আমি গাধা বলছি – ১৫

পনের

দশদিন পর ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছ থেকে দুলাখ টাকা আসার কথা ছিল কিন্তু এলো না। আসল ব্যাপার হয়েছিল, ‘জনি’ ভাইর লেবরেটরীতে টেকনিকালারের কোন বন্দোবস্ত ছিল না। টেকনিকালার একমাত্র লন্ডন ছাড়া তো আর হয় না। অনেক ভেবেচিন্তে সুমনকে ছবি প্রিন্ট করিয়ে আনার জন্য লন্ডনে পাঠানো হল। ভেবেছিলাম পনের বিশ দিনের মধ্যেই সে ফিরে আসবে। কিন্তু কতগুলো টেকনিকেল অসুবিধার সৃষ্টি হলো, যার কারণে তাকে চার সপ্তাহ লন্ডনে থাকতে হলো। তারপর একই কারণে তাকে আবার প্যারিস এবং প্যারিস থেকে রোম অবধি যেতে হলো। এমনি করে সব ব্যাপারে গড়িমসি হয়ে চলল। স্যুটিং বন্ধ করে দেওয়াতে প্রেমবালা হাঁফিয়ে উঠলো। একদিন সে আমাকে বললো,

‘তুমি সুটিং কেন বন্ধ করে রেখেছ? লন্ডন থেকে ছবির প্রিন্ট একদিন তো এসেই যাবে, ডিস্ট্রিবিউটরদের ছ’লাখ টাকাও পেয়ে যাবে। খামাখা কেন তুমি স্যুটিং করা বন্ধ করে সময় নষ্ট করছ? স্যুটিং শুরু করে দাও, টাকা না থাকে তো আমার কাছ থেকে নিয়ে নাও। কত লাগবে, পাঁচ লাখ-দশ লাখ?’

আমি লজ্জায় মরে যেতে লাগলাম। মনে মনে ঠিক করলাম স্যুটিং করতেই হবে।

আমি সুমনকে ইউরোপ থেকে আসতে বারণ করে দিলাম। আরো দশদিন স্যুটিং হয়ে গেলে সেগুলোও লন্ডনে পাঠিয়ে দেব প্রিন্ট করার জন্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে দশদিন পর প্রিন্ট একেবারেই নষ্ট হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে আরো

দশদিন বেহুদা স্যুটিং করতে হল। স্যুটিং শেষ হলে সবাই কথামত টাকা চেয়ে বসল। সবাইকে টাকা দিতে হল। ইতিমধ্যে আবার অশনির সাথে কি নিয়ে প্রেমবালার ঝগড়া হয়ে গেল। আমি ক্রুদ্ধ হয়ে অশনির পাওনা দেনা চুকিয়ে দিয়ে বিদায় করে দিলাম। অশনির স্থলে রূপকুমারকে নিয়ে এলাম। বিশদিন আলাদা স্যুটিং করতে হল। এতে আমার সাত লাখ টাকা নেমে গেল। মোটকথা, এমনি করে পুরো ত্রিশ লাখ টাকাই আমার ছবিতে চলে গেল। কিন্তু ছবি শেষ করতে পারলাম না। ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছ থেকে এক পাই পয়সাও এলো না। ওদিকে সুমন তখন নিউইয়র্কে পৌছে গেছে।

আমি শেঠ ভুসুরীমলের কাছ থেকে টাকা চাইলাম। সে সাফ না করে বলল, ‘সত্যি কথা বলতে কি গুরু ফিল্ম লাইনে আপনাকে মোটেই মানায় না। আর দেরি না করে আপনার হিমালয়ের দিকে রওয়ানা দেওয়া দরকার।’ দাদা ধূমল বলল,

‘কি বলব শেঠ, লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। কি কুক্ষণেই না এ কাজটা হাতে নিয়েছিলাম। দিয়ে থুয়ে আমার কাছে বলতে গেলে একটা স্যাকড়া গাড়ী আছে। বলেন তো সেটা বেচে দিই। কম হলে পাঁচ সাতশ’ টাকা তো বেচা যাবে।’

‘পাঁচ সাতশ’ টাকা? এতে কি হবে?’

‘তাতো ঠিকই—আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করে দেখেছি। এদ্দিন এখানে না খেটে অন্য কোথাও কাজ করলে নির্ঘাৎ দুটো ছবি রিলিজ করিয়ে দেওয়া যেত। তবে শেঠ এখনো এমন কিছু পানিতে পড়ে যাইনি আমরা। লাখ তিনেক টাকা হলেই ছবিটা শেষ করিয়ে দিতে পারি। মাথার দিব্যি দিয়ে বলছি, এর বেশি এক পয়সাও লাগবে না। ছবি তৈরির কাজ শেষ হলে আর বাঁধে কে? ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছ থেকে টাকা আসতে থাকবে তখন, নিজেদের পকেট থেকে আর পাই পয়সা লাগবে না।’

কিন্তু তিন লাখ টাকা দেবে কে? দু’তিন দিন নানা চিন্তাভাবনায় কাটালাম। তৃতীয় দিন সন্ধ্যাবেলা ঠিক করলাম প্রেমবালার কাছে যেয়ে দেখি। তার কাছে টাকাটা চেয়ে নিই। তাছাড়াও সে তো আমার কাছে দেনাও আছে। এগ্রিমেন্টের টাকা ছাড়াও সে আমার কাছ থেকে দু’লাখ নিয়েছিল, সে দু’লাখ, আর একলাখ যদি ধার দেয়, তা হলে কোনমতে এ যাত্রা বেঁচে যেতে পারি।

এসব ভেবেচিন্তে সন্ধ্যাবেলায় তাঁর বাংলোতে যেয়ে উপস্থিত হলাম। ড্রইংরুমে ঢুকতেই আমি যেন হোঁচট খেলাম, দেখলাম প্রেমবালা অশনির কোলে বসে ড্রিংক করছে। অথচ প্রেমবালাকে খুশী করার জন্য আমি অশনিকে বাদ দিয়েছিলাম।

আমাকে দেখেই প্রেমবালা দাঁড়িয়ে গেল এবং চিবিয়ে বলল,

‘কি, হলো? এভাবে না বলে কয়ে হঠাৎ ঢুকে পড়লে যে? কি দরকার এখানে?’ ‘আমি একটা জরুরী কাজে এসেছি তোমার কাছে। এ ছবিতে আমি ত্রিশ লাখ টাকা নিঃশেষ করে ফেলেছি। এখন তিন লাখ টাকা হলেই ছবিটা শেষ করতে পারি। তুমি সে টাকাটা দিয়ে দাও।’

‘আমি দেবো তিন লাখ টাকা! তোমার মাথা খারাপ হয়নি তো?’

‘মাথা খারাপ হয়নি। তবে খুব শীঘ্রই খারাপ হয়ে যাবে। আমি তোমার কাছে

অন্যায়ভাবে কিছু চাচ্ছি না। দু’লাখ টাকা তো তুমি দেনাই আছ ৷’ ‘কিসের দু’লাখ?’ সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল।

‘দেড় লাখ ইনকাম ট্যাক্সের ব্যাপারে নিয়েছিলে, আর গাড়ি কেনার সময় পঞ্চাশ হাজার দিয়েছিলাম। ডার্লিং তুমি কি তা ভুলে গেছ?’

‘ডার্লিং? আমি কারো ডার্লিং নই। শুনেছ অশনি, গাধা আমাকে ডার্লিং বলছে।’

‘এমনই হয়ে থাকে। কাল অবধি আমার কাছে যখন টাকা ছিল, আমি ছিলাম শেঠ আর আজ আমি হয়েছি গাধা।’

‘গেট আউট ইউ ডার্টি ডাংকি।’ বলেই দু’হাতে সে আমাকে চড় মারতে লাগল। আমারও মাথায় রক্ত চড়ে গেল। আমি বললাম,

‘প্রেমবালা, তুমি এসব ভাল করছ না কিন্তু। আমার টাকা কড়ি বুঝিয়ে না দিলে আমি এক পাও নড়বো না। দেখি তুমি আমাকে কি করে বের করো?’ ‘বের হবে না?’

‘না।’

‘হবে না?’

‘না।’

‘আচ্ছা’। বলেই প্রেমবালা একটা ছড়ি কুড়িয়ে নিয়ে অশনিকে বলল, ‘অশনি তুমিও একটা ছড়ি নিয়ে নাও। আর দরজাটা ভাল করে বন্ধ করে দাও।’

পুনার রাস্তা দিয়ে এক গাধা মন্থর গতিতে হেঁটে যাচ্ছিল। যেতে যেতে এক জায়গায় দেখল একটা ষাঁড় মরে পড়ে আছে আর তার পাশে দুজন মানুষ আহাজারী করে কাঁদাকাটি করছে। একজন পুরুষ অপরজন স্ত্রীলোক।

‘কি হয়েছে তোমাদের?’ গাধা জিজ্ঞেস করল।

‘আমাদের ষাঁড়টা মরে গেছে।’

‘মরে গেছে তো কি হয়েছে? আরেকটা কিনে নাও।’

‘আরেকটা কোথায় পাব? এ ষাঁড় দিয়ে আমরা যে রোজগার করতাম তা কোন ষাঁড়ই পারবে না। ষাঁড়ের চোখ বেঁধে দিয়ে কৃষকদের মধ্যে ছেড়ে দিতাম এবং

কৃষকদের ভাগ্য পরীক্ষা করে আমরা পয়সা উপার্জন করতাম।’ মেয়ে লোকটি কাঁদতে কাঁদতে বলল। গাধা বলল,

‘সে জামানা চলে গেছে। ষাঁড়ের চোখ বেঁধে দিয়ে অন্ধ কৃষকদের ভাগ্য পরীক্ষা করবার দিন আর নেই। এখন চোখ খুলে কাজ করার দিন এসেছে। তোমরা আমাকে কৃষক ভাইদের কাছে নিয়ে চলো। আমি তাদেরকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাব এবং তাদেরকে সত্যিকার ভাগ্যের সন্ধান দেব, যে ভাগ্য লটারীর টাকা বা আলাদীনের প্রদীপের স্পর্শে তৈরি হয় না। বরং সত্যিকার পরিশ্রম দিয়ে সে ভাগ্য তৈরি হয়।

উপরে উদার আকাশ। সামনে ধু ধু প্রান্তর। রাস্তা দিয়ে তিনজন পাশাপাশি চলেছে।

একজন পুরুষ, এক গাধা এবং একজন নারী।

পুরুষ-জন্মদাতা।

নারী—গর্ভধারিণী।

গাধা, জীবনের শ্রম এবং ভালমানুষী দিয়ে গড়া এক নিষ্পাপ সত্তা।

(সমাপ্ত)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *