ঈশ্বর যখন বন্দি – ১

ট্যাক্সি থেকে মালপত্র নামিয়ে প্রিয়ম যখন অ্যাপার্টমেন্টের লিফটে উঠল, তখন সূর্য পশ্চিমদিকে অনেকটা হেলে পড়েছে। যদিও ঘড়ির কাঁটা বলছে সবে মাত্র বিকেল পাঁচটা, কিন্তু শীতকালের বেলা, এর মধ্যেই চারদিকে একটা সন্ধে সন্ধে ভাব।

ইদানীং পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুটা কেমন যেন পালটে গেছে, এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে আসতে আসতে ভাবছিল প্রিয়ম। আগে ছোটোবেলায় বড়োদিনের সময় জাঁকিয়ে শীত পড়ত, খাটে বসে লেপের তলায় পা ঢুকিয়ে পিঠে খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা, এখন বেশ কয়েক বছর ধরে শীতটা পড়ছেই বেশ দেরি করে। প্রায় জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ নাগাদ। থাকছেও অল্প দিন, সরস্বতী পুজোর আগেই ফুড়ুৎ। সবই গ্লোবাল ওয়ার্মিং—এর মায়া। বড়ো বড়ো স্কাইস্ক্র্যাপার উঠে ঢেকে দিচ্ছে আকাশের মুখ। তাও তো গঙ্গার ওপারটা যতটা উন্নতি করেছে, এইদিকটা এখনও অতটা করেনি। বেশিরভাগ লোহালক্কড়ের কারখানা আর মাঝেমধ্যেই পুরোনো বাড়ি থাকায় এখনও সেই পুরোনো কলকাতার ঝলক পাওয়া যায় হাওড়ায়। তার মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো ফ্ল্যাটবাড়ি উঠে নবীন—প্রবীণের সুন্দর মেলবন্ধন তৈরি করেছে।

লাগেজগুলোকে সাবধানে লবিতে নামিয়ে রেখে চাবিটা বের করে ফ্ল্যাটের তালা খুলল প্রিয়ম।

যা ভেবেছে ঠিক তাই। ট্রলিটাকে ঢুকিয়ে ভেতরে তাকাতে ওর চোখ দুটো সরু হয়ে মুখ দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। এই কয়েকদিন ছিল না, ওর স্ত্রী রুদ্রাণী মনের সুখে তোলপাড় করেছে ফ্ল্যাটটাকে। রেফ্রিজারেটরের তলা থেকে উঁকি মারছে একটা পেপসির ক্যান। জামাকাপড় সব ছত্রখান হয়ে পড়ে রয়েছে চারদিকে। ল্যাপটপটা বিপজ্জনকভাবে মাইক্রোওয়েভ আভেনের ওপর কাত হয়ে রয়েছে, তার ওপর দু—তিন দিনের পুরোনো কে এফ সি—র টিসু পেপার!

বাঁধা গোরু ছাড়া পেলে যা হয় আর কি, এই ক—দিন আগে জন্ডিস থেকে ভুগে উঠল, প্রিয়মের কড়া নজরে কিছু খেতে পারে না, এই ক—দিন সুদে—আসলে পুষিয়ে নিয়েছে মনে হচ্ছে।

প্রিয়ম বেডরুমে ঢুকল। বালিশগুলোকে দেখে মায়া হল ওর। কী চরম অত্যাচার যে ওদের ওপর হয়েছে এই ক—দিনে, সেটা ভালোমতোই বোঝা যাচ্ছে। ধামসে ধামসে সেগুলোর আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। রুদ্রর একটা কালো ওড়না সরু সাপের মতো হয়ে স্ট্যান্ড ফ্যানটার গলায় সুন্দর একটা টাই হয়ে পেঁচিয়ে রয়েছে। প্রিয় ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ফেলল। বউ তো নয় যেন বিছুটি পাতা!

কিন্তু আধ ঘণ্টা বাদে লাগেজগুলোকে এক কোণে রেখে বাথরুমে গিয়ে ভালো করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে যখন বাড়ির পুলওভারটা গায়ে চড়াল, খুশিতে ওর গলায় গুন গুন সুর এসে গেল। যতই ভালো হোটেল হোক আর খাওয়াদাওয়া হোক, সে দু—দিনই ভালো, তারপর মনটা বাড়ি বাড়ি করে। তার ওপর এবার প্রায় দু—সপ্তাহের টুর ছিল, গেছিল ডিসেম্বরের শেষে, আর ফিরল এই জানুয়ারির মাঝামাঝি, সেই অর্থে নিজের বাড়িতে নতুন বছরে এই প্রথম পা রাখল প্রিয়ম। নিজের বাড়ি ইজ নিজের বাড়ি। তার ওপর যার বাড়িতে এরকম ধানিলঙ্কার মতো বউ থাকে, তার তো বাড়ি ছাড়া কিছু ভালো লাগবার কথাই নয়।

রুদ্র আজ ব্যাঙ্কের কাজে আটকে পড়েছে, গম্ভীর গলায় ফোন করে জানাল আসতে দেরি হবে। ম্যাডাম আবার ব্যাঙ্কে ভীষণ গম্ভীর থাকেন, না হলে বুড়ো বুড়ো স্টাফেরা মানবে কেন? প্রিয়মের হাসি পেয়ে গেল। অথচ বাড়িতে যে কী ছেলেমানুষি করে, সে শুধু ও—ই জানে।

রান্নার মাসি একটু বাদেই এসে পড়বে, বলা আছে। এক কাপ কফি বানিয়ে সোফায় মৌজ করে বসল প্রিয়ম। খবরের কাগজটা সামনে রাখা ছিল, খুলে খেলার পাতায় চোখ রাখল।

কিছুক্ষণ বাদে রুদ্রকে ফোন করতে যাবে, এমন সময় চোখ পড়ল পড়ার টেবিলের দিকে। একটা নতুন ঝকঝকে ডায়েরি রাখা। এই বছরের নিশ্চয়ই। ডায়েরি নিয়ে প্রিয়মের ছোটোবেলার অবসেশনটা আবার জেগে উঠল। ছোটো থেকেই ডায়েরি ওর ভীষণ প্রিয়। একটা ডায়েরি পাওয়ার জন্য নতুন বছর শুরু হবার কত আগে থেকে লোকজনদের বলে রাখত। তারপর সারা বছর ধরে নিজের আনন্দ, দুঃখ উত্তেজনা, হতাশা সব ধরে রাখত ওই ক—টা কাগজের পাতায়। তবে এখন রুদ্রর ব্যাঙ্কের চাকরির দৌলতে প্রচুর ডায়েরি এমনিতেই জুটে যায়।

ও ডায়েরিটার দিকে তাকাল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ খানদানি জিনিস। পুরু কালো চামড়ার বাঁধাই, ওপরে সোনার জলে ২০১৬ লেখা। ডানদিকে ছোট্ট একটা সুদৃশ্য লক। সোৎসাহে ও ডায়েরিটা খুলল।

আরে! এ তো অনেক পাতা লেখা হয়ে গেছে, এদিকে ২০১৬ সালের ডায়েরি। হাতের লেখা তো রুদ্রর—ই। মাত্র ক—দিনে এত কী লিখেছে? স্বামীর বিরহে রোদন আলাপ নাকি! প্রিয়মের ভ্রূ কুঁচকে গেল। না, এ তো সিরিয়াস কেস মনে হচ্ছে! কফিটা এক চুমুকে শেষ করে ডায়েরিটা নিয়ে সোফায় বসে প্রথম পাতাটা খুলল প্রিয়ম।

১ জানুয়ারি, ২০১৬

আজ বছরের প্রথম দিন। অনেক ছোটোবেলায় নিয়ম করে ডায়েরি লিখতাম। আর বাবা অফিস থেকে ফিরলেই জোরে জোরে সারাদিন কী করেছি তা পড়ে শোনাতাম। বাবা হাসিমুখে শুনে যেত আমার সারাদিনের ভালো লাগা, আনন্দ বা মনখারাপের ফিরিস্তি।

আজ বাবা নেই, তাই ডায়েরি লেখার ইচ্ছেও নেই। কিন্তু আজ এমন একটা ঘটনা ঘটেছে সেটা আপাতদৃষ্টিতে অতি মামুলি হলেও মনটা কেমন যেন অস্থির হয়ে আছে। মনে হচ্ছে এ যেন হিমশৈলের চূড়া মাত্র। সেই চাঞ্চল্যের ভাবটা কাটাতেই ক্লান্তিতে চোখ জুড়ে এলেও রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই ঘড়ির কাঁটার সামনে লিখতে বসেছি। কারণ আমার পরবর্তী পদক্ষেপ আমি যা নেব বলে ঠিক করেছি, তার জন্য এই লেখাটি খুবই জরুরি। গত ন—বছর ধরে মনের মধ্যে জমে থাকা সব মেঘগুলোকে আজ বৃষ্টি করে ঝরাব ডায়েরির পাতায়, তা সে যত সময়ই লাগুক না কেন। যদি আমার অবস্থাও বাবার মতো হয় তবে কেউ অন্তত জানতে পারবে আমার অন্তর্ধানের কারণ।

আজ নিউ ইয়ারের সুবাদে ছুটি তো ছিলই না, বরং একটা লোনের কাজে আটকে গিয়ে অফিস থেকে বেরোতে অনেক দেরি হয়েছিল। মাফলারটা ভালো করে মুখে জড়িয়ে নিয়ে হাত দুটোকে যতটা সম্ভব ওভারকোটের মধ্যে চালান করে দিয়ে ব্রাঞ্চ থেকে যখন বেরিয়েছিলাম তখন ঘড়ির কাঁটা ন—টা ছুঁই ছুঁই।

জানুয়ারি মাসের হাড় কাঁপানো শীতের রাত। দূরে ল্যাম্পপোস্টের আলো অন্ধকারের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়ে ঘন কুয়াশার মধ্যে কেমন যেন বরফকুচির মতো সাদা ধোঁয়ার সৃষ্টি করেছে। উলটোদিকের পান বিড়ির দোকানের আলোটা টিমটিম করে ব্যাটারির আলোয় জ্বলছে। বুড়ো রহমত চাচা চাদর জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে ঝিমুচ্ছে। অন্যদিন হলে মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে কথা বলে এগোতাম, কিন্তু আজ সাংঘাতিক দেরি হয়ে গেছে। ন—টা সতেরোর ডাউন লোকালটা মিস করলে এই ঠান্ডায় চোখে সরষে ফুল দেখতে হবে। তাই হাত দুটোকে পকেটের গর্তের মধ্যে আরও জোরে সেঁধিয়ে দিয়ে জলদি পা চালালাম। কবজি উলটে দেখলাম ন—টা পাঁচ। আশা করি পেয়ে যাব।

হাঁটতে হাঁটতে যখনই আজ দুপুরের ঘটনার কথা ভাবছিলাম, বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে যাচ্ছিলাম। এতদিন বাদে এরকম কাকতালীয় যোগাযোগের কি কোনো ব্যাখ্যা হয়?

আমি ব্যাঙ্কে চাকরি করি। হাওড়া বর্ধমান কর্ড লাইন—এ যাঁরা যাতায়াত করেন তাঁরা ধনেখালি হল্ট স্টেশনের সঙ্গে পরিচিত। এই ধনেখালিতেই আমি মাস চারেক আগে বদলি হয়ে এসেছি। এখন প্রতিটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক গ্রামগঞ্জে ব্রাঞ্চ খোলার ব্যাপারে খুব জোর দিচ্ছে। কর্ড লাইন, মেন লাইন ধরে ধরে সব ছোটো ছোটো স্টেশননির্ভর গ্রামগুলোতে ব্যাঙ্কের রুরাল শাখা খোলা হচ্ছে। সেরকমই এই ধনেখালিতে আমাদের ব্যাঙ্কের একটা ছোটো শাখা খুলে আমাকে ম্যানেজার করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে প্রথমে আইটি সেক্টরে ঢুকলেও মাস ছয়েকের মধ্যেই ব্যাঙ্কের প্রবেশনারি অফিসারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম আমি। আমার সাত বছরের বন্ধু কাম ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাসমেট এবং গত মার্চ মাস থেকে আমার বিবাহিত স্বামী হয়ে ওঠা প্রিয়ম অবশ্য আইটিতেই রয়ে গেছে। ওর পোস্টিং কলকাতাতেই তবে এখন অফিসের কাজে পুনে গেছে।

প্রথমে লেডি অফিসার হিসেবে খাস ডালহৌসিতে পোস্টিং দেওয়ায় এই তিন বছর মহানন্দেই কাটিয়েছিলাম। তারপর প্রোমোশন পেতেই হল ঝামেলা। নিয়ম অনুযায়ী দু—বছর গ্রামে পোস্টিং নিতেই হবে। তবে খুব খারাপ জায়গায় ট্রান্সফার আমার হয়নি। আমরা থাকি হাওড়া কদমতলায়। বাড়ি থেকে স্কুটি করে হাওড়া স্টেশন আসি, সেখান থেকে কর্ড লাইন—এর লোকাল ধরে ধনেখালি। মাঝে মাঝে আমাদের সদ্য কেনা ইনোভাটা চালিয়েও চলে আসি, তা ছাড়া এই এলাকাটাও খুব একটা খারাপ নয়। আগে তো একদমই গ্রাম ছিল, এখন বিশ্বায়নের ছোঁয়া লেগে আধা মফস্সলে পরিণত হচ্ছে আস্তে আস্তে।

ধনেখালির তাঁতের শাড়ির তো বেশ কদর। তাঁতশিল্পকে কেন্দ্র করে গরিব মানুষগুলোর জীবনযাত্রার পরিবর্তন হচ্ছে ধীরে ধীরে। এখানকার মানুষজনও ভালো। স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান, হেডমাস্টারমশাই এবং কয়েকজন সম্পন্ন তাঁতকলের মালিককে আমাদের এই ব্রাঞ্চের উদবোধনী অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। ব্যাঙ্ক খোলাতে তারা বেশ খুশি, তার ওপর আমার মতো মাত্র পঁচিশ বছরের ম্যানেজার ম্যাডামকে পেয়ে তারা যারপরনাই বিগলিত।

তাতে আমার অবশ্য বেশ সুবিধাই হয়েছে। এই ক—মাসের মধ্যেই বেশ কয়েকটা স্বাস্থ্যবান লোন আর ক্যাশ ক্রেডিট স্যাংশন করিয়ে আমি এই ছোট্ট ব্রাঞ্চটাকে মোটামুটি দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। এখানকার লোকজনের মধ্যেও বেশ সম্ভ্রম দেখতে পাই। শহুরে দাম্ভিকতা, উগ্রতা, ঔদ্ধত্য এখনও পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলতে পারেনি। অধিকাংশই বড়ো সরল।

যাই হোক, থাক এসব কথা। সারাদিন কাজে ডুবে থাকতে থাকতে এমন হয়েছে যে সব কথাতেই কাজ এসে পড়ে। এই কাজ যে খুব ভালোবাসি তা মোটেই নয়, কিন্তু কখনো কখনো কাজে ডুবে থাকা অনেক কিছু ভুলে থাকাকে সাহায্য করে।

আসল কথায় আসি। দিন কয়েক ধরেই এক বয়স্ক ভদ্রলোক ব্রাঞ্চে আনাগোনা করছিলেন একটা লোনের ব্যাপারে। ওঁর পৈতৃক ভিটের একদিকে উনি গেঞ্জির একটা ছোটো কারখানা করেছেন। জনা পাঁচেক কর্মী। কিছু নতুন মেশিন কেনার ব্যাপারে লোনের প্রয়োজন, তাই এসেছেন। প্রাথমিক কাগজপত্র সব আগেই জমা দিয়েছিলেন, সেগুলো আশাব্যঞ্জক হওয়ায় ফাইনাল স্যাংশনের আগে আজ আমার কারখানাটা দেখতে যাবার কথা ছিল। ব্যাঙ্কিং পরিভাষায় যাকে বলে ‘ইনস্পেকশন’।

ভদ্রলোকের নাম অবিনাশ চৌধুরী। বয়স ষাটের ওপরেই হবে, কিন্তু শরীরের পেটাই গড়ন দেখলেই বোঝা যায় যে তিনি এখনও রীতিমতো কর্মঠ। গায়ের রং একটু আশাতীত রকমের ফর্সা আর হালকা খয়েরি চোখের মধ্যেও বনেদিয়ানার ছাপ, যা ওঁর জমিদারি রক্তের প্রমাণ দেয়।

প্রথম দিন এসেই পাতলা—হয়ে—আসা চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে বলেছিলেন, ‘ম্যাডাম, শরিকদের মারামারি খেয়োখেয়িতে সবই প্রায় গেছে, তবে আজও ধনেখালির জমিদার আমরাই। তবে ওই যে কথায় বলে নামেই তালপুকুর, এদিকে ঘটি ডোবে না। আমাদেরও হয়েছে সেই দশা। বিশাল অট্টালিকার মতো বাড়ি, বাপ ঠাকুরদার কত স্মৃতি, খসে খসে পড়ছে, কিন্তু কিছু করার নেই। আমাদের কারুরই সাধ্য নেই ওই পেল্লাই প্রাসাদকে যত্ন করার। আমি তবু এই কারখানাটা করে বেঁচেবর্তে আছি, এ ছাড়া ছেলেও পাশ করে টিউশনি করছে, মেয়েটার বিয়েও দিয়ে দিয়েছি। অন্য শরিকদের অবস্থা তো আরও সঙ্গিন!’

আমি কাগজপত্রগুলোয় শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে কী কী জিনিস পরখ করে নিতে হবে, মনে মনে একবার ঝালিয়ে নিয়ে আমার পিয়োন কাম সাবস্টাফ সুলোচনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সুলোচন স্থানীয় ছেলে। ওর মুখ থেকেই অবিনাশবাবুদের বাড়ির কথা শুনেছিলাম। এককালে এই জমিদারবাড়ির নাকি সত্যিই নাম, ঠাটবাট সবই ছিল। এঁদের সম্পত্তিও ছিল অগাধ, মাইলের পর মাইল জমি। পুকুর। লেঠেলের দল। সম্পর্কে এঁরা নাকি বর্ধমানের মহারাজার আত্মীয়ও ছিলেন। এখন সবই তলানিতে এসে ঠেকেছে।

অবিনাশবাবু দেখলাম একটা পুরোনো আদ্যিকালের রং—উঠে—যাওয়া অ্যাম্বাসাডর নিয়ে এসেছেন। আমি সেদিকে চেয়ে কারখানার এখনকার অবস্থা কেমন হতে পারে তার একটা আন্দাজ করতে করতে গাড়িতে উঠে বসলাম। স্টার্ট দিতে বেশ একটু বেগ পেতে হল ড্রাইভারকে, তারপর হালকা আর্তনাদ করে চলতে শুরু করল।

সারাটা রাস্তা বিশেষ কথা হল না। আমি খুব একটা গ্রাম দেখিনি। ধনেখালি বাজার চত্বর পেরিয়ে আসতেই গ্রামবাংলার সবুজ শ্যামল রূপ চোখে ভেসে উঠল। দূরে চোখে পড়ল খেজুরগাছের রস নামানো হচ্ছে। মনে পড়ে গেল ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়ার সময় বাবা—মায়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম, শীতকালেই। বাবা ধরে ধরে আমাকে অনেক নাম—না—জানা গাছ চিনিয়েছিলেন। মনে পড়ল খোয়াইয়ের ধারে হাঁটতে হাঁটতে বাবার শেখানো সেই রবীন্দ্রসংগীতটা, ‘শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকীর ঐ ডালে ডালে…।’

হঠাৎ একটা জোর ঝাঁকুনিতে সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখি মাটির কাঁচা রাস্তা ধরে এগোচ্ছে গাড়ি। আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, ‘আর কতক্ষণ মি চৌধুরী?’

অবিনাশবাবু সামনের সিট থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘প্রায় এসে গেছি ম্যাডাম, এই বাঁকটা নিলেই ললিত ভবন।’

শীতকালের রোদ ঝলমলে বেলা। মিষ্টি রোদের তাতে বেশ আরামই হচ্ছিল। কিন্তু বাঁকটা ঘুরতেই হঠাৎ চারদিকের আলো কমে গিয়ে কেমন যেন অন্ধকার নেমে এল। সঙ্গেসঙ্গে আমার বেশ শীত শীত করতে লাগল। বাঁ—দিকে চেয়ে দেখি, দানবসম যে জিনিসটা আকাশটাকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে দাঁড়িয়ে আছে তেমন প্রকাণ্ড বাড়ি আমি ইহজীবনে দেখিনি। বাড়ি না বলে অতিকায় অট্টালিকা বলাই ভালো। এককালে মনে হয় লাল রং ছিল, এখন তার ওপরে শতাব্দীপ্রাচীন শ্যাওলা জমে এক কালচে ধূসর রঙে পরিণত হয়েছে। অসংখ্য সরু মোটা বট—অশ্বত্থ গাছের ঝুরি সাপের মতো জড়িয়ে রেখেছে গোটা বাড়িটাকে।

গাড়িটা বাঁ—দিকে ঘুরে লাল সুরকির এক পথ ধরে কিছুটা চলে একদম বাড়ির মুখোমুখি গিয়ে আমাদের দাঁড় করাল। আমি বিস্মিত দৃষ্টিতে সুলোচনের দিকে তাকালাম। সুলোচনের কাছে মনে হয় আমার এই অভিব্যক্তি খুবই প্রত্যাশিত ছিল। সে হেসে বলল, ‘দেড়শো বছরের পুরোনো বাড়ি ম্যাডাম, এককালে শুনেছি কালীপুজোয় তিনটে মোষ একসঙ্গে বলি হত।’

সামনে বিশাল বিশাল সাদা থাম। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম, এই মুহূর্তে এটাকে বিপজ্জনক বাড়ি হিসেবে ঘোষণা করা উচিত। একদিকের ঝুলবারান্দা ভেঙে প্রায় ঝুলছে, অন্যদিকে মোটা মোটা বট অশ্বত্থের গুঁড়ি দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে ফাটল সৃষ্টি করে ভেতরে ঢুকে গেছে। আশপাশের বিশাল বিশাল কিছু গাছের পাতা বাড়ির ছাদের ওপর ছাউনির সৃষ্টি করেছে। বাপ রে! এ তে পুরো ভূতুড়ে ফিলমের সেট থেকে উঠে এসেছে মনে হচ্ছে!

আমি অবিনাশবাবুর দিকে তাকালাম, ‘এইখানে আপনি গেঞ্জির কারখানা করেছেন! লেবারদের বাড়ি চাপা দিয়ে মারতে চান বুঝি?’

অবিনাশবাবু লম্বা জিভ কেটে হেসে ফেলে বললেন, ‘কী যে বলেন ম্যাডাম, এই বাড়িতে জন্মে ইস্তক রয়েছি, কোনোদিন কিছু অনিষ্ট হয়নি। আর তা ছাড়া সামনের দিকটা একটু বেশিই খসে পড়েছে। আমরা থাকি পেছন দিকটায়। সেদিকটা মেরামত করে মোটামুটি টিকিয়ে রেখেছি। আসুন আসুন।’

অবিনাশবাবুর পেছন পেছন আমি আর সুলোচন বাড়ির ডান দিক দিয়ে পেছনদিকে চললাম। অবিনাশবাবুকে একটু এগিয়ে যেতে দিয়ে আমি সুলোচনকে প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি তো এখানেই থাক। এ বাড়িতে এসেছ কখনো এর আগে?’

সুলোচন জবাব দিল, ‘ছোটোবেলায় বারদুয়েক এসেছিলাম ম্যাডাম। তারপর ওই পাগলা দাদু খুন হবার পর থেকে এদিকে আর তেমন পা বাড়াইনি। তাও হয়ে গেল বছর দশেক…’

আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, অবিনাশবাবু পিছু ফিরলেন, ‘এইদিকে আসুন, ম্যাডাম।’

নাহ, ভদ্রলোক খুব একটা বাজে কথা বলেননি। পেছনদিকটার অবস্থা সত্যিই তুলনামূলকভাবে ভালো এবং লোকজন বাস করে সেটা বোঝাও যায়। কিছুটা অংশ বাসস্থান করে বাকিটুকুতে অবিনাশবাবু তাঁর গেঞ্জির কারখানা করেছেন। জনা পাঁচেক ছেলে মেশিন চালাচ্ছে। আমি আমার ডিউটি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। দুটো ঘর নিয়ে কাজ চলছে। আমি যা দেখবার, মেপে নিতে লাগলাম। ইতিউতি পড়ে থাকা গেঞ্জির টুকরো, মেশিন সব পরখ করছিলাম।

এ যা বিজনেস, তাতে লাখ তিনেকের বেশি স্যাংশন করা যাবে না। কোল্যাটেরাল আর কাস্টমার বেসটা একবার দেখে নিতে হবে, কোথায় সাপ্লাই দেয় সেটা জানতে হবে, ডিস্ট্রিবিউটরদের ডিটেলসও নিতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে আমার জিনসের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলাম। ইনস্পেকশন সাইটের ছবি তোলাটাও কাজের মধ্যে পড়ে। প্রি—স্যাংশন রিপোর্টে লাগে। টুকটাক ছবি তুলছিলাম। লেবারদের খুচখাচ প্রশ্ন করছিলাম, আর পাশ থেকে অবিনাশবাবু এফ এম রেডিয়োর মতো নাগাড়ে তাঁর কাজের খতিয়ান দিয়ে যাচ্ছিলেন।

এমন সময় জিনিসটা আমার চোখে পড়ল। এবং দেখেই আমার বুকের রক্তটা কেমন বিস্ময়ে ছলকে উঠল।

সবার চোখের সামনেই ডান দিকের দেওয়ালে ছবিটা ঝুলছিল। আমি দেখে কেমন নিজের অজান্তেই আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। ছবি না বলে সেটাকে একটা অদক্ষ হাতের পেনসিল স্কেচ বলাই ভালো। বহু পুরোনো হওয়ার কারণে কাগজে হলদেটে ভাব ধরেছে আর স্কেচটাও ফিকে হয়ে গেছে অনেক। তবু আমার এটা চিনতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছিল না।

এই ছবিটা সম্পর্কে কয়েক বছর আগে এত শুনেছি যে এর প্রতিটা ভাঁজ আমি চিনি।

একজন আলখাল্লা পরা সন্ন্যাসী ধ্যানে বসেছেন। তাঁর পায়ের কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে নতজানু হয়ে বসে আছে একটা প্রাণী। সন্ন্যাসী তাঁর ডান হাত উঁচু করে কিছু একটা নির্দেশ দিচ্ছেন জন্তুটাকে। একনজরে দেখলে মনে হয় সেটা একটা সাপ। কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ঠিক সাপ নয়। বসবার ধরনটাও সাপের মতো নয়। সর্পিল এক প্রাণী, যার সম্মুখভাগের অংশটা খুবই হিংস্র। মুখটা শরীরের তুলনায় অনেকটা বড়ো, শ্বাপদের মতো বড়ো বড়ো দাঁতগুলো প্রাণীটার মাংসলোলুপতার পরিচয় দেয়। দু—দিকে মুখ থেকে বেশ খানিকটা বের হয়ে থাকা শ্বদন্ত অনেকটা ডাইনোসরের আদল নিয়েছে।

বীভৎস হাঁ—মুখটা থেকে সরু লকলকে জিভ বেরিয়ে এসেছে অনেকটা অবধি আর জিভের ডগাটা দু—ফলা। জন্তুটার ঘাড়ের কাছটায় ছোটো ছোটো দাঁতের সারি, অনেকটা স্টেগোসরাসের মতো, তারপর বাকি শরীরটা সাপের মতোই এঁকেবেঁকে গেছে কিন্তু অনেক বেশি লোমশ আর বলিষ্ঠ। আর একদম লেজের প্রান্তে একটা তিরের ফলার মতো অংশ। পুরো শরীরটা থেকেই, বিশেষত মুখ থেকে আগুনের শিখার মতো কিছু বিকিরিত হচ্ছে।

ড্রাগন!

কতক্ষণ এভাবে তাকিয়ে ছিলাম জানি না, আমার তাকিয়ে থাকা দেখে অবিনাশবাবু বোধ হয় কিছু আন্দাজ করেছিলেন। বললেন, ‘ওই ছবিটা দেখছেন ম্যাডাম? ওটা আমার এক কাকার আঁকা ছবি। কাকা বৌদ্ধ হয়েছিলেন তো, ইয়ং লাইফে বাড়ি থেকে পালিয়ে আবার বহু বছর বাদে ফিরে আসেন। মাথাটা বিগড়ে গেছিল একটু, এইসব ছাইপাঁশ আঁকিবুঁকি কাটতেন দিনরাত… ইদানীং গেঞ্জিতে এইসব অদ্ভুত প্রিন্ট এখনকার ছেলে—ছোকরারা চাইছে তাই এনে টাঙিয়ে রেখেছি আর কি! তবে কিনা আমার গেঞ্জিতে কোনো খুঁত পাবেন না আপনি, কোয়ালিটিও দারুণ…!’

আমি মাঝপথে বাধা দিয়ে বললাম, ‘অবিনাশবাবু, আপনার কাকার অন্য ছবিগুলো কোথায়?’

অবিনাশবাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘ছবি বলতে তো সেরকম কিছু নেই। ওঁর যখন যেমন খেয়াল হত, এদিক—ওদিক এঁকে ফেলে রাখতেন।’

‘ওঁর সঙ্গে আমার একটু আলাপ করাবেন?’

অবিনাশবাবু এবার একটু ক্লিশে হেসে বললেন, ‘উনি তো অনেকদিন হল মারা গেছেন। কী ব্যাপার বলুন তো ম্যাডাম?’

এতক্ষণে আমি হুঁশ ফিরে পেলাম। বুঝতে পারলাম আমি একটা অফিশিয়াল কাজে এসেছি, সেখানে আমার এই অদ্ভুত কৌতূহল স্বাভাবিক নয়। টের পেলাম আমার পাশ থেকে সুলোচনও আমার ভাবগতিক দেখে একটু থমকে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম, আমার যা জানবার সেটা বের করতে হলে এদের কোনোভাবেই কিছু বুঝতে দেওয়া চলবে না, কৌশলে বের করতে হবে। আমি মুহূর্তের মধ্যে আমার বিমূঢ় ভাবটা কাটিয়ে গাম্ভীর্যটা ফিরিয়ে আনলাম, ‘অবিনাশবাবু, আমার কাজ হয়ে গেছে। দু—তিন দিন বাদে ব্যাঙ্কে আসবেন একবার। চলুন যাওয়া যাক তাহলে।’

অবিনাশবাবু বেশ উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘সে কী ম্যাডাম, এই প্রথম আমাদের ভিটেয় পা দিলেন, একটু মিষ্টিমুখ না করে গেলে চলবে কেন? আসুন ভেতরে আসুন।’ বুঝতে পারলাম উনি ওঁর ঘরে নিয়ে যেতে চাইছেন। এই সুযোগটা হাতছাড়া করা চলবে না। আমি সুলোচনকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম।

কারখানার ঘর দুটো পেরিয়ে একটা ছোটো দালান, তারপর আবার গোটা তিনেক ঘর। সামনের দিকে বাড়িটা দোতলা হলেও এদিকটা একতলা। খুবই বাহুল্যবর্জিত ঘর। পুরোনো দিনের কিছু আসবাবপত্র, কুলুঙ্গিতে ভরতি।

একজন মহিলা, নিশ্চয়ই অবিনাশবাবুর স্ত্রী—ই হবেন, ভেতর থেকে ভারী একটা কাঁসার রেকাবিতে চা, মিষ্টি নিয়ে এলেন। আমি কথা না বাড়িয়ে খেতে শুরু করলাম, ‘আসলে কী বলুন তো অবিনাশবাবু, ছোটো থেকে কলকাতায় মানুষ হয়েছি তো, এরকম বাড়ির কথা শুধু বইয়ের পাতাতেই পড়েছি। তাই খুব থ্রিলড লাগছে। আমি প্রচুর ভূতের গল্প পড়ি। এইরকম বাড়িতেই তো সব ভূতুড়ে ঘটনাগুলো ঘটে। আপনাদের বাড়িতেও কি এরকম কিছু আছে? তার ওপর ওই আঁকাগুলোও কীরকম ছমছমে…।’ আমি কপট ভয়ের হালকা একটা মেয়েলি ভঙ্গি করলাম।

অবিনাশবাবু জোরে হেসে উঠলেন, ‘ম্যাডাম, এই বয়সে ম্যানেজার হয়ে গেলে কী হবে, বয়সটা তো আপনার একদম—ই কম। আপনি হলেন গিয়ে আমার মেয়েরই বয়সি। বাচ্চা মেয়ে, ভয় তো একটু লাগবেই! তবে কিনা, এ বাড়িতে সেসব উৎপাত নেই। তবে হ্যাঁ, একটা ঘটনা আছে যেটা কিনা বেশ ক—বছর আগে খুব হইহই ফেলেছিল এ চত্বরে। সেটা আপনাকে বলতে পারি।’

বুঝলাম ওষুধটা কাজে দিয়েছে। আমি সোৎসাহে বললাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন না!’

অবিনাশবাবু বলতে শুরু করলেন, ‘এই বাড়িটা তৈরি করেছিলেন আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা পঞ্চানন চৌধুরী, ওঁর বাবার নামে। তিনি ছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার। তাও সেটা ইরেজির আন্দাজ ১৮৪৫ সাল। তখনও সিপাই বিদ্রোহ হয়নি। তখন গ্রামের লোকজন জমিদারকে ভগবানের মতোই শ্রদ্ধা ভক্তি করত। এ বাড়িতে লেঠেল বরকন্দাজ থেকে শুরু করে সব—ই ছিল। রোজ দু—শো লোকের পাত পড়ত। বাংলায় তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময় থেকে আমাদের অবনতি হতে শুরু করে। অবস্থার চরম অবনতি হয় দেশ স্বাধীনের পর ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন অ্যাক্ট যখন কায়েম হয়। সরকার জমিদারদের কাছ থেকে জমি দখল করে নিতে লাগল, জমিদাররাও সাধারণ গৃহস্থের মতো হয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু মুশকিল হল, এই বংশের সব ছেলেরাই আয়েশ করে, পায়রা উড়িয়ে, আসর মাতিয়ে অভ্যস্ত। তারা না পারল খেটে খেতে, না পারল অন্যের গোলামি করে চাকরি করতে। তাদের উদাসীনতায় নায়েব, গোমস্তারা লুটেপুটে খেতে লাগল। সম্পত্তি ভেতরে ভেতরে ফোঁপরা হয়ে পড়ল।

এইরকম যখন অবস্থা, তখন আমার ছোটোকাকা বিনোদ বিহারী বছর কুড়ির যুবক। বাড়ির অন্য ছেলেরা যখন ফুর্তিতে দিন কাটাত, উনি ছিলেন ব্যতিক্রম। প্রেসিডেন্সির খুব নামকরা ছাত্র ছিলেন, ইতিহাসে অগাধ পাণ্ডিত্য। ওঁর বাবা মানে আমার ঠাকুরদা উদয়চাঁদ, শেষ যেটুকু তখনও তলানি আছে, তাই দিয়ে ভাবলেন ছেলেকে বিলেত থেকে ব্যারিস্টার করে আনবেন। কিন্তু কাকার ইচ্ছে তিনি ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করবেন। স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াতে ঢুকলেন।

‘তখনকার দিনে মাস্টারিতে একেবারেই মাইনে ছিল না। এ নিয়ে লাগল বাপ ছেলের বিবাদ। ফলে যা হয়, ছেলেরা ঠিকমতো বাবার সামনে দাঁড়িয়ে কথাই বলতে পারত না, তর্ক করা তো দূর অস্ত। মনে আছে আমার বয়স তখন বারো কি তেরো। কাকার বিলেতযাত্রার সব ঠিকঠাক। এরকমই এক শীতের সকালে কাকা দাদুর সঙ্গে প্রবল বাগবিতণ্ডার পর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। তারপর বহু বছর কাকার আর কোনো খোঁজ নেই। ঠাকুরদা গত হবার পর বাবা আর মেজোকাকা কিছুদিন অনুসন্ধান চালিয়ে কিছু খোঁজ না পাওয়ায় হাল ছেড়ে দেন। আমরাও আস্তে আস্তে কাকার কথা প্রায় ভুলেই যাই।

‘কাকা হঠাৎ বাড়ি ফিরে আসেন ২০০৪ সালে। সে এক কাণ্ড। পঁচিশ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এসেছেন প্রায় সত্তর বছর বয়সে। প্রথমে তো আমরা কেউ চিনতেই পারিনি, বড়োরাও কেউ বেঁচে নেই। তবে মুখের আদল দেখে আমরা অবিশ্বাস করিনি। বয়সের ভারে একটু বেঁকে গেলেও মোটামুটি শক্তই ছিলেন, কিন্তু কোনো কারণে সবসময় খুব সতর্ক থাকতেন। কারুর সঙ্গে বিশেষ মেলামেশা করতেন না। এতদিন কোথায় ছিলেন, কী করছিলেন এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেননি। আমরা জিজ্ঞেস করলে দায়সারা উত্তর দিতেন, বলতেন ভুটানে ছিলেন, বৌদ্ধধর্ম নিয়ে পড়াশুনো করতেন।

পুবদিকের মহলে উনি থাকতেন, সম্পত্তির আইনি ভাগ বা অন্য কোনো কারণে কোনোদিন কোনো ঝামেলা পাকাননি। প্রথম প্রথম আমার স্ত্রী দু—বেলা রান্না করে পাঠিয়ে দিতেন। তারপর একদিন বারণ করে দিলেন। সারাদিন ঘর বন্ধ করে নিজের খেয়ালে আঁকিবুঁকি কাটতেন আর ঘর নোংরা করতেন। ও আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি। ফেরার সময় দেচেন নামে এক মাঝবয়সি ভুটানি চাকরকে নিয়ে এসেছিলেন। আমরা দ্বিজেন বলে ডাকতাম। লোকটা বোবা ছিল আর বেশ নিরীহ প্রকৃতির। সে—ই কাকার ঘর সাফসুতরো করে রাখত, টুকটাক ফাইফরমাশ খাটত। পরের দিকে কাকার রান্নাও ও—ই করত। মাঝে মাঝে কাকা ওই দ্বিজেনকে নিয়ে বেরোতেন টুকটাক, আবার ফিরে আসতেন। এইভাবে বছর দুয়েক চলার পরই সেই সাংঘাতিক কাণ্ডটা ঘটে।’ এতটা বলে অবিনাশবাবু একটু থামলেন।

আমি শুনতে শুনতে ভেতরে ভেতরে উত্তেজনার চরমে পৌঁছে গেছিলাম। আমার সন্দেহটা ক্রমেই বদ্ধমূল হচ্ছিল। রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী কাণ্ড?’

‘সেটা ২০০৬ সাল। ডিসেম্বর মাস। আমার ভাইয়েরা আর অন্য জ্ঞাতিরা ততদিনে সব অন্যান্য জায়গায় চলে গেছে। এই পুরো বাড়িতে আমার পরিবার আর ওই মহলে কাকা। আমি আমার বউ, ছেলে মেয়েকে নিয়ে দিনসাতেকের জন্য পুরী বেড়াতে গেছিলাম। মেয়েটার মাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছিল, ক—দিন ঘুরে এসে ফাইনাল পরীক্ষার জন্য তৈরি হবে, তাই। পুরী থেকে কোনারক—চিল্কা সব ঘুরে আসার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এমনই কপাল, মাঝপথেই ফিরে আসতে হল। আমার এক প্রতিবেশী, এখানকার স্কুলের মাস্টার কমলবাবু ফোন করে হোটেলে খবর দিলেন। কাকা খুন হয়েছেন।’

আমি নিশ্বাস ফেললাম। আমার আর কোনো সন্দেহই নেই। ক্লান্তভাবে বললাম, ‘তারপর?’

‘তারপর আর কী! আমার ষষ্ঠীপুজো চলল মাস তিনেক ধরে। একেই তখন সবে এই ব্যাবসাটা শুরু করেছি, টালমাটাল অবস্থা, তার ওপর এই বিপদ, যাকে বলে তখন আমার একেবারে শনির দশা। কথায় বলে পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। আর খুনটা হয়েওছিল খুব বীভৎসভাবে। কাকা ঘরের মেঝেতেই পড়েছিলেন, গলার নলি দু—ফাঁক করা। আর দেচেন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল কাকার পাশেই। তাকেও মারাত্মক জখম করা হয়েছিল, কিন্তু প্রাণে বেঁচে গেছিল। হয়তো ডাকাতের দল ভেবেছিল মরে গেছে। সে চোখে দেখা যায় না, ম্যাডাম। অমন নিরীহ শান্তশিষ্ট লোকটার অবস্থা দেখে চোখে জল আসছিল। বেচারা দু—মাস হসপিটালে রইল… কাছে গেলেই চোখ—মুখ লাল হয়ে উঠত আর মুখ দিয়ে ”আ আ” করে এক তীব্র আর্তনাদ করত।

যেমন হয়, পুলিশ প্রথমে বিশাল গতিতে তদন্ত শুরু করল, যত না তদন্ত, তার চেয়ে বেশি লাঞ্ছনা। সব শরিকদের ডেকে এনে তল্লাশি চলতে লাগল। আমরা নাকি কাকার সম্পত্তির লোভে খুন করিয়েছি। যত আমরা বলি যে ঠাকুরদা এমনিতেই কাকাকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন, তাই কাকার নামে আইনত কিছুই ছিল না, সে কে শোনে কার কথা! এইভাবে তিন চার মাস চলার পর পুলিশও হাল ছেড়ে দিল। ওই মহলটায় গেলে দেখতে পাবেন, এমনিই হুড়কো কপাট সব ভেঙে পড়েছে, তার ওপর একমাত্র যে প্রত্যক্ষদর্শী সব বলতে পারত, তার ওই অবস্থা।/আস্তে আস্তে সব ধামাচাপা পড়ে গেল।’

‘দেচেন এখন কোথায়?’

‘সে হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়ে পুলিশের নির্দেশে কিছুদিন এখানে ছিল। তারপর কোথায় চলে যায়। আমরা আর বিশেষ খোঁজখবর রাখিনি।’

আমি চুপ করে রইলাম। আমার কি বলাটা উচিত হবে যে এই ঘটনাটার সঙ্গে আমার বাবার এক প্রগাঢ় সম্পর্ক রয়েছে? অন্তত আমার তাই বিশ্বাস?

আমার কেমন যেন অবসন্ন লাগছিল। মনে হচ্ছিল কোনো বিছানায় শুয়ে পড়ি। তলিয়ে যাই অতল ঘুমে। কপালের দু—দিকের রগ দুটো দপদপ করছিল। ফ্ল্যাশব্যাকে অনেক কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতির পাতা মাথায় ভিড় করে আসছিল আমার আর মায়ের সেই ভয়ংকর দিনগুলো ফিরে আসছিল বার বার। বহু পুরোনো কান্নাগুলো আবার দলা পাকিয়ে ভিড় করছিল গলায়।

অবিনাশবাবুর মেয়ের মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা ছিল ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আর মাধ্যমিক ২০০৭—এর মার্চে। কবে থেকে কবে সেটাও আমি জানি। কারণ সেই বছরে আমিও ছিলাম একজন পরীক্ষার্থী। পরীক্ষা চলাকালীন প্রতিটা দিন বাবা আমায় নিতে আসতেন। শুধু শেষ দিন বাবাকে দেখতে পাইনি। তারপর থেকে আর কোনোদিনই দেখতে পাইনি আমার বাবাকে।

আমার বাবা ড সুরঞ্জন সিংহরায় ছিলেন একজন আর্কিয়োলজিস্ট, যাকে বাংলায় বলে পুরাতত্ত্ববিদ। ভারত সরকারের আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে প্রধান আর্কিয়োলজিস্টদের মধ্যে বাবা ছিলেন একজন। আমার মা আর বাবা ছিলেন সহপাঠী, দু—জনেই স্কটিশ চার্চে পড়াতেন, সেইসূত্রেই আলাপ। যদিও মায়ের বিষয় ছিল অঙ্ক, মা এখন কলেজে পড়ান আর বাবা ইতিহাস নিয়ে ডক্টরেট করে এ এস আই—তে যোগ দিয়েছিলেন।

মা হলেন একটু রাশভারী ধরনের আর বাবা ছিলেন আমার সবথেকে কাছের আর প্রিয় মানুষ। শাসনের রাশ এতটুকুও আলগা না করে কীভাবে বন্ধুর মতো মিশতে হয় তা বাবার থেকে ভালো কেউ জানত না। বাবাকে কাজের সুবাদে বিভিন্ন ফিল্ডে ঘুরে বেড়াতে হত। আমিও ছোটো থেকেই বাবার সঙ্গে সাইটে যেতাম। ছোটোবেলা থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য, পুরাতাত্ত্বিক বাতাবরণে বড়ো হতে হতে পুরাতত্ত্ব আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছিল। আমার বাবা মা ধরেই নিয়েছিলেন যে, বড়ো হয়ে আমিও বাবার পথের পথিক হব। গর্ব করে বলছি না, তবে ক্লাস নাইন টেনে পড়ার সময়ে আমার ইতিহাসের কিছু কিছু বিষয়ে জ্ঞান ইতিহাসের যেকোনো পি এইচ ডি স্কলারকেও টেক্কা দিতে পারত।

বাবার গবেষণার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল প্রথম শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে লেখা বৌদ্ধ পুথি। কিন্তু কিছু বছর যাবৎ বাবা তাঁর প্রধান রিসার্চ থেকে লাইনচ্যুত হয়ে একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন। কিন্তু সেই তদন্ত এতটাই স্পর্শকাতর এবং বিতর্কিত ছিল যে সরকারের সাহায্য নিতে বাবা চাইছিলেন না। তাঁর কলিগদের কাছেও বাবা সেটা বলেননি। তার একটা কারণ বিতর্ক এড়ানো আর দ্বিতীয় কারণ বিপদ আটকানো। তাই সমস্ত কিছু তিনি শেয়ার করতেন আমার সঙ্গে।

আমি জানি না এই ডায়েরি কার হাতে পড়বে বা আদৌ কেউ পড়বে কি না, বা তখন আদৌ আমি এ জগতে থাকব কি না। তাই পুরো ব্যাপারটা এখানে লিখে রাখছি। আগেও লিখে রাখতে পারতাম, কিন্তু সেই তাগিদ এর আগে কখনো অনুভব করিনি।

ইতিহাস যাদের পছন্দের বিষয়, তাদের জানা আছে যে, গৌতম বুদ্ধের মহাপ্রয়াণের পর তাঁর বাণীগুলো প্রচারকদের মুখে মুখে সংবাহিত হয়ে এক প্রজন্মের থেকে আরেক প্রজন্মের দিকে যেতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই সেগুলির অর্থ লোকের মুখে মুখে পরিবর্তিত হতে থাকে এবং এর ফলে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের প্রায় দু—শো বছর বাদে বৌদ্ধ ধর্ম দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি হল ‘থেরাভাদা’ বা হীনযান গোষ্ঠী যাঁরা ছিলেন প্রাচীনপন্থী বা রক্ষণশীল হিসাবে পরিচিত। আরেকটি হল ‘মহাযান’ গোষ্ঠী যাঁরা ছিলেন উদারমনস্ক। পরবর্তীকালে ‘থেরাভাদা’ অর্থাৎ প্রাচীনপন্থী বৌদ্ধ ধর্মটি প্রধানত দক্ষিণ—পূর্ব এশিয়ার দেশে যেমন কম্বোডিয়া, লাওস, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আর ‘মহাযান’ বৌদ্ধ গোষ্ঠীটি বিস্তার করে মঙ্গোলিয়া, কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান প্রভৃতি উত্তর—পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে।

এই দুটি প্রধান শাখা ছাড়াও আরেকটি উপশাখা এইসময় তৈরি হয়েছিল, যার নাম ‘বজ্রযান’। তৃতীয় এই শাখাটি তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম হিসাবেও পরিচিত। ‘বজ্র’ শব্দের দুটো অর্থ হয় তিব্বতি ভাষায়, একটা বজ্রবিদ্যুৎ, আরেকটা ‘ডায়মন্ড’ বা হিরে। এই শাখার বৌদ্ধদের কাছে ঈশ্বর বজ্রের মতো অপ্রতিরোধ্য আর হিরের মতোই কঠিন। এই বজ্রযান ধর্ম মূলত ছড়িয়ে পড়ে ভুটানে আর তিব্বতে। বজ্রযান সাধকরা তন্ত্র সাধনার মাধ্যমে প্রবল শক্তি সংগ্রহ করতে পারতেন আর তা দিয়ে অনেক অলৌকিক কাজ করতেন, এরকম প্রবাদ কিছু বইতে লেখা আছে। কিন্তু এই প্রবাদকে আধুনিক ইতিহাস সত্যতা দেয়নি। আর এইখানেই বাবার গোপন গবেষণা শুরু হয়।

তবে এই ব্যাপারে বাবাকে যিনি আকৃষ্ট করেছিলেন তাঁর কথা বলতে হলে আরেকটু পিছিয়ে যেতে হবে।

বাবা যখন স্কটিশের ছাত্র, তখন এক তরুণ অধ্যাপক পড়াতে ঢুকেছিলেন। এঁর দ্বারা বাবা ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে পড়েন। অত্যন্ত সোজা ভাষায় বলতে গেলে সেই অধ্যাপকের ধারণা ছিল, বজ্রযান সাধকরা তান্ত্রিক যোগবলে সত্যিই ঝড়ঝঞ্ঝার সময়ে আকাশ থেকে কোনো উপায়ে হাজার হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎশক্তি সংগ্রহ করতেন এবং সঞ্চয় করে তা প্রয়োজনমতো কাজেও লাগাতেন। এই ধারণাটা ওই অধ্যাপক এক পুরোনো তিব্বতি পুথি, যাকে ‘তেঞ্জ্যুর’ বলে, তা থেকে পেয়েছিলেন এবং সেই ব্যাপারে তিনি গবেষণায় মেতে ওঠেন। বাবাও তাঁর সেই শিক্ষকের সহকারী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন পড়ার সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু কিছুদিন পরেই হঠাৎ সেই অধ্যাপক উধাও হয়ে যান। বাবা আর তাঁর কোনো খোঁজ পাননি। স্বাভাবিকভাবেই বাবা ব্যাপারটাতে ওখানেই ইতি টেনে দেন।

প্রতিভাবান সেই অধ্যাপক যে অবিনাশবাবুর কাকা বিনোদ বিহারী সে—ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহই নেই। যদিও বাবা কোনোদিন আমাকে ওঁর নাম বলেননি। কিন্তু একদিন অফিস থেকে ফিরে আমাকে খুব উত্তেজিতভাবে বলেছিলেন যে তাঁর প্রথম জীবনের সেই অধ্যাপক হঠাৎ ফিরে এসেছেন এবং বাবাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে বাবার সঙ্গে আমার সেদিনের কথোপকথন। তখন আমি সদ্য ক্লাস নাইনে উঠেছি।

‘সেই প্রোফেসর মানে তোমার সেই প্রোফেসর চৌধুরী? এতদিন কোথায় ছিলেন? আর তোমার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করলেন?’

‘আমিও তো অবাক হয়ে গেছি রে। তুই তো সুবিমলকে চিনিস। ও তো আমার সঙ্গে স্কটিশে পড়ত আর এখন ওখানেই পড়ায়। সুবিমল আমাকে চার—পাঁচ দিন আগে ফোন করে বলল যে প্রোফেসর চৌধুরী কোন একটা লোককে দিয়ে আমার খবর চেয়ে পাঠিয়েছেন। আমি যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি।’

‘কোথায় বাড়ি ওঁর?’

‘আরে, বাড়িতে ডাকেননি। ওঁর বাড়ি তো যতদূর মনে পড়ে হুগলির কোনো এক গ্রামে ছিল, কিন্তু আমাকে উনি দেখা করতে বললেন কফিহাউসে। আমি তো চিনতেই পারিনি প্রথমে, প্রায় চল্লিশ বছর বাদে দেখা। উনি দেখা হতেই ডাকলেন।’

‘কী কথা হল?’

‘যা জানতে পেরেছি রুদ্র, ইতিহাস এতে আবার নতুন করে লেখা হবে।’

আমি উত্তেজনায় বাবার হাত চেপে ধরে বলেছিলাম, ‘কিছু বাদ দেবে না কিন্তু বাবা। একটা পয়েন্টও না। একদম কপি পেস্ট করো।’

বাবা হেসে বলতে শুরু করেছিলেন, ‘তোকে তো বলেছিলাম প্রোফেসর চৌধুরীর গবেষণার বিষয় কী ছিল। একে এরকম অকওয়ার্ড বিষয় নিয়ে রিসার্চ, তার ওপর স্যার ছিলেন জমিদারবাড়ির ছেলে, স্যারের বাবার আবার এই মাস্টারি লাইনটা পছন্দ ছিল না। একদিন বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগে আমি আর স্যার এই ব্যাপারে অনেকটাই এগিয়েছিলাম। সেটা আমরা দু—জন ছাড়া আর কেউই জানত না। কতটা এগিয়েছিলাম সেটা আগে বলি। স্যার কোথাও থেকে একটা দুষ্প্রাপ্য তেঞ্জ্যুর পেয়েছিলেন, তাতে স্পষ্ট লেখা ছিল বজ্রতান্ত্রিকরা যোগবলে শক্তি সঞ্চয় করে রাখতে পারত। এখন কথা হচ্ছে, কী উপায়ে তারা কোন শক্তি সঞ্চয় করত? আর কোথায়ই—বা সেটা স্টোর করত? আর স্টোর করেই—বা কী করত?

‘ভেবে দেখ আমি বলছি প্রায় তেরোশো সাল আগেকার কথা। তারও আগে গ্রিক বা রোমানরা ক্যাটাপুল্ট বলে এক ধরনের ব্যালিস্টিক যন্ত্র তৈরি করেছিল যা দিয়ে তারা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ত সাধারণ ত্রিকোণমিতির জ্ঞান কাজে লাগিয়ে। শক্তি ক্ষরিত হত ঠিকই, কিন্তু সঞ্চয়ের কোনো ব্যাপার তাতে ছিল না। সুতরাং এটা প্রমাণিত হলে হইহই পড়ে যাবে।

‘এইবার আমাদের রিসার্চের ব্যাপারে বলবার আগে আরেকটা গল্প শোন। গল্পটাকে সত্যিও ভাবতে পারিস বা মাইথলজিক্যালও। অষ্টম শতকে এক বৌদ্ধ গুরু ছিলেন যিনি বজ্রযান গোষ্ঠীকে মূল দেশ—বিদেশে ছড়িয়ে দেন। তাঁকে গৌতম বুদ্ধের মতোই ভগবান বলে মানে তিব্বতিরা। তাঁর নাম ছিল পদ্মসম্ভব। যদিও তিব্বতে বা ভুটানে গুরু রিনপোচে বা ‘দ্বিতীয় বুদ্ধ’ নামেই তিনি পরিচিত। অনেকের মতে, গৌতম বুদ্ধ এঁর রূপে আরেকবার পৃথিবীতে জন্মেছিলেন।

‘এঁর সম্বন্ধে অনেক কিংবদন্তি মিথ চালু আছে। ইনি নাকি কোনো মায়ের গর্ভে জন্মাননি, আট বছরের এক বালক হিসেবে পদ্মফুলের মধ্যে প্রথম দেখা দিয়েছিলেন, এইরকম। বজ্রযান এবং তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মকে ইনি এক অন্য আঙ্গিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। অনেকটা আমাদের স্বামী বিবেকানন্দ যেমন আমাদের হিন্দু ধর্মকে হাজার বছরের কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে নতুন রূপ দিয়েছিলেন, সেইরকম।

‘তিব্বত থেকে শুরু করে নেপাল ভুটানের বিভিন্ন জায়গায় এঁর অনেক গুপ্ত সম্পদ সঞ্চিত আছে যেগুলো পাঁচশো কিংবা হাজার বছর বাদে পুনরুদ্ধার হয়েছে। সম্পদ মানে আবার ভাবিস না কোনো গুপ্তধন বা মণিমুক্তো। সম্পদ বলতে ওঁর নিজস্ব মতাদর্শ, দর্শন, উপলব্ধি, শিক্ষার বাণী এইসব বলতে চাইছি। তবে সবই প্রায় অনুলিখিত, মানে উনি বলেছেন, ওঁর কোনো শিষ্য লিখেছেন, এইরকম।

‘ইনি নাকি তান্ত্রিক যোগসাধনার দ্বারা অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটাতেন। যেমন, একটা মিথ বলি। ভুটানের একটা খুব পবিত্র মনাস্টারি হল তাকসাং মনাস্টারি। এই মনাস্টারি যাবার রাস্তা যেমন বিপদসংকুল, তেমনই কষ্টসাধ্য। ভুটানিজ শহর পারো থেকে অনেকটা হেঁটে ওপরে উঠতে হয়। পদ্মসম্ভব এই মনাস্টারির জায়গায় বসে তন্ত্রসাধনা করেছিলেন। সেই সময় পদ্মসম্ভবের এক শিষ্যা ছিলেন য়েসে যোগ্যাল নামে এক রাজকুমারী। তো, পদ্মসম্ভব এই রাজকুমারীকে যোগবলে এক বাঘিনীতে রূপান্তরিত করে তাঁর পিঠে চড়ে তাকসাং মনাস্টারি পৌঁছেছিলেন—এমনই প্রবাদ। ওখানে পৌঁছে উনি এক গুহায় তিনদিন কঠোর সাধনা করেন, তারপর চলে যান। পরে তেনজিং রাবগ্যে নামে এক ধার্মিক রাজা ওই জায়গায় ১৬০০ সাল নাগাদ মনাস্টারিটা তৈরি করেন।

‘যাই হোক, স্যার জানতে পারেন এই পদ্মসম্ভব ছিলেন আসলে একজন বৈজ্ঞানিক যিনি অঙ্ক এবং বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু আবিষ্কার করেছিলেন যেগুলো তখনকার প্রেক্ষাপটে অলৌকিক বলে মনে হত। স্যার যে তেঞ্জ্যুরটা পেয়েছিলেন সেটা পদ্মসম্ভবের নিজের লেখা। বুঝতেই পারছিস কতটা দুর্লভ জিনিস সেটা। কোথা থেকে সেটা তিনি পান আমাকে বলেননি। ইন ফ্যাক্ট আমি নিজেও তেঞ্জ্যুরটা কখনো দেখিনি। স্যারের মুখে শুনেছি পদ্মসম্ভব কোনো এক দুর্গম স্থানে তাঁর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য এক গোপন গুম্ফা তৈরি করেছিলেন, আর সেই গবেষণাগারে তাঁর করা সমস্ত কাজ তিনি ওই পুথিতে লিখে রেখেছিলেন। এখন এই জায়গাটা কোথায় সে—ব্যাপারে কিছু বলা নেই।’

‘হয়তো ওই তাকসাং মনাস্টারির কথাই বলা হয়েছে ওখানে!’

‘তার কোনো মানে নেই। এটা ভাবিস না যে পদ্মসম্ভব শুধু তাকসাং মনাস্টারিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পুরো সাউথ এশিয়ার অজস্র জায়গায় উনি দীর্ঘদিন পরিব্রাজক হয়ে ঘুরেছেন, অজস্র মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

‘আচ্ছা। কিন্তু দেড় হাজার বছর আগের লেখা তোমার স্যার পড়লেন কী করে? মানে, কী ভাষায় লেখা সেটা?’

‘গুড কোয়েশ্চেন। তখনকার দিনে তিব্বতি পুথি লেখা হত ”কিন কোড” বলে এক সাংকেতিক ভাষায়। দেবনাগরী হরফেই লেখা হত কিন্তু একটু অন্যভাবে। ন্যিংমা বলে এক ধরনের লামা গোষ্ঠী ছিলেন, যাঁরা মূলত সমস্ত ঘটনা লিপিবদ্ধ করতেন। পদ্মসম্ভবের নিজের লেখাও কিছু আছে তবে সেগুলো খুবই দুষ্প্রাপ্য। বজ্রযান সাধকদের অলৌকিক কাণ্ডকারখানার কথা আগেই বলেছি। এরকমও শোনা যায়, বেশ কিছু অশরীরী ডাকিনী ওঁর অনুগামী ছিল, তারাও কিছু কিছু পুথি লিখত, তাই এই ভাষার আরেকটা নাম ‘ডাকিনী স্ক্রিপ্ট’। স্যারের পড়তে পারাটা কোনো ব্যাপার নয়। ‘কিন কোড’ অনেক আর্কিয়োলজিস্টই জানেন। আমিও পড়তে পারি।

‘চৌধুরী স্যার এ ব্যাপারে নিঃসংশয় ছিলেন যে ওঁর পাওয়া তেঞ্জ্যুরটা যে শুধুমাত্র পদ্মসম্ভবের নিজের লেখা তাই নয়, ওটা পদ্মসম্ভবের আত্মজীবনী। অধিকাংশ তেঞ্জ্যুরে পাওয়া যায় উপদেশমূলক বাণী বা নীতিকথা। কিন্তু এতে পদ্মসম্ভব তাঁর নিজের কথা, তাঁর উদ্দেশ্য, গবেষণা এবং আরও নানারকম জিনিস লিখে রেখেছেন।

‘তাতেই লেখা ছিল যে উনি আকাশের বজ্রবিদ্যুৎ থেকে প্রচুর প্রাবল্যের বৈদ্যুতিক শক্তি আহরণ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সেই বিদ্যুৎকে সঞ্চয় করে কাজে লাগানোর কথাও ভেবেছিলেন। মানে ব্যাটারির মতো কিছু জিনিস তিনি তখনই তৈরি করে ফেলেছিলেন।

‘গবেষণা চালানোর সময় ব্যর্থতা, হতাশা, উত্তেজনা সবই পদ্মসম্ভব ওই তেঞ্জ্যুরটার ছত্রে ছত্রে ব্যক্ত করেছিলেন। ডাকিনী স্ক্রিপ্টে লেখা হলেও একটু সাংকেতিক ভাষায় লেখা ছিল, যেগুলো স্যার বহুদিন ধরে পাঠোদ্ধার করেন। পুরোটা পড়ে স্যার এই উপসংহারে আসেন যে ড্রাগনের সঙ্গে বজ্রগোষ্ঠীদের শক্তি সঞ্চয়ের একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল।’

‘ড্রাগন! মানে ফিকশন সিনেমায় যে ড্রাগন দেখায়?’

‘হ্যাঁ। তুই তো জানিস, ড্রাগন হল এমন এক পৌরাণিক প্রাণী যার কোনো অস্তিত্ব বাস্তবে পাওয়া যায়নি, কিন্তু চিন, জাপান, ভুটান এমনকী ভারতীয় পুরাণেও এর উল্লেখ রয়েছে। এক ধরনের সরীসৃপ যার শরীর হিংস্র দাঁত আর কাঁটায় ভরতি এবং মুখ দিয়ে আগুন বের হয়। স্যারের ধারণা হয়, ওই তেঞ্জ্যুরে যা লেখা ছিল তা গল্পকথা নয়। ড্রাগন সত্যিই ছিল।’

একনাগাড়ে বলে বাবা হাঁপাচ্ছিলেন।

‘তারপর?’

‘কিন্তু আরেকটা ব্যাপারও স্যার বুঝতে পারেন যে, আত্মজীবনীটা সম্পূর্ণ নয়। ওখানে গবেষণার বিষয়বস্তু ও ফলাফল দেওয়া থাকলেও পদ্ধতিটা দেওয়া নেই। উনি ভেবেছিলেন খুব সম্ভবত অন্য অংশটা পদ্মসম্ভব ওঁর ওই গোপন গবেষণাগারেই লুকিয়ে রেখেছিলেন। স্যার প্রথমে তাঁর এই চিন্তাধারার কথা এক আন্তর্জাতিক জার্নালে পাঠান। এমনকী, উনি এটাও লেখেন যে, ওঁর ধারণা, হয়তো পদ্মসম্ভবের সেই গবেষণাগারে এখনও কিছু বজ্রসাধক বৈজ্ঞানিক আছে যারা বংশ পরম্পরায় এই অতিপ্রাকৃত রিসার্চ চালিয়ে যাচ্ছে সবার আড়ালে। কিন্তু তাতে ওঁকে প্রবল ব্যঙ্গ—বিদ্রূপের সম্মুখীন হতে হয়। এমনকী কিছু ড্রাগনের মুখ বসিয়ে ওঁর কার্টুন ওই ম্যাগাজিনে পাঠাতে থাকে কিছু নিন্দুকের দল।

প্রথমে স্যার খুব ভেঙে পড়লেও পরে বোঝেন যে, ওই তেঞ্জ্যুরের সত্যতা ওঁকে প্রমাণ করতে হলে ভুটান যেতে হবে। কিন্তু পয়সাকড়ি হাতে তেমন কিছু নেই। সে—ও না হয় ম্যানেজ করা গেল, কিন্তু ভুটান রাজতন্ত্র বাইরের পর্যটকদের তখন সহজে তাদের দেশে প্রবেশের অনুমতিই দিত না। যাওয়ার হাঙ্গামা অনেক, ওখানে গিয়ে কতদিন কোথায় কীভাবে থাকবেন কোনো ঠিক নেই, আর ওঁর বাবাও এই ব্যাপারে ওঁকে হেল্প করতে রাজি নন। উনি তখন কী করবেন ভাবছেন এমন সময় আরেকটা ব্যাপার ঘটে। সেটাই বলতে পারিস সবথেকে চিন্তার ব্যাপার।’

আমি ততক্ষণে আমার ডেস্কটপ কম্পিউটারটা খুলে ইন্টারনেটে পদ্মসম্ভব সম্বন্ধে খোঁজাখুঁজি করছিলাম। তখনও সেই স্লো ডায়াল—আপ কানেকশন। উইকিপিডিয়া লোড করতে দিয়ে বাবাকে বললাম, ‘উনি লুকিয়ে ভুটান চলে গেলেন, তাই তো?’

‘সে তো গিয়েইছিলেন, কিন্তু তার আগে উনি একটা চিঠি পান। ইংল্যান্ডের পূর্বদিকে বেডফোর্ডশায়ার বলে একটা অঞ্চল আছে, সেখানকার এক ধনী ব্যক্তি জার্নালে কাকার সেই পেপার পড়ে যোগাযোগ করেন। ভদ্রলোকের নাম চার্লস ফরেস্টিয়ার। মি ফরেস্টিয়ার জানান, জার্নালে স্যারের পেপার পড়ে তিনি খুবই কৌতূহলী হয়ে পড়েছেন। বজ্রযান কালচার নিয়ে তাঁর বহুদিনের পড়াশুনো এবং তিনি চান স্যার যেন এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়ে যান। ওখানে যাওয়া, থাকা এ সমস্ত ব্যাপারে অর্থনৈতিক সাহায্য তিনি করবেন। শর্ত দেন একটাই ওই গোপন ল্যাবরেটরিতে পৌঁছোনোর প্রতিটা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ওঁকে লিখে জানাতে হবে এবং সেটা অত্যন্ত গোপনে।

‘এরকম একজন স্পনসর পেয়ে স্যার আরও উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। ব্যাপারটা গোপন রাখতে গিয়ে কারুর সঙ্গে আলোচনা করেননি আর উত্তেজনায় অন্য কিছু ভাবেনওনি। মাস কয়েক দু—জনের মধ্যে চিঠিপত্র চলবার পর স্যার ওই ব্রিটিশ ভদ্রলোকের পাঠানো টাকা সম্বল করে ওঁর অভিযানে বেরিয়ে পড়েন। সেটা ১৯৮০ সাল। ইন্টারনেট তো দূর অস্ত, ফোনও কম বাড়িতেই ছিল তখন। উনি লুকিয়ে চোরাপথে ভুটান চলে যান।’

আমি নিশ্বাস বন্ধ করে শুনেছিলাম, ‘তারপর?’

‘কিন্তু উনি ওখানে গিয়ে গবেষণাগারটা খোঁজা যতটা সহজ হবে ভেবেছিলেন ততটা হল না। পদ্মসম্ভব একেই সাংকেতিক ভাষায় লিখেছিলেন তার ওপর দেড় হাজার বছর আগের প্রেক্ষাপটে কোনো জায়গা এখনকার দিনে খুঁজতে শুরু করলে সেটা তো কঠিন হবেই।

‘স্যার বৌদ্ধ ধর্ম নেন এবং প্রায় কুড়ি বছর ধরে বিভিন্ন মনাস্টারিতে থাকেন। প্রচুর লামা এবং তিব্বতি তান্ত্রিকদের সংস্পর্শে আসেন। বজ্রযান সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ফেলেন। ভেবে দ্যাখ, একটা লোক তার পুরো লাইফটা কাটিয়ে দিল কেবল ইতিহাসের ক—টা অজানা পাতাকে জানার জন্য! কতটা স্যাক্রিফাইস ভাব।

‘ভুটানের বিভিন্ন মনাস্টারি ঘুরতে ঘুরতে স্যার পদ্মসম্ভবের ওই ডাকিনী স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী এটা বুঝতে পারেন যে জায়গাটা তাকসাং—এর দিকে তো নয়ই, বরং ভুটানের উত্তর—পূর্ব প্রান্তে। উনি চলে যান বুমথাং—এর দিকে। এই বুমথাং প্রদেশটা ভুটানের উত্তর দিকে, তিব্বত সীমান্তে, খুব কম লোকজনই সেখানে ঘুরতে যায়। বুমথাং—এর একটা রিমোট জায়গায় বহু প্রাচীন এক বৌদ্ধ মঠ ছিল, সেখানে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। উনি লেখা অনুযায়ী আন্দাজ করেন জায়গাটা ওই মঠ অথবা তার কাছাকাছিই হবে।

‘সেই মঠে এক তিব্বতি বজ্রলামার সঙ্গে ওঁর পরিচয় হয়। তাঁর নাম ছিল পেমা লিংপা। এই পিমা লিংপা ছিলেন একজন উচ্চমানের যোগী এবং জ্ঞানী সাধক। তাঁর কাছ থেকেই স্যার জানতে পারেন যে, তিনি ঠিকই ভেবেছিলেন, পদ্মসম্ভবের সেই গোপন গবেষণাগারটি পারোর ওই তাকসাং মনাস্টারিতে ছিল না। বরং সেটা ছিল ওই জায়গাটা থেকে আরও উত্তরে তিব্বত সীমান্তে দুর্গম এক জায়গার পরিত্যক্ত একটা গুহায়। সেই গুহায় পৌঁছোনোর রাস্তার একটা ধারণা স্যার ওই তেঞ্জ্যুর পড়ে তৈরি করেন। পেমা লিংপা এও বলেছিলেন যে, উনি নিজে সেখানে যাননি কোনোদিন। আর বহির্জগতের সঙ্গেও সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সেই উপত্যকাটি প্রায় জনশূন্য। সেখানে সাধারণ মানুষ তো দূর, লামারাও যেতে পারেন না। অলৌকিক সমস্ত ক্রিয়াকলাপ চলে সেখানে। এগজ্যাক্ট লোকেশনটা পেমা লিংপা নিজেও বলতে পারেননি, শুধু বার বার বারণ করেন ওখানে না যাবার জন্য।

‘এতদিন পর্যন্ত যা ঘটত, স্যার নিয়ম করে লিখে পাঠাতেন ফরেস্টিয়ারকে,কিছুটা সেই প্রথমে অতগুলো টাকা একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত যুবককে পাঠানোর কৃতজ্ঞতার তাড়নায় আর কিছুটা ছিল অভিজ্ঞতা শেয়ার করার তাগিদ! নিঃসঙ্গ বন্ধুহীন জীবনে ওঁর গবেষণার প্রোগ্রেস জানাতেও তো কাউকে ইচ্ছে করে! কিন্তু অদ্ভুতভাবে পেমা লিংপার বলা কথাগুলো আর পুরো বুমথাং এপিসোডটা লিখে পাঠানোর পরেই নিষেধটা আসে মি ফরেস্টিয়ারের কাছ থেকে। তিনি হঠাৎ চিঠিতে বারণ করেন, যথেষ্ট হয়েছে, স্যারের আর অনুসন্ধানের দরকার নেই। স্যার কোথায় রয়েছেন, তার লোকেশন আর সেখান থেকে ওই গুহায় যাওয়ার ম্যাপটা স্যার যেন ওঁকে পাঠিয়ে দেন। ওঁর নিজস্ব টিম এবার আসল অনুসন্ধানে নামবে। এইখানেই বাধে গোলমাল। স্যারই—বা কেন জীবনের অর্ধেক সময় নষ্ট করে এত অবধি এসে হাল ছেড়ে দেবেন? তিনি পরিষ্কার জানান যে তিনি ওই পরিত্যক্ত গুম্ফার খোঁজে অবশ্যই যাবেন। স্থানীয় এক বিশ্বস্ত চাকর বহুদিন ধরে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরত, তাকে নিয়েই ঠিক করলেন যাবেন। ফরেস্টিয়ারের বার বার পাঠানো চিঠিতেও স্যার আর কোনো উত্তর দিতেন না।

‘তারপরই ফরেস্টিয়ারের মুখোশ খসে পড়ল। একদিন কিছু বিদেশি গুন্ডার দল স্যারের ঘরে হামলা চালাল অতর্কিতে। খুব সম্ভবত স্যারের পাঠানো চিঠির স্ট্যাম্প থেকে জায়গাটা আইডিয়া করে নিয়েছিল ওরা। স্যার প্রাণে বেঁচে গেলেও ঘর লণ্ডভণ্ড করে ম্যাপটা খুঁজল তারা। না পাওয়াতে শাসিয়ে গেল। আসলে স্যার প্রথমে বুঝতে পারেননি, কিন্তু এরকম নিঃস্বার্থ স্পনসরশিপের আহ্বানে আগে ওঁর খটকা লাগা উচিত ছিল।

‘স্যারের কাছ থেকে পুরোটা শুনে আমার যেটা মনে হয়েছে খুব সম্ভবত ফরেস্টিয়ার ছিল একদন পেশাদার আর্ট থিফ অথবা কোনো আর্ট থেফট দলের পাণ্ডা। আর্ট থিফ জানিস তো, যারা অ্যান্টিক জিনিসপত্র চুরি করে পাচার করে বা তা দিয়ে কোনোরকম ব্যাবসা চালায়। স্যারকে দিয়ে জায়গাটা জেনে নিয়ে এবার আসল কাজটা নিজেরাই ওরা হাসিল করতে চায়।’

বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘বেগতিক বুঝে উনি তাই পালিয়ে এসেছেন কলকাতায়। যেহেতু স্যারের বিশ্বাস ওরা ওঁর ওপর কড়া নজর রেখেছে তাই উনি চান, আমি সেই গোপন গুহাটা খুঁজে বের করি এবং ওই পুথির অবশিষ্ট অংশ থেকে সত্যিটা উদঘাটন করি।’

আমি হাঁ হয়ে গেছিলাম, ‘কী বলছ! এরকম ভাড়াটে গুন্ডার দল আর তুমি যাবে?’

‘আরে কাউকে—না—কাউকে তো যেতেই হবে, না হলে ইতিহাসের একটা দিক অন্ধকারই হয়ে থাকবে যে!’ বাবা কাষ্ঠ হেসেছিলেন।

আমি লিখতে লিখতে এমন তন্ময় হয়ে গেছিলাম যে কোনোদিকে হুঁশ ছিল না। বাইরে তাকিয়ে দেখি পুবদিকের আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে প্রায়। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে জানলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বাবার স্যার খুন হয়েছিলেন সেটা বাবা আমাকে বলেছিলেন। এটাও জানতাম যে ম্যাপটা উনি এমনই কোথাও রেখেছিলেন যে ওরা খুঁজে পায়নি। স্যারের খুনের পরই বাবা আরও ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। ঘুরতে ফিরতে বলতেন, এমন নিরীহ ইতিহাসবিদকে যারা এভাবে খুন করে তাদের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় যাওয়া উচিত নয়। ম্যাপের কপি খুব সম্ভবত বাবার কাছে বিনোদ বিহারী দিয়ে রেখেছিলেন। বাবা যাওয়ার তোড়জোড় করতে লাগলেন। ঠিক হল আমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর মে মাস পড়লে উনি বেরোবেন। আমিও সঙ্গী হব।

এরপরই এল সেই দিনটা। আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিন। দিনটা মনে করতে গেলেই মাথাটা কেমন টিপটিপ করতে শুরু করে। রোজ হল থেকে বেরিয়ে দেখতাম বাবা আমাদের সাদা গাড়িটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত নাড়ছেন, মুখে কেমন হল জানতে চাওয়ার এক্সপ্রেশন। কিন্তু সেদিন পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে বাবাকে দেখতে পাইনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে শেষে বাস ধরে বাড়ি ফিরছিলাম। বাবা সেদিন অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ি চালিয়ে আমার এগজাম সেন্টারে আসছিলেন। স্ট্র্যান্ড রোড পেরিয়ে যে রাস্তাটা পোস্তার পাশ দিয়ে হাওড়া ব্রিজে উঠছে, সেইখানে বাবার গাড়িটা পড়ে ছিল। বাবাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

অনেক খোঁজাখুঁজি চলেছিল। সেইসময় বেশ কয়েকদিন ধরে খবরে হেডলাইন ছিল দেশের নামকরা এক আর্কিয়োলজিস্টের অন্তর্ধানের এই রহস্য। ক—দিন মিডিয়া খুব মাতামাতি করেছিল, তারপর আস্তে আস্তে যেমন হয়, অন্যান্য স্কুপের নীচে চাপা পড়ে গেছিল। আমার রাশভারী মা—ও সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিলেন। আস্তে আস্তে আমাকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরছিলেন। মায়ের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল আমি আর্কিয়োলজিস্ট হলে আমাকেও হারাতে হবে। কেন আমি জানি না। মায়ের মন রাখতে তাই আমি জয়েন্ট দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং—এ ঢুকি। বাবা বেঁচে আছেন কি না সেটা আজও জানি না।

আমার চোখে শুকিয়ে যাওয়া বহু পুরোনো জলটা ফিরে এল। বাবা যদি সত্যিই বেঁচে থাকেন, আমার সঙ্গে কি এই দশ বছরে একবারও যোগাযোগ করতেন না?

তারপর থেকে আমাদের বাড়িটা আরও চুপচাপ হয়ে গেছিল। আমি আর মা নিজের নিজের কাজে বেরোতাম, দিনের শেষে বাড়ি ফিরতাম…আর আমাদের দু—জনের মধ্যে এক অদৃশ্য মিসিং লিঙ্ক হয়ে বাস করতেন বাবা।

এখন বিয়ের পরও চিত্রটা খুব একটা পালটায়নি। প্রিয়ম খুব বুঝদার ছেলে, হঠাৎ হঠাৎ আমার মুড সুইংগুলোর সময় ও সত্যিকারের বন্ধুর মতোই পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু বাবা থাকলে আজ সব কিছু অন্যরকম হত।

তুমি কোথায় চলে গেলে বাবা? এতক্ষণ বাষ্প হয়ে জমতে থাকা চোখের জল এবার বাঁধ ভাঙা স্রোতের মতো ভেঙে পড়ল।

খুব অবসন্ন লাগছে। বাইরে থেকে মিঠে আলো এসে ঠিকরে পড়ছে আমার ডায়েরির পাতায়।

আজ এই অবধি থাক।

১০ জানুয়ারি, ২০১৬

আজ রবিবার, ছুটির দিন। তাই লিখতে বসেছি। কাজের চাপে এই ক—দিন লিখতে পারিনি। তাৎক্ষণিক উত্তেজনাটা কাটিয়ে মনটাকে অনেকটা বশে আনতে পেরেছি এই ক—দিনে। একটা জিনিস আমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি, বিনোদ বিহারীর খুন এবং আমার বাবার নিরুদ্দেশের পেছনে এক ভয়ংকর রহস্য আছে এবং সেটা ইন্টার রিলেটেড। তখন আমি ছোটো ছিলাম, মাথায় এত কিছু খেলেনি, তার ওপর বাবাকে হারিয়ে মা আমাকে আরও আঁকড়ে ধরতে চাইছিলেন। এই প্রসঙ্গ তুলতেই দিতেন না বাড়িতে, এমনকী আমি যা জানতাম সেগুলো নিয়েও আলোচনা করতেন না। কিন্তু এখন আমি আমার লক্ষ্য স্থির করে ফেলেছি। বাবা বেঁচে আছেন কি না আমি জানি না কিন্তু যে বা যারা এই ক্রাইমটার সঙ্গে যুক্ত তাদের আমি শেষ দেখে ছাড়ব।

কী সেই গুপ্ত রহস্য যার জন্য ওই ফরেস্টিয়ারের দল এত দূর যেতে পারে তা আমাকে জানতেই হবে। কিন্তু যা করতে হবে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়, কারণ আমার শত্রুপক্ষের নিষ্ঠুরতার পরিচয় আমি আগেই পেয়েছি। প্রিয়মকে এখনও অবধি কিছু জানাইনি। বেচারা এমনিতেই আমাকে নিয়ে টেনশনে থাকে, তার ওপর এখন বাইরে রয়েছে, এসব বললে আরও চাপে পড়ে যাবে।

ঠিক তিনদিন পরে অর্থাৎ চার তারিখ অবিনাশবাবু আবার এসেছিলেন। আমি ভণিতা না করে সোজাসুজি বলেছিলাম যে উনি সাড়ে তিন লাখ টাকা অবধি লোন পেতে পারেন। ভদ্রলোকের মুখ দেখে মনে হয়েছিল খুব অখুশি হননি। তখন আমি অন্যান্য আর কী ডকুমেন্ট লাগবে বুঝিয়ে দিয়ে পরিষ্কার বলেছিলাম যে ওঁর কাকার পুরোনো ডায়েরি, আঁকা বা আর যা কিছু আছে সব আমি দেখতে চাই। কারণ হিসেবে স্মার্টলি বললাম যে ছোটোবেলা থেকে অবসর সময়ে আঁকার খুব শখ আমার। রিসেন্টলি ভুটানিজ কালচারের ওপর একটা এজিবিশনে ছবি পাঠাব ভাবছি, তাই এই রেফারেন্সটা পেলে ভালো হয়। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ আমার গুণকীর্তন করে সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন।

পরের দিন যখন ললিত ভবনে পৌঁছোলাম, অবিনাশবাবু আমাকে নিয়ে গেলেন বাড়ির বাঁ—দিকের মহলে যেখানে বিনোদ বিহারী থাকতেন। একদম শ্রীহীন অবস্থা। বোঝাই যাচ্ছে এই দশ বছরে কেউ পা—ও মাড়ায়নি। অবিনাশবাবুকে একথা জিজ্ঞেস করাতে বললেন, ‘সে তো বটেই ম্যাডাম, একে খুন তার ওপর পুলিশি হাঙ্গামা পোয়াতে হয়েছে অনেক… এই মাস তিনেক আগে একবার এসেছিলাম, তখনই ওই ছবিটা একটু মনে ধরতে নিয়ে যাই। নইলে এদিকে পা—ও কেউ মাড়ায় না।’

মূল ফটকটা ভেঙে পড়েছে। একটা পাল্লা কাত হয়ে ঝুলছে, অন্যটা হাওয়া। সেইজন্য ভেতরে আলো ঢুকছে। ভেতরে পা দিতেই বহুদিনের জমে থাকা ধুলো জুতোর তলায় কিচ কিচ করে উঠল। সামনে তাকিয়ে দেখি জানলাগুলোয় আর ওপরের কড়িবরগাতে পুরু মাকড়সার জাল। কয়েকটা ব্যাং বা আরশোলা জাতীয় জন্তু হঠাৎ এই দু—জন অনাহূতের আগমনে বোধ হয় বিরক্ত হয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল। আমি অবিনাশবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম যে কোনদিকে ওঁর কাকার ঘর। তিনি ইঙ্গিতে জানালেন আমাদের ওপরে যেতে হবে।

এই মহলটা দোতলা হলেও একটা জিনিস লক্ষ করলাম এর একতলায় একটিমাত্র বড়ো ঘর আর ওপরেও মনে হয় তাই। আলাদা কোনো রান্নাঘর চোখে পড়ল না। অবিনাশবাবুকে ব্যাপারটা বলতে উনি হাত উলটে বললেন, ‘আসলে প্রথমে এই মহলটা তো থাকার জন্য তৈরি হয়নি। এটা ছিল আশ্রিতদের থাকার জায়গা। তখন এ বাড়িতে পঞ্চাশজনের ওপর আশ্রিত থাকত। তারাই এ মহলে থাকত। কাকা আসার পর উনি থাকতেন ওপরে আর দ্বিজেন নীচে। রান্নার বন্দোবস্ত সব নীচের ঘরেই ছিল। কাকার ছুঁতমার্গ বা শুচিবাই জাতীয় কিছু ছিল না।’

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বুঝতে পারলাম এই দিকটার অবস্থা সবথেকে সাংঘাতিক। বটগাছের ঝুরি সিঁড়ির ধাপগুলো পর্যন্ত ফাটিয়ে দিয়েছে। সিঁড়ির রেলিং দেখে অবশ্য আগের রাজকীয় অবস্থা এখনও অনুমান করা যায়। সাবেকি ঘরানায় কলকা আঁকা ডিজাইন। দোতলায় উঠে দেখলাম নীচের মতোই লম্বা একটা বড়ো ঘর আর সামনে বারান্দা। অবিনাশবাবু এগিয়ে গিয়ে তালা খুলতে খুলতে বললেন, ‘কাকা মারা যাবার মাস দুয়েক বাদে একবার চোর হানা দিয়েছিল রাতের বেলা, সেই থেকে গ্রামে একটু অপবাদ রটেছে। যেমন হয় আর কি এরকম ঘটনার পর, তাই তালা দিয়ে রেখেছি। বাইরের চোরই হবে, কারণ এখানকার সকলেই জানে যে এ বাড়িতে ঢুকলে খালি হাতেই বেরোতে হবে। হে হে।’

আমি কান খাড়া করে শুনে যাচ্ছিলাম। একটা জিনিস তার মানে পরিষ্কার, বিনোদ বিহারীকে খুনের সময় ফরেস্টিয়ারের দল ম্যাপটা পায়নি, তাই পরে আবার হানা দেয়।

পরেরবার কি পেয়ে গেছিল?

আমি তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে ঘরটা জরিপ করতে লাগলাম। এটা ব্যাঙ্কের রুটিনমাফিক ইনস্পেকশন নয়, আমার সবথেকে কাছের মানুষকে ফিরে পাওয়ার লড়াই। যদিও আমি অনেক দেরি করে ফেলেছি কিন্তু এই তিনদিনে আমার মন বলেছে হয়তো এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি। বাবাকে খুঁজে পাওয়ার ক্লু আমাকে জোগাড় করতেই হবে।

লিখতে লিখতে মনে পড়ল, ছোটোবেলায় বাবা মা আর আমি একবার বোম্বে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন আমি ক্লাস টু। ভিড়ের মধ্যে জুহু বিচে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে আমি পাগলের মতো ছোটাছুটি করছিলাম। ভয়ে আতঙ্কে যখন আমার প্রায় কথা বন্ধ হয়ে গেছে, দম আটকে আসছে, তখন পেছন থেকে একটা শক্ত হাত এসে জড়িয়ে ধরেছিল আমায়, আদর করে কোলে তুলে নিয়েছিল আর আমিও জাপটে ধরেছিলাম বাবাকে।

ভেতর থেকে আবার কান্না দলা পাকিয়ে ওপরে উঠে এল। হাতের মুঠো শক্ত করলাম। বাবাকে আমি খুঁজে বের করবই। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে।

বিনোদ বিহারীর ঘরে আসবাব বলতে ছিল একটা পুরোনো আমলের প্রকাণ্ড খাট, যেটাকে পালঙ্ক বলাই ভালো, একটা ঝুলে—ভরা কুলুঙ্গি আর দুটো দেরাজ। খাটের একপাশে কাত হয়ে বহুকালের পুরোনো একটা মশারি ঝুলছে। পুরো ঘরটায় একটা সোঁদা গন্ধ। অবিনাশবাবু একটা জানলা খুলে দিতেই অন্ধকার ভাবটা একটু কাটল।

আমি দেরাজটা গিয়ে খুলতে যেতেই অবিনাশবাবু হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘দাঁড়ান ম্যাডাম, আমি খুলে দিচ্ছি। সেবার চোর এসে অন্ধকারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে দেরাজটার কাচ ভেঙেছিল। তারপর থেকে ঝাড়া মোছা তো হয় না, কাচের গুঁড়ো পড়ে থাকতে পারে।’

দুটো দেরাজ, খাটের তলা আর কুলুঙ্গিটা থেকে অনেক কিছুই পাওয়া গেল। বিনোদ বিহারী দেখলাম তাঁর ভুটান এপিসোডের অনেক কিছুই সযত্নে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। এই তিন—চারদিনে ভুটান সম্বন্ধে বেশ ভালোমতো পড়াশুনো করেছিলাম। ইন্টারনেট থেকেও অনেক কিছু জানতে পেরেছিলাম। তাই বেশ কিছু জিনিস চিনতে পারলাম। আমি আর অবিনাশবাবুর ভ্রূকুটির পরোয়া করছিলাম না, কারণ মনে হয় না আমার এরপরে আর এ বাড়িতে আসার দরকার হবে। যদি কিছু সূত্র পাওয়ার, আমাকে এবারেই পেতে হবে। তাই প্রত্যেকটা জিনিস খুঁটিয়ে দেখছিলাম আর আমার মোবাইলে ছবি তুলে নিচ্ছিলাম।

প্রথমে চোখ পড়ল দু—তিনটে সুতির কাপড়ের দিকে। অনেকটা শালের মতো দেখতে কিন্তু আয়তনে ছোটো, আর পুরো কাপড়টায় বিভিন্নরকম নকশা আঁকা। আমার সদ্য—আহরণ—করা জ্ঞান থেকে বুঝলাম এগুলো হল থাঙ্কা। থাঙ্কা হল এক ধরনের সুতির চাদর যার ওপর বুদ্ধ বা অন্যান্য বৌদ্ধ সাধকদের জীবনী ছবির আকারে বর্ণনা করা হয়। এই থাঙ্কাগুলোতেই বিভিন্ন ছবি আঁকা রয়েছে। কিন্তু যতদূর পড়েছিলাম, থাঙ্কাগুলোকে রোল করে দাঁড় করিয়ে রাখাই রীতি যাতে আস্তে আস্তে ম্যাপ পড়বার মতো খোলা যায়। কিন্তু এগুলো সাধারণ কাপড়ের মতো ভাঁজ করে রাখা হয়েছে। এও কি তাহলে ফরেস্টিয়ারের দলের কীর্তি? দেখে নিয়ে এমনি ফেলে রেখে চলে গেছে? আমি ছবিগুলো দেখতে লাগলাম।

প্রথম ছবিটা তো দেখেই চিনতে পারলাম, পদ্মসম্ভবের ছবি। বাবা বলেছিলেন পদ্মসম্ভব আর গৌতম বুদ্ধের ছবির মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল, গৌতম বুদ্ধের মাথা মুকুটহীন, চুল জটা করে ওপরদিকে বেঁধে রাখা আর পদ্মসম্ভবের মাথায় একধরনের চৈনিক মুকুট থাকে, এরকম মুকুট অনেকটা আগেকার দিনের ঢাল তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করবার সময় ব্যবহার করা হত। আরেকটা থাঙ্কায় দেখলাম ছোটোবেলায় পড়া জাতকের গল্পগুলো খুব সুন্দরভাবে আঁকা হয়েছে। আমি যতটা সম্ভব ভালোভাবে ছবি তুলতে লাগলাম। এরকম তিন চারটে থাঙ্কা দেখবার পর চোখ পড়ল প্রায় কালো হয়ে যাওয়া গৌতম বুদ্ধের একটা পিতলের মূর্তির দিকে। প্রায় ইঞ্চি ছয়েক লম্বা হবে মূর্তিটা, বিশেষ কিছু অসাধারণত্ব চোখে পড়ল না। তবু ছবি তুলে নিলাম।

মূর্তিটার পেছন দিকে কিছু কাগজ দলা পাকানো অবস্থায় পড়ে ছিল। সেগুলো টেনে বের করে এনে দেখলাম প্রায় মলিন হয়ে যাওয়া কিছু ছবি আঁকা তাতে, শিল্পীর হাত এমন কিছু নিপুণ নয়, সাধারণ উড পেনসিলে এদিক—ওদিক ছড়ানোভাবে আঁকা ছবি। অবিনাশবাবুর কারখানায় দেখা সেই একই ধরনের মোটা শক্ত কাগজের ওপর আঁকা ছবি। অনেকটা তুলোট কাগজের মতো। এখন বুঝলাম এগুলোই হল ডেজো, ভুটানে তৈরি হওয়া এক ধরনের হ্যান্ডমেড কাগজ।

ডাফনে নামে এক পাহাড়ি গাছের ডাল আর ক্রিপার গাছের আঠা দিয়ে তৈরি করা হয় এই ডেজো। সব মিলিয়ে সাতখানা ডেজো কাগজের ছবি পেলাম। তার বেশিরভাগই ড্রাগনের ছবি আঁকা, কোনোটায় ধ্যানরত লামার ছবি, তাঁর পায়ের কাছে তিন চারটে ড্রাগন, এইরকম বেশ কিছু যা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, বিনোদ বিহারী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই রহস্য সমাধানের চেষ্টা করে গেছেন।

কিন্তু আমি যেটা খুঁজছিলাম সেটা কোথায়? তবে কি বাবাকে বলা ছাড়া আর কোথাও বিনোদ বিহারী সেই ম্যাপটা রেখে যাননি? উনি কি আন্দাজ করেছিলেন যে ওঁর ওপর এখানে আসার পরেও হামলা হবে, তাই অত্যন্ত সাবধানীর মতো কোথাও ম্যাপটা রেখে যাননি?

কিন্তু বাবার কথাগুলো মনে পড়ল। খুন হবার কিছুদিন আগেও বিনোদ বিহারী বাবার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সেদিন তিনি কোনো কারণে প্রচণ্ড বিধ্বস্ত ছিলেন। বাবার হাত ধরে বলেছিলেন, ‘সুরঞ্জন, আমি চাই না, আমার এতদিনের পরিশ্রম, এতদিনের প্রচেষ্টা কোনো বাজে লোকের হাতে পড়ুক। আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি, ওই ফরেস্টিয়ার আসলে কে, কী ওর উদ্দেশ্য, কেনই—বা ও পদ্মসম্ভবের সেই ডেরার খোঁজ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু এটুকু বুঝেছি, আর যাই হোক ওর উদ্দেশ্য শুভ নয়। ইতিহাসের কোনো প্রাচীন রহস্য ভেদ করার দিকে ওর আকর্ষণ নেই, ব্যক্তিগত স্বার্থই শুধু রয়েছে। কিন্তু আমিও শেষ অবধি চেষ্টা করে যাব যাতে ও ওখানে পৌঁছোতে না পারে। আমি গেলেই ওরা আমাকে টার্গেট করবে, তাই তুমি যাও। ইতিহাস এই রহস্য ভেদ করার জন্য তোমাকে যুগ যুগ ধরে মনে রেখে দেবে, সুরঞ্জন।’

অবিনাশবাবুর গলাখাঁকারিতে সামনে তাকিয়ে দেখি ভদ্রলোক ওই ধুলো—মাখা বিছানার ওপরেই বসে পড়ে অধৈর্যভাবে পা নাচাচ্ছেন। আমার একটু খারাপই লাগল। ওঁর কাজের ক্ষতি করে এতক্ষণ আটকে রাখাটা ঠিক নয়, তা ছাড়া আমাকেও ব্রাঞ্চে ফিরতে হবে। আমার ফটো তোলা বা যা দেখবার দেখা হয়ে গিয়েছিল। আমি ওঁকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

তার পরের ক—দিন ব্যাঙ্কে খুব চাপ গেছে। অন্য কোনোদিকে তাকাবার ফুরসত পাইনি। আজ তাই সকাল সকাল উঠে মোবাইলের ছবিগুলো নিয়ে বসেছিলাম। প্রতিটা ছবি ফোন থেকে ল্যাপটপে নিয়ে রেজোলিউশন বাড়ালাম। আঁকা ছবিগুলো জুম করে দেখতে লাগলাম। এখনও অবধি যা বুঝেছি এই গোটা রহস্যটার তিনটে অংশ আছে।

এক নম্বর, বিনোদ বিহারীর সেই অসমাপ্ত তেঞ্জ্যুরে পদ্মসম্ভবের যে গোপন গবেষণাগারে যাওয়ার সন্ধান ছিল, তা খুঁজে বের করে সেখান থেকে অবশিষ্ট অংশটা বের করা।

দু—নম্বর, বিনোদ বিহারীর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা অর্থাৎ কী রহস্য লুকোনো রয়েছে সেখানে সেটা সমাধান করা।

আর তিন নম্বর হল, আমার বাবাকে খুঁজে বের করা।

এর মধ্যে শেষেরটাই আমার কাছে প্রধান এবং অন্যতম, কিন্তু প্রথম দুটোর রহস্যভেদ না করে তিন নম্বরটার কাছে পৌঁছোনো যাবে বলে মনে হয় না। একটা আশঙ্কা বার বার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটা হল, ফরেস্টিয়ারের দলের কাছে বিনোদ বিহারী—ই ছিলেন তুরুপের তাস, তাঁকে বাঁচিয়ে রাখাটা ওদের কাছে খুবই দরকার ছিল, কারণ বিনোদ বিহারী বহু বছর ভুটানে থেকে, ওখানকার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে ওঁকে কাজে লাগিয়ে অকুস্থলে পৌঁছোনোটা ছিল অনেক সহজ। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওরা ওঁকে মেরে ফেলল কেন? তবে কি বাবাকেও ওরা…?’ ভাবতে ভাবতে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল।

এখন আমি আমাদের এই ফ্ল্যাটে একাই আছি। প্রিয়ম কাল বিকেলে ফিরবে। ঠিকে কাজের মাসি আর রান্নার মাসি কাজ সেরে চলে গেছে। সারাটা সপ্তাহ অফিসে হাড়ভাঙা খাটুনির পর আর বাড়িতে এসে কিছু করতে ইচ্ছে করে না। তখন মনে হয় নিজের মতো সময় কাটাই বা বই পড়ি। এ ছাড়াও, কোনোদিনই আমার সংসারের কাজ করা আসে না। প্রিয়ম আমাকে আমার থেকে ভালো চেনে এবং ও কোনোদিনও আশাও করে না আমার কাছ থেকে টিপিকাল বউ বউ হাবভাব পাবে। এক আধদিন কাজের লোক না এলে, আমি বেমালুম বই মুখে বসে থাকি, ও—ই সব সামলে নেয়। বরং আমি ওকে একট সাহায্য করতে গেলে এমন হাঁ হাঁ করে ওঠে যে আমি আরও ভেবলে যাই। আমি যে এতটা অসংসারী এটা মোটেই কোনো গর্বের বিষয় নয়, কিন্তু কী করব জন্মে থেকেই আমি এরকম। বাড়িতেও এরকম ছিলাম, এখানেও তাই। বরং প্রিয়ম ছোটো থেকে হস্টেলে মানুষ, ও সব কাজ পারে। আমি মাঝে মাঝে শখ হলে অফিস থেকে এসে ইন্টারনেটে রেসিপি খুলে কোনো কিছু পদ বানালে সেটা খাদ্যের পর্যায়ে পড়ুক বা না পড়ুক, প্রিয়ম এমন সুখ্যাতি করতে শুরু করে যে আমি লজ্জায় পড়ে যাই। বাবাও ঠিক এরকম করত। মা যখনই ঘরদোর অগোছালো করে রাখলে আমাকে বকত, তখনই বাবা এসে আমার হয়তো হাজার বছর আগের কোনোদিন করা কোনো ভালো কাজের কথা তুলে আমার প্রশংসা করত।

দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে উঠে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিলাম। ফরেস্টিয়ার নামের ইংল্যান্ডের বেডফোর্ডশায়ার নিবাসী কোনো ইতিহাস অনুরাগী ধনী ব্যক্তির খোঁজ পেলাম না। অবশ্য নামটা যে ভাঁড়ানো সে—বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবু একবার নিশ্চিত হওয়া দরকার। হয়তো কোনো শয়তান লোক ফরেস্টিয়ার নামক কোনো মান্যগণ্য সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের নাম নিয়ে এই কীর্তি করেছে। খুঁজতে খুঁজতে ব্রিটিশ নিউজপেপারের ওয়েবসাইটে একটা খবর চোখে পড়ল। বেডফোর্ডশায়ারের দক্ষিণেই একটা ছোটো টাউন আছে, লুটন বলে, সেখানে সম্প্রতি একটা মিউজিয়ামে টিবেটান কালচার এবং রিলিজিয়ন নিয়ে একটা তিনদিনের কনফারেন্স চলছিল। সেখানে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষজন যোগ দিতে এসেছিলেন। ড্যামফ্রেইসশায়ারের এক বৌদ্ধ মঠ থেকে দু—জন প্রতিনিধি গিয়েছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে এক দুষ্প্রাপ্য পুথি চুরি হয়েছে। ওঁরা পুথিটা দেখাতেই আনছিলেন ওই কনফারেন্সে, মাঝপথে সেটি খোয়া যায়। অদ্ভুতভাবে সেই দিনই তাঁদের সেই ড্যামফ্রেইশায়ারের বৌদ্ধ মঠেও রাতের বেলা চোরের উপদ্রব হয়। যদিও কিন্তু চুরি হয়নি বলে মঠ কর্তৃপক্ষের দাবি। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে।

আমি একটু অবাক হলাম। ইউরোপে বৌদ্ধ মঠ যে বেশ কিছু আছে সেটা আমার অজানা ছিল না, কিন্তু দুষ্প্রাপ্য পুথিও ওখানকার মঠে রয়েছে জেনে একটু অবাক হলাম। নেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে আরেকটা তথ্য পাওয়া গেল। পুলিশ সন্দেহ করছে এই কাজও সেই ডবসন গ্যাঙের মতো কোনো পাকা দলের কাজ। এই ডবসন গ্যাংটা কী?

আরও মিনিট পনেরো ধরে সার্ফিং করে বুঝলাম, এই ডবসন গ্যাং হল ইংল্যান্ডের একটা কুখ্যাত দুষ্কৃতির দল যারা প্রায় চার দশক ধরে অ্যান্টিক জিনিসপত্র চুরি করে এসেছে, যাদের বলা হয় আর্ট থিফ। এই দলের বেশ কিছুজন ধরা পড়ে এখন জেল খাটছে কিন্তু কয়েকজন এখনও অধরা, যদিও তাদের কাজের নিদর্শন বিগত বেশ কিছুদিন পাওয়া যায়নি। তাই এই কাজটা ওদের বা ওদের মতো কোনো দলের কিনা সেই ব্যাপারে পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে।

বুঝলাম। মাথাটা আরও ঘেঁটে গেল। অনেক লিখেছি, এবার একটু কড়া করে কফি খাওয়া দরকার।

লেখা এখানেই শেষ। এমন তন্ময় হয়ে প্রিয়ম পড়ছিল যে খেয়ালই করেনি কখন অন্ধকার গাঢ় হয়ে নেমে এসেছে অ্যাপার্টমেন্টের গা বেয়ে ওঠা বোগেনভিলিয়ার ঝাড়ে। বিস্ময়ে, ঘটনার আকস্মিকতায় ও কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। এই ক—দিন এত কিছু ঘটে গেছে? ও ডায়েরিটা পাশে রেখে হাত দুটোকে ঘাড়ের নীচে চালান করে দিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে ভাবতে লাগল।

রুদ্রাণীর সঙ্গে ওর প্রথম আলাপ ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্স্ট ইয়ারেই। কিছুদিন বন্ধুত্বের পরেই প্রিয়ম বুঝতে পেরেছিল, এই আপাতদৃষ্টিতে মিশুকে, খলবলে মেয়েটার মধ্যে কোথাও খুব বড়ো একটা দুঃখ লুকিয়ে আছে। পরে ওর বাবার ঘটনাটা শুনে ও অবাক হয়ে গিয়েছিল। বাবাকে এইভাবে হারিয়ে ফেলার যে অসীম যন্ত্রণা সেটা মাঝেমধ্যেই রুদ্রর খামখেয়ালিপনার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসত। রাগ, দুঃখ, যখন যা মনে হত সব প্রিয়মের ওপর ঝাড়ত। আবার কখনো শিশুর মতো আঁকড়ে ধরত ওকে, বাবার অভাবটা পূরণ করতে চাইত হয়তো। বিয়ের পরেও সেই চিত্রটা এতটুকু বদলায়নি। তাই এই ঘটনাগুলোর গুরুত্ব সে বুঝতে পারছিল। কিন্তু একটা অজানা আশঙ্কা ওর মনে চেপে বসেছিল, এতদিন বাদে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বের করতে গিয়ে রুদ্রকে ছোবল খেতে হবে না তো?

প্রিয়ম উঠে ল্যাপটপটা খুলল। বিনোদ বিহারীর ঘরের ছবির ফোল্ডারটা দেখল ডেস্কটপেই সেভ করা রয়েছে। কুড়িটার মতো ছবি। থাঙ্কা না কী লিখেছে, সেইটার ছবিই বেশি। বিভিন্ন অ্যাঙ্গল থেকে থাঙ্কার ছবি তুলেছে। বেশ রংচঙে আঁকা, এক ধরনের বিশেষ চাদরের ওপর আঁকা। এ ছাড়া যে হাতে—আঁকা ছবিগুলো ছিল সেগুলোও ও খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। যদিও ও ছবিগুলোর মাথামুন্ডু কিছুই বুঝছিল না, কিন্তু এটুকু বোঝা যায় যে বিনোদ বিহারীর আঁকার হাত খারাপ ছিল না।

হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে ওর ঘোরটা কাটল।

রুদ্র হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকল, ‘এত দেরি হয়ে গেছে! লাস্টে এমন একটা বাজে কাজে ফেঁসে গেলাম! তুমি এসে কিছু খেয়েছ? মালতী মাসি এখনও আসেনি?’

প্রিয়ম চুপ করে ওর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে দেখে ওর চোখ পড়ল সোফায় রাখা আধখোলা ডায়েরিটার দিকে।

আধ ঘণ্টা বাদে মালতী মাসি যখন এল, তখন রুদ্র প্রিয়মের কোলে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদছিল। প্রিয়ম বাধা দিচ্ছিল না। এতদিনের চেপে রাখা কষ্ট যদি কান্নার সঙ্গে ধুয়ে যায় তো যাক। ও রুদ্রর চুলে বিলি কাটতে কাটতে খুব নরম সুরে বলল, ‘কীভাবে এগোবে কিছু ঠিক করেছ?’

রুদ্র প্রিয়মের দিকে তাকাল। ও ভেবেছিল এসব পড়ে প্রিয়ম টেনশনে পড়ে যাবে, এগোনোর কথা শুনে মনে জোরটা ফিরে এল ওর।

চোখ মুছে উঠে বসে বলল, ‘মোটামুটি একটা প্ল্যান করেছি। প্রথমেই যেটা দরকার সেটা হল, বিনোদ বিহারীর সেই ম্যাপটার হদিশ পাওয়া। একটা জিনিস পরিষ্কার যে বিনোদ বিহারীকে খুনের সময় ওরা ম্যাপটা পায়নি, তাই পরে আবার হামলা করেছিল। আমার মনে হয়, ওরা কিছুতেই ম্যাপটা খুঁজে না পেয়ে বাবাকে কিডন্যাপ করে, যাতে বাবা ওদের ওইখানে নিয়ে যেতে পারেন। নিশ্চয়ই ওরা বিনোদ বিহারীর গতিবিধির ওপর নজর রেখেছিল আর এ—ও জানত যে বিনোদ বিহারী ওঁর কাজ সম্পূর্ণ করতে বাবাকে পাঠাতে চাইছিলেন। কিন্তু এখানে কি তার মানে উনি ম্যাপটার কোনো কপিই রেখে দেননি? সেই ম্যাপটা না পেলে তো কোনো সূত্রই পাচ্ছি না!’ রুদ্র হতাশভাবে ঠোঁট কামড়াল, ‘ওঁর ঘরে তো সেরকম কিছুই পেলাম না!’

প্রিয়ম উঠে ল্যাপটপটা নিয়ে এল। অন করে বলল, ‘আচ্ছা, ওই থাঙ্কা না কী বলছ, তার মধ্যে একটাতে দেখলাম একটা গাছের তলায় একটা হাতি, হাতির পিঠে একটা হনুমান, তার পিঠে একটা খরগোশ, তার পিঠে একটা পাখি। এটা কি ওই বজ্রযানের কোনো গল্প?’

রুদ্রাণী ভ্রূ কুঁচকোল, ‘এর মধ্যে বজ্রযান আবার কোত্থেকে এল! এটা তো জাতকের গল্প, ফোর হারমোনিয়াস ফ্রেন্ডস। বুদ্ধের বিভিন্ন জন্মের কাহিনিগুলোর মধ্যে একটা। জাতকের গল্প পড়নি ছোটোবেলায় নাকি?’

প্রিয়ম বুঝল তার বউ এবার আস্তে আস্তে ফর্মে ফিরছে। ও ভালোমানুষের মতো মুখ করে ঘাড় নাড়ল। রুদ্রর মুডটা ভালো করা নিতান্তই দরকার।

রুদ্র ল্যাপটপটা টেনে নিয়ে ছবিটা খুলল, ‘গৌতম বুদ্ধ এই গল্পটা তাঁর অনুগামীদের বলেছেন। একটা জঙ্গলে একটা হাতি, একটা হনুমান, একটা খরগোশ আর একটা তিতির পাখি একটা গাছে থাকত। ওদের মধ্যে কেউ গাছটায় থাকত, কেউ গাছের ফল খেয়ে দিন কাটাত, কেউ আবার গাছের তলায় থাকত। একদিন ওদের মধ্যে ঝামেলা লাগল এই নিয়ে যে গাছটার আসল মালিক কে? হাতি বলল, এই গাছটা একমাত্র তারই, কারণ সে—ই প্রথম গাছটাকে দেখেছে। বাঁদর বলল, সে গাছের ফল খেয়ে বেঁচে থাকে, তাই এই গাছটা তার। খরগোশ বলল, যখন এই বিশাল গাছ ছোট্ট একটা চারা গাছ ছিল, তখন থেকে সে এই গাছের পাতা খায়, তাই এই গাছটা তার ছাড়া আর কারুর হতেই পারে না।

ছোট্ট তিতির পাখি চুপ করে সবার বক্তব্য শুনছিল। এবার সে বলল, এই গাছটা এখানে জন্মাতই না যদি না সে এই গাছের ফলের বীজ অন্য একটা জায়গা থেকে মুখ করে নিয়ে এসে এখানে ফেলত। তখন বাকি তিনজন তিতিরকে তাদের বড়ো ভাই হিসেবে সম্মান দিল আর সবাই মিলে ঠিক করল, ওরা শান্তিতে গাছের ফল, ছায়া, ফুলের সুগন্ধ সব কিছু নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নেবে। ঐক্য এবং শান্তি দিয়ে সবাই মিলে কীভাবে আলাদা প্রজাতির, আলাদা শ্রেণির হয়েও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করা যায়, সেটাই এই গল্পের মর্যালে। অথচ গোটা পৃথিবীটাই এখন এই মর্যাল ভুলতে বসেছে!’ রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘কিন্তু এই থাঙ্কার ডিজাইন বা আঁকা ছবিগুলো থেকে এমন কোনো ক্লু পাচ্ছি না যেটা ওই ম্যাপের হদিশ দিতে পারে। কিন্তু এটাও ভাবতে মন সায় দিচ্ছে না যে বিনোদ বিহারী কোথাও কোনো সূত্র রেখে যাননি। ভুটানের হামলার পর যখন এখানে পালিয়ে আসেন, তখন ওঁর মনে নিশ্চয়ই আশঙ্কা ছিল আবার হামলার। আর সেইজন্যই উনি ওরকম আকুল হয়ে আমার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।’

প্রিয়ম মন দিয়ে শুনতে শুনতে বলল, ‘তবে যাই বলো, বাবার এই স্যার কিন্তু মাল্টিট্যালেন্টেড লোক ছিলেন। একদিকে ইতিহাসের এত বড়ো পণ্ডিত, আবার অন্যদিকে অঙ্কের দিকেও ঝোঁক ছিল বেশ।’

রুদ্র ফেসবুক খুলে অন্যমনস্কভাবে কিছু একটা খুঁজছিল, হালকাভাবে বলল, ‘অঙ্কের দিকে ঝোঁক?’

‘হ্যাঁ, ওই থাঙ্কাগুলোর ছবি তো বেশ বড়ো করে নিয়েছ, আমি তো ডিজাইন কিছু বুঝলাম না, তাই ঘরের চারপাশটা দেখছিলাম। খাটের পাশের দেওয়ালগুলোতে দেখি নাম্বার থিয়োরিতে ভরতি। পেনসিল দিয়ে প্রচুর সংখ্যা লেখা।’

রুদ্রর ভ্রূ কুঁচকে গেল, ও তাড়াতাড়ি ছবির ফোল্ডারটা খুলল। প্রিয়মের কথা নির্ভুল। বিনোদ বিহারীর খাটের পাশের দুটো দেওয়াল, কোনো মানুষ শুয়ে শুয়ে লিখলে যেমন লেখা হয়, সেইভাবে অজস্র সংখ্যা লেখা রয়েছে। বহুদিন আগের লেখা, তাই কিছুটা হালকা হয়ে এসেছে। তবু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। অন্তত পঞ্চাশ জোড়া সংখ্যা পরপর লেখা, শুধু শেষে একটাই সংখ্যা আলাদা লেখা। রুদ্র জুম করল ছবিটা। একদম শেষে একটু আলাদা বিচ্ছিন্নভাবে ২০ কিমি লেখা।

এগুলো কে লিখেছে? অবিনাশবাবুর কথা অনুযায়ী বিনোদ বিহারীর আগে ওই মহলে কিছু আশ্রিত থাকত। তারাই কি? হয়তো তাদের মধ্যে কোনো অঙ্কের ছাত্র ওই বাড়িতে পড়াশুনো করত, তার কাজ। মোটা লেড পেনসিলে লেখা সংখ্যাগুলো দেখতে লাগল রুদ্র। কিছুক্ষণ বাদে আলগোছে বলল, ‘আমার মনে হয় এগুলো অন্য কোনো লোকের কাজ।’

প্রিয়ম বলল, ‘মাকে কিছু জানিয়েছ?’

রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘মাকে এখনও কিছুই বলিনি। তুমিও কিচ্ছু বোলো না। মা শুনলে আবার আগেরবারের মতো বাধা দেবে, আমি সেটা চাই না। অনেকদিন তো হল, স্বার্থপরের মতো চুপচাপ বসে রইলাম! মা হয়তো এটাকে নিয়তি ভেবে মেনে নিয়েছে, কিন্তু এত কিছুর পরে আমার পক্ষে আর সেটা সম্ভব নয়।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *