশে কেলি বসে আছে। অন্য পাশে রুদ্র জানলার ধারে বসে ছিল।

ঘরে ঢোকার আগে মুহূর্তের মধ্যে মার্ক নিজের ব্যক্তিত্বটাকে বৌদ্ধ লামায় পরিণত করল। এটা সে গত আট বছর ধরেই করে আসছে।

দামাজি ভেতরে ঢুকে প্রশান্ত মুখে বললেন, ‘কিছু সুরাহা করতে পারলেন?’

প্রিয়ম উঠে বসল, ‘হ্যাঁ পেরেছি, বসুন।’ তারপর কেলির দিকে হাত দেখিয়ে বলল, ‘এঁকেও বলেছি।’

কেলি মুখটা অল্প বেঁকিয়ে বলল, ‘আমি তো এই রাস্তাটাই ভেবেছিলাম, তখন কেউ শুনল না আমার কথা!’

দামাজির মুখের বিরক্তিটা কারোরই নজর এড়াল না। কেলিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে প্রিয়মকে বললেন, ‘একটু বুঝিয়ে বলুন আমাদের। রুডলফ তুমিও এসো।’

প্রিয়ম ওর আঁকিবুঁকি কাটা খাতাটা মেলে ধরল সামনে, ‘দেখুন, আমি প্রথমে সমস্ত প্রচলিত ধারণা দিয়ে এগোচ্ছিলাম কিন্তু তাতে কিছু রাস্তা পাচ্ছিলাম না। তাই আমি নেগেটিভ দিক দিয়ে স্টার্ট করলাম, অর্থাৎ কোন পয়েন্টের সঙ্গে কোন পয়েন্টের ম্যাচিং হতে পারে না এইগুলো আগে আপনার দেওয়া হিন্টস থেকে বের করে সেগুলোকে বাদ দিতে থাকলাম। সেভাবে এগোতে এগোতে একেকটা পয়েন্টের সঙ্গে ডেফিনিট ম্যাপিং করতে থাকলাম। এভাবে আমি একটা সমাধান খুঁজে পেয়েছি।’

পরের পনেরো মিনিট ধরে প্রিয়ম পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করল ওদের কাছে।

সকাল হতে—না—হতেই মার্ক, রুডলফ আর কেলি ব্যস্তসমস্ত হয়ে মনাস্টারির পেছনের সুঁড়িপথ দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে যাচ্ছিল। সামনে অ্যান্ড্রু আর দেচেন। দেচেনের হাতে বেশ বড়ো একটা ঝোলা, তাতে রয়েছে একদিনের মতো খাবার। কখন মনাস্টারিতে ফিরতে পারবে তার তো ঠিক নেই, তাই খাবার সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া। একটা লতানে গাছে পা আটকে প্রায় পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলাল কেলি, ‘আমি একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারছি না, পাজলটা ঠিকঠাক সলভ করল কি না সেটা ভেরিফাই না করেই তুমি ওদের ছেড়ে দিলে কেন?’

মার্ক বলল, ‘অবিনাশ চৌধুরীরা আজ এসে পড়বে, প্রোফেসরের মেয়ে ওকে চেনে। মনাস্টারিতে আসার পর ওদের থুম্পডেন এখানে নিয়ে আসবে। আর তার থেকেও বড়ো কথা আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে সমাধানটা ঠিক হয়েছে। সুদেব আমাকে বলেছিল ম্যাথস ওই ছেলেটার একটা প্যাশন, অনেক অ্যাওয়ার্ডও জিতেছে ও এ ব্যাপারে। আর ঠিক কারণটা যখন ওরা জানে না, ইচ্ছে করে ভুল করবেই—বা কেন! অনেক কাজ আছে এই মুহূর্তে, আজকের মতো এরকম ইম্পর্ট্যান্ট দিনে বেকার ওদেরকে ধরে রাখা মানে মরিস বা অ্যান্ড্রু কাউকে একটা ওদের কাছে বসিয়ে রাখতে হবে, এখানে এমনিই আমাদের লোক কম। আর নিশ্চয় চিমিদের হোমস্টেতে ওরা উঠেছে, না ফিরে এলে ওরাও খোঁজখবর শুরু করতে পারে, পুলিশের কাছেও যেতে পারে, এখন আর উটকো ঝামেলা চাইছি না। তাই ছেড়ে দিলাম।’

সুরঞ্জন মাটির তলায় ঘরে ছিলেন। এই ছমছমে ভৌতিক পরিবেশ তাঁর সয়ে গেছে, এখন আর কিছু মনে হয় না। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে এলেন। মার্ক বলল, ‘প্রোফেসর, ঝটপট কাজ শুরু করে দাও। ম্যাপিংটা আমরা নিয়ে এসেছি।’

সুরঞ্জন অবাক হওয়ার ভান করে বললেন, ‘ম্যাপিংটা কে সলভ করল!’

কেলি ধমক দিল, ‘তা জেনে তোমার কী হবে! তুমি তোমার কাজ করো। আমি সলভ করেছি, খুশি?’

সুরঞ্জন মনে মনে হাসলেন। রুদ্রর সঙ্গে তাঁর প্ল্যানটা এখনও পর্যন্ত মসৃণ গতিতে সাকসেসফুল। তাঁর নিজের মনেও উত্তেজনা তুঙ্গে। যতই বন্দি থাকুন এই সাড়ে আট বছর, ভেতরের অনুসন্ধিৎসু আর্কিয়োলজিস্টটা তো মরে যায়নি! কাল সারারাত নিজের ঘুপচি ঘরে শুয়ে শুয়ে ভেবেছেন, খ্যাতি পান বা না পান, স্যারের অসমাপ্ত কাজটা শেষ করতে পারবেন, একটা মাটির তলায় চাপা পড়ে থাকা গুপ্ত রহস্য উন্মোচিত হবে। তাই সেদিন সারারাত কথা বলার সময় রুদ্র যখন জানিয়েছিল প্রিয়ম অঙ্কে খুব পটু, এমনকী এখানে আসার ম্যাপটা ও—ই বের করেছে, তখন প্রিয়মকে দিয়ে এই পাজল সলভ করানোর কথা বলতে দু—বার ভাবেননি সুরঞ্জন। যদিও তিনি ভালো করেই জানেন, হয়তো আজকের দিনটা বা আর বড়োজোর কয়েকটা দিন, তার পরেই তাঁর জীবন শেষ। রুদ্র যতই চেষ্টা করুক, মার্ক ওঁকে বাঁচিয়ে রাখার মতো বোকামি করবে না এটা সুরঞ্জন ভালো করেই জানে।

শুধু সুরঞ্জন কেন, স্যারের ওই ভাইপো অবিনাশ, সুদেব বা দেচেন থুম্পডেন কেউই বেঁচে থাকবে না। সুরঞ্জন মারা গেলে অবশ্য কোনো হইচই হবে না, কলকাতার কাছে তিনি অনেকদিন আগেই মৃত। দেচেনের মৃত্যুতেও কিছু যাবে আসবে না কারোর। কিন্তু অবিনাশ, সুদেব এদেরকেও মার্ক শেষ করে দিলে তো পুলিশ খোঁজাখুঁজি করবে, তখন মার্ক কী করবে? পরক্ষণেই শ্বাস ফেলেন সুরঞ্জন, মার্কের শয়তানি বুদ্ধির আঁচ পাওয়া সুরঞ্জনের অসাধ্য। হয়তো সব কিছু প্ল্যান করেই রেখেছে ও, হয়তো সব মিটে গেলেই এখান থেকে হাওয়া হয়ে যাবে মার্ক। এমন কোনো মানুষ জীবিত থাকবে না যে জানত মার্ক আর লুংদোপেদরির দাওয়া লামা একই ব্যক্তি!

মার্কের কথায় সুরঞ্জনের হুঁশ ফিরল, চমকে উঠে দেখলেন মার্ক একটা খাতা বের করেছে। সুরঞ্জন ভেতরে ঢুকে গেলেন, জন্তু দুটো আজ সকাল থেকেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে রয়েছে। কাল অবধি যা যা করণীয় সবই উনি করেছেন, আজ সকাল থেকে আর কোনো ইনস্ট্রাকশন দেওয়া নেই পদ্মসম্ভবের লেখায়।

সুরঞ্জন খাঁচার কাছে এগিয়ে গেলেন। চোখ দুটো অস্বাভাবিক লাল হয়ে রয়েছে, বিশাল কুমিরের মতো লেজটা থেকে থেকেই কেঁপে উঠছে। নাহ, আর দেরি করা যায় না। সুরঞ্জন ঘরের একপাশে তাকে রাখা কেমিক্যালগুলোর দিকে একঝলক তাকিয়ে নিলেন।

তাঁর মনে পড়ল পটাশিয়াম সায়ানাইডের স্বাদ কীরকম সেটা জানার জন্য কত বিজ্ঞানী নিজের জীবন দিয়ে দিয়েছেন। ওঁর ব্যাপারটাও অনেকটা সেরকমই, শুধু আফশোস একটাই, বিজ্ঞানের একটা দিক আবিষ্কারের জন্য তাঁকে খুন হতে হবে একটা ক্ষমতালোভী পিশাচের কাছে। মার্ক এই যুগান্তকারী আবিষ্কারকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কীভাবে ব্যবহার করবে সেটা সুরঞ্জনের জানা নেই।

হঠাৎ মনে পড়ল প্রায়—ঝাপসা—হয়ে—যাওয়া পূরবীর মুখটা। রুদ্রর মুখটাও সেদিন অন্ধকারে ভালো করে দেখতে পাননি। তৃষ্ণার্ত পাখির মতো মনটা হু হু করে উঠল সুরঞ্জনের।

মেয়েটাকে শেষ একবার দেখতে বড়ো ইচ্ছে করছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *