আমি গাধা বলছি – ৪

চার

অন্য একজন বলল, ‘না, দুই থেকে এক বাদ দিতে হবে। থাকবে এক।’ গোঁফওয়ালা একজন বলল, ‘না ভাই, আসল নাম্বার এখনো বলেনি।’ কিন্তু এতক্ষণে অন্যান্য লোকরা নাম্বার ধরার জন্য বিদায় হয়ে গেছে। যে যেভাবে নম্বর বুঝে নিয়েছে, সেভাবেই সে লটারী ধরল। মুহূর্তে ভীড় কমে গেল। ইতিমধ্যে জোসেফ, মারিয়া এবং এবং কামতাপ্রসাদ এসে হাসির হল। জোসেফ বলল,

‘কি হয়েছে? তোমার এখানে এত লোকের ভীড় কেন?’

‘গাড়ী যদি ওভারলোড হয়, তাহলে ইঞ্জিন ফেল করে না? তোমরা আমার ওপর ওভারলোড করেছ। ফলে আমাকে নেশায় ধরেছে এবং আমি আবোল তাবোল বকতে শুরু করেছি। আমার মুখে মানুষের ভাষা শুনতে পেয়ে লোক জড়ো হয়েছে। তোমাদের জগৎটা এমনই যে কোন মানুষ যদি গাধার ভাষায় কথা বলে, তাহলে কেউ আশ্চর্য হয় না। কিন্তু কোন গাধা মানুষের ভাষায় কথা বললেই সেটা আশ্চর্যের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এখন যত তাড়াতাড়ি পার, তোমাদের মদগুলো বের করে নিয়ে আমাকে মুক্তি দাও। নইলে আমি এই হার্টফেল করলাম।’

ওরা তাড়াতাড়ি আমাকে সেই অন্ধকার গলির মধ্যে মারিয়ার বাড়িতে নিয়ে গেল। আমি সেখানে পৌছেই বেঁহুশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। আমার যখন জ্ঞান ফিরে এল দেখলাম গলির বাইরে একটা ময়লা আবর্জনাপূর্ণ ড্রেনের পাশে পড়ে আছি আমি। ফেনিল লালায় আমার কণ্ঠনালী ঝাপসা হয়ে আছে। কঁটা দুষ্ট ছেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছিল। আমি চোখ টেনে চারিদিকে ভাল করে তাকালাম। কান নেড়ে চেড়ে যখন পাগুলোকে টানটান করলাম মনে হল আমার পেটটা অনেকাংশে হাল্কা হয়ে গেছে। নেশাও তেমন আর নেই। কিন্তু জোসেফ, মারিয়া আর কামতাপ্রসাদ কোথায়? এ পিশাচগুলো আমার পেট থেকে মদ বের করে আমাকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। মনে করেছে মরে গেছি। হ্যাঁ, এমনই হয়ে থাকে। ব্যবসা জগতের এই ধারা। একটা লোক আর যখন কোন কাজে আসে না তখন তাকে টেনে হিঁচড়ে ড্রেনে ফেলে দেওয়াই স্বাভাবিক। ড্রেনে ফেলে দেওয়ার আগে তার শক্তির সমস্ত নির্যাসটুকু নিংড়ে নিয়ে নেয় ওরা।

মানুষ মানুষের সাথে যখন এমন ধারা ব্যবহার করতে পারে, আর আমি কোন ছার। আমি তো এক গাধা। আমার সহ্য করে নেওয়া উচিত। ভাগ্য বলতে হবে যে, একেবারে প্রাণে মারেনি। খোদার ইচ্ছায় প্রাণটা বেঁচে গেছে। আমি এসব ভাবছিলাম আর ইতি উতি করে চারদিক তাকাচ্ছিলাম, এমন সময় দেখতে পেলাম জোসেফ, মারিয়া এবং কামতাপ্রসাদ আসছে। তাদের সাথে দু’জন পুলিশ। তিনজনের হাতেই হাত কড়া। আমি ঘাবড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মারিয়া আমাকে দেখেই চীৎকার করে বলল,

‘ওই যে গাধাটা’ বলতেই একটা পুলিশ আমাকে ধরবার জন্য দৌড়ে এল। তার এ ভাব সাব দেখে আমিও দৌড় দিলাম।

‘ধর—ধর পালিয়ে গেল …।’

পুলিশটা চিৎকার করে হাত নেড়ে অন্যান্য পুলিশদেরকে বলল। আমার পায়ে যেন বিদ্যুতের ছটা লেগেছে। আমি সমস্ত ইন্দ্রিয় একত্র করে প্রাণপণে দৌড়াতে দৌড়াতে মহমের বাজারের ভেতরে দিয়ে সোজা শিবাজী পার্ক অবধি চলে এলাম। পুলিশের লোকেরা একটা জীপ নিয়ে আমার পিছে ধাওয়া করছিল। কিন্তু আমি তাদের চেয়েও দ্রুতগতিতে জীবনমরণ পণ করে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়াচ্ছিলাম। আমি জানতাম আমাকে ধরতে পারলে এরা জ্যান্ত রাখবে না।

আমি শিবাজী পার্কের দিকে দৌড়াচ্ছিলাম। আমার পিছে পিছে পুলিশের জিপ আসছে। আমি একটা লাফ দিয়ে দেয়াল টপকে শিবাজী পার্কের ভেতর চলে গেলাম। কিন্তু জীপ লাফ দিতে পারল না বলে ওখানেই থেমে গেল। তারপর ঘুরে শিবাজী পার্কের তোরণের দিকে যেতে লাগল। আমি ততক্ষণ ফুটবল খেলোয়াড়দের মাঝখানে দিয়ে, ক্রিকেট খেলোয়াড়দের উইকেট উল্টে দিয়ে অরলি সাইডের দেওয়াল টপকে অনেক দূর চলে এলাম। তারপরও থামলাম না। প্রাণের ভয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে অরলি বাজারের ভেতর দিয়ে ট্রাফিকের সব নিয়ম কানুন ভঙ্গ করে সোজা সমুদ্রের তীরে এসে হাঁফ ছাড়লাম। এখানে এসে আমার সমস্ত শক্তি যেন হারিয়ে গেল। আমি অনেকটা অচৈতন্য হয়ে সমুদ্রের সৈকতে বালির উপর শুয়ে পড়লাম। ,

অরলির দৃশ্য বেশ মনোরম। যতদূর দৃষ্টি যায় সমুদ্র একটা বৃত্তের মত পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। আকাশ যেন সমুদ্রের উপর ঝুঁকে পড়েছে। আকাশের দূর চক্রবালে রঙ্গীন মেঘের আলপনা। এ দৃশ্য দেখে আমি মোহমুগ্ধের মত তন্ময় হয়ে গেলাম। আমি ভাবলাম, এ সৌন্দর্যস্বাদ আমাদের নাগালের বাইরে। ক্ষুধা বেকারত্ব এবং অন্যায়ে পরিপূর্ণ এ ধরা মাঝে সাধারণ গাধাদের এসব দৃশ্যস্বাদ উপভোদ করার অবসর কোথায়? এমন দিন কি কখনো আসবে, যখন গাধাদের এদিন আর থাকবে না?

না, মনে হয় না। গাধা হয়ে সুখের আশা করা দুরাশা। গাধাদের সমতল থেকে কোন ক্রমেই জীবনটাকে একটু উপরে তোলা যাচ্ছে না। যত বাগাড়ম্বরই করি না কেন, আমি গাধাই এবং এমন গাধা যার পেছনে পুলিশ ধাওয়া করছে। ক্লান্তিতে আমার চোখের পাতা মুদে আসতে লাগল। এখন যা ইচ্ছা তাই হোক। পুলিশ এসে গ্রেফতার করে নিয়ে যাক, আপত্তি নেই। এমন কি সমুদ্রের ঢেউ এসেও যদি আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাতেও আপত্তি নেই। আমি এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যে, সব রকম পরিস্থিতির স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে রাজী আছি। চোখ মেলতে না পারলেও আমার কান সজাগ ছিল। আমার কাছেই একটা গাড়ী এসে দাঁড়াল যেন। আমি ভাবলাম আলবত পুলিশের জীপ। আমি যেমন ছিলাম তেমনই পড়ে রইলাম।

সশব্দে গাড়ির দরজা বন্ধ হল। তারপর কুঁজোড়া পায়ের চাপ শোনা গেল ৷ অতঃপর সে পদশব্দ ক্রমশ আমার কাছে এসে থেমে গেল। আমি তখনও চক্ষু মুদে। আমি শুনতে পেলাম একজন অপরজনকে বলছে, ‘শেঠজী, একটা খোলা ট্রাক আনা দরকার।’

‘তা দিয়ে কি হবে রুস্তম শেঠ?’

‘গাধাটাকে আস্তাবলে নিয়ে যেতে হবে।’

‘আস্তাবল? কেন??

‘দেখ খেমজী, মুখের উপর কথা বলো না। এড্‌ভান্স কথা আমি বড্ড অপছন্দ করি। পুলিশের লোকেরা আসতে না আসতে যত তাড়াতাড়ি গাধাটাকে নিয়ে যেতে পারি, ততই মঙ্গল ৷’

‘ঠিক আছে শেঠ, এখনই আনছি। খেমজি ট্রাক আনার জন্য চলে গেল। আমি ভাবলাম, এরা আর যা-ই হোক না, পুলিশের লোক নয়। তাই কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে আমি চক্ষু খুললাম।

দেখলাম, লাল টকটকে চেহারার একটা লোক দাঁড়িয়ে আমাকে খুঁটে খুঁটে দেখছে। মোটা নাক এবং টাক মাথা। রুস্তম শেঠ এসব অবশ্য আমাকে পরে বলেছে। আস্তাবলে নিয়ে আসার পর আমি একাধিক্রমে তিনদিন বেঁহুশ হয়েছিলাম। আমার চিকিৎসার জন্য বড় বড় পশু চিকিৎসকদের আনা হয়েছে।

কিন্তু এরা সবাই এদেশী ছিল বলে আমার চিকিৎসায় জুৎ করতে পারল না। রুস্তম শেঠ আমার জন্য একজন ফরেন এক্সপার্ট-এর কথা ভাবছিলেন। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, বোম্বেতে গাধা রোগের বিশেষজ্ঞ এমন কোন এক্সপার্ট ছিল না। গাধাদের চিকিৎসা করেই বা কে? চিকিৎসা করে দু’পয়সা কামাতে হবে তো তাদের। কিন্তু গাধারাতো ফিস দিতে অপারগ।

কিন্তু রুস্তম শেঠের তো পয়সা কড়ির প্রশ্ন ছিল না। প্রশ্ন হলো উপযুক্ত গাধা বিশেষজ্ঞের। অনেক চেষ্টা চরিত্রের পর খবর পাওয়া গেল হংকং এ ডঃ মেকনিলে নামের এক ইংরেজ চিকিৎসক থাকেন। গাধাদের চিকিৎসার ব্যাপারে তার বেশ নামডাক। তাছাড়া ইংরেজ ডাক্তার বলে শেঠজীর আগ্রহ বেড়ে গেল বেশি। কারণ ইংরেজরা দু’শ বছর অবধি এশীয় গাধাদের চিকিৎসার ব্যাপারে দেদার পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন। সুতরাং দেরি না করে প্লেনযোগে হংকং থেকে তাকে আনিয়ে নিলেন। তিনি এসেই আমার চিকিৎসা শুরু করে দিলেন। এ সমুদয় ঘটনা আমি পরে জানতে পেরেছি। আমার শুধু এতটুকুই মনে আছে তিন চারদিন পর আমি যখন প্রকৃতিস্থ হলাম দেখলাম কাঠের তৈরি একটা বিরাট মশারীর মধ্যে শুয়ে আছি আমি। আমার হাত পা বাঁধা। সিথানে হাওয়া দিয়ে ফোলানো রবারের আরামপ্রদ বালিশ। ডানদিকে এক নার্স দাঁড়িয়ে। বাম দিকে ডঃ মেকনিলে দাঁড়িয়ে। নানা ধরনের কাচের যন্ত্র দিয়ে এটা ওটা পরীক্ষা করছে। আমি চোখ খুলতেই বললাম, ‘আমি এখন কোথায়?’

‘আমার আস্তাবলে ৷’ রুস্তম শেঠ পাশ থেকে বললেন।

‘এসব কি হচ্ছে?’

‘তোমার শিরাতে রক্ত দেয়া হচ্ছে।’

‘কথা বলো না চুপ থাক।’ ডাক্তার মেকনিলে ঠোঁটে হাত রেখে বললেন। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কিছুক্ষণ পর আমার দেহে এক নতুন প্রাণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল। দ্বিগুণ শক্তিতে আমি উজ্জীবিত হয়ে উঠলাম। একটা সুস্থ স্বচ্ছন্দ সুখের আমেজে আমার সারা দেহ মন সজীব হয়ে উঠল। গভীর প্রশান্তিতে এরপর কখন আমি ঘুমিয়ে পড়লাম বলতে পারব না।।

কতকাল পরে যেন ঘুম থেকে জাগলাম। জেগে দেখি ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। আমার মশারীর কাছে নীলচে টেবিল বাতি জ্বলছে। তার নিষ্প্রভ আলো কামরার মধ্যে যেন এক ইন্দ্রজাল মেলে ধরেছে। পাশের একটা আরাম কেদারায় মারিয়া বসে আছে।

‘মারিয়া, তুমি এখানে?’ আমি খুশিতে নেচে উঠলাম। মারিয়া তার ডাগর ডাগর চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে বলল,

‘রুস্তম শেঠ তোমাকে কিনে নিয়েছেন। জোসেফ তোমাকে নিতে এসেছিল, রুস্তম শেঠ তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বিদায় করেছেন। তোমার দেখাশুনার জন্য আমাকে নিয়োজিত করা হয়েছে।

আমি ছাড়া আরও দু’জন নার্স রয়েছে। তারা পালাক্রমে ডিউটিতে আসে। যাক, এখন বল দেখি, কেমন লাগছে তোমার?’

‘কিন্তু তাই বলে পাঁচ হাজার টাকা? মারিয়া ভেবে দেখ দেখি, এ দেশে আর কোন গাধা পাঁচ হাজার টাকায় বিকাবে কিনা? বাবা, গাধার এত দাম।’ আমার চোখ বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হয়ে গেল। মারিয়া বলল,

‘তাতো ঠিকই। এদেশে কোন গাধাইতো দু’এক আনার বেশি পারিশ্রমিক পায় না। এক দুআঁটি ঘাস দিয়ে দিনভর খাটিয়ে নেয়া যায়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে তোমার ভাগ্যের কোন তুলনা হয় না। অথচ শুনেছি, তোমার জাতবংশও নাকি ভাল নয় তেমন।’

‘এক হতভাগ্য গরীব গাধার আবার জাত ভালো হবে কোত্থেকে? আজকাল যার ভাল গাড়ী আছে, সে-ই ভাল জাতের লোক। একখানা কেডিলেক রা রোলস রয়েস আছে তারাই বড় লোক। যারা পায়ে চলে তাদের আবার জাতপাত কিসের? আমার আশ্চর্য লাগে, শেঠ কি দেখে আমাকে পাঁচ হাজার টাকায় কিনে নিল?’

‘কি জানি, তবে আমার জানা মতে, শেঠ এযাবৎ তোমার চিকিৎসার জন্য লাখো টাকা খরচ করে ফেলেছেন। শেঠ অত্যন্ত ভাল লোক। তুমি ঘুমের ঘোরে যখন বিড় বিড় করে আমার নাম উচ্চারণ করছিলে শেঠ তখনি উপযুক্ত বেতন দিয়ে আমাকে তোমার সেবায় নিয়োজিত করলেন।’

বলতে গিয়ে লজ্জায় মারিয়ার মাথা ঝুঁকে এল। আমিও মারিয়ার কথায় সায় দিয়ে বললাম,

‘সত্যি রুস্তম শেঠের মত মানুষ আর হয় না। সে আমার জীবন বাঁচিয়েছে সারা জীবন আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। অসহায় এবং দুর্গতদের জন্য এমন দরদবান মানুষ একালে আর হয় না।’

ভক্তি-গদগদ কণ্ঠে বলতে গিয়ে আমার চোখে জল দেখা দিলো। আমি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় ডাক্তার মেকনিলের আবির্ভাব হল। হাতের ইশারায় মারিয়াকে যেতে নির্দেশ দিয়ে আমাকে বললেন, ‘এখন কেমন মনে হচ্ছে?’ ‘বড় ভালো লাগছে ডাক্তার, থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর।’

ডঃ মেকনিলে মুচকি হাসলেন। শিরা দেখে নিয়ে আমার মশারীর কাছের চেয়ারটাতে বসে পড়ে বললেন, ‘আসলে শেঠকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত তোমার। যথাসময়ে আমাকে না আনালে তোমাকে বাঁচানো যেত কিনা বলা মুস্কিল।’ ‘আমার কি হয়েছিল ডাক্তার?’

‘বেশি খেয়েছিলে।’

‘ওভার ইটিং নয়, ওভার ড্রিংকিং হবে হয়তো।’

‘বেশি খাওয়া বা পান করা এক কথাই তো।’

‘কিন্তু আমার বেশ মনে পড়ছে সেদিন তো আমি কিছুই খেয়েছিলাম না। খাওয়া দূরে থাকুক, আমাকে বরং দু’দিন ধরে উপবাস করতে হয়েছিল। এমনতো কোনদিনই আমার জীবনে হয়নি, যেদিন পেট পুরে খেয়েছিলাম।’

‘জীবনে কোনদিন পেট পুরে খাওনি বলেই তো এই দশা। হঠাৎ যখন খেতে পেয়েছ, গলা অবধি খেয়ে নিয়েছ, আর এসব কাণ্ড করে বসেছ। আমি অধিকাংশ গাধাদের মধ্যে এ রোগ দেখেছি।’

‘এটাতো কোন রোগ নয় ডাক্তার। আসল রোগ তো হল ক্ষুধা।’ ‘ক্ষুধার কোন চিকিৎসা নেই। ক্ষুধা দুরারোগ্য ব্যাধি।

‘আর বেকারত্ব?’

‘তারও কোন চিকিৎসা নেই।’

‘আর মূর্খতা?’

‘মূর্খতাও দুরারোগ্য ব্যাধি। মূর্খতা বরং মারাত্মক ব্যাধি। যেখানে গাধাদেরকে পড়াশুনা করতে দেয়া হয়েছে সেখানেই সরকারের অবস্থা কাহিল হয়েছে। কেবিনেট পালটে দিয়েছে।’

আমি ডাক্তারের সাথে আর তর্ক করতে চাইলাম না। তার সাথে কথা বলা উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মত। এমনও হতে পারে রেগে গিয়ে আমার চিকিৎসা করাই বন্ধ করে দেবে। তারপর হংকং চলে যাবে। আমি কথা কেড়ে নিয়ে বললাম,

‘তাহলে আপনার মতে বেশি খাবার দরুনই আমার এ দশা হয়েছে?’ ‘আলবৎ।’

আমি মনে মনে বললাম, আপনি দেখছি আমার চেয়েও বড় গাধা। ডাক্তার বললেন,

‘আমি তোমাকে আগে থেকেই জানতাম। খবরের কাগজে তোমার সম্পর্কে অনেক কিছু পড়েছি। তুমি ভাল পড়াশোনা জানো এজন্য আমি সব জিনিস তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। তোমার রোগটা কিন্তু মারাত্মক। একে ত বেশি খেয়েছ তদুপরি তোমার রক্ত খারাপ হয়ে গেছে।’

‘রক্ত খারাপ!’

‘হ্যাঁ, যে সব গাধারা পড়ালেখা করে, তাদের রক্ত খারাপ না হয়ে যায় না। শুধু রক্ত কেন, তাদের বুদ্ধিও খারাপ হয়ে যায়। এজন্য আমি আসা মাত্রই তোমার মল, মূত্র, থুথু এবং ঘাম পরীক্ষা করেছিলাম।

‘ঘামের পরীক্ষা হয় নাকি?’

‘হ্যাঁ, তারপর তোমার হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, ফুসফুস, কলিজা, পাকস্থলী ইত্যাদিরও এক্সরে নিয়েছি। সবকিছু দেখাশুনা করে আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, আসলে তোমার রক্তই খারাপ হয়েছে। রক্ত ঠিক করতে হলে তোমার দেহে কোন নিরক্ষর

গাধার রক্ত দিতে হবে। শেঠ ভেবেছিল, ‘বোম্বেতে নিরক্ষর গাধা হয়ত পাওয়া যাবে না। কিন্তু যখন বিজ্ঞাপন দেওয়া হল গণ্ডায় গণ্ডায় গাধা এসে হাজির হল। দশ টাকা থেকে আরম্ভ করে এক আঁটি ঘাসের বিনিময়ে পর্যন্ত তারা রক্ত দিতে প্রস্তুত ৷ শেঠ তো একেবারে হতবাক।’

‘হতবাক হবার কি আছে? গরীবরা সব সময়ই অকাতরে রক্ত দান করে থাকে।’ আমার কথা শুনে ডাক্তারের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ডাক্তার বললেন,

‘তোমার রোগ এখনো পুরোপুরি সারেনি দেখছি। তোমাকে আরো এক সপ্তাহ নিরক্ষর গাধাদের রক্ত দিতে হবে। তোমার নিজস্ব এক ফোঁটা রক্তও যেন আর দেহে না থাকতে পারে।

দশ বার দিন পর আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলাম। দিনভর আস্তাবলের বাইরে পায়চারি করছি। ওদিকে ডাক্তার মেকনিলে মোটা টাকা নিয়ে হংকং চলে গেছেন মারিয়া এখনো আমার সেবায় নিয়োজিত। বাকী নার্স দু’জনকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। মারিয়া সব সময় আমার পায়ে পায়ে থাকত। তার সান্নিধ্য বড় ভালো লাগত আমার। একদিন বিকেলে রুস্তম শেঠ আমাকে দেখতে এলেন। তাঁর সাথে একজন নাপিত। শেঠ আমাকে দেখিয়ে নাপিতকে বললেন, ‘এর গায়ের সব লোম কামিয়ে একেবারে ঘোড়ার চামড়ার মত মসৃণ করে দিতে হবে। পারবে ত?’ নাপিত

বলল,

‘আমি কানপুরের নাপিত। মানুষের চুল ছাড়া কোন জন্তু জানোয়ারের চুল কাটি না আমি ৷’

‘না কেটেছ তাতে কি হয়েছে।’

‘জী না শেঠ, আমি কানপুরের নাপিত। যদি লোকেরা জানতে পারে যে, আমি এক গাধার চুল কেটেছি তাহলে তারা আমাকে এক ঘরে করে রাখবে।’

‘তারা মোটেই জানতে পারবে না। আমরা না বললে তারা কি করে জানবে?’

‘তা তো বুঝলাম। আমি একজন মানুষের বেলায় দুটাকা নেই। কিন্তু এ গাধার সারা শরীরে আমার ক্ষুর কাঁচি যে সব বেকার হয়ে যাবে। তারপরই আমাকে গঙ্গা স্নান করতে হবে। না, শেঠজী না। আমি এত নিচ কাজ করতে পারব না। আমি কানপুরের নাপিত। একথা বলে নাপিত চলে যাচ্ছিল। এমন সময় শেঠ একখানা একশ টাকার নোট দিল তার হাতে।

‘এখন আপত্তি আছে?’

‘না, আপত্তি থাকার আর কি আছে শেঠ। আমার কাজ হল চুল কাটা। তা সে চুল মানুষেরই হোক, আর ভেড়া বকরিরই হোক, তাতে আমার কি আসে যায়?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *