ঈশ্বর যখন বন্দি – ৫

জানলা দিয়ে মিঠে রোদটা এসে সোজাসুজি চোখে পড়তে রুদ্রর ঘুমটা ভেঙে গেল। নরম লেপের মধ্যে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঠান্ডা আমেজটাকে কিছুক্ষণ উপভোগ করে ও উঠে বসল। প্রিয়ম ভোরবেলাতেই বেরিয়ে গেছে নরবুর সঙ্গে, কিছু দূরে একটা পিক আছে, সেখানে সূর্যোদয় দেখতে। তখন ঘুমচোখে উঠেছিল রুদ্র একবার, তারপর ও বেরিয়ে যেতে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।

খানিক আড়মোড়া ভেঙে ও ইলেকট্রিক কেটলিতে কফি বসাল। কাল লুংদোপেদরি থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায় বিকেল পাঁচটা বেজে গিয়েছিল। এসে প্রথমে ঠিক করা হল, এখানে প্রচুর বনমুরগি পাওয়া যায়, তার রোস্ট বানানো হবে। আইডিয়াটা অবশ্যই প্রিয়মের। কিন্তু রুদ্রর মাথাটা এতই ঘেঁটে ছিল যে ও প্ল্যানটা নাকচ করে দেয়। তারপর আজকের দিনটা ইচ্ছে করেই ও ফাঁকা রেখেছে। মাঝে মাঝে একান্তভাবে ভাবাটা খুব জরুরি।

কফির মাগে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে ও ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করল। শেষ লেখা থেকে আজ পর্যন্ত যা যা হয়েছে তা লিখে ফেলল ও। খুঁটিনাটি কিচ্ছু বাদ দিল না। কালকে লুংদোপেদরির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিখে ও জানলায় গিয়ে দাঁড়াল। কালকের ঘটনাটায় কোথাও একটা ওর খটকা লেগেছে, কিছু একটা যে অস্বাভাবিকত্ব রয়েছে, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে, অথচ সেটা যে কী ও বুঝতে পারছে না।

চিমিদের বাড়িটা বেশ ছিমছাম আর সুন্দর। প্রচুর ফুলের টব দিয়ে সারা বাড়িটা ঘেরা। পুরো বাড়িটার বাইরের দিকের দেওয়ালে নানারকম ছবি আঁকা। নীচের একটা কিচিরমিচিরে ওর চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। নীচের দরজার কাছে চিমি দাঁড়িয়ে আছে, পেছনে ওর মা। একটা লোক দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, তার সঙ্গেই হেসে হেসে কথা বলছে।

রুদ্র চোখ সরিয়ে নিয়ে দূর ভ্যালির দিকে তাকাল। এত সুন্দর উপত্যকায় না জানি কত রহস্য লুকিয়ে আছে! ও একটা নিশ্বাস ফেলে জানলা থেকে সরে এসে আবার ডায়েরির পাতা খুলল। অনেক প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সেগুলো লিখে ফেলতে হবে।

১. লুংদোপেদরি—ই কি পদ্মসম্ভবের সেই গোপন গবেষণাগার?

২. বিনোদ বিহারী—ই যদি চিমির আগাই হয়ে থাকেন তবে এখানে কোথায় থাকতেন উনি?

৩. সেদিন রাতে যে বোবা লোকটাকে ধরলাম, সে বোবা, আবার থুম্পডেন—ও বোবা। এমনকী বিনোদ বিহারীর চাকর দেচেনও বোবা ছিল। লুংদোপেদরি গুম্ফায় দামাজি বাদ দিয়ে কি সবাই বোবা? এটা কি কাকতালীয় না ইচ্ছাকৃত?

৪. দামাজির ইংরেজি অ্যাক্সেন্ট খুব জড়ানো, দামি কুকুর নিয়ে ঘোরেন, সারাদিন কম্পিউটারে কাজ করেন। উনি কি সত্যিই তিব্বতি? নাকি বাইরের কেউ?

৫. চিমি কথায় কথায় একবার বলে ফেলেছিল, ‘দামাজি আসার পর পুরো গুম্ফার খোলনলচে বদলে যায়।’ তার মানে দামাজি বাইরে থেকে এসেছিলেন। কোথা থেকে এসেছিলেন?

৬. পেমা লিংপার আগের ঘর, যেটা এখন লাইব্রেরি হয়েছে তাতে প্রচুর অঙ্কের বই। কে পড়ে ওগুলো?

৭. পেমা লিংপা কি সত্যিই অসুস্থ? নাকি দামাজি ইচ্ছে করেই দেখা করতে দিলেন না?

৮. দামাজি আসার পর থেকে চিমি একবারও পেমাজিকে দেখতে পায়নি কেন?

৯. চৌধুরী বলে যে লোকটাকে উরা আসার সময় অবধি দেখলাম সে কোথায় গেল?

১০. গুম্ফার পেছনে ঘন জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে। আবার লামারা সামনে দিয়ে বেরোন না। কোথা দিয়ে ওঁরা বাইরে থেকে জিনিসপত্র আনান?

দরজায় খুট খুট শব্দ হতে ও চমকে উঠে ডায়েরিটা বন্ধ করে দরজাটা খুলল। চিমির মা ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসেছেন। এই মহিলা এত রিমোট প্রদেশে থাকলেও কথাবার্তায় শিক্ষার ভাব স্পষ্ট, চিমির মতোই। হিন্দিও বলতে পারেন যেটা ভুটানের এত ভেতরের এক গ্রামের মহিলার পক্ষে একটু আশ্চর্যের। রুদ্র হেসে ওঁকে সেকথা বলতেই উনি বললেন, ‘ওমা, হিন্দি তো পারবই! আমি তো দার্জিলিং—এর স্কুলে পড়াশুনো করেছি।’

এবার রুদ্রর অবাক হওয়ার পালা। মহিলা বলে চললেন, ‘কী জানেন, আমার বাবা ছিলেন বেশ বড়ো ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। খুব বড়ো কনফেশনারির ব্যাবসা ছিল আমাদের। কেক, পেস্ট্রি থেকে শুরু করে ফ্রুট জুস, হেলথ ড্রিংক সবেতেই একচেটিয়া বাজার ছিল আমাদের। একদম প্রপার থিম্পুতেই থাকতাম আমরা। বাবা নিজে খুব বেশিদূর পড়াশুনো না করলেও মনেপ্রাণে চাইতেন ওঁর ছেলেমেয়েরা অনেক পড়াশুনো শিখুক, বড়ো হোক। তাই আমরা তিন ভাইবোনেই দার্জিলিং—এ পড়তাম। চিমি নিজেও ওখানেই পড়েছে। আমার বাবা—ই নাতিনাতনিদের পড়ার খরচ জোগাতেন। আমি নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলাম। বাবা প্রথমে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন, কিন্তু পরে কাছে টেনে নিয়েছিলেন।’ একটা চাপা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘গতবছর বাবা চলে গেলেন। এখন আমার দুই দাদা ব্যাবসার হাল ধরেছে। আমার স্বামী সেরকম কিছু করতে না পারলেও মানুষ হিসেবে খুব ভালো। তাই আমার কোনো আক্ষেপ নেই। আমাদের বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষা কোনোদিনই ছিল না। তাই বাড়িতে হোম স্টে করে আর অল্প কিছু চাষ করে আমাদের ভালোই কেটে যায়। ফুলের বাগান করি, সেলাই করি। চিমিও এখন এখানকার স্কুলে পড়াচ্ছে।’ একটানা বলে মহিলা থামলেন।

রুদ্র একমনে শুনছিল। এবার বলল, ‘আপনার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। এরকম মানুষ আর ক—জন আছেন যারা পার্থিব সুখটার থেকেও মানসিক শান্তিকে বেশি প্রাধান্য দেন? সবাই তো মেটেরিয়ালিজমের পেছনেই ছোটে।’

ভদ্রমহিলা অল্প হাসলেন, বললেন, ‘আপনার খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে নিন।’ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘চিমি কাল আমাকে এসে সব বলেছে। ও আসলে একটু ভয় পেয়ে গেছে। ভয় পাওয়ার কারণটাও অমূলক নয়। বাইরে থেকে দেখে এই উপত্যকাকে যত সুন্দর ভাবছেন, ততটা নয়। তাই ভাবলাম আমি এসে আপনার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলি। আপনারা কি সত্যিই মনাস্টারির ওপর রিসার্চের কাছে এসেছেন? নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে?’

পূরবী যখন লালবাজারে ঢুকলেন তখন বিকেলের আলো প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। কলেজ থেকে হন্তদন্ত হয়ে এসে ঘামছিলেন পূরবী, কিছুটা ক্লান্তিতে আর কিছুটা উদবেগে। সুকুমারবাবুর কেবিনে ঢুকে বসলেন, আজ আর কেউ আটকাল না আগের দিনের মতো।

সুকুমার সামন্ত লালবাজারের একজন পদস্থ অফিসার, পূরবীর কলিগ মধুছন্দার স্বামী। সেদিন রাস্তায় ওই লোকটার হুমকিতে পূরবী মাথার ঠিক রাখতে না পেরে সুকুমারবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সুরঞ্জনের বেলায় কাছের লোকদের হাজার উপদেশেও পূরবী পুলিশের কাছে যাননি, কিন্তু এবার আর নিজেকে সামলাতে পারেননি। এই ন—টা বছর ধরে নিজেকে অসংখ্যবার দুষেছেন নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য, কেন তখন সাহস করে পুলিশের কাছে যাননি!

ওই ক্রিমিনালগুলোর কথায় তিনি তখন কনভিন্সড হয়ে গিয়েছিলেন, যারা বলেছিল, ‘আপনার স্বামীকে আমাদের একটা কাজে লাগবে, কাজটা শেষ হয়ে গেলেই আমরা ওঁকে ফিরিয়ে দেব। তার আগে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে উনি আর ফিরবেন না।’ সেই আশায় আশায় দিন কাটিয়ে গেছেন পূরবী। সেই কাজ কি এখনও শেষ হয়নি! এখন তো মাঝেমধ্যেই মনে হয়, তখন পুলিশের কাছে গেলে এতদিনে নিশ্চয়ই কিছু একটা কিনারা হত! তাই রুদ্রর বড়ো কোনো বিপদের খবর পাওয়ার আগেই পূরবী ছুটে এসেছেন পুলিশের কাছে। স্বামীহারা হয়ে মরে বেঁচে আছেন, আর কোনো বড়ো আঘাত পেতে চান না।

সুকুমারবাবু কখন ঘরে ঢুকেছেন পূরবী খেয়ালই করেননি, ভাবতে ভাবতে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন! সুকুমারবাবুর কথায় হুঁশ এল, ‘আরে কখন এসেছেন পূরবীদি, আমাকে একটা ফোন করবেন তো। আমারও একদম খেয়াল ছিল না আপনার আসার টাইমটা, সারাদিন ছোটোলোকদের সঙ্গে কারবার করি তো, নিজেরাও ছোটোলোক হয়ে গেছি! হা! হা! চা—টা দিয়েছে আপনাকে কিছু?’

পূরবী অল্প হাসলেন। মধুছন্দার বর পুলিশের বড়োকর্তা হলেও বেশ আমুদে। এর আগে যখনই কোনো ঘরোয়া অনুষ্ঠানে এসেছেন, আসর জমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এখন এই সামান্য রসিকতাও পূরবীর ভালো লাগছে না। সুকুমারবাবু কাউকে একটা উদ্দেশ্য করে চা দিতে বললেন। তারপর চেয়ারটায় সশব্দে বসে বললেন, ‘বলুন, পূরবীদি।’

পূরবী একটু ইতস্তত করে ধীরে ধীরে বললেন, ‘আমি কী বলব। ওরা গেছে পাঁচদিন হয়ে গেল। কোনো খবর নেই, ফোনও সুইচড অফ।’

সুকুমারবাবু হাত দুটোকে মাথার পেছনে দিয়ে হেলান দিলেন, ‘হুম। ওই লোকটার সঙ্গে আপনার যেন কবে দেখা হল?’

পূরবী বললেন, ‘গত পরশুর আগের দিন।’

সুকুমারবাবু বললেন, ‘হুম। দেখুন পূরবীদি, আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি রুদ্র আর ওর বরের টিকিট হাসিমারা পর্যন্ত রিজার্ভড ছিল। কিন্তু হাসিমারায় নেমে ওরা কোনো গাড়ি রিজার্ভ করেনি। এখন হাসিমারায় নেমে লোকে দুটো দিকে যেতে পারে। হয় ডুয়ার্স, ওখান থেকে জলদাপাড়া ফরেস্ট খুব কাছে, আর নয়তো জয়গাঁও গিয়ে সেখান থেকে ভুটান। সেক্ষেত্রে বাসে বা শেয়ার অটোতে গেলে তো আর ট্র্যাক করতে পারছি না।’

পূরবী চমকে উঠলেন শেষ কথাগুলো শুনে, ওঁর বুকে ড্রাম পেটার মতো শব্দ হচ্ছে। প্রাণপণে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললেন, ‘ভুটান! না না ভুটান কেন যেতে যাবে হঠাৎ, বলা নেই কওয়া নেই। এই ঠান্ডায়, আর তা ছাড়া ওরা তো বলেছিল নর্থ বেঙ্গল যাচ্ছে।’

সুকুমারবাবু এবার সোজা হয়ে বসলেন, ‘কিন্তু রুদ্রর ফোনের লাস্ট লোকেশন ট্র্যাক করলে সেটা কিন্তু ফুন্টশোলিং দেখাচ্ছে, ভুটানের শহর হলেও ইন্ডিয়ার বর্ডার বলে ওখানে ইন্ডিয়ার টাওয়ার ধরে। আর আমরা কলকাতায় ভুটানের এমব্যাসিতে খোঁজ নিয়েছি, আপনার জামাই গিয়ে দু—জনের পারমিট করিয়ে এসেছেন যাওয়ার কিছুদিন আগে।’

পূরবী থম মেরে বসে ছিলেন, কী বলবেন কিছু ভেবে পাচ্ছিলেন না।

সুকুমারবাবু বললেন, ‘এত ভাবছেন কেন! ভুটানে বেড়াতে গেলে কারুরই ফোনে টাওয়ার থাকে না, হয়তো আপনার মেয়ে—জামাই ভুটান ঘুরতে গেছে, ক—দিন বাদেই চলে আসবে।’

মনের মধ্যে যে কী তোলপাড় হচ্ছে সেটা পূরবীই জানেন। অস্ফুটে বললেন, ‘কিন্তু ওই লোকটা?’

সুকুমারবাবুর কপালে আবার চিন্তার ভাঁজ পড়ল, ‘হুম, সেটা একটা ফ্যাক্টর। ঠিক আছে, আমরা আরও খোঁজখবর চালাচ্ছি, ভুটান তো ফরেন কান্ট্রি, ওখানে ওদের লোকেশন ট্র্যাক করতে আমাদের একটু সময় লাগবে, আগে স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে পারমিশন নিতে হবে, তারপর ওখানকার পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে এগোতে হবে।’

পূরবী বললেন, ‘একটু তাড়াতাড়ি করুন সুকুমারবাবু, ওদের কোনো বড়ো বিপদ হবে না তো!’

সুকুমারবাবু বললেন, ‘আহা, বিপদের কথা আসছে কোত্থেকে এখানে! দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে ঘুরতে গেছে, এত চিন্তার কী আছে আমার তো মাথায় ঢুকছে না!’

পূরবী কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। চায়ের শেষ অংশটা এক চুমুকে শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন, ‘আচ্ছা, আমি চলি তাহলে। আমি দু—দিন বাদে আর একবার আসব।’

জানলা দিয়ে একটা আবছা অথচ তীক্ষ্ন আলো দেখা দিতেই রুদ্র উঠে বসল। ও জেগেই ছিল, সতর্ক বিড়ালের মতো প্রিয়মকে টপকে বিছানা থেকে নামল। জানলার একপাশে গিয়ে বাইরে দেখতেই পেট্রোম্যাক্স হাতে লোকটাকে দেখতে পেল। সেদিনের মতো আজও পেট্রোম্যাক্সটা মুখের কাছে তুলে ধরে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে এই জানলার দিকে।

কী চায় ও? কেন এই সাংঘাতিক ঠান্ডায় রোজ মাঝরাতে এসে এখানে দাঁড়িয়ে থাকে লোকটা? অথচ সেদিন লুংদোপেদরিতে ওকে দেখতে পেয়ে ওরকম লুকিয়ে পড়ল কেন? মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্নের জট খোলার চেষ্টা করতে করতে রুদ্র দুরন্ত গতিতে তৈরি হতে লাগল। আজ আর পাতলা ট্রাউজার পরার বোকামি করবে না ও। সেদিন ফিরে আসার পর বাকি রাতটা ঠান্ডায় প্রায় অবশ হয়ে যাওয়া পায়ের অসহ্য যন্ত্রণায় ঘুমোতে পারেনি। ভেতরে একটা থার্মাল পরে তার ওপর প্রিয়মের লেদার জ্যাকেটটা চাপিয়ে নিল ও। আগের দিন ট্রেক করে ফেরার সময় প্রিয়ম একটা লাঠি নিয়ে এসেছিল। বেশি কিছু না ভেবে লাঠিটা নিয়ে নিল। হাঁটু অবধি লম্বা বুটটা পরে দরজাটা টেনে টর্চটা হাতে নিয়ে ও সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নামতে লাগল।

সিঁড়ির একদম শেষ ধাপে এসে রুদ্র উঁকি মেরে দেখল, লোকটা পেট্রোম্যাক্সটা নামিয়ে পেছন দিকে ফিরে চলে যাচ্ছে। আরও কিছুটা এগোতে রুদ্র বেরিয়ে এসে ওকে অনুসরণ করা শুরু করল। কৌতূহলে বিস্ময়ে ওর অর্ধেক লোম খাড়া হয়ে উঠেছে প্রায়। প্রথমে ভেবেছিল লোকটা ওদের ওপর নজর রাখছে। এখন মনে হচ্ছে, না, লোকটা এখানে কিছু একটা দেখতে আসে।

আজ পূর্ণিমা না হলেও চাঁদের আলো আছে যথেষ্ট। সকাল বেলা রুদ্ররা যেদিক দিয়ে লুংদোপেদরি গিয়েছিল, লোকটা সেদিকে না গিয়ে রাস্তা থেকে ভ্যালির ওপর উঠে হাঁটতে লাগল। বিশাল আয়তাকার ভ্যালিটা লম্বালম্বি পেরিয়ে পাহাড়ের ওপর উঠতে লাগল ও।

প্রথম দিন জানলা থেকে রুদ্র এইভাবেই পাহাড় থেকে নেমে আসতে দেখেছিল লোকটাকে। অভ্যেস না থাকলেও পাহাড়ের গা বেয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে উঠতে খুব একটা বেগ পেতে হচ্ছিল না রুদ্রকে। এই পাহাড়টা ন্যাড়া প্রকৃতির, গাছপালা বিশেষ কিছু নেই, খাড়াইও খুব একটা নয়। চাঁদের আলো পড়ে সবুজ ঘাসগুলো ঝকঝক করছে, মাঝেমধ্যে দু—একটা বড়ো গাছ।

রুদ্র লোকটার সঙ্গে একটা সুষম দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছিল। মাঝরাতের হিমশীতল ঠান্ডার মধ্যে এই জনমানবহীন ধু—ধু প্রান্তরে শুধুমাত্র মাঝে মাঝে আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখিগুলোকে সাক্ষী রেখে কাকে অনুসরণ করছে ও? কে এই লোকটা? রুদ্রর হিতৈষী নাকি অনিষ্টকারী?

এটা কোনো ফাঁদ নয় তো? ফিরতে পারবে তো ও প্রিয়মের কাছে? নাকি বাবার মতোই চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে? কথাগুলো মনে হতেই ওর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল। তবু ও যন্ত্রের মতো হেঁটে যাচ্ছিল। আর কিছু করার নেই, নিজের মনকে বোঝাল রুদ্র। ধনেখালির ব্রাঞ্চে বসে যেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সত্যিটা খুঁজে বের করার শেষ চেষ্টা করবে, সেদিন থেকেই তো ওকে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হয়েছিল পদে পদে বিপদের আশঙ্কায়। বাড়ি ফেরার সময় সেই ছেলে দুটোর হুমকি, বিনোদ বিহারীর নৃশংস খুনের বর্ণনা, কিছুই টলাতে পারেনি ওকে। বাবাকে ছেড়ে থাকা এই ন—টা বছরের তীব্র অভিমান আর কষ্ট প্রচণ্ড এক জেদে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল মনে মনে।

লোকটা এবার নামতে শুরু করেছে। পাহাড়ের উতরাই ভাঙছে অভ্যস্ত পায়ে। রুদ্র লক্ষ করল, পাহাড় থেকে নামার সময় লোকটা আর সোজাসুজি নামছে না। বাঁ—দিক ঘেঁষে নামছে। অনেকটা নামার পর পাহাড়ের একদম পাদদেশে নেমে এল ওরা। রুদ্র ঘড়ি দেখল, পৌনে চারটে। একটু বাদেই ভোর হবে। এসব জায়গায় ঝুপ করে সন্ধে নেমে আসে, ভোরও হয় তাড়াতাড়ি। পাহাড় যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই শুরু হচ্ছে পুরু এক জঙ্গল। চাঁদের আলোও আর তেমন পৌঁছোচ্ছে না এখানে। তবু রুদ্র টর্চ জ্বালাল না, টর্চের আলো বহুদূর অবধি ছড়িয়ে পড়ে।

আঁকাবাঁকা পথে চলতে চলতে পথটা কেমন ভিজে ভিজে লাগাতে ডান পাশে একটা ঝরনা দেখতে পেল রুদ্র। ছোট্ট পাহাড়ি ঝরনা, কাচের মতো স্বচ্ছ জল। লোকটার সঙ্গে রুদ্রর দূরত্ব এখন বেশ কমে এসেছে, কিন্তু মিশমিশে অন্ধকার বলে লোকটা রুদ্রর অস্তিত্ব এখনও বুঝতে পারেনি। জঙ্গলের ঘন গাছপালায় ঘষা খেতে খেতে চলতে বেশ অসুবিধায় পড়তে হচ্ছিল রুদ্রকে। জোরে একটা পাথরে ধাক্কা লাগতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল ও।

বাঁ—পায়ের বুড়ো আঙুলটা মনে হয় থেঁতলে গেছে। যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত হয়ে গেল ওর, তবু কোনো আওয়াজ বের করল না। দাঁতে দাঁত চেপে হাঁটতে লাগল। চারদিক এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইরে দিন কী রাত কিছুই যায় আসে না, কারণ এ জঙ্গলে সূর্যের আলো ঢোকে না। স্কার্ফটাকে খুলে মুখে, গলায়, মাথায় জড়িয়ে নিয়ে শুধু চোখ দুটোকে বের করে রাখল ও। প্রচণ্ড রোদে এইরকমভাবে কলকাতায় ও বেরোয়। এতে একটা সুবিধা হল, আশপাশ থেকে বেরিয়ে থাকা গাছের পাতা বা ডাল মুখে খোঁচা দিতে পারবে না। কিন্তু অনন্তযাত্রা কি শেষ হবে না? লোকটা কিন্তু সোজাসুজি হাঁটছে না, কিছুটা ডান দিকে গিয়ে তার পরে বাঁ—দিক, আবার ডান দিক গিয়ে তার পরে বাঁ—দিক, আবার ডান দিক এইরকমভাবে চেনা অলিগলিতে চলার মতো করে চলছে। নতুন কেউ এলে সোজা চলতে গেলে এই জঙ্গলের মধ্যে বেঘোরে ঘুরে মরতে হবে তাকে। ভাবল রুদ্র।

হঠাৎ বাঁ—দিকে একটা বড়ো গম্বুজ জাতীয় কিছু পড়ল। লোকটা গম্বুজটাকে পেছনে রেখে ডান দিকে ঢুকে পড়ল। আবার শুরু হল অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ধাক্কা খেতে খেতে পথ চলা। আবার বেশ কিছু বাঁক পেরিয়ে দুটো টিমটিমে আলো দেখা গেল। আরও কিছুটা এগোলে ও বুঝতে পারল দুটো মশাল জ্বলছে। লোকটা কিন্তু সোজা এগোল না মশাল বরাবর। ঘুরে পেছন দিকে চলতে লাগল।

আস্তে আস্তে দিনের আলোর মতো সব কিছু পরিষ্কার হয়ে আসতে লাগল রুদ্রর কাছে। গতকাল ওরা যে অত কষ্ট করে পাহাড়, সাঁকো, নদী পেরিয়ে লুংদোপেদরি পৌঁছেছিল, সেটা ছাড়াও আরেকটা রাস্তা আছে যেটা দিয়ে এইভাবে ভ্যালি আর পাহাড় আড়াআড়ি টপকে পেছন দিয়ে লুংদোপেদরি ঢোকা যায়। আর এই রাস্তাটাই খুব সম্ভবত লামারা ব্যবহার করেন। আসার সময় যে গম্বুজটা অন্ধকারে চোখে পড়ল, সেটাই লুংদোপেদরি গুম্ফার পেছন দিক। লোকটা গুম্ফাটাকে পিছনে রেখে জঙ্গলে ঢুকেছে, অর্থাৎ কালকের দেখা জঙ্গলটার ভেতরে রয়েছে ও। যে জঙ্গলটাকে দেখে কাল দিনের আলোয় মনে হয়েছিল ভেতরে একটা লাঠিও ঢুকবে না এমন ঘন, তার এত ভেতরে মশাল কারা জ্বালিয়েছে? রুদ্র হাতের লাঠিটায় ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দেখার চেষ্টা করল, মশাল দুটোর মাঝে আবছা একটা বাড়ির আভাস পাওয়া যাচ্ছে যেন। লোকটা সামনে দিয়ে ঢুকতে চায় না, তাই পেছন দিক দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে। আরও একটু এগোতে একটা ভগ্নপ্রায় গম্বুজের ধ্বংসাবশেষ, চোখে পড়ল ওর। দু—পাশে দুটো মশাল জ্বলছে ঠিকই, তবে কোনো লোক নেই। ওর ষষ্ঠেন্দ্রিয় যদি ভুল না করে, তবে এ—ই কি পদ্মসম্ভবের সেই গোপন ল্যাবোরেটরি?

উত্তেজনায় রুদ্রর হৃৎপিণ্ডটা প্রায় গলার কাছে উঠে এল।

দু—দিকে মশাল জ্বলতে থাকা বাড়িটার একপাশ দিয়ে পুরো আবর্ত গতিতে ঘুরে লোকটা যখন পেছনদিকটায় এল, তখন পূর্ব দিকের আকাশে অল্প লাল আভা দেখা যাচ্ছে। ঘড়িতে পাঁচটা। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যোদয় হবে। রুদ্র এতক্ষণের দুর্গম পথে অন্ধের মতো হাঁটার ক্লান্তিতে আর মানসিক টালমাটালে বিপযয়স্ত হয়ে পড়েছিল। চোখ দুটো জ্বালা করছে, পা আর চলতেই চাইছে না প্রায়। মনে হচ্ছে যেন এই বনবাদাড়ের মধ্যেই হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে!

তারই মধ্যে জায়গাটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করল ও। গভীর জঙ্গলের মধ্যে ভেঙে—যাওয়া একটা বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। এক নজরে দেখলে মনে হবে পুরোপুরি পরিত্যক্ত, খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় ভেতরের কিছু অংশ এখনও অক্ষত রয়েছে।

লোকটা দু—দিকে তাকিয়ে বিড়াল পায়ে ওই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ঢুকে গেল। তারপর সব চুপচাপ। রুদ্র কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর হাতের লাঠিটা শক্ত করে ধরে ও এগোল। বাড়িটার কাছে এসে দেখল লোকটা যেখান দিয়ে ভেতরে ঢুকেছে সেখানটা বহু আগে একটা পাথরের পাঁচিল ছিল। প্রায় দশ ফুট উঁচু। পাঁচিলটার একটা অংশ ভেঙে গিয়ে একটা গোল ফাটলের সৃষ্টি করেছে। রুদ্র ফাটলটা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। প্রথমে/অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না। টর্চ জ্বালাতে ওর ঠিক সাহস হল না।

অন্ধকারে চোখ একটু সয়ে যেতে সামনে তাকাতেই ও কেঁপে উঠল। ওর থেকে মাত্র হাত তিনেক দূরে একটা নীচে নামার সিঁড়ি, তার মুখে পাথরের একটা ঢিবিতে একটা মানুষ বসে আছে! চোখ সোজা ওরই দিকে।

রুদ্র একবার ভাবল পিছন ফিরে দৌড় লাগাবে, পরক্ষণেই ও ভালো করে তাকাল মানুষটার দিকে। চোখ দুটো সম্পূর্ণ ফ্যাকাশে, চোখের মণি স্থির, রক্তশূন্য মুখ। স্থাণুবৎ হাত দুটোকে সামনের দিকে জড়ো করে বসে আছে। পায়ের পাতা থেকে শুরু করে মাথার চুল সমস্তটাতেই যেন কিছু একটা অস্বাভাবিকত্ব রয়েছে। রুদ্র ঢোঁক গিলে ঘেমে ওঠা হাতের তালুতে লাঠিটা শক্ত করে ধরে এক পা এক পা করে এগোল লোকটার দিকে।

একদম কাছে এসে যখন দেখল লোকটার দৃষ্টি সত্যিই শূন্য, ও সমস্ত মনোবল সঞ্চয় করে ওর কাঁপা কাঁপা হাতটা ঠেকাল লোকটার কপালে। সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখে যেন সারা শরীর থেকে বিদ্যুদবেগে রক্ত এসে জমা হল। এই লোকটা জীবিত নয়!

শুধু তাই নয়, ওর সামান্য ইলেভেন টুয়েলভ অবধি পড়া বায়োলজির জ্ঞান দিয়ে ও বুঝতে পারল অন্তত একবছরের পুরোনো মড়া এটা! বহুদিন ধরে মর্গে বরফের মধ্যে রেখে দিলে মৃতদেহ রক্তশূন্য হয়ে যায়, এ—ও তেমনি! রুদ্রর হঠাৎ প্রচণ্ড শীত করতে লাগল। এ কোথায় এসে পড়ল ও! চিমির কথাই কি তাহলে ঠিক? সত্যি কি লুংদোপেদরির লামারা মৃত মানুষের আত্মাকে সম্মোহন করতে সংরক্ষণ করে রাখেন?

পরমুহুর্তেই নিজেকে তিরস্কার করল ও। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়ে এসব গাঁজাখুরি ও কী করে বিশ্বাস করছে? ও একটা সত্যের অনুসন্ধান করতে এসেছে, যার শেষে লুকিয়ে রয়েছে ওর বাবার অন্তর্ধান রহস্য। সেই কাজটা ওকে শেষ করতে হবে, চোখ বন্ধ করে ভাবল ও। তারপর মৃত লোকটার দিকে একবারও না তাকিয়ে সিঁড়িটা দিয়ে সন্তর্পণে নামতে শুরু করল। একেই ধাপ বলতে কিছুই নেই, একটু অন্যমনস্ক হলেই পা পিছলে যাবার সম্ভাবনা। কিন্তু সিঁড়িটা অনেকটা দীর্ঘ, রুদ্র আন্দাজে বুঝতে পারল, অন্তত ত্রিশ ফুট গভীর তো হবেই।

সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে নামতেই একটা সরু গলি, একদম গলির মুখে দেয়ালের গায়ের একটা খোপে ছোট্ট একটা প্রদীপ জ্বলছে। সেই প্রদীপের আলোতে পুরো গলিটা কেমন মায়াবী হয়ে উঠেছে। রুদ্র একবার নেমে আসা সিঁড়িটার দিকে তাকাল, এখান থেকে মৃতদেহটাকে দেখা না গেলেও বুকের মধ্যে ওর হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ হচ্ছে। প্রাণপণে নিজেকে দৃঢ় রাখতে রাখতে ও এগোল। পুরো গুম্ফাটাই তার মানে মাটির তলায়। ওপরের বাড়িটা একটা নিমিত্ত মাত্র। কীসের একটা গন্ধ চারদিকে। রুদ্রর একবার মনে হল ধূপকাঠির গন্ধ, কিন্তু ধূপের গন্ধ এত কড়া হয় না। গন্ধটা খুব অচেনা আর তীব্র।

প্রথমে একটা ঘর পড়ল, তাতে পাশাপাশি চারটে খাট পাতা। একপাশে একটা বড়ো কুলুঙ্গি। আরেকপাশে একটা দড়িতে কিছু জামা ঝুলছে। আরেকটা জিনিসও লক্ষ করল রুদ্র, একটা বড়ো গোলাকৃতি গর্ত ওই ঘরের দেওয়ালে, যা দিয়ে হালকা সূর্যের আলো এসে পড়েছে। তাতে এই ঘরটা বেশ আলোকিত হয়ে রয়েছে। তার মানে এই ঘরে কিছু মানুষজন থাকে। ওই গর্তটা মাটির ওপর থেকে নীচের এই ঘর অবধি কাটা যাতে সূর্যের আলো এই ঘরে প্রবেশ করতে পারে।

সরু লম্বা গলিটা অনেকটা গিয়ে একটা ঘরে মিশেছে। ঘরটা বিশাল, যেমন চওড়া তেমনই উঁচু। ঘরটার বাঁ—দিকে রয়েছে প্রকাণ্ড একটা পদ্মসম্ভবের মূর্তি, প্রায় পনেরো ফুট লম্বা তো হবেই। তার চারপাশে বড়ো বড়ো প্রদীপ জ্বলছে। গন্ধটা ওখান থেকেই আসছে। সেই প্রদীপগুলো ঘরটা আলোকিত করার বদলে আশ্চর্য এক আলো—আঁধারি সৃষ্টি করেছে। দেওয়ালগুলোতে অজস্র ছবি আঁকা, কিন্তু সেগুলো ঠিক কীসের বোঝা যাচ্ছে না।

রুদ্র ঘরটার ডান দিকে তাকাতে আরও একবার চমকে উঠল। পদ্মসম্ভবের বিশাল মূর্তিটার ঠিক সোজাসুজি ডান দিকে একটা উঁচু বেদি, তার ওপর বসে আছেন এক বৃদ্ধ লামা, একটা হাত আশীর্বাদের ভঙ্গিতে ওপরদিকে তোলা, চোখ দুটো অর্ধ—উন্মীলিত। রুদ্র টর্চের আলো জ্বালাল আর এবার আর অতটা অবাক হল না। ইনিও মৃত এবং ওপরের মৃতদেহটার মতোই রক্তশূন্য, কোনো এক উপায়ে এঁর দেহটাকে অবিকৃত করে রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মনে হচ্ছে এই মৃতদেহটা আরও অনেক পুরোনো।

রুদ্র এখন অনেকটা সামলে নিয়েছে, ভয়ও আর অতটা করছে না ওর। কেউ বা কারা মাটির তলায় এই মৃতদেহগুলোকে অবিকৃত অবস্থায় রেখে দিয়েছে। কিন্তু কেন? রুদ্র একটু উদ্ভ্রান্ত হয়ে তাকাল। মাটির তলার এই পুরো গুম্ফাটাতে কি এই দুটোই ঘর নাকি? ও আবার গলির সামনের দিকটায় এল। না, এদিকে আর কিছুই নেই। ওপাশটা আবার একটা সিঁড়ি, সম্ভবত ওটাই গুম্ফার সামনের দিক, যেদিকটা আসার সময় বিশাল মশাল জ্বলছিল।

লোকটা তাহলে কি উবে গেল নাকি? ও আবার ঘরটায় ফিরে এল। টর্চ জ্বেলে পুরো ঘরটা দেখতে লাগল। দেওয়ালে ছবিগুলো বেশিরভাগই বিভিন্ন ভঙ্গির ড্রাগনের। কোনো ছবিতে বিশাল ডানা মেলে একটা ড্রাগন উড়ে চলেছে, কোনোটায় হিংস্র দাঁতের সারি বের করে হাঁ করে রয়েছে একটা ড্রাগন।

হঠাৎ একটা খুটখুট শব্দ হতে লাগল। রুদ্র চমকে গিয়ে শব্দটা কোনদিক থেকে আসছে বুঝতে পারল না, তারপর দ্রুতগতিতে গিয়ে পদ্মসম্ভবের বিশাল মূর্তিটার পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। ঠিক সোজাসুজি ওই মৃত লামাটাকে দেখতে পাচ্ছিল ও। ঘামে পুরো মুখটা ওর ভিজে গেছে। লোকালয় থেকে বহু দূরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ভোররাতে মাটির প্রায় ত্রিশ ফুট নীচে পরিত্যক্ত এক গুম্ফায় মাথার ওপরে একটা মৃতদেহ আর মাত্র সাত—আট হাত দূরে আরেকটা মৃতদেহকে পাশে নিয়ে রুদ্র কী করছে? আর কি কোনোদিন ও ফিরতে পারবে? নাকি এদের পাশেই এরকমভাবে আরেকটা মৃতদেহ হয়ে অনন্তকাল ধরে ওরকমভাবে চোখ অর্ধ—উন্মীলিত করে বসে থাকবে! ঝোঁকের মাথায় কি একটু বেশিই সাহস দেখিয়ে ফেলল?

শব্দটা আরেকটু জোরে হতে ও বুঝল শব্দটা আসছে ওই মৃত লামার ওখান থেকেই। ভয়ে, আতঙ্কে ওর প্রায় দম আটকে এল, প্রাণপণে নিজের সমস্ত শক্তি একত্র করে উঠে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে পালাতে যাবে, এমন সময় ও চকিতে দেখল, বেদির ওপর বসে থাকা মৃতদেহটার ঠিক পেছনদিকে একটা দরজা খুলে গেল। খুট খুট শব্দটা আরেকটু জোরে হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। একটা লোক সেখান দিয়ে বেরিয়ে এল।

রুদ্রর সামনেই পদ্মসম্ভবের বিশাল মূর্তিটা থাকায় লোকটা ওকে দেখতে পেল না, বরং প্রদীপের আলোয় রুদ্র দেখতে পেল লোকটাকে। লোকটা বিদেশি, গায়ের রং খুব ফর্সা, চোখের মণি নীল, মাথার চুল খয়েরি। হাতে একটা বড়ো ব্যাগ নিয়ে বেশ দ্রুতগতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে বাঁ—দিকে চলে গেল। বাঁ—দিকের সিঁড়ি দিয়ে উঠেই গুম্ফার সামনের দিক, তার মানে লোকটা বেরিয়ে যাচ্ছে।

রুদ্র একবার ভাবল লোকটার পিছু নিয়ে দেখবে কোথায় যাচ্ছে, পরক্ষণেই সেটা নাকচ করে দিল।

লোকটা চলে যাবার পর প্রায় পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে ও সন্তর্পণে উঠে বেদিটার দিকে গেল। আধা আলো আধা অন্ধকারে দেখল দরজাটা দেওয়ালের সঙ্গে এমনভাবে মেশানো, খুব ভালো করে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না ওখানে কোনো দরজা আছে। কোনো হাতল নেই। দরজার গায়ে আঁকা ছবিগুলো—ও দেওয়ালের সঙ্গে মিলিয়ে আঁকা হয়েছে। খুব সূক্ষ্ম দরজার পাল্লা দেখতে পেল ও। পাল্লা বরাবর নখ দিয়ে মৃদু চাপ দিতেই সেটা হালকা শব্দ করে খুলে গেল।

দরজাটা খুলতেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। এই ঘরের প্রদীপের আলো এক কণাও পৌঁছোচ্ছে না ওদিকে। দরজার ওপাশে জমি আছে কি না সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। রুদ্র ওর লাঠিটা দিয়ে আন্দাজে বুঝল যে এই ঘরের মতোই জমি রয়েছে ওদিকে। হাতড়ে হাতড়ে ওপাশে চলে গেল ও। ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের হাতও দেখা যাচ্ছে না। এখানে গন্ধটা আরো তীব্র আর অন্যরকম। কোনো দুর্গন্ধকে চাপা দেওয়ার জন্য কড়া করে ধূপকাঠি জ্বাললে যেরকম মিশ্রিত একটা গন্ধ ছাড়ে, সেরকম। গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল ওর। ভিজে স্যাঁৎসেঁতে দেওয়াল ধরে ধরে এগোতে লাগল ও। হঠাৎ খেয়াল হল তাড়াহুড়োতে টর্চটা পদ্মসম্ভবের মূর্তির পেছনে ফেলে এসেছে। নিজের ওপর বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে গেল। এখন আর ওটা আনতে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না।

গন্ধটা ক্রমশই তীব্র হচ্ছে। সঙ্গে একটা কীরকম শব্দ, হাতির মতো বিশালাকার কোনো প্রাণী জোরে নিশ্বাস ফেললে যেমন একটা ফোঁস ফোঁস শব্দ হয়, ঠিক তেমনই আওয়াজ আসছে কাছ থেকে। ভয়ে রুদ্রর হাত পা সিটিয়ে গেল। কাছাকাছি কোনো ভাল্লুক জাতীয় প্রাণী নেই তো? বইতে পড়েছে অনেক মনাস্টারিতেই পাহারা দেবার জন্য ভাল্লুক পোষা হয়। ও লাঠিটাকে সামনের দিকে উঁচিয়ে চারপাশে ঘোরাতে ঘোরাতে চলতে লাগল, যাতে ওর হাতদুয়েক পরিধির মধ্যে কেউ থাকলে বুঝতে পারে।

যত নিকষ কালো অন্ধকারই হোক না কেন, অনেকক্ষণ থাকবার পর তার মধ্যেও চোখ আলো খুঁজে নেয়। রুদ্ররও চোখ সয়ে গেছিল, অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল আগের গলিটার মতো এটাও আরেকটা গলি, তবে এটার গা দিয়ে সারি সারি বেশ কয়েকটা ঘর। শব্দটা ওই ঘরগুলো থেকেই আসছে।

রুদ্র পা টিপে টিপে প্রথম ঘরটার দিকে এগোল। এই ঘরগুলোয় কোনো দরজা নেই, শুধু পাথরের দেওয়াল দিয়ে আলাদা করা। প্রথম ঘরটায় কিছুই দেখতে পেল না, শুধু বড়ো বড়ো পিপে জাতীয় কিছু দাঁড় করানো রয়েছে। দ্বিতীয় ঘরটায় ঢোকার আগে কিছু একটা শব্দে ও কাঠ হয়ে গেল। কিছু মানুষের কথাবার্তা ভেসে আসছে ভেতর থেকে। কথাগুলো ঠিক বুঝতে না পারলেও ভাষাটা ইংরেজি সেটা বোঝা যাচ্ছিল। গন্ধটা এখানে এতটাই তীব্র যে নাক চাপা দিল ও। ফোঁস ফোঁস শব্দটাও খুব স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে এবার, সেটা আসছে পাশের ঘর থেকে। ও সন্তর্পণে দ্বিতীয় ঘরটা টপকে গিয়ে তৃতীয় ঘরটায় উঁকি দিল। প্রথমে কিছুই দেখতে পেল না, শুধু চাপা এক জান্তব নিশ্বাস ছাড়া। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেল, ঘরটার মধ্যে একটা বিশাল খাঁচা, তার মধ্যে কিছু একটা প্রাণী নড়াচড়া করছে। সেটা কী জন্তু ভালোভাবে বোঝা না গেলেও রুদ্র স্পষ্ট দেখতে পেল প্রাণীটার মুখটা শরীরের তুলনায় অনেক বড়ো কিন্তু ছুঁচালো আকারের মুখের দু—পাশ থেকে বেরিয়ে আসা দাঁতগুলো ঝকঝক করছে, প্রায় পাঁচ ইঞ্চি ব্যাসের মিশমিশে কালো গোলাকার সর্পিল চেহারাটার মধ্যভাগটা ঘোড়ার মতো, দু—পাশ থেকে বাদুড়ের মতো দুটো ডানা বেরিয়ে ড্রাকুলার মতো আকার দিয়েছে প্রাণীটাকে। মোটা বলিষ্ঠ লেজেও দাঁতের সারি, একদম শেষ প্রান্তে তিরের ফলার মতো একটা অংশ। রুদ্র ভয়ে, আতঙ্কে এতটাই হতবুদ্ধি হয়ে গেছিল যে ও নিজের পা দুটোকেও নড়াতে পারছিল না। ওর মুখ দিয়ে অস্ফুট এক আর্তনাদেই হোক, বা অচেনা মানুষের গন্ধেই হোক, জন্তুটা ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল। হাড়—হিম—করা বরফশীতল হিংস্র সেই চাউনিতে প্রায় অচেতন হয়ে যাওয়ার আগে রুদ্র দেখতে পেল ওর চোখের মণি দুটো টকটকে লাল আর ঘাড়ের ওপর কয়েক গুচ্ছ দাঁতের সারি।

ড্রাগন!

জন্তুটা ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল, খাঁচার একদম গায়ে এসে মুখটা হাঁ করল, টকটকে লাল দু—ফলা জিভটা বের করে চাটল খাঁচার ওই অংশটা। বিচ্ছিরি গন্ধে রুদ্রর গা গুলিয়ে আসছিল, তার মধ্যে ওর শরীরটা ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছিল প্রায়। ও জানতেও পারল না যে ওর অলক্ষ্যে পেছনে একজন এসে দাঁড়িয়েছে। কী মনে হতে পেছনে ঘোরার চেষ্টা করতেই মাথায় প্রবল এক আঘাত পেয়ে অস্ফুট আর্তনাদ করে ও মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। সেই মুহূর্তেই ও জ্ঞান হারাল।

আধা অচেতন আধা ঘুমন্ত অবস্থায় রুদ্র ছটফট করছিল। মাথায় বেশ যন্ত্রণা হচ্ছে। ঘুমের মধ্যে অবচেতনে যন্ত্রণায় মুখ দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ বেরোচ্ছিল ওর। অনেক কষ্টে চোখ মেলতে, প্রথমে বুঝতে পারল না ও কোথায়, অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না।

কিছুক্ষণ বাদে ওর একে একে সব মনে পড়তে লাগল। ঘুমের মধ্যে ও কি একটা দুঃস্বপ্ন দেখছিল? জঙ্গলের মধ্যে পরিত্যক্ত একটা গুম্ফা, তাতে অবিকৃত কিছু মৃত মানুষ, মাটির তলার ঘরে একটা বীভৎস জন্তু, কাদের সব কথাবার্তা, সব স্বপ্ন দেখছিল?

ও ধড়মড় করে উঠে বসতে চাইল, কিন্তু পারল না। সারা শরীরে অসম্ভব ব্যথা, চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝল, সরু নাইলনের দড়ির মতো এক ধরনের লতা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা রয়েছে ও। শক্ত সরু লতাটা কেটে বসছে ওর গায়ে। ও ককিয়ে চিৎকার করে উঠতে চাইল ‘প্রিয়ম!’ কিন্তু ওর মুখ দিয়ে একটা আওয়াজও বেরোল না। একধরনের পাতা দিয়ে মুখটা আটকানো রয়েছে ওর। জোরে আওয়াজ বের করতে গিয়ে মাথার পেছন দিকের ব্যথার জায়গাটা চিনচিনিয়ে উঠল। ও বুঝল ও স্বপ্ন দেখেনি। জন্তুটার ঘরে ঢোকার পর কেউ একজন ওকে পেছন থেকে মেরেছিল।

কিছুক্ষণ হাত পা ছাড়ানোর নিষ্ফল চেষ্টা করে ও আবার শুয়ে পড়ল। এখন কি সকাল? না রাত? কিছুই বুঝতে পারল না। দূরে টিমটিম করে জ্বলা প্রদীপের আলোতে শুয়ে শুয়ে ঘরটা দেখতে লাগল ও। এটা কি ওই মাটির তলার গুম্ফারই কোনো ঘর? যদি তাই হয়, এই ঘরটা ও দেখেনি আগে। ঠিক ঘরও বলা যায় না, একটা প্রমাণ সাইজের খাটের থেকেও ছোটো ঘরটা। এতক্ষণ বাদে ও খেয়াল করল ওর গায়ে একটা কম্বল চাপা দেওয়া, মাথার তলাতেও ছোটো একটা গোল বালিশ। ঠান্ডা পাথরের মেঝের ওপর একটা মোটা কম্বল পাতা, তার ওপরেই শুয়ে আছে ও। শুয়ে থাকতে থাকতে চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল ওর। একবার বাথরুম যাওয়াটা ওর নিতান্তই দরকার, কিন্তু নড়তেই পারছে না।

হঠাৎ নিজের ওপরেই খুব রাগ হতে লাগল। কী দরকার ছিল রাতদুপুরে একা একা লোকটার পিছু নেওয়ার! তবু এসেই যখন পড়েছিল, জায়গাটা দেখে নিয়ে পরে প্রিয়মদের সঙ্গে এলেই হত। ঠিকমতো প্রস্তুতি ছাড়া সাহস দেখাতে যাওয়াটা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছুই নয়। ও শুয়ে শুয়েই হাত পা মুচড়ে বাঁধনটা খোলার চেষ্টা করতে লাগল, ফল হল উলটো, আলগা তো হলই না, উলটে হাতে পায়ে ওই লতার দড়িটা কেটে বসে রক্ত পড়তে লাগল। রুদ্র হাল ছেড়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। চোখে হু হু করে এসে যাওয়া জলটা থামাতে পারছিল না। এই কান্নাটা একফোঁটা ভয়ের নয়, দুঃখের।

এত দিন ধরে এত চেষ্টা করে এত দূর অবধি এসেও কাজের কাজ কিছুই হল না। বাবাকে উদ্ধার করা দূর, প্রতিপক্ষ কে, কী তার অভিসন্ধি সেটাই এখনও বুঝে উঠতে পারল না সে! কত আর অন্ধকারে হাতড়াবে? আর এই জন্তুটাই—বা কী? জঙ্গলের মধ্যে মাটির নীচে একটা খাঁচার মধ্যে এরকম করালদর্শন প্রাণীকে কারা কী উদ্দেশ্যে খাঁচায় পুরে রেখেছে?

মুখটা কোনো একটা গাছের শিকড় দিয়ে বাঁধা, এত জোরে যে রুদ্রর নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। এভাবে প্রায় আধ ঘণ্টা কেটে গেল। অত কষ্টের মধ্যেও একভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে রুদ্রর চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা শব্দে ওর তন্দ্রাটা ভেঙে গেল।

ঘরে কেউ একটা ঢুকেছে। প্রদীপটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে বলে লোকটার অবয়বটা ঠিক বুঝতে পারছিল না ও। ইচ্ছে করে চোখ বুজে ঘুমের ভান করে ও পড়ে রইল, চোখটা সামান্য খুলে চোখের কোণ দিয়ে লোকটার গতিবিধি নজর করতে লাগল।

হাতে একটা কাঠের গোল ট্রে জাতীয় কিছু, তার ওপর কিছু খাবার, আকার দেখে ফল মনে হচ্ছে। ও পরিষ্কার বুঝতে পারল লোকটা এসে ঝুঁকে ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল, লোকটার নিশ্বাসের উত্তাপ ওর গায়ে লাগছিল। রুদ্র মটকা মেরে পড়ে রইল। লোকটা একটা ছুরি দিয়ে ওর হাত আর পায়ের বাঁধনগুলো খুলে দিল, তারপর কম্বলের পাশে মেঝেতে ট্রে—টা রাখল।

রেখে চলে গেল বাইরে।

রুদ্র চোখ খুলে দেখল বাইরে যাওয়ার একটা ছোটো দরজা রয়েছে ওর মাথার দিকে। লোকটা চলে যাবার সময় দরজাটা অল্প ফাঁক হতেই বাইরে থেকে আলোর ঝলক এসে ভেতরে কয়েক মুহূর্তের জন্য পড়ল, তারপর আবার অন্ধকার হয়ে গেল। রুদ্রর মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। বাইরে দিনের আলো, তার মানে আর যেখানেই থাকুক ও মাটির তলায় নেই। যেভাবেই হোক এখান থেকে ওকে বেরোতেই হবে। ও শুয়ে শুয়ে হাত—পাগুলোকে কিছুক্ষণ ছোড়াছুড়ি করে আড়ষ্টতাটা কাটিয়ে নিল, তারপর উঠে দাঁড়াল। মুখের বাঁধনটা খুলতে গিয়ে দেখল ছুরি ছাড়া সেটা খোলা প্রায় অসম্ভব। সারা ঘরটায় একঝলক চোখ বুলিয়ে নিল ও। কিছুই নেই বলতে গেলে। একপাশে ছোটো একটা কুলুঙ্গি, তার পাশে কিছু বই। ট্রে—র ওপর পাথরের বাটিতে কিছু ফল সাজানো রয়েছে। ও/বাটিটাকে শক্ত করে ধরে শিকারলোলুপ বাজপাখির মতো শুয়ে ঘুমের ভান করে অপেক্ষা করতে লাগল।

লোকটা ফিরে এল একটু বাদেই। আধা অন্ধকারে রুদ্র দেখল একটা বড়ো গ্লাসে করে কিছু একটা এনেছে লোকটা। ও আর দেরি করল না। শুয়ে থাকা অবস্থাতেই বাটিটা ছুড়ে মারল লোকটার মুখে। ঠিকমতো মুখে লাগল না, কোণ দিয়ে ঘেঁষে চলে গেল। লোকটা অস্ফুট একটা আওয়াজ করে ছিটকে পড়ল একপাশে জ্বলতে থাকা প্রদীপের পাশে। গ্লাসটা ছিটকে পড়েছে কম্বলের ওপর, তা থেকে দুধ জাতীয় সাদা কোনো তরল বেরিয়ে সারা কম্বল ভিজিয়ে দিল।

রুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে গ্লাসটা তুলে লোকটার দিকে দ্বিতীয় আঘাত হানতে যাবে, প্রদীপের আলোয় লোকটার মুখের দিকে চোখ পড়তেই ওর সারাটা শরীর কেঁপে উঠল, চোখ দুটো ঠিকরে বাইরে আসার উপক্রম হল। লোকটার চোখ দুটো দেখে পাথরের মতো স্থবির হয়ে গেল ও। মুখ দিয়ে অজান্তেই একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল ওর!

লোকটার ডান চোখের ওপরটা অল্প কেটে গেছে। তারও একটু ওপরে ভ্রূতে একটা কাটা দাগ।

এই দাগটা রুদ্র খুব ভালো করে চেনে। ছোটোবেলায়, যখন ওর ছোট্ট সাইকেলটা নিয়ে ও পাড়ায় ঘোরাঘুরি করত, তখন একদিন একটা বাইকের সামনে পড়ে ও পিষেই যাচ্ছিল প্রায়, বাবা ওকে বাঁচাতে সাইকেলটা সমেত বাইকের সামনে থেকে ওকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, রুদ্রর কিছুই হয়নি, কিন্তু বাবার ভ্রূতে অনেকটা কেটে গিয়েছিল।

রুদ্রর মুখে আর কথা সরছিল না। এত কষ্টের শেষে ভগবান ওর জন্য এমন একটা উপহার ঠিক করে রেখেছিলেন? আট বছর ন—মাস বাদে বাবাকে দেখল ও। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে বাবার? মুখে বহুদিনের না কাটা অগোছালো দাড়ি, চুল অবিন্যস্ত, গাল দুটো অনেকটা ঢুকে গেছে, সেই কৌতুকময়, সদাহাস্যময় জ্বলজ্বলে চোখ দুটো কোটরগত। ও কথা বলতে গিয়ে খেয়াল করল ওর মুখে তখনও সেই শিকড়ের শক্ত বাঁধন। অল্পক্ষণ আগে যেটা ছেঁড়া অসম্ভব মনে হয়েছিল, কোথা থেকে অমানুষিক শক্তি এসে ভর কল ওর শরীরে, টেনে ছিঁড়ে ফেলল ও শিকড়গুলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বাবার দিকে তাকাল ও। চোখ দিয়ে হঠাৎ বহু বছরের জমে থাকা কষ্ট ঝরনা হয়ে নেমে আসছে।

বাবা কি ওকে চিনতে পেরেছেন?

সুরঞ্জনও একদৃষ্টে চেয়ে ছিলেন, দেখছিলেন তাঁর ছোট্ট মেয়েটাকে। শেষ যেদিন দেখেছিলেন, তখনও রুদ্র ছিল ছটফটে এক কিশোরী। আর আজ তাঁর সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে এক আত্মবিশ্বাসে ভরপুর সাহসী তরুণী। চোখে জল তাঁরও এসে গেছিল। প্রায় একদিন ধরে রুদ্র তাঁর এই ছোট্ট ঘরটায় ঘুমোচ্ছে। তিনি কোনো—না—কোনো ছুতোয় পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর এসে দেখছেন মেয়েকে। শেষ যেদিন দেখেছিলেন রুদ্রর তখন ছোটো করে ছাঁটা চুল, সবাই চলত মেয়ে বাপের মুখ পেয়েছে।

কিন্তু আজ এতদিন বাদে লম্বা চুলের রুদ্রকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে প্রথম জীবনের পূরবীকেই মনে পড়ে যাচ্ছিল বার বার।

জীবন থেকে মহামূল্যবান এই ক—টা বছর তাঁর চলে গেল, রুদ্রকে তিনি ওর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বেড়ে উঠতে দেখলেন না ঠিকই, কিন্তু তাঁর শিক্ষা, তাঁর স্বপ্ন কিছুই ব্যর্থ হয়ে যায়নি। রুদ্র মানুষ হয়েছে। মানুষের মতো মানুষ। দেচেন যখন প্রথম দিন জানিয়েছিল রুদ্র এখানে এসেছে, উনি বিশ্বাস করেননি। তবু কোনো এক দুর্নিবার আকর্ষণে রোজ দেচেনকে পাঠাতেন দেখে আসার জন্য, দেচেনের চোখ দিয়ে সুরঞ্জন রুদ্রকে অনুভব করতেন। যে মেয়ে তাঁর হারিয়ে—যাওয়া বাবাকে খোঁজার জন্য এত বিপদ অগ্রাহ্য করতে পারে, জীবনের এত বড়ো ঝুঁকি নিতে পারে, তেমন সন্তানের বাবা হওয়া তাঁর কত বড়ো গর্ব!

দু—জনে দু—জনের দিকে জলভরা চোখে কতক্ষণ চেয়ে রইল নিজেরাই জানে না, তারপর রুদ্র বাঁধভাঙা বন্যার মতো ছুটে এসে সুরঞ্জনের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

সুরঞ্জনও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তাঁর জীবনের সবথেকে মূল্যবান সম্পদটাকে জড়িয়ে ধরে স্থান—কাল—পাত্র ভুলে কেঁদে ফেললেন।

অন্ধকার ঘরটার এক কোণে বাপ—মেয়েতে বসে ছিল। রুদ্রর মুখ কেঁদে কেঁদে ফুলে উঠেছে।

প্রায় দু—ঘণ্টা কেটে গেছে দেখা হওয়ার পর থেকে, তবু রুদ্রর কথা আর ফুরোচ্ছে না। রুদ্র ছোট্টবেলার সারাদিনের ফিরিস্তি দেওয়ার মতো করে সব বলে চলছিল, সুরঞ্জন স্মিত মুখে শুনছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যাঙ্ক, প্রিয়ম… ঘটনা কি একটা! বিয়ের কথা বলতে গিয়ে রুদ্রর মুখ অল্প লাল হয়ে উঠল। সেটা লক্ষ করে সুরঞ্জনের বুকটা মুচড়ে উঠল। তাঁর একমাত্র মেয়ের বিয়েতে তিনি কোনো ভূমিকাই পালন করলেন না। অবশ্য পূরবীর রুচিতে তাঁর পূর্ণ ভরসা আছে। পরক্ষণেই মনে হল পূরবীকে কতদিন দেখেননি তিনি! অবশ্য কাকেই—বা দেখেছেন তিনি এই ক—বছরে? সূর্যের আলোই—বা দেখেছেন ক—টা দিন?

সুরঞ্জন বললেন, ‘হ্যাঁ রে মা, প্রিয়ম ছেলে ভালো তো?’

রুদ্রর মুখটা আরও লাল হয়ে উঠল, বলল, ‘হ্যাঁ বাবা, তুমি কথা বলে দেখবে।’

সুরঞ্জন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমার সঙ্গে আর কথা কোথায় হবে রে! এই অন্ধকূপ থেকে আমি আর কোনোদিনও বেরোতে পারব না।’

রুদ্র বলল, ‘বাবা, এবার বলো তো, তুমি এখানে কেন পড়ে রয়েছ? আমাদের সঙ্গে এতগুলো বছর কেনই—বা যোগাযোগ করনি?’ রুদ্রর গলা থেকে অভিমান ঝরে পড়ল।

সুরঞ্জন ধীর গলায় বললেন, ‘যোগাযোগ করার সুযোগ থাকলে করব না তুই ভাবলি কী করে! আমি যোগাযোগ করতে পারিনি। বাইরের পৃথিবীর কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ করার অধিকার নেই আমার। ইন ফ্যাক্ট তুই এখানে কী করে যে এসে পৌঁছোলি সেটাই আমি ভেবে পাচ্ছি না! তোকে আমিই এখানে লুকিয়ে রেখেছি। কাল যখন তোদের লুংদোপেদরি আসার খবর পেয়েছিলাম তারপর থেকেই আমি সতর্ক ছিলাম। তোর মুখ আমিই বেঁধে রেখেছিলাম, যাতে জ্ঞান ফিরে এলে তুই শব্দ করতে না পারিস। তোকে আর আমাকে এখানে দেখতে পেলে দু—জনকেই শেষ করে দেবে। তবু মন্দের ভালো যে আজ কেউই ওরা এখানে নেই, পারো গেছে। থাকার মধ্যে আছে রুডলফ, সে বড়ো একটা এই কুঠুরিতে আসে না। না হলে তুই জানিস না এরা কতটা ভয়ংকর!’

রুদ্র বলল, ‘এরা মানে কারা?’

সুরঞ্জন বললেন, ‘সে অনেক লম্বা গল্প। বলতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। অতক্ষণ তোকে এখানে লুকিয়ে রাখাটা রিস্ক হয়ে যাবে। তার থেকে চল তোকে সাবধানে বাইরে বের করে দিয়ে আসি।’

রুদ্র অবাক হয়ে বলল, ‘আর তুমি!’

সুরঞ্জন ফ্যাকাশেভাবে হেসে বললেন, ‘আমি আর কী! এখানেই পড়ে থাকতে হবে আমায়! যতদিন না এদের সমস্ত উদ্দেশ্য সাধন হচ্ছে, এরা আমাকে মুক্তি দেবে না!’

রুদ্র বলল, ‘মুক্তি দেবে না মানে! কারা মুক্তি দেবে না! আর তাদের কথায় তোমার মুক্তি আটকাবে কেন? আর উদ্দেশ্য আবার কী! শিগগিরই বেরিয়ে চলো তুমি এখান থেকে।’

সুরঞ্জন বললেন, ‘তুই কি মনে করছিস এই ক—বছরে আমি বেরোনোর চেষ্টা করিনি? তুই এদের চিনিস না। এখন আমি আমার নিয়তিকে মেনে নিয়েছি। আমার জীবন এভাবেই কাটবে, যদ্দিন না আমাকে দিয়ে এদের সব কাজ শেষ হয়। তার থেকে তোরা ভালো থাক, সুখে থাক, সেটাও আমার একটা বড়ো পাওয়া।’

রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে চোয়াল শক্ত করে বাবার দিকে তাকাল, ‘শোনো বাবা, তুমি আমাকে ভালো করেই চেনো আর আমার জেদও তুমি ভালো করেই জানো। আমি তোমাকে না নিয়ে এখান থেকে এক পা—ও নড়ব না। তার চেয়ে যত দেরিই হোক, তুমি আমাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলো। পুরো ব্যাপারটা না জানলে সব কিছুই ধোঁয়াশার মতো লাগছে আমার কাছে। কোনো ডিসিশনও নিতে পারছি না।’

সুরঞ্জন একটা নিশ্বাস ফেললেন, তারপর উঠে গিয়ে প্রদীপটাকে কাছে নিয়ে এসে রাখলেন আর দরজাটা আরও ভালো করে বন্ধ করলেন যাতে একচুলও আলো না প্রবেশ করতে পারে। ঘরের এককোণে গিয়ে হাতড়ে হাতড়ে নিয়ে এলেন একটা কাচের শিশি, তাতে কিছু বিস্কুট রাখা, ট্রে—টাও নিয়ে এসে বললেন, ‘তুই আগে কিছু খেয়ে নে। দুধটা তো ফেলে দিলি। এই ক—টা ফল আর বিস্কুট খা আগে। এখানে খাবার বেশি থাকে না, এগুলো ফেলে দিলে মুশকিল হবে।’

রুদ্র ভেতর ভেতর অধৈর্য হয়ে পড়ছিল, তবু বাবার মন রাখবার জন্য একটা কমলালেবু ছাড়িয়ে মুখে পুরে বলল, ‘তুমি বলো বাবা পুরো ব্যাপারটা।’

সুরঞ্জন চকিতে একবার দরজার দিকে তাকালেন, তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘তোকে তো এখানে আসার আগে পর্যন্ত যা ঘটেছিল সব বলেছিলাম। তখন তুই অনেক ছোটো, হয়তো ভুলে গেছিস। আমার এক স্যার ছিলেন স্কটিশচার্চে পড়ার সময়…’

রুদ্র বাধা দিয়ে বলল, ‘আমার ওসব পুরো মনে আছে বাবা। ইন ফ্যাক্ট তোমার ওই বিনোদ বিহারী চৌধুরী স্যারের বাড়ি থেকেই আমি এখানে আসার পুরো ক্লু—টা পাই।’

সুরঞ্জন অবাক হয়ে বললেন, ‘স্যারের বাড়ি! সেখানে তুই কী করে গেলি?’

রুদ্র তখন ওর লোন ইনস্পেকশনে ধনেখালির চৌধুরীবাড়ি যাওয়া, বিনোদ বিহারীর আঁকা ছবি, দেওয়ালে লিখে রাখা সাংকেতিক ম্যাপ, সেখান থেকে প্রিয়মের গোল্ডবাখ কনজেকচার দিয়ে ম্যাপটা খুঁজে বের করা, ভুটান আসা সব সংক্ষেপে বিবৃত করল।

সুরঞ্জন শুনতে শুনতে বিস্মিত হয়ে গেলেন। তাঁকে ফিরে পাওয়ার জন্য তাঁর সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়ে, যে রাতে তাঁকে ছাড়া বিছানায় কিছুতেই ঘুমোতে পারত না, এত কিছু করেছে!

শুধু তা—ই নয়, অদেখা জামাই প্রিয়মের প্রতিও তাঁর মনটা স্নেহ ভালোবাসায় দ্রবীভূত হয়ে উঠল। আবেগে সুরঞ্জন কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না।

রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাকে কারা কিডন্যাপ করেছিল?’

সুরঞ্জন নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘তোকে পুরো ঘটনাটাই খুলে বলি তাহলে। হঠাৎ কেউ চলে এলে তুই কিন্তু ওই কুলুঙ্গিটার পেছনে লুকিয়ে পড়বি। স্যার যে তেঞ্জ্যুরটা পেয়েছিলেন সেটা পদ্মসম্ভবের আত্মজীবনী হলেও সেটা ছিল অসমাপ্ত। পদ্মসম্ভব সেখানে ওঁর বিভিন্ন গবেষণার কথা বিশদে লিখে রেখে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য গবেষণা ছিল আকাশের বজ্রবিদ্যুৎ মানে তোরা যাকে বাজ বলিস, সেই থেকে বিদ্যুৎশক্তি আহরণ করে সঞ্চয় করে রাখা এবং প্রয়োজনে সেটা কাজে লাগানো। কিন্তু প্রথম তেঞ্জ্যুরটায় লেখা ছিল যে, এই গবেষণা চালানোর ব্যাপারে কিছু গোঁড়া বজ্রযান সাধক পদ্মসম্ভবের বিরোধিতা করতে শুরু করেছিলেন। বজ্রযান ধর্মে বজ্রবিদ্যুৎকে ঈশ্বর মানা হয়। এদের কাছে ‘বজ্র’ শব্দের অর্থ দুটো, একটা বজ্রবিদ্যুৎ, অন্যটা হিরে। হিরে যেমন সবথেকে কঠিন পদার্থ তেমনি বজ্রবিদ্যুৎ সবথেকে শক্তিশালী ফোর্স যাকে আটকানো যায় না। তাই বজ্রযান ধর্মের মানুষজন বিশ্বাস করেন, বজ্রবিদ্যুতের মাধ্যমেই ঈশ্বর জাগতিক দুঃখ, সুখ, টালমাটাল নিয়ন্ত্রণ করেন। এখন সেই বজ্রবিদ্যুৎকে সরাসরি আকাশ থেকে সঞ্চয় করে রাখতে চাওয়া মানে ঈশ্বরকে বন্দি করার চেষ্টা বলে মনে হয়েছিল তাঁদের। তাঁরা ভাবতেন এই গবেষণা এগিয়ে নিয়ে চললে ঈশ্বর ভয়ংকর ক্রুদ্ধ হবেন, তাঁর রোষানলে ধ্বংস হয়ে যাবে মানবসভ্যতা। তাই তারা পদ্মসম্ভবের এই গবেষণার সম্পূর্ণ বিপক্ষে ছিলেন।

‘বিশ্বের সমস্ত ধর্মেই কালের নিয়মে নতুন আর পুরোনোর মধ্যে বিরোধ লেগেছে, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা বৈজ্ঞানিকদের সংকীর্ণতা আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করতে হয়েছে। গ্যালিলিও থেকে শুরু করে পদ্মসম্ভব, সবার ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারে কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। যদিও গ্যালিলিওর মতো পরিণতি পদ্মসম্ভবের হয়নি। কারণ অলরেডি ওঁর সম্পর্কে প্রচুর কিংবদন্তি মিথ রটে যাওয়ায় পুরো বজ্রযান গোষ্ঠী ওঁকে দ্বিতীয় বুদ্ধ হিসেবে মানতে শুরু করে দিয়েছিল। ওঁর উপদেশ ছড়িয়ে পড়েছিল দেশে দেশে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু প্রাচীনপন্থী যোগী ওঁর এই গবেষণার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছিল। তাই পুরো ব্যাপারটার গুরুত্ব অনুভব করে পুথিটা গোপন ও নিরাপদ রাখবার জন্য উনি কয়েকটা পার্টে পুরো বইটা লিখে গেছিলেন আর সেই পার্টগুলো আলাদা আলাদা জায়গায় রেখে গিয়েছিলেন। স্যারের পাওয়া প্রথম পুথিটায় ছিল শুধুই গবেষণার সারমর্ম, তাঁর এই সমস্ত প্রতিবন্ধকতার কথা আর যেখানে পদ্মসম্ভব ওই গবেষণা চালিয়েছিলেন সেখানে পৌঁছোনোর পথনির্দেশ। দ্বিতীয় পার্টের কথা সেখানে কিছু বলা না থাকলেও একটা ইঙ্গিত দেওয়া ছিল যে গোপন ওই গবেষণাগারেই রয়েছে সেটা।

‘জার্নালে স্যারের লেখা পড়ে ইংল্যান্ডের ফরেস্টিয়ার বলে একজন যোগাযোগ করেছিলেন, বলেছিলাম তোকে মনে আছে? যদিও স্যার জার্নালটায় বিশদে কিছুই লেখেননি, শুধু কনসেপ্টটা লিখেছিলেন, তাতেই ওই ভদ্রলোক স্পনসরশিপের দায়িত্ব নেন এই শর্তে যে, ওই গোপন গবেষণাগারে পৌঁছোনোর ঠিকঠাক ম্যাপ পাওয়ামাত্র স্যারকে দায়িত্ব ওঁর টিমের হাতে ট্রান্সফার করে সরে যেতে হবে। কোনো প্রকৃত আর্কিয়েলজিস্টই এইরকমভাবে মাঝপথে এসে সরে যেতে পারেন না, স্যার প্রথমে সাত পাঁচ না ভেবে রাজি হলেও পরে স্বাভাবিকভাবেই সরে যেতে পারেননি। তখন এই অবড়িই জানতাম, পরে এখানে আসার পর জানতে পারি, আসলে ফরেস্টিয়ার বলে কেউই ছিল না, সেই নামটা ভাঁড়ানো। ছিল ক্রমওয়েল বলে একজন ব্যক্তি, যে ছিল আশির দশকের ইংল্যান্ডের একটা আর্টথিফ গ্যাং—এর পাণ্ডা। বহুদিন ধরে ওর দল নানারকম অ্যান্টিক জিনিস চুরি করে পাচার করত। পুলিশও ওদেরকে ধরার চেষ্টা করতে করতে হন্যে হয়ে গেছিল।

‘এই ক্রমওয়েল লোকটা সাধারণ চোর ছিল না। চুরি করে পাচার করা বা ব্যাবসা করার থেকেও লোকটার ইতিহাস আর বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান ছিল। ও জার্নালে স্যারের লেখাটা পড়ে কিন্তু অন্যদের মতো গাঁজাখুরি ভাবেনি, বরং ও বুঝতে পেরেছিল ঠিকমতো এগোলে এই আবিষ্কারের ফর্মুলাটা ও প্রথম হাতে পাবে। সেইমতো ও স্যারকে টোপ দিয়েছিল।

‘কিন্তু পদ্মসম্ভবের ওই তেঞ্জ্যুরে তেরোশো বছর আগের আঙ্গিকে পথনির্দেশ দেওয়া ছিল, তাও দুর্ভেদ্য জঙ্গলের ভেতর। বর্তমানে সেই জায়গা খুঁজে বের করা সহজ নয়। তাই স্যারেরও বহু বছর লেগে যায় ঠিকঠাক খুঁজে বের করতে। ততদিনে ক্রমওয়েল নিজে তার দলের কিছু লোকের সঙ্গে ধরা পড়ে গেছে। দলটার দায়িত্ব নিয়েছে ওরই এক আত্মীয় অ্যালফ্রেড। অ্যালফ্রেড বুদ্ধিমান হলেও ক্রমওয়েলের মতো অতটা শৈল্পিক জ্ঞান ওর ছিল না। এদিকে স্যার ততদিনে সারা ভুটান ঘুরে ঘুরে এই উরাতে এসে লুংদোপেদরি মনাস্টারির প্রধান লামা পেমা লিংপার সঙ্গে পরিচয় করেছেন আর এটা বুঝতে পেরেছেন যে গোপন গবেষণাগারটা এর কাছেপিঠেই কোথাও রয়েছে। সেটা ফরেস্টিয়ার ছদ্মনামধারী অ্যালফ্রেডকে স্যার জানাতেই অ্যালফ্রেড দুম করে একটা কাঁচা কাজ করে বসে। লিখে পাঠিয়ে দেয় ম্যাপটার ডিটেলস পাঠিয়ে স্যার যেন সরে আসেন পুরো ব্যাপারটা থেকে। খুব স্বাভাবিকভাবেই কোনো মানুষ, যিনি একটা সত্য উদ্ঘাটনের জন্য এত বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি সমাধানের এত কাছে এসে সরে আসবেন না। স্যারও ঠিক সেটাই করেন। ক্রমওয়েল হলে এই বাঁকা পথে যেত না বলেই আমার বিশ্বাস, কিন্তু অ্যালফ্রেডের ধৈর্য কম। সে লোক পাঠিয়ে স্যারের ঘরে হামলা করে ম্যাপটা আদায় করতে চাইল, কিছু ফল তো হল না—ই, উলটে স্যার ভুটান ছেড়ে ফিরে গেলেন ওঁর গ্রামে।

অ্যালফ্রেড তাতে সুর নরম করল না, উলটে কিছু সাধারণ গুন্ডা ভাড়া করে স্যারের গ্রামের বাড়িতে হামলা করল, ফল হল মারাত্মক, গুন্ডাদেরকে বাধা দিতে যাওয়ায় স্যারকে মেরে ফেলল তারা।’ সুরঞ্জনের গলা ভারী হয়ে এল।

রুদ্র ভেতরে ভেতরে আগ্রহী হয়ে পড়েছিল আগে বাবার কথা জানতে। বলল, ‘তুমি এতদিন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করোনি কেন?’

সুরঞ্জন বললেন, ‘তোর কী মনে হয়, যোগাযোগ করার তিলমাত্র উপায় থাকলে আমি করতাম না? সব পথ বন্ধ করে রেখেছে ওরা। আগে পুরোটা শোন। স্যার যখন কলকাতায় গিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, তখন স্যার আঁচ করেছিলেন যে ওঁর ওপর আবার হামলা হবে। তাই উনি ম্যাপটা গোপনে আমাকে দিয়েছিলেন যাতে আমি গিয়ে জায়গাটা খুঁজে বের করি। আমাকে কয়েকদিন ধরে যত্ন করে শেখালেন কী করে ওই লুপ্ত হরফে ডাকিনী স্ক্রিপ্ট পড়তে হয়। বাড়িতে উনি ম্যাপের আর কোনো কপি রেখেছিলেন কি না সে—ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেননি। দেওয়ালে ওইরকম করে লিখে রাখার ব্যাপারে তো আমি কিছুই জানতামই না। তবে এখানে পেমাজির মুখে শুনেছিলাম স্যার আর উনি খুব বন্ধু ছিলেন আর দু—জনেরই অঙ্কে আগ্রহ ছিল। পেমাজি তো অঙ্কে রীতিমতো পণ্ডিত ছিলেন।’ একটু থমকে সুরঞ্জন আবার বললেন, ‘কিন্তু তোর বর ওই কয়েকটা সংখ্যা থেকে পুরো ম্যাপটা বের করে ফেলল! ভারি বুদ্ধিমান ছেলে তো!’

রুদ্র একটু অধৈর্য হয়ে বলল, ‘আসল কথাটা বলো না! তারপর কী হল! তোমাকে ওরা কিডন্যাপ করে কী করল?’

সুরঞ্জন দু—পাশে মাথা নাড়লেন, ‘আমাকে ওরা কিডন্যাপ করেনি তো!’

রুদ্র অবাক হয়ে বলল, ‘মানে?’

সুরঞ্জন বললেন, ‘মানে, স্যারের বেলার মতো ভুল অ্যালফ্রেড আর করেনি আমার সময়। সেদিন তোকে পরীক্ষার হল থেকে আনতে যাব বলে তাড়াহুড়োয় অফিস থেকে বেরোচ্ছি, হঠাৎ একটা ফোন এসেছিল, খুব ভদ্রভাবে বলা হয়েছিল, আমার সঙ্গে একটা জরুরি দরকার, পোস্তার একটা দোকানের সামনে দেখা করতে হবে। আমি ডিটেল জানতে চাইলে বলেছিল যদি নিজের অবস্থাও আপনার স্যারের মতো না করতে চান, তাহলে আসুন। আমি আর কথা না বাড়িয়ে, গেলাম। আমার গাড়িটা সাইড করে কথা বলতে গেছিলাম, ওরা ওদের গাড়িতে আমাকে তুলে নিয়ে একটা হোটেলে নিয়ে গেল। সেখানেই আমার সঙ্গে মার্কের দেখা হল। সঙ্গে আরও কয়েকজন এদেশি সাঙ্গোপাঙ্গ ছিল।’

রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ‘মার্ক কে? অ্যালফ্রেডের অ্যাসিস্ট্যান্ট?’

সুরঞ্জন বললেন, ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট বললে মার্ককে খাটো করা হবে। মার্ক ছিল ক্রমওয়েলের ডান হাত। ও প্রথম থেকে পুরো ব্যাপারটা জানত। সম্ভবত ক্রমওয়েল, জেলে বসে স্যারকে খুনের কথা জানতে পেরে অ্যালফ্রেডের কাণ্ডকারখানায় ভরসা রাখতে না পেরে মার্ককে এখানে পাঠায়। পার্ক স্ট্রিটের ওই হোটেলে বসে মার্ক ভদ্রভাবেই আমাকে বলে যে ওই ম্যাপ অনুযায়ী জায়গাটা আমায় ওদের চিনিয়ে দিয়ে আসতে হবে। আর যেভাবে এসেছি সেভাবেই ওদের সঙ্গে চলে যেতে হবে। কাজ হয়ে গেলে আমাকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমিও বুঝতে পারি যে, এখনও অবধি ভালোভাবে কথা বললেও এরা যেরকম ধরনের, কথা না শুনলে আমার হালও স্যারের মতোই করবে। পুলিশের কাছে গিয়েও কোনো লাভ নেই। এই সমস্ত ইতিহাসের অমূল্য দলিল খোঁজার গুরুত্ব ওরা বুঝবেও না, মোটা কোনো স্টেপ নিয়ে পুরো জিনিসটাই বানচাল করে দেবে।

‘আমি নিজেও ভেবে দেখলাম যে এমনিতেই আমি মাসদুয়েক বাদে যাবার জোগাড়যন্ত্র করেছিলাম, বরং সেখানে আমাকে একাই যেতে হত, এখানে আন্তর্জাতিক ব্যাক—আপটা থাকবে, আমার সুবিধেই হবে। বলতে পারিস স্যার ওদের ফাঁদে ১৯৮০ সালে যেভাবে পা দিয়ে নিজের সর্বনাশ করেছিলেন, আমিও ২০০৭ সালে ঠিক সেই ভুলটাই করলাম।’ সুরঞ্জনের গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ল, ‘আমি আসলে চোরের ওপর বাটপাড়ি করতে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, যেতে যখন আমাকে হবেই তখন নিজের লাভটা পুষিয়ে নেব। তবে বুঝিনি যে এরা কতটা ভয়ংকর।’

রুদ্র চুপ করে গেল। ও বিশ্বাসই করতে পারছে না যে বাবা ইচ্ছা করে চলে গিয়েছিলেন। তার মানে বাবা নিখোঁজ হওয়ার দিন বা তার পরের ক—টা দিন যখন ও আর মা সারাদিন উৎকণ্ঠা, কান্না, আতঙ্ক নিয়ে কাটাচ্ছে, তখন বাবা স্বেচ্ছায় ওদের সঙ্গে যাচ্ছেন এবং সেটা একবারও ওদের জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না!

সুরঞ্জন ওর মুখের দিকে খেয়াল না করে বলেই চলেছিলেন, ‘আমি রাজি হয়েছিলাম কিন্তু বলেছিলাম আমি বাড়িতে একবার জানিয়ে আসতে চাই। গাড়িটা মাঝরাস্তায় পার্ক করে এসেছি। তেমন হলে ওদের কেউ আমার সঙ্গে চলুক। তোর মা আমার এরকম হুটহাট বেরিয়ে পড়াতে অভ্যস্ত, একবার খবর দিলে আর চিন্তা করবে না। কিন্তু মার্ক তাতে বাধা দেয়। হয়তো ওদের মনে ভয় ছিল যে আমাকে ছেড়ে দিলে আমি পুলিশের কাছে যেতে পারি, স্যারের মার্ডারের ব্যাপারটাও জানাতে পারি।’ সুরঞ্জন একটু থেমে আবার বললেন, ‘ওর কাছে তোর আর তোর মায়ের সমস্ত ডিটেলস ছিল। আগের বেশ কিছুদিন ধরে ওরা হোমওয়ার্ক করেছিল বোঝাই যায়। তুই কোন স্কুলে পড়িস, কখন কোথায় টিউশন পড়তে যাস, তোর মা ক—টায় বেরোয়, সব কিছু। আমি বুঝতে পারছিলাম যে ওদের এখানে প্রচুর লোকাল চর ছড়ানো রয়েছে।’ সুরঞ্জন শ্বাস ছাড়লেন, ‘সেই যে বেরিয়ে পড়লাম, আর ফিরতে পারলাম না!’

রুদ্র গুম হয়ে বসে ছিল। শেষ কথাটা শুনে হালকা শ্লেষ মাখিয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘সে তো ঠিকই! ফিরতে চাওয়ার ইচ্ছে না হলে কী করে আর ফিরবে!’

সুরঞ্জন এবার অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালেন, ‘কী বলছিস তুই! আমি ফেরার চেষ্টা করব না! যতবার ফিরতে চেয়েছি কাজ এখনও শেষ হয়নি এই বাহানায় আটকে দিয়েছে।’

রুদ্র বলল, ‘তুমি যাতে পুলিশের কাছে যেতে না পার সেইজন্য ওরা তোমাকে একবার বাড়িতে দেখা করে আসতে দিল না, কিন্তু ওরা তো জানতই যে তুমি ফিরে না এলে বাড়ির লোক পুলিশের কাছে যাবে। তাহলে?’

সুরঞ্জন বললেন, ‘হুম, ঠিক, কিন্তু হয়তো ওরা ভেবেছিল তোরা পুলিশের কাছে গেলেও পুলিশ হয়তো সাধারণ তদন্ত শুরু করবে, তার সঙ্গে স্যারের মার্ডার বা এই ব্যাপারটার যোগসূত্রটা রিভিলড হবে না। হয়তো সে—ব্যাপারটা ওরা নিশ্চিত করেছিল। ওরা তখন এই ব্যাপারে এতটাই এক্সাইটেড ছিল যে নতুন কোনো হাঙ্গামায় জড়াতে চাইছিল না বলেই আমার মনে হয়। যদিও আমি পুরো ব্যাপারটা জানি না।’

রুদ্র বলল, ‘তারপর?’

সুরঞ্জন দূরের প্রদীপের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তারপর আর কী! স্যারের মতো আমারও এই নির্বাসন জীবনের শুরু হয়ে গেল। ওদের সঙ্গে লুকিয়ে ভুটান চলে এলাম। স্যারের তৈরি করা ম্যাপ অনুযায়ী লুংদোপেদরি এলাম। সঙ্গে মার্ক, ওদের দুটো পোষা গুন্ডা মরিস আর অ্যান্ড্রু আর ওদের ইন্ডিয়ার কিছু শাগরেদ। তখনও অবধি সব কিছু ঠিকঠাক ছিল। মার্করা বুঝেছিল যে গোপন গুম্ফাটা উদ্ধার করতে গেলে লুংদোপেদরি মনাস্টারির হেল্প নেওয়া খুবই জরুরি। যে করেই হোক ওই মনাস্টারির প্রধান পেমা লিংপাকে হাত করতে বলল আমায়। স্যারের কাছে আগেই পেমাজি সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছিলাম, উনি খুব বড়ো মাপের সাধক ছিলেন। বৃদ্ধ সৌম্যদর্শন লামাটির মুখে স্মিত হাসি লেগেই থাকত।

পেমাজির সঙ্গে দেখা করে মার্কদের শেখানো অনুযায়ী বললাম, ‘আমরা খুব প্রাচীন বজ্রযান মনাস্টারিগুলো নিয়ে রিসার্চ করছি, মনাস্টারির পরিবেশ আমরা একটুও নষ্ট করব না, যদি ক—দিন থাকতে দেন।’

রুদ্র বলল, ‘কাউকে তো ভেতরে ঢুকতেই দেওয়া হয় না। তোমরা কী করে ঢুকলে?’

সুরঞ্জন বললেন, ‘সে তো এখন। তখন এইরকম ছিল না। গোপনীয়তা থাকলেও আশপাশের গ্রামের মানুষের আপদেবিপদে এখানকার লামারা পাশে দাঁড়াতেন। গ্রামবাসীরা ভয় পেলেও সেটা শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় ছিল।

‘পেমাজির মতো স্নেহাশীল লামা আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। আমাদের আদর করে লুংদোপেদরিতেই থাকার ব্যবস্থা করলেন, সর্বক্ষণের জন্য একটা চাকর পর্যন্ত ছিলেন। খাওয়াদাওয়ারও বন্দোবস্ত হল। পেমাজি তিব্বতি ভাষায় কথা বলতেন, এখানকার জংখা ভাষাও অল্পবিস্তর জানতেন, খুব ভাঙা ভাঙা হিন্দি বলতে পারতেন, আর ইংরেজি তো একবর্ণ বুঝতেন না। শুধু মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে হাসি হাসি মুখে ‘ওয়েলকাম’, ‘ওয়েলকাম’ করতেন। আমাদের বলেছিলেন যদ্দিন না আমাদের কাজ মিটছে আমরা স্বচ্ছন্দে থাকতে পারি। আমি তিব্বতি ভাষা বুঝতাম বলে আমি কমিউনিকেট করতাম ওঁর সঙ্গে। মার্করা কেউ একবর্ণ বুঝত না বলে সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখত আমাকে। আমার খুব অপরাধী মনে হত নিজেকে। সারাক্ষণ ওদের সঙ্গে এক ঘরে থাকতাম, শুতাম, কথা বলতাম, কিন্তু সবসময় মনে হত পেমাজির স্নেহের সুযোগ নিচ্ছি আমি। কিন্তু আমারও হাত পা বাঁধা। মার্কের নেটওয়ার্ক ভীষণ স্ট্রং। এই রিমোট জায়গায় থেকেও তোদের ওপর ওর লোকেরা কড়া নজর চালিয়ে যেত। মাঝে মাঝে তোদের দু—একটা আপডেট দিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে রাখত।

‘সারাদিন ধরে মনাস্টারির গায়ে কয়েকশো বছরের পুরোনো ডাকিনী স্ক্রিপ্টে লেখা উপদেশগুলো নিয়ে পড়াশুনো করার ভান করতাম আর ফাঁক পেলেই স্যারের মাপ অনুযায়ী খোঁজ চালাতাম। একমাসের মধ্যে আমি এই জায়গাটা পয়েন্ট আউট করে ফেললাম। লুংদোপেদরির পেছনের ঘন জঙ্গলেই যে পদ্মসম্ভবের গোপন গুম্ফা ছিল সেটার আভাস আমাকে স্যার নিজেই দিয়ে গিয়েছিলেন। বাকিটা ম্যাপ দেখে শিয়োর হলাম। বলতে গেলে আমি ওদের নজরবন্দি ছিল, তাই ওদের ছাড়া আমার ওখানে যাওয়া অসম্ভব ছিল, তাই বাধ্য হয়ে বলতে হল মার্ককে। সবাই মিলে একদিন দিনের আলোয় দেখেও গেলাম জায়গাটা। তখন গাছপালায় ঢাকা পুরো পরিত্যক্ত একটা গুহা ছিল। আগে থেকে জানা না থাকলে কেউ বুঝতেও পারবে না যে সেখানে কিছু আছে। এত ঘন জঙ্গল হয়ে গিয়েছিল আমরা ভেতরে ঢুকতে পারলাম না। ওরা পরামর্শ করল পরের দিন গিয়ে গাছপালাগুলো সাফ করে ভেতরে ঢোকা হবে।

কিন্তু লুংদোপেদরির একজন দেখে ফেলেছিল আমাদের ওখানে যেতে। স্যার ভুটান থেকে ওঁর গ্রামে ফেরার সময় এখানকার এক চাকরকে নিয়ে ফেরেন, নাম দেচেন। বোবা, কিন্তু খুব বিশ্বাসী। স্যারের খুনিয়া দেচেনের ওপরেও হামলা চালিয়েছিল কিন্তু কোনোরকমে বেঁচে এখানে আবার ফেরত চলে আসে।দেচেন আমাদের দেখতে পেয়ে পুরো ব্যাপারটা পেমাজিকে আকারে—ইঙ্গিতে বলে দেয়। আমরা ফিরে আসামাত্র পেমাজি খুব চেঁচামেচি করলেন আমাদের ওপর।

ওঁকে ওরকম রাগতে তার আগে কখনো দেখিনি। আমি জানতাম স্যার ওঁর বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পেমাজি কোনোদিন একটু উঁচু স্বরে কথা বলেন না, কিন্তু সেদিন খুব রেগে গেছিলেন। চিৎকার করে আমাকে বলেছিলেন, আমরাই তার মানে বিনোদ বিহারীর খুনি! আমরা তাঁর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়েছি। মার্করা কিছুই বুঝছিল না, দূরে একদিকে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। গোপন গুম্ফার খোঁজ পাওয়ার ইচ্ছা আমারও কম ছিল না, কিন্তু এভাবে বৃদ্ধ মানুষের সারল্যের সুযোগ নিয়ে মিথ্যে কথা বলে নয়। আমি দেখলাম এই সুযোগ। তিব্বতি ভাষায় পুরো ব্যাপারটা খুলে বললাম ওঁকে। বললাম, আমি বিনোদ বিহারীর ছাত্র, কীভাবে বিনোদ বিহারী স্যারকে ওরা মার্ডার করেছে, আমার স্ত্রী—কন্যার ক্ষতি করার হুমকি দিয়ে নিয়ে এসেছে আমাকে, সব খুলে বললাম ওঁকে।

‘ওদের আসল উদ্দেশ্য শুনে পেমাজির মুখ সাদা হয়ে উঠল। ওঁর চোখ দিয়ে জল গড়াতে শুরু করল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম যে ওঁর অভিব্যক্তি দেখে মার্করা হয়তো ধরে ফেলবে যে আমি সব জানিয়ে দিয়েছি। আমি সঙ্গেসঙ্গে অনুনয় করে বললাম যে এখন কিছু না বলতে। যদি সম্ভব হয়, আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই, কিন্তু আমি নজরবন্দি। কী করে আড়ালে কথা বলব ওঁর সঙ্গে? পেমা লিংপা আর কিছু না বলে আমাদের ভেতরে যেতে বললেন। মার্কদের খটকা তো লেগেইছিল, আমাকে ঘরে গিয়ে হাজারো প্রশ্ন করতে শুরু করল। আমি হাবিজাবি বললাম ঠিকই, কিন্তু ওরা কনভিন্সড হল না বুঝতে পারলাম। আমাকে আর কিছু বলল না ওরা।

তার পরদিন রাত্রে আমরা সবাই যখন ঘুমোচ্ছি, মনাস্টারির একজন চাকর এসে আমাকে নিঃসাড়ে ডেকে নিয়ে গেল। আমি গেলাম। পেমা লিংপার ঘরে গিয়ে দেখি টিমটিমে প্রদীপের আলোয় উনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি যেতেই হাত ধরে পাশে বসালেন। আমি আর কিছু না লুকিয়ে সব খুলে বললাম আমরা কেন এসেছি। উনি আমাকে বললেন, ‘বিনোদ বিহারী ওঁর খুব কাছের ছিলেন, কাছেরই এক গ্রামে থাকতেন, কিন্তু ওঁর ওই গবেষণার ব্যাপারে পেমাজির প্রবল আপত্তি ছিল। ওই গবেষণাগারের ব্যাপারে উনি ছোটো থেকেই বয়োজ্যেষ্ঠ লামাদের কাছে শুনে এসেছেন, কিন্তু কোনোদিনও যাওয়ার সাহস পায়নি। আমাকে উনি ওই একই কথা বোঝালেন, ওঁরা বজ্রসাধক। ওঁরা বিশ্বাস করেন বজ্রবিদ্যুতের মাধ্যমে ঈশ্বর দেখা দেন আকাশে। সেখান থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে সঞ্চয় করে রাখার অর্থ স্বয়ং ঈশ্বরকে আটকে রাখা, যেটা ওঁরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। সেই অষ্টম শতকে যখন এই পরীক্ষা করা হয়েছিল, তখনও জন্ম নিয়েছিল কিছু বিকৃত প্রাণী যাদের এখন ড্রাগন বলা হয়। অনেক কষ্টে সেই প্রাণীদের সম্পূর্ণ বিনাশ সম্ভব হয়েছে। ওঁরা এও বিশ্বাস করেন, যেদিনই ওই লুপ্ত—হয়ে—যাওয়া প্রাচীন প্রণালী আবার পরীক্ষা করে দেখা হবে, সেদিন পৃথিবীতে নেমে আসবে মহাপ্রলয়। ছারখার হয়ে যাবে সমস্ত শুভ সত্তা, মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে অশুভ শক্তিরা।

আমি বুঝতে পারলাম পেমাজি সেই গোষ্ঠীর অনুগামী যারা এই ব্যাপারে পদ্মসম্ভবের বিরোধিতা করেছিলেন। বরং পদ্মসম্ভব নিজে ছিলেন সংস্কারমুক্ত, যুক্তি দিয়ে ভাবতে চেয়েছিলেন, উন্মোচিত করতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞানের এক নতুন দিক। আমি তর্কে গেলাম না। চুপ করে আছি দেখে পেমাজি বললেন আমি যেন অবিলম্বে ওই বিদেশিদের নিয়ে ওখান থেকে চলে যাই। না হলে ফল ভালো হবে না। আমি যেন বিনোদ বিহারীর পরিণাম থেকে শিক্ষা নিয়ে এই কাজে এগোনো বন্ধ করে দিই।

আমি চুপ করে ওখান থেকে চলে এলাম। একদিকে বৃদ্ধকে অমান্য করতে মন সায় দিচ্ছে না, অন্যদিকে অজানা সেই গুপ্ত রহস্য টানছে বার বার। তবু মনকে বোঝালাম, পৃথিবীতে কত রহস্যই তো অজানা থেকে যায়, এটাও না হয় থাকল, তা বলে এঁদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া ঠিক নয়। মনটা এমনিও উতলা হয়ে ছিল। হিসেব করে দেখেছিলাম ততদিনে তোর মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। কেমন হল সেই নিয়ে সারাক্ষণ মনটা অস্থির লাগছিল। পেমাজির ঘর থেকে বেরিয়ে আমাদের ঘরে আসতে আসতে ভাবছিলাম, অনেক হয়েছে আর নয়। এত নরম হয়ে থাকলে ওরা আরও পেয়ে বসবে। এবার একটু শক্ত হতে হবে।

কিন্তু ঘরে ফিরতেই মার্ক আমাকে দেওয়ালের সঙ্গে চেপে ধরল। আমাকে যখন ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ও সব টের পেয়েছিল, চুপ করে মটকা মেরে পড়েছিল। কিন্তু আমারও সেদিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছিল। আমিও চেঁচিয়ে—মেচিয়ে বললাম যে আমাকে এতদিন ধরে আটকে রাখবার জন্য আমি পুলিশের কাছে যাব। মার্ক কিছু বলল না। স্থির চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শুয়ে পড়ল। পরের দিন থেকেই বুঝতে পারলাম কী ভুল করেছি। সাপের লেজে পা দিয়ে ফেলেছি। ওরা যে কতটা ভয়ংকর তা সেদিন টের পেলাম।’

রুদ্র চুপচাপ শুনছিল, ‘কী হল তারপর?’

সুরঞ্জন উঠে গিয়ে ঘরের এক কোণ থেকে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে একটা বড়ো ঘটি বের করলেন, সেটা মুখের সামনে উঁচু করে ধরে জল খেলেন কিছুটা। এতটা বলে গলা শুকিয়ে গেছিল। দরজার দিকে তাকালেন একবার, তারপর আবার ফিরে এসে বসলেন।

রুদ্রও বাবাকে দেখছিল। বাবা গ্লাস ছাড়া জল খেতে পারতেন না বলে মা হাজারবার বলেও কোনোদিন অফিসে জলের বোতল নিয়ে যেতেন না। বলতেন বোতল থেকে জল খেলে গলাটাই শুধু ভেজে, তেষ্টাটা মেটে না, তার থেকে অফিসে গিয়ে আরাম করে গ্লাসে জল খাব। সেই বাবা আজ এত বড়ো একটা ভারী পাথরের ঘটি থেকে জল খাচ্ছেন। রুদ্রর সাময়িক অভিমানটা অনেকক্ষণ আগেই কেটে গেছিল, এবার কষ্টে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। মনে হল এক ছুটে গিয়ে বাবার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে হাত বুলিয়ে দেয়।

সুরঞ্জন ফিরে এসে বসে পড়ে ক্লান্ত গলায় উত্তর দিলেন, ‘তার পরের দিনই পেমাজিকে মেরে ফেলল ওরা।’

রুদ্র আঁতকে উঠল, ‘কী!’

সুরঞ্জন বললেন, ‘হুম। কোনো আঘাত করে নয়, গলা টিপে। পেমাজির সঙ্গে সঙ্গে যে খাস চাকরটা ঘুরত, সে বাধা দিতে যেতে তাকেও একইভাবে মারল ওরা। তোকে তো বললাম মার্ক ভয়ংকর নৃশংস, নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য ও সব করতে পারে। শুধু আমাকে মারল না কারণ ওই গুম্ফায় গিয়ে ওরা কোনো তেঞ্জ্যুর পেলেও আমি ছাড়া সেটার মানে উদ্ধার করতে পারবে না। ডাকিনী স্ক্রিপ্ট পড়তে পারার লোকের যে খুব অভাব আছে তা নয়, কিন্তু আগেই বলেছি, পদ্মসম্ভব ডাকিনী স্ক্রিপ্টটাকে আরেকটু জটিল করে লিখে গিয়েছিলেন যেটা পড়তে পারার টেকনিক প্রথম তেঞ্জ্যুরে দেওয়া ছিল, সেটা স্যার আর আমি ছাড়া কেউ জানতাম না।

‘পেমাজি ছাড়া আরেকজন খুব বৃদ্ধ লামা ছিলেন, তাঁকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখল। তিনি যদিও বছর পাঁচেক আগে মারা গেছেন। তারপর শুরু হল মার্কের একাধিপত্য। বাইরের গ্রামের একটা লোক ঠিকে কাজ করত, তাকে ছাড়িয়ে দিল। মনাস্টারির একটা চাকর লুকিয়ে পালাতে চেষ্টা করেছিল, ভেবেছিল কাছাকাছি উরা গ্রামে গিয়ে সব জানাবে, একদিন রাতের অন্ধকারে ধরা পড়তে মার্ক ওর কুকুরটাকে লেলিয়ে দিল, পায়ের পুরো মাংস খুবলে নিল কুকুরটা। দু—দিন বাদে ইনফেকশনে মারা গেল চাকরটা। তারপরেই আরেকজন চাকর থুম্পডেনের জিভ উপড়ে ফেলল মার্ক, যাতে ও কিছু বলতে না পারে কাউকে। যন্ত্রণায় ছটফট করত বেচারা। বাকি রইল দেচেন, ও তো এমনিতেই বোবা ছিল।

‘পরের দিনই ওরা গিয়ে সব ঝোপ জঙ্গল কেটে এই পুরো গুম্ফাটাকে দিনের আলোয় বের করে আনল। তখন এসব মাটির তলার ঘরগুলো কিছুই ছিল না। এগুলো সব ওরা তৈরি করেছে। শুধু সুড়ঙ্গ ছিল একটা, সেটাও বুজে গেছিল। আমার আর কিছুই করার ছিল না। পালাবার রাস্তাও বন্ধ, মার্কের দুই পোষা গুন্ডা অ্যান্ড্রু আর মরিস ছায়ার মতো সারাক্ষণ ঘিরে রয়েছে আমায়। স্যারের বলে যাওয়া অনুযায়ী সুড়ঙ্গটা খুঁড়ে প্রায় এক সপ্তাহ পর দ্বিতীয় তেঞ্জ্যুরটা উদ্ধার করলাম। সেসব ডিটেলসে আর যাচ্ছি না।’ সুরঞ্জন থামলেন, ঢোঁক গিলে বললেন, ‘এত কষ্ট শুধু তোদের কথা ভেবে সহ্য করছিলাম, দাঁতে দাঁত চেপে। তোর কি মনে আছে ওই সময় তোকে একটা গাড়ি ধাক্কা মেরেছিল রাস্তায়?’

রুদ্র চমকে উঠল, ‘হ্যাঁ তো, তখন আমি সবে ইলেভেনে ভরতি হয়েছি। স্কুল থেকে সাইকেল চালিয়ে আসছিলাম, একটা গাড়ি এসে আমাকে ধাক্কা মেরেছিল। আমার ডান পা—টা ভেঙে গিয়েছিল! একমাস শুয়ে ছিলাম।’ পরমুহূর্তেই ও বলল, ‘কিন্তু ওটা তো একটা অল্পবয়সি ছেলে চালাচ্ছিল, বলেছিল নতুন শিখছে, ব্রেক কষতে গিয়ে ভুল করে অ্যাক্সিলারেটরে পা দিয়ে ফেলেছে?’

সুরঞ্জন বললেন, ‘ওসব সাজানো। সব মার্ক করিয়েছিল। খবরটা এসে আমাকে দিয়ে বলেছিল আমি আর বেগড়াবাঁই করলে আরও বড়ো ক্ষতি করবে তোর। ভেবেছিলাম আর কিছুদিন চুপ করে থাকি, তারপর ওদের আমার দরকার মিটে গেলে যে করেই হোক এখান থেকে পালাব। কিন্তু পরে বুঝলাম সেটা আর হবে না। এমনকী, কাজ ওদের পুরোপুরি মিটে গেলেও আমি ওদের এত কিছু জানি যে ওরা আমাকে আর বাঁচিয়ে রাখবে না। পালালেও পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে গিয়ে খুন করবে আমায়, বরং তার সঙ্গে ক্ষতি হবে তোদেরও।

‘দ্বিতীয় তেঞ্জ্যুরটার মানে যখন আস্তে আস্তে উদ্ধার করলাম, তখন বুঝতে পারলাম পদ্মসম্ভব তখনকার দিনে কত বড়ো বৈজ্ঞানিক ছিলেন। কতটা জটিল গবেষণার প্রণালী তুই ধারণাও করতে পারবি না, আমিও অত বিশদে বলতে গেলে তোর অনেক দেরি হয়ে যাবে। রাত ফুরোবার আগে তোকে এখান থেকে বের করে যে করেই হোক আমি উরায় পৌঁছে দিয়ে আসব। সংক্ষেপে বলি, স্যারের পাওয়া প্রথম তেঞ্জ্যুরটা ছিল গবেষণার উদ্দেশ্য আর বিষয়বস্তু। সেটা আগেই বলেছি। দ্বিতীয় তেঞ্জ্যুরটায় লেখা ছিল কীভাবে আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে সেখান থেকে লক্ষ লক্ষ ভোল্টের বিদ্যুৎশক্তি ছোটো ছোটো ইমপালসের আকারে পরিণত করে টেনে নিয়ে সঞ্চয় করে রাখতে হবে। এমন কোনো প্রাণী যার রক্ত ঠান্ডা, মানুষের রক্তের মতো গরম নয়, সেরকম একটা প্রাণীর মধ্যে জটিল একটা পদ্ধতিতে বিদ্যুৎটাকে সঞ্চয় করতে হবে। বেশিরভাগ প্রাণীই সেই শকে মরে যাবে, খুব স্ট্রং ইমিউনিটির দু—একজন বাঁচবে। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ ব্যবহারের উপযোগী হবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর। ততদিনে প্রাণীটার শরীরে পরিবর্তন দেখা দেবে, অতটা বিদ্যুৎ ভেতরে সঞ্চিত থাকার জন্য কিছু বিকৃতির আবির্ভাব হবে তার শরীরে। সেই নির্দিষ্ট সময়টা পেরোনোর পর সেই বিদ্যুৎ ব্যবহারের উপযোগী হবে, কিন্তু কীভাবে সেই শরীরের মধ্যে জমে থাকা বিদ্যুৎ বের করে কাজে লাগানো যাবে, সেটা ওই তেঞ্জ্যুরে বলা ছিল না, বরং লেখা ছিল সেই পদ্ধতিটা আরেকটা তেঞ্জ্যুরে লেখা আছে, সেটাই শেষ পার্ট।

মার্ক পুরোদমে কাজ শুরু করে দিল। লন্ডনে ওর লোকজনের সঙ্গে ঘন ঘন কথা হতে লাগল। সেখান থেকে ওদের দলেরই একজন পদার্থবিদ, রুডলফ, তাকে নিয়ে এল। রুড়লফ আর আমি মিলে প্রসেসটা শুরু করলাম। ঠান্ডা রক্তের প্রাণী মানে প্রথমেই মনে আসে সাপের কথা, তাই সাপ দিয়েই শুরু হল। কিন্তু এত ঠান্ডায় সাপ তো বাঁচেই না, তাই ঠান্ডার দেশে সাপ দেখতে পাওয়া যায় না বললেই চলে। কিন্তু মার্ক ওর বিশাল নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে খুব সম্ভবত জয়গাঁও বর্ডার দিয়ে বড়ো প্যাকিং বাক্সে করে লুকিয়ে সাপ নিয়ে আসতে লাগল। মোট দশটা সাপ আনা হয়েছিল। বর্ষাকাল আসতেই পদ্মসম্ভবের লিখে যাওয়া সেই প্রাচীন পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করা শুরু হল, প্রথমে তো অনেক ক’টা মরে গেল, শেষে তিনটে সাপ বেঁচে রইল। পদ্মসম্ভবের লেখা অনুযায়ী আট বছর লাগবে ওদের থেকে বিদ্যুৎ বের করতে। সেই আট বছর শেষ হয়ে এল প্রায়। সামনের সপ্তাহেই শেষ হবে সেই সময়কাল। তবে এখন ওদের দেখলে সাপ বলে আর চিনতে পারবি না। ড্রাগন মনে হবে।’

রুদ্র থ’ হয়ে শুনছিল। এ তো আরব্য রজনীর গল্প শুনছে মনে হচ্ছে। সাপের মধ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চয় করে আট বছর ধরে ট্রান্সফরেমশন! বাবা বলছেন, অবিশ্বাস করার প্রশ্নই নেই, তা ছাড়া ও নিজের চোখে জন্তুটাকে দেখেছে, কিন্তু এ তো পুরো অকল্পনীয় ব্যাপার।

ও বলল, ‘ড্রাগন তার মানে সত্যিই ছিল!’

‘ছিল। কিন্তু ড্রাগন কোনো আলাদা প্রজাতির প্রাণী নয়, কিছু সরীসৃপের বিকৃত রূপ। পদ্মসম্ভব এরকম অনেকগুলো ঠান্ডা রক্তের সরীসৃপকে ড্রাগনে রূপান্তরিত করেছিলেন। এই আমূল পরিবর্তনকে ইংলিশে কী বলে জানিস তো, মেটামরফোসিস। উনি লিখেছিলেন এতটা বিদ্যুৎশক্তি ভেতরে থাকার কারণে সাপগুলোর দেহে বিকৃতি দেখা দিত, সেটাকেই পুরাণে ড্রাগন হিসেবে বলা হয়েছে, এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অপভ্রংশ, মানুষের কল্পনা মিশে ড্রাগনকে এক মিথে পরিণত করেছে। এবার এই আটটা বছর কীভাবে ওদের রাখতে হবে, কোন কোন দিকে নজর দিতে হবে, তার বিশদ বিবরণ লেখা ছিল ওই তেঞ্জ্যুরটায়। আট বছর ধরে সেই কাজটাই করে চলেছি আমি।’

রুদ্র বলল, ‘কিন্তু একটা জিনিস আমার কাছে কিছুতেই ক্লিয়ার হচ্ছে না! মার্কদের গ্যাংটা বললে ইউরোপের নামকরা একটা আর্ট চুরির দল, তারা এরকম একটা স্পেসিফিক ব্যাপার, যেটার শেষে কী বেরোবে, আদৌ কিছু বেরোবে কি না, তার কোনো ঠিক নেই, সেটার পেছনে এতদিন ধরে এত সময় নষ্ট করবে কেন! যতই ওই ক্রমওয়েল সমঝদার লোক হোক না কেন, আলটিমেটলি ও একটা অ্যান্টিক স্মাগলার ছাড়া তো আর কিছুই নয়!’

সুরঞ্জন বললেন, ‘হুম, এটা আমারও প্রথমদিকে মনে হত। তারপর এদের খুচখাচ কথাবার্তায় বুঝতে পারি প্রথমদিকে এই ব্যাপারটা ওদের কাছে অতটা ইম্পর্ট্যান্ট ছিল না, কিন্তু ক্রমওয়েল অ্যালফ্রেড ওদের দলের আরও বাকি কয়েকজন চাঁই পরপর ধরা পড়ে যেতে ওদের ইউরোপে প্রতিপত্তি অনেক কমে গেছে, ওখানে আর সেরকম লোকবলও নেই যে নতুন কোনো কিছু চুরি করবে, তাই এখন এটাকেই শেষ সম্বল হিসেবে ধরেছে। আরও একটা কারণ আছে,’ সুরঞ্জন একটু থেমে বললেন, ‘মার্ক এখানে চলে আসার পর দলটা প্রায় ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছিল। অ্যালফ্রেডের ছেলে এখন হাল ধরতে চাইছে, যদিও সেটা মার্কের একদমই পছন্দ নয়।’

‘তুই ভাবছিস ইউরোপের বৈভব ছেড়ে এই জঙ্গলে পড়ে রয়েছে, স্বার্থ থাকলেও মার্ক কতটা বিজ্ঞানপ্রেমী, তাই তো! এবার ও নিজে কতটা বিকৃত শোন। পদ্মসম্ভব যে প্রক্রিয়াটা সাপের ওপর অ্যাপ্লাই করতে লিখেছেন, সেটা ও মানুষের ওপরেও করে দেখেছে কী হয়। পেমা লিংপা আর তাঁর ওই চাকর, যাদের ওরা খুন করেছিল, তাঁদের মৃতদেহ দুটোতে একই কায়দায় বাজ পড়ার সময় পদ্মসম্ভবের পদ্ধতিটা অ্যাপ্লাই করা হয়। লাভ কিছুই হয়নি, কিন্তু দুটোর পচন বন্ধ হয়ে যায়, একরকম ফ্যাকাশে রঙের হয়ে গিয়ে অবিকৃত রয়েছে।’

রুদ্র চমকে উঠল, ‘মানে, ওপরে যে লামাকে দেখেছিলাম উনিই পেমা লিংপা!’

সুরঞ্জন বললেন, ‘হুম। আতঙ্কের একটা পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য ওই দুটো মৃতদেহকে ওইভাবে সাজিয়ে রেখে ওই তোরা কী যেন বলিস, জোম্বি তৈরি করেছে। যাতে কোনো গ্রামবাসী কদাচিৎ এটার খোঁজ পেলেও ভয়ে পালিয়ে যায়। আমিও যাতে আমার এই পরিণতির কথা চিন্তা করে বেফাঁস কিছু না করে বসি।’

‘কী সাংঘাতিক! কিন্তু মার্কদের তো বললে অ্যান্টিক চুরির ব্যাবসা, ওরা কী করবে এই গবেষণাটায় সফল হলে? মানে, ওদের এতে কী লাভ সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’

‘সেটা আমিও প্রথমে ভাবতাম, তারপর বছর পাঁচেক আগে কেলি, মানে অ্যালফ্রেডের ছেলে এল তখন আস্তে আস্তে জিনিসটা ক্লিয়ার হল। কেলি চায় ওর উত্তরাধিকার—সূত্রে পাওয়া চোরের বদনাম ঘোচাতে। সে নিজে কিছুদিন ফিজিক্স নিয়ে পড়েছিল, মাঝপথে পড়া ছেড়ে দেয়, কিন্তু মনে মনে স্বপ্ন দেখে নিউটনের মতো সায়েন্টিস্ট হবে। ওদের মতলব হল এই গবেষণায় যদি ও সফল হয়, সারা বিশ্বে হইহই পড়ে যাবে। আমার অবশ্য মনে হয়েছে একদিকে মার্কও চায় সফল হয়ে ফর্মুলাটা আদায় করতে, ওদিকে কেলিও তাই চায়। এদেরকে কিছুই বিশ্বাস নেই, বড়ো কোনো অসৎ উদ্দেশ্যও থাকতে পারে, এই বিকৃত ড্রাগন পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করা, নিজেদের ইচ্ছেমতো ড্রাগনগুলোকে দিয়ে যা খুশি করানো, কিংবা এই গবেষণার ফলাফলকে আরও খারাপ কাজে ব্যবহার করা, সবই হতে পারে।’

রুদ্র শুনছিল, ‘তাহলে আট বছরের কোটা কমপ্লিট হয়ে গেলেই তোমাকে ছেড়ে দেবে?’

সুরঞ্জন ক্লিশে হেসে চোখ বন্ধ করে দু—দিকে মাথা নাড়লেন, ‘কী যে বলিস! বললাম তো, আমার আর মুক্তি নেই এদের হাত থেকে। আট বছর শেষ হতে তো আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। ওদিকে শেষ যে তেঞ্জ্যুরটায় লেখা ছিল কীভাবে আট বছর পর শক্তিটাকে ব্যবহার করতে হবে, সেটা মার্ক উদ্ধার করে ফেলেছে।’

‘সেটা কি আবার এর থেকেও ভেতরে কোনো গুম্ফার মধ্যে ছিল?’

‘না। সেও আরেক কাণ্ড। যখন আট বছর আগে এই তেঞ্জ্যুরটা উদ্ধার করি, তখন মার্ক আমাকে চাপ দিয়ে যাচ্ছিল মূল ব্যাপারটা শুরু করার আগে আমি যেন এটা বের করি যে তৃতীয় তেঞ্জ্যুরটা কোথায় রয়েছে। এবার এখান থেকে পাওয়া তেঞ্জ্যুরটা মাটির তলায় এতকাল পড়েছিল বলে শেষ দিকটা খুব অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তার ওপর ডাকিনী স্ক্রিপ্ট এমনিই খুব পেঁচালো হয়। তবু শেষদিকটায় পদ্মসম্ভবের দুঃখ, হতাশা ছত্রে ছত্রে ধরা পড়েছিল। এক জায়গায় উনি লিখেছিলেন, গোঁড়া বজ্রসাধকরা বার বার চাপ দিচ্ছে এই গবেষণাকে মাঝপথে থামানোর জন্য, তাই উনি আট বছর আর অপেক্ষা করতে পারছেন না। এমনকী উনি এ—ও আশঙ্কা করেছিলেন ওঁর লিখে রাখা এই গবেষণার তেঞ্জ্যুরগুলোও ওরা ধ্বংস দিতে পারে। বহু পৃষ্ঠা ধরে ওঁর এই মাঝপথে ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ার কথা লিখেছেন উনি। মানে, তৃতীয় তেঞ্জ্যুরে যা লেখা আছে সেটা পুরোটাই অনুমানের ওপর লেখা, প্রথম বা দ্বিতীয়টার মতো গবেষণা করে ফল পাওয়ার পর লেখা নয়। পদ্মসম্ভব আট বছর সময় আর দিতে পারেননি। তার আগেই খুব সম্ভবত ওঁর মৃত্যু হয়। তাই ওঁর এক অনুগামীকে দিয়ে তৃতীয় তেঞ্জ্যুরটা একটা সংরক্ষিত জায়গায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন এমন লেখা আছে শেষটায়। তারপর আর কিছু পড়াই যাচ্ছিল না।’

‘তারপর? কী করে বের করলে সেটা কোথায়?’

‘মার্ককে ব্যাপারটা বলতে ও কেলির মারফত অনেক লাইব্রেরিতে গিয়ে পুরো নথিপত্র ঘাঁটত শুরু করল। কোথা থেকে খবরটা বের করল আমি ঠিক জানি না, তবে একদিন আমাকে মার্ক বলল, তখনকার দিনের অন্যান্য যোগীদের লেখা পড়ে জানা গেছে, পদ্মসম্ভব দ্বিতীয় বুদ্ধ হিসেবে বজ্রযান ধর্মের কাছে পরিচিত হলেও জীবনের একদম শেষদিকটায় ওঁর এই গবেষণার জন্য অনেক যোগীরাই ওঁর প্রতি বিরূপ হয়েছিলেন। ওঁর সব অনুগামীই এই ব্যাপারটা থেকে ওঁকে বিরত করতে থাকেন, শুধু একজন ছাড়া। একমাত্র সেই শিষ্যই ওঁর সঙ্গে শেষ দিন পর্যন্ত এই গবেষণায় সঙ্গ দিয়ে গেছেন। মার্ক জানতে পারে যে, ওই শিষ্যটি পদ্মসম্ভবের মৃত্যুর পর পরিব্রাজক হয়ে যান। তখনকার দিনে তিনি পাকিস্তান, বেলুচ পেরিয়ে ইরান, টার্কি হয়ে চলে যান ইউরোপে। সেখানে এক বৌদ্ধ মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। মার্ক সেই মনাস্টারিটার ওপর বহুবার হামলার চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। অবশেষে মাসখানেক আগে ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে। কাকতালীয়ভাবে ওই মনাস্টারির লামারা এক এগজিবিশনে নিয়ে আসছিলেন তেঞ্জ্যুরটা দেখাবার জন্য, মার্ক ওখান থেকে লোক লাগিয়ে তেঞ্জ্যুরটা ছিনতাই করায়।’

রুদ্র উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, এটা আমি পড়েছি তো! লন্ডনের ড্যামফ্রেসশায়ারের একটা মঠের লামাদের থেকে একটা দুষ্প্রাপ্য পুথি চুরি হয়েছে।’

সুরঞ্জন বললেন, ‘হ্যাঁ, ওটা মার্কেরই কাজ। এবার সেই তেঞ্জ্যুরটা নিয়ে কাজ শুরু করতে হয়েছে আমাকে। মুক্তি নেই! তেঞ্জ্যুরটা এমনিই পুরো অনুমানের ওপর ভিত্তি করে লেখা তার ওপর বিভিন্নরকম অঙ্কের ধাঁধা, আমি তো অর্ধেক কিছু বুঝতেই পারছি না! কী করে কাজ শেষ হবে জানি না। আর যদিও—বা কাজ শেষ হয়, এরা আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। দু—দুটো খুনের সাক্ষী আমি, আমার দরকার ফুরোলেই মেরে ফেলবে আমাকে। তাই তোর আসার খবর যখন পেলাম ঠিক করেছিলাম আমি মরি মরব, তোর যেন কোনো ক্ষতি না হয়!’

‘আমি আসব তুমি জানতে!’

‘কয়েকদিন আগে জেনেছিলাম। এখানে সারাক্ষণ থাকি আমি, মার্কের দুটো গুন্ডা মরিস, অ্যান্ড্রু আর রুডলফ। মার্ক লুংদোপেদরি থেকে দিনে বারকয়েক আসা যাওয়া করে। কেলি বছর দুয়েক আগে একবার এসেছিল, খুব শিগগির আবার আসবে। লুংদোপেদরি থেকে দিনে দু—বার খাবার দিয়ে যায়। কতদিন ঠিক করে দিনের আলো দেখিনি। একবার বছর তিনেক আগে পালাতে গেছিলাম, মরিস লোহার রড গরম করে পায়ে চেপে রেখে দিয়েছিল, সে—দাগ এখনও রয়েছে। তারপর থেকে আর চেষ্টা করিনি! কী হবে! নিজেরও ক্ষতি, তোদেরও ক্ষতি।’

সুরঞ্জন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘এই ঘরটা কিন্তু মাটির তলায় নয়, পেছনদিকে। এটাতেই থাকি আমি। তোর আসার কথা মার্ককে স্যারের ভাইপো, অবিনাশ না কী নাম, ফোন করে জানিয়েছিল।’

রুদ্র হতবাক হয়ে গিয়ে বলল, ‘অবিনাশবাবু! তিনি তো নিজে আমার কাছে লোনের ব্যাপারে এসেছিলেন! তাঁর বাড়ি গিয়ে আমি প্রথম তোমার স্যারের আঁকা ছবি দেখতে পাই। তোমার মার্কের সঙ্গে ওঁর পরিচয় হল কী করে!’

সুরঞ্জন বললেন, ‘তোকে তো সেটাই বলছি, মার্কের নেটওয়ার্ক কতটা লম্বা তোর ধারণা নেই। ওই অবিনাশের সঙ্গে যোগসাজশ করেই তো স্যারকে খুন করেছিল মার্ক। অবিনাশ ভয় পেত, যদি স্যার বুড়ো বয়সে গিয়ে সম্পত্তির ভাগ চান। স্যারের যে কোনোদিনই পার্থিব জিনিসের প্রতি মোহ ছিল না, সেটা যদি ওরা বুঝত। শুধু অবিনাশ নয়, আরও একজন শরিক সুদেবকে হাত করেছিল মার্ক। ওরা দু—জন স্যারকে খুনের পেছনে মদত দেয়। এর জন্য প্রচুর টাকাও পেয়েছে ওরা। তাতেও ওদের হচ্ছে না, ওদের ধারণা এখানে কিছু গুপ্তধন লুকোনো রয়েছে, ওরা তাতেও ভাগ বসাতে চায়।’

‘তুই যে ওদের বাড়ি গিয়ে সব দেখে এসেছিস সেসব জানতে পারে মার্ক। তোকে বোধ হয় অবিনাশ বাধা দেওয়ারও চেষ্টা করেছে। কিন্তু ওরা এটা ধারণা করতে পারেনি যে তুই লুংদোপেদরির হদিশ পেয়ে যাবি। ইন ফ্যাক্ট আমার ধারণা, ওরা ভেবেছিল তুই ভুটানে এলেও আসল জায়গাটা খুঁজে পাবি না। আমিও জানতে পারতাম না যদি আমাকে সুদেব বলত!’

‘সুদেব মানে অবিনাশবাবুর আরেক শরিক?’

‘হুম। ও মার্কের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এককালে কাজ করলেও এখন জোর খিটিমিটি লেগেছে মার্কের সঙ্গে। ও—ই আমাকে প্রথম বলে যে তুই এখানে আসছিস। সুদেব তোদের ট্রেনেই আসছিল।’

রুদ্র চমকে উঠল। প্রিয়ম ওই লোকটার নাম বলেছিল শুধু চৌধুরী, সে—ই তার মানে অবিনাশ চৌধুরীর আরেক জ্ঞাতি! ও বলল, ‘হুম, আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু সঙ্গে আরেকটা বিদেশি লোক ছিল আর একটা ভুটানি। তারা কারা?’

সুরঞ্জন বললেন, ‘ওহ, তুই খেয়াল করেছিস? ওর সঙ্গে এবার রুডলফ গিয়েছিল কলকাতায় একটা কাজে, তুই ওকেই দেখেছিস। ভুটানি তো কেউ ছিল না! হয়তো রাস্তায় কেউ উঠেছিল গাড়িতে। আগে তোদের গতিবিধির দিকে নজর সুদেবকেই রাখতে হত, কাজেই তোকে ট্রেনে চিনতে ওর কোনো অসুবিধা হয়নি। তারপর উরায় আসার পর আমি দেচেনকে পাঠালাম সুদেবের কথাটা সত্যি কি না যাচাই করতে। কিন্তু সে বেচারা একেই কথা বলতে পারে না, তারপর রাতের অন্ধকারে কিছু বুঝেও উঠতে পারেনি। তারপর পরশু এসে ইশারায় বোঝাল তুই ওকে দেখতে পেয়ে তাড়া করে খুব পিটিয়েছিস। তখনই তোদের লুংদোপেদরি অবধি আসার কথা জানতে পারলাম। কিন্তু আমি কল্পনাও করতে পারিনি তুই এইখানে এসে হাজির হবি! তারপর কাল দেচেন এসে বলল তোরা গিয়ে মার্কের সঙ্গে দেখা করেছিস। মার্ক তোর ওপর নজর রেখেছে ঠিকই, কিন্তু ধারণা করতে পারেনি তুই এখানকার খোঁজ পেয়ে যাবি। আর এমনিতেও কেলি আসবে বলে ও এখন খুব ব্যস্ত। মার্ক আর মরিস দু—জনেই কাল রাতে কেলিকে আনতে বেরিয়ে গেছে। তাই ড্রাগনের ঘরে কেউ ঢুকেছে বুঝতে পেরে আগে আমি তোকে অজ্ঞান করে দিয়েছিলাম, যদি তুই চিৎকার করিস বা অন্য কারোর চোখে পড়িস।’

‘দেচেন কি তোমার দলে? না ওদের দলে?’

‘অবশ্যই ও এদের বিরুদ্ধে। স্যারকে, পেমাজিকে ওর চোখের সামনে খুন করা হয়েছে, আর সে বেচারি কী করে ওদের সাপোর্ট করে! স্যার খুন হবার পর ও এখানে চলে আসে। কিন্তু এখানে এসেও এদের হাত থেকে রেহাই পেল না।’

বলেই সুরঞ্জন সচকিত হয়ে উঠলেন, ‘বাইরে পাখি ডাকছে। আর দেরি করা চলবে না। চল, তোকে বাইরের রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে আসি। যেকোনো মুহূর্তে মার্ক এসে পড়তে পারে। রুডলফও এবার উঠে পড়বে। তখন কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’

রুদ্র বলল, ‘তুমিও আমার সঙ্গে বাইরে চলো।’

সুরঞ্জন ম্লান হাসলেন, ‘পাগল মেয়ে! আমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই পালাই, মার্ক আমাকে ঠিক খুঁজে বের করবে। তাই পালানোর চেষ্টা করা বৃথা। বরং তোরা ভালো থাক, সুখে থাক, তাতেই আমার আনন্দ। যদি কোনোদিন সুযোগ আসে, ফেরার চেষ্টা করব আপ্রাণ। কিন্তু তুই আমাকে কথা দে, এদিকে আর পা মাড়াবি না।’

রুদ্র বলল, ‘আচ্ছা, লুংদোপেদরিতে গিয়ে তো মার্ককে দেখতে পেলাম না! দামাজি, দু—একটা চাকর গোছের লোক ছাড়া তো কাউকেই চোখে পড়ল না! এদিকে তুমি বলছ মার্ক লুংদোপেদরিতে থাকে?’

সুরঞ্জন কাষ্ঠহাসি হাসলেন, ‘এখনও বুঝিসনি! লুংদোপেদরির দামাজি—ই মার্ক। পেমাজিকে খুন করে ও—ই এখন ওই মনাস্টারির সর্বেসর্বা হয়ে বসেছে।’

রুদ্র অবাক হয়ে গেল। দামাজির জড়ানো ইংলিশ, দামি বিদেশি কুকুর দেখে ওর মনে খটকা লেগেছিল, কিন্তু পেমা লিংপার খুনি, সমস্ত কিছুর পাণ্ডা মার্কই যে ছদ্মবেশী দামাজি তা ও ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি।

ওই জন্য এত গোপনীয়তা! মুখ তুলে দেখল বাবা দরজা খুলে বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ও অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘আচ্ছা অঙ্কের ধাঁধার ব্যাপারে কী বলেছিলে?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *