আমি গাধা বলছি – ১

এক

সুহৃদ পাঠকৃবন্দ, আমার বাগাড়ম্বর দেখে অনেকে অনেক কিছু মনে করে থাকেন। রাশিয়ার রকেট বলুন, আর আমেরিকার পকেট বলুন—আমি ওসব কিছু নই। সত্যি কথা হলো, আমি নেহাত গোবেচারী ভবঘুরে এক গাধা। ছোটবেলায় খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল বলে আজ আমার এ দুর্গতি। বহু চেষ্টা করেও এ অভ্যাসটা দূর করা সম্ভব হয়নি।

আসল কাহিনীটাই তাহলে শুরু করা যাক এবার। ছোটবেলায় খবরের কাগজ পড়তে পড়তে আমি মনুষ্যজাতির ভাষা আয়ত্ত করে নিলাম এবং মানুষের বুলি বলতে শুরু করলাম। রাজনীতি এবং জীবন দর্শনের সব রকম জটিল সমস্যাদি আমার কাছে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে ধরা দিতে লাগল। অতঃপর আমি জন্মভূমি বারাবাংকি ছেড়ে ডাংকি হয়ে দিল্লীতে এলাম এবং এক ধোপার বাড়িতে কাপড়ের গাঁট টানার কাজে নিয়োজিত হহলাম। একদিন ধোপা নদীতে কাপড় কাচতে গিয়ে আর ফিরে এল না। এক কুমীরে খেয়ে ফেলল ধোপাকে। ধোপার বিপন্ন স্ত্রী-পুত্রের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব অবশেষে আমি নিলাম। বড় বড় অফিসারদের দ্বারে দ্বারে করুণা ভিক্ষা করতে লাগলাম আমি। ধোপার পরিবারের করুণ দুরবস্থার কথা বলে বলে আমি এ অফিস সে অফিস যেতে যেতে কেমন করে অবশেষে একদিন পণ্ডিত নেহেরুর বাসভবন অবধি গিয়ে উপস্থিত হলাম।

আকস্মিকভাবে পণ্ডিত নেহেরুর সাথে এ সাক্ষাৎকার আমার ভাগ্য খুলে দিল। পণ্ডিত নেহেরু আমাকে খ্যাতির শীর্ষে তুলে ধরলেন। লোকে আমাকে বাড়ি বাড়ি ক্লাবে ক্লাবে, নিমন্ত্রণ করতে লাগল। অলি গলি এবং সড়কে আমাকে নিয়ে মিছিল বের হল। এক শেঠজী মনে করল, আমার মধ্যে কোন কেরামতি আছে। আমি নিশ্চয়ই কোন কোটিপতির নিজের লোক। তার ধারণা, বাইরে যে খোলসেই থাকি না কেন, ভেতরে ভেতরে বেশ কাজ বাগিয়ে যাচ্ছি। সে অনেক অনুনয় বিনয় করে আমাকে তার বাড়ি নিয়ে গেল। তার ফার্মের অংশীদার বানিয়ে মেয়েকে বিয়ে দেবার জন্য সে আমার যারপর নাই খাতির যত্ন করতে লাগল। আমাকে নিয়ে হাই সোসাইটিতে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগল। আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, আমি শিক্ষিত এবং বিচক্ষণ বটে, কিন্তু আসলে এক গাধা বইতো নই? কিন্তু সে অর্থগৃটা আমার কথা শুনতো থোড়াই। তার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে বরাবর আমাকে খাতির তোয়াজ করে যেতে লাগল।

কয়েক মাস তো বেশ আরামেই কাটল। কিন্তু যখন শেঠ জানতে পারল, আমার কাছে কোন পারমিট বা কোটা বলতে কিছুই নেই। সে আমার উপর ক্ষেপে গেল। দরজা জানালা বন্ধ করে শেঠজী এবং তার রূপবতী বিদুষী-কন্যা উভয়ে মিলে আমাকে বেদম মারলো এবং আমার সারা দেহ ক্ষত-বিক্ষত করে রাস্তায় ফেলে দিল।

ছ’মাস ধরে আমি পশু হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর দোলায় দুলতে লাগলাম। ক্ষতের ব্যথায় দিনরাত কাতরাতে লাগলাম। মানবজাতির নির্মমতা এবং গাধাদের অক্ষমতার কথা চিন্তা করে আমি কাঁদলাম। কিন্তু এত কিছুর পরও আমি আবার কি করে বেঁচে উঠলাম, ভাবতে আশ্চর্য লাগে। জীবনের তিক্ত হলাহল পান করা আমার ভাগ্যের লিখন ছিল। নতুবা এর পরও কি কেউ বাঁচে?

পুরোপুরি সুস্থ হবার পর ডাক্তার আমাকে তাঁর চেম্বারে ডেকে পাঠালেন। আমি পৌছলে আমার পিঠে সের দুয়েক ঘাস চাপিয়ে দিয়ে বললেন, ‘নাও, এই ঘাস তোমার আজকের ভরণ-পোষণের জন্য যথেষ্ট হবে। বাদবাকী আল্লাহ ভরসা। কিন্তু যাবার আগে আমার বিলটা চুকিয়ে যেও কিন্তু ‘

‘ডাক্তার সাহেব আমি একজন শিক্ষিত গাধা এ কথা সত্যি। শিক্ষিত হবার দরুনই আজ আমি রিক্ত এবং নিঃস্ব। আমি যতদিন জীবিত থাকব আপনাকে দোয়া করব। কিন্তু এই দু’হাজার টাকার বিল পরিশোধ করা সম্পূর্ণ আমার শক্তির বাইরে।’

ডাক্তার রামঅবতার যথেষ্ট হুঁশিয়ার লোক ছিলেন। আমার অসুবিধার কথা বুঝে একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘তাহলে আমার টাকা তোমার কাছে ধার হিসেবে থাকল। তুমি যদি সত্যি সত্যি এ টাকাটা পরিশোধ করতে চাও তাহলে আমার কথা মত সোজা বোম্বে চলে যাও।’

‘বোম্বে?’

‘হ্যাঁ, বোম্বে। পশ্চিম ভারতে অবস্থিত এই শহরটি সব শহরের ওস্তাদ। তুমি সেখানে চলে যাও এবং আয় উপার্জন করে আমার টাকাটা পরিশোধ কর।’

আমি নিজেও আর দিল্লীর মতো অপদার্থ জায়গায় থাকতে চাচ্ছিলাম না। যে দিল্লী একদিন আমার খ্যাতির চূড়ান্ত দেখেছে, সে আবার কি করে আমার পতন দেখবে? সুতরাং ডাক্তারের পরামর্শ আমার মনে লাগল, আমি পুরাতন দিল্লীকে নমস্কার জানিয়ে বোম্বে রওয়ানা হয়ে গেলাম। রেল সড়ক ধরে ধরে আমি প্রথমে মথুরা যেয়ে পৌঁছলাম। মথুরার ‘পেড়া’ খাবার খুব শখ ছিল আমার। কিন্তু মথুরার পেড়ার বদলে পাণ্ডা পূজারীদের ডান্ডার কবলে পড়তে হল আমাকে। সেখানে থেকে কোনমতে জান বাঁচিয়ে গোয়ালিয়র পৌঁছলাম। এখানে এসে ঠিক করলাম ওস্তাদ তানসেনের মাজারে একটু ভক্তি-শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করব। সমগ্র উপমহাদেশে যাঁর নামে ক্লাসিক্যাল মিউজিক প্রচলিত, তাঁর মাজারে আমি ভক্তি নিবেদন করতে পারব এ যে কত বড় সৌভাগ্য আমার। এটাতো আজকাল সবাই জানে যে, ভারতে অধুনা দুই শ্রেণীর লোকই ক্লাসিক্যাল মিউজিক পছন্দ করে। একদল তানসেনের শিষ্য, অপর দল আমরা গাধারা। আর বাদবাকীরা রেডিও সিলোন শোনে। তানসেনের মাজারে এক নীরব গাম্ভীর্য বিরাজমান। এককোণে দু’জন ভক্ত বসে ঝিমুচ্ছিল। চত্বরে বাসি মালার শুকনো পাপড়ি ছড়িয়ে আছে। মাজারের বাইরে ক’টা ছাগল প্লেব্যাক গায়িকাদের মত অনুচ্চকণ্ঠে চ্যা ভ্যা করছিল। সঙ্গীতগুরুর মাজারের এই দুরবস্থা দেখে আমার মনে দুঃখ হল। আমি তাড়াতাড়ি আভূমি নত হয়ে সালাম করলাম তাঁকে। তারপর মাথা তুলে ভাবে গদগদ হয়ে মরহুম ওস্তাদের এক বিখ্যাত সঙ্গীতের তান তুলে গলা ভাজতে শুরু করলাম। আমার তান শুনে ভক্ত দু’জন মাথা তুলে দেখল আমাকে। ভাবলাম, আমাকে ধন্যবাদ জানাবে। কিন্তু কৈ, তারা বরং উল্টো আমাকে ডাণ্ডা মারতে শুরু করল।

ডাণ্ডার মার খেয়ে আমার তেমন দুঃখ হয়নি। দুঃখ হয়েছে এদেশের আর্টকালচারের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। এদেশের শিল্প-সাহিত্যের এখন আল্লাহই নেগাবান। যে দেশে একজন উচ্চাঙ্গ গায়ক একজন সঙ্গীত সম্রাটের মাজারে ভক্তিশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে বাধা প্রাপ্ত হয়, সেদেশের শিল্প-সাহিত্যের আর ভবিষ্যৎ কোথায়? ডাণ্ডা খেতে খেতে আমি একবার করুণ চোখে মরহুম ওস্তাদের মাজারের দিকে পিছন ফিরে দেখলাম, তারপর পাহাড়-জঙ্গল নদী-নালা অতিক্রম করে সোজা বোম্বে এসে হাঁফ ছাড়লাম।

বোম্বেতে ঘিসু নামের নেহাত কায়ক্লেশে খেটে খাওয়া একজন লোক আমার উপর দয়া দেখাল। আমাকে সে আশ্রয় দিল। ঘিসু বেপারীর মাত্র ১১টা বালবাচ্চা ছিল। সে রোজ চার আঁটি ঘাস আমার পিঠে এবং এক আটি নিজের মাথায় নিয়ে যোগেশ্বরীর গোয়ালাদের কাছে যেত। গোয়ালাদের কাছে ৫ আঁটি বিক্রয় করে সেই পয়সা নিয়ে সে জোসেফ ডি’ সুজার ঝুপড়িতে যেয়ে হাজির হত। তারপর পোয়াটাক মদ নিয়ে সেখানে বসে খেত। রমজানি কসাই এবং কর্ণেল সিং ড্রাইভার আগেভাগেই বসে থাকত সেখানে। তারা সেখানে বসে গালগল্প করত। আর আমি ঝুপড়ির বাইরে নারিকেল গাছের নীচে তাজা ঘাসের উপর চরে বেড়াতাম। তাজা ঘাস খেয়ে আমি আত্মপ্রসাদ লাভ করে মনে মনে বলতাম, যাক অবশেষে একটা নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের নাগাল পাওয়া গেল।

বোম্বেতে এসে আমি মানুষের বুলি ছেড়ে দিলাম। কারণ নানা অভিজ্ঞতা থেকে দেখলাম, পৃথিবীতে যারা নির্বাক গাধা হয়ে থাকতে পারে তাদের ভাগ্যেই সুখ বলতে কিছু আছে। বুদ্ধিমানের জগৎ নয় এটা। কারণ ভালো কথা কারো গায়েই সয় না। তাই আমি মানুষের বুলি পরিত্যাগ করে নিছক পশুর জীবন বেছে নিলাম, যেমন করে বোম্বের আরো অনেকে মনুষ্যজীবন পরিত্যাগ করে গাধার জীবন গ্রহণ করেছে। তারা খাচ্ছে দাচ্ছে দিব্যি আছে। পয়সা জমানোর মতলবই তাদের জীবনের মূলমন্ত্র। তাজা ঘাস খেয়ে আমি ছ’মাসের মধ্যে বেশ মোটা তাজা হয়ে গেলাম।

আমার কালো চামড়া একটুখানি তেলানো হয়ে উঠলো। দেখতে দেখতে আমি সুদর্শন গাধা বনে গেলাম। এখন যে কোন সুন্দরী মেয়ে গাধাই আমার উপর প্রেমাসক্ত হতে পারে। আর এটাতো তাদের ধর্মই, যে-কোন সুদর্শন শক্ত সুঠাম গাধার প্রতিই তারা প্রণয়াসক্ত হয়ে থাকে। এ গাধাদের অন্যান্য সম্পদ থাক আর না থাক, সে কথা আর তাদের মনে থাকে না। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা মেয়েগাধাই আমার কাছাকাছি পাঁয়তারা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু এদের মধ্যে যেটি সবচেয়ে সুন্দরী এবং লাস্যময়ী তার মোটেই খেয়াল ছিল না আমার দিকে। তার এ নির্লিপ্ততা আমাকে বারংবার তার প্রতি আকুল করে তুলত। একটা আজব ধরনের অন্তর্দ্বন্দ্বে আমার সময় কাটত। লম্বা লম্বা সোনালী কান হেলিয়ে দুলিয়ে চলতো সে। তার ছোট ছোট রূপালী দাঁত দিয়ে সে এক আধ কামড় ঘাস খেত। এবং বেছে বেছে এমন করে খেত, মনে হত, অত্যন্ত বিশুদ্ধ ঘাস ছাড়া আজেবাজে ঘাস মোটেই রোচে না তার। এতে মনে হয় অবিশ্যিই সে কোন বড় সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নিয়েছে। নেহাত পায়চারি করে বেড়ানোর উদ্দেশ্যেই যেন সে ডি’সুজার ঝুপড়ির বাইরে এসেছে। কারণ, ক্ষুধা নিবৃত্তি হলো বড়লোকদের বিলাস আর গরীবদের জীবন বাঁচানোর প্রয়াস। একদিন আমি সুযোগ পেয়ে তার কাছাকাছি যেয়ে পৌছলাম। সে নারিকেল গাছের নীচে অত্যন্ত আয়েশী ভঙ্গিতে এক আধ কামড় ঘাস খাচ্ছিল এবং বিলোল কটাক্ষ হেনে চারিদিকে ইতি উতি করছিল। আমি কাছে যেয়ে ফিস ফিস করে বললাম, ‘ওগো সুন্দরী, আর কতকাল দূরে দূরে থাকবে? এ হতভাগার দিকেওতো এক আধটু দৃষ্টিপাত করতে পার।’ ‘হুত’— সে একটা ন্যাক্কারজনক ধ্বনি করল ৷’ ‘এত অবজ্ঞা কেন হে সুন্দরী, আমিওতো এক গাধাই ৷’

‘প্রেমে পড়লে সবাই গাধা হয়ে যায়।’ ঝাঁঝ মাখানো কণ্ঠে সে বললো। শুনে আমি খামোস হয়ে গেলাম। খুবতো উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন দেখছি। মনে হয় উন্নত পরিবেশে মানুষ হয়েছে। সত্যি যদি ওর সাথে আমার বিয়েটা কোনমতে হয়ে যায় তাহলে একেবারে সোনায় সোহাগা। অন্যান্য মামুলি গাধার সাথে বিয়ে হলে এর জীবনটাই মাটি হয়ে যাবে। তখন বোঝা বহন করা আর সন্তান জন্ম দেয়া ছাড়া আর কোন কাজেই সে লাগবে না। অথচ আমার মত শিক্ষিত গাধার সাথে বিয়ে হলে রীতিমত জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হবে আমাদের মাঝে, সিনেমা দেখব, আরো কত কি! আমাদের সংমিশ্রণে একদিন যে সন্তান জন্ম হবে, সে একেবারে গাধা হবে না। আমি আবার তাকে বললাম, ‘ডার্লিং’ শুনে আবারও ন্যাক্কারজনক একটা আওয়াজ করে পেছনের দিকে একটা লাথি মারল। আমি হঠাৎ একটু সরে না দাঁড়ালে আমার চোখই ফুটো হয়ে যেত। সে চোখ পাকিয়ে আমাকে বলল, ‘তোমার লজ্জা করে না, সামান্য একজন ঘাস বিক্রেতার গাধা হয়ে তুমি আমার সাথে প্রেম করতে চাও?’ আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, ‘কে তুমি?’

‘আমি? আমি ভিক্টর বরগঞ্জার আশ্রয়ে থাকি। ভিক্টর তোমাদের ডি’সুজার বস। গোরগাঁও থেকে দাদর পর্যন্ত তার মদ ব্যবসায় ছড়ানো। আমি রোজ চারটি পিপে বহন করে ডি’সুজার এখানে নিয়ে আসি এবং বিকালে খালি পিপা নিয়ে ফিরে যাই। আমি তোমাদের মত দিনভর গাধা-খাটুনি খাটি না।’ I

‘কি খবর বাছা?’ একজন অর্ধবয়েসী মহিলা-গাধা আমায় জিজ্ঞেস করতে করতে এগিয়ে এল। বলায় চলায় একটা আশ্চর্য গম্ভীরতা রয়েছে তার। ‘না, তেমন কিছুই না মা, এ গাধাটা আমার সাথে প্রেম করতে চায়। দেখতো ওর স্পর্ধাটা।’

মা-গাধাটা আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বলল, ‘তুমি কে?’ আমি আমার পরিচয় দিলাম। ‘তোমার সাথে আমাদের কিসের মিল? তুমি হিন্দু, আমরা খ্রিষ্টান। কোথাকার বাসিন্দা তুমি?’

‘ইউপির ৷’

‘তুমি ইউপি’র আর আমরা মহারাষ্ট্রের। তোমাদের সাথে আমাদের কিসের তুলনা? কোন জাত তোমার?’

‘গাধাদের আবার জাত হয় নাকি?’

‘বাহ্, জাত হবে না কেন? মালিকের যে জাত, গাধাদেরও সে জাত হবে। আমরা মালিকের জাতে পরিচিত হব ; আমাদের প্রভুরা যে কাজ করে এবং ভাবে আমরাও তা করি এবং ভাবি।’

‘খালা, আপনার একথা আমি পুরোপুরি মেনে নিতে পারি না। কারণ, আমি বহু মানুষকে পশুদের মত ভাবতে এবং কাজ করতে দেখেছি।’ আমি একটু বিনীত হয়ে বললাম, আমার কথাবার্তা বেশ পছন্দ হল তার। তিনি বললেন, ‘তোমাকে তো বেশ বুদ্ধিমান গাধা বলে মনে হয়। আচ্ছা মনে কর আমার মেয়েকে তোমার কাছে বিয়ে দিলাম। কিন্তু তাকে তুমি কিভাবে খাওয়াবে এবং কোথায় রাখবে? ঘিসুর সেখানে থাকার জন্য তো এমন কোন নির্দিষ্ট জায়গা নেই।’

‘আমাকে রাতের বেলা বাইরে জামগাছ তলায় শুতে হয়। অনেক সময় এমনি ছেড়েও দেওয়া হয় যাতে এদিক সেদিক চরে স্বাধীনভাবে কিছু খেয়ে নিতে পারি।’ ‘কেন, সে তোমাকে কোন ঘাস খেতে দেয় না? তাহলে তো আমার মেয়েও তোমার মত বিনা ঘাসে মারা যাবে।’

‘প্রেম ভালবাসার বেলায় ঘাসের কি প্রশ্ন খালা? ইকবাল বলেছেন, ‘বেখতর কুদপড়া আতশে নমরুদ মে ইশ্ক’। প্রেম প্রেমই আবার ঘাস ঘাসই। প্রেমের সাথে ঘাসের কি সম্পর্ক? এই দেখুন না, আমি প্রেমও করি ঘাসও খাই ৷ যখন ঘাস পাই না তখন কাওয়ালী গাই। খালাম্মা দয়া করে দিয়ে দাও তোমার মেয়েকে। এ বিশাল জগতে ঘাসের কোন অভাব হবে না।’

‘না, তা হয় না ৷’ খালাম্মা দৃঢ়চিত্তে বললেন। ‘আমি আমার মেয়েকে তোমার মত গাধার কাছে বিয়ে দিতে পারি না, যার মা-বাবার ঠিক ঠিকানা নেই, থাকাখাওয়ার কোন বন্দোবস্ত নেই। শুধু পড়া লেখার বুলি আওড়ালেই আমার মেয়েকে তার কাছে বিয়ে দিতে পারি না।’

আমি গর্বদীপ্ত ভঙ্গীতে বললাম।

‘হ্যাঁ, আমি পড়া লেখা জানি, পত্র পত্রিকা পড়ি। কিন্তু এতে আমার দোষটা কোথায়?’

“আলবত দোষ। আজকাল এ দেশে যত পড়ুয়া গাধা আছে সবাই কেরানীগিরি করে নতুবা উপবাস থাকে। নিজেই বল দেখি, কোন শিক্ষিত লোকটা লাখপতি হয়েছে? না বাবা, আমার মেয়েকে আমি বরং কোন লাখপতির ছেলের কাছে দিয়ে দেব, হোক না সে চরম মূর্খ।’ তার এসব কথা শুনে আমার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল। কিন্তু করা কি, প্রেমসংক্রান্ত ব্যাপারে আর কিইবা বলা যায়। আমি নীরবে সব হজম করে নিয়ে তাকে বললাম, ‘দেখ খালা, এই প্রগতির যুগে মানুষ জাতধর্ম মানে না। আমরা সবাই হিন্দুস্তানি এবং আমরা সবাই গাধা। আমরা এক জাতি এটাই আমাদের বড় পরিচয়।’

‘ধনী গরীব এক হয় কি করে? আমাদের সমস্যা এক ধরনের। তোমাদের সমস্যা অন্য ধরনের। তোমার জীবনযাত্রার মান এক রকম, আমাদের অন্যরকম। তাছাড়া সত্যিকার অর্থে আমরা হিন্দুস্থানীও নই। মেয়ের দাদা (খোদা তাকে বেহেস্ত নসীব করুক) খাস ইংরেজি গাধা ছিলেন, আমার মা ছিলেন ফরাসী গাধা। আর তুমি হলে হিন্দুস্থানী ভবঘুরে বাউণ্ডেলে কালো গাধা। তুমি চাচ্ছ আমার মেয়ের সাথে প্রেম করতে। খবরদার, আমার মেয়ের দিকে তাকালে চোখ ফুটো করে দেব।’

বলেই খালাম্মা এমনভাবে লেজ দোলাল এবং ফোঁস ফোঁস করল, মনে হল আমাকে এখন কাবু করে ফেলবে। আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে ডি’ সুজার ঝুপড়ির কাছে এসে দম নিলাম। তারপর সেদিন থকে তওবা করলাম যে, আর প্রেম করার নাম করব না। কারণ এতে একথা প্রতীয়মান হলো যে, প্রেম করার জন্য একটা লোকের কাব্য প্রতিভা এবং পর্যাপ্ত শিক্ষা দীক্ষা থাকাই যথেষ্ট নয়, যথেষ্ট পরিমাণ খাবার বন্দোবস্ত না থাকলে কোন গাধাই প্রেম করে সাফল্য লাভ করতে পারে না।

অতএব আমি সে স্বর্ণকেশী মেয়ে গাধার সাথে প্রেম করার দুরাশা পরিত্যাগ করে রোজ ঘাস টানার কাজে নিয়োজিত হলাম। সাধারণ গাধাদের ভাগ্যে ঘাস টানার কাজ ছাড়া আর কিইবা করার থাকে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *