আমি গাধা বলছি – ৯

নয়

আমি মুহূর্তের জন্যে প্রমাদ গুনলাম, তারপর দ্রুত পা চালিয়ে সামনের বিরাট বাড়িটার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম এবং হাঁপাতে হাঁপাতে যেয়ে একটা প্রশস্ত রুমে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। আমাকে দেখেই একজন ধুতি-পরা লোক চিৎকার করে উঠে বলল,

, ‘আরে এই যে গুরুজী, গুরুজী এসে গেছে আমার।’ বলেই গড় হয়ে প্রণাম করল আমাকে। গুরুজী গুরুজী এদ্দিন কোথায় ছিলেন আপনি? আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি হয়রান। আমার কি জোর কপাল … …

আপন নিজেই পদধূলি দিলেন আরে ও কুরিয়া মজুরিয়া কোথায় গেলি তোরা? জলদি মোনেমজীকে ডেকে আন।’ …

এতক্ষণে আমি কিছু ঠাহর করতে পারলাম তাকে। শেঠ ভুসুরীমল যে, মহমে যাকে আমি লটারীর নম্বর বলেছিলাম। শেঠ আনন্দে নাচতে নাচতে বলল,

‘গুরুজী সেদিন আপনি যে নাম্বার বলেছিলেন, তাতে আমি পাকা তিন লাখ টাকা পেয়েছিলাম। সে টাকাতেই এ বাড়ি করেছি।’

জবাবে আমি কিছু একটা বলব ভাবছিলাম। এমন সময় হঠাৎ লোলা এবং মাস্টার হন্তদন্ত হয়ে কামরায় প্রবেশ করল। আমার গলার শিকল ধরবার জন্যে হাত বাড়াতেই শেঠ বলল,

‘খবরদার, গুরুজীর গায়ে কেউ হাত দিও না কিন্তু ‘

‘এ গাধা আমার।’ মাস্টার বলল।

‘খবরদার, গুরুজীকে যে গাধা বলবে তুমি কোত্থেকে এসেছ, তুমি কে? গুরুজী সাধু সন্ন্যাসী। তার মাহাত্ম্য তুমি কি বুঝবে? সন্ন্যাসীরা বরাবর জন্তু জানোয়ারের বেশ বদল করে থাকে।’

লোলা মাঝখানে পড়ে দু’জনের মধ্যে সন্ধি করবার চেষ্টা করল। মাস্টার বরাবর শর্টহ্যান্ডে টেনে টেনে কথা বলে আর শেঠ বলে লংহ্যান্ডে। শেঠ বলল,

‘ঠিক আছে, গাধা তোমাদের মানি, কিন্তু গাধাটা আমার কাছে বিক্রি করে ফেল। আমি পাঁচশ টাকা দিচ্ছি।’

‘না, ‘মাস্টার অসম্মতি জানাল। ‘এক হাজার?’

‘না।’

‘দশ হাজার?’

এবারে মাস্টার কিছুটা অবাক হয়ে লোলার দিকে চোখ ছানাবড়া করে দেখতে লাগল এ গাধার মধ্যে এমন কি সম্পদ লুকিয়ে আছে যার জন্যে লোকটা দশ হাজার টাকা দিতে চাচ্ছে। টাকার অংক শুনে মাষ্টারের লোভ বেড়ে গেল। সে মাথা নেড়ে বলল,

‘না।’

‘বিশ হাজার।’

‘না।’

‘ত্রিশ হাজার।’

‘নাও-তাওনা।’

‘চল্লিশ হাজার, পঞ্চাশ হাজার, ষাট হাজার, সত্তর হাজার 1’ ‘ভুসুরীমল শুধু টাকা বাড়াতেই লাগল। মাস্টার লোলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না।’

‘এক লাখ ৷’

ভুসুরীমল নিলামের ডাকের মত চিৎকার করে বলে উঠলো। লোলা মাস্টারকে অনেকটা শাসনের ভঙ্গিতে বলল,

‘নিয়ে নাও না, পঞ্চাশ-ষাট টাকা করে তুমি বিস্তর গাধা কিনতে পাবে। একটা গাধার জন্যে এক লাখ টাকা পাচ্ছ, এর চে’ জোর কপাল আর কি হতে পারে? এ টাকা দিয়ে গাধা না কিনে বরং তুমি একপাল ঘোড়াই কিনতে পারবে।’

এক গাধার এত দাম? মাস্টার কিছুই ঠিক করতে পারছিল না। সে এরপর আমার দিকে আরেকবার শেঠের দিকে তাকাল—’একলাখ পঁচিশ হাজার।’

শেঠ আরো পঁচিশ হাজার বাড়িয়ে বলল। মাস্টার তবু সম্মতি দিচ্ছিল না। শেঠ এবারে এক লাখ পঁচিশ হাজার টাকার একটা চেক লিখে মাষ্টারের দিকে এগিয়ে দিল।

‘না, এতেও আমি গাধা বিক্রি করব না।’

‘ঠিক আছে, তাহলে তোমার গাধা তুমি নিয়ে যাও, বেশি দিতে পারি না।’

বলেই শেঠ তার দিকে আমার শিকল এগিয়ে দিল। মাস্টার আমাকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। দরজা অবধি গিয়ে আবার কি মনে করে ফিরে এসে শেঠের হাত থেকে চেকটা পকেটে পুরে নিয়ে আমার শিকলটা শেঠের হাতে তুলে দিয়ে চুপঁচাপ লোলাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

ওরা যখন বেশ কিছুদুর চলে গেল শেঠ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলল, ‘কার সাথে ফাজলামী। আপনার জন্য আমি দু’লাখ টাকা লাগলেও কুণ্ঠাবোধ করতাম না। বোকাটা সোয়া লাখেই রাজী হয়ে গেল। দেখলেন কি বোকা।’ ‘বোকা বটে।’

‘সে মাথা নত করে বলল,

‘আপনি যা বলেন তাই সই। আপনার কথা আমার জন্য অমৃত।’

আরে ও কুরিয়া, মজুরিয়া, হা করে কি দেখছিস, পাশের কামরা আর বাথরুম গুরুজীর জন্য খালি করে দিতে বল। আজ থেকে গুরুজী এখানেই থাকবেন।’

পরদিন শেঠজি এক গাদা খবরের কাগজ নিয়ে আমার কামরায় প্রবেশ করল। অধিকাংশ কাগজের প্রথম পৃষ্ঠাতেই বড় হরফে ফলাও করে আমার খবর ছাপা হয়েছে।

“বিশ্বের চমকপ্রদ গাধা

.শেঠ ভুসুরীমল সোয়া লাখ টাকায় কিনেছে—

অধিকাংশ পত্রিকাওয়ালারা আমার জীবনের বিশেষ ঘটনাবলী সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। পত্রিকাগুলোতে এইচ, বি, মাস্টারের ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছে। মাস্টার আমাকে নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেছে, এক কথার কোথাও অপলাপ হয়নি। তবে সে যে আমাকে এক নাগাড়ে দশদিন উপবাস রেখেছে ঘুণাক্ষরে সে কথা কোথাও বলা হয়নি। পাশাপাশি শেঠ ভুসুরীমলের ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছে। শেঠ বলেছে এ গাধা আমার ভাগ্যদেবতা।

এজন্যে আমি একে সোয়ালাখ টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছি। এ সম্পর্কে সাংবাদিকরা নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন। প্রায় পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বেশি অর্ধেক অংশ জুড়ে আমার খবর ছাপা হয়েছে। সেদিনকার রাজনৈতিক সংবাদস্তম্ভ এবং মন্ত্রীদের বক্তৃতা প্রথম পৃষ্ঠায় জায়গা পায়নি।

শেঠ ভুসুরীমল বলল,

‘দেখলেন কেমন পাবলিসিটি হয়েছে আপনার।’

‘শুধু আমার কেন, এই সাথে তোমাদেরওতো বেশ পাবলিসিটি হয়ে গেল।’ ‘ঠিকই গুরু আজকাল পাবলিসিটির জামানা। গাধার সাথে হোক আর কুকুরের সাথে হোক, পাবলিসিটি হলেই হলো। কাল রাতেই আমি সাংবাদিকদের ডেকে খবরটা দিয়েছিলাম।’

আমি কাগজগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে বললাম,

‘আমি কাল রাত থেকে ভেবে ভেবে হয়রান। একটা গাধার জন্য তুমি কেন এতগুলো টাকা জলে ঢালতে গেলে? আমি এক গাধা বইতো নই।’

‘আপনাকে যে গাধা মনে করে সে নিজেও এক গাধা। আপনার জন্যে আমি যা ইচ্ছে তা করতে পারি। আপনি আমার ভাগ্যদেবতা। এখন এসব কথা থাক। আপনার স্বাস্থ্যের একি অবস্থা? হাড়গোড় সব বেরিয়ে গেছে যে, আপনি নিশ্চিন্তে কিছুকাল বিশ্রাম করুন, তারপর কথা বলা যাবে।’

প্রায় এক পক্ষকাল আমার যারপরনাই সেবাযত্নে কাটল। তিনবেলা তাজা তাজা ঘাস, বিলাতী পানীয়, গ্লুকোজ ইনজেকশন, তাজা ফলের রস, ভিটামিন টেবলেট এবং অনেক নাম না জানা দামী টনিক খেতে হলো আমাকে। একজন ফুল টাইম পশু-চিকিৎসক আমার কাছে থাকতেন। আগাথা ক্রিষ্টির নভেল, ডিটেকটিভ, রোমান্টিক পত্রিকা, সিনেমা ম্যাগাজিন এবং অজস্র বিলাতী পত্রপত্রিকা পড়তে দেয়া হল আমাকে। আর্ট পেপারে ছাপা এসব পত্রিকাগুলোতে মেয়েদের নগ্ন ছবি এবং হত্যাকাণ্ডের বীভৎস সব ছবি থাকত।

পনের দিনে যখন আমি সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হলাম, শেঠ এ উপলক্ষে একটা বিরাট পার্টির আয়োজন করলো। খাদ্যমানের বিচারে পার্টিটা বেশ জমকালো হয়েছিল। এদিকে শেঠ আমার জন্যে কাশ্মীর থেকে প্লেনযোগে এক বিশেষ ধরনের ঘাস আনালেন। গুলবুর্গের পাহাড়ের চূড়ায় নাকি এ ঘাস জন্মে। ঘাসগুলো খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি বলকারক। এ পার্টিতে বেশি লোককে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। শেঠের বন্ধু জুমন সিং ছিল পার্টির মধ্যমণি। এ ছাড়া আর মাত্র দুজন লোক এসেছিল। তাদের নাম ছিল গোপাল সিং এবং সেতাব সিং। বিরাট বপু আর ইয়া মোটা গোঁফ দেখে এ দুজনকে রীতিমত দুর্ধর্ষ গুণ্ডা বলে মনে হলো আমার। সেদিন এত দামী দামী মদ পান করেছি যে, গাধাদের ভাগ্যে কোনদিনই তা জুটে না। ইটালীর কিয়ানে, হাঙ্গেরীর তোকাই, জার্মেনীর বায়েন হাসেন, ফ্রান্সের সাডুব্রিয়ান, স্পেনের ব্রিগান্তি, স্কটল্যাণ্ডের ব্লাক ডগ হুইস্কি। মোট কথা বিশ্বের সব রকম দামী মদের সমাবেশ ঘটেছিল সেদিন। ব্লাক ডগ হুইস্কি মানে কালো কুকুর মার্কা, আমি কালো না হলেও কালো গাধাতো ছিলাম। সুতরাং ব্লাক ডগেরই তিন বোতল সাবাড় করে ফেলে নেশায় ঝিমুতে লাগলাম আমি এবং আর স্থির থাকতে পারছিলাম না। পুরো কার্পেটের উপরই আমি এলভিস প্রিসলের রক-এন-রোলের সুরে ইংরেজি আর হিন্দি মিলিয়ে গাইতে লাগলাম,

জু জু জু কড়য়া কড়য়া থু মিঠা মিঠা হাপ

ইউ—সাট্-আপ ইউ ইউ ইউ জু জু জু তু মেরি জান

ম্যায় তেরা জানি

তেরে মেরে উপর এক মাশহুর দানি

সো হোয়াট

সাট্ আপ

সহসা শেঠ, জুমন দাদা, গোলাপ এবং সেতাব সিং উঠে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরলো। ‘দয়া করো গুরু মহারাজ। নাম্বার বলে দাও গুরু।’ শেঠ ভুসুরীমল আমার পায়ে তার নাক ঘষতে ঘষতে বলল, ‘সাধু বাবা, একবার একটা নাম্বার বলো।’ জুমন দু’হাতে পা চেপে ধরে বলল। ‘পা ছাড়ো বলছি। কে বলে আমি সাধু সন্ন্যাসী? আমি শুধু এক গাধা ‘আমরা জানি। আমরা চিনি তোমাকে গুরু।’ সবাই সমস্বরে বলে উঠল। ‘কি চেনো তোমরা? আমি যদি কোন সন্ন্যাসীই হতাম তাহলে এত মদ খেতাম?’

‘গুরু মহারাজ, এসব কথায় আমরা ভুলব না। আমরা সবই জানি। জানি, যারা সত্যিকার সাধু-ধ্যানী-জ্ঞানী তারা মাছ মাংস দুধ মদ সবই খেতে পারে এবং যে বেশ ধরতে চায় সে বেশ ধারণ করতে পারে। গুরু আমরা আপনাকে কিছুতেই ছাড়বো না। নাম্বার না বললে আমরা কিছুতেই পা ছাড়ব না।’

আমি পা ছাড়াতে অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওরা চারজন আমার পা এমন জেঁকে ধরেছে যে, আমার নড়বার উপায় ছিল না। বাধ্য হয়ে আমি বললাম, ‘আমার পা-গুলো ছাড়। পা না ছাড়লে নাম্বার বলি কি করে?’

একথা শুনতেই ওরা হঠাৎ করে আমার পা ছেড়ে দিল। আমি হাঁফ ছেড়ে মনে মনে একটা ফন্দি আঁটতে লাগলাম। কয়েক মিনিট দম ধরে থেকে আস্তে আস্তে নাচতে শুরু করলাম। এবং গুন গুন করে একটা গানের কলি ভাজতে লাগলাম। আমার দেখাদেখি ওরাও হাতে তালি দিয়ে নাচতে লাগল। নাচতে নাচতে আমি একটা গান শুরু করে দিলাম,

উটি দেখা শিমলা দেখা

দেখা মায়নে কুল্লু,

কুলু মে উলু চিলুর্ম মে চিল্লু

চিল্লু মে পানি

মরগেয়ী চারু কি নানী

নানী কে বেটে গেয়ারা

জু জিতা উভি হারা

গাইতে গাইতে আমার মুখ দিয়ে ফেনা বের হল। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। কাঁপতে কাঁপতে বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলাম। যদিও এসব আমি ইচ্ছে করে করছিলাম। ওরা মনে করেছে সত্যি বেহুঁশ হয়ে পড়েছি আমি।

জুমন বলল,

‘গুরু বেহাল হয়ে পড়েছেন।’

শেঠ বলল,

‘সাধু বাবা অন্তর্ধানে চলে গেছেন?’

জুমন বলল,

‘কিন্তু নাম্বার………. .ľ

‘কেন, নাম্বারতো পরিষ্কারই বলে দিয়েছে। মরগেয়ী চাঁরো কি নানিএবার চৌকাতেই আমাদের বাজীমাৎ হবে।? –

জুমন বলল,

‘কিন্তু ওপেন আসবে না ক্লোজে আসবে সেটাতো বলল না।’

‘সাধুরা কোনদিন কি সব কিছু খুলে বলে? আমারতো মনে হয় ক্লোজে ধরতে

হবে।’

‘তা কেমন করে?

‘কেন মরগেয়ী চাঁরো কি নানি—মরণকে তো আর ওপেন বলা যায় না, মৃত্যুটাতো এক ধরনের ক্লোজ। সুতরাং …’ শেঠ বলল, ‘আমার তো মনে হয় এগার। কারণ, নানিকে বেটে গেয়ারা (এগার) ‘এগারটাই আসলে ঠিক। এগার হয় কি করে? দশের উপর তো কোন নাম্বারই নেই।’ ‘তারও ব্যাখ্যা আছে। ওপেনে টু ক্লোজ এগার। তার মানে এক এবং এক ৷’ ‘আসলে এইটেই ঠিক মনে হয় আমার কাছে।’ সেতাব সিং বলল এবং বলেই সে বিলম্ব না করে নাম্বার ধরতে চলে গেল। এরপর জুমন এবং গোলাব সিং রওনা হয়ে গেল। শেঠ ভুসুরীমল তখনও আকাশপাতাল ভাবছিল। কিছুক্ষণ ভাবনা-চিন্তা করে এক সময় সেও বেরিয়ে গেলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *