ঈশ্বর যখন বন্দি – ২

পরের দিন রুদ্র যখন অফিস থেকে ফিরল, তখন প্রিয়ম ল্যাপটপে বহু পুরোনো প্রেগরি পেকের একটা সাদা কালো সিনেমা দেখতে ব্যস্ত। পুরোনো হলিউডি ক্লাসিক ওর ভীষণ প্রিয়। আজকের দিনটা বিশ্রাম নিচ্ছে বাড়িতে। কাল থেকে অফিস জয়েন করবে। রুদ্রকে ঢুকতে দেখে ও খুশি হয়ে বলল, ‘বাহ! আজ বেশ তাড়াতাড়ি এসে গেছ তো! ভালোই হয়েছে। চিকেন কিনে নিয়ে এসেছি। আজ আমি জমিয়ে রান্না করব। দুটো প্রিপারেশন সর্ট আউট করেছি, লেমন চিকেন আর চিকেন কালিমির্চ। অন্য কিছুর অপশন দিতে পারছি না কারণ একমাত্র এই দুটোরই সব মালমশলা মজুত আছে। বলো, কোনটা খাবে?’

রুদ্র ওর ব্যাগটা খাটের এক কোণে ছুড়ে দিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিল, ‘তার আগে বলো, প্লেনে যাব, না ট্রেনে? আমারও একমাত্র এই দুটোই অপশন আছে। অতীশ দীপঙ্করের মতো পায়ে হেঁটে তো আর যেতে পারব না, ওঁর মতো তিব্বত তো কোন ছার, হাওড়া স্টেশন অবধি হাঁটতে হলেই উলটে পড়ব। আরও একটা জিনিস বলতে হবে, কী বলে অফিস থেকে ডুবটা দেব, নিজের শরীর খারাপ? নাকি তোমার? এক্ষেত্রেও দুটোই অপশন। নর্মাল প্ল্যানড লিভ অ্যাপ্লাই করলে তো আর ছুটি পাব না, ঠিক কোনো—না—কোনো কারণ দেখিয়ে রিজিওনাল অফিস থেকে ডিফার করে দেবে।’

প্রিয়ম ভ্রূ কুঁচকে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকাল, ‘মানে? কোথায় যাবে?’

রুদ্র বিনুনিটা খুলতে খুলতে বলল, ‘কোথায় আবার? ভুটান। সব ব্যবস্থা মোটামুটি করে ফেলেছি। হাতে পয়সাকড়ি বিশেষ নেই। এল টি সি—টা এনক্যাশ করিয়ে নেব ভাবছি, যতই প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র হোক, বিদেশবিভুঁই বলে কথা, তার ওপর নেটে দেখলাম বেশ কস্টলি। ওদের যেটা কারেন্সি, নুল্ট্রাম বলে, সেটা আমাদের টাকার সমানই প্রায়।’

‘তার মানে বিনোদ বিহারীর ম্যাপটা খুঁজে পেয়েছ তুমি?’ প্রিয়মের গলায় বিস্ময়, ‘আজকে আবার ওই ভূতুড়ে বাড়িতে হানা দিয়েছিলে বুঝি?’

‘হ্যাঁ এবং না!’

‘মানে? এগুলো কী ধরনের হেঁয়ালি হচ্ছে?’

রুদ্র একপাশে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে পড়ে থাকা ওর ডাঁই করা জামাকাপড়ের স্তূপটার মধ্যে প্রায় অর্ধেকটা ঢুকে গিয়ে একটা কোঁচকানো জামা সরসর করে বের করে নিয়ে মিষ্টি হেসে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলল, ‘তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর হল, হ্যাঁ। মানে আমি ম্যাপটা খুঁজে না পেলেও যাওয়ার রাস্তাটার ধারণা করতে পেরেছি। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হল, না। আজ আমি ওই ললিতভবনে যাইনি। ইন ফ্যাক্ট, যাওয়ার আর দরকার পড়বে বলে মনেও হয় না। বরং ম্যাপটা খুঁজে পাওয়ার জন্য থ্যাংকসটা কিছুটা হলেও তোমার প্রাপ্য।’

প্রিয়ম তড়াক করে খাট থেকে লাফিয়ে পলায়মান রুদ্রর আধখোলা বিনুনিটা ধরে টান মেরে কাছে নিয়ে এল, ‘অনেকক্ষণ ধরে বাঁদরামি সহ্য করছি। এইসব হেঁয়ালি আমার মোটেও ভাল্লাগে না। চুপ করে এখানে বসে বলো আবার নতুন কী গোল পাকিয়েছ। আর পাঁচ মাস ধরে এখানে পড়ে থাকা এই জামাগুলোতে ছাতা পড়ে গেছে। পরলে স্কিন ডিজিজ অনিবার্য। এটাকে ফেলে ও’ঘরের ওয়ার্ডরোবে মাসি জামাগুলো ভাঁজ করে রেখে গেছে, সেখান থেকে নাও। সেই পিপুফিশুর গল্প পড়েছিলাম না, দুই কুঁড়ে একটা বাড়ির মধ্যে শুয়ে আছে, বাড়িটাতে আগুন লেগে গেছে, তবু তারা এত কুঁড়ে যে বিছানা থেকে উঠছে না, একটা কুঁড়ে আরেকটাকে বলছে পি পু, মানে পিঠটা পুড়ছে। আরেকটা কুঁড়ে তখন উত্তর দিচ্ছে, ফি শু, মানে ফিরে শুই। ওই দু—জনও তোমাকে দেখে লজ্জা পাবে! শিগগির জামাটা হাত থেকে ফেলো। আর থ্যাংকসটা যখন এই শর্মারই প্রাপ্য, তখন তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ সব কিছু বলে উপযুক্ত সম্মানটুকু অন্তত দেখাও।’

রুদ্র কপট রাগের ভঙ্গি করে বিছানায় বসে বলল, ‘ঠিক আছে, বলছি। আগে এক কাপ কড়া করে কফি খাওয়াও দেখি। মাথাটা বড্ড ধরে আছে দুপুর থেকে।’

‘তা সেটা ঝেড়ে কাশলেই হয়! এক মিনিটে হাজির করছি ম্যাডাম।’ প্রিয়ম এক গাল হেসে রান্নাঘরের দিকে ছুট মারল।

কফি করে নিয়ে এসে প্রিয়ম যখন ঘরে ঢুকল, রুদ্র তখন একটা পাতায় আঁকিবুঁকি কাটছে। প্রিয়ম ট্রে—টা খাটের ওপর রেখে বলল, ‘এবার বলো, ম্যাপটা কোথায় পেলে?’

রুদ্র কফিতে লম্বা একটা চুমুক দিল, ‘বিনোদ বিহারী লোকটার সম্পর্কে যতই জানছি ততই শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে। একজন ওইরকম প্রতিভাবান ছাত্র খ্যাতির চূড়ায় উঠতে পারতেন, প্রোফেসর হিসেবে কত সম্মান পেতে পারতেন, দেশ—বিদেশে সেমিনার কনফারেন্সের বিলাসিতায় জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতেন, সেসব কিচ্ছু না করে শুধুমাত্র একটা অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কতগুলো সমালোচককে জবাব দেওয়ার জন্য সারা জীবনটা একটা অজানা সত্যের অনুসন্ধানে কাটিয়ে দিলেন। আমার অনুমান ভুল ছিল না। বিনোদ বিহারী বাবাকে ম্যাপটার হদিশ দেওয়া ছাড়াও আরও একজায়গায় ম্যাপটা রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু উনি জানতেন যে বুমথাং—এর সেই হামলার পুনরাবৃত্তি এখানেও ঘটতে পারে। তাই সেটাকে উনি এমনভাবে রেখেছিলেন যাতে সবার চোখের সামনেই সেটা থাকে অথচ বোঝা না যায়।

এখন কথা হচ্ছে, কোথায় রাখতে পারেন? ওঁর রাখার জায়গা বলতে তো শুধুমাত্র ওই ঘরটা। সবাই ওই ঘরে ম্যাপ খুঁজতে হলে ওঁর জিনিসপত্রের মধ্যেই খুঁজবে। খুনের পরেও চোরের হামলা দেখে বুঝতে পারছিলাম যে আর যাই হোক, ওঁকে খুন করবার সময় ফরেস্টিয়ারের দল ম্যাপটা পায়নি। ঘরটা দেখেও বুঝলাম সেগুলোকে আমার যাওয়ার আগে একাধিকবার ঘাঁটা হয়েছে। এমনকী, কিছু জিনিস হয়তো তার খুন করার পরে নিয়েও গেছিল যেগুলো কী কী ছিল তা এখন আর বলা যাবে না। তবে সেগুলো নিয়ে আমি বেশি মাথা ঘামায়নি, কারণ সেগুলোর মধ্যে ওরা কোনো ক্লু পেলে দ্বিতীয় হামলাটা করত না।’

প্রিয়ম মাঝপথে বাধা দিয়ে বলল, ‘কিন্তু ওদের তো ওঁকে বাঁচিয়ে রাখাটাই লাভজনক ছিল, তাই নয় কি? মেরে ফেলে তো আর ম্যাপটা ওঁর মুখ থেকে বের করা যাবে না।’

‘হুম, সেটা আমিও ভেবেছি। এই ব্যাপারে একটাই ব্যাখ্যা হয় সেটা হল, খুব সম্ভবত ফরেস্টিয়ার এই দেশের কোনো সাধারণ ভাড়াটে গুন্ডার দলকে লাগিয়েছিল বিনোদ বিহারীর বাড়িতে হানা দিয়ে তাঁর ঘরের যাবতীয় জিনিস লুঠ করে আনার জন্য। আর ওই ভাড়াটে গুন্ডার দল উত্তেজনার বশে বা ওই দেচেনের কাছ থেকে হয়তো বাধা পেয়ে বিনোদ বিহারীকে খুন করে ফেলে। আর এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমার ছোট্ট আশাটা।’ রুদ্রর গলাটা ধরে এল, ‘লজিক্যালি যদি ভাবি, বিনোদ বিহারী মারা যেতে আর যিনি একমাত্র পারতেন সেই গোপন গবেষণাগারে নিয়ে যেতে, তিনি হলেন আমার বাবা। বাবাকে কিডন্যাপ করা হয় বিনোদ বিহারী খুনের মাস তিনেকের মধ্যেই এবং বিনোদ বিহারীর বাড়িতে দ্বিতীয়বার চোরের হামলার পর থেকেই। তার মানে একটাই দাঁড়ায়, এইবার ফরেস্টিয়ার নিশ্চয়ই কোনো সাধারণ গুন্ডাকে পাঠাবার ভুল করেনি। এই যুক্তিতে এগোলে বাবা বেঁচে থাকার সম্ভাবনাটা অনেক জোরালো হয়।’ রুদ্রর চোখটা আশায় চকচক করছিল।

‘তার মানে তুমি বলতে চাইছ, ওরা বিনোদ বিহারীকে খুনের সময়েও ম্যাপটা পায়নি, পরে হামলার সময়েও নয়, তাই বাবাকে কিডন্যাপ করেছিল যাতে উনি পথ দেখিয়ে নিয়ে যান।’

‘ঠিক তাই।’

রুদ্র ডায়েরিটা খুলল, ‘এইবার দ্যাখো আরেকটা মজা। তুমি যখন কাল বললে যে বিনোদ বিহারীর অঙ্কের প্রতিও শখ ছিল কি না, তখন আমি ভেবেছিলাম হয়তো ওঁর আগে ওই ঘরে কেউ থাকত যে অঙ্কের ছাত্র ছিল, ওগুলো তারই কীর্তি। কিন্তু, আজ অবিনাশবাবু ওঁর লোনের প্রথম ইনস্টলমেন্টটা নিতে এসেছিলেন, ওঁকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, বিনোদ বিহারীর আগে ওই ঘরে যে ক—জন ছেলে থাকত, তারা কেউই অঙ্কের ছাত্র ছিল না, বরং বিনোদ বিহারীর নিজেরই অঙ্কের প্রতি খুব আগ্রহ ছিল, বিশেষত সংখ্যা নিয়ে খেলা করতে উনি খুব ভালোবাসতেন। বুড়ো বয়সে বাড়ি ফিরে আসার পর অবিনাশবাবুর ছেলেমেয়েকে দু—একবার সংখ্যা নিয়ে অনেক ম্যাজিকও দেখিয়েছিলেন।’ রুদ্র একটু থামল, ট্রে থেকে একটা বিস্কুট তুলে নিয়ে কফিতে চুবিয়ে কামড় দিল, ‘তারপর বিকেলের দিকে অফিসে গিয়ে একটু ফাঁকা ছিলাম, ফোনে আলগোছে ছবিগুলো দেখছিলাম, তখন একটা খটকা লাগল। ভালো করে দেওয়ালের অঙ্কগুলো দেখে খেয়াল করলাম, প্রাথমিকভাবে কোনো ছাড়া সংখ্যা মনে হলেও ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে, ওগুলো দুটো দুটো করে সংখ্যার জোড়।’

রুদ্র ল্যাপটপ থেকে ছবিটা খুলল। ঘরের দেওয়ালের ছবিটাকে জুম করে বলল, ‘দেখো, সারি দিয়ে পরপর লেখা (০,০), (৩,৫), (৪,৭)। এগুলোকে একনজরে দেখলে তোমার কী মনে হয়?’

প্রিয়ম কিছু না ভেবেই হেসে বলল, ‘কিছুই মনে হয় না। মনে হয় মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষার গ্রাফের অঙ্ক করছি।’

রুদ্র উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘কারেক্ট! আমারও সেটাই মাথায় এসেছিল। বিশেষ করে শুরু যখন (০,০) দিয়ে হয়েছে। আমি কী করলাম জানো, একটা লম্বা সাদা কাগজ নিয়ে লম্বালম্বি এক্স অ্যাক্সিস আর ওয়াই অ্যাক্সিস টেনে (০,০) থেকে শুরু নম্বরগুলো প্লট করা শুরু করলাম। কী সাংঘাতিক দূরদর্শিতা বুঝতে পারছ ওঁর? উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ফরেস্টিয়ারের ভাড়াটে গুন্ডারা ওঁর জিনিসপত্রের মধ্যেই ম্যাপটাকে খুঁজবে, তাই তিনি দেওয়ালে এমনভাবে পুরো জিনিসটা লিখে রেখেছিলেন যে কেউ ধারণাই করতে পারবে না যে ওর মধ্যে কোনো মাপের হদিশ লুকিয়ে আছে।’ রুদ্র ডায়েরিটা খুলে ওর ওই পয়েন্টগুলো থেকে প্লট করে আঁকাবাঁকা লাইনটা দেখাল।

‘কিন্তু তুমি কি শিয়োর যে এই নাম্বারগুলোই ওঁর ম্যাপের সংকেত? তুমি না হয় সব পয়েন্টগুলা প্লট করে একটা গতিপথ পেলে কিন্তু শুরুটা কোথা থেকে কী করে বুঝবে? মানে, (০,০) পয়েন্টটা আরম্ভ হবে কোথা থেকে? সেটা কি বুমথাং—এর ওই কী—একটা মনাস্টারি বললে সেখান থেকে শুরু নাকি অন্য কোথাও থেকে সে—ব্যাপারে তো কিছুই বলা নেই।’

‘শিয়োর বলতে কিছুই নেই, তবে গেস করছি, কিন্তু ওয়াইল্ড গেস নয়, ওয়াইজ গেস। বিনোদ বিহারী নিজে জানতেন, যেকোনো সময় তাঁর ওপর হামলা হতে পারে, তাই বাবাকে ম্যাপটা দিয়েছিলেন, কিন্তু বাবাও যদি বিপদের মুখে পড়েন? তাই ব্যাকআপ হিসেবে অন্য কোথাও ম্যাপটা লুকিয়ে রাখবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তবে হ্যাঁ, শুরুটা কোথা থেকে বলা নেই, আর এই ব্যাপারটাই আমাকে ভাবাচ্ছে। শুরুটা যে বলা নেই শুধু তাই নয়, স্কেল সম্বন্ধেও কোনো ইঙ্গিত দেওয়া নেই। মানে একটা পয়েন্ট থেকে আরেকটা পয়েন্ট আসলে কতটা দূরত্ব কভার করছে, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। আর একদম শেষে কিন্তু দ্যাখো ২০ কিমি কথাটা আলাদাভাবে লেখা রয়েছে। সেটাও ঠিক বুঝতে পারছি না। কিছু একটা ক্লু এর মধ্যে লুকিয়ে নিশ্চয়ই রয়েছে। সেটা ভেবে বের করতে হবে। মনে হয় বিনোদ বিহারী নিজের সুবিধের জন্যই ওরকমভাবে লিখে রেখেছিলেন, যাতে পরে ওঁর নিজের বুঝতে অসুবিধা না হয়। উনি হয়তো ধারণাই করতে পারেননি যে এর জন্য ওঁকে নিজের জীবন দিয়ে মাশুল গুনতে হবে।’ রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘তাহলে?’

রুদ্র ডায়েরিটা বন্ধ করে ল্যাপটপ খুলতে খুলতে বলল, ‘তাহলে আবার কী। আমাকে একটা ঝুঁকি নিতে হবে। দুটো রাস্তা হতে পারে। হয় উনি উত্তরবঙ্গ গিয়ে আমাদের বর্ডার শহর জয়গাঁও পেরিয়ে ওপারের ফুন্টশোলিং পৌঁছেছিলেন, সেইখান থেকেই ম্যাপটা আঁকা শুরু করেছেন আর নয়তো ওই বুমথাং—এর ওই মনাস্টারি থেকে। এখান থেকে পারো প্লেনে যাওয়া যায়, কিন্তু সেই সময় পারো এয়ারপোর্টই তৈরি হয়নি, তাই সেই সম্ভাবনাটা বাদই দিচ্ছি। পারো দিয়ে শুরু করে তাই কোনো লাভ নেই। আর এটা আমাকে বাবা বলেছিলেন যে বিনোদ বিহারী ইন্ডিয়া ভুটানের অন্য কোনো বর্ডার দিয়ে যাননি, ফুন্টশোলিং দিয়েই গিয়েছিলেন। তাই আমাকে প্রথমে ওই ফুন্টশোলিং থেকেই যাওয়া শুরু করতে হবে, ওই রাস্তায় গিয়ে কিছু না পেলে তখন বুমথাং—এর দিকটা ট্রাই করব। কিন্তু মুশকিলটা হল, সব নাম্বারগুলো প্লট করে এইরকম লাইনটা পাচ্ছি।’ রুদ্র ডায়েরির পাতাটা প্রিয়মকে দেখাল।

প্রিয়ম ফোনে জি পি এস—টা অন করে খোঁজাখুঁজি চালাচ্ছিল, রুদ্রর আঁকাটা একঝলক দেখে বলল, ‘এটা তো ভীষণ জিগজ্যাগ প্যাটার্নে চলছে, সেরকম তো কিছু বোঝাই যাচ্ছে না। এত আঁকাবাঁকা ম্যাপ হয় নাকি! আর শেষেও তো অনেকগুলো গন্তব্য!’

রুদ্র বলল, ‘হুম। সেটাই ভাবছি। পুরো ব্যাপারটাই আমার অনুমানের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু সূত্র যখন একটা পাওয়া গেছে, সেটাকে তো এক্সপ্লোর করতেই হবে। যদি আমার অনুমান ঠিক হয়, তবে এটাও হতে পারে, যে বিনোদ বিহারী এত সহজেই রাস্তাটা বাতলে দিতে চাননি, আরও কিছু সংকেত আছে এর মধ্যে। কারণ আমি শিয়োর যে অন্যান্য যে জিনিসগুলো আমি ওঁর ঘরে দেখেছি, ওই ছবি বা থাঙ্কা, সেগুলো আমার আগে অনেকবার ঘাঁটা হয়েছে। আর যেহেতু ভুটানেও ওঁর ঘরের জিনিসপত্রই লণ্ডভণ্ড করা হয়েছিল, তাই সেইসব জায়গাতে উনি নিশ্চয়ই লুকিয়ে রাখবেন না ম্যাপটা। এখন এর মধ্যে আরও কিছু জট আছে যেটা ছাড়াতে হলে ভাবতে হবে।’ রুদ্র একটু থেমে আবার বলল, ‘কিন্তু সেটা এখানে বসে ভাবার থেকে জায়গায় গিয়ে চিন্তা করাটাই বেটার। তাই আমি আর দেরি করতে চাইছি না। সামনের উইকেই বেরিয়ে পড়তে চাই। ফুন্টশোলিং থেকে শুরুটা তো করি, তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। এখন ওদিকে ঠান্ডাটা জব্বর হলেও আকাশ পরিষ্কার থাকবে। প্লেনেই যেতাম কিন্তু সেক্ষেত্রে পারোতে নেমে যেতে হবে, তাতে ওই পয়েন্ট অনুযায়ী ট্র্যাকটা গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকবে। তাই নর্থ বেঙ্গলের ট্রেন ধরে হাসিমারা যাব, সেখান থেকে জয়গাঁও হয়ে বর্ডার পেরিয়ে ফুন্টশোলিং ঢুকে পড়ব। তারপর একটা গাড়ি নিয়ে যাব ভেবেছি। তার আগে ফোনে ইন্টারন্যাশনাল রোমিং করিয়ে নিতে হবে, না হলে গিয়ে তোমার সঙ্গে তো যোগাযোগ করতে পারব না।’

প্রিয়ম এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। এবার ভ্রূ নাচিয়ে বলল, ‘ও, তাই নাকি? বাহ, সবই তো ভাবা হয়ে গেছে তাহলে। তা তোমার ভুটানে কি পাশে বসে থাকা মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময়েও রোমিং লাগে নাকি?’

‘মানে? এইবার রুদ্র একটু অবাক হল।’

‘মানেটা কী, সেটাই তো আমি জানতে চাই। তখন থেকে দেখে যাচ্ছি নিজের একা একা ঘোরার বন্দোবস্তটা বেশ সুন্দরভাবে করে ফেলেছ, আর আমাকে একবার ভদ্রতার খাতিরেও কিছু বলছ না! তুমি ওই ভুবন বিহারীর খুনিদের সঙ্গে লড়তে যাবে আর আমি এখানে বসে থাকব? দশটা নয় পাঁচটা নয়, একটামাত্র বউ আমার, আর তাকে আমি ওই ড্রাগনদের মধ্যে ফেলে দেব?’ প্রিয়ম বেশ খেপে গেল, ‘কাল আমি অফিসে গিয়ে দুটো টিকিট কেটে নেব। এ নিয়ে আর ফারদার কোনো ট্যাঁ—ফোঁ আমি শুনতে চাই না।’

রুদ্র তো অবাক, ‘যা ব্বাবা তোমারই তো অফিসে বল ছুটি নেওয়া মুশকিল, একটা দিন ছুটি নিতে বললেই নানা কারণ দেখাও, আর এখানে কতদিন লাগবে আমি কিছুই জানি না। আদৌ ফিরতে পারব কি না তাও জানি না। আর ওঁর নাম বিনোদ বিহারী, নট ভুবন বিহারী!’

‘ওই যাই হোক, যিনি বিনোদ খান্না তিনি—ই ভুবন মান্না! যতদিন লাগুক, গেলে দু—জনেই যাব, নইলে কেউ না। তেমন হলে ওখানে গিয়ে ল্যাপটপ থেকে কাজ করব যতটা পারা যায়। ফিরতে না পারলে ওই ড্রাগনদের সঙ্গে শ্বশুর, মেয়ে, জামাই মিলেমিশে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। কিন্তু বাবাকে খুঁজে আনার ক্রেডিট তুমি একা একাই নেবে সেটা হতে দেব না বস!’ প্রিয়ম মাথা দুলিয়ে বলল।

‘বাবার পাশে থেকে পুরো জীবনটা কোনো অন্ধকার গুহায় কাটাতে হলেও আমার সত্যিই আর কিছু চাই না।’ রুদ্র হেসে ফেলল, ‘বেশ। টিকিট কাটো তাহলে! তার আগে মোটা কিছু জামাকাপড় জোগাড় করতে হবে। না হলে ওখানকার মাইনাস টেম্পারেচারের সঙ্গে যুঝতে পারব না। ফোনটা খোলো তো, একটু শপিং করি। আর তুমি একটু ওঘরে গিয়ে টিভি দেখ, না হলে পাশ থেকে সমানে ফুট কেটে যাবে, শান্তিতে একটু কেনাকাটাও করতে পারব না।’

তার পরের সাত—আট দিন দু—জনেরই কাটল চূড়ান্ত ব্যস্ততায়। ভুটান যেতে গেলে ভারতীয় নাগরিকদের ভিসা লাগে না, কিন্তু ভুটান কনসুলেট থেকে পারমিট করাতে হয়। যদিও বর্ডার শহর ফুন্টশোলিং যেতে কোনো পারমিট লাগে না আর ভুটানের ভেতরে ঢোকার জন্য ওইখানে একদিন থেকেও পারমিশন করা যায়, কিন্তু তাতে একটা দিন দেরি হবে। সেটা ওরা চাইছিল না। তাই প্রিয়ম একদিন গিয়ে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের কনসুলেট থেকে দু—জনের পারমিটটা করিয়ে আনল। এখন ওখানে প্রচণ্ড শীত, তাই টুরিস্ট সিজন নয়। ওদিকে রুদ্র অনলাইনে দু—জনের বেশ কিছু মোটা লেদার জ্যাকেট, পুলওভার এইসব কিনে ফেলেছে। আপাতত ও পনেরো দিনের ছুটি নিয়েছে। পরে আরও লাগলে তখন দেখা যাবে। হানিমুনের পর এই প্রথম দু—জনে বাইরে কোথাও যাচ্ছে। কিন্তু এই ঘোরার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা, অদেখা কোনো দুর্ধর্ষ শত্রুকে মোকাবিলা করার চিন্তা, অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ হবে কিনা সেই আশঙ্কার দোলাচল ভ্রমণের আনন্দকে প্রায় ভুলিয়েই দিয়েছে ওদের।

যাওয়ার পাঁচদিন আগের এক শনিবারের বিকেলে পূরবী এলেন ওদের ফ্ল্যাটে। মাঝেমধ্যেই শনিবার বিকেলে চলে আসেন, রবিবার ছুটির দিনটা মেয়ে—জামাইয়ের সঙ্গে কাটিয়ে সোমবার সকালে এখান থেকেই কলেজ চলে যান।

পূরবী এমনিতেই একটু চাপা প্রকৃতির, কিন্তু তাঁর এই লাজুকে ভাবকে অনেকে দাম্ভিকতা বলে ভুল করে। তার ওপর সুরঞ্জন চলে যাওয়ার পর থেকে নিজেকে আরও গুটিয়ে নিয়েছেন। কলেজ, বাড়ি, বই পড়া—এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন নিজেকে। সুরঞ্জনের হঠাৎ অন্তর্ধানে প্রথমে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লেও রুদ্রর ভবিষ্যতের কথা ভেবে পূরবী শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরেছিলেন। রুদ্রর মাধ্যমিক তখন সবে শেষ হয়েছে, প্রথম বড়ো পরীক্ষার পর যে আনন্দ, তার এক কণাও উপভোগ করতে পারেনি বাবার ন্যাওটা মেয়েটা। রুদ্র হয়তো মনে মনে মা—কে ভীতু ভাবে, আসতে আসতে ভাবছিলেন পূরবী। কিন্তু মেয়েটা জানে না সেই ভয়ংকর সময়ে কীভাবে রাতের পর রাত আতঙ্কে কাটাতে হয়েছে পূরবীকে।

এখনও পরিষ্কার মনে করতে পারেন পূরবী সেই গায়ে—কাঁটা—দেওয়া দিনগুলোকে। আসলে পরে এত হাজারবার ঘটনাগুলোকে নিজের মনের মধ্যে সাজিয়েছেন, পাক খাইয়েছেন, এই প্রান্তর সঙ্গে ওই প্রান্তের সুতোর টানাপোড়েনে জেরবার হয়েছেন, যে চোখ বুজলেই মনে হয় কালকের ঘটনা। রোজকার মতো সেদিনও সুরঞ্জন কলেজে পূরবীকে নামিয়ে দিয়ে অফিস চলে গিয়েছিলেন। সেদিনই রুদ্রর শেষ পরীক্ষা ছিল। কথা ছিল, রুদ্রকে নিয়ে সুরঞ্জন দুপুরের মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবেন, তারপর পূরবীও কলেজ থেকে আগে আগে ফিরে তিনজনে মিলে বাইরে থেকে কোথাও ডিনার করে ফিরবেন। কিন্তু পূরবী বাড়ি ফিরে দেখেছিলেন দরজায় তখনও তালা ঝুলছে। নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকে ল্যান্ডফোন থেকে সুরঞ্জনের অফিসে ফোন করতে ওর সেক্রেটারি জানিয়েছিল স্যার প্রায় ঘণ্টা তিনেক আগে নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছেন।

ব্যাকুল হয়ে পূরবী ঘরবার করছেন, এমন সময় রুদ্র হাঁপাতে হাঁপাতে স্কুল থেকে ফিরেছিল। আত্মীয়স্বজনকে ফোন করেও কোনো খোঁজ মিলল না। তখন মা মেয়ে মিলে চিন্তায় জেরবার হতে হতে শেষমেষ রাত ন—টার সময় লোকাল থানায় যান।

পরের দিন ঠিক সকাল সাড়ে দশটার সময় সেই বুক—কাঁপানো ফোনটা আসে। বাড়িতে তখন বেশ ক—জন আত্মীয় এসেছেন, ফোন চলছে অবিরাম, থানা থেকে পুলিশ এসে জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও জেরবার করে দিচ্ছে, বাড়ির বাইরে মিডিয়ার আনাগোনা শুরু হয়েছে, নানাজনের নানারকম পরামর্শে তিনি আর রুদ্র আরও বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছেন, সেই সময় ফোনটা ধরেন পূরবী। ওপার থেকে চিবিয়ে চিবিয়ে ভাঙা ইংরেজিতে যে হুমকিটা ভেসে আসে সেটা ভাবতে গেলে আজও শিউরে ওঠেন পূরবী। গলাটা বলেছিল, আমরা আপনার স্বামীর কোনো ক্ষতি করব না। আমাদের একটা কাজের জন্য ওঁকে আমাদের কিছুদিন লাগবে, সেই কাজটা শেষ হয়ে গেলেই উনি বাড়ি চলে যাবেন। কিন্তু যদি এই নিয়ে বেশি জানাজানি বা পুলিশ কাছারি করেন, আপনার স্বামীকে জ্যান্ত ফেরত তো পাবেন—ই না, মেয়েকেও লাশ বানিয়ে দেব।’

ভয়ে আতঙ্কে ফোনের কথাটা কাউকে বলতে পারেননি পূরবী। রুদ্র এমনিতেই ছোটো থেকে বাবার মতো ডাকাবুকো, এরকম হুমকি শুনলে আরও খোঁজখবর শুরু করবে। তার ক—দিন বাদে রুদ্র সুরঞ্জনের স্যারের খুন হওয়া, ওঁদের গবেষণার ব্যাপারটা খুলে বলতে পূরবী আরও ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। ওই বয়সেই অতটুকু মেয়েটা এত কিছু মনের মধ্যে চেপে রেখে দিয়েছিল, পুলিশের হাজার জিজ্ঞাসাবাদেও কিছু বলেনি। অনেক কষ্টে, অনেক মিথ্যে স্তোক দিয়ে, সেন্টিমেন্ট দিয়ে রুদ্রর মুখ বন্ধ রেখেছিলেন। রুদ্র তাঁকে ভীতু ভাবুক, সুরঞ্জন পাশে না থাকুক, এই পৃথিবীতে আছে, সেটা ভাবাটাও একটা স্বস্তি। আর তা ছাড়া সুরঞ্জনের প্রোফেসারকে তাঁর নিজের বাড়িতে ঢুকে যারা খুন করতে পারে, সুরঞ্জনের মতো প্রাপ্তবয়স্ক লোককে যারা দিনদুপুরে ওরকমভাবে কিডন্যাপ করতে পারে, রুদ্রর মতো একটা বাচ্চার ক্ষতি করা তো তাদের কাছে সাধারণ একটা ব্যাপার।

পূরবী কাউকে এই ব্যাপারে কিছু জানতে দেয়নি। গাড়িটা পাওয়া যেতে আরেকপ্রস্থ হইচই হল। ক—দিন অনেক জেরা, তদন্ত, তারপর পুলিশও কোনো ক্লু না পাওয়ায় আস্তে আস্তে হাল ছেড়ে দিল। তার মাঝে আরও দু—বার কাউকে না জানানোর ওয়ার্নিং দিয়ে ফোন এসেছিল। আত্মীয়স্বজনরাও সবাই ধরে নিল আর কিছু করার নেই। দিন কাটতে লাগল।

পূরবী ভাবতে ভাবতে নিশ্বাস ফেলেন।

রুদ্র বড়ো হল, কলেজে ঢুকল, চাকরি পেল, বিয়ে করল। আর পূরবী আরও একা, নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছিলেন। সুরঞ্জনের জন্য নিরলস মৌন অপেক্ষা করতে করতে কখন যে চুলে পাক ধরেছে, সুরঞ্জনকে ছাড়াই সব সিদ্ধান্ত নিতে শিখে গেছেন বুঝতেই পারেননি। নিজের অজান্তেই চোখের কোণ দুটো চিকচিক করে ওঠে পূরবীর। একটা অচেনা অজানা বিপদের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে সুরঞ্জন কোথায় হারিয়ে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে পূরবীর জীবনের সমস্ত রং, খুশি নিয়ে চলে গেলেন! যতই বয়স বাড়ছে, জীবনসায়াহ্নের কাছাকাছি পৌঁছোচ্ছেন পূরবী, ততই অবসাদ গ্রাস করছে তাঁকে। যতই পড়াশুনো নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন, একা থাকতে থাকতে একাকীত্বটা তবু মাঝে মাঝেই অসহ্য হয়ে ওঠে, তাই কোনো উইক এন্ডে রুদ্রর ফ্ল্যাটে এলে এক ছলক টাটকা বাতাস পান যেন। তাও এখনও কলেজে থাকতে দিনগুলো কোনোরকমে কেটে যায়, অবসর নেওয়ার আর মাত্র বছর দুয়েক বাকি, তার পরের দিনগুলো কীভাবে কাটবে ভাবলেই শিউরে ওঠেন তিনি।

রুদ্রদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পূরবী দেখলেন, প্রিয়ম ডাইনিং—এর লফট থেকে ট্রলি বের করছে আর রুদ্র যথারীতি খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে রয়েছে। পূরবী একটু অবাক হলেন, ‘তুমি কি আবার টুরে যাচ্ছ নাকি প্রিয়ম? এই তো ফিরলে!’

প্রিয়ম রুদ্রর মুখের দিকে তাকাল। রুদ্র খাটের ওপর উঠে বসল, ‘মা, আমরা ক—দিন একটু ঘুরতে যাচ্ছি। অনেকদিন দু—জনে কোথাও যাইনি।’

পূরবী হাসলেন, বললেন, ‘বাহ, সে তো ভালোই। বলিসনি তো! তা কোথায় যাচ্ছিস?’

রুদ্র স্মার্টলি বলল, ‘একটু নর্থ বেঙ্গলের দিকে যাব মা।’

‘এই ঠান্ডায়?’

রুদ্র হাসল, ‘ঠান্ডাতেই তো ঠান্ডার জায়গায় গিয়ে মজা! না থাকে বেশি লোকজনের ভিড়, উলটোপালটা দাম চাইবে না, খেয়ে আরাম, ঘুরেও আরাম! তোমাকেও নিয়ে যেতাম মা, কিন্তু ঠান্ডায় তোমার অ্যাজমাটা বাড়তে পারে। মনে নেই সেবার সিকিমে গুরুদংমারে গিয়ে তোমার কেমন শরীর খারাপ হয়েছিল?’

‘হুম, মনে আছে। তোর বাবা তাড়াতাড়ি আর্মি হেলথ ক্যাম্পে না নিয়ে গেলে বোধ হয় মরেই যেতাম।’ পূরবী ঠোঁট কামড়ালেন, ‘তোরা সাবধানে ঘুরে আয়। আমার এমনিতেও এখন অনেক খাতা দেখা রয়েছে। তা ছাড়া কলেজে একটা সেমিনার আছে সামনের সপ্তাহে।’

হঠাৎ মনে পড়েছে এরকমভাবে রুদ্র বলল, ‘মা তোমাকে একটা সিরিজ দেখাই, তুমি তো নাম্বার সিস্টেমের ওপর এককালে কাজ করেছিলে। এইটা দেখো তো!’ রুদ্র ডায়েরির পাতাটা পুরবীর দিকে এগিয়ে দিল।

পূরবী পুরো পাতাটা দেখলেন। অজস্র জোড়া সংখ্যা মানে অঙ্কের ভাষায় যেগুলোকে টাপল বলে, তাই দিয়ে একটা লম্বা সিরিজ লেখা রয়েছে। (০,০), (৩,৫), (৪,৭), (৮,১১), (১৩,১৯), (২১,২৪) (২৬,২৬), (২৯,৩১)… এইরকম গোটা পঞ্চাশটা টাপল অর্থাৎ সংখ্যার জোড়া লেখা। একদম শেষে আগেরগুলোর থেকে একটু আলাদা করে লেখা ২০ কিমি। পূরবী অবাক হয়ে বললেন, ‘কী এগুলো?’

প্রিয়ম বলল, ‘এইগুলো দিয়ে একটা ম্যাপের ডিরেকশন দেওয়া আছে। কিন্তু শুধু এই পয়েন্টগুলো গ্রাফে ড্র করলে কোনো ঠিকঠাক রাস্তা পাওয়া যাচ্ছে না। এবড়োখেবড়ো হয়ে যাচ্ছে।’

পূরবী আরও অবাক হয়ে বললেন, ‘ম্যাপ? কীসের ম্যাপ?’

রুদ্র চোখ পাকিয়ে তিরস্কারের ভঙ্গিতে এক ঝলক প্রিয়মের দিকে তাকাল, তারপর পলকের মধ্যে মুখে হাসি এনে বলল, ‘একটা খুব টাফ গেম, মা। কম্পিউটার খেলছিলাম ক—দিন, এখন নেশায় দাঁড়িয়ে গেছে। এই ম্যাপটা অনুযায়ী ঠিকঠাক গেলে তবেই আসল পাজলটা সলভ করতে পারব। তুমি একটু হেল্প করো না, মা।’

পূরবী হেসে বললেন, ‘কবে নাম্বার থিয়োরি নিয়ে কাজ করেছিলাম, এখন কি আর অত মনে আছে? গত কুড়ি বছর ধরে তো সেই একঘেয়ে সিলেবাস কভার করে চলেছি! বরং প্রিয়ম তো অঙ্কে খুব ভালো, তুমি কিছু ক্লু পাচ্ছ না?’

প্রিয়ম বলল, ‘আমার দৌড় তো ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্স্ট ইয়ার অবধি পড়া অঙ্ক পর্যন্ত। তারপর তো পিয়োর ম্যাথ আর আমাদের ছিল না। সবই অ্যাপ্লিকেশন। তবু আমি দেখছিলাম। কিন্তু নরম্যাল যে সিরিজগুলো তৈরি করা যায় সেগুলো দিয়ে ভাবতে চেষ্টা করছিলাম, সেরকম তো কিছু মিল পাচ্ছি না।’

পূরবী বললেন, ‘আচ্ছা, ভেবে দেখছি যদি কিছু পাই। আর সারাদিন তো অফিসে দু—জনে কম্পিউটারেই বসে থাকিস, বাড়ি এসেও এইসব গেমে ঢুকে বসে আছিস, চোখের তো বারোটা বেজে যাবে!’ বলে উঠে দাঁড়ালেন, ‘দাঁড়া, হাত মুখ ধুয়ে আসি। দইবড়া করে এনেছি তোদের জন্য।’

প্রিয়ম উদ্ভাসিত মুখে বলল, ‘আঃ! কতদিন ভালোমন্দ খেতে পাই না। না খেয়ে খেয়ে অর্ধেক হয়ে গেলাম প্রায়! ক—দিন একটু পেট পুরে খাব। কপাল সকালেই মাটন নিয়ে আসব। মা, তোমার সেই অসাধারণ মাটন চাপটা করবে তো!’

রুদ্র রেগে গিয়ে বলল, ‘আহা! এখানে খেতে পায় না গো! সপ্তাহে তিনদিন করে রান্নার মাসি চিকেন মাটন করছে আর উনি না খেতে পেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছেন। কেন, সেপ্টেম্বরের ফার্স্ট উইকে আমি শাহি পনির বানাইনি?’

প্রিয়ম অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘সেপ্টেম্বরের ফার্স্ট উইক? সেটা কী ১৯৫০ সালের কথা বলছ?’

রুদ্র আরও রেগে উঠে আহত গলায় বলল, ‘এই তো মাত্র চার মাস আগে মনে নেই? অফিস থেকে এসে কত খেটেখুটে বানালাম!’

প্রিয়ম আরও খেপিয়ে দিয়ে বলল, ‘ওহ, সেই ল্যাপটপ গ্যাস আভেনের পাশে বসিয়ে ইন্টারনেট দেখে দেখে যেটা করলে? আমি তো ভাবছিলাম সাধের ল্যাপটপটাই না রান্না হয়ে যায়! হুম, ভালোই হয়েছিল বাট ওটা পনির ছিল নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম কাঁচকলার কোফতা ওটা।’

পূরবী এতক্ষণ মিটিমিটি হাসছিলেন ওদের কাণ্ড দেখে। এবার রুদ্র জলের বোতলটা প্রিয়মের পিঠে মারবার জন্য তুলতে রুদ্রকে বললেন, ‘হয়েছে, হয়েছে। খেপাচ্ছে বুঝতে পারছিস না তোকে? পরের দিন অফিস থেকে প্রিয়মই তো আমায় ফোন করে তোর পনিরের কত সুখ্যাতি করেছিল।’

এইবার রুদ্রর মুখে হাসি ফুটেছে। তড়াক করে উঠে বলল, ‘দাঁড়াও, আমি কফি করে আনছি।’

যাওয়ার আগের দিন রুদ্র ব্যাঙ্কে নিজের কেবিনে বসে ছিল। কাজ প্রায় শেষ, কিন্তু পরের দিন থেকে যেহেতু ও দিন পনেরোর ছুটি নিচ্ছে, তাই রিজিওনাল অফিস থেকে ডেপুটেশনে একজনকে পাঠাচ্ছে এই ক—দিন ব্রাঞ্চ সামলানোর জন্য, তাকে সব কিছু চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে চাবি ট্রান্সফার করে রুদ্রকে বেরোতে হবে। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে ছ—টা। এখনও অবধি তো যাঁর আসার কথা এসে পৌঁছোলেন না। ব্রাঞ্চ প্রায় ফাঁকা, সবাই বেরিয়ে গেছে কাজ শেষ করে, শুধু সুলোচন বসে আছে তালা মারবে বলে। ঠান্ডাটা ক—দিন একটু কমেছিল, কিন্তু গত দু—দিন বৃষ্টি হতে আবার জাঁকিয়ে পড়েছে। রুদ্র বন্ধ জানলার কাচ দিয়ে ওপারে উদাস চোখে তাকিয়ে ছিল।

গত এক মাসে ওর জীবনটা আমুল বদলে গেছে। একমাস আগেও ও ছিল কেরিয়ার সচেতন একজন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার যে নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য কাজে ডুবে থাকার চেষ্টা করতে করতে কখন সত্যিই কাজপাগল হয়ে গিয়েছিল, ও নিজেও জানত না। সারাটা সপ্তাহ এই ছোটো ব্রাঞ্চটাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা, আর সপ্তাহান্তে প্রিয়মের সঙ্গে টুকটাক গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়া, মায়ের কাছে যাওয়া, আর মাসে একবার কল্যাণীতে প্রিয়মের বাড়ি যাওয়া। শখ বলতে রাতে বাড়ি ফিরে একটু—আধটু ছবি আঁকা আর বই পড়া, এইভাবেই আবর্তিত হচ্ছিল ওর জীবন।

নিজেকে হঠাৎই খুব ছোটো লাগল রুদ্রর। ও এতটা স্বার্থপর যে এই ক—টা বছর বাবাকে ভুলেই ছিল?

না, ভুলে এক মুহূর্তের জন্যেও যায়নি, ও নিজেকে বোঝাল। প্রতিটা ভালো সময়ে, খারাপ সময়ে বাবাকে মনে পড়েছে ওর। মাধ্যমিকের রেজাল্টের পর বাড়ি ফিরে মাকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কান্নাটার কথা মনে পড়ল ওর। তখনও মনের মধ্যে আশাটা উজ্জ্বল ছিল বাবা যে কোনোদিন ফিরে আসবেন। রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসবার আগে পর্যন্ত ও কল্পনা করত, পরের দিন বাবা হঠাৎ ফিরে এলে ও কী করবে! কিন্তু সুরঞ্জন আসেননি। তারপর আশার মোমবাতিটা টিমটিম করে জ্বলতে জ্বলতে কোন সময় নিভেই গেছিল, পড়ে ছিল শুধু গলে—যাওয়া মোমের মতো চাপা দীর্ঘশ্বাস। উচ্চমাধ্যমিক, জয়েন্টে ভালো র‌্যাঙ্ক, ইঞ্জিনিয়ারিং, ভালোবাসা, ক্যাম্পাসিং—এ জীবনের প্রথম চাকরি পাওয়ার আনন্দ, প্রিয়মের বিয়ের জন্য প্রপোজাল, জীবনের এই প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে বাবার অনুপস্থিতি বুকের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধেছে ওর। মনে মনে ভেবেছে এই সময় বাবা থাকলে কী বলতেন? কতটা আনন্দ পেতেন? মাঝে মাঝে চাপা কষ্টটা যখন বেরিয়ে আসত, ও ফুঁসে উঠত।

বছরখানেক আগেও বিয়ের আগে ঠিক করেছিল মিডিয়ার কাছে এই নিয়ে আরেকবার যাবে, তখনকার থেকে এখন বাংলা মিডিয়া অনেক বেশি করিতকর্মা, এরকম একটা অন্তর্ধান রহস্য পেলে আর কিছু না হোক, তারা দিন সাতেক অন্য কোনো বড়ো স্কুপ না পাওয়া পর্যন্ত তোলপাড় করবে, সেটুকুতে যদি আবার পুলিশ নড়েচড়ে উঠে তদন্ত শুরু করে। কিন্তু মা বাধা দিয়েছিলেন। মৃদু বাধা নয়, জোর করে বারণ করেছিলেন। কেন, ও জানে না।

সুলোচনের ডাকে ওর ঘোর কাটল। রুদ্রর বিকল্প যে ম্যানেজার একদিন ব্রাঞ্চ সামলাবেন, তিনি এসে পড়েছেন। রুদ্র চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেল। প্রাথমিক আলাপচারিতার পর রুদ্র সুলোচনকে চা নিয়ে আসার হুকুম দিল। ভদ্রলোকের নাম দেবেশ সিং। বয়স আন্দাজ তাও বছর ছয়েক হল। প্রথমদিকে ক্যানিং—এর দিকের কোন এক ব্রাঞ্চে ছিলেন, এখন রিজিওনাল অফিসেই। বাংলাটা ভাঙা ভাঙা খুব খারাপ বলেন না, চার্জ বুঝে নিতে নিতে টুকটাক ভালোই কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন রুদ্রর সঙ্গে।

অফিশিয়াল কাজ সব মিটে যাবার পর ব্রাঞ্চ বন্ধ করে রুদ্র বেরিয়ে পড়ল স্টেশনের দিকে। একসঙ্গেই দু—জনে ট্রেন ধরে নেবেন। সাড়ে সাতটা বাজে। কিন্তু এর মধ্যেই রাস্তাঘাট প্রায় নির্জন। এখানকার লোকজন খুব ভোরে উঠে জীবনযাত্রা শুরু করে, আর রাতে আটটা বাজতে—না—বাজতেই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। দোকানপাটও আটটার মধ্যে সব—ই প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এর একটা কারণ, এখানকার রাস্তায় আলো খুবই কম, তাও ঠিকঠাক জ্বলে না, তারপর লোডশেডিং—এর প্রকোপ সাংঘাতিক, আর দিনে দিনে কাজ করলে কারেন্ট খরচাও বাঁচে। বেশিরভাগ বাড়িতে তো ব্যাটারির আলো, সে প্রায় নিভু নিভু। প্রথম প্রথম তো এত অল্প আলোয় পথ চলতে গিয়ে রুদ্র কতবার ঠোক্কর খেয়েছে। একবার তো একটা কুকুরের লেজে পা—ই দিয়ে ফেলেছিল। এখন চোখ সয়ে গেছে, আর অতটা অসুবিধে হয় না। প্রায় অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ‘কলকাতায় থাকেন কোথায় আপনি? মানে কীভাবে আসবেন এখানে?’

‘আমি দমদমে থাকি, ম্যাডাম। এয়ারপোর্ট একনম্বর গেটের কাছে ফ্ল্যাট নিয়েছি। এই ক—দিন ভাবছি দমদম থেকে ট্রেন ধরে ডানকুনি চলে আসব। ওখান থেকে কর্ডের ট্রেন ধরে নেব। প্রবলেম হলে না হয় গাড়িতে আসব।’

দেবেশবাবু একটা জোর হোঁচট খেতে খেতে সামলালেন, ‘আপনি কি এল টি সি নিচ্ছেন নাকি এত লং লিভে যাচ্ছেন যে?

রুদ্র গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, হ্যাঁ, আসলে এখন না নিলে এই ব্লকের এল টি সি—টা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই এনক্যাশ করিয়ে নিচ্ছি। ওটা দিয়ে আমি আর আমার হাজব্যান্ড একটু ঘুরতে যাচ্ছি আর কি!’

‘বাহ ভালো। তা ঘুরতেই যখন পাচ্ছেন এনক্যাশ করালেন কেন? এটাতে তো লস, ব্যাঙ্ক আপনাকে একটা হিসেব করে টাকা দিয়ে দেবে, ট্যাক্সের আওতাতেও পড়ে যাবে। আর এল টি সি—টা অ্যাভেল করলে তো শুধু যাতায়াত নয়, ওখানকার ট্রান্সপোর্টের খরচটাও পেতেন।’

‘হ্যাঁ জানি, কিন্তু ব্যাঙ্ক তো শুধু দেশের মধ্যে দেবে এল টি সি। আমরা তো ভুটান যাচ্ছি, ওটা তো একটা আলাদা কান্ট্রি…’ বলতে বলতে রুদ্র হঠাৎ থমকে গেল।

নিকষ কালো অন্ধকারের বুক চিরে একটা জোরালো আলো একটু বেশিই দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে। আরেকটু কাছে আসতে বুঝতে পারল, ওটা একটা মোটরবাইকের হেডলাইট। তীব্র গতিতে এগিয়ে আসছে। রুদ্র একটু বাঁ—দিক ঘেঁষে সরে দাঁড়াল। একেই গত ক—দিনের বৃষ্টির জন্য রাস্তায় কাদা ভরতি, তারপর কিছুই প্রায় দেখতে পাচ্ছে না। তার ওপর এ কী রে বাবা, একেই এইটুকু সরু রাস্তা, তার মধ্যে এরকম অসভ্যের মতো জোরে চালাচ্ছে কেন! পাশেই তো পানা পুকুর, একটু এদিক—ওদিক হলেই উলটে পড়বে তো! যতসব বখাটে ছেলের দল। দেবেশবাবুও হতচকিত হয়ে সরে এসেছেন।

বাইকটা রুদ্রর কান ঘেঁষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় চিৎকার করে বলে গেল, ‘শালা, তোকেও বাপের কাছে পাঠিয়ে দেব বেশি বাড়াবাড়ি করলে!’

টাল সামলাতে না পেরে রুদ্র পাশের কাদার মধ্যে ছিটকে পড়ল। দেবেশবাবুও থুবড়ে পড়েছিলেন, রুদ্র মুহূর্তের মধ্যে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বিদ্যুৎগতিতে বাইকের পেছনে ধাওয়া করল। কিন্তু কিছুক্ষণ দৌড়োনোর পর বুঝতে পারল কোনো লাভ নেই। বাইক আরোহীর দল তখন অনেক দূরে একটা ক্ষুদ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। নম্বর দেখার চেষ্টাও বৃথা। বাইকের সার্চলাইটের আলোয় রুদ্র এটা দেখেছিল যে ওরা দু—জন ছিল, দু—জনেরই মাথায় মুখ ঢাকা হেলমেট। আর এই অন্ধকার কাদাভরা সরু রাস্তা দিয়ে ওদের পিছু নেওয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

রাগে গজগজ করতে করতে ও ফিরে এল। মোবাইলের আলোটা জ্বালিয়ে দেখল, দেবেশবাবুর চশমাটা পাশে খুলে পড়ে গেছিল, উনি সেটা মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিলেন। সোয়েটার প্যান্ট পুরো কাদায় মাখামাখি।

রুদ্রর নিজের দিকে তাকিয়ে মাথা আরও গরম হয়ে গেল। গত জন্মদিনে মা—র দেওয়া সোয়েটারটায় কাদা তো লেগেইছে, দু—এক জায়গায় ছিঁড়েও গেছে। দেবেশবাবুকেও উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। দু—জনে মিলে খানিকটা থিতু হতে দেখল, নির্জন ভূতের মতো সেই গ্রাম শুনশান হয়ে রয়েছে। কেউ কোনোদিকে নেই। দেবেশবাবু প্রায় বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন, ‘এখানে এরকম প্রায়ই হয় নাকি, ম্যাডাম?’

রুদ্রর কানের দু—পাশের রগ দপদপ করছিল, ও বলল, ‘না, এতদিন তো হয়নি। মনে হয় লোকাল মস্তানের দল। আপনার কোথাও কেটে ছড়ে যায়নি তো? চলুন, এগোনো যাক।’

দেবেশবাবু তখনও ঠিক স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেননি, ‘কী বলছেন কী! এত বড়ো একটা কাণ্ড হল আর কেউ কোনোদিক থেকে ছুটেও এল না! এ কী জায়গা! আচ্ছা ওরা কী বলতে বলতে গেল বলুন তো?’

রুদ্র ততক্ষণে হাঁটা লাগিয়েছে, ‘আমি শুনতে পাইনি। আর বেশি ভেবে লাভ নেই, ফচকে ছেলেদের বাঁদরামি, তাড়াতাড়ি চলুন, না হলে এই ট্রেনটা মিস করলে আবার চল্লিশ মিনিট বসে থাকতে হবে এই ঠান্ডার মধ্যে।’

প্রিয়ম বলল, ‘রাস্তায় দেখেশুনে হাঁটো না, তড়বড় করতে গিয়ে উলটেছ, আর এখন অন্যদের দোষ দিচ্ছ! কী করে বুঝলে ইচ্ছে করে তোমাকে ধাক্কা দিয়েছে? নাকি, তুমি দেখতে পাওনি? পইপই করে বলেছি টর্চটা নিয়ে যেতে!’

রুদ্র যে দু—একটা জায়গা ছড়ে গেছে, সেগুলোয় ডেটল লাগাচ্ছিল, ‘তুমি পুরোটা না শুনেই জ্ঞানদেব হয়ে যেয়ো না, প্লিজ! আর ধাক্কা মোটেও দেয়নি, যে স্পিডে আসছিল, সেই স্পিডে এসে ধাক্কা দিলে এতক্ষণে হসপিটালে থাকতাম, আমাকে ভয় দেখাতেই ওরা এসেছিল।’ রুদ্র পুরো ঘটনাটা খুলে বলল।

প্রিয়ম শুনে হতভম্ব, ‘সে কী! তুমি কথাটা ঠিক শুনতে পেয়েছ, মানে ফচকে লোফারদের কাজ নয় বলছ?’

‘একেবারেই নয়। ব্যাপারটা খুব সোজা। ছেলে দুটো লোকালই হবে, খুব সম্ভবত বিনোদ বিহারীর বাড়ির উপর নজর রাখার জন্য কোনো চর আছে ওই ধনেখালিতেই, সে—ই আমাকে বারদুয়েক ওখানে অবিনাশবাবুর সঙ্গে যেতে দেখেছে। আর আমি কার মেয়ে সেটার খোঁজ নিশ্চয়ই ওদের কাছে আগে থেকেই আছে। দুয়ে দুয়ে চার করে নিয়েছে। লোকাল কোনো মস্তানকে দিয়ে ভয় দেখাল আর কি!’ রুদ্রর ঠোঁটে পাতলা হাসি ফুটে উঠল।

‘তাহলে কী করব? টিকিট কি ক্যানসেল করে দেব?’

‘পাগল নাকি? এটা তো একটা বিরাট সুসংবাদ আমার জন্য। ইন ফ্যাক্ট এরকম কিছু হবে আমি ভাবতেই পারিনি।’ রুদ্র মুখ জ্বলজ্বল করছিল।

‘সুসংবাদ?’

‘তা নয়তো কী! ভেবে দ্যাখো, একটা জিনিস তার মানে পরিষ্কার, আমরা ঠিক রাস্তাতেই এগোচ্ছি। না হলে আমাকে অনর্থক ভয় দেখাত না। আর তার থেকেও বড়ো কথা আমার যাওয়ার উদ্দেশ্য মনে হয় বিফল হবে না। মনে হয় এখনও সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি। বাবা নিশ্চয়ই এখনও আছেন! শুধু রাস্তাটা ঠিক করে ফিগার আউট করতে হবে।’ রুদ্র উদ্ভাসিত মুখে বলে উঠল।

প্রিয়ম এসে রুদ্রর কাঁধে হাত রাখল, ‘নিশ্চয়ই আছেন। কিন্তু আমি ভাবছি, সত্যিই কি ফরেস্টিয়ারের কাজ এটা? এতদূরে এসে? বাংলায় এসে এরা যদি এরকম করে, ওখানে আমরা পৌঁছোলে তো আরও বড়ো ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।’

রুদ্র মুখ টিপে হাসল, ‘করুক না! আমার বডিগার্ড তো সঙ্গে যাচ্ছে! আমার আর চিন্তা কী!’

প্রিয়ম বলল, ‘হুম, বডিগার্ডই বটে! এই পেশাটাই নিতে হবে এবার থেকে মনে হচ্ছে। এতদিন ছুটি নিয়ে যাচ্ছি, এসে চাকরিটা আর থাকলে হয়!’ পরক্ষণেই বলল, ‘ওহ, তোমাকে যেটা বলব বলে ভাবছিলাম। আজ অফিসে ওই ম্যাপ—এর পয়েন্টগুলো দেখছিলাম। একটা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এগোলে কিন্তু পরিষ্কার একটা রাস্তা পাওয়া যাচ্ছে, জানি না সেটা ঠিক না ভুল।’

রুদ্র চোখ সরু করে তাকাল, ‘কীরকম?’

প্রিয়ম বলতে শুরু করল, ‘আমার ধারণাটা যদি ঠিক হয়, তাহলে এটা মানতেই হবে তোমার ওই বসন্ত বিহারী ইতিহাসের প্রোফেসর হলেও অঙ্ক নিয়েও যথেষ্ট চর্চা করতেন। মানে আমার মতো অ্যামেচার শখের গণিতজ্ঞ বলতে পারো। যাই হোক, আগে আমার বক্তব্যটা বলি। ওই জোড়া সংখ্যার সিরিজটা যতবার দেখছিলাম আমার মাথায় একটা জিনিস স্ট্রাইক করছিল। পুরোনো একটা প্রবলেম নিয়ে মেতে থাকতাম আগে, সেটা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তুমি খেয়াল করে দেখবে টোটাল বাহান্নটা জোড়া আছে ওই সিরিজটায়, তার মধ্যে দু—তিনটে জোড়া ছাড়া এমন একটা করে জোড়া রয়েছে যার দুটো সংখ্যাই প্রাইম অর্থাৎ মৌলিক। মানে যে জোড়ার দুটো সংখ্যার মধ্যেই দুটোই এক এবং সেই সংখ্যা ছাড়া অন্য কোনো সংখ্যা দিয়ে বিভাজ্য নয়।’ প্রিয়ম খাতা টেনে লিখল,

(০,০), (৩,৫), (৪,৭), (৪,১), (৮,১১), (১৩,১৯), (২১,২৪), (২৬,২৬), (২৯,৩১)…

‘প্রথমে দ্যাখো দু—নম্বর জোড়াটার দিকে মানে, (৩,৫) এটার দুটো সংখ্যাই কিন্তু প্রাইম, এর পরের তিনটে জোড়া কিন্তু তেমন নয়, তারপর আবার দ্যাখো ছ—নম্বর জোড়া মানে (১৩,১৯) এর দিকে, এটার আবার দুটোই প্রাইম, তারপর আবার ন—নম্বরে রয়েছে (২৯,৩১) এটাও প্রাইম।’ প্রিয়ম আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছিল।

রুদ্র বাধা দিয়ে বলল, ‘এরকমভাবে ভাবলে তো আরও কতরকমভাবেই ভাবা যায়, তুমি যেমন প্রাইম সংখ্যার জোড়াগুলো ধরছ, তেমনি অড—ইভেন মানে, জোড়—বিজোড় সংখ্যাগুলোকে ধরা যেতে পারে। কেউ আবার অন্যরকম ধরতে পারে। এটা কোনো ওয়ে হল নাকি?’

প্রিয়ম মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠিক। কিন্তু প্রাইম নম্বরের সঙ্গে এটার একটা যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছি যেটা আমি এখনও বলিনি। সেটা আগে শোনো। কিছুটা আমি জানতাম, বাকিটা তোমার মাকে ফোন করে জানলাম, আর শেষে ইন্টারনেট ঘেঁটে মোটামুটি কনফার্মড হলাম। সারা বিশ্বের অঙ্কের ইতিহাসে যে ক—টা আনসলভড প্রবলেম রয়েছে সেগুলোর প্রাচীনতমগুলোর মধ্যে একটা হল গোল্ডবাখ কনজেকচার। ১৭০০ সাল নাগাদ জার্মানিতে একজন অসাধারণ ম্যাথমেটিশিয়ান ছিলেন, নাম ক্রিশ্চিয়ান গোল্ডবাখ। তিনি একটা চিঠিতে ইউরালকে এই প্রবলেমটা লিখে পাঠান। ইউলার’স থিয়োরেম তো পড়েইছ। খুব সোজা ভাষায় বলতে গেলে গোল্ডবাখ কনজেকচার—এর বক্তব্য হল, ২—এর থেকে বেশি যেকোনো জোড় ইনটিজারকে দুটো প্রাইম নাম্বারের যোগফল হিসেবে প্রকাশ করা যায়। মানে তুমি যেকোনো জোড়া ইনটিজার ধর, যেমন ১০০, একে দুটো প্রাইম নাম্বার ৯৭ আর ৩—এর যোগফল হিসেবে লেখা যায় তেমনি…’ বলে প্রিয়ম খাতায় লিখতে লাগল,

৫০=৪৭+৩

২০=১৩+৭

৪৪=৩৩+১১

এইরকম আর কি। এখন তুমি যে প্রশ্নটা করলে আমার মাথাতেও সেটাই এসেছিল, যে এরকম তো অনেক দিক থেকেই ভাবা যায়, এটা যে ঠিক হবে তার কী মানে? তখন আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম। এই গোল্ডবাখ ভদ্রলোক ছিলেন সাংঘাতিক ব্রিলিয়ান্ট আর শুধুমাত্র অঙ্কেতেই ওঁর বিচরণ সীমাবদ্ধ ছিল না। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বললেও কম বলা হবে ওঁকে। তুমি জানলে আশ্চর্য হয়ে যাবে, উনি রাশিয়ার এক কলেজে একইসঙ্গে অঙ্কের আর ইতিহাসের প্রোফেসর ছিলেন। ল—এর ডিগ্রিও ছিল ওঁর। জার্মান, রাশিয়ান, ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ান এরকম ছ—সাতটা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। ১৭২৮ সালে যখন দ্বিতীয় পিটার রাশিয়ার জার হন, তখন উনি বিদেশ মন্ত্রকের একজন গুরুত্বপূর্ণ পারিষদ ছিলেন, তার সঙ্গে রাজার শিক্ষকও। এইসময় উনি একবার তিব্বতেও আসেন।’ প্রিয়ম দম নিতে থামল।

এবার রুদ্রর অবাক হবার পালা। ও বলল, ‘তারপর?’

‘ইন্টারনেটে এইটুকুই শুধু দেওয়া আছে। আরও জানবার জন্য আমি আজ অফিস থেকে লাঞ্চ টাইমে তোমার মায়ের কলেজের লাইব্রেরিতে গেছিলাম। পুরোনো অনেক বইপত্র ঘেঁটে জানলাম, গোল্ডবাখ তিব্বত—ভুটান—নেপাল এরকম অঞ্চলের কোথাও মাসছয়েক ছিলেনও এবং তখন বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস নিয়ে ক—দিন মেতেওছিলেন। ইন ফ্যাক্ট কিছুদিন উনি একটা মনাস্টারির আবাসিক ছাত্রদের পড়িয়েওছিলেন। এই থেকেই আমার সিক্সথ সেন্স বলছে যে আমার ধারণাটা ঠিক হলেও হতে পারে। কারণ ওইরকম সময়ে ভুটানে অনেক নতুন নতুন মনাস্টারি তৈরি হচ্ছিল। আর তার থেকেও বড়ো কথা এই অনুযায়ী চললে কিন্তু একটা পরিষ্কার গতিপথ পাওয়া যাচ্ছে। এরকম হতেই পারে যে, বিনোদ বিহারী পনেরো কুড়ি বছর ওখানে ছিলেন বাইরের জগতের সঙ্গে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে, হামলার হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসে কীভাবে ম্যাপটা লুকিয়ে রাখবেন ভাবতে ভাবতে হয়তো গোল্ডবাখ কনজেকচার—এর প্রাইম নাম্বারের কথা—ই মাথায় এসেছিল। হয়তো ওখানকার কোনো অঙ্কপ্রেমী লামাবাবুর থেকে উদবুদ্ধ হয়ে। সব—ই অবশ্য অনুমান।’

রুদ্র নিবিষ্ট মনে শুনছিল, প্রিয়ম থামতে বলে উঠল, ‘কিন্তু ম্যাপের স্কেলটা কী করে বুঝবে? মানে একটা পয়েন্ট থেকে আরেকটা পয়েন্টের মধ্যে আসলে কতটা দূরত্ব কভার করছে?’

প্রিয়ম বলল, ‘ওহ, ওটা বলতে ভুলে গেছি। হ্যাঁ, ওটা সম্পর্কেও একটা থিয়োরি খাড়া করেছি। তোমার মনে আছে, পুরো লেখাটার একদম শেষে একটু বিচ্ছিন্নভাবে ২০ কিমি সংখ্যাটা লেখা ছিল? আমার ধারণা, বিনোদ বিহারী ওই ম্যাপের প্রতি দুটো পয়েন্টের মধ্যে আসলে দূরত্ব ২০ কিলোমিটার, এটাই বোঝানো হয়েছে।’

রুদ্র বিহ্বল চোখে প্রিয়মকে দেখছিল। বলল, ‘তুমি এত কিছু করেছ আমার জন্য?’

এইবার প্রিয়ম একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ‘যাহ বাবা, তোমার জন্য করব কেন! বাবাকে তো সত্যিই খুঁজে বের করতে হবে। আর এইসব ম্যাথের প্রবলেমগুলো নিয়ে ভাবা তো আমার একটা শখ জানোই, তাই সিরিজটা দেখে এটাই মনে এসেছিল। তারপর দুয়ে দুয়ে চার করলাম। এই আইডিয়া অনুযায়ী যে গতিপথটা পাচ্ছি সেটা অমি গুগল ম্যাপে ট্র্যাক করেছি দ্যাখো। ফুন্টশোলিং থেকে যদি শুরু করা হয়, আর প্রতি দুটো পয়েন্টের মধ্যে যদি কুড়ি কিলোমিটার দূরত্ব ধরা হয়, তবে এইভাবে যাচ্ছে পুরো লাইনটা।’ প্রিয়ম ল্যাপটপটা রুদ্রর দিকে এগিয়ে দিল।

‘উরা! সেটা আবার কোন জায়গা!’ বলেই রুদ্র ভালো করে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে, এটা তো বুমথাং জেলায় দেখছি! বাবা বলেছিলেন, বিনোদ বিহারী শেষের দিকটা পুরোটাই বুমথাং—এ কাটিয়েছিলেন!’

‘হুম। কিন্তু কী আছে বলো তো এই ম্যাপের শেষে যার জন্য এত কাণ্ড?’

‘যদি বিনোদ বিহারী এবং বাবার ধারণা ঠিক হয়, তবে এই ম্যাপের শেষে হয়তো রয়েছে এক শতাব্দী প্রাচীন গুম্ফা যার কোনো এক গুপ্ত স্থানে লুকোনো রয়েছে পদ্মসম্ভবের আত্মজীবনীর অবশিষ্ট অংশ, যাতে দেওয়া রয়েছে বজ্রবিদ্যুৎ থেকে শক্তি সঞ্চয়ের আদি প্রণালী। আরও হয়তো রয়েছে কোনো এক অজানা রহস্য যা যুগ যুগ ধরে বজ্রতান্ত্রিকরা নিজেদের মধ্যে গোপন রাখতে রাখতে একসময় হারিয়ে গেছে, চলে গেছে সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালে। আর যেটা উদ্ঘাটনের সঙ্গে মানবজাতির কল্যাণ বা বিনাশ দুটোই হয়তো জড়িত রয়েছে। হয়তো ভুল হাতে পড়লে অপব্যবহারে পুরো পৃথিবীটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আবার ঠিক হাতে পড়লে ভালো হবে কিছু। তাই শয়তানদের এত চোখ ওখানে। তবে কী আছে তার থেকেও আমার কাছে বড়ো হল বাবার খোঁজ পাওয়া যাবে কিনা!’ রুদ্র চাপা নিশ্বাস ফেলল।

‘হুম।’ প্রিয়ম ঘাড় নাড়ল। পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে বলল, ‘কিন্তু আজকে তোমার এই ব্যাপারটাতে একটু চিন্তা হচ্ছে। যাওয়াটা ক—দিন বাদে করলে হয় না? মানে ওরা ভাববে আমরা ভয় পেয়ে পিছিয়ে এসেছি?’

‘অবশ্যই হয় না! একটা দিনও আমি আর নষ্ট করতে চাই না।’ রুদ্র উত্তেজিতভাবে বলল, ‘আইডিয়া যখন একটা পাওয়া গেছে, ভুল হয় হোক, এক্সপ্লোর করতেই হবে। তারপর কিছু না হলে দেখা যাবে। আপাতত যেটা চিন্তা করার সেটা হল, এই ফরেস্টিয়ার ব্যক্তিটি আসলে কে? কী চায় সে?’ বলে উঠে দাঁড়াল, ‘তোমার সব গোছগাছ কমপ্লিট তো?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *